Friday, August 25, 2017

কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৮,৯,১০,১১,১২

কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৮ 
[সব পর্বের তালিকা ও লিংক পাবেন এখানে]


অষ্টম অধায়ঃ বিগ ব্যাং, ব্ল্যাক হোল এবং মহাবিশ্বের বিবর্তন
ফ্রিডম্যানের প্রথম মডেলে (যেখানে বলা ছিল মহাবিশ্ব আবার গুটিয়ে যাবে) স্থানের মতোই চতুর্থ মাত্রা সময়ও সসীম। এটা এমন একটি রেখার মতো, যার দুদিকে দুটি প্রান্ত বা সীমানা আছে। অতএব, সময়ের একটি সমাপ্তি আছে, আবার শুরুও আছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা মহাবিশ্বে যে পরিমাণ বস্তু দেখি তা সম্পর্কে আইনস্টাইনের সমীকরণের যে সমাধানগুলো আছে, তার সবকয়টির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। তা হল, অতীতের কোনো এক সময়ে (১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে) পাশ্ববর্তী গ্যালাক্সিদের মাঝে কোনো দূরত্ব ছিল না। অন্য কথায়, শূন্য ব্যাসার্ধের একটি গোলকের মতো পুরো মহাবিশ্ব জিরো সাইজের একটিমাত্র বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। সেই সময় মহাবিশ্বের ঘনত্ব এবং স্থান-কালের বক্রতা ছিল অসীম। এই সময়কেই আমরা বলি বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণ।
কসমোলজি (মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিবর্তন বিষয়ক বিদ্যা) নিয়ে আমাদের যতগুলো তত্ত্ব আছে তাদের প্রত্যেকটিতেই স্থান-কালকে মসৃণ ও প্রায় সমতল ধরে নেওয়া হয়। এর ফলে আমাদের সবগুলো তত্ত্ব বিগ ব্যাং পর্যন্ত গিয়ে অকেজো হয়ে পড়ে। অসীম বক্রতার কোনো স্থান- কালকে কী করে ‘প্রায় সমতল’ বলা যেতে পারে! এর ফলে বিগ ব্যাং এর আগে যদি কোনো কিছু থেকেও থাকে, আমরা সেটা কাজে লাগিয়ে বলতে পারব না যে তারপর কী ঘটবে? কেননা অনুমান করার ক্ষমতা বিগ ব্যাং পর্যন্ত এসেই শেষ।
একইভাবে, যদি (এবং বাস্তবে তাই) আমরা যদি শুধু বিগ ব্যাং এর পরের ঘটনা জানি, তবে তা কাজে লাগিয়ে এর আগের কিছু আমরা জানত পারব না। বিগ ব্যাং এর আগের কোনো ঘটনা মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার মতো কোনো বৈজ্ঞানিক মডেলের অংশ হতে বা এরকম কোনো মডেলের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাই এই ধরনের তথ্যকে মডেল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলতে হবে সময়ের শুরুই হয়েছে বিগ ব্যাং থেকে। তাই বিগ ব্যাং ঘটার জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ কে তৈরি করেছে তা বিজ্ঞানের দেখার বিষয় নয়।
মহাবিশ্বের আকার শূন্য হলে সেই সময় এর তাপমাত্রাও অসীম হবার কথা। তাই মনে করা হয় বিগ ব্যাং এর সময় মহাবিশ্ব ছিল অসীম পরিমাণ উত্তপ্ত। প্রসারণের সাথে সাথে বিকিরণের তাপমাত্রা কমে আসে। সহজ কথায় বললে, তাপমাত্রা হল কণার গড় শক্তি বা গতি। তাই তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় বস্তুর উপর তার শক্ত প্রভাব পড়ে। উচ্চ তাপমাত্রায় কণাগুলো এত জোরে ছোটাছুটি করতে থাকে যে এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল নিউক্লিয়ার বা তড়িচ্চুম্বকীয় বলকেও এরা পাত্তা দেয় না। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, তাপমাত্রা কমে গেলে এরা একে অপরের দিকে আকর্ষণ অনুভব করে জড় হতে শুরু করবে। মহাবিশ্বে কী কী ধরনের কণিকা থাকবে তাও নির্ভর করে তাপমাত্রা ওপর এবং একই কারণে মহাবিশ্বের বয়সেরও ওপর।
এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন না যে, বস্তু বিভিন্ন কণিকা দিয়ে গঠিত। তিনি মনে করতেন, বস্তুকে যত ইচ্ছা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা যায়। কখনও পদার্থের এমন কোনো কণা পাওয়া যাবে না যাকে আর কোনোভাবে ভাগ করা যাবে না। ডেমোক্রিটাসসহ কয়েকজন গ্রিকের বিশ্বাস ছিল উল্টো। তাঁদের মতে, এক একটি বস্তু অনেকগুলো বিভিন্ন প্রকারের পরমাণু (atom) দ্বারা গঠিত (গ্রিক ভাষায় atom শব্দের অর্থ indivisible বা অবিভাজ্য)। এখন আমরা জানি যে এটাই সঠিক, অন্তত আমাদের পরিবেশে এবং মহাবিশ্বের বর্তমানে পরিস্থিতিতে)। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বের পরমাণুরা সব সময় ছিল না। এরা অবিভাজ্য নয়। মহাবিশ্বের সব রকম কণিকার মধ্যে এদের পরিমাণ একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ।
পরমাণুরা আরও ছোট কণিকা দ্বারা গঠিত। এগুলো হল ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। প্রোটন ও নিউট্রন নিজেরা আবার আরও ছোট কণিকা দ্বারা গঠিত। এদের নাম কোয়ার্ক। এদিকে আবার প্রতিটি কণিকার বিপরীতে আছে প্রতিকণিকা (antiparticle)। এই প্রতিকণিকাদের ভর এদের যমজ কণিকাদের সমান। কিন্তু এদের আধান (চার্জ) ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিপরীত। যেমন, ইলেকট্রনের প্রতিকণিকা হল পজিট্রন। এর চার্জ হল ইল্কেট্রনের বিপরীত, মানে পজিটিভ। প্রতিকণিকায় তৈরি একটি পুরো প্রতিজগৎ (antiworld) এবং প্রতিমানব (antipeople) উপস্থিত থাকতে পারে। তবে একটি কণিকা ও তার প্রতিকণিকার সাক্ষাৎ হলে এরা একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়। অতএব, আপনার প্রতিমানবের সাথে দেখা হয়ে গেলে হাত মেলাতে যাবেন না যেন! এক ঝলক আলো উদ্গীরণ করে দুজনেই হাওয়া হয়ে যাবেন!
আলোক শক্তিও আসলে আরেকটি কণিকারই একটি রূপ। এটি হল ভরহীন কণিকা ফোটন। পৃথিবীতে প্রাপ্ত ফোটনের সবচেয়ে বড় উৎস হল আমাদের পাশে অবস্থিত সূর্য, যা একটি বিশাল নিউক্লিয়ার চুল্লি। সূর্য আরেক ধরনের কণিকারও একটি বড় উৎস। এটা হল আগে উল্লিখিত নিউট্রিনো (এবং অ্যান্টিনিউট্রিনো)। কিন্তু খুব হালকা এই কণিকারা বস্তুর সাথে ক্রিয়া করে না বললেই চলে। এর ফলে এরা নির্বিঘ্নে আমাদেরকে ভেদ করে চলে যায়, তাও প্রতি সেকেন্ডে বিলিয়ন বিলিয়ন হারে। পদার্থবিদরা এই ধরনের ডজন ডজন মৌলিক কণিকা আবিষ্কার করেছেন। সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্ব জটিল বিবর্তন প্রক্রিয়ায় অতিক্রম করার সময় এই কণিকার ভাণ্ডারও বিবর্তিত হয়েছে। কণিকাদের এই বিবর্তনের ফলেই পৃথিবীর মতো গ্রহ এবং আমাদের জীবদের অস্তিত্ত্ব তৈরি হতে পেরেছে।
বিগ ব্যাং এর এক সেকেন্ড পর মহাবিশ্বের প্রসারণ এতটা বেশি হয়েছিল যে এর তাপমাত্রা কমে প্রায় দশ বিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। এই তাপমাত্রা সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রার দশ গুণ। কিন্তু হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণে এত বেশি পরিমাণ তাপমাত্রাও উৎপন্ন হওয়া সম্ভব। এই সময় মহাবিশ্বে প্রধানত ফোটন (প্রোটনের কথা বলছি না), ইলেকট্রন এবং নিউট্রিনো ও তাদের প্রতিকণিকারা ছিল। এর সাথে ছিল কিছু প্রোটন ও নিউট্রন। এ সময় এই কণিকাদের এত বেশি শক্তি ছিল যে এরা মিলিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের বহু কণিকা ও প্রতিকণিকা তৈরি করে। যেমন, ফোটনদের সংঘর্ষে ইলেকট্রন ও এর প্রতিকণিকা পজিট্রন তৈরি হতে পারে। নতুন সৃষ্ট এই কণিকাদের কেউ কেউ এদের প্রতিকণিকার সাথে মিলিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। একটি ইলেকট্রনের সাথে পজিট্রনের দেখা হলে দুজনেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু উল্টোটা ঘটা এত সহজ কথা নয়। ফোটনদের মতো দুটো ভরহীন কণিকা থেকে ইলেকট্রন ও পজিট্রনের মতো একটি কণিকা ও প্রতিকণিকার জোড় সৃষ্টি হতে হলে মিলিত হওয়া ভরহীন কণিকাদের একটি ন্যূনতম শক্তি থাকা প্রয়োজন। এর কারণ হচ্ছে ইলেকট্রন ও পজিট্রনের ভর আছে। আর এই নতুন ভর আসতে হবে সংঘর্ষে লিপ্ত কণিকাদের শক্তি থেকেই। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হলে এবং এর তাপমাত্রা কমে গেলে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণিকাদের সংঘর্ষে যে হারে ইলেকট্রন-পজিট্রন জোড়া তৈরি হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি হারে এরা ধ্বংস হচ্ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ইলেকট্রন ও পজিট্রনই একে অপরকে ধ্বংস করে আরও বেশি ফোটন তৈরি করে। এর ফলে সামান্য কিছু ইলেকট্রন বাকি থাকে। অন্য দিকে নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনোরা নিজেদের সাথে এবং অন্য কণিকাদের সাথেও খুব দুর্বলভাবে ক্রিয়া করে। ফলে এরা এতটা দ্রুত একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে না। আজও এদের উপস্থিতি থাকতে পারে। আমরা যদি এদের দেখতে পাই তবে  মহাবিশ্বের প্রাথমিক উত্তপ্ত অবস্থার ভালো একটি চিত্র পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হল, বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পর আজ তাদের শক্তি এত কমে গেছে যে আমরা তাদেরকে সরাসরি দেখতে পাব না (পরোক্ষভাবে খুঁজে পারার সম্ভাবনা আছে যদিও)।
চিত্রঃ ফোটন/ ইলেকট্রন/ পজিট্রন সাম্য। [আদি মহাবিশ্বে ইলেকট্রন ও পজিট্রনের মিলনে ফোটন তৈরি ও উল্টো প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি ভারসাম্য ছিল। তাপমাত্র কমে গেলে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বেশি বেশি ফোটন তৈরি হওয়া শুরু হয়। শেষে মহাবিশ্বের বেশির ভাগ ইলেকট্রন ও পজিট্রন একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আজকে উপস্থিত সামান্য কিছু ইলেকট্রনই বাকি থাকে।]
চিত্রঃ ফোটন/ ইলেকট্রন/ পজিট্রন সাম্য। [আদি মহাবিশ্বে ইলেকট্রন ও পজিট্রনের মিলনে ফোটন তৈরি ও উল্টো প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি ভারসাম্য ছিল। তাপমাত্র কমে গেলে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বেশি বেশি ফোটন তৈরি হওয়া শুরু হয়। শেষে মহাবিশ্বের বেশির ভাগ ইলেকট্রন ও পজিট্রন একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আজকে উপস্থিত সামান্য কিছু ইলেকট্রনই বাকি থাকে।]
 বিগ ব্যাং এর প্রায় একশ সেকেন্ড পরে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমে এক বিলিয়ন ডিগ্রিতে নেমে আসে। সবচেয়ে উত্তপ্ত নক্ষত্রদের অভ্যন্তরেও এই তাপমাত্রা থাকে। এ তাপমাত্রায় সবল বল (strong force) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সবল বল নিয়ে একাদশ অধ্যায়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব। এটি স্বল্প পাল্লার একটি আকর্ষণী বল। এর প্রভাবে প্রোটন ও নিউট্রন একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে নিউক্লিয়াস (পরমাণুর কেন্দ্র) গঠন করে। যথেষ্ট উচ্চ তাপমাত্রায় প্রোটন ও নিউট্রনের গতি শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে পৌঁছায় (দেখুন পঞ্চম অধ্যায়)। এর ফলে এরা এদের সংঘর্ষ থেকে মুক্ত ও স্বতন্ত্রভাবে বের হয়ে আসতে পারে। কিন্তু এক বিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রায় এরা সবল বলের আকর্ষণকে ফাঁকি দিতে পারে না। এর ফলে এরা যুক্ত হয়ে ডিউটেরিয়াম পরমাণুর (ভারী হাইড্রোজেন) নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এতে একটি করে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে। পরে ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াস আরও প্রোটন ও নিউট্রনের সাথে যুক্ত হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। এতে থাকে দুটি করে প্রোটন ও নিউট্রন। এর সাথে লিথিয়াম ও বেরিলিয়ামের মতো অল্প কিছু অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলও তৈরি হয়। হিসাব করলে দেখা যাবে, উত্তপ্ত বিগ ব্যাং মডেলে প্রোটন ও নিউট্রনের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়।  অল্প কিছু পরিণত হয় ভারী হাইড্রোজেন ও অন্যান্য মৌলে। বাকি নিউট্রন ক্ষয় হয়ে প্রোটনে পরিণত হয়। আর প্রোটনই হল সাধারণ হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস। মহাবিশ্বের আদি উত্তপ্ত অবস্থার এই চিত্র প্রথম তুলে ধরেন বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো। ১৯৪৮ সালে তিনি তাঁর এক ছাত্র র‍্যালফ আলফারের সাথে যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্রে এটি প্রকাশ করেন। গ্যামোর মধ্যে রসবোধের কোনো কমতি ছিল না। তিনি তাঁর বন্ধু ও নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী হ্যান্স বেথেকে রাজি করিয়ে গবেষণাপত্রের লেখক তালিকায় তাঁর নামও যুক্ত করে দেন। এতে করে আলফার, বেথে, গ্যামো- এই তিনটি নাম দেখতে গ্রিক বর্ণমালার প্রথম তিনটি অক্ষর আলফা, বিটা, ও গামা এর মতো হল। এদিকে আবার মহাবিশ্বের শুরু সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্রে এমন নাম থাকাটাও একেবারেই সার্থক। এই গবেষণাপত্রে তাঁরা একটি উল্লেখযোগ্য পূর্বাভাস প্রদান করেন। মহাবিশ্বের আদি উত্তপ্ত দশাসমূহের বিকিরণ (ফোটন এর আকৃতিতে) আজও উপস্থিত থাকা উচিৎ। তবে তার তাপমাত্রা হবে পরম শূন্য তাপমাত্রার মাত্র কয়েক ডিগ্রি ওপরে (পরম শূন্য বা মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হল সম্ভাব্য সবচেয়ে নিম্ন তাপমাত্রা। এ তাপমাত্রায় বস্তুতে কোনো তাপ শক্তি থাকে না)।
১৯৬৫ সালে পেনজিয়াস ও উইলসন এই মাইক্রোওয়েভ বিকিরণই খুঁজে পেয়েছিলেন। আলফার, বেথে ও গ্যামো যখন তাঁদের গবেষণাপত্র লেখেন, সেই সময় প্রোটন ও নিউট্রনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সম্পর্কে খুব বেশি জানা ছিল না। ফলে আদি মহাবিশ্বের বিভিন্ন মৌলের অনুপাত সম্পর্কে করা অনুমানে কিছুটা ভুল ছিল। কিন্তু আধুনিক জ্ঞানের আলোকে এই হিসাবগুলো বারবার করার পর বর্তমানে তা সাথে পর্যবেক্ষণ মিলে গেছে। তবুও মহাবিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ ভর কেন হিলিয়াম হয়ে আছে তা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন।
কিন্তু এই চিত্রেও কিছু সমস্যা আছে। বিগ ব্যাং মডেল অনুসারে আদি মহাবিশ্বের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে তাপ প্রবাহিত হবার মতো যথেষ্ট সময় ছিল না। এর অর্থ হল, মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থায় সব দিকে ঠিক একই পরিমাণ তাপমাত্রা থাকবে। তা না হলে আমরা যে কোনো দিকে তাকিয়ে মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণকে একই তাপমাত্রায় দেখতে পেতাম না। উপরন্তু প্রাথমিক অবস্থায় প্রসারণের হারকেও হতে হয়েছিল খুব নিখুঁত। না হলে আবার শুরু হয়ে যেত সঙ্কোচন। মহাবিশ্ব ঠিক এভাবেই কেন শুরু হল তার ব্যাখা পাওয়া কঠিন। হতে পারে ঈশ্বর আমাদেরকে সৃষ্টি করার জন্যে এ কাজ করেছেন। বর্তমান মহাবিশ্বের মতো কিছু তৈরি হবার মতো অনেকগুলো আলাদা প্রাথমিক অবস্থা নিয়ে একজন বিজ্ঞানী একটি মডেল তৈরির চেষ্টা করেছেন। ইনি হলেন এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) বিজ্ঞানী অ্যালান গুথ। তিনি প্রস্তাব করলেন, প্রাথমিক অবস্থায় মহাবিশ্ব সম্ভবত কিছু সময় ধরে খুব দ্রুত গতিতে প্রসারিত হয়েছিল। এই ধরনের প্রসারণকে বলা হয় স্ফীতি। অর্থ্যাৎ, এ সময় প্রসারণের হার ক্রমশ বাড়ছিল। গুথের মতে, সেই সময় এক সেকন্ডের ক্ষুদ্র একটি ভগাংশ সময়ের মধ্যে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ একশ কোটি কোটি কোটি কোটি (এক এর পরে ৩০ টি শূন্য) গুণ বেড়ে যায়। এই তীব্র প্রসারণের ফলে যে কোনো বিষমতা (একেক দিকে একেক রকম থাকা) উধাও হয়ে যাবার কথা। যেমন আপনি যদি একটি বেলুনকে ফুলিয়ে বড় করেন, তাহলে এর ভাঁজগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। এ কারণে আদি মহাবিশ্বের অনেকগুলো আলাদা বিষম অবস্থা থেকে কীভাবে বর্তমান মসৃণ ও সুষম (সব দিকে একই রকম) মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে স্ফীতির মাধ্যমে তার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। এ কারণে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে আমরা বিগ ব্যাং ঘটার এক সেকেন্ডের এক বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন (এক এর পরে ৩৩ টি শূন্য) ভাগের এক ভাগ পরের সময়ের সঠিক চিত্রও বুঝতে পেরেছি।
প্রাথমিক সময়ের এতসব অস্থির কাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হিলিয়াম এবং লিথিয়ামের মতো অন্য কিছু মৌলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্রায় কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে মহাবিশ্বের প্রসারণ অব্যাহত থাকে, এ সময়ের মধ্যে বড় তেমন কিছু ঘটেনি। এরপর তাপমাত্রা নেমে হয় কয়েক হাজার ডিগ্রি। এবারে ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াস (যেখানে প্রোটন ও ইলেকট্রন থাকে) একে অপরের প্রতি ক্রিয়াশীল তড়িচ্চুম্বকীয় আকর্ষণকে আর এড়িয়ে যেতে পারে না। এরা মিলিত হয়ে গঠন করে পরমাণু। সামগ্রিকভাগে মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়া অব্যাহতই রেখেছিল, ক্রমশ ঠাণ্ডাও হচ্ছিল। কিন্তু যে অঞ্চলের ঘনত্ব গড় ঘনত্বের চেয়ে কিছুটা বেশি তাতে মহাকর্ষের ফলে প্রসারণে কিছুটা ভাটা পড়ে।
কিছু অঞ্চলে শেষ পর্যন্ত প্রসারণ থেমেই গেল। এটি এর পর গুটিয়ে যেতে থাকবে। গুটিয়ে যাবার সময়  বাইরের অঞ্চলের মহাকর্ষীয় টানের প্রভাবে এটি কিছুটা আবর্তিত হতে শুরু করে। এই গুটিয়ে যাওয়া অঞ্চল আরও ছোট হয়ে গেলে এর ঘুর্ণন প্রবণতা বেড়ে যায়। যেমন, বরফের উপর স্কেটিং করার সময় হাতের বাহুকে ভেতরের দিকে গুটিয়ে নিলে বেশি জোরে ঘোরা যায়। শেষে এই অঞ্চল যথেষ্ট ছোট্ট হয়ে গেলে এটি এত জোরে ঘুরতে থাকে যে তা মহাকর্ষীয় টানের সাথে ভারসাম্য করতে সক্ষম হয়। এভাবেই চাকতির মতো ঘূর্ণনশীল গ্যালাক্সিদের জন্ম হয়। যে অঞ্চলে ঘূর্ণন ছিল না, তা রূপ নেয় উপবৃত্তাকার গ্যালক্সিতে। এ অঞ্চলে সঙ্কোচন থেমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে গ্যালক্সির স্বতন্ত্র অংশগুলো এর কেন্দ্রের চারদিকে ভারসাম্য বজায় রেখে ঘুরেই যাচ্ছিল, কিন্তু সামগ্রিকভাবে গ্যালাক্সির নিজের ঘূর্ণন থেমে গিয়েছিল।
সময় পার হবার সাথে সাথে গ্যালাক্সিতে উপস্থিত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস মহাকর্ষের টানে গুটিয়ে গিয়ে ছোট ছোট আলাদা মেঘ গঠন করে। এই মেঘ সঙ্কুচিত হলে এর মধ্যে থাকা পরমাণু একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করে করে গ্যাসের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এক সময় এর তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে এতে নিউক্লিয়ার ফিউশন (সংযোজন) বিক্রিয়া শুরু হয়। এই ফিউশনের ফলে হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয়। নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বিস্ফোরিত একটি হাইড্রোজেন বোমার মতো এই বিক্রিয়ায় নিঃসৃত তাপের কারণেই একটি নক্ষত্র উজ্জ্বল হয়। এই বাড়তি তাপ গ্যাসের চাপও (বাইরের দিকে) বাড়িয়ে তোলে। এক সময় এই চাপ মহাকর্ষীয় টানের (যা কাজ করে ভেতরের দিকে, ঘটাতে চায় সঙ্কোচন) সাথে সেয়ানে সেয়ানে লড়তে পারে। এর ফলে গ্যাসের সঙ্কোচন বন্ধ হয়। এভাবেই এই মেঘ আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্রে পরিণত হয়। এরা হাইড্রোজেন গ্যাস জ্বালিয়ে হিলিয়ামে রূপান্তরিত করে, বিকিরণ করে তাপ ও আলো। এর উদাহরণ অনেকটা বেলুনের মতো- ভেতরে থাকা বাতাসের বাইরের দিকের প্রসারণ চাপ এবং বেলুনের রাবারের নিজস্ব টান (যা বেলুনকে ছোট করে ফেলতে চায়) একে অপরকে স্থির রাখে।
উত্তপ্ত গ্যাসের মেঘ একবার নক্ষত্র হয়ে গেলে তা বহু দিন ধরে স্থিতিশীল থাকে। এ অবস্থায় নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার তাপ ও মহাকর্ষীয় টান একে অপরকে ধরে রাখে। কিন্তু এক সময় নক্ষত্রের হাইড্রোজেন ও অন্যান্য নিউক্লিয়ার জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। মজার ব্যাপার হল, শুরুতে একটি নক্ষত্রের যত বেশি পরিমাণ ভর থাকে, এটি তত তাড়াতাড়ি জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে। এর কারণ হচ্ছে, একটি নক্ষত্রের যত বেশি ভর থাকে এর মহাকর্ষীয় টানের সাথে ভারসাম্যে থাকতে একে তত বেশি উত্তপ্ত হতে হয়। আর নক্ষত্রটি যত বেশি উত্তপ্ত হবে তত দ্রুত গতিতে এর মধ্যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া হবে এবং তত দ্রুত এর জ্বালানি শেষ হবে। আমাদের সূর্যের কাছে যে জ্বালানি আছে তা দিয়ে এটি সম্ভবত আরও প্রায় পাঁচ বিলিয়ন (পাঁচশ কোটি) বছর চলতে পারবে। কিন্তু আরও বেশি ভরের নক্ষত্ররা একশ মিলিয়ন (দশ কোটি) বছরের মধ্যেও জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলতে পারে। এই সময়টি আমাদের মহাবিশ্বের বয়সের তুলনায় অনেক ছোট্ট।
জ্বালনি শেষ হয়ে গেলে নক্ষত্রটি আবার ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। মহাকর্ষ আবার বিজয়ী হয়। শুরু হয় সঙ্কোচন। এর ফলে পরমাণুরা একে অপরের সাথে জড়িয়ে যায়। এর ফলে নক্ষত্রটি আবার উত্তপ্ত হতে থাকে। উত্তাপ আরও বাড়লে এবার এতে হিলিয়াম থেকে আরও ভারী [১] মৌল যেমন কার্বন বা অক্সিজেন উৎপন্ন হবে। এরপর কী হবে তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। কিন্তু খুব সম্ভব, এর কেন্দ্রীয় অঞ্চল গুটিয়ে গিয়ে অতি ঘন অবস্থা যেমন ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি করবে। ব্ল্যাক হোল শব্দটা নতুন। আমেরিকান বিজ্ঞানী জন হুইলার ১৯৬৯ সালে শব্দটি তৈরি করেন। এর মাধ্যমে তিনি অন্তত দুইশ বছর আগের একটি ধারণার চিত্র তুলে ধরেন। এটা সেই সময়ের কথা যখন আলো সম্পর্কে দুটো তত্ত্ব ছিল। একটি মত ছিল নিউটনের পছন্দনীয়। এই মত অনুসারে, আলো কণা দিয়ে তৈরি। আরেকটি মতের বক্তব্য ছিল, আলো তৈরি তরঙ্গ দিয়ে। এখন আমরা জানি, দুটো তত্ত্বই সঠিক। নবম অধ্যায়ে আমরা দেখব, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কণা- তরঙ্গের দ্বৈততায় (দ্বিমুখী আচরণ) আলোকে কণা ও তরঙ্গ দুই- ই মনে করা যায়। কণা ও তরঙ্গের ধারণাগুলো আমরাই বানিয়েছি, এমন না যে প্রকৃতির সব ঘটনা এর কোনো একটির মতো হতেই হবে।
আলোকে তরঙ্গ ধরে নিলে এটি মহাকর্ষের প্রভাবে কীভাবে কাজ করবে তা বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু আলোকে যদি আমরা কণায় তৈরি মনে করি, তাহলে এই কণারা কামানের গোলা, রকেট বা গ্রহদের মতোই মহাকর্ষ দ্বারা আকৃষ্ট হবে বলে আশা করা যায়। যেমন একটি কামানের গোলাকে পৃথিবীর বা কোনো নক্ষত্রের পৃষ্ঠ থেকে উপরে ছুঁড়লে (নিচের ছবিতে দেখুন) এক সময় এটি থেমে যাবে। এর পর এটি আবার নিচে নামতে থাকবে। তবে একে একটি নির্দিষ্ট বেগের চেয়ে জোরে ছুঁড়ে মারলে ভিন্ন কিছু ঘটবে (এটি আর ফিরে আসবে না)। এই ন্যুনতম বেগকে বলে মুক্তি বেগ। কোনো নক্ষত্রের মুক্তি বেগ নির্ভর করে এর মহাকর্ষী টানের উপর। ভর বেশি হলে মুক্তি বেগের মানও হয় বেশি। এক সময় মানুষ ভাবত আলোর গতি হল অসীম।  এর ফলে মহাকর্ষ একে কিছুতেই থামাতে পারবে না। কিন্তু রোমা সাহেব আলোর নির্দিষ্ট গতির কথা আবিষ্কার করলে বোঝা গেল, এর উপর মহাকর্ষের প্রভাব থাকতেও পারে। নক্ষত্রের ভর যথেষ্ট বেশি হলে আলোর বেগও হবে এর মুক্তি বেগের চেয়ে কম। ফলে নক্ষত্র থেকে বের হওয়া যেকোনো আলো আবার এতেই ফিরে আসবে।

চিত্রঃ মুক্তি বেগের উপরে ও নিচের বেগে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলা। [মুক্তি বেগের চেয়ে জোরে ছুঁড়লে what goes up must come down (উপরে উঠলে নিচেও নামতে হবে) কথাটি আর খাটে না।]
চিত্রঃ মুক্তি বেগের উপরে ও নিচের বেগে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলা। [মুক্তি বেগের চেয়ে জোরে ছুঁড়লে what goes up must come down (উপরে উঠলে নিচেও নামতে হবে) কথাটি আর খাটে না।]
এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে ক্যামব্রিজের শিক্ষক জন মিচেল ১৭৮৩ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এটি  লন্ডনের ফিলোসফিক্যাল ট্র্যানজেকশান অব দি রয়েল সোসাইটি জার্নালে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি বলেন যে একটি নক্ষত্র যথেষ্ট আঁটসাঁট (আকারে ছোট) ও বেশি ভর বিশিষ্ট হলে এর শক্তিশালী মহাকর্ষের কারণে এর ভেতর থেকে আলো বের হয়ে আসতে পারবে না। এর পৃষ্ঠ থেকে বের হওয়া যে কোনো আলো বেশি দূর যাবার আগেই এটার মহাকর্ষ তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসবে। এ ধরনের বস্তুদেরকে এখন আমরা ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর বলি, কারণ এরা আসলেই তাই: মহাশূন্যের কালো শূন্যতা। কয়ে বছর পরে ফরাসী বিজ্ঞানী মারকুই দে ল্যাপ্লাসও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে একই রকম একটি মত প্রকাশ করেন। তিনি এই কথাটি প্রকাশ করেন তাঁর ‘দি সিস্টেম অব দি ওয়ার্ল্ড ‘ বইয়ে।
মজার ব্যাপার হল, তিনি কথাটি বইটির প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে উল্লেখ করলেও পরে তা মুছে ফেলেন। হয়ত ভেবেছিলেন চিন্তাটা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। ঊনিশ শতক যেতে যেতে আলোর কণা তত্ত্ব পরাজিত হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, তরঙ্গ তত্ত্ব দ্বারাইতো সব কিছু ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। সত্যি বলতে, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুসারে আলোকেও কামানের গোলার মতো ধরে নেওয়া যুক্তিসংগত নয়। আলোর বেগতো নির্দিষ্ট। পৃথিবী থেকে উপরে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলা অভিকর্ষের ফলে গতি হারিয়ে ফেলবে এবং শেষমেশ থেমে গিয়ে নিচে নেমে আসবে। কিন্তু আলোতো একটি নির্দিষ্ট বেগে উপরের দিকে যেতেই থাকবে। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করলে বোঝা গেল আলো কীভাবে মহাকর্ষ দ্বারা ক্রিয়াশীল হল। বেশি ভরের নক্ষত্রের কী পরিণতি ঘটবে তা প্রথম সমাধান করেন তরুণ আমেরিকান বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার। তিনি ১৯৩৯ সালে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে কাজটি করেন।
ওপেনহাইমারের গবেষণা থেকে বর্তমানে যে ধারণা আমরা পাচ্ছি তা হল: নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে স্থান- কাল ভেদ করে আসা আলোর গতিপথ মূল পথ থেকে সরে যায়। সূর্যগ্রহণের সময় দূরের নক্ষত্রের আলো একারণেই বেঁকে যেতে দেখা যায়। নক্ষত্রটি সঙ্কুচিত হলে এর ঘনত্ব আরও বেড়ে যায়। এর ফলে এর পৃষ্ঠের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র আরও শক্তিশালী হয় (মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে নক্ষত্রটির কেন্দ্র থেকে বাইরে ছড়িয়ে থাকে। নক্ষত্রটি ছোট হয়ে গেলে এর পৃষ্ঠ কেন্দ্রের আরও কাছে চলে আসে। ফলে আকর্ষণ হয় আরও তীব্র)। ক্ষেত্র শক্তিশালী হলে পৃষ্ঠের কাছাকাছি অঞ্চলে আলো ভেতরের দিকে আরও বেশি করে বেঁকে যায়। শেষে নক্ষত্রটি একটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধ্য পর্যন্ত ছোট হয়ে গেলে পৃষ্ঠের মহাকর্ষ এত বেশি শক্তিশালী হয় যে আলোর পথ ভেতরের দিকে এমনভাবে বেঁকে যায়, যা আর বের হয়ে আসতে পারে না।

চিত্রঃ ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে স্থান- কাল এভাবেই বেঁকে গিয়ে আলোকে ভেতরে টেনে নেয়। ছবিঃ অনুবাদক (ইন্টারনেট অবলম্বনে)
চিত্রঃ ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে স্থান- কাল এভাবেই বেঁকে গিয়ে আলোকে ভেতরে টেনে নেয়। ছবিঃ অনুবাদক (ইন্টারনেট অবলম্বনে)
আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে কোনো কিছুই আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে চলতে পারে না। অতএব আলো বের হতে না পারার অর্থ হচ্ছে ওখান থেকে আসলে কোনো কিছুই বের হতে পারবে না। সবকিছুই মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কবলে পড়ে ভেতরে পড়ে থাকবে। সঙ্কুচিত নক্ষত্রটি এর চারপাশে স্থান- কালের এমন একটি অঞ্চল তৈরি করবে যা থেকে আলো বের হয়ে দূরের কোনো দর্শকের চোখ পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়। এই অঞ্চলের নাম ব্ল্যাক হোল। ব্ল্যাক হোলের বাইরের সীমানার নাম ঘটনা দিগন্ত (event horizon)। বর্তমানে হাবল স্পেস টেলিস্কোপসহ আরও কিছু টেলিস্কোপের কল্যাণে আমরা অহরই আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ব্ল্যাক হোল খুঁজে পাচ্ছি। এই টেলিস্কোপগুলো দিয়ে দৃশ্যমান আলোর বদলে এক্স-রে ও গামা রশ্মিতে পর্যবেক্ষণ করা হয়। একটি স্যাটেলাইট আকাশের একটিমাত্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে পনেরশ ব্ল্যাক হোল খুঁজে পেয়েছে। আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও একখানা ব্ল্যাক হোল পাওয়া গেছে। এর ভর সূর্যের ১০ লাখ গুণের চেয়ে বেশি। এই সুপারম্যাসিভি [২] ব্ল্যাক হোলটিকে কেন্দ্র করে একটি নক্ষত্র আলোর ২ শতাংশ  গতি নিয়ে ঘুরছে। একটি নিউক্লিয়াসকে (পরমাণুর কেন্দ্র) কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা একটি ইলেকট্রনের গড় গতিও এর চেয়ে কম।
একটি বিশাল ভরের নক্ষত্র গুটিয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরি হবার সময় কী দেখা যাবে? এটা জানতে হলে মাথায় রাখতে হবে যে আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে পরম সময় বলতে কিছু নেই। অন্য কথায়, প্রত্যেক দর্শক তার নিজের মতো করে সময় মাপবেন। নক্ষত্রের পৃষ্ঠে অবস্থান করলে যে সময় পাওয়া যাবে, দূরে অবস্থান করা কেউ তার চেয়ে ভিন্ন সময় পাবেন। এর কারণ হল, নক্ষত্রের পৃষ্ঠে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র বেশি শক্তিশালী।
এখন ধরুন, একটি নক্ষত্র ভেতরের দিকে গুটিয়ে যাওয়ার সময় এক অকুতোভয় নভোচারী এর পৃষ্ঠে চেপে বসে আছেন। কোনো এক সময় হয়ত তার ঘড়িতে দেখা গেল ১১:০০ বাজে। ঠিক এই সময় নক্ষত্রটি সঙ্কট ব্যাসার্ধ [৩] পার হয়ে আরও ছোট হয়ে গেল। এখন এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতটা শক্তিশালী হল যে কিছুই আর বের হতে পারবে না। এখন ধরুন, তাকে বলা হয়েছিল যে ঘড়ি দেখে প্রতি সেকেন্ডে একটি করে সঙ্কেত পাঠাতে হবে। সঙ্কেত গ্রহণ করার জন্য একটু দূরে একটি মহাকাশযান নক্ষত্রটিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তিনি যখন সঙ্কেত পাঠানো শুরু করেন তখন সময় ১০:৫৯:৫৮। অর্থ্যাৎ, ১১: ০০ টা বাজতে আর দুই সেকেন্ড বাকি। এখন মহাকাশযানে বসে তার সাথীরা কী দেখতে পাবেন?
এর আগে আমরা থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে দেখেছিলাম মহাকর্ষের কারণে রকেটের ভেতরে সময় ধীরে চলে। মহাকর্ষ শক্তিশালী হলে এই প্রভাবও হয় বেশি। নক্ষত্রের পৃষ্ঠে থাকা নভোচারীর কাছে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মান তার সাথীদের চেয়ে শক্তিশালী। এর ফলে তার কাছে যেটা এক সেকেন্ড সেটাই তার সাথীদের কাছে আরও বেশি সময় মনে হবে। নক্ষত্র গুটিয়ে যাবার সময় তিনিও যখন ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছেন, মহাকর্ষ ক্রমেই তত শক্তিশালী হচ্ছে। এর ফলে মহকাশযানের যাত্রীদের কাছে তার পাঠানো বিভিন্ন সঙ্কেতের মধ্যবর্তী সময় ক্রমেই লম্বা মনে হতে থাকবে। সময়ের এই প্রসারণ ১০:৫৯:৫৯ এর আগে খুব ক্ষুদ্র হবে। তাই মহকাশযানের যাত্রীদেরকে ১০:৫৯:৫৮ এবং ১০:৫৯:৫৯ সময়ে পাঠানো সঙ্কেত দুটি পেতে এক সেকেন্ডের চেয়ে সামান্য বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ১১:০০ টার সময় পাঠানো সঙ্কেত পেতে তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে চিরকাল [৪]
১০:৫৯:৫৯ ও ১১:০০ টার মধ্যবর্তী সময়ে নক্ষত্রের পৃষ্ঠে যা কিছু ঘটবে তা মহাকাশযান থেকে দেখতে অসীম সময়ের প্রয়োজন হবে। ১১:০০ টা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নভোচারীর পাঠানোর সঙ্কেতের মতোই আলোর তরঙ্গের পর্যায়ক্রমিক খাঁজ ও চূড়ার পার্থক্য লম্বা হতে থাকবে। আমরা জানি, প্রতি সেকেন্ডে সৃষ্ট চূড়া ও খাঁজের সংখ্যাকেই আলোর কম্পাঙ্ক বলে। অতএব, মহকাশযানের দর্শকদের কাছে নক্ষত্রের আলোর কম্পাঙ্ক কমে যেতে থাকবে। এই আলো তাই ধীরে ধীরে লাল (এবং ঝাপসা) হতে থাকবে। এক সময় নক্ষত্রটি এত অনুজ্জ্বল হয়ে যাবে যে একে আর যান থেকে দেখা যাবে না। সামনে শুধুই পড়ে থাকবে মহাশূন্যের এক কালো গহ্বর। তবে যানের উপর এর মহাকর্ষীয় টান চলতেই থাকবে এবং যানটিও একে ঘিরে চলতে থাকবে।
এই দৃশ্য অবশ্য পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়। এতে একটু সমস্যা আছে। নক্ষত্র থেকে দূরের দিকে মহাকর্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আমাদের নির্ভীক নভোচারীর পায়ের কাছে মহাকর্ষ সব সময় তার মাথার চেয়ে বেশি হবে। মহাকর্ষের এই পার্থক্য তাকে সেমাইয়ের মত টেনে লম্বা করে দিবে। এর ফলে নক্ষত্রটি সঙ্কট ব্যাসার্ধে পৌঁছে ঘটনা দিগন্ত তৈরি করার আগেই তিনি ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। অবশ্য আমাদের বিশ্বাস, মহাবিশ্বে আরও বড় বড় বস্তুও আছে। যেমন গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলেও মহাকর্ষীয় সঙ্কোচনের ফলে ব্ল্যাক হোল তৈরি হতে পারে। আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই এ রকম একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল আছে। এ ধরনের কোনো ব্ল্যাক হোল অভিযানে গেলে নভোচারীকে আগের মত বিপদে পড়তে হবে না। সঙ্কট ব্যাসার্ধে পৌঁছেও তার বিশেষ কোনো অনুভূতি হবে না। তিনি নিজের অজান্তেই পয়েন্ট অব নো রিটার্ন (point of no return, অর্থ্যাৎ যা থেকে আর ফিরে আসা যাবে না) পার হয়ে যাবেন। অবশ্য বাইরে থেকে দেখতে আগের মতোই তার পাঠানো সঙ্কেত দীর্ঘস্থায়ী হতে হতে এক সময় হারিয়ে যাবে। আর নভোচারীর ঘড়ি অনুসারে আরও কয়েক ঘণ্টা পরে ঠিকই বিপদ দেখা দেবে। মহাকর্ষের ফলে সঙ্কোচন অব্যাহত থাকায় এক সময় তার মাথা ও পায়ের কাছে মহাকর্ষীয় বলের পার্থক্য এত বেশি হবে যে তিনি আগের মতোই ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।    
চিত্রঃ মহাকর্ষীয় টান। [দূরত্বের সাথে সাথে মহাকর্ষ দুর্বল হতে থাকে বলে পৃথিবীর আকর্ষণ আপনার পায়ের চেয়ে মাথায় মহাকর্ষীয় টান কম। এখানে পার্থক্য এক মিটার বা তার কাছাকাছি, তাই এখানে মহাকর্ষের পার্থক্য খুব সামান্য বলে তা আমরা টের পাই না। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের কাছে থাকা একজন নভোচারী ঠিকই ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়বেন।]
চিত্রঃ মহাকর্ষীয় টান। [দূরত্বের সাথে সাথে মহাকর্ষ দুর্বল হতে থাকে বলে পৃথিবীর আকর্ষণ আপনার পায়ের চেয়ে মাথায় মহাকর্ষীয় টান কম। এখানে পার্থক্য এক মিটার বা তার কাছাকাছি, তাই এখানে মহাকর্ষের পার্থক্য খুব সামান্য বলে তা আমরা টের পাই না। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের কাছে থাকা একজন নভোচারী ঠিকই ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়বেন।]
 অনেক সময় একটি বড় ভরের নক্ষত্র গুটিয়ে যাওয়ার সময় এর বহিস্থ অঞ্চল তীব্র বিস্ফোরণের মাধ্যমে বাইরে ছিটকে পড়তে পারে। একে বলা হয় সুপারনোভা। এই বিস্ফোরণ এত শক্তিশালী যে এটি একাই পুরো গ্যালাক্সির বাকি সব নক্ষত্রের চেয়ে উজ্জ্বল হতে পারে। এ রকম একটি সুপারনোভার অবশিষ্টাংশকেই আমরা এখন কাঁকড়া নীহারিকা (Crab nebula) নামে চিনি। চীন দেশে ১০৫৪ সালে একে দেখার কথা লেখা আছে। এক্ষেত্রে বিস্ফোরিত নক্ষত্রটির দূরত্ব ছিল পাঁচ হাজার আলোকবর্ষ। এর পরেও বহু মাস ধরে একে খালি চোখে দেখা গিয়েছিল। এটি এত বেশি উজ্জ্বল ছিল যে একে দিনের বেলায়ও দেখা যেত। রাতের বেলায় এর আলোতে বই পড়া যেত। এটি যদি এর দশ ভাগের এক ভাগ অর্থ্যাৎ, পাঁচশ আলোকবর্ষ দূরে থাকত তবে এটি একশ গুণ উজ্জ্বল হত। সেক্ষেত্রে রাত আর দিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকত না। এই বিস্ফোরণের তীব্রতা পৃথিবীতে আলো প্রদানের ক্ষেত্রে সূর্যের সাথে পাল্লা দিতে পারত, যদিও সূর্য এর চেয়ে কোটি কোটি গুণ কাছে। মনে আছে নিশ্চয়ই, আমাদের সূর্যের দূরত্ব কিন্তু মাত্র ৮ আলোক-মিনিট। এত কাছে যদি কোন সুপারনোভা থাকত, পৃথিবী নিজে ঠিকই থাকত, কিন্তু বিকিরণের কারণে সব প্রাণী ধ্বংস হয়ে যেত। সম্প্রতি কেউ কেউ বলেছেনও যে প্রায় ২০ লাখ বছর আগে প্লাইস্টোসিন ও প্লায়োসিন যুগের মাঝখানে যে সামুদ্রিক প্রাণীরা মারা পড়েছিল তাতেও একটি সুপারনোভা থেকে আসা মহাজাগতিক বিকিরণের ভূমিকা ছিল। এই সুপারনোভাটি ছিল আমাদের খুব কাছেই বৃশ্চিক- সেন্টোরাস নক্ষত্রপুঞ্জে (star cluster)। কিছু বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, উন্নত প্রাণের উদ্ভব ঘটে গ্যালাক্সির সেই অঞ্চলের দিকে যেখানে তারকার সংখ্যা খুব বেশি থাকে না। একে বলা হয় জোন অব লাইফ। কারণ বেশি তারকাময় অঞ্চলে নিয়মিত সুপারনোভাদের হানায় প্রাণের বিকাশে বাধা পড়ে। মহাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে প্রতি দিন লাখ লাখ সুপারনোভা বিস্ফোরিত হয়। একটি গ্যালাক্সিতে প্রায় প্রতি শতাব্দীতে একটি করে সুপারনোভার বিস্ফোরণ ঘটে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দূর্ভাগ্য যে জানা তথ্য মতে, মিল্কিওয়েতে সর্বশেষ সুপারনোভার বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৬০৪ সালে, যখনও টেলিস্কোপ আবিষ্কৃতই হয়নি।
আমাদের গ্যালাক্সিতে পরবর্তী সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রো ক্যাসিওপিই নক্ষত্র। ভাগ্য ভাল যে এটি আমাদের থেকে দশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে আছে, যা আমাদের জন্যে নিরাপদ দূরত্ব। এটি একটি হলুদ হাইপারজায়ান্ট (yellow hyper giant) শ্রেণির তারকা। মিল্কিওয়েতে আবিষ্কৃত মাত্র সাতটি হলুদ হাইপারজায়ান্টের মধ্যে এটি একটি। ১৯৯৩ সালে একদল আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ এটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরের কয়েক বছরে তাঁরা দেখলেন, এর তাপমাত্রা পর্যায়ক্রমে কয়েকশ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠা- নামা করছে। এর পর ২০০০ সালের গ্রীষ্মে এর তাপমাত্রা হঠাৎ করে সাত হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে চার হাজারে নেমে আসে। একই সময় তাঁরা এর বায়ুমণ্ডলে টাইটেনিয়াম অক্সাইড খুঁজে পান। তাঁদের মতে একটি প্রচণ্ড শক ওয়েভের মাধ্যমে নক্ষত্রটি থেকে এই পদার্থ বাইরের দিকে চলে এসেছে।
নক্ষত্রের জীবনের শেষের দিকে তৈরি কিছু ভারী পদার্থ সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন নক্ষত্র তৈরিতে এই পদার্থগুলো ভূমিকা রাখে। আমাদের সূর্যেই এ রকম দুই শতাংশ ভারী মৌল রয়েছে। আমাদের সূর্য হল দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের নক্ষত্র। প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বছর আগে এর জন্ম। এর আগে বিস্ফোরিত সুপারনোভার ধ্বংসাবশেষের ঘূর্ণনশীল গ্যাসীয় মেঘ থেকে এর সৃষ্টি। সেই মেঘের বেশির ভাগ অংশই হয় সূর্য তৈরিতে কাজে লেগেছে অথবা আরও দূরে ছিটকে গেছে। অল্প কিছু পরিমাণ ভারী মৌল জড় হয়ে আমাদের পৃথিবীর মতো গ্রহদের জন্ম হয়েছে, যারা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আমাদের অলঙ্কার তৈরির স্বর্ণ এবং নিউক্লিয়ার চুল্লির ইউরেনিয়াম- দুটোই সৌরজগতের জন্মের আগে কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফসল!
নতুন অবস্থায় যখন পৃথিবী ঘনীভূত হয়েছিল, তখন এর উত্তাপ ছিল খুব বেশি, ছিল না কোনো বায়ুমণ্ডল। আস্তে আস্তে এটি ঠাণ্ডা হল। বিভিন্ন পাথর থেকে নির্গত গ্যাস গড়ে তুলল বায়ুমণ্ডল। প্রাথমিক এই বায়ুমণ্ডল নিয়ে আমরা কিন্তু বাঁচতে পারতাম না। এতে কোনো অক্সিজেন ছিল না। তবে এতে অন্য গ্যাস ঠিকই ছিল, কিন্তু তা ছিল বিষাক্ত। যেমন, এতে ছিল হাইড্রোজেন সালফাইড (পঁচা ডিমে এই গ্যাস থাকার কারণেই তা গন্ধ ছড়ায়)। তবে প্রাণের কিছু আদি রূপ এই পরিবেশেও টিকতে পারত। ধারণা করা হয় এদের উৎপত্তি সাগরে। দৈব প্রক্রিয়ায় পরমাণু থেকে এদের বড়ো কাঠামো বা বড়ো অণু (macromolecule) তৈরি হয়। এটিও আবার অন্য পরমাণুকে যুক্ত করে একই ধরনের কাঠামো গঠন করে। এতে পুনরুৎপাদিত হতে হতে সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে পুনরুৎপাদনের সময় থেকে যায় ত্রুটি। এই ত্রুটিগুলো এমন যে নতুন বড় অণু নিজে নিজে তৈরি হতে না পেরে নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু কিছু ত্রুটি থেকে এমন কিছু বড় অণু তৈরি হত যা আগের চেয়ে ভালোভাবে পুনরুৎপাদিত হতে পারে। এরা একটু সবিধাজনক জায়গায় থাকায় আগের বড় অণুদের জায়গা দখলে নিত। এইভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে জটিল থেকে জটিলতর স্ব-উৎপাদনশীল প্রাণীর সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক যুগের প্রাণীরা হাইড্রোজেন সালফাইডসহ বিভিন্ন পদার্থ গ্রহণ করত এবং অক্সিজেন ছেড়ে দিত। ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলের উপাদান পাল্টাল। উন্নত ধরনের প্রাণী যেমন মাছ, সরসৃপ, স্তন্যপায়ী এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের আবির্ভাব ঘটল।
বিংশ শতকে এসে মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টে যায়। আমরা বুঝতে পারি যে বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের স্থান অতি নগণ্য, বুঝতে পারি সময় ও স্থান বক্র ও অবিচ্ছেদ্য, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে এবং এর একটা শুরু আছে।
মহাবিশ্ব শুরুতে উত্তপ্ত ছিল এবং পরে প্রসারিত হয়ে ধীরে ধীরে শীতল হয়- এই তথ্য আমরা পাই আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব- সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে। আজ পর্যন্ত এর সব অনুমান পর্যেবেক্ষণের সাথে মিলে গেছে, যা এই তত্ত্বের এক বড় বিজয়। কিন্তু গণিত অসীম সংখ্যা নিয়ে কাজ করতে ব্যর্থ। অথচ বিগ ব্যাং থিওরি অনুসারে এক সময় মহাবিশ্বের ঘনত্ব ও স্থান-কালের বক্রতা ছিল অসীম। ফলে মহাবিশ্বের একটি বিন্দুতে গিয়ে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব নিজেই নিজের অকার্যকরতা ও ব্যর্থতার কথা ঘোষণা করছে। গণিতে এ ধরনের বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। কোন তত্ত্ব যখন অসীম ঘনত্ব, বক্রতা ইত্যাদির মতো সিঙ্গুলারিটির কথা বলে, বুঝতে হবে তত্ত্বে কিছু ভুল আছে। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব একটি আংশিক তত্ত্ব, কারণ মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হয়েছিল এটি আমাদেরকে তা বলতে অক্ষম।
সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব ছাড়াও বিংশ শতকে আমরা প্রকৃতি সম্পর্কে আরেকটি আংশিক তত্ত্ব পেয়েছি। এটি হল কোয়ান্টাম মেকানিক্স। খুবই ক্ষুদ্র মাপের জগতের ঘটনাবলী নিয়ে এর কাজ। বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে আমরা জানি যে মহাবিশ্ব এক সময় এত ক্ষুদ্র ছিল যে সেই অবস্থায় এর বড় মাপের গঠন নিয়ে চিন্তা করতে গেলেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়াও মাথায় রাখতে হবে। আমরা পরের অধ্যায়ে দেখব যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বকে পুরোপুরি বুঝতে আমরা এই দুটি তত্ত্বের ওপরই নির্ভর করছি। এই দুটো আংশিক তত্ত্বকে জোড়া লাগিয়ে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নামে একটিমাত্র তত্ত্ব তৈরি করতে হবে। এতে বিজ্ঞানের সাধারণ সব সূত্র সর্বত্র কাজ করবে, এমনকি সময়ের শুরুতেও। কোনো সিঙ্গুলারিটির প্রয়োজন হবে না।
[অনুবাদকের নোটঃ
১। ভারী বলার অর্থ হচ্ছে এতে প্রোটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রনের সংখ্যা বেড়ে যায়। প্রথমে এক প্রোটনের হাইড্রোজেন থেকে দুই প্রোটনের হিলিয়াম হতে থাকে। পরে আরও বেশি প্রোটন বিশিষ্ট পরমাণুরা গঠিত হয়।
২। সূর্যের কয়েক লাখ থেকে শুরু করে কয়েক বিলিয়ন বা তারও বেশি ভরের ব্ল্যাক হোলদের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল বলে। এরা সাধারণত বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে।
৩। সঙ্কট ব্যাসার্ধ হল নক্ষত্রের সেই ব্যাসার্ধ, যাতে পৌঁছলে এর ঘটনা দিগন্ত নামক অঞ্চল তৈরি হতে পারে। অর্থ্যাৎ, এটি ব্ল্যাক হোল হবার জন্যে তৈরি হয়।
৪। অর্থ্যাৎ, সেই সঙ্কেত আর কোনো দিনই পাওয়া যাবে না, কারণ ততক্ষণে নক্ষত্রটি ব্ল্যাক হয়ে গেছে এবং কিছুই আর এখান থেকে বের হবে না।]


কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৯


নবম অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি
নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের মতো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাফল্যে অভিভূত হয়ে ঊনবিংশ শতকের শুরুতে মারকুই দ্যা ল্যাপ্লাস বলেছিলেন মহাবিশ্বের সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত (deterministic)। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এমন কিছু বৈজ্ঞানিক সূত্র থাকবে, যার মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটবে তার সবকিছু অনুমান করতে পারব, অন্তত মূলনীতিগুলতো জানবই। কোনো এক সময় মহাবিশ্ব কী অবস্থায় আছে তা জানাই এর জন্যে যথেষ্ট হবে। একে বলা হয় প্রারম্ভিক (initial) বা প্রান্তীয় (boundary) শর্ত। (এই সীমানা স্থানেরও হতে পারে, আবার সময়েরও হতে পারে। স্থানের ক্ষেত্রে প্রান্তীয় শর্তের অর্থ হচ্ছে মহাবিশ্বের যদি কোনো বহিস্থ সীমান্ত বা প্রান্ত থেকে থাকে তবে সেই প্রান্তে এর অবস্থা।) ল্যাপ্লাসের বিশ্বাস ছিল, এক গুচ্ছ পূর্ণাঙ্গ সূত্র এবং উপযুক্ত প্রারম্ভিক ও প্রান্তীয় শর্তের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের অন্য যে কোনো সময়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র হাতে পাব।
প্রারম্ভিক শর্ত কেন প্রয়োজন তা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে: বর্তমানের আলাদা আলাদা চিত্র ভবিষ্যতকেও আলাদা আলাদা রূপ দেবে। তবে স্থানের ক্ষেত্রে প্রান্তীয় শর্তের গুরুত্ব বুঝতে পারা একটু কঠিন। মূলনীতি অবশ্য একই। যে সমীকরণের উপর ভিত্তি করে তত্ত্ব তৈরি হবে, তার সমাধান অনেক রকম হতে পারে। অতএব আপনাকে প্রারম্ভিক বা প্রান্তীয় শর্তের সাহায্য নিয়ে ঠিক করতে হবে কোন সমাধানটি সঠিক হবে। এটা অনেকটা এ রকম যে আপনি বললেন, আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনেক টাকা আসছে-যাচ্ছে। কিন্তু আপনি শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া হয়ে যাবেন নাকি স্বচ্ছল থাকবেন তা শুধু কত টাকা আসছে- যাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে না। আপনি কত টাকা নিয়ে অ্যাকাউন্ট শুরু করেছেন তার প্রারম্ভিক ও প্রান্তীয় শর্তের উপরও এটি নির্ভর করে।   ল্যাপ্লাসের কথা যদি সঠিক হয় তাহলে মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থা জানার পর এই সূত্রগুলোর সাহায্যে এর অতীত ও ভবিষ্যৎ দুটো সম্পর্কেই অনুমান করা যেত। যেমন, সূর্য এবং গ্রহদের অবস্থান জানার মাধ্যমে আমরা নিউটনের সূত্র দিয়েই আগের বা পরের কোনো সময়ে সৌরজগতের অবস্থা বলতে পারি। গ্রহদের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে নিশ্চয়তাবাদ (Determinism) আসলেই সঠিক। জ্যোতির্বিদরা সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের মতো ঘটনার অনুমান করতে বেশ সিদ্ধহস্ত। কিন্তু ল্যাপ্লাস আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে অনুমান করলেন যে, অন্য সব কিছু, এমনকি মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যেও একই রকম সূত্র আছে।
আমরা ভবিষ্যতে কী করব তা কি বিজ্ঞানীরা সত্যিই বলতে পারবেন? এক গ্লাস পানিতে ১০২৪ (১ এর পরে ২৪টি শূন্য, বা এক হাজার কোটি কোটি কোটি) টির বেশি অণু থাকে। বাস্তবে আমরা কোনো দিনই এই প্রত্যেকটি অণুর অবস্থা জানার আশাই করতে পারি না, মহাবিশ্ব বা এমনকি আমাদের দেহের পূর্ণাঙ্গ অবস্থার কথা না হয় বাদই দিলাম। এর পরেও মহাবিশ্বকে পূর্বনির্ধারিত বলার অর্থ হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কের হিসাব করার ক্ষমতা থাক বা না থাক, ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিতই বটে।
বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদের এই ধারণা বহু মানুষের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছিল। বিরোধীরা ভেবেছিল, মহাবিশ্বকে ঈশ্বরের নিজের ইচ্ছা মতো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে এটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবু এই মতবাদ বিংশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত বিজ্ঞানের মৌলিক নীতি ছিল। আস্তে আস্তে এই বিশ্বাসের বিপরীত লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। এর প্রথম দিককার কিছু প্রমাণ আসে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালে ও স্যার জেমস জিন্স এর হিসাব থেকে। তাঁরা নক্ষত্রের মতো উত্তপ্ত বস্তুরা যে পরিমাণ কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ অবশ্যই নির্গত করবে তার হিসাব বের করেন। (সপ্তম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, যে কোনো বস্তু উত্তপ্ত হলে তা থেকে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ নির্গত হবে)
সেই সময়ে আমরা যে সূত্র জানতাম তা অনুসারে, একটি উত্তপ্ত বস্তু যে-কোনো কম্পাঙ্কে [১] সমান হারে তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ নির্গত করবে। সেক্ষেত্রে দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীর প্রত্যেক রং এর জন্যে সমান পরিমাণ শক্তি নির্গত হবে। শুধু তাই নয়, মাইক্রোওয়েভ, বেতার, এক্স-রে ইত্যাদি সব কম্পাঙ্কের জন্যেই সমান শক্তি নির্গত হবে। নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রতি সেকেন্ডে একটি তরঙ্গ কতবার উপরে- নিচে উঠানামা করে তাই হচ্ছে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক। গণিতের ভাষায় বললে, একটি উত্তপ্ত বস্তুর সব কম্পাঙ্কের তরঙ্গ সমান হারে নির্গত করার অর্থ হচ্ছে, বস্তুটি প্রতি সেকেন্ডে শূন্য এবং দশ লাখের মধ্যবর্তী কম্পাঙ্কের তরঙ্গ তৈরি করতে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত করবে, এটি প্রতি সেকেন্ডে দশ থেকে বিশ লাখের মধ্যবর্তী কম্পাঙ্কের তরঙ্গ তৈরি করতেও সেই একই পরিমাণ শক্তি নির্গত করবে। একইভাবে প্রতি সেকেন্ডে আরও বেশি তরঙ্গ তৈরির ক্ষেত্রেও সমান শক্তি নির্গত হবে। মনে করুন যে প্রতি সেকেন্ডে শূন্য থেকে দশ লাখ বা দশ থেকে বিশ লাখ ইত্যাদি পরিমাণ তরঙ্গ সৃষ্টি হতে এক একক পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। তাহলে সব কম্পাঙ্কের মোট নির্গত শক্তির পরিমাণ হবে ১+ ১+ ১+ … অসীম পর্যন্ত। যেহেতু কোনো তরঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে সৃষ্ট তরঙ্গের সংখ্যা অসীম, তাই শক্তির পরিমাণ যোগ করে কখনো শেষ করা যাবে না। অতএব, মোট নির্গত শক্তির পরিমাণও হবে অসীম।
১৯০০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এই হাস্যকর ফলাফল এড়ানোর একটি উপায় বের করেন। তিনি বললেন যে এক্স-রেসহ অন্যান্য তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ শুধু নির্দিষ্ট বিচ্ছিন্ন গুচ্ছ আকারেই নির্গত হয় [২]। তিনি একে নাম দিলেন কোয়ান্টা (কোয়ান্টা হল কোয়ান্টাম শব্দটির বহুবচন)। অষ্টম অধ্যায়ে আমরা বলেছি, আজকে আমরা আলোর কোয়ান্টামইকে বলি ফোটন। আলোর কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে এর শক্তির পরিমাণও হবে তত বেশি। অতএব, যে কোনো নির্দিষ্ট রং বা কম্পাঙ্কের সব ফোটন অবিকল একই রকম হলেও প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব অনুসারে ভিন্ন কম্পাঙ্কের ফোটনরা এই অর্থে আলাদা যে তাদের বহন করা শক্তির পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। এর অর্থ হল কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, কোনো নির্দিষ্ট রং এর সবচেয়ে দুর্বল আলোর (একটিমাত্র ফোটন যে আলো বহন করে) শক্তির পরিমাণ তার রং এর উপর নির্ভর করে। যেমন, বেগুনি আলোর কম্পাঙ্ক লাল আলোর দ্বিগুণ হওয়ার কারণে এক কোয়ান্টাম বেগুনি আলোর শক্তি এক কোয়ান্টাম লাল আলোর শক্তির দ্বিগুণ। তাই, বেগুনি আলোর ক্ষুদ্রতম যে শক্তি থাকা সম্ভব তা লাল আলোর ক্ষুদ্রতম সম্ভাব্য শক্তির দ্বিগুণ।
এতে করে কৃষ্ণবস্তু সমস্যার সমাধান হয় কিভাবে? কোনো নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে একটি কৃষ্ণবস্তু যে ক্ষুদ্রতম পরিমাণ তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি নির্গত করতে পারে তা হল সেই কম্পাঙ্কের একটি ফোটনের বহন করা শক্তির সমান। বেশি কম্পাঙ্কের ফোটনের শক্তি বেশি। তাই বেশি কম্পাঙ্কের ক্ষেত্রে কৃষ্ণবস্তু কর্তৃক নির্গত ক্ষুদ্রতম শক্তির পরিমাণ বড় হয়  (অর্থ্যাৎ, যার কম্পাঙ্ক যত কম তার ক্ষুদ্রতম শক্তি তত কমে যায়)। যথেষ্ট বড় কম্পাঙ্কের ক্ষেত্রে একটিমাত্র কোয়ান্টামের শক্তিই একটি বস্তুতে মোট যে শক্তি আছে তার চেয়েও বেশি হয়। অতএব এই ক্ষেত্রে কোনো আলোই নির্গত হবে না। এর ফলে উপর্যুক্ত যোগের সেই অসীম ধারার অবসান ঘটে। প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব অনুসারে তাই উচ্চ কম্পাঙ্কের ক্ষেত্রে বিকিরণের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে, বস্তুটি সসীম হারে শক্তি হারাবে। এভাবেই কৃষ্ণবস্তু সমস্যার সমাধান হয়।

picture11
চিত্রঃ সম্ভাব্য সবচেয়ে দুর্বল আলো। [আলো দুর্বল হবার অর্থ হল ফোটনের সংখ্যা কম। যে কোনো রং এর সবচেয়ে দুর্বল আলো হচ্ছে একটিমাত্র ফোটন কর্তৃক বহন করা আলো।]
 উত্তপ্ত বস্তু থেকে নির্গত বিকিরণের হারের ব্যাখ্যা দিতে কোয়ান্টাম তত্ত্ব খুব ভালো কাজ করে। কিন্তু ১৯২৬ সালের আগে বোঝা যায়নি নিশ্চয়তাবাদ (determinism) সম্পর্কে এর মতামত কী হবে। এর ব্যাখ্যা দিলেন আরেক জার্মান বিজ্ঞানী ওয়েরনার হাইজেনবার্গ, তাঁর বিখ্যাত অনিশ্চয়তা নীতির মাধ্যমে। অনিশ্চয়তা নীতি বলছে, ল্যাপ্লাসের বিশ্বাস সঠিক নয়। বৈজ্ঞানিক সূত্র ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ অনুমান করার পুরো স্বাধীনতা প্রকৃতি আমাদেরকে দেয় না। এর কারণ হল, ভবিষ্যতে কোনো কণার অবস্থান ও গতিবেগ কী হবে তা জানতে হলে এর প্রাথমিক অবস্থা জানতে হবে। অর্থ্যাৎ, এর বর্তমান অবস্থান ও বেগ সঠিকভাবে জানতে হবে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এটা করতে হলে কণার উপর আলো ফেলতে হবে। এখন, কণাটিতে ধাক্কা লেগে কিছু আলো এদিক- সেদিক সরে যাবে [৩]। আলোর এই ছড়িয়ে পড়া দেখে দর্শক কণার  অবস্থান বের করতে পারবেন। কিন্তু, একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর সংবেদনশীলতা সীমিত। অন্য দিকে ঐ কণার অবস্থান নিক্ষিপ্ত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (তরঙ্গের পরপর দুটি চুড়ার মধ্যবর্তী দূরত্ব) চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম করে বের করা যাবে না। অতএব, ঐ কণার অবস্থান সঠিকভাবে বের করতে হলে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করতে হবে (যাতে বেশি সূক্ষ্ম হিসাব পাওয়া যায়)। তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হওয়ার অর্থ কম্পাঙ্ক বেশি। প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, আপনি চাইলেই ইচ্ছে মতো  অল্প পরিমাণ আলো ব্যবহার করতে পারেন না। আপনাকে অন্তত এক কোয়ান্টা ব্যবহার করতেই হবে। এর শক্তি আবার কম্পাঙ্ক বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকবে। অতএব আপনি যত বেশি নির্ভুলভাবে একটি কণার অবস্থান বের করতে চাইবেন তত বেশি শক্তির আলোর কোয়ান্টা নিক্ষেপ করতে হবে।
কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, আলোর মাত্র একটি কোয়ান্টামও কণাটিকে উত্তেজিত করবে। এর ফলে এর বেগ এমনভাবে বদলে যাবে, যা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আর আপনি যত বেশি শক্তিশালী আলো ব্যবহার করবেন, এই উত্তেজনা তত বেড়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে, অবস্থান ভালোভাবে বের করতে গিয়ে আপনি যখন বেশি শক্তির কোয়ান্টাম ব্যবহার করছেন, আপনি তখনি কণাটিকে খুব বেশি উত্তেজিত করছেন। ফলে, আপনি যত বেশি নির্ভুলভাবে কণাটির অবস্থান বের করবেন, এর বেগ সম্পর্কে ততই অনিশ্চিত তথ্য হাতে পাবেন। একইভাবে সত্য উল্টো প্রক্রিয়াও। হাইজেনবার্গ দেখান, অবস্থান ও বেগের অনিশ্চয়তার গুণফল কখনো একটি নির্দিষ্ট ধ্রুব সংখ্যার চেয়ে ছোট হয় না। এর অর্থ হল, আপনি যদি অবস্থানের অনিশ্চয়তা কমিয়ে অর্ধেক করেন, আপনাকে বেগের অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে। একইভাবে বেগের অনিশ্চয়তা কমাতে গেলেও বেড়ে যাবে অবস্থানের অনিশ্চয়তা। এই দেওয়া- নেওয়ার ঘটনায় প্রকৃতি কাজ করে আমাদের বিপক্ষে।
এখন প্রশ্ন হল, আমাদেরকে কতটুকু অনিশ্চয়তা মেনে নিতেই হবে? এটা নির্ভর করে আগে উল্লেখিত সেই নির্দিষ্ট ধ্রুব সংখ্যাটির মানের উপর। এই সংখ্যাটিকে বলা হয় প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক।  সংখ্যাটি খুবই ক্ষুদ্র। এই সংখ্যাটি ক্ষুদ্র হওয়ার কারণেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের এই অনিশ্চয়তা আপেক্ষিক তত্ত্বের মতোই খুব সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। (অবশ্য আমাদের জীবনযাত্রার উপর কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রভাব আছে। যেমন আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের কথাই চিন্তা করুন।) যেমন ধরুন, আমরা যদি এক গ্রাম ভরের একটি পিং- পং বলের অবস্থান কোনো এক দিকে এক সেন্টিমিটারের মধ্যে নির্ণয় করি, তাহলে আমরা এর বেগও অনেক বেশি নির্ভুলভাবে (কোয়ান্টাম কণিকার তুলনায়) মাপতে পারব। কিন্তু আমরা যদি একটি ইলেকট্রনের অবস্থান একটি পরমাণুর ব্যাসের সমান সূক্ষ্ম করেও মাপতে চাই, তাহলে আমরা এর বেগ মাপতে গেলে তা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার কম- বেশি হয়ে যাবে। একে কোনোভাবেই নিখুঁত মান বলা যায় না।
আপনি কী প্রক্রিয়ায় বা কোন ধরনের কণার বেগ বা অবস্থান বের করতে যাচ্ছেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা নীতি নাক গলায় না। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি প্রকৃতির একটি মৌলিক ও অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। আমরা বিশ্বকে যেভাবে দেখি তার উপর এর বিশাল প্রভাব আছে। সত্তর বছরের বেশি সময় পার হলেও এই প্রভাবগুলো এখনও এখনো বহু দার্শনিকের মাথায় ঢোকেনি, যার ফলে এটা এখনো বিতর্কের ভালো একটি বিষয়। অনিশ্চয়তা নীতির মাধ্যমে ল্যাপ্লাসের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় বিজ্ঞানের সেই সূত্রের স্বপ্ন, যা মহাবিশ্বের সবকিছুই আগে থেকে বলে দিতে পারবে। আমরা যদি বর্তমানকেই ঠিক মতো পরিমাপ করতে না পারি, তবে ভবিষ্যতের ঘটনা অনুমান করারতো প্রশ্নই আসে না!
এর পরেও আমরা এমন কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার কথা কল্পনা করতে পারি যার হাত- পা আমাদের মতো বাঁধা নয়, যিনি মহাবিশ্বকে উত্তেজিত না করেই এর বর্তমান অবস্থা জেনে নিতে পারেন। তার  জন্যে এমন এক গুচ্ছ সূত্র থাকবে, যা ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা সঠিকভাবে বলে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো মরণশীল প্রাণীর কাছে মহাবিশ্বের সেই মডেলের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। এক্ষেত্রে আমাদের জন্যে মিতব্যয়ীতার নীতি অবলম্বন করাই সুবিধাজনক। অর্থ্যাৎ, তত্ত্বের যে অংশটুকু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়, তা বাদ দিতে হবে। দর্শনের জগতে এই নীতির নাম অকাম’স রেজর (Occam’s Razor)। এর উপর ভিত্তি করে ১৯২০ এর দশকে হাইজেনবার্গ, এরভিন স্রডিঞ্জার ও পল ডিরাক মিলে নিউটনীয় বলবিদ্যাকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে নতুন তত্ত্ব কোয়ান্টাম মেকানিক্স [৪] প্রস্তুত করেন। এর অন্যতম প্রধান ভিত্তিই হল অনিশ্চয়তা নীতি। এই তত্ত্ব অনুসারে, পারমাণবিক কণিকাদের কোনো বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট অবস্থান ও বেগ নেই। এরা বরং অনিশ্চয়তা নীতি দ্বারা বেঁধে দেওয়া বেগ ও অবস্থানের সমন্বয়ে একটি কোয়ান্টাম অবস্থার অধিকারী হয়।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি বৈপ্লবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি কোনো পর্যবেক্ষণের জন্যে একটিমাত্র ফলাফল অনুমান করে না, বরং অনেকগুলো আলাদা আলাদা সম্ভাব্য ফলাফল ঘোষণা করে। এর সাথে বলে দেয় প্রত্যেকটির সম্ভাবনা। অর্থ্যাৎ, আপনি যদি একই ধরনের এবং একই প্রক্রিয়ায় শুরু হওয়া অনেকগুলো সিস্টেম [৫] থেকে অনেক বেশি বার পরিমাপ নেন তাহলে দেখা যাবে কিছু ক্ষেত্রে পরিমাপের ফলাফল পাওয়া যাবে ‘ক’, অন্য কিছু ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে ‘খ’ এবং এভাবেই চলতে থাকবে। ‘ক’ অথবা ‘খ’ কতবার ঘটবে আপনি তার একটি অনুমান তৈরি করতে পারবেন, কিন্তু কোনো পরিমাপেরই নির্দিষ্ট ফলাফল বলতে পারবেন না।

চিত্রঃ অনিশ্চিত কোয়ান্টাম অবস্থান। [কোয়ান্টাম থিওরি অনুসারে, একটি বস্তুর অবস্থান ও বেগের পরিমাপের নির্ভুলতা অসীম হওয়া সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে বস্তুটির কী ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।]
চিত্রঃ অনিশ্চিত কোয়ান্টাম অবস্থান। [কোয়ান্টাম থিওরি অনুসারে, একটি বস্তুর অবস্থান ও বেগের পরিমাপের নির্ভুলতা অসীম হওয়া সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে বস্তুটির কী ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।]
 যেমন আপনি যদি বাণ-ফলককে (dartboard) উদ্দেশ্য করে বাণ নিক্ষেপ করেন তাহলে চিরায়ত তত্ত্ব অর্থ্যাৎ, ননকোয়ান্টাম থিওরি অনুসারে এটি লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতেও পারে, আবার মিসও করতে পারে। নিক্ষেপের মুহূর্তে এর বেগ, অভিকর্ষের টান ইত্যাদি বিষয়গুলো যদি আপনি জানেন, তবে এটি লক্ষ্যবস্তুতে লাগবে কি না আপনি তা বলতে পারবেন। কিন্তু কোয়ান্টাম থিওরি বলছে, না, আপনি তা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। এটি বলছে যে আপনার নিক্ষিপ্ত বাণ ফলকের কেন্দ্রে লাগার যেমন সম্ভাবনা আছে, তেমনি এটি মাটিতে পড়ে যাওয়ারও অশূন্য একটি সম্ভাবনা আছে, সম্ভাবনা আছে বোর্ডের অন্য যে কোনো জায়গায় লাগারও। ফলকের মতো বড় বস্তুর ক্ষেত্রে চিরায়ত তত্ত্ব (এক্ষেত্রে নিউটনের সূত্র) যদি বলে বাণটি ফলকের কেন্দ্রে লাগবে তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে ধরে নিতে পারেন, এটি আসলেই লাগবে। কোয়ান্টাম থিওরি অনুসারে এর না লাগার সম্ভাবনা এত ক্ষুদ্র যে আপনি যদি ঠিক একইভাবে কেয়ামত পর্যন্তও বাণ ছুঁড়তে থাকেন, তবু একটিকেও মিস করে যেতে দেখা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু পারমাণবিক জগতের হিসাব ভিন্ন। একটি পরমাণু দ্বারা তৈরি একটি বাণ ফলকের কেন্দ্রে লাগার সম্ভাবনা হয়ত ৯০ শতাংশ, ফলকের অন্য কোথাও লাগার সম্ভাবনা ৫ শতাংশ, আর  একেবারে বাইরে দিয়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বাকি ৫ শতাংশ। আপনি আগে থেকে বলতে পারবেন না এর মধ্যে কোনটি ঘটবে। আপনি শুধু বলতে পারেন যে আপনি যদি অনেক বার পরীক্ষা চালান, তাহলে প্রতি একশ বারের মধ্যে গড়ে নব্বই বার বাণ ফলকের কেন্দ্রে লাগবে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিজ্ঞানের জগতে অনুমান করার অক্ষমতার বিষয়টিকে (unpredictability) প্রবেশ করিয়েছে, যাকে এড়াবার কোনো উপায় নেই । আইনস্টাইন এর বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি তোলেন, যদিও তিনি নিজেও এসব ধারণার ভিত্তি তৈরিতে অবদান রাখেন। সত্যি কথা হল, তাঁর নোবেলও পাওয়া হয়েছে সেই কোয়ান্টাম থিওরির কল্যাণেই। কিন্তু তবু তিনি কখনো মেনে নেননি যে মহাবিশ্ব সম্ভাবনা দিয়ে (অর্থ্যাৎ অনির্ধারিত উপায়ে) চলতে পারে। তাঁর বিখ্যাত বক্তব্য, ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’ তাঁর এই মতেরই প্রতিফলন।
কোয়ান্টাম থিওরি আমাদের সামর্থ্যের লাগাম টেনে ধরে। এর অর্থ কি এই যে কোয়ান্টাম থিওরি বিজ্ঞানেরও লাগাম টেনে ধরে? বিজ্ঞানের অর্থ যদি হয় উন্নতি, তাহলে এই উন্নতি কীভাবে হবে তা ঠিক করবে প্রকৃতি। এক্ষেত্রে আমরা অনুমান বলতে কী বুঝব তার সংজ্ঞা নতুন করে ঠিক করতে হবে। আমরা হয়ত কোনো পরীক্ষার ফলাফল সঠিকভাবে অনুমান করতে পারব না, কিন্তু পরীক্ষাটি বারবার করে আমরা বলতে পারব যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে এই এই ঘটনার সম্ভাবনা এই এই। তাই অনিশ্চয়তা নীতি থাকলেও প্রকৃতির পরিচালনায় কাজ করা সূত্রগুলোর উপর আস্থা হারানোর প্রয়োজন নেই। সত্যি বলতে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে মেনে নিয়েছেন এ জন্যেই যে পরীক্ষায় পাওয়া ফলাফল এর অনুমানের সাথে দারুণভাবে মিলে গেছে।
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে কণারা কিছু ক্ষেত্রে তরঙ্গের মতো আচরণ করে। আমরা আগেও দেখেছি, এদের নির্দিষ্ট কোনো অবস্থানে থাকে না, এরা বরং কিছু সম্ভাব্য অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ওদিকে আলো কিন্তু তরঙ্গ দিয়ে তৈরি। কিন্তু প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলছে, কিছু ক্ষেত্রে আলোও কণার মতো আচরণ করবে। এটি শুধু গুচ্ছ বা কোয়ান্টা আকারে নির্গত বা শোষিত হতে পারে।  সত্যি কথা হল, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পুরোটাই নতুন ধরনের গণিতের উপর নির্ভরশীল। এটি বাস্তব জগতকে কণা বা তরঙ্গ হিসেবে দেখে না। কিছু সময় কণাদেরকে তরঙ্গ হিসেবে মনে করতে হয়, আবার অন্য কাজের জন্যে তরঙ্গকে কণা ধরে নিলে সুবিধা হয়। কিন্তু এভাবে চিন্তা করা হয় শুধু কাজের সুবিধার জন্যেই। পদার্থবিদরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কণা ও তরঙ্গের দ্বৈততা (wave- particle duality) বলতেই একেই বোঝেন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে তরঙ্গের মতো আচরণের ফলে আমরা দুই ধারার কণার মধ্যে ব্যতিচার [৬] দেখতে পাই। সাধারণত ব্যতিচার হল তরঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য। তরঙ্গরা একে অপরের সাথে মিলিত হলে এক ধারার চূড়ার সাথে আরেক ধারার খাঁজের দেখা হতে পারে। এক্ষেত্রে এরা থাকে বিপরীত দশায় এবং একে অপরকে বাতিল করে দেয়। কেউ কেউ ভাবতে পারেন দুটো তরঙ্গ মিলিত হলেই এদের শক্তি বেড়ে যাবে। বাস্তবে কিন্তু সব সময় তা হয় না, যেমন এই ক্ষেত্রে হয়নি। আলোর ক্ষেত্রে ব্যতিচারের একটি পরিচিত উদাহরণ হল সাবানের বুদবুদে দেখা রং। পানির যে হালকা আবরণ দিয়ে বুদবুদ তৈরি হয়, তার দুই পাশের আলোর প্রতিফলনের ফলে এর সৃষ্টি। সাদা আলোতে প্রতিটি আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা রঙের আলোক তরঙ্গ থাকে। কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে সাবানের এক পাশের আবরণ থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গ চূড়া আরেক পাশ থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গের খাঁজের সাথে মিলিত হয়। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রংগুলো প্রতিফলিত আলোতে থাকে না, যার কারণে একে দেখতে রঙিন লাগে [৭] 
চিত্রঃ সম ও বিপরীত দশা।[দুটো তরঙ্গের খাঁজ ও চূড়াগুলো যদি একই সাথে চলে তাহলে দুটোর মিলনে আরও শক্তিশালী তরঙ্গ উৎপন্ন হয় (চিত্রের ২য় অংশ)। কিন্তু যদি একটার খাঁজ মিশ্রিত হয় আরেকটার চূড়ার সাথে, তাহলে তরঙ্গদুটো একে অপরকে নাকচ করে দেয়৮।]
চিত্রঃ সম ও বিপরীত দশা।[দুটো তরঙ্গের খাঁজ ও চূড়াগুলো যদি একই সাথে চলে তাহলে দুটোর মিলনে আরও শক্তিশালী তরঙ্গ উৎপন্ন হয় (চিত্রের ২য় অংশ)। কিন্তু যদি একটার খাঁজ মিশ্রিত হয় আরেকটার চূড়ার সাথে, তাহলে তরঙ্গদুটো একে অপরকে নাকচ করে দেয় [৮]।]
কিন্তু কোয়ান্টাম থিওরি বলছে, ব্যতিচার ঘটতে পারে কণার ক্ষেত্রেও। এর জন্যে দায়ী কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ডুয়ালিটি বা কণা ও তরঙ্গের দ্বৈত আচরণ। এর একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল দ্বি-চির (চির অর্থ হল, লম্বা ও খুব সরু ছিদ্র) পরীক্ষা। একটা সরু দেয়ালের কথা কল্পনা করুন, যাতে দুটি সমান্তরাল ও সরু ছিদ্র আছে। এই ছিদ্রদের ভেতর দিয়ে কণা নিক্ষেপ করলে কী হবে তা দেখার আগে চলুন দেখি আলো ফেললে কী হয়। দেয়ালের এক পাশে একটি নির্দিষ্ট রং এর আলো ফেলুন। আলোর রং নির্দিষ্ট  হওয়ায় এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যও নির্দিষ্ট। এখন বেশির ভাগ আলোই দেয়ালে বাধা পাবে। কিন্তু কিছু আলো ছিদ্র ভেদ করে ওপারে চলে যাবে। ধরুন যে দেয়ালের ওপারে, আলো থেকে উল্টো দিকে একটি পর্দা রেখে দিলেন। এই পর্দার যে কোনো বিন্দুতে দুই ছিদ্রের আলোই পৌঁছাবে। কিন্তু সে বিন্দুগুলোতে আলো পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দুটি আলাদা ছিদ্র দিয়ে যাওয়া আলোকে ভিন্ন পরিমাণ দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। অতিক্রান্ত দূরত্ব ভিন্ন হওয়াতে দুই ছিদ্র দিয়ে যাওয়া তরঙ্গ দুইটি পর্দায় পৌঁছেও ভিন্ন দশায় থাকবে। কিছু জায়গায় এক তরঙ্গের খাঁজ অপর তরঙ্গের চূড়ার সাথে মিলে যাবে। এক্ষেত্রে দুটি তরঙ্গ একে অপরকে বিলীন করে করে দেবে। অন্য জায়গায় দুটি তরঙ্গের চূড়া ও খাঁজরা সমান তালে চলবে (একটির চূড়া অপরটির চূড়া বরাবর থাকবে)। এ কারণে তরঙ্গের শক্তি বেড়ে যাবে। তবে বেশিরভাগ জায়গায়ই এই দুই অবস্থার মাঝামাঝি ঘটনা ঘটবে। এর ফল, আলো- আঁধারির কিছু বৈশিষ্ট্যময় নকশা চোখে পড়বে।
চিত্রঃ পথের দূরত্ব ও ব্যতিচার। [দ্বি-চির পরীক্ষায় উপরের ও নিচের ছিদ্র দিয়ে পর্দার বিভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছা তরঙ্গের দূরত্ব ভিন্ন হওয়ায় কোথাও তরঙ্গ একে অপরেকে শক্তিশালী করে, আবার কোথাও একে অপরকে নাকচ করে দেয়। এই ব্যতিচারের ফলে তৈরি হয় একটি নকশা।]
চিত্রঃ পথের দূরত্ব ও ব্যতিচার। [দ্বি-চির পরীক্ষায় উপরের ও নিচের ছিদ্র দিয়ে পর্দার বিভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছা তরঙ্গের দূরত্ব ভিন্ন হওয়ায় কোথাও তরঙ্গ একে অপরেকে শক্তিশালী করে, আবার কোথাও একে অপরকে নাকচ করে দেয়। এই ব্যতিচারের ফলে তৈরি হয় একটি নকশা।]
 মজার ব্যাপার হল, আপনি যদি আলোক উৎসের বদলে কণা নিঃসারকও (যেখান থেকে নির্দিষ্ট গতিসম্পন্ন কণা যেমন ইলেকট্রন নির্গত হবে) ব্যবহার করেন, তবুও একই ধরনের নকশা পাওয়া যাবে। (কোয়ান্টাম থিওরি অনুসারে ইলেকট্রনকে যদি নির্দিষ্ট বেগ দেওয়া হয় তবে এর জড় তরঙ্গের নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকবে।) মনে করুন, আপনি একটি চির বন্ধ রেখে দেয়ালের দিকে ইলেকট্রন ছুঁড়ে দিলেন। বেশির ভাগ ইলেকট্রনকে দেয়াল থামিয়ে দেবে। কিন্তু কিছু ইলেকট্রন চির ভেদ করে ওপাশের পর্দায় পৌঁছবে। মনে হতে পারে যে দেয়ালে দ্বিতীয় আরেকটি চির খুলে দিলে পর্দার প্রতিটি বিন্দুতে আঘাত হানা ইলেকট্রনের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কিন্তু আরেকটি চির খুলে দিলে দেখা যায়, কিছু বিন্দুতে ইলেকট্রনের সংখ্যা বেশি, আবার কোনোটায় ইলেকট্রনের সংখ্যা খুব কম। মনে হচ্ছে যেন ইলেকট্রনের মধ্যেও আলোর মতোই ব্যতিচার হচ্ছে, যা তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য- কণার নয়।
চিত্রঃ ইলেকট্রনের ব্যতিচার। [দুটি চির দিয়ে ইলেকট্রনের ধারা নিক্ষেপ করা ও প্রত্যেকটি দিয়ে আলাদাভাবে ইলেকট্রন প্রবাহিত করার ফলাফল একই হয় না। এর কারণ এখানেও ব্যতিচার হচ্ছে।]
চিত্রঃ ইলেকট্রনের ব্যতিচার।
[দুটি চির দিয়ে ইলেকট্রনের ধারা নিক্ষেপ করা ও প্রত্যেকটি দিয়ে আলাদাভাবে ইলেকট্রন প্রবাহিত করার ফলাফল একই হয় না। এর কারণ এখানেও ব্যতিচার হচ্ছে।]
এবার কল্পনা করুন, চির দুটি দিয়ে একটি করে ইলেকট্রন প্রবাহিত করা হল। এবারেও কি ব্যতিচার ঘটবে? মনে হতে পারে যে প্রতিটি ইলেকট্রন দুটি চিরের যে কোনো একটি দিয়ে পার হবে। ফলে ব্যতিচার ঘটার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে একটি করে ইলেকট্রন পাঠানো হলেও ব্যতিচারের নকশা দেখা যায়। তার মানে প্রতিটি ইলেকট্রন একই সাথে দুটো চির দিয়েই যাচ্ছে! ব্যতিচার ঘটাচ্ছে নিজের সাথেই!
কণার এই ব্যতিচার আমাদের পরমাণুর গঠন বুঝতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এই পরমাণুই আমরাসহ আমাদের চারপাশের সবকিছুর মূল গাঠনিক উপাদান। বিংশ শতকের শুরুতে মনে করা হত, পরমাণুতে ঋণাত্মক চার্জধারী কণা ইলেকট্রন এর ধনাত্মক চার্জধারী নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে, ঠিক যেমনিভাবে গ্রহরা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। মনে করা হত, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের আকর্ষণ ইলেকট্রনকে কক্ষপথে ধরে রাখে, যেমন করে সূর্য ও গ্রহদের মধ্যে মহাকর্ষীয় টান গ্রহদের কক্ষপথে ধরে রাখে। কিন্তু এই ধারণায় কিছু সমস্যা ছিল। বলবিদ্যা ও তড়িৎ বিজ্ঞানের চিরায়ত সূত্র কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসার আগেই বলে দিয়েছিল যে এই প্রক্রিয়ায় ঘুরতে থাকা ইলেকট্রন বিকিরণ নির্গত করবে। এর ফলে এরা শক্তি হারাতে থাকবে এবং এক সময় পেঁচিয়ে এসে নিউক্লিয়াসে ধাক্কা খাবে। এর ফল দাঁড়াবে, পরমাণু এবং আসলে সকল বস্তুই এক সময় গুটিয়ে গিয়ে খুব অল্প জায়গায় অবস্থান নিবে। বাস্তবে কিন্তু এটা ঘটে না।
ড্যানিশ বিজ্ঞানী নিলস বোর ১৯১৩ সালে এর এই সমস্যার কিছু অংশের সমাধান বের করেন। তিনি বললেন যে হতে পারে ইলেকট্রনরা নিউক্লিয়াস থেকে যে কোনো দূরত্বে ঘুরতে পারে না, ঘুরতে হয় নির্দিষ্ট কিছু বিশেষ দূরত্বে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে এই নির্দিষ্ট দূরত্বে শুধু একটি বা দুটি ইলেকট্রনই থাকতে পারে, তাহলে গুটিয়ে যাওয়ার সমস্যার সমাধান হয়, কেননা ভেতরের দিকের সীমিত কিছু কক্ষপথ পূর্ণ হয়ে গেলে ইলেকট্রনরা আর পেঁচিয়ে ঘুরতে পারবে না। এই মডেলের সাহায্যে সবচেয়ে সরল পরমাণু হাইড্রোজেনের ব্যাখ্যা খুব দারুণভাবে পাওয়া গেল, কারণ এতে নিউক্লিয়াসের চারদিকে একটিমাত্র ইলেকট্রন ঘুরছে। কিন্তু এই মডেল দিয়ে কীভাবে আরও জটিল পরমাণুর ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে তা বোঝা যাচ্ছিল না। এছাড়াও সীমিত কিছু অনুমোদিত কক্ষপথের ধারণাকেও যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না। এই কৌশল গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বেশ মূল্যবান জিনিস, কিন্তু প্রকৃতি কেন এভাবে কাজ করবে তা কারো মাথায় ঢুকছিল না। এর গভীরে আর কী সূত্র থাকতে পারে তাও স্পষ্ট ছিল না।
নতুন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রের মাধ্যমে সমাধান হাতে এল। বোঝা গেল, নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনকে তরঙ্গ ভাবা যেতে পারে। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে বেগের উপর। এবার মনে করুন বোরের মত অনুসারে নিউক্লিয়াসের চারদিকে নির্দিষ্ট দূরত্বে তরঙ্গ ঘুরছে। কিছু কক্ষপথের পরিধির মান হবে ইলেকট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যার (ভগ্নাংশ নয়) মানের সমান। এই কক্ষপথগুলোর ক্ষেত্রে তরঙ্গের চূড়া প্রত্যেকবার পাক খেয়ে আগের অবস্থানে আসবে। এর ফলে এই তরঙ্গগুলো শক্তিশালী হবে। এই কক্ষপথগুলোই বোরের অনুমিত অনুমোদিত কক্ষপথ। কিন্তু যেসব কক্ষপথের পরিধি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যা হবে না, তাতে ইলেকট্রন একবার পাক খেয়ে এসে তরঙ্গের চূড়া ও খাঁজকে মিলিয়ে দিয়ে তরঙ্গকে নাকচ করে দেবে। এই কক্ষপথগুলো অনুমোদিত হবে না। বোরের সূত্রের অনুমোদিত ও নিষিদ্ধ কক্ষপথের ব্যাখ্যা এবার পাওয়া গেল।

