লিখেছেন: অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ —
'বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই। জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন।’
ধর্ম নিয়ে খোলা আলোচনা কিংবা বিশ্লেষণ বাংলাদেশের সমাজ-ক্ষমতা অনুমোদন করে না। কিন্তু আবার সমাজ, মানুষ, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, বন্ধন-নিপীড়ন-শৃঙ্খল এবং সেগুলো থেকে মুক্তি পাবার লড়াইয়ের বিষয় আলোচনা করতে গেলে ধর্মের প্রসঙ্গ এসেই যায়। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, একটা পথ পেতে গেলে ধর্মের প্রসঙ্গ নীরবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলে না। এর কারণ কী? কারণ ধর্ম একটা বিশ্বাস হিসেবে যেরূপই ধারণ করুক না কেন এই ধর্মের মধ্যে আসলে বসবাস করে সমাজ। বসবাস করে সমাজের নানা বিধি, নিয়মনীতি, নৈতিকতা, অনুশাসন। সমাজের, রাষ্ট্রের বিধিই উপস্থিত হয় ঐশ্বরিক বিধান হিসেবে, ধর্মরূপে। এই ধর্মের মধ্যেই আবার থাকে, যেভাবে মার্কস বলেছিলেন, ‘‘হৃদয়হীনের হৃদয়, নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস”।
ধর্ম নিয়ে আরজ আলীর ভাবনা বা গবেষণা, সর্বোপরি প্রশ্ন উত্থাপন কোন পরিকল্পিত কাজ নয়। বাস্তব জীবনে, শৈশবের একটা ধাক্কাই তাঁকে এই পথে নিয়ে আসে, প্রশ্নের মুখোমুখি তাঁকে দাঁড় করায়, প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তাঁকে ব্যস্ত রাখে আজীবন। তাঁর আলোচনা, প্রশ্ন, দার্শনিক বিশ্লেষণ আসলে শুধুই ধর্ম গ্রন্থ নিয়ে নয়। ধর্মের গ্রন্থ বা শাস্ত্র আর জনগণের মধ্যে তার উপস্থিতি এক নাও হতে পারে। গ্রন্থ বা ধর্ম জনগণের মধ্যে কীভাবে উপস্থিত তাকে নিয়েই আরজ আলী মাতুব্বরের বিশেষ মনোযোগ। বস্তুত : জনগণ কিভাবে ধর্মকে গ্রহণ করেন তা শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে না। শাস্ত্রই যদি ধর্ম নির্ধারণ করতো তাহলে একটি ধর্ম পৃথিবীর সর্বত্র এবং সর্বকালে একইরকম হতো। শাস্ত্র আসলে মানুষের বাস্তব জগতে ধর্মের একটি দিক গঠন করে, সেটাকে আমরা কাঠামো বলতে পারি। কিন্তু তার রক্তমাংস, মাথা-মগজ, শরীর, চোখ ইত্যাদি তৈরি করে তার দাঁড়ানোর জায়গা-তার সমাজ ও তার সংস্কৃতি, তার সময়। এই সবকিছুই আরজ আলীর মনোযোগ আকর্ষণ করে, কেননা তিনি এই সবকিছুর মধ্যে মানুষের শৃঙ্খল উপলব্ধি করেছিলেন এবং তার থেকে বেরুবার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলেন। সেভাবেই তৈরি হলেন আমাদের আরজ আলী মাতুব্বর।
শহুরে মধ্যবিত্ত কিংবা গ্রামীণ ক্ষমতাবান কারও কাছেই আরজ আলী মাতুব্বর গ্রহণযোগ্যতা পাননি। কারণ এদেশে মধ্যবিত্ত কিংবা বিদ্বৎসমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে সেখানে ভক্তি দিয়ে জগৎ-সংসার দেখাতেই তার স্বস্তি, তাতেই তার আসক্তি। এই ভক্তি যেমন সৃষ্টিকর্তা কিংবা ধর্মের প্রচলিত বয়ানের প্রতি, তেমনি এই ভক্তি প্রচলিত বা যাকে বলা চলে বিশ্বব্যাংকীয় উন্নয়ন দর্শনের প্রতিও। দুটোই তার আশ্রয়। এই আশ্রয়ের খোলসে নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য তার অস্থিরতা এখন আগের চাইতে বেশি। প্রশ্ন তাই তার জন্য বিপদের কারণ, অস্বস্তির কারণ। আরজ আলী মাতুব্বর তাই তাদের কাছে ভীতিকর। হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম বাদে ‘বুদ্ধিজীবীদের’ কাছে আরজ আলী গৃহিত হননি কারণ প্রথমত: তিনি তাদের ‘উঁচু নাকে’ টোকা দিয়েছেন এবং দ্বিতীয়ত: আরজ আলীর প্রশ্ন উত্থাপনের ভঙ্গী ও ক্ষেত্রকে তারা বিপজ্জনক বিবেচনা করেছেন।
পা ভাঁজ করে মহাবিশ্ব দেখা
আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের এক কোণে বড় হয়েছেন। সেই গ্রাম কোনদিক থেকেই বিশিষ্ট নয়। অন্য আর দশটা গ্রামের মতোই তার সবকিছু। সেখানে সুন্দর প্রকৃতি এবং নিষ্ঠুর সমাজ দুইই ছিল। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাও কোন অনন্য কিছু নয়। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের জীবনে এইরকম কাহিনী পাওয়া যাবে। তখন তো বটেই, এখনও। কী সেটা?
ছোটবেলায় বাবা মারা যান। মাকে নিয়ে যখন তাঁর হাবুডুবু অবস্থা তখন মহা
জনী চাপে তাঁর বাবার কৃষিজমি যায়। ঘর ছিল “দৈর্ঘ্যে পাঁচ হাত ও প্রস্থে চার হাত। ঘরখানা তৈরির সরঞ্জাম ছিল ধৈঞ্চার চাল, গুয়াপাতার ছাউনী, মাদারের খাম, খেজুরপাতার বেড়া ও ঢেঁকিলতার বাঁধ। আর তারই মধ্যে ছিল ভাতের হাঁড়ি, পানির কলসী, পাকের চুলো, কাঁথা-বালিশ সবই। রাতে শুতে হতো পা গুটিয়ে। ঘুমের ঘোরে কখনো পা মেলে ফেললে হয়তো ভাতের হাঁড়ি কাত হয়ে পড়তো বা জলের কলসী পড়ে গিয়ে কাঁথা বালিশ ভিজে যেতো। একটি এঁটেকলা দ্বারা তখন আমরা মায়ে-পুতে পান্তাভাত খেতাম দুবেলা।”
এরকম অবস্থায় যারা বসবাস করেন তাদের জীবনের পরবর্তী অধ্যায় এর থেকে খুব ভিন্ন কিছু হয় না। কেননা এটা হলো এক দুষ্টচক্রের মতো। এই অবস্থার কারণেই জগতের সকল সুযোগ ও সম্ভাবনা থেকে তাঁদের বঞ্চিত থাকতে হয় আবার এই বঞ্চিত থাকার কারণেই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করা সম্ভব হয় না। নিজেদের মেধা, সৃজনশীলতা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়, অপচয় হয়, বিনষ্ট হয়। এই দুষ্টচক্রের থেকে আরজ আলী যে খুব বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তা নয়। তবে এরকম পা ভাঁজ করে শোয়ার অবস্থা থেকে যে তিনি বিশ্বকে দেখার ক্ষমতা আয়ত্ত করেছিলেন সেখানেই আরজ আলী মাতুব্বর হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ।
আরজ আলী মাতুব্বরের গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। পরে এক মক্তব হয়। সেখানে তিনি কিছুদিন পড়েছেন কিন্তু বই খাতা কেনার পয়সা ছিল না। এরকম ভাঙাচোরা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে গেলেও পয়সা লাগে, পরিবারের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজন হয়। সেটা ছিল না বলে ‘মেধাবি ছাত্র’ বলে পরিচিত হবার কোন সুযোগ তিনি পাননি। এই প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রহের বাইরে থেকেই তাঁর বিদ্যাচর্চার প্রতি দুর্মর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। সেজন্য তাঁর শৈশবের সবচাইতে আনন্দদায়ক, উত্তেজনাকর ঘটনা ছিল জ্ঞাতিচাচার কাছ থেকে (বাংলা ১৩২১ সাল) সীতানাথ বসাক কৃত তৎকালীন ‘‘দুআনা দামের একখানা আদর্শলিপি বই’’ পাওয়া। নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন তা আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষের শৈশবের আনন্দ ও বেদনার স্মৃতি। তিনি বলছেন, “সেদিন আমি যে কতটুকু আনন্দ লাভ করেছিলাম, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবো না। সেদিনটি ছিলো আমার জীবনের সর্বপ্রথম বই হাতে ছোঁয়ার দিন। তাই আনন্দ-স্ফূর্তিতে আমার মনটা যেনো ফেটে
যাচ্ছিলো। আমি বইখানা হাতে নিয়ে নৃত্য করতে করতে গিয়েছিলাম প্রতিবেশীর বাড়িতে সহপাঠীদের বইখানা দেখাতে। ...সারাক্ষণ পড়তাম ও সাথে সাথে রাখতাম। ...কিন্তু আমার সে সাধের সম্পত্তিটুকু রক্ষা করতে বিষাদ দেখা দিলো বর্ষাকালে। ...চালে বৃষ্টির পানি মানায় না। ...অল্প বৃষ্টির সময় যেখানে রাখতাম, বৃষ্টি বেশী হলে সেখান থেকে সরাতে হতো, অত্যধিক বৃষ্টি হলে কোথাও স্থান পেতাম না, তখন উপুড় হয়ে বইখানা রাখতাম বুকের নীচে।”
আমাদের সমাজের অসংখ্য মানুষের এই অভিজ্ঞতা অভিন্ন হলেও এই লড়াইয়ে টিকে থাকার এবং ফলাফলের অভিজ্ঞতায় আরজ আলী ভিন্ন। ভয়াবহ কঠিন জীবন সংগ্রাম এবং অভাব অনটন তাঁর পুস্তকপ্রীতি আর কৌতুহল শেষ করতে পারে নি। আদর্শলিপি পাবার সাত বছরের মাথায় তিনি অনটনের মধ্যেও ‘পুঁথি-পুস্তক’ সংগ্রহ শুরু করেন। ১৮ বছরে তিনি বই সংগ্রহ করেছিলেন ৯০০; বইএর আলমারি ছিল না, কেনার সাধ্যও ছিল না। সেজন্যই এক ঘুর্ণিঝড়ে দুর্বল ঘরের সঙ্গে বইগুলোও উড়ে চলে যায়। উন্মাদের মতো চেষ্টা করেছিলেন বহু বছরে বহু কষ্টের সংগ্রহ পুনরুদ্ধার করতে। কিন্তু লাভ হয়নি-- “পরের দিন পথে-প্রান্তরে পেয়েছিলাম দু’চারখানা ছেঁড়া পাতা। মাতৃশোকে আমি কাঁদিনি, কিন্তু বইগুলোর দুঃখে সেদিন আমার যে কান্নার বান ডেকেছিলো, তা আমি রোধ করতে পারিনি।”
