Saturday, August 6, 2016

পুরো লেখাটা আমার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে


(পুরো লেখাটা আমার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। শুধুই আমার চিন্তা। অন্য ধর্মকে আঘাত করে বা ভুল দেখানর জন্য লেখা না। অন্য কোন ধর্মের অনুসারীরা এটাকে সহজভাবে নিবেন- এটাই আশা করব। যদি আপনার ধর্মানুভুতি আহত হবার চান্স থাকে - এটা পড়ে সময় নষ্ট করবেন না।)

আমার “অধার্মিক” (আমি নাস্তিক না, বস্তুবাদী) হওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ লম্বা। সেই সাথে অনেকটা সাইন কার্ভের মতো। আমার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি হাজারবার ফ্লাকচুয়েট করেছে এই জীবনে। নাস্তিক- আস্তিক, আবার আস্তিক-নাস্তিক হয়েছি হাজার বার। আবার অনেকসময় ২-১ বার নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতিও আকর্ষণ জন্মেছে।
আমার জন্ম মুসলিম পরিবারে। বাবা-মা হার্ডকোর ধার্মিক ছিলেন না। নামাজ নিয়মিত পড়তেন না কেউ। মাঝে মাঝে পড়তেন, আর হ্যাঁ, রোজার মাসে পড়তেন। রোজা রাখতেন সব। বাসায় ২-১ টা “নামাজ শিক্ষা” বই দেখেছি, আম্মু কুরআন পড়তেন। এর বেশি কিছু না। তবে আর যাই হোক, তাদের  ধর্ম বিশ্বাস ছিল অটুট। আর আমার দাদাবাড়ীর সবাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন।
আমি আসলে খুব ছোট থেকেই ধর্মের প্রতি তেমন অনুরক্ত ছিলাম না। ব্যাপারটার কারণ আমি জানি না। এটুকু বলতে পারি যে আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় ব্যাপারে যতটা আবেগ, ভয় ছিল, আমার ততটা না। তবে এটা আমি কারও সাথে শেয়ার করতাম না। ধর্ম নিয়ে তেমন কিছু জানতাম না। কিন্তু সবাই যখন ইসলামিক বিভিন্ন মুজিজা নিয়ে কথা বলত, কোন মাজারে মুহাম্মদের ছায়া দেখা গেছে, তা বলত, আমার কেন জানি বিশ্বাস হত না, কিন্তু আবার মনে হত যে বিশ্বাস না করলে যদি গোনাহ হয়? তাই জোর করে সত্য ভাবতাম এগুলো। আমি সুরা শিখেছিলাম অনেক আম্মুর কাছে। রাতে ঘুমানোর সময় মা ডেইলি কিছুক্ষন মুখে মুখে সুরা শিখাতেন। নামাজ পড়া শিখেছি ক্লাস ওয়ান এর আগেই বোধ হয়। কিন্তু মাসুরা- তাশাহহুদ-দরুদ পারতাম না, ওগুলো শিখেছিলাম ৩- ৪ এ। তবে, স্কুলে যাবার আগে আমার ধর্মীয় জ্ঞান কম ছিল।
স্কুলে ধর্ম বই পড়তে পড়তেই আমার প্রথম যে অব্জেকশন এসেছিল ধর্মের বিরুদ্ধে, তা হল-
“আমি কোন ধর্মের, তা ঠিক হয় জন্মের সময়েই। যে হিন্দু, সে তো তার বাবা- মার ধর্মের বাইরে যাবে না, যেমনটা আমিও যাব না। তাহলে হিন্দু ছেলেটা কেন জাহান্নামে থাকবে?? ওর তো দোষ নাই।”
এবং-
“আল্লাহই যদি সব বানায়,তাহলে তিনি কিছু বানানোর আগে তিনি ছিলেন কই?”
