Friday, August 25, 2017

কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৪,৫,৬,৭

কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৪

[সব পর্বের তালিকা ও লিংক পাবেন এখানে]
চতুর্থ অধ্যায়ঃ নিউটনের মহাবিশ্ব
বস্তুর গতি সম্পর্কে আমরা এখন যা জানি তার পেছনে কৃতিত্ব হল গ্যালিলিও এবং নিউটনের। তার আগে সবাই বিশ্বাস করত এরিস্টটলের কথার উপর, যিনি বলেছিলে যে স্থিরাবস্থায় থাকাই হচ্ছে বস্তুর স্বভাবিক ধর্ম। বস্তু গতিশীল হবে যদি এতে কোনো বল বা ঘাত কাজ করে। সেক্ষেত্রে হালকা বস্তুর চেয়ে ভারী বস্তুর পতন দ্রুত হবার কথা,কারণ পৃথিবী একে টানবে বেশি বলে। এরিস্টটলপন্থীদের আরেকটি মত ছিল যে মহাবিশ্বে ক্রিয়াশীল সবগুলো সূত্র নিছক চিন্তাশক্তি দিয়েই বের করা সম্ভব, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করার কোনো প্রয়োজন নেই। ফলে, ভিন্ন ওজোনের বস্তুরা আসলেই ভিন্ন বেগে পতিত হচ্ছে কিনা তা গ্যালিলিওর আগে কেউ পরীক্ষা করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
কথিত আছে, গ্যালিলিও ইতালির পিসার হেলানো টাওয়ার থেকে ভার নিক্ষেপ করে এরিস্টটলের বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করেন। এই গল্পটি যে অসত্য তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে গ্যালিলিও এ রকমই কিছু একটা করেছিলেন। তিনি একটি মসৃণ ঢালু পথে ভিন্ন  ভিন্ন ওজোনের বল গড়িয়ে দেন। উপর থেকে ভারী বস্তুর সোজা নিচে পড়ার মতোই ঘটনাই এখানেও ঘটবে,কিন্তু এখানে গতি অপেক্ষাকৃত কম বিধায় পর্যবেক্ষণ করা হবে সহজ।
গ্যালিলিওর পরিমাপ থেকে বোঝা গেল, ভর যাই হোক না কেন প্রত্যেকটি বস্তুর গতি একই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন ধরুন, কোনো ঢালু পথ দিয়ে একটি বলকে গড়িয়ে পড়তে দিলে এক সেকেন্ড সময় পরে এটি সেকেন্ডে এক মিটার বেগে নিচের দিকে নামবে,দুই সেকেন্ড পরে সেকন্ডে দুই মিটার বেগে নামবে ইত্যাদি। বলটির ভর কম বেশি করা হলেও একই ঘটবে। হ্যাঁ,সিসা দিয়ে তৈরি একটি বস্তু একটি পালকের চেয়ে দ্রুত পড়বে। কিন্তু তার কারণ হল এটাই যে,বাতাসের বাধার কারণে পালকের গতি কমে যাচ্ছে। বাতাসের বাধার অনুপস্থিতিতে আপনি যদি সিসারও আলাদা ভরের দুটি বস্তুকে নিচে পড়তে দেন,তবে দেখা যাবে তারা একই হারে নিচে পড়তে থাকবে (একটু পরই আমরা দেখবো,কেন এমন হয়) । চাঁদের বুকে বস্তুর বেগ কমিয়ে দেবার জন্য কোনো বাতাসের উপস্থিতি নেই। মহাকাশচারী ডেভিড স্কট এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে পালক ও সিসার ভরের পরীক্ষাটি চালিয়ে দেখেন যে এরা আসলেই একই সাথে ভূমি স্পর্শ করছে।
গ্যালিলিওর এই পরিমাপগুলোই ছিল নিউটনের গতি সূত্রের ভিত্তি। গ্যালিলিওর পরীক্ষা অনুসারে,ঢালু বেয়ে নামার সময় কোন বস্তু একটি ফোর্স বা বলের প্রভাবের মধ্যেই থাকে। এই বলের প্রভাবে অবিরাম এর গতি বেড়ে চলে। দেখা গেল যে বলের কাজ শুধু বস্তুকে গতিশীল করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বস্তুর বেগের পরিবর্তন ঘটানোই হচ্ছে বলের সত্যিকার কাজ,যদিও আগে তা মনে করা হত না। এ থেকে আরো বোঝা গেল,বস্তুর উপর কোনো বল ক্রিয়াশীল না হলে এটি একই বেগে সরল রেখায় চলতে থাকবে। সর্বপ্রথম ১৬৮৭ সালে এই ধারণা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশিত হল। নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকায় প্রকাশিত এই কথাই এখন নিউটনের প্রথম সূত্র হিসেবে পরিচিত। এর বক্তব্য হচ্ছে,কোন বস্তু এর উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতে ত্বরিত হবে তথা গতির পরিবর্তন করবে। যেমন,বল যদি দ্বিগুণ হয় তাহলে ত্বরণ (বেগের পরিবর্তন) দ্বিগুণ হবে। বস্তুর ভর যত বেশি হবে ত্বরণ আবার সেই হারে কম হবে। (একই বল দ্বিগুণ ভরের কোন বস্তুর উপর কাজ করলে অর্ধেক ত্বরণ তৈরি করবে।) এক্ষেত্রে গাড়ি একটি পরিচিত উদাহরণ। ইঞ্জিন যত শক্তিশালী হবে,এর ত্বরণও হবে তত বেশি। কিন্তু আবার গাড়ি যত বেশি ভারী হবে,একই বল এতে তত কম ত্বরণ উৎপন্ন করতে সক্ষম হবে।
নিউটনের গতি সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি বলের প্রভাবে বস্তুর মধ্যে কী প্রতিক্রিয়ার হচ্ছে। অন্য দিকে নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা মহাকর্ষ নামক বিশেষ বলটির শক্তি বের করতে জানলাম। আমরা আগেও বলেছি যে এই তত্ত্ব বলছে,প্রত্যেকটি বস্তু একে অপরকে এদের ভরের সমানুপাতিক একটি বলে আকর্ষণ করছে। কাজেই,কোনো একটি বস্তুর ভর দ্বিগুণ করলে এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল বল দ্বিগুণ হবে। এটা কেন হয় তা সহজেই বোধগম্য। কারণ নতুন বস্তুটিকে আগের  ভরবিশিষ্ট দুটি ভিন্ন বস্তু মনে করা যেতে পারে। এই দুটি বস্তুই অন্য বস্তুটিকে প্রাথমিক বলে আকর্ষণ করবে। ফলে নতুন অবস্থায় বস্তুদের আকর্ষণ আগের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। আবার ধরুন একটি বস্তুর ভর ছয় গুণ হল, অথবা একটি বস্তুর ভর দ্বিগুণ এবং অপরটির ভর তিন গুণ হল, তাহলে তাদের মধ্যকার নতুন বল ছয় গুণ  শক্তিশালী হবে।
এবার বোঝা যাচ্ছে, কেন সকল বস্তু একই হারে পড়ে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে দ্বিগুণ ভরের বস্তু দ্বিগুণ মহাকর্ষ বলে নিচের দিকে পড়বে। কিন্তু ভর দ্বিগুণ হবার কারণে আবার নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে এতে ত্বরণও হয়ে যাবে অর্ধেক। নিউটনের সূত্রের এই দুই প্রভাব একে অপরকে পুরোপুরি বাতিল করে দেয়। ফলে,ভর যাই হোক,ত্বরণ হবে একই।
দুইয়ের বেশি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষীয় টান [একটি বস্তুর ভর দ্বিগুণ হয়ে গেলে, এর উপর ক্রিয়াশীল মহাকর্ষও হবে দ্বিগুণ]
দুইয়ের বেশি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষীয় টান [একটি বস্তুর ভর দ্বিগুণ হয়ে গেলে, এর উপর ক্রিয়াশীল মহাকর্ষও হবে দ্বিগুণ]
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আরও বলছে,বস্তু যত দূরে থাকবে বল হবে তত কম। সূত্রের বক্তব্য হচ্ছে, কোনো নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় টান এর অর্ধেক দূরত্বে থাকা একই ভরের নক্ষত্রের চার ভাগের এক ভাগ হবে। এই সূত্রের মাধ্যমে পৃথিবী,চাঁদ এবং গ্রহদের কক্ষপথের পূর্বাভাস অনেকটা নির্ভুলভাবে পাওয়া গিয়েছিল। যদি দূরত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে মহাকর্ষের পরিবর্তন আরেকটু কম বা বেশি হত তবে গ্রহদের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার (Elliptical)হতে পারত না;হয় এরা সর্পিল পথ বেয়ে সূর্যের দিকে চলে যেত অথবা হারিয়ে যেত সূর্য থেকে দূরে। এরিস্টটলের সাথে নিউটন ও গ্যালিলীয় মতের একটি বড়সড় পার্থক্য আছে। এরিস্টটল স্থির অবস্থাকে বস্তুর মৌলিক ধর্ম মনে করেছিলেন,বল বা ঘাত প্রযুক্ত না হলে বস্তু স্থিরই থাকবে। বিশেষ করে, তিনি পৃথিবীকে স্থির ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিউটনের সূত্র থেকে দেখা যায় যে নির্দিষ্ট কোনো বস্তুকে আদর্শ স্থির বলার উপায় নেই। একটি বস্তু স্থির আছে এবং আরেকটু বস্তু ‘খ’ ’ক’ এর সাপেক্ষে গতিশীল- এটা যেমন বলা যেতে পারে, একইভাবে বলা যেতে পারে যে স্থির এবং ’খ’ এর সাপেক্ষে নির্দিষ্ট বেগে গতিশীল। যেমন আপনি যদি কিছুক্ষণের জন্যে পৃথিবীর নিজ অক্ষের চারদিকে আবর্তন এবং সূর্যের চারদিকে এর ঘূর্ণন গতির কথা ভুলে যান, তাহলে আপনি চাইলে বলতে পারেন যে পৃথিবী স্থির এবং এর উপর দিয়ে একটি ট্রেন ঘণ্টায় ৯০ মাইল বেগে উত্তর দিকে যাচ্ছে। আবার চাইলে এটাও বলতে পারেন যে ট্রেনটা স্থির এবং পৃথিবীই ঘণ্টায় ৯০ মাইল বেগে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। আপনি গতিশীল বস্তু নিয়ে ট্রেনের মধ্যে কোনো পরীক্ষা চালালেও নিউটনের সবগুলো সূত্র আগের মতোই ঠিকঠাক কাজ করবে। কে ঠিক তাহলে,নিউটন নাকি এরিস্টটল? এবং আপনি তা কীভাবে বুঝবেন?
একটি পরীক্ষা হবে এমনঃ ধরুন আপনি কোনো বক্সে আবদ্ধ আছেন এবং আপনি জানেন না বক্সটি কি কোনো চলন্ত ট্রেনের মেঝেতে আছে নাকি নিরেট পৃথিবীর বুকে আছে।  এক্ষেত্রে এরিস্টটলের মত অনুসারে পৃথিবী হচ্ছে আদর্শ স্থির বস্তু। এখন আসলে আপনি কোথায় আছেন তা বলার কোন উপায় আছে কি? যদি উপায় থেকে থাকে,তাহলে এরিস্টটল ঠিক আছেন অর্থ্যাৎ পৃথিবীতে স্থির থাকা একটি বিশেষ ব্যাপার। কিন্তু আপনি যদি চলন্ত ট্রেনে রাখা বক্সে কোনো পরীক্ষা চালান তাহলে সেটি ট্রেনের স্থিরপ্ল্যাটফর্মে রাখা বক্সের মধ্যে চালানো পরীক্ষার মতো হুবহু একই ফল দেবে। এখানে অবশ্য আমাদেরকে ধরে নিতে হবে ট্রেন চলার সময় কোন ধাক্কা,মোড় বা অন্য কোনো অস্বাভাবাবিকতা থাকবে না। ট্রেনের ভেতরে পিন-পং খেললেও দেখা যাবে রেল লাইনের পাশের কোনো টেবিলে পিং-পং খেলার সাথে এর কোনো পার্থক্য নেই। আপনি যদি বক্সে বসে পৃথিবীর সাপেক্ষে বিভিন্ন বেগে যেমন ঘণ্টায় শূন্য,পঞ্চাশ ও ৯০ মাইল বেগে গেমটি খেলেন,তাহলে প্রতি ক্ষেত্রেই বল একই আচরণ করবে। বিশ্ব এভাবেই কাজ করে আর নিউটনের সূত্রের গাণিতিক দিকও এটাই বলতে চায়। পৃথিবী গতিশীল নাকি ট্রেন- তা বলার কোনো উপায় নেই। গতির বিষয়টা অর্থবহ হয়ে ওঠে তখনি, যখন একে অন্য বস্তুর সাথে তুলনা করা হয়।
এরিস্টটল নাকি নিউটন সঠিক তার সত্যিই কি কোনো গুরুত্ব আছে? পার্থক্যটা শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কি না? বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব কতখানি? সত্যি বলতে, পরম আদর্শ স্থিরবস্তুর অভাব পদার্থবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর অর্থ হচ্ছে, ভিন্ন সময়ে ঘটা দুটো ঘটনা ঠিক একই স্থানে ঘটেছে কিনা তা আমরা বলতে পারব না।
আরেকটু স্পষ্ট করি। মনে করুন, কেউ ট্রেনের মধ্যে একটি পিং-পং বল উঠা- নামা করাচ্ছে। বলটি এক সেকেন্ড পর পর টেবিলের একই বিন্দুতে ধাক্কা খাচ্ছে। এই লোকটির কাছে বলের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কার স্থান একই থাকছে। কিন্তু রেল লাইনের পাশে দাঁড়ানো কারো কাছে মনে হবে, বলের দুইটি ধাক্কা ৪০ মিটার দূরে দূরে হচ্ছে, কারণ ততক্ষণে ট্রেন এই পরিমাণ পথ অতিক্রম করেছে। নিউটনের মতে দুই পর্যবেক্ষকেরই নিজেকে স্থির মনে করার সমান অধিকার আছে। তার মানে দুটো মতই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। এরিস্টটলের বিশ্বাসের বিপরীতে কোনো একটির উপর অন্য কোনোটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। ট্রেনে ও রেল লাইনের পাশে থাকা ব্যক্তির জন্যে বিভিন্ন ঘটনার দৃশ্যমান অবস্থান ও তাদের মধ্যকার দূরত্বের হিসাব ভিন্ন ভিন্ন হবে। একজনের তুলনায় আরেকজনের পর্যবেক্ষণকে ভালো বলার পেছনে কোনো যুক্তি নেই।
picture2
স্থানের আপেক্ষিকতা
একটি বস্তুর অতিক্রান্ত দূরত্ব এবং চলাচলের পথ ভিন্ন ভিন্ন দর্শকের কাছে আলাদা মনে হতে পারে।
পরম অবস্থান বা কথিত পরম স্থান নামক জিনিসটির অভাব নিউটনকে চিন্তিত করে তোলে, কারণ এটা তাঁর পরম ঈশ্বরের ধারণার সাথে খাপ খাচ্ছিল না। এবং তিনি পরম স্থানের অভাবকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন, যদিও তাঁর নিজেই সূত্রই দিয়েছিল তার বিপরীত ইঙ্গিত। এই অযৌক্তিক বিশ্বাসের জন্যে অনেকেই তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দার্শনিক বিশপ বার্কলে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সব জড় বস্তু এবং স্থান ও কাল আসলে ভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। বিখ্যাত ডঃ জনসন বার্কলের মন্তব্য শুনে বড় একটি পাথরের মধ্যে লাথি মেরে চিৎকার করে বলেন,
আমি এই কথাকে এইভাবে খণ্ডন করছি।
 এরিস্টটল ও নিউটন দুজনেই সময়কে পরম করতেন। অর্থ্যাৎ তাঁদের বিশ্বাস ছিল, ভালো একটি ঘড়ির সাহায্যে কেউ দুটো ঘটনার মধ্যবর্তী সময় সঠিকভাবে মাপতে পারবেন এবং যে কারো মাপা সময় একই পাওয়া যাবে। পরম স্থানের ধারণা নিউটনের সূত্রে ভুল মনে হলেও পরম সময়ের ব্যাপারে কোনো রকম অসংগতি ছিল না। অধিকাংশ মানুষও একেই স্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরে নেবেন। কিন্তু বিংশ শতকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, স্থান এবং সময় দুটো সম্পর্কেই প্রচলিত ধারণা বদলে ফেলতে হবে। আমরা পরে দেখবো, তাঁরা আবিষ্কার করলেন যে বিভিন্ন ঘটনা যেমন পিং পং বল কোথায় ধাক্কা খাচ্ছে তার মধ্যবর্তী সময়ের ব্যাবধান নির্ভর করছে পর্যবেক্ষকের উপর। তাঁরা আরও আবিষ্কার করলেন, সময় স্থান থেকে একেবারে আলাদা ও স্বতন্ত্র নয়। আলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান এই উপলব্ধির পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। একে আমাদের অভিজ্ঞতার বিপরীত মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের সহজাত ধারণা অপেক্ষাকৃত ধীর বস্তু যেমন আপেল বা গ্রহদের বেলায় বেশ ভাল কাজ করলেও আলোর সমান বা কাছাকাছি বেগে চলন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে তা একেবারেই অকেজো।
