Saturday, August 6, 2016

ইসলামে বর্বরতা দাসত্ব-অধ্যায়—১,২,৩,৪,৫

ইসলামে বর্বরতা (দাসত্ব-অধ্যায়—১)

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ১
[রচনাটি লেখক এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের প্রথম অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো। এ পর্বে আলোচিত হয়েছেঃ ১) সূচনা, ২) দাসপ্রথাকে কোরানের অনুমোদন, ৩) নবির চর্চাকৃত দাসপ্রথার আদর্শ।]
লেখক এম, এ, খান
‘আল্লাহ দুই ব্যক্তির মাঝে আরেকটি কাহিনীর অবতারণা করেছেন: তাদের একজন ক্ষমতাহীন ও বোবা, যে তার প্রভুর উপর এক ক্লান্তিকর বোঝা; যেভাবেই তাকে চালনা করা হোক না কেনো, সে কোনোই কাজে আসে না: এরূপ মানুষ কি তার মতোই, যিনি ন্যায়বান ও সঠিক পথের অনুসারী?’ — (আল্লাহ, কোরান ১৬:৭৬)
‘(আল্লাহ) যেসব গ্রন্থভুক্ত লোককে ধরে এনেছেন…. এবং তাদের অন্তরে আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তার কিছু (সাবালক পুরুষ) লোককে তোমরা হত্যা করেছো, কিছুকে (নারী ও শিশু) করেছো বন্দি।’ — (আল্লাহ, কোরান ৩৩:২৬-২৭)
‘কোরানে লেখা রয়েছে যে, মুসলিমদের কর্তৃত্ব অস্বীকারকারী সকল জাতিই পাপী; এ রকম লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ও যুদ্ধে বন্দিদেরকে কৃতদাস বানানো মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার ও দায়িত্ব। এবং এরূপ যুদ্ধে নিহত প্রত্যেক মুসলমানই নিশ্চিত স্বর্গে প্রবেশ করবে।’ — (কী অধিকারে বার্বার মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আমেরিকার নাবিকদেরকে ক্রীতদাস বানাচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তরে টমাস জেফারসন ও জন অ্যাডামস্কে বলেন লন্ডনস্থ ত্রিপোলির রাষ্ট্রদূত আবদ আল-রহমান, ১৭৮৬।)
সূচনা
ক্রীতদাসত্ব হলো একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যাতে ক্রীতদাস নামে কিছু মানুষ প্রভু বা মালিক হিসেবে পরিচিত অপর মানুষের সম্পদে পরিণত হয়। নিজস্ব স্বাধীনতা ও ইচ্ছা বিবর্জিত ক্রীতদাসরা তাদের মালিকের সুবিধা, আরাম-আয়েশ ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অনুগত থেকে নিরলস কাজ করতে বাধ্য। সকল মানবাধিকার বঞ্চিত ক্রীতদাসরা তাদের প্রভুদের শর্তহীন সম্পত্তি। তারা মালিকের অস্থাবর সম্পত্তি মাত্র; তাদের মালিককে ছেড়ে চলে যাবার কোনো অধিকার নেই, কাজ করতে অস্বীকার করার উপায় নেই, নেই শ্রমের জন্য পারিশ্রমিক দাবির অধিকার। সমাজে ক্রীতদাসদের অবস্থান অনেকটা গৃহপালিত পশুর মতো: গরু, ঘোড়া ও অন্যান্য ভারবাহী পশুগুলোকে অর্থনৈতিক সুবিধা, যেমন গাড়ি-টানা ও হালচাষের জন্য যেরূপ কাজে লাগানো হয়, ক্রীতদাসদেরকেও তেমনিভাবে তাদের প্রভুদের লাভ, আরাম-আয়েশ ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজে লাগানো হয়। দাস-ব্যবসা অন্যান্য বাণিজ্যিক লেনদেনের মতোই ক্রীতদাসকৃত মানুষকে পণ্যরূপে বেচাকেনার একটা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বা রীতি। সংক্ষেপে: ক্রীতদাসত্ব হলো সবল কর্তৃক দুর্বলকে শোষণের একটি প্রথা, যার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
ইউরোপীয় শক্তি কর্তৃক আটলান্টিকের পারাপারের দাস-ব্যবসা এবং আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্রীতদাসদের অমানবিক শোষণ ও তাদের উপর অমর্যাদাকর আচরণের জন্য পশ্চিমারা সবার দ্বারাই বড় সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, বিশেষত মুসলিমদের দ্বারা। মুসলিমরা কথায় কথায় ইউরোপীয় দাস-ব্যবসার দিকে আঙ্গুল তোলে। তারা ঘন ঘন দাবি করে যে, ক্রীতদাসদেরকে শোষণ করেই আমেরিকার মতো দেশগুলো বিপুল সম্পদ-ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিল, যা আজ তারা ভোগ করে চলছে। আমেরিকায় জন্ম হওয়া এক তরুণ মুসলিম লিখেছে:
‘জানেন কি, কীভাবে আমেরিকার দাস-শিকারিরা আফ্রিকায় গিয়ে কালো মানুষগুলোকে ধরে ক্রীতদাসরূপে আমেরিকায় নিয়ে আসে? আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তি ওসব ক্রীতদাসদের শ্রমের কাছে ব্যাপকভাবে ঋণী’ (ব্যক্তিগত যোগাযোগ)।
আটলান্টিক পারাপারের ৩৫০ বছরের দাস-বাণিজ্যকে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ও নিষ্ঠুরতম ক্রীতদাস ব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করে আমেরিকার ‘নেশন অব ইসলাম’-এর মিনিস্টার লুইস ফারাহ খান দাবি করেন:
‘অনেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান জানে না যে, অতীতে আমাদের (কৃষ্ণাঙ্গ) উপর যা কিছু ঘটানো হয়েছিল, তার উপর ভিত্তি করেই আজ তারা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।’[১]
অধিকাংশ মুসলিম ভাবে যে, ইসলামের ইতিহাসে ক্রীতদাসত্বের কোনো চিহ্নই ছিল না। ইসলামে ধর্মান্তরিত এক অস্ট্রেলীয় আদিবাসী রকি ডেভিস বা শহীদ মালিক এ. বি. সি. রেডিও’কে বলেন:
‘ইসলাম নয়, খ্রিষ্টান ধর্মই ক্রীতদাসত্বের প্রতিষ্ঠাতা।’[২]
ভারতীয় মুসলিমরা যখন এ উপমহাদেশে প্রচলিত দাসপ্রথা সম্পর্কে আলোচনা করে, তারা কেবলই কীভাবে পর্তুগিজরা গোয়া, কেরালা ও বাংলার সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চল থেকে ভয়াবহ অবস্থায় দাস পরিবহন করতো সেসব লোমহর্ষক কাহিনীর কথা বলে। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তানের ইতিহাস বইয়ে শেখানো হয়: ইসলামের আগে ছিল দাসপ্রথা ও শোষণ, যা ইসলাম আসার সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যায়। তারা ভারতে মুসলিম হানাদার ও শাসক কর্তৃক ব্যাপকভাবে দাসপ্রথাচর্চার কথা কখনোই বলবে না।
ইসলামি শাসনের অধীনে ব্যাপকভাবে চর্চাকৃত দাসপ্রথা (যেমন ভারতে) সম্পর্কে মুসলিমদের এ নীরবতা সম্ভবত তাদের ঐতিহাসিক সত্য সম্বন্ধে অজ্ঞতার ফলশ্রুতি। ভারতের আধুনিক ইতিহাস লেখায় মুসলিম আক্রমণ ও শাসনকালে সংঘটিত নিষ্ঠুরতাকে ব্যাপকভাবে ঢাকা দেওয়া হয়। ইসলামের ইতিহাসের সঠিক চিত্রটির এরূপ বিকৃতিকরণ মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত ব্যাপক ক্রীতদাসত্ব ও দাস-ব্যবসা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতাকে জোরদার করে ও ভুল ধারণা সৃষ্টি করে। এ পুস্তকের আগাগোড়া বর্ণনায়, দুঃখজনকভাবে হলেও ইসলামের কর্তৃত্বের গোটা ইতিহাসে সর্বত্রই যে দাসপ্রথা একটা বিশিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল তা দেখানো হয়েছে। এর কিছু অনন্য বা বিশেষ বৈশিষ্ট্যও ছিল, যেমন ব্যাপকহারে উপপত্নীকরণ, খোজাকরণ ও ‘গিলমান’ চর্চা (নিচে বর্ণিত)।
দাসপ্রথাকে কোরানের অনুমোদন
দাসপ্রথাকে ইসলামে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে নিম্নোক্ত কোরানের আয়াতটি, যার মাধ্যমে আল্লাহ ন্যায়বান ও সত্যপন্থী মুক্ত মানুষ বা প্রভুদেরকে বোবা, অকেজো ও বোঝাস্বরূপ ক্রীতদাসদের থেকে পৃথক করেছেন:
‘আল্লাহ দুই ব্যক্তির মাঝে আরেকটি কাহিনীর অবতারণা করেছেন: তাদের একজন ক্ষমতাহীন ও বোবা, যে তার প্রভুর উপর এক ক্লান্তিকর বোঝা; যেভাবেই তাকে চালনা করা হোক না কেনো, সে কোনোই কাজে আসে না: এরূপ মানুষ কি তার মতোই, যিনি ন্যায়বান ও সঠিক পথের অনুসারী? (কোরান ১৬:৭৬)
আল্লাহ ক্রীতদাসদেরকে মর্যাদায় সমঅংশীদার ও তাদের সম্পদের ভাগীদার করে নেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বাসীদের সতর্ক করে দেন, পাছে অন্যদের মত ক্রীতদাসদেরকেও একইভাবে ভয় করতে হয়:
তোমরা কি তোমাদের দক্ষিণ হস্তের মালিকানাধীন লোকদেরকে (অর্থাৎ ক্রীতদাস বা বন্দি) আমাদের প্রদত্ত সম্পদের সমঅংশীদারী করবে? তোমরা কি তাদেরকেও সেরূপ ভয় করবে, যেমন ভয় করো পরস্পরকে? (কোরান ৩০:২৮)
এ আয়াতটির ব্যাখ্যায় মওলানা আবুল আলা মওদুদি ক্রীতদাসদেরকে সম্মান ও ধনসম্পদে সমান গণ্য করাকে ইসলামে সবচেয়ে ঘৃণ্য শিরক বা অংশীদারিত্বের মতো কাজ বলে মনে করেন।[৩] অন্যত্র আল্লাহ স্বয়ং তার স্বর্গীয় পরিকল্পনার অংশরূপেই কম আনুকূল্যপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের চেয়ে কিছু মানুষকে, অর্থাৎ প্রভু বা দাসমালিকদেরকে, বেশি আশীর্বাদপুষ্ট করেছেন বলে দাবি করেন। তিনি মুসলিমদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যাতে তারা ক্রীতদাসদেরকে তাঁর দেওয়া উপহার বা প্রতিদানে সমান অংশীদার না করে। যারা ক্রীতদাসদেরকে নিজেদের সমান মর্যাদার ভাববে, আল্লাহ তাদেরকে সাবধান করে দেন এটা বলে যে, সেরকম ভাবলে আল্লাহকে অস্বীকার করা হবে:
জীবনধারনের নিমিত্তে আল্লাহ তোমাদের কারো কারো উপর অন্যদের তুলনায় অধিক মুক্তহস্তে তাঁর উপহার বা প্রতিদান বর্ষণ করেছেন। অধিক আনুকূল্যপ্রাপ্তরা তাদেরকে দেওয়া সে উপহার তাদের দক্ষিণ হস্তে ধারণকৃতদের (দাসদের) উপর বর্ষণ করবেনা, যাতে তারা এক্ষেত্রে সমপর্যায়ের হতে পারে। তারা কি আল্লাহর আনুকূল্য অস্বীকার করবে? (কোরান ১৬:৭১)
আল্লাহ শুধু দাসপ্রথাকে অনুমোদনই দেননি, তিনি নারী-দাস বা দাসীদেরকে যৌনসম্ভোগ হিসেবে ব্যবহারের জন্য দাস-মালিকদেরকে স্বর্গীয়ভাবে আশীর্বাদপুষ্টও করেছেন (মুসলিম পুরুষরাই কেবল দাস-মালিক হতে পারে):
তারা তাদের গোপনাঙ্গকে রক্ষা করবে, তবে তাদের স্ত্রীদের ও দক্ষিণ হস্তের মালিকানাধীনদের (ক্রীতদাসীদের) বাদ দিয়ে−এদের সাথে (যৌন-সহবাসে) দোষের কিছু নেই। (কোরান ২৩:৫-৬)
সুতরাং বন্দি ও ক্রীতদাসদের মধ্যে নারীরা থাকলে মুসলিম পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে যেরূপে যৌনক্রিয়া করে, তাদেরকেও সেরূপে ভোগ করার স্বর্গীয়ভাবে অনুমোদিত অধিকার পেয়েছে। আল্লাহর এ রায় ইসলামে যৌনদাসীত্ব বা উপপত্নী প্রথা প্রতিষ্ঠা করে, যা উপনিবেশ-পূর্ব মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক রূপ লাভ করেছিল এবং বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যদিও বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের জন্য একই সময়ে চারজন স্ত্রী রাখার বিধান রয়েছে (কোরান ৪:৩), কিন্তু যৌনদাসী রাখার বেলায় সংখ্যাগত এরূপ কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।
আল্লাহ মুসলিমদেরকে যৌনকর্মে ব্যবহারের জন্য অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নারী ক্রীতদাস সংগ্রহের স্বর্গীয় অনুমোদনও দিয়েছেন এভাবে:
হে নবি! অবশ্যই আমরা তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের বৈধ করেছি, যাদেরকে তোমরা যৌতুক প্রদান করেছো। এবং যাদেরকে তোমাদের দক্ষিণ হস্ত দখল করে রেখেছে, তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ যাদেরকে যুদ্ধবন্দিরূপে তোমাদেরকে প্রদান করেছেন। (কোরান ৩৩:৫০)
মুসলিমরা আটককৃত ক্রীতদাস নারীদের সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে পারে, যদি তারা বিবাহিতও হয়; কিন্তু কোনো বিবাহিত মুক্ত মুসলিম নারীর সঙ্গে নয়:
তোমাদের দক্ষিণ হস্তের মালিকানাধীন নারীরা ব্যতীত যারা ইতিমধ্যে বিবাহিতা, তারা অবশ্যই নিষিদ্ধ… (কোরান ৪:২৪)
কোরানে আরো অনেক আয়াত রয়েছে যাতে ক্রীতদাসের কথা বলা হয়েছে এবং তাদেরকে যুদ্ধের মাধ্যমে আটক বা সংগ্রহ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরূপে পবিত্র কোরানে উপস্থাপিত ইসলামি ঈশ্বরের স্বর্গীয় আদেশ অনুযায়ী মুসলিমরা ক্রীতদাস রাখার অনুমোদন প্রাপ্ত। যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তারা ক্রীতদাস যোগাড় করতে পারে, ক্রীতদাসীদের সঙ্গে যৌন-সংসর্গে লিপ্ত হতে পারে ও অবশ্যই তাদেরকে নিজেদের খুশি মতো কাজে লাগাতে পারে। মুসলিমদের জন্য নারী ক্রীতদাসদের সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া তাদের বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে যৌনকর্মের মতই বৈধ। প্রকৃতপক্ষে দাসপ্রথা ইসলামে অতি আকাক্সিক্ষত একটি স্বর্গীয় প্রথা, কেননা আল্লাহ বহু আয়াতে বারংবার এ ‘স্বর্গীয় অধিকার’ সম্পর্কে মুসলিমদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
নবির চর্চাকৃত দাসপ্রথার আদর্শ
দাসপ্রথায় লিপ্ত হতে মুসলিমদেরকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দিতে আল্লাহ শুধু প্রাণান্তই হননি, কীভাবে অবিশ্বাসীদেরকে দাস করতে হবে সে ব্যাপারে নবি মুহাম্মদকে পরিচালনারও উদ্যোগ নিয়েছেন। যেমন নিচের আয়াতে আল্লাহ বলেন:
এবং তিনি (আল্লাহ) ধর্মগ্রন্থের সেসব লোকদেরকে (বানু কোরাইজা ইহুদি) বের করে এনেছেন, যারা তাদের ঘাঁটিতে বসে থেকে তাদেরকে (কোরাইশ) সহায়তা করেছিল, এবং আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রাণে। (তাদের) কিছু সংখ্যককে (বয়স্ক পুরুষ) তোমরা বধ করেছো, কিছু সংখ্যককে (নারী ও শিশু) করেছো বন্দি… (কোরান ৩৩:২৬-২৭)
