Tuesday, August 29, 2017

হিস্টেরিয়া না জিনের আছর!

রিপোর্ট : ডাঃ আবু ইসহাক আজাদ


জিনের আছর,ভূতে ধরা,মা কালী ভর করাবাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে আনাচে কানাচে এই সমস্যাগুলো প্রায়ই শোনা যায় ।জিন কিংবা ভূতে ধরা রোগী অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে । চিকিৎসার অংশ হিসেবে সাধারনত কবিরাজ বা ওঝা ডেকে আনা হয় । সেই কবিরাজ অমানুষিক অত্যাচারের মাধ্যমে চিকিৎসা চালায়,যার ফলে রোগীর শারীরিক অনেক ক্ষতি হয় এমনকি কখনো কখনো মারাও যায় । চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় হিস্টেরিয়া কিংবা সিজোফ্রেনিয়ার রোগের বিভিন্ন সিম্পটমের সাথে জিনের আছরের লক্ষনগুলো মিলে যায় । আসুন এই রোগগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি ।

হিস্টেরিয়া (Hysteria) গ্রিক শব্দ হিস্টেরাবা জরায়ু থেকে উৎপত্তি হয়েছে হিস্টেরিয়াশব্দের। একসময় মনে করা হতো নারীর জরায়ুর কোন অস্বাভাবিক অবস্থার কারনেই হিসটিরিয়ার সৃষ্টি। পরবর্তীতে একে মানব মনের একধরণের সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। অনেক সময় একে কনভার্সন ডিসঅর্ডার বা কনভারসন ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডারবলা হয় । কনভারসন ডিসঅর্ডারে শারীরিক লক্ষণহাত-পা অবশ, কথা বলতে না পারাপ্রভৃতি নিয়ে রোগের প্রকাশভঙ্গি দেখা যায়। যদিও প্রকৃতপক্ষে শারীরিক কোনো সমস্যা থাকে না। আর ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডারে বিভিন্ন মানসিক লক্ষণ দেখা যায়যেমন, ভুলে যাওয়া, নিজের পরিচয় মনে করতে না পারা, নিরুদ্দেশে চলে যাওয়া, পূর্বের স্মৃতি ভুলে যাওয়া প্রভৃতি।

আমাদের অবচেতন মনের কিছু অবদমিত সহজাত কামনার সঙ্গে আমাদের সামাজিক আচারের সংঘাত ঘটে। সৃষ্টি হয় সহ্যাতীত উৎকণ্ঠা ও মানসিক চাপ। ফলে আমাদের অজ্ঞাতেই কিছু মানসিক ক্রিয়া সেই সহজাত কামনাগুলোকে দমন করে। যখন কোনো কারণে মানসিক ক্রিয়াশক্তি দুর্বল হয়ে যায়, তখন সেই অবাঞ্ছিত অবদমিত কামনাগুলো সজ্ঞান চেতনায় উঠে আসতে চায়। শুরু হয় দ্বন্দ্ব, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানা শারীরিক লক্ষণে। কারও কারও মতে, সামাজিক বিধিনিষেধ যখন আমাদের কামনা-বাসনাগুলোকে অবদমিত করে রাখে, তখন সেই অবদমিত কামনা-বাসনাগুলো অন্যভাবে (শারীরিক লক্ষণ হিসেবে) প্রকাশ পায়; তখন হয় হিস্টেরিয়া।

মস্তিষ্কের বাঁ ও ডানদুটি অংশ থাকে। যখন কোনো কারণে দুই অংশের কাজে সমন্বয়হীনতা ঘটে, তখন হিস্টেরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। মস্তিষ্কের ব্যাসাল গ্যাংলিয়াথ্যালামাস’—এ দুটি অংশকে হিস্টেরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ধারণা করা হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে যদি কাউকে নিপীড়ন করা হয়, কেউ যদি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, কাউকে যদি কোনো কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং এসব ক্ষেত্রে তারা যদি বিষয়টি প্রকাশ করতে না পারে, উপযুক্ত প্রতিকার না পায়, তবে অবদমিত ক্ষোভ ও ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তি থেকে হিস্টিরিয়া দেখা যেতে পারে।