এর উত্তর তখন কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। করেছিলাম আরও পরে। এই সময়রে আমার আরেকটা চাইল্ডিশ চিন্তা এখন বলা দরকার। যা পরে আমার ওপর অনেক বড় প্রভাব ফেলেছিল –
“সবকিছুকেই অন্য কোন কিছুর ভেতরে থাকা লাগে,আমি ঘরে আছি, ঘর বিল্ডিঙে আছে...... পৃথিবী মহাকাশে আছে, মহাকাশ কিসের মাঝে আছে?? মহাবিশ্বের শেষ নাই- এটা কিভাবে হয়?? এটা কোথাও না কোথাও অবশ্যই শেষ হয়েছে ।”


বলা ভাল, আমি ছোট থেকেই অনেক বই পড়তাম। আর আমার এইম ইন লাইফ ছিল বিজ্ঞানী হওয়া। আমার এক মামা আমাকে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন, আমার সব ধরনের “মাথা খাটানো”র পেছনে তার অবদান অনেক। উনি বুয়েটে পড়তেন ইলেক্ট্রনিক্সে। অসাধারণ প্রতিভাশালী মানুষ। এবং জ্ঞানী মানুষ। এখন তিনি বুয়েটের শিক্ষক । বিজ্ঞান, সমাজ, ধর্ম, চলমান বিশ্ব – সব বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল অসাধারণ। তিনি ছিলেন আমার স্বপ্নের মানুষ। আমার আদর্শ। যা হোক, ধর্মীয় ব্যাপারে তিনিও ছিলেন উদাসীন। মাঝে মাঝেই আল্লাহ-নবী নিয়ে হাসাহাসি করতেন। এ নিয়ে আম্মু মাঝে মাঝে এটা ওটা বলতেন। আমার অবশ্য খুব মজা লাগত। আস্তে আস্তে আমি দেখলাম পৃথিবীর বড় বড় সব বিজ্ঞানী, মনীষী – সবাই অনেক বেশি পরিমানে নাস্তিক ছিলেন। তখন আমারও মনে ফ্যান্টাসির মতো ছিল নাস্তিকতা। তবে বলে রাখি- এটা কিন্তু আমার শিশু সুলভ ভাবনা, এর বেশি কিছু না, যৌক্তিক কিছু না। আর তখনকার বয়সে যুক্তি দিয়ে নাস্তিক হবার মতো জ্ঞান বা যৌক্তিক ক্ষমতা আমার ছিল না। তবে হ্যাঁ, বিজ্ঞানে আমার আকর্ষণ ছিল খুব বেশি । আর আমি আমার বয়সের অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি বিজ্ঞান জানতাম। যা হোক, ঠাকুরমার ঝুলি, গোয়েন্দা কাহিনী, ভুতের গল্পের পর মোটামুটি জাতের বই পড়া শুরু করি ক্লাস ২ থেকে। অনেক শখ করে “জাফর ইকবালের সাইন্স ফিকশন” কিনি। ওই সময় বই মেলায় আমি জাফর ইকবালের “ত্রিনিত্রি রাশিমালা” কিনেছিলাম। আর আমার ফুপা আমাকে দিয়েছিলেন তার “বিজ্ঞানের ১০০ মজার খেলা।” (এই বইটা আমাকে অ্যাপ্লাইড সাইন্সের প্রতি, এক্সপেরিমেন্টের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল ব্যাপকভাবে।) সত্যি করে বলছি আমি “ত্রিনিত্রি রাশিমালা”র খুব কম অংশই তখন আমি বুঝি নাই। নতুন জিনিস, সেই রকম মজা লাগল। আমি সারাদিন সাইন্স ফিকশন পড়া শুরু করলাম। জাফর স্যার আমার নতুন আদর্শে পরিনত হল।   তিনি বিজ্ঞানী তা আগেই জানতাম। পরে বুঝলাম তিনিও অধার্মিক। তখন আমার মনে আসত-
“ধর্মে খালি খাওয়া, বিয়ে করা,ব্যাবসা করা- এগুলাই করতে বলছে। নামাজ পড়তে বলছে। কিন্তু বিজ্ঞানী হইতে বলে নাই ক্যান?? বিজ্ঞানী না হইলে তো কিছুই হবে না। ”
