Friday, August 25, 2017

নাস্তিক হয়ে উঠার গল্প....১-৭

পর্ব: ০১
ঝাপসা স্মৃতির পাতা থেকে কিছু খুঁজে বের করার জন্য একটু খানি আস্খার ফুঁ দিলেই বেড়িয়ে আসতে আসতে থাকেস স্মৃতির শৃঙ্খল, যা শেকলের ন্যায় একটার সাথে আরেকটা যেন গেঁথে রয়েছে। তখন আমি মাত্র চার ক্লাসের ছাত্র, মানে চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র। আব্বু যখন ফজরের নামাজ আদায় করতে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতো, তখনই আমাকে ডেকে উঠাতো বই নিয়ে বসার জন্য। মায়ের উক্তি, ভোর বেলার পড়ায় মনোযোগ বেশি থাকে আর সেই পড়াটা মনেও থাকে দীর্ঘদিন, আর ভালো ছাত্ররা নাকি কখনোই সকালে লেট করে ঘুম থেকে উঠে না। স্কুলের সেরা ছাত্র হিসাবে নিজেকে দাবী করার আগ্রহটা সেই সময় থেকেই আমার ছিল। তাই অনেক কষ্ট হলেও কিছুই করার ছিল না। স্কুলের সেরা ছাত্র হয়েছিলাম কিনা জানি না, তবে ক্লাসের প্রথম ছাত্র আমিই ছিলাম। রোল নাম্বার দুই যার হয়েছিল, সে একটা মেয়ে। বাড়ি থেকে প্রায়ই বলতো, যদি ঐ মেয়েটি প্রথম হয়, তাহলে তুমি লজ্জায় মুখ দেখাবে কি করে? একটা মেয়েকে টপকাতে পারো না, কিসের ছেলে মানুষ তুমি? কথাগুলি তখন থেকেই মাথায় ভাইরাসের মত আটকে গেছিল, যেন চেষ্টা সফল না হওয়া পর্যন্ত কোন দম নেই।

সেই সময় থেকেই দেখতাম, বাবা জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে বহুক্ষন চোখ দুটি বন্ধ করে কি যেন জপ করতো, বুঝতে পারতাম না। আম্মুকেও মাঝে মাঝে বলতাম, দেখো বাবা বসে বসেই ঘুমাচ্ছে। তখন মা বলতো, ঘুমাচ্ছে না, যিকির করছে। আল্লাহর নাম জপ করছে, এটা করতে হয়। একপাশে আম্মুও সালাত আদায় করার পর সংসারের কাজে লেগে যেত। এরপর যে যার মত কাজে ব্যস্ত। বাবাকে খুব কমই দেখেছি যে, বাড়িতে উনি নামাজ পড়তেন। বেশিরভাগ সময়েই মসজিদে যেতেন, কারন মসজিদটি আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক বাড়ি পরেই ছিল। বাবার ধার্মিক হওয়ার সুবাদে মসজিদের ইমামের সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক উনার। মসজিদের পাশেই একটা হাফেজিয়া মাদ্রাসা ছিল। বিভিন্ন গ্রামের ছেলেরা এসে এখানে থেকে কোরানের হাফেজ হওয়ার চেষ্টা করতো, আর ইমামই ছিলেন শিক্ষক, কারন উনি একজন মুফতি ছিলেন সেই সময়ের। আমাদের বাড়িতে একজন জায়গীর ছাত্রও ছিল সেই মাদ্রাসার। শুধু খাওয়ার সময় এসে খেয়ে যেত, আর সব সময় থাকতে হত মাদ্রাসাতেই। তাই খুব ভালো বন্ধুত্তপূর্ন সম্পর্ক ছিল না তার সাথে। আমার সম বয়সী, গায়ে পাঞ্জাবী, পরনে পায়জামা আর মাথায় টুপি, দেখতে মন্দ লাগত না।

ঐ ইমাম কবে থেকে যে আমার বাবার মাথা খারাপ করছিল, তা জানা নাই। হঠাত একদিন বিকালে বাবা বললো, আমাকে কোরানের হাফেজ বানাবে। পরিবারের সবাই যেহেতু অনেক ধার্মিক, তাই উনাদের নিকট এ সিদ্ধান্তকে উত্তমই মনে হল। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না, আমার স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে মাদ্রাসায় যেতে। অবশ্য এর জন্য আমাকে খুব বেশি জোর জবরদস্তিও করা হচ্ছিল না, শুধুই বুঝানোর চেষ্টা চলছে সব সময়।
আমার মনে পরে তারও অনেক পূর্ব হতেই রাতে ঘুমানোর আগে আমার মা আমাকে কোরানের বিভিন্ন সূরা পাঠ করাতেন আর মুখস্ত করানোর চেষ্টাও করাতেন। তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, আমার মায়ের জানা সমস্ত সূরা মুখস্ত হয়ে গেছিল। তারপর থেকে নামাজও পরতাম নিয়মিত। ভোর বেলা ফজরের নামাজ পরতে এবং এশারের সময় আব্বার সাথে নামাজ পরতে যেতাম নিয়মিত। এরপর আমাকে আযান দেয়া শেখানো হল। একদিন অনেক সাহস করে মসজিদের মাইকে আজানও দিলাম। তারপর থেকে সাহস বেড়ে গেল আর প্রায়ই মুয়াজ্জিনকে মুক্তি দিতাম এ দায়িত্ব হতে। আমি নাকি খুব ভালো আযান দিতে পারতাম, তাই তারও কোন আপত্তি ছিল না।