হেরে না গিয়ে আবার বই সংগ্রহে নিয়োজিত হলেন। কিন্তু ঘরের উন্নতি না হওয়ায় বই পুস্তক নতুন ভাবে সংগ্রহ করবার ১৭ বছর পর একই ঘটনা তাঁর জীবনে আবারও ঘটলো। বলাই বাহুল্য, বই রাখতে গেলে শুধু ঘর থাকাই যথেষ্ট নয়, দরকার যথেষ্টই শক্তপোক্ত ঘর।
আরজ আলী গ্রামীণ জগতে মানুষের প্রয়োজন এবং দৈনন্দিন কাজ ও সমস্যা থেকে কখনও বিযুক্ত হননি, হবার অবসরও পাননি। এই যুক্ততা ছিল তাঁর জীবন, ছিল তাঁর জীবিকা। তিনি আমিন-এর কাজ করতেন। গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন কাজের সুবিধার জন্য তিনি স্বল্প খরচের চুলাও তৈরি করেছিলেন। দ্বিতীয় খণ্ডে এর নকশা ও প্রস্তুত প্রণালী আছে। জমি জমার পরিমাপের সামান্য ভুলত্রুটি কিংবা জালিয়াতির কারণে বাংলাদেশে কত পরিবার ধ্বংস হয়েছে তার হিসাব করা কঠিন। পরিচিতজনেরা বলেছেন আমিন হিসেবে আরজ আলী এতটাই নিখুঁত ছিল এবং তা সকলের বিশ্বাস এমনভাবেই অর্জন করেছিল যে শুধুমাত্র তাঁর কাজের জন্যই বহু মানুষের জীবন বেঁচেছে, বহুসংঘাত আর খুনোখুনির হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে মানুষ। কাজের এই দক্ষতা ও নিষ্ঠার কারণে শুধু নিজ গ্রাম নয় আশেপাশের একটি বড় অঞ্চল জুড়ে তাঁর একটি গণভিত্তি তৈরি হয়েছিল।
এই গণভিত্তিই তাঁকে শক্তি যুগিয়েছিল প্রচলিত অনেক বিশ্বাস ও প্রথা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের। তাঁকে নাস্তিক বলে কেউ কেউ কোণঠাসা করতে চাইলেও তিনি খুব কদর নিয়ে সারাজীবন কাজ করেছেন। এমনকি আশেপাশের পীর, ধর্মীয় নেতারাও তাঁর বিরুদ্ধে কখনও ফতোয়া জারি করেননি। আরজ আলী এই বিষয় নিয়ে সবার সঙ্গেই আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি উন্মুক্ত ছিলেন, যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করলে তাঁর প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিলে তিনি তা গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। এবং সেটাই, এবং প্রশ্ন উত্থাপনের ভঙ্গিই তাঁকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী করেনি, তাঁকে নিঃসঙ্গ করেনি, যদিও “স্থানীয় বিশেষ সমাজে” তিনি দীর্ঘদিন “অবহেলিত ও তিরস্কৃত” হয়েছেন।
জ্ঞানের কি ডিগ্রী হয়?
নিজের নামে পাননি বলে অন্যের নামে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়েছেন। এক পর্যায়ে এসে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ওয়ারিশদের বুঝিয়ে দিয়ে কাজ করেছেন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি
নিজেই বলেছেন, “দিনমজুরী করেছি মাঠে মাঠে আমিনগিরি রূপে। ...টাকা আমার নেই। আর জীবিকা নির্বাহের জন্য আমার টাকার প্রয়োজনও নেই।” নির্মাণের খরচ কমানোর জন্য লাইব্রেরি নির্মাণে শারীরিক অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি খুব পরিষ্কার ছিলেন এই বিষয়ে যে, “বস্তুত: বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই। জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন। সেই অসীম জ্ঞানার্জনের মাধ্যম স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তা হচ্ছে লাইব্রেরি।”
এই লাইব্রেরি নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি বহু মানুষের কাছে হাত পেতেছেন, তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছেন। কিন্তু সবার কাছ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা একরকম হয়নি। যাদের সঙ্গতি নেই তাঁদের কাছ থেকেই তিনি সহযোগিতা পেয়েছেন সবচাইতে বেশি। সেজন্যই তিনি বলেন, “লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে স্থানীয় বিত্তবানদের আমি সহানুভূতি পাইনি। তবে মজুরদের সাহায্য পেয়েছি প্রচুর। ...তাঁরা তাঁদের মজুরীর অর্ধেক নিয়ে আমার লাইব্রেরির নির্মাণকাজ সমাধা করেছেন। কাজেই এ গ্রামের মজুরদের কাছে আমি ঋণী, হুজুরদের কাছে নয়।”
এই লাইব্রেরি যাতে তাঁর মৃত্যুর পরও টিকে থাকে সেজন্য তাঁর উদ্বেগ ছিল এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও তিনি গ্রহণ করেছেন। লিখিতভাবে তহবিল, লাইব্রেরি ও যাবতীয় অনুষ্ঠানাদির পরিকল্পনা জানিয়ে গেছেন। মৃত্যুর পর নিজের অবশিষ্টাংশ যাতে মানুষের কাজে লাগে সে ব্যবস্থাও করেছেন। মৃতদেহ বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে দান করেন। চক্ষুদ্বয় চক্ষুব্যাংকে। গ্রন্থের প্রতি আরজ আলীর যে এই অপ্রতিরোধ্য আগ্রহ-- তার কারণ কী? ডিগ্রী লাভের তো তাঁর কোন অবস্থাই ছিল না কারণ মক্তবের পর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এদেশের অধিকাংশ মানুষের মতোই, তাঁরও প্রবেশাধিকার কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। ছোটবেলা থেকেই কাজ করেই তাঁর বই সংগ্রহ এবং পড়া। ডিগ্রী লাভের জন্য অবশ্য বই খুব বেশি দরকারও হয় না, চারপাশে দেখি, অনেকসময় ডিগ্রী-পিপাসু ব্যক্তিদের বই-এর প্রতি, বিদ্যাচর্চার প্রতি এক সীমাহীন ঔদাস্য এমনকি বিকর্ষণও তৈরি হয়। এইসব মানুষের মনের মধ্যে ছোট-বড় ডিগ্রীর অল্পশিক্ষা-কুশিক্ষা এমনই জমাট বেঁধে বসে যে সব কৌতূহল, জগত-মানুষ-সমাজ সম্পর্কে সব প্রশ্নও বিলুপ্ত হয়। অচল মস্তিষ্ক এবং বড় বড় ডিগ্রী যে একসঙ্গেই চলতে পারে তার উদাহরণ পাবার জন্য আমাদের খুব বেশি পরিশ্রম করতে হবে না।
অন্যদিকে আরজ আলী মাতুব্বরের বই-এর প্রতি, বিদ্যাচর্চার প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহের প্রধান কারণই হলো জগত মানুষ সংসার নিয়ে, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে, অপার কৌতুহল এবং মাথায় অনেক প্রশ্ন। আসলে কৌতূহল আর প্রশ্ন এমনই যে, তার কোন সীমা বলে কিছু নেই। কৌতূহল পূরণ করবার জন্য যত প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করা যায় ততই নতুন নতুন প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটে। কাজেই কেউ যদি প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে শুরু করেন সে এক অবিরাম যাত্রা। এই যাত্রা কঠিন কেননা তা প্রচলিত অনেক বোধ-বিশ্বাসকে আঘাত করে, এই যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ কেননা তা বিদ্যমান ক্ষমতার কাঠামোকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে, এই যাত্রা গভীর আনন্দের কেননা তা ক্রমান্বয়ে সীমানা সম্প্রসারিত করতে থাকে, অসীমের দিকে তাকানোর ক্ষমতা বা আত্মবিশ্বাস দান করে এবং সীমার মধ্যে নিজকেই যেন পূর্ণ করতে থাকে। এই প্রশ্নই আমাদের সামনে আরজ আলী মাতুব্বরকে উপস্থিত করেছে।
তিনি তাঁর জ্ঞানের সীমা সম্প্রসারণে তাঁর সমাজের সকল জ্ঞানচর্চার মাধ্যমকেই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুঁথি পাঠ করে করে তাঁর পাঠের ক্ষমতা যেমন বাড়ে তেমনি নতুন নতুন চিন্তার জগত উন্মোচিত হতে থাকে। তিনি লিখেছেন, “স্থানীয় কতিপয় তরুণের আগ্রহে পুঁথি ও সারি গানের দল গঠনপূর্বক গান করিতে আরম্ভ করি এবং বিভিন্ন মৌলবি সাহেবদের নিকট কোরান, হাদিস, কেয়াস, ফেকাহ ইত্যাদি মুসলিম ধর্মগ্রন্থগুলির ও পুরুত- ভটচাজ্জিদের নিকট বেদ, পুরাণ, গীতা, রামায়ণ-মহাভারতাদি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলির বঙ্গানুবাদ পাঠ ও শ্রবণ করি-- উক্ত গানের তর্কসমুদ্র পার হওয়ার জন্য।”
কাদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন আরজ আলী মাতুব্বর? তিনি নিজেই বলেন, “প্রশ্নের কারণ কি? কারণ ‘অজানাকে জানার স্পৃহা মানুষের চিরন্তন’ এবং এইরকম ‘কি’ ও ‘কেন’র অনুসন্ধান করিতে করিতেই মানুষ আজ গড়িয়া তুলিয়াছে বিজ্ঞানের অটল সৌধ”; আরজ আলী মাতুব্বর এই সৌধ নির্মাণে হাত দিয়েছেন কোন প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন ছাড়াই।
প্রশ্ন নিয়ে যায় অকূল চিন্তার সাগরে
আমাদের সমাজ প্রশ্ন উত্থাপনকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে। বারবার বলে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’; মানুষের মনোজগতে প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করবার ক্ষেত্রে অস্বস্তি এবং ভয় কাজ করে। আরজ আলীর বিশিষ্টতা এখানে যে, তিনি এই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বর লিখেছেন, “এলোমেলোভাবে মনে যখন যে প্রশ্ন উদয় হইতেছিল, তখন তাহা লিখিয়া রাখিতেছিলাম, পুস্তক প্রণয়ণের জন্য নহে, স্মরণার্থে। ওগুলি আমাকে ভাসাইতেছিল অকূল চিন্তা-সাগরে এবং আমি ভাসিয়া যাইতেছিলাম ধর্মজগতের বাহিরে।”
