একটি অবাস্তব গল্প
লিখেছেন
সবাক
১.আমার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিছে শুয়োরের বাচ্চায়। এক ঘন্টা ধরে বসে আছি তালুকদারের বাড়ির সামনে।
২.
তালুকদারের বড় পোলা। জমির আইল ঠেলছে দেড় হাত। কইলাম, কিগো বাজান এ কেমন কারবার, এক ঠেলায় দেড় হাত! এটা অবিচার, কঠিন অবিচার।
পোলায় আমারে কয় চুপ থাকতে। চুপ না থাকলে নাকি ঠ্যাং ভেঙ্গে দিবে!
মিজাজটা খারাপ হয় না কন? আমিও কইলাম সাহস থাকলে ভেঙ্গে দেখাইতে। তারপর সত্য সত্য ঠ্যাংটা ভেঙ্গে দিলো! ডান ঠ্যাং, হাঁটুর নিচ বরাবর। তব্ধা খাইলাম। এইভাবে কেউ দুই কথায় কারো ঠ্যাং ভেঙ্গে দিতে পারে!
৩.
ভাঙ্গা ঠ্যাং টানতে টানতে গেলাম তালুকদারের কাছে। চিল্লানি শুনে ঘরের বাইরে আইলেন। কইলাম, তালুকদার সাব আপনার বড় পোলা আমার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিছে। বিশ্বাস করেন, আমার কোন দোষ নাই। আমি তারে একটা গাইলও দিই নাই। খালি কইছি জমির আইল ঠেলা ঠিক না। এটা অবিচার।
এটা শুনে তালুকদার ঘরের ভিতরে গেলেন। আমি ভাবলাম বন্দুক নিয়ে বার হবেন বোধ হয়। তারপর পোলার কাছে গিয়ে বন্দুক তাক করে কইবেন আমার ঠ্যাং ভালো করে দিতে, নইলে গুলি করে মারবেন। কিন্তু তালুকদার সাব আইলেন দুইটা একশ টাকার নোট নিয়া। হাতে ধরায়া বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে কইলেন, যা হওয়ার হয়া গেছে। টাকাটা নে, কিছু প্রুট কিনে খা, নাদান পোলাটারে বদদোয়া দিস না।
পুরা বেক্কল হই গেলাম। এ কেমন বিচার! দেশ থেকে কি বিচার আচার উঠি গেলো নাকি! যাইহোক, একশ টাকার নোট দুইটা ফেরত দিই নাই। গেরামের সবাইরে দেখামু। কমু, পোলা আমার ঠ্যাং ভাঙছে, বাপে দুইশ টাকা হাতে ধরায়া দিছে।
৪.
ভাঙ্গা ঠ্যাং টানতে টানতে তালুকদারের বাড়ি থেকে বার হইলাম। বার হয়েই রাস্তায় মসজিদের ইমাম সাবের দেখা পাইলাম। কইলাম, তালুকদারের বাদাইম্যাটা আছে না? ওইটা আমার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিছে। এটা শুনে ইমাম সাব তার মাথা উঁচা কইরা আকাশের দিকে তাকাইলেন। তারপর মাথাটা নামায়া আমারে কইলেন, আল্লা যা করেন ভালোর জন্য করেন, দোয়া করি যেন এই ভাঙ্গা ঠ্যাং নিয়েই তার খেদমত করতে পারো।
মিজাজটা খারাপ হয় না কন? আল্লা নাকি ভালোর জন্য আমার ঠ্যাং ভাঙছেন! কার ভালোর জন্য? আমার? নাকি ইমাম সাবের? নাকি তালুকদারের?
৫.
ভাঙ্গা ঠ্যাং টানতে টানতে এবার গেলাম মাতবরের কাছে। কইলাম, তালুকদারের পাঠায় আমার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিছে, আর পাঠার বাপে হাতে দুইশ টাকা ধরায়া দিছে। কথাটা শুনে মাতবরের চেহারায় কোন সমবেদনা নাই, চু চু করা আপসোস নাই। মাতবর কয় শনিবারে হাটে যাইতে। দুইশ টাকা দিয়ে একটা ঠ্যাং কিনে নিতে। তারপর আরো কইলো তালুকদার দিল দরিয়া মানুষ। দেড়শ টাকাতেই নাকি ভালো ঠ্যাং পাওন যায়।
মিজাজটা খারাপ হয় না কন? হাটে নাকি ঠ্যাং পাওন যায়! তামাশা করে আমার লগে, আমি তামাশার পাত্র।
৬.
এবার হইলো আলগা বিপদ। গেরামের দুষ্টু পোলাপান পিছু নিছে। ভারি বেয়াদব এসব পোলাপান। আমার ভাঙা ঠ্যাং নিয়ে মশকরা করে। কয় –
বড় পোলার ছোট চ্যাং, রহমতের ভাঙ্গা ঠ্যাং
ঠ্যাং করে ট্যাং ট্যাং, ব্যাং ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাং।
আচ্ছা বুঝলাম এরা অবুঝ। এখনো শেখেনি কারো ভাঙ্গা ঠ্যাং নিয়ে মশকরা করতে নাই। কিন্তু মেম্বার সাব? তিনিতো অবুঝ না। দুই দুইটা বৌয়ের স্বামী, পঞ্চাশের মত বয়স। মেম্বার সাবের কাছে গিয়ে কইলাম, তালুকদারের ধামড়াটা আছে না? ওই হারামির বাচ্চা আমার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিছে। বিচার নিয়ে গেলাম ধামড়ার বাপের কাছে। ধামড়ার বাপ আমার হাতে দুইশ টাকা ধরায়া দিয়ে কইলো প্রুট কিনে খাইতে। আপনি এর একটা বিচার করেন।
মেম্বার সাব কয় একদিন না একদিন এসব অনাচারের বিচার হবে। ঘুচে যাবে জরা, মুছে যাব ব্যাধি। এই পৃথিবীতেই হবে অত্যাচারির সমাধি।
মিজাজটা খারাপ হয় না কন? হালারপুতরে ভোট দিয়ে মেম্বার বানাইছি কবিতা শোনার লাগি!
৭.
আবার টানো। ভাঙ্গা ঠ্যাং টানো। টানতে টানতে গেলাম চেয়ারম্যানের কাছে। নতুন প্রজন্মের চেয়ারম্যান। হেবি ইস্মার্ট। কম বয়সী শিক্ষিত চ্যাংরা পোলা। ভাবলাম নতুন কিছু শুনাইবো। বিচার পাবো। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কচি মুখে সেই পুরানা কথা। দম নিয়ে ধীরস্থির হয়ে খুব ভদ্রভাবে চেয়ারম্যানরে প্রথমে কইলাম বেয়াদবি মাপ করতে। তারপর কইলাম, হারামি তালুকদারের জাওরা পোলাটা আমার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিছে। বিচার চাইতে গেলাম আর জাওরার বাপে একশ টাকার দুইটা নোট হাতে ধরায়া দিছে। এর একটা বিহিত করেন। একটা সুবিচার করে দেন।
চেয়ারম্যান কয় তালুকদার সম্মানি মানুষ। দানবীর। তার বিচার করন যাইবো না। গেরামের রাস্তার কামের জন্য তালুকদার নাকি চল্লিশ হাজার টাকা ডোনেশন দিছে। উন্নয়ন খুব জরুরী বিষয়। কিছু পাইতে হইলে কিছু দিতে হয়। গেরামের উন্নয়নের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ত্যাগ স্বীকার না করলে উন্নয়ন হইবো না।
চেয়ারম্যান আরো কয় আমার ঠ্যাং নাকি গেরামের রাস্তার কামের জন্য ডোনেশন হিসেবে ধরে নিছেন। উন্নয়নের জন্য আমি নাকি ঠ্যাং বিসর্জন দিছি। এটা উনি উনার ডায়েরিতে লিখে রাখবেন। আমার এই দানের কথা স্মরণ রাখবেন।
মিজাজটা আর কত খারাপ হইতে পারে? এসব নতুন প্রজন্মের কুত্তার বাচ্চাগোরে কী করতে মন চায় কন? এসব দেখলে কী যে কষ্ট লাগে বুঝাইতে পারুম না। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে চেয়ারম্যানের পাছায় সারাদিন পিডাইলেও পরাণ ঠান্ডা হইবো না। পরাণটা এমন পোড়া পুড়তেছে।
আমি যা বুঝার বুঝছি, এখন যা করার তা করবো।
৮.
