পর্ব-১
কোনো ধর্মগ্রন্থই স্বয়ং আল্লাহ, ফেরেস্তাগণ এমনকি অধিকাংশ নবীগণও নিজ হাতে লিখেননি; লিখেছেন সাধারণ/অসাধারণ মানুষ, আর মানুষ কোনোক্রমেই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কুরআন আল্লাহময় রাছুলের (৩: এমরান- ৭৯) মুখ নিঃসৃত বাণী, নিজ বা অন্যের দ্বারা লিখিত, ভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন লোক দ্বারা পরম্পরায় সংকলিত।খ. সংক্ষিপ্ত ইছলামী বিশ্ব-কোষে বিভিন্ন গ্রন্থের বরাতে লেখা ১. ...রাছুল (সা) তার জীবদ্দশাতেই আল্লাহর আদেশে কুরআনগ্রন্থের সমুদয় আয়াতের বিন্যাস-শৃঙ্খল নিরূপিত করে দিয়েছিলেন এবং স্বয়ং রাছুল (সা) ও বহু ছাহাবী এইভাবে সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থ করেছিলেন...। ২. কোরানের বর্তমান রূপ রাছুল (সা) কর্তৃক নির্দিষ্ট হয়েছিল। - হাদিছ থেকেও জানা যায় যে, রাছুল (সা) প্রত্যেক বছর রামাদান মাসে সমগ্র কুরআনগ্রন্থ অর্থাৎ ঐ সময় পর্যন্ত জিব্রাইল একবার করে এবং তাঁর জীবনের শেষ রমাদানে সমগ্র কুরআনগ্রন্থ জিব্রাইলকে দুই/তিন বার শুনিয়েছিলেন। এ হতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রাছুল (সা)-এর ওফাতের পূর্বেই কুরআন মজিদের ছুরা ও আয়াতগুলোর ক্রম বিন্যাস নির্ধারণ ও নির্দিষ্ট অবস্থায় ছিল এবং যে সকল ছাহাবীর কুরআনগ্রন্থ মুখস্থ ছিল তারাও ঐ ক্রমানুসারে মুখস্থ রেখেছিলেন। ৩. রাছুলের সময়ই আয়াতের সংখ্যা গণনা করা হয়েছিল-হাদিছ হতেও প্রমাণিত হয় যে রাছুলের জীবদ্দশায় কুরআন মজিদের আয়াতের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছিল। ৪. মহানবী কর্তৃক লিখিত কুরআন বিবি হাফসার মারফত প্রাপ্ত হয়ে ওসমান তার আয়াত নম্বরসহ নকল করে আরবের সকল দেশে প্রেরণ করেন যা অদ্যাবধি প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত আছে। [১-৪নং দ্র: সংক্ষিপ্ত ইছলামী বিশ্বকোষ; ১ম খ.৩য় মুদ্রণ; ‘আয়াত’ ও ‘কুরআন’ অধ্যায়; পৃ: ৭০ ও ৩৩৬; ই. ফা.] বেশি দিনের কথা নয়, প্রায় ৫০ বছর পূর্বের অনূদিত ও প্রকাশিত যে কোনো কুরআনগ্রন্থের প্রারম্ভে সুরা, পারা, মনজিল, রুকু, সেজদা ও আয়াত এবং শব্দ, জের, জবর, পেশ, তাসদিদ সংখ্যার হিসাবসহ একটি স্বতন্ত্র তালিকা থাকতো; তাতে আয়াতের সংখ্যা ৬,৬৬৬টি উল্লেখ থাকতো। কিন্তু আধুনিক প্রকাশিত কুরআনে সবই থাকে কিন্তু আয়াতসংখ্যা থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ ইছলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত কুরআনগ্রন্থ অন্যতম। এর কারণ অজ্ঞাত ও রহস্যজনক বটে! বলাবাহুল্য, মোবারক করীম জওহর অনূদিত কুরআনগ্রন্থে আজও ৬,৬৬৬ টি আয়াত লেখা আছে; লেখা আছে আশরাফ আলী থানভীর অনূদিত কুরআনসহ অধিকাংশ গ্রন্থে। কিন্তু কুরআনখানির আয়াত সংখ্যা গণনা করলে পাওয়া যায় মাত্র ৬,২৩৬ টি; অর্থাৎ ৪৩০ টি আয়াত কম! এক্ষণে যে কেউ যে কোনো কুরআনগ্রন্থের আয়াতসংখ্যা গুণে তার সত্যাসত্য পরীক্ষা করতে পারেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এই সাধারণ বা অসাধারণ ভুলটি আজ প্রায় দেড় হাজার বছর যাবৎ কুরআনগ্রন্থ নীরবে বহন করছে! গ. বিশ্বকোষের দ্বিতীয় তথ্য (কুরআনগ্রন্থের মোট আয়াত সংখ্যা )৫. “...আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্বারীগণ কুরআনের আয়াতের সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন: কুফীদের মতে: ৬,২৩৬টি আয়াত; বসরাবাসীদের মতে: ৬,২১৬টি আয়াত; সিরীয়াবাসীদের মতে: ৬,২৫০টি আয়াত; ইছমাইল ইবনে জাফর মদনীর মতে: ৬,২১৪টি আয়াত; মক্কীদের মতে: ৬,২১৮টি আয়াত; বিবি আয়শার মতে: ৬,৬৬৬টি আয়াত”। [দ্র: সং. ই. বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ ‘আয়াত’ অধ্যায়; পৃ: ৭০; ই. ফা.]উদ্বৃত তথ্য দুটি একে অন্যের বিপরীত; অর্থাৎ একটি অপরটিকে মিথ্যা, ভুল তথা কাল্পনিক বলেই সাক্ষ্য দেয়। প্রথমটি যারা বিশ্বাস করবেন, তাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হয় যে, জিব্রাইল কর্তৃক সংশোধিত কুরআনগ্রন্থ আজকের বিশ্বের কেউই অনুসরণ করছে না বা নেই অথবা ধারণাটি ভুল; বরং দল উপ-দল কর্তৃক অনূদিত কুরআনগ্রন্থ সকলেই অনুসরণ করছে; যেমন আজকের ছুন্নী সম্প্রদায় উল্লিখিত কুফি মতের কুরআনগ্রন্থ অনুসরণ করছে; যার আয়াতের সংখ্যা ৬,২৩৬টি। আর দ্বিতীয়টি বিশ্বাস করলে জিব্রাইল কর্তৃক পরীক্ষা ও সংশোধন সম্বন্ধীয় হাদিছগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া বর্ণিত কোন্ মতের কুরআনখানি জিব্রাইল কর্তৃক পরীক্ষীত ও সংশোধিত তা কারো জানা আছে বলে মনে হয় না। আয়শার মতে আয়াতসংখ্যা ৬,৬৬৬ টি।
তার স্ব-পক্ষে একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছেঃ
তৎকালে তুরস্কের শাসনকর্তা আরবের খলিফা নামে রাজা-বাদশাদের শুভ দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কোরানের ৬,৬৬৬ টি আয়াতের প্রমাণ ও প্রতীক স্বরূপ ৬,৬৬৬ টি স্বর্ণের মোমবাতি সংবলিত মহামূল্যবান একটি বাতিদানি তৈরি করেন কাবাঘরে উপহার দেয়ার জন্য। কিন্তু বিধি বাম, হঠাৎ মুছলিম বীর কামাল আতাতুর্কের আগমনে তুর্কী মৌলবাদ লণ্ড-ভণ্ড হওয়ার ফলে সে পরিকল্পনা বাতিল হয়। অতঃপর কামাল পাশা তোপকাপী মিউজিয়ামে ঐ বাতিদানিটি রক্ষণ করেন, যা আজও সেখানে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, ওসমানের লিখিত কোরানও সেখানে রয়েছে। [দ্র: সরাসরি তোপকাপী মিউজিয়াম অথবা এ্যাম্বেসিতে খোঁজ নিতে হবে] পক্ষান্তরে আজকের কুরআনগ্রন্থে লেখা থাকে ৬,৬৬৬ টি আয়াত (বিবি আয়শার মতে), কিন্তু তার সংরক্ষিত কুরআনগ্রন্থ নেই,কারন আজকের কুরআন গ্রন্থে আছে মাত্র ৬,২৩৬ টি (কুফী মত) আয়াত। অতএব বাকি ৪৩০ টি আয়াত কে, কখন এবং কিভাবে গায়েব করলো বা হলো, তা মুছলিমদের একান্তভাবেই ভেবে দেখা জরুরি। কুরআনগ্রন্থের আয়াত সম্বন্ধে উল্লিখিত তথ্য দুটি একে অন্যের বিপরীত তা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। এই বৈপরীত্য ঢেকে নিরীহ জনসাধারণের দৃষ্টি ভ্রম করার জন্য ‘বিশ্বকোষের’ ১৫ জন আলেম-সম্পাদক, যাদের মধ্যে ৫ জন ডক্টরেট, ১ জন অধ্যক্ষ, ২ জন অধ্যাপক ও ১ জন হাফেজও রয়েছেন এবং বাকিগণ সকলেই মনীষী, ইছলামিক চিন্তাবিদ ইত্যাদি; তাদের সম্মিলিত মন্তব্য হল: “আয়াতের আরম্ভ ও শেষ কোথায়, এই সম্বন্ধে মতভেদের কারণে সংখ্যায় এরূপ তারতম্য হয়েছে।” [ দ্র: সং. ই. বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ ‘আয়াত’ অধ্যায় ; পৃ: ৭০; ই. ফা.] প্রকাশ থাকে যে, জিব্রীল (?) কর্তৃক