ক্লাস ৫ এর দিকটায় আমার কাছে ধর্মীয় ঘটনা গুলো (যা বইয়ে পড়তাম) হাস্যকর লাগত। “...যুদ্ধে তার দাঁত মুবারক শহীদ হয়...” টাইপ লাইন পরে প্রচণ্ড হাসি আসত ।তবে আমি ভয়ও পেতাম। বিপদে আল্লাহকেই ডাকতাম। ক্লাস ৫ এ আমি কুরাআন শিখতে মক্তবে ভর্তি হই। দুপুরে ওখানে মুয়াজ্জিন স্টাফ কোয়াটারের ছেলেপেলেদেরকে কুরাআন শেখাতেন। সেখানে আমি অনেক ধার্মিক “বড় বড় মানুষ”কে চিনি। ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম... আমি তখন তাদেরকেই ধর্মের ধারক বাহক ভাবতাম। কয়েকদিনের মাঝেই তাদেরকে আমার বিরক্তিকর লাগা শুরু হল। কথাবার্তা, চালচলন, আচরন খুব লো ক্লাসের লাগত। (এভাবে বলা ঠিক না, তাও বললাম) জান্নাতে যাওয়ার জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য যে কাজ, সেটা “ভাল কাজ” কিভাবে হয়??একদিকে ধার্মিকরা- মসজিদের ইমাম- মুয়াজ্জিন। আরেকদিকে নাস্তিক – আমার মামা, জাফর ইকবাল।


হিসাবটা খুব সোজা ছিল, ধারমিকদের চেয়ে নাস্তিকরা জোস হয়। আবার আইনস্টাইন, মাদার তেরেসার মতো মানুষকে আল্লাহ সাস্তি দিবেন, মুয়াজ্জিনকে আদর করবেন- ক্যান?? সেই সময়ে আমার স্রেনীবিভাগটা ছিল- ধার্মিক আর নাস্তিক। এর বেশি কিছু বুঝতাম না। আমি তখন সবসময়েই নাস্তিক- আস্তিকের মাঝে আসা যাওয়া করতাম ... বেশিদিন নাস্তিক থাকতে পারতাম না- ভয় পেতাম,  কিন্তু পাল্লা ভারি থাকত নাস্তিকতার দিকেই।
কয়েকদিন পরে আমি কুরাআনের ১ পারা শেষ করি, তারপর আর ওখানে যাই নাই। আরবিতে কুরাআন পড়া ওই লাস্ট। ওহ, না ।আর পরও পড়েছি শবে কদরের রাতে।
গল্পের এই পর্যায়ে আমার জীবনের আরেকটা জিনিস বলা দরকার।
আমি ছোটবেলায় যেখানে ছিলাম, তার কাছেই ছিল বস্তি। ক্লাস ৬ পর্যন্ত আমার বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। আমাদের বাসায় ডিশের লাইনও তখন ছিল না। ভিসিপি টাইপ কিছুও ছিল না। আমি রাইফেলস পাবলিকে পড়তাম। ওখানে আমার বেশীরভাগ বন্ধুই ছিল “বড়লোকের পোলাপান”। এই জিনিসটা আমাকে ক্লাস ৩-৪-৫-৬ খুব হীনমন্যতায় রাখত । বন্ধুরা যখন গতকালের ক্রিকেট খেলা নিয়ে কথা বলত, বলিউডের নতুন চরিত্র ঋত্বিক কে নিয়ে কথা বলত, আমি চুপ হয়ে যেতাম। মনে আছে, ক্লাস ৫ এর বৃত্তি পরীক্ষায় আমাকে কোচিং করানো যায় নাই আর্থিক কারণে। যাই হোক, এসময় আমি সমাজের ৩ তা স্তর দেখি খুব কাছ থেকে।
১) বস্তির মানুষ – নিম্নবিত্ত/বিত্তহীন।
২) আমাদের কলোনীর মানুষ – মধ্যবিত্ত।
৩) আমার বন্ধুরা, আমার কিছু কাজিন- উচ্চবিত্ত।
মানুষের জন্মের সাথে কেন তার বিত্ত নির্ধারণ হবে, আর কেন একেক জন একেক ধরনের আরামে থাকবে তা আমাকে সবসময় রাগাত। আমি ভাবতাম যদি সবার টাকা একই হত, সবার একই জিনিস থাকত, কত্ত ভাল হত। আল্লাহ এটা কেন করল তা আমি ভাবতাম। আল্লাহও যে ভুল করতে পারে, সেটা আমি বুঝলাম। উল্লেখ্য, আমি সমাজতন্ত্র বা মার্ক্স কে তখনও চিনি নাই। কিন্তু কমিউনিজমের চেতনা এসেছিল একা একা। সেই ৪-৫ এ। আমার এই কল্পনার সমাজব্যাবস্থার নাম যে কমিউনিজম, তা জেনেছি পরে। এই ব্যাবস্থা আনার জন্য মানুষ যুদ্ধ করে জেনে যে আমি কত খুশি হয়েছিলাম, বলার মতো না।