[অনুবাদকের নোটঃ
১। সময়ের সাথে বেগের এই পরিবর্তনকেই আমরা ত্বরণ বলি। একটু পরেই এই ধারণা আবার কাজে লাগবে।
২। বলটি হল বস্তুর ওজোন। আমরা সাধারণত যাকে ওজোন বলি, বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় ভর। একটি বস্তুতে মোট কতটুকু পদার্থ আছে সেটাই হল তার ভর। আর ওজোন হল এক প্রকার বল। পৃথিবী কোনো বস্তুকে যে বলে নিজের দিকে টানে সেটাই হল তার ওজোন। গাণিতিকভাবে এর মান বের করা হয় ভরের সাথে পৃথিবীর অভিকর্ষজনিত ত্বরণ (যার মান প্রতি বর্গ সেকেন্ডে গড়ে ৯.৮১ মিটার) গুণ করে। সাধারণত পৃথিবীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও ওজোন কথাটি অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ বা নক্ষত্রের বেলায়ও ব্যবহৃত হতে পারে।]


কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৫


পঞ্চম অধ্যায়ঃ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব

ড্যানিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে ক্রিস্টেনসেন রোমা (Ole Christensen Roemer) ১৬৭৬ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন যে অনেক বেশি গতিতে চললেও আলো আসলে একটি নির্দিষ্ট গতিতেই চলাচল করে। বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহগুলো পর্যবেক্ষণ করলে আপনি দেখবেন, মাঝেমাঝে এরা চোখের আড়ালে চলে যায়, যার কারণ তখন এরা বিশাল গ্রহটির পেছনে থাকে। মনে করা হয়েছিল যে বৃহস্পতির উপগ্রহদের গ্রহণ (বৃহস্পতির আড়ালে চলে যাওয়া) নির্দিষ্ট সময় পর পর ঘটবে। কিন্তু রোমা খেয়াল করলেন, গ্রহণগুলো নির্দিষ্ট সময় মেনে হচ্ছে না। তাহলে কি উপগ্রহগুলো তাদের কক্ষপথে থাকা অবস্থায় কোনোভাবে গতি বাড়িয়ে বা কমিয়ে ফেলে? তাঁর কাছে ছিল আরেকটি বিকল্প ব্যাখ্যা। আলো যদি অসীম বেগে চলে, তাহলে পৃথিবীতে বসে আমরা নিয়মিত বিরতিতে গ্রহণ দেখব-ঠিক যে মুহূর্তে তা ঘটবে তখনি, কসমিক ক্লকের দেওয়া টিকের মতো। যেহেতু আলো যে কোনো দূরত্বই মুহূর্তের মধ্যে পার হয়ে যাবে, তাই বৃহস্পতি পৃথিবীর কাছে আসল কি দূরে গেল তাতে কোনো পার্থক্য তৈরি হবে না।
এবার কল্পনা করুন যে আলো একটি নির্দিষ্ট বেগে চলছে। সেক্ষেত্রে আমরা প্রতিটি গ্রহণ দেখবো তা ঘটে যাবার কিছু সময় পরে [১]। কতটুকু দেরি হবে তা নির্ভর করবে আলোর বেগ এবং পৃথিবী থেকে বৃহস্পতির দূরত্বের উপর। বৃহস্পতি থেকে যদি পৃথিবীর দূরত্ব অপরিবর্তিত থাকে তাহলে প্রতিটি গ্রহণের ক্ষেত্রে একই পরিমাণ করে দেরি হবে। কিন্তু বাস্তবে বৃহস্পতি অনেক সময় পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে। এ সময়গুলোতে প্রতিটি গ্রহণের চিত্র আমাদের চোখে পৌঁছতে ক্রমান্বয়ে কম দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। ফলে, গ্রহণের দৃশ্য আমাদের চোখে ক্রমান্বয়ে আগের চেয়ে দ্রুত আসবে। উল্টোভাবে বৃহস্পতি যখন পৃথিবী থেকে দূরে সরবে তখন প্রতিটি গ্রহণ ক্রমান্বয়ে দেরিতে ঘটতে দেখা যাবে। কতটুকু আগে বা পরে গ্রহণের এই দৃশ্য পৌঁছবে তা নির্ভর করবে আলোর বেগের উপর।  ফলে আমারা আলোর বেগ মাপার উপায় পেয়ে যাচ্ছি। রোমা সাহেব এ কাজটিই করেছিলেন।
তিনি লক্ষ্য করলেন, পৃথিবী বৃহিস্পতির কক্ষপথের নিকটবর্তী হবার সময় বৃহস্পতির একটি উপগ্রহের [] গ্রহণ অপেক্ষাকৃত আগে ঘটছে এবং পৃথিবী বৃহিস্পতি থেকে দূরে সরার সময় গ্রহণ অপেক্ষাকৃত দেরিতে হচ্ছে। এই পার্থক্য কাজে লাগিয়ে তিনি আলোর বেগ হিসাব করে ফেললেন। অবশ্য, তিনি খুব বেশি নিখুঁতভাবে পৃথিবী ও বৃহস্পতির দূরত্বের পরিবর্তন পরিমাপ করতে পারেননি। ফলে, তাঁর মাপা আলোর বেগ হয়েছিল সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মাইল, যার আধুনিক মান হল সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। তবুও আলোর বেগকে সসীম প্রমাণ করা এবং একই সাথে তার মান বের করার ক্ষেত্রে রোমার অর্জনটুকু ছিল বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা প্রকাশিত হবার দশ বছর আগেই তিনি তাঁর এই ফলাফল ঘোষণা করেন।
আলোর গতি ও গ্রহণের সময়
আলোর গতি ও গ্রহণের সময়। বৃহস্পতির উপগ্রহদের গ্রহণ কখন দেখা যাবে সেটা এক দিকে গ্রহণের সময়ের উপরও নির্ভর করে, আবার বৃহস্পতি থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে কত সময় লাগে তার উপরও নির্ভর করে। ফলে বৃহস্পতি যখন পৃথিবীর কাছে আসে, তখন গ্রহণ বেশি বেশি হতে দেখা যায়। আর গ্রহটি পৃথিবী থেকে দূরে যেতে থাকলে গ্রহণ কম চোখে পড়ে।
আলোর চলাচল সম্পর্কে প্রকৃত তত্ত্ব পেতে তবু ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল কিছু বিচ্ছিন্ন তত্ত্বকে জোড়া দিতে সক্ষম হলেন। এই তত্ত্বগুলো সেই সময় পর্যন্ত তড়িৎ ও চৌম্বক বলের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হত। প্রাচীন কাল থেকেই তড়িৎ ও চৌম্বক বলের সাথে মানুষের পরিচয় থাকলেও মাত্র অষ্টাদশ শতকে এসে ব্রিটিশ রসায়নবিদ হেনরি ক্যাভেন্ডিশ ও ফরাসী পদার্থবিদ চার্লস কুলম্ব দুটো চার্জিত বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল তড়িৎ বল পরিমাপ করার সূত্র তৈরি করেন। কয়েক দশক পর- ঊনবিংশ শতকের শুরুতে কয়েকজন পদার্থবিজ্ঞানী চৌম্বক বলের জন্যেও অনুরূপ সূত্র বানিয়ে ফেলেন। ম্যাক্সওয়েল গাণিতিকভাবে দেখালেন যে কণিকাদের সরাসরি পারস্পরিক ক্রিয়ার কারণে এই তড়িৎ ও চৌম্বক বলের সৃষ্টি হয় না; বরং প্রতিটি তড়িৎ আধান (চার্জ) ও প্রবাহ (কারেন্ট) এর চারপাশের অঞ্চলে একটি ক্ষেত্র (Field) তৈরি করে। এই ক্ষেত্রই নিকটস্থ অন্য সব আধান ও প্রবাহের উপর বল প্রয়োগ করে। তিনি দেখলেন যে একটিমাত্র ক্ষেত্রই তড়িৎ ও চৌম্বক বল বহন করে। অর্থ্যাৎ, তড়িৎ ও চৌম্বক বল আসলে একই বলের অবিচ্ছদ্য রূপ। তিনি একে নাম দিলেন তড়িচ্চুম্বকীয় বল (Electromagnetic force)। বল বহনকারী ক্ষেত্রের নাম দিলেন তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র।
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ এই পূর্বাভাস দিল যে তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে তরঙ্গের মতো উত্তেজনা (disturbance) দেখা যেতে পারে। এছাড়াও এই তরঙ্গ চলবে একটি নির্দিষ্ট গতিতে, অনেকটা পুকুরে সৃষ্ট ঢেউয়ের মতো। এই গতি পরিমাপ করে তিনি দেখলেন, এর মান হচ্ছে আলোর বেগের সমান!  আজকে আমরা জানি, ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটারের [৩] মধ্যে থাকলে তা আমাদের চোখে আলো হিসেবে দৃশ্যমান হয়। (ক্রমান্বয়ে চুড়া ও খাঁজ তৈরি হওয়াকে বলে তরঙ্গ, আর চূড়া ও খাঁজগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে) যেসব তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে কম তাদেরকে অতিবেগুনি, এক্স-রে এবং গামা রাশ্মি বলে। অন্য দিকে, আরো বড় দৈর্ঘ্যের তরঙ্গকে বেতার (এক মিটার বা তার চেয়ে বড়), মাইক্রোওয়েভ (প্রায় এক সেন্টিমিটার) অথবা অবলোহিত বিকিরণ (এক সেন্টিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম কিন্তু দৃশ্যমান পাল্লার চেয়ে বড়) বলে।
তরঙ্গ
তরঙ্গ। পর পর দুটি চূড়া বা খাঁজের মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে।
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে বোঝা গেল যে বেতার বা আলোক তরঙ্গ একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলবে। পরম আদর্শ স্থির বস্তু বলতে কিছু নেই- নিউটনের এই বক্তব্যের সাথে এই কথাকে ঐকতানে আনা কঠিন হয়ে গেল। কারণ এমন কোন আদর্শ না থাকলে একটি বস্তুর গতির ব্যাপারে সবাই একমত হতে পারবে না। এটি কেন হয় বুঝতে হলে আবারও মনে করুন আপনি ট্রেনের মধ্যে পিং-পং খেলছেন। আপনি ট্রেনের সামনের দিকে বলটিকে ছুঁড়ে দিলেন। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে যদি এর বেগ ঘণ্টায় দশ মাইল হয় তাহলে আপনি আশা করবেন যে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কোনো পর্যবেক্ষক বলটিকে ঘণ্টায় একশ মাইল বেগে যেতে দেখবে। এর মধ্যে দশ হচ্ছে ট্রেনের সাপেক্ষে বেগ এবং নব্বই হচ্ছে প্ল্যাটফর্মের সাপেক্ষে ট্রেনের নিজস্ব বেগ। বলের গতিবেগ আসলে কত, ঘণ্টায় দশ মাইল নাকি একশ মাইল? আপনি একে কার সাপেক্ষে বলবেন-ট্রেনের নাকি পৃথিবীর? পরম আদর্শ স্থির বস্তু বলে কিছু না থাকলে আপনি বলটির জন্যে কোনো পরম গতি নির্ধারণ করতে পারবেন না। একইভাবে আপনি কার সাপেক্ষে বলছেন তার উপর ভিত্তি করে ঐ একই বলের গতি যে কোনো কিছু হতে পারে। নিউটনের তত্ত্ব সত্য হলে একই নীতি মানতে হবে আলোকেও। তাহলে ম্যাক্সওয়েলের থিওরিতে আলোক তরঙ্গের বেগ থাকার নির্দিষ্ট কী অর্থ?
পিং- পং বলের বিভিন্ন গতিবেগ
পিং- পং বলের বিভিন্ন গতিবেগ। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, কারো মত অন্য কারো সাথে যদি নাও মেলে, তবুও প্রত্যেকেরই নিজস্ব মত সঠিক।
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বকে নিউটনের সূত্রের সাথে সন্ধি করানোর জন্যে ইথার নামক একটি বস্তু কল্পনা করা হল, যেটি সর্বত্র উপস্থিত বলে ধরে নেওয়া হয়। এমনকি এটি উপস্থিত শুন্য স্থানেও। বিজ্ঞানীরা এই ইথারের ধারণাকে লুফে নিলেন। তাঁরা ভাবলেন, যেমনি করে জল তরঙ্গের জন্যে পানি বা শব্দ তরঙ্গের জন্যে বাতাস দরকার, তেমনি তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির প্রবাহের জন্যেও একটি মাধ্যমের প্রয়োজন। এই মত অনুসারে, শব্দ তরঙ্গ যেভাবে বাতাস বেয়ে চলে তেমনি আলোক তরঙ্গ চলে ইথার বেয়ে। ফলে, ম্যাক্সয়েলের সমীকরণ থেকে প্রাপ্ত আলোর বেগকে ইথারের সাপেক্ষে বিবেচনা করতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষক আলোকে ভিন্ন বেগে আসতে দেখবে ঠিকই, কিন্তু ইথারের সাপেক্ষে এর বেগ থাকবে একই।
এই মতের পরীক্ষা নেওয়া যেত। মনে করুন, একটি উৎস থেকে আলো নির্গত হল। ইথার তত্ত্ব অনুসারে, আলো এর নিজস্ব বেগে ইথার ভেদ করে চলে। আপনি ইথারের মধ্য দিয়ে আলোর দিকে যেতে থাকলে, আলোর দিকে আপনার গতিবেগ হবে ইথারে আলোর বেগ ও ইথারে আপনার নিজস্ব বেগের যোগফলের সমান। আপনি স্থির থাকলে বা অন্য কোন দিকে গেলে আলোর বেগ যা হত, এক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি হবে।  কিন্তু আমরা কোনো আলোক উৎসের দিকে সর্বোচ্চ যে বেগে যেতে পারি তার তুলনায় আলোর বেগ অনেক বেশি হওয়ায় বেগের এই পার্থক্য পরিমাপ করা সহজ কাজ ছিল না।
১৮৮৭ সালে অ্যালবার্ট মাইকেলসন (যিনি পরে প্রথম আমেরিকান হিসেবে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান) ও এডওয়ার্ড মর্লি নিবিড় যত্নের সাথে একটি কঠিন পরীক্ষা পরিচালনা করেন [৪]। পরীক্ষার স্থান ছিল ক্লিভল্যান্ডের কেইস স্কুল অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স (বর্তমানে এর নাম কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি)। তাঁরা বুঝতে পারলেন, যেহেতু পৃথিবী এর কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে সেকন্ডে প্রায় বিশ মাইল বেগে ঘুরছে, তাহলে তাদের পরীক্ষাগারও ইথারের মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি বেগে ছুটবে। কিন্তু কেউই জানত না কোন দিকে বা কত গতিতে ইথার সূর্যের সাপেক্ষে গতিশীল অথবা আদৌ এটি গতিশীল কি না। কিন্তু বছরের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবী এর কক্ষপথের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে (এবং ভিন্ন দিকে গতিশীল) থাকায় একই পরীক্ষা বার বার করার মাধ্যমে এই অজানা বিষয়টি জেনে ফেলার আশা ছিল। এই উদ্দেশ্যে মাইকেলসন ও মর্লি সাহেব পরীক্ষাটিকে এভাবে সাজালেন- ইথারের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর গতির দিকে (যখন আমরা আলোক উৎসের দিকে গতিশীল) প্রাপ্ত আলোর বেগকে এই গতির সমকোণের দিকে (যখন আমরা উৎসের দিকে গতিশীল নই) আলোর বেগের সাথে তুলনা করতে হবে। বিস্ময়ের সাথে তাঁরা লক্ষ্য করলেন, উভয় দিকেই আলোর বেগ ঠিক একই!