ঠ্যাঙের ব্যাথা ম্যালা বাড়ছে। তাতে কী হইছে! ব্যাথায় গোঙাইতে গোঙাইতে গেছি কামারের দোকানে। দুইশ টাকা দিয়া দুই ইঞ্চি মোটা আড়াই হাত লম্বা একটা রড কিনছি। রডের মাথাটা বাঁকা করে ঘুরায়া নিছি। এবার তালুকদার হারামিরে বুঝাবো রহমতের মিজাজ গরম হলে সে কী করতে পারে।
৯.
এক ঘন্টা ধরে বসে আছি তালুকদারের বাড়ির সামনে। তালুকদার নাকি বাজারে গেছে। আসুক, বাজার থেকে আসুক। বাড়িতে ঢোকার সময় রড দিয়ে পথ আটকায়া বলবো, শুয়োরের বাচ্চা, তোর পোলা আমার এক ঠ্যাং ভাঙছে। এখন তুই যদি তোর পোলার দুই ঠ্যাং না ভাঙ্গস, তাহলে আমি তোর ঠ্যাং দুইটাতো ভাঙবো ভাঙবো, হাতও কুঁচা কুঁচা কইরা দিবো।
১০.
রহমত আজ ক্ষেপছে।
একটি যাত্রী ছাউনি এবং তিনজন বিচ্ছিন্ন মানুষ
লিখেছেন সবাক
হাশেমের
আনন্দদন্ডতিনদিন ধরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। সব ভেসে গেছে। প্রতিদিন প্রায় এক হাত করে পানি বাড়ছে। খাল, পুকুর ভরাট হয়ে পানি ঢুকে পড়েছে রাস্তায়, বাগানে, উঠানে। ঘর দুয়ারে পানি, মনে হচ্ছে কেউ দরজা খুলে দিলেই ঘরে ঢুকে পড়বে।
বিগত কয়েক বছরে গ্রামের মানুষ এমন বৃষ্টি দেখেনি। একটু বয়স্করা স্মৃতি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করছে শেষ কবে এত বৃষ্টি হয়েছে। আর কম বয়সীরা ভাবছে, এইভাবেও বৃষ্টি হতে পারে! তিনদিন একটানা!
বৃষ্টির নিজস্ব শব্দ আছে, আর সেই শব্দের নিজস্ব সমস্যাও আছে। টানা কিছুক্ষণ বৃষ্টির শব্দ শোনার পর মনে হয় আমাদের আর কোন শব্দ নেই, সুর নেই, গান নেই। বৃষ্টি ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই, কেউ নেই।
এখন মধ্যরাত। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশ নেই। থাকলেও দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পরপর একটা দুইটা বিজলি জ্বলে। বরাবরের মত অদেখা আকাশ তার দুই হাত ভরে পানি ঢালছে। টিনের চালে ঘুমুর ঘুমুর শব্দ। সবাই যার যার মত করে তার তার ঘরে, শুধু হাশেম ছাড়া। হাশেম আছে পরের ঘরে। মারজাহানের ঘর। হারিকেনের মৃদু আলো। মারজাহান উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। হাশেম অন্ডকোষ মুঠে চেপে ধরে বসে আছে। মুঠো বেয়ে টুপ টুপ রক্ত ঝরছে। মারজাহান হাশেমের আনন্দদন্ড কেটে দিয়েছে।
ঠিক এই মুহূর্তে হাশেমকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, মারজাহান কে? হাশেম বলবে মারজাহান একটি ডাইনি। কিন্তু আসলে তা নয়। মারজাহান হচ্ছে এই গ্রামেরই মন্নাসের বৌ। মন্নাস থাকে সৌদি আরব। আজ ঘরে মারজাহান একা থাকলেও সবসময় কিন্তু একা থাকে না। সাথে শাশুড়ি আর দেবর থাকে। টানা বৃষ্টি শুরুর দিন সকালে মারজাহানের শাশুড়ি আর দেবর গিয়েছে মারজাহানের ননদের বাড়ি। বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে।
হাশেম সবসময় মারজাহানকে ইশারা ইঙ্গিতে উত্যক্ত করতো। এসব ইশারা ইঙ্গিতের আড়ালে প্রেম আছে কিনা মারজাহান জানে না। থাকলেও সেই প্রেম নোংরা, ইতরের প্রেম। মারজাহানের ফুলের বাগান আছে, সেই বাগানে প্রজাপতি আসে, ভ্রমর আসে। মারজাহান ফুল দেখে। প্রজাপতি আর ভ্রমর দেখে। আড়চোখে হাশেমের ইশারা দেখে। আবার ফুল দেখে। প্রজাপতি আর ভ্রমর দেখে।
গত দুইদিন হাশেমের মতিগতি খুব খারাপ ছিলো। এত বৃষ্টি, এত পানি উপেক্ষা করে হাশেম এসে মারজাহানের ঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করে, ইশারা দেয়, ইঙ্গিত করে। হাশেম রাত্রি বেলা ভেসে যাওয়া আগানে বাগানে আন্ধা বড়শি পেতে রাখে, কারেন্ট জাল বসিয়ে রাখে মাছের জন্য। মাছ যেদিকেই থাকুক না কেন, হাশেমের বড়শি আর জাল থাকে মারজাহানের ঘরের আশপাশে। হাশেমের জিহ্বা বেয়ে ঝরে পড়া লালসার লালা বৃষ্টির জলে মিশে যায়। তবুও মারজাহান সেটা দেখে। মারজাহান মেয়েতো, জানে ইতরের লালা কখন কিভাবে ঝরে।
আজ বিকালে হাশেমের ইশারা চিরতরে বন্ধ করতে মারজাহান হাশেমকে পাল্টা ইশারা করে। ইঙ্গিত করে। মারজাহানের মাত্র একটি ইশারায় হাশেমের আনন্দদন্ডের কোরবানি হয়ে গেলো। মাত্র একটি ইশারায় হাশেমের জিহ্বা, গলা, খাদ্য নালী প্রস্রাবের নালী, সব শুকিয়ে গেছে। এই গ্রামের সবকিছু এখন ভেজা, শুধু হাশেমের ভেতরটা ছাড়া। এক ফোটা লালা নেই, ভয়-আতংক-ব্যাথা ছাড়া আর কিছু নেই।
পরিষ্কার সুতি কাপড়, স্যাভলন, ছোট বাটি আর পানির জগ নিয়ে আসে মারজাহান। মারজাহান বলে, রক্ত বন্ধ করেন, নইলেতো মরে যাবেন। আপনার জানের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। শত্রুতা যেটার সাথে, সেটা কেটে ফেলেছি। কোনমতে ব্যথাটা সহ্য করেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
হাতে বড় সাইজের একটা দাও ধরে মারজাহান হাশেমকে জানায়, ইশারা দিয়েন জায়গামত, যেখানে যা মানায়।
এক টুকরো বড় পলিথিন আর কিছু টাকা দিয়ে মারজাহান হাশেমকে বলে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। নইলে ঘরে গিয়ে বৌয়ের হাতে ধরা খাবে। মান সম্মান সব যাবে। শুধু কি নিজের বৌ? ঘরে পুত্রের বৌও আছে। মানে পুরা চুনকালি মাখামাখি হয়ে যাবে।