ক্লাস ৬ এর শেষে আমার বাবা নতুন চাকরি নিলেন। তখন থেকে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই হুহু করে বদলাতে লাগল। তখন আমার আব্বু থাকতেন ঢাকার বাইরে। সপ্তাহে সপ্তাহে আসতেন। আমার বাবা প্রচণ্ড আরামপ্রিয় মানুষ। এই মধ্যবয়সে এত কষ্ট তার ভাল লাগত না। তিনি পুরা চেঞ্জ হয়ে গেলেন। আব্বুর সাথে আমার চরম সম্পর্ক ছিল, তা নষ্ট হল। হঠাৎ বাসা চেঞ্জ, পরিবেশ চেঞ্জ, পারিবারিক অবস্থার চেঞ্জ আমি সহ্য করতে পারলাম না। মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকলাম। ক্লাস ৮ এ তা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। আমি প্রথমবার সিরিয়াস প্রেমে পড়লাম, আমার চেয়ে অনেক বড় এক আপুর। এবং বুঝতে পারলাম এটা সম্ভব না। আমার মনে হতে লাগল এই দুনিয়ার কোন অর্থ আসলে নাই। আমি পুরপুরি নাস্তিক হয়ে যাই। ছোটবেলার মহাকাশ নিয়ে চিন্তাটা ডালপালা মেলেই এর জন্ম দেয়। এর পেছনে আমার লজিক ছিল-


““সবকিছুকেই অন্য কোন কিছুর ভেতরে থাকা লাগে, আমি ঘরে আছি, ঘর বিল্ডিঙে আছে...... পৃথিবী মহাকাশে আছে, মহাকাশ কিসের মাঝে আছে?? মহাবিশ্বের শেষ নাই- এটা কিভাবে হয়?? এটা কোথাও না কোথাও অবশ্যই শেষ হয়েছে। তাকে আবার যে ধরে রেখেছে, তাকেও আর কারও ভেতর থাকতে হবে। এভাবে তো কখনই শেষ হয় না। তারমানে?? তারমানে, জিনিষটায় ভুল আছে, আমরা আসলে নাই। সব ইলুশন ।আর দুনিয়া যখন নাই, আল্লাহ আবার কিসের??”
তখন আমি নতুন নতুন উপপাদ্য শিখেছিলাম ।মনে হয় উপপাদ্যে ত্রিভুজ অসমান প্রমানের মতো করে চিন্তা করার এই ফল।:D আমার তখন মনে হত এই দুনিয়ায় আমি যাদেরকে দেখছি, যা দেখছি- কিছুই সত্য না। সব ভ্রম। তারা সবাই একটা কাল্পনিক সিস্টেম। আমাকে নিয়ে খেলতেসে। আমি ছোট থেকে খুব ভাল ছাত্র ছিলাম... এবার আমি প্রচণ্ড রেজাল্ট খারাপ করলাম। টিচাররা অবাক হলেন। সারাদিন আকাশ কুসুম ভাবতাম ।আমার তত্তের কিছু আনসল্ভড জিনিশের উত্তর ভাবতাম -কোন কিছুর অস্তিত্ব না থাকলে “আমি”টা কি?? ইলুশন টা কোথায় দেয়া হচ্ছে ??কে দিচ্ছে??...  মনের মতো উত্তর খুজে পাতাম না। উত্তর আসত আস্তিক ভাবাসম্পন্ন, যা আমার মনপুত হত না।
এসময় আমি গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে হাল্কা পরাশুনা করি। তার আদর্শ আমাকে প্রচণ্ড আকর্ষণ করে। নিঃস্বার্থ, নির্মোহের এই নিরেশ্বর আদর্শ (আমি এখনো এটাকে আদর্শই বলি, ধর্ম বলি না ...) মনে হতে লাগল বেস্ট। আমি আবার ছোটবেলায় খুব পশুপাখি প্রেমী ছিলাম। গৌতমের প্রকৃতিপ্রেম তা আরও বাড়িয়ে দেয়। সেবার কুরবানীর ঈদ আমার কাছে নতুন অর্থ নিয়ে আসে, প্রচণ্ড ঘৃণা হয় ইসলাম ধর্মের ওপর। প্রানহত্যার ঈদ। অর্থাৎ আনন্দ। লাখ লাখ জীবিত প্রান হনন করে আনন্দ উৎসবের আয়োজন- অসভ্য, জংলী ছাড়া আর কি?? প্রয়োজনে আমরা প্রানী মারি, কিন্তু সেটাকে “আনন্দের দিন” বানানোর মানে কি??? আমি আর আমার এক ছোট ভাই সেদিন বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তা শুধু ওই পর্যন্তই। বুদ্ধের কঠোর আদর্শ আমরা মানতে পারি নাই ... এ আদর্শ সবার জন্য না।
