মদনের অন্যদিন
লিখেছেন মুরশেদ
ভুত বাবা খুশী হলেন না। মেজাজ মনে হয় খুব খারাপ। বললাম- বাবা, রেগে আছেন?
তিনি কোন কথা বললেন না। আবার আওরাতে শুরু করলাম-‘ভুতেশ্বর ছাড়া বাকী সব ভুত ফালতু। মদন তাহার একমাত্র ঠিকাদার’ ; ‘ভুতেশ্বর ছাড়া বাকী সব ভুত ফালতু। মদন তাহার একমাত্র ঠিকাদার’; ‘ভুতেশ্বর ছাড়া ……
তিনি হাত উচু করে থামিয়ে দিলেন। আমি ঢোঁক গিললাম। ‘আজ কতবার শ্লোক পরেছিস?’
কতবার পরেছি? কী উত্তর দেবো? আজ তো মনে হয় পড়িই নাই।আজ সারাটাদিন কাটিয়েছি বিধর্মী মধুমালার সঙ্গে। মধুমালা আমাকে নরকে নেবে। সেও নরকবাসী হবে। আমার নরকের সঙ্গি। সাত সকালেই তার ফোন পেয়েছিলাম।
-মদন, শাহবাগে চলে, আয়।
-কেন, আজ তোর অফিস নেই? কাজ কাম নেই, শাহবাগে বসে আছিস?
ক’মাস হল সে একটা চাকরী নিয়েছে। একটা গার্মেন্টস কোম্পানিতে জুনিয়র কমার্শিয়াল। বেতন বলার মত কিছু না, মা ছেলের চলে যায়। আসছে জানুয়ারীতে ছেলেকে স্কুলে দিতে হবে। পয়সাও কিছু জমাতে হবে। আমি কিছু টাকা পয়সা দিতে চাইলে নেয়না। বলে- ‘ভুতের পয়সায় মুতি’। খুবই বেধার্মিক, বেতমিজ আর বে-ভুত মেয়েছেলে। কবে যে তার উপর ভুতের গজব পড়বে? ভুত অতি উত্তম গজব প্রদানকারী।
পুবালী ব্যাংকের গেটের সামনে তাকে পেলাম।সে যখন খুব ব্যস্ত থাকে, তাকে খুব অদ্ভুত দেখায়। তার ছিপছিপে শ্যামলা শরীর পূবালী বাতাসে উড়ে চলা ঘন মেঘের মত সহসা বিদ্যুৎ হানে।
বললাম- মেঘমল্লিকা, আজ কি ভাসাবে মদনের দুনিয়াদারী।
-পিরিত বন্ধ কর। রিক্সায় ওঠ।
মানুষ গিজগিজ করছে ঢাকা মেডিক্যালে। বেড গুলিতে জায়গা নাই। অনেককে মেঝেতে শোয়ানো হয়েছে। আহত আরও আসছে। একেক জনের শরীরে হাজার হাজার স্প্লিন্টার। কারও চোখ উড়ে গেছে। হাতের কব্জি উড়ে গেছে পাচ বছরের এক শিশুর। সে আর কোনদিন আইসক্রিম ধরে খেতে পারবে না।
কেউ নতুন ভর্তি হচ্ছে। কেউ ভর্তি হয়ে কাতরাচ্ছে। কারও কাতরানি থেমেছে। পাড়ি দিয়েছে ভুতেশ্বরের কাছে। মানুষ তাও বিশ্বাস আনে না। বড় বেঈমান মানুষ!
লাইন ধরে রক্ত দিলাম। অনেকেই এসেছে রক্ত দিতে। দিচ্ছে। কিন্তু যথেষ্ট নয়। আরও রক্ত লাগবে। এত রক্ত ভুতেশ্বররে রাজ্য মিলবে না। শরিরের অঙ্গ দান মহা পাপের বিষয়। বাচা মরা ভুতের হাতে। ভুতের উপর ভুতগিরি ভুতশ্বরের না পছন্দ।
তবুও রক্ত দিতে হল। মধুর কথা ফেলতে পারিনা। মধুমালার অবাধ্য হবার সাধ্য নেই মদনের।
বিকেলে মধুর সাথে ব্যাংকে গেলাম। তার সেখানে কাজ ছিল। কয়েকটা ডকুমেন্ট এসেছে। র-ম্যটেরিয়ালস পড়ে আছে পোর্টে। ডেমারেজ খাচ্ছে। আগামী তিন সপ্তার মধ্যে এই শিপমেন্ট করতে না পাড়লে তাদের কম্পানির তিন হাজার শ্রমিকের বেতন হবে না। মধুকে খানিত অসহায় মনে হল।
মধুর জন্যে খারাপ লাগল। কিন্তু বাকী তিন হাজারের জন্যে না। তারা মুলত নারী শ্রমিক। নারীদের কেন বেতন পেতে হবে? তাদের কাজ স্বামীদের টাকা পয়সা হিসেব রাখা।
ঐ ব্যাংকের সিনিয়র ক্যাশিয়ার মতলব আলি ভুতেশ্বরের দারুন ভক্ত। বছর তিনেক আগে এ টি এম বুথে জাল নোট সরবরাহের একটা মিথ্যে মামলায় ফেসে গিয়ে চাকুরী যায় যায়। শেষে ভুতবাবার কৃপায় আর একজন ডাইরেক্টর সাহেবে সুপারিশের সুবাদে টিকে গেছে।সেই থেকে সে নিয়মিত ভুতের চাদা দেয়। আজও দিল। আমার পকেট স্বর্গিয় কৃপায় ভরে গেল।
ব্যাংক থেকে বেরিয়ে ছুটলাম টঙ্গি। মধুদের ফাক্টরিতে। আজ কেন জানি মধুর নেশা ধরে গেছে। সে যেখানেই যায়, তার সাথে যেতে হবে। মধু অবশ্য মানা করেছিল। কিন্তু আমি বললাম- রাস্তা ঘাটের অবস্থা ভাল না। আব্দুল্লাহপুরে বাস পূরানো হচ্ছে। আজকে ঢাকায় টার্গেট আছে তিনটি, দুটি পুরেছে, আরও একটি পুড়বে। আমি তোর সাথে থাকি।
-আমার সাথে কেন?
-যদি পুড়ি, দুজনে একসাথেই পুড়ব। এক চিতায় মধুমালা আর মদন কুমার!
-তোর ভুতবাবা মাইন্ড করবে না!
