Thursday, August 31, 2017

জীবনের উত্থান-পতন: আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে আবি সারাহ

আবদুল্লাহ ইবনে সাদ, তিনি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর ছেলে নন, তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-এর দুধ ভাই, মিশরের গভর্নর। প্রথম মুসলিম নৌবাহিনী তৈরির পিছনে তাঁর অবদান ছিল, এবং আফ্রিকার বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবার অবদান রাখেন। কিন্তু তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হন রসূল (সাঃ)-এর প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশের জন্য, আল কুরআনের উপর অবিশ্বাস স্থাপনের জন্য। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরিবর্তীতে ইসলাম ত্যাগ করে অবিশ্বাসীতে পরিণত হন, যাকে ইসলামী পরিভাষায় মুরতাদ বলা হয়। কিন্তু তিনি পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামী খেলাফতের অধীনে বিশ্বস্ততার সহিত দায়িত্ব পালন করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে সাদ কবে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন:
ইবনে আল আথির (১১৬০-১২৩২~৩৩) তার উসুদ উল-ঘাবাহ ফি মারেফাত ইস- সাহাবাহ (The Lions of the Forest and the knowledge about the Companions) বইয়ে বর্ণনা করেন-

He converted to Islam before the conquest of Mecca and immigrated to the Prophet(P) [i.e. in Medina]. He used to record the revelation for the Prophet(P) before he apostatized and went back to Mecca. Then he told Quraysh: ‘I used to orient Muhammad wherever I willed, he dictated to me “All-Powerful All-Wise” and I suggest “All Knowing All-Wise” so he would say: “Yes, it is all the same. [Ibn al-Athîr, Usûd Ulghâbah fî Ma’rifat Is-Sahâbah, 1995, Dâr al-Fikr, Beruit, Lebanon, Volume 3, p. 154.]
অনুবাদ – "তিনি মক্কা বিজয়ের কিছু কাল আগে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবীর নিকট হিজরত করেন। তিনি মুরতাদ হয়ে মক্কায় ফিরে আসার আগ পর্যন্ত নবীর উপর নাজিল হওয়া ওহী লিখে রাখতেন। (মক্কায় ফিরার পর) তিনি কুরাইশদের উদ্দেশ্য করে বললেন, "আমি মুহাম্মদের (সা:) জন্য লিখে রাখতাম যেখানেই চাইতাম, তিনি আমাকে আদেশ করলেন 'সর্বশক্তিমান সর্ব জ্ঞানী' লিখতে, কিন্তু আমি পরামর্শ দিলাম 'সব জানা সর্বজ্ঞ' তখন তিনি বলতেন হ্যাঁ এটি এই রকমই।"
এখান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি মক্কা বিজয়ের কিছু আগে ইসলাম গ্রহণ করেন, তা অবশ্যই হিজরতের পরে এবং পরবর্তীতে ইসলাম ত্যাগ করে মক্কায় ফিরে আসেন।
তিনি কবে ইসলাম পুনঃগ্রহণ করেন:
ইমাম আবু জাফয়ার মুহাম্মদ বিন জারির আল তাবারী (৮৩৮-৯২৩) তার "জামি উল-বায়ান ফি তাফসির আল কুরান" বইয়ে বর্ণনা করেন,