যে প্রশ্নগুলি তিনি টুকে রাখছিলেন সেগুলো তাঁর আশেপাশে মানুষের জীবনযাপন, বিশ্বাস, প্রথা, অনুশাসনকে ঘিরেই। এর প্রায় সবগুলোই ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এর সব ধর্মগ্রন্থে নাও থাকতে পারে। বাস্তবে ধর্ম যেভাবে উপস্থিত সেটাই আরজ আলীর বিবেচনার বিষয় হয়েছে। এই প্রশ্নগুলি নিয়ে শুধু যে তিনিই অকূল সাগরে ভেসে যাচ্ছিলেন তা নয়, তাঁর আশেপাশের মানুষদেরকেও তা নাড়া দিচ্ছিল ভয়ানকভাবে। আর কিছু নয় শুধুই প্রশ্ন। অল্পদিনের মধ্যেই প্রচারিত হলো তিনি নাস্তিকতা প্রচার করছেন। এই প্রচার শুনে এলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, ‘সমাজ-শাসন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত’ সরকারি কর্মকর্তা। ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে (ইং ১৯৫১ সালে) ১৩৫৮ সালের ১২ জ্যৈষ্ঠ বরিশালের তৎকালীন ‘ল-ইয়ার ম্যাজিষ্ট্রেট ও তবলিগ জামাতের আমির’কে তিনি প্রশ্নের তালিকা দেন। জবাবে সন্তুষ্ট হলে তিনি জামাতভুক্ত হবেন এই প্রতিশ্রুতিও প্রদান করেন। কিন্তু সেই ‘‘করিম সাহেব চলিয়া যাইবার পরে আমি পাইয়াছিলাম কম্যুনিজমের অপরাধে আসামী হিসাবে ফৌজদারী মামলার একখানা ওয়ারেন্ট, কিন্তু আমার প্রশ্নগুলির জবাব আজও পাই নাই।’’
১৯৫১ সালের ১২ই জুলাই কোর্টে জবানবন্দী দিতে গিয়ে আগের প্রশ্নগুলোই সুসংগঠিত আকারে ‘সত্যের সন্ধান’ নামে তিনি উপস্থাপন করেন। তিনি বলছেন, ‘সত্যের সন্ধান’-এর পাণ্ডুলিপিখানার বদৌলতে সে মামলায় আমি দৈহিক নিষ্কৃতি পেলাম বটে, কিন্তু মানসিক শাস্তি ভোগ করতে হলো বহু বছর। কেননা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা আমি প্রকাশ করতে পারবো না ও ধর্মীয় সনাতন মতবাদের সমালোচনামূলক অন্য কোনো বই লিখতে পারবো না এবং পারবো না কোনো সভা-সমিতিতে-বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বমত প্রচার করতে। যদি এর একটি কাজও করি, তবে যে কোনো অজুহাতে আমাকে পুনরায় ফৌজদারীতে সোপর্দ করা হবে। অগত্যা কলম-কালাম বন্ধ করে আমাকে বসে থাকতে হলো ঘরে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো আমার কর্মজীবনের অমূল্য ২০টি বছর। বাংলাদেশে কুখ্যাত পাকিস্তান সরকারের সমাধি হলে পর ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা প্রকাশ করা হয় ১৩৮০ সালে, রচনার ২২ বছর পর।”
শুধু প্রশ্ন উত্থাপনের অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিকে কলম কালাম চর্চা থেকে রাষ্ট্রের বল দিয়ে থামিয়ে রাখা হলো। প্রশ্নের প্রতি এত ভয় রাষ্ট্রের, কলম ও কালাম নিয়ে এত ভয়! সেই ১৯৫১ সালের প্রশ্ন থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে নিভৃত গ্রামে একা, মৃদু কেরোসিনের বাতি নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বর যেসব বিষয় অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ ও সূত্রবদ্ধ সেগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।
এগুলো হল:
(১) দৈনন্দিন দুর্ভোগ এবং তার পরিবর্তনের সম্ভাব্যতা।
(২) লোভ এবং ভয় কেন্দ্রিক ধর্ম-ডিসকোর্স।
(৩) জগতের উদ্ভব এবং তার নিয়ম।
(৪) ঈশ্বর, শয়তান, রাম, রাবণ, ফেরেশতা, দেবতা সম্পর্কিত মিথ পর্যালোচনা।
আল্লাহর গজব কিংবা কপালের লেখা
আরজ আলী মাতুব্বরকে বিশেষভাবে ভাবিত করেছে মানুষের দৈনন্দিন দুর্ভোগ এবং সে সম্পর্কে মানুষের নিজস্ব ব্যাখ্যা, সমাজে অধিপতি চিন্তায় সেসব দুর্ভোগ আর অপমান যুক্তিযুক্ত করবার চেষ্টা। এসব বিষয় অনুসন্ধান করতে গিয়েই তিনি ক্রমশঃ আরও গভীর দার্শনিক বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। দারিদ্র, অনাহার, অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্গতি ইত্যাদি আরজ আলীকে বাইরে থেকে দেখতে হয়নি। তিনি এর মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু এসব ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে করতে তিনি সেই বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন যা মনে করে বা মনে করতে শেখায় যে, এসব কিছুই কপালের লেখা, এর পরিবর্তন সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে এযাবতকাল যত বড় দুর্যোগে মানুষ পড়েছেন তার সবগুলোতেই এর কারণ হিসেবে শোনা গেছে যে, এগুলো হল ‘আল্লাহর গজব’। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর কিংবা ১৯৯১ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে যখন লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিলেন তখন ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ঘুরতে গিয়ে এরকম কথা আমি নিজেও অনেক শুনেছি। ১৯৯১ সালের সেই ঘুর্ণিঝড়ে গ্রামের পর গ্রাম সমান হয়ে গিয়েছিল। অক্ষত ঘর তখন সমগ্র এলাকায় খুঁজে পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটো ঘর অক্ষত পাওয়া যাচ্ছিল যেগুলো পাকা, মসজিদও। যুক্তিসঙ্গত কারণেই, যেগুলো পাকা সেগুলো টিকেছিল, ধ্বসে পড়েছিল কাঁচাগুলি। যারা এসবকিছুকে অল্লাহর গজব বলছিলেন তাঁদের বক্তব্য ছিল ‘এগুলো হল পাপের ফল’; কিন্তু পাপ কি তাদেরই বেশি যাদের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় থাকতে হয় এবং যাদের আশ্রয় খুবই ভঙ্গুর? যারা টেকসই বাড়িতে বসবাস করেন এবং নিরাপদ জায়গায় থাকেন হারাম পয়সায়, তাদের পাপে গজব হয় কোথায়? এই বিষয়গুলি নিয়েই আরজ আলী প্রশ্ন তুলেছিলেন।
কোন দেশে ধর্মবিশ্বাস অনেক থাকলেও যদি পানি দূষিত হয় কিংবা পুষ্টির অভাব থাকে সর্বোপরি যদি চিকিৎসার ব্যবস্থার অভাব থাকে তাহলে সেখানে অকাল মৃত্যুর হার অনেক বেশি। শাসকেরা এবং তাদের রক্ষা করতে নিয়োজিত থাকেন যেসব ধর্মপ্রচারক তাঁরা পানি, খাদ্য-পুষ্টি কিংবা চিকিৎসার বিষয়ে প্রশ্ন না তুলে অভিযুক্ত করতে থাকেন যারা গরীব, যারা ভুগছেন তাদেরই। বলেন, দেশের মানুষের ঈমান কম। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, কেন তবে যেসব দেশে ধর্মবিশ্বাস কম সেসব দেশে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু কম? আবার ধর্মের মিথ ধরে প্রশ্ন করেন, “...আর যদি যাবতীয় জীবের খাদ্যই মেকাইল বণ্টন করেন, তবে জগতের অন্য কোন প্রাণীকে নীরোগ দেহে শুধু উপবাসে মরিতে দেখা যায় না, অথচ মানুষ উপবাসে মরে কেন? বৈষম্য কেন?”
এর সঙ্গেই প্রশ্ন, ভাগ্য। কপালের লেখা। তিনি বলেন, “ভাগ্যলিপি কি অপরিবর্তনীয়? ...রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে শিক্ষা দিতেছে— কর্ম কর, ফল পাইবে। কিন্তু ধর্ম শিক্ষা দিতেছে ইহার বিপরীত। ধর্ম বলিতেছে— কর্ম করিয়া যাও, ফল অদৃষ্টে (তকদীরে) যাহা লিখিত আছে তাহাই পাইবে। ...বিশেষত মানুষের কৃত ‘কর্মের দ্বারা ফলোৎপন্ন’ না হইয়া যদি ঈশ্বরের নির্ধারিত ‘ফলের দ্বারা কর্মোৎপত্তি’ হয় তবে ‘সৎ’ বা ‘অসৎ’ কাজের জন্য মানুষ দায়ী হইবে কেন?”
সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলে উত্তরাধিকার প্রশ্নটিও গুরুত্বের সঙ্গে আসে। বর্তমান সকল প্রধান ধর্মেই যেহেতু সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাকে স্থায়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে সেহেতু সব ধমের্ই উত্তরাধিকার বিষয়েও নিয়মবিধি আছে। ইসলাম ধর্মে এ সংক্রান্ত যে বিধি সে সম্পর্কে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে তিনি বলেন, “মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তি তাহার ওয়ারিশগণের মধ্যে বণ্টনব্যবস্থাকে বলা হয় ‘ফরায়েজ নীতি’; ইহা পবিত্র কোরানের বিধান। মুসলিম জগতে এই বিধানটি যেরূপ দৃঢ়ভাবে প্রতিপালিত হইতেছে, সেরূপ অন্য কোনটি নহে। এমনকি পবিত্র নামাজের বিধানও নহে। ইহার কারণ বোধহয় এই যে, ফরায়েজ বিধানের সঙ্গে জাগতিক স্বার্থ জড়িত আছে।” তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন বিধান অনুযায়ী সবাইকে সম্পত্তি বণ্টন করলে মোট সম্পত্তি দিয়ে কুলায় না। দরকার হয় ষোল আনার স্থলে আঠারো আনা। এই সমস্যার সমাধান করেন হজরত আলী। তিনি যে নিয়মের দ্বারা উহার সমাধান করিয়াছিলেন, তাহার নাম ‘আউল’। মানুষের কেন এই সংশোধনের দরকার হল? তিনি প্রশ্ন করেন, ‘পবিত্র কোরানের উক্ত বিধানটি ত্রুটিপূর্ণ কেন?’
