Monday, October 5, 2015

সমস্যা হলো ভোগবাদী সংস্কৃতি আর আছে কিছু মিথ, গালগল্প। 


জীবন মাত্রই মূল্যবান, বিশেষ করে মানবজীবন। একটি
জীবনের পেছনে থাকে অপরিসীম অধ্যাবসায়, ত্যাগ,
যত্ন, কামনা-বাসনা, বিনিয়োগ। এই জীবন অবহেলায়
অযত্নে, কিছু মানুষের লোভ আর স্বার্থপরতার কারণে
শেষ হয়ে যাবে? আমরা কিছুই করব না? রাষ্ট্র
সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবে না? মানুষের জন্যই তো
রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান। নিয়মকানুন সব কিছু।
তাহলে চরম দুদর্দশা নিয়ে অনাহারে ভাসতে থাকা
অগণিত মানবসন্তানদের উদ্ধারে কেন সর্বাত্মক
উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না?
দেশের বেকার সমস্যা প্রকট- এটা যেমন ঠিক, তেমনি
আবার গ্রামে-গঞ্জে এখন আগের মতো কাজের লোক
পাওয়া যায় না-এটাও সত্য।তাহলে বিদেশ যাওয়ার
জন্য এত এত মানুষ ব্যাকুল কেন?
বিদেশ যাওয়ার পেছনে পেটের খিদে নিঃসেন্দহে
প্রধান ভূমিকা পালন করে। যখন কেউ খিদে
মেটানোর ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু করতে ব্যর্থ হয়, তখন সে
মরিয়া ওঠে। মানুষের প্রয়োজন যখন তীব্র হয়, তখন সে
যেকোনও উপায়ে সেই প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা
করে।
আরেকটা সমস্যা হলো ভোগবাদী সংস্কৃতি। অভাব
আমাদের দেশে সব সময়ই ছিল। কিন্তু অভাববোধটা
এখনকার মত এমন সুতীব্র ছিল না। আগে একজন
অতিদরিদ্র মানুষও এখনকার মতো এমন নাই-নাই, চাই-
চাই মনোভাব প্রকাশ করত না। এখন মানুষের মধ্যে
অভাববোধটা বেড়েছে। ভোগবাদী সংস্কৃতি
প্রতিনিয়ত তাকে নিত্যনতুন পণ্যসামগ্রীর মায়াজাল
পেতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তার আর সামান্য
ডাল-ভাত কিংবা সাধারণ বিছানা পছন্দ হয় না।
তারও চাই এলইডি মনিটরের কালার টিভি, টাচস্কিন
মোবাইল, টিভি বিজ্ঞাপন আর নাটকে দেখানো নরম
বিছানার চকচকে ছিমছাম বাড়ি, গাড়ি- আরও কত
কী! কিন্তু এসব আসবে কোত্থেকে? নিজ এলাকায়
কাজ করলে, রিকশা কিংবা ভ্যান চালালে যা
আসে, তাতে টেনেটুনও দিন চলে না। আছে
পরিবারের সদস্যদের দাবি, আবদার। আছে ভবিষ্যতে
আরাম-আয়েশ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটানোর স্বপ্ন।
আর আছে বিদেশ সম্পর্কে কিছু মিথ, গালগল্প।
আমাদের দেশের মানুষ এমনিতেই গল্প করতে, গল্প
শুনতে পছন্দ করে। আর যারা একবার বিদেশে গেছে,
সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে আয়-উপার্জন করে
এসেছে, তারা তো একেকজন রূপকথার জন্মদাতা।
তারা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের, টাকায় আয়ের আশ্চর্য সব
গল্প শোনায়। এসব গল্প শুনে একজন বঞ্চনাক্লিষ্ট
দরিদ্র যুবক মুগ্ধ হয়। সেই স্বপ্নের ‘বৈদেশ’ যেতে
নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত থাকে।
একথাও ঠিক যে, আমাদের দেশে আশি এবং নব্বইয়ের
দশকে বৈধ কিংবা অবৈধভাবে যারা অভিবাসী
হিসেবে বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন, তাদের
বেশিরভাগই ভাগ্যন্নোয়ন করতে পেরেছেন। সেই সময়
তারা দেশে ফিরে টিনের চাল দেওয়া পাকা বাড়ি
করে গ্রামের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন।দেশে
খড়ের ঘরের পরিবর্তে টিনের চালওয়ালা পাকা
বাড়ির ব্যাপক প্রবর্তন প্রবাসীদের উপার্জিত
অর্থেই হয়েছে। আবার প্রতারকের খপ্পরে পড়ে জমি-
জমা সব বিক্রি করেও বিদেশ যেতে পারেনি,
কিংবা বিদেশ গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি,
মাঝখান থেকে সর্বস্ব হারাতে হয়েছে-এমন উদাহরণও
প্রচুর আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, নিরক্ষর দরিদ্র
মানুষেরা এসব নেতিবাচক অভিজ্ঞতার চেয়ে
সাফল্যের গল্পগুলোকেই বিশ্বাস করে বেশি। কারণ,
এই বিশ্বাসের মধ্যে তার নিজের জীবনের
স্বপ্নপূরণের আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে থাকে!
আমরা দেখি যে, এখনও অনেক অভিবাসীই আছে
যারা বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠায়। সেই টাকায়
পরিবারের সদস্যরা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটায়।
এসব দেখে এবং শুনে ভাগ্যবিড়ন্বিত অনেকেই মনে
করে, একবার বিদেশ যেতে পারলেই বুঝি সব সমস্যার
সমাধান হয়ে যাবে। কয়েক বছর কাটিয়ে টাকার
বস্তা নিয়ে দেশে ফেরা যাবে।সব স্বপ্ন পূরণ করা
যাবে।

