Saturday, August 6, 2016

ইসলামের জন্ম, বিকাশ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র (পর্ব ৪,৫)

ইসলামের চার খলিফার কেউই তাঁদের জীবদ্দশায় জনগণের শতদাবির মুখেও ক্ষমতা ত্যাগ করেননি। তাদের তিনজনকেই জনতার রোষানলে পড়ে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম, হজরত উসমানের খেলাফতের মধ্য দিয়ে ইসলামের ঘরে, যে অনলের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠে, তা হজরত আয়েশার যুগে এসে দাবানলে পরিণত হয়। হজরত আয়েশার আশা ছিল, উসমান-পরবর্তী মদিনার খলিফা হবেন তাঁর দুই দুলাভাই হজরত তালহা (রাঃ) অথবা হজরত যোবায়ের (রাঃ)। জনগণ হজরত আলিকে বিপুল ভোটে মদিনার চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত করে। নবীপত্নী আয়েশা এমনিতেই হযরত আলিকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন। হজরত আলি ছিলেন বিবি আয়েশার চক্ষুশূল। আয়েশা ছিলেন ব্যক্তি স্বার্থপর নারী। যে মহিলার বিছানার ভেতর জিব্রাইল ওহি নিয়ে আসতেন বলে নবী মুহাম্মদ (দঃ) গর্ব করতেন, সেই আয়েশা যখন ঘোষণা দিলেন উসমান হত্যায় হযরত আলি জড়িত, মানুষ তা অবিশ্বাস করতে পারলো না। সাহাবি হজরত তালহা ও হজরত যোবায়ের (আয়েশার দুই দুলাভাই) আলিকে খলিফা মেনে নিয়ে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। আয়েশার পরামর্শে তারা সে শপথ অস্বীকার করে বললেন যে তাদেরকে অস্ত্রের মুখে বাধ্য করা হয়েছিল আলিকে খলিফা মানতে। উসমান হত্যার প্রতিশোধ নিতে হজরত আয়েশার ডাকে উমাইয়া বংশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। তাঁর সাথে যোগদান করলো বেশকিছু মুসলিম, যারা নবী মুহাম্মদের (দঃ) অস্ত্রের মুখে প্রাণ রক্ষার্থে মুসলমান হয়েছিল আর যাদের মাতা-পিতা আত্মীয়স্বজন নবী মুহাম্মদের নির্দেশে হজরত আলির হাতে খুন হয়েছিল। এদিকে খেলাফত লাভের সাথে সাথে হজরত আলি সকল প্রাদেশিক গভর্নর পদ বাতিল করে দেন। কিছু উমাইয়া বংশীয় গভর্নরগণ পদত্যাগ করলো বটে কিন্তু রাজস্বভাণ্ডার লুটপাট করে শূন্য করে দিল। আর অনেকেই আলির খেলাফত অস্বীকার করলো। হজরত আলির জন্য প্রাদেশিক গভর্নর সমস্যার চেয়ে আয়েশার সৃষ্ট সমস্যা মারাত্মক হয়ে দেখা দিল। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি, তাঁর সর্বকণিষ্ঠ সৎ শাশুড়ি বিবি আয়েশা তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবেন। হজরত উসমানকে যখন হত্যা করা হয়, আয়েশা তখন মক্কায় ছিলেন। সেখান থেকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। হজরত আয়েশা, আলি কর্তৃক ক্ষমতাচ্যূত, ইয়েমনের গভর্নরের দেয়া পুরস্কার, অত্যাধিক সুন্দর, হৃষ্ট-পুষ্ট তাজা উট আল-আসকারের ওপর আরোহণ করলেন। পেছনে তাঁর ১০০০ হাজার সশস্ত্র সৈন্য। ডান পাশে হজরত তালহা, বামপাশে হজরত যোবায়ের। আয়েশার জীবনে বাল্যকালের আনন্দ ছিল না। যৌবন ছিল চরম হতাশা আর বেদনায় ভরা। যুদ্ধের ময়দানে হারিয়ে যাওয়ায় আয়েশার ওপর লোকে সেনাপতির সাথে কেলেঙ্কারি রটিয়েছে। মানুষ তাঁকে সতীত্বের অপবাদ দিয়েছে। আজ আয়েশার দু’চোখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে সারা জনমের জ্বলন্ত হিংসার স্ফুলিঙ্গ! হায়, নবীজি মুহাম্মদ! একবার এসে দেখে যান, আপনার বিষবৃক্ষে কি অপরূপ ফল ধরেছে। দেখে যান,আপনার আদরের দুলালী ফাতিমা জননীর স্বামীকে বধ করতে আপনার প্রিয়তমা বালিকা বধুর হাতে খঞ্জর। এ তো আপনারই শিক্ষা। এ তো আপনারই দেখানো সেই পথ! সর্বনাশা এই পথের সন্ধান ‘উম্মে সালমা’ জানতেন কিভাবে? উম্মুল-মোমেনিন (মুসলিম জাতির মা) হজরত আয়েশা সৈন্যদল নিয়ে বসোরার পথে রওয়ানা হবার আগে, তাঁর অন্যতম সতীন উম্মে সালমাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। সালমা বললেন- ‘ অসম্ভব! আয়েশা তুমি ঐ সর্বনাশা পথে পা বাড়িও না। নবীজি আমাকে কানে কানে বলে গেছেন, একদিন একদল সশস্ত্র লোক ঐ পথে যাত্রা করবে যাদের নেতৃত্বে থাকবে একজন মুসলিম নারী। সে নারী, আমার উত্তরাধিকারী, খাতুনে জান্নাত মা ফাতিমার স্বামী, আমার প্রিয় জামাতা হজরত আলির নেতৃত্ব অস্বীকার করবে। নবীজি আরও বলেছেন, যারা আমার আলির নেতৃত্ব অস্বীকার করবে, মনে করো তারা আমাকেই অস্বীকার করলো। আয়েশা তুমি সেই অভিশপ্ত নারী হতে যেও না।’


আয়েশার শরীরের রক্তধারা আজ উজান বইছে। উম্মে সালমার নির্বোধ কথা শুনার সময় আয়েশার নেই। বসোরার পথে আয়েশার দলে আরও ২ হাজার লোক যোগদান করলো। বসোরার গভর্নর আয়েশাকে বাধা দিলেন। ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আয়েশা রাজধানীতে ঢুকে পড়লেন। তারা হজরত আলির নতুন খলিফা, গভর্নর উসমান বিন হোনায়েফকে নামাজরত অবস্থায় বন্দী করে তাঁর দাঁড়ি-গোঁফ মুণ্ডায়ে শহর থেকে বের করে দিলেন। হজরত আলি যখন উম্মে সালমা মারফত আয়েশার মনোভাবের সংবাদ পেলেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ৪০ জন নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে আয়েশার সেনাবাহিনী বসোরা দখল করে নিয়েছেন। আলি তাৎক্ষণিকভাবে মাত্র ৯শত সৈন্য নিয়ে বসোরার পথে রওয়ানা হয়ে যান। নবীজির প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র (হজরত আলির সন্তান) হাসান ও হোসেন আর বসে থাকতে পারলেন না। পিতার নির্দেশে হজরত হাসান (রাঃ) অতিসত্তর কুফায় চলে যান। সেখান থেকে ৯ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে পিতার সাথে মিলিত হন। আলির পরাজিত গভর্নর উসমান বিন হোনায়েফ এসে বসোরার অবস্থা বর্ণনা করলেন। আলি মুচকি হেসে বললেন- ‘বৃদ্ধ গভর্নর পাঠিয়ে ছিলাম, এ দেখছি যুবক হয়ে ফিরে আসলেন’।

ধীরে ধীরে হজরত আলির সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো ২০ হাজারে আর আয়েশার ৩০ হাজার। প্রথমাবস্থায় হজরত আলি ও হজরত তালহার মধ্যে সাময়িক বাকযুদ্ধ হলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো, পরের দিন আরো আলাপ হবে বলে তারা নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরে গেলেন। ছোটবেলা থেকেই আয়েশা তার স্বামী মুহাম্মদের (দঃ) রণকৌশল দেখে আসছেন। পরের দিন আরো আলাপ করার জন্যে আয়েশা এতদূর আসেন নাই। রাতের অন্ধকারে অতর্কিতভাবে আয়েশার সৈন্যদল হজরত আলির সেনা-তাঁবুতে আক্রমণ করে বসলো। অতি অল্পসময়েই তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। রাত হতে সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে গেল, যুদ্ধ আর থামে না। হজরত আলির দক্ষ সেনাবাহিনীর সামনে আয়েশার সৈন্যগণ আর কতক্ষণ টিকে থাকবে? আয়েশার সৈন্যদল দুর্বল হয়ে পড়লো। তারা পশ্চাদগমনের প্রস্তুতি নিল। এতক্ষণে দশহাজার মুসলিম সন্তানের তাজা রক্তে শুষ্ক-মরুভূমি রক্তনদীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। নবীজির কাছ থেকে ‘সাইফুল্লাহ’ (আল্লাহর তরবারি) খেতাব প্রাপ্ত বীরের সামনে, উটের ওপর রমণীর উঁচু শীর! হজরত আলির আর সহ্য হয় না। নির্দেশ দিলেন, আয়েশার উটের পা কেটে ফেলা হউক। উটসহ আয়েশা মাটিতে পড়ে যান। হজরত আলি, আয়েশার ভাই মুহাম্মদ ইবনে আবুবকরকে বললেন, তোমার বোনকে উঠিয়ে মদিনায় নিয়ে এসো। (ইসলামের ইতিহাসে এ যুদ্ধ ‘জঙ্গে জামাল’ নামে অধিক পরিচিত) হজরত আলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন বটে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারলেন না, সামনে তাঁর জন্যে ও তাঁর আদরের ধন হজরত হাসান ও হোসেনের জন্যে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ সিফফিন ও কারবালা। জামাল যুদ্ধে পরাজিত আয়েশাকে (রাঃ) বন্দী করে মদিনায় পাঠিযে দিয়ে হজরত আলি (রাঃ) বসোরা থেকে কুফায় গমন করলেন ৩৬ হিজরির রজব মাসে। সিদ্ধান্ত নিলেন মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় স্থানান্তরিত করবেন। হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) তখনও সিরিয়ার গভর্নর। মুয়াবিয়া (রাঃ) যে, হজরত আলিকে খলিফা হিসেবে এত সহজে মেনে নেবেন না, তা আলিরও জানা ছিল। আর মুয়াবিয়াও হজরত আলিকে লোমে-পশমে চেনেন। রহস্যজনক ভাবে মুয়াবিয়া, হজরত আয়েশার সমর্থনে জামাল যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে, নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেন। আলির জন্যে তা ছিল বিরাট উপকারী। কিন্তু আলি জানতেন না যে, আসলে হজরত মুয়াবিয়া সিরিয়ায় হযরত আলিকে লৌহকঠিন খাঁচায় বন্দী করার ফাঁদ পেতে রেখেছেন। মুয়াবিয়া রাজ্যের সর্বত্র প্রচার করে দিলেন যে, আলি ইচ্ছে করলে উসমানকে বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু ক্ষমতালোভী আলি তা না করে হত্যাকারীদেরকে সহযোগিতা করেছেন এবং বাহুবলে শক্তি প্রয়োগ করে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। জামাল যুদ্ধে আলি যখন আয়েশার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে, মুয়াবিয়া তখন অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। হজরত মুয়াবিয়া সারা পৃথিবীতে উমাইয়াবংশীয় শাসন কায়েম করতে চান। তার আগে হাশেমি বংশের নবী মুহাম্মদের (দঃ) একমাত্র উত্তরাধিকারী হজরত আলির জীবন প্রদীপ চিরতরে নিভিয়ে দেয়া চাই।