কয়েকদিন পরে একদিন হুজুর আমাদের বাড়ি আসলো। আমাকে বললো, তোমাকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে বেড়াতে যাবো। আমি রাজি না হলে, আমাকে চকলেট আর আইসক্রিমের লোভ দেখানো হল। বাবাও বলল, মুরুব্বীদের কথা শুনতে হয়। রাজি হয়ে গেলাম। সারা বিকাল বেড়ালাম গ্রামের অনেক জায়গায়। আমাদের গ্রামটাও অনেক বড় ও অনেক সুন্দর ছিল। বেড়ানোর মত অনেক জায়গাও ছিল। তারপর দিন থেকেই আমাদের বাড়ির জায়গীর ছেলেটা আমার সাথে খুব ঘনিষ্ট ভাবে মেলামেশার চেষ্টা করতে থাকলো। কয়েক দিনের মধ্যেই খুব ভালো বন্ধুত্ত হয়ে গেল। এমনটাই হল যে, বাবা বাজার থেকে আমার জন্য কোন খাবার কিনে আনলে, আমি সেখান থেকে অর্ধেকটা রাখতাম তাকে খাওয়ানোর জন্য। এরপর একদিন আমাকে বলল, তাদের সাথে মাদ্রাসায় খেলার জন্য। সেখানে গেলাম বিকালে। দেখলাম সমস্ত ছাত্র গোল্লাছুট খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমিও যোগদান করলাম। ধীরে ধীরে সবার সাথেই খুব ভালো বন্ধুত্ত তৈরি হয়ে গেল সবার সাথেই। আমাদের গ্রামেরও অনেকেই ছিল। গ্রামের ছাত্র হলেও, তাকে বাড়ি থাকা যাবে না, মাদ্রাসাতেই থাকতে হবে, এটা ছিল শর্ত। ধীরে ধীরে হুজুরও অনেক আন্তরিক হয়ে গেল আমার। এরপর একদিন একদিন প্রোপোজ করলো, আমাকে মাদ্রাসাতেই থাকার জন্য। বাড়িতে বাবাও বলছিল, তাদের সাথে কয়েকদিন থাকতে, যদি ভালো না লাগে তাহলে তারা থাকার জন্য আর বলবে না। এবার বাবার কথায় সেই কথায় রাজি হয়ে গেলাম মাদ্রাসায়। বিছানা পত্র গুছিয়ে একবারে গেলাম মাদ্রাসায়,যদিও বাড়িটা ছিল মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ......


 পর্ব: ০২

স্কুলে যাওয়া বন্ধ হল। আমি মাদ্রাসায় কম পড়াশুনা করলেও হুজুর আমাকে কিছুই বলতো না। কিন্তু যেসব ছাত্র কোরান পড়তো এবং ঠিক সময় মত পড়া না হত, তাদেরকে জোড়া বেতের বাড়ি দেয়া হত। কাউকে ৪-৫ টা, কাউকে বা তারও বেশি। উচ্চ স্বরে কান্না করা যাবে না সেখানে, তাহলে শাস্তি আরো বেশি। একজন বড় মানুষ, এভাবে যে মারতে পারে পড়া না হলে, তা মাদ্রাসায় না গেল মনে হয় জানাই হত না। শীতকাল ছিল সেই সময়। অনেক ছোট ছোট ছাত্রও ছিল, যারা আমার থেকেও বয়সে ছোট। তন্মধ্যে দুই তিনজন ছিল, যারা প্রায়ই ঘুমের মধ্যে বিছানায় প্রস্রাব করতো। হাঁসাহাঁসির কিছুই নাই, অনেকেরই ছোটকালে এই সমস্যা থাকে, যা বড় হলে ঠিক হয়ে যায়। যাদের এই সমস্যা হত, তাদেরকে হুজুর মাদ্রাসার পুকুরের পানিতে নামিয়ে দিত ঐ হারকাপানো শীতের ভোরে গোসলের জন্য। তারপর গোসল শেষে বসিয়ে দিত পড়াশোনার জন্য। কতটা যে নির্মম পরিস্থিতি, তা মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র মাত্রেই অবগত রয়েছে।

অবশ্য আমাকে হুজুর কখনোই মাইর দেয় নি। কারন, সেই সময় আব্বা গ্রামের একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিল এবং হুজুরও জানতো যে, আমাকে ভয় দেখালে আমি মাদ্রাসা ছেড়ে চলে যাবো। হয়তো এজন্যই কখনোই মারে নি। অবশ্য মারা প্রয়োজনও হয় নি, কারন আমি ওখানেও ছাত্র হিসাবে খারাপ ছিলাম না। এক মাসের মধ্যেই কোরান তিলায়াতি শুরু করলাম এবং তিন মাসের মধ্যে পুরো কোরান একবার পড়া হয়ে গেছিল। তারপর থেকেই শুরু হল কোরান মুৃখস্ত করানো। তিনমাস পরে স্কুল থেকে মাষ্টার এবং আমার কয়েক জন বন্ধু এসে আব্বাকে রিকুয়েস্ট করলো, আমি যেন দুই মাস পরে বার্ষিক পরীক্ষাটা দেই। আবারো স্কুলের বন্ধুদের খুব মিস করতে থাকলাম। এখানের বন্দি জীবন আর ভালো লাগত না। কাছেই বাড়ি কিন্তু যেতে পারতাম না, কারন ততদিনে আমি হুজুরের পুরোপুরি বাধ্য ছাত্র হয়ে গেছিলাম। শুধুমাত্র খাওয়ার সময় ১৫ মিনিট সময় পেতাম বাড়ি থেকে খেয়ে আসার জন্য। বিকালে ঘন্টা দেড়েক খেলার জন্য সময়। বাঁকি সময় মাদ্রাসার ভেতেরেই থাকতে হতো। বন্দি জীবন আর ভালো লাগছিল না। আব্বাকে স্কুলে যাবার কথা বললে তিনিও রাজি হলেন না, আর হুজুরের তো কথাই ছিল না। কেননা, আমার প্রশংসা করে, ততদিনে আব্বার ব্রেনটা পুরোপুরি ওয়াস করে ফেলেছিল। গ্রাম্য মানুষদের ধর্ম দূর্বলতা এমনি হয়ে থাকে সাধারনত।