নারীর অবস্থান, নারীর অধিকার, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের ‘বৈধতা’-‘অবৈধতা’, সন্তানের উপর অধিকার সম্পর্কে সকল ধর্মেই কড়া বিধিবিধান আছে। ইসলাম ধর্মে কোরান এবং হাদিস থেকে এসব বিধিবিধান গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হয়। আরজ আলী মাতুব্বর এক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন ‘হিল্লা বিয়ে’ নিয়ে। এই বিয়ের প্রথা, অন্যান্য আরও অনেক আইনের মতো, কত নারীর জীবনকে বিষময় ও বিপর্যস্ত করেছে, কত নারীকে ভয়াবহ অপমানের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছে তার পরিসংখ্যান বের করা অসম্ভব। এটি এখনও চলছে। স্বামী ভুলে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আবার যদি তাঁকে গ্রহণ করতে চায় তবে তার একমাত্র বিধিসম্মত ব্যবস্থা হল স্ত্রীকে অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে যার সঙ্গে কোন ভালবাসা তৈরি হবে
না কিন্ত নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আরজ আলী মাতুব্বর বলেন, “অথচ পুনরায় গ্রহণযোগ্যা নির্দোষ স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে ‘হিল্লা’ প্রথার নিয়মে স্বামীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় সেই নির্দোষ স্ত্রীকেই। অপরাধী স্বামীর অর্থদ-, বেত্রাঘাত ইত্যাদি না-ই হউক, অন্তত তওবা পড়ারও বিধান নাই, আছে নিষ্পাপিনী স্ত্রীর ইজ্জতহানির ব্যবস্থা। একের পাপে অন্যকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় কেন?” তিনি পুরো ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করে আরও প্রশ্ন করেন যে, “এইরূপ মিলন ব্যাভিচারের নামান্তর নয় কি?” অথচ ‘ব্যাভিচারের’ অপরাধে কত নারী পুরুষকে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ধর্মের বিধান অনুযায়ী নিষ্ঠুর যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়েছে এমনকি প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
ভাগ্য গড়বার জন্য, ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্য নানাবিধ আয়োজন ও ব্যবস্থা আছে বিভিন্ন ধর্মে। ইসলাম ধর্মে শবেবরাত বা হিন্দুধর্মে লক্ষীপূজা এরকম দুটি পদ্ধতি যা দিয়ে বৈষয়িক জীবন উন্নতি অনুমোদন করেন ঈশ্বর-- এরকম বিশ্বাসই প্রবলভাবে কাজ করে। কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বর চারপাশের, বিশ্বের নানা দেশের উদাহরণ দিয়ে দেখান যে, সম্পদ বা স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর কোন সম্পর্ক দেখা যায় না। বরঞ্চ যারা বিপুল সম্পদের মালিক, বৈষয়িকভাবে সফল যাদের বরাত ‘ভাল’ তাদের বেশিরভাগ এসবের ধারে কাছেও নেই। তাঁদের বরঞ্চ বরাত ভাল হবার পর ধর্মের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখা যায় ভিন্ন কারণে।
হিন্দুধর্মে পশুবলি বা ইসলামে কোরবানী প্রথা সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও তাঁকে খুশি করবার একটি পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে কোরবানীর ব্যাপারে উৎসাহ দিনে দিনে বাড়ছে। এইজন্য যে আয়োজ
ন, উল্লাস এবং প্রতিযোগিতা দেখা যায় সেসব আলোচনা করে আরজ আলী বলেছেন এতে পশুর হয় ‘আত্মত্যাগ’ এবং কোরবানী দাতার হয় ‘সামান্য স্বার্থত্যাগ’; মাংস ভোগের মহোৎসব দেখে তিনি প্রশ্ন করেন যে, এই সামান্য স্বার্থত্যাগের বিনিময়ে যদি দাতার স্বর্গলাভ হইতে পারে, তবে কোরবানীর পশুর স্বর্গলাভ হইবে কিনা?
কেন তাঁকে দাঁড়াতে হয় লোভ আর ভয়ের উপর? ধর্মের বিভিন্ন বক্তব্য, নিয়মনীতি সর্বোপরি প্রধান ধর্মগুলোর ধর্মগ্রন্থসমূহকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণের মধ্যে আনা দরকার। আরজ আলী মাতুব্বর বলেন যে, “ধর্মগ্রন্থের বাণীসমূহ লৌকিক বা অলৌকিক যা-ই হোক, তাতে মানব জীবনের অত্যাবশ্যকীয় বহু মূল্যবান তথ্যও আছে। তাই যাবতীয় ধর্মগ্রন্থই আমাদের পরম শ্রদ্ধার্হ ও সমান আদরণীয়।”
আরজ আলী নিজে জন্মের পর থেকেই ইসলামের আবহেই বড় হয়েছেন। এই ধর্ম তাঁর অনেক নিকটবর্তী যার একদিকে শাস্ত্রীয় বক্তব্য অন্যদিকে তার বাস্তব প্রয়োগের রূপও তিনি দেখেছেন। কোরান সম্পর্কে তিনি বলেন, “পবিত্র কোরান মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ এবং ইহা ঐশ্বরিক গ্রন্থ বলিয়া পরিচিত। যেসব গ্রন্থকে ঐশ্বরিক বলিয়া দাবি করা হয়, পবিত্র কোরান তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বরং অতুলনীয়।”
ধর্ম আর মানুষ কে কাকে তৈরি করে, কে কাকে পালন করে? এর জবাবই ঠিক করে দেয় একজনের মতাদর্শিক অবস্থান। আরজ আলী এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “ধর্ম মানুষকে পালন করে না, বরং মানুষ ধর্মকে পালন করে এবং প্রতিপালনও।” আরজ আলী বলেন, “সাধারণত আমরা যাহাকে ‘ধর্ম’ বলি তাহা হইল মানুষের কল্পিত ধর্ম।” ধর্ম প্রবর্তকদের তিনি অভিহিত করেছেন মহাজ্ঞানী হিসেবে যারা ‘যুগে যুগে’ ‘স্রষ্টার’ প্রতি মানুষের কর্তব্য এবং ‘মানুষের সমাজ ও কর্মজীবনের গতিপথও’ দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছে অনেক ধর্ম ও তা নিয়ে বিভেদ। অনেক রক্তক্ষয়ী সংঘাতও সৃষ্টি হয়েছে এটি থেকে।
কিন্তু ‘সাপে নেউলে’ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধর্মের সারবস্তুর মধ্যে অমিলের চাইতে মিলই বেশি। আরজ আলী প্রশ্ন করেন, ‘‘লক্ষাধিক পয়গম্বর প্রায় সবাই আরব দেশে জন্মিলেন কেন?’’ বাস্তবিকই আরব অঞ্চলের পর ভারত, চীন, জাপান প্রভৃতি অঞ্চলকেই ধর্ম প্রবর্তনের কেন্দ্র হিসেবে পাওয়া যায়। দখল-পূর্ব আমেরিকার ধর্মের খবর এখনও প্রকাশিত হচ্ছে। সেমিটিক ধর্মগুলো ধারাবাহিকতা রেখেছে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। হজরত ইব্রাহিম থেকে শুরু হয়ে ইসলাম ধর্ম পর্যন্ত। ভারত, চীন, জাপান ইত্যাদি অঞ্চলে ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন ধারাবাহিকতা। এটা ঠিক এরকম নয় যে, একটি ধর্ম এসেছে এবং তার সূত্র ধরে সমাজ-অর্থনীতি এগিয়েছে। ঘটনাটা বরঞ্চ উল্টো। সমাজ অর্থনীতির ধরনের উপরই ধর্মের রূপ দাঁড়িয়েছে। বহু ধর্ম মরে গেছে। আবার বহু ধর্ম মিশে গেছে অন্য কোনটির সঙ্গে আবার কোন কোনটি ব্যাপক প্রভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। হিন্দু ধর্ম, যাকে বৈদিক ধর্মও বলা হয়, অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে বহু ক্ষুদ্র আঞ্চলিক ধর্ম, পাওয়া যাবে সেগুলোর দেবদেবী বিশ্বাস আচার।
আরজ আলী ভারতে প্রবর্তিত এই বৈদিক ধর্মের বহু বিশ্বাস ও রীতিনীতির সাথে মিল দেখাচ্ছেন আরবে প্রবর্তিত সেমিটিক ধর্মগুলোর সঙ্গে। এক ধর্মে ‘পৌত্তলিকতা’ ও অন্য ধর্মে ‘পৌত্তলিকতা বিরোধিতা’র মতো মৌলিক তফাৎ থাকলেও এই সাদৃশ্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তিনি অভিন্নতার একটি তালিকা তৈরি করেছেন নিম্নরূপে :
১. ঈশ্বর এক-- একমেবাদ্বিতীয়ম (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)।
২. বিশ্ব-জীবের আত্মাসমূহ এক সময়ের সৃষ্টি।
৩. মরণান্তে পরকাল এবং ইহকালের কর্মফল পরকালে ভোগ।
৪. পরলোকের দুইটি বিভাগ-- স্বর্গ ও নরক (বেহেস্ত-দোজখ)।
৫. স্বর্গ সাত ভাগে এবং নরক সাত ভাগে বিভক্ত
৬. স্বর্গ বাগানময় এবং নরক অগ্নিময়।
৭. স্বর্গ ঊর্ধ্বদিকে অবস্থিত।
৮. পূণ্যবানদের স্বর্গপ্রাপ্তি এবং পাপীদের নরকবাস।
৯. যমদূত (আজ্রাইল) কর্তৃক মানুষের জীবনহরণ।
১০. ভগবানের স্থায়ী আবাস ‘সিংহাসন’।
১১. স্তব-স্তুতিতে ভগবান সন্তুষ্ট।
১২. মন্ত্র (কেরাত) দ্বারা উপাসনা করা।
১৩. মানুষ জাতির আদিপিতা একজন মানুষ-- মনু (আদম)।
