Saturday, August 6, 2016

সময় বিশ্লেষন ২

সময় সম্পর্কে এই আবর্তক ধারণা মানুষের মনে বেশ জোরালো প্রভাব ফেলেছিল। প্রাচীন ভারতীয়দের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় এই ধারনাই স্থায়ী আসন করে নেয়। তবে প্রাচীন ভারতীয়দের আবর্তক ধারণা কিছুটা আরও ব্যাপক আকারের। ওরা মনে করত- একই ঋতু বার বার ফিরে আসা, বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা ফিরে ফিরে ঘটা বা গ্রহদের ফিরে আসাই শুধু না; বরং সমগ্র মহাবিশ্বের সকল ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবে, আবার ধ্বংস হবে; আর এভাবে চলতেই থাকবে। প্রাচীনকালের বেশিরভাগ সভ্যতাই ছিল কৃষিনির্ভর। তাই এই আবর্তক ধারণা প্রায় সব প্রাচীন সমাজেই প্রভাব ফেলেছিল।

উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে সময়কে আমরা আজকে যেমন একটি রেখার মত কল্পনা করি যে- আমাদের পেছনে অসীম অতীত কাল ছিল, আর সামনেও অসীম ভবিষ্যৎ পরে রয়েছে, এমন ধারনাটা প্রাচীন সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল না । সময়ের রৈখিক ধারণার শুরু হয় সেমেটিক ধর্মবিশ্বাস থেকে। আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে বিশ্বাস করা হয় যে- এই মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট সময় আগে সৃষ্টি করা হয়েছিল, আর একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এটি ধ্বংস হয়ে যাবে । অর্থাৎ সেমেটিক ধারণা অনুযায়ী সময়ের রূপ কিছুটা “রৈখিক” । ফলে এই ধারণাকে কিছুটা আধুনিক বলা যেতে পারে।

প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সময় নিয়ে সবচেয়ে সচেতন ছিল মধ্য অ্যামেরিকার মায়া সভ্যতা। মায়ানরাই সর্বপ্রথম নির্ভুলভাবে সময় হিসেব করতে শিখেছিল। ওরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে গণনা করে খুব আধুনিক একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। ভাবতে অবাক লাগবে- আধুনিক সময় গণনার ভিত্তি হিসেবে আমরা যে গেগ্ররি ক্যালেন্ডার ব্যাবহার করি, মায়াদের ক্যালেন্ডার তার থেকেও নির্ভুল ছিল। কারণ, গেগ্ররি ক্যালেন্ডার প্রতি দশ হাজার বছরে তিনদিন পিছিয়ে যায়; আর মায়াদের ক্যালেন্ডার প্রতি দশ হাজার বছরে মাত্র দুই দিন এগিয়ে থাকে।


চিত্রঃ মায়ান ক্যালেন্ডার( পাথরে খোদাই করা )

মায়ানরা নির্ভুলভাবে সময় গণনার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেও সময় সম্পর্কে তাদের ধারণা কিন্তু আজকালকার দিনের মত ছিল না। প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতার মত তাদের কাছেও সময় ছিল কিছুটা ম্যাজিক্যাল। প্রতিটি বছর, দিন বা মুহূর্তকে ওরা কোন বিশেষ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত করত। আমরা যেমন ভাবি- কোন কিছু ঘটুক আর না’ই ঘটুক, সময় বয়ে চলবেই। কিন্তু ওরা ভাবত ঐ বিশেষ ঘটনাগুলো ঘটার জন্যই বুঝি সময় বয়ে চলেছে।

মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের মন থেকে বিভিন্ন প্রকার ম্যাজিক্যাল ধারণা দূর হতে থাকে। সেই সাথে সময় সম্পর্কেও ম্যাজিক্যাল ধারণা বাতিল হয়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হতে থাকে। জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারই প্রথম সময়ের বৈজ্ঞানিক ধারনার উপর জোর দেন। তিনি সময়কে প্রানবাদ ও ম্যাজিক্যাল ধারণা থেকে মুক্ত করে, পুরো মহাবিশ্বটিকেই একটি যাত্রিক ঘড়ি হিসেবে দেখার প্রস্তাব করেন । পরবর্তীতে কেপলারের এই “যাত্রিক ঘড়ি” ধারনার বিকাশ ঘটান রেনে ডেকার্তে, বেঞ্জামিন থম্পসন, লর্ড কেলভিনের মত বিজ্ঞানীরা । মূলত তাদের চিন্তাধারাই সময়ের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবাত্মক চেষ্টা ছিল।

লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন- উপরে বিভিন্ন প্রাণীর সময়-জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা সময় একটি বিষয়ের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, সেটি হলো- “ কে কত দূরভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে পারে”। কারন, যে প্রাণী যত বেশিদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বা পরিকল্পনা করতে পারে, তার সময়-জ্ঞান তত বেশি সূক্ষ্ম। সময়ের উপর থেকে ম্যাজিক্যাল ধারণা দূর হবার আগ পর্যন্ত আমরা আসলে খুব বেশিদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেও পারতাম না। আর একই কারনে খুব বেশিদূর অতীত নিয়েও ভাবতে পারতাম না। ফলে এই পৃথিবী ও মহাবিশ্বটা আমাদের কাছে খুব বেশি পুরনো ছিল না। ডেকার্তে-কেপলারের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হবার আগে পুরো ইউরোপে জুড়ে সেমেটিক বিশ্বাসই ছিল সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। সেমেটিক বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মহাবিশ্বের সবকিছুর সৃষ্টি মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে। ফলে তার আগের বিষয় নিয়ে ভাবার কোন দরকারই ছিল না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হবার পর বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের চেষ্টা চলতে থাকে।ও তাদের ব্যাবহার করা হাতিয়ার ইত্যাদি পাওয়া গেছে।


চিত্রঃ শানিদার গুহা

শানিদার গুহার সর্বশেষ স্তরটিই মূলত সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রায় ১০ টি নিয়ান্ডারথালদের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। তার মধ্যে “শানিদার-৩” ও “শানিদার-৪” কে যে ইচ্ছে করেই কবর দেওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে বিজ্ঞানী ও প্রতœতত্ত্ববিদরা নিশ্চিত হতে পেরেছেন [১] । পাশাপাশি সেখানে থাকা বিভিন্ন জিনিস থেকে বোঝা যায় যে, তারা মৃত্যুর পরবর্তী সময় নিয়ে চিন্তা করেই এই কবরগুলো তৈরি করেছিল। অর্থাৎ নিয়ান্ডারথাল মানবদের যে সময়-জ্ঞান ছিল এটা নিশ্চিত। অন্যান্য প্রাণীদের মত তারা শুধু বর্তমান সময়েই বাস করত না ।

এখন নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে, অন্য কোন প্রাণীর সময় জ্ঞান না থাকলেও শুধু নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের কেন সময় জ্ঞান থাকবে ? এর নিশ্চয় কারণ আছে ? মূলত, অতীত-ভবিষ্যতের ধারণা থাকার জন্য বিশেষ ধরণের মস্তিষ্কের গঠনের দরকার হয় । মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরোন রয়েছে। এই নিউরোনগুলো আবার বিশেষভাবে একটি আরেকটির সাথে যুক্ত হয়ে নিউরাল সার্কিট তৈরি করেছে। এই নিউরাল সার্কিটগুলোই আমাদের স্মৃতি মনে রাখা, সচেতনভাবে ও যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছে। মজার বিষয় হলো, এই নিউরাল সার্কিট কিছুটা কম্পিউটারের লজিক গেটের মত কাজ করে। ক¤িপউটারের প্রোগ্রামিং ল্যাক্সগুয়েজে যেমন হ্যাঁ অথবা না প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যৌক্তিকভাবে কোন সমস্যা সমাধান করা হয়; আমাদের মস্তিষ্কও কিছুটা সেভাবেই কাজ করে ।

