Saturday, August 6, 2016

অভিজিৎ বচনী।

আজ ১২ই ফেব্রুয়ারি, ডারউইন দিবস।
পৃথিবীতে খুব কম বৈজ্ঞানিক ধারণাই জনসাধারণের মানসপটে স্থায়ীভাবে বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব এমনি বিপ্লবী তত্ত্ব, তেমনি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইন আর রাসেল ওয়ালেস প্রস্তাবিত বিবর্তনতত্ত্ব। এই তত্ত্বই আমাদের শিখিয়েছে যে, কোন প্রজাতিই চিরন্তন বা স্থির নয়, বরং আদিম এক কোষী প্রাণী থেকে শুরু করে এক প্রজাতি থেকে পরিবর্তিত হতে হতে আরেক প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে, আর পৃথিবীর সব প্রাণীই আসলে কোটি কোটি বছর ধরে তাদের পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে। ডারউইন শুধু এ ধরনের একটি বিপ্লবাত্মক ধারণা প্রস্তাব করেই ক্ষান্ত হননি, বিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটি (প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে) কিভাবে কাজ করে তার পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন সবিস্তারে, প্রথমবারের মত ১৮৫৯ সালে ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বা ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’ বইয়ে। খুব অবাক হতে হয় এই ভেবে, যে সময়টাতে সৃষ্টি রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে প্রায় সকল বিজ্ঞানী আর দার্শনিকই সবে ধন নীল-মনি ওই বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ে মুখ থুবরে পড়ে ছিলেন আর বাইবেলীয় গণনায় ভেবে নিয়েছিলেন পৃথিবীর বয়স সর্বসাকুল্যে মাত্র ৬০০০ বছর আর মানুষ হচ্ছে বিধাতার এক ‘বিশেষ সৃষ্টি’, সে সময়টাতে জন্ম নিয়েও ডারউইনের মাথা থেকে এমনি একটি যুগান্তকারী ধারণা বেরিয়ে এসেছিলো যা শুধু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকেই তরান্বিত করেনি, সেই সাথে চাবুক হেনেছিলো আমাদের ঘারে সিন্দাবাদের ভুতের মত সওয়ার হওয়া সমস্ত ধর্মীয় সংস্কারের বুকে। দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট বিবর্তনতত্ত্বকে ‘ইউনিভার্সাল এসিড’ বা রাজাম্ল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ইউনিভার্সাল এসিড যেমন তার বিধ্বংসী ক্ষমতায় সকল পদার্থকে পুড়িয়ে-গলিয়ে ছারখার করে দিতে পারে, তেমনি ডারউইনের বিবর্তনবাদী তত্ত্ব সমস্ত প্রথাগত ধর্মীয় ধ্যান ধারণা আর কুসংস্কারকে একেবারে দুর করে দিতে পারে। ‘ডারউইনের বুলডগ’ বলে কথিত বিজ্ঞানী টি এইচ হাক্সলি ডারউইনের ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বইটিকে নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়ার’ পর জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘মহাস্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন; আবার সেই সাথে আবার দুঃখও করেছিলেন এই ভেবে – ‘এতোই নির্বোধ আমি যে এত সহজ ব্যাপারটা আগে আমার মাথায় আসেনি।’ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মায়ার বলেছেন, ‘ডারউইনিয় বিপ্লব যে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণা – এটি যে কারো পক্ষে খণ্ডন করা কঠিনই হবে।’ জীববিজ্ঞানী স্টিফেন জে গুল্ড মনে করতেন তাবৎ পশ্চিমা বিশ্বের আধা ডজন বাছা বাছা তত্ত্বের মধ্যে ডারউইনের তত্ত্ব থাকবে শীর্ষস্থানে। আর অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স তো মনেই করেন যে, শুধু পৃথিবী নয় সমগ্র মহাবিশ্বে কোথাও প্রাণের বিকাশ ঘটলে তা হয়ত ডারউইনীয় পদ্ধতিতেই ঘটবে, কারণ ডারউইনীয় বিবর্তন সম্ভবতঃ একটি ‘সার্বজনীন সত্য’। সমগ্র মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে ‘সার্বজনীন সত্য’ কিনা তা এখনো প্রমাণিত না হলেও স্বীকার করে নিতেই হবে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব আর এর নান্দনিক বিকাশকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের চেয়ে ভাল কোন তত্ত্ব এ মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী এবং আধুনিক বিবর্তনবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা থিওডসিয়াস ডাবঝানস্কি বলেছেন যে, ‘ডারুইনীয় বিবর্তনের আলোকে না দেখতে পারলে জীববিজ্ঞানের কোন কিছুরই অর্থ হয় না।’ দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট এজন্যই বোধ হয় বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণাটির জন্য কাউকে পুরস্কৃত করতে বলা হয়, আমি নিউটন, আইনস্টাইনদের কথা মনে রেখেও নির্দ্বিধায় ডারউইনকেই বেছে নেব।’ কাজেই ডারউইন দিবস আমাদের জন্য ডারউইনের দীর্ঘ শশ্রুমন্ডিত মুখচ্ছবির কোন স্তব নয়, বরং তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের যথাযথ স্বীকৃতি, তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের প্রতি নির্মোহ আর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বিবর্তন সংক্রান্ত কয়েকটি জনপ্রিয় বাংলা বই যা মেলায় পাওয়া যায় -
* বিবর্তনের পথ ধরে, বন্যা আহমেদ [অবসর]
* ডারউইন একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা (সম্পাদনা অনন্ত বিজয়) [অবসর]
* জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ, ফ্রান্সিসকো জে আয়লা (ভাষান্তর অনন্ত বিজয় দাশ, সিদ্ধার্থ ধর) [চৈতন্য]
* বিবর্তনের পথে ইতিহাসের বাঁকে, আসিফ [তাম্রলিপি]
* জৈববিবর্তনবাদ: দেড়শ বছরের দ্বন্দ্ব বিরোধ মনিরুল ইসলাম(সংহতি)
* কেমন করে মানুষ এলো খন্দকার মাহমুদুল হাসান [কথা প্রকাশ]
* মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে অভিজিৎ রায় এবং ফরিদ আহমেদ [অবসর]
* ডারউইন : বিগল যাত্রীর ভ্রমণকথা দ্বিজেন শর্মা [ সাহিত্য প্রকাশ]
* চার্লস ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি দ্বিজেন শর্মা [ সাহিত্য প্রকাশ]
এছাড়া অন্যান্য-
* ডারউইন থেকে ডিএনএ, নারায়ন সেন (আনন্দ)
* বিবর্তনবিদ্যা, ড ম আখতারুজ্জামান (বাংলা একাডেমী)
* প্রজাতির উৎপত্তি, ড ম আখতারুজ্জামান (বাংলা একাডেমী)
* প্রাণের রহস্য সন্ধানে বিজ্ঞান, অপরাজিত বসু (শ্রীভূমি)
* জীবনের রহস্য সন্ধানে, মৃত্যুঞ্জয় প্রসাদ গুহ (শৈব্যা)
* চার্লস ডারউইন ও বিবর্তনবাদ, সুশান্ত মজুমদার (শৈব্যা)
* কোষ বংশবিদ্যা, ড ম আখতারুজ্জামান (হাসান বুক হাউজ)
ইত্যাদি...

১০ ফেব ২০১৫
দেশের বাইরে থাকায় বইমেলা মিস করি সব সময়ই। কখন কোন বই আসে জানতেও পারি না। frown emoticon যাহোক, গতকাল লোকজনের স্ট্যাটাস আর ট্যাগানো ছবি থেকে জানলাম ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে বইটা মেলায় চলে এসছে। আজ তো দিন শেষ, পাঠকেরা চাইলে আগামীকাল ঢু মারতে পারেন - অবসর প্রকাশনার স্টলে [স্টল নং: ১৭৮-১৮১]। আর যারা আমার মতোই বইমেলায় যেতে পারছেন না, তারা চাইলে অনলাইনে বইটা কিনতে পারেন; অর্ডার দিন 'পড়ুয়া' নামের নান্দনিক সাইটটি থেকে। বইটির সাথে যারা জড়িত ছিলেন, যারা কিনেছেন, কিংবা বইটির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি !

৯ ফেব ২০১৫
পত্রিকায় দেখলাম, এ বছর একুশে পদক পেতে যাচ্ছেন প্রকৃতিপ্রেমী দ্বিজেন শর্মা। বাংলাদেশের মত 'অদ্ভুত উটের পিঠে চলা দেশে' বিবর্তনবাদ প্রসারে যে ক' জন ব্যক্তি নিরলসভাবে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে দ্বিজেন শর্মা অন্যতম। এ ছাড়া শিক্ষক হিসেবে, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসেবে, অনুবাদক হিসেবে, সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার ক্ষেত্রে তো তার অবদান আছেই। আমার মনে আছে - আমার এবং ফরিদ আহমেদের লেখা 'মহাবিশ্বে প্রাণ এবং বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' এবং বন্যার 'বিবর্তনের পথ ধরে' বই দুটো যখন প্রথম বইমেলায় বেরিয়েছিল ২০০৭ সালে, দ্বিজেন শর্মা নিজের উদ্যোগেই বই দুটোর চমৎকার একটা রিভিউ করেছিলেন, সেটা বেরিয়েছিল প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী বিভাগে। তখন আমি ভদ্রলোককে চিনতামও না। পত্রিকা খুলে রিভিউ পড়ে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। রিভিউটি রাখা আছে এখানে, পাঠকেরা পড়ে নিতে পারেন, নিঃসন্দেহে পস্তাবেন না। পরের বছর এক সময় দেশে গিয়ে উনার সাথে আলাপ করেছিলাম। ভদ্রলোকের বাসায় গিয়েছিলাম আমি আর বন্যা। সঙ্গে ছিলেন বিজ্ঞান বক্তা আসিফ। ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। বড় মানুষ হতে হলে মিথ্যে অহমিকা যে বাদ দিতে হয়, তা দ্বিজেন শর্মাকে দেখেই অনুভব করেছিলাম সেদিন। একুশে পদক প্রাপ্তিতে দ্বিজেন শর্মাকে অভিনন্দন এবং শ্রদ্ধা!

