Saturday, August 6, 2016

নবী মুহাম্মদকে নিয়ে আমি সবসময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি

নবী মুহাম্মদকে নিয়ে আমি সবসময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি। কিছুতেই বুঝতে পারি না, তিনি ভালো মানুষ ছিলেন, নাকি একজন খারাপ মানুষ ছিলেন। এরকম দোটানা অবস্থায় না থেকে আমি একটি স্থির সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছি। জানতে চেয়েছি, তাঁর মধ্যে ভালোর অংশ, নাকি মন্দের অংশ বেশী ছিল। এজন্য গত কয়েক মাস ধরে তাঁকে নিয়ে লেখা কয়েকটি বই পড়েছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আলী দস্তির ‘নবী মুহাম্মদের তেইশ বছর’, ইবনে হিশামের ‘সিরাতুন্নবি’ এবং ইবনে কাসিরের ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’। এসবের বাইরেও দীর্ঘসময় ইন্টারনেট ঘেঁটেছি কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য। যদিও আরো অনেক পড়াশোনা করতে হতো, তবে মনে হচ্ছে, এখন তাঁকে নিয়ে কিছু কথা লেখা যেতে পারে।
প্রথমেই বলে রাখি, নবী মুহাম্মদের অলৌকিকত্ত্বে আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না। তাঁর জীবনীর যেখানেই দেখেছি অলৌকিকত্ব ঢেলে মহিমা মাখানোর প্রচেষ্টা, সেটাকে এড়িয়ে গেছি। আমি শুধু সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছি, একজন স্বাভাবিক মানুষ হিশেবে তিনি কেমন ছিলেন, সে ব্যপারে। সবরকম ঐশ্বরিক সংস্পর্শের বাইরে তাঁর মধ্যে ভালো-মন্দের অনুপাত কতোটুকু হতে পারে, আমি সেটাই বুঝতে চেষ্টা করেছি।
নবী মুহাম্মদ ছিলেন একজন স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষ। অনেকে বলে থাকেন, তিনি হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত। এটা ঠিক নয়। হিস্টিরিয়ার রোগী কোরানের মতো প্রাসঙ্গিক কোন পদ্য আবৃত্তি করতে পারে না। তবে তাঁর স্কিজোফ্রেনিয়া ছিল কিনা, বলা কঠিন। তিনি জিবরাঈলকে দেখতে পেতেন। একে অন্য কেউ দেখতো না। তিনি জিবরাঈলের কথা শুনতেন, তাকে প্রশ্ন করতেন। এটা স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষনের সাথে মিলে যায়।
নবী মুহাম্মদ ছিলেন সাহসী মানুষ, ধৈর্যশীল মানুষ। মক্কায় ইসলাম প্রচারে তিনি যে ধৈর্য দেখিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। এখানে টানা তিনটি বছর তিনি অমানবিক অবরুদ্ধ জীবন কাটিয়েছেন। তবু কোনরকম আপোষ করেননি। অপরিসীম ধৈর্যশক্তি ছাড়া এটি অসম্ভব ছিল। আর প্রায় সাতাশটি যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি অসীম সাহস দেখিয়েছেন।
নবী মুহাম্মদ রাজনীতি সচেতন একজন বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। তিনি ধাপে ধাপে ইসলাম প্রচার করেছেন। এক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি তায়েফে গিয়ে গোত্রের প্রধানদের সাহায্য চেয়েছেন, আবিসিনিয়ায় লোক পাঠিয়ে বাদশা নাজ্জাশির সাহায্য চেয়েছেন। আর মদিনার বিবদমান আউস ও খাযরাজ গোত্রকে একত্র করে যে কূটনীতিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন, তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয়ের পর তিনি যেভাবে পর্যায়ক্রমে ইহুদিদের উচ্ছেদ ও নির্মূল করে মদিনাকে ইসলামের প্রধান শক্তিকেন্দ্রে পরিনত করেছেন, তাও অভাবনীয়। সাহস, ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তা তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী মানুষে পরিনত করেছে।