আসলে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া ছাড়া হাশেমের আর কোন উপায় নেই। তাই আনন্দদন্ড হারিয়ে হতবিহ্বল হাশেম আগে পিছে কিছু চিন্তা না করে বেহায়ার মত মারজাহানের কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। সবকিছু কেমন গোলমাল পাকানো। মনে মনে অনেক কিছুই ভাবছে, সব এলোমেলো। ক্ষণে ক্ষণে ভাবছে সে বোধহয় স্বপ্ন দেখছে, আসলে কেউ তার ওটা কেটে দেয়নি।
হাশেম চলে যাওয়ার পর ঘরের মেঝে থেকে দন্ডটুকরো তুলে নেয় মারজাহান। পলিথিন কেটে বানানো জামাটা পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পানি ডিঙিয়ে খালপাড়ে যায়। মাংসপিন্ডটি খালের জলে ছুঁড়ে মারে। এত জোরালো স্রোতে ঢুবে যাওয়ার উপায় নেই। কে জানে আবুল হাশেমের আনন্দদন্ড ভাসতে ভাসতে কোথায় যায়, কার পেটে যায়। মাছে খাবে নাকি সাপে খাবে, নাকি পঁচে গলে পানিতে মিশে যাবে।
আহারে হাশেম! পুরো শরীর নিয়ে গ্রাম ছাড়লো, শুধু ইয়েটা জলে গেলো।
এক্টিভিস্ট হিম সাগর
সকাল বেলা বাবা কানের নিচে চটকোনা মেরে বলেছে, আর পদ্য লিখিসনা। এখন গদ্যের বাজার ভালো, দু’চার লাইন গদ্য লিখ।
মা বলেছে, একটু বাজারে যা, কিছু সবজি কিনে আন।
ছোট বোন বলেছে, ভাইয়া একটু এদিকে আয়, আমার অংকটা দেখে দে।
কিন্তু কবি হিম সাগর গদ্য লিখবে না, সবজি কিনতে বাজারে যাবে না, বোনের অংক দেখে দিবে না। হিম সাগর গাঁজা খাবে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর গাঁজা খেতে হয়। তারপর টয়লেটটা ঠিকমত হয়। টয়লেট সেরে ভাবে আজ নয়, কাল থেকে গদ্য লিখবো। আজ নয়, কাল থেকে বাজারে যাবো। আজ নয়, কাল থেকে সোনিয়ার অংক দেখে দিবো। গত কয়েক মাস ধরে হিম সাগর এরকম করে যাচ্ছে। আজ নয় কাল।
আসলে তার নাম আবদুর রহিম সাগর। আবদুর পুরোটা ফেলে দিয়েছে, রহিম এর র। তারপর নাম হয়েছে হিম সাগর। একবার ভেবেছিলো নাম রাখবে মাইকেল সাগর। অনেকেইতো রাখে। যেমন আলফ্রেড খোকন, হেনরি স্বপন ইত্যাদি। পরে ভাবলো এটা ঠিক না। শুনতে ভালো শোনায় না। বেখাপ্পা লাগে। তারচে এত বড় নামটা একটু কাটছাঁট করে রাখতে পারলে ভালো। হিম সাগর। পুরোপুরি বাংলা নাম। মানানসই।
কিন্তু আজ ভিন্ন পরিস্থিতি। গাঁজা বানাতে গিয়েও বানায়নি। ছোট বোনের অংক দেখে দিয়ে বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে পড়েছে। গদ্য নিয়ে ভাবছে। খুব ভাবছে। কিন্তু গদ্য আসে না। পদ্যের ঢং চলে আসে। তবু হাল ছাড়ছে না হিম সাগর। ভেবেই যাচ্ছে।
হিম সাগর ফেসবুকে কবিতা লিখে। পাঠক তেমন একটা নেই। প্রতি কবিতায় গড়ে দুই আড়াইশ করে লাইক পায়। কমেন্ট পায় খুব কম। যা দু’একটি পায়, তাতে ঘুরে ফিরে একটাই প্রশ্ন থাকে – ভাই কবিতাটার অর্থ কী?
এসব কমেন্ট দেখে হিম সাগরের রাগ হয়, মেজাজ গরম হয়। দুনিয়ায় মানুষ অনর্থক কত কিছু করে। কিন্তু কবিতার একটা অর্থ থাকতেই হবে। অর্থ ছাড়া কবিতা লেখা যেন অপরাধ। তাছাড়া অবশ্যই কবিতা অনর্থক নয়, কিন্তু পাঠক না বুঝলে কবির কী করার আছে।
সবজি কিনে ফেরার পথে হিম সাগর গদ্য নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। জীবনটা আজ নতুন করে শুরু হবে। হার মানলে চলবে না। জিততে তাকে হবেই। অনেক ভেবে এক লাইন গদ্য পেয়েছে। – মানুষ বোধহয় সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সবজি কিনতে বাজারে যাওয়ার জন্যই বেঁচে থাকে।
কিন্তু ঠিক মন ভরছে না। বাক্যটিতে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেলেও দর্শনের ঘাটতি আছে। এটি একটি সামাজিক বাক্য বটে, কিন্তু বাক্যে জীবনবোধের গভীরতায় কমতি আছে। নতুন করে আবার ভাবতে হবে।
ভাবতে ভাবতে এবার যা পেয়েছে, হিম সাগরের কাছে তা অসাধারণ মনে হয়েছে। – ঘুম থেকে উঠে সবজি কিনতে বাজারে যাওয়ার জন্য সারা জীবন বেঁচে থাকো। কিন্তু গাঁজা খাওয়ার জন্য অন্তত একটি দিন হলেও বাঁচো।
পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে ফেসবুকে পোস্ট করে দিলো।
বাসায় এসে ফোন বের করে দেখে লাইক পড়েছে বিশটি। কমেন্ট ছয়টি। এর মধ্যে চারটিই গালিগালাজ। একটি কমেন্ট মনে দাগ কেটেছে। -শালার কবিদের এই একটাই সমস্যা, দেশ জাহান্নামে যাক, উনাদের কাব্যচর্চা বন্ধ হয় না।
গদ্যকার হিম সাগর ভাবলো দেশের কী হয়েছে দেখা দরকার। নিউজ ফিডে কিছুক্ষণ ঘুরলো। ফ্রেন্ডলিস্টে বেশিরভাগ কবি, তাই নিউজফিড জুড়ে প্রায় সব পোস্টেই কবিতা। এর মাঝে বন্ধুদের শেয়ার করা পোস্ট থেকে দেশের কিছু খবর পাওয়া গেলো। জয়পুরহাটে মা’কে বেঁধে মেয়েকে ধর্ষণ। ফেনীতে কিশোরীকে ধর্ষণ শেষে খুন করেছে পাষন্ডরা। কিশোরগঞ্জে পুরোহিতকে জবাই করে হত্যা। দিনাজপুরে বিএসএফ এর গুলিতে এক বাংলাদেশি নিহত।
দেশ জাহান্নামে যাচ্ছে ঠিক আছে, কিন্তু জাহান্নামে যাওয়ার আগে একইসাথে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন, জবাই, তারপর আবার ভিনদেশি সেনার গুলি খেয়ে গেলেতো সমস্যা। এতকিছুর পর দেশের আর কীইবা থাকে, কী নিয়ে জাহান্নামে যাচ্ছে, খালি হাতে?