হজরত উসমানের সুদীর্ঘ বারো বছরের অপশাসনে আরব মুসলিম সাম্রাজ্যে যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল, উসমান হত্যার মধ্য দিয়ে তা আরও দ্বিগুণ হয়ে দেখা দিল। হযরত আলির রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে মুসলিমবিশ্ব এই সর্বপ্রথম কোরায়েশবংশের হাশেমি গোত্রের নবী মুহাম্মদের রক্ত-সম্পর্কের একজন খলিফা পেলো। আলি একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন বটে কিন্তু দক্ষ রাজনীতিবিদ মোটেই ছিলেন না। ক্ষমতায় বসেই মারাত্মক ভুল করে বসলেন। আলির চোখে ভেসে ওঠে মুসলিম সাম্রাজ্যের এক কুৎসিত ভয়ঙ্কর প্রতিচ্ছবি। তাঁর মনে পড়ে সেই কালো রাত্রির কথা, যে রাতে হজরত ওমর তাঁর দরজার সামনে এসে হাঁক দিয়ে বলেছিলেন : ‘কে আছো ঘরের ভেতর, বেরিয়ে এসো, আর আবুবকরের খেলাফত গ্রহণ করো, অন্যথায় মানুষসহ ঘরে আগুন ধরিয়ে দেবো।’  হজরত ফাতেমা বের হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার ঘরে নবীজির বিশ্বস্ত কয়েকজন সাহাবি মেহমান আছেন। ওমর, তুমি কি নবীজির মেয়ের ঘর আগুনে পোড়াতে চাও, যার হাতে আছে বেহেস্তের চাবি?’ উল্লেখ্য, আবুবকরের খেলাফত গ্রহণ করার পর থেকে, ফাতেমার ঘরে রাতে কিছু লোক নিয়মিত বৈঠক করে পরামর্শ করতেন। তারা ফাতেমা ও আলির মতো আবুবকরের খেলাফত অস্বীকার করেছিলেন। ঐ ঘটনার পর হজরত ফাতেমা তাঁর স্বামীকে অনুরোধ করেছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাঁকে রাতের আঁধারে গোপনে দাফন করা হয়, যাতে হজরত ওমর তাঁর জানাজায় আসতে না পারেন। এর কিছুদিন পরেই হজরত ফাতেমা ইন্তেকাল করেন। রাজ্যের সর্বত্রই হজরত আলি দেখতে পান মদ্যপায়ী, উচ্চাভিলাসী, শরিয়া বিরোধী, স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী, নারী-আসক্ত, ভোগ-বিলাসী, শাসকদের চেহারা। হজরত আলি এক সাথে সকল প্রাদেশিক গভর্নরের পদ ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে দেন। রাগের বশে, আবেগের বশে, অথবা তাঁর ও তাঁর স্ত্রী হজরত ফাতেমার ওপর আবুবকর, ওমর ও ওসমান কর্তৃক সারা জীবনের অপমান, অত্যাচারের প্রতিশোধ হিসেবেই হোক, হযরত আলির এ কাজটি ছিল অদূরদর্শিতার প্রমাণ। বেশ কিছু প্রাদেশিক গভর্নর তৃতীয় খলিফা উসমান হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগ করাতো দূরের কথা, আলির খেলাফতই মেনে নিতে রাজি হলো না। ‘উসমান হত্যার বিচার’ ইস্যুটি ছিল হজরত মুয়াবিয়ার চক্রান্ত, আলির জন্যে এক মরণফাঁদ। মুয়াবিয়ার কাছে ‘সবার ওপরে ধন আর ক্ষমতা সত্য’-এর উর্ধ্বে কিছুই ছিল না। হজরত মুয়াবিয়াই নবী মুহাম্মদের (দঃ) ইসলাম সৃষ্টির গোপন রহস্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। মুয়াবিয়া ছিলেন মুহাম্মদের (দঃ) রাজনৈতিক সচিব। তাই রাজনৈতিক ইসলামের সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ ফসল সম্ভবত তিনিই সবচেযে বেশি উপভোগ করেছিলেন। মুয়াবিয়া কোনোদিনই মুহাম্মদের (দঃ) ‘ইসলাম ধর্ম’ গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর (মুহাম্মদের) মাস্টার মাইন্ডেড ছল-চাতুরী, ভণ্ডামি, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা ভালভাবেই অনুকরণ করেছিলেন। আর আজ সেই দক্ষতাই মুহাম্মদের (দঃ) শেষ বাতিটি চিরদিনের জন্যে নিভিয়ে দিতে মুয়াবিয়া কাজে লাগাতে উদ্দ্যত হয়েছেন। সারা মুসলিম জগৎ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। উসমান হত্যায় জড়িত মিশর, মক্কা, কুফাসহ বিভিন্ন প্রদেশের বিদ্রোহীগণ হজরত আলিকে পরিস্কার হুমকি দিয়ে বসলো, যদি উসমান হত্যার বিচার করা হয়, তাহলে আলিকেও উসমানের মতো বড়ই দুঃখজনক ও মর্মান্তিক পথে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। আলি দেখলেন তিনি আজ সাত-পাঁকে বাঁধা পড়ে গেছেন। তলোয়ার দিয়ে রক্তের হুলি খেলা যে আলির নেশা, যে আলি মুহাম্মদের (দঃ) সহচরী হয়ে ৯৮টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাঁর কাছ থেকে ‘আলি হায়দার’, ‘সাইফুল্লাহ’ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবসমূহ পেয়েছিলেন সে আলী আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বড়ই ক্লান্ত। আজ মানুষের রক্তাসক্ত, আলির মাতাল তরবারি চায় একটু বিরতি, শান্তির একটু নিঃশ্বাস। কিন্তু তা তো হবার নয়। ক্ষমতা আর রক্ত যে একে অপরের সম্পূরক সে কথা বুঝতে আলির মোটেই দেরি হলো না।


এখানে হজরত মুয়াবিয়ার জীবনের বিবিধ কার্যাবলী ও মুহাম্মদ (দঃ) বংশের হজরত আলির সাথে তাঁর শত্রুতার কারণ বুঝার প্রয়োজনে মুয়াবিয়ার সংক্ষিপ্ত পরিচয় জেনে নেয়া ভাল। হজরত মুয়াবিয়া ছিলেন সাহাবি হজরত আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার জারজ সন্তান। আবু সুফিয়ানের সাথে হিন্দার বিবাহের তিন মাস পরে মুয়াবিয়া জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা হিন্দা ছিলেন একজন ‘বেশ্যা’। উর্দুভাষী একাধিক ঐতিহাসিক, হিন্দার চারিত্রীক বর্ণনায় ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অন্যান্য সূত্রানুযায়ী হিন্দা, বেশ্যা না হলেও তিনি যে বহু-পুরুষগামী মহিলা ছিলেন এবং মুয়াবিয়া যে তার জারজ সন্তান তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় হজরত হাসান (রাঃ) ও হজরত আয়েশার (রাঃ) উক্তিতে। শাম ইবনে মুহাম্মদ কালভি (রঃ) তাঁর ‘কেতাবে মোসাব’ বইয়ে লেখেন- ‘হজরত হাসান (রাঃ) একদিন ব্যঙ্গ করে হজরত মুয়াবিয়াকে বলেন, তোমার কি মনে আছে তোমার আসল পিতা কে? মুয়াবিয়া কর্তৃক হজরত আয়েশার ভাই মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর খুন হওয়ার সংবাদ পেয়ে আবু সুফিয়ানের মেয়ে উম্মে হাবিবা (মুয়াবিয়ার বোন ও নবীজির স্ত্রী) আয়েশাকে আস্ত একটি ছাগল রান্না করে ‘সদকা’ হিসেবে পাঠিয়ে দেন। আয়েশা জিজ্ঞেস করেন, ‘এর অর্থটা কি?’ উত্তরে উম্মে হাবিবা বললেন, ‘উসমান হত্যার পুরুস্কার, তোমার ভাই উসমানকে খুন করেছিল’।আয়েশা অভিশাপ দিয়ে বলেন- ‘বহু-পুরুষগামী হিন্দার মেয়ের ওপর আল্লাহর গজব বর্ষিত হোক’। এর পরে আয়েশা যতোদিন জীবিত ছিলেন, উম্মে হাবিবা ও তাঁর মা হিন্দাকে নামাজ শেষে অভিশাপ দিয়েছেন। হিন্দা ইসলামের ইতিহাসে নবীজির চাচা হজরত হামজার (রাঃ) কলিজা ভক্ষণকারী বলেও পরিচিত! ইবনে আবি আল হাদিদ তাঁর ‘নাহজুল বালাগা’ (ভলিউম ১০, পৃষ্ঠা ১৩০) বইয়ে উল্লেখ করেন, মুয়াবিয়ার জন্মদাতা হিসেবে সম্ভাব্য চারজন পিতার নাম লোকমুখে শুনা যায়; তারা হলেন : আবি ইবনে ওমর বিন মুসাফির, ওমর বিন ওলিদ, আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব এবং সাবাহ (এক ইথোপিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ)। একই বক্তব্য পাওয়া যায় ‘রাবিউল আবরার’ (ভলিউম ৩, পৃষ্ঠা ৫৫১) কেতাবে আল্লামা হজরত জামাক্শারির লেখায়। তবে যেহেতু আবু সুফিয়ানের, উৎবা নামে সর্বজন স্বীকৃত আরেকজন জারজ সন্তান ছিলেন, আমরা ধরে নিতে পারি, বিয়ের আগে হজরত আবু সুফিয়ানের সাথে হিন্দার দৈহিক সম্পর্কের ফসল হজরত মুয়াবিয়া।