একাধিকবার সংশোধন করার পরও তারতম্য যে হয়েছে তা শরিয়ত এক্ষণে স্বীকার করতে বাধ্য। বিশ্বকোষের তথ্য দুটি পরস্পর বিপরীত আর আলেমদের সম্মিলীত মন্তব্যটি বিপরীত বটে! এমন কিশোরসুলভ মন্তব্য তাদের ধর্মজ্ঞান ও দূরদর্শিতা সম্বন্ধে হতাশা ব্যক্ত করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ উপরোক্ত বিবরণের সঙ্গে মন্তব্যটির কোনো মিল নেই। এদের সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করার দুঃসাহস শোভা পায় না! তবে মরহুম আঁকরাম খাঁর ‘মোস্তফা চরিত’-এর লেখা ছোট্ট একটি ঘটনা মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন যে, জীবনে একবারই মাত্র আলেমদের সঙ্গে ধর্ম-তর্কে হেরে জান; কোনো এক গ্রামে খাঁ সাহেব বাহেজে (ধর্মীয় বিতর্ক সভায়) অবতীর্ণ হন। প্রসঙ্গক্রমে আলেমগণ দাবি করেন যে, আলী রামের রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন; তার প্রমাণ স্বরূপ আলেমগণ একখানি বহু পুরনো মস্ত বড় পুঁথিগ্রন্থ এনে খাঁ সাহেবের সামনে পড়ে শোনান। তাতে লেখা ছিল: ‘আলী আর বীর হনুমান/অযোধ্যায় মহা যুদ্ধ/দোনো পলোয়ান।’ অতঃপর কেউ কাউকে হারাতে পারেনি বলেও তাতে উল্লেখ আছে! কেতাবের এই বয়ান শুনে এবং স্বচক্ষে ঐ মস্তবড় কেতাব দেখে উপস্থিত আলেমগণ সমস্বরে নিজেদের পক্ষে জয় জয় ঘোষণা করেন। [দ্র: মোস্তফা চরিত: আকরাম খাঁ] (চলবে)
পর্ব-২
(পূর্বাপর)
বিশ্বকোষের তৃতীয় তথ্য৬. তফসিরে বায়দবীতে বলা হয়েছে যে, সুরা বাকারাতে ২৮১ টি আয়াত আছে। ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, অধিকাংশের মতে কুরআন মজিদের অবতীর্ণ শেষ আয়াতটি সম্বন্ধে রাছুল বলেন, “এটাকে বাকারার ২৮০তম শেষ আয়াতের পরে সন্নিবেশিত করো।” [সং. ই. বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ; ‘আয়াত’ অধ্যায়; পৃ: ৭০; ই. ফা.]। অতএব ছুরা বাকারার আয়াত সংখ্যা হওয়া উচিত মোট ২৮১টি। অথচ সেখানে আছে মোট ২৮৬টি আয়াত। তদুপরি মহানবীর নির্দেশমতো সেই শেষ আয়াতটি সেখানে সন্নিবেশিত করা হয়নি। আরো প্রকাশ থাকে যে অতিরিক্ত ৫টি আয়াত সুরা বাকারায় কিভাবে! কী করে! এবং কোথা থেকে ঢুকে পড়লো, কেন পড়লো এই ঐতিহাসিক প্রশ্নটি আজও অজানা রয়েছে।
৭. হযরত উবিয়্যার (রা) প্রতিলিপিতে ২টি সুরা অতিরিক্ত ছিল।
৮. ইবনে মাসুউদ (রা) এর প্রতিলিপিতে সুরা নং ১১৩ ও ১১৪ বিদ্যমান ছিল না।
৯. শিয়াদের মতে আলী (রা) ও তার বংশের (নবী বংশের) শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধীয় আয়াতসমূহ এমনকি সুরাসমূহ কুরআনগ্রন্থ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, যথা : ক. সুরা আল-নুরায়ন ও খ. সুরা ওয়ালায়া।
১০. ওসমান কুরআনের যে প্রতিলিপি প্রস্তুত করেছিলেন-- ঐ লিখন পদ্ধতি এখনও প্রচলিত রয়েছে। কুরআনের ঐ প্রতিলিপিতে নুকতা: ও স্বর চিহ্ন ছিল না, ফলে অনআরবদের পক্ষে ঐ কুরআনগ্রন্থ শুদ্ধভাবে পাঠ করা কঠিন ছিল।[পরবর্তীতে নোক্তা ও কারক বিভক্তি সংযোজন করা আল্লাহ-রাছুল, জিব্রাইল তথা খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের ইচ্ছা ও কাজের ওপর সাধারণ মানুষের অনধিকার হস্তক্ষেপ। কুরআনগ্রন্থের নোক্তা, কারক বিভক্তি সংযোজন করা হয় খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের প্রায় ১৪০ থেকে ৩৫০ বছর পরে]