১৪. নরবলি হইতে পশুবলির প্রথা প্রচলন।
১৫. বলিদানে পূণ্যলাভ (কোরবানী)
১৭. তীর্থভ্রমণে পাপের ক্ষয়-- কাশীগয়া (মক্কা-মদিনা)।
১৮. ঈশ্বরের দূত আছে ফেরেস্তা)।
১৯. জানু পাতিয়া উপাসনায় বসা।
২০. সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত (সেজদা)।
২১. করজোড়ে প্রার্থনা (মোনাজাত)।
২২. নিত্যউপাসনার নির্দিষ্ট স্থান-- মন্দির (মসজিদ)।
২৩. মালা জপ (তসবিহ পাঠ)
২৪. নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা করা-- ত্রিসন্ধ্যা।
২৫. ধর্মগ্রন্থপাঠে পূণ্যলাভ
২৬. কার্যারম্ভে ঈশ্বরের নামোচ্চারণ
২৭. গুরুর নিকট দীক্ষা
২৮. স্বর্গে গণিকা আছে-- গন্ধর্ব, কিন্নরী, অপ্সরা (হুর-গেলমান)
২৯. উপাসনার পূর্বে অঙ্গ ধৌত করা (অজু)
৩০. দিকনির্ণয়পূর্বক উপাসনায় বসা বা দাঁড়ানো
৩১. পাপ-পূণ্য পরিমাপে তৌলযন্ত্র ব্যবহার (মিজান)
৩২. স্বর্গগামীদের নদী পার হওয়া-- বৈতরণী (পোলছিরাত)।
১৬. ঈশ্বরের নামে উপবাসে পূণ্যলাভ (রোজা)।
আমরা ধর্ম প্রবর্তনের দুটো ধরন দেখি: প্রথমত, এক. নিজেদের জীবনযাপন, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদির স্বাভাবিক তাগিদ এবং জাগতিক নিয়ম সম্পর্কে ধারণার অভাব থেকে কিছু বিশ্বাস, চর্চা, নিয়মনীতির সংগঠন হিসেবে ধর্ম দাঁড়িয়েছে। এগুলোর মধ্যে পড়ে প্রাচীন আঞ্চলিক বা গোত্রীয় সকল ধর্মই। হিন্দু ধর্ম এরকম অনেক ধর্মেরই সম্মিলিত রূপ। সকল বড় ধর্মই প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন আঞ্চলিক বা গোত্রীয় ধর্মের ধারাবাহিকতার উপর সৃষ্টি। দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান সমাজ অর্থনীতি শাসন নিপীড়নের বিরোধিতা করতে গিয়ে সংঘাত হয়েছে শাসকদের ধর্মের সঙ্গে এবং সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নতুন ধর্ম। ইহুদী, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টিয়ান, ইসলাম ধর্ম এই ধারার মধ্যে পড়ে।
প্রচলিত অন্যায় নিপীড়ন বিরোধিতা করে যখন প্রধান ধর্মগুলোর আবির্ভাব ঘটে তখন নিপীড়িত মানুষের আশ্রয় ও বিশ্বাস হিসেবেই এগুলো গড়ে উঠে। কিন্তু ক্রমে এসব ধর্ম যখন নিজেই শাসনক্ষমতার বর্ম হিসেবে রূপান্তরিত হতে থাকে তখন নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে এসব ধর্মশক্তির বিচ্ছিন্নতারও সৃষ্টি হতে থাকে। সমাজ মুক্তির একটি শক্তিশালী মতাদর্শ থেকে যখন ধর্মের দূরত্ব বাড়তে থাকে তখন ক্রমে ভয় এবং লোভই হয়ে দাঁড়ায় এসব ধর্মের মূল ভিত্তি। বস্তুত: প্রধান ধর্মগুলি দাঁড়িয়ে আছে মানুষের স্বর্গ বা বেহেশতের প্রতি লোভ এবং নরক বা দোজখের প্রতি ভয়ের উপর। এখানে নৈতিকতাও এই দুটো দ্বারাই নির্ধারিত। ভয় বা লোভের বাইরে মানবিক বোধ, সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ যে তৈরি সম্ভব তা ধর্মের প্রচলিত ডিসকোর্সে দেখা যায় না। এই ভয় বা লোভ দুটোই যেহেতু ‘মৃত্যু পরবর্তী জগতের’ আওতায় সেহেতু ধর্মের ব্যাখ্যানে জীবনের চাইতে মৃত্যু বরাবরই গুরুত্ব পায় অনেক বেশি। মৃত্যু অনিবার্য এবং তার সময় অনিশ্চিত। মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে মানুষের অপার আগ্রহ কিন্তু ভয়। সেজন্য এটি ঘিরে জন্ম নিয়েছে অনেক ব্যাখ্যা; এ সম্পর্কে আগ্রহ ও ভয়-এর কারণে যার মধ্যে এক ধরনের সাযুজ্যও আছে। সাধারণভাবে ধর্মের ডিসকোর্স মানুষের এই অসহায়ত্ব, সীমাবদ্ধতা এবং ভয়কেই পুঁজি করে। জীবন এই ডিসকোর্সের তুলনায় গুরুত্বহীন।
বৌদ্ধধর্ম ভিন্ন সকল প্রধান ধর্মগ্রন্থেই ইশ্বরের খুশি ও বেজার হবার বিষয়টিকে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ এর উপরই নির্ভর করে মৃত্যুপরবর্তী জীবনে কার অবস্থান অসীম সুখে ভাসবে এবং কার জীবন অসীম দুঃখ ও কষ্টে পতিত হবে সেটি। আরজ আলী প্রশ্ন করেন-- ‘‘খোদার কি মানুষের মতই মন আছে? আর খোদার মনোবৃত্তিগুলি কি মানুষেরই অনুরূপ? ইহারও উত্তর আসে যে, উহা বুঝিবার ক্ষমতা মানুষের নাই। ...খোদাতালার জগৎ-শাসন প্রণালী বহুলাংশে একজন সম্রাটের মত কেন এবং তাঁহার এত আমলা-কর্মচারীর বাহুল্য কেন?’’ তিনি আরও বলেন-- “বেহেস্তের সুখের বর্ণনায় শোনা যায় যে, পূণ্যবানগণ নানারকম সুমিষ্ট সুস্বাদু ফল আহার করিবেন, নেশাহীন মদিরা পান করিবেন, হুরীদের সহবাস লাভ করিবেন-- এক কথায়, প্রত্যেক পূণ্যবান ব্যক্তি মধ্যযুগের এক একজন সম্রাটের ন্যায় জীবনযাপন করিবেন।”
মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মানুষের দেহ রূপান্তরিত হয়। সুতরাং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রসঙ্গে মানুষের সেই দেহ পুনরুদ্ধারের প্রশ্ন আসে। আরজ আলীর সহজ প্রশ্ন, দেহ পুনরুদ্ধার কি সম্ভব? প্রকৃতিতে একটি দেহ আরও অনেক কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি প্রাণীর মৃত্যুর পর তার দেহ থেকে বহু জীবের দেহে-প্রাণ গঠিত হয়। “জীবের মৃত্যুর পর তাহার দেহটি রূপান্তরিত হইয়া পৃথিবীর কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থে পরিণত হয়। আবার ঐ সকল পদার্থের অণুপরমাণুগুলি নানা উপায়ে গ্রহণ করিয়াই হয় নতুন জীবের দেহগঠন। জীবদেহের ত্যাজ্য মসলা। আবার মৃত্যুর পর আমার এই দেহের উপাদানে হইবে লক্ষ লক্ষ জীবের দেহগঠন। ...ইহাতে দেখা যাইতেছে যে, প্রাণীবিশেষের দেহ অন্যান্য বহু প্রাণীর দেহ হইতে আহৃত পদার্থসমূহের সমষ্টির ফল। অর্থাৎ যে কোন একটি জীবের দেহ অন্যান্য বহু জীবের দেহ হইতে উদ্ভুত হইতেছে।” সমস্যাটা দাঁড়াচ্ছে, “এমতাবস্থায় পরকালে একই সময় যাবতীয় জীবের দেহ বর্তমান থাকা কি সম্ভব? যদি হয়, তবে প্রত্যেক দেহে তাহাদের পার্থিব দেহের সম্পূর্ণ পদার্থ বিদ্যমান থাকিবে কিরূপে? যদি না থাকে, তবে স্বর্গ-নরকের সুখ-দুঃখ কি আধ্যাত্মিক?” তাহলে কষ্ট ও সুখের যে পার্থিব বর্ণনা পাওয়া যায় তা কি রূপক? তাহলে পুরো ধর্মের ব্যাখ্যানই কি রূপক বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে? তাহলে বেহেশত-দোজখ, স্বর্গ-নরক সবই কি রূপক বিষয়? আসলে তার অস্তিত্ব নাই? ধর্মপ্রচারক বা ধর্মীয় নেতারা এই কথাটা জনগণকে খোলাসা করে বলতে গেলে আরজ আলীর সকল প্রশ্নের সুরাহাই করতে হবে।
আরজ আলী প্রশ্ন করেন যে, ঈশ্বরকে যে একইসঙ্গে ন্যায়বান ও দয়ালু বলা হয় তা কি একই সময়ে হওয়া সম্ভব? কেননা যিনি দয়ালু তিনি ক্ষমাশীল কিন্তু ন্যায়বান যিনি তিনি ক্ষমাশীল হতে পারেন না। তাঁকে ন্যায়বিচার করতে গেলে নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। অপরাধীর প্রতি ক্ষমাশীল হলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাঁদের প্রতি অবিচার হয়। যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত তাঁদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে গেলে অপরাধীদের প্রতি নির্মম হতে হয়। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের সবচাইতে বড়, সংগঠিত অপরাধ হয়েছিল ১৯৭১ সালে গণহত্যা ও ধর্ষণের মধ্যে দিয়ে। এটি করেছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং তাদের সঙ্গে ছিল ইসলামের নাম নিয়ে এই অঞ্চলের ধর্মীয় নেতাদের উল্লেখযোগ্য অংশ। এই অপরাধীদের প্রতি যে ক্ষমা ঘোষণা করা হয় তাকে মহানুভবতা হিসেবে দেখানো হয়, এদের বিচার ৪০ বছরেও সম্পন্ন হয়নি। এরকম কথাই বিশেষভাবে শোনা গেছে যে, এসব বিচারের কথা তোলা মানে জাতিকে বিভক্ত করা। কিংবা আমাদের ক্ষমাশীল হওয়া দরকার। তাহলে খুনী ও দুর্বৃত্তদের অপরাধের বিচার করলে কি তা জাতিকে বিভক্ত করে? তাহলে তো কোন বিচারের ব্যবস্থাই থাকা ঠিক নয়। আর দুর্বৃত্তদের প্রতি ক্ষমাশীল হলে তাদের অপরাধের শিকার মানুষের প্রতি তবে কী ন্যায়বিচার হলো?