৪ ফেব ২০১৫
গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে গেলেও অনেক সময় টনক নড়ে না, নড়ে কেবল নিজে অসুস্থ হলে কিংবা পরিবারের কাউকে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যেতে দেখলেই। আইসিসের ব্যাপারে জর্ডনের প্রতিরোধের কারণ এখানেই। তবে কারণ যাই হোক, আর যেভাবেই হোক, জিহাদী ভাইরাসের এন্টিবডি তৈরি হোক, ছড়িয়ে পড়ুক, এটাই এখন কাম্য। সভ্যতা বাঁচুক এই সব উগ্র বিশ্বাসের মহামারীর হাত থেকে।

৩০ জান ২০১৫
আগে একবার বলেছিলাম যে, একটি সার্থক সুরেলা সঙ্গীতের পেছনে শুধু কণ্ঠশিল্পীরই অবদান থাকে না, থাকে গীতিকারের, থাকে যন্ত্রীদের কুশলী অবদানও। কিন্তু বহু সময়েই এই পেছনের মানুষদের অবদান অনুচ্চই থেকে যায়। গানের মতো একটি বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও কেবল একজন লেখকের অবদানটাই সামনে আসে, কিন্তু একটি বইয়ের পেছনে নীরবে কাজ করা বহু মানুষের অবদান হয়তো অতল গহ্বরে হারিয়েই যায়। একটা বই নিয়ে কাজ করছিলাম। ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’। নানা কারণেই গতবছরটা ছিল আমার জন্য ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। বিষাদময়। জীবনের রঙগুলো যেন ধূসর হয়ে আসছিল ক্রমশঃ। নিজের সাথে যুঝতে যুঝতে হয়ে পড়েছিলাম একেবারেই ক্লান্ত, অবসন্ন। ... কাঠখোট্টা বিজ্ঞানের লেখা থেকে সরিয়ে তাই রবীন্দ্র-সরোবরে অবগাহন। দুর্দিনে দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের জন্য আছেই বা কে? এরই মধ্যে গত বছরের জুন মাসে আর্জেন্টিনা এবং পেরুতে সপ্তাহ খানেক থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এক ফাঁকে ঢু মেরেছিলাম আর্জেন্টিনার ‘রবি-তীর্থে’ অর্থাৎ, রবিঠাকুরের আর্জেন্টিনীয় বান্ধবী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়ি ‘ভিলা ওকাম্পো’তে। আমার মেয়েকে নিয়ে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছিলাম সে বাড়িতে। বার হাজারের ওপর বইপত্র, নানা পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র এবং ভিক্টোরিয়ার প্রকাশিত পত্রিকার পুরনো সংখ্যা এবং সে বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে আপ্যায়িত মনীষীদের ছবি সম্বলিত সেই বাড়ি দর্শনের অভিজ্ঞতাটা অনেকটা তীর্থস্থান ভ্রমণের সাথে তুলনীয় ছিল যেন। তারই ফসল এ বই। বইয়ের কাজ প্রায় শেষ আশা করছি এ বই মেলার প্রথমেই দেখা যাবে বইটা। প্রকাশক অবসর।
তবে আমি বইটি লিখলেও এর জন্য আমি ঋণী অনেকের কাছেই। বইয়ের পেছনের কুশীলব আমি নই, অন্য অনেকেই। আমি একে একে সবার কথা বলব বলে মনস্থ করেছি। এর আগের স্ট্যাটাসে আসমা সুলতানা মিতার (Asma Sultana Mita) কথা উল্লেখ করেছিলাম। আজ উল্লেখ করব বিডিআর্টসের সম্পাদক রাজু আলাউদ্দিনের (Razu Alauddin ) কথা। রাজু আলাউদ্দিনের পরিচিতি অনেক। তিনি কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, এবং দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্য বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। খুব ভাল স্প্যানিশ জানেন, সে ভাষা থেকে বাংলায় প্রচুর অনুবাদও করেছেন আমাদের জন্য। এই বইমেলাতেই তাঁর নিজেরই চমৎকার ভূমিকা লিখে আমাকে অসীম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন তিনি। তার ভূমিকাটি পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি –

********
ভূমিকা
বিক্তেরিয়া [ইংরেজি উচ্চারণে ভিক্টোরিয়া] ওকাম্পোর (১৮৯০-১৯৭৯) মৃত্যুর সাড়ে তিন মাস পরে এক স্মরণসভায় হোর্হে লুইস বোর্হেস, স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি জানি বিক্তোরিয়া ওকাম্পো ইউরোপের বিচিত্র সংস্কৃতিকে অনুভব করতেন। রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে, দর্শনের মাধ্যমে, কিপলিং-এর মাধ্যমে তিনি ভারতকেও অনুভব করেছিলেন। অর্থাৎ প্রাচ্যকে অনুভব করেছিলেন।” (“Yo se que Victoria Ocampo sentia las viversas culturas de Europa. Sintio tambien, a traves de la filosofia, atraves de Kipling, sintio tambien a la India, es decir sintio al Oriente.” -Borges en sur: 1931-1980, Jorge luis Borges, Emece, Buenes Aires 1999 P-329)
বিক্তোরিয়া ওকাম্পো - যিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বিজয়া’ হিসেবেই আমাদের কাছে সর্বাধিক পরিচিত - লাতিন আমেরিকার সেই গায়ক পাখি যার আতিথ্যপূর্ণ ও রুচি-স্নিগ্ধ স্বরগুচ্ছের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন সমকালের শীর্ষ ব্যক্তিদের অনেকেই : হোসে অর্তেগা ই গাসেৎ, হেরমান কাইজারলিং, ইগর স্ত্রাভিনস্কি, অলডাস হাক্সলি, আঁদ্রো মালরো, গ্রাহাম গ্রিন, এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সংস্কৃতির নানান ক্ষেত্রের এইসব নক্ষত্রের আলো ও উত্তাপে তার আত্মা ছিলো উজ্জীবিত। ইউরোপের প্রধান তিনটি ভাষা আয়ত্তে থাকার কারণে সেখানকার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার যাতায়াত ছিলো অবাধ। অন্যদিকে, প্রাচ্য সম্পর্কে তার উৎসুক্য ছিলো এতটাই গভীর যে তার অদৃশ্য তৃষ্ণার তোরে ভাষার বাধাও প্লাবিত হয়ে গেছে। তাই প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করতে গিয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। (“Mas que leerlo, habia llorado sobre el” - Autobiografia, Vol-iv, Victoria Ocampo, sur, Buenos Aires, 1982, p-18.) প্রতীচ্যের দান্তে, বোদলেয়ার, ভার্জিনিয়া উলফে তিনি পেয়েছিলেন ক্ষুধার্ত আত্মার জন্য অমেয় ভোজ, তেমনি রবীন্দ্রনাথেও তিনি পেয়েছিলেন অনুরূপ আয়োজন। তার একটি ডানা যদি হয়ে থাকে প্রতীচ্য, তবে অন্যটি প্রাচ্য। যদিও এই প্রাচ্যকে তিনি অনুভব করেছিলেন মূলত গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই।
১৯২৪ সালে ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ ছিল একেবারেই আকস্মিক, কিন্তু উভয়ের জীবনেই এই সাক্ষাতের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী ও গভীর। কেন সুদূর প্রসারী ও গভীর সেটার ব্যাখ্যা দেয়ার আগে আরেকটু বিশদভাবে জানা দরকার ওকাম্পোর জীবনের পরম্পরাটুকু।
যে সময়ে ও সমাজে এবং যে দেশে ও সংস্কৃতিতে, এমনকি যে মহাদেশে ওকাম্পোর আবির্ভাব তা প্রথা, কুসংস্কার ও নারীবিরোধী বিশ্বাসে ছিলো পশ্চাৎপদ। ওকাম্পোর কর্মজীবনের সূচনায় যে একেবারে কোথায়ও কোনো প্রথাদ্রোহী স্ফুলিঙ্গ ছিলো না তা নয়, তবে তা সহস্র শিখায় জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। ‘Sur’ আর তার নিজস্ব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি সেই সহস্র শিখার উত্তাপ ও আলোকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার মতো এক বিশাল ভূখণ্ডে।
রবীন্দ্রনাথের মতই ওকাম্পোও ছিলেন বনেদী পরিবার থেকে আসা। দুজনেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেই গড়ে উঠেছিলো সংস্কৃতি ও শিক্ষাদীক্ষার এক অবারিত পরিমণ্ডল। বহু-সংস্কৃতির উদার আপ্যায়নে ওকাম্পো কেবল নিজেকেই নয়, চেয়েছিলেন সে ভোজ সভায় তার জাতির সবাইকে শামিল করতে। বোর্হেস অন্যত্র যে বলেছিলেন “তিনি নিজের দেশ এবং নিজের মহাদেশকে শিক্ষিত করেছেন।” (Ella educo a su pais y a su continente) - তা মোটেই বাড়িয়ে বলেন নি।
নারীর অধিকার ও নারীর ভূমিকা নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি বিশুদ্ধ সাহিত্যিক প্রেরণা থেকে ওকাম্পো লিখেছেন দান্তে ও ভার্জিনিয়া উলফকে নিয়ে। অনুবাদ করেছেন আববেয়ার ক্যামু, গ্রাহাম গ্রিন, ডি এইচ লরেন্স, ডিলান টমাস প্রমুখ। নিজে লিখেই কেবল দায়িত্ব পালন করেননি, এমনকি তরুণ লেখকদের নতুন ভাবনা ও সৃষ্টির ধাত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ‘সুর’ নামক অসাধারণ এক পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। এই পত্রিকাটি কেবল লাতিন আমেরিকারই নয়, হয়ে উঠেছিল বিশ্বের অন্যান্য ভাষার বহু লেখকের জন্যই এক মিলনমঞ্চ। বিভিন্ন সময় এ পত্রিকায় লিখেছেন হোর্হে লুইস বোর্হেস, আদোল্ফো বিয়ই কাসারেস, হোসে বিয়াংকো, ওয়াল্ডো ফ্রাংক, আল্ফন্সো রেইয়েস, টমাস মান, টি এস এলিয়ট, আঁদ্রে মালরো, হেনরি মিলার, অক্তাবিও পাস, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের মতো লেখকরা, যাদের কেউ কেউ সম্মানিত হয়েছেন নোবেল পুরস্কারে। বহুকাল পরে, অক্তাবিও পাস ‘সুর’ পত্রিকার সাংস্কৃতিক ভূমিকার গুরুত্ব স্মরণ করতে গিয়ে বলেছিলেন “‘সুর’ কেবল একটি পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠানই নয়, এ হচ্ছে আত্মার এক ঐতিহ্য...(বিক্তোরিয়া) যা করেছেন তা আমেরিকায় আগে আর কেউই করেননি।”( Sur no es sólo una revista o una institución: es una tradición del espíritu... [Victoria] ha hecho lo que nadie antes había hecho en América) চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রবহমান এই পত্রিকাটি কেবল আর্হেন্তিনাতেই নয়, বরং গোটা লাতিন আমেরিকাতেই ছিলো লেখক ও পাঠকদের আত্মার নবজাগরণের এক অনন্য হেঁসেল। ‘সুর’-এর উদয়াস্ত পর্যন্ত লাতিন আমেরিকাতে বহু সাহিত্যিক আন্দোলন এবং সেসবকে কেন্দ্র করে বহু পত্রপত্রিকা বের হয়েছে বটে, কিন্তু কোনটিই সাহিত্যিক আন্দোলনের তকমা বিহীন ‘সুর’-এর মূর্ছনায় উচ্চাঙ্গের গৌরব অর্জন করতে পারেনি। এমনকি, আজকে আমরা বুম-থেকে-উৎসারিত লাতিন আমেরিকার যেসব লেখকদের বিশ্বব্যাপী পরিচিত হতে দেখছি তাদের প্রায় সবাই ‘সুর’-এরই পালকপুত্র। বিশ্ববোধের প্রাথমিক পাঠ এবং বৈশ্বিক রুচির সাহিত্যিক মনোগঠন তারা অনেকটাই পেয়েছিলেন ‘সুর’ থেকে।
সৃষ্টিশীল লেখার পাশাপাশি রুচি গঠনের লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ যে সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন করেছিলেন - বহু দূরে একই আত্মার প্রতিধ্বনি হিসেবে - ওকাম্পো তার সংস্কৃতিতে প্রায় অনুরূপ ভূমিকাই পালন করেছিলেন। একটু আগেই বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর সাক্ষাৎ আকস্মিক হলেও তার ফলাফল উভয়ের জীবনেই ছিলো সুদূরপ্রসারী ও সুগভীর। মাত্রা যাই হোকনা কেন, উভয়েই যে পরস্পরকে প্রভাবিত করেছিলেন তা তাঁদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড ও রচনা অনুসরণ করলেই লক্ষ্য করা যাবে।
১৯২৪ সালেই যদিও দেখা কিন্তু, ওকাম্পো নিজেই জানিয়েছেন “রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে ১৯১৪ সাল থেকেই প্রোথিত হয়ে আছেন” (Tagore estaba instalado en mi vida desde 1914” - Autobiografia, Vol-iv, Victoria Ocampo, sur, Buenos Aires, 1982, p-17) এবং আরেকটু এগিয়ে তিনি এও বলেছিলেন যে “আমার পক্ষে তো এটা জীবনেরই সবচেয়ে বড় ঘটনা” (শঙ্খ ঘোষ, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ: ৩৫), তবে ঘটনাটাকে কেবল নিজের জীবনেই বড় করে রাখেননি, এই ঘটনার ফলাফলকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্র-চর্চার মাধ্যমে এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্পানঞলভাষী পাঠকদেরকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে।
আমার বিবেচনায়, উত্তরে হোসে বাস্কন্সেলোসের পর দক্ষিণে ওকাম্পোই হচ্ছেন সেই বিদুষী রবীন্দ্র-ভোক্তা যিনি লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্র-বিস্তারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রশতবার্ষিকী যে আর্হেন্তিনায় বিশাল জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হতে পেরেছিল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, তারও পেছনে ছিলেন ওকাম্পোই। এমনকি, ডাকটিকিটও বেরিয়েছিল সেখান থেকে। তারই সম্পাদনায় ‘সুর’ পত্রিকা এ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের উপর একটি বিশেষ সংখ্যাও বের করেছিলো, যাতে লিখেছেন হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ প্রথম সারির বহু লেখক। কিন্তু যদি বলা হয় রবীন্দ্রনাথেও ওকাম্পোর প্রভাব কম নয়, তা আমাদের কাছে আজ অবিশ্বাস্য শুনালেও রবীন্দ্রনাথের বুয়েনোস আইরেস ভ্রমণ-পরবর্তী ভাবনা, রচনা ও চিঠিপত্রগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো যে রবীন্দ্রনাথ তার নারীবিষয়ক ভাবনাকে অনেকটাই বদলে নিয়েছিলেন। আজ যদি এই দাবী করা হয় যে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের আঁতুড়ঘর ওকাম্পোর আতিথ্যপূর্ণ বুয়েনোস আইরেসেই তা কি বাড়িয়ে বলা হবে? এই জন্মের পেছনে যত আকস্মিকতাই থাকুক না কেন, আমরা কখনোই এই নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি না যে প্রায় অগ্রাহ্য করার মতো ঘটনা ও পরিস্থিতিও কখনো কখনো বড় সব ঘটনার পেছনে অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ই কি আমাদের চোখ কানকে জাগ্রত রাখতে শেখায়নি এই ব্যাপারে যে আমরা যাকে ‘সামান্য’ বলে মনে করি তা আসলে ‘সামান্য’ নয় মোটেই? আর রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সমালোচকদের কাছেও পূরবী তার শেষ দিককার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে নানা কারণেই ভাবনা ও কাব্যবোধের সেই উচ্চতম সূচক যেখানে তিনি বহু বছরের ব্যবধানে আবারও পৌঁছুতে পেরেছিলেন। এই পৌঁছানো যে সম্ভব হয়েছিল তার পেছনে ওকাম্পোর ভালোবাসাই ছিল মূল প্রেরণা।
ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এত সব কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বলার কারণ অভিজিৎ রায়ের এই বইটির বিশেষত্বকে যত দূর সম্ভব স্পষ্টভাবে বুঝবার আকাংক্ষা থেকে। পরস্পরের মানসিক ও মননশীল সম্পর্কটিকে যে বিস্তার থেকে অভিজিৎ ধরার চেষ্টা করেছেন তা বাংলা ভাষায় এর আগে কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। যদিও রবীন্দ্রনাথের জীবনে যেমন, তেমনি ওকাম্পোর জীবনেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা আমরা কম বেশি কবি শঙ্খ ঘোষ ও কেতকী কুশারী ভাইসনের মাধ্যমে জানি। কিন্তু বিজ্ঞান-লেখক অভিজিৎ রায় আগের অনেক তথ্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গ্রন্থে হাজির করেছেন। ফলে গ্রন্থটি তথ্যের দিক থেকে প্রতিধ্বনি হলেও, নতুন বিশ্লেষণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের ধারণাগুলোকে যুক্তির আলোকে খণ্ডন করার কারণে ভিন্ন স্বাদের পরিচয় নিয়ে এসেছে। ওকাম্পোর সাথে সম্পর্কের সূত্রে রবীন্দ্রনাথের নারীবিষয়ক ধারণার যে পরিবর্তনগুলো আমরা তার চিঠিপত্রে, প্রবন্ধে ও সৃষ্টিশীল অন্যান্য রচনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি, অভিজিৎ সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিলেন যে ছোটরাও বড়দেরকে প্রভাবিত করতে পারেন। অভিজিতের এই গ্রন্থের আরও একটি  বড় দিক হচ্ছে এর ‘পরিশিষ্ট’ নামক অংশটি। নামে ‘পরিশিষ্ট’ হলেও এটি এই গ্রন্থের অনুপম বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। ‘নারী: তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ নামক ওকাম্পোর প্রবন্ধ এবং রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর ৫০টি চিঠির বাংলা তর্জমার মাধ্যমে পাঠক আবিষ্কার করবেন ভিন্ন দুই সংস্কৃতি ও ভাষার এমন এক যুগলকে যারা এর আগে সম্ভ্রমের কুয়াশায় মোড়ানো ছিলেন বলে আমরা ভালোভাবে কখনো খেয়াল করিনি। অভিজিৎ এই কুয়াশার পর্দা সরিয়ে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোকে যে স্বচ্ছতায় হাজির করেছেন তা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখার মতো। স্বভাবে গবেষণাধর্মী হলেও এই গ্রন্থের মূল প্রাণ তার আখ্যানসুলভ বুনন ও বিজ্ঞানধর্মী যুক্তিবোধের পরম্পরা। অভিজিৎ প্রায় স্বভাব-বিরুদ্ধ এই দুই প্রবণতাকে পুরোপুরি বশে রেখে যে অসামান্য নমুনা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তা মুগ্ধ করার মতো। অভিজিৎকে প্রাণখোলা অভিনন্দন এবং কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদেরকে এমন গ্রন্থের পাঠক হওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য।
রাজু আলাউদ্দিন
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
‘দক্ষিণে সূর্যোদয় : ইস্পানো-আমেরিকায় রবীন্দ্রচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক
*********