১১. কুরআনের প্রামাণ্য পাঠ সুনির্ধারিত রাখার জন্য উমাইয়া যুগে আরবি বর্ণমালার সমরূপী বর্ণসমূহের বিভিন্নতা সূচক নুক্তা: চিহ্ন (বিন্দু) প্রযুক্ত হয়। এতদ্ব্যতীত স্বরচিহ্নসমূহ ও তানভীন স্ত্রীলিঙ্গসূচক অন্ত্য গোল ‘তা’, আলিফের ব্যঞ্জন বর্ণসমূহের দ্বিত্ববোধক চিহ্ন (তাসদিদ) ও প্রচলিত হয়--।
১২. - পাঠ বিচারের এই মান অনুযায়ী সপ্তকারীর পাঠ ইছলামী সমাজে প্রচলিত ছিল। বর্তমান কালে এদের দুজনের পাঠ মাত্র প্রচলিত আছে-। মিশর ব্যতীত আফ্রিকার সর্বত্র নাফি’র পাঠ এবং মিশরে ও পৃথিবীর বাকি অংশে হাফাসে’র পাঠ প্রচলিত।
১৩. স্বর চিহ্নসমূহ প্রথমে বর্ণের বিভিন্ন স্থানে নুক্তারূপে লিখিত হতো। অষ্টম শতাব্দির মধ্যভাগে এই ব্যবস্থা পরিবর্তীত করে ‘আলিফ’, ‘ওয়াও’, এবং ‘য়্যা’-এর অনুকরণে বর্তমানে ব্যবহৃত যবর, পেশ ও যের প্রবর্তিত হয়। কেউ কেউ কুরআনের লিপিতে এগুলোর ব্যবহার সঙ্গত মনে করেননি। [৭-১৩ নং দ্র: সং. ই. বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ, পৃ: ৩৩৬-৩৩৮; ই. ফা.]
১৪. ছুরা তওবা ব্যতীত সকল ছুরার প্রারম্ভে লেখা ‘বিছমিল্লা-হির রাহমা-নির রাহিম’ আয়াতটি অহি নয়; সুতরাং ১১৩ টি আয়াত অযথা ও অতিরিক্ত সংযোগ করা হয়েছে বলে তা হিসেবে ধরাও হয় না।
১৫. ইছলামিক ফাউন্ডেশনসহ সকল কুরআনগ্রন্থে লেখা আছে: ‘বিছমিল্লা-হির রাহমা-নির রাহিম’ পক্ষান্তরে ইউছুফ আলীর লিখিত সংকলনে আছে ‘বিছমে আল্লাহ আররহমান আররাহিম।’ আলিফ-লাম-মিম-এর উপরে তাসদিদসহ দুটি বড় মদ আছে কিন্তু ইউছুফ আলীর লিখিত কুরআনগ্রন্থে তাসদিদ নেই আছে মাত্র দুটি বড় মদ; অনুরূপ উলা-ইকা লিখতে আলিফের উপরে শুধু পেশ পক্ষান্তরে ইউছুফ আলীর সংকলনে আলিফের উপরে হামজা অতঃপর পেশ। অর্থাৎ বিশ্বে দ্বৈত মতের (কুফি ও মাদানী) লেখা ও উচ্চারণ-সংবলিত কুরআনগ্রন্থ প্রচলিত! কথিত হয় যে, ওসমানের সংরক্ষিত কুরআনে এমনকি জের, যবর, পেশ কিছুই নেই।
১৬. ১৪শ বছরের কুরআন সংকলন ৮ম বার সংশোধন করার পরেও ইছলামিক ফাউন্ডেশনের অনূদিত কুরআনে আনকাবুত ছুরার আয়াত সংখ্যা ৬৯-এর স্থলে লেখা আছে ৬৭; ছুরা যুমার-এর ২৩ নং আয়াতে ‘মাশানিয়া’র স্থলে ‘মানানিয়া’ শব্দটি ভুল লেখা আছে।খ. অনুবাদক: আলহাজ্ব তোফাজ্জল হোসেন, চুড়ান্ত নিরীক্ষক মা: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্লা; প্রকাশকাল: ১১ই এপ্রিল, ২০০৬; একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিসার্স লাইব্রেরীর প্রকাশিত ’আল কুরআনুল মজিদ’ গ্রন্থের ৩৪ নং ছুরা সাবা’র ৫৪টি আয়াতের মধ্যে ২৩ নং থেকে শেষের সাড়ে ৩২টি আয়াত নেই; অনুরূপ ৩৫ নং ছুরা ফাতির এর ৪৫টি আয়াতের মধ্যে প্রথম ২০টি আয়াতই নেই। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বাজারের অন্যান্য অনুলিপিগুলি ঠিক থাকলেও আমাদের হস্তগত অনুলিপিতে এই গুরুতর ভুল/ঘাটতি রয়েছে।অতএব প্রচলিত বিভিন্ন অনুবাদ/অনুলিপিগুলি ধারাবাহিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভুল পাওয়া অস্বাভাবিক নয় এবং তাতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই।কিন্তু আশ্চর্য হওয়ার বিষয় হলো এই ’কাগুজে কুরআনগ্রন্থ আল্লাহ সংরক্ষণ করেন’ বলেশরয়িতী বিশ্বাস এক্ষণে মিথ্যা বিভ্রান্তকর বলেই প্রমানিত।