যে প্রাণীর মস্তিষ্কে যত বেশি নিউরন ও নিউরোন থেকে নিউরনের সংযোগ থাকবে, সেই প্রাণী তত বেশি বুদ্ধিমান হবে। মস্তিষ্কে যদি যথেষ্ট পরিমাণ নিউরোন ও আন্তঃনিউরোন সংযোগ থাকে, একমাত্র তখনই সময়-জ্ঞানের মত উন্নত ধরণের ধারণা থাকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকা সম্ভব। আর এত উন্নত মস্তিষ্ক শুধুমাত্র মানুষেরই আছে। আর তার কারণ- তাদের মস্তকটিও যথেষ্ট উন্নত। আসলে নিয়ান্ডারথালদের সাথে আধুনিক মানুষের খুব বেশি তফাৎ নেই। একদম সম্প্রতি, লরেন্স বার্কেলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির এ্যাডয়ার্ড রুবিন পরীক্ষা করে দেখেছেন- আধুনিক মানুষ ও নিয়ান্ডারথাল মানবের ডিএনএ এর মধ্যে মিল ৯৯.৫% – ৯৯.৯% পর্যন্ত । নিয়ান্ডারথালরাও মানুষের মত হাতিয়ার তৈরি করতে পারত। কিছু কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা তাদের সম্ভবত একটি ভাষাও ছিল। নিয়ান্ডারথালদের সময়-জ্ঞান থাকলেও সেটি কিন্তু আধুনিক মানুষের মত উন্নত না। এটি মস্তিস্কের পরিপক্কতার উপর নির্ভর করে। জন্ম নেবার পরেই মানবশিশুদের মস্তিষ্ক পরিনত মানুষের মস্তিস্কের মত কাজ করতে পারে না। ফলে মানবশিশুদের ভবিষ্যৎ সময় সম্পর্কে ধারণা খুবই অ¯পষ্ট। বলা যায় শিশুরাও একরকম বর্তমান চিত্রঃ একটি ইঁদুর কতক্ষণ সময় ব্যয় করে চিজ এক টুকরো চিজ পেয়েছে সেটি তাদের মস্তিষ্ক জেনে রাখে। কিন্তু এখন থেকে কত সময় আগে বা পরে চিজটি পেয়েছে তা তারা জানে না

ইঁদুরের থেকে আরও উন্নত প্রাণীর ক্ষেত্রেও বিষয়টি কিছুটা এমন। কুকুরের মালিকরা লক্ষ্য করে দেখেছেন, কত সময় আগে বা পরে কোন একটি ঘটনা ঘটল, সেটি তাদের কুকুর বুঝতে পারে না। কুকুর তার মালিককে পাঁচ মিনিট পরে দেখলেও যেমন খুশি হয়, পাঁচ ঘণ্টা পর দেখলেও একই রকম খুশি হয়। অর্থাৎ তাদের সময় প্রবাহের জ্ঞান নেই।

এখন অনেকেই হয়ত ভাবছেন, কোন প্রাণীর যদি ভবিষ্যতের ধারণা একদমই না থাকে, তবে সে জীবন ধারণ করে কি করে? খাবার খাওয়া বা কোন শিকার ধরার জন্যও তো কিছুটা পরিকল্পনা করতে হয়! হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। এরকম কাজের জন্য সামান্য হলেও ভবিষ্যতের ধারণা থাকতে হয়। তবে সেই ভবিষ্যৎ চিন্তা খুব সামান্য। একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেই বিষয়টি ঠিকমত বোঝা যাবে। উপরে যেহেতু ইঁদুর ও কুকুরের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, তাই এই বিষয়টিও এসব প্রাণীর ক্ষেত্রে আলোচনা করা যেতে পারে।
এই বিষয়গুলো বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা কিছু মজার পরীক্ষা করেছেন। এসব পরীক্ষা করার জন্য ইঁদুর বা এমন প্রাণীদের প্রথমে কিছুটা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিজ্ঞানীরা কিছু ইঁদুরকে একটি প্রশিক্ষণ দিলেন যে- তোমরা যদি এই লিভারটিতে চাপ দাও তবে তোমরা এক টুকরো খাবার পাবে। দুই থেকে পাঁচ বার এভাবে প্রশিক্ষণ দিলেই ইঁদুরগুলো লিভার চেপে খাবার সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান যদি ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি হয়, ইঁদুর আর এই বিষয়টি মনে রাখতে পার না। অর্থাৎ লিভার চাপা ও খারাব পাওয়া এই দুটি ঘটনার ব্যবধান ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি হলে সেটি ইঁদুরের সময়-জ্ঞানের বাইরে চলে যায়। ইঁদুর থেকে উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই সময় আরও কিছুটা বেশি। বানরের ক্ষেত্রে এই সময় সর্বোচ্চ নব্বই সেকেন্ড। অর্থাৎ ইঁদুর ত্রিশ সেকেন্ড ও বানর নব্বই সেকেন্ডের বেশি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়না।

