Thursday, August 31, 2017

কোরান কি অলৌকিক গ্রন্থ? – ১,২

লিখেছেন |

মুসলমানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান। তারা বিশ্বাস করেন এটি স্বয়ং আল্লাহ নবী মুহাম্মদের কাছে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নাযিল করেছেন। প্রায় সকল মুসলমানই বিশ্বাস করেন যে কোরান অবতরণের পর থেকে তাতে আজ পর্যন্ত কোনো বিকৃতি ঘটে নাই এবং তা লওহে মাহফুজে যেমন রয়েছে ঠিক সেই অবস্থায় বর্তমানে রয়েছে – এসব বিশ্বাসের সমর্থনে কোরানে অজস্র আয়াত রয়েছে। এটা হল কোরানের অলৌকিকতায় বিশ্বাসীদের কথা। এবার কোরানের অলৌকিকতার দাবি কতটা যৌক্তিক সে আলোচনায় আসা যাক।
কোরানের অলৌকিকতাঃ প্রমাণের দায়িত্ব কার
ধরুন, আকমল সাহেবের কাছে একশ’টি বই আছে। এবার তিনি এর মধ্য থেকে একটি বই বের করে বললেন, ‘এই বইটি আল্লাহ দ্বারা রচিত আর বাদবাকি নিরানব্বইটি মানুষের দ্বারা রচিত’। এখন একটু ভাবুন- এর প্রত্যুত্তরে আকমল সাহেবকে কি বলা যেতে পারে। একজন যুক্তিবাদী প্রথমেই তার কাছ থেকে জানতে চাইবেন তিনি কিভাবে ওটা আল্লাহ প্রদত্ত বলে নিশ্চিত হলেন। এটা জানতে চাইলে আকমল সাহেব বলতে পারেন ‘আপনিই বরং প্রমাণ করুন ওটা আল্লাহ রচিত নয়’। আমরা প্রায়ই ধর্মবিশ্বাসীদের কাছ থেকে এধরণের হাস্যকর উদ্ভট কথাবার্তা শুনে থাকি। তাদের কথা হলো আমরা নাস্তিকরা যেহেতু আল্লাহতে বিশ্বাস করি না, ধর্মে বিশ্বাস করি না তাই আমাদেরকেই এগুলো অপ্রমাণ করতে হবে। কিন্তু যা প্রমাণ করা যায় নি তা তো এমনিতেই অগ্রহণযোগ্য, একে কি আলাদাভাবে অপ্রমাণ করার প্রয়োজন আছে?
এবার কোরানের ক্ষেত্রে আসি। বই মানুষ লিখবে এটাই স্বাভাবিক। এখন কেউ যদি কোনো বই কো্নো অলৌকিক সত্তার দ্বারা রচিত বলে দাবি করেন তবে স্বাভাবিকভাবেই তা প্রমাণ করার দায়িত্ব ঐ দাবিকারকের। একজন আকমল সাহেব বা অন্য কেউ কোনো একটা গ্রন্থকে আল্লাহ প্রদত্ত বলে দাবি করলে তা অপ্রমাণের দায়িত্ব অন্য কারো উপর পড়ে না এবং তিনি যদি তার দাবি প্রমাণে ব্যর্থ হোন বা তার দেয়া প্রমাণ ভুল বলে প্রমাণিত হয় তবেই তার দাবি অগ্রহণযোগ্য – এ সহজ কথাটি বুঝার জন্য যদিও গভীর চিন্তার প্রয়োজন নেই তারপরেও ধর্মবাদীরা বরাবরই তা না বুঝার ভান করেন এবং নিজের প্রমাণের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চেপে দিয়ে নিরাপদ থাকতে চান। আপনিই বরং প্রমাণ করুন ওটা আল্লাহ প্রদত্ত নয়- এ ধরণের অজুহাত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় কেননা এতে করে যে কেউ নিজের রচিত বই বা অন্য কারো লেখা বইকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা অন্য কোনো কারণে ঈশ্বরপ্রদত্ত বলে দাবি করতে পারেন এবং তা প্রমাণ করতে না পেরে এ ধরণের ছুঁতো ধরতে পারেন এবং সবচেয়ে বড় কথা – কোনো ধর্মগ্রন্থ আল্লাহ প্রদত্ত নয় তা প্রমাণ করা যুক্তিবাদীদের দায়িত্ব নয়; যুক্তিবাদীদের দায়িত্ব হলো এ পর্যন্ত ঐ গ্রন্থকে আল্লাহ প্রেরিত বলে প্রমাণের জন্য প্রদত্ত যুক্তিগুলো খণ্ডন। তবে কোরানের যেহেতু বস্তুগত অস্তিত্ব আছে তাই যুক্তিবাদীদের কাছে কোরানকে আল্লাহ প্রদত্ত নয় বলে প্রমাণের পন্থা উন্মুক্ত রয়েছে।
মোট কথা, কেউ যদি কোরানকে আল্লাহর দ্বারা রচিত বলে দাবি করেন তবে-
১। এ দাবি প্রমাণ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ তারই। তাকে কোরানের সব বাক্য ও শব্দ আল্লাহ রচিত এবং কোরানের সাথে অন্য কিছুর সামান্যতম মিশ্রণও ঘটে নি বলে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে হবে।
২। যেহেতু তিনি কোরানকে আল্লাহর রচিত বলে দাবি করছেন তাই সর্বাগ্রে তাকে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হবে, বলা বাহুল্য এ পর্যন্ত আল্লার আস্তিত্বের স্বপক্ষে যেসব যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে তার সবগুলোই খণ্ডিত হয়েছে। এ নিয়ে অন্য কোথাও আলোচনা করা যাবে।
৩। আল্লাহ ঠিক কোন্ প্রক্রিয়ায়, কখন, কিভাবে কোরান মানুষের কাছে পাঠালেন এবং কেন পাঠালেন, তা যে উদ্দেশ্যে পাঠালেন তা কতটা সফল হয়েছে এগুলোর উপযুক্ত ব্যাখ্যা তাকে দিতে হবে।
৪। মানুষ নবী ও রাসূল হতে পারে আর মুহাম্মদ নবী ও রাসূল ছিলেন –এ বিষয়টিও তাকে প্রমাণ করতে হবে। আরো প্রমাণ করতে হবে- মুহাম্মদ দীর্ঘ ২৩ বছর পুরো মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন এবং কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে বা বাধ্য হয়ে বা পরিস্থিতির শিকার হয়েও নিজের বা অন্য কারো রচনাকে ওহী বা প্রত্যাদেশ বলে ঘোষণা দেন নি।
৫। যেহেতু কোরান অবতীর্ণ হওয়া একটি অলৌকিক ঘটনা তাই অলৌকিক ঘটনা বাস্তবে ঘটতে পারে তা তাকে প্রমাণ করতে হবে।
এছাড়া মুসলমানরা বিশ্বাস করেন জিবরাইল ফেরেশতা আল্লার কাছ থেকে মুহাম্মদের কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। তাই জিবরাইলের অস্তিত্বও তাদেরকেই প্রমাণ করতে হবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোসহ কোরানের অলৌকিকতা সম্পর্কিত সবগুলো বিষয় যতক্ষণ কোরানের অলৌকিকতার দাবিদাররা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে না পারছেন ততক্ষণ একজন যুক্তিবাদীর কোরআনকে অলৌকিক বলে মেনে নেয়ার কোন সংগত কারণ নেই।
ওহী অবতরণ পদ্ধতি ও কিছু কথা
কোরান আল্লার বাণী? ভালো কথা, ওটা তবে মুহাম্মদের কাছে এলো কিভাবে? এ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর কিভাবে কোরানের অলৌকিকতায় বিশ্বাসীরা দিতে চেয়েছেন তা আলোচনা প্রয়োজন।
কোরান নাকি পুরো ২৩ বছরে মুহাম্মদের উপর অবতীর্ণ(?) হয়েছে। কিভাবে অবতীর্ণ হয়েছে তার বিচিত্র বিবরণ রয়েছে ইসলামে। এগুলো এতই উদ্ভট যে একজন যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে তা ‘ফেয়ারি টেল’ ব্যতীত আর কিছু মনে হওয়ার অবকাশ নেই। আমরা এখন কোরান নাযিলের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানব। এখানে এ, বি, এম, আব্দুল মান্নান মিয়া ও আহমদ আবুল কালামের লেখা “উচ্চ মাধ্যমিক ইসলাম শিক্ষা, দ্বিতীয় পত্র” – এ বর্ণিত বিভিন্ন প্রকার ওহী অবতরণ পদ্ধতি ও তার ব্যাখ্যা নিচে হুবহু তুলে দেয়া হলো-
১।সত্য স্বপ্ন
নবী রাসূলগণের স্বপ্নও ওহী। বিশেষ করে হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর অনেক প্রত্যাদেশ বা ওহী লাভ করেছেন স্বপ্নের মাধ্যমে। এই স্বপ্নকে বলা হয় সত্য বা বাস্তব স্বপ্ন। এ এমনই স্বপ্ন যা অবাস্তব হয় না বা বিফলে যায় না। হযরত আয়েশা (রা) ইরশাদ করেন, রাসুলুল্লাহ (স) এর উপর ওহীর সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। তাঁর জাগতিক পর্যায়ের স্বপ্ন দ্বারা তিনি অবহিত হতে পারেন যে যথাশীঘ্র তার উপর আল্লাহর প্রত্যক্ষ ওহী কুরআন অবতীর্ণ হবে। রাসূলুল্লাহ (স) মাদানী জীবনে যে স্বপ্ন দেখেন তা কুরআনে এসেছে এভাবেঃ