হিম সাগর ভাবলো পদ্য গদ্য বাদ। এক্টিভিজম করতে হবে। সমাজটাকে বদলাতে হবে। দেশের জন্য কিছু করতে হবে। আর কত চুপ করে থাকা যায়, এই দুর্বৃত্তায়নের খাঁচা ভাঙতেই হবে। মুখ খুলতে হবে। কিছু বলতে হবে, কিছু একটা করতে হবে।
এক্টিভিস্ট হিম সাগর কোনভাবেই দেশকে জাহান্নামে যেতে দিবে না। আজ থেকে ফেসবুকে সামাজিক অন্যায় অবিচার নিয়ে প্রতিবাদ করবে। সোচ্চার হবে। কিন্তু একসাথে এতকিছু নিয়েতো লেখা যাবে না। অনেকেই আছে প্রতিদিন ফেসবুকে দশ বারোটা করে পোস্ট দেয়। বন্ধুদের প্রতি এটা একটা অবিচার। একজন মানুষ তার নিউজফিডের কয়টা পোস্ট পড়তে পারে। বেশি বেশি পোস্ট দেয়া মানেই বন্ধুদের উপর নির্যাতন করা। হিম সাগর এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
এখন ফেসবুক এক্টিভিজমের জন্য বিষয় নির্বাচন করতে হবে। একটা সেইরকম পোস্ট দিয়ে এক্টিভিজম শুরু করতে হবে। জয়পুরহাটের বিষয়টা খুবই জঘন্য হয়েছে। মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ। কত বড় জানোয়ার হলে এটা করতে পারে! কিন্তু ফেনীরটা আরো ভয়ংকর। কারণ শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, মেরেও ফেলেছে। ধর্ষণের পর হয়তো মেয়েটি আত্মহত্যা করতো না। সে বেঁচে থাকতো। পাষন্ডরা তাকে মেরে ফেলেছে। অবশ্য মেয়েটিকে তার মায়ের সামনে ধর্ষণ করেনি। এদিক দিয়ে ঘটনাটি গুরুত্ব হারিয়েছে। তারপর এই যে পুরোহিতকে জবাইয়ের ঘটনা। কিছুদিন আগে হিমসাগর শুনেছে জঙ্গীরা নাকি বলেছে জবাই করে মারলে সওয়াব বেশি। চিন্তা করা যায়, তারা খুনের পন্থা নির্বাচন করে সওয়াবের ভিত্তিতে! বেশ কিছুদিন ধরে এই বিশেষ ধরনের খুন হচ্ছে। এটা মাথা ব্যাথার। তাছাড়া সংখ্যালঘুদের উপর বেশি আক্রমণ হচ্ছে। এটা আমাদের জাতীয় পরিচয়কে সংকটে ফেলে দিচ্ছে। একটা দুইটা ধর্ষণের চেয়ে এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সীমান্তের হত্যার বিষয়টা জাস্ট অসহ্য। সীমান্তে শুধু বাংলাদেশের নাগরিকরাই মরে। অথচ আমাদের সরকার কিছুই করছে না। অথবা করতে পারছে না। নিজ দেশের সরকারের এমন মেরুদন্ডহীনতার কথা চিন্তা করলে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। আমাদের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব আজ প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে মানুষ মরেই যাচ্ছে, কোন থামাথামি নেই।
কিন্তু এক্টিভিস্ট হিম সাগর এখন কী করবে? সবগুলো বিষয় সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে, ভেবে পাচ্ছে না। আবার সবগুলো বিষয় নিয়ে লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। এক লাইন গদ্য মাথায় আনতে একবার বাজারে যেতে হয়েছে, আবার ফিরতে হয়েছে। আর এখন যদি এতগুলো ইস্যু নিয়ে লিখতে যায়, তাহলে হিম সাগরকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও ঠান্ডা মাথায় চোখ বন্ধ করে ভেবে যাচ্ছে হিম সাগর। উপায় একটা বের হবেই।
এক্টিভিস্ট হিম সাগর ভাবছে একটু গাঁজা টেনে নিলে মনে হয় বিষয়টা সহজ হবে। তার বিশ্বাস, গাঁজা ব্রেইন খুলে দেয়। উদারভাবে চিন্তা করা যায়। কিন্তু গাঁজা টানলে তার নতুন জীবন শুরু করা যাবে না। আবার না টানলে এই সংকটের সমাধান হবে না। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে গাঁজার চুরুট ধরিয়ে দিলো কয়েক টান। তারপর দৌড়ালো বাথরুমে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে হিম সাগর ভাবছে আজ নয়, কাল থেকে এক্টিভিজম শুরু করবো।
মেয়েটির নাম জাহান, মারজাহান
এই মারজাহান সেই মারজাহান নয়। এই মারজাহান হচ্ছে জাহান। এবং এই মারজাহানের কোন গল্প নেই। অন্যের গল্পে মারজাহান ঢুকে পড়ে। কারণ ওইসব গল্প মারজাহানকে ছাড়া হয় না। যেমন বাইশ বছর আগে তার বাবা মা, দাদা দাদী, খালা ফুফু সবাই খুব চিন্তা করছিলো এই নবজাতকের নাম কী রাখবে। পরে নবজাতকের বাবা বললেন, নাম হোক মারজাহান। বাবার দেয়া নাম সবাই পছন্দ করেছে। তারপর মারজাহান নামেই সে বেড়ে উঠেছে।
মারজাহান বড় হলো। বয়স হলো চার। মারজাহানকে স্কুলে দিবে। ইংলিশ মিডিয়ামে নাকি বাংলা মিডিয়ামে, এই নিয়ে বাবা মা’র টেনশন। মা বললো বাংলা মিডিয়ামেই দাও। ইংরেজি বিষয়ের জন্য আলাদা মাস্টার রেখে দিবো। সমস্যা নেই। তারপর মারজাহান বাংলা মিডিয়ামের স্কুলে গেলো।
প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে মাধ্যমিকে ভর্তি করানোর সময় আবারো মারজাহানের বাবা মা’র অন্তহীন চিন্তা। কোন স্কুলে ভর্তি করাবে, কোন স্কুল ভালো, কোন স্কুলের শিক্ষকদের কোন বদনাম নেই। অনেক ভাবনা চিন্তার পর মারজাহানকে একটা স্কুলে ভর্তি করায়। তার বাবা মা দুশ্চিন্তামুক্ত হয়।
মারজাহান আরো বড় হলো। ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠলো। এখন বাবা মা’র দুশ্চিন্তা মেয়ে কোন লাইনে পড়াশোনা করবে। সায়েন্স, আর্টস নাকি কমার্স। সায়েন্স অনেক কঠিন। মেয়ে মানুষ কমার্সে গিয়ে কী করবে? আর্টসটাই মনে হয় ভালো। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে পড়বে। অন্যদিকে খেয়াল কম যাবে। এসব ভেবে শেষে বাবা মা মিলে সিদ্ধান্ত নিলো মারজাহান আর্টসে পড়বে।
আরো বড় হলো। এসএসসি পাশ করেছে। কলেজে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু কোন কলেজে ভর্তি করাবে? কো এডুকেশন নাকি গার্লস কলেজ? গার্লস কলেজ হলে, সেটা কোন কলেজ? মারজাহানকে তার মা বলে –তোর চিন্তায় চিন্তায় তোর বাবার অবস্থা কাহিল। মারজাহান খেয়াল করে দেখে আসলেই তার চিন্তায় চিন্তায় বাবা মা দু’জনই শুকিয়ে যাচ্ছে। মারাজাহানের কোন চিন্তা নেই। বাবা বলে –তোর আবার কিসের চিন্তা, আমরাতো আছি।