ইঁদুর , কুকুর বা বানরের সময়-জ্ঞান দেখে বোঝা যাচ্ছে, এসব প্রাণীরা মূলত বর্তমান সময়ে বাস করে। কিন্তু বর্তমান সময়টি কত দ্রুত বয়ে যাচ্ছে সেখানেও কিন্তু মানুষের সাথে অন্য প্রাণীদের অনেক তফাৎ রয়েছে। ভাবলে অবাক হবেন, এমনকি প্রায় সব প্রাণীর সময় প্রবাহই আলাদা আলাদা ।

সিনেমা বা ডকুমেন্টারিতে অনেক সময়ই আমরা স্লো মোশনের ভিডিও দেখে থাকি। ভাবুন তো, যদি আমাদেরকে একটি স্লো মোশনের বিশ্বে নিয়ে যাওয়া হয় তবে কেমন হবে ! আশেপাশের সবকিছুর পরিবর্তন তখন খুব ধীর গতিতে হবে। তবে একই সাথে যদি আমাদের মস্তিষ্কও ধীর গতিতে কাজ করে, তাহলে আমরা বিষয়টি বুঝতেই পারব না। কিন্তু আশেপাশের সবকিছু যদি ধীর গতির হয়, আর আমাদের মস্তিষ্ক যদি ঠিকঠাক কাজ করে, তবে বেশ মজাই হবে । তখন ইচ্ছে করলেই টেবিল থেকে পরে যাওয়া গ্লাস ধরে ফেলতে পারব। সমস্যা হবে খেলাধুলা নিয়ে। এমন সুবিধা পেলে গোলকিপারকে আর গোল দেওয়া যাবে না ! কিছু প্রাণী ঠিক এমন কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। ওদের সময় প্রবাহ আমাদের থেকে আলাদা। ওরা জগতটাকে দেখেও কিছুটা স্লো মোশনের ভিডিওর মত।

কুকুরের কথাই ধরা যাক। কুকুরের জীবনকাল মানুষের প্রায় সাত ভাগের একভাগের সমান। অর্থাৎ কুকুরের এক বছর সমান মানুষের সাত বছর। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন আচ্ছা, তাহলে কুকুরের সময় প্রবাহ কি মানুষের তুলনায় ধীর? গবেষণায় দেখা গেল আসলেই তাই। কুকুরের সময় প্রবাহ মানুষের তুলনায় প্রায় পঁচিশ শতাংশ ধীর ।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোন প্রাণীর সময় প্রবাহের হার মূলত নির্ভর করে দুটি জিনিসের উপর। একটি হলো শরীরের ওজন, আর অন্যটি বিপাকের হার। কোন প্রাণীর ওজন যত কম হবে আর শরীরের ভেতর ঘটা রাসায়নিক প্রক্রিয়া যত দ্রুত হবে, সেই প্রাণীর সময় তত বেশি ধীর হবে। তবে সময় প্রবাহের হার যত কম বা বেশিই হোক না কেন, মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা মূলত বর্তমানেই বাস করে। অতীত ও ভবিষ্যতের ধারনা তাদের কাছে একদমই ঝাপসা।

মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সময়-জ্ঞান না থাকলেও নিয়ান্ডারথাল মানবদের সময় জ্ঞান ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিয়ান্ডারথাল মানবরা ঠিক মানুষ না; তবে আধুনিক মানুষের(Homo sapiens) খুব কাছাকাছি । আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে পর্যন্ত মানুষদের পাশাপাশি এই নিয়ান্ডারথাল মানবরাও পাশাপাশি বাস করত। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম হলো- “শুধুমাত্র যোগ্যরাই টিকে থাকে” । প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে নিয়ান্ডারথালরা টিকতে পারে নি।চিরতরে হারিয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে। নিয়ান্ডারথালরা হারিয়ে গেলেও তাদের ইতিহাস হারিয়ে যায় নি। তারা দেখতে কেমন ছিল, তাদের খাদ্যাভ্যাস কেমন ছিল, আর তাদের বুদ্ধিমত্তা কেমন ছিল এসব বিষয়ে রয়ে গেছে শত শত আলামত ।


চিত্রঃ নিয়ান্ডারথাল মানবের কম্পিউটার রিজেনারেটেড ছবি

প্রাচীন মানব ও নিয়ান্ডারথাল মানবদের দেহাবশেষ ও ব্যাবহার করা হাতিয়ার ইত্যাদিসহ অনেক প্রাচীন গুহা রয়েছে। তেমনি এক গুহার নাম শানিদার গুহা। ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে ইরাক সীমান্তের এক উপত্যকার নাম শানিদার। শানিদার মানে হলো স্বপ্ন উপত্যকা। এই উপত্যকার একপাশে অবস্থিত এই “শানিদার গুহা”। এই গুহাটিকে নিঃসন্দেহে বিশেষ একটি স্থান বলা যেতে পারে। কারণ, কার্বন ডেট টেস্ট করে জানা গেছে- এই গুহাটিকে সেই ৫০০০০ হাজার বছর আগে থেকেই বসবাস করার যায়গা হিসেবে ব্যাবহার করা হত। আজ থেকে প্রায় ৫০০০০ বছর আগে নিয়ান্ডারথাল মানবরা যেমন এই গুহাকে আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যাবহার করেছে, তেমনি ১১০০০ বছর আগের আধুনিক মানুষরাও এই স্থানকে ব্যাবহার করেছে। এমনকি আজও কিছু স্থানীয় কুর্দিস্থানীরা বছরের বিশেষ কিছু সময়ে এই স্থানকে এখনো ব্যাবহার করে থাকে। গুহাটির খনন করার সময় চারটি স্তরে বিভিন্ন সময়ের বসবাস করা মানুষদের কঙ্কাল ও তাদের ব্যাবহার করা হাতিয়ার ইত্যাদি পাওয়া গেছে।


চিত্রঃ শানিদার গুহা

শানিদার গুহার সর্বশেষ স্তরটিই মূলত সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রায় ১০ টি নিয়ান্ডারথালদের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। তার মধ্যে “শানিদার-৩” ও “শানিদার-৪” কে যে ইচ্ছে করেই কবর দেওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে বিজ্ঞানী ও প্রতœতত্ত্ববিদরা নিশ্চিত হতে পেরেছেন [১] । পাশাপাশি সেখানে থাকা বিভিন্ন জিনিস থেকে বোঝা যায় যে, তারা মৃত্যুর পরবর্তী সময় নিয়ে চিন্তা করেই এই কবরগুলো তৈরি করেছিল। অর্থাৎ নিয়ান্ডারথাল মানবদের যে সময়-জ্ঞান ছিল এটা নিশ্চিত। অন্যান্য প্রাণীদের মত তারা শুধু বর্তমান সময়েই বাস করত না ।