১৮৮৭ সাল থেকে ১৯০৫ সাল। ইথার তত্ত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে চেষ্টা কম করা হল না। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা ছিল ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী হেনড্রিক লরেন্টজের। তিনি মাইকেলসন- মর্লি পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের ব্যখ্যা দেবার জন্যে বললেন, ইথারের মধ্য দিয়ে চলার সময় বস্তুর দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যায় ও ঘড়ি ধীরে চলে। কিন্তু ১৯০৫ সালে সুইশ প্যাটেন্ট অফিসের একজন অখ্যাত ব্যক্তি একটি বিখ্যাত গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। ব্যক্তিটি আর কেউ নন, স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বললেন, আমরা যদি পরম সময়ের ধারণা বাদ দিতে রাজি হই, তাহলে ইথারের কোন প্রয়োজনই পড়ে না (আমরা একটু পরই এর কারণ দেখবো)। কয়েক সপ্তাহ পরে বিখ্যাত ফরাসী গণিতবিদ অঁরি পয়েনকেয়ার একই রকম কথা বললেন। পয়েনকেয়ারের চেয়ে আইনস্টাইনের যুক্তিগুলো পদার্থবিদ্যার মূলনীতির বেশি কাছাকাছি ছিল। পয়েনকেয়ার সমস্যাটিকে নিতান্তই গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছিলেন। এমনকি তিনি তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্তও আইনস্টাইনের ব্যখ্যা মেনে নেননি।
আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বের মৌলিক স্বীকার্যে বললেন, যে কোনো বেগে মুক্তভাবে গতিশীল সকল পর্যবেক্ষকের জন্যে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো একই থাকবে। নিউটনের গতি সূত্রের জন্যেও এটি সঠিক ছিল। কিন্তু আইনস্টাইন একে আরেকটু লম্বা করে এতে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বও নিয়ে এলেন। অন্য কথায়, যেহেতু ম্যাক্সওয়েলের থিওরি বলছে আলোর বেগের একটি নির্দিষ্ট মান আছে, অতএব মুক্তভাবে গতিশীল সকল পর্যবেক্ষক এই একই মান পাবেন। এক্ষেত্রে তারা কত বেগে উৎস থেকে দূরে যাচ্ছেন বা কাছে আসছেন তা মোটেই বিবেচ্য নয়। এই সাধারণ বক্তব্যের মাধ্যমে ইথার বা অন্য কোনো পছন্দনীয় প্রসঙ্গ কাঠামোর ব্যবহার করা ছাড়াই ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের অর্থ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হল। এর অনেকগুলো সুদূরপ্রসারী ভূমিকা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছিল স্বাভাবিক বুদ্ধির বিপরীত।
যেমন, সকল পর্যবেক্ষক যদি আলোর বেগ একই মাপেন তাহলে আমদেরকে সময়ের ধারণা পাল্টে ফেলতে হয়। গতিশীল ট্রেনের কথা আবার একটু ভাবুন। চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, কেউ ট্রেনের মধ্যে পিং-পং বলকে উপরে ও নিচে বাউন্স করিয়ে এদেরকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি নড়তে দেখলেও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কেউ বলটিকে প্রায় চল্লিশ মিটার যেতে দেখবে। একইভাবে, ট্রেনে থাকা পর্যবেক্ষক কোনো আলো জ্বালালে আলোর অতিক্রান্ত দূরত্ব সম্পর্কেও দুই পর্যবেক্ষক ভিন্ন মত দেবেন। আমরা জানি, দূরত্বকে সময় দ্বারা ভাগ দিলে বেগ পাওয়া যায়। তাহলে তাদের দুজনের মাপা দূরত্ব যদি ভিন্ন হয়, সেক্ষেত্রে তাদের উভয়ের পরিমাপকৃত আলোর বেগ একই হতে হলে তাদের দুজনের মাপা সময়ও ভিন্ন হতে হবে। অর্থ্যাৎ, আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের মাথা থেকে পরম সময়ের ভাবনা সরিয়ে ফেলতে চায়। বরং প্রত্যেক পর্যবেক্ষক তার ঘড়িতে সময়ের জন্যে নিজস্ব একটি মান পাবেন। একই রকম ঘড়ি দিয়ে সময় মেপে অন্য কেউ একই মান নাও পেতে পারেন।
আপেক্ষিক তত্ত্ব মেনে নিলে ইথার নামক কোনো কিছুর উপস্থিতির প্রয়োজনই নেই। মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষায় এই ইথারের কোনো অস্তিত্ব ধরা পড়েনি। বরং আপেক্ষিক তত্ত্বের দাবি হল, স্থান ও কাল সম্পর্কে আমাদের মৌলিক ধারণাটিই পাল্টে ফেলতে হবে। আমাদেরকে মেনে নিতে হবে যে ‘কাল’ ‘স্থান’ থেকে একেবারে আলাদা ও স্বতন্ত্র নয়। দুটো একত্রে মিলেমিশে তৈরি করেছে স্থান-কাল নামে একটি জিনিস। এই ধারণাগুলো বুঝে নেওয়া একটু কঠিনই বটে। পদার্থবিজ্ঞানীরাও আপেক্ষিক তত্ত্বকে মেনে নিতে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দেন। আইনস্টাইন আগেভাগেই এটি বুঝে ফেলার মাধ্যমে তাঁর উন্নত কল্পনাশক্তির পরিচয় দেন। নিজের যুক্তির প্রতি আত্মবিশ্বাস তাঁকে সেই যুক্তিগুলোর ফলাফল বের করতে উদ্বুদ্ধ করে, যদিও সেই ফলাফল ইঙ্গিত করছিল অদ্ভুত কিছু সিদ্ধান্তের দিকে।
আমরা সবাই জানি যে কোনো স্থানের একটি বিন্দুর অবস্থান বোঝানোর জন্যে আমরা তিনটি সংখ্যা বা স্থানাঙ্ক ব্যবহার করি। যেমন আমরা হয়ত বলতে পারি যে কোনো কক্ষের একটি বিন্দু কোনো একটি দেয়াল থেকে ৭ মিটার দূরে আছে, অপর একটি দেয়াল থেকে ৩ মিটার এবং মেঝে থেকে ৫ মিটার উপরে আছে। অথবা আমরা বলতে পারি এভাবে-একটি বিন্দু একটি নির্দিষ্ট অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে এবং সমুদ্র স্তর থেকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় আছে। আমরা আমাদের সুবিধামতো যে কোনো তিনটি স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি। অবশ্য এই স্থানাঙ্কদের গ্রহণযোগ্যতার একটা সীমারেখা আছে।
চাঁদের অবস্থানকে পিকাডিলি সার্কাসের পশ্চিম ও উত্তর এবং সমুদ্র স্তর থেকে উচ্চতার মাধ্যমে বোঝানো হলে তবে তাতো আর বাস্তবসম্মত হবে না। এক্ষেত্রে বরং আমরা এ রকম তিনটি স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারিঃ এক, সূর্য থেকে এর দূরত্ব। দুই, গ্রহদের কক্ষীয় তল থেকে দূরত্ব এবং তিন, সূর্য ও চাঁদের সংযোজক রেখা এবং সূর্য ও কাছাকাছি থাকা অন্য কোনো নক্ষত্র যেমন প্রক্সিমা সেন্টোরির সংযোজক রেখা দুইটি দ্বারা উৎপন্ন কোণ। আবার আমাদের গ্যালাক্সিতে সূর্যের অথবা লোকাল গ্রুপে [৫] আমাদের গ্যালাক্সির অবস্থান বর্ণনা করতে গেলে এই স্থানাঙ্কগুলোও কাজে আসবে না। সত্যি বলতে পরস্পরকে ছেদ করা অনেকগুলো দাগের মাধ্যমে আমরা পুরো মহাবিশ্বের অবস্থান নির্দেশ করতে পারি। সেক্ষেত্রে একটি বিন্দুর অবস্থান বোঝানোর জন্যে প্রত্যেকটি দাগে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানাঙ্ক বসাতে হবে।
স্থানাঙ্ক।
স্থানাঙ্ক। স্থানের তিনটি মাত্রা (Dimension) আছে বলতে আমরা বুঝি একটি বিন্দুর অবস্থান নির্দেশ করতে আমরা তিনটি সংখ্যা বা স্থানাঙ্ক ব্যবহার করি। এর সাথে সময় যোগ করলে স্থান চার মাত্রার স্থান-কালে পরিণত হয়।
নির্দিষ্ট কোনো স্থান ও সময়ে ঘটা কোনো ঘটনাকে আপেক্ষিক তত্ত্বের স্থান- কালে চারটি সংখ্যা বা স্থানাঙ্ক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এখানেও স্থানাঙ্কের ব্যবহার নির্ভর করে  ইচ্ছার উপর। আমরা সময় পরিমাপের পাশাপাশি স্থানের যে-কোনো তিনটি সুসংজ্ঞায়িত স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে স্থান ও কালের স্থানাঙ্কের মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। স্থানের যে কোনো দুটি স্থানাঙ্কের মধ্যে যেমন সত্যিকারের কোনো পার্থক্য থাকে না ব্যাপারটা ঠিক তেমনই। আমরা চাইলে নতুন এক গুচ্ছ স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি। যেমন স্থানের প্রথম স্থানাঙ্কটি বানানো হবে স্থানের আগের স্থানাঙ্কের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাঙ্কের সমন্বয়ে। তাহলে পৃথিবীতে কোনো বিন্দুর অবস্থান বোঝানোর জন্যে আমরা জায়গাটি পিকাডিলির কত মাইল উত্তরে ও পশ্চিমে আছে তা না বলে আমরা বলতে পারি এটি পিকাডেলি থেকে কত মাইল উত্তর- পূর্ব ও কত মাইল উত্তর- পশ্চিমে আছে। একইভাবে আমরা সময়ের জন্যে নতুন স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি। আগের সময়ের (সেকেন্ডের হিসাবে) সাথে পিকাডেলির উত্তর দিকের দূরত্ব সমন্বিত করে এটা তৈরি করা যেতে পারে। এই দূরত্বের একক হতে পারে আলোক সেকেন্ড [৬]
আপেক্ষিক তত্ত্বের আরেকটি সুপরিচিত ফলাফল হল ভর ও শক্তির সমতুল্যতা। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc^2 এদের মধ্যে সম্পর্ক নির্দেশ করে। এখানে E হল শক্তি, m হল ভর এবং c হল আলোর গতিবেগ। অল্প কিছু ভরকে বিশুদ্ধ তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণে রূপান্তরিত করলে কী পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে তা বের করতে এই সূত্র খুব বেশি কাজে লাগে। আলোর বেগের মান অনেক বড় একটি সংখ্যা হওয়ায় পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। হিরোশিমা শহরকে ধ্বংস করেছে যে বোমা তাতে ভর ছিল এক আউন্সেরও [৭] কম। কিন্তু সূত্রটি থেকে আমরা আরও জানতে পারছি যে বস্তুর শক্তি বাড়তে থাকলে এর ভরও বেড়ে যায়। আর ভর বাড়লেই কিন্তু ত্বরণ (বেগের পরিবর্তন) বাধাপ্রাপ্ত হয়।
শক্তির একটি রূপ হচ্ছে গতিশক্তি। একটি গাড়িকে গতিশীল করতে যেমন শক্তির প্রয়োজন হয়, তেমনি যে- কোনো বস্তুর গতি বাড়াতেও শক্তির প্রয়োজন। বস্তুকে গতিশীল করতে যে শক্তি খরচ করতে হয়, গতিশীল বস্তুর গতিশক্তির সাথে তার আদৌ কোন পার্থক্য নেই। এর ফলে বস্তু যত বেশি দ্রুত চলে, ততই এর গতিশক্তি বেড়ে যেতে থাকে। কিন্তু ভর ও শক্তির সমতুল্যতা অনুসারে গতিশক্তি বাড়ার কারণে বস্তুর ভরও বেড়ে যায়। এ কারণে একটি বস্তু যত বেশি দ্রুত চলে, এর গতি আরও বৃদ্ধি করা তত কঠিন হয়ে পড়ে [৮]
আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলা বস্তুর ক্ষেত্রে এই প্রভাব সত্যিই লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।  যেমন, আলোর ১০ শতাংশ গতিতে চলা বস্তুর ভর স্বভাবিকের চেয়ে মাত্র ০.৫ শতাংশ বেশি হবে। কিন্তু আলোর ৯০ শতাংশ গতিতে চলা বস্তুর ক্ষেত্রে ভর স্বাভাবিকের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হবে। আলোর গতির কাছাকাছি যেতে থাকলে ভর আরও বেশি বাড়তে থাকে। ফলে বেগ আরও বাড়াতে তুলনামূলক আরও বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে একটি বস্তু কখনোই আলোর সমান গতি অর্জন করতে পারবে না। কারণ, ততক্ষণে এর ভর হয়ে যাবে অসীম। আর ভর ও শক্তির সমতুল্যতা অনুসারে আলোর গতি অর্জন করতে হলে খরচ করতে হবে অসীম পরিমাণ শক্তি। এই কারণেই যে-কোনো সাধারণ বস্তু সব সময় আলোর চেয়ে অল্প গতিতে চলতে বাধ্য হয়। আলো বা এমন কোনো তরঙ্গ, যার অভ্যন্তরীণ কোনো ভর নেই, তাই কেবল  আলোর সমান গতিতে চলতে পারে।
১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের বিশেষ আপক্ষিক তত্ত্ব। একে বিশেষ বলার কারণ হচ্ছে, সকল পর্যবেক্ষকের কাছে আলোর বেগ কেন একই থাকে এবং আলোর কাছাকাছি গতিতে চললে কী ঘটবে এটি তা ব্যাখ্যা করতে পারলেও নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্রের সাথে এর বনিবনা হচ্ছিল না। নিউটনের তত্ত্ব বলছে, কোনো একটি মুহূর্তে বস্তুরা একে অপরের সাথে যে বলের মাধ্যমে আকৃষ্ট হয় তা এদের সেই মুহূর্তের দূরত্বের উপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হবে, আপনি একটি বস্তুকে সরিয়ে দিলে আরেকটির উপর এর দ্বারা ক্রিয়াশীল বল সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে। যেমন ধরুন, হঠাৎ করে সূর্য উধাও হয়ে গেল। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা জানি, আরও আট মিনিট পৃথিবী আলোকিত থাকবে (কারণ সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে এটুকু সময়ই লাগে)। কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্র অনুসারে সূর্য উধাও হয়ে যাবার  সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবী সূর্যের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে এবং কক্ষপথে ছিটকে দূরে চলে যাবে। অর্থ্যাৎ, সূর্য উধাও যাবার মহাকর্ষীয় প্রভাব আমাদের কাছে চলে আসবে অসীম গতিতে। কিন্তু আলোর চেয়ে বেশি এই গতি বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বকে মহাকর্ষীয় তত্ত্বের সাথে জোড়া লাগাতে আইনস্টাইন ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে অনেকগুলো প্রচেষ্টা চালান। ব্যর্থ হন তার প্রতিটিতেই। শেষ পর্যন্ত ১৯১৫ সালে তিনি এর চেয়ে বড় বৈপ্লবিক তত্ত্ব নিয়ে আসেন। একেই এখন আমরা জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব বলি।
[অনুবাদকের নোটঃ
১। কারণ আমরা কোনো কিছু দেখি বস্তু থেকে আসা আলো আমাদের চোখে প্রবেশ করলে।
২। এটি ছিল বৃহস্পতির উপগ্রহ আয়ো।
৩। এক ন্যানোমিটার এক মিটারের একশো কোটি ভাগের কে ভাগের সমান।
৪। পরীক্ষাটি পথমে মাইকেলসন একা চালিয়েছিলেন। পরে দুজনে মিলে করে আরো নিখুঁত ফল পান।
৫। লোকাল গ্রুপঃ আমাদের সূর্যকে ধারণকারী মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেসহ ৫৪টির বেশি গ্যালাক্সি নিয়ে তৈরি একটি গ্যালাক্সি গ্রুপের নাম লোকাল গ্রুপ।
৬। অর্থ্যাৎ ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল, যেহেতু আলো এক সেকেন্ডে এই পরিমাণ দূরত্ব যায়।
৭। এক আউন্স ২৮ গ্রামের একটু বেশি।
৮। যেহেতু বেশি ভরের বস্তুর গতি বাড়াতে বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয়।]


 

কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৬


ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ স্থানের বক্রতা
আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বও একটি বৈপ্লবিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। কথাটি হল, মহাকর্ষ আসলে অন্যান্য বলের মতো কোনো বল নয়। আগে স্থান- কালকে সমতল মনে করা হত, কিন্তু স্থান- কাল আসলে অসমতল। আর মহাকর্ষ এই অসমতল স্থান- কালেরই ফলাফল। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে ভর ও শক্তির উপস্থিতিতে স্থান- কাল বেঁকে যায়। পৃথিবীর মতো বস্তুরা মহাকর্ষ নামক কোনো বলের কারণে বক্র কক্ষপথে চলছে না, বরং বক্র কক্ষপথে চলার কারণ হল, এরা বক্র স্থানে সরল রেখা বরাবর নিকটতম বস্তুকে অনুসরণ করে। এই পথকে বলা হয় জিওডেসিক (Geodesic)। পারিভাষিক অর্থে এর মানে হল,কাছাকাছি দুটি বিন্দুর মধ্যে ক্ষুদ্রতম (বা বৃহত্তম) পথ।