-করুক। মধুমালার জন্যে আমি পুড়তে পুড়তে নরকে যাব। সেখানেও পুড়ে পুড়ে মদন শুধু মধুর হবে। আর হিংসার আগুনে পুড়বে ভুতেস্বর!
-বাসের জানালা দিয়ে একচিলতে ম্রিয়মান রোদ্দুর মধুমালাকে ভরিয়ে দিল।তার চিবুক ছুয়ে দিয়ে বললাম- তুই আমাকে ভাসিয়ে দিলি মধু।
ভুতেশ্বর বললেন- ঐ বেধর্মি মেয়েটা যখন এতই যাদু মন্ত্র করেছে, তাকে হরন কর। হরন করে ইচ্ছে মত ভোগ কর। বেধর্মি নারী ভোগ করতে তো আর আমি বারন করিনি। তারে বান্দী বানিয়ে রাখ। বান্দির গর্ভে যা জান্মাবে তা হবে তো দাস। ইচ্ছে করলে তাকে রাখতেও পারিস, কিম্বা বেচতেও পারিস।চউদি দেশে বেচলে ভাল দাম পাবি। অযথা ভুত রাজ্য অশ্লিলতা ছড়ানোর মানে কী ?
-মধু কে হরন করতে পারব না।
-কেন?
এর উত্তর কী দেব। এই সর্বজ্ঞানী ভুতেশ্বরকে কে বলে দেবে ভালবাসা হরন করা যায় না।
গোয়ার স্বর্গবাস ১
লিখেছেন মুরশেদ
প্রথমে কথাটা বিশ্বাস হয়নি। দুজন দশজন নয়, শত শত নয়, হাজার হাজার নয়, একবারে ত্রিশ লক্ষ মানুষ ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার মাস্টার মাইন্ড, ভুতেশ্বরের অতি পবিত্র ভুতেস্তানের খুনে নরপতি গোয়া মরণোত্তর স্বর্গ প্রাপ্ত হয়েছেন ! বাবা ভুতেশ্বরের করুনার অন্ত নেই !
গোয়ার রাজসিক স্বর্গবাস স্বচক্ষে দেখার জন্যে মনটা খুব আকুপাকু করছিল। কিন্তু জ্যন্ত মানবের স্বর্গ দর্শনের নিয়ম নেই। তবুও ধরলাম ভুত বাবাকে। যদি কোন ব্যবস্থা থাকে !
ভুতবাবা এই অধমের আকুতি রাখলেন। তিনি স্বর্গচারী ডানা ওয়ালা ছাগী পাঠিয়ে দিলেন। বুধবার দিবাগত আমাবস্যার রাত বারোটা সাত মিনিটে শুরু হল আমার ছাগ যাত্রা। ছাগীটা ছিল কিছুটা মরা ধরনের। প্রথম আকাশ পেরুতেই তার জিহবা বেরিয়ে যাবার দশা। বললাম- কি মশাই, এভাবে চললে স্বর্গে পৌছুতে পৌছতে তো আমার আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাবে। তখন আর আমারে ফিরিয়ে আনার দরকার পড়বে না। তোমার উদ্দ্যশ্যটা কী, বলতো বাপু?
-জনাব, ক্ষমা করবেন। আমি মশাই না, মাসী। পুংলিঙ্গ না স্ত্রী লিঙ্গ।
-ঠিক আছে, ছাগ মাসী। আমরা আর কতক্ষনে স্বর্গে যাব। তোমার গতিটা একটু বাড়ানো যায় না?
ছাগী কিছুটা গতি বাড়াল বটে, তবেঁ লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে লাগল। বেচারাকে খুব কাহিল মনে হল। বললাম- থাক, বেশী জোরে যাবার দরকার নেই। বরং একটু ধীরে সুস্থে দেখতে দেখতে যাই। তুমি বরং পরে আকাশে খানিকটা জিরিয়ে নিও।
মনে হয়ে সে খুশী হল। বিড় বিড় করে বলল- আর কত পারি, বলেন। আমি ছাগলের বাচ্চা ছাগল। মানুষের এমন পাশবিক অত্যাচার আর কত সহ্য করি বলেন?
-অত্যাচার! পাশবিক! কে করে এই স্বর্গ দেশে?
-সবাই করে। সব স্বর্গবাসীই করে। তবেঁ আমার মনিব করে সবচাইতে বেশী। সে এই সবের মাস্টার।
-কোন সবের? কে তোমার মনিব?
-কেন গোয়া, যার কাছে আপনেরে নিয়া যাইতেছি।
-ও, তুমি গোয়ার ডিউটি কর। সে বুঝি খুব ঘুরাঘুরি করে?
ছাগী খুব হাসল। কোন কথা বলল না।
-কি উত্তর দিলা না যে?
-আপনে যে কী কন? কোথায় ঘুরাধুরি করব? স্বর্গে তো কেউ ঘুরতে যায় না। যায় ছহবত করতে আর মদ্যপান করতে। খাইতে আর ঘুমাইতে।
-শুধু এই করে কী আর সময় কাটে?
-আর কি চাই?
-কেন, গান বাজনা, শিল্প কলা, চিত্র কলা, উপন্যস, নাটক, সিনেমা- কত কিছুই না লাগে সময় কাটানোর জন্যে…………
ছাগী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল- শিল্পকলা নিষিদ্ধ বিষয়। জগতে যারা শিল্প সহিত্য চিত্রকলা চর্চা করে তারা স্বর্গ থেকে বিতারিত। স্বর্গ কেবল তাকের জন্য যারা শরীর সর্বস্ব, এবং সুকুমার বৃত্তিহীন।
ও আচ্ছা। তো তোমার কষ্টটা কীসের? গোয়া তোমাকে কী ধরনের পেইন দেয়?
-ছহবত পেইন। গরু ছাগল দুম্বা উট, কিছুতেই তার অরুচি নেই। গত রাতে সাতশ’ বার সে আমাতে উপগত হয়েছ!
-এতো বিরাট অন্যায়, একটা অবুঝ প্রাণীর উপর এমন পাশবিকতা! কেউ কিছু বলে না?
