Saturday, August 6, 2016

নরকের দুয়ারে মহামানবের মিলনমেলায়

[ শার্লি হেবদো ম্যাসাকারে নিহত শিল্পীগণের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ]
হাশরের ময়দান। তীব্র উত্তপ্ত কঠিন সময়। চারদিকে ছোটাছুটি, আতঙ্ক। পায়ের নিচে তামার ফ্লোর, মাথার একহাত ওপরে সূর্য। মানবজাতির ওপর চেপে রাখা এতদিনের গণগণে ক্রোধ এক নিঃশ্বাসে ঢেলে দিচ্ছে অরুণ মহাশয়। অবশ্য “চন্দ্র সূর্যের স্বাধীন ইচ্ছা নেই, তাহারা আবর্তিত হয় এক আল্লাহর নির্দেশে।” সেই এক আল্লাহ কই?
দেখা গেলো, মহান আল্লাহপাক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরশের কুসুম কুসুম গরম তুলতুলে সিংহাসনে একখানি সাগর কলার কাঁদি কোলে লইয়া বসিয়া আছেন। ক্ষণে ক্ষণে তিনি নিচে তাকাইয়া বান্দাদের ছোটাছুটি লক্ষ্য করিতেছেন এবং চেচাইয়া কহিতেছেন, আমি অসীম দয়ালু আমি পরম করুণাময় আমি রাহমানুর রাহীম। চেচাইতে চেচাইতে তাহার পশ্চাদ্দেশ উত্তোলিত হইতেছে, চোখ কোটর হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে, নাক কান লাল হইয়া উঠিতেছে, মুখে ফেনা উঠিয়া যাইতেছে। আমিই রাহমান আমিই রাহীম . . . ।
এদিকে কাফেরদের শাস্তির বিধান হয়ে গেছে। বিনা হিসাবে জাহান্নাম। সারি বেঁধে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জাহান্নামে। একইসাথে একই গন্তব্যের দিকে হেঁটে যাচ্ছে এডলফ হিটলার আর মাদার তেরেসা। একইরকম করে হাতকড়া বাঁধা হয়েছে মুসোলিনি আর মহাত্মা গান্ধীর হাতে। তবে ইহুদি নিধন যজ্ঞের কারণে হিটলারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হয়েছে এবং তাকে জাহান্নামে নেয়া হচ্ছে হাতকড়া ছাড়াই। শূণ্যদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে অ্যানা ফ্রাংক, তারও ঠিকানা হয়েছে উত্তপ্ত নরক।
এদিকে নরকে যেতে যেতেই আড্ডায় মেতেছেন অভিজিত রায়, বন্যা আহমেদ, বিপ্লব পাল, সুষুপ্ত পাঠক প্রমুখ। ফেরেশতারা আড়চোখে দেখছে তাদের। এক ছোটোখাটো নাস্তিক হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার প্রিয় মানুষটাকে। অগুণন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছোটাছুটি করে অবশেষে সে আবিষ্কার করলো তার স্বপ্নের মানুষটাকে। স্বপ্নের মানুষ আড্ডায় মেতে আছেন সীমোন দ্য বোভোয়ার, জাঁ পল সার্ত্র, টি এইচ এলিয়ট, জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেবের সাথে। স্বপ্নের মানুষ বিদ্রুপ করলেন এলিয়টকে, “তুমিতো আস্তিক হয়েও নরকে যাচ্ছো।” এলিয়ট হেসে বললেন, “ওটাই তো স্বর্গ, প্রিয়।” হাসি ঠাট্টা শুনে এগিয়ে আসলেন আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, প্রবীর ঘোষ। আর ওই ছোটোখাটো নাস্তিক মহাশয় লক্ষ মানুষের ছোটাছুটির মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে তার স্বপ্নমানবের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
অন্যদিকে মুসলিমরাও আছে প্যারায়। ৭৩টা লাইনে ভাগ করা হয়েছে তাদের। প্রতিটা লাইনের সামনে আছে একটা করে সাইনবোর্ড আর একজন করে ফেরেশতা আছে গার্ড হিসেবে। প্রথম লাইনের সাইনবোর্ডে লেখা “সহীহ মুসলিম” আর শেষ লাইনের সাইনবোর্ডে লেখা “সহীহ মডারেট মুসলিম”। মডারেটগণ লক্ষ্য করিলো, একদম সামনের লাইনে দাঁড়াইয়া আছে জগতশ্রেষ্ঠ বর্বরের দল। তাহাদের কারো হাতে তরবারি, কারো হাতে রাইফেল, কেউ এনেছে গ্রেনেড। প্রত্যেকে হাতের অস্ত্র প্রদর্শন করিয়া সমস্বর চেচাইয়া উঠে, “আল্লাহু আকবার। আমরা দয়াময় আল্লাহর অনুসারী। হায় আল্লাহ আমরা প্রইত্যেকে ৭২খান হুরপরী ছাই, আর একখান শরাবের নদী ছাই।” সামনে দিয়ে কোনো কিশোরী বা তরুণীকে যেতে দেখলেই উত্তেজনায় তাহারা কাঁপিয়া উঠে। সমস্বরে চিত্‍কার পাড়ে, “তু চিস বাড়ি হ্যা মস্ত মস্ত” অথবা “ছুভানাল্লা ছুভানাল্লা ক্যায়া বানায়া হ্যা রাব নে তুঝকো”। তখন মডারেটগণের বুইঝতে বাকি রইলো না যে উহারা ছহীহ মুছলিম নহে। ইহুদি নাসারা এখানেও ষড়যন্ত্র করিয়াছে।
কাফের শিবিরে তখন চারদিক রঙিন হয়ে উঠেছে, সর্বত্র আলোয় উদ্ভাসিত। স্বপ্নমানব তার ভক্তের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
এই ছেলে, তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগে।
কী নাম তোমার?