এই গোল বস্তুকে পৃথিবীর পৃষ্ঠ মনে করা হলে পৃথিবীর কেন্দ্রকে কেন্দ্র ধরে পৃষ্ঠের উপর অঙ্কিত যে কোনো বৃত্তই গুরুবৃত্ত  হবে। যেমন বিষুব রেখা বরাবর ‘ক’ যেমন গুর বৃত্ত, তেমনি ‘খ’ও গুরুবৃত্ত।
এই গোল বস্তুকে পৃথিবীর পৃষ্ঠ মনে করা হলে পৃথিবীর কেন্দ্রকে কেন্দ্র ধরে পৃষ্ঠের উপর অঙ্কিত যে কোনো বৃত্তই গুরুবৃত্ত  হবে। যেমন বিষুব রেখা বরাবর ‘ক’ যেমন গুর বৃত্ত, তেমনি ‘খ’ও গুরুবৃত্ত।
সমতল দ্বি-মাত্রিক স্থানের একটি উদাহরণ হল জ্যামিতিক তল। এখানে জিওডেসিকরা হল রেখা। পৃথিবীর পৃষ্ঠ দ্বি-মাত্রিক বক্র স্থানের একটি উদাহরণ। এই পৃষ্ঠের জিওডেসিকদেরকে এক একটি গুরুবৃত্ত (Great Circle) বলা হয়। বিষুবরেখাও একটি গুরুবৃত্ত। পৃথিবীর পৃষ্ঠে যদি এমন কোনো বৃত্ত আঁকা হয়, যার কেন্দ্র হবে পৃথিবীর কেন্দ্রেই, তবে সেটিও হবে গুরুবৃত্ত। (এদেরকে গুরুবৃত্ত বলার কারণ হচ্ছে, পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপর উপরে সর্বোচ্চ এই আকারের বৃত্তই আঁকা যাবে)
 দুটি বিমানবন্দরের মধ্যে ক্ষুদ্রতম পথও একটি জিওডেসিক। তাই বিমানের ন্যাভিগেটররা পাইলটদেরকে এই পথ ধরে চলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যেমন ধরুন, আপনি নিউইয়র্ক থেকে মাদ্রিদ যাবেন। আপনি যদি কম্পাস নিয়ে এদের অক্ষাংশ বরাবর প্রায় সোজা পূর্ব দিকে চলেন তাহলে যেতে হবে ৩, ৭০৭ মাইল পথ। আর যদি আপনি একটি গুরুবৃত্ত অনুসরণ করে প্রথমে উত্তর- পূর্ব ও পরে ক্রমান্বয়ে পূর্ব দিকে ঘুরে দক্ষিণ- পূর্ব দিকে যান তাহলে যেতে হবে ৩, ৬০৫ মাইল। পৃথিবীর মানচিত্রে পৃষ্ঠ বিকৃত করে ছড়ানো থাকে বলে দুই পথের চিত্র বোঝা মুশকিল। আপনি যখন সোজা পূর্ব দিকে যাচ্ছেন, আসলে তখন আপনি সোজা যাচ্ছেন না। অন্তত এই অর্থে যে আপনি সবচেয়ে সরাসরি পথ তথা জিওডেসিক দিয়ে যাচ্ছেন না [১]
পৃথিবীর পৃষ্ঠে বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব
পৃথিবীর পৃষ্ঠে বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব
[দুটি স্থানের মধ্যে ন্যূনতম দূরত্ব হল একটি গুরু বৃত্তের অংশ। সমতল মানচিত্রে দেখলে এটি কিন্তু সরল রেখা হবে না। ]
 সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে চতুর্মাত্রিক স্থান-কালে বস্তুরা সব সময় জিওডেসিক দিয়ে চলাচল করে। পদার্থের অনুপস্থিতিতে চতুর্মাত্রিক স্থান- কালের জিওডেসিক ত্রিমাত্রিক স্থানের সরল রেখার ন্যায় আচরণ করে। কিন্তু পদার্থের উপস্থিতি চতুর্মাত্রিক স্থান- কালকে বিকৃত করে দেয়। এর ফলে ত্রিমাত্রিক স্থানে চলতে থাকা বস্তুর পথ বেঁকে যায়। এই বেঁকে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিই আগের নিউটনীয় তত্ত্বে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্যখ্যা করা হয়েছিল। পাহাড়ী এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান দেখার সাথে এর তুলনা করা চলে। বিমানটি হয়ত ত্রিমাত্রিক স্থানের মধ্য দিয়ে সরল পথেই চলছে। কিন্তু তৃতীয় মাত্রা তথা উচ্চতার কথা বাদ দিয়ে পাহাড়ী অঞ্চলের দ্বিমাত্রিক ভূমিতে নজর রাখলে দেখা যাবে বিমানের ছায়া একটি বক্র পথ অনুসরণ করছে [২]
অথবা মনে করুন, একটি মহাকাশযান উত্তর মেরুর ঠিক উপর দিয়ে সরল রেখা বরাবর উড়ে যাচ্ছে। নিচের পৃথিবীর দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠের উপর এর গতিপথের ছবি একেঁ আপনি একটি অর্ধবৃত্ত পাবেন। রেখাটি হবে উত্তর গোলার্ধের উপরস্থ একটি দ্রাঘিমা রেখা। কল্পনা করা কঠিন হলেও আরেকটি উদাহরণ হল সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর গতি। সূর্যের ভর স্থান- কালকে এমনভাবে বাঁকায় যে পৃথিবী চতুর্মাত্রিক স্থান- কালের মধ্য দিয়ে সরল পথে চললেও আমাদের কাছে মনে হয় যেন এটি ত্রিমাত্রিক স্থানের মধ্য দিয়ে প্রায় বৃত্তাকার পথে চলছে।
মহাকাশযানের ছায়ার চলাচলের পথ
মহাকাশযানের ছায়ার চলাচলের পথ
[সরল রেখা ধরে চলা মহাকাশযানের ছায়াকে পৃথিবীর দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে বক্র মনে হবে। ]
 বস্তুত সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব ও নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বে গ্রহদের কক্ষপথের পরিমাপ ভিন্ন উপায়ে করা হয়। তবে দুই ক্ষেত্রেই কক্ষপথের পূর্বাভাস প্রায় একই রকম হয়। সবচেয়ে বড় পার্থক্য দেখা যায় বুধ গ্রহের কক্ষপথ হিসাব করতে গিয়ে। এটি সূর্যের নিকটতম গ্রহ হওয়াতে সবচেয়ে বেশি মহাকর্ষীয় টান অনুভব করে। এর উপবৃত্তাকার কক্ষপথ কিছুটা প্রসারিত। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে উপবৃত্তের বড় অক্ষটি সূর্যের সাপেক্ষে প্রতি দশ বছরে প্রায় এক ডিগ্রি করে আবর্তন করবে। এই প্রভাব খুবই সামান্য হলেও ১৯১৫ সালের অনেক আগেই (তৃতীয় অধ্যায় দেখুন) এটি জানা গিয়েছিল। আইনস্টাইনের তত্ত্বের পক্ষে এটিও ছিল একটি প্রমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে রেডারের (RADAR) সাহায্যে অন্য গ্রহদেরও কক্ষপথের বিচ্যুতি পরিমাপ করা হয়েছে। দেখা গেছে যে এই পরিমাপের সাথে নিউটনীয় হিসাবের একটু অমিল থাকলেও তা মিলে গেছে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের পূর্বাভাসের সাথে।
বুধ গ্রহের কক্ষপথের বিচ্যুতি
বুধ গ্রহের কক্ষপথের বিচ্যুতি
[বুধ গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘোরার সাথে সাথে এর উপবৃত্তাকার কক্ষপথের প্রধান (বড়) অক্ষও আবর্তন করতে থাকে, যা ৩৬০, ০০০ বছরে একটি পূর্ণ চক্র সম্পন্ন করে।]
আলোক রশ্মিরাও স্থান- কালের মধ্যে জিওডেসিক পথে চলতে বাধ্য। আর স্থান যেহেতু বেঁকে আছে, তাই আলোকেও সরল পথে চলতে দেখা যাবে না। কাজেই সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের পূর্ভাবাস হল, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র আলোকে বাঁকিয়ে দেবে। এই তত্ত্ব অনুসারে অনুসারে, সূর্যের ভরের কারণে এর আশপাশ দিয়ে আসা আলো ভেতরের দিকে কিছুটা বেঁকে যাবে। এর ফলে দূর থেকে কোনো তারার আলো সূর্যের কাছ দিয়ে আসার সময় একটি ছোট্ট কোণে সরে যাবে। এ কারণে পৃথিবী থেকে দেখলে তারাটিকে ভিন্ন অবস্থানে দেখা যাবে। অবশ্য তারাটির আলো যদি সব সময়ই সূর্যের খুব কাছ দিয়ে আসে তাহলে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারব না যে আলো বিচ্যুত হয়েছে নাকি তারাটিকে সঠিক জায়াগায়ই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে বলে পৃথিবী থেকে দেখলে একেক সময় একেক তারা সূর্যের পেছনে চলে যায়। এ সময় অন্যদের তুলনায় এ তারাদের আপাত অবস্থান বদলে যায়।
সূর্যের পাশ ঘেঁষে আসা আলোর বক্রতা
সূর্যের পাশ ঘেঁষে আসা আলোর বক্রতা
[যখন সূর্য পৃথিবী ও দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রের ঠিক মাঝখানে থাকে, তখন এর মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণে নক্ষত্র থেকে আসা আলো বেঁকে যায়। ফলে এর আপাত অবস্থান পাল্টে যায়।]
 সাধারণত এই প্রতিক্রিয়া খুব সহজে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। কারণ সূর্যের আলোর কারণে এর আশেপাশে আকাশের তারাদের দেখা পাওয়া অসম্ভব [৩]। কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদ সূর্যের আলোকে ঢেকে ফেলে বলে এ সময় তারাদের আলো দেখা সম্ভব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল বলে আলোর বিচ্যুতি সম্পর্কে আইনস্টাইনের এই ভবিষ্যদ্বাণী ১৯১৫ সালে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯১৯ সালে ঠিকই সম্ভব হল। এই বছর এক দল ব্রিটিশ গবেষক  (বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের নেতৃত্বে- অনুবাদক) আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা গেল আইনস্টাইনের কথা মতোই আলো বিচ্যুত হচ্ছে। একটি জার্মান তত্ত্ব ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে প্রামণিত হওয়ায় এটি যুদ্ধের পর দুই দেশের সমঝোতার পক্ষে কাজ করে। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার হল, এই অভিযানের সময় তোলা ছবিগুলো পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, যেটুকু প্রতিক্রিয়া তাঁরা পরিমাপ করতে চেয়েছিলেন, তাতে সমান পরিমাণ ভুলও ছিল। পরিমাপের ক্ষেত্রে ভাগ্য তাদের সহায়ক ছিল। অথবা বলা যায় যে সম্ভবত তারা যে ফলাফল চাচ্ছিলেন তা আগেই জানতেন বলেই পেয়ে গিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের জগতে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। তবে আলোর বিচ্যুতির ঘটনা কিন্তু পরিবর্তীতে অনেকগুলো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।
সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের আরেকটি পূর্ভাবাস হল, বড় ভরের বস্তুর আশাপাশে সময়কে ধীরে চলতে দেখা যাবে। যেমন পৃথিবীর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটবে। বিষয়টি সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের মাথায় আসে ১৯০৭ সালে। এর পাঁচ বছর তিনি বুঝতে পারেন, মহাকর্ষ স্থানের আকৃতিও বদলে দেয়। আরও তিন বছর পর তিনি তত্ত্বটি সম্পূর্ণ করেন। এই প্রতিক্রিয়া বের করতে তিনি তাঁর সমতুল্যতার নীতি (Principle of equivalence) ব্যবহার করেন। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে আপেক্ষিকতার মৌলিক স্বীকার্য যে ভূমিকা পালন করেছিল, সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে সেই একই ভূমিকা পালন করেছিল এই নীতিটি।
মনে আছে নিশ্চয়, বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের মৌলিক স্বীকার্যের বক্তব্য ছিল যে মুক্তভাবে গতিশীল সকল পর্যবেক্ষকের কাছে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো একই থাকবে, বেগ যাই হোক তাতে কিছু আসে যায় না। বলা চলে যে সমতুল্যতার নীতি আগের এই স্বীকার্যকে আরেকটু লম্বা করেছে। ফলে এটি এমন পর্যবেক্ষকের জন্যেও খাটবে, যিনি মুক্তভাবে গতিশীল নন, কিন্তু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যেই আছেন। এই নীতিকে সংক্ষেপে তুলে ধরতে হলে কিছু পরিভাষিক বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সুষম (সব দিকে একই রকম) নয়। ফলে নীতিটিকে আলাদা আলাদাভাবে অনেকগুলো ছোট ছোট ও পরস্পরচ্ছেদী অংশে ভাগ করতে হবে। অবশ্য এটা আমরা এখানে করব না। আমাদের উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রেখে আমরা এই নীতিকে এভাবে বলতে পারি, ‘যথেষ্ট ক্ষুদ্র স্থানের অঞ্চলে অবস্থান করে এটা বলা সম্ভব নয় যে আপনি কোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থিরাবস্থায় আছেন, নাকি শূন্য স্থানে সুষম হারের ত্বরণ (বেগ বৃদ্ধি) নিয়ে চলছেন’।
মনে করুন, আপনি মহাশূন্যের মধ্যে এমন একটি লিফটে আছেন, যেখান মহাকর্ষ অনুপস্থিত। ফলে এখানে উপর বা বা নিচ বলতে কিছু নেই। আপনি মুক্তভাবে ভেসে আছেন। একটু পর লিফটখানা সমত্বরণে চলা শুরু করল। এখন কিন্তু হঠাৎ করে আপনি ওজোন অনুভব করবেন। আপনি লিফটের এক প্রান্তের দিকে একটি টান অনুভব করবেন। এখন এ দিকটিকেই আপনার কাছে মেঝে মনে হবে! আপনি এখন হাত থেকে একটি আপেল ছেড়ে দিলে এটি মেঝের দিকে চলে যাবে। আসলে এখন আপনার মতোই লিফটের ভেতরের সব কিছুর ত্বরণ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আসলে লিফটটা মোটেই গতিশীল নয়, বরং এটি একটি সুষম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থির অবস্থায় আছে। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন যে ট্রেনের ভেতরে বসে যেমন আপনি বলতে পারেন না যে আপনি সমবেগে চলছেন কি না, তেমনি লিফটের ভেতরে বসেও আপনি বুঝতে পারবেন না আসলে আপনি সুষম ত্বরণে চলছেন, নাকি কোনো সুষম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যে আছেন। আইনস্টাইনের এই চিন্তার ফলাফলই হল সমতুল্যতার নীতি।
সমতুল্যতার নীতি এবং এর উপরের উদাহরণটি সত্য হলে বস্তুর জড় ভর (Inertial mass) ও মহাকর্ষীয় ভরকে (Gravitational mass) অবশ্যই একই জিনিস হতে হবে। বল প্রয়োগের ফলে কতটুকু ত্বরণ হবে তা নির্ভর করে জড় ভরের ওপর। এই ভর নিয়েই কথাই বলা হয়েছে নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রে। আর অন্য দিকে মহাকর্ষীয় ভরের কথা আছে নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্রে। আপনি কতটুকু মহাকর্ষীয় বল অনুভব করবেন তা নির্ভর করে এই ভরের ওপর (চতুর্থ অধ্যায় দেখুন)। এই দুটি ভর যদি একই হয়ে থাকে তবেই কেবল কোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে উপস্থিত সকল বস্তু একই হারে পতনশীল হবে। এবং সেক্ষেত্রে এই পতন এদের ভরের উপর নির্ভর করবে না। আর যদি সমতুল্যতার নীতি সঠিক না হত, তাহলে মহাকর্ষের প্রভাবে কিছু বস্তু অন্যদের চেয়ে দ্রুত পতনশীল হত। এর অর্থ হল, আপনি মহাকর্ষীয় টানের সাথে সুষম ত্বরণের (যেখানে সব কিছু একই হারে পতিত হচ্ছে) পার্থক্য ধরতে পারতেন। জড় ও মহাকর্ষীয় ভরের এই সমতুল্যতা কাজে লাগিয়েই আইনস্টাইন তাঁর সমতুল্যতার নীতি এবং শেষ পর্যন্ত পুরো সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব দাঁড় করান। এর জন্যে দরকার ছিল যুক্তির এমন অবিরত চর্চা, যার দ্বিতীয় নজির মানুষের চিন্তার ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমরা সমতুল্যতার নীতি জানলাম। আইনস্টাইনের যুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবার আরেকটি থট এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। এটা আমাদেরকে দেখাবে মহাকর্ষ সময়কে কীভাবে প্রভাবিত করে। মহাশূন্যে অবস্থিত একটি রকেটের কথা চিন্তা করুন। চিন্তার সুবিধার জন্যে মনে করুন রকেটটি এত বড় যে এর শীর্ষ থেকে তলায় আলো পৌঁছতে  এক সেকেন্ড লাগে। আরও মনে করুন, রকেটের সিলিং ও মেঝেতে একজন করে দর্শক আছেন। দুজনের কাছেই অবিকল একই রকম একটি করে ঘড়ি আছে যা প্রতি সেকন্ডে একটি করে টিক দেয়।
মনে করুন সিলিং এর দর্শক ঘড়ির টিকের অপেক্ষায় আছেন। টিক পেয়েই তিনি মেঝের দর্শকের দিকে একটি আলোক সঙ্কেত পাঠালেন। পরে ঘড়িটি আবারও টিক (সেকেন্ডের কাঁটায়) দিলে তিনি আরেকটি সঙ্কেত পাঠালেন। এ অবস্থায় প্রতিটি সঙ্কেত এক সেকেন্ড পর মেঝের দর্শকের কাছে পৌঁছায়। সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটি সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শকও এক সেকন্ডের ব্যবধানে সঙ্কেত দুটি পাবেন।