মুহাম্মদের (দঃ) মক্কা বিজয়ের পরে আবু সুফিয়ান নিজ পরিবার ও গোত্রের মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আবু সুফিয়ান পেছনের দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকান। বদরের যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত তাঁর নিজের ও মুহাম্মদের (দঃ) মধ্যকার শত্রুতা, কোরায়েশ বংশের অগণিত মানুষের রক্ত দিয়ে লেখা এক দীর্ঘ ইতিহাস। চল্লিশটি বছর যে ছেলেটাকে আদরে আহ্লাদে কেউ এতোটুকু কটু কথা বলেনি, সেই হাশেমি বংশের একটা এতিম ছেলের হাতে উমাইয়া বংশের একি করুণ পরাজয়! আবু সুফিয়ান ও তাঁর পরিবারের মন থেকে সেই পরাজয়ের গ্লানি কোনোদিনই মুছে যায়নি। মুহাম্মদের (দঃ) কাছ থেকে, সরকারি উচ্চপর্যায়ে চাকুরি (সেক্রেটারি অব স্টেইট) দেয়ার অঙ্গিকার নিয়ে আবু সুফিয়ান ছেলে মুয়াবিয়াকে ‘ইসলাম ধর্ম’ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে মুয়াবিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুয়াবিয়া ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী, উচ্চাভিলাষী, চতুর রাজনীতিবিদ। তার অধীনেই মুসলিম সৈন্যগণ ত্রিপলী, আরমানিয়া, সাইপ্রাসসহ অনেক অঞ্চল দখল করে ভারত ও চীন দখল করতে চেয়েছিল। হজরত আলি তা ভাল করেই জানেন। আলি ভাবলেন, মদিনার অলিতে-গলিতে উসমান হত্যার আহাজারি, আকাশে-বাতাসে মানুষের ক্রন্দন ধ্বনি থামতে না থামতেই আয়েশার বিরুদ্ধে করতে হলো ‘জামাল যুদ্ধ’। রক্তক্ষয়ী জামাল যুদ্ধে দশ সহস্রাধিক মানুষের প্রাণনাশের পরপরই, মুয়াবিয়ার সাথে আরেকটি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সমুচিৎ হবে না। হজরত আলি হামদান প্রদেশের গভর্নর, বনি-বাজিলা প্রধান হজরত জারিরকে, মুয়াবিয়ার প্রতি একটি প্রস্তাব দিয়ে সিরিয়া পাঠালেন- ‘ সিরিয়ার গভর্নর যেন অনতিবিলম্বে হজরত আলির খেলাফত মেনে নিয়ে শপথ গ্রহণ করেন।’ হজরত মুয়াবিয়া বিষয়টা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। সুচতুর মুয়াবিয়া হজরত জারিরকে এমন এক মায়াবীনি মন-মাতানো আতিথিয়েতা দিয়ে মুগ্ধ করে দিলেন যে, হজরত জারির ভুলেই গেলেন, তিনি কি জন্যে এসেছিলেন। মুয়াবিয়ার চোখ-জুড়ানো রঙিন প্রাসাদে, চিত্তরঞ্জন করে হজরত জারির (রাঃ) ফিরে আসলেন দীর্ঘ তিন মাস পরে সম্পুর্ণ ভিন্ন মানুষ হয়ে। এসে বললেন- ‘মুয়াবিয়া (রাঃ) হজরত আলির সাথে রাষ্ট্রীয় কোনো বিষয় নিয়ে কোনো প্রকার আলোচনায় বসতে রাজি নন, যতক্ষণ পর্যন্ত না হজরত উসমানের হত্যাকারীর ফাঁসি হবে’। তিনি আরও বললেন- ‘এখনও হজরত উসমানের রক্তাক্ত জামা ও তাঁর স্ত্রী নায়লার কাটা আঙুল দামেস্কের মসজিদের মিনারে ঝুলছে। সিরিয়ার আপামর জনসাধারণ আল্লাহর নামে জীবনমরণ কসম খেয়েছে, যতদিন পর্যন্ত হজরত উসমানের হত্যাকারী ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদেরকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত দামেস্কের মসজিদে হজরত উসমানের রক্তাক্ত জামা ও তার স্ত্রীর কাটা আঙুল ঝুলন্ত থাকবে’। সাহাবি হজরত মালিক আল আশতার (রাঃ) ভীষণ রাগান্বিত হয়ে ধমক দিয়ে হজরত জারিরকে বললেন- ‘তুমিতো আমাদের প্রস্তাব মুয়াবিয়াকে আদৌ দাওনি। দীর্ঘ তিন মাস মুয়াবিয়া তোমাকে তার রাজপ্রাসাদে চিত্তবিনোদনে মত্ত রেখে, আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে’। এই সেই সাহাবি হজরত মালিক আল আশতার (রাঃ) যিনি অস্ত্রের মুখে হজরত আয়েশার দুই ভগ্নীপতি হজরত তালহা (রাঃ) ও যোবায়েরকে (রাঃ) হজরত আলির খেলাফত মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। ভয়ঙ্কর মালিক আল আশতারকে হজরত জারির ভালভাবেই চেনেন। আলি যখন হজরত তালহা (রাঃ) ও যোবায়েরকে (রাঃ) তাঁর খেলাফত মেনে নিয়ে শপথ গ্রহণ করতে প্রস্তাব দেন, মালিক আল আশতার তখন তাদের মাথার ওপর উন্মুক্ত শাণিত তরবারি হাতে দণ্ডায়মান। প্রচণ্ড সাহসী বীর হজরত তালহা, যিনি ওহুদের যুদ্ধে নবীজির প্রাণরক্ষার্থে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে শত্রুপক্ষের তীর বর্ষা নিজের বুকে-পিঠে গ্রহণ করেছিলেন, মালিক আল আশতারের তলোয়ারের সামনে, আলির খেলাফত অনিচ্ছাকৃতভাবেই মেনে নিলেন। সাহাবি যোবায়েরকে জিজ্ঞাসা করায় যখন তিনি নীরব রইলেন, মালিক আল আশতার সিংহের মতো গর্জে উঠে হজরত আলিকে (রাঃ) বললেন- ‘ আলি (রাঃ), যোবায়েরকে আমার কাছে আসতে দিন, তার মাথাটা তলোয়ারের এক আঘাতে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলি।’ উল্লেখ্য, ইসলামের চার খলিফা নির্বাচনে প্রতিবারই একাধিক খলিফা পদপ্রার্থী ছিলেন, কিন্তু কোনোবারই গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন ইঞ্জিনিয়ারিং, কারচুপি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা শুরু হয়েছিল সেই প্রথম খলিফা হজরত আবুবকরের সময় থেকে। হজরত আলির বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

হজরত জারির বুঝতে পারলেন এখানে থাকা তার জন্যে নিরাপদ নয়। তিনি কুফা ত্যাগ করে সিরিয়া চলে যান এবং হজরত মুয়াবিয়ার সৈন্যদলে যোগদান করেন। মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্র ও দুষ্ট ছলচাতুরি দেখে হজরত আলি নিশ্চিত হলেন, বিষয়টার ফয়সালা অস্ত্রের মাধ্যমেই হতে হবে। সুতরাং আবারও যুদ্ধ, আবারও রক্তপাত। আলির জেষ্ঠ্য পুত্র হজরত হাসান, সিরিয়া আক্রমণ করতে পিতাকে নিষেধ করলেন। হাসান বললেন- ‘পিতা, প্রয়োজন হলে খেলাফত ছেড়ে দিন, মোয়াবিয়ার সাথে যুদ্ধে যাবেন না, মুয়াবিয়া সাংঘাতিক ভয়ানক মানুষ! এ যুদ্ধে মুসলিম-জাহানের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। আর কতো রক্তপাত, আর কতো প্রাণহানি?’ হজরত আলি বললেন- ‘আজ যদি মুয়াবিয়াকে ছাড় দেওয়া হয়, যদি তার চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে না পারি, অল্পদিনের মধ্যেই সারা মুসলিম বিশ্ব ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। প্রত্যেকটি প্রদেশ আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করে বসবে।’ আলী বিলম্ব না করে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। আলির ইচ্ছে হলো উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করে সিরিয়া দখল করবেন। তাই মেসোপটামিয়ান মরুভূমির মধ্য দিয়ে একদল সেনাবাহিনী অগ্রীম পাঠিয়ে দেন, কিন্তু সেনাদলটি আল ফোরাত নদীর পশ্চিম কিনারে এসে মুয়াবিয়ার একটি সেনাবাহিনীর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। বাধ্য হয়ে তারা মেসোপটামিয়ান ফিরে যায়। এদিকে হজরত আলী মূল সৈন্যদল নিয়ে টিগরিস হয়ে পশ্চিমে মসুল এলাকার ফাঁড়ি পথে মেসোপটামিয়ান অতিক্রম করে আল-ফোরাত নদীর উপরিভাগে ‘আর-রাককা’ নামক স্থানে এসে উপনীত হলেন। আর-রাককা ‘বালিক’ ও ‘আল-ফোরাত’ নদীর মোহনা স্থান। অবাক বিস্ময়ে আলির সৈন্যদল লক্ষ্য করলেন নদীপাড়ে এক বিরাট মানববন্ধন তাদের পথ রুখে দাঁড়িয়ে আছে। সেনাপতি মালিক আল আশতার শাণিত তরবারী উঁচু করে তাদেরকে আক্রমণ করার হুমকি দিলেন। জনতা ভয় পেয়ে পথ ছেড়ে দিল। সিরিয়ার সীমান্ত এলাকায় পৌঁছার পথে বেশ কয়েকটি জায়গায় হজরত আলির সৈন্যদলের সাথে মুয়াবিয়ার ছোট ছোট সেনাবহিনীর খণ্ডযুদ্ধ হয়। ৩৬ হিজরির জিলহাজ মাসে, হজরত আলি তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে সিরিয়ার ‘সিফ্ফিন’ নামক স্থানে এসে মোয়াবিয়ার ১২০ হাজারের মূল সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি হন। ইতোমধ্যে আলির সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৯০ হাজারে। আলি বুঝতে পারলেন চতুর্দিকে ব্যারিকেড, নদী পারে পানি-পথ বন্ধ, ১২০ হাজার সৈন্য মোতায়েন, এ সকল মুয়াবিয়ার বহুদিনের সুনিপুণ আয়োজন।

