“অলস সময়ধারা বেয়ে, মন চলে শূন্যপানে ধেয়ে…”
বহু কারণেই আজকের দিনে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, তাই একটু প্রয়োজনের
অতিরিক্তই যেন স্পর্শকরেখা ছুঁয়ে সরে সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই দেখলাম
মুখপুস্তিকায় এক সুহৃদ আমাকে সেখানে দু’তিনটি মুক্তচিন্তক গোষ্ঠীতে
সদস্যবর্গের অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেই গোষ্ঠীগুলির সহসদস্যদের নামগুলোতে চোখ
বোলাতে বোলাতে মাথায় অনেক চিন্তা চকিতে খেলে গেল। মনে পড়ল অভিজিতের কথা,
এবং তাঁর দৃঢ়, অবিচলিত কুসংস্কারবিরোধী মানসিকতার কথা – এবং মনে প্রশ্ন
জাগল, আমরা যারা নিজেদেরকে মুক্তচিন্তক, যুক্তিশীল, এবং কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন
বলে মনে করতে পছন্দ করি, ব্যক্তিগত জীবনে, দৈনন্দিন বাস্তবে আমরা সেই
যুক্তি-বুদ্ধি-মনন কতটা ব্যবহার করে উঠতে পারি? মুক্তচিন্তা কি শুধু আমাদের
কথাতেই পর্যবসিত হয়, না কি তার সুস্পর্শ আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকাকেও
ছুঁয়ে তাকে উন্নত করে যায়?
দেশে (অর্থাৎ ভারতে) বেড়াতে গেলে চাক্ষুষ
রাস্তায়ঘাটে – এবং এমনকি দূরদর্শনের পর্দাতে রাশভারী খবরের প্রোগ্রাম বা
সাক্ষাৎকারেও – অবশ্যম্ভাবী ভাবে দৃষ্টিগোচর হয় মানুষজন দুইহাতে দশ আঙ্গুলে
দশ রকমের রঙের পাথর বসানো আংটি, গলায় বা বাহুতে তাগা-তাবীজ-মাদুলি,
মণিবন্ধে লাল বা কালো সুতো জড়ানো। এমনটি মনে করলে চলবে না যে সেই সব
অলঙ্করণ চেহারা বা উপস্থিতির সৌন্দর্যবর্ধনের তাগিদে; তাদের উদ্দেশ্য আরো
গূঢ় এবং গভীর – জ্যোতিষশাস্ত্র-অনুযায়ী গ্রহনক্ষত্রের শান্তি-স্বস্ত্যয়ন,
যার পদ্ধতি উঠে এসেছে সেই অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন
অন্ধবিশ্বাস থেকে যে লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত সুদূর গ্রহ নক্ষত্রের
প্রভাব পৃথিবীতে জন্মানো মানুষের জীবনের গতিবিধি নির্ধারণ করে দেবে। যদিও
জ্যোতিষশাস্ত্রে “নবগ্রহ”-এর মধ্যে চাঁদ আদতে একটি উপগ্রহ, এবং রাহু এবং
কেতুর গল্পকথার বাইরে কোন অস্তিত্ব নেই; যদিও প্রাচ্যদেশীয় এবং
পাশ্চাত্যদেশীয় জ্যোতিষবিদ্যার গোনা-গুনতির মধ্যে বিস্তর ফারাক, এবং
দু’পক্ষই বলে থাকে তাদের মতই সবচেয়ে নিখুঁত।
ভারতীয় আত্মার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে সমস্ত
কুসংস্কার ঢুকে রয়েছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গভীর এবং ক্ষতিকর হোলো
জ্যোতিষবিদ্যা, এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়, সংখ্যাতত্ত্ব (নিউমারোলজী) এবং