কয়েক দিনের মধ্যেই দেখি সবাই আমার সাথে বিট্রয় করতে থাকে। অস্থীর হয়ে গেলাম এখান থেকে মুক্তির জন্য। কোন ভাবেই যখন কিছু হল না, তখন সেখান থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। একদিন দুপুরে খেতে যাবার কথা বলে, রওয়ানা হলাম মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে। মামা বাড়ি অনেক দূরে হলেও অনেক বার যাওয়া আসার কারনে রাস্তাটা আমার জানা ছিল। হারিয়ে যেতে পারি রাস্তা ভুল করে, মুক্তির নেশায় সে ভয়টাও কাজ করলো না মনে। প্রায় সন্ধ্যায় আমি পৌঁছে গেলাম মাম বাড়ি। সবাই তো অবাক হয়ে গেল আমি একাকী এসেছি এটা দেখে। আমি বললাম, মাদ্রাসা থেকে পাঁচ দিনের ছুটি পাইছি, তাই বেড়াতে আসছি, আব্বা আসতে পারে নি ব্যস্ত থাকায়। মামাও বিশ্বাস করে নিল। তখন মোবাইল ছিল না, তাই খবর নেয়াও সম্ভব ছিল না। সম বয়সী মামাতো ভাইয়ের সাথে খুব মজাতেই সময় কাটতে থাকলো আমার।

ওদিকে দুপুতে খেতে গিয়ে না আসাতে, আব্বা যখন আসরের নামাজে মসজিতে আসলেন, তখন আমার না আসার কারন জানার জন্য আব্বাকে প্রশ্ন করলে আব্বা বলে, বাড়িই তো যায় নি খেতে, আমি ভেবেছিলাম মাদ্রাসাতেই হয়তো কোন আয়োজন হয়েছে তাই আসে নি। আরেকটি কথা বলে রাখা দরকার। তার এক মাস আগেই, আমাদের বাড়ির জায়গীর ছেলেটার বাবা মারা যাবার জন্য বাড়ি গিয়েছে, তারপর আর আসে নি। তাই ব্যাপারটা আব্বা এবং হুজুর কেহই দ্রুত জানতে পারে নি। আব্বা মনে করেছিল, মাদ্রাসাতে হয়তো কোন খাবারের আয়োজন হয়েছে তাই আসি নি। কারন এরকম মাঝে মাঝে হয়েই থাকে। অপরদিকে হুজুর মনে করেছিল, বাড়ি গেছি হয়তো কোন কারনে আসি নি। কারন আমারও এরকম মাঝে মাঝে হয় যে, সকালে বাড়ি গেলে বিকালে এসেছি। কিন্তু আসরের সময় যখন আব্বা আর হুজুর মুখোমুখি হল, তখন তাদের ভ্রম ছুটে গেল। কোথায় যেতে পারি, তার কোন আন্দাজ ছিল না কারো। কারন তখনো আমি বেশ ছোট।

অনেক রাত পর্যন্ত আশেপাশের আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে সকল জায়গায় চলল ক্রমাগত খোঁজ খবর। অনেক রাত অবধী চলল আমাকে পাবার প্রচেষ্টা, কিন্তু কোন ফায়দা হল না। পরের দিন সকালে হুজুর আব্বাকে বলল, আপনার ছেলেকে পরী ধরেছে। অনেক জায়গায় এমন দেখা গেছে যে, ভালো ছাত্রদের পরী আছর করে, আর তার সাথে নিয়েও যায়, আবার কিছুদিন পরে ফিরেও আসে। আপনি চিন্তা করেন না, আমি সব ব্যবস্থা করছি। আব্বাকে শান্তনা দিয়ে হুজুর রাতের বেলা নাকি তার চেনা জানা জ্বীন পরী হাজির করে আমার খোঁজ খবর করার চেষ্টা চলছিল, কিন্তু কোন সঠিক হদিস বের করতে হুজুর ব্যর্থ হল। এভাবেই কেচ্ছা কাহিনীর মধ্য দিয়ে কেটে গেলে আরো দুই দিন, আমি তখনো মামার বাড়িতে বহাল তবিয়তেই আছি আর স্বাীধনতার স্বাদ উপবোগ করছি।

 পর্ব: ০৩

অবশেষে চারদিন পরে বড় ভাই মামা বাড়িতে এসে হাজির। তিনি তখন এস.এস.সি এর পরীক্ষার্থী ছিলেন। উনি আমাকে তো স্বত্তির নি:শ্বাস ফেললেন ঠিকই, কিন্তু আমার আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছিলো। আমাকে নিয়ে যেতে চাইলে আমি যেতে রাজি হলাম না কিছুতেই। তারপর উনি মামাকে সব কথা খুলে বলল। মামা ভাইকে বলল, তুই বাড়ি গিয়ে খবরটা দে, আমি কাল নিজেই একে নিয়ে যাবো। তুই যা, তোর সাথে যেতে ভয় পাচ্ছে।

আরো জানতে পারলাম, মা নাকি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে শুধু কান্নাকাটি করছে। আমি আসার পর থেকে নাকি বাড়িতে চুলোয় আগুন জ্বলে নাকি। সবাই শুধু খোঁজাখুজির উপরেই আছে। মায়েল কথা মনে হতেই খুব খারাপ লাগতে লাগল। পরের দিন চলে আসলাম বাড়ি। মা তো আমাকে দূর থেকে দেখেই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। সাথে সাথে প্রতিবেশি সবাই যে ভীর করে আসতে থাকলো আমাকে দেখার জন্য। কারন ইতিমধ্যে হুজুরের পরীতে আছর করার রটনা রটে গেছে পুরো গ্রাম জুড়েই। সেই পরীতে আছর করা মানুষ আবার ফিরে এসেছে, এ কি চারটি খানি ব্যাপার নাকি?