‘সিফ্ফিন’ ময়দানে এসে আলি (রাঃ) বিনা যুদ্ধে তাঁর খেলাফত স্বীকৃতি আদায়ের সকল প্রকার শেষ চেষ্টা করলেন। উসমান হত্যার বিচার করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। শান্তিপূর্ণ আলোচনার জন্যে প্রতিনিধিদল পাঠালেন, নিজেও মুয়াবিয়ার কাছে ব্যক্তিগত পত্র দিলেন। কিন্তু তাঁর এই কোমলমতি আচরণ তীক্ষ্ম বুদ্ধির মুয়াবিয়ার চোখে ধুলো দিতে সক্ষম হলো না। মুয়াবিয়া জানেন আলি মিথ্যাবাদী, প্রতারক। বসোরায় আয়েশার বিরুদ্ধে জামালযুদ্ধের সময়ে আলি প্রথমে হজরত তালহা ও হজরত যোবায়েরের প্রশংসা করে তাদের মন জয় করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ‘তালহা তুমি রসুলের (দঃ) একজন বিশ্বস্ত সাহাবি ইসলামের একজন সাহসী বীর সৈনিক। তুমি আর আমি নবীজির পাশে থেকে অনেক যুদ্ধ করেছি। তুমি না-হলে নবীজিকে ওহুদের যুদ্ধে সাহাবি হজরত খালিদ বিন অলিদের (রাঃ) হাত থেকে রক্ষা করা মুশকিল হতো’। উল্লেখ্য মহাবীর খালিদ বিন অলিদ ওহুদের যুদ্ধে মুহাম্মদের (দঃ) মাথায় তরবারি দিয়ে এমন আঘাত করেছিলেন যে, নবীজির হ্যালমেট ভেদ করে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগায় তাঁর দুটি দাঁত ভেঙে গিয়েছিল। একপর্যায়ে আলি যখন বললেন, ‘তোমরা তো স্বেচ্ছায় আমার খেলাফত মেনে নিয়েছিলে, তাহলে আজ কেন আমার বিরোধিতা করছো’? হজরত তালহা ও হজরত যোবায়ের একবাক্যে চিৎকার করে বললেন- ‘আল্লাহর কসম, আমাদের মাথার ওপর তলোয়ার রেখে আলি স্বীকারোক্তি আদায় করে নিয়েছিলেন।’ বসোরার জনগণ বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে একদল লোক মদিনায় প্রেরণ করলো। খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো, হজরত আলি শুধু তালহা ও যোবায়েরকেই নয়, অন্যান্য নেতৃপর্যায়ের লোক যারা খেলাফতের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন, সকলকেই জোরপূর্বক তাঁর খেলাফত মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। মুয়াবিয়া এও জানেন, তালহা ও যোবায়েরের এতো প্রশংসাকারী হজরত আলিই তাদেরকে হত্যা করে আয়েশার দুই বোনকে একসাথে বিধবার কাপড় পরিয়েছিলেন। মুয়াবিয়া মনে মনে বললেন, আলি, আয়েশার বসোরা দেখেছো, মুয়াবিয়ার সিরিয়া দেখো নাই। আলির প্রতিউত্তরে মুয়াবিয়া জানিয়ে দিলেন- ‘উসমান হত্যাকারীদেরকে আমার হাতে সোপর্দ না করা পর্যন্ত একটা সৈন্যও রণক্ষেত্র থেকে সরানো হবে না।’ এতক্ষণে হজরত আলি বুঝলেন এখানেই হবে হয়তো তার জীবনের শেষ যুদ্ধ। এই যুদ্ধই হয়তো সূচনা করবে ইসলামের ভিন্নমুখী এক নতুন ইতিহাস। মুয়াবিয়া জানেন, উসমান হত্যাকারীদেরকে শাস্তি দেয়া আলির পক্ষে সম্ভব নয়। আলিও জানেন তার সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ লোকই উসমান হত্যায় জড়িত। আলির সেনাপতি মালিক আল আশতার ও মুহাম্মদ বিন আবুবকর তাদের অন্যতম। উসমান হত্যাকারীদেরকে মুয়াবিয়ার হাতে সোপর্দ করা আর প্রকারান্তরে তাঁকে খলিফা মেনে নেয়ারই সমান।


৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস (জিলহজ ৩৭ হিজরী) সৈন্য মোতায়েন, সংলাপ বিনিময়, ছোট ছোট খণ্ডযুদ্ধে অতিবাহিত হলো। মে মাসে বিশাল প্রশস্ত সিফ্ফিন মাঠ, ইসলামের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সেনাদলের পদাঘাতে থরথর করে কেঁপে উঠলো। বর্শা আর তরবারির ঝনঝনানী শব্দে, রণবাদ্যের হুংকারে স্তব্ধ হয়ে যায় জগতের পশুপক্ষী, জীবজন্তুর কলরব। হজরত মুয়াবিয়া তাঁর ১২০ হাজার সৈন্যকে ৮জন সেনাপতি দিয়ে ৮টি দলে বিভক্ত করলেন। অপরপক্ষে আলিও তাই করলেন। যুদ্ধের এই অভূতপূর্ব দৃশ্য, এই বিশাল আয়োজন দেখে উভয় পক্ষই আতঙ্কিত হলো, এই বুঝি ইসলাম ও মুসলিম জাতি বিশ্বের মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যায়! কেউই পুরোদমে যুদ্ধ শুরু করতে চাইলো না। বিচ্ছিন্নভাবে সেক্টর ভিত্তিক যুদ্ধ চললো পুরো একমাস। আসলো জুন, ৩৭ হিজরীর পবিত্র মোহাররম মাস. উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতি চাইল। হজরত আলি পুনরায় সংলাপের মাধ্যমে বিষয়টার সমাধান চাইলেন। চতুর মুয়াবিয়া বিরতির সময়টাকে প্রপাগাণ্ডা ছড়ানোর কাজে লাগালেন। আলির সৈন্যদলে যারা উসমান হত্যার বিচার কামনা করে, তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, আলি সত্যিকার অর্থে উসমান হত্যার বিচার করবেন না, কারণ হত্যাকারীরা আলির আত্মীয়, আলি তাদেরকে চেনেও না-চেনার ভান করেন। খলিফা উসমান হত্যাকারীদেরকে গ্রেফতার করাতো দূরে থাক বরং অনেককে তিনি সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে পুরস্কৃত করেছেন। আলির কিছু লোক তাঁর ওপর সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করলো। উভয় পক্ষের সংলাপ চলতে থাকলো। এক পর্যায়ে সিরিয়ার সংলাপ প্রতিনিধিদল আলিকে প্রশ্ন করেন- ‘আলি, আপনার দৃষ্টিতে খলিফা উসমানকে হত্যা করা কি ন্যায়-সঙ্গত ছিল’? আলি জবাব দেন- ‘এ ব্যাপারে আমি এখন কিছু বলবো না।’

মুয়াবিয়ার প্রপাগাণ্ডার বৃক্ষে ফল ধরতে শুরু করলো। আলির সকল প্রকার চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। তিনি দেখলেন এখান থেকে বিনা যুদ্ধে পরিত্রাণ পাওয়ার সকল পথ মুয়াবিয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আরবি সফর মাসে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। প্রতিদিন উভয় পক্ষে শতশত প্রাণহানি ঘটতে থাকলো। আলির সেনাপতি হজরত মালিক আশতার (রাঃ) একাই একদিনে, প্রতিবার আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করে এক এক করে ৪০০জন শত্রুর মস্তক কেটে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুয়াবিয়ার একজন সৈন্য আলির পেছনে ধাওয়া করে এসেছিল। আলি তলোয়ার দিয়ে তার পেট বরাবর এমন শক্ত কোপ মেরেছিলেন, চোখের পলকে লোকটির শরীরের নীচভাগ ঘোড়ার পিঠে রেখে উপরিভাগ মাটিতে পড়ে যায়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত বিরামহীন যুদ্ধ চললো। দিনে দিনে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়তেই থাকলো। তবে তুলনামূলকভাবে মুয়াবিয়ার দিকে হতাহতের সংখ্যা ছিল বেশি। আলির সেনাপতি হজরত মালিক আশতার (রাঃ) ইঙ্গিত করলেন, বিজয় নিকটবর্তী। মুয়াবিয়া রণক্ষেত্র ত্যাগ করে পলায়নের কথা ভাবছিলেন, ঠিক সেই সময়েই মুয়াবিয়ার সেনাপতি সাহাবি হজরত আমর ইবনে আ’স (রাঃ) তাদের শ্রেষ্ঠ প্রতারণার অস্ত্রটি ব্যবহার করার অনুমতি চাইলেন। মুয়াবিয়ার অনুমতি নিয়ে হজরত আমর ইবনে আস (রাঃ) তার সৈন্যবাহিনীর বর্শার ফলকে ৫০০ কপি কোরআন গেঁথে দিয়ে উড়াতে নির্দেশ দিলেন। আলির সেনাবাহিনী থমকে গেল, বিষয়টা কি? আমর ইবনে আ’স বললেন- ‘আর রক্তপাত নয়, উভয় পক্ষের অসংখ্য মুসলমান নিহত হয়ে গেছেন। আমরা অস্ত্র নয়, কোরআনের মাধ্যমে ফয়সালা চাই’। হজরত আলি তাঁর সিপাহীদেরকে নিষেধ করে বললেন- ‘সাবধান মুয়াবিয়ার প্রতারণায় কর্ণপাত করো না, এ নিছক প্রতারণা বৈ কিছু নয়’। বেশকিছু সৈন্য আলির কথা অমান্য করে যুদ্ধ বন্ধ করে দিল। আলির সেনাপতি হজরত মালিক আশতার দৌঁড়ে এসে বললেন- ‘আল্লাহর কসম, আরো কিছুক্ষণ সময় তোমরা ধৈর্য্য সহকারে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, বিজয় আমাদের অনিবার্য।’