বইয়ের প্রচ্ছদ সংযুক্ত হল [প্রচ্ছদ শিল্পী: আবু তৈয়ব আজাদ রানা]
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে
অভিজিৎ রায়
প্রকাশক: অবসর প্রকাশনী
গুডরিডস: https://www.goodreads.com/book/show/24732100
ফেসবুক পেইজ - https://www.facebook.com/TagoreOcampo
*********

২৪ জান ২০১৫
যতবার বার্নস এণ্ড নোবেলে ঢু মারি, ততবার ‘রিলিজিয়ন’ ‘নিউ এজ’ কিংবা ‘স্পিরিচুয়ালিটি’ সেকশনে রাখা Heaven is For Realঅথবা Proof of Heaven কিংবা The Boy Who Came Back from Heaven সমগোত্রীয় বইগুলোর দিকে চোখ যায় আর নিজের অজান্তেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। মানুষের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার আর মিথ্যাচারকে পুঁজি করে যত রকমভাবে ব্যবসা করা এই বইগুলো সম্ভবত তার উৎকৃষ্ট নমুনা। এই সমস্ত লেখকদের দাবি হচ্ছে তারা কোন কোন রোগে কিংবা দুর্ঘটনায় একেবারে মৃত্যুর কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন, সে সময় তাদের কিছু আধিভৌতিক অভিজ্ঞতা (যেগুলো ‘নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স’ নামে পরিচিত) হয় – যার ব্যাখ্যা স্বাভাবিক যুক্তিতে নাকি মেলে না। যেমন তারা নাকি তাদের সেই ‘মৃতবৎ’ সময়গুলোতে স্বর্গ নরক, যীশু, ঈশ্বর সবকিছু দেখে টেখে ফিরে আসেন। এরপর সেগুলো জানানোর দায়িত্ব পরে এই সব বিরল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষের উপর। এরা বই লেখেন। সেগুলো আবার বিশ্বাসীরা গোগ্রাসে গেলেন। বই উঠে যায় বেস্ট সেলারের তালিকায়। কোন কোন বইকে পুঁজি করে আবার সিনেমা পর্যন্ত হয়ে যায় (Heaven is For Real এমনি একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ)।
শিশু অ্যালেক্সের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এবং এর পরের দিনগুলো ছিল এমনি একটি বইয়ের প্রেক্ষাপট। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে একেবারে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিল অ্যালেক্স নামের ছয় বছরের ছেলেটি। কোমায় থাকতে হয়েছিল দিন পনের। কিন্তু এলেক্স মারা যায়নি, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে উঠে। ডাক্তারদের সহায়তায় বেঁচে উঠলেও হুইল চেয়ারে কাটাতে হচ্ছে বাকি জীবন। কিন্তু সেটার চেয়েও বড় কথা - ছেলেটি কারো পরামর্শেই হোক, কিংবা নিজের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার কারণেই হোক – এক বিশাল গল্প ফেঁদে বসল – সে নাকি কোমায় থাকা সময়ে স্বর্গ নরক, যীশু সব কিছু দেখে ফিরেছে। নরকের শয়তানগুলোর লাল লাল চেহারা, বাদুড়ে পাখা, ফোকলা দাঁত সব কিছুর বর্ণনা ছিল বইয়ে। সেই সব 'সত্য বর্ণনা' নিয়ে তার যুগান্তকারী বই বেরুলো ২০১০ সালে The Boy Who Came Back from Heaven নামে। মানুষও সেই সব গালগপ্প গিলে ফেলল, বই চলে গেল বেস্ট সেলারের তালিকায়।
এভাবেই চলছিল সবকিছু। এর মধ্যে যে কোন কারণেই হোক অ্যালেক্সের সুমতি এসেছে। সে এখন আর শিশু নেই, তিনি প্রকাশ্যেই বললেন 'শিশু বয়সে' এই বইয়ে যে কাহিনী তিনি লিখেছিলেন তা আসলে মিথ্যা। পুরোটাই সাজানো। সেরকম কিছুই হয়নি আসলে। চার্চে ফাদারের কাছে গিয়ে ‘কনফেশন’ও করেছিলেন অ্যালেক্স, চাইছিলেন বইটা মার্কেট থেকে তুলে নিতে। ফাদার নাকি তখন উপদেশ দিয়েছিলেন না করতে, কারণ বইটা মানুষকে ‘আশা’ দেয়, তা যতই মিথ্যা হোক না কেন! এর মধ্যে অ্যালেক্সের মা একটি ব্লগ লিখেন তার ছেলের বইটিকে ‘ডিসওন’ করে। তিনি সেই ব্লগে বলেন, বইটাতে যা আছে তা অতিরঞ্জিত। বানানো। অ্যালেক্স নিজেও একটা খোলা চিঠি লিখে বইটির প্রকাশ বন্ধ করতে বললেন। কিন্তু পাবলিশার অনেকদিন ধরে সেটা বন্ধ করেননি। তারা সেই বইয়ের বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ সত্যের চেয়ে মিথ্যার বেসাতি করা আর সেভাবে অর্থ উপার্জন করা ঢের বেশি আনন্দের।
অবশেষে মিডিয়ার চাপেই হোক, আর সম্প্রতি গণমানুষের এ নিয়ে লেখালিখির কারণেই হোক, পালপিট এণ্ড পেন বইটি বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে। অন্ততপক্ষে আমি সাধুবাদ জানাই অ্যালেক্সকে এবং প্রকাশককে তাদের সুমতি ফেরার জন্য। বার্ন্স এন্ড নোবেলের তাকে অন্তত একটা ‘হট কেক’ স্পিরিচুয়াল বই কম দেখা যাবে এবার থেকে। এটাই বা কম কি। বিশ্বাসের মিথ্যে মেওয়া ব্যাচা অন্য বইগুলোর 'বিরল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন' বাকি লেখকেরা কখন এরকম সত্যের মুখোমুখি হয়ে তাদের হটকেক বইগুলো তুলে নেওয়ার সৎ সাহস দেখাবেন, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
তথ্যসূত্র: ০১ | ০২ | ০৩ | ০৪

