Saturday, October 24, 2015

বারমুডা ট্রাইএঙ্গেল


পৃথিবীতে মানুষের পদচারণা শুরু হয়েছিল সেই অনেক বছর আগে অর্থাৎ হোমো সেপিয়ান্সদের রাজত্ব শুরু হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। তারপর আর থেমে থাকে নি মানুষ। ধীরে ধীরে জয় করেছে পৃথিবীকে, রহস্য উদঘাটন করেছে প্রকৃতির। কিন্তু প্রকৃতির অনেক রহস্য এখনও অজানা রয়ে গেছে। এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে আজ পর্যন্ত মানুষের কোনো পদচিহ্ন পড়ে নি। সেই রকম রহস্যময় জায়গাগুলোর মধ্য অন্যতম একটি “বারমুডা ট্রাইএঙ্গেল”। আটলান্টিক মহাসাগরে যার অবস্থান। নাম থেকেই বোঝা যায় এর আকার ত্রিভুজের মত। কিন্তু অনেকের মতে এটি দেখতে ট্রাপিজিয়ামের মত; যা ছড়িয়ে আছে স্টেট অব ফ্লোরিডা, বাহামা, মেক্সিকো হয়ে পূর্ব দিক দিয়ে আটলান্টিক অঞ্চলজুড়ে। কিন্তু বেশিরভাগ ভু-তত্বব্বিদদের মতে এর অবস্থান পুয়ের্তো রিকো হতে বারমুডা এবং সেখান থেকে পশ্চিমে স্টেট অব ফ্লোরিডার পূর্ব উপকূল জুড়ে। যার আকৃতি দেখতে ত্রিভুজের মতো। অনেকে এটাকে ‘Devil’s triangle’ বা ‘শয়তানের ত্রিভুজ’ বলে থাকে। কোনো অজ্ঞাত কারণে এর সীমানার মধ্য প্রবেশ করা অনেক জলযান এমনকি উড়জাহাজও হারিয়ে গেছে চিরতরে। যাদের কোনো হদীস আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় নি। বর্ণণাকৃত জায়গাটির আবস্থান মূলত জলভাগের উপরেই। অর্থাৎ স্থলভাগের উপর যেসব অঞ্চল পড়েছে সেইসব জায়গায় কখনও দুর্ঘটনা ঘটেনি।

এই ত্রিভুজ সম্পর্কে প্রথম বর্ণণা দেন ক্রিস্টোফার কলোম্বাস ১৪৯২ সালে। তার বর্ণণায় এসেছে যে, তিনি দিগন্তে অদ্ভূদ আলোর নাচানাচি এবং আকাশে ধোয়া দেখতে পান। তা ছাড়া ঐ অঞ্চলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তার কম্পাস উল্টা পাল্টা নির্দেশনা দিচ্ছিল। তারপর ‘ফ্লাইট নাইন্টিন’ এর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে ই. ভি. ডব্লিউ জোন্স – এর ১৯৫০ সালে লেখা একটি রিপোর্টের মাধ্যমে বারমুডা ট্রাইএঙ্গেলের কাহিনী সবার সামনে উঠে আসে।

এর রহস্য নিয়ে অনেক আজগুবী কাহিনীও রচিত হয়েছে। কেউ মনে করে সেখানে ভিন গ্রহের প্রাণী অর্থাৎ এলিয়েনদের কোনো আস্তানা রয়েছে। যার ফলে সেখানে কোনো মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। কেউ বা মনে করে ফোর্থ ডাইমেনশনাল ক্র্যাক বা চতুমাত্রার ফাটলের কথা। অর্থাৎ সেখানে টাইম ও স্পেসের মাঝে একটি ফাটল বিদ্যমান, যার ভিতর পড়লে সবকিছু হাড়িয়ে যায় সময়ের গহবরে। কেউ আবার মনে করে সেখানে রয়েছে এক অজানা সভ্যতা। এসব নিয়ে অনেক লেখকও লিখেছেন কাহিনী। তাদের মধ্যে ভিনসেন্ট গডিস –এর ‘ Invisible Horizon ‘, জন ওয়ালেন্সের ‘Limbo of the lost’ , রিচার্ড উইনারের ‘Devil’s island’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

