Thursday, August 24, 2017

বিজ্ঞানের আর্শিবাদ।


কেন যেন মনে হয় বিজ্ঞান দিন দিন এক স্বভোজী ভাইরাসের রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। খুব বেশী দেরি নেই। প্রতিটা রূপ বদলই কি এক একটা ধ্বংস নয় ? যা আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও ধ্বংসের মানে নতুন নতুন রূপ বদলের দিকে। চাকা থেকে গাড়িতে আসতে মানব জাতির সময় লেগেছে হাজার হাজার বছর। কিন্তু গাড়ি থেকে স্পেস ক্রাফট মাত্র এক শতাব্দী। আর আমরা এখন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হিসাব করছি প্রতি সপ্তাহে। পুরো পাশার ছক উল্টে যাচ্ছে প্রতিটা মিনিটে। আর পলকে পলকে নতুনত্ব এসে আমাদের আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। আমরা ঘুরছি নিয়ন্ত্রনহীনভাবে। আমাদের অগ্রগতি হচ্ছে ক্রমেই, আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি শুধু আমাদেরকে, অন্য কিছু নয়। আত্নকেন্দ্রিকতা ঘনিভুত হচ্ছে; আদর্শহীনতায় পড়েগিয়ে আমরা হয়ে পড়ছি অস্থির, অতৃপ্ত। অর্জন বলতে শুধুই শূণ্যতা। আমাদের হাহাকার অর্থের জন্য। আমরা ইউএফও দেখি, আটকে যাই টিভি চ্যানেলের ফাঁকে, আত্নিক সম্পর্ক টের পেয়ে ভীত চোখে তাকাই, যেন অশরীরীর দেখা পেয়ে ভড়কে যাই। আমরা আজ আমাদের মনের গভীরে জেগে ওঠা প্রশ্নগুলো দেখে আঁতকে উঠি। এসব ব্যাপারগুলোর কোন না কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। আর সত্যি বলতে সেসব ব্যাখ্যাই নির্লজ্জভাবে আমাদের সামনে আরো রহস্যের দুয়ার খুলে দেয়।

 যে টেকনোলজির দ্বারা আমরা এক মুহুর্তেই পৃথিবীর সাথে এক সুরে আবদ্ধ হই ইচ্ছা হলেই, তা ই আমাদের সবথেকে একলা করে দিয়েছে। আজ আমরা বোমার মুখে পড়ে যাই প্রতিহিংসায়, জিঘাংসায়, বিভক্তিতে, নেঈমানিতে। আজকের দিনে আমরা মানুষেরা সবথেকে বেশী একা, সবথেকে বেশী হিংস্র, সবথেকে বেশী অসহায়, সবথেকে বেশী নিকৃষ্ট। মানব ইতিহাসে এমন চরম বিন্দুতে মানুষ আর কখনও দাড়ায়নি।

 বিজ্ঞান শুধু উত্তর খুঁজে যায়, ছিড়ে-খুড়ে জানতে চেষ্টা করে সবটা। আমাদের সমস্ত রহস্যের আধার ডিএনএ কেও তন্য তন্য করে আবার আমাদের সৃষ্টি করার চেষ্টা করে বিজ্ঞান। অর্থ খোঁজার ধাঁধায় পরে সৃষ্টিকর্তার রহস্যগুলোকে আরও অযুত নিযুত ভাগে বিভক্ত করে আমরা শুধুই খুঁজে বেড়াচ্ছি জবাব। আর এত প্রাপ্তি আমাদের শুধুই অপ্রাপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যা আমরা ফেরত পাচ্ছি তার নাম আরও আরও প্রশ্ন। আমাদের ভিতর সবসময়, অহর্নিশি, অষ্টপ্রহর যে ভাবনা গুম্রে মরে সেটার নাম একাকীত্ব আর অসহায়ত্ব। আধুনিক নিঃসঙ্গতা থেকে, টেকনোলজির হাত থেকে, সব পাওয়া জগতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা।