১৭. ‘নাছেক’ ‘মনছুক’ নামে শরিয়তি-মারেফাতি এবং শিয়া-ছুন্নী অসংখ্য তফছিরকারগণ বেশ কিছু আয়াতের ওপর লিখিত প্রমাণাদিসহ আদিকাল থেকে সন্দেহ পোষণ করে আসছেন।ইমাম বাকের বলেন, তিন শতের ওপর কুরআনের বাক্য ‘তাহরীফ’ অর্থাৎ ‘বদল’ করা হয়েছে যা আহলে বাইতের শানে ছিল। এদের মধ্য থেকে ইমাম নেসাই ১৫০টি স্ব-প্রমাণ করেছেন। সিরাতুন্নবি অর্থাৎ নবীর চারিত্রিক গুণরাজি যে সকল বাক্যে উল্লিখিত ছিল তাদের মধ্য থেকে ১১৪টি বাক্য বদল করা হয়েছে। এ সকল বাক্যের অনেকগুলো ইবনে কাছির তার তফসীরে টীকাতে প্রকাশ করেছেন। কী ছিল এবং তার স্থলে কী আছে তা তিনি প্রমাণ করেছেন। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে মাত্র ৩টি উদাহরণ লক্ষণীয়:ক. ছুরা আহযাবের প্রথম বাক্যটি এরূপ ছিল: ইয়া আইয়ুহান নাবি কুল এত্তাকিল্লাহা অলা তুতিইল কাফেরীনা অল মোনাফেকিনা-। অর্থাৎ হে নবী, আপনি (বিশ্বাসীগণকে) বলে দিন আল্লাহকে ভয় করতে এবং কাফের ও মোনাফেকগণকে অনুসরণ না করতে-। বাক্যটিতে ‘কুল’ অর্থাৎ ‘বলে দিন’ কথাটি ফেলে দিয়ে এই ছুরার প্রথম তিনটি বাক্যে উল্লিখিত হেদায়েত নবীর ওপরেই হয়েছিল বলে চাপিয়ে দেয়া হলো। এতে নবীর চরিত্র অত্যন্ত হীন এবং সাধারণ মানব চরিত্রে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এরূপ বহু জায়গায় নবীর নিষ্কলংক চরিত্রের মধ্যে কত যে কলঙ্কের রেখাপাত কুরআনগ্রন্থে তৈরি করে দেয়া হয়েছে তা চিন্তাশীল পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন যদিও প্রতিকার করতে অক্ষম।খ. ছুরা আল এমরানের পাঁচ নম্বর বাক্যটি হল: ইন্নাল্লাহা লা ইয়াখ্ফা আলাইহে শাইউন ফিল্ আরদে অলা ফিছ্চ্ছামায়ে। এটা নিম্নরূপে ছিল বলে উল্লিখিত আছে: ‘ইন্নাল্লাহা (নফ্সা ইল্লা উছয়াহা) লা ইয়াখ্ফা আলাইহে শাইউন ফিল্ আর্দে অলা ফিছচ্ছামায়ে।’ বাক্যটি থেকে ‘নফসা ইল্লা উছয়াহা’ কথাটি বাদ দিয়ে বাক্যটি রাখা হয়েছে।গ. অ ইন্নাহু লা এলমুন লিচ্ছায়াতে ফালা তাম্তারুন্না বেহা অত্তাবেউনী। হাজা সিরাতুম মুস্তাকীম। [৪৩: যুখরুখ-৬১] অর্থ: এবং নিশ্চয় তিনি (ঈছা) হলেন সায়াতের জন্য জ্ঞান, সুতরাং তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ করো না এবং আমাকে অনুসরণ করো। এটাই সিরাতুম মোস্তাকীম।ইবনে মাগাজেনী ফকিয়ে শাফেয়ী মনাক্বেবের মধ্যে জাবের বিন আবদুল্লাহ আনসারী থেকে সনদসহ উল্লেখ করেছেন যে, উক্ত ৬১ নং বাক্যে আসলে এইভাবে নাজেল হয়েছিল: অ ইন্না আলীয়ান লেএলমু লিছ-মুস্তাকীম।
১৮. ৩: এমরান-১৪৪ নং আয়াতের অর্থ: মুহাম্মদ একজন রাছুল ব্যতীত নহেন। নিশ্চয়ই তার পূর্বে বহু রাছুল গত হয়েছেন। যদি তিনি মরে যান অথবা কতল হন; তোমরা কি পশ্চাদপদ হয়ে ফিরে যাবে? ...এই বাক্য কুরআনগ্রন্থের নয় বলে প্রাচীন তফসীরকারগণের লিখিত তফসীর থেকে আজও কোনো কোনো তফসীরকার মন্তব্য প্রকাশ করে আসছেন। [তথ্যসুত্র: ১০, ১১, ১২: তফসীর দুর্বে মনসুর: ২য় খ.পৃ: ১৪০; তফসীর কাশ্শাফ ১ম খ. পৃ: ৩৯০; তফসীর কবির ৩য় খ. পৃ: ২০০ (মিশরীয় প্রকাশনা)। তথ্য: হাদিছ সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ: ১০৮-১১৬; সাদ উল্লাহ্]১৯. ড. রাশাদ খলিফার নাম জানা আছে। তিনি অলৌকিক ‘১৯’ সংখ্যার সাহায্যে কম্পিউটারে কুরআনগ্রন্থের প্রত্যেকটি ছুরা নির্ভুলতা প্রমাণ করতে গিয়ে ছুরা তওবার শেষ দুটি আয়াতের জন্য পূর্ণ নির্ভুলতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাছুল দাবি করতঃ ঐ দুটি আয়াত মানুষের সংযোজন এবং কুরআনে নয় বলে ঘোষনা দেন এবং সর্বমোট আয়াতসংখ্যা ৬৬৬৬ ও ৬২৩৬ এর পরিবর্তে ৬২৩৪টি আয়াত নির্ধারণ করেছেন। [দ্র: কুরআন, দি ফাইনাল টেস্টামেন্ট, অথরাইজ্ড ইংলিশ ভারসান; ড. রাশাদ খলিফা] (চলবে-৩)
কোনো ধর্মগ্রন্থই স্বয়ং আল্লাহ, ফেরেস্তাগণ এমনকি অধিকাংশ নবীগণও নিজ হাতে লিখেননি; লিখেছেন সাধারণ/অসাধারণ মানুষ, আর মানুষ কোনোক্রমেই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কুরআন আল্লাহময় রাছুলের (৩: এমরান- ৭৯) মুখ নিঃসৃত বাণী, নিজ বা অন্যের দ্বারা লিখিত, ভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন লোক দ্বারা পরম্পরায় সংকলিত।খ. সংক্ষিপ্ত ইছলামী বিশ্ব-কোষে বিভিন্ন গ্রন্থের বরাতে লেখা ১. ...রাছুল (সা) তার জীবদ্দশাতেই আল্লাহর আদেশে কুরআনগ্রন্থের সমুদয় আয়াতের বিন্যাস-শৃঙ্খল নিরূপিত করে দিয়েছিলেন এবং স্বয়ং রাছুল (সা) ও বহু ছাহাবী এইভাবে সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থ করেছিলেন...। ২. কোরানের বর্তমান রূপ রাছুল (সা) কর্তৃক নির্দিষ্ট হয়েছিল। - হাদিছ থেকেও জানা যায় যে, রাছুল (সা) প্রত্যেক বছর রামাদান মাসে সমগ্র কুরআনগ্রন্থ অর্থাৎ ঐ সময় পর্যন্ত জিব্রাইল একবার করে এবং তাঁর জীবনের শেষ রমাদানে সমগ্র কুরআনগ্রন্থ জিব্রাইলকে দুই/তিন বার শুনিয়েছিলেন। এ হতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রাছুল (সা)-এর ওফাতের পূর্বেই কুরআন মজিদের ছুরা ও আয়াতগুলোর ক্রম বিন্যাস নির্ধারণ ও নির্দিষ্ট অবস্থায় ছিল এবং যে সকল ছাহাবীর কুরআনগ্রন্থ মুখস্থ ছিল তারাও ঐ ক্রমানুসারে মুখস্থ রেখেছিলেন। ৩. রাছুলের সময়ই আয়াতের সংখ্যা গণনা করা হয়েছিল-হাদিছ হতেও প্রমাণিত হয় যে রাছুলের জীবদ্দশায় কুরআন মজিদের আয়াতের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছিল। ৪. মহানবী কর্তৃক লিখিত কুরআন বিবি হাফসার মারফত প্রাপ্ত হয়ে ওসমান তার আয়াত নম্বরসহ নকল করে আরবের সকল দেশে প্রেরণ করেন যা অদ্যাবধি প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত আছে। [১-৪নং দ্র: সংক্ষিপ্ত ইছলামী বিশ্বকোষ; ১ম খ.৩য় মুদ্রণ; ‘আয়াত’ ও ‘কুরআন’ অধ্যায়; পৃ: ৭০ ও ৩৩৬; ই. ফা.] বেশি দিনের কথা নয়, প্রায় ৫০ বছর পূর্বের অনূদিত ও প্রকাশিত যে কোনো কুরআনগ্রন্থের প্রারম্ভে সুরা, পারা, মনজিল, রুকু, সেজদা ও আয়াত এবং শব্দ, জের, জবর, পেশ, তাসদিদ সংখ্যার হিসাবসহ একটি স্বতন্ত্র তালিকা থাকতো; তাতে আয়াতের সংখ্যা ৬,৬৬৬টি উল্লেখ থাকতো। কিন্তু আধুনিক প্রকাশিত কুরআনে সবই থাকে কিন্তু আয়াতসংখ্যা থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ ইছলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত কুরআনগ্রন্থ অন্যতম। এর কারণ অজ্ঞাত ও রহস্যজনক বটে! বলাবাহুল্য, মোবারক করীম জওহর অনূদিত কুরআনগ্রন্থে আজও ৬,৬৬৬ টি আয়াত লেখা আছে; লেখা আছে আশরাফ আলী থানভীর অনূদিত কুরআনসহ অধিকাংশ গ্রন্থে। কিন্তু কুরআনখানির আয়াত সংখ্যা গণনা করলে পাওয়া যায় মাত্র ৬,২৩৬ টি; অর্থাৎ ৪৩০ টি আয়াত কম! এক্ষণে যে কেউ যে কোনো কুরআনগ্রন্থের আয়াতসংখ্যা গুণে তার সত্যাসত্য পরীক্ষা করতে পারেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এই সাধারণ বা অসাধারণ ভুলটি আজ প্রায় দেড় হাজার বছর যাবৎ কুরআনগ্রন্থ নীরবে বহন করছে! গ. বিশ্বকোষের দ্বিতীয় তথ্য (কুরআনগ্রন্থের মোট আয়াত সংখ্যা )৫. “...আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্বারীগণ কুরআনের আয়াতের সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন: কুফীদের মতে: ৬,২৩৬টি আয়াত; বসরাবাসীদের মতে: ৬,২১৬টি আয়াত; সিরীয়াবাসীদের মতে: ৬,২৫০টি আয়াত; ইছমাইল ইবনে জাফর মদনীর মতে: ৬,২১৪টি আয়াত; মক্কীদের মতে: ৬,২১৮টি আয়াত; বিবি আয়শার মতে: ৬,৬৬৬টি আয়াত”। [দ্র: সং. ই. বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ ‘আয়াত’ অধ্যায়; পৃ: ৭০; ই. ফা.]উদ্বৃত তথ্য দুটি একে অন্যের বিপরীত; অর্থাৎ একটি অপরটিকে মিথ্যা, ভুল তথা কাল্পনিক বলেই সাক্ষ্য দেয়। প্রথমটি যারা বিশ্বাস করবেন, তাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হয় যে, জিব্রাইল কর্তৃক সংশোধিত কুরআনগ্রন্থ আজকের বিশ্বের কেউই অনুসরণ করছে না বা নেই অথবা ধারণাটি ভুল; বরং দল উপ-দল কর্তৃক অনূদিত কুরআনগ্রন্থ সকলেই অনুসরণ করছে; যেমন আজকের ছুন্নী সম্প্রদায় উল্লিখিত কুফি মতের কুরআনগ্রন্থ অনুসরণ করছে; যার আয়াতের সংখ্যা ৬,২৩৬টি। আর দ্বিতীয়টি বিশ্বাস করলে জিব্রাইল কর্তৃক পরীক্ষা ও সংশোধন সম্বন্ধীয় হাদিছগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া বর্ণিত কোন্ মতের কুরআনখানি জিব্রাইল কর্তৃক পরীক্ষীত ও সংশোধিত তা কারো জানা আছে বলে মনে হয় না। আয়শার মতে আয়াতসংখ্যা ৬,৬৬৬ টি।
তার স্ব-পক্ষে একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছেঃ
তৎকালে তুরস্কের শাসনকর্তা আরবের খলিফা নামে রাজা-বাদশাদের শুভ দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কোরানের ৬,৬৬৬ টি আয়াতের প্রমাণ ও প্রতীক স্বরূপ ৬,৬৬৬ টি স্বর্ণের মোমবাতি সংবলিত মহামূল্যবান একটি বাতিদানি তৈরি করেন কাবাঘরে উপহার দেয়ার জন্য। কিন্তু বিধি বাম, হঠাৎ মুছলিম বীর কামাল আতাতুর্কের আগমনে তুর্কী মৌলবাদ লণ্ড-ভণ্ড হওয়ার ফলে সে পরিকল্পনা বাতিল হয়। অতঃপর কামাল পাশা তোপকাপী মিউজিয়ামে ঐ বাতিদানিটি রক্ষণ করেন, যা আজও সেখানে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, ওসমানের লিখিত কোরানও সেখানে রয়েছে। [দ্র: সরাসরি তোপকাপী মিউজিয়াম অথবা এ্যাম্বেসিতে খোঁজ নিতে হবে] পক্ষান্তরে আজকের কুরআনগ্রন্থে লেখা থাকে ৬,৬৬৬ টি আয়াত (বিবি আয়শার মতে), কিন্তু তার সংরক্ষিত কুরআনগ্রন্থ নেই,কারন আজকের কুরআন গ্রন্থে আছে মাত্র ৬,২৩৬ টি (কুফী মত) আয়াত। অতএব বাকি ৪৩০ টি আয়াত কে, কখন এবং কিভাবে গায়েব করলো বা হলো, তা মুছলিমদের একান্তভাবেই ভেবে দেখা জরুরি। কুরআনগ্রন্থের আয়াত সম্বন্ধে উল্লিখিত তথ্য দুটি একে অন্যের বিপরীত তা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। এই বৈপরীত্য ঢেকে নিরীহ জনসাধারণের দৃষ্টি ভ্রম