বাস্তুশাস্ত্র; এই জ্যোতিষবিদ্যার বুজরুকির বিষবাষ্প সমাজের স্তরে স্তরে ছড়িয়ে গেছে,
এবং তাকে ব্যবহার করে ভণ্ড-প্রতারকসমূহ সাধারণ মানুষজনের অশেষ ক্ষতি করে
চলেছে, কিন্তু কতিপয় চিন্তাশীল ব্যক্তিসমূহ ছাড়া আর কেউ সেটা খেয়াল করছেন
না। সূক্ষ্ম পর্যায়ের সুনিপুণ বুজরুকির এ একটা মহা লক্ষণ।
এই ধরণের বুজরুকি এবং কুসংস্কারের শিকার
সাধারণ মানুষজন কিন্তু আমাদেরই মধ্যে, আমাদেরই চতুষ্পার্শ্বে ঘুরে
বেড়াচ্ছেন, কাজকর্ম করছেন
ডাক্তার-মোক্তার-ইঞ্জিনীয়ার-কারীগরিবিশারদ-প্রযুক্তিবিদ, মায় বিজ্ঞানী
হিসেবে। নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে যাদের প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক নিয়মের নিগড়ে
বাঁধা পদার্থবিদ্যা, রসায়ণ, জৈববিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়, সকালবেলা
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় একবার বাড়ির ঠাকুরের আসনের সামনে, এবং তারপর পাড়ার
মন্দিরে সিঁদুর-মণ্ডিত একখণ্ড কালো পাথরের সামনে, কপালে এবং বুকে তিনবার
করে তর্জনী ঠেকিয়ে চকিত প্রণাম করার সময়ে একবারও বাধে না, মনে একবারও
প্রশ্ন ওঠে না যে এইসব বুদ্ধিবৃত্তিশূন্য, চিন্তাশক্তির পক্ষে অপমানজনক
অর্থহীন আচার অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন আছে কিনা? এই মহা অসঙ্গতি-কেই
“জ্ঞানীয় অনৈক্য” বা কগ্নিটিভ ডিসোনেন্স বলা হয়। এই জ্ঞানীয় অনৈক্যের
কারণেই চিকিৎসক-সার্জেন পূজো করে অপারেশন থিয়েটার-এ ঢোকেন, নারকোল ফাটিয়ে
কন্সট্রাকশন-এর কাজ শুরু হয়, বিজ্ঞানীর গাড়ির সামনের কাচে সুতোয় লাগান লেবু
আর লঙ্কার মালা ঝোলে, ভারতীয় মহাকাশবিজ্ঞানীরা পূজো না করে এবং লক্ষ্মীমন্ত জামাকাপড় না পরে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করেন না।
এই জ্ঞানীয় অনৈক্যের মহাপাশ থেকে আমরা
মানবজাতি কখনও কি বেরিয়ে আসতে পারব? যুক্তি-বুদ্ধি-মুক্তচিন্তাকে প্রাধান্য
দিয়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, পেশাগত বা ব্যক্তিগত, সুস্থ মানসিকতার
সঙ্গে নির্বাহ করতে পারব? উদ্ভট যত কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিঁড়ে নিজেদের
আত্মগত সম্ভাবনাকে চরিতার্থ করতে পারব? এর উত্তর আমার জানা নেই।
এই ধরণের প্রশ্ন আমার মনে ওঠাটা অস্বাভাবিক
নয়। কেন? কারণ অল্পকিছু বছর আগে আমি নিজেও সেই ধর্মনামক অন্তহীন
ঘূর্ণিচক্রর মধ্যে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে ছিলাম। এবং বর্তমানে যে উপলব্ধিটুকু
হয়েছে – যে মনের মধ্যে যুক্তিহীন, বিচারহীন, হতচৈতন্য, নির্জ্ঞান,