এ আয়াতটিতে আল্লাহ বানু কোরাইজা ইহুদিদেরকে নিজস্ব বস্তির মধ্যে বসে থেকেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে মক্কার কোরাইশদেরকে সমর্থন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। এ অবান্তর অভিযোগের ভিত্তিতে আল্লাহ অনুমোদন দেন: ইহুদি গোত্রটির বয়স্ক পুরুষদেরকে হত্যা করতে হবে এবং অবশিষ্ট নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস বানাতে হবে। নবি যথাযথরূপে সে আদেশ পালন করেন এবং তাঁর অনুসারীদের মাঝে ক্রীতদাসকৃত নারী ও শিশুদেরকে বিতরণ করে দেন ও এক-পঞ্চমাংশ নিজের ভাগ হিসেবে রাখেন। বন্দি নারীদের মধ্যে যারা তরুণী ও সুন্দরী তাদেরকে যৌনদাসী করা হয়। নবি নিজে যৌনদাসী হিসেবে ১৭-বছর-বয়স্কা সুন্দরী রায়হানাকে গ্রহণ করেন, যার স্বামী ও পরিবারের সদস্যরা সে হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছিল, এবং সে রাতেই তিনি তাকে বিছানায় নেন যৌন-সহবাসে লিপ্ত হতে।[৪]
ঐ বছরই খাইবার ও বানু মুস্তালিকের ইহুদিদেরকে আক্রমণ ও পরাজিত করার পর মুহাম্মদ তাদের নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাসরূপে উঠিয়ে নিয়ে যান। অন্যান্য অনেক আক্রমণে নবি ও তাঁর অনুসারীরা পরাজিতদের নারী ও শিশুদেরকে একইভাবে ক্রীতদাসরূপে কব্জা করেছিল। সুতরাং অবিশ্বাসীদের উপর নিষ্ঠুর আক্রমণ চালিয়ে পরাজিত করার পর তাদের নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাসকরণ মুহাম্মদের যুদ্ধের মডেল বা আদর্শ কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়, যা উপরোক্ত আল্লাহর নির্দেশের বাস্তবায়ন মাত্র। নবি কিছু ক্রীতদাসকে বিক্রি করেছিলেন এবং তাদের কিছু সংখ্যককে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করতেন। নারী বন্দিদের মধ্যে সুন্দরী যুবতীরা যৌনদাসী হতো।
ইসলামি চিন্তা-চেতনায় খাঁটি মুসলিম জীবনের কেন্দ্রীয় বিষয় যেহেতু তাদের কর্ম ও কৃতিত্বে মুহাম্মদের সমকক্ষ হওয়ার প্রয়াস, সে কারণে মুসলিমরা যথার্থরূপেই তাঁর দাসপ্রথা চর্চার এ মডেলকে (ক্রীতদাসকরণ, দাস-বাণিজ্য ও দাস-উপপত্নীকরণ) আঁকড়ে ধরে থেকেছে; এবং এ প্রক্রিয়া পরবর্তী শতাব্দীগুলোত ইসলামিক শাসনাধীনে চিরন্তনরূপে বহাল থাকে। খাইবার বা বানু কুরাইজার সঙ্গে যুদ্ধে মুহাম্মদের আচরণ ক্রীতদাস আটককরণের মানদণ্ডে পরিণত হয়। এবং সেটাই মধ্যযুগের ইসলামি রাজত্বে ক্রীতদাসকরণ, যৌনদাসীত্ব ও দাস-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের জন্য দায়ী। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর মুসলিমরা কোরান ও সুন্নতের অনুমোদন-অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ইসলামের প্রসার ও শাসন সম্প্রসারণে বিশ্বজয়ের নিমিত্তে পবিত্র ধর্মযুদ্ধের এক লাগামহীন কর্মকাণ্ড শুরু করে। আরবাঞ্চলে ইসলামের বিস্ফোরণ ঘটার সাথে সাথে মুসলিম হানাদাররা পরাজিত অবিশ্বাসীদের নারী ও শিশুদেরকে ব্যাপক সংখ্যায় ক্রীতদাসরূপে আটক করণে দক্ষ হয়ে উঠে।
ইসলামি চিন্তাধারায় (ইতিমধ্যেই উল্লেখিত) ইসলাম-অতীত ও ইসলাম-বহির্ভূত সভ্যতা হলো ‘জাহিলিয়া’ বা ভ্রান্ত প্রকৃতির, যা ইসলামের আগমনে অকার্যকর ও বাতিল হয়ে গেছে। ইসলাম একমাত্র সত্যধর্ম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কেবলমাত্র মুসলিমরাই প্রকৃত সত্যের অধিকারী। তাদের চিন্তায়, বার্নার্ড লুইস উল্লেখ করেছেন,
‘ইসলামের সীমানা ও ধর্মের বাইরের জগতে কেবল বিধর্মী ও বর্বররাই বসবাস করতো। তাদের কেউ কেউ কোনো প্রকারের ধর্ম ও সভ্যতার একটি আভার অধিকারী ছিল; অবশিষ্ট বহু-ঈশ্বরবাদী ও পৌত্তলিকদেরকে প্রধানত ক্রীতদাসের উৎসরূপে দেখা হয়।’[৫]
মুসলিমরা এত বেশি পরিমাণে মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়েছে যে, দাস-ব্যবসা একটা বিস্ফোরিত ব্যবসায়িক উদ্যোগে পরিণত হয়: মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বাজারগুলো দাসে ভরে উঠে। সুতরাং, লিখেছেন অধ্যাপক লাল:
‘ব্যাপকহারে দাস-বাণিজ্যের সৃষ্টি ও মুনাফার উদ্দেশ্যে অন্যান্য ব্যবসার মতো দাস-ব্যবসা চালিত করার কৃতিত্ব ইসলামেরই।’[৬]
[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ প্রাচীন বিশ্বে দাসপ্রথার চর্চা]
সুত্রঃ
1. Farra khan L, What does America and Europe Owe? Final Call, 2 June 2008
2. ABC Radio, Aboriginal Da’wah- “Call to Islam”, 22 March 2006; http://www.abc.net.au/rn/talks/8.30/relrpt/stories/s1597410.htm
3. Famous scholar Abu Ala Maududi in his interpretation of this verse notes: “When you do not make your own slaves partners in your wealth, how do you think and believe that Allah will make His creatures partner in His Godhead?” (Maududi AA, Towards Understanding the Quran, Markazi Muktaba Islami Publishers, New Delhi, Vol. VIII). In other words, associating partners with Allah, which is the most abhorrent thing to do in Islam, is tantamount for a man to take his slaves as equal partner.
4. Ibn Ishaq, The Life of Muhammad, Oxford University Press, Karachi, p. 461-70
5. Lewis B (1966), The Arabs in History, Oxford University Press, New York p. 42
6. Lal K S (1994), Muslim Slave System in Medieval India, Aditya Prakashan, New Delhi, p. 6
—-


ইসলামে বর্বরতা (দাসত্ব-অধ্যায়—২)

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো। এ পর্বে আলোচিত হয়েছে:]
ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ২
লেখক: এম, এ, খান
প্রাচীন বিশ্বে দাসপ্রথা
ইসলাম দাসপ্রথার প্রবর্তক নয়; তাতে শুধু ইসলামের একচেটিয়া কর্তৃত্বও ছিল না। খুব সম্ভবত সেই আদিম বর্বরতার যুগে দাসপ্রথার উৎপত্তি হয়েছিল এবং তা লিখিত ইতিহাসের পুরোটা ব্যাপী বিশ্বের প্রধান প্রধান সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। দাসপ্রথা ব্যাবিলোনিয়া এবং মেসোপটেমিয়াতেও প্রচলিত ছিল। খ্রিষ্টান ধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে প্রাচীন মিশর, গ্রিস ও রোমেও দাসপ্রথা বিশেষ লক্ষ্যণীয় ছিল। খ্রিষ্টান ধর্মগ্রন্থে দাসপ্রথা অনুমোদিত ও মধ্যযুগের খ্রিষ্টানজগতে দাসপ্রথা চালু ছিল।
প্রাচীন মিশরে:
প্রাচীন মিশরে পিরামিড নির্মাণে ক্রীতদাসরা শ্রমিকের কাজ করেছে। বিখ্যাত গ্রিক পরিব্রাজক হেরোডটাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪-৪২৫ সাল) জানান: গিজার বিখ্যাত পিরামিডটি নির্মাণে প্রায় ১০০,০০০ শ্রমিক ২০ বছর ধরে কাজ করেছিল; মিশরের প্রাচীন সাম্রাজ্যের চিওপ্স নামক ফারাও (শাসনকাল খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৮৯-২৫৬৬ সাল) এটি নির্মাণ করেছিলেন, যা ছিল বিশ্বের প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্যের একটি।[৭] কিংবদন্তির কাহিনী থেকে শোনা এ সংখ্যা স্পষ্টতঃই ছিল অতিরঞ্জিত; তথাপি এ তথ্যটি প্রমাণ করে যে, তৎকালে এরূপ কাজে ব্যাপক সংখ্যায় ক্রীতদাস ব্যবহৃত হতো। মিশরের ফারাওরা যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রীতদাস সংগ্রহ করতেন অথবা বিদেশ থেকে তাদেরকে ক্রয় করতেন। সেসব ক্রীতদাস ছিল রাষ্ট্রের সম্পদ, ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে তাদেরকে উপহার হিসেবে সেনানায়ক বা যাজকদেরকে দেওয়া হতো।
প্রাচীন গ্রিসে:
গ্রিসের প্রাচীন নগররাষ্ট্রে, যেমন এথেন্স ও স্পার্টায়, দাসপ্রথা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। স্বাধীন নাগরিক এবং বিদেশীদের পাশাপাশি ‘হিলোট’ নামক একটি শ্রেণীও বাস করতো গ্রিসে। হিলোটরা ছিল দাসশ্রেণীর, যারা দাসের মতই দায়বদ্ধভাবে কৃষিকাজসহ চাকর-বাকরের মতো কাজ করতো। অনেক পণ্ডিত ধারণা করেন যে, এর ফলে সমাজের উঁচু স্তরের লোকজন ও স্বাধীন নাগরিকরা অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় রত হওয়ার সুযোগ পায় এবং সে কারণেই প্রাচীন গ্রিস বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। গ্রিক কৃষকদের বড় একটা অংশ ভূমির মালিক ছিল না। ফলে উৎপাদিত ফসলের বড় একটা অংশ জমির মালিকদেরকে দিতে হতো। এর ফলে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তো এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদেরকে দাস হিসেবে সমর্পণ করে ‘হিলোট’ শ্রেণীতে যুক্ত হতো। জানা যায়, এক সময় এথেন্সে মাত্র ২,১০০ স্বাধীন নাগরিকের বিপরীতে ৪৬০,০০০ ক্রীতদাস ছিল। স্পার্টার চেয়ে এথেন্সে ক্রীতদাসরা তুলনামূলক ভাল আচরণ পেতো। পরবর্তীকালে ড্রাকো’র সংবিধান (খ্রি: পূ: ৬২১) ও সলোন (জীবনকাল খ্রি: পূ: ৬৩৮-৫৫৮)-এর আইনে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বানানো হয়; ফলে তাদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। সলোনের ফরমান ঋণের কারণে দাসকরণ নিষিদ্ধ করে। এ সময় ক্রীতদাসরা কিছু মৌলিক অধিকার ভোগের সুযোগ পায় এবং রাষ্ট্র ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা ক্রীতদাসকে মৃত্যুদণ্ডদান নিষিদ্ধ করা হয়।
রোমান সাম্রাজ্য:
প্রাচীন রোম প্রজাতন্ত্র ও রোম সাম্রাজ্যের প্রাথমিক যুগে জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ছিল ক্রীতদাস।[৮] অগাস্টাস সিজারের শাসনামলে (শাসনকাল খ্রি: পূ: ৬৩-১৪) এক দাসমালিক নাকি ৪,০০০ ক্রীতদাস রেখে মারা যান।[৯] খ্রি: পূ: দ্বিতীয় শতাব্দি পর্যন্ত দাসমালিকরা বৈধভাবে ক্রীতদাসকে হত্যা করতে পারতো, যদিও তা ঘটতো খুবই কম। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২ অব্দে কর্নেলিয়ান আইনের মাধ্যমে ক্রীতদাস হত্যা নিষিদ্ধ হয়; ৮২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পেট্রোনিয়ান আইন ক্রীতদাসদেরকে যুদ্ধে ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। সম্রাট ক্লডিয়াসের শাসনকালে (৪১-৫৪ খ্রি:) মালিকের অবহেলার কারণে ক্রীতদাসের মৃত্যু ঘটলে, মালিক খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হতো। বিখ্যাত বক্তা, লেখক, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ ডিয়ো ক্রিসোস্টোম সম্রাট ট্রজানের শাসনামলে (৯৮-১১৭ খ্রি:) দাসপ্রথার নিন্দা করে ‘ফোরামে’ প্রদত্ত তার দুটি বক্তৃতা (১৪ ও ১৫) উৎসর্গ করেছিলেন। ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রীয় কর্মকতা সেনিকা দ্য এল্ডার (৫৪−৩৯ খ্রি: পূ:) কর্তৃক লিখিত ‘দা ক্লিমেন্সিয়া’ (১:১৮)-তে লিখিত হয়েছে যে, ক্রীতদাসদের উপর নিষ্ঠুর আচরণকারী মালিকদেরকে প্রকাশ্যে ভড়ৎসনা করা হতো। পরবর্তীকালে সম্রাট হাড্রিয়ান (শাসনকাল ১১৭-১৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) কর্নেলিয়ান আইন পুনঃপ্রবর্তন করেন। সম্রাট কারাকালার (শাসনকাল ২১১-২১৭ খ্রিষ্টাব্দ) অধীনে স্টয়িক (ভোগবিরোধী) আইনজীবী আলপিয়ান পিতা-মাতা কর্তৃক সন্তানদেরকে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি করা অবৈধ করেন। রোমের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য পৌত্তলিক সম্রাট ডিয়োক্লিশিয়ান (শাসনকাল ২৮৪-৩০৫ খ্রিষ্টাব্দ) ঋণদাতা কর্তৃক ঋণগ্রস্তকে ক্রীতদাসকরণ এবং ঋণগ্রস্তকে ঋণ পরিশোধের জন্য নিজেকে ক্রীতদাস হিসেবে সমর্পণ করা নিষিদ্ধ করেন। কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট (শাসনকাল ৩০৬-৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) ক্রীতদাস বিতরণকালে পরিবারের সদস্যদেরকে বিচ্ছিন্ন করা নিষিদ্ধ করেন। স্পষ্টতঃ খ্রিষ্টানপূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে ক্রীতদাসদের অবস্থার ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছিল।
প্রাচীন চীনে:
প্রাচীন চীনে ধনী পরিবারগুলো ক্ষেত-খামারের ও বাড়ির চাকর-বাকরের কাজের জন্য ক্রীতদাস রাখতো। সম্রাটরা সাধারণত শত শত, এমনকি হাজার হাজার ক্রীতদাস রাখতেন। অধিকাংশ ক্রীতদাস ছিল ক্রীতদাস মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী। কিছু সংখ্যক ক্রীতদাস হতো ঋণশোধে ব্যর্থ হয়ে; অন্যেরা ছিল যুদ্ধে আটককৃত বন্দি।
প্রাচীন ভারতে:
অপর একটি বড় প্রাচীন সভ্যতা ভারতে দাসপ্রথার উল্লেখ খুবই সামান্য। বিখ্যাত গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিস (খ্রি: পূ: ৩৫০-২৯০) − যিনি গ্রিসসহ তার সফর করা অন্যান্য বহু দেশে দাসপ্রথা সম্পর্কে বিশেষ পরিচিত ছিলেন − তিনি লিখেছেন: ‘ভারতীয়রা সবাই স্বাধীন; তাদের কেউ-ই দাস নয়; এমনকি তারা বিদেশীদেরকেও দাস বানায় না; সুতরাং তাদের নিজস্ব দেশীয় লোকদেরকে ক্রীতদাস বানানোর প্রশ্নই উঠে না।’[১০] একইভাবে মুসলিম ইতিহাসবিদরা, যারা ভারতে ইসলামি ক্রীতদাসকরণের ভুরি-ভুরি বিবরণ লিখে গেছেন, তারাও ইসলামপূর্ব হিন্দু সমাজে দাসপ্রথার কথা উল্লেখ করেননি। তবে প্রাচীন ভারতেও দাসপ্রথা যে কিছু মাত্রায় বিদ্যমান ছিল, তা অনুমান করা যায়, কেননা ঋগবেদে (প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ) দাসপ্রথার উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও বুদ্ধের শিক্ষাসহ অন্যান্য দার্শনিক ও ধর্মীয় সাহিত্যে দাসপ্রথার উল্লেখ পাওয়া যায়।
বুদ্ধ (জীবনকাল অনুমান খ্রি: পূ: ৫৬৩-৪৮৩ সাল) তাঁর অনুসারীদেরকে নির্দেশ দেন ক্রীতদাসদেরকে এমন পরিমাণ কাজ দিতে, যা তারা সহজেই করতে পারে। ক্রীতদাসরা অসুস্থ হলে তাদের সেবাযত্ন করতে তিনি দাসমালিককে উপদেশ দেন। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কৌটিল্য (বা চানক্য), যার শিষ্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বিখ্যাত মৌর্য সাম্রাজ্য (আনুমানিক ৩২০-১০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি দাসমালিক কর্তৃক বিনা কারণে ক্রীতদাসদেরকে শাস্তি দান নিষিদ্ধ করেন; এ নির্দেশ ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র মালিকদেরকে শাস্তি দিতো। মৌর্য বংশের সম্রাট অশোক (শাসনকাল ২৭৩-২৩২ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) তার পাথরে খোদাইকৃত ৯ নং অনুশাসনে দাসমালিককে ক্রীতদাসের প্রতি সহানুভূতিশীল ও বিবেচনাপ্রসূত আচরণ করার উপদেশ দেন।
প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগবেদে ক্রীতদাস উপহার দেওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে এবং শাসকরা উপহারস্বরূপ নারী ক্রীতদাসদেরকে প্রদান করতেন। ভারতে ক্রীতদাসরা শাসকদের প্রাসাদে, অভিজাতদের প্রতিষ্ঠানসমূহে ও ব্রাহ্মণদের ঘরে গৃহ-পরিচারক বা চাকর-বাকরের কাজ করতো। সম্ভবত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ লোকেরা ভারতে ক্রীতদাস হতো।[১১]
তবে এটা বোঝা যায় যে, প্রচীন ভারতে দাসপ্রথার চর্চা ছিল খুবই সামান্য এবং তৎকালীন মিশর, গ্রিস, চীন ও রোমের তুলনায় ভারতে ক্রীতদাসরা অধিকতর মানবিক আচরণ পেত। ক্রীতদাসরা কখনোই বাণিজ্যিক পণ্য বিবেচিত হয়নি ভারতে, সেখানে কখনোই দাস বেচাকেনার বাজার ছিল না। মুসলিমরা দাস-বাণিজ্য আনয়নের আগে দাস-বাণিজ্য ভারতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কোনো অংশ বা বৈশিষ্ট্য ছিল না।
খ্রিষ্টান ধর্মে দাসপ্রথা:
নিউ টেস্টামেন্টে দাসপ্রথা সুস্পষ্টরূপে স্বীকৃত, এমনকি অনুমোদিত (ম্যাথিউ ১৮:২৫, মার্ক ১৪:৬৬)। উদাহরণস্বরূপ যিশু ঋণগ্রস্তকে ঋণ পরিশোধের জন্য পরিবারসহ নিজেদেরকে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি হওয়ার পরামর্শ দেন (ম্যাথিউ ১৮:২৫)। একইভাবে সেন্ট পলের কয়েকটি শ্লোকে, যেমন ইফ. ৬:৫-৯, কর. ১২:১৩, গল. ৩:২৪ ও কোল. ৩:১১ প্রভৃতি দাসপ্রথা এবং দাস (বাঁধা) ও মুক্ত মানুষের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ।
নিউ টেস্টামেন্টের এসব অনুমোদনমূলক বা সম্মতিসূচক উক্তিই সম্ভবত অবিশ্বাসীদেরকে (অখ্রিষ্টানদেরকে) ক্রীতদাসকরণে খ্রিষ্টানদেরকে উৎসাহিত করেছিল। স্পষ্টতঃ খ্রিষ্টানপূর্ব রোম সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছিল এবং দাসদের অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছিল। চতুর্থ শতাব্দীতে সম্রাট কনস্টানটাইনের খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণের পর যখন খ্রিষ্টানরা রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তখন পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ খ্রিষ্টানপন্থি সম্রাট ফ্লাভিয়াস গ্রাটিয়ানাস (শাসনকাল ৩৭৫-৩৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) এ অনুশাসন জারি করেন যে, কোন ক্রীতদাস মালিকের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ করলে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে। ৬৯৪ সালে স্পেনীয় সম্রাট চার্চের চাপে ইহুদিদেরকে খ্রিষ্টানধর্ম গ্রহণ অথবা ক্রীতদাসত্ব বরণ করার নির্দেশ দেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে চার্চের ফাদার ও পোপরা মধ্যযুগে খ্রিষ্টান জগতে দাসপ্রথার বৈধতা দিতো। আধুনিক যুগের শুরুতে ইউরোপে এ ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার মুখেও তারা দাস-বাণিজ্যের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখে। বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছেন: ‘প্রত্যেকেই জানে যে, চার্চগুলো যতদিন পেরেছে সাধ্যমতো দাসপ্রথা বিলুপ্তিকরণের বিরোধিতা করেছে।’[১২]
[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ভারতে মুসলিমদের দ্বারা ক্রীতদাসকরণ]
সূত্রঃ
7. Lal (1994), p. 2
8. Slavery, Wikipedia, http://en.wikipedia.org/wikis/Slavery
9. Lal (1994), p. 3
10. Ibid, p. 5
11. Ibid, p. 4
12. Russell B (1957) Why I Am Not a Christian, Simon & Schuster, New York, p. 26

ইসলামে বর্বরতা (দাসত্ব-অধ্যায়—৩)

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো। এ পর্বে আলোচিত হয়েছেঃ ভারতে মুসলিমদের দ্বারা ক্রীতদাসকরণ]
ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ৩
লেখক: এম, এ, খান
প্রাচীন বিশ্বে দাসপ্রথা
ভারতে মুসলিমদের দ্বারা ক্রীতদাসকরণ
ভারতে মুসলিমদের দ্বারা ক্রীতদাসকরণ
মুসলিম দখলদার ও শাসকরা ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার যেখানেই গেছে, সেখানেই বিধর্মীদেরকে ব্যাপক হারে ক্রীতদাস বানিয়েছে। এ আলোচনায় মধ্যযুগীয় ভারতে তৎকালীন মুসলিম ঐতিহাসিক কর্তৃক লিপিবদ্ধ করে যাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মুসলিমদের দ্বারা ক্রীতদাসত্ব চর্চার কিছুটা বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরা হবে। আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য স্থানে ইসলামিক দাসপ্রথা চর্চা সম্বন্ধেও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উপস্থাপন করা হবে।
মোহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক: নবি মুহাম্মদের মৃত্যুর চার বছর পর খলিফা ওমরের শাসনামলে ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় সীমান্তীয় থানা অঞ্চলটি আক্রমণ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে ভারতে ইসলামি হামলার সূচনা হয়। পরবর্তীতে খলিফা ওসমান, আলী ও মুয়াবিয়ার সময়ে এরূপ আরো আটবার লুণ্ঠন অভিযান চালানো হয়। এসব প্রাথমিক আক্রমণে কখনো কখনো লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ড ছাড়াও লুণ্ঠনদ্রব্য ও ক্রীতদাস সংগ্রহ করা হয়, কিন্তু ভারতে ইসলামের স্থায়ী পদাঙ্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়। খলিফা আল-ওয়ালিদের আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধুতে উবায়দুল্লাহ ও বুদাইলের নেতৃত্বে দু’টো অভিযান প্রেরণ করেন। উভয় অভিযানই চরমভাবে ব্যর্থ হয় অনেক মৃত্যুর মাশুল দিয়ে, নিহত হয় উভয় সেনাপতি। অন্তরে ক্ষতবিক্ষত হাজ্জাজ এরপর ৬,০০০ সৈন্যের নেতৃত্বে ১৭-বছর-বয়স্ক তারই ভাতিজা ও জামাতা কাসিমকে প্রেরণ করেন। মোহাম্মদ বিন কাসিম ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধুর দেবাল বন্দর জয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইসলামের শক্ত ও স্থায়ী ভিত্তি রচনা করে। বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ আল-বিরাদুরী লিখেছেন: ‘দেবাল আক্রমণ করে সেখানে তিনদিন ধরে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালানো হয়; মন্দিরের যাজকদের সবাইকে হত্যা করা হয়।’[১৩] কাসিম ১৭ বছরের অধিক বয়সী পুরুষদেরকে তলোয়ারের ডগায় হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস বানায়। দেবালে কত লোককে বন্দি করা হয়েছিল সে সংখ্যা লিখা হয়নি, তবে তাদের মধ্যে ছিল মন্দিরে আশ্রয়গ্রহণকারী ৭০০ রমণী, জানায় ‘চাচনামা’। লুণ্ঠিত মালামাল ও ক্রীতদাসদের মধ্যে খলিফার এক-পঞ্চমাংশের হিস্যায় ছিল পঁচাত্তর জন কুমারী, যাদেরকে হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অবশিষ্টদেরকে কাসিম তার সেনাদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়।[১৪]
রাওয়ার আক্রমণে, লিখিত হয়েছে চাচনামায়, ‘বন্দিদের গণনা করলে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০,০০০, যাদের মধ্যে ছিল সেনাধ্যক্ষদের কন্যারা ও একজন ছিল রাজা দাহিরের বোনের মেয়ে।’ বন্দি ও লুণ্ঠিত মালামালের এক-পঞ্চমাংশ হাজ্জাজের নিকট প্রেরণ করা হয়।১৫. ব্রাহ্মণাবাদ যখন মুসলিম আক্রমণে পতিত হয়, জানায় ‘চাচনামা’: ৮,০০০ থেকে ২৬,০০০ লোককে নিধন করা হয়; ‘এক-পঞ্চমাংশ বন্দিকে আলাদা করে গণনা করা হলে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার; অবশিষ্টদেরকে যোদ্ধাদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়।’[১৬] তার অর্থ দাঁড়ায়: এ আক্রমণে প্রায় ১০০,০০০ নারী ও শিশুকে ক্রীতদাস করা হয়েছিল।
খলিফার হিস্যা হিসেবে একবার প্রেরিত লুণ্ঠনদ্রব্য ও ক্রীতদাসদের মধ্যে ছিল ৩০,০০০ নারী ও শিশু এবং নিহত দাহিরের ছিন্ন মস্তক। সেসব বন্দির মধ্যে ছিল সিন্ধুর বিশিষ্ট মর্যাদাবান পরিবারের কিছু তরুণী কন্যা। হাজ্জাজ লুণ্ঠনদ্রব্য ও ক্রীতদাস বহনকারী বহর দামেস্কে খলিফা আল-ওয়ালিদের নিকট পাঠিয়ে দেন। ‘সে সময়ের খলিফা যখন চিঠিটি পড়েন’, লিখেছে চাচনামা: ‘তিনি সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রশংসা করেন। তিনি সেনাধ্যক্ষদের কন্যাদের কিছুকে বিক্রি করে দেন এবং কিছু উপহার হিসেবে প্রদান করেন। তিনি রাজা দাহিরের ভগ্নির কন্যাদেরকে যখন দেখেন, তাদের সৌন্দর্য ও মনোহর রূপে এতই অভিভূত হন যে, হতবাক হয়ে আঙ্গুল কামড়াতে থাকেন।’[১৭]
আল-বিলাদুরী লিখেছেন, মুলতান আক্রমণে বন্দি হওয়া লোকদের মধ্যে ‘মন্দিরের পুরোহিতদের সংখ্যাই ছিল ৬ হাজার’।১৮ এ সংখ্যাটি আমাদেরকে ধারণা দিতে পারে মুলতান আক্রমণে মোট কত সংখ্যক নারী ও শিশুকে ক্রীতদাস করা হয়েছিল। কাসিম একই রকমের অভিযান চালিয়েছিল সেহওয়ান ও ধালিলায়। সংক্ষিপ্ত তিন বছরের (৭১২-১৫) নেহাৎই ছোট কৃতিত্বে কাসিম সম্ভবত সর্বমোট তিন লাখের মতো লোককে ক্রীতদাস বানিয়েছিল।
৭১৫ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে: ৭১৫ সালে কাসিমকে দামেস্কে ডেকে পাঠানোর পর ভারত সীমান্তে মুসলিমদের হত্যাযজ্ঞ ও ক্রীতদাসকরণ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে স্বল্পমাত্রার অভিযান অব্যাহত থাকে। একমাত্র গোঁড়া মুসলিম উমাইয়া শাসক খলিফা ওমরের শাসনামলে (৭১৭-২০) তার সেনাপতি আমরু বিন মুসলিম হিন্দু ভূখণ্ডগুলোর বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে পরাজিত করেন। এসব অভিযানে নিঃসন্দেহে বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস কব্জা করা হয়েছিল। খলিফা হাসাম বিন আব্দুল মালিকের শাসনামলে (৭২৪-৪৩) সিন্ধুর সেনাপ্রধান জুনাইদ বিন আব্দুর রহমান কয়েকটি বিজয় অভিযানে লিপ্ত হন। কিরাজ আক্রমণে তিনি ‘আকস্মিকভাবে হানা দিয়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ছাড়াও লুটতরাজ ও লোকজনকে বন্দি করেন।’ উজ্জ্বেন ও বাহারিমাদ আক্রমণে তিনি শহরতলীর বাড়িঘর ভস্মীভূত করেন ও বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেন।[১৯] লুণ্ঠিত মালামালের মধ্যে অনিবার্যরূপে থাকতো বন্দিকৃত ক্রীতদাসরা।
৭৫০ খৃষ্টাব্দে গোঁড়ামির ভিত্তিতে আব্বাসীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পর খলিফা আল-মনসুর (শাসনকাল ৭৫৫-৭৪) হিন্দু ভূখণ্ডগুলোর বিরুদ্ধে পবিত্র ধর্মযুদ্ধের জন্য হাসাম বিন আমরু’কে প্রেরণ করেন। আমরু ‘কাশ্মীরকে পদানত করে বহু বন্দি ও ক্রীতদাস সংগ্রহ করেন’।[২০] তিনি কান্দাহার ও কাশ্মীরের মধ্যবর্তী অনেক স্থানে আক্রমণ চালান এবং প্রতিটি বিজয়ে অবশ্যই বহু লোককে বন্দি করে নিয়ে যান, যা লিখিত হয়নি।
বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে আসির (আথির) ‘কামিল উৎ-তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে লিখেছেন: খলিফা আল-মাহদির শাসনামলে ৭৭৫ সালে সেনাধ্যক্ষ আব্দুল মালেক ভারতের বিরুদ্ধে একটা বিশাল নৌ-জিহাদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তারা বারাদায় জাহাজ থেকে নেমে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকদের সাথে দীর্ঘ যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনী জয়ী হয়। আসির জানান: ‘কিছু সংখ্যক মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়, বাকিদেরকে হত্যা করা হয়। কুড়ি জন মুসলিম এ ধর্মযুদ্ধে প্রাণ হারায়।’[২১] কতজন বন্দিকে তারা তুলে নিয়ে যায়, তা লিখিত হয়নি।
খলিফা আল-মামুনের রাজত্বকালে (৮১৩-৩৩) সেনাপতি আফিক বিন ঈসা বিদ্রোহী হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক অভিযান পরিচালনা করেন। তাদেরকে বন্দি ও হত্যা করার পর জীবিত ২৭,০০০ পুরুষ, নারী ও শিশুকে ক্রীতদাস করা হয়।[২২] পরবর্তী খলিফা আল-মুতাসিমের আমলে সিন্ধুর গভর্নর আমরান বিন মুসা মুলতান ও কান্দাবিল আক্রমণ ও জয় করেন এবং ‘অধিবাসীদেরকে বন্দি করে নিয়ে যান’।[২৩] ৮৭০ সালের দিকে ইয়াকুব লেইস আর-রুখাজ (আরাকোশিয়া) আক্রমণ করেন এবং ক্রীতদাসকৃত বাসিন্দাদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেন।[২৪]
গজনীর হানাদারদের দ্বারা: মোহাম্মদ বিন কাসিমের লুণ্ঠনকার্যের প্রায় তিন শতাব্দী পর সুলতান মাহমুদ উত্তর ভারতে ১৭ বার চরম ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালান (১০০০-২৭)। এসব হামলায় তিনি ব্যাপক গণহত্যা, লুণ্ঠন, বহু মন্দির ধ্বংস ও অগণিত মানুষকে ক্রীতদাস বানান। আল-উতবি লিখেছেন: ১০০১-০২ সালে রাজা জয়পালকে আক্রমণ করলে ‘আল্লাহ তাঁর বন্ধুদেরকে এমন বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠনদ্রব্য প্রদান করেন যা সীমাহীন ও বর্ণনার অতীত, এবং সে সঙ্গে পাঁচ লক্ষ ক্রীতদাস নারী ও পুরুষ।’ বন্দিদের মধ্যে ছিলেন রাজা জয়পাল নিজে, তার সন্তানরা, নাতিরা ও ভাতিজারা, তার গোষ্ঠির প্রধানবর্গ এবং তার আত্মীয়-স্বজন।[২৫] মাহমুদ তাদেরকে বিক্রির জন্য গজনিতে নিয়ে যান।
আল-উতবি জানান: ‘১০১৪ সালে নিন্দুনা (পাঞ্জাবে) আক্রমণের ফলে ক্রীতদাসের এতই প্রাচুর্য হয় যে, তাদের দাম একেবারে সস্তা হয়ে পড়ে। স্বদেশের বিশিষ্ট ও সম্মানিত লোকেরা (গজনীর) সাধারণ দোকানদারের ক্রীতদাস হয়ে অবমানিত হয়।’ পরের বছর থানেসার (হরিয়ানায়) আক্রমণে, জানান ফেরিশতা: মুসলিম বাহিনী ‘২০০,০০০ বন্দিকে গজনীতে নিয়ে আসে; এর ফলে রাজধানী গজনীকে ভারতের একটা নগরীর মতো দেখায়। সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিকের কয়েকজন করে ক্রীতদাস পুরুষ ও বালিকা ছিল।’ ১০১৯ সালের ভারত অভিযান থেকে তিনি ৫৩,০০০ বন্দিকে নিয়ে ফিরেন। মাহমুদের ১৭ বার ভারত আক্রমণের মধ্যে কেবলমাত্র কাশ্মীর অভিযানটি ব্যর্থ হয়েছিল। বিজয়ী অভিযানগুলোতে তিনি লুণ্ঠনের মাধ্যমে প্রচুর মালামাল হস্তগত করেন, যার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ক্রীতদাস অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে তাদের সংখ্যা লিপিবদ্ধ হয়নি। ‘তারিখই আলফি’ গ্রন্থটি উল্লেখ করেছে যে, তিনি খলিফার জন্য এক-পঞ্চমাংশ লুণ্ঠনদ্রব্য পৃথক করে রাখতেন, যার মধ্যে ছিল ১৫০,০০০ ক্রীতদাস।[২৬] তার অর্থ দাঁড়ায়, সুলতান মাহমুদ নিদেন পক্ষে ৭৫০,০০০ ক্রীতদাস ধরে এনেছিলেন ভারত থেকে।
সুলতান মাহমুদ (মৃত্যু ১০৩০) পাঞ্জাবে একটা ইসলামি সুলতানাতের প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করেন, যেখানে গজনবি রাজবংশ ১১৮৬ সাল পর্যন্ত শাসন চালায়। ১০৩৩ সালে সুলতান মাহমুদের অখ্যাত পুত্র সুলতান মাসুদ-১ ‘কাশ্মীরের সুরসুতি দুর্গটি আক্রমণ করেন। সেখানে নারী ও শিশু ব্যতীত দুর্গের সমস্ত সেনাকে হত্যা করা হয়। বন্দি নারী ও শিশুদের ক্রীতদাসরূপে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়’।[২৭] ১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাসুদ গুরুতর অসুস্থ হলে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে আল্লাহকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হান্সির বিরুদ্ধে পবিত্র ধর্মযুদ্ধ চালনা করবেন। সুস্থ হয়ে উঠে তিনি হানসি আক্রমণ ও দখল করেন। এ আক্রমণে, জানান আবুল ফজল বাইহাকি, ‘ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বিশিষ্ট লোকদেরকে হত্যা করা হয় এবং নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়।’[২৮]
১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে দুর্বল গজনবি সুলতান ইব্রাহিম পাঞ্জাবের জেলাগুলো আক্রমণ করেন। সপ্তাহের পর সপ্তাহব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধে উভয়পক্ষেই ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। ‘তারিখ-ই আলফি’ ও ‘তাবাকাত-ই-আকবরী’ গ্রন্থদ্বয় জানায়, পরিশেষে তার বাহিনী জয়লাভ করে এবং বিপুল ধনসম্পদ ও ১০০,০০০ ক্রীতদাস কব্জা করে, যাদেরকে গজনীতে প্রেরণ করা হয়।[২৯]
গোরী দখলদারদের দ্বারা: মোহাম্মদ গোরী, যিনি ছিলেন একজন আফগান, তিনি দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারতে ইসলামি আক্রমণের তৃতীয় তরঙ্গ পরিচালনা করে দিল্লিতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন (১২০৬)। তার ১১৯৪ সালের বেনারস আক্রমণে, ইবনে আসির লিখেছেন: ‘হিন্দু হত্যাকাণ্ড ছিল অগণন; নারী ও শিশু ব্যতীত কাউকে জীবিত রাখা হয়নি। ধরিত্রী আতঙ্কে শিউরে না উঠা পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন থামেনি।’[৩০] নারী ও শিশুদেরকে যথারীতি ক্রীতদাসরূপে কব্জা করা হয়। তার সেনাধ্যক্ষ কুতুবদ্দিন আইবেক ১১৯৫ সালে গুজরাটের রাজা ভীমকে আক্রমণ করে ২০,০০০ ক্রীতদাস আটক করেন।[৩১] হাসান নিজামী লিখেছেন: ১২০২ সালে তার কালিঞ্জর আক্রমণে ‘পঞ্চাশ হাজার মানুষ ক্রীতদাস হয় এবং হিন্দুদের রক্তে সমতলভূমি কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে।’[৩২] ১২০৬ সালে মোহাম্মদ গোরী অবাধ্য খোখার বিদ্রোহীদের দমনে অগ্রসর হন; এরা মুলতান অঞ্চলে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিদ্রোহীদেরকে নিধন এতই ব্যাপক ছিল যে, তাদেরকে পোড়ানোর জন্য আগুন জ্বালাবার লোকও ছিল না। নিজামী আরো লিখেছেন: ‘অগণিত ক্রীতদাস ও অস্ত্রশস্ত্র বিজয়ীদের হস্তগত হয়।’[৩৩] সুলতান গোরী ও আইবেকের ক্রীতদাস বানানোর কৃতিত্বের বর্ণনায় ‘ফখর-ই-মুদাব্বির’ গ্রন্থটি লিখেছে: ‘এমনকি গরিব (মুসলিম) বাসিন্দারাও বহু ক্রীতদাসের মালিক বনে যায়।’[৩৪] ফেরিস্তা জানান: ‘মোহাম্মদ গোরী কর্তৃক তিন থেকে চার লক্ষ খোখার ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়।’[৩৫] এসব ধর্মান্তরকরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকে ক্রীতদাসকরণের মাধ্যমে সাধিত হয়েছিল।
১২০৬ সালে নিজেকে ভারতের প্রথম সুলতান ঘোষণা করে আইবেক হান্সি, মীরাট, দিল্লি, রাঁথাম্বর ও কল (আলিগড়) জয় করেন। তার শাসনকালে (১২০৬-১০) আইবেক অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করে দিল্লি থেকে গুজরাট, লক্ষ্ণৌতি থেকে লাহোর, পর্যন্ত অনেক এলাকা কব্জা করেন। প্রত্যেক বিজয়ে প্রচুর ক্রীতদাস কব্জা করা হয়, যদিও তাদের সংখ্যা লিখিত হয়নি। তবে আইবেকের যুদ্ধে ক্রীতদাস শিকারের বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে ইবনে আসিরের এ দাবিতে যে: ‘(তিনি) হিন্দু প্রদেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন… তিনি বহু লোককে হত্যা করেন এবং যুদ্ধবন্দি ও লুণ্ঠন দ্রব্যসহ ফিরে আসেন।’[৩৬]
একই সময়ে বখতিয়ার খিলজি পূর্ব-ভারতের বিহার ও বাংলায় হত্যাযজ্ঞ ও ক্রীতদাসকরণেপূর্ণ ব্যাপক দখলাভিযান চালান। তিনি কত সংখ্যক লোককে ক্রীতদাস করেছিলেন তারও কোনো তথ্য-দলিল রাখা হয়নি। বখতিয়ার সম্পর্কে ইবনে আসির বলেছেন, অত্যন্ত সাহসী ও উদ্দীপনাপূর্ণ বখতিয়ার মুঙ্গির (বাংলা) ও বিহারে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ করে বিপুল লুণ্ঠিত মালামাল কব্জা করেন এবং অসংখ্য ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র ও ‘মানুষ’ (ক্রীতদাস) হস্তগত করেন।[৩৭] ১২০৫ সালে বখতিয়ারের বাংলার লক্ষণসেনকে আক্রমণে, লিখেছেন ইবনে আসির: ‘তার সমস্ত কোষাগার, স্ত্রী, পরিচারিকা, সঙ্গী-সাথী ও নারীরা সবাই হানাদারের হস্তগত হয়।’[৩৮]
কুতুবউদ্দিন আইবেক দিল্লিতে স্থায়ী হওয়ার পর ভারতে আটককৃত ক্রীতদাসদেরকে আর দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো না গজনী থেকে আসা সুলতান মাহমুদ ও মোহাম্মদ গোরীর সময়ের মতো। এরপর থেকে বন্দিদেরকে রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন কাজে এবং সেনাধ্যক্ষ, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও সৈনিকদের কাজে লাগানো হতো। বাকি ক্রীতদাসদেরকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারগুলোতে বিক্রিত করা হতো, যা ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ প্রথম।
সুলতান ইলতুতমিস থেকে বলবনের সময়কালে (১২১০-১২৮৫): পরবর্তী সুলতান ইলতুতমিস (শাসনকাল ১২১০-৩৬) তার শাসনকালের প্রথম কয়েক বছর ক্ষমতা থেকে বহিষ্কৃত মুসলিম তুর্ক প্রতিপক্ষকে দমনে কাটিয়ে দেন। তিনি চেঙ্গিস খানের আক্রমণের ভয়েও ভীত ছিলেন। ক্ষমতা পোক্ত করার পর তিনি ১২২৬ সালে রাঁথাম্বর আক্রমণ করেন। সে আক্রমণে, লিখেছেন মিনহাজ সিরাজ: ‘তার অনুসারীদের হাতে বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠনদ্রব্য চলে আসে’;[৩৯] স্পষ্টতই লুণ্ঠনদ্রব্যের মধ্যে ছিল ক্রীতদাস। সিরাজ ও ফেরিশতা জানান, ১২৩৪-৩৫ সালের উজ্জ্বেন আক্রমণে তিনি ‘অবাধ্য লোকদের নারী ও শিশুদেরকে’ বন্দি করেন।[৪০]
ইলতুতমিসের মৃত্যুর পর সুলতানের ক্ষমতার দুর্বলতার কারণে ক্রীতদাসকরণ কার্যক্রমে কিছুদিনের জন্য ভাটা পড়ে। ফেরিশতা লিখেছেন: ১২৪৪ সালে উলুগ খান বলবনের নেতৃত্বে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ মুলতানের জুদ পর্বতের গুক্কার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান এবং ‘সকল বয়সী ও উভয় লিঙ্গের কয়েক হাজার গুক্কারকে বন্দি করে আনেন।’ [৪১]
১২৪৮ সালে উলুগ খান বলবন কারা আক্রমণ করেন। সিরাজ লিখেছেন: সেখানে তার ‘বিধর্মীদেরকে বন্দিকরণ ও আটককৃত মহান রানাদের (হিন্দু যুবরাজ) পোষ্যদের সংখ্যা ছিল অগণন।’ রানা ‘দালাকি ওয়া মালাকি’কে আক্রমণে ‘তিনি বন্দি ও সে হতভাগার স্ত্রী-পুত্র ও পোষ্যদেরকে নিয়ে আসেন এবং বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত মালামাল কব্জা করেন।’[৪২] ১২৫২ সালে বলবন মালোয়া’র মহান রানা জাহির দেবকে আক্রমণ করে পরাজিত করেন। সিরাজ লিখেছেন, ‘বহু বন্দি বিজয়ীদের হাতে পড়ে।’[৪৩]
১২৫৩ সালে রাঁথাম্বর আক্রমণ করে বলবন বহু ক্রীতদাস কব্জা করেন এবং ১২৫৯ সালে হরিয়ানা আক্রমণে বহুসংখ্যক নারী-শিশুকে ক্রীতদাস বানান। বলবন কাম্পিল, পাতিয়ালি ও ভোজপুরে দু’বার করে আক্রমণ করেন এবং প্রতিবার বিপুল সংখ্যক নারী-শিশুকে ক্রীতদাস বানান। কাটিহারে আট বছরের উর্ধ্ব-বয়সী বিধর্মীদেরকে পাইকারি হারে হত্যার পর তাদের নারী ও শিশুদের তিনি আটক করে নিয়ে আসেন, লিখেছেন ফেরিশতা। ১২৬০ সালে বলবন রাঁথাম্বর, মেওয়াত ও সিউয়ালিক আক্রমণ করে তার যোদ্ধাদেরকে লক্ষ্য করে ঘোষণা দেন: যারা একজন জীবিত বন্দিকে আনবে, তারা পাবে দুই তাঙ্খা (রৌপ্য মুদ্রা), আর বিধর্মীদের ছিন্নমস্তক আনলে পাবে এক তাঙ্খা। ফেরিশতা লিখেছেন: অচিরেই তার সমীপে তিন থেকে চারশ’ জীবিত বন্দি ও ছিন্ন-মস্তক এনে হাজির করা হয়। সুলতান নাসিরুদ্দিনের (মৃত্যু ১২৬৬) অধীনে সেনানায়ক হিসেবে কাজ করার সময় বলবন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে বহু হামলা পরিচালনা করেন। কিন্তু কী পরিমাণ বন্দি তিনি কব্জা করেছিলেন তা লিখিত হয়নি। তবে তিনি যে কী বিপুল পরিমাণ ক্রীতদাস সংগ্রহ করেছিলেন তা অনুমান করা যাবে এ ঘটনা থেকে যে, সুলতান নাসিরুদ্দিন লেখক মিনহাজ সিরাজকে তার খোরাসানবাসী ভগ্নির জন্য চল্লিশ জন ক্রীতদাসকে উপহার দিয়েছিলেন।[৪৪]
বলবন ১২৬৫ সালে ক্ষমতা দখল করে সুলতান হন ও গিয়াসউদ্দিন বলবন নাম ধারণ করেন। পূর্ববর্তী সুলতানের সেনাপতি থাকাকালীন বলবন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধ পরিচালনায় অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তার প্রথম কর্তব্য হয়ে পড়ে হাজার হাজার অবাধ্য হিন্দু বিদ্রোহী বা মুয়াত্তিকে নির্মূল করা। সে অভিযানে তিনি ‘বিদ্রোহীদের গ্রামগুলো ধ্বংস, পুরুষদেরকে হত্যা এবং নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করার নির্দেশ দেন।’[৪৫]