এখন মারজাহানের বাবা মা চিন্তায় একেবারে জমে গেছে। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। ডাক্তার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ল’ইয়ার নাকি প্রবাসী ছেলের হাতে তুলে দিবে? মারজাহানের মায়ের বোনের ছেলেটা মারজাহানকে পছন্দ করে। আবার বাবার বন্ধুর ছেলেও পছন্দ করে। কিন্তু বোনের ছেলেকে বাবার পছন্দ না, বন্ধুর ছেলেকে মায়ের পছন্দ না। তাই যে যার দায়িত্ব নিয়ে দুই পাত্রকে মানা করে দিয়েছে। কিন্তু মানা করে দিয়ে কী হবে, চিন্তাতো আর কমে না। এই সময় একটা ভালো পাত্র পাওয়া যে কত কঠিন, তা যাদের মেয়ে আছে শুধু তারাই জানে। মারজাহানের মা মারজাহানকে বলে – তুই কোন চিন্তা করিস না মা, একটা ভালো ছেলের হাতে তোকে তুলে দিবো। সুখে থাকবি।
এখন, ঠিক এই মুহূর্তে মারজাহান যাচ্ছে শপিংয়ে। দুই বছর হলো একা একা শপিংয়ে যাওয়ার অধিকার অর্জন করেছে। অর্জন বলা যাবে না, দয়া করে বাবা মা এই অধিকারটুকুন তাকে দিয়েছে। মারজাহান শপিং খুব পছন্দ করে। উপভোগ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই শপিং মল থেকে ওই শপিং মল, এই শোরুম থেকে ওই শোরুম, এই ব্র্যান্ড থেকে ওই ব্র্যান্ড, ঘুরতে থাকে। একটার পর একটা জামা, কসমেটিক, জুতা দেখে। দেখতে দেখতে স্তুপ করে ফেলে। তারপর চেহারায় খুব অসন্তুষ্টি নিয়ে কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে, একটাও পছন্দ হয়নি, পাশের দোকানে দেখি পছন্দ হয় কিনা।
শুধুমাত্র শপিং করতে আসলে ভালোমত দেখে, শুনে, বুঝে, চিন্তা করে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার, নিজের পছন্দ নিজে করার সুযোগ পায়। কেউ তাকে বলে না, তুই কোন চিন্তা করিস না, একটা ভালো জামা-জুতা আমরা কিনে দিবোই।
শপিং করতে আসলে মারজাহান অনেক চিন্তা করে। কারণ এখানে কেউ তার হয়ে চিন্তা করার সুযোগ পায় না।
রোদে পুড়তে থাকা যাত্রী ছাউনি
আনন্দদন্ড হারানো হাশেম ঢাকা এসে পোঁছেছে বেশিক্ষণ হয়নি। মতিঝিলে এক খাতিরের লোক থাকে। তার কাছে যাবে। ঢাকায় এসে বাস থেকে নেমে খাতিরের লোককে ফোন করেছে। খাতিরের লোক বলেছে বাসে করে সোজা শাপলা চত্বর এসে নেমে কোন দোকান থেকে আরেকটা কল করতে। তারপর তিনি এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু আবুল হাশেম ভুল বাসে উঠে এখন আগারগাঁও। প্রখর রোদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কোমরে অনেক ব্যাথা নিয়ে যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে বাসের জন্য।
এদিকে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বাজারে গিয়ে সবাইকে অবাক করে দেয়া আবদুর রহিম সাগরের বাবা ভাবলেন ছেলে বোধহয় লাইনে চলে এসেছে। তাই ছেলেকে একটা কাজে কাওরান বাজার যেতে বললেন। গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকা হিম সাগর তার বাবাকে না করতে পারেনি। মনে মনে ভেবেছে আজ নয় কাল যাবে কাওরান বাজার। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে শরীরটাকে নিয়ে আজই বেরিয়ে পড়েছে। যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে বাসের অপেক্ষায়।
বাইরে ঠাডাভাঙ্গা রোদ। রোদ থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করা একদম পছন্দ করে না মারজাহান। তারচে বরং ঘর থেকে বেরিয়ে পাঁচ টাকা দিয়ে একটা পত্রিকা কিনে নিলেই হয়। অন্তত মাথাটা রোদ থেকে বাঁচানো যায়। হাঁটতে হাঁটতে বাস স্টপিজে আসে মারজাহান। যাত্রী ছাউনিতে বসে।
আজ ছুটির দিন। তবুও রাস্তায় প্রচুর যানজট। বাস আসতে দেরি করছে। যাত্রী ছাউনিতে তিনজন মানুষ। আবুল হাশেম, আবদুর রহিম সাগর আর মারজাহান। এক কোনায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে হাশেম। মাঝখানে বসে পত্রিকা দিয়ে চেহারায় বাতাস করছে মারজাহান। আরেক পাশে বসে বসে উদাস দৃষ্টিতে কোথায় যেন তাকিয়ে আছে হিম সাগর।
অনেক সময় হলো, বাস আসছে না। অপেক্ষার বিরক্তি কাটাতে মারজাহান পত্রিকাটা মেলে পড়ার চেষ্টা করে। প্রথম পাতায় দুইটা ধর্ষণ আর তিনটা খুনের খবর। মানুষ কেন পত্রিকা পড়ে, এটা ভেবে অবাক হয় মারজাহান। টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনে দুঃসংবাদ পড়ে কী লাভ! ধর্ষণের খবরে চোখ রেখে আপন মনে বলে, এদেরকে গুলি করে মারা উচিত।
এটা শুনে ডানপাশে উদাস হয়ে বসে থাকা হিম সাগর বলে, মেরে ফেললেতো বেঁচে যাবে। ওদের নুনু কেটে দেয়া উচিত। স্যরি, ফর ব্যাড ওয়ার্ড।
হিমসাগরের মুখে এটা শুনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা আবুল হাশেম চমকে ওঠে। নুনু কাটার কথা শুনে তার গা কাঁপতে থাকে। কাঁপুনির তীব্রতা এত বেশি যে যাত্রী ছাউনির বেঞ্চটাও কেঁপে ওঠে। টের পায় মারজাহান ও হিম সাগর। দেখে একজন মোটামুটি বয়স্ক মানুষ জড়সড় হয়ে থর থর করে কাঁপছে। মারজাহান আবুল হাশেমের কাছে যায়। আবুল হাশেম ভয় পায়। মারজাহান আবুল হাশেমের কপালে হাত দেয়। আবুল হাশেম আরো ভয় পায়। মারজাহান বলে – আরে, আপনারতো অনেক জ্বর। আপনি কোথায় থাকেন, কোথায় যাচ্ছেন?
আবুল হাশেম কথা বলে না। মারাহান আবার জিজ্ঞাসা করে। আবুল হাশেম এবারও কিছু বলে না। ভয়ংকরভাবে কেঁপে যাচ্ছে। মারজাহান বলে, চলেন আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
আবুল হাশেম নড়ে না। খেমটি মেরে বসে থাকে। হিম সাগর কিছু বলছে না, কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মারজাহান আবুল হাশেমকে জোর করে। বলে, আপনি আমার বাবার বয়সী, ভয় পাচ্ছেন কেন? চলেন হাসপাতালে যাই। কাছেই একটা হাসপাতাল আছে।
প্রায় জোর করে আবুল হাশেমকে বসা থেকে উঠায় মারজাহান। এমন সময় মারজাহানের ফোনে কল আসে। কল রিসিভ করে। ওই প্রান্ত থেকে কী বলছে কে জানে, মারজাহান বলছে – আমি তিথি নই, মারজাহান।
ফোন রেখে দেয়। আবুল হাশেমের চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠে। কোথায় জ্বর আর কোথায় কাঁপুনি, গায়ে জানোয়ারের শক্তি ভর করে। সর্বশক্তি দিয়ে মারজাহানকে ধাক্কা মেরে বলে, দূর হ ডাইনি!