একটি কেস স্টাডি পর্যালোচনা করা যাক ।এই ওয়েবসাইটে ঘটনাটি পেয়েছি ।ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষার্থী মিতু হঠাত্ করেই বলতে লাগল, তার খুব খারাপ লাগছে। বলতে বলতেই গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। সবাই ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিল। তার দুই চোখ শক্ত করে বন্ধ। নিঃশ্বাস নিতে লাগল খুব জোরে জোরে, যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হাজারো ডাকাডাকি, চোখেমুখে পানির ঝাপটা, তবু সে চোখ খুলল না। শক্ত করে বন্ধ থাকা তার দুই চোখ পিটপিট করছে কেবল। বাবা-মা অস্থির হয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন কাছের একটি হাসপাতালে। পরীক্ষা করে চিকিত্সক তাঁদের জানালেন, মিতু সম্ভবত হিস্টেরিয়া রোগে ভুগছে।

মিতুর ঘটনার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারেযেমন সামনে তার এইচএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো নয় কিন্তু তার এই খারাপ প্রস্তুতিটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তার মধ্যে তৈরি হয়েছে তীব্র মানসিক চাপ ও উত্কণ্ঠা। আর সেই মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার শারীরিক লক্ষণের মধ্য দিয়ে। আবার এমনটাও হতে পারে যে সে তার এক সহপাঠীকে পছন্দ করে, কিন্তু তার বাবা-মা সেই সম্পর্ক মেনে নিতে পারছেন না। আবার মিতুও তার বাবা-মার মতের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাই তার মনের অন্তর্দ্বন্দ্বগুলো শারীরিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আবার এমনটাও হতে পারে, মিতু তার বাড়িতে বা কলেজে বা কোচিংয়ে কারও দ্বারা ক্রমাগত উত্ত্যক্ত হচ্ছে, কিন্তু লজ্জায় সে কাউকে তা বলতে পারছে না। তখন বলতে না পারা কথাগুলো তার মনে তৈরি করছে মানসিক চাপ ও দ্বন্দ্ব, যার প্রকাশ ঘটছে শারীরিকভাবে।

এইরকম আরো অসংখ্য কারন (মানসিক দ্বন্দ্ব) এর কারনে হিস্টেরিয়া হয়ে যেতে পারে। প্রথম পিরিয়ড হওয়ার সময় কাউকে লজ্জায় কিছু বলতে না পারা থেকে হিস্টেরিয়া হতে পারে । বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সম্পর্কে মুখ বুজে থাকা, কারো সাথে শেয়ার করতে না পারার কারনে হিস্টেরিয়া হতে পারে । আনোয়ারা সৈয়দ হকের লেখা মানসিক সমস্যার গল্পবইটাতে ৩০ বছর বয়স্ক এক হিস্টেরিয়া রোগীর গল্প বর্ননা করা হয়েছে । মহিলার স্বামীর সাথে তার বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি । তার স্বামীর যৌবন তখন শেষ হয়ে গেছে । মহিলার সাথে তিনি আর শারীরিক মিলন করতে পারেননা। কিন্তু মহিলাটির যৌবন তো আর শেষ হয়নি, তিনি তো আর অক্ষম নন । স্বামীর অক্ষমতার কারনে তিনি কেন সুখ থেকে বঞ্চিত হবেন ? এটা এমন এক সমস্যা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ মেয়েই এই সমস্যার কথা কাউকে বলতে পারেনা । গল্পের ভিক্টিম কাউকে কিছু বলতে না পেরে শেষ পর্যন্ত হিস্টেরিয়ার রোগীতে পরিনত হয়েছিল এবং ডাক্তার আনোয়ারা সৈয়দ হকের চেম্বারে এসেছিল ।  
এদেশে নারীরা এমনিতেই সামাজিক ভাবে নানা সময় লাঞ্ছনা, অবহেলা বা শারীরিক অত্যাচারের স্বীকার হন যার ফলে প্রধানত মহিলাদেরকেই হিস্টেরিয়া রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এই সকল ক্ষেত্রে রোগীকে ঝাড়ফুকের জন্য সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে নেওয়া উচিত কিংবা ডাক্তার দেখানো উচিত ।   জহির রায়হানের লেখা হাজার বছর ধরেউপন্যাসটি আমাদের সময়ে SSC এর সহপাঠ হিসেবে ছিল । এই উপন্যাসে মজু ব্যাপারীর মেয়েকে একদিন ভূতে ধরে । ভূত ছাড়ানোর জন্য তাকে গনু মোল্লার কাছে নিয়ে আসা হয় ঝাড়ফুক করার জন্য। বইটা থেকে কোট করছি।
কাল ভোর সকালে পরির দীঘীর পাড়ে শুকনো ডাল পাতা কুড়োতে গিয়েছিলো মেয়েটা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল মেয়ে আর ফিরে না। ওদিকে মেয়ের মা তো ভেবে আকুল। বয়স্কা মেয়ে কে জানে আবার কোনো বিপদে পড়লো। প্রথমে ওকে দেখলো কাজি বাড়ির থুরথুরে বুড়িটা। লম্বা তেঁতুল গাছের মগডালে উঠে দুপা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে টেনে টেনে দিব্যি গান গাইছে মেয়েটা। বুড়ি তো অবাক, বলি লজ্জা শরমের কি মাথা খাইছ? দিন দুপুরে গাছে নাহি উইঠা গীত গাইবার লাগছ। ও মাইয়্যা, বলি লজ্জা শরম কি উইঠা গেছে দুনিয়ার ওপর থ্যাইকা?
বুড়ি যত চিৎকার করে মরে, মেয়ে তত শব্দ করে হাসে। সে এক অদ্ভুত হাসি। যেন ফুরোতেই চায় না। খবর শুনে মজু ব্যাপারি নিজে ছুটে এলো দীঘির পাড়ে। নিচে থেকে আবার মেয়ের নাম ধরে বারবার ডাকল সে। সখিনা, মা আমার নাক-কান কাটিছ না মা, নাইম্যা আয়। বাবকে দেখে ওর গাঁয়ের ওপর থুতু ছিটিয়ে দিলো সখিনা। তারপর খিলখিল শব্দে হেসে ওঠে বললো, আর যামু না আমি। এইহানে থাকুম। ওমা কয় কী। মাইয়্যা আমার এই কী কথা কয়? মেয়ের কথা শুনে চোখ উল্টে গেলো মজু ব্যাপারির।থুরথুরে বুড়ি এতক্ষন চুপ করে ছিলো। সহসা বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়লো সে, লক্ষন বড় ভালো না ব্যাপারি। মাইয়্যারে তোমার ভুতে পাইছে।

খবরদার বুড়ি বাজে কথা কইস না। ওপর থেকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানালো সখিনা। বেশি বক বক করলে ঘাড় মটকাইয়া দিমু।এ কথার পরে কারো সন্দেহের আর অবকাশ রইলো না। বুড়ি বললো, এ বড় ভালো লক্ষণ নয়, জলদি কইরা লোকজন ডাহ। লোকজন ডাকার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। কারণ হাঁক-ডাক শুনে ততক্ষণে গ্রামের অনেক লোক এসে জড়ো হয়ে গেছে সেখানে। বুড়ো ছমির মিয়া বললো, দাঁড়ায়া তামাশা দেখতাছ ক্যান মিয়ারা, একজন উইঠ্যা যাও না ওপরে। কে উঠবে, কে উঠবে না তাই নিয়ে বচসা হল কিছুক্ষণ। কারণ যে কেউ তো আর উঠতে পারে না। এমন একজনকে উপরে উঠতে হবে, মেয়ের গায়ে হাত ছোঁয়াবার অধিকার আছে যার। অবশেষে ঠিক হল তকু ব্যাপারিই উঠবে ওপরে। মেয়ের আপন চাচা হয় সে। সুতরাং অধিকারের প্রশ্ন আসেনা।