-কে বলবে? কি বলবে? স্বর্গবাসীর সকল ইচ্ছা পুরন করতে ভুতেশ্বর বাধ্য। তারা যা ইচ্ছে প্রকাশ করবে, ভুত তাই তার জন্যে সিদ্ধ ঘোষণা করবে। এটাই স্বর্গের আইন। দেইখেন- আপনি যেন খুব বেশী তার কাছে থাইকেন না। তার যদি আপনের উপর ইচ্ছা জাগ্রত হয়ে যায়, তাইলেই সর্বনাশ! ভুতেশ্বর আপনাকেও তার জন্যে সিদ্ধ ঘোষণা করে দিবে।
ছাগযান অবশেসে শেষ আসমান পার হয়ে পৌছে গেল গোয়ার স্বার্গ বাড়ীর বারান্দায়। তখন সকাল হয়ে গেছে। বেলা আনুমানিক এগারটা হবে।
বিশাল আলীশান বাড়ী পেয়েছে। শত শত কক্ষ। বিশাল বাগান। চারটে বিস্তীর্ন ঝর্না। পানির, দুধের, মধুর আর মদের ঝর্না।
প্রতিটা ঝর্নার আশে পাশে পান পাত্র নিয়ে বসে আছে ছোট কিশোর বালকেরা। মনি-মুক্তর মত তাদের চেহারা। ভিতর থেকে আদেশ আসা মাত্র শুরু হয়ে যায় শিশুদের হন্তদন্ত যাত্রা।কেউ পানি, কেউ দুধ, কেউ মধু আর একু মদ নিয়ে ছোটে। মদের কদর একটু বেশী।
পাশে বাগানে অনেকগুলি বেঞ্চি পাড়া আছে। বেঞ্চি গুলিতে স্বর্গবালারা উৎকণ্ঠিত অপেক্ষায়। কথন কার ডাক পড়ে। তারা আনত নয়না। প্রত্যেকে গায়ে ট্যাগ লাগানো আছে- আমাকে কোন মানুষ কিম্বা কোন প্রেত কখনো ছোয়নি। তাদের ত্বক এত পাতলা যে, দেহের স্কেলিটন পরিস্কার দেখা যায়। এমন হাড় জিরজিরে কঙ্কালের উপর কেউ উপগত হয়, ভাবতে অবাক লাগে?
তাদের দেখে মধুমালার কথা মনে পড়ল। মধুমালা। বাঙলার কৃষ্ণ নারী। স্বাধীন, সুঠাম, আর নির্ভিক। তার উপর কেউ উপগত হয় না। সে পুতুল না। সে আত্বপ্রত্যয়ী মানুষ। সে এক নিমিষে মদনকে হরন করতে পারে। ৭২ স্বর্গ বেশ্যা মধুমালার কাছে নস্যি।
হাটতে গোয়ার খাস কামড়ার কাছে গেলাম। কামড়ার দরোজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাইরে একটা সর্গবালক নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে। আরেকটি বালক তার পায়ুপথে তরল জাতীয় পদার্থ ঢালছে।
বললাম- একি হচ্ছে?
শোয়া বালকটি বলল- এখন চলছে স্বর্গবালা নম্বর-৩৯ এর ডিউটি। এর পরে আমার পালা। আমাদের মুনিব একজন বালার পরে একজন বালকে উপগত হন। উনি খুব রসিক আর রুচীবান মানুষ। ভুতেশ্বরের অতিপ্রিয় শিষ্য।
আমি বললাম- আমি তো তার সাথে দেখা করতে এসেছি। ঢাকা থেকে। আমি ঢাকার মদন। তার সাথে এখন দেখা হবে না?
– এখন হবে না। উনি দুপুর পর্য্যন্ত ৭২ দাসী আর সমান সখ্যক বালক সঙ্গ করেন। তারপরে তিনি আহার করেন। তারপর বিশ্রাম। বিকেলের আগে আপনি তার দেখা পাবেন না।
– দুপুরের মধ্য এত কম সময়ে এত সহবাস কীভবে হবে? তিনি কী মিনিটে মিনিটে একটা করে সারেন?
– না। স্বর্গের এক এক দিন মর্ত্যের পঞ্চাশ হাজার বছর। তাই সময় এখানে কোন সমস্যা না, সমস্যা সময় কাটানোর।
হিসেব কষতে গিয়ে ঘেমে উঠলাম। বিকেল হতে অন্থত কুড়ি হাজার বছর অপক্ষে করতে হবে। সময় কাটানো যে কত বড় সমস্যা তা স্বর্গে না গেলে বোঝা যায় না!
মদনের উৎসর্গ উপাখ্যান
লিখেছেন মুরশেদ বিষয়: অবিশ্বাসের
জবানবন্দী,
নির্দেশ
পর্বতাঁর বক্তব্য ছিল খুবই শর্ট কার্ট। খুবই ইংগিত ময়। কয়েকটি মাত্র শব্দঃ
‘হে মদন, উৎসর্গ কর, তোমার প্রিয় বস্তুকে’।
ব্যাস। আর কিছু নেই। কিসের উৎসর্গ, কোথায় উৎসর্গ, কিভাবে উৎসর্গ, কোন ডিটেইলস নেই। ভুতেশ্বরকে নিয়ে এই এক ঝামেলা। ক্লিয়ারকাট কিছু বলে না। কখনও আবার একই কথা বার বার বলে। কখনও একেবারে খাপছাড়া কী যে বলে বসে কিছুই বোঝা যায় না। রূপক। খালী রূপক। যে বুঝবে না সে মদনা!
উৎসর্গ তো বুঝলাম। কিন্তু কোন বস্তু? কিভাবে উৎসর্গ? কোথায়? কোন ঘোড়ার ডিম ভুতেস্বরের পছন্দ কে জানে? সে সোজাসুজি কিছু বলে না। খালী ত্যানা পেচায়। ভুতেশ্বর তেনা প্যাচানোর মাস্টার!
বউরে বললাম। বললাম- তোর গয়নাগাটিগুলান দে। ভুতেশ্বরের আদেশ। প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করতে হবে। তাঁর কথার নড়চড় করা যাবে না। করলে মহা বিপদ। তবে কী বিপদ জানিনা।
খুবই বে-দ্বীন টাইপের মেয়ে সে। গয়নাগাটি জড় করে নিয়ে বাপের বাড়ী চলে গেল। যাবার আগে বলে গেলঃ বাসায়ই থেক। বড় ভাইয়াকে খবর দিয়েছি। তোমাকে পাবনায় নিয়ে যাবে।
বউ চলে গেল। তাঁর বড় ভাই এল। আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা প্রশ্ন করল। বিশেষ করে আমার বংশে কেউ পাগল ছিল কিনা সেটাই তাঁর মুখ্য জিজ্ঞাস্য। বললাম- না। আমার বাবা অত্যধিক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন।
-কেমন জ্ঞানী মানুষ? –তাঁর চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
– তিনি পীর ছিলেন। তাঁর দেয়া পানি পড়া খেয়ে পোয়াতি হয়নি এমন নারী আমাদের অঞ্চলে নাই।
-তাই নাকি! তো তিনি তোমাকে পানি পড়ার তরিকা শিখিয়ে দেননি?