Abdullah Ibn Sâd Ibn Abî Sarh converted back to Islam before the conquest of Mecca by the Prophet. [Abû Jacfar Muhammad bin Jarîr al-Tabarî, Jâmic ul-Bayân fî Tafsîr Il-Qur’ân, Volume 5, published by Wizârat ul-Ma’rifah, The Ministry of Education, Beirut, Lebanon]
অনুবাদ – "ইসলামের নবী মক্কা বিজয়ের কিছু আগেই আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ইসলাম পুনরায় গ্রহণ করেন।"
এ থেকে প্রমাণিত হয় আবদুল্লাহ ইবনে সাদ সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় ইসলাম পুনরায় গ্রহণ করেন। কারণ ঠিক মক্কা বিজয়ের সময় কালে তাকে প্রভাবিত করার কোন মুসলিম সামরিক শক্তি তার আশেপাশে ছিল না।
পরবর্তী জীবন:
ইমাম আল কুরতবী (১২১৪-১২৭৩) বর্ণনা করেন: According to Abû Omar, "cAbdullâh Ibn Sâd Ibn Abî Sarh converted back to Islam during the conquest of Mecca and his Islam was fine, and later, his behavior was beyond reproach.He was among the wise and the noble from Quraysh, and was the knight of Banî 'Aamir Ibn Lu'ayy was respected among them. Later, 'Uthmân named him to govern Egypt in the year 25 H. He conquered Africa in the year 27 H and conquered Nuba in the year 31 H and he was the one who signed with the Nubites the armistice that is still valid today. He defeated the Romans in the battle of as-Sawaary in the year 34 H. When he returned from his advent, he was prevented from entering al-Fustât [the capital of Egypt], so he went to ‘Asqalân where he lived until the murder ofcUthmân(R). It was also said: he lived in Ramlah until he died away from the turmoil. And he prayed Allah saying: “O Allah make the prayer of subh the last of my deeds. So he performed wudu and prayed; he read Surat al-Fâtihah and al-‘Aadiyât in the first rak’ah and read al-Fâtihah and another sûrah in the second rak’ah and made salâm on his right and died before he made salâm on the left side. All this report was conveyed by Yazîd Ibn Abî Habîb and others. He didn’t pledge allegiance tocAlî nor to Mu’âwiyah (RR). His death was before the people agreed on Mu’âwiyah. It was also said that he died in Africa, but the correct is that he died in ‘Asqalân in the year 36 H or 37 H and it was rather said 36 H. [al-Qurtubî, Al-Jâmic li Ahkâm Il-Qur’ân, Volume 7, page 40-41]
অনুবাদ – "আবু উমরের ভাষ্য অনুসারে, আবদুল্লাহ ইবনে সাদ মক্কা বিজয়ের সময় কালে ইসলাম পুনঃগ্রহণ করেন, তাহার ইসলাম ভাল ছিল এবং তাহার পরবর্তী কার্যক্ষম ইহা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। তিনি ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে জ্ঞানী এবং অভিজাত, এবং বনী আমির ইবনুল লুয়াই এর একজন যোদ্ধা এবং সম্মানিত মানুষ। ২৫ হিজরিতে হযরত উসমান (রাঃ) তাকে মিশরের গভর্নর নিয়োগ করেন। তিনি ২৭ হিজরিতে আফ্রিকা বিজয় করেন এবং ৩১ হিজরিতে নুবা