দিন শেষে অন্ধকার ঘনিয়ে আসলো, আবারো দিন আসলো দিনের নিয়মে। কেউ আর মাদ্রাসায় যাবার কথা বলে না। আমিও বলে দিয়েছি, আবার মাদ্রাসায় যাবার জন্য জোর করলে, এবার এক বারেই পরীতে নিয়ে যাবে, আর ফেরত দিয়ে যাবে না। তাই সবাই নীরব। পরদিন থেকেই শুরু হল আমার স্কুল যাওয়া। যথানিয়মে চলতে থাকলো দিনগুলো। সময়ের চক্রে পুন:পুন ফিরে আসতে থাকলো সময় নতুন রুপে। কিন্তু এইবার ক্লাসের আর প্রথম হতে পারলাম না। রীতিমত আমার স্থানটা দখল করে নিল সেই মেয়েটি আর আমি তার স্থানে ঝড়ে পরলাম। এই ঘটনায় বাবা মাকেই দোষী মনে হচ্ছিল। বাড়ি এসেই সব রাগ গিয়ে পরতে থাকলো বইয়ের উপর, যেহেতু বাবা মাকে আর রাগ দেখানো যাচ্ছে না। আলমিরা থেকে সব বই বের করে আগুন লাগিয়ে দিলাম। মা আমার এরকম অবস্খা দেখে, গাল বরাবর কষে দিল থাপ্পর।

এরপর যখন সপ্তম শ্রেনীতে উঠলাম, তখন আমাকে একটা শহরের নামকরা স্কুলে ভর্তি করানো হল। সময়ের স্রোতে ভাঁসতে ভাঁসতে এস.এস.সি পাশ করলাম। তখন নতুনই গ্রেডিং সিস্টেমের রেজাল্ট বের হয়েছিল। নিজের রেজাল্ট নিজেই বুঝতে পারছিলাম না, হঠাত করেই পড়াশোনার এমন সিস্টেমের এমন পরিবর্তনের জন্য ছাত্র শিক্ষক সবাই খুব বিভ্রান্তিতে ছিল। তাই খুব ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব না হলেও, সেই সময়ের জন্য সম্মান জনক রেজাল্ট ছিল।

তখন পর্যন্ত কিন্তু আমি যথেষ্ট ধার্মিক। দিনে পাঁচ বার নামাজ হতো না সত্যি, কিন্তু প্রতি শুক্রবার মিস হতো না, আর কোরান তিলায়াতে ভুল অবশ্যই হতো না। কারন আমার রুমেই কোরান ছিল, আর আমিই একমাত্র কোরান পড়তাম সপ্তাহের একদিন পুরো হোস্টেল জুরে। এরপর ভর্তি হলাম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে। বিজ্ঞানের প্রতি আমার ছোটবেলা হতেই একটা বিশেষ আকর্ষন ছিল। বিভিন্ন রকম ধর্মের বই পড়তাম তখন থেকেই। ইন্টার মিডিয়েটে সর্ব প্রথম হঠাত করেই এক রাতে মাথায় একটা আজব প্রশ্নের উদয় হল। তা হল সৃষ্টি আর স্রষ্টা সম্পর্কিত।

পর্ব: ০৪

প্রশ্নটা হল, সব কিছুরই যদি স্রষ্টা একজন হয়, তাহলে স্রষ্টাকে কি সৃষ্টি করলো?
পরক্ষনেই অন্তরটা ভয়ে কেঁপে উঠলো। এ কি ধরনের প্রশ্ন? স্রষ্টার যদি কোন স্রষ্টা থাকে, তাহলে তাকে আবার স্রষ্টা মানা যায় কেমনে? তাছাড়া সেই স্রষ্টার যে স্রষ্টা, তার আবার আরেক স্র্রষ্টা আসবে কোথা থেকে। এভাবে তো স্রষ্টার লাইন লেগে যাবে তবু হিসাবের সমাপ্তি ঘটবে না। এটা আসলে ভুল প্রশ্ন, এমন প্রশ্ন করা যাবে না। হয়তো আমাকে শয়তারে মতিভ্রম ঘটাচ্ছে, এরকম চিন্তা করে আপাতত মস্তিষ্কটাকে রেস্ট দিলাম। কিন্তু কৌতুহলী মানুষের কৌতুহল কি এতো সহজে যাবার মত বিষয়? না পারছিলাম প্রশ্নটা ভুলতে, না পারছিলাম এরকম একটা প্রশ্ন কাউকে করতে, না পাচ্ছিলাম কোন উত্তর। ক্রমান্বয়ে আমি অন্য মনষ্ক হয়ে যেতে থাকলাম।

প্রায় মাস দেড়েক পরে, এক শুক্রবার প্রতিবারের মতই জুম্মার নামাজ আদায় করতে গেলাম। শহরের মানুষ, জুম্মার দুই রাকাত নামাজ শেষ হলেই সাধারনত দুই তৃতীয়াংশ লোক চলে যায়। বাঁকি থাকে মুরুব্বী শ্রেনীর কিছু লোক পরের চার রাকাত নামাজের জন্য। সেদিন আমারও কেন জানি অনেক সাহস হয়েছিল, মসজিদের ইমামকে প্রশ্নটা করবো, মনে হচ্ছিল উনি এর সঠিক উত্তরটা দিতে পারবে। তাই আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম, হুজুর কখন বের হয় মসজিদ থেকে। হুজুরের শিক্ষাগত যোগ্যতা কি, তা আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি যে, ঐ মসজিদ ছিল শহরের সবচেয়ে বড় মসজিদ, যেখানে অন্তত হাজার খানেক মানুষের জামাত হয় শুক্রবারে। ৫০-৫৫ বছর বয়স হবে হুজুরের। সাদা দাঁড়ি মেহেদী রংগে রঙ্গীন।

অবশেষে আমার প্রতীক্ষা শেষ হল। হুজুর বের হতেই আমি হুজুরের সামনে দাঁড়ালাম, হয়তো পা দুটো ভয়ে তখনো হুজুরের অলক্ষ্যে কাঁপছিলো থরথর করে। হুজুরকে বললাম, হুজুর কিছু মনে না করলে, আপনার থেকে একটা বিষয় জানতে চাই। অনেক দিন যাবত বিষয়টি আমার মাথা থেকে যাচ্ছে না।
হুজুর চিন্তাযুক্ত চেহারা দেখেই হয়তো অনুমতিটা দিলেন।
আমি বললাম, হুজুর, সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা তো আল্লাহই, তাই না?
হুজুর মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ অবশ্যই।
আমি: যদি স্রষ্টা ছাড়া কোন কিছু সৃষ্টি হতে নাই পারে, তবে আল্লাহ আসলো কোথা থেকে?
হুজুরও যেন এবার চমকে উঠলেন আমার কথা শুনে। হয়তো এতো ছোট একটা ছেলেরৈ থেকে এরকম একটা প্রশ্ন হুজুরও আশা করতে পারে নি। হুজুর কিছুক্ষন নীরব থেকে বললেন, তুমি কাল আসরের নামাজ আদায় করতে আসো, উত্তরটা তখন দিবো।