এক নাগাড়ে একমাস যুদ্ধ করে অবশ ক্লান্ত দেহের আলির একদল সৈন্য হাতের অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে বললো- ‘আমরা অস্ত্রের চেয়ে কোরআনের মাধ্যমে ফয়সালা শ্রেষ্ঠ মনে করি।’ চতুর্দিক দিক থেকে ‘আল্লাহর আইন, কোরআনের ফয়সালা’ চিৎকার ধ্বনি শুনা গেলো। আলি পুনরায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলে তার দলের কিছু লোক, এই বলে আলির ওপর অভিযোগ আনলো যে, আলি ইচ্ছে করেই ক্ষমতার লোভে মুসলিম জাতিকে এ যুদ্ধে লিপ্ত করেছেন এবং তিনি উসমান হত্যার বিচার মোটেই চান না। আলিকে বাধ্য হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে হলো। বনি-কিন্দা প্রধান হজরত আল-আশা’ত মুয়াবিয়াকে জিজ্ঞেস করেন : ‘৫০০ খানি কোরআন বর্শার মাথায় গাঁথার মানেটা কি? মুয়াবিয়া বললেন- ‘আল্লাহর ইচ্ছের ওপর, তাঁর কোরআনে লিখিত সমস্যার সমাধান খোঁজা আমাদের উচিৎ।’ কোরআনকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেও মুয়াবিয়া কোরআনিক সমাধানটা নিজেই দিয়ে দিলেন। বললেন- ‘উভয় পক্ষ নিজ নিজ দল থেকে একজনকে প্রধান করে মধ্যস্থতাকারী কমিটি গঠন করা হউক। মধ্যস্থাতাকারী দুই প্রধান যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা উভয় পক্ষকে মেনে নিতে হবে।’ আলির লোকজন সমস্বরে বলে উঠলেন : ‘আমরা মানি, আমরা মানি।’ বৈঠক বসার আগে হজরত মুয়াবিয়া অতি গোপনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে ফেললেন। হজরত উসমানের সময়ের মিশরের গভর্নর হজরত আমরকে বললেন, ‘বৈঠকে সিদ্ধান্ত যাই হোক তুমি মিশর ছাড়বে না।’ হজরত আমর বললেন, ‘যদি মিশর আলির দখলে চলে যায়’? ‘সর্বপ্রথম মিশর আক্রমণ করা হবে, তোমরা প্রস্তুত থেকো’। মুয়াবিয়া হজরত আমরকে আশ্বস্ত করলেন। আলির পক্ষে মধ্যস্থতাকারী দল-প্রধানও মুয়াবিয়ার তৈরি। আলি প্রস্তাব করলেন, দল-প্রধান হিসেবে প্রবীণ নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) নাম। আলির লোকেরা প্রতিবাদ করলো। তারা প্রস্তাব করলো মুয়াবিয়ার সমর্থক হজরত আবু-মুসার (রাঃ) নাম। আলি বললেন- ‘সর্বনাশ, আবু মুসা একজন দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক। তাকে আমি কুফার অস্থায়ী গভর্নর করে পাঠিয়েছিলাম। সে আমার খেলাফত অস্বীকার করায় এই সেদিন আমি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছি’। এক সময়কার হযরত আলির (রাঃ) অন্ধসমর্থনকারী কুফাবাসীও আজ আলির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলো। তারা বললো- ‘আলি তোমারই কারণে আয়েশার বিরুদ্ধে জামাল যুদ্ধে কুফার হাজার হাজার নারী বিধবা হয়ে কাঁদছে, তাদের চোখের জল আজও শুকায়নি।’

৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি (৩৭ হিজরীর রমজান মাস) ঐতিহাসিক ‘আলি-মুয়াবিয়া’ শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। সত্তর হাজার মানুষের রক্তে আজ স্যাত স্যাতে পিচ্ছিল সিফ্ফিনের বিশাল সবুজ মাঠ। হজরত আলির ২৫ হাজার আর হজরত মুয়াবিয়ার পক্ষের ৪৫ হাজার মানুষের গলাকাটা লাশ পড়ে রইলো সিফ্ফিন প্রান্তরে। সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দেখতে মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, কুফা, বাসরা, মিশরসহ রাজ্যের সকল প্রদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হলো। কোনো এক গোপন রহস্যে হজরত মুয়াবিয়া, ‘সন্ধিপত্র’ লেখার দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে হজরত আলির পক্ষকে অনুরোধ করলেন।

পর্ব-৫


তারা সন্ধিপত্র তৈরি করতে থাকুন, ইতিমধ্যে আসুন দেখা যাক, যুদ্ধের মাঠে ও যুদ্ধের নিকটবর্তী সময়ে কে, কোথায়, কী বলেছিলেন। হজরত আম্মার (রাঃ) তাঁর অধীনস্থ আলির একদল সৈন্যকে যুদ্ধে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন-

‘বন্ধুগণ, তোমরা কি শুনো নাই, নবীজি জীবিতকালে বহুবার বলেছেন, যে লোক আমার আলিকে দুঃখ দেবে, মনে করো সে আমাকেই দুঃখ দিল, যে লোক আমার আলির বিরুদ্ধাচরণ করবে, মনে করো সে আমারই বিরুদ্ধাচারণ করলো। তোমরা কি জানো না এই মুয়াবিয়া একজন বিধর্মী, ইসলামের শত্রু, সে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের প্রেমে ইসলাম গ্রহণ করে নাই? তার রাজপ্রাসাদে অমুসলিম নারীদের আনাগোনা, বিধর্মীদের সাথে তার মেলামেশা। আমরা জেহাদ করছি নবীজির শত্রুদের বিরুদ্ধে, বিধর্মী শাসকের হাত থেকে ইসলামকে বাঁচাতে।’
হজরত আম্মারের (রাঃ) কথা সম্পূর্ণই সত্য। মুয়াবিয়া এবং তাঁর পিতা আবু-সুফিয়ান স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নাই। ঘটনাটি ছিল এরকম : মক্কা বিজয়ের পরপরই নবি মুহাম্মদ (দঃ) কোরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানকে তাঁর একটি খাস কামরায় তলব করলেন। বুদ্ধিমান আবু সুফিয়ান ঘরে ঢুকেই ঘরের পরিবেশ দেখে অনুমান করতে পারলেন, কী জন্যে তাঁকে ডাকা হয়েছে? মুহাম্মদের (দঃ) ডানে বামে দুইজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাদের একজন। ইবনে আব্বাসের চাদরের নিচে তলোয়ার লুকানো। কোরায়েশ নেতার বুঝতে বাকি রইলো না, মুহাম্মদ (দঃ) তাকে কী প্রশ্ন করবেন। মাথা দেবে, না মুহাম্মদের অধীনতা মেনে নেবে? আবু সুফিয়ান অধীনতা মেনে নিলেন। ঘরে গিয়ে পুত্র মুয়াবিয়াকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরামর্শ দিলেন। মুয়াবিয়া বললেন- ‘এ কী বলছেন আপনি? এই সেদিন বদরের যুদ্ধে আপনার চোখের সামনে মুহাম্মদ আমার দুই ভাইকে খুন করেছেন। আপনি নিজের হাতে আপনার ছেলেগণকে দাফন করেছেন। পুত্রশোকে মা আমার পাগলবেশে মক্কার অলিতে-গলিতে গড়াগড়ি করেছেন। ইসলাম গ্রহণ করবো না, আমি এর প্রতিশোধ নেবো।’ আবু সুফিয়ান বললেন- ‘শত্রুকে শক্তিবলে পরাজিত করতে না পারলে, তার দলে যোগদান করা বুদ্ধিমানের কাজ, প্রতিশোধ নেয়ার সময় একদিন আসতেও পারে’।
হজরত ওবায়দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) মুয়াবিয়ার সৈন্যদলের এক সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ওবায়দুল্লাহ, দ্বিতীয় খলিফা সাহাবি হজরত ওমরের (রাঃ) সেই সন্ত্রাসী পুত্র, যিনি উসমানের শাসনামলে, তিনটি নিরপরাধ মানুষের খুনের আসামী, যাকে জনতার আদালতে হজরত আলি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, আর উসমান তাকে বেকসুর মুক্তি দিয়েছিলেন। আজ সিফফিনের ময়দানে সাহাবি হজরত ওমরের (রাঃ) পুত্র ওবায়দুল্লাহ ও সাহাবি হজরত আবুবকরের (রাঃ) পুত্র মুহাম্মদ একে অপরকে বধ করতে অস্ত্র হাতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। হজরত ওবায়দুল্লাহ ইবনে ওমর তাঁর সৈন্যদেরকে বলেন-