তকু ব্যাপারিকে ওপরে উঠতে দেখে ক্ষেপে গেলো সখিনা। চিৎকার করে ওকে শাসাতে লাগলো সে, খবরদার খবরদার ব্যাপারি, জানে খতম কইরা দিমু। বলে ছোট ছোট ডাল পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ওর ঘাড়ের ওপরে মারতে লাগলো সে। তারপর অকস্মাৎ এক লাফে দীঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেয়েটা। অনেক কষ্টে দীঘির পানি থেকে পাড়ে তুলে আন হল তাকে।

কলসি কলসি পানি ঢালা হল মাথার ওপর। তারপর যখন জ্ঞান ফেরে এলো সখিনার তখন সে একবারে চুপ হয়ে গেছে। তারপর থেকে একটা কথাও বলেনি সখিনা। একটা প্রশ্নেরও জবাব দেয়নি সে। তাই আজ সকালে গনু মোল্লার কাছে নিয়ে এসেছে ওকে। যদি ভুতটাকে কোনো মতে তাড়ানো যায়। নইলে মেয়েটাকে বাচিয়ে রাখা অসম্ভব হবে। ব্যাপারির ভাইয়ের কাছ থেকে সব কিছু শুনলো মন্তু। গনু মোল্লার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা সাদা কাপড়কে সরষের তেলের মধ্যে ডুবিয়ে নিয়ে তাঁর মধ্যে আগুন ধরিয়ে সেই কাপড়টাকে সখিনার নাকের ওপর গনু ধরছে আর চিৎকার করে বলছে, কোনহান থাইকা আইছস শিগগির কইরা ক, নইলে কিন্তুক ছাড়মু না আমি। ক শিগগির। সখিনা নীরব। তাঁর ঘড়ের ওপর চেপে থাকা ভুতটা কোনো কথাই বলছে না। তবে, উপন্যাসের বর্ননা পড়ে মনে হয়মজু ব্যাপারীর মেয়ে আসলে হিস্টেরিয়া আক্রান্ত হয়েছিল ।

সিজোফ্রেনিয়া (schizophrenia) এবারে আসুন সিজোফ্রেনিয়া রোগটি সম্পর্কে কিছু জানা যাক । বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে বিশেষত অশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে এই রোগটি দেখা যায়। রোগী অলিক কিছু দেখে বা শোনে বা চিন্তা করে। অধিকাংশ সময়েই সে অডিটরী হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়।সে এমন কিছু শোনে যেটা আশেপাশের আর কেউ শুনতে পায় না। সে ভাবতে পারে কেউ তার সাথে সবসময় কথা বলছে/নিরদেশ দিচ্ছে। আবার একাধিক মানুষ তার মাথার ভেতর বসে কথা বলছে,রোগী জাস্ট রানিং কমেন্ট্রির মত করে তাদের কথা শুনছে ,এমন উপসর্গও হতে পারে। সে ভাবতে পারে কেউ তার সাথে সবসময় কথা বলছে। অনেক একে গায়েবী আওয়াজ বলে অভিহিত করে। অলীক অনেক কিছুই সে দেখতে পারে। উদ্ভট অনেক কিছুই সে করতে পারে। ধর্ম বা পরিবেশ অনুযায়ী কেউ আরবীতে সুরা কেরাত পড়া শুরু করতে পারে, কেউ বা জয় মা কালী বলে নাচানাচি করতে পারে। উপসর্গ দেখে বাংলাদেশের সকল ধরনের জিনে ধরাভুতে ধরাআছর পড়ানজর লাগাভর করা ইত্যাদি সকল রোগকেই সিজোফ্রেনিয়া ধরা যায়।

