Thursday, August 25, 2016

রিচার্ড ডকিন্সের বাস্তবতার জাদু - প্রথম অধ্যায় (এক)

লিখেছেন: কাজী হাসান —  

[(অনুবাদকের ভূমিকা : ২০১১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রিচার্ড ডকিন্স, শিল্পী ডেভ ম্যাককিনের অলঙ্করণসহ প্রকাশ করেছিলেন The Magic of Reality: How We Know What's Really True; বইটি মূলত কিশোর আর অল্প বয়সী তরুণদের জন্য লেখা। বইটির হৃদয়স্পর্শী একটি অংশ হলো বইটি তিনি তার প্রিয় বাবা Clinton John Dawkins কে উৎসর্গ করেছিলেন। কৃষিবিজ্ঞানী বাবাই তার মনে প্রকৃতি আর বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসার বীজটি বপন করেছিলেন পূর্ব আফ্রিকায় কাটানো তার শৈশবে। রিচার্ড ডকিন্সের তিনটি অপ্রকাশিত বা প্রায় প্রকাশিত পাণ্ডুলিপির পর ঠিক করেছিলাম কিশোর তরুণ পাঠকদের উদ্দেশ্যে লেখা কয়েকটি জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই অনুবাদ করবো। সেই উদ্দেশ্যেই মূলত একটি নিবেদিত ফেসবুক পেজে বাস্তবতার জাদু নামে অনুবাদটি প্রকাশ করতে শুরু করেছিলাম, সেই লেখাটি এই ব্লগেও শুরু করার উদ্যোগ নিলাম। যদিও আমি কিছুটা ভাষাগত পরিবর্তন করে এটি খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করেছি যে কোনো কৌতুহলী পাঠকদের জন্য - বয়সের কোনো সীমাবদ্ধতা ছাড়া। বাস্তবতার জাদু বইটির ভূমিকার এই অংশটি বইটির একটি চমৎকার পরিচিতি হতে পারে। জাদু অনেক ধরনেরই হতে পারে । প্রাচীন মিসরীয়রা ভাবতো দেবী নুট (বা নিউথ) রোজ রাতে যখন সূর্যকে গিলে ফেলে তখন রাত হয়। ভাইকিংরা রঙধনুকে মনে করতো দেবতাদের বানানো সেতু যা দিয়ে তারা পৃথিবীতে নেমে আসে। এইসব কিছুতেই জাদুময়তা আছে, অপার্থিব বিস্ময়কর সব কাহিনী। কিন্তু আরো এক ধরনের জাদু আছে, আর সেই জাদুটি থাকে এই সব প্রশ্নগুলোর সত্যিকারের উত্তর আবিষ্কার করার আনন্দের মধ্যে। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবতার জাদু - বিজ্ঞান। - কাজী মাহবুব হাসান ( পোষ্টে ব্যবহৃত অলঙ্করণগুলো মূল বই থেকে সংগ্রহ করা, যার শিল্পী ডেভ ম্যাককিন)] রিচার্ড ডকিন্সের বাস্তবতার জাদু - প্রথম অধ্যায় (এক) বাস্তবতা কি ? জাদু কি ? বাস্তবতা হচ্ছে সেই সবকিছু যার অস্তিত্ব আছে। বেশ সহজবোধ্য মনে হয় কথাটি, তাই না? আসলে বিষয়টি এত সহজবোধ্য নয়। বেশ কিছু সমস্যা আছে। ডায়নোসরদের ব্যাপারটি তাহলে কি, তাদের একসময় অস্তিত্ব ছিল কিন্তু এখন আর তো তাদের অস্তিত্ব নেই? আর নক্ষত্রগুলো, এত দূরে যাদের অবস্থান যে, যখন তাদের আলো আমাদের কাছে এসে পৌছায়, আর আমরা তাদের দেখতে পারি, তখন তাদের হয়তো আর কোনো অস্তিত্বই নেই ? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ডায়নোসর আর নক্ষত্রদের নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু যাই হোক না কেন, কিভাবে আমরা জানি যে, কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে, এমনকি বর্তমানেও? বেশ, আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় - দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্পর্শ, শ্রবণ আর স্বাদ - তারা বেশ ভালোই দ্বায়িত্ব পালন করে বহু জিনিসের বাস্তব অস্তিত্ব আমাদের জন্য বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে: যেমন, কোনো পাথরের টুকরো কিংবা উট, নতুন কাটা ঘাস আর কেবলমাত্র বানানো কফি, শিরিস কাগজ আর মখমল, জলপ্রপাত এবং দরজার ঘন্টি, চিনি এবং লবন। কিন্তু আমরা কি শুধুমাত্র এমন কিছুকেই ‘বাস্তব’ বলবো, যদি সেগুলোকে আমরা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যে কোনো একটি দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে শনাক্ত করতে পারি? তাহলে দূরের ছায়াপথগুলোর ক্ষেত্রে কি হবে, খালি