নবী মুহাম্মদ ছিলেন রক্ত-মাংসের মানুষ। তিনি জৈবিক কামনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। আরব মরুচারীদের আনন্দের প্রধান উপকরন নারীসঙ্গকে তিনি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন। এক্ষেত্রে আমি কিছুতেই তাঁর প্রশংসা করতে পারি না। আমি প্রশংসা করতে পারি না তাঁর দাসপ্রথা জিইয়ে রাখার মনোভাব, মেয়েদের অবদমিত করে রাখার চিরন্তন পুরুষালি আকাঙ্ক্ষা, সৎ-অসৎ সবরকম উপায়ে ইসলাম প্রচারের নির্দেশনা। শত্রুকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য নৃশংস গণহত্যা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী শহরের ব্যবসায়ীদের সম্পদ লুটতরাজ কিংবা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক পঞ্চমাংশ নিজের জন্য রেখে দেওয়া কিংবা জিযিয়া করের প্রচলন-এসবের কোনটিকে আমি সমর্থন করতে পারি না।
তিনি গুপ্তঘাতক দ্বারা হত্যা করেছেন অশীতিপর বৃদ্ধকে, টগবগে এক যুবককে, সন্তানকে দুগ্ধপানে রত মহিলাকে, যারা প্রত্যেকে ছিলেন কবি, যারা প্রত্যেকে ছিলেন তাঁর সমালোচক। বিরোধী ব্যক্তি, গোত্র এবং জাতির প্রতি তিনি দেখিয়েছেন সহজাত নিষ্ঠুরতা। হায় নবী মুহাম্মদ, এসব কী ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি! তাঁর অনুকরনে পৃথিবীর সর্বত্র উগ্র মুসলমানগণ তাদের বিরোধীদের হত্যা করছে কোনরকম অনুশোচনা ছাড়াই।
নবী মুহাম্মদ মোটেও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেননি। তিনি নিষিদ্ধ করেছেন সংগীত, চিত্রকলা, নৃত্য, আনন্দদায়ক খেলাধুলা। তিনি হস্তক্ষেপ করেছেন বেঁচে থাকার সকল উপাদানে ও অনুষঙ্গে। তিনি সবকিছু নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন। পৃথিবীর সকল দেশের, সকল জাতির মানুষের জন্য এক অভিন্ন সংস্কৃতির বন্দোবস্ত করে দিয়ে গেছেন। এগুলো তাঁর অনুসারীদের হ্নদয়কে পচে ফেলেছে।
অথচ, অথচ তিনি হতে পারতেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুকরনীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি পৃথিবীকে করতে পারতেন আরো সুন্দর, আরো মানবিক, আরো নিরাপদ। তিনি প্রচণ্ড কষ্ট করেছেন জীবনে। প্রচণ্ড কষ্ট করে তিনি ঝগড়াটে আরবদের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। তিনি বিচ্ছিন্ন আরবদের একটি একক শক্তিতে পরিণত করার মাধ্যমে তাদের সুযোগ করে দিয়েছেন বিজ্ঞান গবেষনার, দর্শনের পুনর্জাগরনের। তাঁর সততা ও অধ্যবসায়ের কাহিনী হাজার বছর মানুষের মুখে মুখে ফিরবে। অথচ এখন তাঁর নামে প্রচারিত দর্শনে পরিচালিত হয় পৃথিবীর অপরাধের একটা বড়ো অংশ।
নবী মুহাম্মদ সভ্যতাকে খানিকটা এগিয়ে দিয়েছেন। তিনি মানবতার জন্য অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু তিনি আরো অনেক কিছু করতে পারতেন। সময়ের পরিক্রমায় কিছু কিছু মানুষের হাতে জমা হয় বিপুল ক্ষমতা। বিপুল ক্ষমতা সৃষ্টি করে বড়ো দায়িত্ববোধ। কিন্তু নবী মুহাম্মদ তখন খুব বেশী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেননি। ক্ষমতা মানুষকে কতোইনা বদলে দেয়!
নবী মুহাম্মদ দোষ-গুন মিলিয়ে একজন ভালো মানুষ, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ, এই ব্যপারে আমার আপত্তি আছে অনেক।