৭ জান ২০১৫
প্যারিসে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে ১২ জনকে হত্যা করেছে ব্যাঙ্গানুভুতির ইমানে খাড়া হওয়া তাগুদি জিহাদীরা। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহি ইসলামের সাথে এর কোন সম্পর্ক খোঁজা হবে হারাম কাজ। ধর্মকে 'ভাইরাস' বলে আখ্যায়িত করাও হবে কবিরা গুনা। চলেন আমরা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আশয়, যেমন - তেল লুণ্ঠন, ইস্রায়েল, আম্রিকার মুসলিম বিদ্বেষী পররাষ্ট্র নীতি - এগুলোকে টার্গেট করে আলোচনা করি, নাইলে আবার আমরা 'সালাফি সেক্যুলার' হয়ে যাব।

৫ জান ২০১৫
মীজান ভাই আর নেই। যারা মীজান ভাইকে চেনেন না, তাদের জন্য বলি - মীজান রহমান ছিলেন পেশায় গণিতবিদ। শুধু গণিতবিদ বললে ভুল হবে, বাংলাদেশের যে কয়জন একাডেমিয়ার সাথে যুক্ত শিক্ষাবিদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন, বাংলাদেশকে পরিচিত করতে পেরেছেন দর্পভরে বিশ্বের অঙ্গনে, তার মধ্যে মীজান রহমান ছিলেন অন্যতম। সেই ১৯৬৫ সালে কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে একটানা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গণিতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষকের সম্মান সহ বহু সম্মানেই তিনি ভূষিত হয়েছেন। শুধু শিক্ষক হিসেবে তিনি খ্যাতিমান তা নন, শিক্ষায়তনে সাফল্য পেতে হলে যা যা দরকার, সবই তাঁর ঝুলিতে ছিল। গণিতের বিখ্যাত জার্নালগুলোতে খুঁজলেই যে কেউ পাবেন তাঁর অসংখ্য গবেষণাপত্রের হদিস, পাশাপাশি কিছুদিন আগে গণিত শাস্ত্রের পণ্ডিত জর্জ গ্যাসপারের সাথে লিখেছেন মহামূল্যবান একটি পাঠ্যপুস্তক ‘বেসিক হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজ’ (১৯৯০) শিরোনামে, যেটা প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই গণিতের ছাত্রদের জন্য অবশ্যপঠিত পুস্তক হিসেবে বিবেচিত। তিনি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক প্রফেসর আলবার্তো গ্রুনবাম এবং নেদারল্যাণ্ডের গণিতবিদ এরিখ কোয়েলিংক প্রমুখের সাথেও গণিত বিষয়ক বহু গবেষণা করেছেন। গণিতে তার অবদান এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ১৯৯৮ সালে কানাডার ওই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তাঁকে ‘এমিরিটাস অধ্যাপক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যারা ‘এমিরিটাস’ শব্দার্থটির সাথে পরিচিত নন, তাদের কানে কানে জানাই – এমিরিটাস অধ্যাপক হবার ব্যাপারটি খুব বিরল সম্মানের, যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই। এঁরা অবসর নেবার পরেও যে কোন জায়গায় নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত করতে পারেন, আজীবন ধরেই। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘Distinguished Research Professor হয়েছিলেন। গণিত বিষয়ে বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তির তালিকা কেউ কোনদিন বানাতে বসলে মীজান রহমানকে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু গণিতের কাঠখোট্টা জগতের বাইরেও তার আরেকটা পরিচিতি ছিল। তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক। তার প্রথমদিককার উপন্যাস ‘লাল নদী’ (২০০১) পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, আলোড়িত হয়েছিলাম, সহসা আবিষ্কার করেছিলাম এক সমাজ সচেতন প্রগতিশীল সুলেখকের প্রতিচ্ছবিকে। পরে জেনেছি এই নিভৃতচারী লেখকের এই একটি নয়, একগাদা ভাল ভাল বই আছে। তার মধ্যে রয়েছে ‘তীর্থ আমার গ্রাম, ‘প্রসঙ্গ নারী’, ‘অ্যালবাম’, ‘অনন্যা আমার দেশ’, ‘আনন্দ নিকেতন’, ‘দুর্যোগের পূর্বাভাষ’, ভাবনার আত্মকথন’, ‘শুধু মাটি নয়’ প্রভৃতি। সে সময় লজ্জিতই হয়েছিলাম তার বইয়ের সাথে আগে পরিচিত না হওয়ায়। এর পরে যখনই সুযোগ পেয়েছি মীজান রহমানকে পড়বার চেষ্টা করেছি, নিজ উদ্যোগেই। এক ধরণের দায়িত্ববোধ থেকেই। বলা বাহুল্য, তাঁর লেখা পড়ে কখনোই হতাশ হইনি, বরং আলোকিত হয়েছি নানাভাবে। ভাল লাগা আরো বেড়েছে পরবর্তীতে যখন জানলাম তিনি একজন ধর্মমোহমুক্ত সত্যিকার মুক্তমনা মানুষ, একজন মানবতাবাদী। শুধু তাই নয়, দর্শনের জগতে আমরা যাদের ‘স্কেপ্টিক’ বলি, মীজান রহমান সেই গোত্রভুক্ত ছিলেন। সে অনুভূতি আমার আরো দৃঢ় হয়েছে পরবর্তীতে তার মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত লেখাগুলো পড়ে। তিনি ধর্মগ্রন্থের বানীগুলোকে কেবল নিনির্মেষ স্তব করতেন না, বরং সময় সময় প্রকৃত অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীদের মতো ক্রিটিকালি দেখতে চাইতেন। তাই তিনি শমশের আলী আর জাকির নায়েকদের মত কোরানের আয়াতে বিগ ব্যাং খুঁজে পাননি, বরং ঈশ্বর নির্দেশিত ধর্মগ্রন্থগুলোতে আবিষ্কার করেছেন অপবিজ্ঞান, কুসংস্কার, অসাম্য আর নিপীড়নের দীর্ঘদেহী করাল ছায়া। মুক্তমনা সাইটে রাখা তাঁর ব্লগের ‘ইনশাল্লাহ’, ‘কোথায় স্বাধীনতা’, ‘হতবুদ্ধি, হতবাক’ কিংবা ‘আউট অব্ কন্টেক্সট’ শিরোনামের প্রবন্ধগুলো পড়লেই মীজান রহমানের প্রগতিশীল দার্শনিক অভিজ্ঞার সন্ধান পাবেন পাঠকেরা। তিনি বোধ করি ছিলেন বাংলা ব্লগের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগার। চিরতরুণ মীজান ভাই ছাড়া ৮২ বছর বয়সে আর কেউ কি এভাবে বাংলায় ব্লগ করে গেছেন? মুক্তমনায় তার ব্লগ এখানে এবং এখানে।
বয়সে আমার বাবার থেকেও বড়। কিন্তু আমাদের কাছে উনি সব সময়েই ছিলেন ‘মীজান ভাই’ হিসেবে। আমার স্ত্রী বন্যা অবশ্য আরো অনেক আগে থেকেই তাঁকে চিনতেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন কানাডার সকল মুক্তমনা এবং প্রগিতিশীল তরুণ-তরুণীদের কাছে একেবারে ছায়ার মতোন। একটু আগে Monikaকে ফোন করলাম। কাঁদছেন। অনেককেই এভাবে কাঁদিয়ে গেলেন মীজান ভাই। মাথার উপর থেকে হঠাৎ ছাদ সরে গেলে কার না কান্না হয়। এ লেখাটা লিখতে গিয়ে আমারো কি গলাটা আটকে আসছে না? কান্না আমিও থামাতে পারছি কই? আমার সাথে একটা বই লেখার কথা ছিল তাঁর। তার মত সফল একাডেমিয়ান এবং সুসাহিত্যিকের আমার মতো ছাপোষা কারো সাথে কিছু লেখার কথা নয়। কিন্তু লিখলেন। বিপুল উৎসাহে প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার একটা বই। শূন্য থেকে মহাবিশ্ব । বইটা নিয়ে দারুণ উচ্চাশা ছিল তাঁর। বইটি নিয়ে কথা হইলেই শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন তিনি। পাণ্ডুলিপি গত বছরই জমা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বইটি দেখে যেতে পারলেন না। Ahmedur Rashid Tutul কে ইমেইল করে বইটির ব্যাপারে প্রায়ই জানতে চাইতেন তিনি। শূন্য থেকে মহাবিশ্বের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে... শূন্যেই হারিয়ে গেলেন প্রিয় মীজান ভাই। গুড বাই ড. Mizan Rahman

২ জান ২০১৫
পিকে মুভিতে যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে তা অসাধারণ কিছু নয়। আমাদের ধর্ম এবং সমাজের দ্বিচারিতারই প্রতিফলন এগুলো। কিন্তু সামান্য কথাগুলোই অসামান্য হয়ে উঠেছে উপস্থাপনার গুণে। আসলে পিকের প্রশ্নগুলো সবাই কমবেশি করে ছোটবেলায়। শিশুমনে যে প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে আসতে থাকে, সেগুলোকেই বড় হতে হতে ক্রমশ আমরা নানা অপযুক্তি আর কুযুক্তির আস্তরণ চাপিয়ে চাপিয়ে পুরু করে ফেলি। তৈরি হয় অন্ধবিশ্বাসের অচলায়তন। পিকের মতো সিনেমাগুলো সেই অচলায়তনেই একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে যায়। প্লাবনের ধাক্কায় সংস্কারের পলেস্তরা খসে পড়ে, মূর্তি থেকে মাটির আস্তরণ ক্রমশ ধুয়ে যায়, ধুয়ে যায় আলগা রং। বিগ্রহ খসে বেরিয়ে পড়ে ধর্মের ভিতরকার হাড়গিলগিলে নগ্নরূপ। ভয়টা বোধ হয় এখানেই। পিকে দেখুন।

২ জান ২০১৫
নববর্ষের প্রথম দিনেই প্রকাশকের কাছ থেকে একটি আনন্দের সংবাদ পেলাম।অবিশ্বাসের দর্শন বইটির তৃতীয় সংস্করণ আসছে। ছাপা শেষ, প্রচ্ছদও হয়ে গেছে। বিভিন্ন কারণেই ২০১৪ সালটি ছিল এক বিভীষিকাময় বছর। ২০১৫ সালের শুরুটা অন্ততঃ একটা আনন্দের বার্তা দিয়ে শুরু হল, এটাই বা কম কি! "মুক্তি আসুক যুক্তির পথ ধরে! জীবন হোক বিশ্বাসের ভাইরাস মুক্ত"। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।

২০১৪
১৭ ডিস
ধর্ম একটি ভাইরাস। পাকিস্তানের পেশোয়ারে তালিবানদের বর্বরোচিত হামলার পর যদি এ নিয়ে কারো সংশয় থাকে তা ঝেড়ে ফেলা উচিৎ। স্কুলের ১৪০ জন নিষ্পাপ শিশুদের গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিতে যাদের হাত এতোটুকু কাঁপে না, তাদের মস্তিষ্ক ভাইরাসাক্রান্ত নয়তো আর কি! বিশ্বাসের ভাইরাস ! যতোই ভাবি এগুলো নিয়ে আর পোস্ট দিব না, ততই দেখছি ঘটনাগুলো অক্টোপাসের শুর দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চায়। আইসিসেরা সহি উপায়ে গলা কাটা শুরুর পর কেবল ধর্মকে ভাইরাসের সাথে তুলনা করেছিলাম একটা লেখায়, তখন - জামাতি, বামাতি আর আগরবাত্ততিওয়াল্লারা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে আমাকে ‘সালাফি সেক্যুলার’ বলে ট্যাগ পর্যন্ত করে দিল। বাংলাদেশের স্বার্থেই নাকি আমার বিরুদ্ধে তাদের লেখা লাগে। ঠিক আছে, বাংলাদেশের স্বার্থ বলে যখন কথা, মুখে কুলুপ আঁটাই তো ভাল। কিন্তু আমি কুলুপ আঁটলে হবে কি, বাচাল বিধাতা কি আর থামবেন, না তার তাগুদি বান্দাদের থামাবেন? কত ঘটনা যে এর মধ্যে ঘটে গেল – রেইহানা নামে এক মেয়েকে ধর্ষণ করা হল, আবার উল্টে শরিয়া আইনে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল। সৌদি আরবে এক মুয়াজ্জিন আজান দিতে দেরী করায় গুলি করে দিয়েছে ধর্মের এক দ্বীন এক ‘পাগলা’ সেবক। অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে এক ক্যাফে দখল করে মানুষজনকে জিম্মি করে রাখল আইসিসের পতাকাবাহী এক মধ্য বয়সী যুবক। আর এখন তালিবানী গুলিতে শিশুরা কচুকাটা দেখতে হচ্ছে।

অবশ্য এর মধ্যেই আবারো পুরানো ন্যাত ন্যাতা ত্যানা ছয় গিট্টু মেরে আবারো প্যাচানো শুরু হয়েছে – ‘তালিবানদের এই কাজের সাথে সহি ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই’ । এহ!! ভাল তো, ভাল না? আমার মনে হয় কথা না বাড়িয়ে আগেকার একটা স্ট্যাটাসের পুরনো তালিকাটা আপডেট করাটাই এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ হবে -
*******************
- মক্কা বিজয়ের পর, মহানবী নাকি কাবার সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। তালিবানরাও প্রায় একই কায়দায় আফগানিস্তান দখলের পর ঐতিহাসিক বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছিল। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- বাংলাদেশে পূজার সময় যেভাবে প্রতিমা ভাঙা হয়, চিটাগং এ লালনের মূর্তি ভাঙা হয় – এগুলোর সাথে ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ইসলামী জিহাদের নামে গত বারো শতক ধরে সারা পৃথিবীতে মিলিয়নের উপর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- সৌদি আরবে মেয়েদের বাইরে কাজ করার অধিকার নেই, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার নেই, ড্রাইভিং এর অধিকার নেই, নেই পুরুষদের সমান সাক্ষ্য কিংবা উত্তরাধিকারেও। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ইসলামে বহু বিবাহের বৈধতা আছে,মুসলিম বিশ্বে একই সাথে একাধিক স্ত্রী রাখারও বিধান আছে। কিন্তু তাতে কি। ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ইরানে সম্প্রতি দত্তক নেয়া কন্যা শিশুকে বিয়ে করার আইন পাশ হয়েছে, কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- মুসলিম দেশে গার্ল উপভোগ, কিংবা যুদ্ধের সময় তাদের যুদ্ধবন্দিনী ধর্ষণ, মালে গনিমত হিসাবে বিধর্মীদের স্ত্রী-কন্যাদের দখল – কোন কিছুর সাথেই ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- পাকিস্তানে এত দিনের সিয়া সুন্নি বিরোধ, মারামারি, হানাহানি, লোকক্ষয় - ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- আইসিস, আল্ কায়দা, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, ইসলামিক জিহাদ, হামাস, হরকত-উল-জিহাদ, হরকত-উল-মুজাহিদিন, জেইস-মুহম্মদ, জিহাদ-এ-মুহম্মদ, তাহ-রিখ-এ-নিফাজ-সারিয়াত-এ-মুহম্মদ, আল-হিকমা, আল-বদর-মুজাহিদিন, জামাতে ইসলামিয়া, হিজাব-এ-ইসলামিয়া, জমিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি), শাহাদাত ই আল হিকমা ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), শাহাদাত-ই আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি, শহীদ নসুরুল্লাহ আল আরাফাত বিগ্রেড, হিজবুত তাওহিদ, জামায়াত-ই ইয়াহিয়া, আল তুরাত, আল হারাত আল ইসলামিয়া, জামাতুল ফালাইয়া তাওহিদি জনতা, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, জুম্মাতুল আল সাদাত, শাহাদাত-ই-নবুওয়ত, আল্লাহর দল, জইশে মোস্তফা বাংলাদেশ, আল জিহাদ বাংলাদেশ, ওয়ারত ইসলামিক ফ্রন্ট, জামায়াত-আস-সাদাত, আল খিদমত, হরকত-এ ইসলাম আল জিহাদ, হিজবুল্লাহ ইসলামী সমাজ, মুসলিম মিল্লাত শরিয়া কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট ফর জিহাদ, জইশে মুহাম্মদ, তা আমীর উদদ্বীন বাংলাদেশ, হিজবুল মাহাদী, আল ইসলাম মার্টায়ারস বিগ্রেড ও তানজীম – এত শত জঙ্গিদল ইসলাম কায়েমের বাসনা নিয়ে জিহাদ, কতল সবই করে যাচ্ছে, কিন্তু এদের কারো কর্মকান্ডের সাথেই ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

- ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারের ওপর আল কায়দা আত্মঘাতী বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বসে পড়ে। মারা যায় ৩০০০ আমেরিকান নাগরিক। আক্রমণকারীদের নেতা মোহাম্মদ আতা নিজেও তার সুটকেসে কোরআন বহন করছিলেন। ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত আতার কাছ থেকে পাওয়া তার শেষ নির্দেশাবলীগুলোও সেই সাক্ষ্যই দেয় যে, তারা পবিত্র আল্লাহ এবং ইসলামের প্রেরণাতেই এই জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন (Last words of a terrorist, Guardian UK দ্রঃ)। কিন্তু তাতে কি! ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ২০০২ সালে বালি বোম্বিং, ২০০৫ সালে লণ্ডন পাতাল রেল বোম্বিং, দিল্লিতে ২০০৮ সালে বোম্বিং, বোস্টন ম্যারাথন বোম্বিং, নিদাল হাসানের শুটিং - কোন কিছুর সাথেই ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথা-বিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা চালায় মৌলবাদী একটি দল। চাপাতি দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলা হয় তার দেহ, যা পরে তাকে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ২০০৪ সালের ২রা নভেম্বর চিত্র পরিচালক থিও ভ্যান গগকে প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি এবং ছুরিকাহত করে হত্যা করা হয়; নারীবাদী লেখিকা আয়ান হারসি আলীকেও মৃত্যু পরোয়ানা দেওয়া হয়। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামের একুশ বছরের যে যুবক জিহাদ করতে এসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গ্রেফতার হয়ে বিশ্বব্যাপী পত্র-পত্রিকার আলোচিত খবর হয়েছিলেন। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি ঘটনা। সৌদি আরবের এক হতভাগ্য নারী তার এক স্কুল-বন্ধুর কাছে থেকে একটি ছবি আনতে গিয়ে সেই বন্ধু আর তার ৬ জন সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা ধর্ষিত হন। সৌদি আইনে (যার মূল ভিত্তি হচ্ছে ইসলামের শরিয়া), হতভাগ্য নারীটিই উল্টে বিচারের রায়ে দুশোটি বেতের আঘাত পেয়েছেন, কারণ, তিনি সুরা নিসায় (৪:১৫) বর্ণিত ‘চারজন লোকের ইতিবাচক সাক্ষ্য’ আনতে পারেননি। তাই শরিয়া মতে - ‘বিনা প্রমাণে’ ধর্ষনের অভিযোগ উত্থাপনের মাধ্যমে আসলে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেন যে তিনি ‘বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে’ জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাতে কি, এটার সাথে ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। সহি ইসলামের সাথে সম্পর্ক নেই রেইহানার ফাঁসির ঘটনারও।
- ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে রাজীব হায়দার শোভনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ধৃত অপরাধীরা স্বীকার করে ‘ঈমানী দায়িত্ব’ পালনের জন্য ইসলামবিদ্বেষী এই ব্লগারকে তারা হত্যা করেছে। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- ২০১৪ সালের মে মাসে নাইজেরিয়ার বোর্নো এলাকা থেকে ২২৩ জন স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে মুসলিম জঙ্গি দল বোকো হারাম। বিবৃতিতে তারা বলে, ‘মেয়েদের স্কুলে যাওয়া উচিৎ না। বরং তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়া উচিৎ। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- আইসিস আজ কোরান এবং সুন্নাহ মতাবেক বিধর্মীদের ধরে ধরে জবাই করছে। সম্প্রতি পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেছে ওক দম্পতিকে, সমকামীদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলছে, কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
- অস্ট্রেলিয়ার সিডনীর ক্যাফেতে আইসিসের পতাকাবাহী যুবকের জিহাদী জোশপূর্ণ কর্মকাণ্ড এবং মানুষজনকে জিম্মি হিসেবে আটকে রাখার সাথে সহি ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।
- পাক তালিবান প্রধান সহি বুখারির রেফারেন্স দিয়ে বলেছে, তাদের পেশোয়ারে গনহত্যা মুহম্মদের জীবনী এবং হাদিস শরিফ দিয়ে সমর্থিত। পেশোয়ারে যা তারা করেছে, তা ইসলামী 'সুন্নত'। [লিংক] কিন্তু তারপরেও ....
পেশোয়ারে স্কুলের নিরপরাধ ছাত্রছাত্রীদের গুলি করে হত্যার বর্বোরেচিত সাম্প্রতিক ঘটনার সাথেও 'সহি ইসলামের' নাকি কোন সম্পর্ক নেই।
...
...
**************
আমার মনে কেন যেন সন্দেহটা ক্রমশঃ ফুলে ফেঁপে উঠছে --- ইসলামের সাথেই বোধ হয় ‘সহি ইসলামের’ কোন সম্পর্ক নেই।