অরণ্য।
পৃথিবীর সব অরণ্য নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে আমার রাঢ়িখালে।
আপনার ভয় করে না?
কীসের ভয়?
আগুনের ভয়। আমার খুব ভয় করে।
হাহাহা। আমি তো জানতাম, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
না, জগতের সমস্ত অন্যায় নিপাত যাবে। মুখের পেশী হঠাত্‍ শক্ত হয়ে ওঠে অরণ্যের।
আলাপ জমে উঠেছে ব্রুনো, গ্যালিলিওর মাঝে। ব্রুনো রসিকতা করলেন, “আপনি তো মিয়া মহাভীতু।” গ্যালিলিও কী বলবেন বুঝতে পারছেন না।
নিউটন গেলেন আইনস্টাইনের কাছে, “এই যে শোনো, তোমার কী যেন একটা বিখ্যাত তত্ত্ব আছে- ওটার তো কিছুই বুঝি না।” আইনস্টাইন উদাসস্বরে বললেন, “আমার ড্রাইভারের কাছে যাও। সে তোমায় বুঝিয়ে দেবে।” নিউটন রেগেমেগে তেড়ে আসলেন,”আমাকে অপমান করছো তুমি? জানো তুমি আমাকে রাগানোর পরিণাম?” আইনস্টাইন ঐ দূরে নরকের দ্বারপ্রান্তে মেরিলিন মনরোর দিকে তাকিয়ে আনমনে চুল ছিড়তে লাগলেন।
রিচার্ড ডকিন্স তাকিয়ে ছিলেন মুমিনদের শিবিরে। মুমিনদের এতসব দল উপদল, প্রতিটা দল আবার অন্য সবাইকে অমুসলিম অ্যাখ্যা দেয়, অথচ সব দলের হাতেই একই কোরান শরীফ- ব্যপারটা তাঁকে বেশ বিনোদিত করছে। পেছন থেকে একটা যান্ত্রিকস্বর ভেসে আসলো, “তুমি কি তাদের বক্তৃতা শোনাবার কথা ভাবছো? না, তা করো না। বেচারাগুলো স্বর্গে যাবার স্বপ্ন দেখেছে এতোদিন। এখন তোমার কথা শুনে নাস্তিক হয়ে গেলে তীরে এসে তরী ডুববে।” রিচার্ড ডকিন্স পেছন ফিরে হুইলচেয়ারে উপবিষ্ট স্টিফেন হকিংকে দেখতে পেলেন। হেসে উত্তর দিলেন, “আরে বস, বক্তৃতা দিয়ে দুই চারজনকে নাস্তিক বানাই দিলে কোনো প্রবলেমই নাই। কারণ পেছনের ৭২টা লাইন আস্তিক হোক আর নাস্তিক হোক, নরকেই যাবে। আর যে লাইনটা স্বর্গে যাবে, তাদের নাস্তিক হবার মতো ব্রেইন নেই বলেই যাবে; বক্তৃতা দিয়ে এদের নাস্তিক বানানো যাবে না, হুরপরী কিছু দিয়ে বানানো যেতে পারে।” দুজনেই একসাথে হেসে উঠলেন।
এদিকে মডারেটদের অন্তরে সুখ নাই মোটেও, যেমন ছিলো না কোনোকাল। এখনও তারা একইরকম অস্থির আর বিভ্রান্ত। তাদের মধ্যে একজন, ইহকালে যিনি সম্মানিত চিকিত্‍সক ছিলেন এবং ব্যস্ততার কারণে নামাজ পড়ার সময় পাইতেন না, যিনি গেরামের বাড়িতে গেলেই অতি ধার্মিক বনিয়া যাইতেন, গেরামের মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান হইছিলেন এবং সময়ে সময়ে জাকির নায়েকের ডিবেট দেখিয়া ঈমানী জোশ বাড়াইতেন, আল কায়েদার হামলায় ইহুদি নাসারার মৃত্যুতে মনের গহীনে স্বস্তি পাইতেন, সেই ডাক্তার সাব মাটিতে বসিয়া মাথা চাপড়াইতেছেন। তার একমাত্র ছেলে নাস্তিক হুমায়ুন আজাদের পাল্লায় পড়িয়া নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বিনা হিসাবে জাহান্নাম দেয়া হইয়াছে তার ছেলেকে। এখন ছেলের কুকীর্তির কারণে তাকেও হয়তো জাহান্নামেই ফেলা হইবে।
