Saturday, August 6, 2016

আদিম মানুষদের অন্ধ আদিম কল্পনা

আদিম মানুষদের অন্ধ আদিম কল্পনা, আর পরবর্তী অনেকের সুপরিকল্পিত মিথ্যাচার, কখনো কখনো মত্ততা, নানাভাবে বিধিবদ্ধ হয়ে নিয়েছে যে-বিচিত্র রূপ, তাই পরিচিত ধর্ম নামে। বার্ট্যান্ড রাসেল, তার “ আমি কেন খ্রিষ্টান নই” বইটিতে, বলেছেন, ‘সব ধর্মই ক্ষতিকর ও অসত্য।’ কোনো অলৌকিক জগত থেকে কেউ ধর্ম পাঠায় নি, যদিও এটা বিশ্বাস করার নির্দেশ দিয়ে ভয় দেখানো হয়; কোনো অলৌকিক জগত নেই, মানুষ নিয়ে কোনো অলৌকিক সত্তার কোনো উদ্বেগ নেই। মহাবিশ্বে মানুষ খুবই ক্ষুদ্র । ধর্ম অলৌকিক নয়—বিধাতার বা দেবদেবীদের প্রণীত নয়; ধর্ম লৌকিক—মানুষের প্রণীত এবং বেশ সন্ত্রাসবাদী, ব্যাপার। মানুষ উদ্ভাবনশীল; মানুষের অজস্র উদ্ভাবনের একটি, ও সম্ভবত নিকৃষ্টটি, ধর্ম। ধর্মকে শাশ্বত সর্বজনীন মনে করার একটা চাপ রয়েছে; তবে ধর্ম শাশ্বত নয়, সর্বজনীন নয়। কোনো ধর্ম নেই, যা মানুষের শুরু থেকে চলে এসেছে, ও চিরকাল চলবে; কোনো ধর্ম নেই, যাতে বিশ্বাস করে সবাই। অনেক সত্য আছে, যা সবাই শুধু বিশ্বাস নয়, স্বীকার করে; কিন্তু বিশেষ একটি ধর্ম ও তার বিধাতার বিশ্বাস করে শুধু ওই ধর্মের মানুষ। অন্য ধর্মের মানুষের কাছে তা হাস্যকর ও অনেক সময়, ঘৃণার বিষয়। চারপাশে ধর্ম দেখে মনে হতে পারে যে মানুষ ধর্ম ছাড়া বাচতে পারে না; সত্য হচ্ছে ধর্মের মধ্যে মানুষ বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। মানুষ মৰ্মমূলে ধর্মবিরোধী, মানুষের পক্ষে বেশি ধর্ম সহ্য করা অসম্ভব;–ধার্মিকেরাও যতোটা ধাৰ্মিক তার থেকে অনেক বেশি অধাৰ্মিক। মানুষের সৌভাগ্য মানুষ বেশি ধর্ম সহ্য করতে পারে না, তাই বিকাশ ঘটেছে মানুষের। বেশি ধর্মে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, ধাৰ্মিক মানুষ অসুস্থ মানুষ। মানুষ যদি আপাদমস্তক-চব্বিশ ঘণ্টা, তিরিশ দিন, বারোমাস—ধাৰ্মিক প্রাণী হতো, আজো তাহলে থাকতো আদিম অবস্থায়। মানুষের মনের আদিম অংশটুকু ধর্ম। ধাৰ্মিক মানুষকে প্রশংসা করার একটা রীতি প্রচলিত রয়েছে; বলা হয় যে প্রকৃত ধাৰ্মিক মানুষ খুব ভালো মানুষ; কিন্তু সত্য তার উল্টো,—প্রকৃত ধাৰ্মিক মানুষ প্রকৃত খারাপ মানুষ। সে অবিকশিত, এবং মানুষের বিকাশের বিরোধী। হিন্দু, ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলমান যদি সবাই হতো প্রকৃত হিন্দু, ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলমান, তবে তারা আজো বাস করতো পাচ থেকে দেড় হাজার বছর আগের সমাজে। ধর্ম মানুষকে এগিয়ে দেয় নি, ধর্ম থাকা সত্ত্বেও মানুষ এগিয়েছে; কেননা মানুষ কখনোই পুরোপুরি ধাৰ্মিক নয়। মানুষ কখনো ধর্মের বিধান পুরোপুরি মানে নি। ধর্মের কোনো উপকারিতা দেখা যায় নি, কিন্তু অজস্র অপকারিতা সব সময়ই দেখা যায়। প্রত্যেক ধর্মের রয়েছে দুটি দিক;—ধর্মগুলো নিজেদের দায়িত্ব হিশেবে ব্যাখ্যা করে বিশ্বসৃষ্টির রীতি, এবং তৈরি করে সামাজিক বিধান। ধর্মের বইগুলো বিজ্ঞানের বই নয়, ওগুলো খুবই অবৈজ্ঞানিক। এগুলোতে বিশ্বসৃষ্টির যে-বর্ণনা পাওয়া যায়, তা পুরোপুরি ভুল; ওই বর্ণনা বইগুলো রচনাকালের মানুষের বিভ্রান্ত কল্পনামাত্র। বিশেষ এক ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠাই ধর্মপ্রবর্তকদের লক্ষ্য, তাই ধর্ম মূলত আদিম রাজনীতি। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি বর্ণনা ধর্মের এক প্রিয় বিষয়; এ-এলাকায় ধর্মগুলো মানুষকে লোভের পর লোভ আর ভয়ের পর ভয় দেখায়। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি সম্পর্কে ধর্মগুলো যা বলে, তা হাস্যকর, যাতে বিশ্বাস করতে পারে শুধু লোভী ও ভীত মানুষ। মানুষ সম্পর্কে খুবই নিম্ন ধারণা পোষণ করে ধর্মগুলো। ধর্মগুলো ধ’রে নিয়েছে যে মানুষ লোভী ও ভীত; তাই তাদের লোভ দেখাতে হবে, এবং রাখতে হবে সন্ত্রস্ত করে। ধর্মগ্রন্থ পড়ার সময় ধাৰ্মিক মানুষ বারবার লোভে পড়ে, আর ভয়ে কেঁপে ওঠে; তাই ধাৰ্মিক মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়, লোভ ও ভয়ের মধ্যে বাস ক’রে তারা হয়ে পড়ে বিকলনগ্রস্ত। ধার্মিকেরা খুবই অমানবিক, তারা নিজেদের ধর্ম ও ধর্মের বই ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম ও ধর্মের বইকে মর্যাদা দেয় না। এক ধর্মের ধাৰ্মিক অন্য ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ ও গৃহকে অবলীলায় অপমানিত করতে পারে, যা নাস্তিকেরা কখনো করে না। যে-কোনো নির্বোধের পক্ষে ধাৰ্মিক হওয়া সহজ, কিন্তু শুধু জ্ঞানী ও মানবিক ব্যক্তিই হতে পারে নাস্তিক। নাস্তিক হত্যা আর ধ্বংস করে না; কিন্তু ধাৰ্মিক সব সময় হত্যা ও ধ্বংসের জন্যে ব্যগ্র থাকে; তারা ইতিহাসের পাতাকে যুগে যুগে রক্তাক্ত করেছে। প্রত্যেক ধর্মে রয়েছে অসংখ্য সন্ত, যারা ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের হত্যাকারী। নাস্তিক চায় মানুষের চেতনাকে বদলে দিতে, মানুষকে বিকশিত করতে; আর ধাৰ্মিক চায় মানুষের চেতনাকে নষ্ট করতে, মানুষকে রুদ্ধ করতে। ধার্মিকদের নৈতিকতাবোধ খুবই শোচনীয়। বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন, তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন? তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতে পারতাম। তিনি তা করে নি কেনো? তবে কি তিনি একলা নন? ওই অলৌকিক জগতেও কি রয়েছেন বহু প্রতিদ্বন্দ যারা মানুষের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে ব্যগ্র? তাদের কেউ হিন্দুর, কেউ ইহুদির, কেউ খ্রিস্টানের, কেই মুসলমানের, এবং কেউ ঙ-র, কেউ চ-র, কেউ ছ-জ-ঝর? যদি তিনি একলা, তাহলে এতো ধর্ম পাঠিয়ে কেনো তিনি বিভ্রান্ত করছেন মানুষকে? শুধু বিভ্রান্ত ক’রেই তিনি সুখ পাচ্ছেন না; তিনি মানুষের মধ্যে তৈরি করেছেন বিভাজন—কাউকে করেছেন ইহুদি, কাউকে খ্রিষ্টান, কাউকে মুসলমান, কাউকে হিন্দু। কেনো এদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন শক্রতা, এবং লিপ্ত করেছেন পারস্পরিক হত্যাকাণ্ডে? আরো নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। তিনি কেনো শুধু এক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন? তিনি কেনো একজনের কাছে বাণী পাঠান? তিনি কেনো শুধু প্রাচীন কালেই দেখা দিতেন? কেনো তিনি দেখা দিচ্ছেন না আধুনিক কালে? আধুনিক কাল নিয়ে তার বা তাদের কোনো উদ্বেগ নেই? কেনো তিনি একদলকে গরু খেতে নিষেধ করেন, আরেক দলকে খেতে বলেন; কেনো তিনি একদলের জন্যে নিষিদ্ধ করেন মদ্য, এবং সিদ্ধ করেন আরেক দলের জন্যে? কেনো তিনি সর্বশক্তিমান হয়েও শক্তির প্রকাশ ঘটান না? তার ক্রিয়াকলাপ কেনো এতো বিস্ময়কর, অস্বাভাবিক, এবং সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস্য?