যথা সময়ে আমি হাজির। আসরের সালাত আদায় করে, আমি মসজিদেই এবার বসে রয়েছি, হুজুরের উত্তরের অপেক্ষায়। সবাই চলে গেল মসজিদ থেকে বেড়িয়ে। এবার হুজুর আমার সামনে এসে বসে যে উত্তর উনি উনার মত করে দিলেন, তাকে আমার তৃপ্ততা আসলো না। কেননা তা যুক্তিযুক্ত মনে হল না আমার নিকট। পরিশেষে আমাকে উপদেশ দিলেন, এরকম প্রশ্ন করতে হয় না, তাহলে নাকি ঈমান হালকা হয়ে যায়, কারন স্রষ্টার নিজের সম্পর্কিত জ্ঞান একমাত্র স্রষ্টারই আছে, অন্যদের সামান্য জ্ঞান দেয়া হয়েছে। এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে সব কিছুর উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়।
এই কথাটিও আমার ভালো লাগলো না। কারন, ক্ষুদ্র জ্ঞানে এই রকম প্রশ্ন যদি আসতে পারে, তবে ক্ষুদ্র জ্ঞানে এই রকম উত্তর থাকবে না কেন, আর বুঝবো না কেন?
আবারো হতাশা নিয়েই ফিরতে হল।

 পর্ব: ০৫

ইন্টার মিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এখন আমি। প্রশ্নের উত্তরটা দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। শুনেছিলাম, পীর বাবাজীরা নাকি সাধারন মোল্লাদের চাইতে অনেক বেশি জ্ঞান রাখে। তাদের অনেক অনেক মুরিদ ভক্ত থাকে পীর বাবাজীদের থেকে ধর্মীয় জ্ঞান আহরনের জন্য। এবার মনে হল, তাদের কাছে হয়তো সঠিক উত্তরটা পাবো। আমার গ্রামের এরকম একজন ভক্ত রয়েছে একজন পীর বাবাজীর। পীরের বাড়িটা একটু দূরে হলেও, তাকে রাজি করালাম পীর বাবাজীর বাড়ি যাবার জন্য। প্রায় এক মাস পরে গেলাম সেই পীরের বাড়ি। এলাকার সুনামধন্য পীর উনি। অনেক অধ্যাতিক জ্ঞান এবং ক্ষমতা রয়েছে উনার। অবশেষে রাত প্রাায় ১০ টার দিকে কথা বলার জন্য বসলাম চারজন। আমি, আমার সাথে যাওয়া লোক, পীর বাবাজী এবং তার এক ভক্ত। একটা বড় চৌকির উপর বসা আমরা, পীর বাবাজী একখান পানের বাটা নিয়ে বসলো। প্রথমেই পরিচয় পর্বটা শেষে শুরু হল আসল কথা। আমি বললাম, আংকেল, আপনারে কে কি বলে ডাকে আমি জানি না, আমি আপনারে আংকেল বললে আপনার কোন আপত্তি আছে?
পীর বাবাজী হাঁসতে হাঁসতে বললেন, না না, সমস্যা নাই। আমি তো তোমার আংকেলের মতই।
আমি: আসলে অনেক দিন যাবত ধর্ম সম্পর্কিত একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে খুব বিভ্রান্তিতে আছি। অনেক হুজুরকে জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু তাদের উত্তর আমার মনমত হয় নি।
পীর বাবাজী: দেখো বাবা, তুমি ছোট মানুষ, তাছাড়া সবার সব জ্ঞান থাকে না। হয়তো উনার কাছে তোমার সে প্রশ্নের উত্তরই ছিল না। তাই তোমাকে বুঝ দেয়ার জন্য তার মত করে উত্তর দিয়েছে, তাই তোমার পছন্দ হয় নি।
প্রশ্নটা কি, একটু বলো তো শুনি।

আমি: আমি ছোটবেলা থেকেই জেনে ও মেনে আসছি, সব কিছুরই স্রষ্টা আল্লাহ। উনিই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। কেননা, স্রষ্টা ব্যতিত কোন কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু হঠাত করেই মনে প্রশ্ন উদয় হল, তাহলে আল্লাহর নিজের স্রষ্টা কে?

পীর বাবাজী: সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা থাকতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা তোমাকে কে দিয়েছে?
আমি: যদি আপনার কথাই ঠিক হয়, তবে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য আল্লারে সৃষ্টিকর্তা মানতে হবে কেন? উনি যে সৃষ্টি করেছে, এটা তো কেবল কোরান হাদিসের কথা। আমরা তো জানি না আদৌ কিভাবে কি হয়েছে। শুধু বিশ্বাস করি মাত্র।

পীর বাবাজী: দেখো বাবা, বিশ্বাস দু রকমের হয়। এক হল অন্ধ বিশ্বাস, আর দুই হল প্রমান বা যুক্তির উপর নির্ভর করে বিশ্বাস। কাঠ মোল্লারা অন্ধ বিশ্বাসে বিশ্বাসী। কিন্তু আমাদের মত অধ্যাতিক এলমে মারিফত পন্থী মানুষরা যুক্তি অথবা প্রমানের উপর নির্ভর করে বিশ্বাসী। তবে তোমারে আমি যুক্তিতে বুঝাচ্ছি।
উনি বললেন, পাঁচের আগে কি সংখ্যা থাকে?
আমি: চার।
পীর বাবাজী: চারের আগে?
আমি: তিন।
পীর বাবাজী: তিনের আগে?
আমি: দুই।
পীর বাবাজী: দুইয়ের আগে?
আমি: এক।
পীর বাবাজী: একের আগে?
আমি: শূন্য।
পীর বাবাজী: শূন্যের আগে?
আমি: এর আগে তো আর কিছু নাই।