‘আমিরুল মোমেনিন হজরত মুয়াবিয়ার সমর্থক সিপাহী সাথীরা, আমার চক্ষের সামনে হজরত উসমানের খুনীকে (মুহাম্মদ ইবনে আবুবকরকে ইঙ্গিত করে) স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। যে সকল খুনীদের বিচার আলি করতে পারেননি, আজ এই মাঠে তাদেরকে হত্যা করে আমরা খলিফা উসমানের হত্যার প্রতিশোধ নেবো, আমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবো’।
ওবায়দুল্লাহর সেই সাধ পুরণ হয়নি। কিছুক্ষণ পরেই আলির সৈন্যের তীরের আঘাতে তার সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। উবায়দুল্লাহর মরদেহ কেউ না তুলেই পলায়নের পথ খুঁজছিল। ওবায়দুল্লাহ যা বলছিলেন, তা আংশিক সত্য। মুহাম্মদ ইবনে আবুবকর, উসমান হত্যায় জড়িত ছিলেন কিন্তু আলির ৯০ হাজার সৈন্যদলের সবাই উসমান হত্যার পক্ষে ছিলেন না। সত্য কথা হলো, মুয়াবিয়ার দলেও উসমান হত্যায় জড়িত অনেক লোক ছিলেন। মুয়াবিয়া অতি কৌশলে কিছু লোককে সোনা-দানা, টাকা-পয়সা ইত্যাদি দিয়ে, যাকে যেভাবে পারেন লোভ-প্রলোভন দেখিয়ে তার পক্ষে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুতরাং হজরত আলি (রাঃ) উসমান হত্যার বিচার করলেও সিফফিন যুদ্ধ এড়াতে পারতেন না।

মোহরম মাসে যুদ্ধ বিরতির সময়ে মুয়াবিয়ার এক যোদ্ধাকে হজরত হাশিম ইবনে উৎবা (রাঃ) বলেন-

‘তোমাদের হয়েছেটা কী? তোমরা কেন বুঝতে পারছ না, উসমানকে কেন আমরা হত্যা করেছি? উসমান নিজের পছন্দের লোক দিয়ে কো্রান লিখিয়েছেন। নবী পরিবার ও কোরানের অবমাননা করেছেন, আগুন দিয়ে কোরান পুড়িয়েছেন। যারা জালিম খলিফা উসমানকে হত্যা করে নবীর শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা তো নবীর বিশ্বস্ত লোক। তোমরা কি নবী পরিবারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে’?
হজরত আলি একে একে বেশ কয়েকজন সাহাবির নাম উল্লেখ করে তাদের চারিত্রিক পরিচয় দিলেন। তন্মধ্যে মুয়াবিয়া, হজরত আমর ইবনে আ’স, হজরত আবি মুয়্যাত, হজরত ওবায়দুল্লাহ ইবনে ওমর, হজরত আব্দুল্লাহ বিন সা’দ ইবনে-আবি সারাহ, ও হজরত হাবিব মাসলামাহ অন্যতম। আলি বললেন-

‘মুয়াবিয়া বিধর্মী, ওবায়দুল্লাহ সর্বজন নিন্দিত সন্ত্রাসী-খুনী, আমর ইবনে আস লুটেরা ডাকু স্বৈরাচারী, ইবনে আবি সারাহ নিজে কোরান লিখে এখনো কোরান আল্লাহর বাণী বলে বিশ্বাস করে না, আবি মুয়্যাত ও হাবিব মাসলামাহ্ দেশদ্রোহী, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক। তোমরা সবাই এদেরকে না চিনলেও আমি ছোটবেলা থেকে এদেরকে চিনি, জানি। তোমরা বিশ্বাস করো, এ জেহাদ মিথ্যের বিরুদ্ধে সত্যের জেহাদ, এ জেহাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জেহাদ।’
শেষ পর্যন্ত ৭০ হাজার মানুষের প্রাণনাশের পর যুদ্ধ থামলো। এবার সন্ধিপত্র লেখা হবে। মক্কা, মদিনা, কুফা, সিরিয়ার বড় বড় প্রবীণ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত। লেখক লিখলেন- ‘পরম করুণাময় আল্লাহর নামে, এই মর্মে আমিরুল মোমেনিন হজরত আলি (রাঃ) ইবনে আবি তালিব ও হজরত মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান…’ থামুন! বজ্রকণ্ঠে আমর বিন আস লেখককে থামিয়ে দেন। কী ব্যাপার? লেখক জিজ্ঞেস করেন। আমর বিন আস বলেন- ‘আমিরুল মোমেনিন হজরত আলি (রাঃ) লাইনটি কেটে ফেলা হউক। আলি তোমাদের আমিরুল মোমেনিন হতে পারেন, আমাদের নন’। সঙ্গে সঙ্গে হজরত আলির বুকটা ছ্যাত করে ওঠে! যেন একটা বিষ-মাখানো তীর তাঁর বুক ভেদ করে পৃষ্ঠদেশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আলি বুঝলেন, মুয়াবিয়া বহুদিনের পুরনো একটি ঘটনার হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটালো। সেদিন মুহাম্মদ (দঃ) ও কোরায়েশদের মধ্যকার ঐতিহাসিক ‘হুদাইবিয়া-সন্ধি’কালে একই ঘটনা ঘটেছিল। ঐ দিন কলম ছিল আলির হাতে। আলি লিখছিলেন, ‘পরম করুণাময় আল্লার নামে, এই মর্মে আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ্ ও …’ থামুন! কোরায়েশ প্রতিনিধি সুহায়েল ইবনে আমর ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর রসুল কথাটি বাদ দিয়ে শুধু মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ লেখা হউক, মুহাম্মদ তোমাদের রসুল হতে পারেন, আমাদের নয়’। হজরত আল আহনাফ (রাঃ) বললেন, ‘দোহাই আপনাদের, হজরত আলির নাম থেকে ‘আমিরুল মোমেনিন’ উপাধিটি মুছে ফেলবেন না, নবি বংশকে জগত থেকে চিরদিনের জন্যে মুছে ফেলার এ এক জঘন্য ষড়যন্ত্র’। নবিজির কথা মনে পড়ায় আলির চোখের জলের বাধ ভেঙে যায়। ফোটা দু-এক অশ্রু গাল বেয়ে তার দাড়ি ভিজিয়ে দিল। জীবনে নবিজি দুজন মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, একজন আলি, আর একজন হজরত ফাতেমা (রাঃ)। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে, ‘হুদাইবিয়া-সন্ধি’ কালে নবিজি যেভাবে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর রসুল কথাটি বাদ দিয়ে শুধু মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ লেখা হউক’ ঠিক সেভাবেই আলি বললেন- ‘ঠিক আছে ‘আমিরুল মোমেনিন’ কথাটি কেটে দিয়ে ‘আলি ইবনে আবু তালিব’ হোক।’ উভয়পক্ষের প্রতিনিধি প্রধানগণ পরামর্শ দিলেন, যতদিন পর্যন্ত কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত ব্যক্ত না করেছেন, ততদিন পর্যন্ত আলির লোকজন আলিকে ও মুয়াবিয়ার লোকজন মুয়াবিয়াকে তাদের খলিফা হিসেবে মেনে চলবে। কেউ কাউকে আক্রমণ করতে পারবে না। কমিটি সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার সময় নিলেন কমপক্ষে ছয় মাস। এবার নিজ নিজ লাশ গ্রহণের পালা। মানুষের রক্তে পিচ্ছিল মাঠ, হাটতে গিয়ে অনেকেই বারবার হোঁচট খেল। উভয়পক্ষের সত্তর হাজার মানুষ আর গৃহে ফিরে এলো না। স্বামীহারা বিধবাদের আর্তচিৎকার, পিতৃহারা শিশুদের ক্রন্দনরোল শুনা গেল আরব দেশের ঘরে ঘরে বহুদিন।

কয়েক মাস পর আজ তত্ত্বাবধায়ক কমিটি কোরান নিয়ে বসেছেন কোরানিক ফয়সালা দিতে। হায়রে জগতের অভাগা মুসলমান! মুয়াবিয়ার প্রতিনিধি প্রধান সিংহরূপী আমর ইবনে আস-এর সামনে, আলির প্রতিনিধি প্রধান আবু মুসা ‘মুষিক ছানা’র সমান। প্রবীণ নেতা আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) আবু মুসাকে ধূর্ত আমর ইবনে আস সম্পর্কে সতর্ক করে দিলেন। তিনি বললেন- ‘সাবধান আবু মুসা, এই ধূর্ত মানুষটা মিশরের গভর্নর থাকাকালীন সময়ে খলিফা উসমানও তাঁকে ভয় পেতেন। খলিফার নিযুক্ত মিশরের গভর্নর আব্দুল্লাহ বিন সা’দকে বাধ্য করেছিল তার সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে’। আমর ইবনে আস হজরত আবু মুসাকে এক গোপন বৈঠকে আহ্বান করলেন। মুয়াবিয়ার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমর, আবু-মুসাকে মাত্রাতিরিক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখালেন। শাহি ভোজন ও আপ্যায়ন পর্ব সমাপন করে আমার ইবনে আস আবু-মুসাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার কি মনে হয় আলি কোনোদিন উসমান হত্যার বিচার করবেন?’ আবু মুসা উত্তর দেন, ‘উসমান হত্যা পূর্ব সময় থেকে এ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে, আমি মনে করি এসব কিছুর জন্যে হজরত আলি ও মুয়াবিয়া সমভাবে দায়ী’। এ উত্তরটাই হজরত আমর ইবনে আস কামনা করেছিলেন। তারিখ ঘোষণা করে সমাবেশ ডাকা হলো বিচারকদের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হবে। সমাবেশে আমর ইবনে আস খুব নম্র ভাষায় বিনয় সহকারে অনুরোধ করলেন, আবু-মুসা যেন প্রথম বক্তব্য প্রদান করেন। আবু-মুসা ঘোষণা দেন :