আল্লাহ তার রাসূলের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন যে তোমরা অবশ্যই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে……(সূরা আল ফাতহ)
হযরত ইব্রাহিম (আ) তার পুত্র ইসমাঈল (আ) কে কুরবানী করার আদেশও লাভ করেছিলেন স্বপ্নের মাধ্যমে। আরো অনেক নবী স্বপ্নের মাধ্যমে ওহী লাভ করেছেন বলে জানা যায়।
২। ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতি
ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতিতে মহানবী (স)- এর উপর ওহী নাযিল হত। ওহী নাযিল হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত হতে তাঁর কানে এ ঘন্টা ধ্বনি বাজতে থাকত। তাঁর কাছে উপস্থিত কোন কোন সাহাবীও এ ঘন্টা ধ্বনি শুনেছেন বলে জানা যায়। হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত হারিছ ইবনে হিশাম রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করেন-
হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট কিভাবে ওহী আসে? এর উত্তরে তিনি বলেন-
কখনও কখনও আমার নিকট ওহী আসে ঘন্টা ধ্বনির মত। এ প্রকার ওহী আমার খুবই কষ্টকর মনে হয়। তবুও সে (জিবরাঈল আ) যা বলে আমি তা তাৎক্ষণিক আয়ত্ত করি।
এই ঘন্টা ধ্বনি কিসের ধ্বনি সে বিষয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন, এটি আল্লাহর কথা বলার ধ্বনি। কেউ বলেছেন, এটি জিবরাঈল (আ)- এর পা বা ডানার ধ্বনি ইত্যাদি। শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ) বলেছেন, মানুষের বাহ্য ইন্দ্রীয় পার্থিব জীবন হতে পৃথক করা হলে নৈসর্গিকভাবেই উক্তরূপ ঘন্টা ধ্বনি শোনা যেতে পারে।
৩। অন্তর্লোকে ঢেলে দেওয়া পদ্ধতি
রাসুলুল্লাহ (সা)- এর ‘ইলক্বায়ি ফিল ক্বালব’ বা অন্তরে ওহী সঞ্চারণ পদ্ধতি নামেও অভিহিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) এ বিষয়ে ইরশাদ করেন,
রুহুল কুদুস জিবরাঈল (আ) আমার অন্তর্লোকে ঢেলে দিয়েছেন বা সঞ্চারিত করেছেন বা ফুঁকে দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে এমনও হতে পারে যে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা)- এর অন্তরে তার ওহী সরাসরি সঞ্চার করেন নিজ ক্ষমতা বলে। যেভাবেই হোক রাসূল (সা) খুবই কম কসরতে এ প্রকার ওহী তার অন্তর্লোকে আপনা আপনি প্রস্তুতভাবে লাভ করে থাকেন।
৪।ফেরেশতার মানবাকৃতিতে আগমন
ফেরেশতাগণের নিজ নিজ আকৃতি রয়েছে। হযরত জিবরাঈল নিজ আকৃতিতে প্রকাশিত হন আবার কখনও কখনও মানব আকৃতিতেও প্রকাশিত হন রাসূল (সা)এর নিকট। সহীহ হাদীস দ্বারা জানা যায় হযরত জিবরাঈল (আ) মানুষরূপে রাসূলুল্লাহ (সা) –এর নিকট এসে আল্লাহর ওহী পৌঁছে দিতেন। সিংহভাগ ক্ষেত্রে সাহাবিগণ উক্ত মানুষটি দেখতে পেতেন কিন্তু বুঝতে পারতেন যে উক্ত মানুষটি আসলে মানুষ নয় ফেরেশতা। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত দাহিয়াতুল কালবী (রা) এর আকৃতিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফেরেশতে ওহী নিয়ে আসতেন। অন্য সাহাবী বা অপরিচত লোকের আকৃতিতেও ফেরেশতা ওহী নিয়ে আসতেন।
৫। নিজ আকৃতিতে ফেরেশতার আগমন
আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরাঈল (আ) –কে যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছে সে আকৃতিতেও তিনি রাসূল (সা) –এর নিকট ওহী নিয়ে আসতেন বলে জানা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা) কুরআনের প্রথম ওহী যখন গারে হেরায় লাভ করেন তখন হযরত জিবরাঈল (আ) নিজ আকৃতিতে আগমন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) দুবার বা তিন বার তাঁকে তাঁর নিজ আকৃতিতে দেখেছেন বলে জানা যায় (১) একবার গারে হেরায় (২) একবার মিরাজকালে সিদরাতুল মুনতাহায় (৩) আরেক বার ওহী বন্ধের পরে পুনঃ ওহী চালুর সময়।
৬। পর্দার অন্তরাল হতে
মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (স) –এর প্রতি তার জাগ্রতকালে পর্দার আড়াল হতে সরাসরি ওহী করেছেন। পর্দার অন্তরালে আল্লাহ কথা বলেছেন পর্দার বাইরে মুহাম্মদ (স) –এর সংগে। মিরাজ রজনীতে আল্লাহ এরূপ রাসূল (স) –এর সংগে কথা বলেছেন বলে জানা যায় এবং এ পদ্ধতিতেই তার প্রতি প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত এবং পরবর্তী পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিধান অবতীর্ণ ও ফরজ হয় এই মিরাজ রজনীতে।
৭। তন্দ্রাকালে ওহী লাভ
রাসুলুল্লাহ (স) যেমন জাগ্রত অবস্থায় ওহী পেয়েছেন তেমন পেয়েছেন নিদ্রিত অবস্থায়। একটি রিওয়ায়াত হতে জানা যায় যে রাসূল (স) এ পদ্ধতিতে সাতবার ওহী পেয়েছেন।
৮। হযরত ইসরাফীল (আ) –এর মাধ্যমে ওহী লাভ
আল্লাহ তাআলা কখনও কখনও হযরত ইসরাফীল (আ) –এর মাধ্যমে রাসূল (স)-এর নিকটে ওহী পাঠিয়েছেন বলে জানা যায়। খুব কমই তিনি ওহী নিয়ে এসেছেন।
ওহী অবতরণ পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন,
কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যে আল্লাহ তার সংগে বাক্যালাপ করবেন সরাসরী ওহী ব্যতীত কিংবা পর্দার অন্তরাল ব্যতীত কিংবা দূত প্রেরণ ব্যতীত অতঃপর উক্ত দূত (মানুষের নিকট) তাঁর ইঁচ্ছা মাফিক তার প্রত্যাদেশ পৌছে দিবে তার অনুমতিক্রমে। হযরত হারিছ ইবন হিশাম (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) –এর নিকট ওহী আসার পদ্ধতি জিজ্ঞাসা করলে রাসূল (স) বলেনঃ
কখনও আমার নিকট ওহী আসত ঘন্টা ধ্বনির মত। এটি আমার উপর অত্যন্ত কষ্টকর মনে হয়। এতে আমার ঘাম বেরিয়ে যায়। তবুও ফেরেশতা যা বলে আমি তা তাৎক্ষণিকভাবে আয়ত্ত করে লই। কখনও কখনও ফেরেশতা আগমন করে পুরুষের আকৃতিতে। অতঃপর সে আমার সংগে বাক্যালাপ করে। সে যা বলে আমি তা তাৎক্ষণিকভাবে আয়ত্ত করে লই। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি দেখেছি যে তাঁর (রাসূল (স)-এর) উপর ওহী আসে কঠিন শীতের দিনে, এতে তাঁর কষ্ট ও উষ্ণতাপ অনুভূত হয় আর তখন তাঁর ললাট হতে টপ টপ করে ঘাম ঝরে পড়ে। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)”
(পৃষ্টা ২৬-২৮; চতুর্থ সংস্করণঃ জুন,২০০৫; প্রকাশকঃ হাসান বুক হাউসের পক্ষে ডঃ মোহাম্মদ আবুল হাসান, ৬৫, প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০)
বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ এর ওহী অবতরণ সম্পর্কিত অংশ –

ওহী অবতরণের উক্ত পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। উপরের বর্ণনায় দেখলাম মুহাম্মদ স্বপ্নকেও ওহী বা প্রত্যাদেশ বলে মনে করেছেন বা চালিয়ে দিয়েছেন। এটি অবশ্য খুব নিরাপদ একটা পদ্ধতি – কেউ কোন প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। কেউ যদি নিজে কিছু রচনা করে তা স্বপ্নের মাধ্যমে ওহী হিসেবে পেয়েছেন বলে দাবী করেন তবে তা প্রমাণিত হবে কিভাবে? (আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা কবিরাজ যারা স্বপ্নে পাওয়া গাছ-গাছড়ার সাহায্যে চিকিৎসা করেন তাদের কাছে গেলে হয়ত বিষয়টি বোধগম্য হয়ে উঠত!)
ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। যারা মানসিকভাবে অসুস্থ, মৃগী রোগী বা হিস্টিরিয়াগ্রস্থ তাদের এরকম হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। তখনকার সময়ে মৃগী রোগকে পবিত্র বলে মনে করা হত। তাই মুহাম্মদ যদি মৃগী রোগ বা এ ধরণের কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তবে তা তাকে নবী হওয়ার ক্ষেত্রে এবং কোরানকে অলৌকিক বলে প্রচার করতে সহায়ক হয়েছিল। আরো কিছু বিষয় মুহাম্মদের মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে, যেমন- সিনা সাকের ঘটনা- ফেরেশতারা তার বুকের রক্ত যা শয়তানি প্রণোদনার উৎস তা নাকি বুক চিরে কয়েকবার পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়েছিলেন(বলাবাহুল্য ধারণাটি হাস্যকর, সিনাসাক করে পাপচিন্তা দূর করা অসম্ভব, এর জন্য প্রয়োজন ব্রেন সাক!!), কথিত ওহী নাযিলের সময়ে অস্বাভাবিক আচরণ- অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া তারপর সবাই তাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিত ইত্যাদি। এছাড়া ওহী নাযিল পদ্ধতিটি যদি আল্লাহ নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে তাতে মুহাম্মদের কষ্ট বা বিভিন্ন ধরণের বিপত্তি হওয়ার কারণ কি? দেখেন ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতিটি তার কাছে নাকি খুব কষ্টকর ছিল। কোরান যেহেতু বরকতময় এবং প্রশান্তিদায়ক তাহলে ওটা নাযিল হলে মুহাম্মদের আরাম অনুভব হওয়াই যৌক্তিক ছিল। শোনা যায়, কোরান যদি পাহাড়ে নাযিল হত তবে তা নাকি ধ্বংস হয়ে যেত আর কোরান নাযিল হওয়ার সময় মুহাম্মদ উটের উপরে থাকলে তা নাকি ভারের আধিক্যে অস্থির হয়ে উঠত। কোন গ্রন্থকে মহিমান্বিত করতে এত বিচিত্র প্রচার আসলেই অনন্য। উপরের বর্ণনায় ঘণ্টা ধ্বনিটি কিসের তার যে বিবরণ বিভিন্ন বুজুর্গ দিয়েছেন তা বড়ই মনোরম। কোরান অবতরণের ঘণ্টা ধ্বনি পদ্ধতিটি শুরু থেকেই অমুসলিমদের হাসির খোরাক যোগিয়ে আসছে।
অন্তর্লোকে ঢেলে দেয়া পদ্ধতিটি আরো চমৎকার। কারো যদি হঠাৎ কিছু মনে আসে আর তারপর তিনি মনে করেন তা আল্লাহর ওহী এবং তা পরবর্তীতে কাব্যে রূপ দিয়ে উপস্থাপন করে একে ওহী বলে দাবী করেন তবে তা নিয়ে কিছু বলার নেই। এ পদ্ধতিটিও পরম সুবিধাজনক। কারণ সত্যি সত্যি ওহী নাযিল হয়েছে কি না তা প্রমাণ করার কোনো ঝামেলা আর রইল না।
আরেকটি উদ্ভট পদ্ধতি হল ‘ফেরেশতার মানবাকৃতিতে আগমন’। ফেরেশতারা মানবাকৃতি ধারণ করে নাকি মুহাম্মদকে বিভিন্ন মেসেজ দিতেন। আমাদেরকে দেখতে হবে এ মানুষগুলো কারা ছিল। একজন সম্পর্কে জানলাম যার নাম ছিল দাহিয়াতুল কালবী। লোকটির সাথে মুহাম্মদের কি বিশেষ সম্পর্ক ছিল? ফেরেশতার মানবাকৃতিতে আসার প্রয়োজনটাই বা কি ছিল আর মাঝে মাঝে দাহিয়ান কালবী এর রূপ ধারণের কারণ কি ছিল তা কিছুটা ভাবলেই আঁচ করা সম্ভব।
এবার নিজ আকৃতিতে ফেরেশতার আগমন। ফেরেশতাদের নাকি নিজস্ব আকৃতি রয়েছে যদিও তারা যেকোন কিছুর আকৃতি ধারণ করতে পারেন। ফেরেশতাদের নিজস্ব আকৃতির রকমারি বর্ণনা শুনতে পাওয়া যায়। কারো কারো আকার নাকি এত বড় যে পৃথিবীর সব জল ঢেলে দিলেও একফোটা জল দেহ থেকে বেয়ে পড়বে না, কারো কারো রয়েছে হাজার হাজার ডানা, কারো আবার প্রতিটি পশমেই মাথা, হাত, পা সংযুক্ত ইত্যাদি। ফেরেশতারা ডানা দিয়ে কি করে তা বুঝা বেশ মুশকিল, কারণ বায়ুমণ্ডলের পরেই তো আর বাতাস নেই। বলাবাহুল্য ইসলামে এত অতি উদ্ভট ‘ফেরেশতা’ ধারণাটি কিভাবে আসল তা জানতে খুব একটা গবেষণা প্রয়োজন নেই; জ্বিন, ভুত, ফেরেশতা – এগুলোর ধারণা আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে আরবে বহুল প্রচলিত ছিল।
জিবরাইলকে রেখে ইসরাফিল ওহী নিয়ে কেন আসত তা বুঝা দুষ্কর। ইসরাফিল তার শিঙ্গার ডিউটি রেখে ওহী নিয়ে আসলেন –বিষয়টি কি অস্বাভাবিক নয়?
পর্দার অন্তরাল হতে কেনো ওহী নাযিল করতে হয় ওটাও বোধগম্য নয়। মুহাম্মদের সম্মুখে আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করলে সমস্যা কি ছিল? অনেকে হয়ত বলবেন মুহাম্মদ তা সহ্য করতে পারবেন না। কিন্তু কথা হলো –আল্লাহ তো ইচ্ছে করলেই সে ক্ষমতা মুহাম্মদকে দিতে পারতেন। আরেকটি ব্যাপার ঠিক পরিষ্কার হলো না- এ পর্দাটি কিসের পর্দা? আর পর্দার অন্তরাল হতে আল্লাহ যদি ওহী পাঠাতে পারেন তবে জিবরাইলকে দিয়ে পাঠালেন কেন? আল্লাহ যদি সব জায়গায় আছেন তবে মুহাম্মদকে কেন মেরাজে রজনীতে উর্ধ্বলোকে নিয়ে গিয়ে আল্লাহ পর্দার অন্তরাল হতে তার সাথে আলাপ করলেন তা বুঝা একদম অসাধ্য ব্যাপার!(মেরাজ কিন্তু রাতের বেলায়ই হয়, দিনের বেলায় যদি হয় আর মানুষ দেখে ফেলে তবে তার আর মাহাত্ম্য থাকল কোথায়?)
তন্দ্রাকালে ওহী লাভ? মাঝে মাঝে জটিল চিন্তায় আচ্ছন্ন হলে যদি তন্দ্রা ভাব আসে আর তখন যদি কিছু নতুন আইডিয়া মাথায় আসে তাহলে এগুলোকে কি ওহী বলতে হবে?
আরো বেশ কিছু প্রশ্ন মাথায় এসে ভর করে। যেমন- আল্লাহ সরাসরি বা জিবরাইলের মাধ্যমে নবী-রাসূলদের সাথে যেমন যোগাযোগ করতেন সেরকমভাবে সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করলে সমস্যা কোথায়? অনেকে বলবেন, তাতে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তা ব্যাহত হবে। আমরা বলব, তাতে বরং মানুষের পরীক্ষা নেয়া বাস্তবসম্মত হত কেননা এতে করে মানুষ আল্লার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ধর্মসংক্রান্ত প্রশ্নগুলোর সমাধান পেত ও আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার একটা উপায় খূঁজে পেত এবং এতে করে ধর্ম না মানার জন্য পরকালের অবর্ণনীয় শাস্তির কিছুটা হলেও যৌক্তিকতা থাকত।
(ওহী অবতরণ সম্পর্কিত বেশ কিছু হাদিস পাবেন প্রধান হাদিসগ্রন্থ বোখারিতে; লিংক-
http://www.usc.edu/org/cmje/religious-texts/hadith/bukhari/
বোখারি এর ওহী অবতরণ সম্পর্কিত হাদিসগুলোঃ
Volume 1, Book 1, Number 2; Volume 1, Book 1, Number 3; Volume 1, Book 1, Number 4; Volume 4, Book 52, Number 95; Volume 4, Book 54, Number 438; Volume 4, Book 54, Number 458; Volume 4, Book 54, Number 461; Volume 5, Book 59, Number 618; Volume 5, Book 59, Number 659; Volume 6, Book 60, Number 447; Volume 6, Book 60, Number 448; Volume 6, Book 60, Number 478; Volume 6, Book 60, Number 481; Volume 6, Book 61, Number 508;
এগুলো ভিন্ন ওহী অবতরণ সম্পর্কিত আরো অনেক হাদীস বোখারি সহ সিহাহ সিত্তাহ এর অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে পাওয়া যাবে।
অন্যান্য হাদিসগ্রন্থ পাবেন- http://www.usc.edu/org/cmje/religious-texts/hadith/
বোখারি এর বাংলা অনুবাদ – http://www.banglakitab.com/BukhariShareef.htm



কোরান কি অলৌকিক গ্রন্থ? -২

কোরানের অলৌকিকতা প্রমাণে প্রদত্ত যুক্তিগুলো খণ্ডনঃ
কোরানকে বিশ্বাসীরা নানাভাবে অলৌকিক বলে প্রমাণ করতে চান। তাদের দেয়া যুক্তিগুলো এখানে উপস্থাপন করে খণ্ডন করা হলো।
১। কোরান সর্বশ্রেষ্ট গ্রন্থ। আজ পর্যন্ত কেউ কোরানের মত কোনো গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম হয় নাই। সুতরাং এটা আল্লাহর রচিত।
এ যুক্তিটি কোরান থেকে আহরিত। নিম্নোক্ত আয়াত তিনটি মনোযোগ সহকারে পড়ি-
“তারা যদি (তাদের দাবিতে) সত্যবাদী হয়ে থাকে তবে কোরানের মত কোনো গ্রন্থ তারা রচনা করুক”(সূরা তূরঃ ৩৪)
“আপনি বলে দিন, “কোরানের অনুরূপ কোন কিছু রচনা করার জন্য যদি সকল মানুষ ও জিন একত্রিত হয় ও তারা পরস্পর সহযোগিতা করে, তবুও তারা এর অনুরূপ কোন কিছু রচনা করতে পারবে না”(সূরা বনি ইসরাঈলঃ৮৮)
“আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তার অনূরুপ কোন সূরা আনয়ন কর এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহবান কর। যদি তোমরা আনয়ন না কর এবং কখনই পারবে না, তবে ভয় কর সেই আগুনকে, মানুষ ও পাথর হবে যার ইন্ধন, কাফিরদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে”(সূরা বাকারাঃ ২৩, ২৪)
এবার মূল আলোচনায় আসি। কোরানের শ্রেষ্টত্বের এই দাবি কতটা হাস্যকর তা যেকোনো যুক্তিবাদিই উপলব্ধি করতে পারবেন। আসলে আমার গ্রন্থই শ্রেষ্ট, এর মত গ্রন্থ রচনা সম্ভব নয় এ ধরণের দাবির কোনো অর্থই হয় না। যখন কোরানেই এধরণের দাবি থাকে তখন তা একে কতটা নিম্নমানের দিকে নিয়ে যায় তা ভাববার বিষয়। কোরান শ্রেষ্ট গ্রন্থ- এর মত কোনো গ্রন্থ রচনা অসম্ভব এরকম দাবী কেউ করলে যে প্রশ্ন সর্বাগ্রে চলে আসে তাহলো কোন দিক থেকে কোরান শ্রেষ্ট? কিসের দিক থেকে কোরান অনন্য? আর কে কিভাবে কোরানের এই শ্রেষ্টত্ব নিরুপণ করেছেন ?