এসব সরল প্রশ্নের উত্তর ধর্মের বইগুলোতে পাওয়া যাবে না, কিন্তু পাওয়া যাবে যদি আমরা ধর্মের উদ্ভবের রীতি উদঘাটন করি। ধর্মগুলো কোনো অলৌকিক জগত থেকে কেউ পাঠায় নি, তেমন কেউ নেই; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীই সৃষ্টি করেছে এগুলো। কোনো পরম সত্তা যদি থাকতেন, এবং তিনি যদি পৃথিবীতে ধর্মের প্রয়োজন বোধ করতেন (সম্ভবত বোধ করতেন না, তুচ্ছ মানুষের তুচ্ছতর স্তব তার ভালো লাগতো না), তাহলে একটি ধর্মই পাঠাতেন তিনি। ধর্মগুলো বাতিল ক’রে দেয় একটি অন্যটিকে; একই সময়ে সবগুলো ধর্ম সত্য হতে পারে না। কোনো সত্যের থাকতে পারে না একাধিক ব্যাখ্যা বা তত্ত্ব; কোনো প্রপঞ্চের একাধিক তত্ত্ব পেলে বুঝতে হবে এগুলোর একটি ঠিক হতে পারে, বা সবগুলোই ভুল। বিভিন্ন প্রতিযোগী তত্ত্বের মধ্যে মাত্র একটিই ঠিক হতে পারে, বা ভুল হতে পারে সবগুলোই। ধর্মগুলো বিশ্বসৃষ্টি, মানবসমাজ, মানুষের পরিণতি সম্পর্কে প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রতিযোগী তত্ত্ব;–পরস্পরবিরোধী, ও ভুল। এজন্যেই বহু সরল প্রশ্নের উত্তর এগুলো দিতে পারে না; সাধারণত নিষেধ করে প্রশ্ন করতে। এগুলো কথা বলে এমনভাবে, যা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায় না। যা প্রমাণ ও অপ্রমাণ করা যায় না, তা অবৈজ্ঞানিক । ধর্মগুলো একদিনে দেখা দেয় নি; হঠাৎ কোনো ঈশ্বর কোনো ধর্ম পাঠান নি। মানুষ আদিম কাল থেকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে বিশ্বকে—বিশ্ব ও নিজের উদ্ভবকে, চারপাশের প্রপঞ্চরাশিকে; কিন্তু তখন তার সত্য উদঘাটনের শক্তির বিকাশ ঘটে নি; তাই সে সাহায্য নিয়েছে কল্পনার। সে অবিরাম ভুল কল্পনা করেছে, ভুল কল্পনার পর ভুল কল্পনাকে সত্য ব’লে বিশ্বাস করেছে, এবং বিকাশ ঘটিয়েছে বিচিত্র রকম ধর্মের। ধর্ম হচ্ছে আদিম ও ভুলবিজ্ঞান। আজ আমরা বজ্র আর বিদ্যুৎ ব্যাখ্যা করতে পারি; বিজ্ঞান বজ্রবিদ্যুতের সত্য বের করেছে; কিন্তু আদিম মানুষের পক্ষে এ-সত্য বের করা সম্ভব হয় নি। তারা কল্পনা করেছে দেবতা, আর দেবতাদের অস্ত্র। দেবতা, দেবতার অস্ত্র ইত্যাদি হচ্ছে আদিম মানুষের কল্পিত ব্যাখ্যা, যার মূলে কোনো সত্য নেই; কিন্তু এসব ভুলই গৃহীত হয়েছে ধর্মরূপে ।
আদিম মানুষ চারপাশের প্রপঞ্চ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বহু কাহিনী বা কিংবদন্তি তৈরি করেছিলো, বর্ণনা করেছিলো দেবতা বা অতিপ্রাকৃত সত্তার উপাখ্যান। আদিম মানুষের কল্পিত উপাখ্যানগুলোকে বলা হয় পুরাণ, এবং পুরাণ থেকেই হয়েছে ধর্মের উৎপত্তি। পুরাণ আদিম চিন্তাভাবনাকল্পনার ফল। বহু পৌরাণিক উপাখ্যান অত্যন্ত উপভোগ্য, এমনকি তাৎপর্যপূর্ণ; কিন্তু ওগুলো উপাখ্যান । পুরাণের এক উদ্দেশ্য