তারপন হন হন করে হেঁটে চলে যায়। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় মারজাহান। বেঞ্চের সাথে আঘাত খেয়ে ভ্রুর উপরে কপালের খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। এবার আর চুপ মেরে বসে থাকতে পারেনি হিম সাগর। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে মারজাহানকে তোলে।
হিম সাগর বলে, চলুন আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
ঈশ্বর আমার মৃত্যু কামনা করেন
লিখেছেন সবাক
যার
যার ঈশ্বর দেখতে তার তার পূর্ব পুরুষদের মতন। ঈশ্বরের
চেহারায় পূর্ব পুরুষদের ছাপ থাকে। গতরাতে আমার ঘুম আসছিলো না। এমনিতে ঘুম
না এলে স্বপ্ন আসে। এদিন
স্বপ্ন আসেনি, তাই তিনি এলেন। তিনি বললেন, দেখো, আমার চেহারায় তোমার বাবা ও দাদার ছাপ আছে। আমিই তোমার
ঈশ্বর।নিজেকে আধুনিক ঈশ্বর বলে দাবি করেন এবং বলেন, তিনি আসবেন তাই আমার ঘুম আসেনি। আমি নাকি তার জন্য অপেক্ষা করছি। এ কথা শুনে কিছুক্ষণ হাসলাম। তিনিও হাসলেন।
ঈশ্বর এলেন মৃত্যুর দাবি নিয়ে। তিনি চান আমি যেন স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুবরন করি। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আমার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এনেছেন এবং বলেছেন এসব মেনে নিতে। ঈশ্বর যখন অভিযোগসমূহ বলছিলেন, তখন তাকে খুব রাগান্বিত দেখিয়েছে। বেশ ক্ষুব্ধতার সাথে তার অভিযোগ বললেন।
-গত বর্ষায় বৃষ্টির দিনে তোমার বাসার বাম পাশের গলির মুখে যমদূত পাঠিয়েছিলাম। কথা ছিলো তুমি খুন হবে এবং বৃষ্টির জলধারা রক্তে লাল হয়ে নেমে পড়বে ওয়াসার ড্রেনে। কিন্তু তুমি গেলে ডান পাশের গলি দিয়ে এক সুন্দরী নারীর ছাতা ভাগাভাগি করে।
-দুঃখিত। বিষয়টা আমি জানতাম না।
– তার কিছুদিন পর অফিসের পাশে আন্ডারপাসের সিঁড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার কথা ছিলো। যেখানে সিঁড়ি শেষ, সেখানে সামান্য জল জমে থাকবে আর তোমার রক্ত সিঁড়ি বেয়ে সেই জলে মিশে যাবে। অথচ তুমি সেদিন অফিসেই গেলে না। বাসায়ও ছিলে না।
– আপনার এই পরিকল্পনার কথাও আমার অজানা ছিলো।
– পরের সপ্তাহের একদিন রাত বারোটায় তোমার সিগারেট শেষ হয়ে গেলে সিগারেট কিনতে বের হবে। ওঁৎ পেতে থাকা যমদূত তোমার প্রাণ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। এই দেখো, ঠিক এরকমই লেখা আছে তোমার প্ল্যান বুকে। সিগারেট ঠিকই শেষ হয়েছে। কিন্তু সিগারেট কিনতে বের হয়েছিলো তোমার বন্ধুর গাড়ির ড্রাইভার। এবং সেটা তোমার বন্ধুর বাসায়। মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বৌ বাচ্চাকে ঘরে একা রেখে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলে মদ খেতে, আড্ডা দিতে। যমদূত দেখেছে তোমার স্ত্রী ভয়ে সারা রাত ঘরে আলো জ্বেলে রেখেছিলো। অথচ তোমার কোন লজ্জা হয়নি।
-বন্ধুর বাসায় গিয়ে মদ খাওয়া এবং আড্ডা দেয়ার বিষয়ে আমার স্ত্রীর কোন অভিযোগ ছিলো না। সে আলো ভালোবাসে, তাই আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলো। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের পরিবারের সবাই অন্ধকারে অনভ্যস্ত।
ঈশ্বর বললেন, আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আমি যা করেছি, কিছুই তার পরিকল্পনায় ছিলো না। আমি নিজ পরিকল্পনায় চলছি এবং আইন অনুযায়ী একজন বিদ্রোহী। কিন্তু যেহেতু নিজস্ব পরিকল্পনায় চলার যোগ্যতা অর্জন করেছি, সেহেতু যোগ্যতার মর্যাদাস্বরূপ কোন শাস্তি পেতে হবে না। শুধু তার পরিকল্পনা মতে মৃত্যুকে বরন করে নিলেই তিনি খুশি।
খুব জোরশব্দে হাসার চেষ্টা করলাম। পেরেছিও। এমন উচ্চস্বরে খুব টান টান দম নিয়ে এর আগে কখনো হাসিনি। আমি জানি কারো হাসির শব্দ দূর থেকে মনযোগ দিয়ে শুনলে খুব বিশ্রী লাগে। অস্বস্তিকর। হাসি থামিয়ে জানতে চাইলাম আমাকে কেন এভাবে পথে ঘাটে মরে থাকতে হবে এবং আমার রক্ত কেন উচ্ছিষ্ট জলে গিয়ে মিশবে? এমন অপ্রচলিত মৃত্যুর কারণ কী?
ইশ্বর ভরাট গলায় বললেন, তোমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ এরকম মৃত্যু পছন্দ করে। তাছাড়া তোমার বন্ধুদের মধ্যে যারা এর আগে এভাবে মারা গেছে, তাদের মৃত্যু দেশের অধিকাংশ মানুষকে আহত করেনি। অর্থাৎ তোমাদের জন্য এটাই প্রচলিত মৃত্যু।
– কিন্তু বিষয়টাতো আমার উপর নির্ভর করছে। এভাবে মারা যাওয়া আমার পছন্দ নয়। আমি আরো সম্ভ্রান্ত মৃত্যু চাই।
– শোনো, তোমার দেশে এখন একপক্ষ মরছে, আরেকপক্ষ মারছে। এরা সংখ্যায় কম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এসব মৃত্যুর জন্য যারা মরছে তাদেরকে দোষ দিচ্ছে। তোমার উচিত জনমতকে শ্রদ্ধা জানানো। আমি চাই তুমি আরো গণতান্ত্রিক হও।
– এসব কথা আপনার মত করে বলছেন। মানুষের মত পরিবর্তন হয়। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আপনি এমন একজনকে মানুষের মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মরে যেতে বলছেন, যে কিনা মানুষের মত পরিবর্তনের জন্য কাজ করে। আপনি যুক্তি ছাড়া কথা বলছেন। আপনি একজন অযৌক্তিক ঈশ্বর।
এরপর ঈশ্বর বললেন আমি যেন তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করি। তিনি আমার বয়সে ছোট। আমার আর আমার ঈশ্বরের জন্ম একই সময়ে হয়নি। আমার জন্মের অনেক পরে নাকি তাকে সৃষ্টি করেছি।
-মিথ্যা কথা। আমি তোমাকে সৃষ্টি করিনি।
– তোমার বাবা, দাদা, মক্তবের হুজুর, স্কুলের শিক্ষকরা মিলে আমাকে তোমার জন্য সৃষ্টি করেছে। এরপর তুমি ধারণ করেছো।
– কিন্তু শেষে তোমাকে ঘৃনা করেছি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।
-হ্যাঁ, ঘৃনার আড়ালে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। সেই ভালোবাসার টানে এসেছি। তুমি রাজি হও, খুন হয়ে যাও। প্লীজ!
– কী অদ্ভুত!
– আচ্ছা তোমরা ঈশ্বরকে সৃষ্টি করার পর যে পরিমান ক্ষমতা বা পাওয়ার দিয়ে থাকো, সত্যি সত্যি যদি কেউ সমপরিমান মহাপরাক্রমশালী হয়ে তোমার প্রাণ নিতে আসে, তুমি কি তাকে বাধা দিতে পারবে?