খিলজি শাসনকালে: খিলজি (১২৯০-১৩২০) ও তুঘলক (১৩২০-১৪১৩) শাসনামলে ভারতে মুসলিম শাসন বিশাল সেনাবাহিনী ও বিস্তৃত ভূখণ্ড নিয়ে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আফিফ উল্লেখ করেছেন, সুলতানের ক্ষমতা এ সময় এতই ব্যাপক ছিল যে, ‘কারো সাহস ছিল না উচ্চ-বাচ্য করার’। বহু হিন্দু বিদ্রোহ দমনের জন্য অভিযান চালানোর পাশাপাশি তিনি বিধর্মী অঞ্চলগুলোকে মুসলিম নিয়ন্ত্রণে আনার উদগ্র আকাক্সক্ষায়ও বহু অভিযান চালান সেসব অঞ্চলে। এসব অভিযানে তিনি বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য কব্জা করেন, যার মধ্যে ছিল ক্রীতদাস; কিন্তু সে সম্পর্কে লিখিত দলিল খুব কম। সম্ভবত এর কারণ হলো: ক্রীতদাসকরণ ও লুণ্ঠন এসময় একেবারে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে সমসাময়িক কালের লেখকদের রেখে যাওয়া সামান্য কিছু প্রামাণ্য দলিল বিবেচনা করলে সে সময়ে ক্রীতদাসকরণের পরিসর সম্পর্কে সাধারণ ধারণা পাওয়া যাবে। খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন খিলজির শাসনকালে (১২৯০-৯৬) হিন্দু বিদ্রোহীদের দমন ও সুলতানাতের সীমানা সম্প্রসারণের নিমিত্তে নির্মম ও নিষ্ঠুর অভিযান শুরু করা হয়। তিনি কাটিহার, রাঁথাম্বর, জেইন, মালোয়া ও গোয়ালিয়রে অভিযান চালান। রাঁথাম্বর ও জেইন অভিযানে তিনি মন্দিরসমূহ বিধ্বস্ত এবং বিপুল লুণ্ঠন ও বন্দি সংগ্রহের মাধ্যমে একটা “স্বর্গের নরক” সৃষ্টি করেন, লিখেছেন আমির খসরু। আমির খসরু আরো লিখেছেন: মালোয়া অভিযান থেকে বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠন দ্রব্য (যার মধ্যে সর্বদা থাকতো ক্রীতদাস) দিল্লিতে আনা হয়।[৪৬]
পরবর্তী সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল ১২৯৬-১৩১৬) ক্রীতদাসকরণের ক্ষেত্রে আগের সব সুলতানকে ছাড়িয়ে যান। তিনি ১২৯৯ সালে গুজরাটে এক বড় ধরনের অভিযান চালিয়ে সবগুলো বড় বড় শহর ও নগর, যেমন নাহারওয়ালা, আসাভাল, ভানমানথালি, সুরাট, ক্যামবে ও সোমনাথ তছনছ করেন। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইসামি ও বারানী জানান: তিনি এ অভিযানে বিপুল পরিমাণে লুণ্ঠিত মালামাল ও উভয় লিঙ্গের ব্যাপক সংখ্যক বন্দি সংগ্রহ করেন। ওয়াসাফের তথ্য অনুযায়ী, মুসলিম বাহিনী বিপুলসংখ্যক সুন্দরী তরুণীকে বন্দি করে, যার সংখ্যা ছিল প্রায় ২০,০০০ এবং সে সঙ্গে উভয় লিঙ্গের শিশুদেরকেও বন্দি করে নিয়ে যায়। ১৩০১ সালে রাঁথাম্বর ও ১৩০৩ সালে চিতোর আক্রমণ করা হয়। চিতোর আক্রমণে ৩০,০০০ লোককে হত্যা করা হয়েছিল এবং প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মুসলিমরা পরাজিতদের নারী-শিশুকে ক্রীতদাস করে। এ সময় কিছু রাজপুত নারী জওহর বরণ করে আত্মহত্যা করে। ১৩০৫ থেকে ১৩১১ সালের মধ্যে মালোয়া, সেভানা ও জালোর অভিযান করে বিপুল সংখ্যক লোককে বন্দি করা হয়। সুলতান আলাউদ্দিন তার রাজস্থান অভিযানেও বহু ক্রীতদাস আটক করেন। আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে ক্রীতদাস ধরা যেন শিশু-খেলার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমির খসরু লিখেছেন: ‘তুর্কিরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো যে কোনো হিন্দুকে ধরতে, কিনতে বা বিক্রি করতে পারতো।’ ক্রীতদাসকরণ এতটাই ব্যাপক ছিল যে, সুলতান ‘তার ব্যক্তিগত কাজের জন্য ৫০,০০০ হাজার দাস-বালক নিয়োজিত ছিল এবং তার প্রাসাদে ৭০,০০০ ক্রীতদাস কাজ করতো’, জানান আফিফ ও বারানী। বারানী সাক্ষ্য দেন: ‘সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকালে দিল্লির দাস-বাজারে নতুন নতুন দলে অবিরাম বন্দিদের আনা হতো।’[৪৭]
তুঘলক শাসনামলে: ১৩২০ সালে তুঘলকরা ক্ষমতা দখল করে। ভারতে সবচেয়ে শিক্ষিত ও জ্ঞানী মুসলিম শাসকদের মধ্যে একজন ছিলেন মোহাম্মদ শাহ তুঘলক (১৩২৫-৫১) এবং সুলতানাত আমলের (১২০৬-১৫২৬) সবচেয়ে শক্তিধর শাসক। তার ক্রীতদাস ধরার কুখ্যাত উদ্দীপনা আলাউদ্দিন খিলজির কৃতিত্বকেও ম্লান করে দিয়েছিল। তার ক্রীতদাস আটক করা সম্বন্ধে শিহাবুদ্দিন আহমদ আব্বাস লিখেছেন: ‘সুলতান বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তার অন্তরের উদগ্র বাসনা পূরণে কখনো পিছপা হননি… প্রতিদিন অত্যন্ত সস্তা দরে হাজার হাজার ক্রীতদাস বিক্রি হয়, বন্দিদের সংখ্যা এমনই বিপুল।’ তার কুখ্যাত শাসনামলে ভারতের দূর-দূরান্তে ইসলামি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সুদূর বাংলা ও দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত বহু অভিযান পরিচালনা করেন। এছাড়াও তিনি চরম নিষ্ঠুরতার সাথে ১৬টি প্রধান প্রধান বিদ্রোহ নিস্তব্ধ করেন। এসব বিজয় ও দমন অভিযানের অনেকগুলোতে বিপুল পরিমান লুণ্ঠিতদ্রব্য কব্জা করেন, যার মধ্যে অনিবার্যরূপেই থাকতো প্রচুর সংখ্যক ক্রীতদাস। ক্রীতদাসের প্রাচুর্য এমন ছিল যে, পরিব্রাজক ইবনে বতুতা যখন দিল্লিতে পৌঁছেন, সুলতান তাকে ১০ জন ক্রীতদাসী উপহার দেন।[৪৮] ইবনে বতুতার নেতৃত্বে সুলতান চীন সম্রাটের নিকট উপঢৌকনসহ এক কূটনৈতিক বহর পাঠান। সে বহরের সঙ্গে ছিল একশ’ ফর্সা ক্রীতদাস এবং একশ’ হিন্দু নৃত্যশিল্পী ও গায়িকা।[৪৯] সুলতান ইলতুতমিস ও ফিরোজ শাহ তুঘলকের (মৃত্যু ১৩৮৮) শাসনকালে খলিফা ও শাসকদের নিকট উপহারস্বরূপ ক্রীতদাস প্রেরণ করা ছিল সাধারণ ঘটনা। ইবনে বতুতা লিখেছেন: সুলতান সারা বছর ধরে ক্রীতদাস সংগ্রহ করতেন এবং ইসলামের প্রধান দুই ঈদ-উৎসবের দিন তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দিতেন।[৫০] স্পষ্টতই এটা ছিল ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিমিত্তে।
পরবর্তী সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনকাল ১৩৫১-৮৮) ভারতীয়দের প্রতি ছিলেন যথেষ্ট দয়ালু, কারণ তিনিই প্রথম মুসলিমদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারতীয়দেরকে (ধর্মান্তরিত মুসলিম) সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেন। তার শাসনাধীনেও বিধর্মীদেরকে ক্রীতদাসকরণ অত্যন্ত জোরের সাথেই চলতে থাকে। আফিফ সাক্ষ্য দেন: তার প্রাসাদে তিনি ১৮০,০০০ তরুণ ক্রীতদাস বালককে সংগ্রহ করেছিলেন।[৫১] পূর্বসূরী মোহাম্মদ তুঘলকের মতোই তিনি সারা বছর হাজার হাজার নারী ও পুরুষ ক্রীতদাস আটক করতেন এবং ঈদ-উৎসবের দিন তাদের বিয়ে দিতেন। আফিফ জানান: ফিরোজ শাহ তুঘলকের অধীনে ‘ক্রীতদাসের সংখ্যা অগণিত হয়ে উঠে’ এবং ‘দেশের প্রতিটি কেন্দ্রে এ প্রথার (দাসপ্রথার) ভিত্তি মজবুত হয়ে উঠে।’ এর পরপরই সুলতানাতটি ভেঙ্গে কয়েকটি পৃথক রাজ্যে পরিণত হয়, কিন্তু দেশের প্রতিটি কেন্দ্রে বিধর্মীদেরকে দাসকরণের প্রক্রিয়া স্বাভাবিকরূপে চলতে থাকে, লিখেছেন আফিফ।[৫২]
আমির তিমুরের আক্রমণে: মধ্য এশিয়া থেকে আগত আমির তিমুর একজন ‘গাজী’ কিংবা ‘শহীদ’ হওয়ার ইসলামি গৌরব অর্জনের খায়েশে ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হন (১৩৯৮-৯৯)। দিল্লি পৌঁছাবার প্রাক্কালে তিনি ইতিমধ্যে ১০০,০০০ বন্দিকে কব্জা করেছিলেন। দিল্লি আক্রমণের পূর্বে তিনি সেসব বন্দিকে নির্বিচারে হত্যা করেন। দিল্লি আক্রমণ থেকে শুরু করে তার রাজধানীতে ফেরা পর্যন্ত পথিমধ্যে তিনি রেখে যান বর্বরতার লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক ইতিহাস: হত্যা, ধ্বংসলীলা, লুটতরাজ ও ক্রীতদাসকরণ, যা তিনি তার নিজস্ব স্মৃতিকথা ‘মালফুজাত-ই তিমুরী’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।[৫৩]
১৩৯৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তার দিল্লি আক্রমণে, লিখেছেন তিমুর: ‘১৫,০০০ তুর্ক সেনা হত্যা, লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়। লুণ্ঠনের মালামাল এতই বিপুল ছিল যে, প্রত্যেকে পঞ্চাশ থেকে একশ জন করে পুরুষ, নারী ও শিশুকে ভাগে পেয়েছিল। কারো ভাগেই কুড়ি জনের কম ক্রীতদাস পড়েনি।’ যদি প্রতিটি যোদ্ধা গড়ে ৬০ জন বন্দিকেও পেয়ে থাকে, সেদিন কমপক্ষে ১,০০০,০০০ (১০ লাখ) ক্রীতদাস কব্জা করা হয়েছিল (হিসাবের ভুলক্রমে ২০০৯ ইংরেজী সংস্করণে লিখা হয়েছে ১ লাখ)।
তিমুর বর্ণনা করেছেন, মধ্য এশিয়ায় তার রাজধানীতে ফেরার পথে তিনি সেনানায়কদেরকে নির্দেশ দেন যে, পথিমধ্যে প্রত্যেক দুর্গ, শহর ও গ্রামে হানা দিয়ে সমস্ত বিধর্মীকে তরবারির খাদ্যে পরিণত করতে। তার বর্ণনা মতে: ‘আমার সাহসী সঙ্গীরা তাদেরকে পিছু ধাওয়া করে অনেককে হত্যা করে এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে বন্দি করে।’
কুতিলায় পৌঁছানোর পর তিনি সেখানকার বিধর্মীদেরকে আক্রমণ করেন। তিমুর লিখেছেন: ‘সামান্য প্রতিরোধের পর শত্রুরা পলায়ন করে, কিন্তু তাদের অনেকেই আমার সৈনিকদের তলোয়ারের নিচে পড়ে। বিধর্মীদের সকল স্ত্রী ও সন্তানকে বন্দি করা হয়।’
সামনে অগ্রসর হয়ে গঙ্গা-স্নান উৎসবের সময় গঙ্গাতীরে পৌঁছানোর পর তার যোদ্ধারা ‘বহু অবিশ্বাসীকে হত্যা করে এবং যারা পাহাড়ে পালিয়ে যায় তাদেরকে পিছু ধাওয়া করে।’ ‘লুণ্ঠনের মালামালের পরিমাণ ও সংখ্যা, যা আমার যোদ্ধাদের হস্তগত হয়, তা সকল গণনা ছাড়িয়ে যায়,’ লিখেছেন তিমুর। লুণ্ঠন দ্রব্যের মধ্যে অবশ্যই ছিল ক্রীতদাস।
তিনি সিউওয়ালিক পৌঁছালে, লিখেছেন তিমুর, ‘তাদেরকে দেখেই বিধর্মী ‘গাবর’রা পলায়ন করে। ধর্মযোদ্ধারা তাদেরকে পিছু ধাওয়া করে নিহতদের স্তূপ বানায়।’ অগণিত লুন্ঠন-দ্রব্য তার বাহিনীর হাতে আসে এবং ‘উপত্যকার সমস্ত হিন্দু নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করা হয়।’
নদীর অপর তীরে রাজা রতন সেন তিমুরের অগ্রসর হওয়ার খবর শুনে তার যোদ্ধাদের নিয়ে ত্রিসর্তর (কাংড়ার) দুর্গের ভিতরে আশ্রয় নেন। তিমুর লিখেছেন: দুর্গটি আক্রমণ করা হলে ‘হিন্দুরা ছত্র ভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে এবং আমার বিজয়ী যোদ্ধারা তাদেরকে ধাওয়া করলে মাত্র কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠন দ্রব্য কব্জা করে, যা ছিল গণনার অতীত। প্রত্যেকে ১০ থেকে ২০ জন করে ক্রীতদাস পায়।’ এর অর্থ দাঁড়ায়: এ আক্রমণে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার লোককে ক্রীতদাস বানানো হয় (ভুলক্রমে ২০০৯ ইংরেজী সংস্করণ-এ লিখা হয়েছে ২০ থেকে ৩০ হাজার)।
সিউওয়ালিক উপত্যকার অপর অংশে ছিল নগরকোট নামক হিন্দুস্তানের একটি বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। তিমুর উপসংহার টেনেছেন: এ আক্রমণে ‘পবিত্র ধর্মযোদ্ধারা মৃতদেহের বিশাল স্তূপ সৃষ্টি করে এবং বিপুল সংখ্যক বন্দিসহ ব্যাপক পরিমাণ লুণ্ঠিত মালামাল ও ক্রীতদাস নিয়ে বিজয়ী বীরেরা অতি উল্লসিত চিত্তে ফিরে যায়।’
দিল্লি থেকে ফেরার পথে তিমুর হিন্দু দুর্গ, নগরী ও গ্রামে প্রধান পাঁচটি আক্রমণ করেন। এছাড়াও অন্যান্য ছোট ছোট আক্রমণ করা হয়েছিল এবং প্রতিটিতে ক্রীতদাস শিকার করা হয়েছিল। কব্জাকৃত ক্রীতদাসদের আনুমানিক সংখ্যা একমাত্র কাংড়া আক্রমণের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়, যা ছিল ২ লাখ ২৫ হাজারের মতো। অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনুরূপ সংখ্যায় ক্রীতদাস ধরা হলে তিনি তার ফেরার পথে ১০ থেকে ১৫ লাখ ক্রীতদাস সংগ্রহ করেছিলেন। এর সঙ্গে যদি দিল্লিতে কব্জাকৃত ক্রীতদাসদের যুক্ত করা হয়, তাহলে তিনি অন্তত ২০ থেকে ২৫ লাখ ভারতীয় নাগরিককে ক্রীতদাস বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার রাজধানীতে। তিনি দিল্লিতে কয়েক হাজার শিল্পী ও কারিগরও বাছাই করেছিলেন তার রাজধানীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।[৫৪]
সৈয়দ ও লোদী শাসনালে (১৪০০-১৫২৫): তিমুরের অভিযানের পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে কত সংখ্যক লোককে ক্রীতদাস বানানো হয়, তা লেখা হয়নি; তবে বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিল থেকে ভাসাভাসা আভাস পাওয়া যায় মাত্র।[৫৫] দিল্লির ক্ষমতা বিধ্বস্ত করে তিমুরের প্রত্যাবর্তনের পর স্বল্প সময়ের জন্য তুঘলকরা ও পরে সৈয়দরা তাদের ক্ষমতা সংহত করতে অনেক অভিযান পরিচালনা করেন। ফেরিশতা লিখেছেন: সুলতান সৈয়দ মুবারকের শাসনামলে (১৪১৩-৩৫) মুসলিম বাহিনী কাটিহার লুন্ঠন করে ও বহু রাথোর রাজপুতকে ক্রীতদাস বানায় (১৪২২)। ১৪২৩ সালে আলয়ারে বহু মুয়াত্তি বিদ্রোহীকে ও ১৪৩০ সালে হুলকান্তের (গোয়ালিয়রে) রাজার প্রজাদেরকে বন্দি ও ক্রীতদাসরূপে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।[৫৬]