বিষয়বস্তুর দিক থেকে কোরান আন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোর মতই খেলো। কিছু বিষয় আমরা বিবেচনা করি-
>ছন্দ- কোরানকে খু-উ-ব ছন্দময় গ্রন্থ বলতে শুনি অনেককে। এই ছন্দময়তার বিষয়টি কোরানের বেলায় একেবারেই খাটে না। সূরা নাসে আমরা দেখতে পাই প্রতিটি আয়াতের শেষে “স” রয়েছে, এটি উন্নতমানের কোনো ছন্দ বলা যায় না কারণ এই ধরণের ছন্দ একঘেয়েমির সৃষ্টি করে এবং তা একে নিছক নিম্নমানের পদ্য বা ছন্দবন্ধ ছড়ার মত করে তোলে। এছাড়া কোরানের বেশির ভাগ আয়াতে এই ছন্দ-বদ্ধতাটাও নেই। আর ছন্দ থাকা অলৌকিকতার প্রমাণ নয়- মানুষ অজস্র ছন্দময় কবিতা-ছড়া-গান রচনা করেছে। আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছন্দের জাদুকর হিসাবে বিখ্যাত, তিনি কখনো তার এই ছন্দ বা ছন্দ প্রতিভা অলৌকিক ভাবে পেয়েছেন বলে দাবি করেন নাই।
> সুরেলা- কোরান নাকি খুব সুরেলা গ্রন্থ। কোরান যেহেতু একটা গ্রন্থ এবং “সুর” বিষয়টি কৃত্রিম বা মানুষ আরোপিত তাই এটি কোরানের মৌলিক ধর্ম নয়। কোরান যখন সুর করে পড়া হয় তখন তা বিশ্বাসীদের আবেগে সুড়সুড়ি দেয় তাই তারা আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন। কোরানের সুরে ইচ্ছে করলে আরবি গালিও পাঠ করা সম্ভব এবং বলাবাহুল্য আমি নিজেই পরীক্ষা করে দেখেছি যিনি কোরানের অলৌকিকতায় বিশ্বাসী অথচ জানেন না ইহা কোরানের অংশ নয় তিনি এতে কোরান পাঠ শোনার সময়ের মতই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আর কোনো কিছু সুরেলা হওয়াটা পাঠক বা গায়কের অবদান। এটা তো ঐশ্বরিক না বা আল্লা কোরানকে অডিও আকারে মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন এমনও তো না। এছাড়া কেউ যদি হেড়ে গলায় কোরান পাঠ করে তবে তা যতই শুদ্ধ হোক না কেন বিরক্তির উদ্রেক করে। তাই “কোরান তেলওয়াত শুনলেই মনে হয় তা অলৌকিক গ্রন্থ” এরকম দাবিরও কোনো অর্থই হয় না। এছাড়া কোরান শুনলেই বা পড়লেই যদি কারো একে অলৌকিক বলে মনে হয় তবে তাও একে অলৌকিক বলে প্রমাণ করে না। এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির কাছে ঠিক কোন কারণে একে অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে তা-ই গবেষণার বিষয়।
কেউ যদি আপনাকে ওমর খৈয়ামের কবিতার মত কবিতা লেখতে বলে আপনি তাকে কি বলবেন? কেউ যদি চর্যাপদকে অলৌকিক বলে দাবি করে তবে এর জবাবে কি কেউ এ ধরণের কোনো গ্রন্থ রচনা করবে বা করতে যাবে? আল্লার যুক্তিবোধের এই নমুনা দেখে যে কেউ ভড়কে যেতে পারে। উপরের এক আয়াতে আল্লা বলছেন মানুষ ও জ্বীন সবাই মিলেও কোরানের মত কিছু রচনা করতে পারবে না। এ ধরনের কথার অর্থ উদ্ধারও একজন বোধ সম্পন্ন মানুষের জন্য দূরহ বঠে। আচ্ছা, মানুষ আর জ্বীন জাতি কিভাবে একত্রিত হবে আর কে তাদের একত্রিত করবে? কোরান রচনার জন্য সকল মানুষই বা এক হবে কেন? সকল মানুষের তো একসাথে মতিভ্রম হতে পারে না। আর কোরানে এমন কি আহামরি আছে যে ওটা নিয়ে এরকম উদ্ধত ও একগুঁয়ে দম্ভোক্তি করতে হবে? আর কোরানে সন্দেহকারীদের কি বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে দেখেন, “যদি তোমরা(সূরা রচনা করে তা) আনয়ন না কর এবং কখনই পারবে না, তবে ভয় কর সেই আগুনকে, মানুষ ও পাথর হবে যার ইন্ধন, কাফিরদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে”(উপরে আয়াতটি উল্লেখিত হয়েছে)। এই হলো পরম করুণাময়ের করুণাময়তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সন্দেহ করার প্রতি মানুষকে এভাবে হুমকি কোনো সভ্য সত্ত্বার কাছ থেকে আসতে আরে না। সন্দেহ করা মানুষের অনেক বড় গুণ, মানুষ যদি সন্দেহ করতে না পারত বা না করত তবে সভ্যতা কখনো এ পর্যায়ে আসতে পারত না, মানুষ সন্দেহ করতে পারে বলেই সে সত্যের কাছাকাছি পৌছতে পারে।
কেউ কোরানের মত কোনো গ্রন্থ রচনায় অক্ষম হলে তা কোরানকে অলৌকিক প্রমাণ করে না। যদি কেউ কোরানের মত কোনো গ্রন্থ রচনা করতে না পারে তবে হয়ত বলা যাবে কোরান “অনন্য” , এর লেখকরা সর্ব শ্রেষ্ট লেখক ইত্যাদি- কিন্তু এটা অলৌকিকতার প্রমাণ তো হতে পারে না।
কোরানের মত গ্রন্থ রচনা সম্ভব নয় বলে যারা দাবি করেন তাদেরকে উপযুক্ত জবাব দেয়া হয়েছে এই ভিডিওতে
httpv://www.youtube.com/watch?v=1fOIXwbVfVs
স্ক্রিপ্ট
Produce a Sura like it
২। কোরান সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস। আর তা আল্লার বাণী বা অলৌকিক গ্রন্থ বলেই সম্ভব।

এ ধরণের দাবি শুধু হাস্যকর নয় নির্বুদ্ধিতার পরিচায়কও বটে। কোরান যদি সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস তবে মানুষ কেন যুগ-যুগ ধরে জ্ঞান অর্জনের নেশায় এত শ্রম দিচ্ছে এমনকি জীবন পর্যন্তও দিয়ে দিচ্ছে। তাহলে তো সব কিছু বাদ দিয়ে একখান কোরান খুলে বসলেই যে কেউ সর্ব-জ্ঞানী হয়ে উঠত। অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমান জাতিই সবার চেয়ে পিছিয়ে।
বিজ্ঞান কিছু আবিষ্কারের পর পরই আমাদের ধর্মগ্রন্থে ওটা আগে থেকেই ছিল এ ধরণের দাবি অনেক ধর্মাবলম্বীরাই করে থাকেন তবে মুসলমানরা এ বিষয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে। খ্রিস্টানরা যতই বাইবেলের সায়েন্স অথবা হিন্দুরা বেদিক সায়েন্স নিয়ে লাফালাফি করুক না কেন মুসলমানদের কাছে সবাই এ বিষয়ে হার না মেনে উপায় নেই। বিজ্ঞান কোনো কিছু আবিষ্কারের পর পরই তা তারা কোরান থেকে অভিনব উপায়ে আবিষ্কার করেন কিন্তু তাদেরকে যদি আপনি শত অনুরোধ করেন যে বিজ্ঞান আজ যেসব বিষয় আবিষ্কার করতে পারছে না বা দূর ভবিষ্যতে যেসব বিষয় আবিষ্কার হবে তা কোরান থেকে আগেই খুঁজে বের করে দিতে তবে তা তারা পারবেন না।
যারা মনে করেন কোরান জ্ঞানের উৎস তাদের অনেককে আমি অনুরোধ করেছি কিছু উদাহরণ দেয়ার জন্য যে জ্ঞান তারা কোরান থেকে পেয়েছেন এবং যা অন্য কোনো উৎস থেকে জানা সম্ভব নয়, কিন্তু কেউ একটিও দেখাতে পারেন নি।
এছাড়া ধর্মগ্রন্থগুলোতে আদৌ কোনো জ্ঞান রয়েছে কি না তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ কেননা যেকোনো জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত ব্যাখ্যা ও দলিল যা ধর্মগ্রন্থগুলো সরবরাহে অক্ষম।
আরেকটি কথা, এমনকি কোনো শাস্ত্র যদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস হয়ে যায় তবে তাও একে অলৌকিক বলে প্রমাণ করে না। বরং তা একে “জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস” বলেই প্রমাণ করে ।
সমস্যার বিষয় হল অধিকাংশ মুসলিমই ইসলাম পূর্ব মানুষের অগ্রগতি সম্পর্কে খুব কম জানে বা একেবারেই জানে না আর কোরান পরবর্তী সকল আগ্রগতিতে কোনো না কোনো ভাবে কোরানের অবদান রয়েছে বলে মনে করে। তারা আয়নীয় দার্শনিকদের কথা জানে না, তারা সক্রেটিস-এরিস্টটল-প্লেটোর অবদানের খবর রাখে না, ফিরাউনীয় সভ্যতার নামও শুনে নি, হিব্রু সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি তাদের কাছে অজানা কিছু ।
৩। কোরান যদি অলৌকিক গ্রন্থ না হত তবে তাতে অনেক পরস্পর-বিরোধী কথা বা অসঙ্গতি থাকত। কোরান যদি অলৌকিক গ্রন্থ না হত তবে তা বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হত না। যেহেতু কোরানে বিজ্ঞানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছুই পাওয়া যায় নি তাই এটি অলৌকিক গ্রন্থ।
এ কথাটিও কোরান থেকে উৎসরিত। কোরানে আছে,
“তারা কি কোরান অনুধাবন করে না? তা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও পক্ষ থেকে নাজিল হত তবে তারা এতে বহু অসঙ্গতি পেত”। (সূরা-নিসাঃ৮২)
আবারো আল্লার যুক্তিবোধ দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। কোনো গ্রন্থ যদি আল্লা না লেখে তবে তাতে অসঙ্গতি পেতে হবে কেন? আল্লা ছাড়া যারাই বই লেখেছে তাদের বইতে কি নানা রকম অসঙ্গতি রয়েছে? আর কোনো গ্রন্থে অসঙ্গতি পেতে হলে ঐ গ্রন্থ সম্পর্কে নির্মোহ থাকতে হয়। যে গ্রন্থকে আপনি আল্লাহ প্রেরিত গ্রন্থ বলে গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন এতে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু আছে বলে আপনি কি মনে করবেন বা মেনে নিবেন? একটা গল্প বলি- “এক লোক একবার বলেছিল সে কোনো একদিন সারা দিন ঘুমিয়েছিল। পরে দেখা গেল সে ঐ দিনে মোটেও ঘুমায় নি, রাত্রে ঘুমিয়েছিল। পরে তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, আরে দিন তো সূর্যের আলো যুক্ত রাত। আমি দিনে ঘুমাই নি তো কি হয়েছে রাতে ঘুমিয়েছি। আর দুটোই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আমার কথার সত্যতা বুঝতে হলে তা বুঝার মত জ্ঞান থাকতে হবে”। এ ধরণের কথা শুনলে কি বলবেন? বস্তুত কোরানে অনেক পরস্পর বিরোধি কথা রয়েছে কিন্তু এগুলোকে ঐ গল্পের মত করে ব্যাখ্যা দেয়া হয়। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের সাথে একদল খোদার খাসী কোরানের বিভিন্ন শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে বিজ্ঞানময় করার মহান কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছেন। এরা এতই নির্লজ্জ যে বিজ্ঞানের কোনো কিছু কোরানের সাথে সংঘাত তৈরী করলে সাথে সাথে শব্দের অর্থ-ব্যাখ্যা পরিবর্তন করবেন, নতুন অভিধান তৈরী করবেন, আধুনিক তফসির বানাবেন আর অবশেষে দাবি করবেন তাদের কোরানে সবই ছিল ঐ বিষয়টি বিজ্ঞান খোঁজে পাবার আগেই।
কোরানে প্রচুর অসংগতিপূর্ণ আয়াত আছে। কিন্তু এগুলো ধরলে ঈমানদাররা বলবেন, ‘ঊহা রুপক’, নতুবা বলবেন, ‘এই হুকুম রহিত করা হয়েছে ‘। রহিত বা মনসুখ আয়াত সম্পর্কে আপত্তি তোলা যায় এই বলে যে – এ হুকুম পরবর্তীতে রহিত হয়ে যাবে জেনেও আল্লা কেন এই আয়াত নাজিল করলেন, যেহেতু কোরান কিয়ামতের আগ পর্যন্ত সর্ব কালের জন্য অনুসরণ যোগ্য গ্রন্থ। আর কোরানে রুপকের এত প্রাদুর্ভাব কেন, কেন আল্লার সাহিত্যরস কোরান রচনার সময় এভাবে উছলে পড়ে বিরুপ হয়ে দাড়াল যে একে রুপক না বললে ইমান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে? আর দিনদিন কোরানের আয়াতগুলোকে যে হারে রুপক বানানোর হিড়িক পড়েছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে স্বয়ং আল্লার অস্তিত্বই রুপক হয়ে যায় কিনা কে জানে।
কোনো শাস্ত্রের অলৌকিকতায় অতিমাত্রায় বিশ্বাসে কারো যদি বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় তাহলে আসলেই সমস্যা বটে। কেউ যদি কোনো পুঁথি শাস্ত্রে বিজ্ঞান রয়েছে বলে মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাস করেন তবে তা থেকেও বিজ্ঞান উদ্ধার করতে পারবেন।
এই আয়াতটি দেখেন-
আর আমি পাঠাইলাম নূহকে তাহার ক্বওমের প্রতি, অতঃপর তিনি উহাদের মধ্যে অবস্থান করিলেন পঞ্চাশ বৎসর কম এক হাজার বৎসর, অনন্তর প্লাবন আসিয়া তাহাদিগকে পাকড়াও করিল, বস্তুত তাহারা বড়ই অনাচারী লোক ছিল। (সূরা আনকাবুত, ২৯: আয়াত ১৪)
আয়াতটির “আলফা সানাতিন ইল্লা খামছিনা আ’মা” মানে হল –“পঞ্চাশ বৎসর কম এক হাজার বৎসর”। অর্থাৎ নূহ নূন্যতম ৯৫০ বৎসর বেচেছিলেন। (এই সানাতুন শব্দ থেকে বাংলা “সন” শব্দটি এসেছে)
আজ আমরা জানি মানুষ কখনো এত বৎসর বেচে থাকতে পারে না এবং ব্যাপারটা রীতিমত উদ্ভট। ইমানের জোরে কেউ যদি এ আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে চান যে নূহের উম্মতেরা ১২ মাসে বছর হওয়াটা জানত না, তারা অপেক্ষাকৃত কম দিনকে বছর বলে মনে করত তবুও এই ব্যাখ্যাটা ধোপে টিকে না। কারণ এখানে আল্লা বক্তা, তিনি তো ১২ মাসে বছর হওয়ার ব্যাপারটা জানতেন। আর তিনি এটাও জানতেন যে, তিনি যদি বলেন নূহ নূন্যতম ৯৫০ বছর বেচে থাকেন তবে আরবের মানুষেরা এর মানে কি বুঝবে, আরবের মানুষেরা ঠিকই ১২ মাসেই বছর পরিমাপ করত। ধরেন আমি কোনো এক দ্বীপে ৩ বছর কাঠিয়ে এলাম যা ওই দ্বীপের পশ্চাদ পদ বাসিন্দাদের হিসাবে ৫ বছর। এখন আমি কি ফিরে এসে সকলকে বলে বেড়াব যে, আমি ঐ দ্বীপে ৫ বছর ছিলাম? এছাড়া নূহের উম্মতেরা কম দিনে বছর পরিমাপ করত এ কথার একেবারেই কোনো প্রমাণ নেই এবং কোরানে কোথাও এ কথার উল্লেখ নেই।
আরেকটি আয়াত দেখেন-
আর তিনি এমন যে, সমস্ত আসমান ও যমীনকে সৃষ্টি করিয়াছেন ছয় দিনে, তখন তার আরশ(সিংহাসন) ছিল পানির উপরে(সূরা হূদ,১১: আয়াত ৭)
আয়াতটি একেবারেই সরল। এই আয়াতে “সিত্তাতি আইয়্যাম” বলতে সরলভাবেই ছয় দিন বুঝাচ্ছে আর “মাউন” মানে পানি। এবার প্রশ্ন, সৃষ্টির পূর্বে দিন এলো কোথা থেকে, পানিই বা এলো কোথা থেকে? আর সিংহাসন ছিল পানির উপরে শুনেই তো হাসতে হাসতে হাসপাতালে যাবার যোগাড়। আবার ধর্মবাদিরা তাদের ইমান ঠিকিয়ে রাখতে এই আয়াতের যেসব ব্যাখ্যা দেন তা এই আয়াতটি থেকে কম উপভোগ্য নয়।
আরো কিছু আয়াত বলি-
“আর তিনিই প্রতিরোধ করিয়া রাখিতেছেন আসমান সমূহকে পড়িয়া যাওয়া হইতে” (সূরা আল-হাজ্জ, ২২: আয়াত ৬৫)
>>এত বড় নীল আকাশ কিভাবে উপরে কিভাবে ঠিকে থাকে তা তখনকার মানুষের জন্য একটা বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা ছিল। আল্লাহ চমৎকার ভাবে তাদের এ জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন। আবার কোরানে অন্যত্র বলেছেন –
“লোকদের উপর প্রতিষ্টিত আকাশমণ্ডলের প্রতি কি ওরা কখনও তাকিয়ে দেখে নি, কিভাবে আমরা সেটি নির্মাণ করেছি এবং সেটিকে চাকচিক্যময় বানিয়েছি এবং তাতে কোন ফাটল নেই(সূরা ক্বাফ, ৫০: আয়াত ৬)
>>হুম, কোনোই ফাটল নাই! এ জন্যই তো তিনি সর্বজ্ঞ আর মহান!
“তোমরা কি জাননা আল্লাহ কেমন ভাবে সাত আসমানকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন?” (সূরা নূহ, ৭১: আয়াত ১৫)
>> আল্লা যে স্তরে স্তরে সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন তা আমরা জানব না কেন? আমরা না আল্ল্যা সুবহানাহু ওয়া তাআ’লার গর্বিত ব্যান্দা।
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই উপযোগী যিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা যিনি ফেরেশতাকে সংবাদবাহী বানান যাহাদের দুই দুইটি, তিন তিনটি ও চার চারটি পালক বিশিষ্ট ডানা আছে। (চারিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ নহে) বরং তিনি সৃষ্টিতে যত ইচ্ছা অধিক করিয়া থাকেন(হাদিসে বর্ণীত আছে, জিবরাইলের ছয় শত ডানা রয়েছে), (সূরা ফাতির,৩৫: আয়াত১)
>>অতি উত্তম! তিনি সৃষ্টিতে যত ইচ্ছা অধিক করিয়া থাকেন!! ফেরেশতা সেমেটিক উর্বর মস্তিষ্কের বাজে চিন্তার ফসল। রাজাধিরাজ আল্লার মানুষের সাথে যোগাযোগের জন্য তো দূত প্রয়োজন!! তাই এই ফেরেশতার ব্যবস্থা। আর আল্লা কেন পাইক পেয়াদা ছাড়া সরাসরি মানুষের সাথে যোগাযোগ করেন না সে ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই, আর আল্লার যদি এক পাল ফেরেশতা রয়েছে তবে তাদের মাধ্যমেই অন্তত মানুষের সাথে যোগাযোগ করে মানুষের আধুনিক যত সমস্যা তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ কেন নেন না সর্ব-শক্তিমান ও অসীম করুণাময় তাও এক প্রশ্ন বঠে। যাই হোক, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পরেই যে সব শূন্য, সেখানে ডানার সাহায্যে উড়া সম্ভব নয় তা যদি সর্বজ্ঞ আল্লার জানা থাকত তাহলে নিশ্চয় তিনি ফেরেশতার ডানার কথা বলতেন না। আর তা জানতেন না বলেই তো, “সমস্ত প্রশংসা তার জন্যই” !!
বেশি না বলে কোরানের অসংগতি একটা তালিকা দেই Quranic contradictions
আর আগেই বলেছি, এটা কোনো যুক্তি নয়। কোনো গ্রন্থে যদি কোনো অসংগতি না থাকে তবেই তা আল্লা কতৃক রচিত গ্রন্থ হয়ে যায় না যদিও আল্লার মত কোনো মহা মহা জ্ঞানী এমন দাবী করে থাকেন( উপরোল্লিখিত সূরা নিসার৮২ নং আয়াত দ্রষ্টব্য)।
৪। বিশ্বের কোটি কোটি লোক কোরানকে আল্লাহ রচিত বলে রায় দিয়েছে।
এটা কোনো প্রমাণ নয়। সত্যতা ভোট দ্বারা নির্বাচিত হয় না। বিশ্বের কোটি কোটি লোক কোরানকে অলৌকিক মনে করে বলেই যদি তা অলৌকিক হয়ে যায় তবে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ যেগুলোও কোটি কোটি লোক অলৌকিক বলে মনে করে সেগুলো অলৌকিক হবে না কেন? আবার, কোরানকে যত লোক অলৌকিক বলে মনে করে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মানুষ একে অলৌকিক বলে মনে করে না, তাহলে এই যুক্তিতে কোরানকে অলৌকিক নয় বলে কেউ যদি মনে করে তবে সমস্যা কোথায়? এক সময় বিশ্বের প্রায় সকল লোকই বিশ্বাস করত সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে, তাই বলে কি তা সত্য হয়ে গিয়েছিল? অনেক লোক কোনো কিছু বললেই বা বিশ্বাস করলেই তা সত্য হয়ে যায় এ ধরণের আর্গুমেন্টকে বলে Argumentum ad populum যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
৫। যেহেতু আল্লা আছেন তাই তিনি অবশ্যই মানুষের জন্য একটা গাইডলাইন দিবেন আর এটাই আসমানী কিতাব আল-কোরান।
ঈশ্বর যে মানুষের কল্পনার সৃষ্টি তা এই ধরণের দাবি থেকে উপলব্ধি করা সহজ। আল্লা যে মানুষের জন্য গাইড লাইন দিবেন বা এর প্রয়োজন অনুভব করবেন তা নিশ্চিত হলেন কিভাবে? মানুষ ঈশ্বরকে নিজের মত কল্পনা করে- ফলে মনে করে মানুষের সকল বৈশিষ্ট্য যেমন খুশি হওয়া, রাগ করা, সৃষ্টি হিসাবে মানুষের খোঁজখবর নেয়া ইত্যাদি মনুষ্যসুলভ বৈশিষ্ট্য তার রয়েছে এবং সে ইবাদত করলেই তিনি খুশি হয়ে যাবেন।
আরো সমস্যা হল, আল্লা বলি আর ঈশ্বর বলি সে যে খুব একটা শুভকর কিছু সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হলাম কিভাবে? আমরা যদি আমাদের আনন্দে থাকাটাকে ঈশ্বরের অবদান বলে মনেও করি তাহলেও তাকে শুভকর কিছু বলে মেনে নিতে আমার আপত্তি আছে, কেননা অশুভ কিছু কি মানুষকে আনন্দ দিতে পারে না? এখানে যুগের পর যুগ মানুষের অফুরন্ত দুর্দশার কথা নাইবা বললাম যা ঈশ্বরের দ্বারা এক মূহুর্তে সমাধান যোগ্য। এছাড়া ঈশ্বর অধিকাংশ মানুষকে অনন্ত কাল নরক বাসের জন্যই সৃষ্টি করেছেন (কারণ কে কি করবে তা জেনেও তাকে সৃষ্টি করেছেন আর মানুষকে পাপ প্রবণ করে তৈরী না করলে তো সে পাপ করত না। অনেকে বলবেন তাহলে আল্লা তাদের পরীক্ষা করবে কিভাবে? আমি বলব, আল্লার পরীক্ষা করার দরকারটা কি? তার কিসের অভাব? মানুষকে সে যদি ইবাদত/স্তুতি পাবার জন্য সৃষ্টি করে তবে তো বলব সে সফল না, কারণ বেশির ভাগ মানুষ তার ইবাদত করা তো দূরে থাক বিশ্বাসও করে নি। এছাড়া আল্লার ইবাদত পাবার অভিলাষটা তাকে নিদারুণ খাটো করে তোলে।) ঈশ্বর যদি মানুষের জন্য অনন্ত কাল নরক বাসের শাস্তি দিতে চান তবে আমি নির্দ্বিধায় বলব সে অসীম অশুভকর ও চরম নিন্দনীয় সত্ত্বা এবং সেই সাথে তাকে না মানাটাও নিদারুন গর্বের বিষয় বলে মনে করব। আর যদি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ঈশ্বর ও ঈশ্বরের গুণাবলি ঐ ধর্মের প্রচারকের বুজরুকি হয় তবে আমি বলব ওই ধর্মপ্রচারকটা তার কল্পিত ঈশ্বরের মতই নিন্দনীয়। এই ধরনের একটা ঈশ্বর যে নাকি মানুষকে অনন্তকাল( এর কম হলে সমস্যা কি ছিল?) আগুনে পোড়াতে চায় সে আবার মানুষের ভালোর জন্য নবী-রচুল পাঠায়, কোরান পাঠায়। তিনি যদি মানুষের এত ভাল চান তবে চরম বিপদ গ্রস্ত মানুষকে একটু সাহায্য করলে সমস্যা কি ছিল? যদিও সাহায্য করলে তার কোনো ক্ষতি নেই এবং তিনি যদি চাইতেন তবে নাকি মানুষ এই ধরণের বিপদেও পড়ত না। দেখি মানুষ হজে গিয়ে একেবারে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেও আল্লার কোনো খুঁজ নাই!! লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে আছে, মারা যাচ্ছে অহরহ কিন্তু আল্লা কারো ডাক শুনেনি, অথচ মানুষের জন্য তার কি দরদ, নবি-রচুল-কোরান পাঠাচ্ছেন হেদায়াতের জন্য। কেন, মানুষ কোরানের আইন না মেনে কি খুব খারাপ অবস্থায় আছে- উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে কি কোরানের আইন চলে?