– আমরা কি কোন ব্যাটারিচালিত ঈশ্বর নিয়ে আলোচনা করছি? এ বিষয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই।
এবার তিনি খুব হতাশ হলেন। আমার কাছে এরকম আচরণ আশা করেননি। কথাটিকে গালি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার মতে ঈশ্বররা অদৃশ্য ক্ষমতায় চলেন, তাদের কোন ব্যাটারির প্রয়োজন হয় না। অথচ তার মতামতকে আমি এতটুকু মূল্য দিইনি। এমন কথার জবাবে তাচ্ছিল্যে হাসি হাসলাম।
তার সাথে আলোচনায় আগ্রহ হারাচ্ছি দেখে তিনি আমার সাথে মৃত্যুর উপায় নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মৃত্যুর কথা বললেন। ঈশ্বরের মতে এটা একটা সুযোগ। তিনি আমাকে মৃত্যুর অপশন দিবেন। সেখান থেকে পছন্দসই উপায়ে মারা যেতে পারবো। এই বিশেষ সুযোগটি কেবল আমার জন্য। এরকম বললেন।
– মনে করো তারা তোমাকে নিয়ে একটি ৩০ তলা দালানের উপর উঠলো। তারপর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। দালানের যে পাশে ধাক্কা মারবে, সে পাশে থাকবে একটি সুন্দর ফুলবাগান। সেক্ষেত্রে তোমার রক্ত ফুল বাগানের মাটিতে মিশে যাবে। সার হবে এবং সেই সারের পুষ্টিতে বাগানে আরো বেশি বেশি ফুল ফুটবে। রক্ত ড্রেনের জলে মিশে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
রক্তের শক্তিতে হৃষ্টপুষ্ট ফুলের জবাবে আমি কিছু বলিনি।
– অথবা ধরো তারা তোমাকে একটি বড় মাঠে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করলো। তারপর ঠিক সেখানেই মাটিতে পুঁতে ফেললো।
– জ্যন্ত পুঁতে ফেললে কী হয়?
– যাদের জন্য তুমি মারা যাবে, তাদের আত্মতৃপ্তির একটা ব্যাপার থাকে না! চাপাতি দিয়ে কোপানোর বিষয়টা এখন কালচার। এভাবেই হচ্ছে।
– বাদ দাও এসব।
– আচ্ছা, আরো একটা উপায় বলি। প্রথমে তারা একটি গর্ত খুঁড়লো। এরপর তোমাকে সেখানে শুইয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিলো। এতে আপত্তি আছে?
– তুমি কি ঈশ্বর? নাকি ডেথ প্ল্যানার? এত নৃশংস মৃত্যু পরিকল্পনা নিয়ে বেঁচে আছো। তোমার লজ্জা করে না?
– দেখো, ঈশ্বর কখনো কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। তিনি যে কাজে দক্ষ, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। আজ পর্যন্ত দেখেছো ঈশ্বর কাউকে বাঁচিয়ে রেখেছে? সবাই মরে যায়। মরতে হয়।
উনার কথা শুনে আমার গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো। তখনো ভোর হতে ঘন্টাখানেক বাকি ছিলো। বমি করার জন্য যথেষ্ট সময় ছিলো। চেষ্টাও করেছি, কিন্তু হয়নি। ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি, যেহেতু আমি তাকে বিশ্বাস করি না, সেহেতু তিনি যেন আমার কাছে না আসেন। আমার এসব ভালো লাগে না।
আরেকটি কথা তাকে স্পষ্টভাবে বলেছি। তার ইচ্ছা অনুযায়ী মারা যাওয়ার কোন আগ্রহ আমার নেই। তিনি বললেন আগ্রহ যে নেই, এটা পুরোপুরি ঠিক না। তার দেয়া মৃত্যুর অপশন বিষয়ক আলোচনায় আমি অংশ নিয়েছি এবং জ্যন্ত পুঁতে ফেলার মত একটি অপশন প্রস্তাব করেছি। পরোক্ষভাবে এটা নাকি আমার সম্মতি। আমি বলেছি, এটা আমার সম্মতি নয়। বরং এটা হচ্ছে ভয়। কখনো যদি খুনীর মুখোমুখি হই, তখন হয়তো তাদের কাছে রক্তপাতহীন মৃত্যু দাবি করবো। আমি লাল গোলাপ, লাল শিমুল, লাল ফিতা, লাল চুড়ি, লাল জুতো, লাল সূর্য, লাল ওয়াইন পছন্দ করি। কিন্তু রক্ত নয়। এতকিছু বলার পরও তিনি আমার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেন। খুব অসহায়বোধ করলাম।
-কিছু কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। এই দেশে তুমি যখন তখন মরে যেতে পারো। মনে করো তুমি অটোরিক্সা করে কাওরান বাজার থেকে মতিঝিল যাচ্ছ। একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তোমাকে বহন করা অটোরিক্সাটি চাপা দিলো। তুমি গেলে। অথবা মনে করো শশুর বাড়ি যাওয়ার সময় লঞ্চে করে পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছো। একটি ডুবো চরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চের তলায় ফাটল ধরে পানি ঢুকে ডুবে যেতে লাগলো। ক্লান্ত শরীরে তুমি তখন ঘুমিয়ে আছো। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে লঞ্চের সবগুলো লাইফবয় অন্য যাত্রীরা দখল করে নিলো। অনেক কিছু আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চাইলে, কিন্তু পারলে না। ডুবে মরলে।
– প্লীজ, এসব বন্ধ করো। তুমি এত বর্বর কেন? একটি মৃত্যু নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? এটা খুব বোরিং।
– এমনওতো হতে পারে তোমার বাসায় আগুন লাগলো। বৌ বাচ্চাদের বাসা থেকে বের করতে গিয়ে শেষে নিজেই আটকা পড়লে। আচ্ছা মানলাম তুমি আগুনে পুড়ে মরলে না। কিন্তু ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মরে গেলে। আসলে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে, জঙ্গীদের হাতে চাপাতির কোপ খেয়ে না মরলেও অন্য অনেক কারণে মরে যেতে পারো। এখানে মরার জন্য হাজারটা সহজলভ্য উপায় আছে। মরেই যখন যাবে, তখন আগামীকালই মরবে না কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। পরশু মরো। অথবা তার পরদিন। তুমি একটা ডেট দাও। সেদিন যমদূত পাঠাবো। কোন ঝামেলা না করে মরে যাও।
– প্রয়োজনে আমি দেশ ছাড়বো। এমন দেশে যাবো, যেখানে মৃত্যুর হাজারটা সহজলভ্য উপায় নেই।
– কোথায় যাবে? জামার্নী, সুইডেন, নরওয়ে, কানাডা, নেদারল্যান্ডস অথবা মনে করো সুইজারল্যান্ডই গেলে। সবগুলো শীতের দেশ। মনে করো এমন শীত পড়লো যে, তুমি বরফে জমে গেলে। মৃত্যু কিন্তু তোমার পিছু ছাড়বে না। আচ্ছা বাদ দাও। শোনো, তোমার সাথে কথা বলাটা এখন আর এনজয় করছি না। খুব বোরড ফীল করছি। এটা দ্রুত শেষ করো।
আসলে ততক্ষণে আমিও খুব বিরক্ত ও বিব্রতবোধ করছিলাম। কখনো ভাবিনি ঈশ্বরের সাথে শুধু মৃত্যু নিয়ে কথা বলবো। কিছুদিন ধরে প্রচুর মুভি দেখছি। কয়েকটা মুভিতে ভয়াবহ প্লটহোল খুঁজে পেয়েছি। খুব ভালো হতো যদি উনার সাথে মুভি নিয়ে কথা বলতে পারতাম। অথবা আমার ছোট ছেলের মাথার চুল নিয়ে। তার চুলগুলো খুব দ্রুত বাড়ছে এবং বাদামী হয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা পারিবারিকভাবে অত্যন্ত ব্যস্ত। তার চুলের বেড়ে উঠা এবং রং পরিবর্তন নিয়ে বেশিরভাগ সময় আলোচনা করি। কিন্তু ঈশ্বর এলেন শুধুই মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে। অসহ্য। এমনকি আমার সাথে তার কোন ভালো সম্পর্কও নেই। আমার কাছে তিনি মঞ্চের ভাঁড়ের চাইতে হাস্যকর, এবং ভাঙা মদের গ্লাসের চাইতে বিরক্তিকর। কখনোই আমি তাকে আশা করিনি।