১৪৩০ সালে কাবুলের আমির শেখ আলী পাঞ্জাবের শিরহিন্দ ও লাহোর আক্রমণ করেন। ফেরিশতা লিখেছেন: লাহোরে ‘গুণে গুণে ৪০,০০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয় ও বিপুল সংখ্যক হিন্দুকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়’; টুলুম্বায় (মুলতানে) তার বাহিনী ‘স্থানটি লুটপাট করে, অস্ত্রবহনে সক্ষম সব পুরুষকে হত্যা করে এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে বন্দি করে নিয়ে যায়।’[৫৭]
সৈয়দদের অনুসরণে লোদী বংশ (১৪৫১-১৫২৬) সুলতানাতের কর্তৃত্ব পুনরায় সুপ্রতিষ্ঠিত করে এবং ক্রীতদাসকরণ প্রক্রিয়া যথারীতি অব্যাহত রাখে। লোদী রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান বাহলুল ‘ছিলেন এক স্বেচ্ছাচারী লুণ্ঠনকারী এবং বন্দিদেরকে দিয়ে তিনি এক শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন।’ নিমসারের (হারদয় জেলায়) বিরুদ্ধে আক্রমণে তিনি ‘সেখানকার বাসিন্দাদের হত্যা ও ক্রীতদাসকরণের মাধ্যমে স্থানটিকে একেবারে জনশূন্য করে ফেলেন।’ তার উত্তরসূরী সিকান্দার লোদী রেওয়া ও গোয়ালিয়র অঞ্চলে একই দৃশ্যের অবতারণা করেন।[৫৮]
মুঘল শাসনামলে (১৫২৬…): ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে ইব্রাহিম লোদীকে পরাভূত করার মাধ্যমে আমির তিমুরের গর্বিত উত্তরসূরী জহিরুদ্দিন শাহ বাবর ভারতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তার আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা ‘বাবরনামা’য় কোরান থেকে তুলে ধরা আয়াত ও সূত্রের অনুপ্রেরণায় তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদ অভিযান চালান বলে বর্ণনা করেছেন। বাবরের শাসনামলে তার ক্রীতদাসকরণের কথা পদ্ধতিগতভাবে লিখিত হয়নি।
বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অবস্থিত তৎকালীন ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য বাজাউর আক্রমণ সম্বন্ধে বাবর লিখেছেন: ‘তাদের উপর সাধারণ হত্যাকাণ্ড চালানো হয় এবং তাদের স্ত্রী-কন্যাদেরকে বন্দি করা হয়। আনুমানিক ৩,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। (আমি) আদেশ দিলাম যে, উচ্চস্থানে ছিন্ন-মস্তক দ্বারা একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।’[৫৯] একইভাবে তিনি আগ্রায় হিন্দুদের ছিন্ন-মস্তক দিয়ে স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। ১৫২৮ সালে তিনি কনৌজের শত্রুদেরকে আক্রমণ ও পরাজিত করেন এবং ‘তাদের পরিবার-পরিজন ও অনুসারীদেরকে বন্দি করা হয়’।[৬০] এসব দৃষ্টান্ত ইঙ্গিত করে যে, বাবরের ‘জিহাদ’ অভিযানগুলোতে নারী-শিশুদেরকে বন্দি ও ক্রীতদাসকরণ ছিল একটা সাধারণ নীতি বা অংশ। ‘বাবরনামা’য় উল্লেখ রয়েছে যে, হিন্দুস্তান ও খোরাসানের মধ্যে দু’টো প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল কাবুল ও কান্দাহারে, যেখানে উচ্চ মুনাফায় বিক্রির জন্য ভারত থেকে ক্রীতদাস (বার্দা) ও অন্যান্য পণ্যবোঝাই গাড়ির-বহর আসতো।
বাবরের মৃত্যুর পর (১৫৩০) তার পুত্র হুমায়ুন ও শেরশাহ সূরীর (একজন আফগান) মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে একটা বিক্ষুব্ধ সময় অতিবাহিত হয়। ১৫৬২ সালে বাবরের নাতি ইসলাম-ত্যাগী ‘আকবর দ্য গ্রেট’ যুদ্ধে পাইকারিহারে নারী-শিশুদের ক্রীতদাসকরণ নিষিদ্ধ করেন।[৬১] তবুও, লিখেছেন মোরল্যাণ্ড, ‘আকবরের শাসনকালে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই একটা গ্রাম বা গ্রামগুচ্ছে হানা দিয়ে বাসিন্দাদেরকে ক্রীতদাসরূপে তুলে নিয়ে আসা একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’ এ কারণে সম্রাট আকবর শেষ পর্যন্ত ক্রীতদাসকরণ নিষিদ্ধ করেন।[৬২] তবে গভীরভাবে প্রোথিত এ কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। নিষেধ সত্ত্বেও আকবরের সেনাধ্যক্ষ ও প্রাদেশিক শাসকরা নিজেদের ইচ্ছামতো অমুসলিমদের বাড়িঘর ও ধনসম্পদ লুণ্ঠন এবং তাদেরকে ক্রীতদাসকরণ অব্যাহত রাখে। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আকবরের স্বল্পকালীন এক প্রাদেশিক সেনাপতি আব্দুল্লাহ খান উজ্বেক ৫০০,০০০ (পাঁচ লক্ষ) নারী ও পুরুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে বিক্রয় করার কৃতিত্বে গর্ব প্রকাশ করেন। এমনকি আকবরও নিজস্ব আইনের অমর্যাদা করে ১৫৬৮ সালে চিতোরের যুদ্ধে নিহত রাজপুত সেনাদের স্ত্রী-কন্যাদেরকে ক্রীতদাসকরণের নির্দেশ দেন, যারা বিষপানে বা অগ্নিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিয়ে তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করেছিল। নিষিদ্ধ ঘোষণা সত্ত্বেও প্রদেশগুলোতে ক্রীতদাসকরণ অব্যাহত থাকে আকবরের আমলে। মোরল্যাণ্ড লিখেছেন: আকবরের শাসনকালে স্বাভাবিক সময়ে শিশুদেরকে চুরি বা অপহরণ ও বেচা-কেনা করা হতো; বাংলা ছিল এসব অপকর্মে কুখ্যাত, যেখানে তা সবচেয়ে বীভৎসরূপে (ক্রীতদাসদের খোজাকরণ ইত্যাদি) চর্চা করা হতো।[৬৩] এ কারণে আকবর ১৫৭৬ সালে ক্রীতদাসকরণ নিষিদ্ধ আইন পুনরায় জারি করতে বাধ্য হন। তার শাসনকালে ডেলা ভ্যাল তার প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যে জানান: চাকর ও ক্রীতদাসের সংখ্যা এত অগণন ও সস্তা যে, ‘প্রত্যেকেই, এমনকি দুর্ভাগা গরিবরাও, বড় বড় পরিবার রাখতো এবং চমৎকার সেবা-সহায়তা পেতো।’[৬৪] এসব দৃষ্টান্ত মহান আকবরের শাসনামলেও কী মাত্রায় ক্রীতদাসকরণ চলছিল তার একটা স্বচ্ছ ধারণা দেয়।
ক্রীতদাসকরণ পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটে আকবরের উত্তরসূরী জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭) ও শাহজাহানের (১৬২৮-৫৮) শাসনামলে। এ দুই সম্রাটের শাসনকালে গোঁড়ামি ও ইসলামিকরণ ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হয়। জাহাঙ্গীর তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: বাংলায় রাজস্ব পরিশোধে অপারগ পিতা-মাতারা আপন সন্তানদেরকে খোজা করে গভর্নরকে দিতো রাজস্বের পরিবর্তে। ‘এ চর্চা একেবারে সর্বজনীন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে’, লিখেছেন জাহাঙ্গীর। বেশ কয়েকটি তথ্য-দলিল জানায় যে, জাহাঙ্গীরের পরিষদের উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তা সৈয়দ খান চাগতাই একাই ১,২০০ খোজাকৃত ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন।[৬৫] জাহাঙ্গীর শুধুমাত্র ১৬১৯-২০ সালেই ২০০,০০০ বন্দিকৃত ভারতীয় ক্রীতদাসকে বিক্রির জন্য ইরানে পাঠিয়েছিলেন।[৬৬]
পরবর্তী সম্রাট শাহজাহানের অধীনে হিন্দু কৃষকদের অবস্থা ক্রমান্বয়ে অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছে। মুঘল আমলে ভারত সফরকারী পর্যটক মানরিকে দেখেন: কর আদায়কারী কর্মকর্তারা বিপন্ন ও দরিদ্র কৃষক ও তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে ধরে নিয়ে যেতো, কর আদায়ের জন্য তাদেরকে বিভিন্ন বাজার ও মেলায় বিক্রি করতে। ফরাসি চিকিৎসক ও পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার, যিনি ভারতে ১২ বছর বসবাস করেন ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন, তিনিও এরূপ ঘটনার সত্যতা জ্ঞাপন করেছেন। তিনি কর প্রদানে অপারগ দুর্ভাগা কৃষকদের সম্পর্কে লিখেছেন: তাদের শিশুদেরকে ক্রীতদাসরূপে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। মানরিকেও একই ঘটনার সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করেছেন।[৬৭] আওরঙ্গজেবের শাসনকাল (১৬৫৮-১৭০৭) হিন্দুদের জন্য ভয়ঙ্কর বিবেচিত। তার শাসনামলে কেবলমাত্র ১৬৫৯ সালেই গোলকুণ্ডা (হায়দরাবাদ) শহরে ২২,০০০ তরুণ বালককে খোজা করা হয়, শাসক ও গভর্নরদেরকে প্রদান কিংবা ক্রীতদাস-বাজারে বিক্রির জন্য।[৬৮]
ইরানের নাদির শাহ ১৭৩৮-৩৯ সালে ভারত আক্রমণ করেন। ব্যাপক নির্মম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের পর তিনি বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস সংগ্রহ করেন এবং বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত মালামালসহ তাদেরকে নিয়ে চলে যান। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে আফগানিস্তান থেকে আহমাদ শাহ আবদালী তিন-তিন বার ভারত আক্রমণ করেন। ‘পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ’ (১৭৬১) বিজয়ী হয়ে তিনি নিহত মারাঠা সেনাদের ২২,০০০ স্ত্রী-সন্তানকে ক্রীতদাসরূপে বন্দি করে নিয়ে যান।[৬৯] ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতে সর্বশেষ স্বাধীন মুসলিম শাসক টিপু সুলতান ত্রিবাঙ্কুরে ৭,০০০ লোককে ক্রীতদাস করেছিলেন। তাদেরকে অন্যত্র উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়।[৭০] যতদিন মুসলিমরা ভারতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব খাটিয়েছে, ততদিন বিধমীর্দেরকে ক্রীতদাসকরণ পুরোদমে চলেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে ব্রিটিশদের ক্ষমতা সংহত হওয়ার সাথে ক্রীতদাসকরণ কর্মকাণ্ড রুদ্ধ হতে থাকে। ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে যে, এমনকি ১৯৪৭ সালে ভারত-ভাগের সময়ও মুসলিমরা হাজার হাজার হিন্দু ও শিখ নারীকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক মুসলিম বানিয়ে মুসলিমদের সঙ্গে বিয়ে দেয়; এটা দীর্ঘকালব্যাপী ইসলামি ক্রীতদাসকরণের কিছুটা নমনীয় রূপ মাত্র। এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে হামলাকারী পাঠান মুসলিমরা কাশ্মীর থেকে হিন্দু ও শিখ মেয়েদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের ঝেলুম জেলার বাজারে বিক্রি করেছে।[৭১]
উপরোক্ত আলোচনা প্রধানত উত্তর ভারতে মুসলিম আক্রমণকারী ও শাসকদের ক্রীতদাসকরণের খতিয়ান মাত্র। গুজরাট, মালোয়া, জৈনপুর, খান্দেশ, বাংলা ও দক্ষিণাত্যসহ ভারতের দূর-দূরান্তের প্রদেশসমূহ − যেগুলো ছিল কখনো দিল্লির নিয়ন্ত্রণাধীন কখনো স্বাধীন মুসলিম সুলতানাত − সেসব অঞ্চলের সর্বত্রও ক্রীতদাসকরণ উদ্দীপনার সাথে চলতে থাকে। কিন্তু ওসব অঞ্চলে ক্রীতদাসকরণের তথ্য পদ্ধতিগতভাবে লিখিত হয়নি।
[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ অন্যত্র মুসলিমদের দ্বারা দাসকরণ]
সূত্রঃ
13. Eliot HM & Dawson J, The History of India As Told By Its Own Historians, Low Price Publications, New Delhi Vol. I, p. 119-20; Sharma SS (2004) Caliphs and Sultans: Religious Ideology and Political Praxis, Rupa & Co, New Delhi, p. 95
14. Lal (1994), p. 17
15. Elliot & Dawson, Vol. I, p. 173
16. Ibid, p. 181
17. Sharma, p. 95-96
18. Elliot & Dawson, Vol. I, p. 122-23, 203
19. Ibid, p. 125-26
20. Ibid, p. 127
21. Ibid, Vol. II, p. 246
22. Ibid, p. 247-48
23. Ibid, Vol. I, p. 128
24. Ibid, Vol. II, p. 419
25. Ibid, p. 25-26
26. Lal (1994), p. 19-20
27. History of Punjab: Ghanznivide Dynasty, http://www.punjabonline. com/servlet/library.history?Action=Page&Param=13
28. Elliot & Dawson, Vol. II, p. 135, 139-40
29. Ibid, Vol. V, p. 559-60; Lal (1994), p. 23
30. Elliot & Dawson, Vol. II, p. 251
31. Ferishtah MK (1997 print) History of the Rise of the Mahomedan Power in India, translated by John Briggs, Low Price Publication, New Delhi , Vol. I, p. 111
32. Elliot & Dawson, Vol. II, p. 232; also Lal (1994), p. 42
33. Elliot & Dawson, Vol. II, p. 234-35
34. Lal (1994), p. 44
35. Ibid, p. 43
36. Elliot & Dawson, Vol. II, p. 251
37. Ibid, p. 306
38. Ibid, p. 308-09
39. Ibid, p. 325
40. Lal (1994), p. 44-45
41. Ferishtah, Vol. I, p. 130
42. Elliot & Dawson, Vol. II, p. 348; also Ferishtah, Vol. I, p. 131
43. Elliot & Dawson, Vol. II, p. 351
44. Lal (1994), p. 46-48
45. Elliot & Dawson, Vol. III, p. 105
46. Lal (1994), p. 48
47. Ibid, p. 49-51
48. Ibid, p. 51
49. Gibb, HAR (2004) Ibn Battutah: Travels in Asia and Africa, D K Publishers, New Delhi, p. 214
50. Lal (1994), p. 51-52
51. Elliot & Dawson, III, p. 297
52. Lal (1994), p. 53
53. Elliot & Dawson, Vol. III, p. 435-71; Bostom AG (2005) The Legacy of Jihad, Prometheus Books, New York, p. 648-50
54. Lal (1994), p. 86
55. Ibid, p. 70-71
56. Ferishtah, Vol. I, p. 299-303