রোগের কারন বংশগত এবং পরিবেশগত। বংশে অতীতে কারো সিজোফ্রেনিয়া থাকলে সেই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই রোগের সম্ভাবনা থাকে। তবে বেশি প্রভাব পরিবেশের।ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক জগতের উপরে দৃড় বিশ্বাস তার মনে সিজোফ্রেনিয়ার বিজ বপন করে। ইসলামে বিশ্বাসী কোন তরুন তরুনীর উপর কখনো মা কালী ভর করে না।আবার কোন হিন্দুর উপর মুসলমান জিনের আছর পড়তে দেখা যায় না।     দেখা যায়যে এলাকায় শিক্ষার হার কম, সেই এলাকার কমবয়সীরা এই রোগে আক্রান্ত হয়।অশিক্ষিত মানুষদের মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে নতুনঅদ্ভুত বিষয় সহজে গ্রহন করতে পারে না। কোন নির্দিষ্ট ঘটনা বা তথ্য(কোন ভূত তাড়ানোর দৃশ্য,কোন প্যারানরমাল এক্টিভিটিজ,কোন ধর্মীয়/ সামাজিক মিথ অথবা এমনকিছু যা সে ব্যাখ্যা করতে পারছে না) এই কিশোর কিশরীদের মস্তিষ্ক যখন আলোড়িত করেতখন সে সর্বক্ষন এটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে।চিন্তা করে যখন কোন সল্যুশন পায় না তখন মস্তিষ্কে এম্ফেটামিন হরমোন নিসৃত হয়। এম্ফেটামিন আবার ডোপামিন নামক আরেক হরমোনকে নিঃসরনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এই ডোপামিনের প্রভাবেই রোগি কাল্পনিক কথা শোনে, অবাস্তব জিনিস দেখে এবং অসম্ভব কাজ করতে পারে।

ধরা যাক, কোন তরুনী দুপুরে গোছলের পরে বকুল গাছ তলায় বসেছিল। বিকালে তার মা তাকে ডেকে বলল,কেন সে বকুল তলায় বসেছিল? সে কি জানে না গোছলের পরে ভেজা চুলে বকুল তলায় বসলে জিনের নজর লাগে? তরুনী যদি অশিক্ষিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয় তাহলে এ ঘটনায় ওই তরূনীর মনে বেশ শক্ত একটা ভয় ঢুকে যাবে। (সে কুসংস্কার মুক্ত হলে একটুও ভয় পাবে না) রাতে হয়তো তার পরিবারের বয়স্ক দাদী নানী কারো কাছ থেকে সে কিছু জিনে ধরার গল্প শুনলজিনে ধরলে মানুষ কি করে সে বিষয়ে তার কিছু ধারনা হল। এখন তার কাছে ভয়টা অনেক শক্ত হয়ে গেথে যাবে। তার ব্রেনে ডোপামিনের কাজ শুরু হয়ে গেছে।পরের কয়েক দিনের মধ্যেই তার সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। এবং আক্রান্ত হয়ে সে সেই সব আচরন করার চেষ্টাই করবেযে কাজের ইনফরমেশন গুলা তার মাথায় আছে।(দাদীর কাছে শুনেছে জিনে ধরলে পুরুষ কন্ঠে কথা বলে। সে চাইবে গলা মোটা করে কথা বলতে। তার পাশের ঘরের আচারের ওপর হয়তো তার লোভ ছিল। সে আদেশ করবে আমাকে ওই ঘর থেকে আচার এনে খেতে দাও ইত্যাদি)।

নির্দিষ্ট কিছু ড্রাগের প্রভাবেও সিজোফ্রেনিয়া ঘটতে পারে।বিভিন্ন পূজা পার্বনে নেশা করার পর অনেকের মধ্যে উন্মত্ততার ভাব আসে। ক্লান্তিহীনভাবে সে তখন নাচ গান করতে পারে।অনেক অপ্রত্যাশিত আচরন ও করতে পারে সে তখন।