একসময় আমার বাসায়ও মা আমার দশা বুঝল, নিজে অনেক বুঝালো, ডাক্তার দেখালো। লাভ হল না। দুনিয়াদারী ভাল্লাগত না একদমই। গুরুত্তহীন লাগত সব। রেজাল্ট চরম খারাপে পৌঁছানোর পর আমার গার্ডিয়ান ডাকা হল স্কুলে। আমি প্রথমবার ইচ্ছা করে মাথায় গ্লাস ভেঙ্গে অসুস্থ হয়ে বাবা মার স্কুলে যাওয়া থামাই। কিন্তু পরে তারা ঠিকই স্কুলে যান। আমি প্রথমবার আমার সবকিছু খুলে বলি। ম্যাডাম বলেন আমার রেজাল্টের কথা। আমার অবনতির কথা শুনে আব্বু আম্মু খুব কষ্ট পান। আব্বুর কাছে আমার জীবনের সেরা মার খাই ওই রাতে। ঘাড়ে, হাতে রক্ত বের হয়ে গিয়েছিল আমার ঐদিন মার খেয়ে।রাতে মা আমাকে জরিয়ে ধরে কেদেছিল। পরদিন সকালে আমি অবাক হয়ে দেখি বাবা কাদতে কাদতে বাসা থেকে চলে যাচ্ছেন কর্মস্থলে।
এটা ছিল আমার জন্য টারনিং পয়েন্ট। ঐদিন আমি সারাদিন ভেবেছি আমি কি করব তা নিয়ে। সিদ্ধান্তে আসলাম এটা যদি কোন ইলুশন-ই হয়, সেটাকেও আমি আনন্দের বানানোর চেষ্টা করব, এসব নিয়ে আর ভাবব না। ধার্মিক হয়ে যাব, ধর্ম মানব। অন্তত হারানোর কিছু থাকবে না। তারপর আমি হঠাৎ পুরা চেঞ্জ হয়ে যাই।


ঈশ্বর নিয়ে আর ভাবি না ।ধর্ম নিয়ে চিন্তা করি না- মেনে নেই সব। সবকিছু পজিটিভলি নিতাম এসময় আমি। আমি আবার আগের মতো প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি হলাম, রেজাল্ট ভাল হল ।হতাশা দূর হল। জীবনের নতুন মানে খুজে পেলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়গুলোর একটা ছিল এটা।
ক্লাস ৯ এর ২-১ মাস এভাবেই কাটে। কিন্তু আবার মাথায় আসে ওসব ভাবনা। এবার আর আমি হতাশ থাকি না। রেজাল্ট ও খারাপ হয় না। আমি তখন মোটামুটি সঠিক রাস্তা পাই-
“বিজ্ঞান ছাড়া কিছু বিশ্বাস করা গাধামি ।যেটার প্রমান নাই, সেটা আমি মানব না। আল্লাহ যদি থাকে, একদিন সাইন্স তা বের করবে। তখন মানব, খামাখা বিশ্বাস করব কেন?? আমি সত্যিটা জানতে চাই, আল্লাহ নিশ্চই রাগ করবেন না থাকলেও। আমি তাকে বিশ্বাস করি কিনা, সেটায় তো তার কিছু যায় আসে না, সে তো বিশাল এক সত্তা। তার চেয়ে আমি ভাল কিছু করি, যাতে মানুষের ভাল হবে, আল্লাহ থাকলে তাতেই খুশী হবে, আর না থাকলে নাই।”
বলা ভাল, আমি এসময় ধর্মে বিশ্বাস করতাম না... আপোসটা ছিল আস্তিকতা- নাস্তিকতা নিয়ে, ধর্ম নিয়ে না। ধর্ম সম্পর্কে ধারনাটা ছিল-
“ধরে নিলাম- আখিরাত আছে, আল্লাহ আছে। “দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র”। এটা পরীক্ষার জায়গা। যে ভাল করবে, তার স্থান হবে জান্নাতে, তাকে আল্লাহ পছন্দ করবে। এখন এটাকে বাংলা পরীক্ষার সাথে তুলনা করা যাক-