57. Ibid, p. 303, 306
58. Lal (1994), p. 86
59. Babur JS (1975 print) Baburnama, trs. AS Beveridge, Sange-Meel Publications, Lahore, p. 370-71
60. Ferishtah, Vol. II, p. 38-39
61. Nazami KA (1989) Akbar and Religion, Idarah-i-Adabiyat-i-Delhi, New Delhi, p. 106
62. Moreland WH (1995) India at the Death of Akbar, Low Price Publications, New Delhi, p. 92
63. Ibid, p. 92-93
64. Ibid, p. 88-89
65. Lal (1994), p. 116-117
66. Levi SC (2002), (2002) Hindus Beyond the Hindu Kush: Indian in the Central Asian Slave Trades, Journal of the Royal Asiatic Society, 12(3), p. 283-84
67. Lal (1994), p. 58-59
68. Ibid, p. 117
69. Ibid, p. 155
70. Hasan M (1971) The History of Tipu Sultan, Akbar Books, Delhi, p. 361-63
71. Talib, SGS (1991) Muslim League Attack on Sikhs and Hindus in the Punjab 1947, Vice of India, Delhi, p. 201

ইসলামে বর্বরতা (দাসত্ব-অধ্যায়—৪)

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো। এ পর্বে আলোচিত হয়েছেঃ অন্যত্র মুসলিমদের দ্বারা দাসকরণ]
ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ৪
লেখক: এম, এ, খান
অন্যত্র মুসলিমদের দ্বারা দাসকরণ
মুসলিম হানাদার ও শাসকরা সর্বত্রই তাদের হামলার শিকার ও যুদ্ধে পরাজিত বিধর্মীদেরকে বিপুল সংখ্যায় ক্রীতদাসকরণের কাজে লিপ্ত হয়েছে। বিক্রি বা গৃহকর্মে নিয়োগ ও উপপত্নীকরণে নবি মুহাম্মদ কর্তৃক অমুসলিমদেরকে পাইকারিভাবে ক্রীতদাসকরণের অভিষেকের পর তা ক্রমান্বয়ে গতি ও বিস্তার লাভ করে সঠিক পথে পরিচালিত খলিফাগণ (৬৩২-৬৬০) এবং উমাইয়া (৬৬১-৭৫০) ও আব্বাসীয় (৭৫১-১২৫০) শাসনকালের মধ্য দিয়ে ইসলামি ক্ষমতা উত্তরোত্তর বর্ধিত হওয়ার সাথে সাথে।
খলিফা ওমরের নির্দেশে মুসলিম সেনাপতি আমর ৬৪৩ সালে ত্রিপোলি জয় করে খ্রিষ্টান-ইহুদি উভয় ধর্মের নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করে নিয়ে আসেন। নবম শতকের ইতিহাসবিদ আবু খালিফ আল-ভূটুরি জানান: খলিফা ওসমান ৬৫২ সালে পরাভূত নুবিয়ার (সুদান) শাসকদের উপর একটা চুক্তি আরোপ করেন আনুগত্যকর হিসেবে প্রতিবছর ৩৬০ জন ক্রীতদাস খলিফাকে ও ৪০ জন মিশরের গভর্নরকে পাঠানোর শর্তে।[৭২] ১২৭৬ সাল পর্যন্ত এ চুক্তিটি কার্যকর থাকে। একই ধরণের চুক্তি আরোপ করেছিল উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরা ট্রানসক্সিয়ানা, সিজিস্তান, আর্মেনিয়া ও ফেজান (আধুনিক উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা)-এর শাসকদের সঙ্গে, যাদেরকে প্রতিবছর নারী-পুরুষ উভয় লিঙ্গের নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রীতদাস আনুগত্য-কর হিসেবে প্রদান করতে হতো।[৭৩] উমাইয়া শাসনামলে বিশিষ্ট ইয়েমেনি সেনানায়ক মুসা বিন নুসায়েরকে নবোত্থিত বার্বার বিদ্রোহ দমন ও ইসলামের পরিসর বৃদ্ধির জন্য উত্তর আফ্রিকার গভর্নর নিযুক্ত করা হয় (ইফ্রিকিয়া, ৬৯৮-৭১২)। মুসা সফলভাবে সে বিদ্রোহ দমনকালে ৩০০,০০০ বিধর্মীকে ক্রীতদাস হিসেবে বন্দি করেন। খলিফার এক-পঞ্চমাংশ হিস্যার ৬০,০০০ বন্দিকে দাস-বাজারে বিক্রি করে দিয়ে গৃহিত অর্থ খলিফার কোষাগারে জমা করা হয়। মুসা বন্দিদের মধ্যে থেকে ৩০,০০০-কে তার সেনাবাহিনীতে যুক্ত করেন।[৭৪]
স্পেনে তার চার বছরের অভিযানে (৭১১-১৫) মুসা কেবলমাত্র সম্ভ্রান্ত গোথিক পরিবারগুলো থেকেই ৩০,০০০ অবিবাহিত বালিকাকে আটক করেছিলেন।[৭৫] এ সংখ্যা ছিল ক্রীতদাসকৃত অন্যান্য নারী-শিশুদের থেকে ভিন্ন। ৭৮১ সালে এফিসাস (বর্তমান তুর্কিতে) লুট ও ধ্বংসযজ্ঞে ৭,০০০ গ্রিককে ক্রীতদাসরূপে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ৮৩৮ সালে আমোরিয়াম (তুর্কিতে) দখলে বন্দিকৃত ক্রীতদাসের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে, খলিফা আল-মুতাসিম তাদেরকে পাঁচ ও দশজনের দলে ভাগ করে নিলামে বিক্রি করার নির্দেশ দেন। থেসালোনিয়া আক্রমণে (গ্রিস, ৯০৩ সাল) ২২,০০০ খ্রিষ্টানকে ক্রীতদাস করে সেনানায়কদের মাঝে ভাগ কিংবা বিক্রি করে দেওয়া হয়। ১০৬৪ সালে আল্প আরসালান-এর জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া ধ্বংসযজ্ঞে বিপুল সংখ্যক লোক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় এবং জীবিত অবশিষ্টদেরকে ক্রীতদাস করা হয়। স্পেনের আলমোহাদ খলিফা ইয়াকুব আল-মনসুর ১১৮৯ সালে লিসবন আক্রমণ করে প্রায় ৩,০০০ নারী-শিশুকে ক্রীতদাস বানান। ১১৯১ সালে তার কর্ডোভাস্থ গভর্নর পর্তুগালের সিলভে আক্রমণ করে ৩,০০০ নারী-শিশুকে ক্রীতদাস বানান।[৭৬]
১১৮৭ সালে ক্রুসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে নিয়ে সুলতান সালাহুদ্দিন নগরীর খ্রিষ্টান জনগণকে ক্রীতদাস বানিয়ে বিক্রি করে দেন। ১২৬৮ সালে অ্যান্টিওক দখল করে মামলুক সুলতান আল-জাহির বেইবার (শাসনকাল ১২৬০-৭৭) গ্যারিসনের ১৬,০০০ প্রতিরোধকারী যোদ্ধাকে তলোয়ারের ডগায় হত্যার পর সে স্থানের ১০০,০০০ লোককে ক্রীতদাস বানান। হিট্টি লিখেছেন: ‘দাস-বাজার এতই ভরপুর হয়ে উঠে যে, একজন দাস-বালক মাত্র বার দিরহামে ও দাস-বালিকা পাঁচ দিরহামে বিক্রি হয়।’[৭৭]
ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মুসলিমরা ক্ষমতাগ্রহণের মাধ্যমে দাসপ্রথাকে এমন এক স্তরে পৌঁছে দেয় যে, এক শতাব্দী পর পর্তুগিজরা এসে দেখে প্রায় সব মানুষই কোনো না কোনো দাস-মালিকের অধীন; আর মালিকের মধ্যে আরবরা বা আরব-বংশোদ্ভূতরা ছিল শীর্ষ স্থানে। এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মুসলিম শাসকরা একটা ভূখণ্ড দখল করার পর কখনো কখনো গোটা জনসংখ্যাকেই দাস হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে। মুসলিম শাসকরা জনসংখ্যার একটা বড় অংশ, যারা পাহাড়ে বাস করতো, তাদের প্রায় সবাইকে হামলা ও ক্রয়ের মাধ্যমে ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল। মালয় বিজয়ের পর আচেহ্ সুলতান ইস্কান্দর মুদা (১৬০৭-৩৬) হাজার হাজার ক্রীতদাসকে তার রাজধানীতে নিয়ে আসেন। ১৫০০ শতাব্দীর দিকে জাভা হয়ে উঠেছিল প্রধান ক্রীতদাস রপ্তানিকারক। গ্রন্থকার রীড জানান, এসব ক্রীতদাসকে ‘ইসলামিকরণমূলক যুদ্ধে’ আটক করা হতো।[৭৮] ফিলিপিনে স্পেনীয়রা মুসলিম অঞ্চল দখল করে নেওয়ার অবিরাম হুমকি হওয়া সত্ত্বেও সুলু সুলতানাত ১৬৬৫ ও ১৮৭০ সালের মধ্যে মোরো জিহাদী মুসলিমদের হামলার মাধ্যমে স্পেনীয় নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে প্রায় ২৩ লক্ষ ফিলিপিনোকে ক্রীতদাস করে নিয়ে আসে। ১৮৬০ থেকে ১৮৮০’র দশকের শেষদিক পর্যন্ত মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের মুসলিম-শাসিত অঞ্চলে ক্রীতদাসরা ছিল মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ থেকে দুই-তৃতীয়াংশ।
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে মরক্কোর সুলতান মৌলে ইসমাইল (১৬৭২-১৭২৭) ২৫০,০০০ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের এক বিশাল সামরিক বাহিনী গড়েছিলেন।[৭৯] ১৭২১ সালে মৌলে ইসমাইল এটলাস পর্বতের এক বিদ্রোহী ভূখণ্ডে হামলার নির্দেশ দেন, সেখানকার জনগণ সুলতানকে আনুগত্যকর প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে। বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করার পর তাদের সকল সমর্থ পুরুষকে হত্যা করে নারী-শিশুদেরকে রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়। এর পরপরই তিনি তার পুত্র মৌলে আস-শরীফের নেতৃত্বে ৪০,০০০ শক্তিশালী এক যোদ্ধাবাহিনীকে গুজলান বিদ্রোহী নগরীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন, কারণ তারাও আনুগত্যকর প্রদান বন্ধ করেছিল। প্রচণ্ড যুদ্ধের মুখে বিদ্রোহীরা জয়ের কোনো আশা নেই দেখে আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু মৌলে আস-শরীফ প্রত্যেককে হত্যা করে মস্তক ছিন্ন করার নির্দেশ দেন।[৮০] তাদের নারী ও শিশুদেরকে অনিবার্যরূপেই ক্রীতদাসকরণের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গিনি (আফ্রিকা, বর্তমানে ৮৫ শতাংশ মুসলিম) মুসলিম শাসনাধীনে আসে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এ শতকেরই শেষ দিকে ‘আপার গিনি উপকূলে এক-এক জন নেতা বা সর্দারের অধীনে ১,০০০ বাসিন্দা অধ্যুষিত ‘ক্রীতদাস-নগরী’ ছিল।’ ১৮২৩ সালে ইসলামি সিয়েরালিওন ভ্রমণ করতে গিয়ে মেজর লেইং ফালাবা’য় ‘ক্রীতদাস নগরী’ প্রত্যক্ষ করেন, যা ছিল সালিমা সুসু’র রাজধানী।[৮১] ওসব ক্রীতদাসরা নগরী-প্রধানের কৃষিখামারে কাজ করতো। খ্যাতিমান সুলতান সৈয়দ সাঈদের পূর্ব আফ্রিকার সাম্রাজ্য, যার রাজধানী ছিল জাঞ্জিবার (১৮০৬-৫৬), ‘সেটা গড়েছিলেন ক্রীতদাসের উপর ভিত্তি করেই… সেখান থেকে ক্রীতদাসদেরকে উত্তর আফ্রিকা ও পারস্যের বাজারগুলোতে পাঠানো হতো গৃহকর্মে ব্যবহার বা উপপত্নীরূপে বিক্রির জন্য।’[৮২]
ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল লেখক রোনাল্ড সিগল জানান,[৮৩] সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে মুসলিম বাহিনীতে নিযুক্ত করার জন্য দশ থেকে বার বছর বয়সের বিপুল সংখ্যক আফ্রিকার শিশুকে ধরা হতো ক্রীতদাসরূপে। পারস্য থেকে মিশর, মিশর থেকে মরক্কো, পর্যপ্ত ৫০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ হাজারের ক্রীতদাস-বাহিনী ছিল মামুলি ব্যাপার।[৮৪] অটোমান জানিসারি সেনাদেরকে সংগ্রহের মতোই (নিচে আলোচিত) সুলতান মৌলে ইসমাইল কৃষ্ণাঙ্গ-ক্রীতদাস উৎপাদন খামার ও নার্সারি থেকে দশ-বছর-বয়স্ক শিশুদেরকে বাছাই করে খোজা করার পর দুর্ধর্ষ যোদ্ধারূপে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ দিতেন। এসব যোদ্ধাদেরকে বলা হতো ‘বোখারী’, কেননা তাদেরকে ‘সহি বোখারী’ স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করানো হতো সুলতানের প্রতি আনুগত্যের নিমিত্তে। উৎকৃষ্ট বোখারীরা হতো সুলতানের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও প্রাসাদরক্ষী; বাকিদেরকে প্রদেশগুলোতে সামরিক কর্মকাণ্ড পালনে নিযুক্ত করা হতো। রাজধানী মেকনেস রক্ষার জন্য তিনি রাখতেন ২৫,০০০ বোখারী; ৭৫,০০০ মোতায়েন করেছিলেন গ্যারিসন নগরী মাহাল্লায়।[৮৫]
পল লাভজয়ের হিসাব অনুযায়ী (ট্রান্সফর্মেশনস ইন শ্লেইভারী, ১৯৮৩), কেবলমাত্র উনবিংশ শতাব্দীতেই আফ্রিকা ও লোহিত সাগরের উপকূল থেকে ২০ লক্ষ ক্রীতদাসকে মুসলিম বিশ্বে পাঠানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে ৮০ লক্ষ লোক মারা যেয়ে থাকতে পারে, কেননা ক্রীতদাসকরণ অভিযান থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত মৃত্যু হার ছিল ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। অষ্টাদশ শতাব্দীর হিসাব অনুযায়ী আফ্রিকায় ১,৩০০,০০০ জন (১৩ লাখ) কৃষ্ণাঙ্গকে ক্রীতদাস করা হয়। লাভজয় হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আফ্রিকা থেকে মোট ১১,৫১২,০০০ জন (১ কোটি ১৫ লক্ষ ১২ হাজার) ক্রীতদাসকে মুসলিম বিশ্বে পাচার করা হয়। অপরদিকে রেইমন্ড মুভি (‘দ্যা আফ্রিকান শ্লেইভ ট্রেইড ফ্রম দ্যা ফিফটিন্থ টু দ্যা নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি’, ইউনেস্কো, ১৯৭১) মোট সংখ্যা দেখিয়েছেন ১ কোটি ১৪ লক্ষ, যার মধ্যে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আটককৃত ৩০০,০০০ জন ক্রীতদাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।[৮৬] মারে গর্ডনের ‘শ্লেইভারি ইন দ্য আরব ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে মুসলিম ক্রীতদাস-শিকারিদের দ্বারা সংগৃহীত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের সংখ্যা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ১০ লক্ষ। এ সংখ্যা নিউ ওয়ার্ল্ড বা নতুন বিশ্বের (উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ) উপনিবেশগুলোতে ইউরোপীয় বণিকদের নিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের সংখ্যার প্রায় সমান। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সুদানের দারফুর থেকে ক্রীতদাস বোঝাই গাড়িবহরগুলোতে এক যাত্রায় ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ ক্রীতদাস কায়রোতে নিয়ে যাওয়া হতো। এমনকি ১৮১৫ সালে ইউরোপ দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করার পর তা বন্ধ করতে মুসলিম সরকারগুলোকে চাপ প্রয়োগ সত্ত্বেও, ‘১৮৩০ সালে জাঞ্জিবারের সুলতান ৩৭,০০০ ক্রীতদাসের বাৎসরিক পাওনা দাবি করেন; ১৮৭২ সালে সুয়াকিন (আফ্রিকা) হতে ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ ক্রীতদাস আরবাঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে’, লিখেছেন ব্রডেল।[৮৭]