ধর্মে ক্ষমা পাবার নানা ব্যাখ্যা আছে। পাপ পূণ্যের নানা মাপ আছে। তাতে বিপুল পূণ্য অর্জনের জন্য এমন বহু রাস্তা আছে যেগুলো টাকা থাকলে সহজেই ক্রয় করা যায়। এবং এগুলো অপরাধীদের জন্য স্বস্তিদায়ক। এসব ব্যাখ্যার অনেকগুলোতে, বলাই বাহুল্য, বিভিন্ন কালে বিভিন্ন স্থানের ক্ষমতাবানদের স্পর্শ আছে। আবার এরকম কিছু ব্যাখ্যাও পাওয়া যাবে যেখানে উচ্চকিত ক্ষমতাবানদের বিপরীতে জনগণের কণ্ঠস্বর। এই দুক্ষেত্রে এক ধর্ম পরিষ্কার দুটো বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে।
জগৎ ও মানুষ
আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করি সেই পৃথিবীর বয়স কত? কীভাবে এর উৎপত্তি? দিনরাত কীভাবে হয়? কীভাবে মৌসুমের পরিবর্তন ঘটে? কীভাবে প্রাণের উদ্ভব হয়? কোন প্রাণ দিয়ে প্রাণীজগতের শুরু? এই পৃথিবীর সঙ্গে বাকি জগতের কি সম্পর্ক? এই জগতের শেষ কোথায়? আরজ আলী মাতুব্বর এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের জন্য যতধরনের ধর্মগ্রন্থ আশেপাশে পাওয়া যায় দেখেছেন, প্রচলিত ভাষ্য নোট করেছেন আর পাশাপাশি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, প্রতœবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আবিষ্কার, তত্ত্বের খোঁজ করেছেন, সংগ্রহ করেছেন, অধ্যয়ন করেছেন। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ধর্মসহ অন্য সবকিছুর মতো প্রবল ছিল একই কারণে: প্রশ্নের উত্তর সন্ধান। বলাই বাহুল্য বিজ্ঞান তাঁকে এসব প্রশ্নের উত্তরে যুক্তিসঙ্গত একটি কাঠামো দান করেছিল।
‘সত্যের সন্ধান’ গ্রন্থটি প্রচলিত বিশ্বাস নিয়ে বহু প্রশ্ন ও প্রশ্নের ব্যাখ্যার সংকলন। ‘সৃষ্টি রহস্য’ গ্রন্থটি মূলত: সৃষ্টি বিষয়ক বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের ধারণা এবং বিজ্ঞানের তৎকালীন সময় পর্যন্ত প্রাপ্ত জ্ঞান থেকে লেখা। ‘সত্যের সন্ধান’ গ্রন্থের ষষ্ঠ প্রস্তাবে আদিমানব নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন ধর্মেই আদিমানব বিষয়ে ধারণা বা বিশ্বাস পাওয়া যায়। সেমিটিক সব ধর্মে আদম-হাওয়া বিষয়টি একই। হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনুই আদি মানব। আরজ আলী এই বিশ্বাস এবং তার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন কাহিনী যতেœর সঙ্গে অধ্যয়ন করেছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন।
আগুন, অস্ত্র, বাহন, তাঁত, চাকা, নৌকা ও পাল, কাগজ, ধর্ম, বাষ্পীয় শক্তি, বৈদ্যুতিক শক্তি, পারমাণবিক শক্তির আবিষ্কার ও ব্যবহারের বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন। কৃষি ও পশুপালন সম্পর্কে ইতিহাস পর্যালোচনা করে তিনি লিখেছেন, “সেমিটিক জাতির মতে, কৃষি ও পশুপালন শুরু করিয়াছিলেন বাবা আদম বেহেশত হইতে পৃথিবীতে আসিয়াই। হালের বলদ, লাঙ্গল-জোয়াল ও ফসলের বীজ বেহেশত হইতে আমদানি হইয়াছিল কি না তাহা জানি না, তবে তিনি নাকি চাষাবাদ করিয়াই জীবন যাপন করিতেন। ...বাবা আদমের লাঙ্গলের আকৃতি কিরূপ ছিল, জোয়াল কিভাবে জুড়িতেন এবং রশারশি কোথায় পাইয়াছিলেন সেই বিষয়ে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।”
আদমের সময়কাল এবং স্থান নিয়ে হিসাবনিকাশ করে তিনি দেখাচ্ছেন খৃঃ পূঃ ৪০০৪ সালে হযরত আদমের সৃষ্টি (জন্ম); কিন্তু পাশাপাশি এটাও দেখাচ্ছেন যে, সেই সময়ের আগেই মিশরে পঞ্জিকা আবিষ্কার হয়েছে, সেইসময়ে মিশরে চাষাবাদ, লোকবসতি। তারও ৪ হাজার বছর আগে লোকবসতির প্রমাণ পাওয়া যায় সিরিয়ায়। তিনি এটাও মনে করিয়ে দেন যে, “জীববিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হইয়াছিল লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্বে। তবে আধুনিক চেহারার মানুষের আবির্ভাব ঘটিয়াছে মাত্র প্রায় ৩০ হাজার বৎসর পূর্বে।”
মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞানের সর্বশেষ প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্য বিশ্লেষণ করে আরজ আলী মাতুব্বর বলছেন, “পূর্বোক্ত বিষয়গুলি পর্যালোচনা করিলে মনে আসিতে পারে যে, আদম হয়ত এশিয়া মাইনর বা আর্মেনিয়া দেশের কোন ক্লানের বিতাড়িত ব্যক্তি এবং আরব দেশে আগন্তুক প্রথম মানুষ, সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে আদিম মানুষ নয়।” মানুষের সঙ্গে অন্যান্য জীবের শরীরতত্ত্বীয় মিল নিয়ে আরজ আলী বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে মানুষ সম্পূর্ণ বিশিষ্ট এই ধারণার উপর অনেক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলছেন, “চা, কফি ও মাদক জাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণে ও কতক বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগে মানুষ ও পশুর একই লক্ষণ প্রকাশ পায়, ইহাতে উহাদের টিস্যু ও রক্তের সাদৃশ্য প্রমাণিত হয়। গো-মহিষাদি পশুরা লোমশ প্রাণী, মানুষও তাহাই এবং পশুদের দেহে যেরূপ পরজীবী বাস করে, মানুষের শরীরেও তদ্রুপ উকুনাদি বাস করে। প্রজননকার্যে মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবদের বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। পূর্বরাগ, যৌনমিলন, ভ্রুণোৎপাদন, সন্তান প্রসব ও প্রতিপালন সকলই প্রায় একরূপ।” নারীর রজঃশীলা ও সন্তান ধারণ বিষয়ে এরকম সাদৃশ্য দেখেছেন। সৃষ্টি রহস্য-তে এটি নিয়েও আলোচনা করেছেন। সত্যের সন্ধান গ্রন্থে তাঁর প্রশ্ন ছিল, “বিশেষত আদি নারী বিবি হাওয়া নাকি রজঃশীলা হইয়াছিলেন গন্ধম ছেঁড়ার ফলে, কিন্তু অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীকূল রজঃশীলা হয় কেন?”
তাহলে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে কি মানুষের কোন পার্থক্য নেই? তিনি বলেন, “মানুষের সহিত অন্যান্য জীবদের তথা পশুদের শত শত রকম সামঞ্জস্য বিদ্যমান। কাজেই যাবতীয় জীব বিশেষত পশুরা মানুষের আত্মীয়, এ কথাটি অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তথাপি মানুষ মানুষই, পশু নহে। এখন দেখা যাক যে, অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের তফাৎ কি? জীবজগতে মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য তিনটি— হাত, মগজ, ভাষা।” এরপর এই বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা করে শেষে এসে যা বলছেন তা উল্লেখ না করে পারা যায় না। বলছেন, “...ভাষাভাষী হিসাবে মানুষ একান্তই সামাজিক জীব। উন্নত মস্তিষ্ক, কর্মক্ষম হাত এবং সুসমঞ্জস ভাষা সহায়ক হইল এক রকম জীবের— তাহারই নাম মানুষ। কিন্তু হাত, মগজ ও ভাষা জীবজগতের সর্বত্র দুর্লভ নহে। অনুন্নত জীবজগতের সর্বত্র-দুর্লভ— মানুষের হাসি।”
দেবতা ফেরেশতা রাক্ষস শয়তান
ইতিহাস বলে, বিদ্যমান যতগুলো ধর্ম আছে সেগুলোর চাইতে অনেক বেশি সংখ্যক ধর্ম মানুষ পার হয়ে এসেছেন। যত ধর্ম জীবিত আছে তার থেকে মৃত ধর্মের সংখ্যা অনেক বেশি। এসব ধর্ম নিয়ে যদি আমরা ঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করি তাহলে প্রকৃতপক্ষে আমাদের পক্ষে ঐ ধর্মের কাল ও স্থানকে উদ্ধার করা সম্ভব। আরজ আলী সাধ্যমতো বর্তমান-অতীত, জীবিত-মৃত ধর্ম ও বিশ্বাস অনুসন্ধান করেছেন তার কাল-স্থান ধরে এবং সেইসঙ্গে অঙ্গীভূত মিথগুলোকে পরীক্ষা করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর এসব আলোচনা আছে সৃষ্টিরহস্য, সত্যের সন্ধান ছাড়াও অনুমান গ্রন্থে।
তিনি খ্রীষ্টপূর্বকালের বিভিন্ন ধর্ম ও তার চেহারা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “সেকালে দেবতারা স্বর্গ থেকে নেমে আসতেন পৃথিবীতে বলতে গেলে ঘনঘনই। আর বিভিন্ন দেশে তাদের সংখ্যাও ছিল অগণ্য। আরবের— লাত-মানাত, কেনানে বাহু ইত্যাদি নানারকম ছিলেন দেবতা। আবার বিভিন্ন দেশের কতক দেবতারা ছিলেন একই ধাঁচের। যেমন মিশরে— আসিরিস, আইসিস, হোরাস; ব্যাবিলনে— আলু, বেল, ঈয়া; ভারতে— ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ইত্যাদি। যে যুগে সমগ্র পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বোধহয় যে এককোটিও ছিলো না, সে যুগে নাকি হিন্দুদের দেব-দেবীর সংখ্যা ছিলো প্রায় তেত্রিশ কোটি। ভারতীয় দেব-দেবীরা তো ঘাঁটিই করেছিলেন হিমালয় পর্বতের কোনো কোনো অঞ্চলে। ...মুনিঋষি ও দেবদেবীগণ প্রায় একইকালে বর্তমান ছিলেন এবং প্রায় একইকালে ঘটেছে তাঁদের তিরোভাব। এযুগে দেখা যায় না ওঁদের কাউকে। ওঁরা সকলেই এখন কালের কোলে ঘুমিয়ে আছেন।”
বঙ্কিমচন্দ্র তেত্রিশ কোটি দেবতার সংখ্যা নিয়ে রীতিমতো ঠাট্টাই করেছেন। তিনি অনেক গণনা করেও দেবতার সংখ্যা শত অতিক্রম করতে পারেননি।
আবার বলেছেন, “পবিত্র বাইবেল পাঠে বোঝা যায় যে, ‘জাভে’ নামক ঈশ্বরটির ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি মহাদেশ ও চীন, জাপান, ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদির অধিবাসীদের জন্য যেনো কোনো মাথাব্যথা নেই, তিনি যেনো শুধু ইহুদী জাতি তথা বনি-ইস্রায়েলদের সমাজ ও ঘরসংসার নিয়েই ব্যস্ত।”