ছিলো মানুষের সাথে মহাজগতের সম্পর্ক ব্যাখ্যা; পুরাণরচয়িতারা তা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে অনেকের কাছে এপুরাণই হয়ে ওঠে ধর্ম। আমাদের চারপাশের বড়ো ঘটনাগুলোকেও আমরা মহাজগতের সাথে জড়িত করি না; কিন্তু আদিম মানুষের স্বভাবই ছিলো জীবনে তুচ্ছতম ব্যাপারটিকেও মহাজগতের সাথে জড়িয়ে দেয়া। দাতের পোকা তাড়াতেও তারা এমন সব মন্ত্র আবৃত্তি শুরু করতো, যেনো ওই পোকার সাথে মহাজাগতিক বিশাল সব ব্যাপারের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পুরাণ ভরে পাওয়া যায় বিভিন্ন দেবতার জন্মের বিবরণ, তাদের শক্তি ও স্বভাবের কথা, বিশ্বসৃষ্টির উপাখ্যান। বিভিন্ন পুজো আর অর্চনার কারণও বর্ণনা করা হয় পুরাণে । পুরাণের গল্পগুলোতে পাওয়া যায় আদিম যুক্তি-অবিকশিত মানুষের মনের পরিচয় । পুরাণ যুক্তিপরায়ণ মনের সৃষ্টি নয়; সহজেই বোঝা যায় যে পুরাণগুলো এসেছে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে থেকে। আমরা পৌরাণিক উপাখ্যানগুলোকে গল্প বলে মনে করি, সত্য মনে করি না; এবং জেসাসের, যদি সত্যিই জেসাস ব’লে কেউ জন্ম নিয়ে থাকেন, জন্মের বহু আগেই অনেকের কাছে এগুলো গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। তাই অনেক ধর্মপ্রণেতা, পুরোহিত, এবং কবি এগুলোকে গ্রহণযোগ্য রূপ দিতে চেয়েছেন। থিআগেনেস (৫২০ খ্রিপূ) অশোভন মনে করেছেন গ্রিক পুরাণের দেবতাদের যুদ্ধবিগ্রহ ও অন্যান্য কার্যকলাপ; তার মতে দেবতারা এমন অশোভন কাজ করতে পারেন না। ইন্দ্র আর জিউস যতো নারী ধর্ষণ করেছে, কোনো পুরুষ ততো করার স্বপ্নও দেখে নি। তিনি দেবতাদের যুদ্ধবিগ্রহকে ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্ন মৌল উপাদানের, আগুন-বাতাস-জলের, সংগ্রামের রূপকরূপে। বাইবেল বলেছে বিধাতা নিজের আদলে মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আসলে মানুষ নিজের আদলে সৃষ্টি করেছে দেবতাদের। জেনোফানেস পছন্দ করেন নি মানুষ আকৃতির দেবতাদের। তার মতে: ঈশ্বর একজনই, যিনি শ্রেষ্ঠ দেবতা আর মানুষদের মধ্যে; অবয়ব আর চিন্তা কোনো কিছুতেই তিনি মানুষের মতো নন, তবু মানুষ কল্পনা করে যে দেবতারা মানুষের মতোই জন্মেছে, এবং তাদের অবয়ব আর কণ্ঠস্বর মানুষেরই মতো। যদি বৃষ, সিংহ, আর অশ্বরা মূর্তি বানাতে পারতো, তবে তারাও নিজেদের অবয়বের মতোই বানাতো দেবতাদের মূর্তি।
প্রাচীন মিশরিরাও বিস্মিত হতো যে তাদের অধিকাংশ দেবতাই পশু । তারা এটা মেনে নিতে পারতো না; এবং ব্যাখ্যা করতো যে দেবতারা পশু নয়, শুধু বিপদের সময়েই দেবতারা আশ্রয় নিতো নানা পশুর শরীরে ।
ম্যাক্স মুলার পুরাণরচয়িতাদের মনে করেছিলেন উন্মাদ । পুরাণে আদিম অযৌক্তিক উপাদানের প্রাচুর্য দেখে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, মানবজাতির জীবনে এসেছিলো এক অস্থায়ী পাগলামোর কাল; তারা ভুগেছিলো পাগলামো রোগে । একই পাগলামোতে কি ভুগেছিলো ভারত, গ্রিস, মিশর, ব্যাবিলন, প্যালেস্টাইন, আর আইসল্যান্ডের আদিম মানুষ? পুরাণকে কি মনে করবো পাগলামো? পুরাণের অযৌক্তিকতা পাগলামো নয়; তারা পাগল ছিলো না, ছিলো অবিকশিত। পুরাণ অবিকশিত মনের মানুষের সৃষ্টি। তাদের মনের বিকাশ ঘটে নি, যেমন আজো অধিকাংশের মন অবিকশিত রয়ে গেছে। তাদের অভিজ্ঞতা ছিলো কম, এবং ছিলো না বিজ্ঞানসম্মত, বস্তুনিষ্ঠ, ব্যাখ্যার মননশীলতা, যেমন আজো নেই অধিকাংশের। তারা বিভিন্ন প্রপঞ্চ যুক্তিসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করতে না পেরে ব্যাখ্যা করেছিলো আদিম কল্পনার সাহায্যে; সত্য আবিষ্কারের বদলে তারা বানিয়েছিলো কল্লোপাখ্যান। তারা ছিলো মানসিক শৈশবে, যেমন আজো আছে অধিকাংশ। তারা মনে করেছিলো প্রকৃতির শক্তিগুলো মানুষের মতোই; সেগুলো মানুষের মতোই কথা বলতে, কাজ ও চিন্তা করতে পারে। এরকম বিশ্বাসকে বলা হয় “অয়ানিমিজম বা সর্বাত্মাবাদ” যা বিশ্বাস করে প্রত্যেক বস্তুর আছে আত্মা । তারা মনে করেছিলো বাতাস, জল, আর গাছ কথা বলে; তারা বিশ্বাস করেছিলো যে আকাশ ভরে রয়েছে দেবতা। তারা যা দেখেছিলো, তা ব্যাখ্যার জন্যে যুক্তির সাহায্য নেয় নি, সাহায্য নিয়েছিলো কল্পনার। সব দেশের পুরাণের উপাখ্যানেই মেলে মানুষের বর্বরতার কালের পরিচয় । মানুষের প্রথম উদ্ভাবিত ধর্ম সর্বাত্মাবাদ। তারা বিশ্বাস করতো সব কিছুরই আত্মা আছে, যদিও আজ আত্মা ব’লে কিছু আমরা মানি না। সর্বাত্মাবাদী পুরাণে পাওয়া যায় আত্মা সম্পর্কে আদিম ভাবনার স্পষ্ট পরিচয়। পাওয়া যায় অনেক গল্প, যাতে কেউ ভূতপ্রেতের দেশে যায়, বা যায় এমন দেশে, যেখানে পশুপাখি কথা বলে, যেখানে মানুষকে রূপান্তরিত করা হয় পশু বা গাছে। সর্বাত্মাবাদী বিশ্বাসে আত্মা আর শরীরের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য, যা টিকে আছে আজো সমস্ত ধর্মে। আজ বিজ্ঞান আত্মা মানে না, কিন্তু সাধারণ বিশ্বাসে আদিম বিশ্বাস এখনো টিকে আছে। বলা হয় ফেট’জম বা যদুবাদ বা ইন্দ্রজলবাদ। আদিম মানুষ বিশ্বাস করতো যে অনেক বস্তুর রয়েছে যাদুশক্তি। আফ্রিকা, এশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, অর্থাৎ সব করতো কোনো কোনো বস্তুতে বাস করে কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তি। যাতে অতীন্দ্রিয় শক্তি বাস করে, সেটি যাদুবস্তু; যেমন কোনো অস্থি, বা পাথর, বা একগুচ্ছ পালক, বা ঝিনুকের মালা, বা অন্য কিছু। তারা বিশ্বাস করতো কোনো কোনো ব্যক্তি ওই বস্তুতে ডেকে আনতে পারে ওই বস্তুটির সাথে জড়িত অলৌকিক সত্তাটিকে, জিন বা দৈত্যকে, বা ওই সত্তাটি সব সময়ই থাকে ওই বস্তুটিতে। যাদুবাদ আজো টিকে আছে পৃথিবী জুড়ে। যাদুবাদের যাদুবস্তুতে যে-সত্তাটি বাস করে, সেটি হচ্ছে প্রেত। প্রেত দেবতা নয়, প্রেত আর দেবতার মধ্যে রয়েছে পার্থক্য; তবে প্রেত এক সময় হয়ে উঠতে পারে দেবতা। প্রেত আর দেবতার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে দেবতার থাকে ভক্ত, তার পুজো করা হয়; আর যাদুবাদের প্রেত থাকে কোনো ব্যক্তি বা গোত্রের অধীনে; যেমন আরব্যরজনীর প্রেত। সেটি দেবতা নয়, ভৃত্য; প্রদীপটি, অর্থাৎ যাদুবস্তুটি যার অধিকারে থাকে, সে হয় তার গোলাম। তবে অনেক সময় যাদুবাদের প্রেত হয়ে উঠতে পারে দেবতা। যাদুবাদের পর মানুষ পৌছে ধর্মের আরেক স্তরে, যার নাম টোটেমিজম বা উৎসবস্তুবাদ। টোটেম হচ্ছে কোনো পশু, বা উদ্ভিদ, বা বস্তু, যা কোনো সামাজিক শ্রেণীর সাথে সম্পর্কিত। টোটেমবাদে বিশেষ বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর নাম হয়ে থাকে সম্পর্কিত টোটেমের নাম অনুসারে; তারা নিজগোত্রের প্রতীক হিশেবে ব্যবহার করে টোটেমটিকে। ওই গোত্রের লোকেরা মনে করে যে তারা ওই টোটেম প্রাণী বা উদ্ভিদ বা বস্তুটি থেকে জন্মেছে, এবং টোটেমটি তাদের জন্যে পবিত্র। পুরাণে পাওয়া যায় টোটেমের প্রচুর উদাহরণ। এর পর মানুষ সৃষ্টি করে দেবতা; দেবতা এবং দেবতা এবং দেবতা; এবং দেখা দেয় বহুদেবতাবাদ বা বহুঈশ্বরবাদ বা বহুভগবানবাদ । বহুদেবতাবাদে দেবতারা পরিপূর্ণ বিকশিত, ও তারা শক্তিমান। দেবতারা শক্তিমান হ’লেও স্তরক্রম অনুসারে। বহুদেবতাদের বিকাশ ঘটে নানা পথে। আদিম মানুষ দেবতার পর দেবতা তৈরি করে, দেবতাদের দেয় বিভিন্ন ভূমিকা বা দায়িত্ব, এবং তাদের পুজো করে; অনেক সময় একদল দেবতার কিছু কিছু শক্তি কমিয়ে ওই শক্তি অন্য দেবতার ওপর অর্পণ করে তৈরি করে নতুন দেবতা, বা পুরোনো দেবতাদের ঔরসে জন্ম দেয়া হয় নতুন দেবতাদের। কখনো কোনো দেবতা হয়ে ওঠে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোনো দেবতা হারিয়ে ফেলে তার গৌরব; এতে ওই দেবতা কোনো ভূমিকা পালন করে না, ভূমিকা পালন করে মানুষ। মনে করা যাক কোনো নগরে বা ধর্মকেন্দ্রে পূজিত হতো কয়েকটি দেবতা; কিন্তু তাদের মধ্যে কে বড়ো কে ছোটো তা ছিলো অনিণীত। দেবতারা নিজেরা যুদ্ধ করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতো না; পুরোহিতেরাই দেবতাদের নানাভাবে বিন্যস্ত করে সৃষ্টি করতো দেবমণ্ডলী। দেবতাদের ভাগ্য পুরোপুরি নির্ভর করতো ভক্তদের ওপর। ভক্তরা তাদের দেবতাদের ভূষিত করতো নানা গুণে, অনেক সময় ভুল বুঝে বদল ঘটাতো দেবতাদের নামের। তারপর ছিলো ভক্ত রাজাদের উত্থানপতন, ভক্তদের দেশত্যাগ, জয় আর পরাজয়, এবং নতুন জাতির