 মেডিসিন, ইলেক্ট্রনিক কমুনিকেশন, স্পেস ট্রাভেল, জেনেটিক ম্যানিপুলেশন ইত্যাদি ইত্যাদি এ গুলোই আজকের দিনের মিরাকল। এই জাদুর কথাই আমরা আমাদের সন্তানদের বলি। এ রহস্যগুলো নিয়েই আমরা মেতে উঠি, তেতে উঠি এবং বিজ্ঞান এসবের সঠিক জবাব বের করে দেয়। আদ্যিকালের যত মিথ, লোককথা, কাহিনি, জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কথা, নীল নদ বিভক্ত হওয়া বা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন আর প্রমাণিত সত্য নয়।

 বিজ্ঞান হয়ত আমাদের জীবনের সকল রহস্যের দ্বার খুলে দিয়েছে, রক্ষা করেছে আমাদের দুরারোগ্য সব অসুখের হাত থেকে, দূর করে দিয়েছে জ্বরা, কিন্তু একই সাথে আমাদের জীবনকে করে তুলেছে রহস্যহীন, একঘেয়ে। পুরো সৃষ্টিজগতের সমস্ত জটিলতা রহিত করে দেয়া হয়েছে এক একটি ছোট্ট ইকুয়েশনে। এমনকি আমাদের মানব হয়ে থাকার অপরূপতাও মুহুর্তে ম্লান হয়ে যায় কঠিন বৈজ্ঞানিক তথ্যের সামনে। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটায় প্রানের উন্মেষ একটা নিছক দূর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

 রক্ষক আজ ভক্ষক হয়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের। একবার নিজেদের চারপাশে দৃষ্টি রাখুন, চোখ মেলে তাকান চারদিকে- অজেয় বিজ্ঞান তার কথা রাখেনি। সারল্যের ছলনায় আমাদের দিয়েছে সে অসহ্য জটিলতা। অবিরাম সমস্যা উঠে আসছে আমাদের ঘাড়ে। আমরা আজ ভেঙ্গে পড়া বিনষ্ট প্রজাতি। ধ্বংসের অন্ধকূপে পতিত গোটা মানব প্রজাতি।

 বিজ্ঞান এমন এক পিতা যে তার সন্তানের হাতে আগুন তুলে দেয় কিন্তু, বলেন না কি করে সেটাকে ব্যবহার করতে হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় ভালো আর মন্দ বলে কিছুই নেই। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন বিজ্ঞানের ঐশ্বরিকতা। কিন্তু কি করে সেটা কল্যাণের পথে চালিত করতে হবে তা থাকেনা বিজ্ঞানের বইতে।

 ধর্মও আজ আর শাসন করেনা বিজ্ঞানকে। কারণ তাতে করে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, জঙ্গি নানান তীর বিঁধতে থাকে গায়ে। কারণ জগত এখন শুঁয়োপোকার স্তর ছেড়ে প্রজাপতির পাখা মেলেছে বিবর্তনের ধারায়। কারণ এ জগত এখন এত দ্রুত ঘুরছে যে একটা, মাত্র একটা মুহুর্তের জন্যও পিছনে ফেরার সময় নেই; ভাবার বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নেই। তা করতে গেলেই, আপনার চেয়ে বেশী গতির কেউ আপনার ঝান্ডাটা তুলে নিয়ে যাবে ব্যাস ! তাই আমরা অহর্নিশি ছুটে চলেছি অবিরাম গতিতে ! কিন্তু ধর্ম সেটাই যা কিনা আপনাকে আপনার রাশ টেনে ধরতে বলে, আপনার কৃত কাজের দিকে ফিরে তাকাতে বলে, আপনার তৈরী করা আরও আরও ব্যাপক ধ্বংসাত্বক অস্ত্রের মুখে লাগাম দিতে বলে। যখন আপনি নিজেকে ভাবেন আধুনিক সভ্যতার অভিন্ন একক হিসেবে, ধর্ম আপনাকে বলে আপনি আলাদা একজন মানুষ এবং আপনার কর্মফল সম্পর্কে আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। গবেষণার নামে বিজ্ঞান যখন পৃথিবীর আলো না দেখা একটা শিশুর ভ্রূণ নষ্ট করে, ধর্ম বলে তারও একটা আলাদা অধিকার ছিল। বিজ্ঞান বলে ধর্ম কুসংস্কার, ধর্ম অবজ্ঞার পাত্র। কে বেশী অবজ্ঞার যে লোকটা বজ্রপাতের আলোকে দেখতে পায়না, নাকি সে ব্যক্তি যে অত্যুজ্বল ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করতে জানেনা ?
ধর্ম যতই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে আপনাকে-আমাকে একটু স্বস্তি দিতে ততই আমরা তাকে অবজ্ঞাভরে দূরে ঠেলে দেই। বলি একটা প্রমাণ দেখাও যে সৃষ্টিকর্তা আছেন। বিজ্ঞান কি তার আকাশ ছত্রখান করা অতিকায় টেলিস্কোপ দিয়ে স্বর্গভেদ করে দেখাতে পেরেছে যে সৃষ্টিকর্তা নেই ? তারপরও আমরা বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করি কারণ বিজ্ঞান একটা পরমাণুর ভিতর উঁকি দিয়ে বলতে পারে সৃষ্টি জগত আসলে নিষ্প্রাণ একটা ধোঁয়াশা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে কোথায় তার প্রানসাগর ? এই স্তম্ভিত করে দেওয়া ব্যাপারটার ভিতর সৃষ্টিকর্তার হাতের কাজ আমরা দেখতে কি পাইনা ? টের পাইনা তার অজেয় মূর্তিমান উপস্থিতি। ধর্মে তাই ক্ষয় শুরু হয়ে গেছে। অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়। আজ ধর্ম হাল্কা হয়ে গেছে তার একমাত্র কারণ মানবজাতি হাল্কা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে পল্কা। আমরা এতটা সংকির্ণমনা কি করে হই যে কিছু গাণিতিক হিসেবের বেড়াজাল তৈরী করে দিয়ে ভেবে আপ্লুত হই যে আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোন অস্তিত্ব নেই ? এতটাই সংকির্ণ যে মেনে নিতে জানিনা যে আমাদের চেয়েও ক্ষমতাবান কেউ থাকতে পারে।
আপনি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন বা না করেন, এটা আপনাকে মানতেই হবে যে যখন আমরা প্রজাতি হিসেবে আমাদের থেকে শ্রেয়তর কোন শক্তির উপস্থিতি অস্বীকার করি, আমরা আমাদের হিসেব করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলি আত্নগরিমায়। হয়ে পড়ি একচোখা দানব যে কিনা নিজেকেই সবথেকে বড় বলে জানে। সকল বিশ্বাসই একটা কথা জোর দিয়ে বলে, আমরা জানতে পারিনা, বুঝতে পারিনা এমন একটা স্বত্বার অস্তিত্ব ঠিক ঠিক আছে। আমরা সবাই গণ্য, একে অন্যের কাছে গণ্য, গণ্য উচ্চতর বিশ্বাসের কাছে।
সত্যি সত্যি কি এই পৃথিবীর প্রয়োজন আছে এমন কোন কন্ঠের বা প্রতিষ্ঠানের যা দরিদ্রের প্রতিনিধি হবে; দূর্বল, প্রতারিত এমনকি জন্ম না নেওয়া শিশুর পক্ষে কণ্ঠ মিলিয়ে শোর তুলবে ? বলবে সত্যিকারের মানবতার কথা ? এমন কোন মানুষের কি আদৌ প্রয়োজন আছে যারা আধুনিকতায় দক্ষ না হলেও তাদের জীবনটা উৎসর্গ করবে মানুষকে নৈতিকতার সাইনবোর্ড দেখানোর কাজে ? মূল পথ অনুসরণ করার কাজে ?
শয়তান তার পাখা বিস্তার করেছে। বাড়িয়ে চলেছে তার শক্তি। অন্ধকারের শক্তি ! আর সেটা করতে ব্যবহার করেছে মানুষের সব থেকে বড় বন্ধু জ্ঞানকে। এটা মোটেও হেলা করার কোন বিষয় নয়। তবে সে শক্তি যতই শক্তিমান হোকনা কেন অজেয় নয়। শুভশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই। ধ্বংসস্তুপের ভিতর থেকে নতুনরূপে আবির্ভূত হবেই সে শক্তি . . .