হঠাৎ খবর ছড়াইয়া পড়িলো, পুণ্যবান বান্দাগণকে আল্লাহর আরশের সুশীতল ছায়াতে আপ্যায়ন করা হইতেছে। মডারেটগণ এ কথা শুনিয়া দৌড়াইয়া গ্যালেন সেদিকে। গিয়া দেখিতে পাইলেন, আল্লাহর রাসুল ও তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়ানো লম্বা দাড়ি-পাঞ্জাবিওয়ালা অনেকগুলো লোক খানাপিনায় মশগুল। ঠাণ্ডা লেবুর শরবত দেখিতে পাইয়া ও তাহার ঘ্রাণ শুকিয়া মডারেটগণের তৃষ্ণা বহুগুণ বাড়িয়া গেলো। তাহাদের মধ্যে একজন শান্তিপ্রিয় মুসলিম চিৎকার করিয়া কহিলো, হায় খোদা, এরা সবাই সন্ত্রাসী! অন্যরাও তখন লক্ষ্য করিলো, ইহাদিগকে টিভিতে দেখানো হইতো। পত্রিকায় ইহাদের ছবি আসিতো। ইহারা ইসলামের নামে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হত্যা কইরতো, নারীদের গনিমতের মাল বানিয়ে ধর্ষণ করতো। কেউ আল কায়েদা, কেউ তালেবান, কেউ আইসিস; ভিত্রে ভিত্রে একই চিস। আর ঐ যে একদম আল্লাহর রাসুলের পাশে যে লোকটা, তার নাম ওসামা বিন লাদেন। সে ছিলো এদের সবার ন্যাতা এবং আদর্শ। মডারেটগণ যথেষ্ট বুদ্ধিওয়ালা। তাদের আর বুইঝতে বাকি রইলো না যে, এইখানেও ইহুদি নাসারা শালাগুলার ষড়যন্ত্র আছে। তাহারা ইসলামের নামে কুৎসা রটাইবার জইন্যে আল্লাহর হাবীবকে হাত কইরা ফেইলছে। ইসলাম তো আসলে অইত্যান্ত শান্তির ধর্ম।
আর দেরি করা উচিত নহে। দ্রুত আল্লাহপাকের দরবারে এই ঘটনা জানাইতে হইবেক। মডারেটগণ ছুটিয়া গেলেন আল্লাহপাকের পদপ্রান্তে। আল্লাহ দেখিলেন, নিচে কিছু বান্দা জটলা পাকাইতেছে। ঈষৎ বিরক্ত হইয়া তিনি জিবরাঈলকে কহিলেন, ইহাদিগের কী প্রবল্যাম? জিবরাইল শরমে নতশির হইলো। আল্লাহপাক নিজেই ঈষৎ কাইত হইয়া চিক্কুর পাড়িলেন, ওহে তোমরা কী চাও? আমারে কও। আমি রাহমান আমি রাহীম আমি কাদীর . . . ।
হায় খোদা, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসলাম তো সহীহ ইসলাম নহে।
ইহা শ্রবনে বিস্ময়ের চোটে আল্লাহপাক আরশ হইতে সিধা মডারেটগণের উপর ভূমিসাৎ হইয়া ইন্তেকাল ফরমাইলেন।
সূর্য তার আপন স্থানে উদিত হলো। রাড়িখালের অরণ্য মিষ্টি রোদে হেসে উঠলো। একটি গাছে দুটি পাখি, আমাদের অরণ্য যাদের নাম জানে না, মধুর চুম্বনে বিভোর তখন।
অরন্য তার স্বপ্নমানবের হাত ছুঁয়ে বললো, বলেছিলাম না, সমস্ত অন্যায় নিপাত যাবে।

ওমর খইয়্যাম লিখেন-
যদি মাতালের শিক্ষাকেন্দ্র মাদ্রাসাগুলো এপিকুরাস, প্লেটো এরিস্টটলের দর্শন- শিক্ষালয় হতো, যদি পীর দরবেশের আস্তানা ও মাজারগুলো গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতো, যদি মানুষ ধার্মিকের ধর্মান্ধতার পরিবর্তে
নীতিজ্ঞানের চর্চা করতো, যদি উপাসনালয়গুলো সর্ববিদ্যা চর্চাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতো,
ধর্মতত্ত্বের চর্চার পরিবর্তে যদি গণিত-বীজগণিতের উন্নতি সাধন করতো, যুক্তিবিদ্যা যদি সুফিতত্ত্ব, সংস্কার, কুসংস্কারের জায়গা দখল করতো, ধর্ম যা মানবজাতিকে বিভক্ত করে তা মানবতার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতো, পৃথিবী তাহলে বেহেশতে পরিণত হতো, পরপারের বেহেশত বিদায় নিতো, প্রেম- প্রীতি- মুক্তি- আনন্দে জগৎ পরিপূর্ণ হতো নিঃসন্দেহে।