জয় করেন এবং তিনি নুবার অধীবাসীদের সাহিত যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করেন যা এখনো বর্তমান। তিনি ৩৪ হিজরির আস সাওয়ারীর যুদ্ধে রোমানদের পরাজিত করেন। (তিনি নিজের কাজকর্ম ডিফেন্ড করার জন্য মদিনার পথে ছিলেন, কিন্তু মদিনায় সমস্যা দেখে ফেরত আসেন) যখন তিনি পুনরাগমণ করেন, তখন তিনি আল ফুসতাত(মিশরের রাজধানী) শহরে ঢুকতে বাধাপ্রাপ্ত হন, এ জন্য তিনি আসকালানে চলে যান, যেখানে তিনি হযরত উসমান (রাঃ) শহীদ হবার আগ পর্যন্ত থেকে যান। এও বলা হয়েছিল যে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রামাল্লা শহরে বসবাস করেছিলেন। এবং তিনি আল্লাহ পাকের নিকট পার্থনা করেছিলেন, আমাকে দিয়ে সাহাবাদের প্রতি দোয়া চাওয়া যেন আমার শেষ দিন হয়; এজন্য তিনি উজু করেন এবং নামাজে দাঁড়ান, তিনি নামাজের প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহা এবং আল আদিয়াত পড়েন, দ্বিতীয় রাখাতে সূরা ফাতিহা এবং আরেকটি সূরা পড়েন, তিনি ডান দিকে সালাম ফিরান, তারপর বাম দিকে সালাম ফেরার আগেই ইহজগত ত্যাগ করেন। এইসব রিপোর্ট ইয়াজিদ বিন আবু হাবিব ও অন্যদের থেকে প্রাপ্ত। তিনি আলী (রাঃ) অথবা মুয়াবিয়া (রাঃ) কারো প্রতি একমত প্রকাশ করেননি। এবং তাহার মৃত্যু হয় হযরত মুয়াবীয়া (রাঃ)-এর প্রতি সবার ঐক্যমতের আগে। ইহা বলা হয়েছিল তিনি আফ্রিকায় মারা যান কিন্তু সঠিক হল তিনি আসকালানে মৃত্যুবরণ করেন ৩৬ অথবা ৩৭ হিজরিতে এবং এটা ৩৬ হিজরি বলা যেতে পারে।"
অভিযোগ:
আবদুল্লাহ ইবনে বাইদায়ই (১২৭৬) তার তফসিরে বর্ণনা করেন,

"'To me it has been revealed', when naught has been revealed to him" (Sura al-An`am 6:93) refers to `Abdallah Ibn Sa`d Ibn Abi Sarh, who used to write for God's messenger. The verse (23:12) that says, "We created man of an extraction of clay" was revealed, and when Muhammad reached the part that says, "… thereafter We produced him as another creature (23:14), `Abdallah said, "So blessed be God the fairest of creators!" in amazement at the details of man's creation. The prophet said, "Write it down; for thus it has been revealed." `Abdallah doubted and said, "If Muhammad is truthful then I receive the revelation as much as he does, and if he is a liar, what I said is a good as what he said." [Anwar al-Tanzil wa Asrar al-Ta’wil by `Abdallah Ibn `Umar al-Baidawi, সূত্র: Answering Islam]
অনুবাদ – "ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় জালেম কে হবে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলে: আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে।" (আল কুরআন, ৬:৯৩) উক্ত আয়াত আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে আবি সারাহকে উদ্দেশ্য করে, যে রাসূল পাকের (সাঃ) জন্য লিখত। আয়াত ২৩:১২ যেখানে বলা হয়েছে, "আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি," তা নাজিল হয়েছিল এবং নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যখন এই আয়ত পর্যন্ত বললেন, এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি।" আব্দুল্লাহ বলে উঠলেন "নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়" তখন নবী বলে উঠলেন ইহাও লিখে ফেল, এও নাজিল হয়েছে।"