পীর বাবাজী এবার মুচকী হেঁসে বললেন, ঠিক একই রকম, সব সৃষ্টিরই একটা শৃঙ্খল আছে। যেমন তোমার পূর্বে ছিল তোমার বাবা, তার রয়েছে আরেক বাবা, তার রয়েছে আরেক বাবা, এভাবে অতীতে যাইতে যাইতে একটা সময় আটকে যাবে, আর পেছনে যাইতে পারবে না। মূলত সেখানেই স্রষ্টার অস্তিত্ত্ব।

আমি: তাহলে একটা কথা বলুন। আপনি নিশ্চয় স্কুলে পড়াশোনা করেছেন, সেখানে অঙ্কও করেছেন অনেক। একটা অঙ্ক মানেই একটা সমস্যা। আমরা জটিল অঙ্কের সমাধানের শুরুতেই, ধরি বা মনে করি নামক শব্দ বা বাক্যের দ্বারা একটা সংখ্যাকে কল্পনা করে নেই। যেমন, ধরি করিমের আছে ক টাকা, কিংবা মরে করি রহিমের আছে খ টাকা ইত্যাদি। তারপর সেই কল্পনাকে কেন্দ্র করে সমস্যাটির একটা সুন্দর সমাধান করে ফেলি। তারপর সমাধান শেষে ঐ মনে করি বা ধরে নেয়ার সংখ্যাকে কি আর আমরা মেনে নেই? কারন, ঐ ধরে নেয়ার উত্তরটাই তো সমাধান থেকে বের হয়।
এখানে, আমাদের অঙ্কের ধরে নেয়ার ব্যাপারটা আর আপনার পেছনে হটতে হটতে আটকে গেলে সেখানে আল্লাকে ধরে নেয়ার ব্যাপারটা এক হয়ে গেল না? আল্লাহ কি তবে শুধুই ধরে নেয়ার মত ব্যাপার?

যুক্তির পাল্টা যুক্তিতে পীর বাবাজীর মনে হয় এবার রাগ হল, কিন্তু ছোট মানুষ বলেই হয়তো রাগটা প্রকাশ পেল না, তবে কথার মধুরতা দূর হয়ে গেল। তারপর উনার যুক্তির কাউন্টার আর কোন যুক্তি দেখালাম না। সকালে পুনরায় হতাশা নিয়েই ফিরতে হল আমাকে।


 পর্বঃ ০৬

বুঝতে পারলাম, এভাবে আসলে হবে না। যার কাছেই জানতে চাই, সেই তার মত করে উত্তর শুনিয়ে দেয়, যা তিনি বিশ্বাস করেন। নয়তো সে যে অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি, সস্তার সেই প্রশংসায় কালিমা লেগে যায়। বাধ্য হয়েই নিজের উত্তর নিজেই খুঁজতে লাগলাম। শুরু করলাম কোরানের বাংলা অনুবাদ দিয়ে। পুরো ছয় মাসে কোরানের অনুবাদ শেষ করে আমার প্রশ্নের জবাব তো পেলামই না, উল্টা আরো বিভ্রান্তির প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল। আগে ছিলাম একটা মাত্র প্রশ্নের যন্ত্রনায়, আর এখন বেশ কয়েকটা। আগের প্রশ্নের উত্তর তো পেলাম না, উল্টা পরতে হল আরো ভোগান্তিতে। আবারো প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম এবং যেখানে বিভ্রান্তি মনে হল, এবার সেখানে কলম দিয়ে আন্ডার লাইনের মাধ্যমে মার্ক করে রাখলাম। ২য় বার পড়া শেষ হবার পূর্বেই এইচ.এস.সি পরীক্ষা সামনে চলে আসলো। তাই এসব চিন্তা আপাতত মাথা থেকে বের করে নিজের পড়ায় মনোযোগ দিলাম। দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষও হয়ে গেল। এবার মেস থেকে চলে আসলাম বাড়ি। রেজাল্ট প্রকাশ হতে তিনমাস বাঁকি। অনেক লম্বা সময় আমার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য। শুক্রবারে মসজিদে নামাজ শেষ করে যখন প্রায় সবাই চলে গেল, আমি তখন মসজিদের আলমারি খুললাম। ইমাম সাহেব বললেন, কি খুঁজো?
আমি বললাম, একটা হাদিস বই খুঁজি। দেখি তো পাই কিনা। অবশেষে একটা কোরানের তাফসীর পেলাম। হুজুর বললেন, তিন চার বছর আহে সৌদি থেকে এই তাফসীর পাঠানো হয়েছে। সারা বিশ্বের মুসলিম দেশেই এই তাফসীর সেই দেশের ভাষা উপযোগী করে পাঠানো হয়।

এবার শুরু হল তাফসীর খোঁজা। বিভ্রান্তিকর আয়াতের ব্যাখ্যা এবার তাফসীরে বের করে জানতে লাগলাম। এতে কিছুটা বিভ্রান্তি দূর হলেও ৩০% বিভ্রান্তি দূর হল এবং আরো কিছু নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল। তন্মেধ্যে প্রধান প্রশ্ন হল, এই তাফসীর কেউ না কেউ তো তার মত করে লিখেছে। এটা তাফসীর কারকের জ্ঞানের ফসল। আল্লাহ তো আর তাফসীর সহ কোরান নাযিল করি নি। কাজেই তাফসীর কারকের তাফসীর যে ১০০% সঠিক, এটা বিশ্বাস করাটাও বোকামী হবে। এর সঠিকতা জানতে হবে ইসলামের ইতিহাস থেকে। এরপর মসজিদ থেকে আরো কিছু হাদিস বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করলাম। ইতোমধ্যে আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। মোটামুটি ভালো একটা রেজাল্টও হল এবং এবার অন্য একটা শহরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম অনার্সে। সাবজেক্ট হল কেমিস্ট্রি। পরের মাসেই শহরের মেসে উঠলাম। যোগাযোগ তৈরি হল লাইব্রেরীর সাথে। বিভিন্ন রকম ধর্মের বই কিনি আর অন্ধের মত পড়ি, কিন্তু সমাধান আর হয়ে উঠে না।