চলুন এবার আসা যাক আসল রহস্যের দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা - ফ্লাইট নাইন্টিন, ইউ. এস. নেভীর একটি ফ্লাইং স্কোয়াড তাদের প্রশিক্ষণ মিশন শেষ করে রওনা দিয়েছিল ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে। উড়তে উড়তে হঠাৎ হাড়িয়ে গেল কোনো অজ্ঞাত কারণে ঐ অঞ্চল দিয়ে উড়ে আসার সময়। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকেও আর যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ একটি বার্তা ভেসে আসে স্কোয়াড ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে – “We don’t know where we are, water is green and there is no white”. “আমরা জানি না আমরা কোথায় আছি, পানির রঙ সবুজ এবং কোথাও কোনো সাদা নেই”। এরপর চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যায় ফ্লাইট নাইন্টিন স্কোয়াড। অনেক খোজাখুজির পর তাদের ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় নি। তারপর একদিন সান জুয়ান থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি অটার প্লেন যার নাম ‘ডগ্লাস ডি. সি. – ৩’ একইভাবে হাড়িয়ে যায়। সেই প্লেনে ৩২ জন যাত্রী ছিল। তারা হটাৎ ককপিটের সাথে যোগাযোগ হাড়িয়ে ফেলে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর তারা বার্তা পাঠাতে সক্ষম হচ্ছিল। এমনকি সমুদ্র তীর থেকেও প্লেনটাকে দেখা যাচ্ছিল। এভাবে ত্রিশ মিনিট তারা এলোপাতাড়ি চক্কর দিতে দিতে সবার চোখের সামনে থেকেই হাড়িয়ে যায়। এরপর আরও দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে। কিন্তু তাদের কারণ বিশ্লেষণ করে কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা দাড় করানো সম্ভব হয় নি। কারণ কোনো দুর্ঘটনারই কোনো ধবংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় নি। যদিও ১৯৭৫ সালে লরেন্স ডেভিড কুসচে ‘বারমুডা ট্রাইএঙ্গেল মিস্ট্রি সলভড’ নামে একটি বই বের করেছিলেন। যেখানে তিনি বলেছেন যে, এই রহস্যকে লেখকরা জিইয়ে রেখেছেন কিছু মনগড়া কাহিনীর উপর ভিত্তি করে। তিনি এর কিছু ব্যাখ্যাও দাড় করান। যদিও তার ব্যাখ্যাগুলো সর্বস্মম্মতভাবে গৃহীত হয় নি কিন্তু তিনি এই রহস্যকে ঘিরে যে বাণিজ্য শুরু হয়েছিল তার মুখোশ খুলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কি ? ব্যাপারটা এখনও ভূতুড়ে মনে হচ্ছে ? বিজ্ঞানীরা এই ভূতুড়ে কাহিনীগুলো বিশ্লেষণ করে মোটামুটি একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করেছেন। ব্যাখ্যাটি হল – মিথেন হাইড্রেড সেলভে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ মিথেন হাইড্রেড অনেক সময় বুদবুদ আকারে বেরিয়ে আসে। বাতাসের বুদবুদ পানির প্লবতা কমিয়ে দেয়। যার ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাহাজ ডুবে যায়। আরও একটি কারণ হতে পারে ‘গলফ স্ট্রিম’। এটি হল স্টেট অব ফ্লোরিডা থেকে উত্তর আটলান্টিকের দিকে প্রবাহিত হওয়া একটি উষ্ণ সমুদ্র স্রোত যা যে কোনো ভাসমান বস্তুকে তার বলের বিরুদ্ধে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে স্রোতের অভিমুখে। কিন্তু উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার কোনো ব্যাখ্যা এখনও দেয়া সম্ভব নি।

রহস্য যত গভীরই হোক না কেন অযৌক্তিক কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের জ্ঞান ও প্রযুক্তি হয়তো বা এখনও সেই পর্যায়ে পৌছায় নি বারমুডা ট্রাইএঙ্গেলের রহস্য উদঘাটন করার জন্য। কিন্তু তাই বলে কখনও হবে না এটা বলাও তো ঠিক না। একদিন না একদিন আমরা অবশ্যই পারব এই রহস্যের ইতি টানতে। কারণ মানুষ কখনও হার মানে না।