=>এই দাবীর স্বপক্ষে কিছু ভিন্নরূপে কুরতবীর বর্ণনাও পাওয়া যায়।
=> "সীরাত রাসূল আল্লাহ" এ ইবন হিসাম (মৃ. ২১৮ হি./৮৩৩ খৃ.) ও "কিতাব আল তাবাকাত আল কাবীর" এ ইবন সা’দের (মৃ. ২৩০ হি./৮৪৫ খৃ.) বিবরণে আমরা শুধু আব্দুল্লাহর মদিনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ ও মুরতাদ হয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন এবং মক্কা বিজয়ের পর তার উপর বিরাজিত মৃত্যু-দণ্ডাদেশের বিবরণ পাই। তাছাড়া, ওসমানের (রাঃ) মধ্যস্থতায় আব্দুল্লাহর দণ্ডাদেশ মাওকুফ করার কথা আছে।
বিশ্লেষণ:
(১) ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে
কারো কথার সাথে নিজের কথা মিললে কিছুই প্রমাণ হয় না। তাছাড়া, আব্দুল্লাহর কথা-বার্তার ধরণ থেকে স্পষ্ট হয় যে তিনি ওহীর প্রকৃতি বুঝতে পারেননি। এখানে ওহী, বিশ্বাস, texualisation, textuality শানে নুজুলের সাথে টেক্সটের সম্পর্ক ইত্যাদির মধ্যে যে সমন্বয় কাজ করে – তা মনে হয় তার বুঝের অনেক দূরে ছিল। কোরআন ২৩ বৎসর ব্যাপী বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাজিল হয়েছিল। প্রত্যেক ঘটনার পূর্বেই অনেক ‘কথা-বার্তা’ হত, আলোচনা হত। কোরান যখন নাজিল হত তখন সেই আলোচ্য বিষয়ের শব্দ ও বাক্যাংশ ওহীতে প্রতিফলিত হত। এই পর্যায়ের কোন বাক্য বা বাক্যাংশকে উলুমুল কোরআনে ‘বি-লিসানে কাজা/ফুলান’ নামে চিহ্নিত হয়। এমনও হয়েছে যে দুই-এক বিষয়ে ওমর (রা.) মন্তব্য প্রকাশ করেছেন এবং পরে দেখা গিয়েছে যে সেই অবিকল বাক্যে আয়াত নাজিল হয়েছে। এমন দু/চারটি আয়াতকে ‘নুজিলা বি-লিসানি ওমর’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এমনটি অন্য দু-এক জনের ব্যাপারেও হয়েছে। ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনায় এটা এক অতি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য যে, যে বিষয়ের উপর আপনি কথা বলবেন/লিখবেন তাতে ইতোপূর্বে আলোচিত শব্দ ও বাক্যাংশ ব্যবহৃত হবে। লেখার জগতে বিশেষ করে discourse এনালিসিসে এটাকে texuality বলা হয়। গোটা কোরআনই আরবী ভাষায় এবং বিশেষ করে ‘বি-লিসানি’ কোরাইশ। আরেকটি কথা হল এই যে আমরা যদিও কোরানের আয়াতগুলো পাশাপাশি দেখছি কিন্তু পাশাপাশি দুটি আয়াতের মধ্যবর্তী সময় সম্পর্কে জ্ঞাত নাও হতে পারি। দুটি আয়াতের মধ্যবর্তী সময়ের দূরত্ব দিন, সপ্তাহ, মাস এমনকি আরও বেশি হতে পারে। তাছাড়া অনেক বাক্য আমরা নিজেরা বলি এবং লিখি কিন্তু সেই একই বাক্য অন্য স্থানেও দেখতে পাই – এটাই ভাষাতাত্ত্বিক বাস্তবতা। আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবি সারফ যে বাক্যটির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিলেন বলে দেখতে পাওয়া যায়, সেই বাক্য তো অবিকলভাবে ওমর (রাঃ)-ও বলেছিলেন। অর্থাৎ এই বাক্য, ‘فتبارك الله أحسن الخالقين’ কিন্তু কই ওমর (রাঃ) তো এটা বলেননি যে আমিও এমন বাক্য বলেছি সুতরাং "আমিও তো পারি"। মূল ব্যাপার হচ্ছে ওহী এবং ওহীর উপর ‘বিশ্বাস", বিশ্বাসের বাইরে সন্দেহের চিন্তা করতে গেলে সেখানে সন্দেহের এক বিস্তৃত ক্রমধারা এসে হাজির হতে পারে। নবীদের উপর যা নাজিল হচ্ছিল সেই বস্তুতেও তারা সন্দেহ করতে পারতেন। যে জিব্রাঈল (আঃ) তাদের সামনে আসতেন, তিনি জিব্রাঈল (আঃ) নাকি জিব্রাঈল (আঃ) না, তা কীভাবে স্থির করবেন? তিনি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসছেন – এটা কীভাবে নিশ্চিত হবে? আল্লাহ স্বয়ং এসেও যদি বলেন, ‘আমি আল্লাহ এবং এই হচ্ছে আমার বাণী’, তবে তা কীভাবে নিশ্চিত করবেন? সুতরাং নবীদেরকেও এইসব বিষয় “বিশ্বাস” করতে হয়েছে। আমাদের মধ্যে তাদের লক্ষ-যোজন ফাঁক থাকা সত্ত্বেও তারা ছিলেন আমাদের মতো “বিশ্বাসী”। ‘আমানার রসুলু বিমা উনজিলা ইলাইহিম’ –রসুলদের উপর যা নাজিল করা হত, তারা তার উপর “বিশ্বাস” করতেন। ব্যাপারটা যে কত জটিল ও গভীরের ব্যাপার তা কি অনুমান করতে পারছেন? মাক্কী জীবনের প্রথম থেকেই যারা নবীর (সাঃ) সাহচর্যে ছিলেন এবং একনিষ্ঠভাবে ওহীতে প্রাপ্ত তাওহীদ, রেসালত ও আখেরাতের বিষয়াদি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন এবং বিশ্বাস ও আমলের সুগভীরে গিয়েছিলেন, সাহচর্যের দৃষ্টিতে এঁরাই ‘সাহাবি’ এবং এঁরা যা অর্জন করেছিলেন তা অতি ব্যস্ত জীবনে নব্য মুসলিমদের অনেকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই সাহচর্যের গভীরে পৌঁছাও মামুলী বিষয় ছিল না। সুল্লাতুল আওয়ালিন ও সুল্লাতুল আরিখিনদের মধ্যকার পার্থক্য এখানে। বিনা হিসেবে যারা বেহেস্তে যাবেন, তাঁরা সেই প্রথম পর্যায়ের। এঁরাই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ‘খাইরু উম্মাহ’, আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবি সারাহ মক্কা থেকে মদিনায় গিয়েই তার লেখার স্কিলের মর্যাদা পেয়েই হয়ত ভেবেছিলেন সবকিছু বুঝে ফেলেছেন। কিন্তু ঈমানের ব্যাপার লেখা-পড়া জানার সাথে নয়। তাই তার ‘সন্দেহ’ ঈমানকে গিলে ফেললে, যা হওয়া সম্ভব, যা বলা সম্ভব তা'ই তিনি করেছেন ও বলেছেন। এমনটি স্বাভাবিক।
(২) ঘটনা সম্পর্কে দলিল কী বলে
প্রথমেই যে আয়াত সম্পর্কে উপরের কথাগুলি সে আয়াত সম্পূর্ণ দেখে নিই,
"ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় জালেম কে হবে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলেঃ আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ তার প্রতি কোন ওহী আসেনি এবং যে দাবী করে যে, আমিও নাযিল করে দেখাচ্ছি যেমন আল্লাহ নাযিল করেছেন। যদি আপনি দেখেন যখন জালেমরা মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকে এবং ফেরেশতারা স্বীয় হাত প্রসারিত করে বলে, বের কর স্বীয় আত্মা! আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহর উপর অসত্য বলতে এবং তাঁর আয়াত সমূহ থেকে অহংকার করতে।" (আল কুরান ৬:৯৩)