ইতোমধ্যে হঠাত করেই মনে হল, সব বিষয়েরই যুক্তির সাথে, কাউন্টার যুক্তি অবশ্যই থাকে। কাজেই শুধুমাত্র ইসলামের বই পুস্তকই যদি পড়ি, তাহলে কাউন্টার যুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না। তখন প্রথমে পড়া শুরু করলাম গীতা, এরপর বাইবেল। সেই সাথে আরো বিভিন্ন রকমের বই। যেমন, কোরান বাইবেল ও বিজ্ঞান, স্রষ্টার ইতিবৃত্ত, সৃষ্টি রহস্য, মহাবিশ্ব, কোরানের অলৌকিকত্ব, অলৌকিক নয় লৌকিক, আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতোমধ্যে জানতে জানতে আর পড়তে পড়তেই অনার্স প্রথম বর্ষ শেষ হয়ে গেল। এরপর অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয় হল। উনার সাবজেক্ট ছিল দর্শন। আমার সাথে ফ্রেন্ডলী সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সেই সুবাদে আমার সমস্ত বিষয় উনাকে খুলে বললে, উনি আমাকে বলল, এভাবে এলোমেলো বই পড়লে হবে না, একটা সিরিয়াল মেইনটেইন করে পড়তে হবে। সেই অনুপাতে উনি আমাকে বললেন, চিন্তাটাকে আগে ফ্রি করতে হবে, নয়তো সিদ্ধান্ত হবে এক তরফা। কাজেই চিন্তা কি, জ্ঞান কি, জ্ঞানের উৎস কি, সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে হয়, এরকম বিষয় ব্যাখ্যা করে, উনি আমাকে অনার্স লেভেলের মনোবিজ্ঞানের বই পড়ার সাজেস্ট করলেন প্রথমে।

এরপর শুরু হল প্রথম মিশন, যেন শুরুর থেকে শুরু করা। ২৪ ঘন্টায় ঘুম মাত্র ৫ ঘন্টা, আর বাঁকি সময় বইয়ের উপর। যতটুকু সম্ভব হল, মনোবিজ্ঞানের বিষয়টা বুঝলাম, অটোমেটিক্যালি তৈরি হতে থাকলো আমার বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর, আর ততদিনে জেনেও গেলাম, মন কি, কিভাবে কাজ করে, মন কেন একটা কিছুতে আকৃষ্ট হয়, মানুষ ধর্মকে কেন ধারন করে চলে, কেন মানুষ ধর্মে এতো দূর্বল, সমাজে মানুষের উপর ধর্মের প্রভাব কেমন আর কিভাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরপর সাজেস্ট করলেন দর্শনের বই। সংগ্রহ করতে থাকলাম অনার্স লেভেলের বই এবং আবারো পড়াশুনা। ২য় বর্ষ শেষ হতে হতে দর্শনের মূল বিষয় জানতে ও বুঝতে পারলাম, শিখলাম যুক্তি কি, আর কিভাবে প্রয়োগ করতে হয়, শিখলাম কিভাবে প্রশ্ন করতে হয় এবং কেন করতে হয়।


 পর্বঃ ০৭

কলেজের দর্শন বিভাগের স্যার, উনি উনার স্টুডেন্টসদের নিকট বেশ ফেভারিট। আমি আর আমার বন্ধুরুপী দুই বড় ভাইয়ের সাথে ঐ স্যারের সাথে দেখা করে, কিছুক্ষন সময় চেয়ে নিলাম। একটা ফাঁকা রুমে অবস্থান নিলাম আমরা। উদ্দেশ্য ছিল আমাার কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা। শুনেছি উনি নাকি নাস্তিক। কোন ধর্মের কল্পিত স্রষ্টারে বিশ্বাস করেন না। শুরুতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং বললাম,
স্যার, আমি রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্র। বহুদিন যাবত কিছু বিষয় মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছিল। তাই বড় ভাইদের সাহায্যে আপনার শরনাপন্ন হওয়া।
উনি আমাকে নির্ভয়ে এবং নিশ্চিন্তে প্রশ্ন করতে বললে, আমি বললাম,
আমি ছোট বেলা থেকে বর্তমান অবধী ধার্মিক। যতটুকু পারি আমি আমার ধর্ম পালন করি ও বিশ্বাস করি। অপরদিকে আমি একজন বিজ্ঞানের ছাত্র। যতই বড় হচ্ছি এবং কিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হচ্ছি, ততই বিভিন্ন বিষয়ে আমি ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সংঘর্ষ দেখতে পাচ্ছি। একদিকে ধর্ম যা বলে, তা বিশ্বাস করতে হয় কোন রকম প্রমান ব্যতিত। অপরদিকে বিজ্ঞান যা বলছে, তা প্রমান দিচ্ছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ভাষায়। ধর্ম মানতে গেলে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে হচ্ছে, অন্যদিকে বিজ্ঞান মানতে গেলে, ধর্মের সাথে সংঘর্ষ বাধছে। কি করা উচিত আমার, তা বুঝতে পারছি না।

স্যার আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন এবং বললেন, বিজ্ঞান এমন একটা প্রক্রিয়া, যেখানে বিশ্বাস বলে কিছু নাই, কেননা বিশ্বাস শব্দ একমাত্র সেখানেই ব্যবহৃত হবে, যেখানে প্রমান করা যায় না। আর যা প্রমান করা যায়, সেখানে বিশ্বাসের প্রয়োজন পরে না। সেখানে বিষয় আসে, মেনে নেয়া কিংবা না মানা। আমার হাতে দেখতে পাচ্ছো একটা ফোন। আমাকে বলতে হবে না, "আমার হাতে যে ফোন আছে, এটা কি তুমি বিশ্বাস কর?"
কারন, আমার হাতে যে ফোন আছে, তা আমি তোমার চোখের সামনে প্রমান করতে পারি। কিন্তু বিশ্বাস ব্যাপারটি ঠিক উল্টো। যা প্রমান করা যায় না, কেবল সেটাকে মেনে নিতে কিংবা কাউকে মানাতে এই শব্দটা ব্যবহৃত হয়, নিজের প্রতি অন্যের আস্থা অর্জনের লক্ষে।