[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ অটোমান দিউশারমি (ক্রীতদাস সংগ্রহ প্রথা)]
সূত্রঃ
72. Vantini G (1981) Christianity in the Sudan, EMI, Bologna, p. 65-67
73. Ibn Warraq (1995) Why I am not a Muslim, Prometheus Books, New York, p. 231
74. Umayyad Conquest of North Africa, Wikipedia, http://en.wikipedia.org/ wiki/Umayyad_conquest_of_North_Africa
75. Lal KS (1999) Theory and Practice of Muslim State in India, Aditya Prakashan, New Delhi, p 103; Hitti PK (1961) The Near East in History, D. Van Nostrand Company Inc., New York, p. 229-30
76. Brodman JW (1986) Ransoming Captives in Crusader Spain: The Order of Merced on the Christian-Islamic Frontier, University of Pennsylvania Press, Philadelphia, p. 2-3
77. Hitti (1961), p. 316
78. Reid A (1988) Southeast Asia in the Age of Commerce 1450–1680, Yale University Press, New Haven, p. 133
79. Lewis B (1994) Race and Savery in Middle East, Oxford University Press, Chapter 8, http://www.fordham.edu/halsall/med/ewis 1.html
80. Milton G (2004) White Gold, Hodder & Stoughton, London, p. 143, 167-71
81. Rodney W (1972) In MA Klein & GW Johnson eds., Perspectives on the African Past, Little Brown Company, Boston, p. 158
82. Gann L (1972) In Ibid, p. 182
83. Segal emphasizes that anti-Semitism is in complete conflict with the amicable relationship Prophet Muhammad had established with Judaism and Christianity. He asserts that there is no historical conflict between Jews and Muslims, although some conflict arose only after the crusades. Such assertions go directly against Prophet’s exterminating or exiling the Jews of Medina and Khaybar and his final instruction, while in death-bed, to cleanse Arabia of the Jews and Christians. He also urged his followers to killl the Jews and Christians. He also urged his followers to kill the jews to the last one (Sahih Muslim, 41:6985)
84. Segal R (2002) Islam’s Black Slaves, Farrar, Straus and Giroux, New York, p. 55
85. Milton, p. 147-150
86. Segal R (2002) Islam’s Black Slaves, Farrar, Straus and Giroux, New York, p. 56-57
87. Braudel F (1995) A History of Civilizations, Translated by Mayne R, Penguin Books, New York, p. 131


ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ৫

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো। এ পর্বে আলোচিত হয়েছেঃ অটোমান দিউশারমি (ক্রীতদাস সংগ্রহ প্রথা)]
লেখক: এম, এ, খান
অটোমান দিউশারমি (ক্রীতদাস সংগ্রহ প্রথা)
ইসলামি দাসপ্রথার একটা অতি নিন্দিত ব্যবস্থা হলো অটোমান সাম্রাজ্যে প্রচলিত ‘দিউশারমি’ প্রথা, যা অটোমান সুলতান ওরখান প্রবর্তন করেছিলেন ১৩৩০ সালে। এ প্রকল্প অনুযায়ী অটোমান সাম্রাজে বসবাসকারী খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম পরিবারের ৭ থেকে ২০ বছর বয়স্ক বালকদের একটা অংশকে যোগাড় করা হতো। নীতিটির প্রবর্তন সম্বন্ধে বার্নার্ড লুইস ষষ্ঠদশ শতকের অটোমান ইতিহাসবিদ সাদেদ্দীন (হোক্কা ইফেন্দি)-এর উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেছেন এভাবে:
‘খ্যাতিমান রাজা… তার রাজ্যের মন্ত্রীদের নিয়ে এক আলোচনায় বসেন, যাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ভবিষ্যতে অবিশ্বাসীদের সন্তানদের মধ্য থেকে কর্মক্ষম সাহসী ও পরিশ্রমী যুবকদেরকে বাছাই করা হবে; তাদেরকে ইসলাম ধর্মের দ্বারা মর্যাদাবান করা হবে, যা হবে তাদেরকে ধনী ও ধার্মিক করার একটা উপায় এবং অবিশ্বাসীদের শক্তিকেন্দ্র ধ্বংস করার এক মোক্ষম উপায়ও।’[৮৮]
এ পরিকল্পনার অধীনে অটোমান শাসনাধীন গ্রিস, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, জর্জিয়া, ম্যাসিডোনিয়া, বস্নিয়া-হার্জেগোভিনা, আর্মেনিয়া ও আলবেনিয়া থেকে অমুসলিম শিশুদেরকে চয়ন করা হতো। নির্দিষ্ট দিনে অমুসলিম পিতাকে (প্রধানত খ্রিষ্টান) একটা নির্দিষ্ট খোলা মাঠে তাদের সন্তানদেরকে নিয়ে আসতে হতো। মুসলিম নিয়োগ কর্মকর্তারা তাদের মধ্য থেকে স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী ও সুঠামদেহী বালকদেরকে বাছাই করতো। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত কনস্টান্টিনোপল (পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুল) জয় করার পর ‘দিউশারমি’ প্রথা ব্যাপক প্রসার লাভ করে, যে বিষয়ে স্টিফেন ও’শিয়া লিখেছেন: ‘এ বিজয়ের সূত্র ধরে ফাতিহ্ (বিজয়ী সুলতান) নিষ্ঠুর ‘দিউশারমি’ বা ‘সংগ্রহ’ পদ্ধতিটি সম্প্রসারিত করেন, যার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক খ্রিষ্টান তরুণকে অপহরণ করে রাজধানীতে আনা হতো… কয়েক বছর পর পর মেধাবী বালক সংগ্রহকারী কর্মকর্তারা সৈনিকদের সাথে গ্রামে গ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে খেলার সাথী ও জ্ঞাতিদের মধ্য থেকে প্রতিশ্রুতিশীল কৃষক-সন্তানদেরকে বাছাই করে ধরে নিয়ে যেতো।’[৮৯] ‘দিউশারমি’ প্রথার মাধ্যমে সংগ্রহকৃত শিশুদের সংখ্যার ব্যাপারে ‘কোনো কোনো পণ্ডিত এ সংখ্যা বছরে ১২,০০০ বলে উল্লেখ করেছেন, কেউ কেউ বলেছেন ৮,০০০; তবে সম্ভবত গড়ে বছরে কমপক্ষে ১০,০০০ বলে ধরা যেতে পারে।’[৯০]
এভাবে সংগ্রহকৃত উৎকৃষ্টতর খ্রিষ্টান, ইহুদি ও জিপ্সি (বেদুইন) সন্তানদেরকে সুন্নত দিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হতো। অতঃপর সহজেই প্রভাবান্বিত হওয়ার মতো এ তরুণ বয়স থেকেই তাদেরকে জিহাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হতো এবং অটোমান বাহিনীর জ্যানিসারি রেজিমেন্টের অধীনে জিহাদী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ব্যারাকে আবদ্ধ ও বিবাহ-নিষিদ্ধ এসব তরুণের জীবনের শুধু একটাই লক্ষ্য ছিল: অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, কয়েক বছর আগেও যারা ছিল তাদেরই জাতি ও ধর্মের মানুষ।
এ নীতিটি অটোমান শাসকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠে। মুসলিম শাসকরা খ্রিষ্টান ধর্মের সর্ববৃহৎ ও আকর্ষনীয় কেন্দ্রস্থল কনস্টান্টিনোপল দখলের জন্য খলিফা মুয়াবিয়ার (মৃত্যু ৬৮০) আমল থেকে বারংবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। অতীতে কনস্টান্টিনোপল দখলের অভিযানে বহুবার তারা মারাত্মকভাবে মার খেয়েছিল। পরিশেষে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে জ্যানিসারিরা কনস্টান্টিনোপলের উপর ভয়ানকভাবে চড়াও হয়ে তা জয় করে ইসলামের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার বয়ে আনে। তৎকালীন অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত জ্যানিসারিদেরকে তিন দিন ধরে এক-কালীন তাদেরই স্বধর্মী লোকদেরকে পাইকারি হারে হত্যা ও নগরীর সর্বত্র লুটতরাজ করার অনুমতি দেন। যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদেরকে ক্রীতদাস করা হয়। পরে বাছ-বাছাইহীনভাবে জ্যানিসারি রেজিমেন্টে সৈনিক নিয়োগ করা হয়, যখন ‘দিউশারমি’র অংশরূপে মুসলিমদেরকে, এমনকি অনেক সুফিকেও, জ্যানিসারি বাহিনীতে নিযুক্ত করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে রেজিমেন্টটিতে শৃঙ্খলা ও দৃঢ়তা ভেঙ্গে পড়ে, যার সাথে সাথে ঘটনাক্রমে অটোমান শক্তির পতনেরও সূচনা হয়।
‘দিউশারমি’ প্রথা এ সত্যটির সাক্ষী হয়ে রয়েছে: কীভাবে ইসলামি বিশ্ব বিধর্মীদেরই শক্তি বা বাহুবলকে তাদের ভূখণ্ড দখলে ব্যবহার করতো! দিউশারমি প্রথাকে অনুকরণ করে সমকালীন ভারতে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনকাল ১৩৫১-৮৮) একই উপায়ে হিন্দু শিশুদেরকে তার বাহিনীতে নিয়োগ করতেন। তিনি প্রাদেশিক কর্মকর্তা ও সেনাধ্যক্ষদেরকে নির্দেশ দেন উৎকৃষ্ট অমুসলিম তরুণদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে ধরে এনে তার দরবারে পাঠিয়ে দিতে। এ প্রক্রিয়ায় তিনি ১৮০,০০০ তরুণকে ক্রীতদাসরূপে যোগাড় করেছিলেন।[৯১]
দিউশারমি প্রথার সমালোচনা: ১৬৫৬ সালে বিলুপ্ত হওয়া অটোমান ‘দিউশারমি’ ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্রীতদাস সংগ্রহের প্রক্রিয়া ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তবে গোঁড়া অটোমান শাসকরা, যারা সুন্নি শরীয়া আইন মোতাবেক রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি বিধিবদ্ধ করতেন, ‘দিউশারমি’ প্রথা প্রণয়নে কোরান ও ইসলামি আইনে তারা যথেষ্ট যৌক্তিকতা ও সমর্থন পান। কোরানের ৮:৪২ নং আয়াতে বলা হয়েছে: ‘এবং জেনে রাখো যে, তোমরা যা কিছুই (যুদ্ধে লুণ্ঠিত মালামাল) কব্জা করো, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর ও তাঁর নবির।’
যুদ্ধে অর্জিত মালামালের এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত নবির জন্য বরাদ্দ। প্রাথমিক পর্যায়ে এটা যেতো নবি মুহাম্মদ-কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত তাঁর উদীয়মান ইসলামি রাষ্ট্রের কোষাগারে। তাঁর মৃত্যুর পর এ অংশটি যেতো খলিফার রাজকোষে। জিম্মি প্রজাদের নিকট থেকে খলিফা ওমরের ঘোষিত করনীতির অধীনে ‘খারাজ’ হিসেবে আদায় করা হতো উৎপাদিত পণ্যের কমপক্ষে এক-পঞ্চমাংশ, যদিও বিশেষ পরিস্থিতিতে অথবা খামখেয়ালি মুসলিম শাসকদের অধীনে প্রায়শই তা আরো উচ্চহারে আদায় করা হতো। যেহেতু অবিশ্বাসীদের নবজাতক শিশুরাও ছিল রাষ্ট্রের এক ধরনের উৎপাদিত সম্পদ, সে সূত্রে পবিত্র ইসলামি আইনে ‘দিউশারমি’ প্রথা বৈধতা পায়। নবি নিজেই খ্রিষ্টান শিশুদেরকে জোরপূর্বক সংগ্রহ করার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলেন, যখন তিনি তাগলিব গোত্রকে তাদের সন্তানদেরকে ব্যাপটাইজকরণ নিষিদ্ধ করেন, যার মাধ্যমে সেসব সন্তানরা মুসলিম হিসেবে গৃহিত হয়। পরে খলিফা ওমরও আরেকটি তাগলিব গোত্রকে নির্দেশ দেন তাদের সন্তানদেরকে চিহ্নিত (কব্জিতে ‘ক্রস’ চিহ্ন প্রদান) না করতে ও তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা না দিতে (অর্থাৎ ব্যাপটাইজ না করতে)।[৯২] এর ফলে, সেসব শিশুরা ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তবে একটা মাত্র পার্থক্য রয়েছে: ‘সংগ্রহ’ বা ‘দিউশারমি’ প্রথার মাধ্যমে অটোমানরা কেড়ে নিতো মাত্র এক-পঞ্চমাংশ বা তারও কম অমুসলিম সন্তানকে; কিন্তু নবি ও খলিফা ওমর সংগ্রহ করেছিলেন তাগলিব গোত্রদ্বয়ের সমস্ত শিশুকে।
কোরানের এরূপ অনুমোদন ও নবির দৃষ্টান্ত খলিফা ওমর কর্তৃক পালনের পর, সঠিক পথে পরিচালিত খলিফা ওসমান ‘দিউশারমি’র মত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন নুবিয়ার খ্রিষ্টানদেরকে আনুগত্য-কর হিসেবে প্রতিবছর কায়রোতে ক্রীতদাস পাঠাতে বাধ্য করে (৬৫২-১২৭৬); একইরকম চুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে, যা ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ‘দিউশারমি’ নীতি অটোমানদের আবিষ্কার নয়। অধিকন্তু অটোমানদের প্রবর্তিত এ নীতি অনেক বেশি মানবিক ছিল নবি মুহাম্মদের ক্রীতদাস ধরার নীতির তুলনায়, যা তিনি বানু কোরাইজা, খাইবার ও মুস্তালিক ইহুদি গোত্রের উপর প্রয়োগ করেছিলেন, এবং যার মাধ্যমে তিনি আল্লহর স্বর্গীয় অনুমোদনে (কোরান ৩৩:২৬-২৭) সমস্ত সাবালক পুরুষকে হত্যা এবং নারি ও শিশুকে ক্রীতদাস করেছিলেন। বহু শতাব্দীব্যাপী ইসলামের বিজয় ও শাসনে ‘দিউশারমি’র চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও বর্বর নবি মুহাম্মদের এ ক্রীতদাসকরণ নীতি সাধারণভাবে প্রয়োগ করা হয়।
[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ক্রীতদাসদের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান]
সূত্রঃ
88. Lewis B (2000) The Middle East, Phoenix, London, p. 109
89. O’Shea S (2006) Sea of Faith: Islam and Christianity in the Medieval Mediterranean World, Walker & Company, New York, p. 279
90. Ibn Warraq, p. 231
91. Lal (1994), p. 57-58
92. Al-Biladhuri AY (1865) Kitab Futuh al-Buldan, Ed. KJ De Geoje, Leiden, p. 181