‘আমারা তত্ত্বাবধায়ক কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আজ থেকে আলি ও মুয়াবিয়া উভয়ের খেলাফত অবৈধ ঘোষণা করা হলো। সাধারণ নির্বাচানের মাধ্যমে জনগণ নতুন খলিফা নির্বাচিত করবেন।’ তারপরই আমর ইবনে আস তার বক্তব্যে ঘোষণা দেন: ‘আবু মুসার সাথে আমিও একমত। রাজনীতিতে আলি সম্পূর্ণই নতুন। খলিফা হওয়ার যোগ্যতা তাঁর এখনও হয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে রাজ্যের আইন প্রশাসন বলতে কিছুই নেই। জাতি আজ এক অশুভ রাহুগ্রস্থ। এই সঙ্কটময় দিনে আমীরুল মোমেনীন হজরত মুয়াবিয়ার মতো একজন বিচক্ষণ, দক্ষ রাজনীতিবিদ আমাদের প্রয়োজন’।
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো আবু মুসার মাথায়। গালি দিয়ে উঠলেন অশ্লীল ভাষায়। শুরু হলো কোরানের ‘কালাম-যুদ্ধ’। দুনিয়ার যত অশ্লীল গালি আছে তারা ছুঁড়তে থাকলেন একে অপরের প্রতি। আলির প্রতিনিধি দল চিৎকার করে তেলাওত করলেন কোরানের ৭নং সুরা ‘আল আলাফে’র ১৭৫নং আয়াত : ‘আর তাদেরকে পাঠ করে শুনাও ওর বৃত্তান্ত, যাকে আমি আমার নির্দেশাবলী পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু সে ওসব থেকে দূরে সরে যায়, আর শয়তান তার পিছু নিল, কাজেই সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়’। আলির সমর্থকগণ মিছিল বের করে শ্লোগান দিতে থাকলেন ‘মুয়াবিয়া শয়তান! মুয়াবিয়া শয়তান!’ অপরপক্ষে মুয়াবিয়ার লোকজন নিয়ে এলো ৬২নং সুরা আল জুমুআ’র ৫ ও ৬ নং আয়াত দুটো : ‘যাদের তাওরাতের ভার দেয়া হয়েছিল তারপর তারা তা অনুসরণ করেনি, তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে গাধার মতো, সে শুধু গ্রন্থরাজির বোঝাই বইছে। কত নিকৃষ্ট সে জাতির দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর নির্দেশাবলী প্রত্যাখ্যান করে। আর আল্লাহ অন্যায়কারীকে সৎ পথে চালান না, এবং বলো, ওহে, যারা ইহুদি-মত পোষণ করো, যদি তোমরা মনে করো যে, লোকজনকে বাদ দিয়ে তোমরাই আল্লাহর বন্ধু-বান্ধব তাহলে তোমরা মৃত্যু কামনা করো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।


কোরান থেকে ‘কালাম-যুদ্ধ’ করতে করতে তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারলেন না। সম্মেলন ভঙ্গ হয়ে যায়। শান্তি প্রদানে ব্যর্থ কোরান বুকে নিয়ে তারা বাড়ি ফিরলেন। হজরত আলি কুফায় বসে সম্মেলনের এ সংবাদ শুনে খুবই আহত হলেন। আকাশ পানে দু-হাত তুলে লম্বা একটি দোয়া করলেন: ‘হে দয়াময়, মহা-শক্তিমান প্রভু, তোমার সর্বনিকৃষ্ট গজব অর্পিত করো তাদের ওপর, বিশেষ করে মুয়াবিয়া, আমর ইবনে আস, আবুল আওয়ার আল সুলাইমি, আবি সারাহ, হাবিব ইবনে মাসলামাহ, আব্দুর রহমান বিন খালিদ, জাহাক বিন কায়েস আর অলিদ বিন উকবার ওপর।’ আলির এই দোয়া আল্লাহর কাছে পৌঁছিল কি না জানা যায়নি, তবে মুয়াবিয়ার কানে যথা সময়েই পৌঁছিল। মুয়াবিয়া জুমার নামাজের জন্যে খুতবায় নতুন কিছু আয়াত সংযোজন করতে তার সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলেন। মুয়াবিয়া সেদিন থেকে আইন করে প্রতি শুক্রবার খুতবায়, নবি পরিবার অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হজরত হামজাহ, হজরত আলি, হজরত ফাতেমা, হজরত হাসান ও হোসেনকে অভিশাপ দেয়া বাধ্যতামূলক করে দেন। হুজুর ইবনে আদি নামে একজন মুসলমান মুয়াবিয়ার এ আদেশ অমান্য করায় মুয়াবিয়া তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ঘটনাটা হজরত মৌলানা আবুল আলা মওদুদি (রঃ)-তাঁর ‘খেলাফত ও মুলকিয়াত’ কেতাবের ৪র্থ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন (আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত করে তুলে ধরছি) :

“হুজর ইবনে আদি নবীজির প্রিয়ভাজন একজন ধর্মভীরু মুসলমান ছিলেন। হজরত মুয়াবিয়ার (রাঃ) শাসনামলে যখন মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে হজরত আলিকে ভর্থসনা ও অভিশাপ দেয়ার প্রচলন শুরু হয়, মৃত্যু ভয়ে অনেকেই প্রতিবাদ করার সাহস পেলো না। কুফা নগরীতে হজরত হুজর ইবনে আদি (রাঃ) মুয়াবিয়াকে প্রত্যাখান করতঃ আলির (রাঃ) প্রশংসা করতে লাগলেন। হজরত মুগিরা (রাঃ) কুফার গভর্নর থাকালীন সময়ে ইবনে আদির কোন অসুবিধা হয়নি কারণ তখনো কুফায় খুতবায় অভিশাপ দেয়ার প্রচলন শুরু হয়নি। কিন্তু বসোরার গভর্নর হজরত যিয়াদের (রাঃ) আমলে কুফাকে যখন বাসারার অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যিয়াদ (রাঃ) জুমআর খুতবায় হজরত আলিকে অভিশাপ দেয়া শুরু করে দেন। হুজর ইবনে আ’দি (রাঃ) এর প্রতিবাদ করলেন। একদিন ইবনে আদি (রাঃ) হজরত যিয়াদকে জুমার নামাজে দেরি করে না আসার জন্য সতর্ক করেন। হজরত যিয়াদ (রাঃ) ইবনে আদি ও তাঁর ১২জন সঙ্গী-সাথীর ওপর মিথ্যা দেশদ্রোহিতা ও খলিফা মুয়াবিয়াকে অভিশাপ দেয়ার অভিযোগ এনে তাদেরকে গ্রেফতার করে মুয়াবিয়ার নিকট সিরিয়া পাঠিয়ে দেন। মুয়াবিয়া অভিযুক্ত ৮জনকে মৃত্যুদণ্ড শাস্তি দেন। তাদের একজন সাথী হজরত আব্দুর রহমান ইবনে হাসানকে জীবিত মাটিতে পুঁতে হত্যা করা হয়।”
সম্মেলনের সংবাদ শুনে কুফার জনগণ কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে যায়। হজরত আলি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি স্থাপনের অজুহাতে ‘খোরাইজ’ গোত্র সরাসরি আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিলো। মধ্যপথে বিজয়ক্ষণে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়ায় আরেক দল অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলো। অনেকে প্রকাশ্যে বলাবলি করতে লাগলো মুয়াবিয়া একজন সুদক্ষ, শক্তিশালী শাসক। দিন যত যায়, মুয়াবিয়ার দল বড় ও শক্তিশালী হতে থাকলো আর আলির খেলাফতের প্রাচীর ভেঙে একটি একটি করে ইট খসে পড়তে থাকলো। কিন্তু আলি থেমে যাওয়ার পাত্র নন। মুহাম্মদের (দঃ) রক্ত তাঁর শিরা-উপশিরায়। হজরত আলি মরণপণ প্রতিজ্ঞা করলেন, এ অপমানের প্রতিশোধ নেবেন। বিদ্রোহী চরমপন্থী মৌলবাদী ‘খোরইজ’ বা খারিজি দল আলি ও মুয়াবিয়া উভয়কে প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব একটি দল গঠন করলো। তারা আল্লাহর হুকুমত, কোরআনের শাসন কায়েম করতে চায়। তাদের মতে আলি ও মুয়াবিয়া দুজনই কোরআন-বিরোধী শাসক। সিফ্ফিনের যুদ্ধ পর্যন্ত এরা আলির পক্ষেই ছিল। যেহেতু আলি, মুয়াবিয়ার মতো একজন বিধর্মীর সাথে শান্তি-চুক্তিতে দস্তখত করেছেন এবং রাজ্যে শরিয়ার আইন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সুতরাং তাদের দৃষ্টিতে হজরত আলিও একজন বিধর্মী। খারিজি দল ‘হারোরা’ নামক একটি গ্রামে সমেবেত হয়ে তাদের মতাদর্শ প্রচার করতে লাগলো। কিছুদিনের মধ্যেই তারা এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী দলে পরিণত হলো। তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণকারীদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে, মানুষের গলা কেটে, জীবন্ত মাটিতে পুঁতে, নির্বিচারে হত্যা করে সারা এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে দেয়। হজরত আলি দিন-রজনী কষ্ট করে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাবলিগ করে কিছু লোককে পুনরায় সিরিয়া আক্রমণের জন্যে রাজি করিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন, এখন তাঁর সামনে সিরিয়া আক্রমণের চেয়ে বিদ্রোহী খারিজি দলকে দমন করা আবশ্যক হয়ে গেছে। এদিকে খারিজিরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে, মুয়াবিয়া, আলি ও আমার ইবনে আস এই তিনজনকে হত্যা না করা পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবেন না। তাদের শ্লোগান হলো ‘লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর শাসন ছাড়া কোনো শাসন নাই। হজরত আলি তাদের কাছে লোক পাঠালেন, বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে, তিনি কোরআনের খেলাফ কোনো কাজ করেন নাই। ব্যক্তিগত পত্র লিখলেন- ‘রাজ্যে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে সকল আগে মুয়াবিয়াকে ধ্বংস করতে হবে। আর এ জন্যে তোমাদেরকে আমার সাথে যোগদান করে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যেহাদে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছি’। তারা পাল্টা উত্তর দিল, ‘আলি আপনি কোরআন অমান্যকারী, আপনিও কোরআন বুঝেন না’।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাবের নেতৃত্বে বিদ্রোহী খারিজি দল, তাদের ঘাঁটি স্থাপন করলো বাগদাদ থেকে ১২ মাইল দূরে ‘নাহরাওয়ান’ নামক স্থানে। বসোরাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কিছু লোক এসে তাদের সাথে যোগদান করলো। ১২ হাজার সদস্যের খারিজি জঙ্গি দল এখান থেকেই রাষ্ট্রের সর্বত্র খাটি ইসলামি আইন বাস্তাবয়ন করবে। তাদের মূল মন্ত্র হলো রাজ্যের সকল সমস্যার ফয়সালা করবে একমাত্র কোরআন। খারিজিদেরকে নিজ দলে আনতে সকল প্রকার চেষ্টা করে হযরত আলি (রাঃ) ব্যর্থ হয়ে ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিরিয়া আক্রমণের যাত্রা পথে ‘নোখাইল’-এর উপত্যকায় এসে তাবু ফেল্লেন। আলির কাছে সংবাদ এল, সন্ত্রাসী খারিজিরা ‘নাহরাওয়ান’-এর গভর্নর হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে খাববাব (রাঃ) কে মুরগিকাটা কেটে খুন করেছে, সাথে গভর্ণরের অন্তসত্তা ক্রীতদাসী ও বনু-তায়ি গোত্রের তিনজন নিরপরাধ মহিলাকেও অত্যন্ত নির্মমভাবে তারা হত্যা করেছে। বিষয়টা তদন্ত করতে আলি, হজরত হারিস ইবনে মুররাহকে ‘নাহরাওয়ান’ প্রেরণ করলেন। খারিজিরা ইবনে মুহরাহকেও হত্যা করে ফেলে। আলির সন্দেহ হলো এই মুহূর্তে সিরিয়া আক্রমণ করতে গেলে খারিজিরা কুফা দখল করে নিতে পারে। হজরত আলি খারিজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। ৩৮ হিজরীর সফর মাসের ৯ তারিখ খারিজিদের সাথে আলির যুদ্ধ হয়, যা ইতিহাসে ‘যুদ্ধে নাহরাওয়ান’ বা ‘খাল-যুদ্ধ’ নামে অভিহিত। আলির শক্তিশালী সৈন্যগণ অতি অল্পসময়ের মধ্যেই খারিজিদের ১২ হাজার সদস্যকে তাদের তলোয়ারের নিচে কতল করতে সক্ষম হলেন। মাত্র ৯জন খারিজি পলায়ন করে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। দুই বছর পর ৪০ হিজরিতে এই ৯জনের তিন জন মিলে হজরত আলিকে মসজিদ প্রাঙ্গণে খুন করে। খারিজিদেরকে হত্যা করে আলি ভেবেছিলেন একটা আপদ গেলো, এবার সিরিয়া আক্রমণ করতে আর কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু বিধি বাম, আলির সৈন্যগণ আর কোনোমতেই যুদ্ধ করতে রাজি হলো না। হজরত আলির বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ভগ্ন হৃদয়ে কুফায় ফিরে গিয়ে আলি নিজের লোকজনকে ভীরু-কাপুরুষ বলে ধিক্কার দিয়ে শান্ত হয়ে যান। এদিকে আলির এই নীরবতা হজরত মুয়াবিয়ার মোটেই ভাল লাগলো না। মুয়াবিয়ার দৃঢ় সংকল্প, ‘আমি সেই দিন হবো শান্ত, যেদিন জগতের মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার মতো হাশেমি বংশের কেউ থাকবে না।’