এখন নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে, অন্য কোন প্রাণীর সময় জ্ঞান না থাকলেও শুধু নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের কেন সময় জ্ঞান থাকবে ? এর নিশ্চয় কারণ আছে ? মূলত, অতীত-ভবিষ্যতের ধারণা থাকার জন্য বিশেষ ধরণের মস্তিষ্কের গঠনের দরকার হয় । মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরোন রয়েছে। এই নিউরোনগুলো আবার বিশেষভাবে একটি আরেকটির সাথে যুক্ত হয়ে নিউরাল সার্কিট তৈরি করেছে। এই নিউরাল সার্কিটগুলোই আমাদের স্মৃতি মনে রাখা, সচেতনভাবে ও যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছে। মজার বিষয় হলো, এই নিউরাল সার্কিট কিছুটা কম্পিউটারের লজিক গেটের মত কাজ করে। ক¤িপউটারের প্রোগ্রামিং ল্যাক্সগুয়েজে যেমন হ্যাঁ অথবা না প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যৌক্তিকভাবে কোন সমস্যা সমাধান করা হয়; আমাদের মস্তিষ্কও কিছুটা সেভাবেই কাজ করে ।

যে প্রাণীর মস্তিষ্কে যত বেশি নিউরন ও নিউরোন থেকে নিউরনের সংযোগ থাকবে, সেই প্রাণী তত বেশি বুদ্ধিমান হবে। মস্তিষ্কে যদি যথেষ্ট পরিমাণ নিউরোন ও আন্তঃনিউরোন সংযোগ থাকে, একমাত্র তখনই সময়-জ্ঞানের মত উন্নত ধরণের ধারণা থাকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকা সম্ভব। আর এত উন্নত মস্তিষ্ক শুধুমাত্র মানুষেরই আছে। আর তার কারণ- তাদের মস্তকটিও যথেষ্ট উন্নত। আসলে নিয়ান্ডারথালদের সাথে আধুনিক মানুষের খুব বেশি তফাৎ নেই। একদম সম্প্রতি, লরেন্স বার্কেলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির এ্যাডয়ার্ড রুবিন পরীক্ষা করে দেখেছেন- আধুনিক মানুষ ও নিয়ান্ডারথাল মানবের ডিএনএ এর মধ্যে মিল ৯৯.৫% – ৯৯.৯% পর্যন্ত । নিয়ান্ডারথালরাও মানুষের মত হাতিয়ার তৈরি করতে পারত। কিছু কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা তাদের সম্ভবত একটি ভাষাও ছিল। নিয়ান্ডারথালদের সময়-জ্ঞান থাকলেও সেটি কিন্তু আধুনিক মানুষের মত উন্নত না। এটি মস্তিস্কের পরিপক্কতার উপর নির্ভর করে। জন্ম নেবার পরেই মানবশিশুদের মস্তিষ্ক পরিনত মানুষের মস্তিস্কের মত কাজ করতে পারে না। ফলে মানবশিশুদের ভবিষ্যৎ সময় সম্পর্কে ধারণা খুবই অ¯পষ্ট। বলা যায় শিশুরাও একরকম বর্তমান সময় নিয়েই ভাবে।

শিশুর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার মস্তিষ্ক পরিণত হয়। আর সেই সাথে সে ভবিষ্যৎ স¤পর্কে আরও ভালমতো ভাবতে পারে। আর সময়কেও আরও সূক্ষ্মভাবে উপলব্ধি করতে পারে। এই মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশের বিষয়টি, মানুষের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানব জাতিরও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটেছে, ভাষার বিকাশ ঘটেছে, সেইসাথে সময় সম্পর্কে উপলব্ধি আরও তীক্ষè হয়েছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত সময় স¤পর্কে মানুষের ধারণা দিন দিন পরিবর্তন হয়েই চলেছে।

প্রাচীনকালের মানুষরা খুব বেশি দূরের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবতে পারত না। আগুণ জালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ যোগার, বাড়তি খাদ্য সংরক্ষণ এসবের মধ্যেই তাদের চিন্তা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সভ্যতা শুরু হবার পর মানুষ সময়কে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শিখেছে। তবে সেসময় তাদের কাছে সময় ছিল কিছুটা যাদুর মত। তারা ভাবত, যেটা ঘটার সেটা সময় হলে ঘটবেই।