– জি না। উনার কাছে জ্বীন ছিল। আমার নেই।
-উনার পানি পড়ায় পাগল ভাল হত না? খোয়াব দেখা পাগল?
বুঝলাম তিনি আমার উপর খুব রেগে আছেন। ভুতেশ্বরে তাঁর বিন্দু মাত্র বিশ্বাস নেই। বেটা ঘোর নাস্তিক। আস্তে আস্তে বললাম- ভাইয়া, আসলে তিন দিন একই স্বপ্ন দেখাছি। তিনি খালী বলেন- হে মদন, উৎসর্গ কর, তোমার প্রিয় বস্তুকে। কিন্তু কী যে উৎসর্গ করব তা বলেন না। ভীষণ বিপদে আছি।
আমার কথা তাঁর বিশ্বাস হল বলে মনে হল না। কিছুক্ষন এক দৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হল তিনি এক আজব চিরিয়া দেখছেন। শেষে বল্লেন-রাতে ভাল ঘুম হয়?
বললাম- জ্বী না। খালী স্বপ্ন দেখি। তারপর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন ঘামতে থাকি।
-স্বপ্নে কি খালী ভুতই দেখ? নাকি অন্য কিছুও দেখা যায়?
– নানান জিনিস দেখি। একদিন দেখলাম-আমি ছাগলে চড়ে আকাশে উড়ে বেরাচ্ছি। হটাত তাঁর পিঠ থকে পড়ে যাচ্ছি। নীচে একটা অজগর সাপ হা করে আছে। সোজাসুজি তাঁর মুখে গিয়ে পরছি।
-তারপর? সাপ তোমাকে গিলে ফেলল?
– তক্ষুনি ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে শ্লোক ইউনুস পড়লাম। এই শ্লোক পড়ে মাছের পেট থেকেও বের হওয়া যায়। ভুতেশ্বর বলেছে।
-ঘুমের ওষুধ খাও। আজে বাজে চিন্তা কম কর। ভাল মুভি দেখ।বই পড়। দেখবে ভাল লাগছে।
আরও অনেক উপদেশ দিলেন। এবং ইংগিতে বেশ বুঝিয়ে দিলেন-দরকার পড়লে আমাকে পাবনায় পাঠাবেন।
অনেক অনুনয় বিনয় করলাম। বললাম- বাচ্চাদের স্কুল খোলা। এমন সময় বউয়ের বাসায় থাকা দরকার।
তাঁর পাষাণ মন গলল না। বললেন- চিন্তা কর না। বাচ্চারা আপাতত আমার কাছেই থাক। সেখান থেকেই স্কুলে যাবে। সমস্যা নেই।
সেই রাত্রে আবার ভুতেশ্বরের দেখা। সেই একই নির্দেশ- হে মদন, উৎসর্গ কর, তোমার প্রিয় বস্তুকে।
বললাম- হে মহান ভুত্ব্বেশ্বর- আমার বে-দ্বীন বউ সব গয়নাগাটি নিয়ে বাপের বাড়ী গেছে। তবে কী উৎসর্গ করি?
-মূর্খ কোথাকার? হে মদন, উৎসর্গ কর, তোমার প্রিয় বস্তুকে।
তারপর আর ঘুম হল না। সারারাত এপাশ ওপাশ করলাম।
তিনি খুব প্রিয় জিনিস চেয়েছেন। কার প্রিয়? তাঁর না আমার? আমার প্রিয় জিনিস দিয়ে তিনি কী করবেন? খাবেন? ভুতেশের কী খান? কী খেতে তাঁর সবচাইতে ভাল লাগে? কী খেতে দিলে তিনি হাপুস হুপুস করে খাবেন?
তাঁর কী খুব খিদে পেয়েছে? হতেও পারে। আজকাল মানুষেরা ভীষণ নাস্তিক প্রকৃতির হয়ে গেছে। কেউ কিছু আর উৎসর্গ করে না। মসজিদে, মাজারে, মঠে, মন্দিরে যা কিছু ভক্তরা দিয়ে যায়, পুরুতেরা তা লুটেপুটে খায়। কে ভাবে ভুতেশ্বরের কথা?
আহারে, বেচারা না জানি কত দিন অভুক্ত আছেন? মুখ ফুটে তিনি চেয়েছেন? আমি, এই পাপী মদন কি না দিয়ে পারি?
বউকে দিয়ে হবে না। মধুমালার কাছে যেতে হবে। হ্যা মধুমালাই সমাধান দিতে পারে। হতে পারে সে বে-ধর্মী, কিন্তু সে মদনের অন্তপ্রান। মদনের জন্য সে সব কিছু উজার করে দেয়। সে মদনের প্রানেশ্বরী। সে মধুমালা।
প্রস্তুতি পর্ব
মধুর হাসিতে পদ্ম ফোটে। তাঁর দেহে নিপুন ঢেউ জাগে, আবার তা ভেঙ্গে পড়ে শাহবাগ মোড়ের কাঁচ ভাঙ্গার উদ্দামতায়। নিস্তরঙ্গ চন্দ্রিমা লেকেও কোথায় যেন আলোড়ন হয়। গাছালীর ছায়া কাঁপতে থাকে অসীম শুন্যতা বুকে নিয়ে। আমি একটানা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারিনা। চোখ নামিয়ে নেই তাঁর গ্রীবায়। গ্রীবার অনাবৃত অংশে একটা কাল তিল আছে। সেই তিল- যার বিনিময় মুল্য দিতে হলে পুরো ঢাকা শহর নিলামে তুলতে হবে।
আমি তাঁর হাত ধরে বলি- মধুমালা। এই চন্দ্রিমা মাঠের প্রতিটি পদপিষ্ট ঘাস তাঁর অসীম ধুলিকনার বুকে মুখ লুকিয়ে ছিল বহুকাল। তোমাকে স্যালুট করে জেগে উঠেছে তৃণদল।
মধু হাসে। পদ্ম ফোটানো সেই হাসি। বলল- ‘ইতারমী বন্ধ কর, শয়তান। এত জরুরী তলব? বিষয়টা কী? তাড়াতাড়ি বল’। মধু তুইতুকারী তে কথা বলছে। এটা ভাল লক্ষ্মণ। তাঁর মন ভাল আছে।
ভুতেশ্বরের আর্জি তাঁর কাছে পেশ করলাম।
-তোর ভুত বাবা কে জুতা দিয়ে পেটা। তাঁর এত উৎসর্গ পাবার শখ ক্যান? তাঁর কীসের অভাব পড়ল? আর যদি কিছু পেতেই ইচ্ছে করে, তো সোজাসুজি বললেই পারে। এমন ঢাক গুড়গুড়ের মানে কি?
ঢোক গিললাম। বললাম- তিনি হলেন পরম রহস্যময়। রহস্য করা তাঁর স্বাভাব। তবে একটা ক্লু অবশ্য দিয়েছেন। আমার প্রিয় বস্তু হতে হবে।
– তো দিয়ে দে তোর প্রিয় বস্তু। কী দিবি ঠিক করলি?
– সেটাই তো পরম সমস্য? কি প্রিয়? আমার প্রিয় কী- আমিই তা জানি না।
মধু অবাক হল। তোর প্রিয় কী জিনিস- সেটা কি অন্য কেউ বলে দেবে? তুই জানিস না?
– না জানি না। আমি নিজেই তো আমার নিজের খুবই আপ্রিয়। আমার বেঁচে থাকতে যত ভাল লাগে, তাঁর চাইতে বেশী ভাল লাগে মরে যেতে।
– তো মরে যা। কখন মরবি? – মধুমালা চোখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি তাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। আজও দেখলাম না। মধুমালাকে কাঁদতে দেখলে আমার ভাল লাগত না।
-আপাতত মরবার ইচ্ছে নেই। মৃত্যু তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। বেচারা ভুতেশ্বর ছাড়া সকলেই মরে বাঁচবে। শুধু বেঁচে মরে থাকবে ভুত।
একটু থেমে বললাম- তোর বর কবে আসবে?
– আগামী সপ্তায়। খুব ঝামেলায় আছিরে, মদন। পোলারে সে মানবে না। বলেছে বিচার বসাবে।
বললাম – তাঁর দরকার নেই। কাল থেকে সে আমার কাছেই থাক। আপাতত আমার বাড়ী খালী আছে। চিন্তা নেই। তোর জামাই না ফেরা পর্যন্ত আমার বউয়ের ফেরার আশা নেই। বোধন আমার কাছেই থাক।
প্রতিপালন পর্ব
ভুতেশ্বরের কৃপায় বোধনের জন্ম। যে রাত্রে মধুর ঘর থেকে ভুতেশ্বরের পবিত্র দর্শন যাত্রা করলাম, সে রাত্রেই বিস্ময়করভবে মধুর পেটে বোধনের আবির্ভাব হল। আমি বলি- সেটা ভুত বাবার বিরাট মোজেজা। কিন্তু মধু কিছু বলে না। শুধু হাসে। কাঁচ ভাঙ্গা হাসি। বুকের ভেতরটা শাহবাগ হয়ে যায়।
ভাল করে একবার বোধনের দিকে তাকালাম। চমকে উঠলাম। অবিকল মধুমালা। সেই চোখ, সেই নাক, গ্রীবায় একটা কাল তীল। আর ঠোটে সারাক্ষণ লেগে আছে কাঁচ ভাঙ্গা হাসি। তিন বছর বয়সে মধুও কী ঠিক এমনই ছিল? মধুকে কেন সারাজীবন ধরে দেখিনি? এইভাবেই মধু কথা বলতে বলতে হাসে। আর হাসতে হাসতে কথা বলে।
-‘অমন করে তাকাচ্ছ কেন মদন?’- বোধনের চোখে মুখে কৌতূহল।
-‘ তোকে আজ জবাই করব’-কথাটা বেশ শান্ত ভাবে বললাম, যাতে সে রসিকতা না ভাবে। কিন্তু ফল হল না। বোধনের মুখে ভয়ের ছায়া নেই। বরং বিষয়টা বেশ উপভোগ করছে বলেই মনে হল।
-মুরগীর মত কাটবা?
-না, যেভাবে গরু কুরবানী দেয়, কিম্বা পাঠা বলি দেয় সেভাবেই। ভুতেশ্বর যেটা পছন্দ করে।
-তিনি কোনটা পছন্দ করেন? বলি না কুরবানী?
-জানিনা। তুই ভুত বাবার সন্তান। ভুত বাবাকে দিয়ে দেব। ভুতের নামে তুই উৎসর্গ হবি। তোর বিরাট ভাগ্য।
– উৎসর্গ কি মদন?
– উৎসর্গ হল ভুত বাবার খানা খাদ্য। তিনি থাকেন আকাশের উপড়ে। সেইখানে মাটি নেই। জল নেই। মেঘ বৃষ্টি নেই। তাই কিছু ফলে না। ভুত বাবা তাই উৎসর্গ খেয়ে বেঁচে থাকেন। উনি খুব শখ করেছেন তোকে খাবেন।
– বেশ তো তাহলে পাঠিয়ে দাও। তাজাই পাঠাও। কাঁটাকুটি করার দরকার কী?
-না, তাজা পাঠালে উনার সমাস্য। উনি জবেহ করতে পারবেন না। জবেহ করার মন্ত্র সেখানে নেই।
-মানে?
-এই ধর আমরা কোন পশু জবেহ করার সময় মন্ত্র বলি- জয় বাবা ভুতেশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ। সৌদিরা মানুষের মাথা কাটবার সময়ও এমন মন্ত্র বলে। কিত্নু তিনি কী বলবেন? তিনি তো নাস্তিক।
-ভুত বাবা নাস্তিক? – কথাটা বোধনের বিশ্বাস হয় না।
-হ্যাঁ নাস্তিক। তিনি তাঁর স্রষ্টার অস্তিত্ত্ব মানেন না।
– পরকালে যে ব্যাটার কেমন শাস্তি হবে।
বললাম- ছি বোধন। ওভাবে বলতে হয় না। তিনি তোমার বাবা হন। বাপকে ব্যাটা বলতে নেই। তাকে সম্মান করে কথা বল।
-ঠিক আছে। এখন কাট। কীভাবে কাটবা? বলি না কুরবানী?
বললাম -বুঝতে পারছি না। স্বপ্নে ডিটেইলস বলা নেই।
– তারপরে আমার মাংসগুলা কী করবা? ভুত বাবা খেতে আসবেন?
-না। তিনি আসেন না। নিয়ম হল উৎসর্গের মাংসগুলা ভক্তেরা খায়। ভক্তের খাওয়া হলে আপনা আপনি ভুতের পেট ঢুকে যায়।
-তাইলে তুমি আমারে খাবা?
আমি একা খেলে হবে না। সমান তিন ভাগ হবে। একভাগ আমি, তুই আর তোর মা, একভাগ আত্মীয় পরিজন আর এক ভাগ ফকির মিসকিন। কোন ফাকির সুযোগ নেই। চামড়াটা দান করব ভুত মন্দিরে।
-ওহ। তাহলে তুমি আমার মাংস খাবা?
-না খেতে পারব না।
– মা খাবে?
– মনে হয় খাবে না।
-আত্মীয় পরিজন ফকির মিসকিন- তারা খাবেন?
– না খাবে না।
-চামড়া কী নেবে মন্দিরের লোকজন? মানুসের চামড়া?
-না, তোর চামড়া নিয়ে গেলে তারা আমারে পুলিশে দেবে।
-তাইলে আমারে কীভাবে কাটবা? ক্যান কাটবা?
বোধনের গা থেকে মধুমালার গন্ধ আসে। সে পদ্মফুলের হাসিতে আমাকে পাগল করে দেয়। আমি তাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরি।
মদন কাঁদতে জানে না। তাই সে এক ফোটাও কাঁদে না।
বললাম- তোকে কাটব নারে সোনা। পশুই কাটব। পশুর জন্যে পশুই উত্তম উৎসর্গ।
মদনের চন্দ্রজয়
লিখেছেন মুরশেদ
মধুমালাকে
ফোন করে বললাম ব্যপারটা। সে যথারীতি বিশ্বাস করল না। সে পড়ে আছে
শাহবাগে। আজ ক’সপ্তা হতে
চলল।তাকে বুঝিয়ে বললাম- দেখ, এমন হতেই পারে। আমাদের মত মহামানুষকে মাঝে মধ্যে চাঁদে, সূর্যে, গ্রহে, নক্ষত্রে, পানিতে, পাথরে, দেখা যাবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই ভুতেশ্বরের বিধান। জয় ভুতেশ্বর।
মধুমালা ফোন কেটে দিল। সে ঘোর অবিশ্বাসী। তারপর গিয়ে পড়ে আছে শাহবাগে।বদ্ধ উন্মাদ সে। দিনের পর দিন। নাওয়াখাওয়া ভুলে পড়ে আছে। ভুতেশ্বরের অতি প্রিয় বান্দাদের ফাঁসীর দাবী নিয়ে বসে আছে। মামুর বাড়ীর আব্দার!
মধুমালার চিন্তা বাদ দিলাম। মধু বিশ্বাস না করলেও অনেকেই বিশ্বাস করেছে। আমার বাসায় রান্না বান্না করে দেয় যে মেয়েটা তার নাম সুফিয়া খাতুন। সে বিশ্বাস করেছে। সে নিজে দেখেনি। তবে শুনেছে। নুরজাহান রোডের সবাই নাকি পষ্ট দেখেছে। চাঁদের মধ্যে আমার মানে শ্রীমান মদনের কালার ছবি! আবার কেউ দেখেছে চাঁদের বুকে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেটে চলেছে ঢাকার মদন!
নুরজাহান রোডে আমার কিছু ভাল শিষ্য আছে। ফল ব্যবসায়ী আব্দুল হাই আমার প্রথম শ্রেণীর ভক্ত। তাকে যা বলি তাই বিশ্বাস করে। এই সব মাল আছে বলেই না এখনও ভুত টিকে আছে। তার ফলের দোকানে গেলাম। আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি করে ভিতরে নিয়ে গেল। পাশের দোকান থেকে নানা রকমের ফল এনে কেটে দিল। সে সবসময়ই এটা করে। নিজের দোকানের ফল সে নিজেও খায় না, আমাকে খাওয়ায় না। জিজ্ঞাসা করলে হাসে। কোন জবাব দেয় না।
-‘বাবা, আবার কবে দেখা দিবেন চান্দের পিঠে?
-আর যাব না। আসা যাওয়া খুব ঝক্কির ব্যাপার। আর সেখানে খাওয়া দাওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। খালি পাহাড় আর পাহাড়। যতক্ষণ ছিলাম, না খেয়ে ছিলাম। আমার সঙ্গে একটা টিয়া পাখি ছিল। ব্যচারীও না খেয়ে ছিল।
-আহারে, আমারে আগেই কইতেন সঙ্গে খানাখাদ্য দিয়া দিতাম। ফলমূল দিতাম।ফরমালিন আলাদা কইরা দিতাম।
-আলাদা করে কেন?
-ফরমালিন দেয়া ফল পাখপাখালির জন্যে হালাল না। মানুষের জন্য হালাল। তাই আলদা ব্যাবস্থা। যখন যেটায় খুশী মিশাইয়া লইতেন।
-আমার ময়না পাখি তো ফল খায়না।
-এইনা কইলেন টিয়া পাখি?
-যাহা ময়না তাহাই টিয়া। তুমি ভুতেশ্বরের কাজ কারবার সব বুঝবা না।
– ও আচ্ছা। তো হুজুর, আপনার ওই পাখি কী খায়?
-লইট্ট্যা ফিশ।
দেখলাম আব্দুল হাইয়ের চক্ষু সরু হতে শুরু করেছে। তাই আর পাখি প্রসঙ্গ বাড়ালাম না। বললাম- তোর ফলের আড়তে কি কুড়ি বাইশ জনের মিটিং করার জায়গা হবে?
-একটু ঠাসাঠাসি হবে। তবে চালিয়ে নেয়া যাবে। হুজুরের কাছে কি নতুন ভুতবার্তা এসেছে?
-হু। তবে তোদের জন্যে না। আমার কিছু আধুনিক ভক্ত আছে। তারা টিয়া পাখি ময়না পাখি লইট্ট্যা ফিশ সবই খায়।তাদের জন্যে বিশেষ বার্তা। সেইখানে বসে পরামর্শ হবে। তুই চোখ কান খোলা রাখবি। কেউ যেন না জানে। পুলিশ খুব তৎপর।
-পুলিশ! হাইয়ের চোখ ছানাবড়া। ‘দুই পয়সার পুলিশ। টাকা ছাড়লেই ঠাণ্ডা। আমার আড়তের ফরমালিন পুলিশের নাকের ডগা দিয়া আসে!’
– একাত্তরে প্রথম প্রতিরোধ তৈরী করেছিল পুলিশ। টাকা পয়সা তো দুরের কথা জীবনের মায়া পর্যন্ত করেনি এই পুলিশের দল। এই সব শয়তান গুলার মধ্যে কেন যে এত দেশপ্রেম!
-দেশপ্রেম কি নিষিদ্ধ, হুজুর?
-অবশ্যই। প্রেম শুধু ভুতেশ্বেরের জন্যে। অন্য সব প্রেম গভীর পাপ।
হাইকে মিটিঙের পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। সেখানে থাকবে প্রকৌশলী, বুদ্ধিজীবী, রসায়নবিদ, বোমা এক্সপার্ট। নিখুত প্ল্যান হবে। একরাতে উড়িয়ে দেয়া হবে শাহবাগ, টি এস সি, শহীদ মিনার। পাশাপাশি ভুত মন্দিরও ভাঙ্গা হবে। ব্যলাঞ্চিং। ফাকিস্তান থেকে সব সরঞ্জাম এসে গেছে।
সব কিছু ঠিকঠাক করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। মোবাইল দিয়ে অন্তর্জালে ঢুকলাম। মুখোপাতায় দেখলাম আমার চন্দ্রারোহনের ছবি বেড়িয়েছে। আমার শিষ্যরা তেলেসমাতিতে বিশ্বসেরা। নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। ভুতরাজ্য প্রতিষ্ঠা আর বেশী দেরী নেই।
মধুমালার কথা মনে পড়তেই বুকের ভিতরটা নাড়া দিয়ে উঠল। প্রলয় ঘটার আগেই তাকে সেখান থেকে বের করে আনতে হবে। হোক সে বিধর্মী। সে আমার মধুমালা। আমার মধু।
তাকে ফেরাতে হবে। কিন্তু সে তো কথা শুনছে না। তাকে কথা শোনাতে হবে। ভুতেশ্বর নারীর উপর পুরুষের প্রধান্য দিয়েছেন। নারীর এমন অবাধ চলাচল খুবই অধর্ম। আর থাকা যায় না।
পুবালী ব্যাংকের গেটের সামনে তাকে পেলাম। রোদে পুড়ে মানুষের মুখ এমন তামাটে হয়! তার মুখের পেশী শক্ত। চোখে আগুন। তার কণ্ঠ ধীর, কিন্ত দৃঢ়। তার কপালে জ্বলজ্বল করছে বঙ্গোপসাগরের নোনা জল।
বললামঃ মধুমালা!
-উঁহু, আমি রাজীব হায়দার। আমি লাকী আখতার। আমি আসাদ। আমি সালাম বরকত রফিক জব্বার।
-আমি তোমাকে এখানে থাকতে দেব না। এখানে যে নতুন প্রজন্মের জোয়ার উঠেছে, যে তারুন্যে কেঁপে উঠছে বাংলাদেশ, কাঁপছে নতুন বিশ্ব, ভুতেশ্বর তার আগমনী মানতে পারছে না। ভুতেশ্বর অন্তিম ঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে শাহবাগ। মধুমালা, তুমি চল আমার সঙ্গে।
খানিক সময় সে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। মনে হল আমার কথা সে কিছুই বোঝেনি। তারপর বিড়বিড় করে বলল- আর পিছানোর কোন উপায় নেই।
-বোঝার চেষ্টা কর। এখানে আসলে কেউই নিরাপদ না। ভুতেশ্বর এত সহজে দমবার পাত্র না। তার সেপাই সান্ত্রী ছড়িয়ে আছে চারদিকে। তাদের আছে ব্যাংক। আর ব্যাংক ভর্তি টাকা। তাদের আছে অস্ত্র আর গোলাবারুদ। আর আছে বিশাল ব্রহ্মাস্ত্র। ভুতানুভুতি। এই অনুভূতি অতি মারাত্মক। একবার তা ছড়িয়ে দিলেই ফেটে পড়বে অসংখ্য মানুষ। দিকে দিকে জ্বলবে গোলাবারুদ। তোমরা কেউ বাঁচবে না মধু। তোমাদের ছিঁড়ে ফুঁরে খাবে অজস্র হায়না। তুমি ফেরে এস মধু।
আমাকে ছেড়ে দাও মদন। আমি চললাম। সে ফিরে গেল তার সাথীদের কাছে। সেখানে উত্তাল শ্লোগানে অজস্র মোমের সোনালী আলো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ধাবমান আধারকে।
ধার্মিকের সুখ, ধার্মিকতার সুখানুভূতি
লিখেছেন মুরশেদ
ধার্মিকেরা
সর্বদাই দাবী করে ধর্মচারন করে সুখ পাওয়া যায়। ইবাদত
বন্দেগী কিম্বা পূজা অর্চনা করার পরে মনে নাকি এক ধরনের ঐশী
প্রশান্তি অনুভূত হয়। তা
অপার্থিব। সে অনুভুতি
প্রকাশ যোগ্য নয়। অধার্মিকেরা কিম্বা নাস্তিকেরা তার মর্ম কখনই বুঝবে না।খুবই গুরুত্বপূর্ণ দাবী। ঈশ্বর তার ভক্তবৃন্দের জন্য স্বর্গ থেকে সুখ পাঠিয়ে দেন। সেই সুখে বিশ্বাসীগণ ভড়ে ওঠেন কানায় কানায়। আর অবিশ্বাসীগণ কেবল অশান্তিতে ডুবে দাপাদাপি করে মরে। অবিশ্বাসীগণের জন্য দুঃখ হয়।
খুব জানতে ইচ্ছে করে স্বর্গ থেকে কে সেই সুখ পাঠান? আল্লা, ভববান, গড, জেহোভা নাকি অন্য কেউ? নাকি সবাই। যার যার ভক্তের কাছে সেই সেই ঈশ্বর সুখ নাজেল করেন? তবে কী সব ঈশ্বরই স্বর্গ ভঁরে রয়েছেন? তারা তাদের ভক্তের নানাবিধ বিচিত্র রীতি-পদ্ধতির প্রার্থনা শোনেন আর বিনিময়ে তাদেরকে সুখী করেন? কেননা সব ধর্মের সব ধার্মিকেরাই তো সেই অত্যাশ্চার্য সুখ ভোগ করেন বলে দাবী করে চলেছেন।
প্রার্থনার সেই সুখ দেখবার জন্য ছেলেবালা থেকেই উবুর হয়েছি হাজার বার। প্রহরে প্রহরে। দিনে রাতে। সপ্তায় সপ্তায়। আর সব পুন্য রজনীতে। আমি পাইনি। আমার উবুর হওয়াটা হয়তো ঈশ্বর গ্রহন করেননি। আমি হতভাগা। কিন্তু ভাগ্যবান কে?