এই আয়াতটি একটি মাক্কি সূরার আয়াত, তবে এই নিয়ে সামান্য কিছু মতবিরোধ আছে। নতুন পাঠকদের সুবিধার্থে আল কুরানের যে সব সূরা মক্কায় নাজিল হয়েছে, তাদেরকে মাক্কি সূরা বলা হয়; এবং যে সব সূরা মদিনায় নাজিল হয়েছে, তাদেরকে মাদানী সূরা বলা হয়। উপরে উল্লেখ করেছি, আবদুল্লাহ ইবনে সাদ মদিনায় এসে মুসলিম হয়েছিলেন। তাছাড়া, অনেক রেওয়াতেই উল্লেখ করা হয়েছে ৬:৯৩ আয়াতটি ভণ্ড নবী মুসাইলামা এবং এ ধরণের নবী দাবী করা ব্যক্তিদের শানে নাজিল হয়েছিল। [Muhammad Ghoniem & M S M Saifullah]
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, কোন সূরা কোথায় নাজিল হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে ইসলামী পরিভাষায় "আসবাব উন-নজুল" বা "Asbâb un-Nuzûl" নামে একটি সাবজেক্ট রয়েছে। এই সাবজেক্টের উপর অন্যতম বই আল ইতকান ফি উলুম ইল কুরান, লিখেছেন জালালউদ্দিন আল সুয়ুতি (১৪৪৫-১৫০৫) যেখানে বলা হয়েছে সূরা ২৩ [যে সূরার ১২ আয়াতে আবদুল্লাহ কিছু সংযোজন করেছেন বলে দাবী করা হয়] পুরাটাই মক্কান। [Jalaluddîn as-Suyûtî, Al-Itqân fî cUlûm il-Qur’ân, (In Two Volumes), First Edition, Dâr al-Kutub al-cIlmiyyah, Beirut Lebanon, p. 82] তাছাড়াও, ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের বইয়ে সূরা মু’মীনের ব্যাপারে বলা হয়েছে ‘১১৮ আয়াত ৬ রুকূ সম্বলিত সূরা মু’মীন মক্কায় অবতীর্ণ’ [কুরানুল করীম, ২য় খণ্ড, ঢাকা: ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, পৃ ৬৪৭] তারমানে যে আয়াতের প্রক্ষিতে আব্দুল্লাহ বিন সাদ ইসলাম ত্যাগ করেছেন বলা হচ্ছে, সে আয়াত আবদুল্লাহ বিন সাদ ইসলাম গ্রহণের বহু আগেই নাজিল হয়েছে।
এটা হতে পারে রাসূল (সাঃ) পুরাতন সূরা আবদুল্লাহ ইবনে সাদকে দিয়ে আবার লিখাচ্ছিলেন। তাহলে পুরাতন সূরা আবদুল্লাহ ইবনে সাদের পরামর্শের আগেই নাজিল হওয়া সেটার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে সাদ নিজেই নিজেকে ভুল বুঝিয়েছেন। এমনও হতে পারে যে, আবদুল্লাহ ইবনে সাদ অবচেতন মনে কোথাও সেই আয়াত তেলোয়াত করতে শুনছেন, এবং অবচেতন ভাবে ঐ কথা বলে, পরবর্তীতে নিজেই নিজেকে ভুল বুঝিয়েছেন।
কিছু বিবেচ্য বিষয়:
আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ছিলেন শিক্ষিত ব্যক্তি। কারুর সন্দেহ, উনার ১০ম প্রপিতা লু’আই এর এক ছেলে মাক্কায় পৌত্তলিকতা শুরু করেছিলেন। মক্কায় আবদুল্লাহর সময় কালে শিক্ষিত ব্যক্তি কম থাকায়, আবদুল্লাহকে পুরোহিতের মত ব্যক্তি ধরা যায়, কারণ তিনি অভিজাত এবং একই সাথে বনী আমির ইবনে লু'আই গোত্রের একজন যোদ্ধা ছিলেন। তার পিতা সাদ একজন মুনাফিক ছিলেন বলে আল মারিফ রিপোর্ট করেন [Al-Ma`ārif, Page 131, শিয়া রেফারেন্স] যদিও এই রেফারেন্সের বক্তব্য আমার নিকট ঠিক সেভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। (কারণ নিচে বর্ণিত)