চোখে দেখার মত দূরত্বে যারা অবস্থান করে না? একটি ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেই বা কি হবে, যা এতই ক্ষুদ্র যে শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া যাদের দেখাই সম্ভব নয়? তাহলে আমাদের কি অবশ্যই বলতে হবে যে, তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই কারণ আমরা তাদের দেখতে পাইনা? না, অবশ্যই আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়কে শক্তিশালী করতে পারি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করার মাধ্যমে: ছায়াপথ দেখার জন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্র আর ব্যাকটেরিয়া দেখার অণুবীক্ষণ যন্ত্র। যেহেতু আমরা জানি ও বুঝি দূরবীক্ষণ যন্ত্র আর অণুবীক্ষণ যন্ত্র কিভাবে কাজ করে, আমরা তাদের ব্যবহার করতে পারি আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সীমানা বৃদ্ধি করতে - এই ক্ষেত্রে - আমাদের দৃষ্টিশক্তি - এবং সেগুলো যা দেখতে আমাদের সক্ষম করে তোলে, তা ছায়াপথ আর ব্যকটেরিয়ার অস্তিত্ব আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। তাহলে বেতার তরঙ্গ? তাদের কি অস্তিত্ব আছে? আমাদের চোখতো তাদের শনাক্ত করতে পারেনা, আমাদের কানও সেটি করতে পারেনা. কিন্তু আবারো বিশেষ কিছু যন্ত্র - যেমন, টেলিভিশন সেট - তাদের এমন একটি সংকেতে রুপান্তর করে, যা আমরা দেখতে আর শুনতে পারি। সুতরাং যদিও আমরা বেতার তরঙ্গ দেখতে ও শুনতে পাইনা, আমরা জানি যে, তারা বাস্তবতারেই একটি অংশ। দূরবীক্ষণ এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতই, আমরা জানি কিভাবে রেডিও আর টেলিভিশন কাজ করে। সুতরাং তারা আমাদের ইন্দ্রিয়কে সাহায্য করে যার অস্তিত্ব আছে তার একটি চিত্র নির্মাণ করার জন্য: বাস্তব পৃথিবী - বাস্তবতা। রেডিও দূরবীক্ষণ যন্ত্র ( এবং এক্স রে দূরবীক্ষণ যন্ত্র) আমাদের নক্ষত্র আর ছায়াপথদের দেখার সুযোগ করে দেয় আরো ভিন্ন চোখ দিয়ে দেখার মাধ্যমে: বাস্তবতা সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করার অন্য আরেকটি উপায় হচ্ছে সেগুলো। ডায়নোসরদের কথায় ফিরে আসি। আমরা কিভাবে জানি যে তারা একসময় এই পৃথিবীতে বাস করতো? আমরা তাদের কখনো দেখিনি অথবা শুনিনি বা তাদের আক্রমন থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করিনি। দূর্ভাগ্য, যে আমাদের কোনো টাইম মেশিন নেই যা কিনা আমাদের ডায়নোসরদের সরাসরি দেখাতে পারতো। এখানে আমাদের ইন্দ্রিয়কে সহায়তা করার জন্য আছে ভিন্ন ধরনের একটি সহায়ক: আমাদের কাছে আছে জীবাশ্ম, এবং তাদের আমরা খালি চোখেই দেখতে পারি। জীবাশ্মরা দৌড়ায় না বা লাফিয়ে বেড়ায়না ঠিকই, কিন্তু, যেহেতু আমরা জানি কিভাবে জীবাশ্ম তৈরী হয়,তারা আমাদের কিছু বলতে পারে বহু মিলিয়ন বছর আগে কি ঘটেছিল। আমরা এখন বুঝি কিভাবে পানি, এর মধ্যে দ্রবীভূত খনিজসহ কাদা ও শিলার স্তরের নিচে সমাহিত মৃতদেহর মধ্যে চুইয়ে চুইয়ে প্রবেশ করে। আমরা জানি কিভাবে খনিজ পদার্থগুলো স্ফটিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পানি থেকে স্ফটিক হিসাবে বের হয়ে আসে এবং মৃতদেহের খনিজ পদার্থগুলোর একের পর এক প্রতিটি অণুকে ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত করে, পাথরে উপর ছাপের মত শুধুমাত্র মূল জীবের আকৃতি আর কাঠামোর প্রামাণিক সাক্ষ্য রেখে যায়। সুতরাং, ইন্দ্রিয় দিয়ে সরাসরি ডায়নোসরদের আমরা দেখতে না পারলেও, অবশেষে আমাদের সেই ইন্দ্রিয়গুলোর (আমরা সেই প্রাচীন জীবনের চিহ্ন দেখতে ও স্পর্শ করে দেখি) কাছে পৌছানো এইসব পরোক্ষ প্রমাণগুলো ব্যবহার করে আমরা ঠিকই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, তাদের অবশ্যই অস্তিত্ব ছিল। (চলবে)