আমার কাল বাংলা পরীক্ষা। ক্লাসের ভাল ছাত্ররা নিজেরা নোট করেছে, তাই লিখবে পরীক্ষায়। মোটামুটি ছাত্ররা, ফেল্টুসরা পড়বে জুপিটার গাইড। অনেকে বানিয়ে লিখবে নিজের মতো করে। জুপিটার গাইড সবার জন্য। এটা টিচাররাই লিখে। এটা পড়লে ৭০% নাম্বার পাওয়া যায়। কিন্তু ৮০ পাওয়ার জন্য লাগবে নিজের স্বকীয়তা। নিজের নোট, বা বানায় লেখা। সবাই বানাতে পারে না। তাই তাদের গাইড লাগে। কিন্তু যারা সেরা হতে চায়, আলাদা হতে চায়, তাদেরকে নিজের মতো করেই আগাতে হবে- টিচার এতেই খুশি হবেন।
কুরআন-বাইবেল – এগুলো হল “গাইড”। এগুলো ফলো করলে মোটামুটিভাবে সমাজ চলবে। কিন্তু আমি যদি নিজের মতো করে চলি, আমি বেস্ট হতে পারব, আল্লাহ সেটাই আসলে চান। পরীক্ষায় নিজে থেকে লিখলে যদি তা খারাপ হয়, তাহলে নাম্বার খুব কম আসবে। এক্ষেত্রেও তাই। নিজের মনে চলে, কোন “গাইড” ইউজ না করে আমার খারাপ হবার চান্সও আছে। কিন্তু ভাল হলে খুব ভাল। তাই, এই ধর্ম হল ছাপোষা মানুষের জন্য। মহানদের জন্য না। তাই আল্লাহই যদি ধর্ম পাঠায়, তা আমি এটা মানব না, আরও জোস কিছু করব। আল্লাহ ও আসলে তাই চায়।”
এরপর স্টিফেন হকিন্সের বই পরে আমি বুঝতে পারি যে আসলে সৃষ্টিকর্তা আছে কি না, সেটা আসলে গবেষনার বিষয় হতে পারে, অর্থাৎ বিশ্বাসের না।
দুনিয়া তৈরির জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এসময় আমি পরাশুনা করি। কোন প্রকার ঈশ্বর ছাড়াই বিগ ব্যাং এর পরের সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়। ওপারিনের প্রান সৃষ্টি মতবাদও ছিল জানা। তৈরি হল প্রান। এককোষী। সেখান থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে বর্তমান কাল। বিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশে অনেক ফালাফালি হয়, কিন্তু ডিসকভারি বা ন্যাট জিওতে দেখেছিলাম- সবকিছু বিবর্তন দিয়েই ব্যাখ্যা করা হয়, নেট ঘেটে ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমীর ওয়েবেও পাই এর সপক্ষে কথা। বুঝি সত্যি আসলে কি।


এটাও বুঝি যে এটা নিয়ে আসলে সত্যিকারের বিজ্ঞানীদের কোনই সন্দেহ নাই।
তবে বিগ ব্যাং এর ওই কনা কত্থেকে এল, তা আমি তখন জানতাম না, ওটাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে আল্লাহ আসে – “আল্লাহ বানাইসে”। তারপর “আল্লাহর দেয়া নিওমে এগুলা চলতেসে” – এরকম ভাবা আরম্ভ করলাম। আবার কিছুটা  আস্তিক হয়ে গেলাম!!
এর কিছুদিন পর জানলাম যে ইউনিভার্স অনেকগুলা, একেকটায় ফিজিক্সের সুত্র একেকরকম। এটা ফিক্সড না, তাই “নিয়ম তৈরি করার জন্য” আল্লাহকে লাগল না। কিন্তু বিগ ব্যাং এর আগের কণাটা???
এরও উত্তর পেলাম কিছুদিন পর- কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন। কণাটা তৈরি হবার জন্যও কাউকে লাগে না।
হুদাই তাইলে ক্যান এই দুনিয়ারে ব্যাখ্যা করতে আল্লাহরে টানুম??