মুয়াবিয়া জানেন এখন আলি ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সিংহ ও ছাগলের ব্যবধান। মুয়াবিয়ার বাবা আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, ‘শত্রুর প্রতি প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ একদিন আসতেও পারে’। পূর্ণ প্রতিশোধ নেয়ার এখনো কিছুটা বাকি। সুতরাং দুর্বল ছাগলের শক্তিও আলির আছে কিনা পরীক্ষা করতে মুয়াবিয়া দিকে দিকে ছোট্ট ছোট্ট সেনাদল পাঠালেন। আজ থেকে কয়েক যুগ পূর্বে ঠিক যেভাবে নবি মুহাম্মদ রাতের অন্ধকারে একটি একটি করে আরব অমুসলিম গোত্রের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা করে তাদের সহায়-সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর দখল করেছিলেন, মুয়াবিয়ার সৈন্যগণ সেভাবেই একের পর এক আলির প্রদেশসমূহ দখল করতে লাগলো। ইসলামের জন্মভূমি ও নববি মুহাম্মদের রাজধানী মদিনা আক্রমণ করার জন্যে সাহাবি হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) হজরত বাশারকে সেনাপ্রধান করে একটি শক্তিশালী দল মদিনা পাঠালেন। হজরত বাশারের সৈন্যবাহিনী দানবের মতো আক্রমণ করে বসে মদিনার মানুষের ওপর। তারা ক্ষণিকের মধ্যেই সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে তছনছ করে দেয়। ভীত-সন্ত্রস্ত মদিনাবাসী বিনা যুদ্ধেই মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করলো। বিজয়ী বাশার মদিনাবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন- ‘মদিনার লোক, যদি আজ খলিফা মুয়াবিয়ার নির্দেশ নিয়ে না আসতাম, আল্লাহর কসম মদিনার একটা পুরুষও আমি জীবিত রাখতাম না’। সেনাপতি বাশার, নবী মুহাম্মদকর্তৃক বনি মুত্তালিক গোত্রের ওপর আক্রমণের তুলনায় মদিনাবাসীর ওপর অশেষ করুণাই করলেন। সেদিন নবী মুহাম্মদ বনি মুত্তালিক গোত্রের একটা পুরুষকেও জীবিত রাখেন নাই, উপরন্তু তাদের সকল নারীদেরকে বন্দী করে তাঁর সেনাবাহিনীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মদিনা জয় করে বাশার, তার দল নিয়ে ইয়েমেন দখল করতে রওয়ানা হলেন। মদিনা পতনের সংবাদ পেয়ে হজরত আলি কাগুজে বাঘের মত কিছুক্ষণ গর্জন করলেন। কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত করলো না। মদিনার মত একই পদ্ধতিতে আক্রমণ করে সেনাপতি বাশার ইয়েমন দখল করে নেন। তবে সেখানকার গভর্ণর হজরত ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বাধা প্রদান করায় তাঁকেও তাঁর ছোট ছেলেকে বাশার হত্যা করেন।

ছোট ছোট রাজ্যগুলো দখল করে হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এবার দৃষ্টি ফেললেন মিশরের ওপর। সেনাপতিকে নির্দেশ দিলেন, ‘তোমরা মিশরের গভর্নর আবুবকরের পুত্র মুহাম্মদকে হত্যা করতে পারবে না। তাকে বন্দী করে আমার কাছে নিয়ে আসবে, আমি নিজ হাতে তার বিচার করবো’। উল্লেখ্য, আবুবকর মদিনার খলিফা হওয়ার পর, হজরত আবু সুফিয়ান তাঁর পুত্র মুয়াবিয়াকে বলেছিলেন, ‘এই আবুবকর তোমার দুই ভাইয়ের হত্যাকারী, আমার বিশ্বাস তুমি একদিন এর প্রতিশোধ নেবে’। মুয়াবিয়ার সন্দেহ ছিল আলি কুফা থেকে সৈন্য পাঠিযে মিশর রক্ষা করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আলির পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। সুতরাং মিশর দখল করতে মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনীর তেমন বেগ পেতে হলো না। আবুবকরের পুত্র মুহাম্মদকে বন্দী করে মুয়াবিয়ার কাছে নিয়ে আসা হলো। মুয়াবিয়া ঠাণ্ডা মাথায় মুহাম্মদকে বলেন, ‘তোমাকে এমন মৃত্যু উপহার দেবো যা খলিফা উসমান হত্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর, তরবারি ও বর্শার আঘাতে মৃত্যুর চেয়েও কষ্টদায়ক’। হজরত মুয়াবিয়া আবুবকরের পুত্র মুহাম্মদকে শুকনো খড়কুটা দিয়ে মুড়িয়ে বস্তাবন্দী করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। মুয়াবিয়ার মনে আছে, বদরের যুদ্ধে তার পিতা আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে এই আবুবকর, তার পুত্র মুহাম্মদ ও তার কন্যা আয়েশা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ কারণেই মুয়াবিয়া সেদিন ‘জামাল যুদ্ধে’ আলির বিরুদ্ধে আয়েশাকে সাহায্য করেননি।

হিজরি ৪০ সনের রমজান মাস। খারিজি দলের তিনজন লোক হজরত আলিকে হত্যার উদ্দেশ্যে মসজিদের পাশে অবস্থান নেয়। আলি মসজিদ থেকে বেরিয়ে, দ্বারপ্রান্থে আসামাত্র শাবির ও আব্দুর রহমান ইবনে মুলজাম, হজরত আলির মাথায় তলোয়ার দিয়ে সজোরে আঘাত করে। কিছুদিন পরেই ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে হজরত আলি কুফায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পিতৃশোকে কাতর আলির পুত্র হজরত হাসান (রাঃ) বাবার শোকসভায় বলেন- ‘আজ এমন একটি পবিত্র মাসে নবিজির শ্রেষ্ট মানুষটিকে ঘাতকরা হত্যা করলো, যে মাসে কোরআন শরিফ নাজিল হয়েছিল। যে মাসে হজরত ঈসাকে (আঃ) আল্লাহ আকাশে তুলে নেন, যে মাসে হজরত মুসা (আঃ) তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে কথা বলেন। কোরআনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাসীরা কোরআন লেখককেই খুন করে ফেললো।’ উল্লেখ্য, হজরত আলী নবি মুহাম্মদের পাশে পাশে থেকে কোরআনের বাণী লিখতেন। হজরত উসমান যখন কোরআন সংকলন করেন, হজরত আলিকে সংকলন কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়। ৩৩ সন্তানের জনক, হজরত আলি জীবনে তাঁর প্রথম স্ত্রী ফাতেমার মৃত্যুর পর আরো ৮ জন রমণীর পাণি গ্রহণ করেছিলেন।