২৮ নভ ২০১৪

আমার এখন মনে হয় আমরা সাংস্কৃতিকভাবেই সাম্প্রদায়িক – হিন্দু, মুসলিম সবাই। আগেও ছিলাম, এখন আছি। মাঝে সাঝে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শাহবাগ আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার – এধরণের কিছু ঘটনায় আমরা আশায় বুক বাঁধি বটে, কিন্তু শেষপর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে হয় সেই তিতুমীর, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ কিংবা শফি হুজুরেই। স্বকৃত নোমান একটি লেখা লিখেছেন তীতুমীরের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে , আমি একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম এ প্রসঙ্গে, সেখানে কিছু রেফারসেন্স হাজির করে বলেছিলাম কেবল তিতুমীর, হাজি শরিয়তুল্লাহরাই না, এমনকি বাংলার সুফীরা – যারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন বলে মনে করা হয় (যেমন খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি, নিজামুদ্দিন আউলিয়া ও শাহ জালাল), তাদের মধ্যেও জিহাদের উপকরণ ছিল যথেষ্ট পরিমাণেই।
তবে এটা অবশ্যই উল্লেখ্য যে, ধরনের সাম্প্রদায়িকতা কেবল মুসলিমদের মধ্যে ছিল না, ছিল হিন্দুদের মধ্যেও বহুল পরিমাণেই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘ইতিহাস-ভিত্তিক’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে কেবল হিন্দু সন্ন্যাসীদের লড়াইকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন; তাঁর রচনার বিষয়বস্তু করলেন, কোন মুসলিম ফকিরদের নামগন্ধও তাতে ছিল না । দেবী চৌধুরানীকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়েছেন, সত্যানন্দকে বীরের গৌরব দিয়েছেন, কিন্তু মজনু শাহ্‌র নামটি উল্লেখ করার উদারতা পর্যন্ত দেখাতে পারেননি। তার অনেক উপন্যাসই সাম্প্রদায়িকতাদোষে দুষ্ট। তিনি মীর মোশারফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পন’এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, বলেছিলেন, ‘আমরা পরামর্শ দেই এ সময় এ গ্রন্থের বিররণ বন্ধ হউক’। ইতিহাসবেত্তারাই বলেন (যেমন সুমিত সরকারের ‘আধুনিক ভারত দ্রঃ) ‘আঞ্চলিক জীবনে মুঘল কেন্দ্রীকরণের ক্ষতিকর প্রভাবের উপর জোর দিয়েছেন, আর তার পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে – বিশেষ করে আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম-এ মুসলমানদের নিন্দা করেছেন যথেচ্ছ। ... ‘স্বদেশী’ দিন্দু যুবকেরা বিশেষ করে ১৯০৫ থেকে বঙ্কিমকে দেবতা করে তুলেছিলেন। তার বহু রচনায় ‘যবন’দের বিরুদ্ধে কটুকাব্য ছিল”। আর ইংরেজপ্রতি তো ছিলই। তার ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ শীর্ষক লেখায় বঙ্কিম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে এবং ইংরেজদের স্তব করেছিলেন এভাবে –
‘চিরস্থায়ী-বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমত কুপরামর্শ ইংরেজদিগকে দেই না। যেদিন ইংরেজদের অমঙ্গলাকাংক্ষি হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাংক্ষি হইব, সেইদিন পরামর্শ দিব।“ সাম্প্রদায়িকতার উল্লেখ পাওয়া যায় এমনকি শরৎচন্দ্রের অনেকে লেখাতেও। যদিও এই শরৎচন্দ্রই গফুরের মত চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন,মহেশ গল্পে হিন্দুজমিদারদের নিপীড়নের বর্ণনা দিয়েছেন, তিনিই কিন্তু প্রবন্ধ লেখার সময় (তাঁর “বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা" শীর্ষক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য) মুসলিমবিদ্বেষকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি।
ব্যাপারটা ঠাকুর পরিবারের জন্যও সত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ তার সময়ে যথেষ্টই সাংস্কৃতিক-ভাবে অগ্রসর একজন মানুষ ছিলেন; শিল্প সাহিত্যের প্রতি ছিলো তার প্রগাঢ় অনুরাগ, কিন্তু তিনিও কৃষক শ্রমিকদের সমাবেশ, দাবী দাওয়া আর আন্দোলনকে তিনি কখনোই ভাল চোখে দেখতেন না। সেজন্যই দ্বারকানাথ আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘বাংলার রেনেসাঁর পথিকৃত’ রামমোহন একসময় নীলকরদের শোষণ উৎপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষকদের গৌরবময় সংগ্রামকে ‘সংস্কারবদ্ধ মনের অদূরদর্শী আস্ফালন’ বলে বক্রোক্তি করেছিলেন । ১৮২৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর দ্বারকানাথ ইংরেজদের কাছ থেকে সুবিধাভোগী মুৎসুদ্দি-জমিদারশ্রেনীর অন্যান্য প্রতিভুদের (যেমন, রাজা রামমোহন, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ) সাথে কলকাতার টাউন হলে একটি সভায় মিলিত হয়ে নীলকর সাহেবদের সমর্থনে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেন বলে নানা ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখাতেও (যেমন রায়তের কথা) জমিদারী প্রথা টিকিয়ে রাখার পক্ষে পরোক্ষ সমর্থন আছে। আর বরীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্ম সমাজের পুরোধা হওয়া হওয়া সত্ত্বেও অনেক সংস্কার ত্যাগ করতে পারেননি। পৈতা একবার বর্জন করেও পরে আবারো সেটি ধারণ করেছিলেন। পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ পিতা সম্বন্ধে একসময় লিখছেন, ‘আমার বাবা যদিও মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু মজ্জ্বাগতভাবে তিনি ছিলেন একজন রক্ষণশীল’। পৌত্তলিকতা বা মূর্তিপূজার মতো ব্যাপারে তাঁর বিরোধিতা থাকলেও হিন্দুসমাজের প্রচলিত বর্ণভেদপ্রথার সঙ্গে আপস করতে তার দ্বিধা ছিল না, ছিল না অসবর্ণ বিয়ে কিংবা বিধবা বিয়ের মত ‘অকল্যাণমূলক’ কাজে বাধা দিতেও। প্রসঙ্গত এখানে আরো উল্লেখ্য, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতি ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী রাজা রধাকান্ত দেব সতীদাহ প্রথা রহিতকরণের বিরুদ্ধে ছিলেন, এবং বিধবা বিবাহ আইনের বিরুদ্ধে বৃটিশ আদালতে আবেদনপত্র দাখিল করেছিলেন।

আর আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ তো ছিলেন আদ্যোপান্ত স্ববিরোধিতাগ্রস্থ। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম একসময় (স্ববিরোধী বিবেকানন্দ, মুক্তমনা, http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=22071 ) যেটা অবধারিতভাবে হিন্দুত্ববাধগীদের গা জলানোর জন্য ছিল যথেষ্ট। কিন্তু গায়ে জলুনি হলে কি হবে, তাদের কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারেননি যে প্রিয় বিবেকানন্দ এক দিকে জীবপ্রেমের গান শুনাচ্ছেন তো অন্যদিকে নিজেই বরাহনগর মঠে পশুবলি প্রবর্তন করেছেন। একদিকে চণ্ডালদের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন তো অন্যদিকে আবার বলছেন, ‘ভারতে ব্রাহ্মনেরাই চরম আদর্শ’। একদিকে বাল্য বিবাহকে খারাপ বলছেন তো পর-মুহূর্তেই আবার বলছেন, ‘বাল্য বিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করেছে’। একবার কুসংস্কার দূর করার জিকির তুলছেন তো একই মুখে আবার জন্মান্তর, আত্মা আর জাতিভেদ জিইয়ে রাখার পক্ষে সাফাই গাইছেন। একবার নিজেকে সন্ন্যাসী বলে জাহির করেছেন তো আরেকবার ভোগ, বিলাস ব্যসনে আর রাজ রাজাদের গৃহে গিয়ে উদরপূর্তিতে অফুরন্ত সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু ভক্তকুলের নিবিষ্ট প্রচেষ্টায় সেই বিপরীত কথাগুলো কিংবা তার স্ববিরোধী কাজগুলোকে সযত্নে আড়াল করে ফেলা হয়েছে। ভক্তকুলের অহর্নিশি স্তব, ফুল চন্দন আর নানাবিধ প্রশংসায় বিবেকানন্দ এখন পরিণত হয়েছেন ‘যুগ নায়ক’-এ, ‘অফুরন্ত প্রেরণার উৎসে’ । লাগাতার প্রচারণার মাধ্যমে বিবেকানন্দকে খুব ঘটা করে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদী’ ব্যক্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে, তাকে দেয়া হয়েছে ‘দেশ নায়ক’ উপাধি। অথচ বিবেকানন্দের স্বজাত্যবোধের উৎস কখনোই ভারতীয়তা ছিলো না, ছিল হিন্দুত্ব। এ প্রসঙ্গে তার নিজস্ব উক্তিই ছিলো – ‘হিন্দু জাতি সমগ্র জগত জয় করিবে’। তিনি প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকে ‘বেশ্যাবৃত্তির’ সাথে তুলনা করে তিরস্কার করেছেন, হিন্দু সমাজত্যাগী মুসলিমদের স্বামীজি ‘দেশের শত্রু’ বলেও চিহ্নিত করেন - ‘কোন লোক হিন্দু সমাজ ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তা নয়। একটি করে শত্রু বৃদ্ধি হয়’। তিনি হিন্দু সমাজককে মুসলিমদের সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, – ‘এইটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, মুসলমানগণ যখন ভারতে প্রথম আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশি হিন্দুর বসবাস ছিল, আজ তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে’। শুধু ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের উপর ঝাল ঝেড়েই স্বামীজি ক্ষান্ত হননি, হিন্দু ধর্মের যাবতীয় কুসংস্কারের দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন বৌদ্ধধর্মের উপরে। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে যে সকল বিশেষ দোষ রহিয়াছে, সেইগুলি বৌদ্ধধর্মজাত। বৌদ্ধধর্মই আমাদিগকে তাহার উত্তরাধিকারস্বরূপ এই অবনতির ভাগী করিয়াছে। বিবেকানন্দ তার বহু লেখাতেই ইংরেজদের অভিহিত করেছেন ‘বীরের জাতি’,’ প্রকৃত ক্ষত্রিয়’, ‘অটল ও অকপট’, এবং ‘প্রভু’ হিসেবে । কীভাবে ‘বীর্য, অধ্যবসায় ও সহানুভূতির’ সাথে শাসন করলে ভারতে ‘শতবার’ ইংরেজ শাসন বজায় থাকবে, তার ফিরিস্তি দিয়েছেন। বিবেকানন্দ যে ছিলেন চরম ও পরম ইংরেজভক্ত, সেটা নিজেই লেখায় উল্লেখ করেছেন। ভক্তদের পক্ষ থেকে আজ তাকে অযথা ‘যুগনায়ক’, ‘মহাবিপ্লবী’ প্রভৃতি বানানোর চেষ্টা করা হলেও আসল কথা হল, স্বামীজি কখনোই ইংরেজ শাসনের সংগে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় যেতে চাননি। ব্রিটিশ শাসককে তোষামোদ করতে গিয়ে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষকে ভর্ৎসনা করতেও দ্বিধান্বিত হননি। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে বাতিল করে, এবং বিদ্রোহীদের ‘ডাকাত’ হিসেবে অভিহিত করে দিয়েছিলেন নিম্নোক্ত মন্তব্য-
“সকল কথার ধুয়ো হচ্ছে – ‘ইংরেজ আমাদের দাও।’ বাপু আর কত দেবে? রেল দিয়াছে, তারের খবর দিয়াছে, রাজ্যে শৃঙ্খলা দিয়াছে, ডাকাতদের তাড়াইয়াছে, বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়াছে। আবার কী দেবে? নিঃস্বার্থভাবে কে কী দেয়? বলি তোরা কী দিয়েছিস?”
এই উক্তি থেকে বোঝা যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে বিবেকানন্দের কোন স্পষ্ট ধারনা ছিলো না। হ্যাঁ, রেল ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা প্রচলন, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি ব্রিটিশরা করেছে, কিন্তু এগুলোও তারা করেছে তাদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার প্রয়োজনেই, ভারতের উন্নতি করার মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, যা রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দেরা সে সময় ভাবতেন। ব্রিটিশেরা ভারতে এসে প্রথমেই যেটা করতে সফল হয়েছিল তা হচ্ছে দেশী শিল্পের ধ্বংস সাধন, এবং পাশাপাশি ব্রিটেন থেকে আসা দ্রব্যের একটা বড় সড় বাজার তৈরি। এই প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে ভারতে রেলপথ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সে সময় অনুভব করে ইংরেজরা। ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো শিল্পজাত নানা দ্রব্য ভারতের বন্দরগুলো থেকে দেশের অভ্যন্তরে বহন করে নিয়ে যাওয়া, ভারতের কাঁচামাল বন্দর পর্যন্ত পৌঁছানো, আর তার সাথে চলমান বিদ্রোহ বিপ্লবকে ঠাণ্ডা করে ভারতকে সামরিক শক্তির পদানত রাখার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ কম সময়ের মধ্যে সৈন্য সামন্ত প্রেরণের সুবিধার জন্য ভারতে রেলপথ স্থাপন খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। এমনকি লর্ড ডালহৌসির ১৮৫৩ সালের প্রতিবেদনেও ব্যাপারটা স্বীকার করে বলা হয়েছিল, রেলওয়ে স্থাপনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ভারতকে গ্রেট ব্রিটেনের কাঁচামাল সরবরাহের উৎস এবং অপরদিকে ভারতকে গ্রেট ব্রিটেনের রপ্তানিকৃত শিল্পদ্রব্যের বাজার হিসেবে গড়ে তোলার সুস্পষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। এ ধরণের আরো উদাহরণ চাইলেই দেয়া যাবে।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে সমস্ত হিন্দুবিপ্লবীদের কথা জানা যায় – অরবিন্দ, বাল গঙ্গাধর তিলক – এদের সবার কাজ কারবার সাম্প্রদায়িকতাদোষে দুষ্ট ছিল। গঙ্গাধর তিলক সাম্প্রদায়িকতাকে গণসংযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন – গণপতি উৎসব ,শিবাজি উৎসব প্রভৃতি পালনে উৎসাহিত করতেন। অরবিন্দ ঘোষ তো গীতা থেকে বিপ্লবের উপকরণ পেতেন এটা তো সবাই জানে।ধর্মের উপর মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাসের কারণে বিপ্লবী অরবিন্দ বিপ্লব ফিব্লব সব বাদ দিয়ে শেষ জীবনে ‘সাধক অরবিন্দে’ পরিণত হয়েছিলেন। এধরনের ন্যুব্জ দর্শনের পরিণতি ঘটে সম্ভবতঃ এভাবেই।