আমার শাশুড়ি? দিনে রাতে কত ওক্ত উনি নামাজ পরেন, মনে হয় ঈশ্বরও মনে রাখতে পারবে না। জায়নামাজ তার বিছানোই থাকে। নানাবিধ শারীরিক সমাস্য ভুগছেন। ডাক্তার তাকে রাতে ঘুমুতে বলেছেন। কিন্তু তিনি তো ঘুমনোর বান্দা না। তিনি রাতের পর রাত জেগে ঈশ্বরকে খুশী করে চলেছেন।
কিন্তু আল্লাপাক তাকে খুশী করছেন বলে মনে হয় না। তিনি একজন অসুখী মানুষ। তার দুঃখের শেষ নেই। সংসারে কে কখন একবেলা উবুর হতে ভুলে গেছে – তো তিনি অসুখী হন। তিনি অশান্তিতে থাকেন বউঝিরা স্টার প্লাসে নাটক দেখলে। নাটকে পুজো দেখায়। পুজো দেখা হারাম। পিস টিভি কেউ দেখে না বলে তার দুঃখের শেষ নেই।
তিনি সর্বাপেক্ষা অসুখী থাকেন রমজান মাসে। প্রতিদিনই বাড়ীর বউয়ের সাথে তর্ক হয়। তর্কটা দুপুর গড়ালে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তবে ইফতারটা শান্তিপূর্ণ। দানাপানি পেটে ঢুকলে পরে আল্লাপাক একটু একটু করে প্রশান্তি পাঠাতে থাকেন।
হেকমত উল্লা। ছেলেবেলায় দেখা মহল্লার সবচাইতে প্রভাবশালী অসুখী মানুষ। মহল্লার কোন বেগানা নারী কবে বুরখা ছাড়া ঘর থেকে বের হয়েছে তিনি তার খোজ রাখতেন। কবে কে সিনেমা দেখতে গেছে, কার ছেলে সারাদিন সাইকেল চালিয়ে বেড়ায়, নামাজকালাম নেই, কোথায় যাত্রার আসর বসেছে- সবই তার দুশ্চিন্তার কারন। তিনি সর্বদা অসুখী থাকতেন- কেননা দেশময় মানুষেরা হাসে, খেলে, মেয়েরা দাপাদাপি করে ছুটে বেড়ায়। যুবকেরা জিকির ফিকির করার চাইতে বাংলা কিম্বা হিন্দি গানের কলি আওরাতেই বেশী উৎসাহী। মহিলারা পোলাপান হতেও হাসপাতালে যায়! সবই নাসারাদের ষড়যন্ত্র!
এলাকায় টেলিভিশন এলো। আরেক গজব। পাড়ার ছেলেরা সেখানে টিভি দেখে। মহিলারাও দলবেঁধে সেখানে যায়। মহিলাদের নানারকম হাঁসিতে শব্দে আল্লার আরশ কেঁপে ওঠে। হেকমত উল্লা কাউকেই আর বেধে রাখতে পারেন না। এমনকি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকেও না! ( উল্লেখ্য তাঁর প্রথম স্ত্রী কোন এক মাঝ রাতে কুয়োয় পরে মারা গেছিল। মাঝরাতে কেন তিনি জল তুলতে গেছিলেন, এই প্রশ্নের কোন সুরাহা না হলেও তিনি অতি দ্রুত তার শালিকাকে বিয়ে করে পরিস্থিতি সামাল দেন)। তার এই বিবি তাকে সুখ না দিলেও, হেকমত উল্লা গোটা এলাকার মানুষকে তাঁর শাসনের মুখে রাখলেও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে কখনই কোন ব্যপারে ঘাটাননি !
আমার ধার্মিক স্বজনদের বেশ আত্ন তৃপ্তি পেতে দেখেছি, যখন কোন হিন্দু আমাদের বাসায় গোপনে গরুর গোস্ত বেশ মৌজ করে খেত। হিন্দুকে গরু খাওয়াতে পারলে মনে হয় ইসলামের বিজয়ানুভুতি জাগ্রত হয়। তারা হিন্দুর গোমাংস ভক্ষন দেখে সুখ পেত। কিন্তু আমি দুঃখ পেতাম। গরু খাওয়া হিন্দুদের হিংসে হত। তারা স্বাধীন হয়েছে। আমি কবে স্বাধীন হব? কবে শুকুর খাব, কচ্ছপ খাব, মদ্যপান করব!
অবশ্য হিন্দুরাও কম যায় না। কয়েকমাস আগের কথা। আমার অফিসে (ব্যাংকে) এক হিন্দু মহিলার সাথে কথা হচ্ছিল। পেশায় তিনি একজন ডাক্তার। আলোচনার বিষয় হজরত মুহাম্মদ। তিনি আমাকে খুশী করার জন্যে বললেন- দেখুন মুহাম্মদের মত শান্তিকামী মানুষ জগতে কয়জন আছে? তিনারা সারাজীবন জগতে কেবল শান্তি্র বানীই দিয়ে গেছেন! অহিংসার কথা বলেছেন!
আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেমন শান্তি? তিনি মক্কা থেকে মদিনায় গিয়ে একটা দল গঠন করলেন। তাদের পেশা কী ছিল? কৃষিকাজ নাকি ব্যবসা বনিজ্য? কিছুই না। সেটা ছিল মুলত একটা লুটেরার দল। মদিনা আর আশপাশের অঞ্চলে অভিযান চালনোই ছিল তাদের পেশা। লুটের মালামালের নামই গণিমত। তারা রাশি রাশি গণিমত লাভ করতেন। তার মধ্যে অর্থ, সম্পদ, কৃষিজমি, নারী সবই ছিল। এই গণিমত ভাগবাটোয়ারা করার জন্যে দরকার কিছু নিয়ম কানুন। এই নিয়ম কানুনের নামই শরীয়ত।
মহিলা বেশ খুশী হলেন। কিন্তু ধরা দিলেন না। মাথা নীচু করে বললেন- কী যে বলেন ভাই!
কদিন পরে তিনি তার স্বামী সহ এসে একাউন্ট খুললেন। তাদের আশ্রমের একাউন্টাও খোলা হল। তিনি এখন তার বন্ধু বান্ধবদের বলে বেড়ান- ম্যনেজার সাহের অতি অমায়িক মানুষ! অতি প্রগতিশীল!
ভগবানের কৃপায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাল ডিপোজিট পাচ্ছি।
তবে ধার্মিকের মত সুখ পেতে এখন আর ইচ্ছে করে না।