নাস্তিক হয়া গেলাম।
৯-১০ এভাবেই কাটে। হঠাৎ পরিবর্তন আসে টেস্ট এর পরে। এসময় আমার একজনের সাথে ব্রেক আপ হয়। ব্রেক আপ পরবর্তী সময় মানুষের জন্য খুব ইম্পরট্যান্ট। নতুনভাবে সবকিছু উপলব্ধি করা যায়, নিজেকেও। আমার মনে হতে লাগল, আমি নষ্ট হয়ে গেছি। মনে হয়- প্রেম- ভালবাসার জন্য আমার জন্ম হয় নাই। এগুলা করে সময় নষ্ট করতেসি আমি- ছিঃ। গত ৩ টা মাস পড়ি নাই। সামনে পরীক্ষা। আমি আমার মাঝে আরও অনেক খারাপ জিনিস আবিষ্কার করি। কয়েক মাস পর ছিল এসএসসি পরীক্ষা। তখন আমার মনে হল জীবনকে লাইনে রাখতে সিস্টেম দরকার। তখন আমি আমার জীবনকে কম্পিউটারের সাথে তুলনা করে নতুন থিউরীতে আসি -
“একটা পিসি কিভাবে কাজ করবে, তা নির্ধারণ করবে অপারেটিং সিস্টেমের ওপর। একেকটা সিস্টেমের একেকটা ফেচার আছে। ধরা যাক, আমার পিসি-তে এক্সপি আছে। আমি ম্যাক্স পেইন ১ খেলতে চাই। উইন্ডোজ ৯৮ এটা চালাতে পারে, এক্সপি পারে না। তাহলে আমাকে ৯৮ ইন্সটল করতে হবে এক্সপি বাদ দিয়ে। কিন্তু এক্সপির গ্রাফিক্স আবার ভাল। আমাকে দেখতে হবে কোনটা দরকার বেশি- আউটলুক, নাকি গেমটা খেলা?? গেম খেলা আমার মেইন উদ্দেশ্য, তাই আমি আউটলুক বিসর্জন দিব, ৯৮ লাগাবো পিসি-তে। আর আমি যদি চাই ২ টা জিনিসই থাকবে, তাহলে আমাকে রেডিমেড জিনিস ইউজ করা যাবে না। লিনাক্স ইউজ করা লাগবে, প্রোগ্রামিং করে নিজের কাঙ্ক্ষিত সবকিছু তৈরি করতে হবে, কিন্তু তা খুব সময়সাপেক্ষ।”
এই তত্ত আমি তখন নিজের ওপর ঝাড় ।
“আমার মাস ২ পর পরীক্ষা, আমাকে অন্য কিছু রেখে পরাশুনা করা লাগবে। ওই মেয়ের দিকে নজর দেয়া যাবে না। বস্তুত কারও দিকেই না। আমি যদি এখন হাতে ধরে আমার সব খারাপ জিনিস চেঞ্জ করতে যাই, আমার চেঞ্জ হতে সময় লাগবে। তার চেয়ে আমি রেডিমেড কোন লাইফস্টাইল নিজের মাঝে ইন্সটল করি। আর সেটা ছিল ইসলাম ধর্ম। ইসলামে নারী হারাম, তাই আমি এখন দেবদাশ হতে পারব না, পরাশুনা করতে পারব নিজের মতো থেকে। তবে কিছু বাড়তি জিনিস আসবে- আল্লাহ, রাসুল, নামাজ। কিন্তু আমার সময় নাই- আমাকে এই প্যাকেজ-ই নিতে হবে।”
আমি “মুসলমান” হয়ে গেলাম ৩ মাসের জন্য। ধর্মকে আল্লাহ প্রদত্ত ভাবি


নাই,বিশ্বাসও করি নাই। কিন্তু ওখানকার লাইফস্টাইল মেনেছি। শুক্রবার নামাজ পড়েছি। এভাবে কিছুদিন কাটালাম। আমার জীবনের শেষ ঐচ্ছিক নামাজ এই সময়েই পরেছিলাম। কিছুদিন পর নিজেকে নিজে “প্রোগ্রাম” করলাম (হ্যাঁ, পরীক্ষার আগেই)। এসএসসি দিলাম। কলেজে উঠলাম। আমার সত্যিকারের “RELIGIOUS VIEW” তৈরি হয়েছে এই কলেজেই।
কলেজে এসে দেখলাম বেশীরভাগ ছেলে সেইরকম ধার্মিক। ওয়াটারকিংডমে মেয়েদের স্তনে হাত বুলানো ছেলেরাও ধার্মিক, ফোনে টাংকিবাজরাও ধার্মিক। আবার ভাল মানুষও ধার্মিক ।স্কুলে আমার ধারনা ছিল ট্যালেন্টরা নাস্তিক হয়। কলেজে এসে ধাক্কা খেলাম। তখন আমি ধর্ম নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে দেখলাম, আমার জ্ঞান বেশ কম ।নারীদের প্রতি অবিচার ছাড়া আমি আর কোন পয়েন্ট জানি না। আমি তখন ইসলাম ধর্ম নিয়ে বেশ পড়াশুনা করি, কুরাআন পড়ি, এর হাজারটা খুত বের করি-কুরআনের রেফারেন্স দিয়ে। (হাদীস নিয়ে আমি ঘাটাই নাই। কারণ হাদীস আসছে হজরতের মৃত্যুর অনেক পরে। “সিহাহ সিত্তাহ” আল্লাহ-নবী নির্ধারণ করে দেয় নাই। মানুষ ই নিজের মতো করে ঠিক করেছে। সো, এগুলায় চেঞ্জ থাকা স্বাভাবিক।) তারপর লিস্ট করি সেগুলার।