১২ নভ ২০১৪
ধরা যাক এমন একজনের স্ট্যাটাস আপনাকে পড়তে দেয়া হল যেখানে লেখা আছে –
*********************
“...জামাত ই ইসলামকে বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে কোনও জনসভা করতে দেওয়া হয় নি। পশ্চিম বাংলার প্রথম সারির ১১টি মুসলিম সংগঠন একটি জনসভা করেছিল। ১১টি সংগঠনের মধ্যে জামাত ইসলামী হিন্দের নামটাই ছিল না। সেই জনসভা বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে করা হয়নি। মমতা দেবীর প্রশাসনের ১০ গাড়ী র্যানফ অনেক আগেই তাদের আটকে দেয়। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামাতি রাজাকারদের পক্ষে ১১টি সংগঠন সেই জনসভা করেনি। তারা সেই জনসভা করেছিল বাংলাদেশে ইসলাম অবমাননাকারী কুলাঙ্গার ব্লগারদের বিরুদ্ধে। যে কুলাঙ্গাররা দিনের পর দিন আল্লাহ, ইসলাম, মোহাম্মদ (সঃ), কুরাণ এবং হাদিসকে অকথ্য অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে চলছিল। ময়দানে জামাত ই ইসলাম যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামাতি সাঈদী-নিজামীর মত রাজাকারদের পক্ষে পুলিশের সহায়তায় জনসভা করেছিল। আপনার মিথ্যা। আপনি যে জনসভাটির কথা বলতে চেয়েছেন সেটিতেও জামাত ই ইসলাম হিন্দ নামটি ছিল না। সেই জনসভা ময়দানে নয়, শহীদ মিনার ময়দানে হয়েছিল। পশ্চিম বাংলার প্রথম সারির ১৫ টি মুসলিম সংগঠন এই জনসভা করেছিল। এই অধিকাংশ সংগঠনই নীতিগতভাবে জামাত ই ইসলাম হিন্দ বিরোধী। সেখানে তাদের জনসভা করা হয়েছিল বাংলাদেশের বহুল বিতর্কিত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল কৃত সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে, রায় পরবর্তিতে একসপ্তাহের মধ্যে পুলিশের গুলিতে ২০০ জনের মৃত্যু এবং মানবধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশে ইসলাম অবমাননাকারী কুলাঙ্গার ব্লগারদের বিরুদ্ধে। এই জনসভা বাংলাদেশ জামাত ই ইসলামের নায়েব সাঈদীর পক্ষে নয়, বরং ইসলামিক স্কলার- এশিয়া মহাদেশের অন্যতম সেরা তাফসীরে কুরান আল্লামা দিলোয়ার হোসেন সাঈদীর পক্ষে সমাবেশ হয়েছিল। এই সমাবেশের জন্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সমস্ত অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। ...”
*****************************

আপনি কী ভাববেন? কেপি টেস্ট (কাঁঠাল পাতা টেস্ট) না করেও আপনি বুঝবেন ব্যাটা এক রাম ছাগু। আপনি সোজা ট্র্যাশে চালান করে এক নম্বর পচা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন। কিন্তু যদি দেখেন কোন এক বিখ্যাত ‘সেলেব্রিটি’ সে ম্যাসেজটাকে আয়েশ করে মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ওয়ালে সযত্নে শেয়ার করেছে, তখন? ঠিক এই কাজটিই করেছেন বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী কবীর সুমন। উনি এক অখ্যাত ‘ছাগু’র স্ট্যাটাস ওয়ালে পোস্ট করে ছাগুটিকে লাইম লাইটে নিয়ে এসেছেন। যে শিল্পী দু’দিন আগেই শাহবাগ নিয়ে গান বেধেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন, আজ তিনিই এমন পোস্ট শেয়ার করেছেন যেখানে মুক্তচিন্তার ব্লগারদের ‘কুলাঙ্গার ব্লগার’ বলা হয়ছে আর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাইদীর (যিনি হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেদের বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা সহ বহু অপরাধে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত) আগে বসেছে ‘ইসলামিক স্কলার- এশিয়া মহাদেশের অন্যতম সেরা তাফসীরে কুরান’ টাপের আদেখালামো বিশেষণ!
কেন করলেন এ কাজটি সুমন?
কারণ তার দেউলিয়াপনা প্রকাশ করে দিয়েছেন পরিচয় পাত্র নামের এক লেখক একটি সাইটে (চিঠিটি পড়তে হলে দেখুন এখানে -http://www.guruchandali.com/defa…/…/11/08/1415446016404.html)। তারপর থেকেই মনে হচ্ছে সুমনের ‘মগজে কারফিউ’! এই চিঠির জবাব দিতে গিয়ে সুমন যা করলেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। ‘আমি’ ‘আমি’ আমি’ করে দেড় বিঘত লম্বা চওড়া এক ফিরিস্তি দিলেন, বাংলা গানের উন্নয়নে তার কী বিশাল ভূমিকা (যেন এটাতে কেউ সন্দেহ করেছে, কিংবা এটা প্রসাঙ্গিক)। সেখানে থামলেও না হয় চলতো, তিনি পত্রলেখককে ঠারেঠোরে ‘নিম্নবর্ণ মাহিষ্য’ বলে আখ্যায়িত করলেন, বললেন, ছেলেটা ‘বাবার পয়সায় অস্ট্রেলিয়া পড়তে গেছে’, কিংবা এও ইঙ্গিত করলেন ‘দেশে থাকলে গামছা বেচেও রোজগার করতে পারত না’ জাতীয় মন্তব্য। অথচ এই সুমনই না তার গানে গানে আমাদের শিখিয়েছিলেন –
বিরোধীকে বলতে দাও…
বিরোধীকে বলতে দাও…
বিরোধীকে বলতে দাও…
তোমার ভুলের ফর্দ দিক।
বিরোধীকে বাঁচতে দাও…
বিরোধীকে বাঁচতে দাও…
বিরোধীর দৃষ্টি দিয়েও সবাই নিজের হিসেব নিক।
যুক্তিকে বাঁচতে দাও…
যুক্তিকে বাঁচতে দাও…
যুক্তির স্বচ্ছ আলোয় শানিয়ে নিচ্ছি আমার চোখ।
বিরোধীর যুক্তিটাও বন্ধুরা আমল দাও,
বিরোধীর স্বাধীনতাটাই স্বাধীনতা সাব্যস্ত হোক।
এই কি তার নমুনা?