আরজ আলী এটি লেখার কয়েক দশক আগে এরকম একটি প্রশ্ন রোকেয়াও তুলেছিলেন। রোকেয়া ধর্মগ্রন্থের অবতরণের স্থান এবং তার পুরুষকেন্দ্রিকতা দুই নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন।
ঈশ্বর সম্পর্কে বর্তমানে আমরা যে ধরনের ধারণায় অভ্যস্ত ঈশ্বর সে রূপে পৌঁছেছেন বহু হাজার বছরে ধর্ম সম্পর্কিত বিশ্বাসের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। একক ঈশ্বরের উদ্ভব খণ্ড খণ্ড দেবতাদের উদ্ভবের অনেক পরের ঘটনা। আরজ আলী বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন এভাবে, “আদিম মানবদের ঈশ্বরকল্পনা ছিল না, কল্পনা ছিল দেবতার। যে তাপ ও আলো দান করে, সে একজন দেবতা; যে খাদ্য দান করে, সে একজন দেবতা; যে বৃষ্টি দান করে, সে একজন দেবতা; ...পরমেশ্বর বা একেশ্বর কল্পনার পূর্বে যাঁহারা ছিলেন দেবতা, একেশ্বর কল্পনার পরে তাঁহারাই বনিয়াছেন স্বর্গীয় দূত।”
দেবতা, নরবলি, জন্মান্তর, ভূত, শপথ, জাদু, ইন্দ্রজাল, শুভাশুভ লগ্ন, ভাগ্য, সতীদাহ, ভবিষ্যৎ গণনা, প্লাবন ও পুনঃসৃষ্টি, প্রলয় সম্পর্কে বিভিন্ন মত: বৈদিক মত, মিশরীয় মত, ইরানীয় মত, ইহুদী মত, খ্রিষ্টীয়, মুসলিম, চৈনিক, বৌদ্ধ, চার্বাকীয় ও তার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক মত এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা সৃষ্টি রহস্য গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
অনুমান গ্রন্থে আরজ আলী রাবণ চরিত্রটি নিয়ে অনেকখানি আলোচনা করেছেন। সাধারণভাবে রাবণ বলতে একটি রাক্ষসের চিত্রকল্প তৈরি হয় যেমন অসুর বললে মনে হয় ভয়াবহ, মানব বিরোধী কোন অপশক্তি। কিন্তু প্রচলিত মিথগুলি খুঁটিয়ে দেখলে এবং অধিপতি বিশ্বাসকে অতিক্রম করে সেসব পরীক্ষা করলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ায় দেখা সম্ভব যে, রাবণ বা অসুর এবং রাম বা দুর্গার চেহারা প্রচলিত নির্মাণের সম্পূর্ণ বিপরীত। আরও অনেক মিথ-এর মতো এসব চরিত্র নির্মাণের পেছনেও মানুষের রক্তাক্ত ইতিহাস আছে। সমাজের অধিপতি শ্রেণীর ধারণার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই নায়ক বা খলনায়ক নির্মিত হয়েছে। যাকে প্রচলিত বিশ্বাস অভিহিত করছে খলনায়ক হিসেবে, জনগণের দিক থেকে ইতিহাসের বিশ্লেষণ করলে তাকে হয়তো তাদের প্রতিনিধি হিসেবেই সনাক্ত করা যাবে। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এর সহজ উদাহরণ আছে। ব্রিটিশ বিরোধী ফকির, সন্ন্যাসী কিংবা অনুশীলন ইত্যাদি সবাই ব্রিটিশ ইতিহাসে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত; ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হত দুষ্কৃতকারী হিসেবে। সকল পর্বেই এরকম বিপরীত সত্য দেখা যাবে। প্রতিষ্ঠিতকে প্রশ্ন না করে আসল ঘটনার কাছে তাই পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
রামায়ণে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা ও বক্তব্যগুলো পরীক্ষা করেছেন আরজ আলী সেভাবেই। বিশ্লেষণ করে তিনি রাবণকে পেয়েছেন এক অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ হিসেবে, তবে অনার্যহেতু রামের বৈরী। তিনি বলেছেন, “হয়তো আর্য-ঋষি বাল্মীকি— আর্যপ্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষ বশত শ্রীরামকে প্রদীপ্ত ও রাবণকে হীনপ্রভ করার মানসে একের প্রোজ্জ্বল ও অন্যের মসিময় চিত্র অংকিত করেছেন নিপুণ হস্তে রামায়ণের পাতায়।”
হনুমান চরিত্রটিও তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন হনুমান কোন একক ব্যক্তি বা প্রাণী নয় এটি আসলে গোত্রের নাম। ফেরাউন ইসলাম ধর্মে একটি খুবই খারাপ নাম, ঈশ্বরদ্রোহী-মানুষের শত্রু। আরজ আলী বলেছেন ফেরাউন হচ্ছে মিশররাজদের উপাধি। তিনি তৎকালীন সৃজনশীল কাজ ও বিশাল নির্মাণের নমুনা দেখে অনেক ফেরাউনের বিশাল অবদানের বিষয়টি সামনে এনেছেন। মুসার মিশর থেকে বিতাড়িত হয়ে যাবার পথ অনুসন্ধান করে তিনি বুঝতে চেয়েছেন মুসার সমুদ্র পার হবার মিথ এবং দেখিয়েছেন পথ, সময় বর্ণনায় অসঙ্গতি। “অধুনা কোন কোন গবেষক বলেন যে, হজরত মুসা ‘তিমছাহ হ্রদ’ পার হইয়াছিলেন।”তিনি পানি শুকিয়ে যাবার ঘটনা ব্যাখ্যা করে জোয়ার ভাটার সঙ্গে সেই কাহিনীর সম্পর্ক পেয়েছেন। “শয়তানের জবানবন্দী” নামে আরজ আলীর একটি দীর্ঘ লেখা আছে, যেখানে তিনি শয়তানকে ঘিরে যে বিশ্বাস সেগুলো নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। অন্য অনেক কিছুর মতো শয়তান সম্পর্কেও ধর্মীয় বয়ানে মেলা স্ববিরোধিতা আছে। আর শয়তান শুধু এক ইসলাম ধর্মের বিষয় নয়। তবে সেমিটিক ধর্মগুলোতে শয়তানের কাহিনী অভিন্ন। এই শয়তান বস্তুত: আল্লাহর বিপরীত শক্তি; সকল ‘খারাপ— এর কেন্দ্রীয় শক্তি। আসলে চিন্তার জগত যত সমৃদ্ধ হচ্ছে ধর্মের ব্যাখ্যাও নতুন নতুন রূপ পাচ্ছে। কারও কারও কাছে এখন শয়তান একটি রূপক, এটি আসলে নফস-এর বিষয়। ধর্মগ্রন্থের কাহিনী অনুযায়ী শয়তান হলো অভিশপ্ত ফেরেশতা, যে আগে আল্লাহর খুব প্রিয় ফেরেশতা ছিল। অভিশপ্ত হবার কারণ শুধু আল্লাহর একটি আদেশ অমান্য করা, আদমকে সালাম না করা। অবাধ্য, কিন্তু প্রবল শক্তিধর এই শয়তান অমর। আরজ আলী তাই প্রশ্ন তোলেন : “জন্ম-মৃত্যুর ঠোকাঠুকিতেও বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ টিকিয়া আছে প্রায় তিনশ’ কোটি। আর মানুষের চেয়ে দশগুণ বৃদ্ধি পাইয়া অমর শয়তানের সংখ্যা কত?” অর্থাৎ মানুষ মরণশীল এবং শয়তান অমর হবার কারণে মানুষের মাথাপিছু শয়তানের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন প্রতি মানুষপিছু শয়তানের সংখ্যা বহু বহু গুণ বেশি। সেই হিসেবে পাপের পরিমাণ আগের তুলনায় সেই পরিমাণ, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবার কথা। কিন্তু দেখা যায় বহু অঞ্চলে পুরনো প্রথাগত অপরাধই অনেক কমে গেছে। শয়তানের ভূমিকা বা প্রভাব তার সংখ্যা অনুযায়ী বৃদ্ধি পেলে মানুষ আরও আগেই ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।
এই ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে ধর্মপ্রচারকদের আগমন হার নিয়ে। তাদের আগমনের কারণ শয়তানের প্রভাবকে খর্বকরণ। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের আগমন হার অনেক কমে যায়। অর্থাৎ যখন শয়তানের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন নবীদের আগমন একেবারে বন্ধ হয়ে গেল কী কারণে? আরজ আলী বলেন, ‘‘বাইবেলের বিবরণমতে হযরত আদম হইতে হযরত ঈসার জন্ম পর্যন্ত সময় ৪০০৪ বৎসরে প্রতি বৎসর গড়ে নবী জন্মিয়াছিলেন প্রায় ৩১ জন! ...কিন্তু হযরত ঈসা নবী জন্মিবার পর নবীদের জন্মহার কমিয়া ৫৭০ বৎসরে জন্মিলেন মাত্র একজন, অতঃপর কেয়ামত পর্যন্ত নাকি একেবারেই বন্ধ। ...হয়ত পাপীর সংখ্যা বা পাপের পরিমাণ আগের চেয়ে হ্রাস পাইয়াছে, নতুবা এ যুগের পাপীদের উপর বীতস্পৃহ হইয়া আল্লাহ তাঁহার হেদায়েত বন্ধ করিয়াছেন।”
এর একটা ব্যাখ্যা আরজ আলীর আছে। তিনি বলেছেন, “উত্তরোত্তর জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের গুরুবাদিতা হ্রাস পেতে থাকে। ফলে কমতে থাকে দেবতাগণের মহিমা। অবশেষে বুদ্ধ (জ্ঞানী) দেব যখন আবির্ভূত হয়ে প্রচার করলেন দেব-দেবীর স্তবস্তুতি ও পূজা-অর্চনার অসারতা-অযৌক্তিকতা, তখন থেকেই দেবতাদের পাত্তা গোটাতে হলো চিরতরে। যদিও ভারতীয় দেবতাদের ঔপনিবেশিক স্বর্গধামটি আর্য ভারত থেকে বেশি দূরে নয়, তথাপি আর কোনো দেবদেবীর ভারতের ভূমিতে পদার্পণের কথা শুনা যায় না, বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পরে। কেননা এ যুগে তাঁদের ভক্ত মুনি-ঋষি মেলে না। অভিন্ন কারণেই যীশুখ্রিষ্টের আবির্ভাবের পরে পশ্চিমাঞ্চলেও দেবতাদের আনাগোনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।”
ধর্ম, বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার
কুসংস্কার আরজ আলী মাতুব্বরের মনোযোগের অন্যতম, কিংবা বলা যায় অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। সমাজে এর দাপট-এর বিরুদ্ধেই তিনি যুদ্ধে নেমেছিলেন। ধর্ম আর কুসংস্কারকে সমার্থক হিসেবে ঘোষণা না করে, কুসংস্কার সম্পর্কে পাইকারি কিংবা অনির্দিষ্ট কথা না বলে তিনি এটিকে সুনির্দিষ্ট করেছেন, বলেছেন: “কুসংস্কার কি, অল্প কথায় ইহার উত্তর হইল, যুক্তিহীন বিশ্বাস বা অসার যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদে বিশ্বাস; এক কথায় অন্ধবিশ্বাস। যেখানে কোনো বিষয় বা ঘটনা সত্য কি মিথ্যা, তাহা যাচাই করিবার মতো জ্ঞানের অভাব, সেখানেই কুসংস্কারের বাসা।”
অর্থাৎ যখন মানুষ চিন্তার সমস্ত ক্ষমতা নিষ্ক্রিয় করে রাখে এবং নিজের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অন্য কারও কাছে সমর্পণ করে তখন কুসংস্কারের জায়গা তৈরি হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা শুধু নয় মতাদর্শিক ক্ষমতাও এই আধিপত্য তৈরি করতে সক্ষম। আরজ আলী বলেন, “বর্তমান কালেও কোনো কোনো মহলে দেখা যায়, সত্য-মিথ্যার বিচার নাই, গুরুবাক্য শিরোধার্য।”