সংস্পর্শ। কোনো ভূভাগের রাজা পুজো করতো যে-দেবতাদের, তারা হতো প্রধান দেবতা; অন্য দেবতাদের ভক্ত যখন তাকে পর্যুদস্ত ক’রে রাজা হতো, তখন পর্যুদস্ত হতো আগের রাজকীয় দেবতারা, শক্তিমান আর প্রধান হয়ে দেখা দিতো নতুন রাজার দেবতারা। দেবতাদের ভাগ্য নির্ভর করতো ভক্তদের ভাগ্যের ওপর। দেবতারা ভক্তদের ভাগ্য কখনো নির্ধারণ করে নি, চিরকাল ভক্তরাই নির্ধারণ করেছে দেবতাদের ভাগ্য। বিধাতারা কখনো নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে নি, ভক্তরাই বিস্তার করেছে তাদের বিধাতাদের সাম্রাজ্য।
মানুষ উৎপাদন করেছিলো অজস্র দেবতা। এক সময় তারা আকাশমণ্ডল ভরে ফেলেছিলো দেবতায়; এবং তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো নানা বিভাগের দায়িত্ব। কাউকে দেয়া হয়েছিলো অগ্নিবিভাগের দায়িত্ব, সে অগ্নিদেবতা; কাউকে জলবিভাগের দায়িত্ব, সে জলদেবতা; এভাবে দেখা দিয়েছিলো বায়ুদেবতা, বজ্রদেবতা, মাটির দেবতা, মদের দেবতা, শস্যের দেবতা, এবং শিল্পকলা, শিক্ষা, ধন ও আরো অসংখ্য বিভাগের দেবতা। ঋগ্বেদ এর ঋষিরা তৈরি করেছিলো ৩৩টি দেবতা;—১১টি পৃথিবীতে, ১১টি অন্তরীক্ষে, ১১টি স্বর্গে; তারপর বিভিন্ন বস্তুর অধিপতি হিশেবে কল্পনা করেছিলো ৩৩ কোটি দেবতা। তারা এসব দেবতা জন্যেই। তারা চারপাশের সব কিছুকে নিজেদের কল্যাণের জন্যে ব্যবহার করতো, এবং বিশ্বাস করতো ওই সব কিছুরই দেবতা রয়েছে, তাই দেবতাদের পুজো করলে দেবতারা তাদের জীবনকে সম্পদে ভ'রে দেবে। দেবতাদের সাথে তাদের থাকতো একটি চুক্তি, চুক্তিটি হচ্ছে দেবতারা তাদের অন্ন দেবে, বিনিময়ে তারা দেবে দেবতাদের অর্ঘ্য । তাদের কয়েকটি দেবতার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আজ আমরা জানি সূর্যই পার্থিব সব কিছুর উৎস; আদিম মানুষেরাও সূর্যকেই মনে করতো জীবনের উৎস বলে। তবে তারা আজকের মতো জানতো না, তারা জানতো তাদের মতো করে। সব দেশে পুরাণেই দেবমণ্ডলীর মধ্যে সূর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে। সর্বাত্মাবাদীরা মনে করতো মানুষের মতোই সূর্যের আছে প্রাণ ও ইচ্ছাশক্তি, তাই সে চলতে পারে। বৈদিকরা সূর্যশ্রেণীতে সৃষ্টি করেছিলো বহু দেবতা : আদিত্য, মিত্র, বরুণ, পূষা, ভগ, অশ্বিনীকুমার, সবিতা প্রভৃতি। গ্রিকরা দুটি সূর্যদেবতা সৃষ্টি করেছিলো, একটি অ্যাপোলো, আরেকটি সূর্য নিজে, যার নাম হেলিওস। অ্যাপোলো তিমিরবিনাশী দেবতা, যে সোনালি তীরের আঘাতে হত্যা করে রাত্রির সাপ পাইথনকে, এবং তার এক কাজ হচ্ছে সভ্যতার বিকাশ ঘটানো। পৃথিবী জুড়েই পাওয়া যায় সূর্যদেবতা—ইন্দ্র, ক্যাডমাস, হোরাস প্রভৃতি, এবং তাদের উদ্ভবের উপাখ্যানের মধ্যেও মিল রয়েছে। সূর্যদেবতার মতো বজ্রদেবতাও পাওয়া যায় পৃথিবী ভরে।