এসব ধারণার পেছনে মূলত আদিম ধর্মবিশ্বাসের ভূমিকাটাই ছিল প্রধান। কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা শুরু হবার পর সময়কে কিছুটা আবর্তক মনে করা হত। ওরা ভাবত সবকিছুই বুঝি ঘুরে ফিরে আবার ঘটবে। কৃষিকাজ শুরু করার পর মানুষকে প্রকৃতির উপর খেয়াল রাখতে হত। তারা দেখত – একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর, গ্রীষ্ম আসে, বর্ষা আসে, শীত আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোও ফিরে ফিরে আসে। আদিম বিশ্বাস, তীক্ষè পর্যবেক্ষণের অভাব, প্রকৃতির উপর নির্ভরতা মানুষকে সময় সম্পর্কে এমন আবর্তক ও ম্যাজিক্যাল ধারণা পেতে বাধ্য করেছে। তবে এর পেছনে কিছু মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাও ছিল। আদিম বিশ্বাসের কারণে তারা ভাবত- সবকিছু যদি ফিরে ফিরে এসেই থাকে- তবে মৃত মানুষও বুঝি আবার জন্মগ্রহন করতে পারে। কে চায় এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে। এসব মনস্তাত্ত্বিক কারণেই তারা মৃতের কবরে ফুল, খাদ্য , হাতিয়ার ইত্যাদি রেখে দিত।


চিত্রঃ প্রাচীন মানুষের খুব বেশি দূর-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে পারত না। তাদের চিন্তা শুধুমাত্র খাদ্য যোগার, আগুনের জন্য কাঠ যোগার বা শিকারের জন্য হাতিয়ার তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত।


কমটি ডি বাফুন নামে এক ফরাসি গণিতবিদ প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণ করেন। তার হিসেবে দেখা যায় – পৃথিবীর বয়স কমপক্ষে পঁচাত্তর হাজার বছর। পরবর্তীতে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের সঠিক উপায় আবিষ্কারের পর দেখা যায় পৃথিবীতে কয়েক শত কোটি বছর পুরনো পাথরের অস্তিত্ব রয়েছে ।আর মহাবিশ্ব সৃষ্টির আধুনিক তত্ত্ব থেকে দেখা যায় ১৩.২ বিলিয়ন বছর আগে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। মহাবিশ্ব সৃষ্টিরও কয়েকশত কোটি বছর পরে, মাত্র ৪৫০ কোটি বছর আগে আমাদের এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। বিজ্ঞানের তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে আমরা আজ থেকে ৫০০ কোটি বা তারও বেশি সময় পরে এই পৃথিবী-সৌরজগতের অবস্থা কেমন হবে সেটাও ভাবতে পারছি। মূলত সৌরজগতের বিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত আমাদের কাছে বৃহৎ সময় বলে তেমন কিছু ছিল না বললেই চলে। কিন্তু মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্ব পাবার পর সময়ের অনেক বড় পর্যায় পর্যন্ত আমরা ভাবতে পারি । এমনকি সময় শুরু এবং শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমরা ভাবতে পারি। অনেক বড় সময়ের পাশাপাশি অনেক ক্ষুদ্র সময় নিয়েও আমরা ভাবতে পারি। এখন আমাদের এক সেকেন্ডের কয়েক কোটিভাগের মধ্যে ঘটে যাওয়া কোয়ান্টাম কণিকার সংঘর্ষের পরিণতি মাপতে হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে- মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের সময়-জ্ঞান দিন দিন বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম হচ্ছে।

[১] শানিদার গুহায় পাওয়া ১০ টি নিয়ান্ডারথাল মানবদেরকে শানিদার-১ , শানিদার-২ এভাবে নামকরন করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র

টাইম ট্র্যাভেলঃসময় ভ্রমণ এবং সময়ের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ।