Wednesday, August 3, 2016

উগ্র নাস্তিক বনাম উগ্র আস্তিকদের চিপা অন্বেষী ‘সেলিব্রাটি’ ব্লগারদের জন্য!

লিখেছেনঃ অভিজিৎ রায়

ধর্মান্ধরা নাস্তিকদের পছন্দ করবে না জানা কথা। কিন্তু মানবতার বাণী কপচানো, সংখ্যালঘুদের জন্য অন্তপ্রাণ, গলা কাঁপিয়ে ‘টক শো’ করা ‘পুলিশ প্রোটেকশন’ নিয়ে চলা সেলিব্রেটি ব্লগাররাও দেখবেন চামের উপ্রে বামে গালি দিয়ে যাবে – ‘ব্যাটা তুই নাস্তিক হইছস ক্যান! ধর্মের বিরুদ্ধে লেখস ক্যান, দোষ তো তোরই। গলায় তুই কোপ খাইবি না তো খাইবো টা কে?’।
টিপিকাল ‘women raped, women blamed’ অ্যাটিচুড। বেডি তুই উগ্র পোষাক পড়ছস ক্যান, হ্যাল হ্যাল কইরা চলছস ক্যান, ছিনালী হাসি হাসছস ক্যান। তুই ঠাপ খাবি না তো খাইবো কে!
ওয়েল, চামে চামে ‘চিপায় পড়া আর চিপা খোঁজা’ এইসব সনাতন মানসিকতার লোকজন নাকি নতুন প্রজন্মের সৈনিক, দেশকে নতুন দিশা দেখাবে। দিশার ঠেলায় দিশাহারা অবস্থা আমাগো। ধর্ষিতা নারীদের মতোই। একবার ফিজিকালি ধর্ষিতা হয়, তারপর যখন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আঙ্গুল তুলে বলে – ‘ঐ পোশাক পইড়া গেছিল বইলাই না হইছে’। এইভাবে দ্বিতীয়বার হয় আরেকদফা ধর্ষণ। নাস্তিকেরাও তাই। গলায় খায় কোপ একবার। তারপর আসে আরো বড় কোপ – ১৫০০ লাইক আর ছয়শ শেয়ার হওয়া ‘চিপা খোঁজা’ সেলিব্রিটি ব্লগারদের স্ট্যাটাসের কোপ।

উগ্র নাস্তিক বনাম উগ্র আস্তিকদের চিপা : উগ্রতার দাঁড়িপাল্লা কি সমান?
পুরানা কথা বার বার বলতে ভাল লাগে না, তাও বলতে হয়। ‘উগ্র ধার্মিক’ আর ‘উগ্র নাস্তিক’ দুইটাই নাকি খুব খ্রাপ, দুইটাই একাত্তরের বিরোধী। এর চেয়ে বড় ফাউল কথা, এর চেয়ে বড় মিথ্যার বেসাতি আর কি হতে পারে? ইদানিং দেখছি ‘উগ্র’ শব্দটা পজিটিভ নেগেটিভ সসব কিছুর সাথেই ট্যাগ করে কাঠালের আমসত্ত্ব কিংবা হাঁসজারুমার্কা বাক্য তৈরি করছেন দিশা দেখানো সেলিব্রিটি ব্লগারেরা । ইদানিং এটা একটা খুব ভাল চল হয়েছে বটে। কিন্তু একটু চোখ খোলা রাখলেই দেখা যায়, এই ধরণের বক্তব্য কত অসার। যারা এগুলো বলেন তাদেরকেই যদি উল্টে বলা হয়- ‘উগ্র আওয়ামিলীগ আর উগ্র বিএনপি দুইটাই খারাপ, একাত্তর বিরোধী’ কিংবা ‘উগ্র মুক্তযোদ্ধা আর উগ্র রাজাকার দুইটাই খারাপ’ – তখন কিন্তু এই মাইনকার চিপা খোঁজা ‘মিডেল ম্যান’রাই হাঁ রে রে করে উঠবেন। নিপুন পলিটিশিয়ানদের মতো তাদের প্রক্ষিপ্ত বাক্যারলীতে চটক থাকলেও সেটা বোধশক্তির বিচারে অর্থহীন। কেউ যদি বলে ‘উগ্র সেক্যুলার আর উগ্র মৌলবাদী দুইটাই খারাপ’ – এটার কি কোন অর্থ হয়? কোন অর্থ হবে যদি কেউ বলে ‘উগ্র বিজ্ঞানমনস্ক আর উগ্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন দুইটাই বাজে, দুটোই একাত্তরবিরোধী?’ না হয় না। ওয়ান সাইড ক্যান বি রং, ডেড রং। ‘বিবর্তন বনাম সৃষ্টিবাদী রূপকথা’ কিংবা ‘বিজ্ঞান বনাম সংস্কার’ ‘একাত্তরের চেতনা বনাম রাজাকারী’ – এগুলোর মাঝে একটা স্ট্যান্ড নিতেই হয়। দুই নৌকায় পা রেখে মডারেট সাজার কোন অর্থ নেই। ‘হাফ প্রেগ্নেন্সি’ কিংবা ‘মডারেট প্রেগ্নেন্সি’ যেমন হয় না ; কোন নারী হয় ‘প্রেগনেন্ট’, নতুবা ‘প্রেগনেন্ট নয়’ – এইটাই বাস্তবতা। মাঝে মধ্যে বাস্তবতাটা বোঝা জরুরী। কাজেই ‘উগ্র ধর্মান্ধ আর উগ্র ধর্মবিদ্বেষীর চিপায় বিরক্তিকর অনলাইন জীবন’ এর আহাজারি করবেন না; এটা আমাদের কাছে ‘উগ্র মুক্তিযোদ্ধা আর উগ্র রাজাকারের চিপায় আপনার বিরক্তিকর অনলাইন জীবন’ এর মতো হ্যাস্যকর শোনাচ্ছে।

আর নাস্তিকদের উগ্রতাই বা কতটুকু? ‘ধর্মবিশ্বাসে’ আঘাতের কথা যেটা বলা হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা কেবল লেখালেখির মাধ্যমে সমালোচনা কিংবা বড়জোর ঠাট্টা তামাসা ব্যঙ্গবিদ্রূপেই সীমাবদ্ধ (যে ধরণের সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, ঠাট্টা তামাসা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ক্রীড়া সহ সকল শাখাতেই দেখা যায়)। ধার্মিকদের ভঙ্গুর অনুভূতি সামান্যতেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ধর্মযুদ্ধের নামে বিধর্মীদের উপর কি ধরণের অত্যাচার করা হয়েছিলো তা বললে তাদের ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পয়গম্বর-নবী-রসুল আর ধর্মের দেবদূতদের অমানবিক কার্যকলাপ তুলে ধরলে ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, নারীদের অন্তরিন করে তাদের অধিকার হরণ করা হয় তা বললে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, কৃষ্ণের লীলাখেলার কথা বললে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, ধর্মগ্রন্থ গুলোতে বর্ণিত অবৈজ্ঞানিক আয়াত বা শ্লোক তুলে ধরলেও তারা আহত হন। আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা হলে তো কথাই নেই; ঈশ্বর যে ‘খুঁটি ছাড়া আকাশকে ছাদ স্বরূপ ধরে রাখেন’ তা যেন চৌচির হয়ে তাদের মাথায় তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে পড়ে। ধর্ম সব সময়ই কৌতুকের বড় উৎস হলেও ব্যঙ্গ এবং কৌতুকবোধের ব্যাপারটা ধার্মিকদের সাথে সবসময়ই কেন যেন রেসিপ্রোকাল। অথচ, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি চলচ্চিত্র, খেলাধুলা বা অন্যান্য যাবতীয় বিষয়কে সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কেবল ধর্মের বেলাতেই গণেশ উল্টে যায় বরাবরই।
avijit1
বড় মজা না? ধার্মিক, মডারেট ধার্মিক, বক ধার্মিকেরা সব করতে পারবেন, কিন্তু নিজের বিশ্বাসের বেলায় ‘ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেয়ার পক্ষে আমি নই’। কি চমৎকার হিপোক্রেসি। অন্যের বিশ্বাস কিংবা ধারনার সমালোচনা করতে তো ধার্মিকদের কোন সমস্যা দেখি না। ডারউইনের সাথে বাঁদরের ছবি যোগ করে ‘বিবর্তনকে ভুল প্রমাণ’ থেকে শুরু করে নাস্তিকদের গায়ের জোরে ‘ছাগু’ প্রমাণ করা, বজ্জাত, মিথ্যেবাদী, চরিত্রহীন প্রমাণ করা, চড়া সুরে মাইক বাজিয়ে আজান দিয়ে পাবলিক নুইসেন্স তৈরি করে প্রার্থনার জন্য ডাকা, নামাজে ইমামদের খুতবা পড়ে পড়ে ইহুদী নাসারা বিধর্মীদের প্রতি উস্কানো- এমন কিছু নেই তো নেই যা তথাকথিত ‘ধর্মবিশ্বাসীরা’ করছেন না। তাতেও যখন কুলায় না, ‘কাফির অবিশ্বাসীদের গর্দানে আঘাত করার’, ‘যেখানেই পাওয়া যাক, হত্যা করার’ আয়াত আউড়িয়ে কোপানো পর্যন্ত জায়েজ হয়ে যায়। গলায় কোপ খাওয়া রক্তাক্ত নাস্তিকদের রক্তমাখা ছিদ্রান্বেষণ করে তার মধ্যে নিজের পাজামার গিঁট খুলে ধর্মোত্থিত শিশ্ন প্রবেশ করার প্রচেষ্টাও হয়ে যায় কত মহান।
avijit2
নাস্তিকেরা ধর্মবিদ্বেষী, খুব সমস্যা ?
সেলিব্রেটি ব্লগার বলেছেন, ‘আমাদের দেশের নব্য অনলাইন নাস্তিকদের অধিকাংশই আসলে নাস্তিক না, তাদের অধিকাংশই আসলে ধর্মবিদ্বেষী।’। হ্যা, নাস্তিকরা যেহেতু ধর্মে বিশ্বাস করেন না, ধর্মের সমালোচনা করবেন তারা, সেটাই স্বাভাবিক নয়? ধর্মের সমালোচনাটাকে কুৎসিৎ রূপ দেওয়ার জন্য ‘ধর্মবিদ্বেষী’ বলে ট্যাগ করেছেন। তো সে হিসেবে তো সেই সেলিব্রিটি ব্লগার আর তার অনুসারীরাও রাজাকার বিদ্বেষী, গোলাম আযম বিদ্বেষী, ফরহাদ মজহার বিদ্বেষী, হিযবুত তাহরীর বিদ্বেষী। তারা সেগুলোর সামালোচনা করেন। খুব প্যাশনেটলিই করেন। তাদের ‘ছাগু’ হিসেবে ট্যাগ করেন। কারণ তারা জানেন জামাত-শিবিরের আদর্শ মিথ্যার উপর, বর্বরতার উপর প্রতিষ্ঠিত। তা তারা যে কাজটা স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে করেন, সেটার লিমিট নাস্তিকদের উপর বেঁধে দিচ্ছেন কেন? নাস্তিকেরা যদি মনে করে, ধর্ম জিনিসটা পুরোটাই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত, ধর্মপ্রচারকেরাই সবচেয়ে বর্বর কাজগুলোর উদাহরণ হাজির করেছেন – বেদ পাঠের জন্য শম্বুকের শিরোচ্ছেদ করেছেন, শূদ্রদের পাছায় গরম শলাকা দিয়ে ছ্যাকা দেয়ার বিধান দিয়েছেন, গোপবালাদের সাথে লীলা খেলা করেছেন, নারীকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করেছেন, যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে যুদ্ধবন্দিনী এবং দাসীদের সাথে সহবাসের বিধান দিয়েছেন – সেগুলোর উল্লেখ এবং সমালোচনা করা যাবে না কেন? তবে কি তারা চান, আমরা সবাই চোখ বুঝে থাকি, আর আজন্ম লালিত কুসংস্কারে কেবল আস্থাশীল থাকি? কুসংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ তো নিজের সাথে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। ধর্মগুলোর মধ্যে বিরাজমান নিষ্ঠুরতার কথা কি তার অজানা? প্রতিটি ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন আয়াত এবং শ্লোকে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে ঢালাওভাবে, কখনো দেয়া হয়েছে হত্যার নির্দেশ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্ম আসলে জ্বিহাদ, দাসত্ব, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, হোমোফোবিয়া, অসহিষ্ণুতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারী নির্যাতন এবং সমঅধিকার হরণের মূল চাবিকাঠি হিসেবে প্রতিটি যুগেই ব্যবহৃত হয়েছে। সেগুলোর আলোচনা সমালোচনা করলে যদি ‘বিদ্বেষী’ ট্যাগ পেতে হয়, তবে আমরা বিদ্বেষীই বটে, ঠিক যেমন অনেকেই হিটলার বিদ্বেষী, উনারা গোলাম আজম বিদ্বেষী, কাদের মোল্লা বিদ্বেষী; সভ্য মননশীল বহু মানুষ যেমন ফ্যানাটিসিজম, রেসিজম, সেক্সিজম, বার্বারিজম বিদ্বেষী, ঠিক তেমনি অনেক নাস্তিক থাকবে যারা ধর্মবিদ্বেষী । টেক ইট।
জামাত শিবিরও ছাগু, নাস্তিকেরাও ছাগু?
আরেক সেলিব্রিটি ব্লগার নাস্তিকদেরও ‘ছাগু’ প্রমাণের মিশন নিয়ে নেমেছেন। কারণ নাকি রোহিঙ্গা ইস্যুতে ছাগুদের লজিকের সাথে নাস্তিকদের লজিক মিলে যায়। কি মনে হচ্ছে এই লজিক দেখে? রবীন্দ্রনাথেরও দাঁড়ি আছে, রাম ছাগলেরও দাঁড়ি আছে। অতএব রবীন্দ্রনাথ রামছাগল!
রোহিঙ্গারা নিজ দেশে নিপিড়িত হয়ে যখন বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিল, তখন তাদের যেভাবে তাড়ানো হয়েছে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কেউ সেটা মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখেছেন, কেউ বা দেশের সীমিত সম্পদ প্রভৃতির কথা ভেবে ভিন্নমত দিয়েছেন। আমি মুক্তমনাতেই দেখেছি বহু আওয়ামী নাস্তিককর্মী (আবার বইলেন না যে আওয়ামিলীগ করলে নাস্তিক হওয়া যায় না) পার্টির লাইন মোতাবেক রোহিঙ্গাদের তাড়ানোটাকে সমর্থন করেছেন। অনেকেই আবার সেটা সমর্থন করেনি। কিন্তু সেলিব্রেটি ব্লগার এক বাক্যে ফতোয়া দিয়ে দিলেন – ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে সব নাস্তিকই ছাগুদের লজিক ফলো করে’। কি আচাইয্য!
আর যদি রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘সব নাস্তিকের লজিক সব ছাগুদের লজিকের সাথে’ মিলে যেতেও তাতেই বা কি? তারা সব ছাগু হয়ে যেত? মইত্যা রাজাকার যদি বলে ‘সূর্য পূব দিকে উঠে’, আর সেলিব্রিটি ছাগু খোঁজা ব্লগারও যদি কখনো কোন লেখায় সেটা বলে বসেন, তবে কি তিনি মইত্যা রাজাকার হয়ে যাবেন? অদ্ভুত যুক্তি!
আপনাদের মনে আছে নিশ্চয় শফিক রেহমানের পরিচালনায় আশি না নব্বইয়ের দশকে দেশে ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতার’ আয়োজন করা হয়েছিল কোন একটা বনেদী হোটেলে। জামাত শিবির, আর ওলেমা, টোলেমা সহ সব ইসলামী দল এর প্রতিবাদ করেছিল – কারণ নারীদেহের বেপর্দা প্রদর্শনী শরিয়তসম্মত নয়। অন্যদিকে আরেকটা দলও এর প্রতিবাদ করেছিল – সেটা হল নারীপক্ষ এবং প্রগতিশীল নারী সমাজ। কারণ তারা মনে করেছে এখানে নারীকে পণ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এখন দুই দলই ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতার’ বিরুদ্ধাচরণ করেছে বলেই যে ‘নারীপক্ষ এবং প্রগতিশীল নারী সমাজ’ ‘ইসলামী ওলেমাদলে’ পরিণত হয়েছে তা কিন্তু নয়। উনার যুক্তি শুনলে তাই হবার কথা। কারণ, রবীন্দ্রনাথেরও দাঁড়ি আছে, রাম ছাগলেরও দাঁড়ি আছে যে! কে লজিক বোঝাবে বাপ!
স্যালুট টু নিঝুম!
এর মধ্যেও সবাই যে সেলিব্রিটি ব্লগারদের মত আচরণ করেছেন তা নয়। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হচ্ছেন নিঝুম মজুমদার। উনি নিজে আস্তিক বলেই আমি জানি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারেও দারুণ সোচ্চার। ব্লগে লিখছেন, ফেস বুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, লণ্ডনের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সেমিনার, দেন দরবার জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য দৌড়ে বেড়াচ্ছেন; নিজের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিচ্ছেন এই যুবক এই লক্ষ্যে। সেলিব্রিটি ব্লগারদের তুলনায় তার পরিশ্রম এবং অবদান তার কম কিছু নয়। মনে প্রাণে আস্তিক হওয়া সত্ত্বেও উনি তার একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন যা টক শো করা ‘সেলিব্রেটি ব্লগার’দের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। উনি বলেছেন
আজকে একটি ছেলে সামিউর রহমানকে জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা নৃশংস ভাবে কুপিয়ে জখম করেছে আজকে। সাথে সাথেই আমাদের কিছু পরিচিত কাছের মানুষ কিংবা গণজাগরণ মঞ্চের সাথে জড়িত ব্যাক্তিরা ঘোষণা দিলেন এই বলে যে, সামিউর রহমানকে তাঁরা চেনেন না এবং তিনি গণজাগরণ মঞ্চের কেউ নন। আমি জানিনা কার বিবেচনায় এমন স্টেটমেন্ট এসেছে কিন্তু আমার ভালো লাগে নি। কার ভয়ে, কিসের ভয়ে কিংবা কোন প্রাপ্তির জন্য এ স্টেটমেন্ট আপনাকে বা আমাকে দিতে হবে? একজন নাস্তিক কি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে থাকতে পারবেন না? এইসব পশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য কি এখন আমাকে এইরকম স্টেটমেন্ট দিয়ে বেড়াতে হবে? …
এইসব ধর্মান্ধদের জন্য যখন দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন, কার্টুনিস্ট আরিফ দেশ ছেড়ে চলে যায় তখন আপনি আমি চুপ ছিলাম। মহান লেখক হুমায়ুন আজাদকে যখন এই ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা কুপিয়েছিলো তখন আমরা চুপ ছিলাম, শহীদ রাজীবকে ওরা যখন জবাই করে চলে গেলো তখন আমরা সবাই ব্যাস্ত ছিলাম আমরা কে কে নাস্তিক বা আস্তিক সেটি প্রমাণ করবার জন্য (এই আমিও সেটি বার বার বলে গেছি, ধিক্‌ নিঝুম মজুমদার!!!! কেন আমাকে প্রমাণ করতে হবে আমি আস্তিক না নাস্তিক? কার কাছে প্রমাণ করব? ওই জামাতী পশুদের কাছে?)
আসিফ মহিউদ্দিনকে যখন ওরা জবাই করবার জন্য হিংস্রতা দেখালো তখনও আমরা চুপ ছিলাম, আজকে সামিউরকে ওরা জবাই করতে এসেছিলো, আজকে আমরা বলে বেড়াচ্ছি সে আমাদের কেউ নয়। কেন? কিসের জন্য? আমরা আস্তিক না নাস্তিক না সংশয়বাদী না কিছুইনা এটার প্রমাণ কোনো মানুষের কাছে আমি কেন দেব? কেন আমার বিশ্বাস নিয়ে আমি অন্যের কাছে জবাবদিহি করব?
একদিন আমাকে খুন করে চলে গেলে বা জবাই করলে আপনারাই হয়ত সাথে সাথে স্টেটমেন্ট দিবেন যে আমি কেউ না, আমি ব্লগ করিনি, আমাকে কেউ চেনেন না। একদল আমাকে বানাবেন এই পলিটিকাল দলের, আরেকজন বানাবেন ওই পলিটিকাল দলের, ওই সংগঠনের, এই সংগঠনের, আমাকে নিয়ে ব্লগ বের হবে, আমাকে নিয়ে গল্প বের হবে। কেউ কেউ ব্যাক্তিগত মেসেজে বলবেন, আরে নিঝুম তো বিখ্যাত হবার অন্য বলেছিলো, ফরগেট হিম!! সিলেটের জগৎজ্যোতির মত আমাকে হত্যা করবার জন্য মামলাও হয়ত হবে চার পাঁচ দিন পর, ইনফ্যাক্ট হবে কিনা সন্দেহ।
আজকে সামিউরকে কোপানোর পর সবার স্ট্যান্ড দেখে এই ছাড়া আর কি ভাবব। একের পর এক মেসেজ আসছে ফেসবুকে। নিঝুমদা, সামিউরকে নিয়ে এখন শুরু হয়ে যাবে মৌলবাদীদের উৎপাত। ভাই কিছু করেন। কেন করব? কেন বলব? কেন লিখব? আপনারা সবাই জানেন কে করছে এসব, কেন করছে এসব, কিসের জন্য করছে এসব। বার বার লিখছি, বলছি, দিন রাত ২৪ ঘন্টা আপনাদের ফেসবুকে বিরক্ত করছি তারপরেও আপনারা এসব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসব কথা বলেন, ভয় পান, ধর্ম নিয়ে কুঁকড়ে থাকেন।
শেইম!!!! শেইম অন ইউ!!! শেইম অন মি!!! ধর্ম নিয়ে এত কুরকুরানি থাকলে চলেন ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকি। আন্দোলন সবার জন্য না। ফুলস্টপ।
বোধদয় হয়েছে সচলায়তনের পুরোধা এস এম মাহবুব মুর্শেদেরও। 
তিনি তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন –
‘Sorry Asif I doubted you. Glad that you are back and healthy again.’
আমার কিংবা নিঝুম বা মুর্শেদের মত ‘চুনোপুঁটি’ ব্লগারদের বোধদয় হলেও ‘সেলিব্রিটি’ ব্লগারদের বোধদয় হবে বলে মনে হয় না। এই ফেসবুকেই আছে ভিডিও – নবী মুহম্মদ যেভাবে ক্কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিন্তে মারওয়ানের মত কবিদের হত্যা করেছিলেন ইসলামের আর নবীর বিষেদগার করার জন্য, ঠিক একইভাবে থাবা বাবাকে মেরে ফেলাও জায়েজ আছে। বহু মানুষই সেই লিঙ্ক দেখেছে। এখনো সেটা বহাল তবিয়তেই আছে। সেলিব্রিটি ব্লগারেরা যদি এই ব্যাখ্যা ভুল মনে করেন, কই দেখছি না তো এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, যতটা বুক ফুলিয়ে তারা নাস্তিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন।
দেশে এখন সবচেয়ে যেটা কম প্রার্থনীয় সেটা হল শক্তিশালী ব্লগারদের মধ্যে বিভাজন। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাওয়াটাই মূখ্য হবার কথা ছিল না? মনে হচ্ছে সেলিব্রেটি ব্লগাররা তা চান না। রাজীব বা সানিউরের যে ইস্যুগুলো আমাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারতো সেটাকে তারা প্রবাহিত করেছেন আস্তিক-নাস্তিক বিভাজনের হাতিয়ারে। শিবির তো প্রথম থেকেই চেয়েছে এই সূক্ষ্ম বিভাজন তৈরি করে শাহবাগের আন্দোলন স্তিমিত করতে। এখন শিবির যা চায়, সেলিব্রিটি ব্লগারও তা চাচ্ছেন। তো আপনাদের সেই ‘রবীন্দ্রনাথের দাঁড়ি আছে … রামছাগলেরও …’ লজিকে কিন্তু আপনাদেরও শিবির বানিয়ে দেয়া যেতে পারে। কেমন হইবে সেটা?
যদি তারা সত্যিই মনে করেন, মৌলবাদীরা তাদের ‘শান্তির ধর্ম’কে বিকৃত করছে, তবে তাদের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হবার কথা ছিল না? তা না করে সুনিপুন রাজনীতিবিদদের মতো নাস্তিকদের চরিত্রহননে নেমে গেলেন। অবশ্য আমার মত নাস্তিকদের আর চরিত্র কি! তারা ঠিক করেছেন ক্ষতবিক্ষত নাস্তিকদের কাঁধে বন্দুক রেখেই শান্তির চায়ের পেয়ালায় চুকুক দেবেন। তারা এখন মরিয়া হয়ে ‘শান্তি’ স্থাপনে ব্যস্ত। তা তাদের দেখানো শান্তির রূপটা কেমন?
অতঃপর ওম শান্তি!
কৌশিকের স্ট্যাটাসটা এক্ষেত্রে মাইল ফলক-
নাস্তিক মারতে মারতে মোটামুটি সাফ করে ফেলেছে। আমার দেশ মোটামুটি শান্ত। তারপরে একদিন জানা গেলো আস্তিকদের মধ্যে একদল নাস্তিক মারাকে পছন্দ করে নাই। নাস্তিক মারা সমর্থন করে না যারা তারাও নাস্তিক বলে সাব্যস্ত হলো। দলটা একটু বড় হলেও তাদেরকেও মারতে শুরু করলো। মোটামুটি সাফ হয়ে গেলো। এরপরে জানা গেলো, আস্তিকদের মধ্যে আরো একটা বৃহৎ দল তৈরী হয়েছে – যারা এটাকে গণহত্যা বলছে। কিন্তু এটাও তো পরিস্কারভাবে নাস্তিকদের পক্ষালম্বন। সুতরাং তারাও নাস্তিক বলো ঘোষিত হলো এবং সবাইকে মেরে ফেলা হলো। তারপরে….আরো কিছু সংঘর্ষ, আরো মানুষ মারলো। তবে কে কাকে মারলো সেসব আর ইতিহাসে লেখা থাকলো না।
দেশে অতপর একটা শান্তি স্থাপিত হলো। যে দেশে মানুষ থাকে না সে দেশে শান্তিকে তো থাকতেই হবে।
সবাই বলেন, ওম শান্তি!
[Avijit Roy(Notes)

 

 

হুমায়ূন আহমেদকে অভিজিৎ রায়ের একগুচ্ছ চুতরাপাতা

লিখেছেনঃ অভিজিৎ রায়
বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। নিউইয়র্কের বাংলাদেশীদের প্রিয় চ্যানেল ‘প্রবাসী টিভি’র অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। কিন্তু এসে তার মন ভরছে না। কেমন যেন দায়সারা গোছের সেট। সেটের উপরের আলোগুলো ফ্লাড লাইটের মতোই চোখে এসে পড়ছে। অনুষ্ঠানের এক কমবয়সী উপস্থাপিকা ইংরেজি উচ্চারণে টেনে টেনে বাংলা বলছে। লেখালিখিতে কার ইন্সপিরেশন আছে, ‘রাভিন্ড্রোনাঠ টেগোরের’ গান শুনেন কিনা, শাওন বাংলাদেশি রান্নার পাশাপাশি ‘ইটালিয়ান পাস্তা কুক’ করে কিনা এইগুলো প্রশ্ন চলল কিছুক্ষণ।
অনুষ্ঠানের শেষে এসে শাওন এবং হুমায়ূন আহমেদকে একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়া হল। উপস্থাপিকা টেনে টেন বললেন, ‘আপনারা টো ডুই জনি সাংস্কৃটিক জীবেনের সাথে জরিত, দুইজনই একে অপরকে love করে marry করেছেন। আপনারা দুইজনই কাগজে English এ একটি sentence লিখুন যেখানে love এবং sex ঠাকবে’।
শাওন কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন-
‘কেন লাভ আর সেক্স দিয়ে বাক্য হতে হবে?’