সিজোফ্রেনিয়ার প্রভাবে রোগীর সাময়িক ভাবে স্মৃতিভ্রম হতে পারে। আবার কখনো কখনো শুধু নির্দিষ্ট কিছু স্মৃতিই তার মাথায় থেকে যায়। রোগী এ সময় নিজের সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা পোষন করে।তার আশেপাশের পরিবেশে কি হচ্ছে সে এটা ধরতে পারে না। অসংলগ্ন কথা বার্তা বলে থাকেযা স্বাভাবিক অবস্থায় তার বলার কথা না। এমনকি এ অবস্থায় তার গলার স্বর ও পরিবর্তিত হতে পারে। চূড়ান্ত অবস্থায় রোগী নিজের বা অন্যদের শারীরিক ক্ষতি করতে পারে। তার শারীরিক শক্তি এ সময় অনেক বেশি বলে মনে হতে থাকে বা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে সে অনেক বেশি কাজ করতে পারে এ সময়।

convulsion
রোগের কিছু কিছু উপসর্গও এই ধরনের জিনের আছরের সাথে মিলে যায় । কনভালশনের ক্ষেত্রে রোগীর শরীর কাপতে থাকে, তাদের মুখ দিয়ে ফেনা বের হয় এবং কিছুক্ষন পরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ব্যাপার। এর সাথে ভৌতিক কোন ব্যাপার না। চিকিৎসা করালে এ রোগ সম্পুর্ন সেরে যায় ।

উপসংহারঃ ভূত আছে নাকি নেই সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে । তবে ভূতের উপদ্রব কিংবা জ্বিনের আছরের অনেকগুলা ঘটনাই যে আসলে হিস্টেরিয়া কিংবা মাস হিস্টেরিয়া নামক রোগসেটা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন। এই ধরনের রোগিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অল্প কিছু চিকিৎসা পেলেই এই ধরনের রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। তাই এই ধরনের রোগী দেখলে পীর ফকির ডেকে এনে ঝাড় ফুক না করিয়ে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান ।

বাংলাদেশে অনেক পীর ফকির আছে, তারা রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে নিষেধ করে। তারা রোগীর আত্মীয় স্বজনকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখায়। রোগীকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলে ক্ষতি হবে, রোগী মারা যাবে এমন কথা বলে । রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব পেলে ভূত নামানোর জন্য রোগীর উপর অনেক অত্যাচার করে। হাজার বছর ধরে উপন্যাসের গনু মোল্লা ভূত নামানোর জন্য শুকনো মরিচে আগুন ধরিয়ে মজু ব্যাপারীর মেয়ের নাকে ঠেসে ধরত । এই ধরনের আরো অনেক অত্যাচার ফকিররা করে থাকে । ঝাটা কিংবা বেত দিয়ে পিটানো,পানিতে চুবানো কিংবা শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মত ভয়াবহ কাজও তারা করে । এই ধরনের কাজের পিছনে তাদের যুক্তি হচ্ছে ,’আমি যতই মারিমেয়েটা কোন ব্যথা পাচ্ছে নামেয়েটার ঘাড়ে থাকা জিন ব্যথা পাচ্ছে। এটা সম্পূর্ন ভুল কথা । মেয়েটা অবশ্যই ব্যথা পায়।

কিন্তু হিস্টেরিয়া রোগের কারনে সঠিকভাবে বলতে পারে না। কোনো কোনো সময় ফকিরের অত্যাচারে রোগী মারাও যায় , ফকির তখন জিনের ঘাড়ে দোষ চাপায় (মেয়েটাকে জিন মেরে ফেলেছে, আমি কিছু করিনি) । এই সকল পীর ফকির কিংবা সাধূ সন্যাসীর কাছ থেকে সাবধান। এদের কাছ থেকে উপকারের বদলে ক্ষতিই হবে শুধু। কাজের কাজ কিছুই হবেনামাঝখান দিয়ে টাকা পয়সা খরচ হবে ।
হিস্টেরিয়া কিংবা সিজোফ্রেনিয়া কিংবা অন্যান্য যে কোনো অস্বাভাবিক রোগের ক্ষেত্রেই রোগিকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। আপনার আমার একটু সচেতনতাই অনেককে বাঁচাতে পারে অপচিকিৎসার হাত থেকে।
লেখকঃ মেডিকেল অফিসার( রোগ নিয়ন্ত্রণ), উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিয়ানিবাজার, সিলেট -