বিশ্বাসসর্বস্ব জানালা হাট করে ধর্মের জন্য খুলে রাখলে সে গবাক্ষপথে
অনাচার, অযুক্তি-কুযুক্তি, কুসংস্কারাদি নানাপ্রকার সামাজিক ব্যাধিও বিনা
বাধায় ঢুকে পড়ে – সে চেতনা তখনও আমার মন আলোকিত করেনি। তাই বিজ্ঞানের
পুঁথিগত ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও, বিনা প্রশ্নে ধর্ম এবং ধর্মগুরুর অলৌকিকত্ব
সমেত জ্যোতিষবিদ্যা, সংখ্যাতত্ত্ব এবং বাস্তুশাস্ত্রের মত অবৈজ্ঞানিক
কুসংস্কারের বেনোজলকে মনে সমাদরে জায়গা দিয়েছিলাম – এই ভেবে, যে হয়ত এসবের
মধ্যে কোন গভীর অন্তর্নিহিত সত্য লুকিয়ে আছে, যা আমি সেই পর্যায় পর্যন্ত
অনুধাবন করে উঠতে পারিনি, সে আমারই অক্ষমতা। জানি, গতস্য শোচনাঃ নাস্তি,
কিন্তু সেই সব অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকার মুহূর্তগুলো যে আর
কোনদিনই ফিরে পাব না, সেই জন্য মাঝে মাঝে মনের গভীরে চূড়ান্ত পশ্চাত্তাপ
জাগে বৈকি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এ কর্মসূত্রে অবতরণ
করার পর আমার বছর দুয়েক সময় লেগেছিল তমসা থেকে জ্যোতির্গমন করতে,
অজ্ঞানমৃত্যুকে অতিক্রম করে আত্মবিদ্ধির অমৃতত্ত্বের দিকে অগ্রসর হতে; বেশ
কিছু নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী বন্ধু, এবং কতিপয় যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তক
লেখক-চিন্তাবিদদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সান্নিধ্য না পেলে হয়ত আজও সেই
একদা-দুঃসাধ্য কাজ আমার পক্ষে সমাধা করা সম্ভবপর হোতো না। সেই সময়কার একটা
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাকি কথাটা বলব।
শিশুবয়স থেকেই দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে
জ্যোতিষবিদ্যার বেজায় কদর ছিল; কুষ্ঠী-ঠিকুজী, হস্তরেখা বিশ্লেষণ,
গ্রহনক্ষত্র-শান্তিস্বস্ত্যয়নের জন্য বহুব্যয়ে অমুক পাথর (পান্না, চূণী,
নীলা, পোখরাজ, সিংহলী গোমেদ, মুক্তো, ইত্যাদি; তা আবার লোহা বা তামার
আংটিতে বাঁধানো হলে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট ফল এবং সোনার আংটি হলে সর্বোৎকৃষ্ট
ফল) বা তমুক শাঁখের আংটি, দশ আঙুলে পারলে দশটি, পুরোদস্তুর। শুধুমাত্র
সংসারের শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য এবং ছেলের ভবিষ্যতের বিঘ্ননাশ করার আপ্রাণ
প্রচেষ্টায় আমার একান্তই মধ্যবিত্ত মা-বাবা না খেয়ে না দেয়ে অর্জিত পয়সা
ঢেলে গেছেন অমুক বাবা, তমুক মাতাজী, তসুক শাস্ত্রীর তেতলা পাকাবাড়ি পাঁচতলা
বাড়ানোর খরচার জোগান দিতে।
স্কুল-ফাইন্যাল (মাধ্যমিক) অতিক্রম করে যেই
বেরোলাম, আমার জন্য কোন এক পারিবারিক বন্ধুস্থানীয় জ্যোতিষবিদ্ পরামর্শ