কোথায় যেন পড়েছিলাম ব্রাহ্মণ যখন মুসলমান হয়, গরু খাওয়ায় নাকি সবাইকে লজ্জা দেয়। পাকিস্তানী খ্রিস্টান ক্রিকেটার ইউসুফ ইউহানা মুসলিম হবার পর নাকি এক ওয়াক্ত নামাজ বেশি পড়তেন। সুমনেরও মনে হয় একই ধরণের সিন্ড্রোম কাজ করছে। ধর্মান্তরিত হবার পর (সেটা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নাই, ইনফ্যাক্ট সুমন –সাবিনা পরিণয়ে আবদ্ধ হবার পর আমি খুশি হয়েছিলাম সবচেয়ে বেশি) থেকেই দেখছি ক্রমশ ফরহাদ মাজহারীয় জমজমের পানিতে ক্রমশ মাথা ধুয়ে ফেলছেন তিনি- মুসলিম মানেই এখন তার কাছে ‘নির্যাতিত নিপীড়িত’ শক্তি – সেটা রাজিয়া বিবি হোক, বিন লাদেন হোক, ঔরঙ্গজেব হোক, বাদশাহ আকবর হোক, কিংবা হোক না সৌদি কিং আব্দুল্লাহ। মুসলমান যেহেতু, নিশ্চয় পশ্চিমা ইয়াহুদি-নাসারাদের অত্যাচারের শিকার তারা। তাই বর্ধমানে বোমা বানানোয় অভিযুক্ত জিহাদিনী রাজিয়া তার কাছে বিপ্লবী। মনে নেই - ফরহাদ মজহারও একসময় লাদেনকে বিপ্লবী বলতেন, জেএমবির সন্ত্রাসীদের বানিয়েছিলেন ‘মুক্তিযোদ্ধা’। সেই মুক্তিযোদ্ধারা নাকি তাদের মত করে ‘সমাজটাকে বদলাতে চায়’। ছাগতত্ত্ব আর বামতত্ত্বের খিচুড়ি রাঁধলে যা হয় আর কি – ‘সাম্যবাদের ডাক ঘুমে জাগরণে’! কে যেন বলেছিল না (চরম উদাস কি?) রামছাগল আর বামছাগলের মাঝে পার্থক্য কেবল তলে একটা ফুটার!
সুমন আমার খুব প্রিয় শিল্পী। যারা আমার লেখা পড়েন তারা জানেন - আমার বহু লেখার শিরোনামই করা হয়েছে সুমনের গানের কলি ধার করে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর যা আমি সবচেয়ে বেশি শুনেছি তা হল এই ‘সুমনের জীবনমুখী গান’। কিন্তু আজ এখানে এসে মনে হচ্ছে আলু ব্যাচা, ছোলা ব্যাচার কিংবা বাখরখানি ব্যাচার মতো সুমনও কেবল জীবনমুখী গান বেঁচে খান। ওটাই তার পেশা। রাস্তার পাশের ময়রা যেমন জিলিপিটা খুব ভাল বানায়, সুমনও তার বানী দিয়ে, ছন্দোবদ্ধ কথা দিয়ে, হৃদয় নিংড়ানো সুর দিয়ে আর পাশাপাশি তার সাংস্কৃতিক গভীরতা মাখিয়ে জিলিপির মতোই গান বাঁধেন খুব ভাল। শেষ বিচারে তিনি একজন গান ব্যাচা ময়রাই। গুরুচণ্ডালীতে Sandeepan DasGupta এই সত্য কথাগুলো কি অবলীলায় বলেছেন – “দোষ কবীর সুমন নয়, আমাদের প্রত্যাশার। মুক্তচিন্তার কথা গানে সুন্দরভাবে বললে আমরা ভাবি- এনার ব্যবহারিক চিন্তাও বোধহয় এতটাই সুন্দর। এটা ভুল প্রত্যাশা - কারণ চিন্তা থেকে গান হয় না - ওটা হয় পরিশ্রম আর চর্চা থেকে, ঠিক যেভাবে একটা জার্মান গাড়ি, ইতালীয় বেহালা, বা মেচেদার চপ তৈরি হয়।
এটা ঠিক যে এতটা আমিও প্রত্যাশা করি নি - ছাগু পোষ্টের প্রশংসা তো তুচ্ছ ব্যাপার, সামগ্রিকভাবে যুক্তির অভাব, মাত্রাতিরিক্ত অযৌক্তিক অভিযোগ, গালিগালাজ, বিরুদ্ধমতের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা - এসব চলতে চলতে শেষে পরিচয়বাবুকে PA করতে গিয়ে গোটা একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন সেটা নন্দীগ্রাম পরবর্তী সময়ে CPM-র অর্কুট ক্যাডারকুলের লেভেলের। "বিরোধীকে বলতে দাও" -এর জন্মদাতার কাছে এটা পেয়ে খারাপ লেগেছে যাদের - তারা মনে রাখুন, সৃষ্টি সৃষ্টির জায়গায়, আর মানুষটা মানুষের। কবি মিথ্যুক, কবিতাও মিথ্যে। গায়কের মূল্য যদি তার যুক্তিতে বা সত্যনিষ্ঠায় থাকত, তবে তিনি বৈজ্ঞানিক হতেন। এতে দু:খ পাওয়া বোকামো। সত্যেরে লও সহজে”। সত্য যে কঠিন সে কঠিনেরে ভালবাসিলাম, সে কখনো করেনা বঞ্চনা!

২৯ অক্ট ২০১৪

অদ্ভুত এ পৃথিবীতে খুব অদ্ভুতভাবে বেঁচে আছি আমরা। রেইহানি নামের একটা মেয়েকে ধর্ষন করা হলো ইরানে। শরিয়া আইন মোতাবেক মেয়েটিকেই উল্টো ফাঁসিতে ঝোলানো হল। আর মতিউর রহমান নিজামী নামের এক বদর বাহিনীর জানোয়ার অগনিত খুন খারাবি ধর্ষনের সাথে জড়িত থাকার কারণে ফাঁসির আদেশ হবার পরেও আমাদের শঙ্কা যায় না, কে জানে 'আড়ালে তার আপিল' হাসছে কিনা! নিশ্চয়ই আমরা নাকি মধ্যযুগের নই, একবিংশ শতকের আধুনিক যুগের বাসিন্দা।

২৪ অক্ট ২০১৪
পাকিস্তান থেকে ভাসতে ভাসতে বাংলায় চলে আসা আমাদের বিখ্যাত 'ভাসা সৈনিক' (ইহা সহি বানান) গোলাম আজম আর নেই। তার অকাল প্রয়ানে বদনাবোধ (আবারো, ইহা সহি বানান) করছি। তবে মৃত মানুষের নামে খারাপ কথা বলা যেহেতু নিষিদ্ধ - ইদানীং রামছাগলের সাথে বামছাগলেরাও এই ফতোয়া দিচ্ছেন- তাই আসুন তাঁর নামে কেবল ভাল ভাল কথামালা তৈরি করি। আর দৃপ্তকন্ঠে আওয়াজ তুলি - হুজুরেপাক ভাসা শকুন থুড়ি সৈনিকের লাশ শহীদ মিনারে নিতে হপে! কেউ দ্বিমত করলে সাম্রাজ্যবাদের কালো হাড্ডি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হবে - এ মর্মে আদালতের রুল জারি করা হোক।

১০ অক্ট ২০১৪
‘সারাদিন নর্দমা ঘাটা যার স্বভাব, ফুলের গন্ধ তার নাকে যায় না’। গান্ধী কি বলেছিলেন কথাগুলো? যেই বলুন, মালালা প্রসঙ্গে বাঙালির ফেসবুকিয় বুদ্ধিজীবীতার নমুনা দেখে আমার নিরেট মাথায় কেন যেন এ কথাগুলোই বারে বারে ঘুরে ফিরে উঠে আসছে। মালালা সম্বন্ধে একবিন্দু না জেনে তার কাজ, কিংবা অবদান সম্বন্ধে এতটুকু জ্ঞান না রেখে ফেসবুকের গালিবাজরা গালির তুবড়ি ছোটাচ্ছেন অহর্নিশি - "একটা গুলি খায়াই নোবেল পায়া গেল?" কেউ বা বলছেন, “মালালা একটা গুলি কেয়ে নোবেল পাইল, আমারে কামান মার”,কেউ আবার বলছে, “একটা গুলি খাওয়া ছাড়া মালালার শান্তিতে কি অবদান আছে?” বেচারি মালালা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী হয়েও গালি খাচ্ছেন তালিবানদের, ইসলামিস্টদের, মৌলবাদীদের। পাশাপাশি দেশপ্রেমিক বাঙালিদের, জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশীদের, সেক্যুলারিস্টদের, কমিউনিস্টদের। সবার। তালিবানি ইসলামিস্ট ঘরনার লোকজন মালালার উপর কেন ক্ষ্যাপা তা বোধ হয় বিশ্লেষণ না করলেও চলবে। কিন্তু অন্যরা? অন্যদের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং! ‘পাইক্কা বিরোধী’ দেশপ্রেমিক বাঙালিরা, জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশীরা, সেক্যুলারিস্টদের কিছু অংশ ক্ষ্যাপা, কারণ পাকিস্তানের সবকিছুই তাদের কাছে হারাম, এমনকি তাদের কেউ ‘যদি ফুল নিয়ে আসে তবুও’। তাদের বাঙালিপনা এমনই যে উর্দু ফার্সি শব্দ, ভাষাও জঘন্য, যদিও তাদের অনেক কথাতেই উর্দু শব্দের আধিক্য চোখে পড়বে, এমনকি বলিউডি সিনেমার কিছু কিছু চোস্ত উর্দু ডায়ালগও তাদের ঠোটস্থ। তাতে কি? ‘পাইক্কার সাথে সম্পৃক্ত’ যে কোন কিছুতেই গাইল দিতে হবে না? এদের কাছে তালিবানও যা, আসমা জাহাঙ্গিরও যা, পারভেজ হুদোভয়ও যা, মালালাও তা।

রের পেছনে যথারীতি, ‘পশ্চিমা চক্রান্ত’-এর গন্ধ পাচ্ছেন, হেজিমনি হেঁজেল গোঁফে তা দিয়ে ভাবছেন হঠাৎ করেই আইসিস ঠেকাতে এ বছর মালালাকে নির্বাচন করা হয়েছে নোবেলের জন্য, তারা জানেনও না আসলে মালালার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল গত বছরই। গতবছরই মালালা পুরস্কারের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। বহু পিটিশন করা হয়েছিল যেন মালালা এটি পান। ২৫৯০০০ সাক্ষর জমা হয়েছিল সপ্তাহখানেকের মধ্যেই, এমনকি রিচার্ড ডকিন্সের পক্ষ থেকেও ক্যাম্পেইন করা হয়েছিল। ২৫৯টি নমিনেশনকে পেছনে ফেলে মালালা এগিয়েও ছিল, কিন্তু গতবছর তিনি নোবেল কমিটির বিবেচনায় উত্তীর্ণ হননি। কিন্তু গতবার নোবেল না পেলেও সবাই বুঝেছিল মালালার নোবেল-প্রাপ্তি কেবল সময়ের ব্যাপার। তো এ বছর তিনি নোবেল পেলে সেটা ভুঁইফোড় ভাবে কিংবা ‘আইসিস আর ইসলামোফোবিয়া’কে ট্যাকেলের জন্য হবে কেন, তা আমার বোধগম্য হল না কোনভাবেই।
অবশ্য এর মাধ্যমে আমি বোঝাতে চাইছি না যে, নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। অবশ্যই আছে। ওবামা, রুজভেল্ট, হেনরি কিসিঞ্জার এর মতো লোকজন এই পুরস্কার পেয়েছেন, যা অবশ্যই বিতর্কিত। কিন্তু এ পুরস্কার তো মার্টিন লুথার কিং, শাকারভ, মাদার তেরেসা, নেলসন মেন্ডেলাও পেয়েছেন। সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন? মালালা এ পুরস্কার পেলে সেটা ঘৃণিত বা হবে কেন, আর পিস প্রাইসের কবরই বা হবে কেন? মালালার পুরস্কারে খুশি না হতে পারি, অন্ততঃ ঘৃণা করার মতো তো কিছু ঘটেনি। আরেকটি ব্যাপার। মালালার এ পুরস্কারের প্রচার আর বিতর্কে কৈলাস সত্যার্থীর পুরস্কার প্রাপ্তির ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। তার "বাচপান বাঁচাও" আন্দোলন ভারতের শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখনও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী অধিকারবঞ্চিত সুযোগসুবিধা বঞ্চিত হয়ে দিন কাটাচ্ছে, এখনো যে কৈলাস সত্যার্থী মতো লোকজন এ জন্য কাজ করে চলেছেন সেটাই আশার কথা। তারচেয়েও বড় কথা, উপমহাদেশের দুই চিরশত্রুদেশ অন্তত একটি ব্যাপারে এক হয়ে পুরস্কার ভাগ করে নিতে যাচ্ছে। এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ কিছুই নয় বলাই বাহুল্য।