আমাদের দেশে ধান্দাবাজ অসাধু মানুষের অভাব
কোনও কালেই ছিল না। নানা ফিকিরে কিভাবে
কিছু বাড়তি টাকা উপার্জন করা যায়- এমন
মানসিকতার লোকজন চারদিকে ভিড় করেই থাকে।
সবাই খালি সুযোগ খোঁজে। একজনের দারিদ্র্যের
সুযোগ নিয়ে তাকে আরও বেশি নাজেহাল করা,
প্রলোভন ও স্বপ্ন দেখিয়ে তার সর্বস্ব লুটে নেওয়ার
জন্য এক শ্রেণির মানুষ মুখিয়ে থাকে। ওদিকে চরম
দারিদ্র্যক্লিষ্ট-অসহায়-অসচেতন কিন্তু নিজের
ভাগ্যন্নোয়নে ব্যকুল মানুষগুলো কেবলই ঠকে, ঠকতেই
থাকে।
একটি স্বাধীন দেশে এই অনাচার চলতে পারে না।
মানবপাচার ঠেকাতে যেখানে যতটুকু ব্যবস্থা গ্রহণ
করা দরকার তার সবটুকুই করতে হবে। সীমান্ত
রক্ষীবাহিনীর দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে। টেকনাফ-
উখিয়া হয়ে কীভাবে দিনের পর দিন হাজার হাজার
মানুষ পাচার হয়? এখানে সীমান্ত নিরাপত্তা
রক্ষীরা কী করে? ব্যর্থতার জন্য তাদের চাকরি যায়
না কেন? এটা যদি অবৈধ মানবপাচারের মেইন পয়েন্ট
হয়, তাহলে সেখানে বিশেষ বাহিনী নিয়োগ দেওয়া
হচ্ছে না কেন? বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না
কেন?
দালাল চক্রকে খুঁজে বের করা, তাদের দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তির ব্যবস্থা করাও জরুরি। কিন্তু কথা হলো ঘণ্টা
বাঁধবে কে? প্রশাসনের সঙ্গে এসব দালালচক্রের
লেনদেনের সম্পর্কের কথা সুবিদিত। এই সন্ধি
ভাঙ্গবে কে? সেই হিম্মত আর সদিচ্ছা বর্তমান
সরকারের কর্তাব্যক্তিদের আদৌ আছে কি?
বিশ্বে প্রবাসী আয় সংগ্রহকারী শীর্ষ ১০টি দেশের
মধ্যে বাংলাদেশের স্থান অষ্টম। এটি নিঃসন্দেহে
আমাদের জন্য আনন্দের সংবাদ। এটাকে পরিচর্যা
করতে হবে। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে হবে।
জনশক্তি রফতানিকে সরকারের এক নম্বর
প্রায়োরিটি দিতে হবে। শেষ বিচারে জনসংখ্যাই
কিন্তু আমাদের একমাত্র সম্বল। প্রাকৃতিক সম্পদ
যেটুকু যা আছে তা এক সময় শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু
জনসংখ্যা রয়ে যাবে। এই জনসংখ্যাকে কীভাবে
দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়, কীভাবে
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনশক্তির চাহিদা পূরণে
ব্যবহার করা যায় তা গভীরভাবে ভেব
ে দেখতে হবে।
যে দেশে যে ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি দরকার
সে অনুযায়ী দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর
সেখানে তাদের পাঠাতে হবে। সরকারের কূটনৈতিক
মিশনগুলোকে এ ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব দিতে
হবে।যেসব দেশে জনশক্তি রফতানির সম্ভাবনা আছে
এবং বেশি সংখ্যক অভিবাসী যেসব দেশে আছে,
দরকার হলে সেসব দেশে সরকারি লোকবল বাড়াতে
হবে।
পৃথিবীর তাবত সুখী দেশের সুখী মানুষগুলো তাদের
থাকার একটা জায়গা দেয়ার কথা ভাবা উচিত । হতে
পারে ঘন জঙ্গল যেখানে কেউ থাকে না । হতে পারে দুর্গম
পাহাড়ি এলাকা একেবারে নির্জন সেখানেও কেউ থাকে
না । তারা সেখানে থাকুক , অনাবাদি জমি আবাদ করুক ।
সুখী মানুষের মত জীবন যাপন করুক । অন্তত বাঁচার চেষ্টা
করুক ।
অথবা এখন যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক । সমুদ্রে ভাসুক
। দিনের পর দিন । এরপর খেয়ে না খেয়ে মারা যাক । সমুদ্রে বিলীন
হোক মানুষগুলো । অন্তত পৃথিবীর কিছু বোঝা তো কমবে ।
আর অনাহারক্লিষ্ট , হাহাকারে বিদীর্ণ মুখগুলো না
দেখলেও পৃথিবীর মানুষের শান্তি ।