এসময় আমি ইসলামের ৩ ধরনের অসঙ্গতি পাই-
    ১. বৈজ্ঞানিক অসঙ্গতি। “গগনমণ্ডলী”র ব্যাপারস্যাপার। অস্পষ্টভাবে “চাঁদ-সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোড়ে”- এইসব ব্যাপার। মডারেটেড মুসলিমরা যেরকম বলে- “কুরাআন বিজ্ঞানের আধার”, আমার তা মনে হয় না। বিজ্ঞান খুব ই কম আছে, যা আছে, তা মোটামুটি ৫৬০ সালে মানুষ যা জানত, তাই ই। এর বাইরে যা আনার চেষ্টা করা হয়েছে, সব ভুল বা অস্পষ্ট।
   ২. সামাজিক ও নৈতিক অসঙ্গতি। ক্রীতদাসীদের সাথে সেক্স এর ব্যাপারটা, মেয়েদের শাস্তি বেশি হওয়া, এগুলো দেখে অবাক লাগে, এই ধর্ম এখনও টিকে আছে কিভাবে? তাছাড়া আরেকটা জিনিস, এই দুনিয়ায় সেক্স নিষেধ, কিন্তু জান্নাতে ঠিক ই ৭০ টা... তাহলে নৈতিকতার কি থাকল?? গাধার সামনে মুলা ঝুলানো ছাড়া এটাকে আর কি বলব??
   ৩. ধর্মের নিয়ম কানুনের অনেক কিছুই এই যুগে আর চাইলেও মানা সম্ভব না এবং আরবের বাইরেও মানা সাম্ভব না। এই ধর্ম নির্দিষ্ট যুগে, জায়গায় হয়ত ঠিক ছিল, কিন্তু “সর্বকালের সমাজব্যাবস্থা” না।  যারা এখন ধর্ম মানে এবং জ্ঞানের কথা বলে, তারাও আসলে অনেক কিছু চেঞ্জ করেই মানছে। ছেলে মেয়ের মুখ দেখতে পারবে ১ বার, কথা হবে পর্দার আড়াল থেকে- এগুলা মান পারলে ... নিজেদের মতো করে এডিট করে এই যুগের মডারেটেড মুসলমানরা নিজেরাই আসলে এই ধর্মের “সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সমাজব্যাবস্থা, পরিবর্তিত হবে না” এইসব অস্বীকার করে। তারা আসলে নিজেরাও জানে না যে তারা আসলে ধার্মিক না...
এই সময়টায় আমি ক্ষ্যাপা নাস্তিক হয়ে গেলাম ।কেউ আমাকে ধর্মের কথা শোনালেই তাকে ধুয়ে দিতাম...  আমার নতুন জ্ঞান আমাকে তর্ক করার শক্তি দিল ধর্মের বিরুদ্ধে, নিজের অবিশ্বাসকে জ্ঞানে রুপান্তরিত করল।
কুরআনের আয়াত লেখা কাগজটা আমার কাছে ছিল বহুদিন। কলেজের মাঝের দিকে আমার মাথায় আবার কিছু দুশ্চিন্তা আসে ঈশ্বর নিয়ে ।কিছুটা আস্তিক হই এসময়ে। এবারের টপিক-“অলৌকিক ঘটনা”। “সুপারন্যাচারাল পাওয়ার”।
১ম বর্ষের শেষে আমি গ্রামে যাই একা একা। মুলত আরেকটা ব্রেক আপ হজম করতেই এই গমন। কলেজে লেখাপড়াতেও আমি খারাপ হয়ে গিয়েছিলাম। নটরডেম এর প্রেসার আমি সহ্য করতে পারিনি ।  একটা চেঞ্জ দরকার ছিল। যা হোক, এই ট্রিপে আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম। তার মাঝে একটা হল “জাদু”। আমার একমাত্র খালাতো বোনের ছেলের ওপর তার পরিবারের ই একজন (সঙ্গত কারনেই নির্দিষ্ট করে বললাম না।) চুল দিয়ে পুতুল বানিয়ে না জানি তাবিজ করে কি জানি করেছিল। এর অনেক সাইড ইফেক্ট ছিল – সারাদিন কাঁদা, শক্তি বেড়ে যাওয়া... ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো কমন। তবে আনকমন ছিল একটা জিনিস।