মহাশূন্যে মুক্তভাবে ভেসে না চলে রকেটখানা যদি পৃথিবীর মহাকর্ষীয় টানের মধ্যে থাকত তাহলে কী ঘটত? নিউটনীয় তত্ত্ব অনুসারে এই ঘটনায় মহাকর্ষের কোনো হাত নেই। সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ডের ব্যবধানে সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শকও এক সেকেন্ডের মধ্যেই তা পাবেন। কিন্তু সমতুল্যতার নীতি ভিন্ন কথা বলে। চলুন দেখা যাক, নীতিটি কাজে লাগিয়ে আমরা মহাকর্ষের বদলে সুষম ত্বরণ নিয়ে চিন্তা করি। নিজের মহাকর্ষ তত্ত্ব তৈরি করতে আইনস্টাইন সমতুল্যতা নীতিকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছেন এটা হল তার একটি উদাহরণ।
তো এখন তাহলে মনে করুন রকেটটি ত্বরণ নিয়ে চলছে (অর্থ্যাৎ, প্রতি মুহূর্তে এর বেগ বেড়ে যাচ্ছে। আমরা আপাতত ধরে নিচ্ছি এর ত্বরণের মান ক্ষুদ্র, না হলে আবার এটি আলোর বেগের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে!)। রকেটটি উপরের দিকে গতিশীল বলে প্রথম সঙ্কেতটিকে আগের চেয়ে (যখন রকেট স্থির ছিল) কম দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। কাজেই সঙ্কেতটি এখন এক সেকেন্ড পার হবার আগেই পৌঁছে যাবে তলায়। রকেটটি যদি নির্দিষ্ট বেগে (ত্বরণহীন) চলত, তাহলে আগে-পরের সব সঙ্কেত এক সেকেন্ড পরপরই পৌঁছত। কিন্তু এখানে ত্বরণ আছে বলে প্রথমে যখন সঙ্কেত পাঠানো হয়েছিল রকেট এখন তার চেয়ে দ্রুত চলছে। কাজেই দ্বিতীয় সঙ্কেতকে আরও কম দূরত্ব পার হতে হবে। ফলে এটি পৌঁছতেও আরও কম সময় লাগবে। কাজেই মেঝের দর্শক দুই সঙ্কেতের মাঝে সময় ব্যবধান পাবেন এক সেকেন্ডের চেয়ে কম। অথচ সিলিং এর দর্শক তা পাঠিয়েছেন ঠিক এক সেকেন্ড পরে। হয়ে গেল সময়ের গরমিল।
ব্যাখ্যা পাবার পর ত্বরণপ্রাপ্ত রকেটের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটা এখন নিশ্চয়ই অদ্ভুত লাগছে না। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, সমতুল্যতার নীতি বলছে, রকেটটি যদি কোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রেও স্থির থাকে তবু একই ঘটনা ঘটবে। অর্থ্যাৎ, রকেটটি যদি ত্বরণপ্রাপ্ত নাও হয় (যেমন ধরুন এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠে উৎক্ষেপণের জন্যে বসিয়ে রাখা আছে) তাহলেও সিলিং এর দর্শক এক সেকেন্ড পর দুটো সঙ্কেত পাঠালে মেঝের দর্শক তা পাবেন এক সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যেই। এবার অদ্ভুৎ লাগছে, তাই না!
হয়ত প্রশ্ন করবেন, এর অর্থ তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে- মহাকর্ষ সময়কে বিকৃত করছে, নাকি ঘড়িকে অচল করে দিচ্ছে? ধরুন, মেঝের দর্শক উপরে উঠে সিলিং এর দর্শকের সাথে ঘড়ি মিলিয়ে নিলেন। দেখা গেল, দুটো ঘড়ি অবিকল একই রকম। তারা এও নিশ্চিত যে দুজনে এক সেকেন্ড বলতে সমান পরিমাণ সময়কেই বোঝেন। মেঝের দর্শকের ঘড়িতে কোনো ঝামেলা নেই। এটি যেখানেই থাকুক, তা তার স্থানীয় সময়ের প্রবাহই মাপবে। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের বলছে, ভিন্ন বেগে চলা দর্শকের জন্যে সময় ভিন্ন গতিতে চলে। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব বলছে, একই মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের বিভিন্ন উচ্চতায় সময়ের গতি আলাদা। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মেঝের দর্শক এক সেকেন্ডের চেয়ে কম সময় পেয়েছেন, কারণ পৃথিবীর পৃষ্ঠের কাছে সময় অপেক্ষাকৃত ধীরে চলে। মহাকর্ষ ক্ষেত্র শক্তিশালী হলে এই প্রভাবও হবে বেশি। নিউটনের গতি সূত্রের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছিল পরম স্থানের ধারণা। এবার আপেক্ষিক তত্ত্ব পরম সময়কেও বিদায় জানিয়ে দিল।
১৯৬২ সালে এই অনুমান পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। একটি ওয়াটার টাওয়ারের উপরে ও নিচে দুটি অতি সূক্ষ্ম ঘড়ি বসানো হয়। দেখা গেল নিচের ঘড়িটিতে (যেটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের বেশি কাছে আছে) সময় ধীরে চলছে, ঠিক সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব যেমনটি অনুমান করেছিল তেমনই। এই প্রভাব খুব ক্ষুদ্র। সূর্যের পৃষ্ঠে রাখা কোনো ঘড়িও পৃথিবীর পৃষ্ঠের তুলনায় মাত্র এক মিনিট পার্থক্য দেখাবে। কিন্তু পৃথিবীর ওপরের বিভিন্ন উচ্চতায় সময়ের এই ক্ষুদ্র পার্থক্যই বর্তমানে বাস্তব ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্যাটেলাইট থেকে আসা সঙ্কেতের মাধ্যমে আমাদের ন্যাভিগেশন সিস্টেমকে ঠিক রাখার জন্যে এর প্রয়োজন হয়। এই প্রভাব উপেক্ষা করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অবস্থান বের করলে ভুল হয়ে যাবে কয়েক মাইল!
সময়ের প্রবাহের পার্থক্য ধরা পড়ে আমাদের শরীরেও। এমন এক জোড়া যমজের কথা চিন্তা করুন, যাদের একজন বাস করছে পাহাড়ের চূড়ায় এবং আরেকজন সমুদ্র সমতলে। প্রথম জনের বয়স অপরজনের চেয়ে দ্রুত বাড়বে। দুজনে আবার দেখা করলে দেখবে একজনের বয়স আরেকজনের চেয়ে বেশি। এই ক্ষেত্রে বয়সের পার্থক্য খুব ক্ষুদ্র হবে হবে। তবে এদের একজন যদি আলোর কাছাকাছি গতিতে মহাকাশযানে করে দীর্ঘ ভ্রমণ করে ফিরে আসে তাহলে দেখা যাবে যমজের চেয়ে তার বয়স অনেক বেশি পরিমাণে কম হচ্ছে। একে বলা হয় টুইন প্যারাডক্স। তবে মাথার মধ্যে পরম সময়ের ধারণাকে স্থান দিলে তবেই একে প্যারাডক্স (পরস্পর বিরোধী বা আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব ঘটনা) মনে হবে। আপেক্ষিক তত্ত্বে একক পরম সময় বলতে কিছু নেই। বরং প্রত্যেক দর্শক তার নিজের মতো করে সময় মাপেন। তার মাপা এই সময় কেমন হবে তা নির্ভর করে তার অবস্থান ও গতির উপর।
১৯১৫ সালের আগে স্থান ও কালকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল ধরা হত, যেখানে কোনো ঘটনা ঘটে, কিন্তু যা ঘটবে তা এদেরকে (স্থান- কাল) প্রভাবিত করবে না। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও এটা সত্য ছিল। বস্তুরা চলছে, বল আকর্ষণ- বিকর্ষণ করছে, কিন্তু স্থান ও কাল চলছে নির্বিঘ্নেই। সময় ও স্থান অবিরত চলছে এমন ভাবাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে অবস্থা একেবারে ভিন্ন। এখানে স্থান ও কাল হল গতিশীল রাশি। একটি বস্তু চললে বা কোনো বল ক্রিয়াশীল হলে প্রভাবিত হয় স্থান ও কালের বক্রতা। ফলশ্রুতিতে বস্তু কীভাবে চলবে এবং বল কীভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করে স্থান- কালের গঠনের উপর। মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে তাকে স্থান- কাল শুধু প্রভাবিতই করে না, তা দ্বারা নিজেরাও প্রভাবিত হয়। স্থান- কালের ধারণা ছাড়া যেমন আমরা মহাবিশ্বের কোনো ঘটনা বোঝাতে পারি না, তেমনি সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বের সীমানার বাইরের স্থান- কাল নিয়েও আমাদের নাক গলানো অর্থহীন। ১৯১৫ সালের পরবর্তী দশকগুলোতে স্থান- কালের এই নতুন জ্ঞান মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ভাবনায় বিপ্লব সূচিত করে। আমরা পরে আরও বিস্তারিত দেখবো যে, আগে মনে করা হত মহাবিশ্বে কোনো পরিবর্তন নেই। এটা যুগ যুগ ধরে বিরাজমান ছিল এবং চিরকাল টিকে থাকবে। এই ভাবনা বদলে গেল। এর স্থানে এল গতিশীল ও সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা। এখন মনে হচ্ছে এটি একটি নির্দিষ্ট সময় আগে শুরু হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময় পরে এর ইতি ঘটবে।
[অনুবাদকের নোটঃ
১। সমতল মানচিত্রে যে আসলে বক্র পৃথিবীকে সঠিকভাবে দেখানো সম্ভব নয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যথাসম্ভব অস্ট্রেলিয়া ও গ্রিনল্যান্ডের মানচিত্র দেখা বোঝা যায়। সমতল মানচিত্রে অস্ট্রেলিয়াকে গ্রিনল্যান্ডের চেয়ে অনেক ছোট দেখায়, যদিও আসলে গ্রিনল্যান্ডই অনেক ছোট। এর কারণ হল, বক্র পৃথিবীতে গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীর উত্তর মেরুর খুব কাছে হওয়ায় এর অঞ্চল অনেক কুঁচকে আছে, যেটা সমতল দ্বিমাত্রিক মানচিত্রে দেখানো অসম্ভব।
২। বুঝতে অসুবিধা হলে পরের ছবিতে দেখানো উদাহরণের সাথে মিলিয়ে পড়ুন।
৩। পৃথিবী প্রায় এক বছরে সূর্যের চারদিকে এক বার ঘুরে আসে। পৃথিবী কক্ষপথের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকার সময় আমরা রাতের আকাশে ভিন্ন ভিন্ন তারার সমাবেশ দেখি। এক বছর পর আবার আগের তারাগুলো দেখি। প্রত্যেক মাসেই কিছু তারা সূর্যের সাথে সাথে বা একটু আগে বা পরে অস্ত যায়। এরাই পৃথিবীর আকাশে সূর্যের কাছাকাছি থাকে। সূর্যের ভরের কারণে এদের আলো আমাদের চোখে বক্র পথে এসে দেখা যাওয়ার কথা। যায়ও বটে, তবে এরা যেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ সময় সূর্যের আশেপাশে থাকে তাই এই সময় সূর্যের আলোর তেজে এদের নিজস্ব আলো আর দেখা যায় না। তাহলে দেখার উপায় কী? উত্তর হল, সূর্যগ্রহণের সময়।
৪। যেহেতু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মতোই সুষম ত্বরণে চলমান কোনো সিস্টেম (যেমন উপরের উদাহরণে লিফটের মধ্যে থাকা সকল বস্তু) একই হারে পতনশীল হচ্ছে, তাদের ভর যাই হোক না কেন, তাই মহাকর্ষ ও সুষম ত্বরণের পার্থক্য বলার কোনো উপায় নেই। এটাই সমতুল্যতার নীতি।
৫। যে পরীক্ষা বাস্তবে করা যায় না, চিন্তা করে করে বুঝতে হয়, তাকে থট এক্সপেরিমেন্ট বলে।
৬।  অর্থ্যাৎ এর দৈর্ঘ্য ১, ৮৬,০০০ মাইল।
৭। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে পৃথিবী থেকে দূরে গিয়ে অনেক বেশি বেগে ভ্রমণ করে এলে আপনার বয়স অপেক্ষাকৃত কম হবে। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, আপনি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে দূরে অবস্থান করলে বয়স দ্রুত বাড়বে। একটি প্রভাব আপাত দৃষ্টিতে আরেকটি থেকে উল্টোভাবে কাজ করে। অবশ্য বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব কার্যকর হবার জন্যে আপনাকে রকেটে চড়ে মহাশূন্যেই যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আপনি যদি পৃথিবীতেই একটি অসম্ভব দ্রুতগামী ট্রেনে চড়েও ভ্রমণ করেন তবু ট্রেনের বাইরে থাকা আপনার বন্ধুর চেয়ে আপনার বয়স কম হবে।]



কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৭


সপ্তম অধ্যায়ঃ সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব
চাঁদহীন পরিষ্কার রাতের আকাশের দিকে তাকালে সবার আগে আপনার চোখে পড়তে পারে শুক্র (শুকতারা), মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ।[১] এছাড়াও থাকবে অনেক অনেক নক্ষত্র। এসব বস্তুরা বাস্তবে আমাদের সূর্যের মতো হলেও আমাদের থেকে বহু দূরে অবস্থিত। আমরা এদেরকে স্থির ধরে নিলেও পৃথিবী সূর্যের চারদিকে কক্ষপথের বিভিন্ন অবস্থানে থাকার সময় এদের অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন হতে দেখা যায়।  বাস্তবে কিন্তু এরা মোটেই স্থির নয়। আসলে এদের মধ্যে যারা তুলনামূলকভাবে আমাদের কাছে, তাদের নড়াচড়াই শুধু আমরা টের পাই। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে বলে আমাদের নিকটবর্তী তারকারা আরও দূরের তারকাদের সাপেক্ষে অবস্থান পরিবর্তন করে।  একটি উন্মুক্ত রাস্তা দিয়ে চলার সময় দূরের দৃশ্যপটের তুলনায় কাছাকাছি থাকা গাছগুলোর আপাত অবস্থান পরিবর্তনের সাথে একে তুলনা করা যায়। যে গাছগুলো যত কাছে, তারা অবস্থান তত বেশি বদলে যাচ্ছে বলে মনে হয়। অবস্থানের এই আপাত পরিবর্তনকে বলা হয় প্যারালাক্স (চিত্র দেখুন)। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এর মাধ্যমে (প্যারালাক্স) এই নক্ষত্রদের দূরত্ব সরাসরি বের করতে পারি।
প্যারালাক্স বা লম্বন
প্যারালাক্স বা লম্বন
[রাস্তা দিয়ে চলুন, অথবা মহাশূন্যে- আপনার চলার সাথে সাথে কাছের এবং দূরের বস্তুর আপেক্ষিক অবস্থান বদলে যায়। এই পরিবর্তন কাজে লাগিয়ে বস্তুর আপেক্ষিক দূরত্ব বের করা যায়।]
প্রথম অধ্যায়েই আমরা বলেছি, (সূর্যের পরে) আমাদের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরি প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই দূরত্বটি ২৩ লক্ষ কোটি মাইলের সমান। আমরা খালি চোখে যেসব তারা দেখি তাদের অধিকাংশই আমাদের কয়েকশ আলোকবর্ষের মধ্যে অবস্থিত। সে তুলনায় আমাদের সূর্য মাত্র ৮ আলোকমিনিট দূরে (আলো আট মিনিটে যত দূর যায়) আছে। দৃশ্যমান তারকাদেরকে পুরো আকাশে ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও একটি বলয়ের মত অংশে এদের সংখ্যা খুব বেশি। এর নাম মিল্কিওয়ে। ১৭৫০ সালের দিক থেকেই কিছু জ্যোতির্বিদ বলছিলেন যে মিল্কিওয়েকে এরকম দেখা যাওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে, দৃশ্যমান তারাদের অধিকাংশ একটি চাকতির মত বিন্যাসের মধ্যে অবস্থান করছে। এটি হচ্ছে বর্তমান সর্পিল ছায়াপথের (spiral galaxy) একটি উদাহরণ।
কয়েক দশক পরে জ্যোতির্বিদ স্যার উইলিয়াম হার্শেল এই ধারণা নিশ্চিত করেন। এ কাজ করতে তাঁকে অমানুষিক পরিশ্রম করে বহু নক্ষত্রের অবস্থান ও দূরত্বের তালিকা তৈরি করতে হয়েছিল। তবু এই ধারণা পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি পেল মাত্র বিংশ শতকের শুরুর দিকে। বর্তমানে আমরা জানি, আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের ব্যাস প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ। এটি ধীরে ধীরে আবর্তনও করছে। এর সর্পিল বাহুতে থাকা নক্ষত্রগুলো কয়েকশ মিলিয়ন বছরে একবার এর কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরে আসে। আমাদের সূর্য একেবারেই সাধারণ মানের একটি নক্ষত্র। মাঝারি আকারের হলুদ এই নক্ষত্রটি ছায়াপথের একটি সর্পিল বাহুর ভেতরের দিকের প্রান্তে অবস্থিত। এটা নিশ্চিত যে এরিস্টটল ও টলেমির সময় থেকে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমরাতো তখন পৃথিবীকেই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসিয়ে রেখেছিলাম!