প্রথমেই বলেছো ধর্মের বিশ্বাসের কথা। ধর্মের ক্ষেত্রে বিশ্বাস শব্দটা কেন আসে জানো? কারন, ধর্ম যে সত্যি, এটা প্রমান করা সম্ভব নয়। তুমি যে ধর্মের পরিবারে জন্ম নিয়েছো, তোমার নিকট সেটাই সঠিক মনে হবে, কারন ছোটবেলা থেকেই তোমার মস্তিষ্কে এই ধর্ম প্রবেশ করিয়ে করিয়ে তা বিশ্বাস ও ভরসায় রুপ দান করিয়েছে। অনুরুপ সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই একই অবস্খা। ধর্ম যে কি, আর ধর্মের সংজ্ঞা যে কি, তা ধার্মিক ব্যক্তিরা জানেই না। মুসলিম জানে, আল্লারে তেল মারতে হবে, হিন্দুরা জানে দেব দেবতার পায়ে তেল মারতে হবে, তাই লিঙ্গ পর্যন্ত পূজা করতে দ্বিধা করে না, আর খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবত্মক যীশুর তো বৈবাহিক সূত্রে পিতৃ পরিচয়ই নাই।

ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপার, যেটা একন্তই তোমার মনের ব্যাপার। আর বিজ্ঞান ভিন্ন বিষয়। তোমাদের ধর্মে বিশ্বাসের নাম ঈমান। যদি এখন বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মের সঠিকতার মানদন্ড খুঁজতে যাও, তবে কি তুমি ঈমানদার থাকতে পারবে? কারন বিশ্বাস সেই বিষয়, যেখানে কোন প্রমান চলে না। আর যেখানে প্রমান থাকে, সেখানে বিশ্বাসের দরকারই পরে না।

বাঁকি থাকে তোমার সিদ্ধান্ত গ্রহনের ব্যাপার। কিসের ভিত্তিতে কি সিদ্ধান্ত নেবে তুমি? সবেমাত্র অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র তুমি। এখনো বহু কিছু জানার বাঁকি রয়েছে তোমার। আরো জানো, আরো উচ্চতর বিজ্ঞান জানো, ধর্মের আরো বিষয় আরো গভীর ভাবে জানো। তুমি যদি বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাও, তবে তুমি নিজেরে মুক্ত চিন্তার মানুষ ভাবতে পারবে না, কারন তখন তোমার যুক্তি বুদ্ধি থাকবে শুধুই বিজ্ঞানের পক্ষে আর ধর্মের বিপক্ষে। ধার্মিকরা যেমন তার ধর্মের মধ্যে কোনরুপ ভুল ত্রুটি দেখতে পায় না, সকল যুক্তি কেবল ধর্মের পক্ষেই হয়ে থাকে, তোমার অবস্খাটাও এমনই হবে। এক তরফা যুক্তি হবে। ধার্মিকরা এমন যুক্তি কেন দেখায় জানো? কারন তাদের এ বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস যে, পৈত্তিক সূত্রে পাওয়া তাদের ধর্ম সম্পূর্ন নির্ভূল। আর তার ধর্মটারেই সত্যের মানদন্ড ধরে নিয়ে, তারা প্রয়োজনে বিজ্ঞানের প্রমানিত সত্যকেও উপেক্ষা করতে পিছু হটবে না। যদি বিশ্বাস না হয়, তবে তোমার পরিচিত কোন ধার্মিকদের প্রশ্ন করে দেখো যে,বায়ুশূন্য স্থানের মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ কেমনে মুহুর্তের মধ্যে মেরাজ সম্পন্ন করে ফিরে আসলো? তারপর দেখো তাদের যুক্তি, নিজেরই লজ্জা তোমার তাদের যুক্তি শুনে। আর যে বিজ্ঞানের কিছুই বুঝে না, সেও কোন যুক্তি না পেলে বলবে, আল্লায় সব পারে।

অনুরুপ হিন্দুদের বলো, আপনাদের গীতায় ভগবান তো নিষ্কাম কর্মের উপদেশ দিয়েছে। তো ভগবান কোন না কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সব কিছু সৃষ্টি করেছে। বাচ্চাদের মত হেয়ালী করে তো আর সৃষ্টি করে নি। তো যায় কর্মের পূর্বেই উদ্দেশ্য ঠিক করা থাকে এবং সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বারংবার যাকে পৃথিবীতে আগমন করতে হয়, সেই ভগবান কেমনে নিষ্কাম হতে পারে? আর নিজে যেখানে নিষ্কাম হতে পারে না, সেখানে তার ভক্তদের কেমনে সেই উপদেশ দিতে পারে?

কিংবা খ্রিষ্টানদের বলো, বাস্তবিকই কি তাদের যীশু পুরুষের শুক্রানু ব্যতিত জন্ম নিয়েছিল? তাহলেই বুঝতে পারবে আসল খেলা। দেখবে, মুসলিমের নিকট তার নিজেদের যুক্তি সহীহ মনে হবে, কিন্তু অন্য দুই ধর্মের যুক্তি শুনলে হাঁসবে। অনুরুপ হিন্দুদের যুক্তি তাদের নিকট মধুময় মনে হবে, কিন্তু বাঁকি দুই ধর্মের নিকট হবে হাস্যকর, তদ্রুপ খ্রিষ্টানদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। এর কারন কি আসলে? এসব বুঝতে তোমাকে আরো জানতে হবে এবং নিরপেক্ষ হতে শিখতে হবে। নিরপেক্ষতা এতো সহজ নয়।