উপস্থাপিকা বললেন-
এটে আমাডের new generation এর ছেলে মেয়েরা correct ধারণা গেইন করতে পারবে।
অগত্যা দুইজনই কাগজে লেখা শুরু করলেন।
শাওন অনেক চিন্তা ভাবনা করে লিখলেন,
when two people love each other very much just like Humayun and I do, their attraction grow physically and spiritually, it is then morally acceptable to exchange sex romantically.
এবার হুমায়ূন আহমেদের কাগজটি নেয়ার পর দেখা গেল তিনি লিখেছেন তিনটে শব্দ –
I love sex.
——————————–
ডিসক্লেমার -বাই দ্য ওয়ে, এটি একটি নির্দোষ কৌতুক। হুমায়ূনভক্তরা দয়া করে মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না। এই কৌতুকের সাথে সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘সুপার হিরো’ শিরোনামের লেখাটিতে আহমদ শরীফকে মূর্খ বলার কিংবা আসিফ মহীউদ্দীনের এই বিশ্লেষণমূলক লেখার সাথে কোন সম্পর্ক নেই। এর আগে রিচার্ড ডকিন্স, জাকির নায়েক, শাফায়েত সহ অনেককে নিয়েই কৌতুক করা হয়েছে, এইটাও সেরকমই একটা কৌতুক।
হুমায়ূন আহমেদ বর বড় বাক্য পছন্দ করেন না (এটা নিয়ে আনিসুল হকের একটা সমালোচনা ছিলো বোধ হয়, যেটা মুহিত হাসান দিগন্ত কোথাও উল্লেখ করছিলেন সম্ভবত)।
উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন –
” কমলা একজন সুন্দর,লম্বাচুলের দীর্ঘ-কর্ণ, তিলবিশিষ্ট ফর্সা নারী। তিলটাই তার চেহারায় আলাদা বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে। আপন মনে বসে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছে আর ভাবছে…”
-এই বাক্যটি হুমায়ূন আহমেদের কোন বইয়ে থাকবে না। ‘কমলা একজন সুন্দর,লম্বাচুলের দীর্ঘ-কর্ণ, তিলবিশিষ্ট ফর্সা নারী’র বদলে উনি লিখবেন ,
– ‘কমলা এসেছে । লম্বা ধরণের মেয়ে। ধবধবে ফরসা। লম্বা চুল। মুখে তিল। মায়াবতী মেয়ে। বড়ই মায়াবতী’।
এর পাশাপাশি উনি বিশিষ্ট ফিশিষ্ট, শ্রদ্ধেয় টাইপের কঠিন শব্দ কিংবা যুক্তাক্ষর তার লেখায় আনবেন না। আনতে পারেন যদি কোন চরিত্র নিয়ে ফাজলামো আর গুঁতাগুঁতি করতে ইচ্ছে হয় তার। যেমন সালাম আকবর নামের কোন চরিত্র তৈরি করলেন লেখায়, যিনি সমাজে মান্য গণ্য লোক, কিন্তু ভিতরে ভিতরে চুপা জামাতি টাইপ কেউ। কম বয়সী মেয়ে দেখলেই ছোক ছোক করে। উনার মতোই লিবিডো বেশি। তখন উনি লিখবেন, “সালাম সাহেব একজন ভদ্রলোক। বিশিষ্ট ভদ্রলোক”। শ্রদ্ধেয় শব্দটাও তাই। উনি মূলতঃ মূর্খ মানুষজনকে বোঝাতে ব্যবহার করেন। অনেকেই মনে করেন, প্রথম আলোর ‘সুপার হিরো’ নামের আহমদ শরীফ আর সিরাজুল ইসলামকে ‘শ্রদ্ধেয়’ বলেছেন সেটা কাকতালীয় নয়।
কাজেই লাভ আর সেক্স দিয়ে বাক্য করতে বললে সম্ভবতঃ উনি ওটাই লিখতেন, কারণ এর চেয়ে ছোট বাক্য সম্ভব নয় বলেই মনে হয়।