মহাবিশ্বের আধুনিক ধারণার সূচনা ঘটে মাত্র ১৯২৪ সালে, আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবলের হাত ধরে। তিনি দেখালেন যে মিল্কিওয়েই একমাত্র ছায়াপথ (গ্যালাক্সি) নয়। তিনি (টেলিস্কোপের মাধ্যমে) আরও অনেকগুলো ছায়াপথ খুঁজে পেলেন, যাদের মাঝে আছে বিশাল ফাঁকা স্থান। এসব ছায়াপথের উপস্থিতি প্রমাণ করার জন্যে পৃথিবী থেকে এদের দূরত্ব বের করা প্রয়োজন। সমস্যা হল এরা এত দূরে দূরে অবস্থিত যে আমাদের নিকটস্থ তারকাদের মতো এদের কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ে না, দেখতে একেবারেই স্থির মনে হয়। তাই এদের দূরত্ব মাপতে প্যারালাক্স কোন কাজে আসল না। ফলে এদের দূরত্ব মাপতে তাঁকে আশ্রয় নিতে হল পরোক্ষ উপায়ের ওপর। নক্ষত্রের দূরত্ব সম্পর্কে একটি স্পষ্ট তথ্য হল এর উজ্জ্বলতা। কিন্তু নক্ষত্রের আপাত উজ্জ্বলতা (আমরা একে যত উজ্জ্বল দেখি) শুধু এর দূরত্বের উপরই নির্ভর করে না, এটি কতটুকু আলো বিকিরণ করছে (দীপ্তি) তার উপরও নির্ভর করে।  নিকটে অবস্থিত একটি অনুজ্জ্বল তারাও দূরের যে- কোনো ছায়াপথের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের চেয়ে উজ্জ্বল দেখাবে। তাই আপাত উজ্জ্বলতা থেকে দূরত্ব বের করতে হলে নক্ষত্রের দীপ্তিও জানা চাই।
নিকটস্থ তারকাদের ক্ষেত্রে প্যারালাক্স কাজে লাগিয়ে দূরত্ব বের করে ফেলা যায় বলে আপাত উজ্জ্বলতা থেকেই এদের দীপ্তি বের করা যায়।
হাবল দেখলেন, নিঃসৃত আলোর ধরনের উপর ভিত্তি করে নিকটস্থ নক্ষত্রদেরকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা সম্ভব। একই প্রকারের নক্ষত্রগুলোর দীপ্তি সব সময় একই রকম থাকে। এরপর তিনি যুক্তি দেখালেন যে যদি আমরা দূরের গ্যালাক্সিতেও নিকটস্থ নক্ষত্রদের মতো একই ধরনের নক্ষত্র খুঁজে পাই তবে আমরা ধরে নিতে পারি তাদের দীপ্তিও একই হবে। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে আমরা সেই গ্যালাক্সির দূরত্বও বের করতে পারি। এভাবে একই গ্যালাক্সির অনেকগুলো নক্ষত্রের দূরত্ব বের করে যদি আমরা সব সময় একই দূরত্ব পাই, তবে ভরসা রাখতে পারি যে হিসাব ঠিক আছে। এই উপায় অবম্বন করে হাবল নয়টি আলাদা গ্যালাক্সির দূরত্ব বের করতে সক্ষম হন।
এখন আমরা জানি খালি চোখে আমরা যে নক্ষত্রগুলো দেখি তা সব নক্ষত্রের একটি সামান্য অংশ। আমরা প্রায় পাঁচ হাজার নক্ষত্র খালি চোখে দেখি। এটা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরই প্রায় ০.০০০১ শতাংশ মাত্র। আধুনিক টেলিস্কোপ দিয়ে আমরা দশ হাজার কোটির বেশি গ্যালাক্সি দেখতে পাই। প্রত্যেকটি গ্যালাক্সিতে আবার গড়ে প্রায় দশ হাজার কোটি তারকা আছে। একটি তারকাকে যদি একটি লবণের কণা মনে করা যায় তাহলে খালি চোখে দৃশ্যমান সব তারকাকে একটি চায়ের কাপে রেখে দেওয়া যাবে, যেখানে মহাবিশ্বের সব তারকাকে রাখতে হলে ১০ মাইলের চেয়ে বড়ো ব্যাসের একটি গোলক লাগবে।
তারকারা বহু দূরে থাকার কারণে এদেরকে আলোক বিন্দুর মতো দেখায়। আমরা খালি চোখে এদের আকার- আকৃতি বুঝতে পারি না। কিন্তু হাবল দেখলেন, তারকাদের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন টাইপ। আলো দেখেই আমরা এদের পার্থক্য ধরতে পারি। নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন যে সূর্যের আলো ত্রিভুজাকৃতির এক খণ্ড প্রিজমের মধ্যে দিয়ে পার হলে রঙের বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে, রংধনুতে যেমন দেখা যায় সেভাবে। একটি নির্দিষ্ট আলোক উৎস থেকে আসা বিভিন্ন রঙের আপেক্ষিক তীব্রতাকে বলে বর্ণালী (Spectrum)। একটি নির্দিষ্ট তারকা বা গ্যালক্সির দিকে টেলিস্কোপ তাক করে রেখে সেই তারকা বা গ্যালাক্সির আলোর বর্ণালী দেখা সম্ভব।
এই আলো দেখে আমরা এর তাপমাত্রাও জানতে পারি। ১৮৬০ সালে জার্মান পদার্থবিদ গুস্তাভ কার্শফ উপলদ্ধি করেন যে যেমনিভাবে উত্তপ্ত হলে কয়লা জ্বলে ওঠে তেমনি যে-কোনো বস্তু, এমনকি তারকারাও উত্তপ্ত অবস্থায় আলো বা অন্যান্য বিকিরণ নির্গত করবে । বস্তুর এই জ্বলে ওঠার কারণ হচ্ছে এর অভ্যন্তরে থাকা পরমাণুর তাপীয় গতি। এই ঘটনার নাম ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন বা কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ (যদিও আলো বিকিরণকারী বস্তুরা দেখতে কালো নয়)। কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের বর্ণালী থেকে পাওয়া তথ্যে ভুল হওয়া প্রায় অসম্ভব। তাপমাত্রা বদলাবার সাথে সাথে এর ধরন বদলাতে থাকে। ফলে উজ্জ্বল বস্তু থেকে আসা আলো থার্মোমিটারের মতো কাজ করে। আমরা বিভিন্ন তারকার যে বর্ণালী দেখি তার ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। এই বর্ণালী তারকাটির তাপীয় অবস্থার সব নাড়ি- নক্ষত্র উন্মুক্ত করে দেয়।
চিত্রঃ তারকার বর্ণালী
তারকার বর্ণালী
[একটি নক্ষত্রের আলোর বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করে এর তাপমাত্রা ও বায়ুমণ্ডলের উপাদান বের করা যায়।]
 ভালো করে দেখলে নক্ষত্রের আলো আমাদেরকে আসলে আরও তথ্য দেয়। আমরা দেখি যে নির্দিষ্ট কিছু রঙ এখানে অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিত রঙগুলো কী হবে সেটা আবার বিভিন্ন নক্ষত্রের ক্ষেত্রে ভিন্ন। যেহেতু আমরা জানি যে প্রতিটি রাসায়নিক মৌল স্বতন্ত্র ধরনের এক গুচ্ছ রঙ শোষণ করে, তাই তারকার বর্ণালীতে অনুপস্থিত রঙের সাথে তুলনা করে আমরা বলে দিতে পারি ঐ তারকার বায়ুমণ্ডলে কী কী উপাদান আছে।
কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ
কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ
[শুধু তারকারাই নয়, সকল বস্তুই এর আণুবীক্ষণিক উপাদানগুলোর তাপীয় গতির কারণে বিকিরণ নিঃসরণ করে। বিকিরণের কম্পাঙ্কের বিন্যাস থেকে বস্তুর তাপমাত্র বলা সম্ভব।]
 ১৯২০ এর দশকে জ্যোতির্বিদরা অন্যান্য গ্যালাক্সির নক্ষত্রদের বর্ণালী দেখা শুরু করে অবাক হয়ে গেলেন। আমাদের গ্যালাক্সির মতোই এখানেও অনুপস্থিত রঙের প্যাটার্ন একই রকম, তবে এরা একই আপেক্ষিক হারে বর্ণালীর লাল প্রান্তের দিকে সরে যাচ্ছে।
পদার্থবিদরা রঙ বা কম্পাঙ্কের এই সরে যাওয়াকে ডল্পলার ইফেক্ট বলেন। শব্দের ক্ষেত্রে এর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আপনি যদি রাস্তায় চলা একটি গাড়ির দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন যে এটি যখন কাছে আসে তখন এর ইঞ্জিন বা হর্নের শব্দ তীক্ষ্ণ হয়ে যাচ্ছে, আবার এটি যখন আপনাকে ক্রস করে দূরে সরে যায় তখন এর শব্দের তীক্ষ্ণতা কমে যায়। ইঞ্জিন বা হর্নের শব্দ একটি তরঙ্গ, যেখানে ক্রমান্বয়ে তরঙ্গের চূড়া ও খাঁজ সৃষ্টি হয়। একটি গাড়ি যখন আমাদের কাছে আসে, এর প্রত্যেকটি পরবর্তী চূড়া নির্গত করার সময় এটি আগের চেয়ে আমাদের বেশি কাছে থাকে। পরপর দুটি তরঙ্গচূড়ার মধ্যবর্তী দূরত্বকে বলা তরঙ্গদৈর্ঘ্য। তাহলে স্থির থাকলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যেমন হত, গাড়ি কাছে আসার সময় তা তার চেয়ে ছোট হবে। আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ছোট হবে, চূড়া ও খাঁজ তত বেশি সৃষ্টি হবে, যার ফলে আমাদের কানে শব্দের তীক্ষ্ণতা বা কম্পাঙ্ক জোরালো হবে। উল্টো দিকে, গাড়ি আমাদের থেকে দূরে সরে গেলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড় হয়ে যাবে বিধায় আমাদের কানে এর কম্পাঙ্ক ছোট হবে। গাড়ি যত দ্রুত চলবে, এই প্রভাবও তত বাড়বে। কাজেই, ডপলার ইফেক্টের সাহায্যে আমরা গতি মাপতে পারি। আলো বা বেতার তরঙ্গও একই আচরণ করে। সত্যি বলতে, পুলিশও ডপলার ইফেক্টের সাহায্যে গাড়ির গতিবেগ মাপে। এক্ষেত্রে তারা কাজে লাগায় প্রতিফলিত বেতার তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য।
চতুর্থ অধ্যায়েই আমরা বলেছি, দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুবই ক্ষুদ্র। এর পাল্লা হল এক সেন্টিমিটারের চল্লিশ ভাগ থেকে শুরু করে থেকে আট কোটি ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত। আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যই আমাদের চোখে আলাদা আলাদা রং হিসেবে ধরা পড়ে। সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো থাকে লাল প্রান্তের দিকে এবং ছোটগুলো নীল প্রান্তের দিকে। এবার আমাদের থেকে নির্দিষ্ট দূরের একটি আলোক উৎস, যেমন একটি নক্ষত্রের কথা চিন্তা করুন, যা থেকে শুধু একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যেরই আলো আসছে। এটি নিজে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্গত করবে আমরাও ঠিক সেটাই দেখতে পাব। এবার মনে করুন আলোর উৎসটি দূরে সরতে লাগল। শব্দের মতোই এ ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড়ো হয়ে যাবে এবং এর বর্ণালী লাল দিকে সরে যাবে।
মিল্কিওয়ের বাইরে আরও গ্যালাক্সির উপস্থিতি প্রমাণ করার পরের বছরগুলোতে হাবল এদের বর্ণালী দেখে দেখে দূরত্ব বের করার কাজে লেগে গেলেন। সেই সময় বেশির ভাগ মানুষ মনে করত গ্যালাক্সিরা এলোমেলোভাবে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করবে। সেজন্যে হাবলও আশা করেছিলেন, তিনি গ্যালাক্সিদের লাল সরণ (তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল দিকে সরে যাওয়া) যত দেখবেন নীল সরণও সেই পরিমাণ দেখবেন। কাজেই বেশির ভাগ গ্যালাক্সির বর্ণালীর সরণ লালের দিকে দেখে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। এদের প্রায় সবাই আমাদের থেকে দূরে সরছে! ১৯২৯ সালে হাবল এর চেয়েও অবাক করা তথ্য প্রকাশ করেন। গ্যালাক্সিদের লাল সরণও এলোমেলোভাবে হচ্ছে না, বরং এটা আমাদের থেকে তাদের দূরত্বের সরাসরি সমানুপাতিক। এর অর্থ হচ্ছে, একটি গ্যালাক্সি যত দূরে অবস্থিত, সেটি তত দ্রুত গতিতে সরে যাচ্ছে। অর্থ্যাৎ আগের ধারণা ভুল, মহাবিশ্বের আকার স্থির বা অপরিবর্তনশীল নয়। এটি আসলে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন গ্যালাক্সির মধ্যবর্তী দূরত্ব বাড়ছে।
ডপলার প্রভাব
ডপলার প্রভাব
[একটি তরঙ্গ উৎস দর্শকের দিকে এগিয়ে গেলে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যায়, আর দর্শক থেকে দূরে সরলে হয়ে যায় বড়ো। এটিই ডপলার প্রভাব।]
 মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ আবিষ্কার বিংশ শতকের বিরাট এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব। অতীতে ফিরে তাকালে একটু অবাকই হতে হয়, আগে কেউ কেন এভাবে চিন্তা করেনি। নিউটনসহ অন্যদের বোঝা উচিত ছিল একটি স্থির মহাবিশ্ব হবে অস্থিতিশীল। কারণ সবগুলো নক্ষত্র ও ছায়াপথ মিলিতভাবে একে অপরের উপর যে মহাকর্ষীয় টান প্রয়োগ করবে তাকে ঠেকানোরতো কেউ নেই। কাজেই, কোনো এক সময় যদি মহাবিশ্ব স্থির থেকেও থাকে, তবু এর পক্ষে স্থির হয়ে বসে থাকা অসম্ভব ছিল। কারণ সবগুলো নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির পারস্পরিক আকর্ষণের ফলে মহাবিশ্ব পরক্ষণেই সঙ্কুচিত হতে শুরু করত।