তাছাড়া, সোলেমানিয়া বুক হাউস কর্তৃক প্রকাশিত, আল্লামা শিবলী নোমানী রহঃ রচিত- বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী ৫৩৬ পৃঃ অনুসারে, আব্দাল্লাহ ইবন সাদ ইসলাম ত্যাগ করে কাফেরদের সাথে মিলিত হয়ে ইসলামের প্রতি মিছামিছি দোষারূপ করে লোকদেরকে ইসলাম হতে বিরত রাখার প্রোপাগাণ্ডায় রত ছিলেন।
উল্লেখ্য যে, মারাফ ফাউন্ডেশন [শিয়া রেওয়াত] আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে আবি আবি সারাহ আর্টিক্যালে বলা হয়েছে, আবদুল্লাহ মিশরে অত্যাচার করেছিলেন, যা মুহাম্মদ বিন হুজাইফিয়ার বিরোধের কারণ হয়। তার অত্যাচারের কারণেই মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের উপর রাগান্বিত ছিল। অবশেষে মিশরের লোকজন আবদুল্লাহ ইবনে সারাহকে অপসারাণ করার জন্য এক দল লোক মদিনায় পাঠায় [ঠিক হজ্বের আগে কেন?]। ইতিহাস বলে লোক-দল ঠিক হজ্বের সময় মদিনায় অবস্থান করছিল, এবং হযরত উসমান রাঃ হত্যায় অংশগ্রহণ করেছিল। সে হিসাবে হযরত উসমান রাঃ এর শহীদ হবার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী করা যায়।
শেষকথা:
আবদুল্লাহ ইবনে সাদের ইসলাম গ্রহণ-ত্যাগ-পুনঃগ্রহণ অতি সংক্ষিপ্ত সময় কালের মধ্যে হয়েছিল। এটা নিয়ে তেমন অভিযোগ করার মত কিছু নেই। তিনি আল কুরানের উপর যে অভিযোগ তুলে ছিলেন, তা নিতান্তই তার নিজের মনগড়া এবং তার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুল ছিল।
ইসলাম পুনঃগ্রহণের পর আবদুল্লাহ ইবনে সাদের জীবন ঘটনা পূর্ণ। এই ঘটনাগুলির মধ্যে মিশরের গভর্নর হিসেবের সময় কাল অগ্রগণ্য। এটা সত্য তার মধ্যে তখন ইসলাম পরিপন্থী সরাসরি ব্যক্তিগত কাজের মধ্যে কিছু দেখা যায়নি। আবার এটাও সত্য তার শাষন কালে মিশরবাসী খলিফার দরবারে অভিযোগ পাঠাতে লোকবল পাঠায়। হতে পারে তিনি ইসলাম তখনো পুরোপুরি বুঝে উঠেননি। আবার এমন হতে পারে তিনি ইসলাম বুঝতেন কিন্তু তিনি পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। তাই আবদুল্লাহ ইবনে সাদের ২য় জীবনকে অন্তত দু'ভাবে করা যায়। (ক) তিনি ভাল মানুষ ছিলেন এবং ভাল মুসলিম ছিলেন। (খ) তিনি খারাপ মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে শিয়া রেফারেন্সগুলি তাকে খারাপ বানাতেই ব্যস্ত। কিন্তু শিয়া রেফারেন্সগুলি মাঝে মধ্যেই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয়ে থাকে। তাই শিয়া রেফারেন্স গ্রহণ করার আগে অন্তত অনেকবার ভাবা উচিত।
তাই আপনারাই ভেবে নিন কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন।
কৃতজ্ঞতা:
লেখার মূল ভিত্তি নেওয়া হয়েছে Muhammad Ghoniem & M S M Saifullah, Abdullah Ibn Sad Ibn Abi Sarh: Where Is the Truth? Islamic Awareness দেখা হয়েছে এখান থেকে http://www.islamic-awareness.org/Quran/Sources/Sarh/ এবং Ahmed, M. m000ahmed@aol.com. Abdullah ibn Amr bin Abi Sarh. 3rd October 2012
শিয়া সোর্স: মারাফ ফাউন্ডেশন, Abdullah Ibn S'ad, দেখা হয়েছে এখান থেকে
http://www.maaref-foundation.com/english/library/pro_ahl/imam01_ali/biography_of_imam_ali/081.htm