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বললে অনেকেই তাকে ধর্মের সমালোচনা হিসেবে গণ্য করেন। আরজ আলী বিষয়টি পরিষ্কার করেন এইভাবে যে—“যদি কেহ কুসংস্কার ত্যাগ করিতে অনিচ্ছুক হন এবং বলিতে চাহেন যে, কুসংস্কার ত্যাগ করিলে ধর্ম থাকিবে না, তাহা হইলে মনে আসিতে পারে যে, ধর্মরাজ্যে কুসংস্কার ভিন্ন আর কিছুই নাই? এ প্রসঙ্গে কেহ যেন মনে না করেন যে, আমরা ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছি। আমাদের অভিযান শুধু অসত্য বা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, কোন ধর্মের বিরুদ্ধে নয়।” আরজ আলীর দেয়া কুসংস্কারের সংজ্ঞা অনুযায়ী বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতাদর্শিক কাঠামো, বিশ্বব্যাংকীয় অর্থশাস্ত্র এবং যাকে বিজ্ঞান বলা হয় তারও অনেক কিছুকে কুসংস্কার বলতে হবে। কারণ বর্তমান বিশ্বে যুক্তি, বিশ্লেষণ, ঐতিহাসিকতা ছাড়া এর অনেক কিছু গ্রহণ ও তার চিরস্থায়ীত্বে বিশ্বাস স্থাপন করবার প্রবণতা কিংবা পরিকল্পিত চেষ্টা প্রবল প্রতাপে বিজ্ঞান, আধুনিকতা আর যুক্তিশীলতার নামেই জারী আছে।
বিজ্ঞান ও সভ্যতা নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বরের মনোযোগ ও আগ্রহ দেখে এরকম কারও মনে হতে পারে যে, তিনি বোধহয় এগুলোকে সরলরৈখিকভাবে বিবেচনা করছেন, বোধহয় কোন না কোন ভাবে বিজ্ঞানের বিকাশকেই মানুষের সকল মুক্তির পথ বলে বিবেচনা করছেন। কিন্তু তা যে ঠিক নয় সেটি স্পষ্ট হয় নিচের কয়েকটি বাক্য থেকে: “সভ্যতাবৃদ্ধির সাথে সাথে তাম্র ও লৌহ আবিষ্কারের পর তীর-ধনুকের উন্নতি হইয়াছিল অসাধারণ। কিন্তু উন্নতি হইলে কি হইবে, উহা দিয়া পশু-পাখি হত্যার বদলে আরম্ভ হইয়াছিল নরহত্যা এবং পশু-পাখির স্থলাভিষিক্ত হইয়াছিল রামানুজ লক্ষ্ণণ, লঙ্কেশ্বর রাবণ, ও নূরনবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেনও। আধুনিক যুগে আবার তীর-ধনুকের চেহারা বদল হইয়া উহার তীরটি হইয়াছে গোল এবং ধনুটি হইয়াছে সোজা— সৃষ্টি হইয়াছে বন্দুক, কামান ইত্যাদি মারণাস্ত্রের। শেষমেষ পারমাণবিক বোমা।”
পারমাণবিক শক্তি মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অর্জন, কিন্তু এই বিশাল শক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার হয় না। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যদি জনগণের কাছে না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের এই বিশাল শক্তিই ধ্বংসের উপকরণ হয়ে উঠতে পারে। সেজন্য পারমাণবিক শক্তি যেখানে মানুষের বহু সমস্যার সমাধানে সক্ষম সেখানে সেই শক্তি এখন মানব সমাজের অস্তিত্বের জন্যই একটা হুমকি।
জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আরজ আলী তাঁর ধারণা স্পষ্ট করেছেন এইভাবে: “বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে এক মহাশক্তি। সেই মহাশক্তিই আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিরূপে প্রকাশ পেয়ে থাকে। যা তাপশক্তি, আলোকশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি, চুম্বকশক্তি ইত্যাদি এবং সর্বোপরি প্রাণশক্তি। ...অন্যান্য শক্তির ন্যায় ‘প্রাণ’ শক্তিটিও মহাশক্তির কোটি কোটি বছরের আবর্তন, বিবর্তন ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফল।”
অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজ ও তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও একটি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, “সমাজদেহের অঙ্গবিশেষের অর্থাৎ শ্রেণীবিশেষের অতিমাত্রায় উত্থান ও পতন ডেকে আনে সমাজদেহের পঙ্গুতা ও অকর্মণ্যতা। ...‘সমাজতন্ত্র’ তথা ‘সাম্যবাদ’ হচ্ছে বিশ্বমানবের মঙ্গল বিধানের একমাত্র মাধ্যম।” এই শর্ত পূরণ ছাড়া বিজ্ঞান ও ধর্মের ফলাফল তাঁর কাছে মনে হয়েছে অভিন্ন, অর্থহীন; ‘রকেট-রোবট ব্যবহার’ অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিচ্ছিন্ন ‘বিকাশ’ এবং ধর্মের আধিপত্য কিংবা ‘স্বর্গ নরকের স্বপ্ন দর্শন, তাঁর বিবেচনায়, মানুষকে একই জায়গায় নিক্ষেপ করে। তিনি তাই বলেছেন, উপরের শর্ত পূরণ ছাড়া “শুধুমাত্র রকেট-রোবট ব্যবহার ও স্বর্গ নরকের স্বপ্ন দর্শনের দ্বারা সমাজ উন্নয়নের যে প্রচেষ্টা, তা ভেল্কি ছাড়া আর কিছু নয়।”
এক ধর্ম বহু ধর্ম : ধর্ম না সমাজ?
আরজ আলী বলেন, “আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কার পর্যন্ত অন্য কোন আবিষ্কারেই আঞ্চলিকতা নেই, কিন্তু ধর্ম ও রাষ্ট্র হচ্ছে আঞ্চলিকতায় ভরপুর।”
একদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, তার সমাজ ও সংস্কৃতির আদলে ধর্ম গড়ে উঠে, অন্যদিকে প্রকৃতপক্ষে সমাজ-রাষ্ট্রের অভিব্যক্তি হয়ে উঠে ধর্ম। ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা আসলে তাই সমাজ রাষ্ট্র নিয়েই আলোচনা। কেননা সমাজ-রাষ্ট্র বাদ দিয়ে ধর্মের অস্তিত্ব নেই। আমরা ইতিহাসে দেখি, মানুষের সমাজ জীবনের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মের রূপও পরিবর্তিত হয়েছে। গোত্র জীবন থেকে মানুষ যখন রাষ্ট্র জীবনে প্রবেশ করেছে তখন ধর্মও গোত্রীয় পরিচয় থেকে রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে। যেসব জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রিক-সামরিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়েছে তাদের ধর্মের প্রভাবও পড়েছে তত বেশি। মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মের ঈশ্বরের জ্ঞানও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেজন্যই আগের ঈশ্বরের চাইতে অনেক পরিণত দেখা যায় পরের ঈশ্বরের জ্ঞান। বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু গোত্র যেভাবে বিলুপ্ত হয়েছে তেমনি বিলুপ্ত হয়েছে অনেক ধর্ম, অনেক ঈশ্বর, অনেক দেবতা ও অনেক নবী। এই কালে যে আর কোন ধর্মের উদ্ভব হয় না, কেউ চেষ্টা করলেও তা পাত্তা পায় না সেটাও মানুষের ক্রমবিবর্তিত সমাজেরই ‘ইচ্ছা’।
এক ধর্ম কখনোই আসলে এক ধর্ম নয়। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই বহু ধর্মের বাস। এটাও নির্ধারিত হয় সমাজেরই ইচ্ছা দিয়ে, তার তাগিদে। সমাজে মানুষের মধ্যেকার বৈষম্য, ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থান, নিপীড়ক ও নিপীড়িত এর সবেরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ‘একই’ ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি, চর্চা ও ব্যাখ্যার মধ্যে। ‘একই’ আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা ‘একই’ নবী, দেবতা ভিন্নভিন্ন ভাবে গৃহিত হন ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে। কখনো হয়ে যায় তা সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৭১ এ বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনী নারকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহ আর রসুলের নাম ব্যবহার করে; আবার নিপীড়িত অসংখ্য নারী পুরুষ বুক চিরে আর্তনাদ করেছে, জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সেই একই আল্লাহ আর রসুলের নামেই। পোপের যীশু বিশ্বব্যাপী যখন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, দেশে দেশে স্বৈরশাসন, নিপীড়ন ও বৈষম্যকে মহিমান্বিত করে তখন দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে যীশুকে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে স্থাপন করে মুক্তির ধর্মতত্ত্ব। এই বৈপরীত্য, এই লড়াই ধর্মের লড়াই নয় এটা সমাজের ভেতরে শ্রেণীসমূহের, বিভিন্ন বর্গসমূহের (লিঙ্গীয়, জাতিগত, বর্ণগত) সমাজের ভেতরকার ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির লড়াই। ধর্ম এসব ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা।
আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্নের যে শক্তি তা নিজে নিজে তৈরি হয়নি। সে শক্তি এসেছিল ‘পা ভাঁজ করে শোয়ার অবস্থা’ নিয়েও মহাবিশ্বকে, মানুষ ও জগতকে দেখার ক্ষমতা থেকে, সামাজিক কর্তৃত্ব এবং মতাদর্শিক আধিপত্যকে অস্বীকার করবার অব্যাহত লড়াই থেকে। আরজ আলী মাতুব্বর সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়েই সামনে লাঠি হাতে দাঁড়ানো দেখেছিলেন ধর্মকেই। তিনি যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন সেগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন মনে হলেও আদতে সেগুলো সমাজ ক্ষমতা কর্তৃত্ব অধিপতি সংস্কৃতি নিয়েই প্রশ্ন। কেননা একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সমাজে ধর্মের অধিপতি অস্তিত্ব আসলে ঐ সময়ের ঐ সমাজের বিধিব্যবস্থা অনুশাসন আর প্রবল মতাদর্শিক অবস্থানেরই একটি সংগঠিত রূপ।
[ইলিয়াস ও প্রশ্নের শক্তি বই থেকে নেয়া, প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, শ্রাবণ প্রকাশনি]