এমনকি মহাবিশ্ব যদি মোটামুটি ধীর গতিতেও প্রসারিত হত, তবু মহাকর্ষের প্রভাবে এক সময় এর প্রসারণ থেমে যেত এবং অবশেষে শুরু হত সঙ্কোচন। কিন্তু যদি মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট হারের চেয়ে দ্রুত প্রসারিত হয়, তাহলে মহাকর্ষ কখনোই একই প্রসারণ থামানোর মত শক্তিশালী হতে পারবে না। এর ফলে এটি চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে। পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে রকেট নিক্ষেপ করলে যা ঘটে তার সাথে এর কিছুটা মিল আছে। রকেটের গতি যদি একটু কম হয় অভিকর্ষ একে থামিয়ে দেবে এবং এটি নিচে পড়ে যাবে। কিন্তু রকেটের গতি যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি হয় (সেকেন্ডে প্রায় সাত মাইল), তাহলে একে থামানোর শক্তি মহাকর্ষের হবে না। এর ফলে এটি পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে।
ঊনিশ, আঠারো বা এমনকি সতেরো শতকের শেষের দিকেই নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব থেকে মহাবিশ্বের এই আচরণ অনুমান করা যেত। কিন্তু স্থির মহাবিশ্বের ধারণা সবার মনে এতটা বদ্ধমূল হয়ে আসন গেঁড়েছিল যে এই ধারণা টিকে থাকল বিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত। এমনকি আইনস্টাইনেরও স্থির মহাবিশ্বের উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল। ১৯১৫ সালে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করার সময় নিজের তত্ত্বকে সেই বিশ্বাসের সাথে মিলানোর জন্যে তিনি কিছুটা গোঁজামিলের আশ্রয় নেন। তিনি তাঁর সমীকরণে মহাজাগতিক ধ্রুবক (Cosmological constant) নামে একটি রাশি আমদানী করেন। নতুন এই মহাজাগতিক ধ্রুবকের প্রতিক্রিয়া ছিল মহাকর্ষের বিপরীত। অন্যান্য বলের মতো এই বলের জন্যে কোনো উৎসের প্রয়োজন নেই, বরং এটি স্থান- কালেরই পরতে পরতে মিশে আছে। নতুন এই বলের প্রভাবে স্থান- কাল নিজে থেকেই প্রসারিত হবার প্রবণতা লাভ করে। মহাজাগতিক ধ্রুবক যোগ করে আইনস্টাইন এই প্রবণতার শক্তিকে ভারসাম্যে নিয়ে আসেন। তিনি দেখলেন যে তাঁর পক্ষে মহাবিশ্বের সকল পদার্থের পারস্পরিক আকর্ষণকে ব্যালেন্স করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে পাওয়া গেল স্থির মহাবিশ্ব। কিন্তু পরে তিনি মহাজাগতি ধ্রুবকটি প্রত্যাহার করেন এবং একে তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে অভিহিত করেন। একটু পরই আমরা দেখবো, আসলে এটি যোগ করে তিনি সম্ভবত ঠিক কাজটিই করেছেন। কিন্তু আইনস্টাইন হতাশ হয়েছিলেন এ জন্যে যে তিনি তাঁর বিশ্বাস ধরে রাখতে গিয়ে তাঁর তত্ত্বের (যা বলছিল মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে) ইঙ্গিতটিও এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একজন ব্যক্তি সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের ইঙ্গিতকে ঠিকই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন। যখন আইনস্টাইন ও অন্যরা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের গতিশীল মহাবিশ্বের ইঙ্গিত এড়ানোর উপায় খুঁজছিলেন, সেই সময়েই রুশ গণিত ও পদার্থবিদ অ্যালেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান সেই গতিশীলতার ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে নেমে পড়লেন।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে ফ্রিডম্যান খুব সরল দুটো অনুমান প্রস্তাব করলেন। এক, আমরা যে দিকেই তাকাব, মহাবিশ্বকে একই রকম দেখব এবং দুই, যদি আমরা মহাবিশ্বকে অন্য কোথাও থেকেও দেখি তবুও এই কথা সত্য হবে। এই দুটি ভাবনা মাথায় রেখে ফ্রিডম্যান সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের সমাধান বের করলেন এবং দেখালেন, মহাবিশ্বকে স্থির মনে করা অনুচিত। প্রকৃতপক্ষে, হাবলের আবিষ্কারের কয়েক বছর আগেই ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান তাই অনুমান করলেন, যা পরে হাবল পর্যবেক্ষণ করলেন।
মহাবিশ্ব সব দিকে একই রকম দেখায়- এই অনুমান বাস্তবে পুরোপুরি সঠিক নয়। যেমন আমরা বলেছি, রাতের আকাশে কিছু তারা একটি স্বতন্ত্র বলয় গঠন করে, যাকে আমরা মিল্কিওয়ে বলি। কিন্তু যদি আমরা দূরের গ্যালাক্সির দিকে তাকাই তবে আমরা দেখবো যে সব দিকেই তারার সংখ্যা প্রায় সমান। মহাবিশ্বে আসলেই সব দিকে প্রায় একই রকম দেখায়। শর্ত হল চিন্তা করতে হবে গ্যালাক্সিদের মত বড় দূরত্বের মাপকাঠিতে এবং ছোট দূরত্বের পার্থক্যে ছাড় দিতে হবে। মনে করুন আপনি একটি জঙ্গলের মধ্যে আছেন, যেখানে বিভিন্ন গাছপালা এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এক দিকে তাকিয়ে আপনি হয়ত দেখবেন, সবচেয়ে কাছের গাছটি আছে এক মিটার দূরে। আরেক দিকে তাকালে সবচেয়ে কাছের গাছটিকে হয়ত তিন মিটার দূরে পাওয়া যাবে। অন্য আরেক দিকে হয়ত দুই মিটারের মধ্যে অনেকগুলো গাছ পাওয়া যাবে। জঙ্গলটিকে সব দিকে একই রকম মনে হচ্ছে না। কিন্তু আপনি যদি এক মাইলের মধ্যের সব গাছ নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে এই পার্থক্যগুলো আর থাকবে না। দেখা যাবে যে আপনি যেদিকেই তাকান, জঙ্গলের চেহারা একই রকম।
আইসোট্রপিক বন
আইসোট্রপিক বন
[বনের গাছগুলো সুষম হারে বিন্যস্ত থাকলেও নিকটস্থ গাছগুলোকে দেখে তা বোঝা যায় না। একইভাবে আমাদের আশেপাশে তাকালে মহাবিশ্বকে সুষম (সব দিকে একই রকম) মনে হয় না। কিন্তু বড় দৈর্ঘ্যের স্কেলে চিন্তা করলে আমরা যেদিকেই তাকাই একই রকম দেখি।]
 সত্যিকারের মহাবিশ্ব সম্পর্কে ফ্রিডম্যানের অনুমানটি একটি মোটামুটি ধারণা প্রদান করে। এর প্রমাণ হিসেবে তারকাদের সুষম বিন্যাসের ব্যাপারটি অনেক দিন ধরে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আরো পরে ঘটা একটি ইতিবাচক দূর্ঘটনা ফ্রিডম্যানের অনুমানের নতুন একটি দিকে উন্মোচিত করে। এতে দেখা যাচ্ছে, ফ্রিডম্যানের অনুমান মহাবিশ্ব সম্পর্কে খুব নিখুঁত চিত্র তুলে ধরছে। ১৯৬৫ সালে দুইজন আমেরিকান পদার্থবিদ আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন নিউ জার্সির বেল টেলিফোন ল্যাবে কাজ করছিলেন। টেস্ট করছিলেন খুবই সংবেদী একটি মাইক্রোওয়েভ ডিটেকটর। মাইক্রোওয়েভ হল আলোর মতোই এক ধরনের তরঙ্গ, তবে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় এক সেন্টিমিটার। ডিটেকটরে স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি নয়েজ পাওয়া যাচ্ছে দেখে পেনজিয়াস ও উইলসন চিন্তিত হলেন। ডিটেকটরে পাখির মল খুঁজে পাওয়া গেল। ঝামেলা হওয়ার মতো অন্যান্য কারণগুলোও খতিয়ে দেখা হল। কিন্তু এগুলোর কোনোটা করেই উলেখযোগ্য কোনো ফল আসল না। অদ্ভুত এই নয়েজটি দিনে-রাতে সমানে পাওয়া যাচ্ছে। আবার এটি বছরের যে-কোনো সময়ই পাওয়া যাচ্ছে, অথচ পৃথিবীর আবর্তন ও সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণনের কারণে একেক সময় ডিটেকটরের মুখ একেক দিকে তাক করা ছিল। কাজেই তাঁরা বুঝলেন, এই নয়েজ সৌরজগৎ শুধু নয়, গ্যালাক্সিরও বাইরে থেকে আসছে। এটি মহাকাশের সব দিক থেকে সমানভাবে আসছে বলে মনে হল। এখন আমরা জানি, আমরা যেদিকেই তাকাই না কেন, এই নয়েজের খুব বেশি তারতম্য কখনোই হয় না। ফলে নিজেদের অজান্তেই পেনজিয়াস ও উইলসন ফ্রিডম্যানের প্রথম অনুমানের একটি দারুণ উদাহরণ হাতে পেয়ে গেলেন। অর্থ্যাৎ, মহাবিশ্ব সব দিকে একই রকম।
এই মহাজাগতিক নয়েজের উৎস কী তাহলে? পেনজিয়াস ও উইলসন যখন তাদের ডিটেকটরের নয়েজ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন তার প্রায় একই সময়ে কাছাকাছি এলাকায় আরও দুজন আমেরিকান পদার্থবিদ মাইক্রোওয়েভ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। এরা হলেন প্রিনস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বব ডিক ও জিম পিবলস। তাঁরা জর্জ গ্যামোর (যিনি এক সময় অ্যালেক্সান্ডার ফ্রিডম্যানের ছাত্র ছিলেন) একটি প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছিলেন। প্রস্তাবনাটি ছিল যে আদি মহাবিশ্ব নিশ্চয় খুব বেশি উত্তপ্ত ও ঘন ছিল, যা উত্তপ্ত অবস্থায় সাদা আলোতে জ্বলজ্বল করছিল। ডিক ও পিবলস বললেন, আদি মহাবিশ্বের এই বিকিরণ আমাদের আজও দেখার কথা। কারণ এর খুব দূরের অংশ থেকে আসা আলো আমাদের কাছে এইমাত্র এসে পৌঁছাবে। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে এতে মারাত্মকভাবে লাল সরণ ঘটবে। এর ফলে এটি আমাদের কাছে দৃশ্যমান আলোর বদলে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ হিসেবে আসবে। ডিক ও পিবলস এই বিকিরণ খোঁজ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এটা জানতে পেরে পেনজিয়াস ও উইলসন বুঝলেন তারা এটাই পেয়ে গেছেন। এই অবদানের জন্যে ১৯৭৮ সালে পেনজিয়াস ও উইলসন নোবেল পুরস্কার পান (বিষয়টি ডিক ও পিবলসের জন্যে অবশ্যই একটু কষ্টকর, গ্যামোর কথা আর নাইবা বললাম।
আমরা যেদিকেই দেখি তার সব দিকে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখা যায়- এই কথা থেকে প্রথমে মনে হতে পারে আমরা মহাবিশ্বের বিশেষ কোনো জায়গায় আছি। বিশেষ করে মনে হতে পারে যে আমরা যদি সব গ্যালাক্সিকে আমাদের থেকে দূরে সরতে দেখি তার অর্থ হচ্ছে আমরা নিশ্চয়ই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আছি। কিন্তু ব্যাখ্যা আছে আরেকটিও। অন্য যে-কোনো গ্যালাক্সি থেকে দেখলেও সব দিকে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। আমরা আগেই বলেছি, এটাই ছিল ফ্রিডম্যানের দ্বিতীয় অনুমান।
দ্বিতীয় অনুমানের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কয়েকশ বছর আগে এ ধরনের অনুমান গির্জা মেনে নিত না। গির্জার নীতিমালা ছিল যে আমরা মহাবিশ্বের কেন্দ্রের একটি বিশেষ জায়গায় আছি। কিন্তু বর্তমানে প্রায় উল্টো কারণে আমরা ফ্রিডম্যানের অনুমানে বিশ্বাসী। একটু উদার মনোভাব দেখানো-এই আর কি! অর্থ্যাৎ, যদি মহাবিশ্বকে আমাদের চারদিকে একই রকম মনে হত, কিন্তু অন্য কোনো স্থান থেকে একেক দিকে একেক রকম লাগত, তবে তা বড় একটি ব্যাপার হত।
ফ্রিডম্যানের মডেল অনুসারে গ্যালাক্সিরা সরাসরি একে অপরের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। একটি বেলুনে কিছু দাগ দিয়ে ধীরে ধীরে ফোলানোর সাথে একে তুলনা করা যায়। বেলুন বড়ো হতে থাকলে যে কোনো দুটি দাগের দূরত্ব বেড়ে যায়। কিন্তু প্রসারণের কেন্দ্র বলা যাবে এমন কোন বিন্দু নেই। উপরন্তু, বেলুনের ব্যাসার্ধ বাড়ছে বলে বেলুনের যে দাগগুলো যত দূরে আছে সেগুলো তত দ্রুত সরতে থাকবে। যেমন ধরুন প্রতি সেকেন্ডে বেলুনের ব্যাসার্ধ দ্বিগুণ হচ্ছে। আগে যে দুটি দাগ এক সেন্টিমিটার দূরে ছিল এখন তারা থাকবে দুই সেন্টিমিটার দূরে (বেলুনের পৃষ্ঠের উপর দূরত্ব মাপলে)।  তাহলে এদের আপেক্ষিক বেগ হবে সেকেন্ডে এক সেন্টিমিটার। কিন্তু ধরুন, অপর দুইটি দাগ আছে দশ সেন্টিমিটার দূরে। তাহলে এখন তারা থাকবে বিশ সেন্টিমিটার দূরে। সুতরাং, তাদের আপেক্ষিক বেগ হবে সেকেন্ডে দশ সেন্টিমিটার। একইভাবে ফ্রিডম্যানের মডেল অনুসারে, যে কোনো দুটি গ্যালাক্সির দূরে সরার গতি তাদের দূরত্বের সমানুপাতিক। তাই তিনি অনুমান করলেন, কোনো গ্যালাক্সির লাল সরণ আমাদের থেকে এর দূরত্বের সরাসরি সমানুপাতিক হবে। হাবলও তাই পেলেন। এই মডেলের সাফল্য এবং হাবলের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর পরেও পাশ্চাত্য বিশ্বে এই মডেল দীর্ঘ দিন ধরে অজানা থেকে যায়। শেষে ১৯৩৫ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ হাওয়ার্ড রবার্টসন ও ব্রিটিশ গণিতবিদ আর্থার ওয়াকার একই রকম মডেল আবিষ্কার করেন। মহাবিশ্বের সুষম প্রসারণ সম্পর্কে হাবলের আবিষ্কারই ছিল তাঁদের আবিষ্কারের ভিত্তি।
সম্প্রসারণশীল বেলুন মহাবিশ্ব
সম্প্রসারণশীল বেলুন মহাবিশ্ব
[মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে সবগুলো গ্যালাক্সি একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সময় যেতে যেতে ফুলে ওঠা বেলুনের মত বেশি দূরত্বে থাকা গ্যালাক্সিরা কাছের গ্যালাক্সির চেয়ে দ্রুত সরে যায়। কাজেই, যে কোনো গ্যালাক্সির একজন দর্শক দেখবেন, একটি গ্যালাক্সি যত দূরে আছে তা তত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে।]
 ফ্রিডম্যান মহাবিশ্ব সম্পর্কে কেবল একটিমাত্র মডেল তৈরি করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর অনুমান সঠিক হলে আইনস্টাইনের সমীকরণ অনুসারে সম্ভাব্য সমাধান পাওয়া যায় তিনটি। অর্থ্যাৎ, ফ্রিডম্যানের মডেলেরই তিনটি আলাদা দিক আছে। মহাবিশ্বের থাকতে পারে তিনটি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য।
প্রথম সমাধানে (যা ফ্রিডম্যান নিজে বের করেন) মহাবিশ্ব যথেষ্ট ধীরে প্রসারিত হচ্ছে, যার ফলে বিভিন্ন গ্যালাক্সির মহাকর্ষীয় টানের প্রভাবে প্রসারণের গতি এক সময় কমে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত থেমে যাবে। এরপর গ্যালাক্সিরা একে অপরের দিকে এগিয়ে আসবে, সঙ্কুচিত হতে শুরু করবে মহাবিশ্ব। দ্বিতীয় সমাধানে মহাবিশ্ব এত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে যে মহাকর্ষীয় টান কখনোই একে থামাতে পারবে না, গতি একটু কমবে যদিও। আরেকটি সমাধান বলছে মহাবিশ্ব এমন একটি যথেষ্ট দ্রুত গতিতে প্রসারিত হচ্ছে যাতে সঙ্কোচন শুরুই না হতে পারে। গ্যালাক্সিরা যে গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে তা কমে যাচ্ছে, কিন্তু কখনোই তা শূন্য হবে না।
প্রথম ধরনের ফ্রিডম্যান মডেলের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এটি অনুসারে মহাবিশ্ব অসীম নয়। কিন্তু আবার এর কোনো সীমানাও নেই। মহাকর্ষ এত শক্তিশালী যে স্থান গোলাকার হয়ে নিজের উপরই বেঁকে আছে। একে পৃথিবীর পৃষ্ঠের সাথে তুলনা করা যায়। এটি অসীম নয় ঠিকই, কিন্তু এর কোনো সীমানাও নেই। আপনি যদি নির্দিষ্ট কোনো দিকে যেতে থাকেন, আপনি কখনোই অভেদ্য কোনো বাধার মুখে পড়বেন না, বা প্রান্তে পৌঁছে গিয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকবে না। শেষমেশ পৌঁছে যাবেন সেখানেই, যেখান থেকে শুরু করেছিলেন।
প্রথম মডেল অনুসারে স্থানের চরিত্র এমনই। অবশ্য পৃথিবীর পৃষ্ঠের দুই মাত্রার বিপরীতে এখানে মাত্রা আছে তিনটি। মহাবিশ্বকে পুরো একবার ঘুরে এসে আগের জায়গায় পৌঁছার বিষয়টি সায়েন্স ফিকশনে ভালো মানায়, বাস্তবে এর তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ, দেখানো যায় যে আপনি পুরোটা ঘুরে ফিরে আসার আগেই মহাবিশ্ব গুটিয়ে গিয়ে জিরো সাইজ হয়ে যাবে। এর সাইজ এত বড় যে পুরোটা ঘুরে আসতে হলে আপনাকে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলতে হবে। কিন্তু তা অসম্ভব, যার ফলে আপনি ফিরে আসার আগেই মহাবিশ্ব শেষ হয়ে যাবে। ফ্রিডম্যান মডেলের দ্বিতীয় অংশেও বক্র স্থানের কথা আছে। এর চিত্র অবশ্য ভিন্ন। ফ্রিডম্যান মডেলের তৃতীয় অংশটিতেই কেবল বড়ো মাপের দৈর্ঘ্যে মহাবিশ্বের জ্যামিতি সমতল (যদিও বড় ভরের বস্তুদের আশেপাশে স্থান বক্রই থাকবে)।
ফ্রিডম্যানের কোন মডেলটি সঠিক? এক সময় কি মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ হবে, নাকি চিরকাল এর প্রসারণ চলতেই থাকবে?
প্রশ্নটার উত্তর যে এতটা জটিল তা আগে বিজ্ঞানীরা আগে বুঝতে পারেননি। এই প্রশ্নের মৌলিক উত্তর নির্ভর করে দুটি জিনিসের উপর- মহাবিশ্বের প্রসারণের বর্তমান হার এবং বর্তমান গড় ঘনত্ব (একটি নির্দিষ্ট আয়তনে যে পরিমাণ পদার্থ উপস্থিত)। বর্তমানে প্রসারণের হার যত বেশি হবে, তাকে থামাতে তত শক্তিশালী মহাকর্ষের প্রয়োজন হবে। এর জন্যে গড় ঘনত্বের মানও হতে হবে বেশি। যদি ঘড় ঘনত্ব একটি নির্দিষ্ট সঙ্কট মানের (যা নির্ভর করে প্রসারণের হারের উপর) বেশি হয়, তাহলে মহাকর্ষীয় টানের প্রভাবে প্রসারণ থেমে গিয়ে পতন শুরু হবে। এটাই হল ফ্রিডম্যানের প্রথম মডেল। যদি গড় ঘনত্ব সঙ্কট মানের চেয়ে কম হয়, তাহলে প্রসারণ থামানোর মতো যথেষ্ট মহাকর্ষীয় টান থাকবে না। কাজেই, মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে। এটা হল ফ্রিডম্যানের দ্বিতীয় মডেল। আর গড় ঘনত্ব যদি সঙ্কট মানের ঠিক সমান হয় তবে মহাবিশ্বের প্রসারণ হার চিরকাল ধরে কমতে থাকবে। এটি দ্রুত একটি নির্দিষ্ট সাইজের কাছাকাছি হতে থাকবে, কিন্তু কোনো দিনই সেই সাইজ পর্যন্ত পৌঁছবে না। এটা হল ফ্রিডম্যানের তৃতীয় মডেল।
এর মধ্যে কোনটি ঘটবে? ডপলার প্রভাবের সাহায্যে আমরা অন্যান্য গ্যালক্সিদের আমাদের থেকে দূরে সরার বেগ মাপতে পারি। এর মাধ্যমে প্রসারণের বর্তমান হার জানা যাবে। খুব নির্ভুলভাবে এর মান বের করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল, গ্যালাক্সিদের দূরত্বের খুব বেশি সঠিক হিসাব জানা নেই। এদের দূরত্ব আমরা সরাসরি মাপতে পারি না। আমরা শুধু জানি যে প্রতি বিলিয়ন বছরে মহাবিশ্ব ৫ থেকে ১০ শতাংশ প্রসারিত হয়। অন্য দিকে মহাবিশ্বের বর্তমান গড় ঘনত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আরও অস্পষ্ট। কিন্তু আমরা আমাদের ও অন্যান্য গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ তারকা দেখি তাদের মোট ভর মহাবিশ্বের প্রসারণ থামানোর জন্যে যথেষ্ট নয়, প্রসারণের হারকে যতটা সম্ভব ছোট ধরে নিলেও। ভর উপস্থিত আছে প্রয়োজনীয় ভরের একশ ভাগের মাত্র এক ভাগ।
কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়। আমাদের গ্যালাক্সিসহ অন্যান্য গ্যালাক্সিতে বিপুল পরিমাণ ডার্ক ম্যাটারও আছে। এদেরকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রদের কক্ষপথের উপর এর মহাকর্ষীয় প্রভাবের কারণে এর উপস্থিতি আঁচ করা যায়। এর সবচেয়ে বড়  প্রমাণ সম্ভবত আমাদের মিল্কিওয়ের মতো সর্পিল গ্যালাক্সিগুলোর বাইরের দিকে অবস্থিত নক্ষত্রগুলোর বেগ। এ নক্ষত্রগুলো যে তীব্র গতিতে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে তাতে গ্যালাক্সির নক্ষত্রদের মোট মহাকর্ষীয় টান এদেরকে কক্ষপথে ধরে রাখতে পারার কথা নয়
উপরন্তু বেশির ভাগ গ্যালাক্সিকে গুচ্ছ গুচ্ছ (Cluster) আকারে অবস্থান করতে দেখা যায়। তাই একইভাবে গ্যালাক্সিদের গতির প্রকৃতি দেখে আমরা এদের মাঝখানে আরও বেশি ডার্ক ম্যাটার আছে ধরে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ সাধারণ বস্তুর তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু এই সব ডার্ক ম্যাটার যোগ করেও আমরা প্রসারণ থামানোর মতো প্রয়োজনীয় ভরের দশ ভাগের মাত্র প্রায় এক ভাগ ভর পাই। কিন্তু মহাবিশ্বে আরেক ধরনের ডার্ক ম্যাটারও থাকতে পারে, যা সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে আছে। আমরা এখনও এটি শনাক্ত করতে পারিনি। তবে এটি পাওয়া গেলে মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব আরও অনেক বেশি হতে পারে। নিউট্রিনো নামে এক ধরনের মৌলিক কণিকা আছে। এরা সাধারণ পদার্থের সাথে কোনো ক্রিয়া করে না বলে এদেরকে শনাক্ত করা খুব কঠিন (সম্প্রতি নিউট্রিনো নিয়ে পরিচালিত একটি পরীক্ষায় পানির নিচে ব্যবহৃত একটি ডিটেকটরের পঞ্চাশ হাজার টন পানির প্রয়োজন পড়ে)। আগে মনে করা হত এদের ভর নেই বলে এরা মহাকর্ষীয় আকর্ষণও অনুভব করে না। কিন্তু কয়েক বছর আগে পরিচালিত অনেকগুলো পরীক্ষায় দেখা গেছে এদের সামান্য ভর আছে যা আগে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যদি ভর থেকে থাকে, তবে তা ডার্ক ম্যাটারের একটি রূপ হতে পারে। নিউট্রিনোর এই ভরের কথা হিসাবে ধরলেও মহাবিশ্বের প্রসারণ থামানোর মতো প্রয়োজনীয় ভরের চেয়ে অনেক কম ভর পাওয়া যায়। এ কারণে সম্প্রতি পদার্থবিদরা আপাতত ফ্রিড্যমানের দ্বিতীয় মডেলটির ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
এরপর পাওয়া গেল নতুন কিছু পর্যবেক্ষণ। গত কয়েক বছরে গবেষকদের কয়েকটি দল পেনজিয়াস ও উইলসনের আবিষ্কৃত মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণের তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেছেন। এই তরঙ্গের যে সাইজ, তাতে এ থেকে মহাবিশ্বের বড়ো মাপের কাঠামো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। ফ্রিড্যমানের তৃতীয় মডেলের মতোই এর ইঙ্গিত সমতল মহাবিশ্বের পক্ষে। একে ব্যাখ্যা করার মতো সাধারণ বস্তু ও ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ যথেষ্ট না হওয়াতে পদার্থবিদরা আরেক ধরনের বস্তুর কথা ভাবছেন। এর নাম ডার্ক এনার্জি।
সম্প্রতি আরও কিছু পর্যবেক্ষণ জটিলতা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। দেখা গেছে যে মহাবিশ্বের প্রসারণ হার না কমে বরং দিন দিন বাড়ছে। ফ্রিডম্যানের একটি মডেলেও এই কথা নেই। এটি খুবই অবাক করা ব্যাপার, কারণ মহাবিশ্বের ঘনত্ব কম হোক বা বেশি- বস্তুর উপস্থিতিতিতো প্রসারণ কিছুটা কমাবেই। আর তাছাড়া মহাকর্ষতো কেবল আকর্ষণই করে (বিকর্ষণ নয়)। প্রসারণ হার বেড়ে যাওয়াকে বোমার বিস্ফোরণের সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু এখানে বিস্ফোরণের পর দুর্বল হবার বদলে বোমার প্রতিক্রিয়া আরও শক্তিশালী হচ্ছে। কোন সেই শক্তি যা ক্রমেই দ্রুততর গতিতে মহাবিশ্বকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর উত্তর নিশ্চিত করে কেউ জানে না। কিন্তু আইনস্টাইন যে মহাজাগতিক ধ্রুবক (ও তার অ্যান্টিগ্র্যাভিটি ইফেক্ট বা বিপরীত মহাকর্ষ প্রভাব) নিয়ে এসে ঠিকই করেছিলেন এটা তার পক্ষে প্রমাণ হতে পারে।
প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি ও নতুন ধরনের উপগ্রহ টেলিস্কোপের কল্যাণে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে ক্রমশ নতুন নতুন বিস্ময়কর তথ্য জানতে পারছি। ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের কী হবে তা সম্পর্কে এখন আমাদের জ্ঞান বেশ ভালো: মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হবে এবং প্রসারণের হার ক্রমাগত বাড়বে। সময়ও চলবে চিরকাল পর্যন্ত, তবে যারা ব্ল্যাক হোলে পড়ে যাবার মতো বোকামী করবে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার কী খবর? এর শুরু কীভাবে হল, প্রসারণইবা শুরু হয়েছিল কী করে?
 অনুবাদকের নোটঃ
১। এদের সবাই অবশ্য একসাথে একই রাতে নাও থাকতে পারে।
২। একই কারণে গ্রহরা যেহেতু আরও অনেক বেশি কাছে, তাই দূরের তারকাদের তুলনায় এদের নড়চড়া খুব বেশি চোখে পড়ে।
৩। কোনো বস্তু অন্য বস্তুর চারপাশে কক্ষপথে টিকে থাকে দুটো বলের প্রভাবে। একটি হল, কেন্দ্রীয় বস্তুটির মহাকর্ষীয় টান। অপরটি হল বস্তুটির কক্ষপথের বেগ, যা কেন্দ্রবিমুখী বলের যোগান দেয়। মহাকর্ষ বল একমুহূর্তের জন্যে অনুপস্থিত হলে অপর বলটির প্রভাবে কক্ষপথ থেকে বস্তুটি নাক (স্পর্শক) বরাবর বাইরে ছিটকে যাবে। এখন এক্ষেত্রে গ্যালাক্সিদের বাইরের দিকের নক্ষত্ররা যে গতিতে ঘুরছে তাতে কেদ্রীয় মহাকর্ষ এদেরকে কক্ষপথে ধরে রাখতে পারার কথা নয়।






দশম অধ্যায়ঃ ওয়ার্মহোল ও টাইম মেশিন



 মূলঃ Stephen Hawking এবং Leonard Mlodinow
অনুবাদঃ আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ
শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়