ব্রিটিশ দার্শনিক ব্রায়ান ম্যাজি ১৯৭৮ সালে বিবিসি তে Men of Ideas নামে একটি ধারাবাহিক টিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতেন। অনুষ্ঠানটির জন্য আধুনিক দর্শনের ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচন করেন এবং প্রতিটি বিষয়ের বিখ্যাত কোনো বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আসেন সে নিয়ে আলোচনা করার জন্য। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো দার্শনিক চিন্তাধারার স্বয়ং প্রবর্তককেই তিনি নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন নোম চমস্কি, ডব্লিউ ভি কোয়াইন এবং ইসায়াহ বার্লিন। এছাড়া The Great Philosophers নামে ১৯৮৭ সালে আরেকটা টিভি অনুষ্ঠানও করেছিলেন যেখানে প্লেটো থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ পাশ্চাত্য দার্শনিককে নিয়ে তার দর্শনের কোনো বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করতেন।
দুটো অনুষ্ঠানই বর্তমানে ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে, তবে সব আমার এখনও দেখা হয়নি। আমি সর্বকালের সেরা নারী দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার এর Pyrrhus et Cinéas পড়তে গিয়ে হাইডেগার সম্পর্কে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ হাইডেগার ছাড়া বোভোয়ারের অস্তিত্ববাদ (existentialism) বুঝা সম্ভব নয়। তো হাইডেগার পড়তে গিয়ে দেখলাম লিখতে হলে আগে তাকে নিয়েই লেখা উচিত, জঁ-পল সার্ত্র বা বোভোয়ার কে নিয়ে নয়। ম্যাজির দুটো অনুষ্ঠানেই হাইডেগারকে নিয়ে একটা করে পর্ব ছিল, মেন অফ আইডিয়াস-এ এটা নিয়ে আলাপ করেছেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’র নিট্শে-কিয়ের্কেগর-হাইডেগার ভক্ত দর্শন-অধ্যাপক উইলিয়াম ব্যারেটের সাথে, আর দ্য গ্রেট ফিলোসফার্স-এ কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি’র বিশিষ্ট হাইডেগার-বিশেষজ্ঞ হিউবার্ট ড্রাইফাসের সাথে।
আমি এখানে দ্য গ্রেট ফিলোসফার্স-এ ড্রাইফাসের সাথে কথোপকথনটার স্বেচ্ছাচারী অনুবাদ করছি। প্রতিটি লাইন ধরে অনুবাদের পরিবর্তে আমি একবারে একজন আলোচক যা বলছেন তার পুরোটাকে নিজের ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। এবং ক্ষেত্রবিশেষে আমার নিজের কিছু সহযোগী কথাও যোগ করব। সুতরাং এটাকে কোনোভাবেই সৎ অনুবাদ বলা যাবে না। সহযোগী কথাগুলো তৃতীয় বন্ধনীর ভিতরে উল্লেখ করব। হাইডেগারের দর্শনকে এক কথায় বলা যায় “ব্যক্তিগত জীবন যাপনের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনার মতো” দর্শন। তবে শুরুতে এটুকুও বলে রাখা ভালো যে হাইডেগার একজন নাৎসি ছিলেন। তিনি ১৯৩৩ সালে ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রেক্টর পদাভিষিক্ত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে নাৎসি পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে পার্টির বিলুপ্তি পর্যন্ত এ সদস্যপদ বহাল রাখেন, যদিও এক বছরের মাথায় রেক্টর থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও তিনি নাৎসিদের অপকর্ম যেমন হলোকস্ট নিয়ে কিছু বলেননি, এবং কোনোদিন কারো কাছে ক্ষমাও চাননি। তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে ক্ষমা করা যতটা অসম্ভব, তার যুগান্তকারী দর্শনকে অবহেলা করাও ততটাই অসম্ভব। অনেকটা যেমন ক্রিস্টোফার হিচেন্সের ইরাক যুদ্ধ সমর্থন ক্ষমা করা ও তার কর্মকে অবহেলা করা দুটোই অসম্ভব, বা সর্বকালের সেরা নারী চলচ্চিত্রকার লেনি রিফেনস্টালের নাৎসি প্রোপাগান্ডা ক্ষমা করা এবং তার চলচ্চিত্রতত্ত্বকে নগণ্য মনে করা দুটোই অসম্ভব। তবে শুরু করা যাক হাইডেগার-চর্চা, বা হাইডেগিরি।
১৯২১ সালে জার্মানির Sankt Märgen এ এডমুন্ড হুসার্ল ও তার ছাত্র মার্টিন হাইডেগার।
ব্রায়ান ম্যাজি’র ভূমিকা
বিংশ শতকের শুরুর দিকের একজন দার্শনিক দর্শনের বাইরে খুব একটা পরিচিত না হলেও দর্শনের ভিতরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হলেন জার্মান এডমুন্ড হুসার্ল যার জন্ম ১৮৫৯ সালে আর মৃত্যু ১৯৩৮ সালে। তার সর্বজন স্বীকৃত মাস্টারপিস হচ্ছে Logische Untersuchungen (“যুক্তিগত অনুসন্ধান”) যা ১৯০০ এবং ১৯০১ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। তার অন্য বইগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে ১৯১৩ সালের Ideen (“আইডিয়াসমূহ”)। হুসার্লের মূল চিন্তাধারা ছিল এমন। আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা ব্যাপার একেবারে সুনিশ্চিত, তা হলো আমাদের নিজস্ব চেতনা (consciousness, awareness)। সুতরাং আমরা যদি বাস্তবতার চিত্র কোনো প্রস্তরকঠিন ভিত্তির উপর তৈরি করতে চাই, তাহলে সেখান থেকেই শুরু করা উচিত। এই পর্যন্ত অবশ্যই তার ধারণা ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্তের (১৫৯৬-১৯৬০) মতো। এরপর তিনি দেখলেন, আমাদের চেতনাটা বিশ্লেষণ করতে গেলেই দেখা যায় যে সেটা সবসময়ই “কোনো কিছুর” বা “কোনো কিছু সম্পর্কিত” চেতনা। চেতনা নিজে নিজে একটা বস্তুহীন (object-less) মনের দশা হিসেবে থাকতে পারে না, তার সবসময়ই একটা লক্ষ্যবস্তু থাকা চাই। [যেমন টেবিল নিয়ে ভাবাটা টেবিল সম্পর্কিত চেতনা, সেক্স নিয়ে ভাবাটা সেক্স সম্পর্কিত চেতনা ইত্যাদি।] আসলে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে চেতনার দশা ও চেতনার বস্তুর মধ্যে কখনোই পার্থক্য করতে পারি না: বিমূর্ত ধারণার মাধ্যমে দুটোকে আলাদা হয়ত ভাবতে পারি, কিন্তু প্রকৃত অভিজ্ঞতায় তারা একেবারে অবিভাজ্য। এক্ষেত্রে তিনি স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউমের (১৭১১-৭৬) সাথে একমত। কিন্তু এবার হুসার্লের চিন্তা একটা মৌলিক দিকে মোড় নেয়। হাজার বছর ধরে সংশয়বাদীরা দাবী করে আসছে যে, আমাদের চেতনার বস্তুগুলো আমাদের অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষভাবে আসলেই আছে কি না তা কোনোদিন প্রমাণ করা সম্ভব নয়। [অর্থাৎ আমি যে টেবিলটা দেখছি এই দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলেও টেবিলটার অস্তিত্ব থাকবে কি না তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়।] হুসার্ল এসে বললেন আমাদের চেতনার বস্তুগুলো যে “আমাদের চেতনার বস্তু” হিসেবে সত্যিকার অর্থেই আছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না, এখন আমাদের চেতনা-নিরপেক্ষভাবে তারা থাকুক বা না-ই থাকুক। সুতরাং সেই বস্তুগুলোর কোনো পরম স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে কথা না বলে যদি আমরা তাদেরকে কেবলই আমাদের চেতনার বস্তু হিসেবে বিবেচনা করি এবং সে অনুযায়ীই তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করি তাহলে কোনো ঝামেলা থাকে না। আর এই বস্তুগুলোর সাথেই যেহেতু আমাদের সবচেয়ে সরাসরি ও নিবিড় সংযোগ আছে, সেহেতু এগুলো সম্পর্কে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি জানা যাবে। বস্তুগুলো স্বাধীনভাবে আছে কি নেই সেই অনুত্তরযোগ্য প্রশ্ন নিয়ে এই ধরণের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আমাদের ভাবতেই হচ্ছে না। সেই প্রশ্নগুলোকে আমরা সিঁকেয় তুলে রাখতে পারি, হুসার্লের ভাষায় ব্র্যাকেটবন্দি করে রাখতে পারি। এটা করলে লাভ যা হবে তা হলো, দার্শনিকরা একই প্রশ্নের মারপ্যাঁচে আজীবন আটকে না থেকে নিজেদের কাজে সত্যিকারের অগ্রগতি ঘটাতে পারবেন।
এভাবে হুসার্ল দর্শনের একটি নতুন ধারার পত্তন ঘটান যার কাজ হচ্ছে চেতনা ও চেতনার বস্তু নিয়ে গবেষণা করা। ধারাটির নাম রূপতত্ত্ব বা ফেনোমেনোলজি। [বস্তুর রূপ বা phenomenon আমাদের অভিজ্ঞতায় যেভাবে ধরা দেয় ঠিক সেটাকেই বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলেই এমন নাম।] বর্তমানে আসলে ‘রূপতত্ত্ব’ শব্দটা আরো ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যখনই কেউ সরাসরি অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত কিছু বিশ্লেষণ করে এবং সেই অভিজ্ঞতার বস্তুর ব্যক্তি-নিরপেক্ষ বা পরম বা অন্য কোনো রকমের অস্তিত্ব আছে কি নেই তা নিয়ে মাথা ঘামায় না, তখনই বলা যায় সে রূপতত্ত্ব করছে। এখানে “চেতনার বস্তু” বলতে কি বুঝায় তা আরেকটু পরিষ্কার করা প্রয়োজন। “বস্তু” বলতে এখানে কেবলমাত্র ভৌত বস্তু যেমন টেবিল, চেয়ার বুঝানো হচ্ছে না, বরং এর ব্যাপ্তি অতি বিশাল। এর মধ্যে পড়বে আমাদের চিন্তা, বেদনা, আবেগ, স্মৃতি, বা এমনকি সঙ্গীত, গণিত এর মতো বিমূর্ত বিষয়গুলোও, আমাদের চেতনায় যা কিছু থাকতে পারে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আর এই সব বস্তুর পরম অস্তিত্বগত কোনো প্রশ্নে না গিয়ে এদেরকে রূপতত্ত্বে কেবলই “চেতনার আধেয়” (content) হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং তারা যে আসলেই আমাদের চেতনার আধেয় তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।
হুসার্লের ছাত্র ও অনুসারীদের একজন, মার্টিন হাইডেগার ১৯২৭ সালে Sein und Zeit (Being and Time বা “বিরাজ ও সময়”) বইটি প্রকাশের মাধ্যমে হুসার্লীয় ধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজের একটি আলাদা ধারা প্রতিষ্ঠিত করে। বইটা বিংশ শতকের অস্তিত্ববাদ, অর্থাৎ আধুনিক অস্তিত্ববাদের উৎসমুখে পরিণত হয় যদিও হাইডেগার নিজে কখনো গায়ে “অস্তিত্ববাদী” লেবেল লাগানোটা পছন্দ করেননি। ১৯২৭ এর পর তিনি আরো প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল বেঁচে ছিলেন, মারা গেছেন ১৯৭৬ সালে, এবং এর মধ্যে প্রচুর বই লিখেছেন যাদের অনেকগুলো প্রভাবশালীও হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই “বিরাজ ও সময়” কে ছাড়াতে পারেনি। অন্যান্য অস্তিত্ববাদী চিন্তাবিদেরা, বিশেষ করে জঁ-পল সার্ত্র বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন এবং দর্শনের বাইরে অস্তিত্ববাদের প্রচার-প্রসারে বেশি অবদান রেখেছেন, কিন্তু হাইডেগারই ছিলেন সবসময় তাদের শিক্ষাগুরু। এমনকি সার্ত্র তার সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের নাম রেখেছেন L’Être et le néant (Being and Nothingness বা “বিরাজ ও নাস্তিত্ব”)। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত এ বইটি বহুলাংশে হাইডেগারের অবদানধন্য।
এই হলো মোটামুটি আধুনিক অস্তিত্ববাদের রূপরেখা, যা প্রবাহিত হয়েছে হুসার্ল থেকে শুরু করে হাইডেগারের মধ্য দিয়ে সার্ত্র পর্যন্ত। তবে এখানে আরেক জনের নামও বলে রাখা উচিত। ১৯৪৫ সালে মরিস মের্লো-পোঁতি Phénoménologie de la perception (Phenomenology of Perception বা “প্রত্যক্ষণের রূপতত্ত্ব”) নামে একটি বই প্রকাশ করেন যা এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ। একসময় মের্লো-পোঁতি ও সার্ত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং একসাথেই প্রভাবশালী স্বাধীন বামপন্থী সাময়িকী Les Temps modernes (“আধুনিক কাল”) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। [উল্লেখ্য নামটা চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত সিনেমা মডার্ন টাইমস থেকে নেয়া।] মের্লো-পোঁতি অবশ্য সার্ত্র’র অনেক আগে ১৯৬১ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা যান।
আধুনিক দর্শনের এই গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি নিয়ে কথা বলার জন্য আমি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি’র অধ্যাপক হিউবার্ট ড্রাইফাস কে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
আলোচনা
ম্যাজি: ভূমিকার শুরুতে আমি বলেছিলাম, হুসার্ল আকাদেমীয় দর্শনের বাইরে অতটা পরিচিত নন। আপনি কি এই বিষয়টা দিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারবেন যে, কিভাবে সাধারণ্যে এত স্বল্প পরিচিত একজন দর্শনে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারলেন?
ড্রাইফাস: হুসার্ল গুরুত্বপূর্ণ আসলে এক রকমের প্রতিক্রিয়াশীল উপায়ে। [“প্রতিক্রিয়াশীল” কোনো খারাপ অর্থে বুঝানো হচ্ছে না, বরং অতীতের কোনো দার্শনিক ধারার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া বুঝানো হচ্ছে যা দর্শনের অগ্রগতিতে আবশ্যক।] দেকার্তের দর্শনধারাতে মানুষের সাথে বিশ্বের সম্পর্ককে ব্যক্তির সাথে বস্তুর সম্পর্ক হিসেবে দেখা হয় যেখানে মানুষ একটি পৃথক সত্তা হিসেবে বিশ্বকে জানে। হুসার্ল নিজেকে এই ধারাটির পূর্ণতা দানকারী ভাবতেন। আসলে কেবল দেকার্ত নয়, তিনি নিজেকে প্লেটো থেকে শুরু হওয়া গোটা পাশ্চাত্য দর্শনের চূড়া হিসেবে বিবেচনা করতেন, যেহেতু তিনি এমন একটা সংশয়াতীত ভিত্তি আবিষ্কার করেছিলেন যার উপর ভিত্তি করে সবকিছুর বোধগম্যতা তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে তাকে হেগেলের সাথে তুলনা করা যায় যিনি নিজেকে ভাববাদের পূর্ণতাদানকারী ভাবতেন। কিয়ের্কেগর অস্তিত্বগত চিন্তাভাবনার মাধ্যমে হেগেলের বিরোধিতা করেছিলেন যা পরবর্তীতে অস্তিত্ববাদে রূপলাভ করেছে, এবং মার্ক্সও নিজেকে হেগেলের বিরুদ্ধে স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু অস্তিত্ববাদ নয় বরং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নামে। একইভাবে হুসার্ল নিজেকে কার্তেসীয় ধারার চূড়ায় স্থাপন করেন, তার শেষ বইটির নামই ছিল Méditations cartésiennes (“কার্তেসীয় ধ্যানমালা”, ১৯৩১)। হুসার্লের কারণেই পরবর্তীতে হাইডেগার ও মের্লো-পোঁতি রা আগের ঐতিহ্যের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, এবং এক পর্যায়ে এমনকি হুসার্লের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করতে পেরেছিলেন। হুসার্লকে নিয়ে কথা বলা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় মূল-ভূখণ্ডের দর্শন আলোচনা অসম্ভব।
ম্যাজি: শুরুর কথাগুলোতে আমি কেবল হুসার্লের দর্শনের সামগ্রিক রূপরেখা টেনেছিলাম, তার চেয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয় এখন বিষয়টার আরো গভীরে যাওয়া উচিত। আপনি কী আমার ঐ কথাগুলোর সাথে আরো কিছু যোগ করবেন?
ড্রাইফাস: হুসার্লের মূল চিন্তাটা হচ্ছে: মন [অর্থাৎ মানুষের মন] বিভিন্ন বস্তুর দিকে নির্দেশিত বা নিবদ্ধ থাকে। যেমন এখন আমার মন টেবিলটার দিকে নির্দেশিত এবং আমি সেটার উপর দিকটা প্রত্যক্ষ (perceive) করছি। প্রত্যক্ষণটা এমনকি আমার মনেও আছে, এবং আমি সে সম্পর্কে বিশ্বাস পোষণ করতে পারি, কামনা ব্যক্ত করতে পারি ইত্যাদি। আমার মনের প্রায় সব আধেয় বা সামগ্রী (মাথাব্যথা বা মেজাজ বাদে) এভাবেই নির্দেশিত। এবং হুসার্ল বলেছিলেন, এই নির্দেশনতা একমাত্র মনেরই আছে, এটা মনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। একমাত্র মন ছাড়া মহাবিশ্বের আর কিছুই নিজের বাইরের কোনোকিছুর প্রতি এভাবে নির্দেশিত বা নিবদ্ধ হতে পারে না, এই ছিল তার মত।
ম্যাজি: এটা আসলেই একদিক দিয়ে খুব রহস্যময়। যেমন, যখন আমি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করি তখন আমার মাথার খুলির ভিতরে ঘটতে থাকা কর্মকাণ্ডগুলো কিভাবে বহুদূরের গ্যালাক্সির সাথেও একটা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে নিতে পারে?
ড্রাইফাস: হুসার্ল এটাকে আসলেই এক ভুন্ডারবার (wunderbar: বিস্ময়কর) ঘটনা মনে করতেন। [উল্লেখ্য হুসার্ল স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরুই করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত দিয়ে।] তিনি নিজের গোটা জীবনই উৎসর্গ করেছিলেন এটা বুঝার জন্য।
তো মনের এই সংশ্লিষ্টতা ধর্মটিকে দর্শনজগতে “নির্দেশনতা” (intentionality) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইন্টেনশনালিটি’র সাথে ইন্টেনশন বা অভিপ্রায়ের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এর দ্বারা কেবল নির্দেশিতা, নিবদ্ধতা বা সংশ্লিষ্টতাকেই বুঝানো হচ্ছে। হুসার্ল মনে করতেন এই নির্দেশনতা বা সংশ্লিষ্টতা সৃষ্টির জন্য মনের ভিতরে নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ সামগ্রী বা আধেয় আছে যার নাম তিনি দিয়েছিলেন “নির্দেশনী আধেয়” (intentional content)। নির্দেশনী আধেয় বাস্তবতার এক ধরণের বর্ণনা, এবং এই বর্ণনক্ষমতা আমার ভিতরে প্রোথিত আছে বলেই আমি কোনো বস্তুকে নির্দিষ্ট কোনোভাবে প্রত্যক্ষণ, স্মরণ, কামনা ইত্যাদি করতে পারি। হুসার্লই নির্দেশনতাকে দর্শনের সবচেয়ে কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোর একটিতে পরিণত করেছিলেন।
ম্যাজি: এই মানসিক নির্দেশনতা বা সংশ্লিষ্টতা ধর্মের ধারণাটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ঠিক কী করেছিলেন?
ড্রাইফাস: আসলে তিনি এটা দিয়ে খুবই জটিল ও সর্বাঙ্গীণ একটা দার্শনিক অট্টালিকা তৈরি করেছিলেন। তার চিন্তাধারা সবকিছুকে এত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল যে এর বিরুদ্ধ বিদ্রোহ করতে চাওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। প্রথমত, তিনি সত্যিকার অর্থেই ভাবতেন, টেবিলটা আসলেই আছে কি নেই তা তার নির্দেশনতার জন্য একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। টেবিলটাকে ব্র্যাকেটবন্দি করেই কাজ চালিয়ে যেতেন। এমনকি তিনি গোটা জগৎটাকেই ব্র্যাকেটবন্দি করতে পারতেন। তার কাছে এটুকুই যথেষ্ট ছিল যে, তিনি একটা টেবিল “আছে বলে ধরে নিয়েছেন”। সবকিছুকে এই ধরে নেয়াতে নামিয়ে আনার নামই দিয়েছিলেন ‘রূপতাত্ত্বিক লঘুকরণ’ (phenomenological reduction)। নিজের মনের নির্দেশনী আধেয় নিয়ে তিনি ভেবেছিলেন এবং সেটাই তাকে শুরু করার মতো একটা সন্দেহাতীত ভিত্তি দিয়েছিল। টেবিলটার অস্তিত্বের কোনো পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ আছে বলে তিনি এটা ধরে বা মেনে নিয়েছেন এমন নয়। তিনি ধরে নিয়েছেন বলেই তার-ধরে-নেয়া-টেবিলটি আছে। তার নিজের বর্ণনামতে, তার সংশয়াতীত প্রমাণও তার নিজের উদ্ভাবন। ওখানে টেবিলটা আছে ধরে নেয়ার কারণে তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন যে, তার ধরে নেয়া টেবিলটা ওখানে আছে। এছাড়া তো তার ধরে নেয়াই সম্ভব হতো না। এতে কোনো ভুলই থাকতে পারে না। দ্বিতীয়ত, এই স্বপ্রমাণিত নির্দেশনী আধেয় কে তিনি অন্য সবকিছুর জন্য একটা পরম ভিত্তি হিসেবে নিয়েছিলেন। নির্দেশিত মানসিক আধেয় ছাড়া মানুষের পক্ষে কোনো অভিজ্ঞতা লাভই সম্ভব হতো না, তা সে হোক সঙ্গীত, অন্য মানুষ, টেবিল বা গ্যালাক্সি। সুতরাং সকল জ্ঞান বা উপলব্ধির সন্দেহাতীত ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন বলে তিনি অতিশয়োক্তি করেননি। তিনি ইমানুয়েল কান্টের মতোই মানুষ কিভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে তা আবিষ্কারের দাবী করেছেন। এবং তিনি এটাকে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণের দাবী করেছেন, দেকার্তের মতো তুরীয় (transcendental) যুক্তির আশ্রয় নিয়ে নয়। চেতনার ব্যক্তিক আধেয় কিভাবে বস্তুর দিকে নির্দেশিত থাকে তা বর্ণনা করার মাধ্যমেই এই সবকিছু করেছিলেন।
ম্যাজি: এবং সে কারণে, আপনি আগে যেমন বলেছেন, তিনি দেকার্ত-হিউম-কান্ট দিয়ে তৈরি দার্শনিক ধারাটির পূর্ণতা দানকারী হতে পারেন। এই ধারাতে মানুষকে বস্তু পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ব্যক্তি ও বস্তুর এই মৌলিক বিভাজনটির বিরুদ্ধেই হাইডেগার আপত্তি তুলেছিলেন, ঠিক না?
ড্রাইফাস: ঠিক। হুসার্লের মাধ্যমে কার্তেসীয় ধারাটি এত স্পষ্ট ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে হাইডেগার ভাবা শুরু করলেন, ব্যক্তি-বস্তুর দ্বৈততা বিশ্বের সাথে আমাদের সম্পর্কটা আসলেই ঠিকভাবে বর্ণনা করে কি না। অন্য মানুষ বা যেকোনো বস্তুর সাথে মিথস্ক্রিয়ার জন্য কি আমাদের আসলেই একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ধারণাটি দরকার পড়ে? হুসার্ল সবসময় রূপতত্ত্বের উপর জোর দিতেন, অর্থাৎ বলতেন, কোনো পূর্বানুমান না করে সবকিছুকে তার নিজের মতো করে তোমার সামনে প্রকাশিত হতে দাও এবং তারপর সেই প্রকাশিত রূপটাকেই বর্ণনা করো। হাইডেগার ঠিক এই রূপতত্ত্বটাই মানুষের সাথে বস্তুর সম্পর্ক বুঝার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখলেন, এই সম্পর্কটা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ও বস্তুর সম্পর্কের মতো নয়। এমনকি এই সম্পর্কে চেতনা তথা সচেতনতার তেমন কোনো আবশ্যকীয় ভূমিকাই নেই। এখন, এটা শুনতে খুবই অদ্ভুত লাগতে পারে। এ কেমন কথা? একটা উদাহরণ দিলে হয়ত সুবিধা হবে এবং হাইডেগার খুব সরল উদাহরণ খুঁজে নিতে ওস্তাদ ছিলেন। এই ক্ষেত্রে তার উদাহরণ ছিল হাতুড়ি পিটানো। একজন কাঠমিস্ত্রি যখন হাতুড়ি দিয়ে একটা পেরেক গাঁথতে থাকেন, তখন সব যদি ঠিক থাকে, মানে যদি হাতুড়িতে কোনো সমস্যা না থাকে এবং তিনি কাজটাতে যথেষ্ট দক্ষ হন, তাহলে হাতুড়িটা যেন তার জন্য স্বচ্ছ বা উধাও হয়ে যায়, হাতুড়ির উপস্থিতিই যেন তিনি আর টের পান না। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তি হিসেবে হাতুড়ি নামক বস্তুটার প্রতি নিবিষ্ট নন। তিনি হয়ত হাতুড়িটার কথা ভাবছেনই না, বরং পেরেকটা নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু যদি তিনি খুবই উঁচুমানের মিস্ত্রি হন তাহলে হয়ত পেরেকটাও তার মন থেকে উধাও হয়ে যাবে, এবং তার কাজটার সাথে যুক্ত কোনোকিছুর প্রতিই তিনি সচেতন থাকবেন না। হয়ত সে সময় দুপুড়ের খাবারের কথা ভাববেন, বা কোনো সহমিস্ত্রির সাথে কথা বলতে থাকবেন। তার হাতুড়ি চলতে থাকবে, তিনি যেন খুব স্বচ্ছভাবে গোটা পরিস্থিতিটার সাথে নিজেকে মানিয়ে চলবেন যাকে হাইডেগারীয় ভাষায় বলা যায় ‘স্বচ্ছ মানানো’ (transparent coping)। [কাঁচ স্বচ্ছ থাকলে যেমন তার মধ্য দিয়ে সব দেখা যায় এবং স্বয়ং কাঁচটার অস্তিত্বই উধাও হয়ে যায়, তেমনি এখানেও হাতুড়ি, পেরেক যেন স্বচ্ছতার আড়ালে উধাও হয়ে যায়।] প্রাত্যহিক জীবনে এরকম দক্ষতার সাথে মানিয়ে চলাটাকে তিনি ‘আদিমতম উপলব্ধি’ আখ্যা দিয়েছিলেন, এবং এই মানানোতে আমাদের সাথে যে সত্তাগুলো জড়িত থাকে তাদের নাম দিয়েছিলেন ready-to-hand, বা বলা যায় ‘সদাপ্রস্তুত’। [যেমন, স্বচ্ছ মানানোর সময় মিস্ত্রির হাতে হাতুড়িটি যেন সদাপ্রস্তুত।] এক্ষেত্রে ব্যক্তি ও বস্তুর পার্থক্য থাকে না বরং উভয়ে একত্রে বিরাজে, এবং বিরাজমান সত্তাগুলোকে বা গোটা বিরাজটিকে সদাপ্রস্তুত বলার পাশাপাশি, বিরাজ করার এই বিশেষ দশাটিকেও সদাপ্রস্তুত দশা বলা যায়।
ম্যাজি: দর্শন করার গতানুগতিক পদ্ধতির সাথে এর পার্থক্যটা এত বেশি যে আমার মনে হয় ব্যাপারটা আরেক বার ঝালিয়ে নেয়া উচিত, যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না থাকে। দেকার্তের সময় থেকে দার্শনিকরা মানুষকে অনেক বস্তুবিশিষ্ট এই বিশ্বের মাঝে এক ধরণের ব্যক্তি হিসেবে দেখে এসেছেন, যার ফলে দর্শনের মূল সমস্যা ছিল প্রত্যক্ষণ ও জ্ঞান। ব্যক্তিরা কিভাবে বিশ্ব গঠনকারী বস্তুগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে পারে? সেরকম জ্ঞান কি কখনও নিশ্চিত হতে পারে? হলেও সেই নিশ্চয়তার ভিত্তিটা কী হবে? এবং এরকম আরো অনেক সমস্যা। এখন হাইডেগার বলছেন, এই সমস্যাগুলো মূলগতভাবেই ভ্রান্ত। বা আরো নিখুঁতভাবে বললে, এই প্রশ্নগুলো অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে উত্থাপিত হতে পারে, কিন্তু এগুলোকেই মূল সমস্যা ভাবা তার মতে এক বিশাল বড় ভ্রান্তি। আমরা মানুষেরা মুখ্যত অর্থাৎ আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিরাজন দশাতে বিশ্ব থেকে একটি অদৃশ্য কাঁচের জানালা দিয়ে আলাদা হয়ে থাকা কোনো ব্যক্তি, দর্শক বা পর্যবেক্ষক নই। ব্যাপারটা এমন না যে, আমরা জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আমাদের বাইরে অবস্থিত একটি বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছি। বরং এর বিপরীতটাই সত্য। আমরা একেবারে গোঁড়া থেকেই এই সব কিছুর অংশ, এই সব কিছুর মধ্যে প্রোথিত, এই সবকিছুর মধ্যে বিরাজমান, এই সবকিছুর সাথে মানিয়ে চলায় রত। সুতরাং প্রথাগত দার্শনিকরা এতদিন যেমন বলে এসেছেন আমরা তেমন কোনো “পর্যবেক্ষণরত ব্যক্তি” বা “জ্ঞানার্জনরত সত্তা” নই। আমাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রূপটা হচ্ছে “মানিয়ে-চলায়-রত সত্তা”, বা এটুকু শোনার পর কেউ আমাদেরকে “বিরাজনরত সত্তা” (being beings) বলতেও প্রলুব্ধ হতে পারে। আমরা নানান সত্তায় ভরপুর এই জগৎ থেকে অবিচ্ছিন্ন আরেকটি সত্তা, অস্তিত্বশীল জগতের আরেকটি অস্তিত্ব কেবল। এবং এখান থেকেই আমাদের শুরু করা উচিত।
ড্রাইফাস: ঠিক। গিলবার্ট রাইল “বিরাজ ও সময়” পর্যালোচনা করতে গিয়ে ব্যাপারটা ভালোভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি “বিরাজ ও সময়” এবং হুসার্লের “যুক্তিগত অনুসন্ধান” দুটোরই পর্যালোচনা প্রকাশ করেছিলেন। তার কাছে দুটোকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, কিন্তু তার মতে বিশেষ করে হাইডেগার মোক্ষম কিছু একটাতে হাত দিয়েছিলেন। রাইল বলেছেন, গতানুগতিক দর্শনে গুরুত্বের বিষয় “কিছু-জানা” (know-that), আর হাইডেগারে গুরুত্বের বিষয় “কিভাবে-জানা” (know-how)। এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ধরিয়ে দেয়া উচিত। হাইডেগার কিন্তু কেবল ব্যবহারিক কাজকর্মের মুখ্যতা ধরিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। প্রয়োগবাদীরাও1 তো সেই মুখ্যতার দাবী করেছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক, দক্ষতাপূর্ণ “কিভাবে-জানা” গুলোকে হাইডেগার রূপতত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছেন, যার ফলে আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস, নিয়মানুসরণ বা সেগুলোর নির্দেশনী আধেয়গুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে।
তবে হাতুড়ি চালনার মতো কাজকে হুসার্লও তার ব্যক্তি-বস্তু ভিত্তিক মানসিক কর্মকাণ্ডের মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। কোনোকিছুকে হাতুড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে হলে আমাকে আগে জানতে হবে যে সেটা একটা হাতুড়ি, বলেছিলেন হুসার্ল। কিন্তু হাইডেগারের দাবী ছিল এমনকি হাতুড়িটা হাতে তুলে নেয়াও খুব ‘স্বচ্ছ’ (পূর্বতন অর্থে) কাজ হতে পারে, এবং এক্ষেত্রে তিনি আরেকটা সরল উদাহরণ উঠিয়ে আনেন। তিনি তার শিক্ষার্থীদেরকে ব্যাপারটা মোটামুটি এভাবে বলেছিলেন: “ক্লাসরুমে ঢুকার জন্য তোমাদেরকে নিশ্চয়ই তার দরজার হাতল ঘুরাতে হয়েছে, কিন্তু তোমরা হাতলটা প্রত্যক্ষ করোনি, হাতল হিসেবে ধরে নাওনি, ঢুকতে হলে যে তা ঘুরাতে হবে সেটা বিশ্বাস করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করোনি, বা হাতল ঘুরানোর চেষ্টাও তোমাদের করতে হয়নি। আমাদের পর্যবেক্ষণ কেবল বলে যে, তোমরা এই ঘরে ঢুকেছ এবং হাতল না ঘুরালে নিশ্চয়ই ঢুকতে পারতে না। ঘুরানোর স্মৃতিটাও তোমাদের নেই কারণ পুরো ঘটনাটা এত স্বচ্ছ যে তা চেতনার মধ্য দিয়ে অতিক্রমই করেনি।” সাথে আমরা যোগ করতে পারি যে, একজন গাড়িচালক এক গিয়ার থেকে আরেক গিয়ারে যাওয়ার সময়ও একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়। গিয়ার পাল্টানোর জন্য ক্লাচ নিয়ে খেলা করাটা তার জন্য এতই চেতনা-বহির্ভূত হতে পারে যে একইসাথে সে কারো সাথে গভীর দার্শনিক আলোচনা চালিয়ে যেতেও সক্ষম। মানিয়ে চলাটাকে সবসময় চেতনার মধ্যে প্রবেশ করতে হয় না।
ম্যাজি: উদাহরণগুলোকে খুব মামুলি মনে হলেও তারা যা ফুটিয়ে তুলছে সেটা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো দেখাচ্ছে যে, মানুষের প্রচুর বা হয়ত অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কাজই সচেতন পছন্দ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বা মনের কোনো সচেতন দশার সাথে সম্পর্কিত নয়। এটা এই কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা সত্য হলে মানব স্বভাব বিশ্লেষণের অনেক প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বেরই পায়ের নিচে মাটি খুঁজে না পাওয়ার মতো অবস্থা হবে।
ড্রাইফাস: ঠিক। অনুধ্যান এবং সচেতনভাবে করা কাজের অস্তিত্ব হাইডেগার মোটেই অস্বীকার করতে চাননি, সেটাও আছে, কিন্তু তার মতে, আমরা প্রথমত এবং প্রধানত মানিয়ে চলা সত্তা যারা বিশ্বের সাথে শুরু থেকেই পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট। কিন্তু কোথাও যদি সমস্যা হয়, যেমন হাতুড়ির উদাহরণে হাতুড়িটি যদি বেশি ভারী হয় তাহলে আমি নিশ্চিত তা সচেতনভাবে লক্ষ্য করব। এক্ষেত্রে আমি গতানুগতিক দর্শনের সুপ্রিয় সমস্যা-সমাধানকারী ব্যক্তি বনে যাব; হয়ে উঠব একটি যুক্তিসম্পন্ন প্রাণী। আমি নিবিষ্ট মনে সমস্যাটির কথা ভাবব, বুঝতে পারব যে এই কাজের জন্য এই হাতুড়ি বেশি ভারী এবং পরিশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছাব যে অন্য একটি হাতুড়ি এক্ষেত্রে বেশি ভালো কাজ করবে। এরকম এরিস্টটলীয় প্রায়োগিক যুক্তির স্থান অবশ্যই আছে। একইভাবে দরজার হাতল যদি বেশি টাইট হয় তাহলে তা ঘুরানোর জন্য আমাকে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সবসময়ই আমরা এমন চেষ্টা করে কাজ করি মনে করাটা আসলে এক ধরণের যাকে বলে ভূতাপেক্ষিক ভ্রম। সমস্যাকালীন সময়ে কোনো জিনিস আমাদের সামনে যেভাবে উপস্থিত হয় তাকে স্বচ্ছ রেডি-টু-হ্যান্ড তথা সদাপ্রস্তুত দশার বিপরীতে হাইডেগার বলেছিলেন unready-to-hand দশা, বা বলা যেতে পারে ‘অপ্রস্তুত’ দশা। [যেমন হাতুড়ি বেশি ভারী লাগলে মিস্ত্রি অপ্রস্তুত হবেন।] হাইডেগারের মতে হুসার্ল তার রূপতত্ত্ব শুরু করেছিলেন অপ্রস্তুত দশা থেকে, অর্থাৎ প্রথম স্তরের দশাটিকে এড়িয়ে গিয়ে হুসার্ল দ্বিতীয়টি থেকে আলোচনা শুরু করেছেন।
প্রসঙ্গ যখন আসলোই তখন বিরাজ করার তৃতীয় ও সর্বশেষ দশাটির কথাও বলে ফেলা যায়। জিনিসপত্রের সাথে আমাদের সম্পর্কের এই দশার নাম হাইডেগার দিয়েছিলেন present-at-hand, বা ‘বিদ্যমান’ দশা। এটাও গুরুত্বপূর্ণ। হাতে যা প্রেজেন্ট তথা বিদ্যমান আছে তাকে নীরিক্ষা করাটাই বিদ্যমান দশা। হাতুড়ির মাথাটা যদি ছুটে যায়, বা পেরেক যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, বা যদি আমরা কেবল চিন্তা করার মেজাজে থাকি তাহলে হয়ত হাতুড়িটার দিকে অবশেষে আমাদের চোখ পড়বে এবং আমরা দেখব যে এটা একটা কাঠের টুকরো যার আগায় একটা লৌহখণ্ড লাগানো রয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমরা একটা বস্তুকে তার বৈশিষ্ট্যসহ দেখতে পাই। দার্শনিকরা এই স্তরটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। ব্যাকরণে ব্যবহৃত উদ্দেশ্য ও বিধেয়’র যুক্তিবিদ্যাগত ভিত্তি নিয়ে আলোচনার জন্য বিধেয় ক্যালকুলাস নামে একটা আলাদা শাখাই রয়েছে। এর গুরুত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু হাইডেগারের মতে এটা দৈনন্দিন মানিয়ে নেয়া থেকে দুই স্তর নিচে, গুরুত্বের দিক দিয়ে এটা মিথস্ক্রিয়ার তৃতীয় স্তরের দশা। এর আগে দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ অপ্রস্তুত দশা রয়েছে যা ব্যবহারিক সমস্যার সম্পর্কিত। তো মিথস্ক্রিয়ার এই তৃতীয়, নৈর্ব্যক্তিক দশাটিতে হাতুড়িটি আর ঠিক হাতুড়ি থাকে না, বরং কেবল ডগায় লৌহখণ্ড বিশিষ্ট একটা কাঠের টুকরাতে পরিণত হয়। এবং এর গুরুত্ব হাইডেগার স্বীকার করতেন কারণ, ‘বস্তুটির ওজন ১ কেজি’-র মতো বাক্যগুলো বিজ্ঞান ও তত্ত্বের নীতি দিয়ে তৈরি করা যায়, এবং হাইডেগার মোটেই বিজ্ঞান বা তত্ত্ব বিরোধী ছিলেন না। এমনকি “বিরাজ ও সময়” বইয়ে তিনি মানুষের সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক বিধেয়গুলোর একটা অস্তিত্ববাদী ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো, বিজ্ঞানের নীতি ও বিধেয়তে পৌঁছানোর আগে মানুষের ব্যবহারিক মানিয়ে চলার দুটি স্তর পার হয়ে আসতে হবে। সুতরাং বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রেক্ষাপট-মুক্ত কারণিক সম্পর্ক খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলেও, আমাদের ভেবে নেয়া উচিত হবে না যে তা হাইডেগার বর্ণীত দৈনন্দিন অর্থপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। এবং অবশ্যই হুসার্লের মানসিক আধেয় দিয়েও এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
ম্যাজি: আপনার কথার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা কেবল তখনই কোনোকিছু সম্পর্কে পূর্ণভাবে সচেতন হই যখন তাতে কোনো সমস্যা থাকে। কিন্তু তেমনটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে না, তাই আমাদের মনের মূল দশা সেটা নয়। অধিকাংশ সময় আমরা এমন একটা জীবন-মাধ্যমে ভেসে চলি যা আমরা অবধারিত বলে মেনে নিয়েছি, যা সম্পর্কে আমরা সচেতন নই, এবং যার প্রতি আমরা মনোযোগীও হই না। এর একটা পরিণাম হচ্ছে অধিকাংশ দার্শনিক যেমন বিশ্বের অস্তিত্ব অনুমান করা এবং সেই অনুমানকে প্রমাণসিদ্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন হাইডেগার তেমন মনে করেন না। আমরা গতানুগতিক যে চিন্তাধারাতে অভ্যস্ত তার সারকথা হচ্ছে, আমার সবচেয়ে বেশি প্রবেশগম্যতা আছে আমার মনের আধেয়তে, এবং এই আধেয় থেকেই আমাকে আমার বাইরের জগৎটার অস্তিত্ব অনুমান করে নিতে হবে, যা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। হাইডেগার এসে বললেন: না, সমস্যা-পরিস্থিতিটা আসলে তা না। বিশ্ব এমন নয় যে তাকে অনুমান করা যায়, অনুমান করতে চাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। আমি শুরু করি বিশ্বের সাথে থেকে, ভিতরে থেকে।
ড্রাইফাস: আবারো একদম ঠিক। দেকার্তের সময় থেকেই দার্শনিকরা বহির্জগতের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে আসছেন। কান্ট বলেছিলেন, এটা না কি বিশাল কেলেঙ্কারি যে এযাবৎ কেউ তা করতে পারেনি। আর হাইডেগার কান্টের প্রত্যুত্তরে “বিরাজ ও সময়” এ বলেছেন: বিশাল কেলেঙ্কারিটা হচ্ছে এই যে, দার্শনিকরা বহির্জগতের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ভাবখানা এমন যেন আমরা কোনো অন্তর্জগতে আটকে গেছি এবং বের হতে পারছি না। দার্শনিকদের বরং দেখা উচিত যে আমাদের দৈনন্দিন মানানোর জীবনে মানসিক আধেয়র কোনো দরকারই পড়ে না, তার ভাষায় আমরা “সর্বদা ইতিমধ্যেই জগৎ-মধ্যে-বিরাজমান”। আমার মনে হচ্ছে এটা আরেকটু ব্যাখ্যা করা দরকার।
যেকোনো একটা হাতুড়ির ব্যবহার আসলে নানান দক্ষতা, অনুশীলন ও যন্ত্রের একটা পটভূমিতে ঘটে, যে পটভূমিকে হাইডেগার বলছেন ‘জগৎ’। হাতুড়িটার অর্থ থাকতে পারে কেবল পেরেক, কাঠ ও বাড়িঘরের মতো জিনিসপত্রের সাপেক্ষে যে যন্ত্র বা উপাদানগুলোর সমষ্টিকে হাইডেগার বলছেন ‘তাৎপর্য’। আমার হাতুড়ি চালনার জন্য পটভূমির আরো কিছু দক্ষতার উপস্থিতি আবশ্যক, যেমন দাঁড়ানো, চলাচল, কাপড় পরা, কথা বলা ইত্যাদি। সুতরাং আমরা কোনোকিছুর সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারি, কোনোকিছুর মুখোমুখি হতে পারি কেবল একটা গোটা জগতের এবং সেই জগতের মধ্যে বা সেই জগতের অংশ হিসেবে আমার বিরাজ করার পটভূমিতে। সুতরাং বস্তুর সাথে আমার সম্পর্ককে যে জিনিসটা সম্ভব করে তোলে তা আমার মনের ভিতরে নয়, যেমনটা হুসার্ল মনে করতেন, বরং আমার মনের বাইরে, অনেক মানুষের যৌথ জিনিসপত্র ও কর্মকাণ্ডের মাঝে অবস্থিত। আমাদের যৌথ কর্মকাণ্ডের মধ্যে যে যৌথ অর্থটা আছে তাকে হাইডেগার বিরাজনের উপলব্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এবং এই উপলব্ধিটাকে যেহেতু মনের মধ্যে প্রতিবিম্বিত করা সম্ভব নয় সেহেতু তিনি মনে করেন, মনের আধেয় বাইরের কোনোকিছুর প্রতিনিধিত্ব করে কি না সেই প্রশ্ন পাইকারি সংশয়বাদীর মতো জিজ্ঞাসা করতে থাকা বাদ দেয়া উচিত। আমরা যে অনেক সময় বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে এমন কিছু ভাবতে বা বলতে পারি না তা নয়, পদার্থবিজ্ঞানীরা এবং রাস্তার সাধারণ পথচারীটিও তা হরহামেশাই করে থাকেন, কিন্তু আমাদের মনের আধেয় বাইরের কিছুর প্রতিনিধিত্ব কেবল একটা গোটা পটভূমির সাপেক্ষেই করতে পারে যে পটভূমিটা মনের আধেয় নয়, এবং এটা কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে কি করে না সেই প্রশ্নই অবান্তর।
ম্যাজি: এই ধারণাগুলো দিয়ে হাইডেগার শুধু মানুষের পরিস্থিতিই নয় বরং স্বয়ং মানব সত্তার অর্থাৎ মানুষের পরিচয়েরই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছিলেন যা গতানুগতিক যেকোনো দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একেবারে আলাদা। সেই দৃষ্টিভঙ্গিটার সাথে কি এবার আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন?
[চলবে…]
হুসার্ল, হাইডেগার ও আধুনিক অস্তিত্ববাদ – ২
<< গত পর্বের পর
ম্যাজি: এই ধারণাগুলো দিয়ে হাইডেগার শুধু মানুষের পরিস্থিতিই নয় বরং স্বয়ং মানব সত্তার অর্থাৎ মানুষের পরিচয়েরই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছিলেন যা গতানুগতিক যেকোনো দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একেবারে আলাদা। সেই দৃষ্টিভঙ্গিটার সাথে কি এবার আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন?
ড্রাইফাস: আচ্ছা। এটা তো নিশ্চিত যে তিনি কর্তা, ব্যক্তি, মন বা চেতনা থেকে শুরু করতে পারবেন না। আমাদের সত্তার যৌথ উপলব্ধির পটভূমিতে আমাদের চলমান কর্মকাণ্ডকে বর্ণনা করার একটা উপায় তার বের করতে হবে। এটা করার জন্য তিনি মারাত্মক একটা শব্দ বেছে নেন: Dasein (উচ্চারণ: ডাজাইন)। জার্মান ভাষায় ‘ডাজাইন’ অর্থ অস্তিত্ব, একেবারে নিত্য নৈমিত্তিক অস্তিত্ব। কিন্তু শব্দটির দুটো অক্ষরকে যদি আলাদা করে ফেলা হয় তাহলে ‘Da-sein’ অর্থ দাঁড়ায় ইংরেজিতে ‘being-there’ বা ‘সেথা-বিরাজন’। যে পরিস্থিতির সাথে আমরা মানিয়ে চলি, বা যে পরিস্থিতিতে আমরা বিভিন্ন কিছুর সাথে মিথস্ক্রিয়া করি, ডাজাইন বলতে সেই পরিস্থিতিটা হয়ে যাওয়াকেই বুঝানো হচ্ছে। [এখানে ‘ডা’ বা ‘সেথা’ দিয়ে পরিস্থিতিটার দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে, এবং এরকম ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা থেকে যে আমাদেরকে একেবারেই আলাদা করা যায় না সেটাই বলার চেষ্টা করা হচ্ছে।]
ম্যাজি: কিন্তু আমি কিভাবে স্বয়ং একটা পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারি?
ড্রাইফাস: একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমি যখন গাড়ি চালাচ্ছি তখন—যদি আমার ভৌত দেহের কথা না ভেবে কেবল আমার মানানোতে রত দিকটার কথা ভাবি—আমার ‘সেথা-বিরাজন’ টা নির্দেশিত কাজকর্মের ঐ পরিস্থিতিটার সাথে পুরোপুরি মিশে যায়। আমার দক্ষতাগুলো পরিস্থিতিটার সাথে খাপে খাপে মিলে যায়। হাইডেগার একটু নিগূঢ় ভাষায় বলেছিলেন, “Dasein is its world existingly.” মানব সত্তা বলতে কী বুঝায় ডাজাইন তার একটা একেবারে নতুন ব্যাখ্যা। মানুষকেই তিনি ডাজাইন বলছেন। এবং “মানব সত্তা” দ্বারা যেমন একজন ব্যক্তিমানুষ বুঝানোর পাশাপাশি মানুষের সার্বিক অস্তিত্বশীলতা বুঝানো যায়, তেমনি ডাজাইন দ্বারাও মানুষের বিরাজ করার গোটা প্রক্রিয়াটাকে বুঝানো যায়, যে প্রক্রিয়ার একটা নিদর্শন হচ্ছে একজন একক ডাজাইন। হাইডেগার দুই অর্থেই ‘ডাজাইন’ ব্যবহার করেছেন। এর ফলে যৌথ পরিস্থিতির মধ্যে পুরোপুরি নিমজ্জিত মানুষের ক্ষেত্রে তিনি যেমন ডাজাইন ব্যবহার করতে পেরেছেন, তেমনি ধীর-স্থির মনে সম্মুখে উপস্থিত কিছু নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ-গবেষণায় রত মানুষকেও ডাজাইন বলতে পেরেছেন। তবে অবশ্যই ডাজাইন যে দশাতেই থাকুক না কেন, সবসময়ই সে একটা যৌথ পটভূমিতে অবস্থিত।
ম্যাজি: আমাদেরকে তিনি যে বিশেষ বিরাজন-প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তাকে শেষ পর্যন্ত মূলগত দিক দিয়ে তিনি সরাসরি সময়ের সাথে মিলিয়েছিলেন, ঠিক না? যেখান থেকেই তার সবচেয়ে বিখ্যাত বইটার শিরোনাম এসেছে। এই সম্পর্কটা কি আমাদেরকে একটু বলতে পারবেন?
ড্রাইফাস: হ্যাঁ, সেটা এখন প্রকাশ করে দেয়াই উচিত। কোনো পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জিনিসের প্রতি এই উন্মুক্ততাকে হাইডেগার আরেকটা নামে ডাকতেন: খোলামাঠ (clearing)। আমাদের একটা যৌথ খোলামাঠ আছে যেখানে আমরা বিভিন্ন জিনিসের মুখোমুখি হই বা বিভিন্ন জিনিসের সাথে মিথস্ক্রিয়া করি, এবং এই খোলামাঠটিকে উন্মুক্ত হিসেবে ধরে রাখার কার্যক্রম অর্থাৎ উন্মুক্তকরণটাই হচ্ছি আমরা। হুসার্লের বিপরীতে হাইডেগার ভাবতেন, সক্কলের একটা যৌথ উন্মুক্তকরণের কর্মকাণ্ড আছে এবং সেই কর্মকাণ্ডের পটভূমিতেই একজন একক মানুষের নিজস্ব উন্মুক্তকরণ সংঘটিত হয়। এই কর্মকাণ্ডের একটা তিন স্তরের কাঠামো হাইডেগার তৈরি করেছিলেন। প্রথম স্তর হচ্ছে পরিস্থিতির সাথে ডাজাইনের ঐকতান (attunement), যাকে মেজাজের (mood) সমার্থক হিসেবেও ভাবা যায়। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকার কারণেই ডাজাইনের কাছে কোনো জিনিস গুরুত্বপূর্ণ ঠেকে, বা ডাজাইন বিভিন্ন জিনিসকে পরোয়া করে, যেমন কোনোকিছুকে তার আকর্ষণীয়, হুমকিজনক, উপকারী, একগুয়ে ইত্যাদি মনে হয়। হাইডেগারের মতে এই ধরণের তাৎপর্যকে গতানুগতিক দর্শনে এতদিন অবহেলা করা হয়েছে, যেহেতু একে সরাসরি কোনো জ্ঞানার্জন, কামনা বা অনুধ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না বরং এই সবকিছুর পটভূমি হিসেবে তাকে পূর্বানুমান করে নিতে হয়। ঐকতান আছে বলেই আমাদের যেকোনো পরিস্থিতি সবসময়ই আমাদের কাছে অর্থবহ বা গুরুত্বপূর্ণ ঠেকে। [অর্থাৎ আমরা সবসময়ই কোনো না কোনো মেজাজের মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করি।] আর মেজাজ যে কেবল একজন একক ব্যক্তির মনের মধ্যেই পাওয়া যায় তা নয়। একটা জনসমাগমের একটা যৌথ মেজাজ থাকতে পারে, কোনো কোম্পানির নিজস্ব সংস্কৃতি থাকতে পারে, এমনকি একটা গোটা যুগেরও একটা নির্দিষ্ট সংবেদনশীলতা বা সুবেদিতা থাকতে পারে। সমাজ যে মেজাজগুলো আমাদেরকে দেয় তার মধ্য থেকেই ব্যক্তিকে তার নিজস্ব মেজাজ বেছে নিতে হয়। এবং অবশ্যই মেজাজের ঊর্ধ্বে উঠা কখনো সম্ভব নয়, এক মেজাজ থেকে বেরিয়ে মেজাজহীনভাবে কিছুক্ষণ থেকে তারপর অন্য মেজাজ বেছে নেয়া সম্ভব নয়, বরং একটি মেজাজ থেকে আমরা সরাসরি অন্য একটি মেজাজে পতিত হই।
ডাজাইনকে হাইডেগার সবসময়ই একটা ক্রিয়াপদ হিসেবে দেখতে বলেছেন। তো এই ডাজাইনগিরির দ্বিতীয় গাঠনিক উপাদানকে তিনি বলছেন ‘আলোচনা’ (discourse)। আলোচনা শব্দটা একটু বিভ্রান্তিকর হতে পারে যেহেতু এখানে ঠিক ভাষাগত আলোচনার কথা বলা হচ্ছে না, ‘আলোচনা’ ভাষার ব্যবহারের থেকেও মৌলিক একটা জিনিস, কিন্তু এখানে তিনি একটা চমৎকার শব্দখেলা খেলেছেন যা একটু পরেই পরিষ্কার হবে। বিশ্বটা সবসময় ইতিমধ্যেই ‘গ্রন্থিবদ্ধ’ (articulated)। অর্থাৎ সবকিছু সবসময় যার যার কাজের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সজ্জিত হয়ে থাকে; আমাদের কোনো যন্ত্র ব্যবহার করতে পারার জন্য প্রতিটি যন্ত্রকে অন্য যন্ত্রগুলোর সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে। মানুষ এই গ্রন্থিবদ্ধ বিশ্বের কিছু গ্রন্থিকে ছিন্ন করার মাধ্যমেই বিরাজ করে, অর্থাৎ গোঁড়া থেকেই মানুষের উপস্থিতি বিশ্বটাকে ভেঙে একটা নতুন রূপ দিয়ে দেয়। তারপর কোনো একটা যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ সেই নতুন রূপকে আরো নতুন কোনো রূপ দিতে থাকে। তাৎপর্যের এই পূর্ণাঙ্গ কাঠামো থেকে আমি একটি হাতুড়ি তুলে নিলে একটা গ্রন্থি ভেঙে যাবে, তারপর হাতুড়িটা দিয়ে কোনো পেরেক গাঁথতে পারি বা বিপরীত প্রান্ত দিয়ে কোনো পেরেক তুলতেও পারি; দুই ক্ষেত্রে আমি হাতুড়িটার দুই রকম নতুন তাৎপর্য তৈরি করলাম। এবং আমি যা করেছি সে সম্পর্কে কথাও বলতে পারি। যেমন, বলতে পারি যে পেরেক গাঁথা বা তোলাটা সহজ ছিল। সেক্ষেত্রে আমি ইতিমধ্যে যা গ্রন্থিবদ্ধ করেছি তার উপর আরেকটি গ্রন্থি রচনা করব। জিনিসপত্রকে এভাবে বিভিন্ন উপায়ে সজ্জিত করাকেই তিনি আলোচনা বলেছিলেন। যে পরিস্থিতির মধ্যে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করি তাকে নতুন রূপ দেয়াই আলোচনা। [এক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের সাথে সর্বদা আলোচনায় রত, এবং সেই আলোচনার অনেক মাধ্যম রয়েছে যার মধ্যে কথা একটি।]
ডাজাইনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি ইতিমধ্যেই কিছুটা উঠে এসেছে। তা হলো, ডাজাইন সর্বদা নতুন সম্ভাবনার দিকে ধাবমান। আমার হাতুড়ি দিয়ে পেরেক লাগানোর উদ্দেশ্যে হয়ত কোনো ঘর মেরামত করা, আর ঘর মেরামত করার উদ্দেশ্যে আমার মিস্ত্রি পেশার সম্মান রক্ষা। ডাজাইনের নানান যন্ত্র ব্যবহারের কারণকে এদিক থেকে দার্শনিকদের ভাষায় “লক্ষ্য” বলা যেতে পারে। হাইডেগার বলেন, আমাদের সব কর্মকাণ্ড একটা “যার-দিকে” (towards-which) এর প্রতি নিবদ্ধ। এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের গোটা জীবনের যে পরিকল্পনা থাকে সেই চূড়ান্ত বা অন্তিম যার-দিকে কে হাইডেগার বলেছেন “যার-তরে” (for-the-sake-of)। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে হাইডেগার সাধারণ অর্থে “জীবনের” লক্ষ্য বা পরিকল্পনার কথা বলছিলেন না, বরং কেবল বোঝানোর সুবিধার্থে এমন শব্দগুলো ব্যবহার করেছিলেন। আসল ব্যাপার হচ্ছে, প্রাত্যহিক স্বচ্ছ মানানোয় রত ডাজাইন সবসময় নিজের অজান্তেই ভবিষ্যতের দিকে মুখ করে থাকে, অর্থাৎ সে একটা কাজ এই কারণে করে যাতে পরবর্তিতে আরেকটা কাজ করার মতো অবস্থা তৈরি হয়। এবং এই সবকিছুর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি চূড়ান্ত কোনোকিছুর দিকে ধাবিত হতে থাকে, যদিও সেই কোনোকিছুটা সম্পর্কে সে একেবারেই সচেতন নয়। এবং সমাজ প্রদত্ত অনেকগুলো যৌথ যার-তরে এর পটভূমির সাপেক্ষেই আমাদের কোনো সময়ের কোনো একটা কাজের অর্থ থাকে। আমাদের মধ্যে কেবল তখনই ডাজাইন তৈরি হয় যখন আমরা সামাজিকীকরণের মাধ্যমে এক সেট যৌথ যার-তরে অর্জন করি। সুতরাং ডাজাইন ইতিমধ্যেই সংস্কৃতি থেকে আসা অনেকগুলো সম্ভাবনার জগতে বিচরণশীল, এবং সে এগুলোর মধ্যে কোনো একটা সম্ভাবনার দিকে ধাবিত হয়, কিন্তু সেই সম্ভাবনা সে সচেতনভাবে পছন্দ করে না এবং কোনো মুহূর্তেই সে ধাবমান না থেকে পারে না। এই সবকিছুকে হাইডেগার বলেছিলেন বোধ।
সুতরাং এই কাঠামোর স্তর তিনটি হচ্ছে: ইতিমধ্যেই কোনো একটা মেজাজে নিক্ষপ্ত অবস্থায় নিজেদের আবিষ্কার করা যার কারণে কোনোকিছুকে আমাদের কাছে গুরুত্ববহ মনে হয়, কোনো জিনিস ব্যবহার করে তার ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করা, এবং সর্বদা কোনো সম্ভাবনার দিকে ধাবমান থাকা। এই কাঠামোটা আসলে স্বয়ং ডাজাইন এরই গঠন কাঠামো। “বিরাজ ও সময়” এর দ্বিতীয় অংশে হাইডেগার দেখিয়েছিলেন যে, এই কোনো পরিস্থিতিতে বিরাজ করার এই তিনটি স্তর আসলে যথাক্রমে সময়ের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মাত্রা তিনটির সমার্থক।
ম্যাজি: আসলে আমার শেষে মনে হয়েছিল হাইডেগার বলছেন, বিরাজ করাই সময়। তিনি বোধহয় প্রায় আক্ষরিক অর্থেই বলছিলেন যে, আমরা হচ্ছি সময়ের মূর্তরূপ, বা সংক্ষেপে, মূর্ত সময়।
ড্রাইফাস: তার ভাষায়, ডাজাইন হচ্ছে পরোয়া করা, আর পরোয়া করার কাঠামোটা কালিক। বিরাজন ও সময়ের মৌলিক সম্বন্ধটা বুঝার পথে এটাই হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ।
ম্যাজি: এতক্ষণ যাবৎ আমরা কেবল একজন ব্যক্তি মানুষ নিয়ে কথা বলেছি, অর্থাৎ এতক্ষণ আমাদের ডাজাইন ছিল একবচন। কিন্তু পৃথিবীতে অবশ্যই অনেক মানুষ আছে, এবং একমাত্র উন্মাদ ছাড়া আর কেউই মনে করে না যে, সে ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই। আপনি এতক্ষণ যে বিশ্লেষণটা পেশ করলেন সেটা কিভাবে এই ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে? অন্যান্য কোটি কোটি ডাজাইনের কথা এখানে কিভাবে আসে?
ড্রাইফাস: হ্যাঁ, আসলে তাদের কথা অবশ্যই একেবারে শুরু থেকেই আসতে হবে। হুসার্লের মতো দেকার্তবাদীরা শুরু করে একজন বিচ্ছিন্ন, একক ব্যক্তি থেকে, যার ফলে তাদের জন্য বহির্জগতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যত কষ্টকর, ভিন্ন মন অর্থাৎ অন্য মানুষের অস্তিত্ব প্রমাণ করাও ততটাই কষ্টকর। হাইডেগার একেবারে ভিন্নভাবে শুরু করেন; ভিন্ন মনের রূপ আমাদের অভিজ্ঞতায় যেভাবে ধরা দেয় তার কাছাকাছি থাকার কারণে তাকে এই সমস্যায় পড়তে হয়নি। আমরা ডাজাইন হই, বা আমাদের মধ্যে ডাজাইন রূপলাভ করে কেবল তখনই যখন সামাজিকীকরণের মাধ্যমে আমরা বেশকিছু মানানোর দক্ষতা, মেজাজ, সম্ভাবনা ইত্যাদি অর্জন করি। ডাজাইন সবসময়ই ইতিমধ্যেই সঙ্গে-বিরাজ করে, অন্য সবার সঙ্গে, [যাকে বলা যায় সহ-বিরাজন।] আর এই দক্ষতাগুলো যেহেতু সামাজিক, সেহেতু ডাজাইন তার সমাজের অন্য সবাই কোনো পরিস্থিতিতে যা করে ঠিক তা-ই করে। আমি হাতুড়ি দিয়ে কিছু একটাকে বাড়ি দেই কারণ আমার সমাজে সবাই হাতুড়ি দিয়ে বাড়িই দেয়। সবাই যেভাবে খায় আমিও সেভাবেই খাই। আমার দেশে সবাই যেভাবে কোনো শব্দ উচ্চারণ করে আমিও সেভাবেই করি…
ম্যাজি: এবং আমাকে সেভাবে উচ্চারণ করতেও হবে, কারণ নইলে কেউ আমার কথা বুঝবে না…
ড্রাইফাস: ঠিক। হাইডেগার বলেছিলেন, মানুষ গতানুগতিক রীতি থেকে বিচ্যুতি সহ্যই করতে পারে না। যেমন, প্রায় সবাই অন্যের ভুল উচ্চারণ শুধরে দিতে তৎপর থাকে। সবাই যা করে তা করাতে প্রায় কাউকেই বাধ্য করতে হয় না। প্রথা মেনে চলতে মানুষ নিজে থেকেই সবসময় ব্যাগ্র থাকে। প্রতিটি মানুষ কিভাবে ডাজাইনে রূপলাভ করে হাইডেগার তা বিস্তারিত বলেননি, কিন্তু আমরা ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য এখানে বলতে পারি যে, একটি শিশু যখন সবাই যা করে তা-ই করতে পারে, সবাই যা বলে তা-ই বলতে পারে তখনই বলা যায় তার মধ্যে ডাজাইন আছে। সুতরাং সামষ্টিক রীতির অনুবর্তী হয়ে চলাটা ডাজাইনের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য। অবশ্যই এর মানে গণজোয়ার যেদিকে যায় সেদিকেই যাওয়া নয়। হাইডেগার একবার বলেছিলেন, এমনকি সবাই গণজোয়ার থেকে যেভাবে পালায়, কোনো একজন সেভাবেই পালায়। দেখা যাচ্ছে, স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা রীতিই অনুসরণ করি, সবাই যেভাবে স্রোতের বিপরীতে যায় সেভাবেই যাই। হাইডেগার পরিশেষে বলেছিলেন: One is what one does, or Dasein’s self is a one’s self.
ম্যাজি: আপনার বলা বিভিন্ন কথাগুলোকে পাশাপাশি স্থাপন করলে যে চিত্রটা ফুটে উঠে তা বেশ উদ্বেগজনক হতে পারে। আগে আপনি বলেছিলেন, আমরা অধিকাংশ কাজ চিন্তাভাবনা করে অর্থাৎ সচেতনভাবে করি এই ধারণা হাইডেগার উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন আবার বলছেন, সবাই যা করে আমরাও তা-ই করি, এবং আমাদের স্বাধীনতা খুবই কম। এই ধারণাগুলোকে একসাথে নিলে তা কি মানুষকে এক প্রকারের জীয়ন্ত লাশে পরিণত করে ফেলে না, যে নিজের পছন্দ মতো কিছু করে না, বাইরের বিভিন্ন চাপের প্রতি প্রায় অচেতনভাবে সাড়া দেয় কেবল?
ড্রাইফাস: সেটা ঠিক। সবাই যা করে কোনো চিন্তাভাবনা না করে তা-ই করে যাওয়া এই সত্তাকে জীয়ন্ত লাশের মতোই লাগে। কিন্তু আসলে একটি বিচ্ছিন্ন, একক ব্যক্তি থেকে শুরু করলে যে কার্তেসীয়/হুসার্লীয় সমস্যার জন্ম হয় তা এড়ানোর জন্য হাইডেগার সবকিছু উল্টো দিক থেকে ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছিলেন। প্রথানুবর্তী গণসত্তা থেকে শুরু করার পর তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে এর মধ্যেই স্বায়ত্তশাসিত ব্যক্তিসত্তা রূপলাভ করতে পারে। “বিরাজ ও সময়” এর দ্বিতীয় অংশে যথার্থতার (authenticity) ধারণার মাধ্যমে সেটাই দেখানো হয়েছে। অস্তিত্ববাদীরা হাইডেগারের এই অংশটাই নিয়েছিল। এই অংশে হাইডেগার সুপরিচিত ও জনপ্রিয় অস্তিত্ববাদী বিষয়গুলো যেমন মৃত্যু, অপরাধবোধ, পতন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন যার গভীরে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই। তবে তিনি দেখিয়েছিলেন, অপরাধবোধ ও মৃত্যু উদ্বেগের দুটি সংস্করণ, তাই উদ্বেগ নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। হাইডেগারের মতে, ডাজাইন, যেকোনো ডাজাইন, সবসময় এই ব্যাপারে সামান্য পরিমাণে হলেও সচেতন থাকে যে, বিশ্বের কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই, [বিশ্বে যা কিছু ঘটছে তার কোনো অর্থ নেই।] এর দ্বারা আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি তা হলো, সবাই যা করে আমারও তা-ই করার কোনো কারণ নেই। কোনো ঈশ্বর আমাকে এমনটা করার আদেশ দেননি, এবং মানব প্রকৃতিও এমনটা দাবী করে না। এই অস্তিত্ববাদী অবস্থান ব্যক্ত করতে গিয়ে হাইডেগার বলেছিলেন, অস্তিত্বই ডাজাইনের সারধর্ম (essence), [এবং এই সারধর্মের বাইরে তার আর কোনো সুনির্ধারিত ধর্ম নেই।] এর অর্থ হচ্ছে, মানব প্রকৃতি বলতে কিছু নেই, আমরা নিজেদের যা ভাবি আমরা তা-ই, আমাদের কাজকে আমরা যেভাবে ব্যাখ্যা করি তা দিয়েই আমাদের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। কিন্তু এটা বেশ অস্বস্তিকর। কোনো ভিত্তি, অর্থ না থাকার কারণে আমরা, হাইডেগারের ভাষায়, উনহাইমলিখ (Unheimlich) বোধ করি, অর্থাৎ বিশ্বকে আমাদের অজানা, অচেনা, ভুতুড়ে, ছমছমে মনে হয়। সেথা-বিরাজ করার এই অস্বস্তিকর, মূলোৎপাটিত অবস্থার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই আমাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?’ একটা উপায় হতে পারে পলায়ন; আমরা উদ্বিগ্নতা থেকে পালাতে পারি, সেটা ভুলে থাকতে পারি, যেক্ষেত্রে আগের মতো প্রথানুবর্তী জীবন যাপনই আমাদের ভাগ্য হবে, এবং সবার মতো কাজ করা, সবার মতো কথা বলাকে ব্যবহার করে আমরা অস্বস্তি থেকে মুক্তি খুঁজব। এমনকি আমরা হয়ত প্রাণপন চেষ্টা করে যাব সবার মতো করে কাজ করতে, কথা বলতে, পোশাক পড়তে, যাতে কোনো দিক দিয়েই কোনো উদ্বেগ আমাদের স্পর্শ করতে না পারে। এই কাজটাকে বলা যায় অযথার্থতায় পলায়ন। এটা ডাজাইন বলতে যা বুঝায় তা অস্বীকার করা, বা ডাজাইনের সব সম্পত্তি বিকিয়ে দেয়ার সমতুল্য। কিন্তু ডাজাইনের সম্পত্তি ধরে রাখতে হলে পালানো যাবে না, বরং উদ্বেগকেই আঁকড়ে ধরতে হবে। এটা যদি কেউ করতে পারে, তাহলে চিন্তাহীনভাবে কোনো একটা সম্ভাবনার পশ্চাদ্ধাবনের পরিবর্তে সে চিন্তাভাবনা করে সম্ভাবনা নির্বাচন করতে পারবে, এবং নিজের জন্য মানুষ হওয়ার একেবারে নতুন একটা সংজ্ঞা বানিয়ে নিতে পারবে। এর মানে এই নয় যে, এতদিন যা করে এসেছে তাকে তার থেকে ভিন্ন কিছু করতে হবে। কারণ, সবাই যা করে তা না করলে তো সে নিছক উন্মাদে পরিণত হবে। সুতরাং, সে আগে যা করত তা-ই করতে থাকে, কিন্তু ভিন্নভাবে, একই কাজ এবার সে ভিন্ন ভঙ্গিতে বা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করে। এবার আর সে জীবনের কোনো নিগূঢ় অর্থ বা পরম লক্ষ্য, বা বিশ্বের কোনো যুক্তিসম্মত ভিত্তির আশা করে না। সুতরাং কোনো কাজ সে এই ভেবে করে না যে এটা করলে অবশেষে সে জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে, বা কোনো কাজ জীবনের অর্থ যোগান দিতে না পারলে তা ছুঁড়ে ফেলেও দেয় না। আমার এক ছাত্র একবার ব্যাপারটা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিল, “You are able to stick with things without getting stuck with them .”
এভাবে মানুষ যথার্থ বা অথেন্টিক হয়ে উঠে। এবার বিশ্বের সাধারণ পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দেয়ার পরিবর্তে মানুষ একটা অনন্য পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দেয়। এর কোনো উদাহরণ হাইডেগার দেননি। তবে আমি ব্যাপারটা এভাবে ভাবি। সেই পরিচিত কাঠমিস্ত্রিকেই আবার নিয়ে আসা যাক। দুপুড়ের খাবারের সময় হাতুড়িটি নামিয়ে রেখে মিস্ত্রি চাইলে সবসময় সবাই যা করে তা-ই করে যেতে পারে, অর্থাৎ খাবার খেতে পারে। কিন্তু হয়ত বাইরে যদি সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটতে দেখা যায়, এবং সে যদি যথার্থ হয়, তাহলে সব মিস্ত্রি এই পরিস্থিতিতে সর্বদা যা করে সে তা নাও করতে চাইতে পারে। সে খাবারের কথা ভুলে বাগানে ফুলেদের মাঝে বেড়িয়ে আসতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কোনো পরিস্থিতিতে সবাই সম্ভাব্য যত কিছু করতে পারে তার থেকে ভিন্ন কিছু করা তার পক্ষে অসম্ভব। সে গায়ের সব কাপড় খুলে বাগানে গড়াগড়ি যেতে পারে না, কারণ লোকে সেটা করে না। কিন্তু তারপরও যথার্থতার সুযোগ আছে। এখানেও সে সবাই যা করে তা-ই করছে, কিন্তু ভিন্নভাবে, সামাজিক মর্যাদা ও অনুবর্তীতায় গা ভাসিয়ে না দিয়ে সে তার অনন্য পরিস্থিতির প্রতি অনন্যভাবে সাড়া দেয়। এই ধরণের জীবন যাপন করলে, অর্থাৎ জীবনের কোনো পরম অর্থ না খুঁজলে এবং কেবল বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি সচেতনভাবে সাড়া দিতে থাকলে মানুষ আর জীয়ন্ত লাশ থাকে না, বরং একজন ব্যক্তি হয়ে উঠে। হাইডেগার বলেছিলেন, এটা মানুষকে নমনীয়, জীবন্ত ও হাসিখুশি করে তোলে। তার মতে মানুষের এভাবেই জীবন যাপন করা উচিত।
ম্যাজি: আপনার এখনকার কথা আগের চেয়ে অন্যরকম লাগছে। এখন মনে হচ্ছে এই দর্শনটা আসলে এক ধরণের ব্যক্তিগত মুক্তির দর্শন।
ড্রাইফাস: হ্যাঁ, কিন্তু এটা এক ধরণের অস্তিত্ববাদী মুক্তিদর্শন। এদিক থেকে এটা সব ধরণের মুক্তিদর্শনের মধ্যে সবচেয়ে নবীন ও সবচেয়ে অদ্ভুত। এখানে যৌন কামনার বা নির্যাতিত শ্রেণীর মুক্তির কথা হচ্ছে না। বরং মুক্তিটা আসছে এই চিন্তা থেকে যে, উন্মুক্ত করার মতো কোনো নিগূঢ়, গভীর অর্থই নেই। ব্যক্তিমানুষের মধ্যেও ফ্রয়েডের বর্ণনার মতো কোনো নিগূঢ় সত্য নেই, বা ইতিহাসের মধ্যেও মার্ক্সের বর্ণনার মতো কোনো সত্য নেই। ডাজাইনের কোনো অন্তর্নিহিত অর্থই নেই। বরং ডাজাইনের এই অস্বস্তিকর ভিত্তিহীনতাকে সাহসের সাথে গ্রহণ করে নেয়ার মাধ্যমেই মুক্তিটা আসে।
ম্যাজি: আলোচনা জুড়ে আপনি বেশ কিছু অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করেছেন। কেবল ডাজাইন-ই নয়, আরো আছে আনরেডি-টু-হ্যান্ড, অ্যাটিউনমেন্ট ইত্যাদি। আপনি একজন মানুষকেই একটা পরিস্থিতি হিসেবে দেখেছেন, এবং যার-দিকে কে বলেছেন যার-তরে। আরো একটা অদ্ভুত কথা ছিল “Dasein is its world existingly.” অধিকাংশ পাঠক হাইডেগারের প্রথম দিককার রচনাতে বিশেষ করে “বিরাজ ও সময়” এর যতটুকু নিয়ে আমরা কথা বললাম ততটুকুতে এসব অদ্ভুত শব্দ দেখে ঘাবড়ে যান। এমনকি আমি বলতে চাই, আমার জীবনে পড়া সবচেয়ে কঠিন ও দুর্বোধ্য বইগুলোর একটা ছিল “বিরাজ ও সময়”। এটা এতই গুপ্তভাষায় লেখা যে অনেকে এর মধ্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দর্শন থাকার ব্যাপারটাই অস্বীকার করেছেন। যা মোটেই সত্য নয়, আপনার লেখাতেই আপনি হাইডেগারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনের কথা বলেছেন। আমার প্রশ্নটা এখানেই। হাইডেগার যা স্পষ্ট করতে পারেননি, আপনি সেটা কিভাবে পারলেন? হাইডেগারও আপনার মতো করেই লিখলেন না কেন? এত নিগূঢ় ও দুর্বোধ্য হওয়ার কী দরকার ছিল?
ড্রাইফাস: আসলে উত্তরটা আমার এতক্ষণের আলোচনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আমি কোনো জটিল দার্শনিক ধারণাকেও প্রাত্যহিক ব্যবহার্য একটা শব্দ দিয়ে বর্ণনা করেছি, এবং তারপর পিছু হটে আবার বলে দিয়েছি যে প্রাত্যহিক শব্দটা যথার্থ নয়, এবং আসল দার্শনিক শব্দটা এই। হাইডেগারও যদি এমনটা করতেন তাহলে হয়ত আরো ভালো হতো। যেমন, আমি লক্ষ্য শব্দটা ব্যবহার করেছি, কিন্তু পরে আবার বলে দিয়েছি যে লক্ষ্য একটা মানসিক ব্যাপার, এবং সত্যিকার অর্থে আমাদের মনে কোনো সুচিন্তিত লক্ষ্যই থাকে না। একইভাবে জীবনের পরিকল্পনার কথা বলা যায়, যা গতানুগতিক অর্থে কোনো পরিকল্পনাই নয়। তারপর আমি হাইডেগারের অদ্ভুতুড়ে নবশব্দগুলোও উল্লেখ করেছি, যেমন মন-বহির্ভূত লক্ষ্য ও পরিকল্পনাকে বলেছি যথাক্রমে যার-দিকে ও যার-তরে। একইভাবে আমরা ডাজাইন এর মতো শৈল্পিক শব্দ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, আমরা অধিকাংশ সময় যৌথভাবে সমাজ ও বিশ্বের মধ্যে বিরাজমান, এবং খুব সামান্য সময়ই সচেতন ব্যক্তি হিসেবে কোনো বস্তুর দিকে নিবদ্ধ থাকি। হাইডেগার বলতেন, হাজার বছরের গোটা দর্শনচর্চাটা আমাদের বিরাজনের সত্যিকারের রূপটাকে পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়েছে, এর প্রথম কারণ সবকিছু মসৃণভাবে চলতে থাকলে সেই বিরাজনের ব্যাপারটা আমরা বুঝতেই পারি না, আর দ্বিতীয় এবং প্রথমটির সাথে সম্পর্কিত কারণটা হচ্ছে, সেই বিরাজন ফুটিয়ে তোলার মতো কোনো শব্দও আমাদের ভাষাতে নেই। বিশ্বের কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করার জন্য আমাদের ভাষা আছে, যেমন দরজার বেশি টাইট হাতল, বা বেশি ভারী হাতুড়ি বুঝানোর জন্য আমাদের শব্দ আছে। কিন্তু সবকিছু একেবারে স্বচ্ছ ও মসৃণভাবে চলতে থাকলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তা ফুটিয়ে তোলার মতো কোনো শব্দই আমাদের নেই, আর আমাদের প্রাত্যহিক কাজকর্মের পটভূমিতে যে যৌথ বোধ আছে সেটা ভাষায় প্রকাশ তো আরো অসম্ভব। এজন্যই হাইডেগার এর জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটা শব্দভাণ্ডার তৈরি করে নিয়েছিলেন। একবার সে ভাণ্ডারে ঢুকতে পারলে তাকে বেশ কার্যকরি ও মিতব্যয়ী মনে হয়, এবং এই শব্দগুলো হাইডেগার খুব নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব জায়গায় ব্যবহার করেন। একবার “সদাপ্রস্তুত”, “বিদ্যমান” বা “জগৎ-মধ্যে-বিরাজন” এর মতো শব্দগুলো উত্থাপন করার পর তিনি সেগুলো সবসময় ব্যবহার করে যান।
ম্যাজি: এবার তাহলে হাইডেগারের পরবর্তী দর্শনগুলোতে যাওয়া যাক। “বিরাজ ও সময়” প্রথমবার প্রকাশিত হওয়ার সময় বলা হয়েছিল যে, এটা দুই খণ্ডের একটা কাজের কেবল প্রথম খণ্ড। কিন্তু সেই দ্বিতীয় খণ্ড আর প্রকাশিত হয়নি। অনেকে এর কারণ হিসেবে বলেন, হাইডেগার “বিরাজ ও সময়” এর ধারণাগুলো পরবর্তীতে নিজেই পরিত্যাগ করেছিলেন যার ফলে সেটা শেষ করা আর তার কাছে অর্থবহ মনে হয়নি। এই মতপরিবর্তন হাইডেগার গবেষণায় খুবই আলোচিত একটা বিষয় এবং এর একটা গালভরা নামও আছে: ‘die Kehre’ বা ‘দ্য টার্ন’। ‘পরবর্তী হাইডেগার’ বলতে এই টার্নের পরের হাইডেগারকেই বুঝানো হয়, আরে টার্নের আগেরটাকে বলা হয় ‘পূর্ববর্তী হাইডেগার’। এতক্ষণ আমরা যত কিছু বলেছি তার সবই পূর্ববর্তী হাইডেগারের কথা, এবং এটা এখন পর্যন্ত অনেক বেশি প্রভাবশালী হলেও কে জানে হয়ত ভবিষ্যতে পরবর্তী হাইডেগারই পূর্ববর্তীকে ছাড়িয়ে যাবে। তো এই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী হাইডেগারের মধ্যে প্রধান মতানৈক্য কী কী?
ড্রাইফাস: হাইডেগারের ‘টার্ন’ নিয়ে অনেক রকমের ব্যাখ্যা আছে এবং হাইডেগার বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এটা খুব বিতর্কিত বিষয়। অনেকে বলেন প্রথমে হাইডেগার সবকিছুর মর্মার্থ একেবারে বুঝে ফেলার দাবী করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে সেখান থেকে সরে এসে কেবল ভাসাভাসা ভাবে বুঝতে পারার কথা বলেন। অন্যদের মতে, তিনি ব্যক্তি নিয়ে চিন্তা করা থেকে সরে এসে সংস্কৃতি নিয়ে ভাবা শুরু করেছিলেন। আমি মনে করি এগুলো সবই সত্য, কিন্তু টার্নের মূল ব্যাপারটা অন্য। এক পর্যায়ে হাইডেগারই স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, তিনি তুরীয় (transcendental) ব্যাখ্যা থেকে সরে এসে অর্থাৎ hermeneutics বর্জন করে ইতিহাসনির্ভর ব্যাখ্যার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই তার দর্শনে নতুন। আগে তিনি এটা করছিলেন না। এতক্ষণ আমি যা বলেছি তা যেন সব যুগে, সব স্থানে সব মানুষের মৌলিক কাঠামো। এমনকি উদ্বেগকেও তিনি সব স্থানে, সব কালে, সব সংস্কৃতির মধ্যে একটা অভিন্ন উপাদান হিসেবে দেখেছিলেন যা থেকে পালাতে হয় বা যাকে আঁকড়ে ধরতে হয়।
পরবর্তী হাইডেগার দেখেন যে, পাশ্চাত্যে বিরাজন বুঝার একটা ইতিহাস আছে, এবং তিনি যে বিরাজ নিয়ে কথা বলছিলেন সেটা আসলে কেবল আধুনিক বিরাজন, যদিও তখন তিনি সেটা টের পাননি। তিনি বিভিন্ন যুগের বিরাজের সংজ্ঞা তৈরির চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, প্লেটোর আগে গ্রিকরা বিশ্বে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, এবং তখনও তাদের মধ্যে অস্বস্তি ও উদ্বেগ দেখা দেয়নি। কোনো জিনিসকে তারা হয় প্রকৃতির নয় মানুষের সৃষ্টি হিসেবে সানন্দে গ্রহণ করত। পরবর্তী খ্রিস্টান রীতি সবকিছুকে ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে দেখা শুরু করে, এবং বলে যে, বিশ্বকে দেখার মাধ্যমেই ঈশ্বরের পরিকল্পনা বুঝে ফেলা সম্ভব। আর আমরা অর্থাৎ আধুনিক পাশ্চাত্য মানুষেরা নিজেদেরকে ব্যক্তি হিসেবে দেখি এবং সকল বস্তুকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের অভিলাষ পূরণ করতে চাই। এই যুগেরও একেবারে শেষ সময়ে অর্থাৎ বর্তমানে আমরা সবকিছুকে, এমনকি স্বয়ং আমাদেরকেও এক ধরণের সম্পদ হিসেবে দেখছি যাকে বাড়াতে হবে এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। একটা বস্তু, একজন ব্যক্তি, বা একটি প্রতিষ্ঠান হওয়া বলতে কি বুঝায় এগুলো তারই বিভিন্ন সংজ্ঞা। হাইডেগার হলে বলতেন, বিরাজ করার বিভিন্ন বোধ বা বোধগম্যতা আছে, এবং যখন যেমন বোধ উপস্থিত থাকে তখন তেমন ধরণের জিনিস বা মানুষই দেখা দেয়। যেমন হোমার বা তারও আগে গ্রিসে মহাবীর বা বিভিন্ন চমকপ্রদ জিনিস দেখা দিত। খ্রিস্টানরা দেখা পেত সাধু ও পাপী, পুরস্কার ও প্রলোভনের। প্রাচীন গ্রিসে সাধু-সন্ত থাকতে পারত না, থাকলেও তারা হতো কেবল ভয়ানক দুর্বল মানুষ যাদেরকে সবাই মাড়িয়ে চলে যায়। একইভাবে মধ্যযুগে গ্রিক মহাবীর বা মহানায়ক থাকতে পারত না, থাকলেও তারা হতো পাপী-তাপী, অহংকারী ব্যক্তি যারা ঈশ্বরের উপর পরম নির্ভরতাকে অস্বীকার করে সমাজ ধ্বংস করতে চায়। সুতরাং আমাদের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের মানুষ ও জিনিসপত্র দেখা দেয়, এবং পরবর্তী হাইডেগার কেবল এই বিষয়টার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন যে, বিরাজনের বোধ একটি নয়, অনেকগুলো।
হাইডেগারের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই পরিবর্তনটা ভালোভাবে ফুটে উঠে তার উদ্বেগের ধারণা থেকে। পরবর্তীতে তিনি উদ্বেগকে আর কোনো সর্বজনীন কাঠামো মনে করতেন না। প্রাচীন গ্রিকরা সবকিছুর অর্থহীনতা দেখে উদ্বিগ্ন হতো না, এমনকি খ্রিস্টানরাও হতো না। উদ্বেগ, তার মতে, একটা আধুনিক বিষয়, এবং বিরাজ করার মূলহীন, মূলোৎপাটিত, নাস্তিবাদী ও প্রাযুক্তিক বোধের কারণেই আমাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
পরবর্তী হাইডেগার “বিরাজ ও সময়” এর সকল বিরাজনকে ইতিহাসায়িত করে ফেলেন, এমনকি যন্ত্রপাতির বিরাজনকেও। এদিক থেকে দেখলে পরবর্তীতে তিনি কম কান্টের মতো এবং বেশি হেগেলের মতো হয়ে উঠেন। তবে হেগেলের সাথে তার পার্থক্য হচ্ছে, তিনি পাশ্চাত্যের ইতিহাসকে ক্রমান্বয়িক পতনের ইতিহাস হিসেবে দেখেন, যেখানে মানুষ দিনদিন নিজেদের-নিয়ন্ত্রণ-নিরপেক্ষভাবে কোনো বস্তুর অস্তিত্বের বোধটা হারিয়ে ফেলছে, যে বোধটা সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিসে ছিল। এবং আধুনিক মানুষেরা এটাও বুঝতে অক্ষম যে, বিরাজনের বোধটা মানুষকে একেবারে শুরু থেকেই দিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের কাজকর্মেই বিরাজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়, এটা আমাদের উৎপাদন করতে হয় না, বরং সে-ই আমাদেরকে এমন মানুষ হিসেবে উৎপন্ন করে। হাইডেগারের মতে, তার আগের কোনো দার্শনিকই এটা বুঝতে পারেনি, তবে সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিকরা না বুঝলেও এটা অন্তত অস্বীকার করত না যেমনটা দেকার্ত থেকে নিট্শে পর্যন্ত সবাই করে এসেছে। আমাদের কাজকর্মের মধ্যে বিরাজনের এই বোধটা ক্রমান্বয়ে ভুলে যাওয়ার এই ব্যাপারটা—যাতে দার্শনিকদের অবদান আছে—হাইডেগারের মতে আবশ্যিক ছিল না। এর কারণ বেশ কিছু ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা, তবে একটা দুর্ঘটনা ঘটার জন্য তার পূর্বের অন্য একটা ঘটা আবশ্যিক ছিল।
দুটো অনুষ্ঠানই বর্তমানে ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে, তবে সব আমার এখনও দেখা হয়নি। আমি সর্বকালের সেরা নারী দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার এর Pyrrhus et Cinéas পড়তে গিয়ে হাইডেগার সম্পর্কে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ হাইডেগার ছাড়া বোভোয়ারের অস্তিত্ববাদ (existentialism) বুঝা সম্ভব নয়। তো হাইডেগার পড়তে গিয়ে দেখলাম লিখতে হলে আগে তাকে নিয়েই লেখা উচিত, জঁ-পল সার্ত্র বা বোভোয়ার কে নিয়ে নয়। ম্যাজির দুটো অনুষ্ঠানেই হাইডেগারকে নিয়ে একটা করে পর্ব ছিল, মেন অফ আইডিয়াস-এ এটা নিয়ে আলাপ করেছেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’র নিট্শে-কিয়ের্কেগর-হাইডেগার ভক্ত দর্শন-অধ্যাপক উইলিয়াম ব্যারেটের সাথে, আর দ্য গ্রেট ফিলোসফার্স-এ কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি’র বিশিষ্ট হাইডেগার-বিশেষজ্ঞ হিউবার্ট ড্রাইফাসের সাথে।
আমি এখানে দ্য গ্রেট ফিলোসফার্স-এ ড্রাইফাসের সাথে কথোপকথনটার স্বেচ্ছাচারী অনুবাদ করছি। প্রতিটি লাইন ধরে অনুবাদের পরিবর্তে আমি একবারে একজন আলোচক যা বলছেন তার পুরোটাকে নিজের ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। এবং ক্ষেত্রবিশেষে আমার নিজের কিছু সহযোগী কথাও যোগ করব। সুতরাং এটাকে কোনোভাবেই সৎ অনুবাদ বলা যাবে না। সহযোগী কথাগুলো তৃতীয় বন্ধনীর ভিতরে উল্লেখ করব। হাইডেগারের দর্শনকে এক কথায় বলা যায় “ব্যক্তিগত জীবন যাপনের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনার মতো” দর্শন। তবে শুরুতে এটুকুও বলে রাখা ভালো যে হাইডেগার একজন নাৎসি ছিলেন। তিনি ১৯৩৩ সালে ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রেক্টর পদাভিষিক্ত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে নাৎসি পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে পার্টির বিলুপ্তি পর্যন্ত এ সদস্যপদ বহাল রাখেন, যদিও এক বছরের মাথায় রেক্টর থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও তিনি নাৎসিদের অপকর্ম যেমন হলোকস্ট নিয়ে কিছু বলেননি, এবং কোনোদিন কারো কাছে ক্ষমাও চাননি। তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে ক্ষমা করা যতটা অসম্ভব, তার যুগান্তকারী দর্শনকে অবহেলা করাও ততটাই অসম্ভব। অনেকটা যেমন ক্রিস্টোফার হিচেন্সের ইরাক যুদ্ধ সমর্থন ক্ষমা করা ও তার কর্মকে অবহেলা করা দুটোই অসম্ভব, বা সর্বকালের সেরা নারী চলচ্চিত্রকার লেনি রিফেনস্টালের নাৎসি প্রোপাগান্ডা ক্ষমা করা এবং তার চলচ্চিত্রতত্ত্বকে নগণ্য মনে করা দুটোই অসম্ভব। তবে শুরু করা যাক হাইডেগার-চর্চা, বা হাইডেগিরি।
১৯২১ সালে জার্মানির Sankt Märgen এ এডমুন্ড হুসার্ল ও তার ছাত্র মার্টিন হাইডেগার।
ব্রায়ান ম্যাজি’র ভূমিকা
বিংশ শতকের শুরুর দিকের একজন দার্শনিক দর্শনের বাইরে খুব একটা পরিচিত না হলেও দর্শনের ভিতরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হলেন জার্মান এডমুন্ড হুসার্ল যার জন্ম ১৮৫৯ সালে আর মৃত্যু ১৯৩৮ সালে। তার সর্বজন স্বীকৃত মাস্টারপিস হচ্ছে Logische Untersuchungen (“যুক্তিগত অনুসন্ধান”) যা ১৯০০ এবং ১৯০১ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। তার অন্য বইগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে ১৯১৩ সালের Ideen (“আইডিয়াসমূহ”)। হুসার্লের মূল চিন্তাধারা ছিল এমন। আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা ব্যাপার একেবারে সুনিশ্চিত, তা হলো আমাদের নিজস্ব চেতনা (consciousness, awareness)। সুতরাং আমরা যদি বাস্তবতার চিত্র কোনো প্রস্তরকঠিন ভিত্তির উপর তৈরি করতে চাই, তাহলে সেখান থেকেই শুরু করা উচিত। এই পর্যন্ত অবশ্যই তার ধারণা ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্তের (১৫৯৬-১৯৬০) মতো। এরপর তিনি দেখলেন, আমাদের চেতনাটা বিশ্লেষণ করতে গেলেই দেখা যায় যে সেটা সবসময়ই “কোনো কিছুর” বা “কোনো কিছু সম্পর্কিত” চেতনা। চেতনা নিজে নিজে একটা বস্তুহীন (object-less) মনের দশা হিসেবে থাকতে পারে না, তার সবসময়ই একটা লক্ষ্যবস্তু থাকা চাই। [যেমন টেবিল নিয়ে ভাবাটা টেবিল সম্পর্কিত চেতনা, সেক্স নিয়ে ভাবাটা সেক্স সম্পর্কিত চেতনা ইত্যাদি।] আসলে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে চেতনার দশা ও চেতনার বস্তুর মধ্যে কখনোই পার্থক্য করতে পারি না: বিমূর্ত ধারণার মাধ্যমে দুটোকে আলাদা হয়ত ভাবতে পারি, কিন্তু প্রকৃত অভিজ্ঞতায় তারা একেবারে অবিভাজ্য। এক্ষেত্রে তিনি স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউমের (১৭১১-৭৬) সাথে একমত। কিন্তু এবার হুসার্লের চিন্তা একটা মৌলিক দিকে মোড় নেয়। হাজার বছর ধরে সংশয়বাদীরা দাবী করে আসছে যে, আমাদের চেতনার বস্তুগুলো আমাদের অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষভাবে আসলেই আছে কি না তা কোনোদিন প্রমাণ করা সম্ভব নয়। [অর্থাৎ আমি যে টেবিলটা দেখছি এই দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলেও টেবিলটার অস্তিত্ব থাকবে কি না তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়।] হুসার্ল এসে বললেন আমাদের চেতনার বস্তুগুলো যে “আমাদের চেতনার বস্তু” হিসেবে সত্যিকার অর্থেই আছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না, এখন আমাদের চেতনা-নিরপেক্ষভাবে তারা থাকুক বা না-ই থাকুক। সুতরাং সেই বস্তুগুলোর কোনো পরম স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে কথা না বলে যদি আমরা তাদেরকে কেবলই আমাদের চেতনার বস্তু হিসেবে বিবেচনা করি এবং সে অনুযায়ীই তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করি তাহলে কোনো ঝামেলা থাকে না। আর এই বস্তুগুলোর সাথেই যেহেতু আমাদের সবচেয়ে সরাসরি ও নিবিড় সংযোগ আছে, সেহেতু এগুলো সম্পর্কে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি জানা যাবে। বস্তুগুলো স্বাধীনভাবে আছে কি নেই সেই অনুত্তরযোগ্য প্রশ্ন নিয়ে এই ধরণের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আমাদের ভাবতেই হচ্ছে না। সেই প্রশ্নগুলোকে আমরা সিঁকেয় তুলে রাখতে পারি, হুসার্লের ভাষায় ব্র্যাকেটবন্দি করে রাখতে পারি। এটা করলে লাভ যা হবে তা হলো, দার্শনিকরা একই প্রশ্নের মারপ্যাঁচে আজীবন আটকে না থেকে নিজেদের কাজে সত্যিকারের অগ্রগতি ঘটাতে পারবেন।
এভাবে হুসার্ল দর্শনের একটি নতুন ধারার পত্তন ঘটান যার কাজ হচ্ছে চেতনা ও চেতনার বস্তু নিয়ে গবেষণা করা। ধারাটির নাম রূপতত্ত্ব বা ফেনোমেনোলজি। [বস্তুর রূপ বা phenomenon আমাদের অভিজ্ঞতায় যেভাবে ধরা দেয় ঠিক সেটাকেই বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলেই এমন নাম।] বর্তমানে আসলে ‘রূপতত্ত্ব’ শব্দটা আরো ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যখনই কেউ সরাসরি অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত কিছু বিশ্লেষণ করে এবং সেই অভিজ্ঞতার বস্তুর ব্যক্তি-নিরপেক্ষ বা পরম বা অন্য কোনো রকমের অস্তিত্ব আছে কি নেই তা নিয়ে মাথা ঘামায় না, তখনই বলা যায় সে রূপতত্ত্ব করছে। এখানে “চেতনার বস্তু” বলতে কি বুঝায় তা আরেকটু পরিষ্কার করা প্রয়োজন। “বস্তু” বলতে এখানে কেবলমাত্র ভৌত বস্তু যেমন টেবিল, চেয়ার বুঝানো হচ্ছে না, বরং এর ব্যাপ্তি অতি বিশাল। এর মধ্যে পড়বে আমাদের চিন্তা, বেদনা, আবেগ, স্মৃতি, বা এমনকি সঙ্গীত, গণিত এর মতো বিমূর্ত বিষয়গুলোও, আমাদের চেতনায় যা কিছু থাকতে পারে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আর এই সব বস্তুর পরম অস্তিত্বগত কোনো প্রশ্নে না গিয়ে এদেরকে রূপতত্ত্বে কেবলই “চেতনার আধেয়” (content) হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং তারা যে আসলেই আমাদের চেতনার আধেয় তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।
হুসার্লের ছাত্র ও অনুসারীদের একজন, মার্টিন হাইডেগার ১৯২৭ সালে Sein und Zeit (Being and Time বা “বিরাজ ও সময়”) বইটি প্রকাশের মাধ্যমে হুসার্লীয় ধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজের একটি আলাদা ধারা প্রতিষ্ঠিত করে। বইটা বিংশ শতকের অস্তিত্ববাদ, অর্থাৎ আধুনিক অস্তিত্ববাদের উৎসমুখে পরিণত হয় যদিও হাইডেগার নিজে কখনো গায়ে “অস্তিত্ববাদী” লেবেল লাগানোটা পছন্দ করেননি। ১৯২৭ এর পর তিনি আরো প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল বেঁচে ছিলেন, মারা গেছেন ১৯৭৬ সালে, এবং এর মধ্যে প্রচুর বই লিখেছেন যাদের অনেকগুলো প্রভাবশালীও হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই “বিরাজ ও সময়” কে ছাড়াতে পারেনি। অন্যান্য অস্তিত্ববাদী চিন্তাবিদেরা, বিশেষ করে জঁ-পল সার্ত্র বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন এবং দর্শনের বাইরে অস্তিত্ববাদের প্রচার-প্রসারে বেশি অবদান রেখেছেন, কিন্তু হাইডেগারই ছিলেন সবসময় তাদের শিক্ষাগুরু। এমনকি সার্ত্র তার সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের নাম রেখেছেন L’Être et le néant (Being and Nothingness বা “বিরাজ ও নাস্তিত্ব”)। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত এ বইটি বহুলাংশে হাইডেগারের অবদানধন্য।
এই হলো মোটামুটি আধুনিক অস্তিত্ববাদের রূপরেখা, যা প্রবাহিত হয়েছে হুসার্ল থেকে শুরু করে হাইডেগারের মধ্য দিয়ে সার্ত্র পর্যন্ত। তবে এখানে আরেক জনের নামও বলে রাখা উচিত। ১৯৪৫ সালে মরিস মের্লো-পোঁতি Phénoménologie de la perception (Phenomenology of Perception বা “প্রত্যক্ষণের রূপতত্ত্ব”) নামে একটি বই প্রকাশ করেন যা এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ। একসময় মের্লো-পোঁতি ও সার্ত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং একসাথেই প্রভাবশালী স্বাধীন বামপন্থী সাময়িকী Les Temps modernes (“আধুনিক কাল”) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। [উল্লেখ্য নামটা চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত সিনেমা মডার্ন টাইমস থেকে নেয়া।] মের্লো-পোঁতি অবশ্য সার্ত্র’র অনেক আগে ১৯৬১ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা যান।
আধুনিক দর্শনের এই গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি নিয়ে কথা বলার জন্য আমি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি’র অধ্যাপক হিউবার্ট ড্রাইফাস কে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
আলোচনা
ম্যাজি: ভূমিকার শুরুতে আমি বলেছিলাম, হুসার্ল আকাদেমীয় দর্শনের বাইরে অতটা পরিচিত নন। আপনি কি এই বিষয়টা দিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারবেন যে, কিভাবে সাধারণ্যে এত স্বল্প পরিচিত একজন দর্শনে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারলেন?
ড্রাইফাস: হুসার্ল গুরুত্বপূর্ণ আসলে এক রকমের প্রতিক্রিয়াশীল উপায়ে। [“প্রতিক্রিয়াশীল” কোনো খারাপ অর্থে বুঝানো হচ্ছে না, বরং অতীতের কোনো দার্শনিক ধারার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া বুঝানো হচ্ছে যা দর্শনের অগ্রগতিতে আবশ্যক।] দেকার্তের দর্শনধারাতে মানুষের সাথে বিশ্বের সম্পর্ককে ব্যক্তির সাথে বস্তুর সম্পর্ক হিসেবে দেখা হয় যেখানে মানুষ একটি পৃথক সত্তা হিসেবে বিশ্বকে জানে। হুসার্ল নিজেকে এই ধারাটির পূর্ণতা দানকারী ভাবতেন। আসলে কেবল দেকার্ত নয়, তিনি নিজেকে প্লেটো থেকে শুরু হওয়া গোটা পাশ্চাত্য দর্শনের চূড়া হিসেবে বিবেচনা করতেন, যেহেতু তিনি এমন একটা সংশয়াতীত ভিত্তি আবিষ্কার করেছিলেন যার উপর ভিত্তি করে সবকিছুর বোধগম্যতা তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে তাকে হেগেলের সাথে তুলনা করা যায় যিনি নিজেকে ভাববাদের পূর্ণতাদানকারী ভাবতেন। কিয়ের্কেগর অস্তিত্বগত চিন্তাভাবনার মাধ্যমে হেগেলের বিরোধিতা করেছিলেন যা পরবর্তীতে অস্তিত্ববাদে রূপলাভ করেছে, এবং মার্ক্সও নিজেকে হেগেলের বিরুদ্ধে স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু অস্তিত্ববাদ নয় বরং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নামে। একইভাবে হুসার্ল নিজেকে কার্তেসীয় ধারার চূড়ায় স্থাপন করেন, তার শেষ বইটির নামই ছিল Méditations cartésiennes (“কার্তেসীয় ধ্যানমালা”, ১৯৩১)। হুসার্লের কারণেই পরবর্তীতে হাইডেগার ও মের্লো-পোঁতি রা আগের ঐতিহ্যের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, এবং এক পর্যায়ে এমনকি হুসার্লের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করতে পেরেছিলেন। হুসার্লকে নিয়ে কথা বলা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় মূল-ভূখণ্ডের দর্শন আলোচনা অসম্ভব।
ম্যাজি: শুরুর কথাগুলোতে আমি কেবল হুসার্লের দর্শনের সামগ্রিক রূপরেখা টেনেছিলাম, তার চেয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয় এখন বিষয়টার আরো গভীরে যাওয়া উচিত। আপনি কী আমার ঐ কথাগুলোর সাথে আরো কিছু যোগ করবেন?
ড্রাইফাস: হুসার্লের মূল চিন্তাটা হচ্ছে: মন [অর্থাৎ মানুষের মন] বিভিন্ন বস্তুর দিকে নির্দেশিত বা নিবদ্ধ থাকে। যেমন এখন আমার মন টেবিলটার দিকে নির্দেশিত এবং আমি সেটার উপর দিকটা প্রত্যক্ষ (perceive) করছি। প্রত্যক্ষণটা এমনকি আমার মনেও আছে, এবং আমি সে সম্পর্কে বিশ্বাস পোষণ করতে পারি, কামনা ব্যক্ত করতে পারি ইত্যাদি। আমার মনের প্রায় সব আধেয় বা সামগ্রী (মাথাব্যথা বা মেজাজ বাদে) এভাবেই নির্দেশিত। এবং হুসার্ল বলেছিলেন, এই নির্দেশনতা একমাত্র মনেরই আছে, এটা মনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। একমাত্র মন ছাড়া মহাবিশ্বের আর কিছুই নিজের বাইরের কোনোকিছুর প্রতি এভাবে নির্দেশিত বা নিবদ্ধ হতে পারে না, এই ছিল তার মত।
ম্যাজি: এটা আসলেই একদিক দিয়ে খুব রহস্যময়। যেমন, যখন আমি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করি তখন আমার মাথার খুলির ভিতরে ঘটতে থাকা কর্মকাণ্ডগুলো কিভাবে বহুদূরের গ্যালাক্সির সাথেও একটা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে নিতে পারে?
ড্রাইফাস: হুসার্ল এটাকে আসলেই এক ভুন্ডারবার (wunderbar: বিস্ময়কর) ঘটনা মনে করতেন। [উল্লেখ্য হুসার্ল স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরুই করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত দিয়ে।] তিনি নিজের গোটা জীবনই উৎসর্গ করেছিলেন এটা বুঝার জন্য।
তো মনের এই সংশ্লিষ্টতা ধর্মটিকে দর্শনজগতে “নির্দেশনতা” (intentionality) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইন্টেনশনালিটি’র সাথে ইন্টেনশন বা অভিপ্রায়ের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এর দ্বারা কেবল নির্দেশিতা, নিবদ্ধতা বা সংশ্লিষ্টতাকেই বুঝানো হচ্ছে। হুসার্ল মনে করতেন এই নির্দেশনতা বা সংশ্লিষ্টতা সৃষ্টির জন্য মনের ভিতরে নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ সামগ্রী বা আধেয় আছে যার নাম তিনি দিয়েছিলেন “নির্দেশনী আধেয়” (intentional content)। নির্দেশনী আধেয় বাস্তবতার এক ধরণের বর্ণনা, এবং এই বর্ণনক্ষমতা আমার ভিতরে প্রোথিত আছে বলেই আমি কোনো বস্তুকে নির্দিষ্ট কোনোভাবে প্রত্যক্ষণ, স্মরণ, কামনা ইত্যাদি করতে পারি। হুসার্লই নির্দেশনতাকে দর্শনের সবচেয়ে কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোর একটিতে পরিণত করেছিলেন।
ম্যাজি: এই মানসিক নির্দেশনতা বা সংশ্লিষ্টতা ধর্মের ধারণাটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ঠিক কী করেছিলেন?
ড্রাইফাস: আসলে তিনি এটা দিয়ে খুবই জটিল ও সর্বাঙ্গীণ একটা দার্শনিক অট্টালিকা তৈরি করেছিলেন। তার চিন্তাধারা সবকিছুকে এত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল যে এর বিরুদ্ধ বিদ্রোহ করতে চাওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। প্রথমত, তিনি সত্যিকার অর্থেই ভাবতেন, টেবিলটা আসলেই আছে কি নেই তা তার নির্দেশনতার জন্য একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। টেবিলটাকে ব্র্যাকেটবন্দি করেই কাজ চালিয়ে যেতেন। এমনকি তিনি গোটা জগৎটাকেই ব্র্যাকেটবন্দি করতে পারতেন। তার কাছে এটুকুই যথেষ্ট ছিল যে, তিনি একটা টেবিল “আছে বলে ধরে নিয়েছেন”। সবকিছুকে এই ধরে নেয়াতে নামিয়ে আনার নামই দিয়েছিলেন ‘রূপতাত্ত্বিক লঘুকরণ’ (phenomenological reduction)। নিজের মনের নির্দেশনী আধেয় নিয়ে তিনি ভেবেছিলেন এবং সেটাই তাকে শুরু করার মতো একটা সন্দেহাতীত ভিত্তি দিয়েছিল। টেবিলটার অস্তিত্বের কোনো পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ আছে বলে তিনি এটা ধরে বা মেনে নিয়েছেন এমন নয়। তিনি ধরে নিয়েছেন বলেই তার-ধরে-নেয়া-টেবিলটি আছে। তার নিজের বর্ণনামতে, তার সংশয়াতীত প্রমাণও তার নিজের উদ্ভাবন। ওখানে টেবিলটা আছে ধরে নেয়ার কারণে তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন যে, তার ধরে নেয়া টেবিলটা ওখানে আছে। এছাড়া তো তার ধরে নেয়াই সম্ভব হতো না। এতে কোনো ভুলই থাকতে পারে না। দ্বিতীয়ত, এই স্বপ্রমাণিত নির্দেশনী আধেয় কে তিনি অন্য সবকিছুর জন্য একটা পরম ভিত্তি হিসেবে নিয়েছিলেন। নির্দেশিত মানসিক আধেয় ছাড়া মানুষের পক্ষে কোনো অভিজ্ঞতা লাভই সম্ভব হতো না, তা সে হোক সঙ্গীত, অন্য মানুষ, টেবিল বা গ্যালাক্সি। সুতরাং সকল জ্ঞান বা উপলব্ধির সন্দেহাতীত ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন বলে তিনি অতিশয়োক্তি করেননি। তিনি ইমানুয়েল কান্টের মতোই মানুষ কিভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে তা আবিষ্কারের দাবী করেছেন। এবং তিনি এটাকে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণের দাবী করেছেন, দেকার্তের মতো তুরীয় (transcendental) যুক্তির আশ্রয় নিয়ে নয়। চেতনার ব্যক্তিক আধেয় কিভাবে বস্তুর দিকে নির্দেশিত থাকে তা বর্ণনা করার মাধ্যমেই এই সবকিছু করেছিলেন।
ম্যাজি: এবং সে কারণে, আপনি আগে যেমন বলেছেন, তিনি দেকার্ত-হিউম-কান্ট দিয়ে তৈরি দার্শনিক ধারাটির পূর্ণতা দানকারী হতে পারেন। এই ধারাতে মানুষকে বস্তু পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ব্যক্তি ও বস্তুর এই মৌলিক বিভাজনটির বিরুদ্ধেই হাইডেগার আপত্তি তুলেছিলেন, ঠিক না?
ড্রাইফাস: ঠিক। হুসার্লের মাধ্যমে কার্তেসীয় ধারাটি এত স্পষ্ট ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে হাইডেগার ভাবা শুরু করলেন, ব্যক্তি-বস্তুর দ্বৈততা বিশ্বের সাথে আমাদের সম্পর্কটা আসলেই ঠিকভাবে বর্ণনা করে কি না। অন্য মানুষ বা যেকোনো বস্তুর সাথে মিথস্ক্রিয়ার জন্য কি আমাদের আসলেই একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ধারণাটি দরকার পড়ে? হুসার্ল সবসময় রূপতত্ত্বের উপর জোর দিতেন, অর্থাৎ বলতেন, কোনো পূর্বানুমান না করে সবকিছুকে তার নিজের মতো করে তোমার সামনে প্রকাশিত হতে দাও এবং তারপর সেই প্রকাশিত রূপটাকেই বর্ণনা করো। হাইডেগার ঠিক এই রূপতত্ত্বটাই মানুষের সাথে বস্তুর সম্পর্ক বুঝার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখলেন, এই সম্পর্কটা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ও বস্তুর সম্পর্কের মতো নয়। এমনকি এই সম্পর্কে চেতনা তথা সচেতনতার তেমন কোনো আবশ্যকীয় ভূমিকাই নেই। এখন, এটা শুনতে খুবই অদ্ভুত লাগতে পারে। এ কেমন কথা? একটা উদাহরণ দিলে হয়ত সুবিধা হবে এবং হাইডেগার খুব সরল উদাহরণ খুঁজে নিতে ওস্তাদ ছিলেন। এই ক্ষেত্রে তার উদাহরণ ছিল হাতুড়ি পিটানো। একজন কাঠমিস্ত্রি যখন হাতুড়ি দিয়ে একটা পেরেক গাঁথতে থাকেন, তখন সব যদি ঠিক থাকে, মানে যদি হাতুড়িতে কোনো সমস্যা না থাকে এবং তিনি কাজটাতে যথেষ্ট দক্ষ হন, তাহলে হাতুড়িটা যেন তার জন্য স্বচ্ছ বা উধাও হয়ে যায়, হাতুড়ির উপস্থিতিই যেন তিনি আর টের পান না। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তি হিসেবে হাতুড়ি নামক বস্তুটার প্রতি নিবিষ্ট নন। তিনি হয়ত হাতুড়িটার কথা ভাবছেনই না, বরং পেরেকটা নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু যদি তিনি খুবই উঁচুমানের মিস্ত্রি হন তাহলে হয়ত পেরেকটাও তার মন থেকে উধাও হয়ে যাবে, এবং তার কাজটার সাথে যুক্ত কোনোকিছুর প্রতিই তিনি সচেতন থাকবেন না। হয়ত সে সময় দুপুড়ের খাবারের কথা ভাববেন, বা কোনো সহমিস্ত্রির সাথে কথা বলতে থাকবেন। তার হাতুড়ি চলতে থাকবে, তিনি যেন খুব স্বচ্ছভাবে গোটা পরিস্থিতিটার সাথে নিজেকে মানিয়ে চলবেন যাকে হাইডেগারীয় ভাষায় বলা যায় ‘স্বচ্ছ মানানো’ (transparent coping)। [কাঁচ স্বচ্ছ থাকলে যেমন তার মধ্য দিয়ে সব দেখা যায় এবং স্বয়ং কাঁচটার অস্তিত্বই উধাও হয়ে যায়, তেমনি এখানেও হাতুড়ি, পেরেক যেন স্বচ্ছতার আড়ালে উধাও হয়ে যায়।] প্রাত্যহিক জীবনে এরকম দক্ষতার সাথে মানিয়ে চলাটাকে তিনি ‘আদিমতম উপলব্ধি’ আখ্যা দিয়েছিলেন, এবং এই মানানোতে আমাদের সাথে যে সত্তাগুলো জড়িত থাকে তাদের নাম দিয়েছিলেন ready-to-hand, বা বলা যায় ‘সদাপ্রস্তুত’। [যেমন, স্বচ্ছ মানানোর সময় মিস্ত্রির হাতে হাতুড়িটি যেন সদাপ্রস্তুত।] এক্ষেত্রে ব্যক্তি ও বস্তুর পার্থক্য থাকে না বরং উভয়ে একত্রে বিরাজে, এবং বিরাজমান সত্তাগুলোকে বা গোটা বিরাজটিকে সদাপ্রস্তুত বলার পাশাপাশি, বিরাজ করার এই বিশেষ দশাটিকেও সদাপ্রস্তুত দশা বলা যায়।
ম্যাজি: দর্শন করার গতানুগতিক পদ্ধতির সাথে এর পার্থক্যটা এত বেশি যে আমার মনে হয় ব্যাপারটা আরেক বার ঝালিয়ে নেয়া উচিত, যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না থাকে। দেকার্তের সময় থেকে দার্শনিকরা মানুষকে অনেক বস্তুবিশিষ্ট এই বিশ্বের মাঝে এক ধরণের ব্যক্তি হিসেবে দেখে এসেছেন, যার ফলে দর্শনের মূল সমস্যা ছিল প্রত্যক্ষণ ও জ্ঞান। ব্যক্তিরা কিভাবে বিশ্ব গঠনকারী বস্তুগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে পারে? সেরকম জ্ঞান কি কখনও নিশ্চিত হতে পারে? হলেও সেই নিশ্চয়তার ভিত্তিটা কী হবে? এবং এরকম আরো অনেক সমস্যা। এখন হাইডেগার বলছেন, এই সমস্যাগুলো মূলগতভাবেই ভ্রান্ত। বা আরো নিখুঁতভাবে বললে, এই প্রশ্নগুলো অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে উত্থাপিত হতে পারে, কিন্তু এগুলোকেই মূল সমস্যা ভাবা তার মতে এক বিশাল বড় ভ্রান্তি। আমরা মানুষেরা মুখ্যত অর্থাৎ আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিরাজন দশাতে বিশ্ব থেকে একটি অদৃশ্য কাঁচের জানালা দিয়ে আলাদা হয়ে থাকা কোনো ব্যক্তি, দর্শক বা পর্যবেক্ষক নই। ব্যাপারটা এমন না যে, আমরা জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আমাদের বাইরে অবস্থিত একটি বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছি। বরং এর বিপরীতটাই সত্য। আমরা একেবারে গোঁড়া থেকেই এই সব কিছুর অংশ, এই সব কিছুর মধ্যে প্রোথিত, এই সবকিছুর মধ্যে বিরাজমান, এই সবকিছুর সাথে মানিয়ে চলায় রত। সুতরাং প্রথাগত দার্শনিকরা এতদিন যেমন বলে এসেছেন আমরা তেমন কোনো “পর্যবেক্ষণরত ব্যক্তি” বা “জ্ঞানার্জনরত সত্তা” নই। আমাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রূপটা হচ্ছে “মানিয়ে-চলায়-রত সত্তা”, বা এটুকু শোনার পর কেউ আমাদেরকে “বিরাজনরত সত্তা” (being beings) বলতেও প্রলুব্ধ হতে পারে। আমরা নানান সত্তায় ভরপুর এই জগৎ থেকে অবিচ্ছিন্ন আরেকটি সত্তা, অস্তিত্বশীল জগতের আরেকটি অস্তিত্ব কেবল। এবং এখান থেকেই আমাদের শুরু করা উচিত।
ড্রাইফাস: ঠিক। গিলবার্ট রাইল “বিরাজ ও সময়” পর্যালোচনা করতে গিয়ে ব্যাপারটা ভালোভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি “বিরাজ ও সময়” এবং হুসার্লের “যুক্তিগত অনুসন্ধান” দুটোরই পর্যালোচনা প্রকাশ করেছিলেন। তার কাছে দুটোকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, কিন্তু তার মতে বিশেষ করে হাইডেগার মোক্ষম কিছু একটাতে হাত দিয়েছিলেন। রাইল বলেছেন, গতানুগতিক দর্শনে গুরুত্বের বিষয় “কিছু-জানা” (know-that), আর হাইডেগারে গুরুত্বের বিষয় “কিভাবে-জানা” (know-how)। এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ধরিয়ে দেয়া উচিত। হাইডেগার কিন্তু কেবল ব্যবহারিক কাজকর্মের মুখ্যতা ধরিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। প্রয়োগবাদীরাও1 তো সেই মুখ্যতার দাবী করেছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক, দক্ষতাপূর্ণ “কিভাবে-জানা” গুলোকে হাইডেগার রূপতত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছেন, যার ফলে আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস, নিয়মানুসরণ বা সেগুলোর নির্দেশনী আধেয়গুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে।
তবে হাতুড়ি চালনার মতো কাজকে হুসার্লও তার ব্যক্তি-বস্তু ভিত্তিক মানসিক কর্মকাণ্ডের মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। কোনোকিছুকে হাতুড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে হলে আমাকে আগে জানতে হবে যে সেটা একটা হাতুড়ি, বলেছিলেন হুসার্ল। কিন্তু হাইডেগারের দাবী ছিল এমনকি হাতুড়িটা হাতে তুলে নেয়াও খুব ‘স্বচ্ছ’ (পূর্বতন অর্থে) কাজ হতে পারে, এবং এক্ষেত্রে তিনি আরেকটা সরল উদাহরণ উঠিয়ে আনেন। তিনি তার শিক্ষার্থীদেরকে ব্যাপারটা মোটামুটি এভাবে বলেছিলেন: “ক্লাসরুমে ঢুকার জন্য তোমাদেরকে নিশ্চয়ই তার দরজার হাতল ঘুরাতে হয়েছে, কিন্তু তোমরা হাতলটা প্রত্যক্ষ করোনি, হাতল হিসেবে ধরে নাওনি, ঢুকতে হলে যে তা ঘুরাতে হবে সেটা বিশ্বাস করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করোনি, বা হাতল ঘুরানোর চেষ্টাও তোমাদের করতে হয়নি। আমাদের পর্যবেক্ষণ কেবল বলে যে, তোমরা এই ঘরে ঢুকেছ এবং হাতল না ঘুরালে নিশ্চয়ই ঢুকতে পারতে না। ঘুরানোর স্মৃতিটাও তোমাদের নেই কারণ পুরো ঘটনাটা এত স্বচ্ছ যে তা চেতনার মধ্য দিয়ে অতিক্রমই করেনি।” সাথে আমরা যোগ করতে পারি যে, একজন গাড়িচালক এক গিয়ার থেকে আরেক গিয়ারে যাওয়ার সময়ও একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়। গিয়ার পাল্টানোর জন্য ক্লাচ নিয়ে খেলা করাটা তার জন্য এতই চেতনা-বহির্ভূত হতে পারে যে একইসাথে সে কারো সাথে গভীর দার্শনিক আলোচনা চালিয়ে যেতেও সক্ষম। মানিয়ে চলাটাকে সবসময় চেতনার মধ্যে প্রবেশ করতে হয় না।
ম্যাজি: উদাহরণগুলোকে খুব মামুলি মনে হলেও তারা যা ফুটিয়ে তুলছে সেটা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো দেখাচ্ছে যে, মানুষের প্রচুর বা হয়ত অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কাজই সচেতন পছন্দ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বা মনের কোনো সচেতন দশার সাথে সম্পর্কিত নয়। এটা এই কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা সত্য হলে মানব স্বভাব বিশ্লেষণের অনেক প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বেরই পায়ের নিচে মাটি খুঁজে না পাওয়ার মতো অবস্থা হবে।
ড্রাইফাস: ঠিক। অনুধ্যান এবং সচেতনভাবে করা কাজের অস্তিত্ব হাইডেগার মোটেই অস্বীকার করতে চাননি, সেটাও আছে, কিন্তু তার মতে, আমরা প্রথমত এবং প্রধানত মানিয়ে চলা সত্তা যারা বিশ্বের সাথে শুরু থেকেই পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট। কিন্তু কোথাও যদি সমস্যা হয়, যেমন হাতুড়ির উদাহরণে হাতুড়িটি যদি বেশি ভারী হয় তাহলে আমি নিশ্চিত তা সচেতনভাবে লক্ষ্য করব। এক্ষেত্রে আমি গতানুগতিক দর্শনের সুপ্রিয় সমস্যা-সমাধানকারী ব্যক্তি বনে যাব; হয়ে উঠব একটি যুক্তিসম্পন্ন প্রাণী। আমি নিবিষ্ট মনে সমস্যাটির কথা ভাবব, বুঝতে পারব যে এই কাজের জন্য এই হাতুড়ি বেশি ভারী এবং পরিশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছাব যে অন্য একটি হাতুড়ি এক্ষেত্রে বেশি ভালো কাজ করবে। এরকম এরিস্টটলীয় প্রায়োগিক যুক্তির স্থান অবশ্যই আছে। একইভাবে দরজার হাতল যদি বেশি টাইট হয় তাহলে তা ঘুরানোর জন্য আমাকে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সবসময়ই আমরা এমন চেষ্টা করে কাজ করি মনে করাটা আসলে এক ধরণের যাকে বলে ভূতাপেক্ষিক ভ্রম। সমস্যাকালীন সময়ে কোনো জিনিস আমাদের সামনে যেভাবে উপস্থিত হয় তাকে স্বচ্ছ রেডি-টু-হ্যান্ড তথা সদাপ্রস্তুত দশার বিপরীতে হাইডেগার বলেছিলেন unready-to-hand দশা, বা বলা যেতে পারে ‘অপ্রস্তুত’ দশা। [যেমন হাতুড়ি বেশি ভারী লাগলে মিস্ত্রি অপ্রস্তুত হবেন।] হাইডেগারের মতে হুসার্ল তার রূপতত্ত্ব শুরু করেছিলেন অপ্রস্তুত দশা থেকে, অর্থাৎ প্রথম স্তরের দশাটিকে এড়িয়ে গিয়ে হুসার্ল দ্বিতীয়টি থেকে আলোচনা শুরু করেছেন।
প্রসঙ্গ যখন আসলোই তখন বিরাজ করার তৃতীয় ও সর্বশেষ দশাটির কথাও বলে ফেলা যায়। জিনিসপত্রের সাথে আমাদের সম্পর্কের এই দশার নাম হাইডেগার দিয়েছিলেন present-at-hand, বা ‘বিদ্যমান’ দশা। এটাও গুরুত্বপূর্ণ। হাতে যা প্রেজেন্ট তথা বিদ্যমান আছে তাকে নীরিক্ষা করাটাই বিদ্যমান দশা। হাতুড়ির মাথাটা যদি ছুটে যায়, বা পেরেক যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, বা যদি আমরা কেবল চিন্তা করার মেজাজে থাকি তাহলে হয়ত হাতুড়িটার দিকে অবশেষে আমাদের চোখ পড়বে এবং আমরা দেখব যে এটা একটা কাঠের টুকরো যার আগায় একটা লৌহখণ্ড লাগানো রয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমরা একটা বস্তুকে তার বৈশিষ্ট্যসহ দেখতে পাই। দার্শনিকরা এই স্তরটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। ব্যাকরণে ব্যবহৃত উদ্দেশ্য ও বিধেয়’র যুক্তিবিদ্যাগত ভিত্তি নিয়ে আলোচনার জন্য বিধেয় ক্যালকুলাস নামে একটা আলাদা শাখাই রয়েছে। এর গুরুত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু হাইডেগারের মতে এটা দৈনন্দিন মানিয়ে নেয়া থেকে দুই স্তর নিচে, গুরুত্বের দিক দিয়ে এটা মিথস্ক্রিয়ার তৃতীয় স্তরের দশা। এর আগে দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ অপ্রস্তুত দশা রয়েছে যা ব্যবহারিক সমস্যার সম্পর্কিত। তো মিথস্ক্রিয়ার এই তৃতীয়, নৈর্ব্যক্তিক দশাটিতে হাতুড়িটি আর ঠিক হাতুড়ি থাকে না, বরং কেবল ডগায় লৌহখণ্ড বিশিষ্ট একটা কাঠের টুকরাতে পরিণত হয়। এবং এর গুরুত্ব হাইডেগার স্বীকার করতেন কারণ, ‘বস্তুটির ওজন ১ কেজি’-র মতো বাক্যগুলো বিজ্ঞান ও তত্ত্বের নীতি দিয়ে তৈরি করা যায়, এবং হাইডেগার মোটেই বিজ্ঞান বা তত্ত্ব বিরোধী ছিলেন না। এমনকি “বিরাজ ও সময়” বইয়ে তিনি মানুষের সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক বিধেয়গুলোর একটা অস্তিত্ববাদী ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো, বিজ্ঞানের নীতি ও বিধেয়তে পৌঁছানোর আগে মানুষের ব্যবহারিক মানিয়ে চলার দুটি স্তর পার হয়ে আসতে হবে। সুতরাং বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রেক্ষাপট-মুক্ত কারণিক সম্পর্ক খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলেও, আমাদের ভেবে নেয়া উচিত হবে না যে তা হাইডেগার বর্ণীত দৈনন্দিন অর্থপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। এবং অবশ্যই হুসার্লের মানসিক আধেয় দিয়েও এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
ম্যাজি: আপনার কথার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা কেবল তখনই কোনোকিছু সম্পর্কে পূর্ণভাবে সচেতন হই যখন তাতে কোনো সমস্যা থাকে। কিন্তু তেমনটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে না, তাই আমাদের মনের মূল দশা সেটা নয়। অধিকাংশ সময় আমরা এমন একটা জীবন-মাধ্যমে ভেসে চলি যা আমরা অবধারিত বলে মেনে নিয়েছি, যা সম্পর্কে আমরা সচেতন নই, এবং যার প্রতি আমরা মনোযোগীও হই না। এর একটা পরিণাম হচ্ছে অধিকাংশ দার্শনিক যেমন বিশ্বের অস্তিত্ব অনুমান করা এবং সেই অনুমানকে প্রমাণসিদ্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন হাইডেগার তেমন মনে করেন না। আমরা গতানুগতিক যে চিন্তাধারাতে অভ্যস্ত তার সারকথা হচ্ছে, আমার সবচেয়ে বেশি প্রবেশগম্যতা আছে আমার মনের আধেয়তে, এবং এই আধেয় থেকেই আমাকে আমার বাইরের জগৎটার অস্তিত্ব অনুমান করে নিতে হবে, যা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। হাইডেগার এসে বললেন: না, সমস্যা-পরিস্থিতিটা আসলে তা না। বিশ্ব এমন নয় যে তাকে অনুমান করা যায়, অনুমান করতে চাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। আমি শুরু করি বিশ্বের সাথে থেকে, ভিতরে থেকে।
ড্রাইফাস: আবারো একদম ঠিক। দেকার্তের সময় থেকেই দার্শনিকরা বহির্জগতের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে আসছেন। কান্ট বলেছিলেন, এটা না কি বিশাল কেলেঙ্কারি যে এযাবৎ কেউ তা করতে পারেনি। আর হাইডেগার কান্টের প্রত্যুত্তরে “বিরাজ ও সময়” এ বলেছেন: বিশাল কেলেঙ্কারিটা হচ্ছে এই যে, দার্শনিকরা বহির্জগতের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ভাবখানা এমন যেন আমরা কোনো অন্তর্জগতে আটকে গেছি এবং বের হতে পারছি না। দার্শনিকদের বরং দেখা উচিত যে আমাদের দৈনন্দিন মানানোর জীবনে মানসিক আধেয়র কোনো দরকারই পড়ে না, তার ভাষায় আমরা “সর্বদা ইতিমধ্যেই জগৎ-মধ্যে-বিরাজমান”। আমার মনে হচ্ছে এটা আরেকটু ব্যাখ্যা করা দরকার।
যেকোনো একটা হাতুড়ির ব্যবহার আসলে নানান দক্ষতা, অনুশীলন ও যন্ত্রের একটা পটভূমিতে ঘটে, যে পটভূমিকে হাইডেগার বলছেন ‘জগৎ’। হাতুড়িটার অর্থ থাকতে পারে কেবল পেরেক, কাঠ ও বাড়িঘরের মতো জিনিসপত্রের সাপেক্ষে যে যন্ত্র বা উপাদানগুলোর সমষ্টিকে হাইডেগার বলছেন ‘তাৎপর্য’। আমার হাতুড়ি চালনার জন্য পটভূমির আরো কিছু দক্ষতার উপস্থিতি আবশ্যক, যেমন দাঁড়ানো, চলাচল, কাপড় পরা, কথা বলা ইত্যাদি। সুতরাং আমরা কোনোকিছুর সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারি, কোনোকিছুর মুখোমুখি হতে পারি কেবল একটা গোটা জগতের এবং সেই জগতের মধ্যে বা সেই জগতের অংশ হিসেবে আমার বিরাজ করার পটভূমিতে। সুতরাং বস্তুর সাথে আমার সম্পর্ককে যে জিনিসটা সম্ভব করে তোলে তা আমার মনের ভিতরে নয়, যেমনটা হুসার্ল মনে করতেন, বরং আমার মনের বাইরে, অনেক মানুষের যৌথ জিনিসপত্র ও কর্মকাণ্ডের মাঝে অবস্থিত। আমাদের যৌথ কর্মকাণ্ডের মধ্যে যে যৌথ অর্থটা আছে তাকে হাইডেগার বিরাজনের উপলব্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এবং এই উপলব্ধিটাকে যেহেতু মনের মধ্যে প্রতিবিম্বিত করা সম্ভব নয় সেহেতু তিনি মনে করেন, মনের আধেয় বাইরের কোনোকিছুর প্রতিনিধিত্ব করে কি না সেই প্রশ্ন পাইকারি সংশয়বাদীর মতো জিজ্ঞাসা করতে থাকা বাদ দেয়া উচিত। আমরা যে অনেক সময় বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে এমন কিছু ভাবতে বা বলতে পারি না তা নয়, পদার্থবিজ্ঞানীরা এবং রাস্তার সাধারণ পথচারীটিও তা হরহামেশাই করে থাকেন, কিন্তু আমাদের মনের আধেয় বাইরের কিছুর প্রতিনিধিত্ব কেবল একটা গোটা পটভূমির সাপেক্ষেই করতে পারে যে পটভূমিটা মনের আধেয় নয়, এবং এটা কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে কি করে না সেই প্রশ্নই অবান্তর।
ম্যাজি: এই ধারণাগুলো দিয়ে হাইডেগার শুধু মানুষের পরিস্থিতিই নয় বরং স্বয়ং মানব সত্তার অর্থাৎ মানুষের পরিচয়েরই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছিলেন যা গতানুগতিক যেকোনো দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একেবারে আলাদা। সেই দৃষ্টিভঙ্গিটার সাথে কি এবার আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন?
[চলবে…]
হুসার্ল, হাইডেগার ও আধুনিক অস্তিত্ববাদ – ২
<< গত পর্বের পর
ম্যাজি: এই ধারণাগুলো দিয়ে হাইডেগার শুধু মানুষের পরিস্থিতিই নয় বরং স্বয়ং মানব সত্তার অর্থাৎ মানুষের পরিচয়েরই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছিলেন যা গতানুগতিক যেকোনো দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একেবারে আলাদা। সেই দৃষ্টিভঙ্গিটার সাথে কি এবার আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন?
ড্রাইফাস: আচ্ছা। এটা তো নিশ্চিত যে তিনি কর্তা, ব্যক্তি, মন বা চেতনা থেকে শুরু করতে পারবেন না। আমাদের সত্তার যৌথ উপলব্ধির পটভূমিতে আমাদের চলমান কর্মকাণ্ডকে বর্ণনা করার একটা উপায় তার বের করতে হবে। এটা করার জন্য তিনি মারাত্মক একটা শব্দ বেছে নেন: Dasein (উচ্চারণ: ডাজাইন)। জার্মান ভাষায় ‘ডাজাইন’ অর্থ অস্তিত্ব, একেবারে নিত্য নৈমিত্তিক অস্তিত্ব। কিন্তু শব্দটির দুটো অক্ষরকে যদি আলাদা করে ফেলা হয় তাহলে ‘Da-sein’ অর্থ দাঁড়ায় ইংরেজিতে ‘being-there’ বা ‘সেথা-বিরাজন’। যে পরিস্থিতির সাথে আমরা মানিয়ে চলি, বা যে পরিস্থিতিতে আমরা বিভিন্ন কিছুর সাথে মিথস্ক্রিয়া করি, ডাজাইন বলতে সেই পরিস্থিতিটা হয়ে যাওয়াকেই বুঝানো হচ্ছে। [এখানে ‘ডা’ বা ‘সেথা’ দিয়ে পরিস্থিতিটার দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে, এবং এরকম ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা থেকে যে আমাদেরকে একেবারেই আলাদা করা যায় না সেটাই বলার চেষ্টা করা হচ্ছে।]
ম্যাজি: কিন্তু আমি কিভাবে স্বয়ং একটা পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারি?
ড্রাইফাস: একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমি যখন গাড়ি চালাচ্ছি তখন—যদি আমার ভৌত দেহের কথা না ভেবে কেবল আমার মানানোতে রত দিকটার কথা ভাবি—আমার ‘সেথা-বিরাজন’ টা নির্দেশিত কাজকর্মের ঐ পরিস্থিতিটার সাথে পুরোপুরি মিশে যায়। আমার দক্ষতাগুলো পরিস্থিতিটার সাথে খাপে খাপে মিলে যায়। হাইডেগার একটু নিগূঢ় ভাষায় বলেছিলেন, “Dasein is its world existingly.” মানব সত্তা বলতে কী বুঝায় ডাজাইন তার একটা একেবারে নতুন ব্যাখ্যা। মানুষকেই তিনি ডাজাইন বলছেন। এবং “মানব সত্তা” দ্বারা যেমন একজন ব্যক্তিমানুষ বুঝানোর পাশাপাশি মানুষের সার্বিক অস্তিত্বশীলতা বুঝানো যায়, তেমনি ডাজাইন দ্বারাও মানুষের বিরাজ করার গোটা প্রক্রিয়াটাকে বুঝানো যায়, যে প্রক্রিয়ার একটা নিদর্শন হচ্ছে একজন একক ডাজাইন। হাইডেগার দুই অর্থেই ‘ডাজাইন’ ব্যবহার করেছেন। এর ফলে যৌথ পরিস্থিতির মধ্যে পুরোপুরি নিমজ্জিত মানুষের ক্ষেত্রে তিনি যেমন ডাজাইন ব্যবহার করতে পেরেছেন, তেমনি ধীর-স্থির মনে সম্মুখে উপস্থিত কিছু নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ-গবেষণায় রত মানুষকেও ডাজাইন বলতে পেরেছেন। তবে অবশ্যই ডাজাইন যে দশাতেই থাকুক না কেন, সবসময়ই সে একটা যৌথ পটভূমিতে অবস্থিত।
ম্যাজি: আমাদেরকে তিনি যে বিশেষ বিরাজন-প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তাকে শেষ পর্যন্ত মূলগত দিক দিয়ে তিনি সরাসরি সময়ের সাথে মিলিয়েছিলেন, ঠিক না? যেখান থেকেই তার সবচেয়ে বিখ্যাত বইটার শিরোনাম এসেছে। এই সম্পর্কটা কি আমাদেরকে একটু বলতে পারবেন?
ড্রাইফাস: হ্যাঁ, সেটা এখন প্রকাশ করে দেয়াই উচিত। কোনো পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জিনিসের প্রতি এই উন্মুক্ততাকে হাইডেগার আরেকটা নামে ডাকতেন: খোলামাঠ (clearing)। আমাদের একটা যৌথ খোলামাঠ আছে যেখানে আমরা বিভিন্ন জিনিসের মুখোমুখি হই বা বিভিন্ন জিনিসের সাথে মিথস্ক্রিয়া করি, এবং এই খোলামাঠটিকে উন্মুক্ত হিসেবে ধরে রাখার কার্যক্রম অর্থাৎ উন্মুক্তকরণটাই হচ্ছি আমরা। হুসার্লের বিপরীতে হাইডেগার ভাবতেন, সক্কলের একটা যৌথ উন্মুক্তকরণের কর্মকাণ্ড আছে এবং সেই কর্মকাণ্ডের পটভূমিতেই একজন একক মানুষের নিজস্ব উন্মুক্তকরণ সংঘটিত হয়। এই কর্মকাণ্ডের একটা তিন স্তরের কাঠামো হাইডেগার তৈরি করেছিলেন। প্রথম স্তর হচ্ছে পরিস্থিতির সাথে ডাজাইনের ঐকতান (attunement), যাকে মেজাজের (mood) সমার্থক হিসেবেও ভাবা যায়। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকার কারণেই ডাজাইনের কাছে কোনো জিনিস গুরুত্বপূর্ণ ঠেকে, বা ডাজাইন বিভিন্ন জিনিসকে পরোয়া করে, যেমন কোনোকিছুকে তার আকর্ষণীয়, হুমকিজনক, উপকারী, একগুয়ে ইত্যাদি মনে হয়। হাইডেগারের মতে এই ধরণের তাৎপর্যকে গতানুগতিক দর্শনে এতদিন অবহেলা করা হয়েছে, যেহেতু একে সরাসরি কোনো জ্ঞানার্জন, কামনা বা অনুধ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না বরং এই সবকিছুর পটভূমি হিসেবে তাকে পূর্বানুমান করে নিতে হয়। ঐকতান আছে বলেই আমাদের যেকোনো পরিস্থিতি সবসময়ই আমাদের কাছে অর্থবহ বা গুরুত্বপূর্ণ ঠেকে। [অর্থাৎ আমরা সবসময়ই কোনো না কোনো মেজাজের মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করি।] আর মেজাজ যে কেবল একজন একক ব্যক্তির মনের মধ্যেই পাওয়া যায় তা নয়। একটা জনসমাগমের একটা যৌথ মেজাজ থাকতে পারে, কোনো কোম্পানির নিজস্ব সংস্কৃতি থাকতে পারে, এমনকি একটা গোটা যুগেরও একটা নির্দিষ্ট সংবেদনশীলতা বা সুবেদিতা থাকতে পারে। সমাজ যে মেজাজগুলো আমাদেরকে দেয় তার মধ্য থেকেই ব্যক্তিকে তার নিজস্ব মেজাজ বেছে নিতে হয়। এবং অবশ্যই মেজাজের ঊর্ধ্বে উঠা কখনো সম্ভব নয়, এক মেজাজ থেকে বেরিয়ে মেজাজহীনভাবে কিছুক্ষণ থেকে তারপর অন্য মেজাজ বেছে নেয়া সম্ভব নয়, বরং একটি মেজাজ থেকে আমরা সরাসরি অন্য একটি মেজাজে পতিত হই।
ডাজাইনকে হাইডেগার সবসময়ই একটা ক্রিয়াপদ হিসেবে দেখতে বলেছেন। তো এই ডাজাইনগিরির দ্বিতীয় গাঠনিক উপাদানকে তিনি বলছেন ‘আলোচনা’ (discourse)। আলোচনা শব্দটা একটু বিভ্রান্তিকর হতে পারে যেহেতু এখানে ঠিক ভাষাগত আলোচনার কথা বলা হচ্ছে না, ‘আলোচনা’ ভাষার ব্যবহারের থেকেও মৌলিক একটা জিনিস, কিন্তু এখানে তিনি একটা চমৎকার শব্দখেলা খেলেছেন যা একটু পরেই পরিষ্কার হবে। বিশ্বটা সবসময় ইতিমধ্যেই ‘গ্রন্থিবদ্ধ’ (articulated)। অর্থাৎ সবকিছু সবসময় যার যার কাজের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সজ্জিত হয়ে থাকে; আমাদের কোনো যন্ত্র ব্যবহার করতে পারার জন্য প্রতিটি যন্ত্রকে অন্য যন্ত্রগুলোর সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে। মানুষ এই গ্রন্থিবদ্ধ বিশ্বের কিছু গ্রন্থিকে ছিন্ন করার মাধ্যমেই বিরাজ করে, অর্থাৎ গোঁড়া থেকেই মানুষের উপস্থিতি বিশ্বটাকে ভেঙে একটা নতুন রূপ দিয়ে দেয়। তারপর কোনো একটা যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ সেই নতুন রূপকে আরো নতুন কোনো রূপ দিতে থাকে। তাৎপর্যের এই পূর্ণাঙ্গ কাঠামো থেকে আমি একটি হাতুড়ি তুলে নিলে একটা গ্রন্থি ভেঙে যাবে, তারপর হাতুড়িটা দিয়ে কোনো পেরেক গাঁথতে পারি বা বিপরীত প্রান্ত দিয়ে কোনো পেরেক তুলতেও পারি; দুই ক্ষেত্রে আমি হাতুড়িটার দুই রকম নতুন তাৎপর্য তৈরি করলাম। এবং আমি যা করেছি সে সম্পর্কে কথাও বলতে পারি। যেমন, বলতে পারি যে পেরেক গাঁথা বা তোলাটা সহজ ছিল। সেক্ষেত্রে আমি ইতিমধ্যে যা গ্রন্থিবদ্ধ করেছি তার উপর আরেকটি গ্রন্থি রচনা করব। জিনিসপত্রকে এভাবে বিভিন্ন উপায়ে সজ্জিত করাকেই তিনি আলোচনা বলেছিলেন। যে পরিস্থিতির মধ্যে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করি তাকে নতুন রূপ দেয়াই আলোচনা। [এক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের সাথে সর্বদা আলোচনায় রত, এবং সেই আলোচনার অনেক মাধ্যম রয়েছে যার মধ্যে কথা একটি।]
ডাজাইনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি ইতিমধ্যেই কিছুটা উঠে এসেছে। তা হলো, ডাজাইন সর্বদা নতুন সম্ভাবনার দিকে ধাবমান। আমার হাতুড়ি দিয়ে পেরেক লাগানোর উদ্দেশ্যে হয়ত কোনো ঘর মেরামত করা, আর ঘর মেরামত করার উদ্দেশ্যে আমার মিস্ত্রি পেশার সম্মান রক্ষা। ডাজাইনের নানান যন্ত্র ব্যবহারের কারণকে এদিক থেকে দার্শনিকদের ভাষায় “লক্ষ্য” বলা যেতে পারে। হাইডেগার বলেন, আমাদের সব কর্মকাণ্ড একটা “যার-দিকে” (towards-which) এর প্রতি নিবদ্ধ। এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের গোটা জীবনের যে পরিকল্পনা থাকে সেই চূড়ান্ত বা অন্তিম যার-দিকে কে হাইডেগার বলেছেন “যার-তরে” (for-the-sake-of)। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে হাইডেগার সাধারণ অর্থে “জীবনের” লক্ষ্য বা পরিকল্পনার কথা বলছিলেন না, বরং কেবল বোঝানোর সুবিধার্থে এমন শব্দগুলো ব্যবহার করেছিলেন। আসল ব্যাপার হচ্ছে, প্রাত্যহিক স্বচ্ছ মানানোয় রত ডাজাইন সবসময় নিজের অজান্তেই ভবিষ্যতের দিকে মুখ করে থাকে, অর্থাৎ সে একটা কাজ এই কারণে করে যাতে পরবর্তিতে আরেকটা কাজ করার মতো অবস্থা তৈরি হয়। এবং এই সবকিছুর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি চূড়ান্ত কোনোকিছুর দিকে ধাবিত হতে থাকে, যদিও সেই কোনোকিছুটা সম্পর্কে সে একেবারেই সচেতন নয়। এবং সমাজ প্রদত্ত অনেকগুলো যৌথ যার-তরে এর পটভূমির সাপেক্ষেই আমাদের কোনো সময়ের কোনো একটা কাজের অর্থ থাকে। আমাদের মধ্যে কেবল তখনই ডাজাইন তৈরি হয় যখন আমরা সামাজিকীকরণের মাধ্যমে এক সেট যৌথ যার-তরে অর্জন করি। সুতরাং ডাজাইন ইতিমধ্যেই সংস্কৃতি থেকে আসা অনেকগুলো সম্ভাবনার জগতে বিচরণশীল, এবং সে এগুলোর মধ্যে কোনো একটা সম্ভাবনার দিকে ধাবিত হয়, কিন্তু সেই সম্ভাবনা সে সচেতনভাবে পছন্দ করে না এবং কোনো মুহূর্তেই সে ধাবমান না থেকে পারে না। এই সবকিছুকে হাইডেগার বলেছিলেন বোধ।
সুতরাং এই কাঠামোর স্তর তিনটি হচ্ছে: ইতিমধ্যেই কোনো একটা মেজাজে নিক্ষপ্ত অবস্থায় নিজেদের আবিষ্কার করা যার কারণে কোনোকিছুকে আমাদের কাছে গুরুত্ববহ মনে হয়, কোনো জিনিস ব্যবহার করে তার ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করা, এবং সর্বদা কোনো সম্ভাবনার দিকে ধাবমান থাকা। এই কাঠামোটা আসলে স্বয়ং ডাজাইন এরই গঠন কাঠামো। “বিরাজ ও সময়” এর দ্বিতীয় অংশে হাইডেগার দেখিয়েছিলেন যে, এই কোনো পরিস্থিতিতে বিরাজ করার এই তিনটি স্তর আসলে যথাক্রমে সময়ের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মাত্রা তিনটির সমার্থক।
ম্যাজি: আসলে আমার শেষে মনে হয়েছিল হাইডেগার বলছেন, বিরাজ করাই সময়। তিনি বোধহয় প্রায় আক্ষরিক অর্থেই বলছিলেন যে, আমরা হচ্ছি সময়ের মূর্তরূপ, বা সংক্ষেপে, মূর্ত সময়।
ড্রাইফাস: তার ভাষায়, ডাজাইন হচ্ছে পরোয়া করা, আর পরোয়া করার কাঠামোটা কালিক। বিরাজন ও সময়ের মৌলিক সম্বন্ধটা বুঝার পথে এটাই হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ।
ম্যাজি: এতক্ষণ যাবৎ আমরা কেবল একজন ব্যক্তি মানুষ নিয়ে কথা বলেছি, অর্থাৎ এতক্ষণ আমাদের ডাজাইন ছিল একবচন। কিন্তু পৃথিবীতে অবশ্যই অনেক মানুষ আছে, এবং একমাত্র উন্মাদ ছাড়া আর কেউই মনে করে না যে, সে ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই। আপনি এতক্ষণ যে বিশ্লেষণটা পেশ করলেন সেটা কিভাবে এই ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে? অন্যান্য কোটি কোটি ডাজাইনের কথা এখানে কিভাবে আসে?
ড্রাইফাস: হ্যাঁ, আসলে তাদের কথা অবশ্যই একেবারে শুরু থেকেই আসতে হবে। হুসার্লের মতো দেকার্তবাদীরা শুরু করে একজন বিচ্ছিন্ন, একক ব্যক্তি থেকে, যার ফলে তাদের জন্য বহির্জগতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যত কষ্টকর, ভিন্ন মন অর্থাৎ অন্য মানুষের অস্তিত্ব প্রমাণ করাও ততটাই কষ্টকর। হাইডেগার একেবারে ভিন্নভাবে শুরু করেন; ভিন্ন মনের রূপ আমাদের অভিজ্ঞতায় যেভাবে ধরা দেয় তার কাছাকাছি থাকার কারণে তাকে এই সমস্যায় পড়তে হয়নি। আমরা ডাজাইন হই, বা আমাদের মধ্যে ডাজাইন রূপলাভ করে কেবল তখনই যখন সামাজিকীকরণের মাধ্যমে আমরা বেশকিছু মানানোর দক্ষতা, মেজাজ, সম্ভাবনা ইত্যাদি অর্জন করি। ডাজাইন সবসময়ই ইতিমধ্যেই সঙ্গে-বিরাজ করে, অন্য সবার সঙ্গে, [যাকে বলা যায় সহ-বিরাজন।] আর এই দক্ষতাগুলো যেহেতু সামাজিক, সেহেতু ডাজাইন তার সমাজের অন্য সবাই কোনো পরিস্থিতিতে যা করে ঠিক তা-ই করে। আমি হাতুড়ি দিয়ে কিছু একটাকে বাড়ি দেই কারণ আমার সমাজে সবাই হাতুড়ি দিয়ে বাড়িই দেয়। সবাই যেভাবে খায় আমিও সেভাবেই খাই। আমার দেশে সবাই যেভাবে কোনো শব্দ উচ্চারণ করে আমিও সেভাবেই করি…
ম্যাজি: এবং আমাকে সেভাবে উচ্চারণ করতেও হবে, কারণ নইলে কেউ আমার কথা বুঝবে না…
ড্রাইফাস: ঠিক। হাইডেগার বলেছিলেন, মানুষ গতানুগতিক রীতি থেকে বিচ্যুতি সহ্যই করতে পারে না। যেমন, প্রায় সবাই অন্যের ভুল উচ্চারণ শুধরে দিতে তৎপর থাকে। সবাই যা করে তা করাতে প্রায় কাউকেই বাধ্য করতে হয় না। প্রথা মেনে চলতে মানুষ নিজে থেকেই সবসময় ব্যাগ্র থাকে। প্রতিটি মানুষ কিভাবে ডাজাইনে রূপলাভ করে হাইডেগার তা বিস্তারিত বলেননি, কিন্তু আমরা ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য এখানে বলতে পারি যে, একটি শিশু যখন সবাই যা করে তা-ই করতে পারে, সবাই যা বলে তা-ই বলতে পারে তখনই বলা যায় তার মধ্যে ডাজাইন আছে। সুতরাং সামষ্টিক রীতির অনুবর্তী হয়ে চলাটা ডাজাইনের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য। অবশ্যই এর মানে গণজোয়ার যেদিকে যায় সেদিকেই যাওয়া নয়। হাইডেগার একবার বলেছিলেন, এমনকি সবাই গণজোয়ার থেকে যেভাবে পালায়, কোনো একজন সেভাবেই পালায়। দেখা যাচ্ছে, স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা রীতিই অনুসরণ করি, সবাই যেভাবে স্রোতের বিপরীতে যায় সেভাবেই যাই। হাইডেগার পরিশেষে বলেছিলেন: One is what one does, or Dasein’s self is a one’s self.
ম্যাজি: আপনার বলা বিভিন্ন কথাগুলোকে পাশাপাশি স্থাপন করলে যে চিত্রটা ফুটে উঠে তা বেশ উদ্বেগজনক হতে পারে। আগে আপনি বলেছিলেন, আমরা অধিকাংশ কাজ চিন্তাভাবনা করে অর্থাৎ সচেতনভাবে করি এই ধারণা হাইডেগার উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন আবার বলছেন, সবাই যা করে আমরাও তা-ই করি, এবং আমাদের স্বাধীনতা খুবই কম। এই ধারণাগুলোকে একসাথে নিলে তা কি মানুষকে এক প্রকারের জীয়ন্ত লাশে পরিণত করে ফেলে না, যে নিজের পছন্দ মতো কিছু করে না, বাইরের বিভিন্ন চাপের প্রতি প্রায় অচেতনভাবে সাড়া দেয় কেবল?
ড্রাইফাস: সেটা ঠিক। সবাই যা করে কোনো চিন্তাভাবনা না করে তা-ই করে যাওয়া এই সত্তাকে জীয়ন্ত লাশের মতোই লাগে। কিন্তু আসলে একটি বিচ্ছিন্ন, একক ব্যক্তি থেকে শুরু করলে যে কার্তেসীয়/হুসার্লীয় সমস্যার জন্ম হয় তা এড়ানোর জন্য হাইডেগার সবকিছু উল্টো দিক থেকে ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছিলেন। প্রথানুবর্তী গণসত্তা থেকে শুরু করার পর তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে এর মধ্যেই স্বায়ত্তশাসিত ব্যক্তিসত্তা রূপলাভ করতে পারে। “বিরাজ ও সময়” এর দ্বিতীয় অংশে যথার্থতার (authenticity) ধারণার মাধ্যমে সেটাই দেখানো হয়েছে। অস্তিত্ববাদীরা হাইডেগারের এই অংশটাই নিয়েছিল। এই অংশে হাইডেগার সুপরিচিত ও জনপ্রিয় অস্তিত্ববাদী বিষয়গুলো যেমন মৃত্যু, অপরাধবোধ, পতন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন যার গভীরে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই। তবে তিনি দেখিয়েছিলেন, অপরাধবোধ ও মৃত্যু উদ্বেগের দুটি সংস্করণ, তাই উদ্বেগ নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। হাইডেগারের মতে, ডাজাইন, যেকোনো ডাজাইন, সবসময় এই ব্যাপারে সামান্য পরিমাণে হলেও সচেতন থাকে যে, বিশ্বের কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই, [বিশ্বে যা কিছু ঘটছে তার কোনো অর্থ নেই।] এর দ্বারা আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি তা হলো, সবাই যা করে আমারও তা-ই করার কোনো কারণ নেই। কোনো ঈশ্বর আমাকে এমনটা করার আদেশ দেননি, এবং মানব প্রকৃতিও এমনটা দাবী করে না। এই অস্তিত্ববাদী অবস্থান ব্যক্ত করতে গিয়ে হাইডেগার বলেছিলেন, অস্তিত্বই ডাজাইনের সারধর্ম (essence), [এবং এই সারধর্মের বাইরে তার আর কোনো সুনির্ধারিত ধর্ম নেই।] এর অর্থ হচ্ছে, মানব প্রকৃতি বলতে কিছু নেই, আমরা নিজেদের যা ভাবি আমরা তা-ই, আমাদের কাজকে আমরা যেভাবে ব্যাখ্যা করি তা দিয়েই আমাদের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। কিন্তু এটা বেশ অস্বস্তিকর। কোনো ভিত্তি, অর্থ না থাকার কারণে আমরা, হাইডেগারের ভাষায়, উনহাইমলিখ (Unheimlich) বোধ করি, অর্থাৎ বিশ্বকে আমাদের অজানা, অচেনা, ভুতুড়ে, ছমছমে মনে হয়। সেথা-বিরাজ করার এই অস্বস্তিকর, মূলোৎপাটিত অবস্থার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই আমাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?’ একটা উপায় হতে পারে পলায়ন; আমরা উদ্বিগ্নতা থেকে পালাতে পারি, সেটা ভুলে থাকতে পারি, যেক্ষেত্রে আগের মতো প্রথানুবর্তী জীবন যাপনই আমাদের ভাগ্য হবে, এবং সবার মতো কাজ করা, সবার মতো কথা বলাকে ব্যবহার করে আমরা অস্বস্তি থেকে মুক্তি খুঁজব। এমনকি আমরা হয়ত প্রাণপন চেষ্টা করে যাব সবার মতো করে কাজ করতে, কথা বলতে, পোশাক পড়তে, যাতে কোনো দিক দিয়েই কোনো উদ্বেগ আমাদের স্পর্শ করতে না পারে। এই কাজটাকে বলা যায় অযথার্থতায় পলায়ন। এটা ডাজাইন বলতে যা বুঝায় তা অস্বীকার করা, বা ডাজাইনের সব সম্পত্তি বিকিয়ে দেয়ার সমতুল্য। কিন্তু ডাজাইনের সম্পত্তি ধরে রাখতে হলে পালানো যাবে না, বরং উদ্বেগকেই আঁকড়ে ধরতে হবে। এটা যদি কেউ করতে পারে, তাহলে চিন্তাহীনভাবে কোনো একটা সম্ভাবনার পশ্চাদ্ধাবনের পরিবর্তে সে চিন্তাভাবনা করে সম্ভাবনা নির্বাচন করতে পারবে, এবং নিজের জন্য মানুষ হওয়ার একেবারে নতুন একটা সংজ্ঞা বানিয়ে নিতে পারবে। এর মানে এই নয় যে, এতদিন যা করে এসেছে তাকে তার থেকে ভিন্ন কিছু করতে হবে। কারণ, সবাই যা করে তা না করলে তো সে নিছক উন্মাদে পরিণত হবে। সুতরাং, সে আগে যা করত তা-ই করতে থাকে, কিন্তু ভিন্নভাবে, একই কাজ এবার সে ভিন্ন ভঙ্গিতে বা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করে। এবার আর সে জীবনের কোনো নিগূঢ় অর্থ বা পরম লক্ষ্য, বা বিশ্বের কোনো যুক্তিসম্মত ভিত্তির আশা করে না। সুতরাং কোনো কাজ সে এই ভেবে করে না যে এটা করলে অবশেষে সে জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে, বা কোনো কাজ জীবনের অর্থ যোগান দিতে না পারলে তা ছুঁড়ে ফেলেও দেয় না। আমার এক ছাত্র একবার ব্যাপারটা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিল, “You are able to stick with things without getting stuck with them .”
এভাবে মানুষ যথার্থ বা অথেন্টিক হয়ে উঠে। এবার বিশ্বের সাধারণ পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দেয়ার পরিবর্তে মানুষ একটা অনন্য পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দেয়। এর কোনো উদাহরণ হাইডেগার দেননি। তবে আমি ব্যাপারটা এভাবে ভাবি। সেই পরিচিত কাঠমিস্ত্রিকেই আবার নিয়ে আসা যাক। দুপুড়ের খাবারের সময় হাতুড়িটি নামিয়ে রেখে মিস্ত্রি চাইলে সবসময় সবাই যা করে তা-ই করে যেতে পারে, অর্থাৎ খাবার খেতে পারে। কিন্তু হয়ত বাইরে যদি সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটতে দেখা যায়, এবং সে যদি যথার্থ হয়, তাহলে সব মিস্ত্রি এই পরিস্থিতিতে সর্বদা যা করে সে তা নাও করতে চাইতে পারে। সে খাবারের কথা ভুলে বাগানে ফুলেদের মাঝে বেড়িয়ে আসতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কোনো পরিস্থিতিতে সবাই সম্ভাব্য যত কিছু করতে পারে তার থেকে ভিন্ন কিছু করা তার পক্ষে অসম্ভব। সে গায়ের সব কাপড় খুলে বাগানে গড়াগড়ি যেতে পারে না, কারণ লোকে সেটা করে না। কিন্তু তারপরও যথার্থতার সুযোগ আছে। এখানেও সে সবাই যা করে তা-ই করছে, কিন্তু ভিন্নভাবে, সামাজিক মর্যাদা ও অনুবর্তীতায় গা ভাসিয়ে না দিয়ে সে তার অনন্য পরিস্থিতির প্রতি অনন্যভাবে সাড়া দেয়। এই ধরণের জীবন যাপন করলে, অর্থাৎ জীবনের কোনো পরম অর্থ না খুঁজলে এবং কেবল বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি সচেতনভাবে সাড়া দিতে থাকলে মানুষ আর জীয়ন্ত লাশ থাকে না, বরং একজন ব্যক্তি হয়ে উঠে। হাইডেগার বলেছিলেন, এটা মানুষকে নমনীয়, জীবন্ত ও হাসিখুশি করে তোলে। তার মতে মানুষের এভাবেই জীবন যাপন করা উচিত।
ম্যাজি: আপনার এখনকার কথা আগের চেয়ে অন্যরকম লাগছে। এখন মনে হচ্ছে এই দর্শনটা আসলে এক ধরণের ব্যক্তিগত মুক্তির দর্শন।
ড্রাইফাস: হ্যাঁ, কিন্তু এটা এক ধরণের অস্তিত্ববাদী মুক্তিদর্শন। এদিক থেকে এটা সব ধরণের মুক্তিদর্শনের মধ্যে সবচেয়ে নবীন ও সবচেয়ে অদ্ভুত। এখানে যৌন কামনার বা নির্যাতিত শ্রেণীর মুক্তির কথা হচ্ছে না। বরং মুক্তিটা আসছে এই চিন্তা থেকে যে, উন্মুক্ত করার মতো কোনো নিগূঢ়, গভীর অর্থই নেই। ব্যক্তিমানুষের মধ্যেও ফ্রয়েডের বর্ণনার মতো কোনো নিগূঢ় সত্য নেই, বা ইতিহাসের মধ্যেও মার্ক্সের বর্ণনার মতো কোনো সত্য নেই। ডাজাইনের কোনো অন্তর্নিহিত অর্থই নেই। বরং ডাজাইনের এই অস্বস্তিকর ভিত্তিহীনতাকে সাহসের সাথে গ্রহণ করে নেয়ার মাধ্যমেই মুক্তিটা আসে।
ম্যাজি: আলোচনা জুড়ে আপনি বেশ কিছু অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করেছেন। কেবল ডাজাইন-ই নয়, আরো আছে আনরেডি-টু-হ্যান্ড, অ্যাটিউনমেন্ট ইত্যাদি। আপনি একজন মানুষকেই একটা পরিস্থিতি হিসেবে দেখেছেন, এবং যার-দিকে কে বলেছেন যার-তরে। আরো একটা অদ্ভুত কথা ছিল “Dasein is its world existingly.” অধিকাংশ পাঠক হাইডেগারের প্রথম দিককার রচনাতে বিশেষ করে “বিরাজ ও সময়” এর যতটুকু নিয়ে আমরা কথা বললাম ততটুকুতে এসব অদ্ভুত শব্দ দেখে ঘাবড়ে যান। এমনকি আমি বলতে চাই, আমার জীবনে পড়া সবচেয়ে কঠিন ও দুর্বোধ্য বইগুলোর একটা ছিল “বিরাজ ও সময়”। এটা এতই গুপ্তভাষায় লেখা যে অনেকে এর মধ্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দর্শন থাকার ব্যাপারটাই অস্বীকার করেছেন। যা মোটেই সত্য নয়, আপনার লেখাতেই আপনি হাইডেগারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনের কথা বলেছেন। আমার প্রশ্নটা এখানেই। হাইডেগার যা স্পষ্ট করতে পারেননি, আপনি সেটা কিভাবে পারলেন? হাইডেগারও আপনার মতো করেই লিখলেন না কেন? এত নিগূঢ় ও দুর্বোধ্য হওয়ার কী দরকার ছিল?
ড্রাইফাস: আসলে উত্তরটা আমার এতক্ষণের আলোচনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আমি কোনো জটিল দার্শনিক ধারণাকেও প্রাত্যহিক ব্যবহার্য একটা শব্দ দিয়ে বর্ণনা করেছি, এবং তারপর পিছু হটে আবার বলে দিয়েছি যে প্রাত্যহিক শব্দটা যথার্থ নয়, এবং আসল দার্শনিক শব্দটা এই। হাইডেগারও যদি এমনটা করতেন তাহলে হয়ত আরো ভালো হতো। যেমন, আমি লক্ষ্য শব্দটা ব্যবহার করেছি, কিন্তু পরে আবার বলে দিয়েছি যে লক্ষ্য একটা মানসিক ব্যাপার, এবং সত্যিকার অর্থে আমাদের মনে কোনো সুচিন্তিত লক্ষ্যই থাকে না। একইভাবে জীবনের পরিকল্পনার কথা বলা যায়, যা গতানুগতিক অর্থে কোনো পরিকল্পনাই নয়। তারপর আমি হাইডেগারের অদ্ভুতুড়ে নবশব্দগুলোও উল্লেখ করেছি, যেমন মন-বহির্ভূত লক্ষ্য ও পরিকল্পনাকে বলেছি যথাক্রমে যার-দিকে ও যার-তরে। একইভাবে আমরা ডাজাইন এর মতো শৈল্পিক শব্দ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, আমরা অধিকাংশ সময় যৌথভাবে সমাজ ও বিশ্বের মধ্যে বিরাজমান, এবং খুব সামান্য সময়ই সচেতন ব্যক্তি হিসেবে কোনো বস্তুর দিকে নিবদ্ধ থাকি। হাইডেগার বলতেন, হাজার বছরের গোটা দর্শনচর্চাটা আমাদের বিরাজনের সত্যিকারের রূপটাকে পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়েছে, এর প্রথম কারণ সবকিছু মসৃণভাবে চলতে থাকলে সেই বিরাজনের ব্যাপারটা আমরা বুঝতেই পারি না, আর দ্বিতীয় এবং প্রথমটির সাথে সম্পর্কিত কারণটা হচ্ছে, সেই বিরাজন ফুটিয়ে তোলার মতো কোনো শব্দও আমাদের ভাষাতে নেই। বিশ্বের কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করার জন্য আমাদের ভাষা আছে, যেমন দরজার বেশি টাইট হাতল, বা বেশি ভারী হাতুড়ি বুঝানোর জন্য আমাদের শব্দ আছে। কিন্তু সবকিছু একেবারে স্বচ্ছ ও মসৃণভাবে চলতে থাকলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তা ফুটিয়ে তোলার মতো কোনো শব্দই আমাদের নেই, আর আমাদের প্রাত্যহিক কাজকর্মের পটভূমিতে যে যৌথ বোধ আছে সেটা ভাষায় প্রকাশ তো আরো অসম্ভব। এজন্যই হাইডেগার এর জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটা শব্দভাণ্ডার তৈরি করে নিয়েছিলেন। একবার সে ভাণ্ডারে ঢুকতে পারলে তাকে বেশ কার্যকরি ও মিতব্যয়ী মনে হয়, এবং এই শব্দগুলো হাইডেগার খুব নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব জায়গায় ব্যবহার করেন। একবার “সদাপ্রস্তুত”, “বিদ্যমান” বা “জগৎ-মধ্যে-বিরাজন” এর মতো শব্দগুলো উত্থাপন করার পর তিনি সেগুলো সবসময় ব্যবহার করে যান।
ম্যাজি: এবার তাহলে হাইডেগারের পরবর্তী দর্শনগুলোতে যাওয়া যাক। “বিরাজ ও সময়” প্রথমবার প্রকাশিত হওয়ার সময় বলা হয়েছিল যে, এটা দুই খণ্ডের একটা কাজের কেবল প্রথম খণ্ড। কিন্তু সেই দ্বিতীয় খণ্ড আর প্রকাশিত হয়নি। অনেকে এর কারণ হিসেবে বলেন, হাইডেগার “বিরাজ ও সময়” এর ধারণাগুলো পরবর্তীতে নিজেই পরিত্যাগ করেছিলেন যার ফলে সেটা শেষ করা আর তার কাছে অর্থবহ মনে হয়নি। এই মতপরিবর্তন হাইডেগার গবেষণায় খুবই আলোচিত একটা বিষয় এবং এর একটা গালভরা নামও আছে: ‘die Kehre’ বা ‘দ্য টার্ন’। ‘পরবর্তী হাইডেগার’ বলতে এই টার্নের পরের হাইডেগারকেই বুঝানো হয়, আরে টার্নের আগেরটাকে বলা হয় ‘পূর্ববর্তী হাইডেগার’। এতক্ষণ আমরা যত কিছু বলেছি তার সবই পূর্ববর্তী হাইডেগারের কথা, এবং এটা এখন পর্যন্ত অনেক বেশি প্রভাবশালী হলেও কে জানে হয়ত ভবিষ্যতে পরবর্তী হাইডেগারই পূর্ববর্তীকে ছাড়িয়ে যাবে। তো এই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী হাইডেগারের মধ্যে প্রধান মতানৈক্য কী কী?
ড্রাইফাস: হাইডেগারের ‘টার্ন’ নিয়ে অনেক রকমের ব্যাখ্যা আছে এবং হাইডেগার বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এটা খুব বিতর্কিত বিষয়। অনেকে বলেন প্রথমে হাইডেগার সবকিছুর মর্মার্থ একেবারে বুঝে ফেলার দাবী করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে সেখান থেকে সরে এসে কেবল ভাসাভাসা ভাবে বুঝতে পারার কথা বলেন। অন্যদের মতে, তিনি ব্যক্তি নিয়ে চিন্তা করা থেকে সরে এসে সংস্কৃতি নিয়ে ভাবা শুরু করেছিলেন। আমি মনে করি এগুলো সবই সত্য, কিন্তু টার্নের মূল ব্যাপারটা অন্য। এক পর্যায়ে হাইডেগারই স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, তিনি তুরীয় (transcendental) ব্যাখ্যা থেকে সরে এসে অর্থাৎ hermeneutics বর্জন করে ইতিহাসনির্ভর ব্যাখ্যার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই তার দর্শনে নতুন। আগে তিনি এটা করছিলেন না। এতক্ষণ আমি যা বলেছি তা যেন সব যুগে, সব স্থানে সব মানুষের মৌলিক কাঠামো। এমনকি উদ্বেগকেও তিনি সব স্থানে, সব কালে, সব সংস্কৃতির মধ্যে একটা অভিন্ন উপাদান হিসেবে দেখেছিলেন যা থেকে পালাতে হয় বা যাকে আঁকড়ে ধরতে হয়।
পরবর্তী হাইডেগার দেখেন যে, পাশ্চাত্যে বিরাজন বুঝার একটা ইতিহাস আছে, এবং তিনি যে বিরাজ নিয়ে কথা বলছিলেন সেটা আসলে কেবল আধুনিক বিরাজন, যদিও তখন তিনি সেটা টের পাননি। তিনি বিভিন্ন যুগের বিরাজের সংজ্ঞা তৈরির চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, প্লেটোর আগে গ্রিকরা বিশ্বে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, এবং তখনও তাদের মধ্যে অস্বস্তি ও উদ্বেগ দেখা দেয়নি। কোনো জিনিসকে তারা হয় প্রকৃতির নয় মানুষের সৃষ্টি হিসেবে সানন্দে গ্রহণ করত। পরবর্তী খ্রিস্টান রীতি সবকিছুকে ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে দেখা শুরু করে, এবং বলে যে, বিশ্বকে দেখার মাধ্যমেই ঈশ্বরের পরিকল্পনা বুঝে ফেলা সম্ভব। আর আমরা অর্থাৎ আধুনিক পাশ্চাত্য মানুষেরা নিজেদেরকে ব্যক্তি হিসেবে দেখি এবং সকল বস্তুকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের অভিলাষ পূরণ করতে চাই। এই যুগেরও একেবারে শেষ সময়ে অর্থাৎ বর্তমানে আমরা সবকিছুকে, এমনকি স্বয়ং আমাদেরকেও এক ধরণের সম্পদ হিসেবে দেখছি যাকে বাড়াতে হবে এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। একটা বস্তু, একজন ব্যক্তি, বা একটি প্রতিষ্ঠান হওয়া বলতে কি বুঝায় এগুলো তারই বিভিন্ন সংজ্ঞা। হাইডেগার হলে বলতেন, বিরাজ করার বিভিন্ন বোধ বা বোধগম্যতা আছে, এবং যখন যেমন বোধ উপস্থিত থাকে তখন তেমন ধরণের জিনিস বা মানুষই দেখা দেয়। যেমন হোমার বা তারও আগে গ্রিসে মহাবীর বা বিভিন্ন চমকপ্রদ জিনিস দেখা দিত। খ্রিস্টানরা দেখা পেত সাধু ও পাপী, পুরস্কার ও প্রলোভনের। প্রাচীন গ্রিসে সাধু-সন্ত থাকতে পারত না, থাকলেও তারা হতো কেবল ভয়ানক দুর্বল মানুষ যাদেরকে সবাই মাড়িয়ে চলে যায়। একইভাবে মধ্যযুগে গ্রিক মহাবীর বা মহানায়ক থাকতে পারত না, থাকলেও তারা হতো পাপী-তাপী, অহংকারী ব্যক্তি যারা ঈশ্বরের উপর পরম নির্ভরতাকে অস্বীকার করে সমাজ ধ্বংস করতে চায়। সুতরাং আমাদের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের মানুষ ও জিনিসপত্র দেখা দেয়, এবং পরবর্তী হাইডেগার কেবল এই বিষয়টার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন যে, বিরাজনের বোধ একটি নয়, অনেকগুলো।
হাইডেগারের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই পরিবর্তনটা ভালোভাবে ফুটে উঠে তার উদ্বেগের ধারণা থেকে। পরবর্তীতে তিনি উদ্বেগকে আর কোনো সর্বজনীন কাঠামো মনে করতেন না। প্রাচীন গ্রিকরা সবকিছুর অর্থহীনতা দেখে উদ্বিগ্ন হতো না, এমনকি খ্রিস্টানরাও হতো না। উদ্বেগ, তার মতে, একটা আধুনিক বিষয়, এবং বিরাজ করার মূলহীন, মূলোৎপাটিত, নাস্তিবাদী ও প্রাযুক্তিক বোধের কারণেই আমাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
পরবর্তী হাইডেগার “বিরাজ ও সময়” এর সকল বিরাজনকে ইতিহাসায়িত করে ফেলেন, এমনকি যন্ত্রপাতির বিরাজনকেও। এদিক থেকে দেখলে পরবর্তীতে তিনি কম কান্টের মতো এবং বেশি হেগেলের মতো হয়ে উঠেন। তবে হেগেলের সাথে তার পার্থক্য হচ্ছে, তিনি পাশ্চাত্যের ইতিহাসকে ক্রমান্বয়িক পতনের ইতিহাস হিসেবে দেখেন, যেখানে মানুষ দিনদিন নিজেদের-নিয়ন্ত্রণ-নিরপেক্ষভাবে কোনো বস্তুর অস্তিত্বের বোধটা হারিয়ে ফেলছে, যে বোধটা সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিসে ছিল। এবং আধুনিক মানুষেরা এটাও বুঝতে অক্ষম যে, বিরাজনের বোধটা মানুষকে একেবারে শুরু থেকেই দিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের কাজকর্মেই বিরাজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়, এটা আমাদের উৎপাদন করতে হয় না, বরং সে-ই আমাদেরকে এমন মানুষ হিসেবে উৎপন্ন করে। হাইডেগারের মতে, তার আগের কোনো দার্শনিকই এটা বুঝতে পারেনি, তবে সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিকরা না বুঝলেও এটা অন্তত অস্বীকার করত না যেমনটা দেকার্ত থেকে নিট্শে পর্যন্ত সবাই করে এসেছে। আমাদের কাজকর্মের মধ্যে বিরাজনের এই বোধটা ক্রমান্বয়ে ভুলে যাওয়ার এই ব্যাপারটা—যাতে দার্শনিকদের অবদান আছে—হাইডেগারের মতে আবশ্যিক ছিল না। এর কারণ বেশ কিছু ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা, তবে একটা দুর্ঘটনা ঘটার জন্য তার পূর্বের অন্য একটা ঘটা আবশ্যিক ছিল।