দিলেন আমাকে একটা ভালো (অর্থাৎ, দামী) ধরণের গোমেদ এবং দুটো শাঁখের আংটি
পরানোর জন্য। গোমেদকে থাকতে হবে ডানহাতের মধ্যমায়, এবং প্রতিদিন তাকে
সূর্যালোক-সম্পৃক্ত করতে হবে – গোমেদ-এর মধ্যে দিয়ে পরিস্রুত হয়ে নাকি আমার
শরীরে ঢুকবে সূর্যরশ্মি, তাতে নাকি আমার রাহুর দশাকাল, যা কিনা
অষ্টাদশ-বছরব্যাপী চলে, তা অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ ভাবে কাটবে। দামী গোমেদ
কিনে ছেলেকে পরানোর মতো সামর্থ্য আমার মা-বাবার ছিলনা, তাই মা নিজের হাত
থেকে খুলে নিজের রুপোবাঁধানো গোমেদের আংটি আমার আঙ্গুলে পরিয়ে দিলেন। অন্য
হাতের অনামিকায় এল দুটো শাঁখের আংটি। (ঘটনাচক্রে দেখা গেল, যে পরা থাকতে
থাকতে, আঙ্গুলে ঘষা খেয়ে খেয়ে অচিরেই শাঁখের আংটি দুটো ভেঙে যেতে লাগল; তাই
কোত্থেকে যেন পাইকারী হারে গুচ্ছ শাঁখের আংটি কিনে রাখা হয়েছিল।)
সেই আংটি আমার সঙ্গী হোলো; স্নান করার সময়
গোমেদ-এর আংটিটা খুলে ভিতরটা পরিস্কার করতে হয় – নইলে খাঁজে খাঁজে নোংরা
জমে যায় – সেই সময়েও জ্যোতিষবিদের নির্দেশানুযায়ী সেটাকে অন্তত দুই আঙ্গুলে
ছুঁয়ে রাখতে হবে। এইসব পিণ্ডি চটকাতে চটকাতেই সেই আংটি আমার সঙ্গে চলে এল
ভিন্রাজ্যে এবং তৎপরে ভিন্দেশে, আমি এলাম উচ্চ থেকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য।
এত শিক্ষা হোলো, এত জ্ঞানার্জন হোলো, কিন্তু মন যেই তিমিরে, সেই তিমিরেই
রয়ে গেল; গোমেদের আংটি আর হস্তচ্যূত হোলোনা।
বাস্তবিকই, সেই আংটি আঙ্গুল থেকে খুলে মা-কে
ফিরিয়ে দিতে আমার প্রায় পনেরো বছর লেগে গেল। শেষ দেড়বছর, ‘মা-র দেওয়া
জিনিষ, ফেরত দিলে মা-র মনোকষ্টের কারণ হতে পারে’ – ইত্যাদি নানা রকম
স্বদোষস্খালন এবং ন্যায্যতা প্রতিপাদনের চেষ্টা উঠে বারবার এসেছিল মনের
মধ্যে, কিন্তু শেষপর্যন্ত উপলব্ধি হোলো যে নিজের কাছে সৎ এবং বিশ্বস্ত
থাকতে হলে এসব অজুহাত পরিত্যাগ করতেই হবে। তাই পরের সুযোগেই দেশে গিয়ে মা-র
হাতে সেই গোমেদের আংটি আবার হস্তার্পণ করে এলাম, বুঝিয়ে বলে এলাম যে সেটা
আর আমার পরে থাকার উপায় নেই, কারণ আমার জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটে গেছে।
যে অপ্রিয় প্রশ্নের সম্মুখীন আমি প্রায়শই
নিজেই নিজেকে করে থাকি, তা হল এই – আমার নিজের যদি পনেরো বছর লেগে থাকে
একটা ধারণা বা অন্ধবিশ্বাসের সত্যিমিথ্যা যাচাই করে সেটাকে চূড়ান্তভাবে
বর্জন করতে পারতে, তাহলে সেই দেশের সেই আচার-ব্যবহার, প্রথা-সংস্কৃতির
মধ্যে জীবনভর নিমজ্জিত থাকা মানুষের কাছে থেকে আমার কি প্রত্যাশা করা উচিত
যে অচিরেই সব বদলে যুক্তি-বুদ্ধি-মুক্তচিন্তার জয়জয়াকার শুরু হবে? আমার
জীবদ্দশায় নয়।