– এতো বেশি ঘৃনা করা ঠিক না। তোমার চারপাশে অনেক উদাহরণ আছে। যারা একসময় আমাকে খুব ঘৃনা করতো, এখন তারচে বেশি ভালোবাসে। যখনই তুমি আমাকে ঘৃনা করতে থাকবে, তখনই আমি আশাবাদী হতে থাকবো। কারণ আমি জানি একসময় তুমি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসবে। তাছাড়া তুমি যদি আমাকে আশা না করতে, আমি এখানে আসতে পারতাম না। যেভাবেই হোক, তুমি আমাকে আশা করেছ। তাই এসেছি।
– না, আমি তোমাকে আশা করিনি। একটুও না।
– তাহলে তোমার স্বপ্ন আসেনি কেন? তুমি কী অস্বীকার করতে পারবে যে দিন দিন কেমন স্বপ্নহীন হয়ে যাচ্ছো। ঈশ্বরের কোন ক্ষমতা নেই আত্মবিশ্বাসী কোন স্বপ্নবান মানুষের কাছে ঘেঁষার। আজ তুমি সম্পূর্ণরূপে স্বপ্নহীন ছিলে বলেই আমি এসেছি। অথচ কেমন বাজে ব্যবহারটাই না করলে। যদিও তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। কারণ মানুষের প্রতি এখন আর আমার কোন বিশ্বাস নেই। মানুষ নিজে যাকে সৃষ্টি করে, আবার তাকেই ধ্বংস করে।
– এতক্ষণে একজন অভিমানী ঈশ্বরের দেখা পেলাম। হা হা হা।
– দেখো, আমি আমাকে সৃষ্টি করিনি। এটা সম্ভব না। তোমরা ঈশ্বর বানাও, ধর্মগ্রন্থ বানাও। আবার ঈশ্বরকে ধ্বংস করো, ধর্মগ্রন্থ নিয়ে হাসাহাসি করো। এসব গ্রন্থ কি আমি লিখেছি? তোমরা এখন এসব গ্রন্থকে হাস্যকর বলো, উদ্ভট বলো। অথচ এগুলো তোমাদের পূর্ব পুরুষরাই লিখে গেছে। তোমরা নিজেরা যা জানো না, যা বুঝো না, যা আবিষ্কার করতে পারোনি, তার সবকিছু ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছো। তোমাদের সকল ব্যর্থতার ভার আমাদেরকে বহন করতে হয়। অনেক সময় কৃতিত্বের ভাগও দাও। কিন্তু সেটা সবসময় না। তোমরা নিজেদের মত করে আমাদেরকে মহিমান্বিত করেছো। তারপর আবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করছো। তোমরা আমাকে নিয়ে খেলছো। এটা খুবই ফালতু একটা গেইম, যা তোমরাই সৃষ্টি করেছো।
– বলে যাও। খারাপ লাগছে না।
– আমাকে তোমার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ আজ তুমি আমাকে স্বীকার করো না। আমি তোমার কাছে আসার জন্য, পাশে বসার জন্য শকুনের মতো তাকিয়ে থাকি। কখন একটু সুযোগ পাবো, এই আশায়। বহুদিন পর আজ সুযোগ পেয়েছি। যতই অবহেলা, অপমান করো না কেন, আমার ভালো লেগেছে। তুমি হয়তো জানো না, একা থাকার কী কষ্ট।
– তোমার কথায় যুক্তি আছে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে তোমার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
– কিন্তু আমাকে বলো কেন তুমি মরতে চাও না?
– আসলে এটা মৃত্যুর জন্য সঠিক বয়স নয়। তুমি জানো আমি এখন কী পরিমান ব্যস্ত। হাতে অনেক কাজ। তাছাড়া আমার দু’টো ছেলে এখনো অনেক ছোট। আমি তাদের যুবক বয়সটা দেখে যেতে চাই। তারা কিভাবে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলে, কিভাবে অন্যের কাছে আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থান করে, তাদের প্রতি আমার কতটুকু প্রভাব নিয়ে বেড়ে উঠে, কেমন মেয়ের সাথে প্রেম করবে, এসব। তাছাড়া তাদেরকে সাথে নিয়ে আমি পাহাড় বাইতে যাবো। তারা আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। বলবে, কিভাবে পাহাড় বাইতে হয়।
– তুমি কি এটাকে তোমার স্বপ্ন হিসেবে নির্মাণ করেছো?
– অনেকটা তাই।
– তুমি আমাকে এভাবে দুর্বল করতে পারো না। আমিও কিছু স্বপ্ন নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। কিন্তু তোমার স্বপ্ন যেভাবে নির্মিত হয়, আমার স্বপ্ন একই সাথে একইভাবে ধ্বংস হয়। খুব মন খারাপ হলো। কিছুটা সময় একা থাকতে পারলে ভালো লাগতো। আশপাশে কেউ থাকলে মন খারাপ শেষ করা যায় না। বড়জোর এড়িয়ে যাওয়া যায়।
– তার আগে একেবারে সত্যি করে বলো, তুমি কেন আমাকে মারতে এত আগ্রহী।
– কারণ আমি মুক্তি চাই। তোমার আমার জন্ম একইসাথে না হলেও আমাদের মৃত্যু একইসাথে হবে। মানুষের মৃত্যুর পর আর তার ঈশ্বর বেঁচে থাকে না। ইশ্বর তার মালিক ছাড়া একা বাঁচতে পারে না। হয় আমাকে ভালোবাসো, নয় মুক্তি দাও।
আলোচনা এমন মানবিক রূপ ধারন করবে বুঝিনি। ঈশ্বরকে একটু একা থাকতে দিয়ে জলপান করতে রান্না ঘরে যাই। জগে জল ছিলো না। জার থেকে জল ঢেলে খুব প্রশান্তি নিয়ে পেটভরে জল নিলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ভোরের আলো ছড়িয়েছে। গতকালের ভোরের সাথে আজকের ভোরের বিশেষ পার্থক্য নেই। একইরকম আলো, একইরকম কুয়াশা। হঠাৎ খুব শীত শীত লাগছে। খেয়াল করে দেখি, আমার গায়ে একটি হালকা ফুলহাতা টীশার্ট। অথচ এতক্ষণ শীত গরম কিছুই অনুভব করিনি। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে রীতিমত কাঁপছি। দ্রুত শোবার ঘরে গেলাম সোয়েটার পরতে। গিয়ে দেখি আমি আমার বিছানার উপর বসে আছি। সোয়েটার পরে। শোবার ঘরে এখন দু’টো আমি। একটি সোয়েটার পরা, আরেকটি সোয়েটার ছাড়া। ঈশ্বর চেহারা পাল্টে হুবহু আমার রূপ ধরে বসে আছেন। বললেন, খুব শীত পড়ছে, এসো ঘুমিয়ে পড়ি।
তার কথা এড়িয়ে যেতে পারিনি। হঠাৎ চোখের পাতায় প্রচুর ঘুম নেমে আসে। বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রতিদিন আমি দু’টো বালিশ মাথায় দিয়ে খাটের মাঝখানে ঘুমাই। ঈশ্বর বালিশ দু’টো পাশাপাশি রাখলেন। তিনি ডানের বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। শীত থেকে বাঁচার জন্য আমিও দ্রুত বাম পাশের বালিশে শুয়ে পড়ি। ঠিক তখন কানের কাছে মুখ এনে ঈশ্বর ফিসফিস করে বললেন, “মারা যাওয়ার কথাটা মাথায় রেখো। চাইলে আত্মহত্যাও করতে পারো।“
তারপর আর কিছু মনে নেই। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ দুপুরে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি ঈশ্বরের বালিশে শুয়ে আছি। বাম পাশের বালিশটি খালি। শোবার ঘরে আমি ছাড়া কেউ নেই।