চিত্রঃ পরমাণুর কক্ষপথের তরঙ্গ। [নিলস বোর কল্পনা করেছিলেন, পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনের তরঙ্গ অবিরত ঘুরছে। এই চিত্র অনুসারে, যেসব কক্ষপথের পরিধি ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যার সমান হবে শুধু সেই সেই কক্ষপথগুলোই টিকে থাকবে।]
চিত্রঃ পরমাণুর কক্ষপথের তরঙ্গ। [নিলস বোর কল্পনা করেছিলেন, পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনের তরঙ্গ অবিরত ঘুরছে। এই চিত্র অনুসারে, যেসব কক্ষপথের পরিধি ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যার সমান হবে শুধু সেই সেই কক্ষপথগুলোই টিকে থাকবে।]
 কণা- তরঙ্গের দ্বৈততার চিত্র বোঝার জন্যে আমেরিকান বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান একটি সুন্দর কৌশল বের করেন। একে বলা হয় সামষ্টিক ইতিহাস (sum over history)। এই ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, একটি কণার মাত্র একটি ইতিহাস বা গতিপথ থাকে না। একটিমাত্র ইতিহাসের ধারণা ছিল আগের নন-কোয়ান্টাম তত্ত্বে। এখন বলা হচ্ছে, একটি কণা ‘ক’ বিন্দু থেকে ‘খ’ বিন্দুতে যাবার জন্যে যতগুলো পথ আছে তার সবগুলো ব্যবহার করবে।  ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে যাওয়ার প্রতিটি পথের জন্যে ফাইনম্যান সাহেব কিছু সংখ্যা বরাদ্দ করেন। একটি সংখ্যা দ্বারা তরঙ্গের বিস্তার বা আকার বোঝানো হবে। আরেকটি দ্বারা বোঝানো হবে এর দশা বা চক্রে এর অবস্থান (অর্থ্যাৎ, এটি তরঙ্গের খাঁজে, চূড়ায় নাকি এর মধ্যবর্তী অন্য কোথাও আছে)। ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে  যাবার সম্ভাবনা পেতে হলে ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে বিন্দুতে যাবার সবগুলো পথের তরঙ্গ যোগ করতে হবে।  সাধারণত কাছাকাছি অবস্থিত কিছু পথের তুলনা করলে চক্রের দশা বা অবস্থানের পার্থক্য খুব বেশি দেখা যাবে। এর অর্থ হচ্ছে এই পথগুলোতে অবস্থিত তরঙ্গগুলো একে অপরকে প্রায় পুরোপুরি নাকচ করে দেবে। কিন্তু কাছাকাছিতে অবস্থিত কিছু পথের ক্ষেত্রে দশার পার্থক্য খুব বেশি হবে না। এই পথগুলোর তরঙ্গ টিকে যাবে। এই পথগুলোই হচ্ছে বোরের অনুমোদিত কক্ষপথ।
চিত্রঃ ইলেকট্রনের বহু পথ। [চিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে, কোয়ান্টাম থিওরির ব্যাখ্যায় রিচার্ড ফাইনম্যানের মত হল, কোনো কণা উৎস থেকে পর্দায় যেতে সম্ভাব্য প্রতিটি পথ অতিক্রম করে।]
চিত্রঃ ইলেকট্রনের বহু পথ। [চিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে, কোয়ান্টাম থিওরির ব্যাখ্যায় রিচার্ড ফাইনম্যানের মত হল, কোনো কণা উৎস থেকে পর্দায় যেতে সম্ভাব্য প্রতিটি পথ অতিক্রম করে।]
এই ধারণাগুলোকে গণিতের ভাষায় প্রয়োগ করার মাধ্যমে সহজেই জটিল পরমাণুর জন্যেও অনুমোদিত কক্ষপথের হিসাব পাওয়া গেল। ব্যাখ্যা পাওয়া গেল অণুরও, যা তৈরি হয় অনেকগুলো পরমাণুর সমন্বয়ে,  যেখানে ইলেকট্রনরা একের বেশি নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে। রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের একেবারে মৌলিক বিষয় হল বিভিন্ন অণু ও তাদের মধ্যে বিক্রিয়া। এর ফলে, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে আমরা আমাদের চারপাশের প্রায় সবকিছু অনুমান করতে পারি। অবশ্য তা করতে গিয়ে অনিশ্চয়তা নীতির জন্যে কিছু ছাড়তো দিতেই হয়। (বাস্তবে আমরা অবশ্য একটিমাত্রর ইলেকট্রন বিশিষ্ট সবচেয়ে সরল পরমাণু হাইড্রোজেন ছাড়া অন্য কোনো পরমাণুর জন্যে সমীকরণ সমাধান করতে পারি না। তাই আমরা এক্ষেত্রে কাছাকাছি একটা মান ধরে নিই। আরও জটিল অণু ও পরমাণুর জন্যে ব্যবহার করি কম্পিউটার।) কোয়ান্টাম মেকানিক্স দারুণ সফল এক তত্ত্ব। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় সব আবিষ্কারের কৃতিত্ব এর। টেলিভিশন ও কম্পিউটারসহ সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রের  প্রয়োজনীয় উপাদান হল ট্রাঞ্জিস্টর ও আইসি বা সমন্বিত বর্তনী (integrated circuit)। এই দুটোই মেনে চলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র। রসায়ন ও জীববিজ্ঞানেরও ভিত্তি এই কোয়ান্টাম মেকানিক্স। ভৌত বিজ্ঞানের (physical science) যে অংশে এখনো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হাত পড়েনি তা হল মহাকর্ষ এবং মহাবিশ্বের বড় মাপের (লার্জ স্কেল) কাঠামো। আগে উল্লিখিত আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তা নীতি মেনে চলে না। কিন্তু এটিকে অন্যান্য তত্ত্বের সাথে সন্ধি করতে হলে সেটা হওয়া খুব দরকার।
আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, আমরা এখনই জানি যে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বকে সংশোধন করতে হবে। অসীম ঘনত্বের অনুমান করতে গিয়ে চিরায়ত (অর্থ্যাৎ নন-কোয়ান্টাম) সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব নিজেই নিজের দুর্বলতা স্বীকার করছে। ঠিক এভাবেই কৃষ্ণবস্তু অসীম পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করবে বা পরমাণু গুটিয়ে অসীম ঘনত্ব লাভ করবে বলার মাধ্যমে চিরায়ত বলবিদ্যা নিজের দুর্বলতা স্বীকার করেছিল। এই অগ্রহণযোগ্য সিঙ্গুলারিটি (অসীম ঘনত্বের বিন্দু) এড়াতে চিরায়ত সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বকে কোয়ান্টাম থিওরির রূপ দিতে হবে। নতুন থিওরির নাম হবে কোয়ান্টাম থিওরি অব গ্র্যাভিটি বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব [৯]
কিন্তু সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব যদি ভুলই হয়, তবে বিভিন্ন পরীক্ষায় এর সত্যতা দেখা যাচ্ছে কেন? আমরা এখনো এই তত্ত্বে কোনো ত্রুটি খুঁজে না পাওয়ার কারণ হল, আমরা সাধারণত যেসব মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের দেখা পাই তারা খুব দুর্বল। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, মহাবিশ্বের সকল পদার্থ ও শক্তি আদি অবস্থায় যখন ক্ষুদ্র একটি জায়গায় গুটিয়ে ছিল, তখন এতে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী। এই শক্তিশালী ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি থিওরির প্রভাব হবে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা এখনো কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব হাতে পাইনি। কিন্তু আমাদের মতে এর যে যে বৈশিষ্ট্য থাকা উচিৎ তার অনেকগুলোই আমাদের জানা হয়ে গেছে। এর একটি হল, কোয়ান্টাম থিওরিকে সামষ্টিক ইতিহাসের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হলে ফাইনম্যানের প্রস্তাবনা মেনে চলতে হবে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এমন, যা যে কোনো চূড়ান্ত তত্ত্বে থাকতে হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এটি হচ্ছে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রকে বক্র স্থান- কালের মাধ্যমে প্রকাশ করা।  বক্র স্থানের কোনো কণা নিকটস্থ বিন্দুতে যেতে চায় সরল পথে। কিন্তু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে স্থান- কাল সমতল না হবার কারণে এই পথকে বাঁকা মনে হয়। ফাইনম্যানের সামষ্টিক ইতিহাসকে আমরা আইনস্টাইনীয় মহাকর্ষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে কণার ইতিহাসের উদাহরণ এখন পূর্ণাঙ্গ বক্র স্থান- কালের মতো হচ্ছে, যা বলছে পুরো মহাবিশ্বের ইতিহাস।
মহাকর্ষের পুরাতন তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বের আচরণ মাত্র দুরকম হতে পারে। এক, এটি অনাদি কাল ধরে উপস্থিত ছিল। দুই, একটি সিঙ্গুলারিটি থেকে অতীতের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে এর যাত্রা শুরু। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে মহাবিশ্ব সব সময় উপস্থিত ছিল বলে বিশ্বাস না করার মতো কারণ আমাদের হাতে আছে। কিন্তু তবু এর যদি শুরু থাকেও তবে প্রচলিত সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব দিয়ে যদি আমরা জানতে চাই যে সমীকরণের কোন সমাধান আমাদের মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে খাটবে, তাহলে আমাদেরকে এর আদি অবস্থা জানতে হবে। অর্থ্যাৎ, মহাবিশ্বের শুরু ঠিক কীভাবে হয়েছিল তা জানা দরকার। ঈশ্বর হয়ত শুরুতে প্রকৃতির নিয়মগুলো জারি করেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এরপর তিনি একে সেই নিয়মের মাধ্যমে বিবর্তিত হতে দিয়েছেন, পরে আর নাক গলাননি। মহাবিশ্বের আদি অবস্থাকে তিনি কোন প্রক্রিয়ায় বাছাই করেছিলেন? সময়ের শুরুতে প্রান্তীয় শর্তগুলো কেমন ছিল? প্রচলিত সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে এটা একটা সমস্যা, কারণ মহাবিশ্বের আদিতে গিয়ে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব আত্মসমর্পণ করে।
কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্বে কিন্তু আরেকটি সম্ভাবনা আছে। এটা যদি সত্য হয়, তবে এই সমস্যার সমাধান হবে। কোয়ান্টাম থিওরিতে স্থান- কালের সীমানা বা প্রান্ত তৈরি করার মতো কোনো সিঙ্গুলারিটি না থাকলেও তা পরিমাণে নির্দিষ্ট বা সসীম হতে পারে। স্থান- কাল হবে পৃথিবীর পৃষ্ঠের মতো। তবে মাত্রা থাকবে দুটো বেশি। আগেই আমরা বলেছি, আপনি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে যে কোনো এক দিকে যেতে থাকলে সামনে অভেদ্য কোনো বাধা পাবেন না বা প্রান্তে [১০] গিয়ে পড়েও যাবেন না, শেষ পর্যন্ত যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেখানেই ফিরে আসবেন। কোনো সিঙ্গুলারিটিতে গিয়ে পড়তে হবে না। যদি বাস্তবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও এটাই হয়ে থাকে তবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব নতুন একটি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এতে এমন কোনো সিঙ্গুলারিটি থাকবে না, যেখানে গিয়ে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো আত্মসমর্পণ করবে।
যদি স্থান- কালের প্রান্ত বা সীমানাই না থাকে, তাহলে সেই সীমানায় কী হবে তা নিয়েও মাথা ঘামানোর দরকার নেই। মহাবিশ্বের আদি অবস্থা জানারও কোনো দরকার নেই। স্থান- কালের এমন কোনো প্রান্ত থাকবে না যেখানে ঈশ্বর বা নতুন কোনো সূত্রকে স্থান- কালের প্রান্তীয় শর্ত তৈরি করে দিতে হবে। আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের প্রান্তীয় শর্ত হচ্ছে, ‘এর কোনো প্রান্তই নেই’। মহাবিশ্ব নিজেই নিজেকে ধারণ করবে। বাইরের কোনো কিছু একে প্রভাবিত করবে না। এর সৃষ্টি বা ধ্বংস বলতে কিছু থাকবে না। এর শুধু অস্তিত্বই থাকবে। মহাবিশ্বের শুরু আছে বিশ্বাস করলে স্রষ্টার ভূমিকা পরিষ্কার। কিন্তু মহাবিশ্বের যদি কোনো প্রান্ত বা সীমানা না থাকে, এটি নিজেই নিজেকে ধারণ করে, এর শুরু বা শেষ না থাকে তাহলে ঈশ্বরের ভূমিকা কী হবে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। 
[অনুবাদকের নোটঃ
১। একটি তরঙ্গ প্রতি সেকেন্ডে যতগুলো কম্পন বা পূর্ণ তরঙ্গ উৎপন্ন করে তাকে কম্পাঙ্ক বলে।
২। অর্থ্যাৎ একের পর এক অবিচ্ছিন্নভাবে বা অবিরত সব কম্পাঙ্কের জন্যে নির্গত হয় না।
৩। আলোর এই ছড়িয়ে পড়াকে আলোর বিক্ষেপণ (scattering) বলে। সূর্যের আলো আমাদের বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণায় ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ে বলেই আমরা আকাশ নীল দেখি।
৪। তত্ত্বটি আরও নাম হল কোয়ান্টাম থিওরি বা কোয়ান্টাম ফিজিক্স। বাংলায় এক কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা বা কণাবাদী বলবিদ্যা ইত্যাদি অনেক কিছু বলা হয়।
৫। যেখানে পরীক্ষা চালানো হয় তাকে সিস্টেম বলা হয়। একই ধরনের সিস্টেম বলতে বোঝায় সিস্টেমের সব শর্ত একই থাকবে।
৬। দুটি তরঙ্গ একটির উপর দিয়ে আরেকটি যেতে চেষ্টা করলে সেখানে তরঙ্গের উপরিপাতন হয়। ব্যতিচার হল উপরিপাতন সংক্রান্ত ঘটনা। দুটি তরঙ্গের মধ্যে উপরিপাতনের ফলে একটি বিন্দুতে যদি সমদশা উৎপন্ন হয় তখন সেখানে উজ্জ্বল বিন্দু এবং বিপরীত দশার উপরিপাতন হলে অন্ধকার বিন্দু দেখা যায়। এটিই হল ব্যতিচার।
৭। যেহেতু সাদা আলো হচ্ছে সব আলোর সমষ্টি, তাই এখান থেকে কয়েকটি রঙের আলো বাদ পড়লে তাকে রঙিন দেখাব।
৮। ফলে আর তরঙ্গের কোনো চিহ্নই থাকে না। যেমন চিত্রের প্রথম অংশের রেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এখানে কোনো তরঙ্গ নেই।
৯।  কারণ, সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের কাজ মহাকর্ষ নিয়ে।
১০।  পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে যেগুলোকে বলা হয় পৃথিবীর প্রান্ত। বাস্তবে এরা পৃথিবীর প্রান্ত নয়। প্রান্ত বলা যেত এমন কোনো বিন্দুকে যেখানে গেলে আমরা পৃথিবী থেকে নিচে পড়ে যেতাম, আর উঠে আসতে পারতাম না। কিন্তু পৃথিবী গোল হওয়ায় এমন কোন জায়গা বাস্তবে নেই। ঐ জায়গাগুলোর নাম তাই শুধুই প্রতীকী।]




কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-১০


দশম অধ্যায়ঃ ওয়ার্মহোল ও টাইম মেশিন
আগের অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখেছি, কালের  বিবর্তনে ‘সময়’ সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টেছে। বিংশ শতকের শুরুতেও মানুষ পরম সময়ের প্রতি বিশ্বাসী ছিল। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো ঘটনা কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়েই ঘটতে পারে [১] এবং যে কোনো ভালো ঘড়ি দুটো ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ের পরিমাপ একই দেখাবে। কিন্তু দেখা গেল, দর্শক যেদিকেই যান, আলোর বেগ সব সময় একই থাকে। এর ফলে সময়ের পরম ধারণা ভেঙে গেল। আমরা পেলাম আপেক্ষিক তত্ত্ব। একই ঘটনার সময়ের পরিমাপ বিভিন্ন রকম হতে পারে। প্রত্যেক দর্শক তার নিজের ঘড়িতে অন্যদের থেকে ভিন্ন সময় পাবেন। ফলে সময় একটি একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটি নির্ভর করছে কে মাপছেন তার উপর।  কিন্তু এত কিছুর পরেও সময়কে রেল লাইনের পথের মতো সোজা মনে করা হচ্ছিল, যেখানে আপনি শুধু যে কোনো এক দিকেই যেতে পারেন। কিন্তু কেমন হবে যদি রেল লাইনের মধ্যে লুপ (চক্র বা ফাঁস) বা শাখা-প্রশাখা থাকে, যাতে চাইলে ট্রেন সামনেও এগিয়ে যেতে পারে আবার চাইলে পেরিয়ে আসা স্টেশনে আবার ফিরেও আসতে পারে। সোজা কথায়, কেউ কি চাইলে ভবিষ্যৎ বা অতীতে যেতে পারে? দি টাইম মেশিন উপন্যাসে এইচ জি ওয়েলস এই সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখেছেন। একই কাজ করা হয়েছে আরও বহু সায়েন্স ফিকশনে। অতীতে দেখা গেছে সায়েন্স ফিকশনের অনেক কিছুই বাস্তবে সম্ভব হয়েছে, যেমন সাবমেরিন, চন্দ্র ভ্রমণ ইত্যাদি। তাহলে টাইম ট্র্যাভেল বা সময় ভ্রমণের সম্ভাবনা আসলে কেমন?
টাইম মেশিন
টাইম মেশিন। [টাইম মেশিনে বসে আছেন দুই লেখক]
টাইম ট্র্যাভেল করে ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব। আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে আমরা এমন একটি টাইম মেশিন বানাতে পারি যেটা আমাদেরকে ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দেবে। টাইম মেশিনে চেপে বসুন, একটু অপেক্ষা করুন, নেমে দেখবেন পৃথিবীতে আপনার নিজের চেয়ে অনেক বেশি সময় পার হয়েছে। এই মেশিন বানানোর মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এখনো আমাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু আমরা জানি এটা বানানো সম্ভব, কী কৌশল প্রয়োগ করতে হবে তাও জানা। আমাদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচিত টুইন প্যারাডক্সের সুবিধা নিয়ে এমন একটি মেশিন বানানো যেতে পারে। কৌশল হল, আপনি রকেটে করে উড়াল দেবেন। এটি গতি বৃদ্ধি করে আলোর বেগের কাছাকাছি পৌঁছবে। কিছুক্ষণ এভাবে ভ্রমণ করে ফিরে আসুন (কত সময় এভাবে চলবেন তা নির্ভর করে আপনি কতটুকু ভবিষ্যতে যেতে চান তার উপর।) আপনি নিশ্চয়ই এতে অবাক হবেন না যে আপনার টাইম মেশিন একই সাথে একটি মহাকাশযানও [২]। পুরো সময়টা আপনি এই টাইম মেশিনের ভেতরেই থাকবেন। বের হয়ে আপনি দেখবেন আপনার নিজের চেয়ে পৃথিবীতে বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আপনি চলে এসেছেন ভবিষ্যতে। কিন্তু আমরা কি পেছনে যেতে পারব? অর্থ্যাৎ, আমরা কি অতীতে যাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করতে পারব? পদার্থবিদ্যার সূত্র ব্যবহার করে অতীতে ভ্রমণ করার সম্ভাবনা সবার আগে খুঁজে পান কার্ট গোদেল। তিনি ১৯৪৯ সালে আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণের একটি নতুন সমাধান বের করেন। এ থেকে দেখা গেল যে নতুন ধরনের একটি স্থান- কাল পাওয়া যাচ্ছে। আইনস্টাইনের সমীকরণ থেকে  অনেকগুলো গাণিতিক মডেল বের করা যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এর সবগুলো সমাধানই আমাদের মহাবিশ্বের জন্যে প্রযোজ্য। যেমন, এদের প্রারম্ভিক অথবা প্রান্তীয় শর্তগুলো ভিন্ন হয়। এই মডেলগুলো যা বলছে তা বাস্তব পর্যবেক্ষণের সাথে মিলিয়ে নিয়ে আমরা বুঝতে পারব যে এগুলো আমাদের মহাবিশ্বের জন্যে চলবে কি না।
গোদেল ছিলেন একজন গণিতবিদ। একটি গাণিতিক প্রমাণের জন্য তিনি খুব বিখ্যাত। তিনি প্রমাণ করেন যে সব সঠিক বক্তব্য প্রমাণ করা সম্ভব নয় (অর্থ্যাৎ, কিছু কথা এমন থাকবে যা সঠিক, কিন্তু তা প্রমাণ করা যাবে না)। এমনকি আপনি যদি সব সঠিক বক্তব্যের মধ্যে কাটছাঁট করে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়, যেমন পাটিগণিতের সবগুলো টপিকও প্রমাণ করতে চান, তবুও তা সম্ভব হবে না। অনিশ্চয়তা নীতির মতোই হয়ত গোদেলের এই ইনকমপ্লিটনেস থিওরেম  বা অপূর্ণাঙ্গতার উপপাদ্য (incompleteness theorem)  মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অর্জন ও পূর্বাভাস তৈরিতে বিধি- নিষেধ আরোপ করছে। আইনস্টাইন ও গোদেল দুজনেরই জীবনের শেষের মুহূর্তগুলোতে গবেষণার স্থান ছিল প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডি। এ সময় গোদেল সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। গোদেলের প্রস্তাবিত স্থান- কালের মজার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি বলছে যে পুরো মহাবিশ্বই আবর্তিত হচ্ছে বা ঘুরছে।
 পুরো মহাবিশ্বই আবর্তিত হচ্ছে- এই কথার মানে কী? আবর্তিত হবার মানে হল, কোনো স্থির প্রসঙ্গ বিন্দুর উপস্থিতি যাকে কেন্দ্র করে বস্তুটি ঘুরবে। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, ‘কিসের সাপেক্ষে ঘুরছে?’ উত্তরটা হবে একটু গুরুগম্ভীর। মূলত ছোট্ট লাটিম বা জাইরোস্কোপের মুখ যেদিকে থাকে, দূরের বস্তুগুলো মহাবিশ্বের মধ্যে সেদিকে মুখ করে ঘুরবে। গোদেলের স্থান- কালে গাণিতিকভাবে এতে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। আপনি যদি পৃথিবী থেকে অনেক দূর ভ্রমণ করে আবার ফিরে আসেন, তবে সম্ভাবনা আছে যে আপনি পৃথিবীতে ফিরে আসবেন রওনা দেবার আগের কোনো সময়ে!
নিজের সমীকরণ থেকে এই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে বলে আইনস্টাইন খুব হতাশ হয়েছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব কখনো টাইম ট্র্যাভেল বা সময় ভ্রমণের সুযোগ রাখবে না। কিন্তু যদিও গোদেলের সমাধান আইনস্টাইনের সমীকরণ থেকেই এসেছে, তবু এটি আসলে আমাদের মহাবিশ্বের জন্যে খাটবে না। কারণ হল, পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানি যে আমাদের মহাবিশ্ব ঘুরছে না (আবর্তন করছে না), বা করলেও তা খুব নগণ্য। অন্য দিকে আমাদের মহাবিশ্বের মতো গোদেলের মহাবিশ্ব সম্প্রসারিতও হচ্ছে না। কিন্তু তারপর আইনস্টাইনের সমীকরণের পেছনে লেগে থাকা বিজ্ঞানীরা দেখলেন, সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব দ্বারা অনুমোদিত অন্য স্থান- কাল দিয়ে ঠিকই সময় ভ্রমণ করে অতীতে যাবার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আবার মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ এবং হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মতো মৌলের আধিক্য প্রমাণ করছে যে সময় ভ্রমণের পরিবেশ তৈরির হওয়ার মতো মহাবিশ্বের শুরুতে যে বক্রতা প্রয়োজন, তা ছিল না। প্রান্তহীনতার প্রস্তাবনাও (আগে উল্লিখিত) যদি সঠিক হয়, তাহলে তাত্ত্বিকভাবেও একই ফলাফল আসবে। অতএব প্রশ্ন হচ্ছে: সময় ভ্রমণের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিয়ে যদি মহাবিশ্বের যাত্রা না হয়ে থাকে, তাহলে কি পরে আমরা স্থানীয় কোনো অঞ্চলের স্থান- কালকে বাঁকিয়ে তার সুযোগ তৈরি করতে পারব?
আবার যেহেতু স্থান ও কাল একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, তাই শুনতে হয়ত অবাক লাগবে না যে অতীতে ভ্রমণের সমস্যা ও আলোর চেয়ে বেশি গতিতে যাওয়া যাবে কি না তা আসলে একই সমস্যা । সময় ভ্রমণের সাথে আলোর চেয়ে বেশি বেগে যাওয়ার ব্যাপারটি যে একই সূত্র গাঁথা তা বোঝা সহজ: আপনি যদি সময় ভ্রমণ করে অতীতেই চলে যান, তাহলে আপনি আপনার সম্পূর্ণ ভ্রমণের জন্যে প্রয়োজনীয় সময়টুকুকে ইচ্ছেমতো কমিয়ে আনতে পারবেন।  এর অর্থ হবে আপনি ভ্রমণ করবেন অসীম গতিতে। কিন্তু আমরা দেখব, উল্টোটাও কাজ করে। আপনি যদি অসীম গতিতে ভ্রমণ করতে পারেন, তাহলেও আপনি অতীতে যেতে পারবেন। একটি ছাড়া অপরটি সম্ভব নয়।
সায়েন্স ফিকশন লেখকরা আলোর চেয়ে বেশি গতির বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি ভাবেন। সমস্যা হল, আপেক্ষিক তত্ত্ব বলছে যে আমরা যদি প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরের আমাদের নিকটতম (সূর্যের পরে) নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরিতে একটি মহাকাশযান পাঠাই, তাহলে এর অভিযাত্রীরা তাদের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে ফিরে আসতে অন্তত আট বছর পার করবে। আর যদি গন্তব্য হয়  আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র, তাহলে এর ফিরে আসতে সময় লাগবে অন্তত ১ লক্ষ বছর। গ্যালাক্সিব্যাপী যুদ্ধের কাহিনি লেখার জন্যে বিষয়টা মোটেই সুখকর নয়। কিন্তু এখানেও আপেক্ষিক তত্ত্বের কাছে আরেকটি উপায় আছে। এর সাথেও সম্পর্ক রয়েছে ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচিত টুইন প্যারাডক্সের। পৃথিবীবাসীদের তুলনায় মহাকাশ অভিযাত্রীদের সময় অনেক কম অতিবাহিত হবে বলে মনে হওয়া সম্ভব। কিন্তু মহাকাশযাত্রা থেকে ফিরে এসে আনন্দের খুব বেশি উপলক্ষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারণ দেখা যাবে পৃথিবীতে আগে যারা ছিল তাদের কেউ বেঁচে নেই, মরে গেছে হাজার হাজার বছর আগেই। এ কারণে পাঠকদের আগ্রহ তৈরি করতে সায়েন্স ফিকশন লেখকদেরকে ধরে নিতে হয়েছে যে কোনো এক সময় আমরা আলোর চেয়ে দ্রুত চলার উপায় আবিষ্কার করব। এই লেখকদের অধিকাংশই বুঝতে অক্ষম যে আপনি যদি আলোর চেয়ে দ্রুত ছুটতে পারেন, তাহলে আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে আপনি অতীতেও যেতে পারবেন।
ইংরেজিতে এ রকমই একটি পঞ্চপদী ছড়া আছে, যার বাংলা হয় এ রকমঃ
বলব এক বুদ্ধিমতী তরুণীর গল্প
আলোর বেগও যার কাছে ছিল স্বল্প
আপেক্ষিক বেগ নিয়ে,
এক দিন গেলেন হারিয়ে,
আর ফিরে এলেন তার আগের রাতে
 এই ছড়ার সূত্রও আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথেই গাঁথা। এটি বলছে যে কোনো ঘটনার সময়ের পরিমাণ যেমন সবার কাছে একই নাও হতে পারে, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটনার ক্রমও দর্শকদের কাছে একই রকম নাও হতে পারে। যেমন, যদি দুটো ঘটনা ‘ক’ ও ‘খ’ এতটা দূরে ঘটে যে একটি রকেটকে ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে যেতে হলে আলোর চেয়ে জোরে ছুটতে হবে, তাহলে ভিন্ন গতিতে ছোটা দুজন দর্শকের একজন বলবেন ‘ক’ আগে ঘটেছে, আরেকজন বলবেন, না, ‘খ’ আগে ঘটেছে। মনে করুন যে ‘ক’ ঘটনাটি হল ২০১২ অলিম্পিক গেমসের ফাইনালের ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা। আর ‘খ’ ঘটনাটি হল প্রক্সিমা সেন্টোরির সংসদের ১০০,০০৪ তম মিটিং। মনে করুন পৃথিবীতে থাকা কোনো দর্শকের কাছে মনে হবে ‘ক’ আগে ঘটেছে, তার পরে ঘটেছে ‘খ’। আরো মনে করুন, পৃথিবীর সময় অনুসারে ‘খ’ ঘটেছে এর এক বছর পরে, ২০১৩ সালে। যেহেতু পৃথিবী ও প্রক্সিমা সেন্টোরি প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরত্বে আছে, এই দুটো ঘটনা আগের শর্ত পূরণ করবে। ‘ক’ ঘটনাটি ‘খ’ এর আগে ঘটলেও ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে যেতে আপনাকে আলোর চেয়ে জোরে ছুটতে হবে। এর ফলে, পৃথিবী থেকে বিপরীত দিকে যেতে থাকা প্রক্সিমা সেন্টোরির একজন দর্শকের কাছে ঘটনার ক্রম উল্টো মনে হবে। তিনি দেখবেন, ‘খ’ ঘটনাটি ‘ক’ এর আগে ঘটেছে। এই দর্শক বলবেন, আপনি আলোর চেয়ে দ্রুত ছুটতে পারলে ‘খ’ ঘটনা থেকে ‘ক’ তে আসতে পারবেন। আসলে আপনি যদি সত্যিই খুব দ্রুত চলতে পারেন তাহলে পৃথিবীতে দৌড় প্রতিযোগিতা শেষ হবার আগেই প্রক্সিমা সেন্টোরি গিয়ে খেলা নিয়ে বাজি ধরতে পারেন। আপনি জিতবেনই কারণ আপনিতো খেলার ফলাফল জেনেই এসেছেন!
আলোর গতিকে হারাতে গেলে কিন্তু ভীষণ মুশকিলে পড়তে হয়। আপেক্ষিক তত্ত্ব বলছে যে কোনো রকেটের গতি আলোর গতির কাছাকাছি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হলে রকেটের ক্ষমতা ক্রমেই বাড়াতে হয়। আমাদের কাছে এর পরীক্ষিত প্রমাণ আছে। তা অবশ্য রকেট দিয়ে করা নয়, করা হয়েছে ফার্মিল্যাব বা সার্নের (ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর নিক্লিয়ার রিসার্চ বা সংক্ষেপে CERN) কণা ত্বরকযন্ত্রে মৌলিক কণিকা ব্যবহার করে। কোনো কণিকার বেগ আলোর বেগের ৯৯.৯৯ শতাংশ পর্যন্ত করা সম্ভব। কিন্তু যত বেশিই জ্বালানি ব্যবহার করা হোক না কেন, আলোর বেগকে কোনো ক্রমেই অতিক্রম করানো যায় না। একই কথা খাটবে মহাকাশযানের ক্ষেত্রেও। রকেটের ক্ষমতা যতই হোক, এর গতি বাড়িয়ে আলোর গতির ওপরে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অথচ সময় ভ্রমণ সম্ভব হবে যদি আলোর চেয়ে বেশি গতি পাওয়া যায়। ফলে, দেখা যাচ্ছে দ্রুত গতির মহাকাশ ভ্রমণ ও অতীতে ভ্রমণ- দুটোই ভেস্তে যাচ্ছে।
কিন্তু উপায় আছে আরেকটি। আপনি হয়ত স্থান- কালকে বাঁকিয়ে ‘ক’ ও ‘খ’ ঘটনার মধ্যে কোনো শর্টকাট পথ বানিয়ে ফেলতে পারেন। এর একটি উপায় হবে ‘ক’ ও ‘খ’ এর মাঝখানে ওয়ার্মহোল তৈরি। নাম থেকেও বোঝা যাচ্ছে, ওয়ার্মহোল হচ্ছে অনেক দূরের প্রায় সমতল দুটো অঞ্চলের মাঝে স্থান- কালের একটি সরু সুড়ঙ্গ। এটা অনেকটা এ রকম যেন আপনি কোনো উঁচু পাহাড়-শ্রেণির এক পাশের পাদবিন্দুতে আছেন। স্বাভাবিক উপায়ে অন্য পাশে যেতে হলে আপনাকে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে অপর পাশ দিয়ে নামতে হবে। কিন্তু যদি পাহাড়ের এপাশ থেকে ওপাশে একটি বিশাল ওয়ার্মহোল থাকে তাহলে আর তা করতে হবে না। আমাদের সৌরজগতের কাছ থেকে প্রক্সিমা সেন্টোরি পর্যন্তও একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করা বা খুঁজে বের করার কথা কল্পনা করা যেতে পারে। ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে দূরত্ব মাত্র কয়েক মাইল হতে পারে, যদিও সাধারণ হিসেবে পৃথিবী ও প্রক্সিমা সেন্টোরি ২০ লক্ষ কোটি দূরত্বে অবস্থিত। আমরা ১০০ মিটার দৌড়ের খবরটি ওয়ার্মহোল দিয়ে পাঠাতে পারলে ওদের কংগ্রেসের মিটিং হবার বেশ আগেই এটি ওখানে পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে পৃথিবীর দিকে আসা একজন দর্শকও সেই ওয়ার্মহোল দিয়ে প্রক্সিমার সেন্টোরির মিটিং থেকে অলিম্পিক রেসের আগে আগে পৌঁছে যেতে পারবেন। ফলে, আলোর চেয়ে বেশি গতির মাধ্যমে অর্জিত সময় ভ্রমণের মতোই ওয়ার্মহোলও অতীতে যাবার সুযোগ করে দিচ্ছে।
ওয়ার্মহোল। [ওয়ার্মহোল যদি থাকে তবে তা দুটো দূরবর্তী স্থানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত পথ তৈরি করবে।]
ওয়ার্মহোল। [ওয়ার্মহোল যদি থাকে তবে তা দুটো দূরবর্তী স্থানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত পথ তৈরি করবে।]
 স্থান- কালের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ওয়ার্মহোল থাকার ভাবনাটি সায়েন্স ফিকশন লেখকদের মাথা থেকে আসেনি, এসেছে খুব সম্মানজনক জায়গা থেকে। ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন ও ন্যাথান রোজেন একখানা গবেষণাপত্র লেখেন। এতে তাঁরা দেখালেন যে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের সমাধান থেকে ওয়ার্মহোল পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরা অবশ্য এটাকে ওয়ার্মহোল না বলে ব্রিজ বা সেতু বলেছিলেন। জিনিসটি আইনস্টাইন- রোজেন ব্রিজ নামে খ্যাতি লাভ করে। কিন্তু এর ভেতর দিয়ে একটি মহাকাশযানকে পেরিয়ে যেতে হলে যেটুকু সময় দরকার এটি তত বেশি সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। ওয়ার্মহোলটি গুটিয়ে যেতে যেতে মহাকাশযানের স্থান হবে সিঙ্গুলারিটিতে। কিন্তু ধারণা করা হয়, কোনো উন্নত সভ্যতার প্রাণীরা হয়ত একটি ওয়ার্মহোলকে সময় ভ্রমণ করার মতো যথেষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। এটা করতে হলে, অর্থ্যাৎ, সময় ভ্রমণের জন্যে স্থান- কালকে বাঁকাতে হলে দেখা যায়, প্রয়োজন হয় নেগেটিভে কার্ভেচার বা ঋণাত্মক বক্রতার। ঋণাত্মক বক্রতা দেখতে ঘোড়ার জিনের পৃষ্ঠের মতো। সাধারণ বস্তুতে শক্তির ঘনত্ব ধনাত্মক হওয়ায় এর স্থান- কালের মধ্যে পাওয়া যায় ধনাত্মক বক্রতা। যেমন, কোনো গোলকের পৃষ্ঠ। অতএব, স্থান- কালকে বাঁকিয়ে অতীতে যেতে হলে প্রয়োজন এমন পদার্থ, যার শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক।
বিভিন্ন রকম বক্রতা।
বিভিন্ন রকম বক্রতা।
শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক হবার মানে কী? শক্তি হচ্ছে টাকার মতো। আপনার কাছে যদি পজিটিভ ব্যালেন্স থাকে, তাহলে আপনি তা অনেকভাবে ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু একশো বছর আগের পুরাতন সূত্র অনুসারে, আপনার ব্যালেন্সের চেয়ে বেশি টাকা আপনি উঠাতে পারবেন না। এভাবে এই পুরাতন সুত্রগুলো শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক হওয়া মেনে না নিয়ে অতীতে ভ্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আগের অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করা হয়েছে যে পুরাতন সূত্রগুলো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হাতে রাজত্ব ছেড়ে দিয়েছে, যার ভিত্তি হল অনিশ্চয়তা নীতি। কোয়ান্টাম সূত্রগুলো খুব উদার। এই সূত্রগুলো আপনাকে দুই একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যালেন্সের চেয়ে কিছু বেশি টাকা উঠাতেও বাধা দেয় না, অবশ্য যদি মোট ব্যালেন্স পজিটিভ থাকে। অন্য কথায়, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রের মাধ্যমে কোনো কোনো জায়গায় শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক হতে পারে, যদি অন্য কোনো জায়গার শক্তির ধনাত্মক ঘনত্ব তা পুরণ করে দেয়, যাতে শক্তির মোট পরিমাণ ধনাত্মকই থাকে। অতএব, স্থান- কালকে বাঁকানো যাবে বলে যেমন আমরা বিশ্বাস করি, তেমনি একে বাঁকিয়ে সময় ভ্রমণ করা যাবে বলেও বিশ্বাস করার মতো কারণ রয়েছে।
ফাইনম্যানের সামষ্টিক ইতিহাস অনুসারে একটি নির্দিষ্ট কণিকার দৈর্ঘ্যের স্কেলে সময় ভ্রমণ হচ্ছে। ফাইনম্যানের কৌশল অনুসারে, একটি সাধারণ কণিকার ক্ষেত্রে সময় বেয়ে সামনে যাওয়া আর একটি প্রতিকণিকার (যার চার্জ কণিকার বিপরীত, বাকি সব একই) ক্ষেত্রে পেছনে যাওয়া একই কথা। তাঁর দেখানো গাণিতিক হিসাব অনুসারে, আপনি এক জোড়া কণিকা ও প্রতিকণিকার একই সাথে সৃষ্টি ও পরে ধ্বংস হবার ঘটনাকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করতে পারেন। এটি হল, কণিকা আসলে মাত্র একটিই, যা স্থান- কালের আবদ্ধ চক্র বেয়ে চলছে। এই চিত্র বুঝতে হলে প্রথমে গতানুগতিক উপায়ে ভাবুন। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে, ধরুন ‘ক’ সময়ে একটি কণিকা ও প্রতিকণিকা তৈরি হল। দুটিই সময় বেয়ে সামনে যাচ্ছে। এর পরে অন্য কোনো সময় ‘খ’ তে পৌঁছে দুটো কণিকার দেখা হল, আর সাথে সাথে দুটোই ধ্বংস। ‘ক’ এর আগে এবং ‘খ’ এর পরে এদের কোনোটিই ছিল না। ফাইনম্যান বলছেন, এই ঘটনাকে আরেকভাবে দেখার সুযোগ আছে। ‘ক’ সময়ে একটি মাত্র কণিকাই সৃষ্টি হয়েছে। এটি সময় বেয়ে চলতে চলতে ‘খ’ তে পৌঁছে আবার ‘ক’ সময়ে ফিরে এল। একটি কণিকা ও একটি প্রতিকণিকা একই সাথে সময় বেয়ে সামনে যায়নি, বরং একটি মাত্র কণিকাই চক্রাকারে ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে এবং উল্টো পথে চলাচল করেছে। বস্তুটি যখন সময় বেয়ে সামনে যাচ্ছে (‘ক’ থেকে ‘খ’), তখন একে আমরা কণিকা বলছি। আর এটি যখন পেছনে চলছে (‘খ’ থেকে ‘ক’), তখন একে দেখে মনে হচ্ছে একটি প্রতিকণিকা সময় বেয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
ফাইনম্যানের দৃষ্টিতে প্রতিকণিকার ব্যাখ্যা। [প্রতিকণিকাও আসলে এমন একটি কণিকা, যা সময় বেয়ে পেছনে চলে। ফলে ভার্চুয়াল কণিকা ও প্রতিকণিকার একটি জোড়াকে স্থান- কালের আবদ্ধ চক্রে একই কণিকার গতি মনে করা যায়।]
ফাইনম্যানের দৃষ্টিতে প্রতিকণিকার ব্যাখ্যা। [প্রতিকণিকাও আসলে এমন একটি কণিকা, যা সময় বেয়ে পেছনে চলে। ফলে ভার্চুয়াল কণিকা ও প্রতিকণিকার একটি জোড়াকে স্থান- কালের আবদ্ধ চক্রে একই কণিকার গতি মনে করা যায়।]
 এই ধরনের সময় ভ্রমণের প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। যেমন ধরুন, কণিকা বা প্রতিকণিকার কোনো একটি (ধরুন প্রতিকণিকা) ব্ল্যাক হোলে পড়ে গেল। এর ফলে আরেকটি গেল একা হয়ে, এটি ধ্বংস হবার মতো কোনো সঙ্গীকে খুঁজে পাচ্ছে না। হতাভাগা কণাটিও ব্ল্যাক হোলে পড়ে যেতে পারে, আবার ব্ল্যাক হোলের খুব কাছ থেকে পালিয়েও [৪] আসতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে দূর থেকে মনে হবে কণিকাটি ব্ল্যাক হোল থেকে বের হয়ে এসেছে। ব্ল্যাক হোল থেকে আসা বিকিরণকে আপনি আরেকটি ভিন্ন কিন্তু সমতুল্য উপায়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন। দুই কণিকার মধ্যে যেটি ব্ল্যাক হোলে পড়ে গেছে (আমরা ধরে নিয়েছি, প্রতিকণিকা) তাকে আমরা ব্ল্যাক হোল থেকে সময় বেয়ে পেছনে চলা একটি কণিকা বলতে পারি। এটি যখন সেই জায়গায় পৌঁছে, যেখানে কণিকা বা প্রতিকণিকা একই সাথে উৎপন্ন হয়েছিল, তখন এটি ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়ে সময় বেয়ে সামনে চলতে থাকে এবং ব্ল্যাক হোল থেকে পালিয়ে আসে। অথবা যদি দুটোর মধ্যে কণিকাটি ব্ল্যাক হোলে পতিত হয় তাহলে আপনি একে এমন একটি প্রতিকণিকা বলতে পারেন, যা ব্ল্যাক হোল থেকে বেরিয়ে সময় বেয়ে পেছনে চলছে। তাই ব্ল্যাক হোলের বিকিরণ থেকে দেখা যাচ্ছে, আণুবীক্ষণিক জগতে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অতীতে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে। অতএব, আমরা প্রশ্ন করতেই পারি যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব কি এই অনুমতি দেয় যে ভবিষ্যতের উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা শেষ পর্যন্ত একটি টাইম মেশিন বানাতে পারব? প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, হ্যাঁ, দেওয়া উচিৎ। ফাইনম্যানের সামষ্টিক ইতিহাসকে সামগ্রিক বা সম্পূর্ণ ইতিহাস ধরা হয়। অতএব, এতে সেই ইতিহাসও থাকবে, যাতে স্থান- কাল এত বেশি বক্র যে অতীতে চলে যাওয়া সম্ভব। যদিও পদার্থবিদ্যার পরিচিত কোনো সূত্র সময় ভ্রমণকে উড়িয়ে দিচ্ছে না, তবু এমন কিছু বিষয় আছে যা একে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
একটি প্রশ্ন এ রকম: যদি অতীত ভ্রমণ সম্ভবই হয় তাহলে কেউ ভবিষ্যত থেকে ফিরে আসেনি কেন? কেন ফিরে এসে আমাদেরকে বলেনি কীভাবে এ কাজ করা হল? আমাদের মতো কম উন্নত জাতির কাছে সময় ভ্রমণের গোপন রহস্য ফাঁস করা কেন বোকামী হবে তার অনেকগুলো ভালো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু মানুষের স্বভাব যদি ভবিষ্যতেও না পাল্টায়, তাহলে বিশ্বাস করা কঠিন যে ভবিষ্যতের কোনো আগন্তুক এই তথ্য ফাঁস করে দেবে না। কেউ কেউ অবশ্যই বলবেন যে বিভিন্ন সময় দেখা যাওয়া ইউএফও (Unidentified  Flying Object বা অচেনা উড়ন্ত বস্তু) এলিয়েন বা ভবিষ্যতের আগন্তুকদের প্রমাণ বহন করে। (যদি এলিয়েনরা উপযুক্ত সময়ে এখানে আসতেও চায়, তবু নক্ষত্রদের মধ্যে যে বিশাল দূরত্ব তাতে তাদেরকে আলোর চেয়ে জোরে ছুটতে হবে। ফলে, দুটো সম্ভাবনা সম্ভবত একই হয়ে যাচ্ছে) ভবিষ্যতের কোনো আগন্তুক দেখা না যাওয়ার আরেকটি কারণ সম্ভবত অতীত নির্দিষ্ট, কারণ আমরা এটি দেখে ফেলেছি, এবং এও দেখেছি যে এতে ভবিষ্যত থেকে ফিরে আসার মতো প্রয়োজনীয় বক্রতা নেই। অন্য দিকে ভবিষ্যৎ হচ্ছে অজানা এবং উন্মুক্ত। ফলে তাতে হয়ত প্রয়োজনীয় বক্রতা থাকতে পারে। এর অর্থ হবে হয়ত যেকোনো টাইম ট্র্যাভেল শুধু ভবিষ্যতের দিকেই হতে পারে। স্টার ট্রেক মুভি সিরিজের ক্যাপ্টেন ক্লার্ক ও স্টারশিপ এন্টারপ্রাইজের বর্তমানে উপস্থিত থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমরা ভবিষ্যতের কোনো আগন্তুককে কেন দেখিনি এটা তার ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু আরেকটি সমস্যা থেকেই যাবে। আমরা কি অতীতে গিয়ে ইতিহাস বদালতে পারব? ইতিহাস কিন্তু এখানে সমস্যা করবে। মনে করুন কেউ অতীতে গিয়ে নাৎসি সরকারকে পরমাণু বোমার কৌশল বলে দিল, অথবা ধরুন কেউ ফিরে গিয়ে দাদার দাদার দাদাকে মেরে ফেলল, মৃত্যুর আগে বেচারা দাদা কোনো সন্তানের বাবা হবারও সুযোগ পাননি। এই প্যারাডক্সকে [৫] (পরস্পর বিরোধী ঘটনা) অনেকভাবেই বলা যায়। কিন্তু সবগুলো আসলে একই অর্থ বহন করে। আমরা যদি অতীতকে বদালাবার ক্ষমতা পাই, তাহলে বৈপরিত্যে জড়িয়ে পড়ব।
সময় ভ্রমণের প্যারাডক্সের দুটো সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। প্রথমটিক বলা যায় ধারাবাহিক ইতিহাস (consistent history) পদ্ধতি। এটি বলছে যে স্থান- কালের বক্রতা অতীতে যাবার সুযোগ করে দিলেও সেখানে গিয়ে যা ঘটবে তা হবে পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনেই। এই মত অনুসারে, আপনি শুধু তখনই অতীতে যেতে পারবেন যখন ইতিহাস থেকে দেখা যাবে যে আপনি অতীতে গিয়েছিলেন এবং আপনার দাদার দাদার দাদাকে খুন করেননি বা এমন কিছু করেননি যাতে আপনার বর্তমান ইতিহাস সৃষ্টিতে বাধা পড়ে। এছাড়াও আপনি অতীতে গেলেও এর আগের ইতিহাস বদলাতে পারবেন না, শুধু পর্যবেক্ষণ করেই যেতে পারবেন। এই মত অনুসারে, অতীত নির্দিষ্ট। আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন না।
আপনি অবশ্য বলতে পারেন যে স্বাধীন ইচ্ছা আসলে একটি ভ্রম। যদি পদার্থবিদ্যার আসলেই কোনো পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কাজকর্মও নির্ধারণ করবে। কিন্তু সূত্রটি আমাদের মতো জটিল প্রাণীদের ক্ষেত্রে এত জটিল্ভাবে কাজ করে যে তা হিসাব করে বের করা সম্ভব নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রভাবের কারণে এতে কিছু দৈব ঘটনা থাকবে। সুতরাং আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা থাকার একটি অর্থ এমন হতে পারে যে আমরা আসলে জানি না এই সূত্রগুলো কী করবে। কিন্তু একজন মানুষ যদি রকেটে করে ভ্রমণ করে তার রওনা দেবার আগের কোনো সময়ে ফিরে আসে তাহলে আমরা বলতে পারব সে কী করবে, কারণ এটা ইতিহাসে লেখা আছে। অতএব, এই পরিস্থিতিতে সময়ের অভিযাত্রীর আসলেই কোনো স্বাধীন ইচ্ছা থাকবে না।
সময় ভ্রমণের প্যারাডক্সের আরেকটি সমাধানকে বলা যেতে পারে বিকল্প ইতিহাস (alternative history) তত্ত্ব। এই মত অনুসারে, সময়ের অভিযাত্রীরা অতীতে গিয়ে আগের ইতিহাসের বদলে বিকল্প ইতিহাসে প্রবেশ করবেন, যা আগের ইতিহাস থেকে ভিন্ন হবে। এখানে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন, আগের ইতিহাসের ধারবাহিকতা বা সীমাবদ্ধতা মানতে হবে না। স্টিভেন স্পিলবার্গ তার ব্যাক টু দি ফিউচার মুভিতে এই ধারণা ব্যবহার করে মজা করেছেন। মুভিতে মারটি ম্যাকফ্লাই অতীতে গিয়ে তার মা- বাবার সম্পর্ককে আরো সুখকর করে তুলেছেন।
রিচার্ড ফাইনম্যান কোয়ান্টাম তত্ত্বে সামষ্টিক ইতিহাস দিয়ে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন (নবম অধ্যায়) তার সাথে বিকল্প ইতিহাসের মিল আছে। এটি বলছে যে মহাবিশ্বের ইতিহাস একটি নয়, এতে সম্ভাব্য সব রকম ইতিহাস তাদের নিজস্ব সম্ভাবনা নিয়ে টিকে আছে। তবে ফাইনম্যানের প্রস্তাবের সাথে বিকল্প ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। ফাইনম্যানের সমষ্টিতে প্রত্যেকটি ইতিহাসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ স্থান- কাল ও তার ভেতরের সব কিছু অন্তর্ভূক্ত। স্থান- কাল এতটা বক্র হতেও পারে যে রকেট নিয়ে অতীতে চলে আসা যাবে। কিন্তু রকেট একই স্থান- কালের মধ্যেই থাকবে এবং তার ফলে তার ইতিহাসও একই হবে যাতে করে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। ফলে দেখা যাচ্ছে ফাইনম্যানের প্রস্তাবনা আসলে বিকল্প ইতিহাসের বদলে ধারাবাহিক ইতিহাসের পক্ষ নিচ্ছে।
এই সমস্যাগুলো আমরা এড়াতে পারি ঘটনাপঞ্জি সংরক্ষণ তত্ত্বের  (chronology protection) মাধ্যমে। এর বক্তব্য হচ্ছে, ম্যাক্রোস্কোপিক বা বড় সাইজের বস্তুরা যাতে কোনো তথ্য অতীতে নিতে না পারে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো তাতে কড়া নজর রাখে। এই তত্ত্বের কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু একে সত্য মনে করার পক্ষে যুক্তি আছে। যুক্তি হল, যখন স্থান- কালকে বাঁকিয়ে অতীতে যাওয়া সম্ভব করে তোলা হবে, তখন কোয়ান্টাম তত্ত্বের হিসাব- নিকাশ থেকে দেখা যায় কণিকা বা প্রতিকণিকারা আবদ্ধ চক্রের মধ্যে ঘুরতে থাকে। এতে করে শক্তির ঘনত্ব এত বেশি হয় যে স্থান- কালের বক্রতা হয়ে পড়ে ধনাত্মক, যার ফলে যে বক্রতার মাধ্যমে সময় ভ্রমণ সম্ভব হয়েছিল সেই বক্রতা আর থাকে না। এটা আসলেই ঘটে কিনা তা নিশ্চিত না হবার কারণে সময় ভ্রমণের দুয়ার এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু এর পক্ষে বাজি ধরা ঠিক হবে না, কারণ আপনার প্রতিপক্ষ হয়ত ভবিষ্যত জেনে ফেলে সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে যাবে!
 [অনুবাদকের নোটঃ
১। অর্থ্যাৎ, কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটতে যে সময় লাগবে, তার পরিমাণ যে কোনো দর্শকের কাছে একই মনে হবে।
২। টাইম মেশিনকে সব সময় মহাকাশযানই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এখানে বিশেষ উদাহরণটি এ রকম দেওয়া হয়েছে বলে এর কথা বলা হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি, আপনি যদি পৃথিবীর পৃষ্ঠেও সোজা কোনো রেল লাইন বানিয়ে এতে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে ট্রেন চালিয়ে দেন তাতেও একই ঘটনা ঘটবে। বিষয়টি বেগের সাথে জড়িত, কোনো নির্দিষ্ট স্থান, যেমন মহাকাশের সাথে নয়। স্থানের সাথে সম্পর্ক আছে অন্যভাবে, যা আমরা পরে দেখব।
৩। কারণ সময় ও গতি গুণ করে দূরত্ব পাওয়া যায়। এখন একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের ক্ষেত্রে, সময় যদি কম হয় গতিতো বেশি হতেই হবে। আর সময় যেহেতু ইচ্ছে মাফিক কম করা যাচ্ছে, গতিও তাহলে ইচ্ছে মাফিক বড়ো হবে। যেমন ধরুন, আমরা ৪ আলোকবর্ষ দূরের প্রক্সিমা সেন্টোরিতে গিয়ে আবার ফিরে এলাম। সাধারণ হিসাবে এই ভ্রমণ শেষ করতে ৮ আলোকবর্ষের চেয়ে বেশি সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে ৮ বছরের আগে আমাদের ফিরে আসার কথা নয়। ধরুন, আমরা রওনা দিলাম ২০১৬ সালে। ২০২০ সালে ওখান থেকে ফিরতি পথে রওনা দিলে ফিরে আসার কথা ২০২৪ সালের পরে। কিন্তু অতীতে ভ্রমণ করে আমরা ফিরে এলাম ২০১৭ সালে। তার মানে ২০২০ সালে ওখান থেকে নির্গত কোনো আলোক রশ্মির চেয়েও  দ্রুত চলে এলাম আমরা। এভাবে আমরা যত বেশি অতীতে আসব, আলোর বেগকে তত বেশি বড় ব্যবধানে পরাজিত করা হবে।
৪। ব্ল্যাক হোল থেকে কোনো কিছু বের হতে পারে না- এই কথা একেবারে চূড়ান্ত নয়। এই বইয়ের অন্যতম লেখক ড. হকিং ই আবিষ্কার করেন, কোয়ান্টাম সূত্রের কল্যাণে ব্ল্যাক হোল থেকে কিছু কণা বের হতেও পারে। তাঁর নাম অনুসারেই এই প্রক্রিয়ার নাম হকিং বিকিরণ (hawking radiation)।
৫। একে বলা হয় গ্র্যান্ডফাদার প্যরাডক্স। দাদার কোনো সন্তান হবার আগেই কেউ যদি অতীতে গিয়ে তার দাদাকে মেরে ফেলেন, তাহলে তার বাবার জন্ম হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাহলে তিনি এলেন কোথেকে? এভাবেই সময় ভ্রমণ করতে গেলে মুখোমুখি হতে হয় বিভিন্ন প্যারাডক্সের।
৬। খালি চোখে দৃশ্যমান- এমন সাইজের জিনিসকে ম্যাক্রোস্কোপিক বলা হয়।]



কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-১১


একাদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতির বলসমূহ এবং পদার্থবিদ্যার একীভবন
তৃতীয় অধ্যায়েই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে মহাবিশ্বের সবকিছুকে এক বাক্যে প্রকাশ করার জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব প্রস্তুত করা বেশ কঠিন একটি কাজ। ফলে আমরা একবারে তা না করে আংশিক তত্ত্ব বের করে করে এগিয়েছি। এ তত্ত্বগুলো অল্প কিছু ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, বাকি প্রতিক্রিয়াগুলোকে হয় বাদ দিতে হয়, না হয় কিছু সংখ্যার মাধ্যমে কাছাকাছি একটি মান নেওয়া হয়। আজ পর্যন্ত আমরা বিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে যে পর্যায়ে আনতে পেরেছি তাতে অনেকগুলো সংখ্যা রয়ে গেছে। যেমন ধরুন, এখনও আমরা ইলেকট্রনের চার্জের পরিমাণ এবং প্রোটন ও ইলেকট্রনের ভরের অনুপাত তত্ত্ব প্রয়োগ করে বলতে পারি না, তথ্যগুলো পেতে হয় পর্যেবক্ষণ থেকে। আর দেখে জেনে নেওয়া এই তথ্য আমরা বসাই সমীকরণে [১]। কেউ কেউ এগুলোকে মৌলিক ধ্রুবক বলেন। অন্যরা বলেন এগুলোর কোনো মৌলিকত্ব নেই, শুধু কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের সাথে মিলানোর জন্যেই বসাতে হয়েছে।
আপনি যে মতের পক্ষেই থাকুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই সংখ্যাগুলোর মান প্রাণের উদ্ভবের পেছনে বেশ সূক্ষ্ম ভূমিকা পালন করেছে। যেমন, ইলেকট্রনের চার্জ যদি সামান্য এদিক-ওদিক হত তবে তা নক্ষত্রের মধ্যে তড়িচ্চুম্বকীয় ও মহাকর্ষীয় বলের ভারসাম্য নষ্ট করত। হয় এরা হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পোড়াতে ব্যর্থ হত অথবা এরা বিস্ফোরিত হয়ে যেত [২}। দুই ক্ষেত্রেই প্রাণের অস্তিত্ব হত অসম্ভব। আমারা আশা করছি, শেষ পর্যন্ত এমন একটি পূর্ণাঙ্গ, সুসংগত, ও একীভূত তত্ত্ব পাওয়া যাবে, যা থেকে সবগুলো আংশিক তত্ত্বও বের করে নেওয়া যাবে এবং যাকে পর্যেবক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যে সংশোধন করে বিশেষ কিছু সংখ্যা, যেমন ইলেকট্রনের চার্জ ইত্যাদি যুক্ত করতে হবে না।
এমন একটি তত্ত্বের অনুসন্ধানকে বলা হয় পদার্থবিদ্যার একীভবন (unification of physics)। এই তত্ত্ব খুঁজতে খুঁজতেই আইনস্টাইন তাঁর শেষ জীবনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু সময়টা উপযুক্ত ছিল না। সে সময় মহাকর্ষ ও তড়িচ্চুম্বকীয় বলের জন্যে আংশিক তত্ত্ব ছিল, কিন্তু নিউক্লিয়ার বলসমূহ সম্পর্কে তখনকার সময়ে জ্ঞান ছিল খুব সামান্য। উপরন্তু আমরা নবম অধ্যায়ে দেখেছি যে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপর আস্থা রাখতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু তবু দেখা যাচ্ছে অনিশ্চয়তা নীতি আমাদের মহাবিশ্বের একেবারে মৌলিক একটি বৈশিষ্ট্য। অতএব, একীভূত কোনো তত্ত্বকে সফলতার মুখ দেখতে হলে এই নীতিকে অগ্রাহ্য করে তা সম্ভব হবে না।
বর্তমানে এমন একটি তত্ত্ব খুঁজে পাবার সম্ভাবনা বেড়েছে। এখন আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে অনেক বেশি জানি। কিন্তু আমাদেরকে সতর্কও হতে হবে, বেশি আত্মবিশ্বাসে গা ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না। অতীত ইতিহাসেও আমরা অনেক নকল সাফল্য দেখেছি। বিংশ শতকের শুরুতে মনে করা হত, অবিচ্ছিন্ন বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা ও তাপের পরিবহন ইত্যাদি জাতীয় ধর্মগুলো দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যাবে। পরমাণুর কাঠামো এবং অনিশ্চয়তা নীতি আবিষ্কারের মাধ্যমে এই ধারণা বাতিল হয়ে গেল। ১৯২৮ সালে কিছু দর্শনার্থী গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ ম্যাক্স বর্নের সাথে দেখা করতে যান। তিনি তখন মন্তব্য করেন, ‘আমরা যে পদার্থবিদ্যাকে চিনি তা ছয় মাস পর বিলুপ্ত হয়ে যাবে।‘ তার কিছু দিন আগে বিজ্ঞানী পল ডিরাকের ইলেকট্রনের সমীকরণ আবিষ্কার থেকে তিনি এই আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলেন। মনে করা হয়েছিল যে একই রকম একটি সমীকরণ প্রোটনের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করবে। তখন শুধু এই দুটো কণিকার কথাই জানা গিয়েছিল। অতএব, মনে করা হল তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু ১৯৩২ সালে নিউট্রন আবিষ্কারের মাধ্যমে লক্ষ্য আরো দূরে সরে গেল। তবুও এই সাবধানতার কথা মাথায় রেখে আমরা আশা করতে পারি যে প্রকৃতির চূড়ান্ত সূত্রের অনুসন্ধান সাফল্যের খুব নিকটে চলে এসেছে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে, সকল জড় কণিকাদের মধ্যে বল ও মিথষ্ক্রিয়া বহন করে কণিকারাই। এক্ষেত্রে যা ঘটে তা হল, একটি জড় কণিকা, যেমন ইলেকট্রন বা কোয়ার্ক একটি বলবাহী (force carrying) কণিকা নির্গত করে। এই নির্গমণের ধাক্কায় জড় কণিকার বেগ বদলে যায়। এই একই কারণে গোলা নিক্ষেপের পর কামান একটু পেছনে সরে আসে। এই বলবাহী কণিকা তখন আরেকটি আরেকটি জড় কণিকার সাথে মিলিত হয়, যেটি একে শোষণ করে নেয়। ফলে এই জড় কণিকাটির বেগও পরিবর্তন হয়। দুটি জড় কণিকার মধ্যে কোনো বল কাজ করলে যে ফলাফল হত, নির্গমণ ও শোষণের এই প্রক্রিয়াও ঠিক সেরকমই।
প্রত্যেকটি বল পরিবাহিত হয় এর নিজস্ব বলবাহী কণার মাধ্যমে। বলবাহী কণার ভর বেশি হলে এদেরকে উৎপন্ন করা ও বেশি দূরত্বে পাঠানো কঠিন। ফলে, এদের বহন করা বলের পাল্লা হবে ছোট্ট। অন্য দিকে বলবাহী কণার যদি নিজস্ব ভর না থাকে, তাহলে বলের পাল্লা হবে অনেক বিশাল। জড় কণিকাদের মধ্যে বিনিময় হওয়া বলবাহী কণিকাদেরকে ভার্চুয়াল কণা বলার কারণ হচ্ছে এদেরকে বাস্তব কণিকার মতো সরাসরি শনাক্ত করা যায় না। পার্টিকেল ডিটেকটর এখানে ব্যর্থ। কিন্তু এদের পরিমাপযোগ্য প্রভাব থাকার কারণে আমরা জানি যে এদের অস্তিত্ব আছে। জড় কণিকাদের মধ্যে এরাই বল উৎপন্ন করে।

কণার বিনিময়। [কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে বলের উদ্ভব ঘটে বলবাহী কণা বিনিময়ের মাধ্যমে।]
বলবাহী কণাদেরকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। এখানে বলে রাখা ভাল, এই যে চারটি ভাগ তা কিন্তু আমাদের মানুষেরই বানানো, আমাদের আংশিক তত্ত্ব তৈরির জন্যে এতে সুবিধা হয় বলে। কিন্তু এই বিভাজন আরো গভীরে নাও কাজ করতে পারে। বেশির ভাগ পদার্থবিজ্ঞানীর আশা, চারটি বলের সবগুলোকে একটি বলেরই বিভিন্ন রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করার মতো একটি একীভূত তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে। অনেকের মতে বর্তমানে এটাই পদার্থবিদ্যার প্রধান লক্ষ্য। প্রথমটি হল মহাকর্ষী বল। এই বলটি সার্বজনীন। অর্থ্যাৎ, প্রত্যেকটি কণাই এর ভর বা শক্তি অনুসারে মহাকর্ষ অনুভব করে। মহাকর্ষ অন্যান্য বলগুলোর তুলনায় অনেক অনেক দুর্বল। এটি এতই দুর্বল যে এর বিশেষ দুটি বৈশিষ্ট্য না থাকলে এর কথা আমরা জানতামই না। এক, এটি বিশাল দূরত্ব পর্যন্ত কাজ করতে পারে। দুই, এটি সব সময় আকর্ষণ করে, কখনো বিকর্ষণ করে না। এর ফলে, পৃথিবী ও সূর্যের মতো দুটো বিশাল বস্তুর প্রতিটি কণিকার মধ্যকার দুর্বল মহাকর্ষীয় বলও সব মিলিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বল তৈরি করবে। অন্য তিনটি বল হয় স্বল্প পাল্লায় কাজ করে, নয়ত কখনো আকর্ষণ করে এবং কখনো বিকর্ষণ করে প্রতিক্রিয়া হারিয়ে ফেলে।
এর পরে বলতে হয় তড়িচ্চুম্বকীয় বলের কথা। এটি ইলেকট্রন ও কোয়ার্কের মতো তড়িতগ্রস্থ (চার্জিত) কণিকাদের সাথে প্রতিক্রিয়া করে। নিউট্রনের মতো চার্জহীন কণাদের নিয়ে এটি কাজ করে না। মহাকর্ষ বলের চেয়ে এটি অনেক বেশি শক্তিশালী। দুটি ইলেকট্রনের মধ্যে ক্রিয়াশীল তড়িচ্চুম্বকীয় বল এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বলের তুলনায় ১ কোটি কোটি  কোটি কোটি কোটি কোটি (১ এর পরে ৪২ টি শূন্য) গুণ শক্তিশালী। আবার ইলেকট্রিক চার্জ হতে পারে দুরকম। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক। দুটি ধনাত্মক বা দুটি ঋণাত্মক চার্জের মধ্যে বিকর্ষণ কাজ করে। কিন্তু একটি ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের মধ্যে কাজ করে আকর্ষণ বল।
সূর্য বা পৃথিবীর মতো বিশাল বস্তুদের মধ্যে প্রায় সমান সংখ্যক ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ থাকে। এর ফলে, স্বতন্ত্র কণিকাদের মধ্যকার আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বল একে অপরকে প্রায় পুরোপুরি নাকচ করে দেয় এবং খুব সামান্য পরিমাণ তড়িচ্চুম্বকীয় বল বাকি থাকে। কিন্তু পরমাণু বা অণুর খুব ক্ষুদ্র স্কেলে তড়িচ্চুম্বকীয় বলই রাজত্ব করে। মহাকর্ষের ফলে যেমন পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, তেমনি ঋণাত্মক চার্জধারী ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জধারী প্রোটনের মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বলের কারণেই পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারদিকে ইলেকট্রনরা ঘুরতে থাকে। ফোটন নামক বিপুল সংখ্যক ভার্চুয়াল কণিকা বিনিময়ের মাধ্যমে তড়িচ্চুম্বকীয় বল কাজ করে। এখানেও ফোটনদের বিনিময় ঘটে ভার্চুয়াল কণা হিসেবেই। কিন্তু একটি ইলেকট্রন এক কক্ষপথ থেকে নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি আরেক কক্ষপথে চলে গেলে কিছু শক্তি নির্গত হয় এবং একটি বাস্তব ফোটন বেরিয়ে আসে। যদি এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট মানের মধ্যে থাকে, তবে একে দৃশ্যমান আলোতে আমাদের চোখ বা কোনো ফোটন ডিটেকটর, যেমন ফটোগ্রাফিক ফিল্ম দিয়ে দেখা সম্ভব। একইভাবে, একটি বাস্তব ফোটন কোনো পরমাণুর সাথে ধাক্কা খেলে নিউক্লিয়াসের কাছের কোনো কক্ষপথ থেকে একটি ইলেকট্রন আরো দূরে সরে যেতে পারে।  এতে করে ফোটনের শক্তি ব্যবহৃত হয়ে যাবার কারণে এটি শোষিত হয়ে যায়।
তৃতীয় ধরনের বল হল দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। আমরা চলতে ফিরতে কখনও সরাসরি এই বলের সাক্ষাৎ পাই না। কিন্তু এই বলটিই পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে উৎপন্ন হওয়া তেজষ্ক্রিয়তার জন্যে দায়ী। ১৯৬৭ সালে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা ছিল না। ঐ বছর লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের ডঃ আব্দুস সালাম এবং হার্ভাডের স্টিভেন উইনবার্গ একই সাথে তড়িচ্চুম্বকীয় বলের সাথে এই বলের একীভবনের একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। এর প্রায় একশ বছর আগে ম্যাক্সওয়েল এভাবেই তড়িৎ ও চুম্বকীয় বলকে একত্র করেছিলেন। এই তত্ত্বের অনুমান পরীক্ষার সাথে খুব ভালো মতো মিলে যাওয়ায় ১৯৭৯ সালে সালাম ও উইনবার্গ পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। একই সাথে নোবেল পান হার্ভাডের আরেক বিজ্ঞানী শেলডন গ্ল্যাশো। তিনিও তড়িচ্চুম্বকীয় ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বলকে এক্ত্রিত করতে একই রকম একটি তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন।
চতুর্থ ধরনের বল হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী। এর নাম সবল নিউক্লিয়ার বল। আগেরটির মতো এই বলটির সাথেও আমাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু আমাদের চারপাশের প্রায় সবকিছুকে এই বলটিই যুক্ত করে রেখেছে। প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে কোয়ার্কদেরকে যুক্ত করেছে এই বল। এই বলটিই পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও ইলেকট্রনকে ধরে রেখেছে। সবল বল না থাকলে ধনাত্মক চার্জধারী প্রোটনদের মধ্যকার বিকর্ষণের ফলে মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে তছনছ হয়ে যেত। একমাত্র ব্যতিক্রম হাইড্রোজেন গ্যাস, কারণ এর নিউক্লিয়াসে মাত্র একটি প্রোটন থাকে [৩]। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস গ্লুওন (gluon) নামে একটি কণা এই বলটিকে বহন করে। এই গ্লুওন প্রতিক্রিয়া করতে পারে শুধু কোয়ার্ক ও নিজের সাথে [৪]
তড়িচ্চুম্বকীয় ও দুর্বল নিউক্লিয়াস বলকে সফলভাবে একীভূত করার পর এই দুটোকে সবল নিউক্লিয়ার বলের সাথে একীভূত করার জন্যেও অনেকগুলো প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। প্রস্তাবিত এই একীভূত তত্ত্বের নাম গ্র্যান্ড ইউনিফাইড থিওরি (GUT) । নামটিতে আসলে কিছুটা বাড়াবাড়ি  প্রকাশ পেয়েছে। কারণ এখানে তত্ত্বটি এক দিকে খুব বেশি গ্র্যান্ড বা বড়ো নয়, আবার এটি  পরিপূর্ণভাবে একীভূত তত্ত্বও নয়, কারণ এতে মহাকর্ষের কথা নেই। অন্য দিকে এটি আসলে পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বও নয়, কেননা এতে অনেকগুলো এমন ধ্রুবক আছে যাদের মান তত্ত্ব থেকে বলা যায় না, পরীক্ষা করে বের করে নিতে হয়। তবে যাই হোক, পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে এটি প্রস্তুত করা সম্ভব হলেওতো অন্ততঃ এক ধাপ সামনে যাওয়া হবে।
মহাকর্ষকে অন্যান্য তত্ত্বের সাথে যুক্ত করতে প্রধান সমস্যা হল, মহাকর্ষের সূত্র বা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব হচ্ছে একমাত্র তত্ত্ব, যা কোয়ান্টাম তত্ত্ব মেনে চলে না (মানে এটি একটি ননকোয়ান্টাম থিওরি)। এটি অনিশ্চয়তা নীতির ধার ধারে না। কিন্তু যেহেতু অন্যান্য বলের আংশিক তত্ত্বগুলো অনিবার্যভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর নির্ভরশীল, তাই মহাকর্ষকে অন্যান্য তত্ত্বের সাথে একীভূত করতে হলে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের মধ্যে অনিশ্চয়তা নীতিকে স্থান দিতে হবেই। কিন্তু এ পর্যন্ত কেউই কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব প্রস্তুত করতে পারেননি।
কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব তৈরি করা এতটা কঠিন হয়ে ওঠার পেছনেও অনিশ্চয়তা নীতির হাত আছে। নীতিটি বলছে যে ‘শূন্য’ স্থানেও প্রচুর পরিমাণ ভার্চুয়াল কণা ও প্রতিকণার জোড়া রয়েছে। যদি তা না হত, মানে ‘শূন্য’ স্থান যদি আসলেই সম্পূর্ণ খালি হত, তাহলে তার অর্থ হত মহাকর্ষীয় এবং তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রসহ সবগুলো ক্ষেত্রের মান একেবারে শূন্য হত। কিন্তু একটি ক্ষেত্রের মান ও সময়ের সাথে তার পরিবর্তনের হার একটি কণার অবস্থান ও বেগের (অবস্থানের পরিবর্তন) সাথে তুলনীয়। অনিশ্চয়তা নীতি বলছে যে আপনি এই দুটি রাশির একটিকে যত বেশি সঠিকভাবে পরিমাপ করতে চাইবেন, আরেকটিতে ভুলের পরিমাণ ততই বেড়ে যাবে। অতএব, শূন্য স্থানের কোনো ক্ষেত্রের মান যদি পুরোপুরি শূন্য হয়, তার মানে একই সাথে এর মান (অর্থ্যাৎ শূন্য) এবং পরিবর্তনের হার (এটাও শূন্য) দুটোরই একটি সূক্ষ্ম হিসাব পাওয়া যাবে। এটি অনিশ্চয়তা নীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। অতএব, ক্ষেত্রের মানের মধ্যে কিছু পরিমাণ অনিশ্চয়তা থাকতেই হবে। একে বলা হয় কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশান।
কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশানকে এমন এক জোড়া কণা ভাবে যেতে পারে, যারা একই সময়ে একত্রে আবির্ভূত হয়, ভিন্ন দিকে চলে, এরপর একই দিকে আসে এবং একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়। বল বহনকারী কণিকাদের মতো এরাও ভার্চুয়াল কণিকা। বাস্তব কণিকাদের মতো এদেরকে পার্টিকেল ডিটেকটরের সাহায্যে সরাসরি শনাক্ত করা যায় না। কিন্তু এদের পরোক্ষ প্রভাব পরিমাপ করা যায়। যেমন, ইলেকট্রনের কক্ষপথের শক্তির ক্ষুদ্র পরিবর্তন পরিমাপ করা যায়। এই তথ্য তাত্ত্বিক অনুমানের সাথে বেশ নির্ভুলভাবে মিলে যায়। তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের ফ্লাকচুয়েশানের ক্ষেত্রে এই কণিকাগুলো হল ভার্চুয়াল ফোটন, আর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যেই এই কণিকারা হল ভার্চুয়াল গ্র্যাভিটন। কিন্তু  দুর্বল ও সবল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল জোড়া হল ইলেকট্রন, কোয়ার্ক ও তাদের প্রতিকণিকা ইত্যাদির মতো জড় কণিকাদের জোড়া।

ভার্চুয়াল কণা ও প্রতিকণারর জোড় বিষয়ক ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম। [অনিশ্চয়তা নীতিকে ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে দেখা যায় যে এমনকি শূন্য স্থানেও কণা ও প্রতিকণার জোড়া থাকে, যারা প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয় এবং একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়।]
সমস্যা হল, এই ভার্চুয়াল কণিকাদেরও এনার্জি বা শক্তি আছে। আবার যেহেতু ভার্চুয়াল কণিকার সংখ্যা অসীম, তাই এদের শক্তির পরিমাণও হবে অসীম। এর ফলে, আইনস্টাইনের সমীকরণ E = mc2 অনুসারে (পঞ্চম অধ্যায় দেখুন) এদের ভরের পরিমাণও হবে অসীম। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ভাষায় এর অর্থ হল, মহাকর্ষ পুরো মহাবিশ্বকে গুটিয়ে অসীম সাইজের ক্ষুদ্র বানিয়ে ফেলবে। কিন্তু বাস্তবতাতো তা নয়! সবল, দুর্বল ও তড়িচ্চুম্বকীয় বলের মতো আংশিক তত্ত্বগুলোতেও একই রকম অদ্ভুত অদ্ভুত অসীম জিনিসের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এদের তিনটার ক্ষেত্রেই একটি এই অসীমের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি উপায় আছে। এই কৌশলের নাম রিনর্মালাইজেশান। এর কারণেই এই বলগুলো নিয়ে কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে। রিনর্মালাইজেশানের মাধ্যমে নতুন অসীম সংখ্যা নিয়ে এসে তত্ত্বে উপস্থিত অসীম সংখ্যার সাথে কাটাকাটি করা হয়। কিন্তু এদেরকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার প্রয়োজন হয় না। আমরা নতুন অসীম রাশিগুলো এমনভাবে নিতে পারি, যাতে ভাগশেষ খুব ছোট্ট হয়। এই ছোট্ট ভাগশেষদেরকে তত্ত্বে রিনর্মালাইজ  করা রাশি বলা হয়।
গাণতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই কৌশলকে একটু জগাখিচুড়ি মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু এতে কাজ হয়। এই কৌশল কাজে লাগিয়ে সবল, দুর্বল ও তড়িচ্চুম্বকীয় বল সম্পর্কে যে অনুমান করা হয়েছিল, তা খুব দারুণভাবে পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে গেছে। কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ থিওরি প্রস্তুত করার কথা চিন্তা করলে রিনর্মালাইজেশানের বড় একটি দুর্বলতা রয়েছে। এর কারণ হল, এটি অনুসারে বলের প্রকৃত শক্তি ও ভরের মান তত্ত্ব থেকে অনুমান করা সম্ভব হয় না, জেনে নিতে হবে পর্যবেক্ষণ থেকে। দূর্ভাগ্যের বিষয় হল, রিনর্মালাইজেশান ব্যবহার করে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের অসীম রাশিগুলোকে দূর করতে গেলে মাত্র দুটি রাশিকে মানিয়ে নেওয়া যায়। এর একটি হল মহাকর্ষের শক্তি ও অপরটি হল মহাজাগতিক ধ্রুবক, যেটিকে আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণে যুক্ত করেছিলেন মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে না মনে করে (সপ্তম অধ্যায় দেখুন)। কিন্তু বাস্তবতা হল, শুধু এই দুটি রাশিকে ঠিক করে সব অসীম সংখ্যার হাত থেকে বাঁচা যায় না। ফলে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব আমাদেরকে বলছে যে স্থান- কালের বক্রতার মতোই কিছু রাশি বাস্তবিকই অসীম হবে। অথচ, এই রাশিগুলো পরিমাপ করে আমরা সম্পূর্ণ সসীম বা নির্দিষ্ট মান পাই!
সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং অনিশ্চয়তা নীতিকে একীভূত করতে গেলে যে এই সমস্যা তৈরি হবে তা অনেক দিন থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালে বিস্তারিত হিসাব- নিকাশের মাধ্যমে এটি নিশ্চিত হয়। চার বছর পরে একটি সম্ভাব্য সমাধান এল। এর নাম সুপারগ্র্যাভিটি। কিন্তু দূর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, সুপারগ্র্যাভিটি তত্ত্বে শেষ পর্যন্ত কোনো অসীম রাশি থাকবে কি না তা জানতে হলে এত বিশাল হিসাব- নিকাশ করতে হয় যে তা করার সাহস কারোই হয়নি। এমনকি কম্পিউটার ব্যবহার করে এই হিসাব করলেও তাতে বছরের পর বছর লেগে যাবে। আর এতেও যে অন্তত একটি বা সম্ভবত তারও বেশি ভুল থেকে যাবার সম্ভাবনাও খুব বেশি। ফলে, আমরা তখনই জানবো যে এটি সঠিক উত্তর, যখন অন্যও কেউও এই হিসাব- নিকাশ করে একই উত্তর পাবেন। আর এমন সম্ভাবনাও কিন্তু খুব ক্ষুদ্র। এছাড়াও সুপারগ্র্যাভিটি তত্ত্বের কণিকারা পর্যবেক্ষণে পাওয়া কণিকাদের সাথে মেলে না। কিন্তু তবু বেশির ভাগ বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, এই থিওরিকে ঠিকঠাক করে নেওয়া যেতে পারে এবং মহাকর্ষকে অন্যান্য বলগুলোর সাথে একীভূত করার ক্ষেত্রে সম্ভবত এটাই সঠিক পথ। এরপর ১৯৮৪ সালে এসে মতামত দারুণভাবে পাল্টে গেল। লাইমলাইটে চলে এল স্ট্রিং থিওরি।
স্ট্রিং থিওরি আসার আগে মনে করা হত প্রত্যেকটি মৌলিক কণিকা একটি নির্দিষ্ট স্থান দখল করে রাখে। স্ট্রিং থিওরি অনুসারে মৌলিক বস্তুরা কোনো বিন্দু কণা নয় বরং এমন বস্তু যার শুধু দৈর্ঘ্য আছে, কিন্তু অন্য কোনো দিক (প্রস্থ বা উচ্চতা) নেই, অসীম পাতলা এক টুকরো সুতোর মতো। এই স্ট্রিংদের প্রান্তও থাকতে পারে (এদেরকে ওপেন বা উন্মুক্ত  স্ট্রিং বলা হয়), আবার এদের কয়েকটি যুক্ত হয়ে আবদ্ধ লুপ বা চক্রও গঠন করতে পারে (এদের নাম ক্লোজড বা বদ্ধ স্ট্রিং)। প্রত্যেকটি মুহূর্তে কোনো কণিকা স্থানের একটিমাত্র বিন্দুতে অবস্থান করে। অন্য দিকে, স্ট্রিং প্রতি মুহূর্তে স্থানের একটি লাইন বা রেখা বরাবর অবস্থান করে। দুটো স্ট্রিং জোড়া লেগে একটিমাত্র স্ট্রিং গঠিত হতে পারে। ওপেন স্ট্রিংদের ক্ষেত্রে এরা প্রান্ত বরাবর যুক্ত হয়। আর ক্লোজড স্ট্রিংদের ক্ষেত্রে এদের জোড়া ট্রাউজারের মতো দেখায়। একইভাবে একটিমাত্র স্ট্রিং ভেঙে দুটি আলাদা স্ট্রিং তৈরি হতে পারে।
স্ট্রিংই যদি মহাবিশ্বের মৌলিক বস্তু হয়, তাহলে আমরা বিভিন্ন পরীক্ষায় যে কণিকাদের দেখি তারা কী? স্ট্রিং থিওরি বলছে, আগে আমরা যাকে বিভিন্ন বিন্দু কণা বলতাম, সেটা আসলে স্ট্রিং এর বিভিন্ন তরঙ্গ ছাড়া কিছুই নয়, অনেকটা ঘুড়ির কম্পমান সুতোর মতো। তবে স্ট্রিং ও এর ওপর দিয়ে চলতে থাকা কম্পন এত ক্ষুদ্র যে আমাদের সেরা প্রযুক্তি দিয়েও এদের আকৃতি বুঝতে পারা অসম্ভব। ফলে আমাদের সব পরীক্ষায় এরা বৈশিষ্ট্যহীন ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো আচরণ করে। নিকট থেকে বা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে একটি বালুকণার দিকে তাকালে এতে হয়ত এলোমেলো ছোপ ছোপ দাগ দেখা যাবে, স্ট্রিং এর মতো আকৃতিও হয়ত দেখা যেতে পারে। কিন্তু দূর থেকে দেখলে একেও বৈশিষ্ট্যহীন বিন্দুর মতোই লাগবে।
একটি কণিকা দ্বারা আরেকটির নির্গমণ বা শোষণকে স্ট্রিং থিওরিতে স্ট্রিং এর বিভাজন বা সংযোজন হিসেবে দেখা হয়। যেমন কণা তত্ত্বে পৃথিবীর উপর সূর্যের মহাকর্ষীয় বলের ব্যখ্যা দেওয়া হয়েছিল এভাবে যে, সূর্যে উপস্থিত কোনো জড় কণিকা সূর্য থেকে বলবাহী কণা গ্র্যাভিটন নির্গত করে এবং পৃথিবীতে উপস্থিত কোনো জড় কণিকা তা শোষণ করে। স্ট্রিং থিওরিতে এই কাজটি হয় H আকৃতির নল বা পাইপের মাধ্যমে (এক অর্থে স্ট্রিং থিওরি বিল্ডিং এর পাইপ সিস্টেমের মতো)। H  এর খাড়া বাহু দুটি সূর্য ও পৃথিবীর কণিকার মতো কাজ করে, আর অনুভূমিক দাগটি হচ্ছে তাদের মধ্যে চলাচলকারী গ্র্যাভিটন।

স্ট্রিং থিওরির ফাইনম্যান চিত্র। [স্ট্রিং থিওরি বলছে যে দীর্ঘ পাল্লার বলগুলো বলবাহী কণিকা বিনিময়ের বদলে নলের সংযোগের মাধ্যমে কাজ করে।]
 স্ট্রিং থিওরির ইতিহাস বেশ আকর্ষণীয়। এর প্রথম উদ্ভব ঘটে ১৯৬০ এর দশকে। উদ্দেশ্য ছিল স্ট্রিং এর (সুতা বা দড়ি) টান বলের ব্যাখ্যা দেওয়ার তত্ত্ব খুঁজে বের করা। ভাবা হয়েছিল যে প্রোটন ও নিউট্রনের মতো কণিকাদেরকে স্ট্রিং এর তরঙ্গ মনে করা যেতে পারে। মাকড়সার জালের মতো এক স্ট্রিং এর বিটের মধ্যে চলে আসা অন্য স্ট্রিং এর টুকরোগুলোকে বিভিন্ন কণিকার মধ্যে ক্রিয়াশীল ‘সবল বল’ হিসেবে ধরা যেতে পারে। কণিকাদের মধ্যকার সবল বলের বাস্তব মান এই তত্ত্ব থেকে পেতে হলে স্ট্রিংদেরকে প্রায় দশ টন ওজোনের রবারের চুড়ির মতো হওয়া দরকার ছিল। ১৯৭৪ সালে প্যারিসের জোয়েল শের্ক ও ক্যালটেকের (ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) বিজ্ঞানী জন সোয়ার্জ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এতে তাঁরা দেখালেন যে স্ট্রিং থিওরি মহাকর্ষীয় বলের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। তবে শর্ত হল স্ট্রিং এর টান হতে হবে দশ হাজার কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি (এক এর পরে ৩৯ টি শূন্য) টন। সাধারণ দৈর্ঘ্যের স্কেলে স্ট্রিং থিওরির অনুমান সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে হুবহু মিলে যাবে। কিন্তু এক সেন্টিমিটারের এক লক্ষ কোটি কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগের (বা এক সেন্টিমিটারকে এক এর পরে ৩৩ টি শূন্য দিলে যা হয় সেই সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে যা হয়) চেয়ে ক্ষুদ্র দূরত্বে এদের অনুমান ভিন্ন হয়। কিন্তু তাঁদের এই গবেষণা খুব নজর কাড়েনি, কারণ প্রায় ঠিক একই সময়ে বেশির ভাগ মানুষ সবল বলের মূল স্ট্রিং থিওরিকে পরিত্যাগ করেন এবং পর্যেবেক্ষণের সাথে ভালো মিল দেখে কোয়ার্ক ও গ্লুওনভিত্তিক থিওরির দিকে ঝুঁকে পড়েন। একটি মর্মান্তিক অবস্থায় শের্ক মৃত্যুবরণ করেন (তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন এবং পরে এক সময় কোমায় চলে যান। দরকার ছিল ইনসুলিন নেওয়ার। কিন্তু আশেপাশে ইঞ্জেকশান দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।) ফলে স্ট্রিং থিওরির পক্ষে সোয়ার্জ হয়ে গেলেন একা। তবে তিনি স্ট্রিং এর টান বলের প্রস্তাবিত মান অনেক বেশি বৃদ্ধি করলেন।
১৯৮৪ সালে হঠাৎ করে স্ট্রিং থিওরি নতুন করে আলোচনায় চলে এল। এর পেছনে কাজ করেছে দুটি কারণ। এক, সুপারগ্র্যাভিটি সসীম অথবা এটি আমাদের পর্যবেক্ষণে পাওয়া কণিকাদের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম- এমন প্রমাণ পাওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না। দুই, জন সোয়ার্জ এবারে লন্ডনের কুইন মেরি কলেজের মাইক গ্রিনের সাথে যৌথভাবে আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এখানে তাঁরা দেখালেন, আমাদের দেখা কিছু কণিকার মতো যেসব কণিকারা সহজাতভাবেই বামধর্মী তাদের অস্তিত্ত্ব স্ট্রিং থিওরির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। (দর্পণের মধ্যে প্রতিফলিত করে পরীক্ষার পরিবেশ পাল্টিয়ে নিলেও বেশির ভাগ কণিকার  আচরণ একই থাকে, কিন্তু এই কণিকাদের আচরণ একই থাকে না। এরা হয় বাম, নয়ত ডানধর্মী। দর্পণ দিয়ে দেখলে তাই ভিন্ন রকম দেখায়।) কারণ যেটাই হোক, বিপুল সংখ্যক মানুষ স্ট্রিং থিওরি নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তৈরি হল নতুন আরেকটি সংস্করণ। আমরা বিভিন্ন ধরনের যেসব কণিকা দেখি এটি তার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম বলে মনে হল।
স্ট্রিং থিওরিগুলোও অসীম রাশি থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু মনে করা হয় এদের সঠিক সংস্করণটিতে অসীম রাশিগুলো কাটাকাটি হয়ে যাবে (যদিও নিশ্চিত নয়)। কিন্তু স্ট্রিং থিওরিগুলোতে এর চেয়েও বড় একটি সমস্যা আছে। এরা শুধু তখনই কাজ করে যখন স্থান- কালের মাত্রা সাধারণ চারের পরিবর্তে দশ বা ছাব্বিশ হয়। স্থান- কালের এই বাড়তি মাত্রাগুলো সায়েন্স ফিকশনে খুব সহজেই পাওয়া যায়। আর আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ভ্রমণ করার বিপক্ষে আপেক্ষিক তত্ত্ব যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছে তা অমান্য করারও কিন্তু একটি উপায় হল এটি (দশম অধ্যায় দেখুন)। কৌশলটা হল বাড়তি মাত্রার সুযোগ কাজে লাগিয়ে শর্টকাট বা সংক্ষিপ পথে ভ্রমণ করা। মনে করুন আমরা যে স্থানে বাস করছি তা শুধু দুটি মাত্রা নিয়ে গঠিত এবং আংটি বা ডোনাটের পৃষ্ঠের মতো বাঁকানো।
ডোনাটের (এক ধরনের পিঠা) আকৃতি।
 আপনি যদি এর বলয়ের ভেতরের প্রান্ত থেকে এর ঠিক উল্টো পাশের কোনো বিন্দুতে আসতে চান, তাহলে আপনাকে বলয়ের ভেতরের প্রান্ত বরাবর বৃত্ত অনুসরণ করে টার্গেটে পৌঁছতে হবে। কিন্তু তৃতীয় মাত্রায় ভ্রমণ করতে পারলে আপনি বলয় ধরে না এগিয়ে সোজা অপর পাশে চলে আসতে পারেন।
বাস্তবে যদি থেকেই থাকে তাহলে এই বাড়তি মাত্রাগুলোকে আমরা দেখি না কেন? আমরা কেন শুধু স্থানের তিনটি ও সময়ের একটি মাত্রা দেখি? এর উত্তরে বলা হয়, অন্যান্য মাত্রাগুলো আমাদের পরিচিত মাত্রা থেকে ভিন্ন। এরা খুব ক্ষুদ্র সাইজের স্থানের মধ্যে কুঞ্চিত হয়ে আছে, অনেকটা এক ইঞ্চির একশ কোটি কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগের দৈর্ঘ্যের মতো। এটা এত ক্ষুদ্র যে একে দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা সময়ের একটি ও স্থানের তিনটি মাত্রা দেখি, যেখানে স্থান- কাল প্রায় সমতল বা চ্যাপ্টা। এর ব্যাখ্যা বুঝতে হলে একটি স্ট্র (তরল পানীয় গ্রহণের জন্যে আমরা যে নল ব্যবহার করি) এর পৃষ্ঠের কথা ভাবুন। কাছ থেকে এর দিকে তাকালে আপনি এর পৃষ্ঠকে দ্বিমাত্রিক দেখবেন। অর্থ্যাৎ, স্ট্র এর মধ্যে অবস্থিত কোনো বিন্দুকে দুটি সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করা যায়। এরা হল এর দৈর্ঘ্য এবং বৃত্তাকার মাত্রার চারদিকে (পরিধি বরাবর) দূরত্ব। কিন্তু এর বৃত্তাকার মাত্রা এর দৈর্ঘ্যের চেয়ে অনেক ছোট হওয়াতে দূর থেকে দেখলে এর পুরুত্ব চোখে পড়ে না। মনে হয় এটি একটি একমাত্রিক বস্তু। অর্থ্যাৎ, এর উপরস্থ কোনো বিন্দুর অবস্থান বোঝানোর জন্যে শুধু এর দৈর্ঘ্য বলাই যথেষ্ট। তাই স্ট্রিং থিওরির সমর্থকরা বলেন, খুব ক্ষুদ্র স্কেলে স্থান- কাল দশটি মাত্রা নিয়ে গঠিত এবং এর বক্রতাও খুব বেশি। কিন্তু আরো বড় স্কেলে এই বাড়তি মাত্রাগুলোর বক্রতা দেখা যায় না।
এই ধারণ যদি সঠিক হয়, তবুও তা হবে ভবিষ্যৎ মহাকাশ যাত্রীদের জন্যে কোনো সুসংবাদ দিতে পারছে না। এই বাড়তি মাত্রাগুলো এত বেশি ক্ষুদ্র হবে যে এদের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানীদের জন্যেও এটি একটি সমস্যা জমা রেখেছে। সবগুলো মাত্রার বদলে অল্প কিছু মাত্রাই কেন ক্ষুদ্র জায়গায় গুটিয়ে থাকবে? খুব সহজেই বোঝা যায়, আদি মহাবিশ্বে সবগুলো মাত্রাই কুঞ্চিত ছিল। কিন্তু সময়ের একটি ও স্থানের তিনটি মাত্রাই কেন ছড়িয়ে পড়ল? অন্য মাত্রা গুলো কেন গুটিয়েই থাকল?
এর একটি সম্ভাব্য উত্তর হল অ্যানথ্রোপিক নীতি (anthropic principle)। সংক্ষেপে এর ব্যাখ্যা হল, ‘মহাবিশ্বকে আমরা এখন যে রূপ দেখছি তার কারণ হল আমাদের অস্তিত্ব আছে’। অ্যানথ্রোপিক নীতির আবার দুর্বল ও শক্তিশালী নামে দুটি আলাদা রূপ আছে। দুর্বল অ্যানথ্রোপিক নীতি অনুসারে, স্থান- কালের হিসাবে অনেক বড় বা অসীম মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণের বিকাশের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ শুধু নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলেই তৈরি হবে। ফলে এই অঞ্চলের বুদ্ধিমান প্রাণীরা নিজদেরকে বাসযোগ্য পরিবেশে দেখে মোটেই অবাক হবে না। এটা অনেকটা একজন ধনী ব্যক্তির স্বচ্ছল সমাজে বাস করার মতো, যে আশপাশে কোনো গরীব মানুষকে দেখতে পায় না।
কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে এই নীতির শক্তিশালী রূপটি উত্থাপন করেন। এই নীতি অনুসারে, হয় মহাবিশ্ব আছে অনেকগুলো, অথবা একটি মহাবিশ্বেরই অনেকগুলো অঞ্চল আছে। এদের প্রতিটির নিজস্ব প্রাথমিক পরিবেশ এবং সম্ভবত এক গুচ্ছ আলাদা সূত্র রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ মহাবিশ্বেই জটিল প্রাণী সৃষ্টির জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। আমাদের মতো অল্প কিছু মহাবিশ্বেই বুদ্ধিমান জীবদের জন্ম হয়েছে, যাদের প্রশ্ন, ‘আমরা যেমন দেখি, মহাবিশ্ব কেন এমন হল?’ এর উত্তর খুব সহজ। আমরা যেমন দেখছি মহাবিশ্ব যদি তেমন না হত, তাহলে আমরা থাকতামই না।
দুর্বল অ্যানথ্রোপিক নীতির বিপক্ষে কম লোকই আপত্তি করবেন। কিন্তু মহাবিশ্বের দেখা রূপের ব্যাখ্যায় শক্তিশালী অ্যানথ্রোপিক নীতির বিপক্ষে অনেকগুলো আপত্তি তোলা যেতে পারে। যেমন, এতগুলো মহাবিশ্ব থকার অর্থ ঠিক কী? এরা যদি একটি অপরটি থেকে আলাদা হয়, তাহলে অন্য কোনো মহাবিশ্বে কী ঘটছে তার কোনো প্রভাব আমাদের মহাবিশ্বে পড়ার কথা নয়। অতএব আমাদেরকে মিতব্যয়িতা অবলম্বন করে সেই মহাবিশ্বগুলোকে আমাদের তত্ত্ব থেকে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু এরা যদি একই মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে থাকে, তাহলে প্রত্যেকটি অঞ্চলেই বিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে একই হতে হবে। তা না হলে আমরা ক্রমাগত এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যেতে পারব না। এক্ষেত্রে এসব অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হবে এদের প্রারম্ভিক পরিবেশ। এর ফলে অ্যানথ্রোপিক নীতির শক্তিশালী রূপ দুর্বল রূপে পর্যবসিত হবে।
স্ট্রিং থিওরির বাড়তি মাত্রাগুলো কেন গুটিয়ে গেল তার একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা অ্যানথ্রোপিক নীতির মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের মতো জটিল প্রাণীদের সৃষ্টির জন্যে স্থানের মাত্র দুটি মাত্রা যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। যেমন বৃত্তে (একটি দ্বিমাত্রিক পৃথিবীর পৃষ্ঠে) বসবাসকারী প্রাণীরা একে অপরকে পার হয়ে যেতে হলে মাথার উপর দিয়ে যেতে হবে। আবার দ্বিমাত্রিক প্রাণিরা খাবার খাওয়ার পর তা পুরোপুরি হজমও করতে পারবে না। যে পথে এটি খাবার গিলেছে সে পথেই আবার তা বের করে দিতে হবে। এর কারণ হল, এর দেহের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত কোনো পথ থাকলে তা একে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলবে। আমাদের দ্বিমাত্রিক প্রাণীটির জন্যে সমবেদনা! একইভাবে এটা বোঝাও কঠিন যে দ্বিমাত্রিক প্রাণীর দেহে রক্ত সঞ্চালন কীভাবে হবে।

দ্বিমাত্রিক প্রাণীর খাদ্যনালির দুটি প্রান্ত থাকলে প্রাণীটিই দুই ভাগ হয়ে যাবে। ছবিঃ অনুবাদক, সূত্রঃ ইন্টারনেট।
আবার তিনের বেশি মাত্রা হলেও সমস্যা হবে। দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে এখানে মহাকর্ষ বলের মান তিন মাত্রার তুলনায় খুব দ্রুত কমবে। (আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতে দূরত্ব দ্বিগুণ হলে মহাকর্ষ চার ভাগের এক ভাগ হয়। চতুর্মাত্রিক জগতে তা আট ভাগের এক ভাগ হবে, পঞ্চমাত্রিক জগতে হবে ষোলো ভাগের এক ভাগ ইত্যাদি) এর ফলে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর মতো গ্রহদের কক্ষপথ হত অস্থিতিশীল। ফলে বৃত্তাকার কক্ষপথ থেকে সামান্য বিচ্যুতি (যা অন্যান্য গ্রহদের আকর্ষণে ঘটে) ঘটলেই পৃথিবী পেঁচিয়ে সূর্যের দিকে বা উল্টো দিকে চলে যেত। আমরা হয় ঠান্ডা হয়ে জমে যেতাম, নয়ত পুড়ে ছারখার হয়ে যেতাম।  এমনকি তিনের চেয়ে বেশি মাত্রায় দূরত্বের সাথে মহাকর্ষের কমতির কারণে সূর্য নিজেও ঠিক থাকতে পারত না। এর বাইরের দিকের চাপ ও মহাকর্ষ ভারসাম্য ধরে রাখতে পারত না। সূর্য হয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত, নয়ত গুটিয়ে গিয়ে ব্ল্যাক হোল হয়ে যেত। দুই ক্ষেত্রেই এটি পৃথিবীর জন্যে তাপ ও আলোর ভালো উৎস হতে পারত না। আবার ছোট পারমাণবিক জগতের ক্ষেত্রেও মহাকর্ষের মতোই ঘটনা ঘটবে। যে বলের কারণে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে তা বিপর্যস্ত হত, যার ফলে ইলেকট্রন হয় নিউক্লিয়াস ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেত, অথবা চলে আসত নিউক্লিয়াসের দিকে। দুই ক্ষেত্রেই আমাদের পরিচিত কোনো পরমাণু গঠিত হতে পারত না।
ত্রিমাত্রিক হবার গুরুত্ব। [স্থানের তিনের অধিক মাত্রার ক্ষেত্রে গ্রহদের কক্ষপথ অস্থিতিশীল হত, গ্রহরা হয় সূর্যের দিকে চলে যেত, নয়ত ছিটকে দূরে সরে যেত।]
এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আমরা অন্তত প্রাণ বলতে যা বুঝি, সেটা তৈরি হবার জন্যে সময়ের একটি এবং স্থানের তিনটি মাত্রাকে কোনোভাবেই গুটিয়ে থাকা চলবে না। এর অর্থ হচ্ছে আমরা দুর্বল অ্যানথ্রোপিক নীতি মেনে নিতে পারি। শর্ত হচ্ছে, আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে স্ট্রিং থিওরি মহাবিশ্বের এ রকম অঞ্চলের অনুমোদন দেয়। হতে পারে যে মহাবিশ্বের অন্য কোনো অঞ্চল বা অন্য কোনো মহাবিশ্বের (এর অর্থ যাই হোক না কেন) সবগুলো মাত্রাই গুটিয়ে আছে, অথবা চারের বেশি মাত্রা প্রায় সমতল অবস্থায় আছে। কিন্তু এসব অঞ্চলে ঠিক কয়টি মাত্রা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে তা দেখার জন্যে কোন বুদ্ধিমান জীব থাকবে না। মাত্রা ছাড়াও স্ট্রিং থিওরিতে আরেকটি সমস্যা আছে। স্ট্রিং থিওরির অন্তত পাঁচটি আলাদা সংস্করণ আছে (দুটি ওপেন স্ট্রিং নিয়ে এবং বাকি তিনটি ক্লোজড স্ট্রিং নিয়ে)। আর থিওরির অনুমিত বাড়তি মাত্রাগুলো লক্ষ লক্ষ ভিন্ন উপায়ে কুঞ্চিত থাকতে পারে। একটি বিশেষ স্ট্রিং থিওরিকেই কেন বেছে নেওয়া হবে, আর কোন ধরনের কুঞ্চনই বা সঠিক হবে? কিছু দিন ধরে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে সব অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়ল। ১৯৯৪ সালের দিকে আবার কিছু আবিষ্কার হাতে এল। একে বলা হচ্ছে ডুয়ালিটি বা দ্বৈততা। ভিন্ন ভিন্ন স্ট্রিং থিওরি এবং  বাড়তি মাত্রাদের বেঁকে যাওয়ার ভিন্ন ভিন্ন উপায় চার মাত্রার ক্ষেত্রে হয়ত একই ফলাফল দেবে। এছাড়াও স্থানের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে থাকা কণিকা এবং রেখার মতো স্ট্রিং ছাড়াও পি- ব্রেইন (p-brane) নামে কিছু বস্তু পাওয়া গেল। এরা দুই বা তার বেশি মাত্রার স্থানের আয়তনে থাকে।
(একটি কণিকার ব্রেইন ০ (p=0), স্ট্রিং এর ব্রেইন ১ এবং এভাবে p=2, থেকে p=9 পর্যন্ত আছে। ২-ব্রেইনকে দ্বিমাত্রিক মেমব্রেন মনে করা যেতে পারে। আরো বেশি মাত্রার কথা চিন্তা করা আরো কঠিন।) এসব থেকে মনে হচ্ছে সুপারগ্রাভিটি, স্ট্রিং ও পি-ব্রেইন থিওরির মধ্যে এক ধরনের গণতন্ত্র (বক্তব্যের সমান অধিকার থাকার অর্থে) কাজ করছে। এদেরকে সবগুলোকে ঠিক মনে হচ্ছে, কিন্তু কোনোটাকেই অন্য কোনোটার চেয়ে বেশি মৌলিক বলা চলে না। বরং সবগুলোই মনে হচ্ছে অন্য কোনো মৌলিক থিওরি থেকে আসা। প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় সঠিক।
এই মৌলিক তত্ত্ব খোঁজারও কম চেষ্টা চলেনি। কিন্তু এ পর্যন্ত সাফল্য ধরা দেয়নি। এমনও হতে পারে যে এক গুচ্ছ গাণিতিক স্বীকার্যের মাধ্যমে যে মৌলিক তত্ত্ব তৈরি করা সম্ভব, তার বাইরে মৌলিক তত্ত্বের কোনো একক রূপ নেই। বরং এটি হয়ত মানচিত্রের মতো- আপনি একটি সমতল ম্যাপে পৃথিবীর গোলাকার পৃষ্ঠ বা আংটির পৃষ্ঠের ছবি তুলতে পারবেন না। প্রতিটি বিন্দু দেখাতে হলে পৃথিবীর ক্ষেত্রে আপনার অন্তত দুটি ম্যাপ লাগবে, আর আংটির ক্ষেত্রে লাগবে চারটি ম্যাপ [৫]। প্রত্যেকটি ম্যাপ একটি সীমিত অঞ্চলে জন্যে সঠিক থাকবে। তবে ভিন্ন ভিন্ন ম্যাপের মধ্যেও কিছু অঞ্চল একই রকম হবে। সবগুলো ম্যাপ মিলিয়ে পৃষ্ঠের একটি পূর্ণ চিত্র তৈরি হবে। একইভাবে পদার্থবিদ্যায় হয়ত ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন সূত্র প্রযোজ্য হবে, কিন্তু দুটি আলাদা সূত্র আবার একই পরিবেশেও হয়ত কাজ করতে পারে।
এটা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে সবগুলো আলাদা সূত্রের সংগ্রহকে একটি পূর্ণ একীভূত তত্ত্ব বলা যেতে পারে, যদিও এই তত্ত্বটিকে একটিমাত্র বক্তব্যের মাধ্যমে লেখা যাবে না। প্রকৃতির কাছ থেকে এটাই হবে অনেক বড় পাওয়া। এটা কি সম্ভব যে বাস্তবে কোনো একীভূত তত্ত্বই নেই? আমরা মরীচিকার পেছনে ছুটছি নাতো? এখানে সম্ভাবনা আছে তিনটিঃ
এক, বাস্তবিকই একটি পূর্ণ একীভূত তত্ত্ব (অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিল আছে এমন কিছু সূত্রের সমাবেশ) আছে । আমরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান হলে এক দিন সেটা আবিষ্কার করতে পারব।
দুই, মহাবিশ্বের চূড়ান্ত কোনো তত্ত্ব নেই। একটির পর একটি তত্ত্ব হাতে আসে, যা মহাবিশ্বকে আরেকটু ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। এভাবে অসীম পর্যন্ত চলেও কখনো প্রকৃত তত্ত্ব পাওয়া যাবে না।
তিন, মহাবিশ্বের আসলে কোনো তত্ত্বই নেই, কোনো ঘটনার অনুমান একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত করা যাবে, তার বেশি নয়। ঘটনা ঘটে এলোমেলোভাবে।  কেউ কেউ তৃতীয় যুক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলবেন, যদি পূর্ণাঙ্গ এক গুচ্ছ সূত্র থেকে থাকে তবে তা হবে ঈশ্বরের স্বাধীন ইচ্ছায় বাধা হবে। এক্ষেত্রে তিনি ইচ্ছামতো তাঁর মন বদলিয়ে বিশ্বের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না [৬]
কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু সর্বশক্তিমান, তিনি কি চাইলেই নিজের স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করতে পারেন না? এর সাথে পুরাতন একটি প্যারাডক্সে কিছুটা মিল আছে। ঈশ্বরকি এমন কোনো পাথর বানাতে পারেন যা তিনি নিজেই তুলতে পারবেন না? সেন্ট অগাস্টিনের মতে, আসলে ঈশ্বর মন পরিবর্তন করবেন কি না এমন প্রশ্ন করা খোদ তাঁকেও সময়ের মধ্যে উপস্থিত হিসেবে কল্পনা করার সমতুল্য, যা একটি ভুল পদ্ধতি।  সময় হল ঈশ্বরের সৃষ্ট মহাবিশ্বের একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। ধরে নেওয়া যায় যে তিনি কী তৈরি করতে চাচ্ছিলেন তা ভালোমতোই জানতেন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবির্ভাবের ফলে আমাদেরকে মানতে হচ্ছে, কোনো ঘটনা সম্পর্কে একশো ভাগ নির্ভুল করে কিছু অনুমান করা সম্ভব নয়। সব সময় কিছু অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। আপনি চাইলে এই র‍্যান্ডম বা দৈব [৭] হস্তক্ষেপের জন্যে ঈশ্বরকে দায়ী করতে পারেন। কিন্তু এই হস্তক্ষেপটা বড়ই অদ্ভুত। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে এটি কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ সেক্ষেত্রে একে দৈব বলা যেত না। এখন আমরা বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যকে নতুন করে নির্ধারণ করেছি। ফলে তৃতীয় সম্ভাবনাটি বাদ পড়ে গেছে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন এক গুচ্ছ সূত্র বের করা, যা আমাদেরকে অনিশ্চয়তা নীতির বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে থেকে বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে অনুমান করে সহায়তা করবে।
অন্য দিকে, এত দিনের আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিতীয় সম্ভাবনাই পরিলক্ষিত হচ্ছে, অর্থ্যাৎ, সূত্রগুলো প্রতিনিয়ত পরিমার্জিত হবে। এভাবেই চলবে অসীম পর্যন্ত। বিভিন্ন সময় আমরা আমাদের পরিমাপের সূক্ষ্মতা বাড়িয়েছি অথবা নতুন নতুন পর্যেবেক্ষণ পেয়েছি। পেয়েছি এমন এমন নতুন পর্যবেক্ষণ, যা প্রচলিত তত্ত্ব অনুমানও করতে পারেনি। এই পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তৈরি করতে হয়েছে নতুন তত্ত্ব। এখন আমরা কোয়ার্ক ও ইলেকট্রনকে ‘মৌলিক’ কণিকা বিবেচনা করি। যেসব কণিকারা আরো বেশি বেশি শক্তি নিয়ে একে অপরের সাথে প্রতিক্রিয়া করে, তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করে হয়ত আমরা আরো মৌলিক কোনো স্তর খুঁজে পাব।
‘বক্সের ভেতরে বক্স’ জাতীয় এই ধারায় মহাকর্ষ হয়ত বাধ সাধতে পারে। আমাদের কাছে যদি এমন কোনো কণিকা থাকে যার শক্তি কথিত প্ল্যাঙ্ক এনার্জির চেয়ে বেশি, তাহলে এটি এত বেশি সঙ্কুচিত হবে যে এটি মহাবিশ্বের বাকি অংশ থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলবে, তৈরি করবে একটি ছোট্ট ব্ল্যাক হোল। কাজেই মনে হচ্ছে যে আরো বেশি বেশি পরিমার্জিত সূত্রের ধারার একটি সীমা আছে। এবং উচ্চ থেকে উচ্চতর শক্তি নিয়ে গবেষণা করতে করতে আমরা হয়ত মহাবিশ্বের চূড়ান্ত কোনো সূত্রের দেখা ঠিকই পাব। কিন্তু এখনো আমরা পরীক্ষাগারে যে শক্তি প্রস্তুত করতে পারি, প্ল্যাঙ্ক এনার্জি তা থেকে অনেক দূরে। আমাদের অনুমিত ভবিষ্যতেও পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর (যেখানে বিভিন্ন কণিকাকে উচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে বেগ বাড়িয়ে সংঘর্ষ ঘটানো হয়) এই গ্যাপ পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক সময়গুলোতে এই শক্তি নিশ্চয় ছিল। মহাবিশ্বের আদি অবস্থা নিয়ে গবেষণা করে তা গাণিতিকভাবে সুসঙ্গত উপায়ে তুলে ধরতে পারলে যে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্ব পাব তার সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। এবং তা হতে পারে আমরা যারা এখন বেঁচে আছি তারা থাকতে থাকতেই, যদি না আমরা তার আগেই নিজেদেরকে ধ্বংস করে ফেলি!
মহাবিশ্বের চূড়ান্ত তত্ত্ব আবিষ্কারের ফল কী হবে? তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে  আমরা যদি সঠিক তত্ত্বটি পেয়েও যাই, আমরা বুঝতেও পারব না এটাই সেই কাঙ্ক্ষিত তত্ত্ব, কারণ তত্ত্ব প্রমাণ করা যায় না [৮]। কিন্তু যদি তত্ত্বটি গাণিতিকভাবে সুসঙ্গত হয় এবং এর অনুমান পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে যায়, তাহলে আমরা ধরে নিতেই পারি যে এটাই সত্যিকারের সূত্র। এর ফলে ইতিহাসের সেই গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়টির ইতি ঘটবে যা মহাবিশ্বের কলাকৌশল উদ্ঘাটন করার বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে ভরপুর। পাশাপাশি মহাবিশ্বের সূত্রগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জ্ঞানের জগতেও বিপ্লব ঘটবে।
নিউটনের সময়েও একজন শিক্ষিত মানুষ সবগুলো জ্ঞান আয়ত্ত্বে রাখতে পারতেন, অন্তত মূলনীতিগুলো জানতেন। কিন্তু তার পর থেকে বিজ্ঞানের গতি এই কাজটিকে অসম্ভব করে তুলেছে। যেহেতু সব সময় নতুন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তত্ত্বের পরিবর্তন ঘটে, তাই এই তত্ত্ব কখনোই সাধারণ মানুষের বোঝার মতো সহজ হয় না। বুজতে পারেন শুধু বিশেষজ্ঞরাই, এবং তার পরেও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর অল্প অংশই বুঝে ওঠা সম্ভব। উপরন্তু, অগ্রগতি এত দ্রুত হচ্ছে যে আপনি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা জানতে পারছেন তাও কিছুটা সেকেলে হয়ে পড়ে। অল্প কিছু মানুষই জ্ঞানের পরিধি বেড়ে যাবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন। এটা করতে গিয়ে তঁদেরকে পুরো সময়টা একটি বিশেষ দিকের প্রতি ঝুঁকে থাকতে হয়। বাকি মানুষরা নতুন নতুন অগ্রগতি সম্পর্কে কমই জানতে পারেন, তার উত্তেজনাও অনুভব করেন কম। অন্য দিকে বিজ্ঞানী এডিংটনের মত অনুসারে, সত্তর বছর আগে মাত্র দুই ব্যক্তি আপেক্ষিক তত্ত্ব বুঝতেন। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববদ্যালয় পাস করা হাজার হাজার শিক্ষার্থী তা বোঝে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্তত এই ধারণার সাথে পরিচিত। একইভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্ব পাওয়া গেলে মুহূর্তের মধ্যেই সবাই এটি বুঝে ফেলবে, পড়ানো হবে স্কুলেও, অন্তত প্রাথমিক ধারণাটুকু। তখন আমরা কিছুটা বুঝতে পারব যে মহাবিশ্ব কোন সূত্রগুলো দিয়ে চলছে এবং আমরাইবা কীভাবে এলাম।
যদি আমরা একটি সম্পূর্ণ একীভূত থিওরি হাতে পাইও, তবু এর মাধ্যমে যে সব ধরনের ঘটনা সম্পর্কে অনুমান করা যাবে তা কিন্তু নয়। এর পেছনে আছে দুটো কারণ। প্রথমটি হচ্ছে অনিশ্চয়তা নীতি, যা আমাদের অনুমানের ক্ষমতাকে খর্ব করে দেয়। আমরা কোনোভাবেই এর হাত থেকে বাঁচতে পারি না। তবে দ্বিতীয় কারণটি আরো বেশি মারাত্মক। বাস্তবে এমন তত্ত্বের সমীকরণ শুধু সরল ক্ষেত্রগুলোতে সমাধান করা যায়। আগেও আমরা বলেছি, কোনো পরমাণুর একটি নিউক্লিয়াস ও একের বেশি ইলেকট্রনের জন্যে কোয়ান্টাম সমীকরণের প্রকৃত সমাধান বের করা যায় না। এমনিক, নিউটনের সহজ- সরল মহাকর্ষ তত্ত্ব থেকেও আমরা তিনটি বস্তুর গতির সমাধান বের করতে ব্যর্থ। বস্তুর সংখ্যা আরো বাড়লে এই কাজ হয়ে পড়ে আরো কঠিন, তত্ত্ব হয়ে পড়ে জটিল থেকে জটিলতর। বাস্তবে আসন্ন সমাধান (প্রকৃত সমাধানকে সরল করে কাছাকাছি একটি মান বের করা) দ্বারা কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু সকল কিছুর একীভূত তত্ত্ব পাওয়ার আকাশচুম্বী প্রত্যাশাতো এর মাধ্যমে পূরণ হয় না।
বর্তমানে আমরা জেনে ফেলেছি যে কোন সূত্রগুলো বস্তুর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে চরম অবস্থায় (extreme condition) এ সূত্রদের প্রভাব কী হবে তা জানা সম্ভব হয়নি। যেমন, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের সবগুলো মৌলিক সুত্র আমরা জানি। এর পরেও আমরা চূড়ান্তভাবে বলতে পারি না যে এদের সমাধান পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেছে। তার উপর মানুষের আচরণকে গাণিতিক সমীকরণ দ্বারা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বলা চলে আমরা প্রায় ব্যর্থ। ফলে আমরা এক গুচ্ছ মৌলিক সূত্র যদি পাইও, তবে তার আগে বহু বছর ধরে প্রচলিত সূত্রগুলো থেকে ক্রমেই বেশি নির্ভুল আসন্ন মান পাওয়ার মতো কঠিন কাজটি করে যেতে হবে। তাহলে আমরা বিভিন্ন ঘটনার জটিল ও বাস্তবে ক্ষেত্রে উপযোগী অনুমান তৈরি করতে পারব। একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুসঙ্গত একীভূত তত্ত্ব পাওয়ার মাধ্যমে মাত্র এক ধাপ কাজ হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বসহ চারপাশে যেসব ঘটনা ঘটছে তার পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান।
 [অনুবাদকের নোটঃ
১। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকমঃ কল্পনা করুন যে কোন দিন কটায় সূর্য উঠবে আমরা তা জানি না, যার ফলে প্রতি দিন সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় এটি কটায় উঠে তা দেখার জন্যে। বাস্তবে এটা আমরা জানি। সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয়ের সময় বলার মতো তত্ত্ব আমাদের কাছে আছে। কিন্তু ইলেকট্রনের ভর বলার মতো তত্ত্ব নেই। এটা জানতে হয় পর্যবেক্ষণ থেকে। অর্থ্যাৎ তথ্য পাওয়ার দুটো উৎস আছে। একটি হল তত্ত্ব, আরেকটি হল পর্যবেক্ষণ। অবশ্য পর্যবেক্ষণ থেকেই ধীরে ধীরে তত্ত্বের জন্ম হয়।
২। আমরা জানি, নক্ষত্রের জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় ধরে এর মধ্যে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেনরা নিজেদের সাথে যুক্ত হয়ে হিলিয়াম হতে থাকে। এর ফলে তৈরি বাইরের দিকের চাপ নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় টানকে প্রতিহত করে। কিন্তু এই ভারসাম্য বজায় থাকার পেছনে ইলেকট্রনের চার্জের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
৩। দুই বা তিন ভর বিশিষ্ট হাইড্রোজেন, অর্থ্যাৎ যথাক্রমে ডিউটেরিয়াম ও টিট্রিয়ামও স্থিতিশীল থাকত , কারণ এদের মধ্যেও প্রোটন একটি করেই থাকে, বেশি থাকে একটি করে নিউট্রন, যার কোনো চার্জ নেই বলে আকর্ষণ বা বিকর্ষণের মাধ্যমে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা এর নেই।
৪। গ্লুওন (gluon) শব্দটির সাথে glue এর মিল আছে, যার অর্থ আঠা, বা আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো। যেহেতু এই কণাটি কোয়ার্কদের জোড়া লাগিয়ে নিউট্রন ও প্রোটন গঠন করে, তাই বলা যায় নামটি সার্থক হয়েছে।
৫। কারণ এর উপরের দিকে একটি পৃষ্ঠ, আবার ভেতরের দিকেও আংটির ভাঁজের কারণে আরেকটি পৃষ্ঠ আছে।
৬। কিন্তু এমনতো হতেই পারে যে ঈশ্বর আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন যে সূত্র দিয়ে দেবার পর তিনি আর মহাবিশ্বের কোনো কর্মকাণ্ডে নাক গলাবেন না বা মন পরিবর্তন করবেন না, অন্তত নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। অথবা এমনও হতে পারে যে তিনি যে পরে কিছু সময়ের জন্যে  আর নাক গলাবেন না বা মন পরিবর্তন করবেন না, এটাও সূত্রেররই অংশ হবে।
৭। গাণিতিক পরিসংখ্যানের ভাষায় সে ঘটনাকে দৈব বলা হয়, যেটি ঘটবে কি না নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, বড়জোর ঘটার একটি সম্ভাবনা বলা যাবে।
৮।  অর্থ্যাৎ, কোনো তত্ত্ব আসলে ঠিক কি না তা আমরা বলতে পারি না, আমরা শুধু বলতে পারি একে এখনো ভুল বলার মতো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।]



কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-১২


দ্বাদশ অধ্যায়ঃ উপসংহার
আমরা যে জগতে বাস করছি তা আসলে বড়ই অদ্ভুত। আমরা চারপাশে যা ঘটতে দেখছি তার ব্যাখ্যা জানার জন্যে উদগ্রীব। মহাবিশ্বের স্বভাব কেমন? এতে আমাদের অবস্থান কোথায়? মহাবিশ্ব এবং আমরা কোথা থেকে এলাম? আমরা যেমন দেখছি, সব কিছু কেনইবা এমন হল?
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমরা জগত সম্পর্কে কিছু ধারণা তৈরি করি। সমতল একটি পৃথিবীকে বহু সংখ্যক কাছিমের টাওয়ারের মাথায় অবস্থিত বলে ধরে নেওয়াও এমন একটি ধারণা। আবার সুপারস্ট্রিং থিওরিও একটি ধারণা। দুটি থিওরিরই উদ্দেশ্য মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করা। কিন্তু আগেরটির চেয়ে পরেরটি অনেক বেশি গণিত নির্ভর এবং বেশি সূক্ষ্ম। কোনোটির পক্ষেই নেই পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ। কেউ কখনো এমন কোনো দৈত্যাকার কাছিমকে দেখেনি, যে তার পিঠে পৃথিবীকে পিঠে বসিয়ে রেখেছে। আবার কেউ কিন্তু কখনও সুপারস্ট্রিংও দেখেনি। কিন্তু কাছিম তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে কার্যকর নয়,কারণ এটি সঠিক হলে মানুষ পৃথিবীর প্রান্তে গিয়ে নিচে পড়ে যেত। আমাদের প্রাত্যাহিক অভিজ্ঞতা থেকে এমন কিছু দেখা যায় না, যদি না বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের ভাগ্যে এমনটি ঘটে থাকে!
মহাবিশ্বের ব্যাখ্যায় সর্বপ্রথম যে তত্ত্বটি দাঁড় করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল বিভিন্ন প্রাকৃতকি ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে আত্মারা। এদের মধ্যে মানুষের মতো আবেগ আছে। এরা মানুষের স্টাইলেই কাজ করে, কিন্তু কখন যে কী করবে সেটা আগে থেকে বলা যায় না। এই আত্মাদের বাস বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুতে। এই যেমন নদী, পাহাড় এবং সূর্য ও চন্দ্রসহ আকাশের বস্তুরা। কৃষি জমির উর্বরতা ও ঋতুর পরিবর্তনের জন্যে এই আত্মাদেরকে শান্ত রাখতে হত এবং প্রার্থনা করতে হত। আস্তে আস্তে দেখা গেল, সব কিছু নিয়ম মেনেই চলছে। দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ না করলেও সূর্য সব সময় পূব দিকেই উঠছে এবং পশ্চিমে ডুবে যাচ্ছে। এছাড়াও সূর্য, চন্দ্র এবং গ্রহরা আকাশের নির্দিষ্ট পথ ধরে চলছে। আকাশের এসব ঘটনা আবার অনেকটা নির্ভুলভাবে আগে থেকেই বলা যায়। সূর্য ও চন্দ্র যদি দেবতাও হয় তবু তারা এমন দেবতা, যারা কিছু নিয়ম খুব শক্তভাবে মেনে চলে। এতে কোনো দৃশ্যমান ব্যতিক্রম চোখে পড়ছিল না, যদিও সূর্যের থেমে যাবার একটি ব্যতিক্রম গল্প দেখা যায় বাইবেলের জোশুয়ার গল্পে।

চিত্রঃ কাছিম থেকে বক্র স্থান।[মহাবিশ্বের প্রাচীন ও আধুনিক ধারণা]
 এই নিয়ম ও সূত্রগুলো শুরুতে শুধু জ্যোতির্বিদ্যা ও এর বাইরের অল্প কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সভ্যতার উন্নতি হলে, বিশেষ করে গত তিন শতকে যে উন্নতি হল, তাতে আরো বেশি সূত্র আবিষ্কৃত হল। এই সূত্রগুলোর সাফল্যে মুগ্ধ হয়েই ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ল্যাপ্লাস বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদ (scientific determinism) প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বললেন যে এমন কিছু সূত্র থাকবে, যা দ্বারা কোনো এক সময়ের মহাবিশ্বের অবস্থা জেনে ফেলার পর সঠিকভাবে এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করা যাবে। ল্যাপ্লাসের নিশ্চয়তাবাদ দুইটি কারণে অসম্পূর্ণ ছিল। প্রথমত, এতে বলা ছিল না যে সূত্রগুলো কীভাবে বাছাই করা হবে। দ্বিতীয়ত, এটি মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থাও নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি। কাজগুলো রেখে দেওয়া হয়েছিল ঈশ্বরের জন্যে। ঈশ্বরই ঠিক করবেন কীভাবে মহাবিশ্বের শুরু হবে এবং একে কোন সূত্রগুলো মেনে চলতে হবে। একবার মহাবিশ্বের শুরু হয়ে গেলে ঈশ্বর আর এই সূত্রগুলোতে নাক গলাবেন না। সত্যি বলতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান যা বুঝতে পারেনি তা ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
আমরা এখন জানি যে বাস্তবে ল্যাপ্লাসের নিশ্চয়তাবাদ সম্ভব নয়, অন্তত তিনি যে ভাষায় বুঝতেন সেই অর্থেতো নয়ই। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তা নীতি বলছে, কিছু যুগপৎ রাশি যেমন, অবস্থান ও বেগ, একই সাথে পুরোপুরি নির্ভলভাবে জানা সম্ভব নয়। এই পরিস্থতিতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এক গুচ্ছ কোয়ান্টাম সূত্র দিয়ে কাজ করে, যাতে কণিকাদের সুনির্দিষ্ট কোনো অবস্থান ও বেগ থাকে না। বরং এদেরকে বিবেচনা করা হয় তরঙ্গ হিসেবে। এই কোয়ান্টাম থিওরিগুলো এই অর্থে ‘পূর্বনির্ধারিত’ যে এদের মাধ্যমে সময়ের সাথে সাথে তরঙ্গের পরিবর্তন জানা যায়। কাজেই, আমরা কোনো এক সময়ে তরঙ্গের অবস্থা জেনে নিয়ে অন্য সময়ে এর অবস্থা বের করতে পারি। অনুমানের অতীত এবং অনিয়মতান্ত্রিক ঘটনা তখনই ঘটে যখন আমরা তরঙ্গকে কণার অবস্থান ও বেগের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করি। কিন্তু হতে পারে আমরা ভুল করছি। হয়ত কণিকাদের কোনো বেগ বা অবস্থান নেই, আছে শুধুই তরঙ্গ। হয়ত আমরা আমাদের মনে আসন গেঁড়ে থাকা অবস্থান ও বেগের পূর্বধারণা দিয়ে তরঙ্গকে বুঝতে চাচ্ছি। এতে করে বাস্তবতার সাথে যে অমিল তৈরি হয় তার ফলেই আমরা অননুমেয়তার (unpredictability) সম্মুখীন হই।
ফলে আমরা বিজ্ঞানের দায়িত্ব কী হবে তা নতুন করে ঠিক করেছি। এর কাজ হবে অনিশ্চয়তা নীতির সীমার মধ্যে থেকেই কোনো ঘটনা সম্পর্কে অনুমান করতে পারার মতো সূত্র আবিষ্কার করা। প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে: কীভাবে ও কেন মহাবিশ্বের সূত্রগুলো এবং আদি অবস্থা বাছাই করা হয়েছিল?
এই বইয়ে মহাকর্ষ সূত্রের দিকে একটু বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর কারণ, এই মহাকর্ষই মহাবিশ্বের বড় স্কেলের কাঠামো নির্ধারণ করে, যদিও চার প্রকারের বলের মধ্যে এটিই সবচেয়ে দুর্বল। কিছু দিন আগ পর্যন্তও যে অপরিবর্তনশীল মহাবিশ্বের ধারণা প্রচলিত ছিল, তা মহাকর্ষীয় সূত্রের সাথে খাপ খাচ্ছিল না। যেহেতু মহাকর্ষ সব সময় আকর্ষণ করে, তাই মহাবিশ্ব হয় প্রসারিত নয়ত সঙ্কুচিত হতে থাকবে। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে অসীম ঘনত্বের একটি পরিবেশ নিশ্চয়ই ছিল। এখান থেকে বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে সময়ের শুরু। একইভাবে মহাবিশ্ব গুটিয়ে গেলে ভবিষ্যতে আবারো অসীম ঘনত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে সময় বিলুপ্ত হবে। এই ঘটনাকে বলা হয় বিগ ক্রাঞ্চ (big crunch) বা মহা ধ্স। যদি মহাবিশ্বের পুরোটা নাও গুটিয়ে যায়, তবু নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল গুটিয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরির মাধ্যমে সিঙ্গুলারিটি তৈরি হবে। বিগ ব্যাং ও অন্যান্য সিঙ্গুলারিটিগুলোতে সবগুলো সূত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে। ফলে মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হবে বা কী ঘটবে তাতে ঈশ্বরের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে মিশ্রিত করলে নতুন একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়, যা আগে ছিল না। স্থান ও কাল মিলিত হয়ে হয়ত এমন একটি সসীম ও চতুর্মাত্রিক স্থান তৈরি হতে পারে, যাতে কোনো সিঙ্গুলারিটি বা সীমান্ত নেই। এটা হবে পৃথিবীর পৃষ্ঠের মতো, তবে মাত্রা হবে আরো বেশি। দেখা যাচ্ছে এই পদ্ধতিতে মহাবিশ্বের অনেগুলো পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। যেমন গ্যলাক্সি, নক্ষত্র এবং মানুষ ইত্যাদিসহ বড়ো দৈর্ঘ্যের হিসাবে মহাবিশ্ব সব দিকে একই রকম দেখায় কেন এবং ছোট স্কেলে কেন এটি এই বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে।  কিন্তু মহাবিশ্ব যদি হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ (self- contained), যেখানে কোনো সিঙ্গুলারিটি বা সীমান্ত (প্রান্ত) থাকবে না এবং যাকে একটি একীভূত থিওরি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে, তাতে স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সাপেক্ষ।
আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় ঈশ্বরের স্বাধীনতা কতটুকু ছিল?’যদি স্ট্রিং থিওরির ভাষ্য সঠিক হয় এবং আসলেই প্রান্ত না থাকে তাহলে আদি অবস্থা বাছাই করার ক্ষেত্রে করতে ঈশ্বর স্বাধীন ছিলেন না। এরপরেও অবশ্য ঈশ্বর নিজের ইচ্ছেমতো মহাবিশ্বের জন্যে সূত্রগুলো তৈরি করার স্বাধীনতা রাখেন। অবশ্য এই স্বাধীনতা হয়ত খুব বেশি ছিল না। হতে পারে মাত্র একটি অথবা স্ট্রিং থিওরির মতো অল্প কিছু সংখ্যক পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্ব আছে, যেগুলো সুসঙ্গত এবং মানুষের মতো জটিল প্রাণীর সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করে, যারা মহাবিশ্বের সূত্রগুলো নিয়ে গবেষণা করে এবং ঈশ্বর সম্পর্কে প্রশ্ন করে।
আর যদি মাত্র একটি সম্ভাব্য একীভূত তত্ত্বই থেকে থাকে, তবে তাও হবে কিছু নিয়ম ও সমীকরণের সমাবেশ। সেই সমীকরণগুলোকে বাস্তবে নিয়ে এসে তাদেরকে মেনে চলার মতো মহাবিশ্ব কে তৈরি করবে। গাণিতিক মডেল তৈরির প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে ব্যর্থ যে কেন কোনো একটি মডেলকে মেনে চলার মতো একটি মহাবিশ্ব থাকবে। মহাবিশ্বের অস্তিত্ত্বই থাকবে কেন? একীভূত তত্ত্ব কি এতটা শক্তিশালী যে এটি নিজেই নিজেকে তৈরি করে। অথবা এর কি স্রষ্টার প্রয়োজন আছে এবং যদি প্রয়োজন থাকে তাহলে মহাবিশ্বের উপর কি তাঁর অন্য কোনো প্রভাব আছে? এবং তাহলে তাঁকে কে সৃষ্টি করেছে?
এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম এমন নতুন তত্ত্ব তৈরি করতে গিয়ে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে এই কেন জাতীয় প্রশ্নগুলো করার সময় তাঁদের হয় না। অন্য দিকে এই কেন জাতীয় প্রশ্ন করার কাজ যারা করেন, সেই দার্শনিকরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দার্শনিকরা বিজ্ঞানসহ জ্ঞানের পুরো ক্ষেত্রকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করতেন। মহাবিশ্বের শুরু আছে কি নেই- এই জাতীয় প্রশ্নগুলো করতেন। কিন্তু ঊনিশ ও বিশ শতকে এসে বিজ্ঞান এতটা টেকনিক্যাল ও গণিত নির্ভর  হয়ে পড়েছে যে অল্প কিছু বিশেষজ্ঞ ছাড়া দার্শনিক বা অন্য কারো পক্ষে তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। দার্শনিকরা তাঁদের প্রশ্নের জগতকে এতটা সীমিত করে ফেলেছেন যে বিংশ শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক ভিটজেনস্টাইন বলেছিলেন, ‘দার্শনিকদের জন্যে ভাষা নিয়ে গবেষণা করা ছাড়া আর কিছুই বাকি রইল না।‘ দর্শনের ঐতিহ্য এরিস্টটলের থেকে কান্ট পর্যন্ত এসে এভাবেই মুখ থুবড়ে পড়ল!
যদি আমরা একটি একীভূত তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারি, তবে সেটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝার উপযোগী হতে হবে, শুধু কিছু বিজ্ঞানীকে বুঝলেই চলবে না। তখন বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং সাধারণ মানুষ- সবাই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনায় অংশ নিতে পারবেন। আমরা যদি এই উত্তর পাই, তবেই তা হবে মানুষের বুদ্ধির জগতের চূড়ান্ত বিজয়, কারণ তখনই আমরা ঈশ্বরের মন (mind of God) জানতে পারব।
[অনুবাদকের নোটঃ
১। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অধিকাংশ রহস্যই আসলে রহস্য না। এখানে যে পরিমাণ দূর্ঘটান ঘটেছে তা এত বেশি হারে জাহাজ বা বিমান চলাচল করা একটি এলাকার জন্যে খুবই স্বাভাবিক। ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর ন্যাচার নৌযান চলাচলের জন্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রধান দশটি জলপথের তালিকা তৈরি করে। এই তালিকায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের স্থান হয়নি। আমেরিকান নেভির মতে এমন কোনো অঞ্চলের বাস্তবে অস্তিত্বই নেই। এমন না যে লেখকদ্বয় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে বিশ্বাসী, বরং তাঁরা একটুখানি রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারেননি।
২। অর্থ্যাৎ, এমন কোনো অংশ নেই যাতে অন্য কোনো অংশের সাথে অমিল আছে।
৩। অর্থ্যাৎ একবার সৃষ্টি করে ফেলার পর পরে আর মহাবিশ্বে হস্তক্ষেপ করেন কি না।
৪। অনেক সময় এই সমস্যার জবাব দেওয়া হয় এভাবে যে সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞাই হল, তাঁকে কেউ সৃষ্টি করেনি। যেমন একজন চিত্রকর (painter) একটি ছবি আকঁল। ছবি সম্পর্কে প্রশ্ন করা যায় যে একে কে এঁকেছে। কিন্তু চিত্রকর সম্পর্কে বলা যায় না যে বা চিত্রকরকে কে এঁকেছে? চিত্রকরের জন্যে ‘আঁকা’ শব্দটা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। ]

 অনুবাদকের পরিচিতি:
15822441_1225598204200440_226368786_nআব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ। পাই জিরো টু ইনফিনিটির মাধ্যমে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির শুরু। বর্তমানে লিখছেন ও কাজ করছেন প্রথম আলো পরিবারের মাসিক বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বিজ্ঞান চিন্তায়।পাশাপাশি নিয়মিত লিখছেন জিরো টু ইনিফিনিটি , ব্যাপন ও অনলাইন বিজ্ঞান পোর্টাল বিজ্ঞান পত্রিকায়। বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করণ ও সহজে উপস্থাপন করার জন্যে তৈরি করেছেন অনলাইন পোর্টাল বিশ্ব ডট কম (www.bishwo.com)।
প্রিয় শখঃ জ্ঞানার্জন (বিশেষ করে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান) ও রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ।
পড়াশোনাঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ।
ফেসবুকঃ Facebook.com/mahmud.sbi
পৈত্রিক নিবাসঃ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ঝাউডগী গ্রাম।