আরো সমস্যা আছে। মহাবিশ্বের কোনো স্রষ্টা আছে মানেই ধর্মবাদীরা মনে করেন তিনি কোনো একটি ধর্মের বর্ণিত ঈশ্বর হবেন আর ঐ ধর্ম তাদের-ই ধর্ম। অন্য ধর্মে জোর করে হলেও বা যত মত তত পথ জাতীয় বুলি আউড়িয়ে হলেও মানুষকে কিছুটা শান্ত রাখা সম্ভব কিন্তু মুসলমানরা এ ব্যাপারে একেবারেই নাছোড়বান্দা। তাদের ধর্মের বাইরে যে ঈশ্বর থাকতে পারে তা তাদের চিন্তারও বাইরে। তাদের কথা হল- ঈশ্বর আছে, তিনি ধর্মের জগতের বাইরের কেউ নন এবং তিনিই আল্লা , আল্লা ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই। অনেককে দেখেছি আল্লার পরিবর্তে ঈশ্বর শব্দটার ব্যবহার নিয়েও আপত্তি তুলতে আবার আল্লা শব্দটি ব্যবহার করে এ নামে মন্দ কিছু বললে মাথা নিয়ে ঠিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
৬। কোরান রচনায় মুহাম্মদের স্বার্থ কি ছিল? তিনি যদি কোরানকে নিজের রচিত বলে প্রচার করতেন তবে যুগ শ্রেষ্ট কবি হতে পারতেন।
মুহাম্মদ “মুহাম্মদ” হতে পেরেছিলেন কোরানকে আল্লার বাণী বলে প্রচারের মাধ্যমে। আজ থেকে ১৪০০ বছরের অধিক সময় আগে এরকম প্রচার ও তাতে বিশ্বাস করার মত লোকের অভাব ছিল না যেখানে আজকের যুগেও এমন উদ্ভট বিষয়ে বিশ্বাসের মত মানুষের সংখ্যা কম নয়। এখনো অনেক ভণ্ড পীরের হাজার হাজার মুরিদের খোঁজ পাবেন একটু খবর নিলেই। মুহাম্মদ একজন নারীর(খাদিজা) ব্যবসা দেখাশুনাকারী থেকে একটা জাতির নেতা হতে পেরেছিলেন কোরানকে অলৌকিক বলে প্রচারের মাধ্যমে। মুহাম্মদের যা কিছু অর্জন সব এর মাধ্যমেই। নিচের কয়েকটি আয়াত লক্ষ্য করি-
“হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে”। (৩৩:৪৫-৪৬)
“হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ্ আপনার করায়ত্ব করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি, খালাতো ভগ্নিকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পন করে,নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে। মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল,দয়ালু”।(৩৩:৫০)
“আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ কর”।(৩৩:৫৬ )
স্বীয় পোষ্যপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করলে তা জায়েজ করার জন্য নিম্নোক্ত আয়াত নাজিল করানো হল-
“অতঃপর জায়েদ যখন জয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে”। (সূরা আহযাব,৩৩:৩৭)
(এই আয়াতটি নিয়ে পরে বলছি)
অবশ্যই বিদ্যমান আছে রসুলুল্লার মধ্যে সর্বোত্তম আদর্শ (সূরা আহযাব, ৩৩:২১)
কী অবস্থা ভেবে দেখেন। এভাবে নিজেকে মহিমান্বিত করতে, সুবিধা আদায় করতে এমনকি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যায় পড়লেও তা সমাধানের জন্য মুহাম্মদ নিজের ইচ্ছেমত আয়াত নাজিল করে নিয়েছেন।
কোরান যে খুব একটা ভাল কাব্যগুণ রয়েছে তা কোনো নিরপেক্ষ বিচারে নির্ধারিত করা যায় নি। বরং কোরানের কাব্যগুণকে ফেলনা বলে প্রত্যাখ্যাত হতে দেখি প্রায়ই। কোরানের উপর অলৌকিকতা আরোপ ছাড়া কোরানের প্রতি মানুষের এত সমীহ আনা সম্ভব ছিল না কোনোকালেই।
৭। মুহাম্মদ উম্মী বা নিরক্ষর ছিলেন। তার মত একজন মানুষের পক্ষে কোরানের মত অসাধারণ একটা গ্রন্থ রচনা সম্ভব নয়। সুতরাং উহা অলৌকিক গ্রন্থ।
এটি একটি খোঁড়া যুক্তি। এর সমস্যা অনেক-
– ১) মুহাম্মদ নিরক্ষর ছিলেন তার স্বপক্ষে নিশ্চিত হবার মত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। অনেকেই মনে করেন তিনি অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে সফলভাবে খাদিজার ব্যবসা পরিচালনা করেছেন যা তার দক্ষতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ।
– ২) কোরান রচনার জন্য অক্ষর জ্ঞান থাকতে হবে কেন? কোরান লেখার জন্য সব সময় কাতিবে ওহী বা ওহী লেখকরা প্রস্তুত ছিলেন।
– ৩) আমাদের দেশের বাউলদের কথা ধরেন। এদের প্রায় সবাই নিরক্ষর বা একেবারেই শিক্ষা-দীক্ষা নেই। কিন্তু লালন শাহ, আব্দুল করিম এঁরা এমন অনেক কিছু রচনা করে গেছেন যেগুলো কোরানের যেকোনো আয়াতের চেয়ে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ ও মানবিক।
– ৪) কোরান অতি এলোমেলো ভাবে সংকলিত হয়েছে। যা প্রথমে রচিত হয়েছে তা গেছে শেষে আবার যা শেষে তার অনেক কিছু প্রথম দিকে, এভাবে এলোমেলো ভাবে জোড়াতালি দেয়া এক অদ্ভুত গ্রন্থ এই কোরান। একে অসাধারণ বলার কোনো কারণ নেই।
– ৫) ধারণা করা যায় যে মুহাম্মদ তার মাথায় কোনো ভাবনা আসলে তিনি সর্বদা নিযুক্ত থাকা ওহী লেখকদের তা বলতেন আর ওরাই তা কাব্যে রুপ দিত। হয়ত ওহী লেখকদের বলতেন যে তিনি ওই ধারণা বা মত বা আদেশ আল্লার কাছ থেকে পেয়েছেন। পরবর্তীতে মানুষ মনে করতে লাগল যে কোরান যেভাবে তারা দেখতে পাচ্ছে অবিকল সেভাবেই আল্লা মুহাম্মদের কাছে তা নাজিল করেছেন।
৮। মুহাম্মদ এতই সৎ ছিলেন যে কাফিরেরা পর্যন্ত থাকে আল-আমিন বা বিশ্বাসী বলত। তার মত একজন মানুষ কোরান নিজে রচনা করে আল্লার নামে চালিয়ে দেয়ার মত প্রতারণা করতে পারেন না।

আসলে তথাকথিত এই সব নবি-রচুলদের নিয়ে সমস্যা বঠে। ওরা কে ছিলেন, কি রকম ছিলেন তা নির্ধারণ করা বেশ জটিল। মুহাম্মদকে নিয়ে আরো সমস্যার বিষয় হল তিনি মক্কা বিজয়ের পর সেখানে রাজার মতই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলেন। প্রকাশ্যে তার নিন্দা করার মত সাহস কারো ছিল না। এছাড়া যারাই মুহাম্মদের জীবন ইতিহাস লিখেছে ও সংরক্ষণ করেছে তারা সবাই মুসলমান ছিল অর্থাৎ মুহাম্মদকে আল্লা প্রেরিত রসুল বলে বিশ্বাস করত। (পরবর্তীতে মুসলিম-অমুসলিম সকলেই এই সব উৎসকে ব্যবহার করেই মুহাম্মদকে জেনেছে।) একজন মানুষ যিনি কাউকে নবী-রসুল বলে বিশ্বাস করেন তিনি কি পারবেন ওর জীবন ইতিহাস লিখতে? স্বাভাবিক ভাবেই তিনি যা লিখবেন তা হবে নবি-প্রশস্তি। আমরা দেখেছি মুহাম্মদের জন্মের সময়কালকে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বলে প্রচার করে মুহাম্মদের আগমনকে আবশ্যক ছিল বলে প্রচার করতে। আরো দেখেছি মুহাম্মদের নামে অনেক আজেবাজে কাহিনী প্রচার করতে যেমন মেরাজের ঘটনা, কেউ দেখেনি অথচ সকালে উঠে মুহাম্মদ বললেন বলেই তা বিশ্বাস যোগ্য হয়ে গেল? আমরা জেনেছি অনেকেই তা মেনে নেয় নি, অনেকেই হাসি-ঠাট্টা করেছে, অবিশ্বাস করেছে। আজো মানুষ প্রশ্ন তুলছে মুহাম্মদ যদি মেরাজে যাবেন তো সবার সামনে গেলে সমস্যা কি ছিল? কেন শুধু রাতের বেলাতেই আর গোপনে চুপিচুপি তিনি আল্লার সাথে কারবার করেন?
যাই হোক, যা বলতে চাচ্ছি- মুহাম্মদ যে একজন সৎ মানুষ ছিলেন আর কাফিররা পর্যন্ত তাকে আল-আমিন বা বিশ্বাসী বলত তা আমরা জানতে পারছি তার অনুসারীদের কাছ থেকে যারা নাকি তাকে নবি-রসুল বলে বিশ্বাস করে।
এছাড়া মুহাম্মদের সততা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোরান বা ইসলামের অভ্রান্ততা একটা অনিবার্য বিষয়- এটি সার্কুলার লজিকের মত একটা অবস্থার সৃষ্টি করে-“যেহেতু মুহাম্মদ সৎ ছিলেন সুতরাং কোরান আল্লার বাণী “ আবার, “যেহেতু কোরান আল্লার বাণী সুতরাং মুহাম্মদ সৎ ছিলেন”। তাই এর কোনো গুরুত্ব নেই। এছাড়া ২৫ বছর বয়সে খাদিজাকে বিয়ে করার পর মুহাম্মদের অর্থের অভাব ছিল না। নিন্দুকরা বলে, তিনি নবুয়তি দাবীর আগ পর্যন্ত খাদিজার অঢেল সম্পদ বসে বসে ভোগ করেছেন আর নবুয়তির স্বপ্নে দিন গুজরান করেছেন(খাদিজাকে বিয়ে করার পর থেকে তার আর কোনো পেশা ছিল বলে জানা যায় নি)।
মুহাম্মদ সৎ ছিলেন কিনা তা নিয়ে অনেক কিছুই বলা সম্ভব। এখানে শুধু কোরানের একটা আয়াত দেই-
“ইহারা আপনাকে গণিমতের মাল(যুদ্ধলব্ধ মালের) বিধান জিজ্ঞাসা করিতেছে, আপনি বলিয়া দিন এই গণিমতসমূহ আল্লাহর ও রসূলের। অতএব, আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের সংস্কার কর, আর আল্লাহ ও তার রসূলের আদেশ মানিয়া চল যদি তোমরা মুমিন হও”।(সূরা আনফাল,৮:আয়াত ১)
এখানে আল্লাহ তো মাল নিতে আসবেন না, তাহলে সব মাল কার হল?
নিজ (পালক)পুত্রবধূ জয়নবকে যে কৌশল অবলম্বন করে তিনি বিয়ে করেছেন তাকে সততা বলা সম্ভব নয়। মুহাম্মদ বিষয়টাকে এমন করে তুললেন যেন তার পালক পুত্র যায়েদ নিজেই তার স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় তালাক দিচ্ছে তার সাথে বিয়ে হওয়ার জন্য যদিও মুহাম্মদের ঘরে একাধিক স্ত্রী ছিল তখন। অথচ মুহাম্মদ যায়েদের স্ত্রীকে স্বামীর প্রতি সৎ থাকার জন্য আদেশ করতে পারতেন । কিন্তু তা না করে আয়াত নাজিল করিয়ে নিলেন যেখানে সরাসরি মুহাম্মদকে (যায়েদের স্ত্রী) জয়নবের সাথে বিয়ের বৈধতা দেয়া হচ্ছে। আয়াতটিতে বলা হয়েছে, পালক পুত্রের স্ত্রী বিয়ে করার ব্যাপারে মুসলমানদের যাতে কোনো সংকীর্ণতা না থাকে সে জন্যই নাকি জয়নবের স্ত্রীর সাথে মুহাম্মদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে( ভণ্ডামির সীমা নেই?)। আয়াতটি দেখি,
“অতঃপর জায়েদ যখন জয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে”। (সূরা আহযাব, ৩৩:৩৭)
এ আয়াত থেকে জানতে পারলাম, মুমিন-মুসলমানরা তদের পালক পুত্রের স্ত্রী বিয়ে করতে পারছে না তা আল্লার নিকট অনেক বড় সমস্যা!!
মোটকথা, মুহাম্মদ ব্যক্তিগত জীবনে খুব সৎ ছিলেন বলেই কোরান আল্লার বাণী এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় , কারণ
– ১) মুহাম্মদ সৎ ছিলেন তা নিরপেক্ষ উৎস থেকে যাচাই করা সম্ভব নয়।
– ২) মুহাম্মদের সততা আর কোরান আল্লার বাণী হওয়া ভিন্ন দুটি ব্যাপার। কেউ সৎ ছিলেন তার মানেই তিনি সব কাজেই সৎ ছিলেন তা না। আর মুহাম্মদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি হল ইসলাম প্রচার যার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন ২৩ বছর। এখন ইসলাম প্রচারের বিষয়টাকে বাদ দিয়ে তাকে সৎ বা অসৎ বলে প্রমাণ করে কি লাভ?
– ৩) তার জীবনে তিনি এমন অনেক কাজ করেছেন যেগুলোকে সততা বলা অসম্ভব।
– ৪) অনেকে মনে করেন মুহাম্মদের মানসিক বা মনোদৈহিক রোগ ছিল, তিনি প্রায়ই কল্পনা আর বাস্তবতার পার্থক্য্ বুঝতে অক্ষম হয়ে পরতেন। এখন মুহাম্মদ যদি অসচেতন ভাবে কোরানকে আল্লা কর্তৃক প্রেরিত বলে মনে করেন ও তা প্রচার করেন তবে অবশ্য ভিন্ন বিষয়।
– ৫) মুহাম্মদ নবুয়তির এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ রেখে যান নি যার জন্য আমরা আজো তাকে নবী বলে মেনে নেব অথচ তার নবুয়তীর প্রমাণের দায়িত্ব তার উপরই ছিল। কারো নবী হয়ে যাওয়ার দাবী নিঃসন্দেহে অতি হাস্যকর আর এরকম উদ্ভট একটা দাবীকে কেন আমরা মেনে নেব সততার দোহাই দিয়ে?
– ৬) ভিন্ন ধর্মের অনেকেই বিভিন্ন অশুভ সত্তা যেমন শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। এখন তাদের কেউ যদি কোরানকে শয়তানের বাণী বা ধোঁকা বলে দাবী করেন তবে এর প্রত্যুত্তরে কি বলা যেতে পারে যেখানে স্বয়ং কোরানও এরকম অশুভ সত্তার অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয়। অনেকেই বলে, কোরান শয়তানের বাণী এবং মুহাম্মদের সাথে শয়তান লেগেছিল এবং তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছিল, এরকম দাবী মুহাম্মদের সময়ও অনেকে করত।
– ৭) মুহাম্মদ যদি এতটা সৎ ছিলেন যে তার কথা বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়া যায় তবে তার সময় কালেই লোকেরা তাকে বিশ্বাস করে নি কেন? কেন অনেকে তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত? মুহাম্মদের সময়কালেই যেখানে লোকেরা তার নবুয়তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সেখানে আমরা মুহাম্মদের মৃত্যুর এতকাল পরে এসে কিভাবে তা বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করব?
৯। কোরান দুর্বোধ্য। আল্লার বাণী তো দুর্বোধ্য হবেই। এছাড়া কোরান অনুবাদ পড়ে বুঝা সম্ভব হয় না। আর এর ফলে মানুষ তা আল্লার কিতাব বলে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়।
আল্লা যদি মানুষের সাথে কোনো বিষয়ে কথা বলেন তবে নিশ্চয়ই তা মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলার দায়িত্ব তারই। কেননা মানুষ কি বুঝবে, আর কি বুঝবে না, কোন বিষয়টা কতটুকু বুঝবে তা আল্লা জানেন(কারণ তিনি সর্বজ্ঞ)। সুতরাং তিনি যদি মানুষকে এমন ভাষায় উপদেশ বা আদেশ দেন যা মানুষ বুঝতেই পারল না বা ভুল বুঝল তবে সে দোষ নিঃসন্দেহে আল্লারই এবং এ ধরণের কাজ আল্লার মহানত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। কোরানেও অনেক আয়াতে কোরানকে সহজ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কোরান দুর্বোধ্য এ দাবিটা তখনই শুনি যখন কেউ কোরান নিয়ে কোনো বিরুপ প্রশ্ন করে ফেলেন। আর ধর্ম-ব্যবসায়ী মোল্লারা চায় না মানুষ কোরান ভাল করে বুঝুক, তারা মানুষকে কোরান পাঠ শিক্ষা দিলেও আরবি ভাষাটা কাউকে শিখাতে চায় না কারণ এতে করে তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে।
আচ্ছা, কোরান দুর্বোধ্য, মানলাম কিন্তু তা কি সবার কাছেই দুর্বোধ্য? যিনি তা বুঝতে পারেন তিনি ব্যাখ্যা করে সকলকে বুঝিয়ে দিলেও সবাই কি তা বুঝবে না? আর যেটা বললাম, কোরানের দুর্বোধ্যতার জন্য কেউ যদি কোরান পড়ে এটা অনুধাবন করতে অক্ষম হয় যে কোরান আল্লার গ্রন্থ তবে তার দায় তো আল্লারই, তাই না?
অনেকে আবার দাবি তোলেন তাদের কোরান নাকি অনুবাদ পড়ে বুঝা সম্ভব না। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান মানুষ বিনিময় করেছে, অর্জন করেছে অনুবাদের সাহায্যে কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শোনা গেল না, শুধু কোরানের বেলায়ই যত বিপত্তি। আর মহা-সর্বজ্ঞ আল্লা এমনভাবে কেন কোরান নাজিল করবেন যে তা আর কোনো ভাষায় সঠিক অনুবাদ সম্ভব নয়! এখন শুধু কোরান বুঝার জন্যই নতুন একটা ভাষা শিখতে হবে! একটি ভাষা শিখা নিঃসন্দেহে একটা জটিল কাজ। এভাবে একেকটি ধর্ম যাচাই করার জন্য যদি শুধু একেকটা ভাষা শিখতে হয় তাহলে ভাষা শিখতে শিখতেই জীবন পার হয়ে যাবে। কোরান বুঝার জন্য যেমন আরবি শিখছি তেমনি বেদ বুঝার জন্য এবার সংস্কৃত শিখি, ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ বুঝার জন্য হিব্রু শিখি এভাবে চলুক।
আর কোরান যদি জ্ঞানের ভাণ্ডার হয় তাহলে তো যাদের মাতৃভাষা আরবি বা যারা আরবি জানে তারা আরবিতে কোরান পড়ে জ্ঞানের সেই ভাণ্ডার আত্মস্থ করে টাইটুম্বুর হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু আমরা কি তা দেখতে পাচ্ছি? আর কোরানের অনুবাদ পড়ে কোরান ঠিকমত বুঝা হয় নি যারা দাবী করেন তারা কি অন্য ধর্মগুলোকে যাচাই করেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন? আর যাচাই করতে গিয়ে ঐসব ধর্মগ্রন্থ মূল ভাষায় পড়েছেন নাকি অনুবাদ পড়েছেন? অবশ্য আদৌ কিছু যাচাই-বাছাই না করে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া ইমান নিয়ে লম্ফ-ঝম্প করলে ভিন্ন কথা।
আমরা দেখেছি আরবি ভাষাভাষি বা আরবি ভাষা জানে এমন অনেক অমুসলিম আছে। মুহাম্মদের সময় তার প্রতিবেশিরা নিশ্চয় আরবি জানত বা অন্তত কোরান বুঝত। তাবে তাদের কাছে কোরানকে আল্লার বাণী বলে মনে হয় নি কেন? তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি কোরানে এমন কোনো গুণ নেই যে কোরান বুঝলেই মনে হবে তা আল্লার প্রেরিত গ্রন্থ।
কোরানে অনেকগুলো আয়াতে কোরানকে সহজ-সরল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
নিশ্চয় আমি এ কোরানকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। (৪৪, সূরা দুখান:আয়াত ৫৮)
আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে। (১৪, সূরা ইব্রাহিম:আয়াত ৪)
নিশ্চয় আমি কোরানকে আরবি ভাষায় নাজিল করেছি, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পার। (১২, সূরা ইউসুফ:আয়াত ২)
আমি কোরানকে আপনার ভাষায় এই জন্য সহজবোধ্য করিয়াছি যেন আপনি উহার সাহায্যে খোদাভীরুগণকে সুসংবাদ দিতে পারেন। (১৯, সূরা মারইয়ামঃ ৯৭)
আর আমি সহজ করিয়া দিয়াছি কোরানকে উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব, কেহ উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি। (৫৪, সূরা ক্বামারঃ আয়াত ১৭)
এরপর আর কোরানকে দুর্বোধ্য, অনুবাদ পড়ে বুঝা সম্ভব নয় ইত্যাদি বলা কি চলে?
১০। কোরানের সাংখ্যিক মাহাত্ম রয়েছে। সুতরাং কোরান অলৌকিক গ্রন্থ।
এই অভিনব দাবীর জবাব এখানে দেয়া হয়েছে- কোরানের ‘মিরাকল ১৯’-এর উনিশ-বিশ! । তাই নতুন করে আর কিছু না বলে এই লেখাটা একটু পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।
আরেকটি প্রাসঙ্গিক লেখা পড়ার জন্য সকলকে অনুরোধ- আল্লাহ, মুহম্মদ সা এবং আল-কোরআন বিষয়ক কিছু আলোচনার জবাবে..