করার জন্য ‘বিশ্বকোষের’ ১৫ জন আলেম-সম্পাদক, যাদের মধ্যে ৫ জন ডক্টরেট, ১ জন অধ্যক্ষ, ২ জন অধ্যাপক ও ১ জন হাফেজও রয়েছেন এবং বাকিগণ সকলেই মনীষী, ইছলামিক চিন্তাবিদ ইত্যাদি; তাদের সম্মিলিত মন্তব্য হল: “আয়াতের আরম্ভ ও শেষ কোথায়, এই সম্বন্ধে মতভেদের কারণে সংখ্যায় এরূপ তারতম্য হয়েছে।” [ দ্র: সং. ই. বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ ‘আয়াত’ অধ্যায় ; পৃ: ৭০; ই. ফা.] প্রকাশ থাকে যে, জিব্রীল (?) কর্তৃক একাধিকবার সংশোধন করার পরও তারতম্য যে হয়েছে তা শরিয়ত এক্ষণে স্বীকার করতে বাধ্য। বিশ্বকোষের তথ্য দুটি পরস্পর বিপরীত আর আলেমদের সম্মিলীত মন্তব্যটি বিপরীত বটে! এমন কিশোরসুলভ মন্তব্য তাদের ধর্মজ্ঞান ও দূরদর্শিতা সম্বন্ধে হতাশা ব্যক্ত করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ উপরোক্ত বিবরণের সঙ্গে মন্তব্যটির কোনো মিল নেই। এদের সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করার দুঃসাহস শোভা পায় না! তবে মরহুম আঁকরাম খাঁর ‘মোস্তফা চরিত’-এর লেখা ছোট্ট একটি ঘটনা মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন যে, জীবনে একবারই মাত্র আলেমদের সঙ্গে ধর্ম-তর্কে হেরে জান; কোনো এক গ্রামে খাঁ সাহেব বাহেজে (ধর্মীয় বিতর্ক সভায়) অবতীর্ণ হন। প্রসঙ্গক্রমে আলেমগণ দাবি করেন যে, আলী রামের রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন; তার প্রমাণ স্বরূপ আলেমগণ একখানি বহু পুরনো মস্ত বড় পুঁথিগ্রন্থ এনে খাঁ সাহেবের সামনে পড়ে শোনান। তাতে লেখা ছিল: ‘আলী আর বীর হনুমান/অযোধ্যায় মহা যুদ্ধ/দোনো পলোয়ান।’ অতঃপর কেউ কাউকে হারাতে পারেনি বলেও তাতে উল্লেখ আছে! কেতাবের এই বয়ান শুনে এবং স্বচক্ষে ঐ মস্তবড় কেতাব দেখে উপস্থিত আলেমগণ সমস্বরে নিজেদের পক্ষে জয় জয় ঘোষণা করেন। [দ্র: মোস্তফা চরিত: আকরাম খাঁ] (চলবে)
পর্ব-২
(পূর্বাপর)
বিশ্বকোষের তৃতীয় তথ্য৬. তফসিরে বায়দবীতে বলা হয়েছে যে, সুরা বাকারাতে ২৮১ টি আয়াত আছে। ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, অধিকাংশের মতে কুরআন মজিদের অবতীর্ণ শেষ আয়াতটি সম্বন্ধে রাছুল বলেন, “এটাকে বাকারার ২৮০তম শেষ আয়াতের পরে সন্নিবেশিত করো।” [সং. ই. বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ; ‘আয়াত’ অধ্যায়; পৃ: ৭০; ই. ফা.]। অতএব ছুরা বাকারার আয়াত সংখ্যা হওয়া উচিত মোট ২৮১টি। অথচ সেখানে আছে মোট ২৮৬টি আয়াত। তদুপরি মহানবীর নির্দেশমতো সেই শেষ আয়াতটি সেখানে সন্নিবেশিত করা হয়নি। আরো প্রকাশ থাকে যে অতিরিক্ত ৫টি আয়াত সুরা বাকারায় কিভাবে! কী করে! এবং কোথা থেকে ঢুকে পড়লো, কেন পড়লো এই ঐতিহাসিক প্রশ্নটি আজও অজানা রয়েছে।
৭. হযরত উবিয়্যার (রা) প্রতিলিপিতে ২টি সুরা অতিরিক্ত ছিল।
৮. ইবনে মাসুউদ (রা) এর প্রতিলিপিতে সুরা নং ১১৩ ও ১১৪ বিদ্যমান ছিল না।
৯. শিয়াদের মতে আলী (রা) ও তার বংশের (নবী বংশের) শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধীয় আয়াতসমূহ এমনকি সুরাসমূহ কুরআনগ্রন্থ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, যথা : ক. সুরা আল-নুরায়ন ও খ. সুরা ওয়ালায়া।
১০. ওসমান কুরআনের যে প্রতিলিপি প্রস্তুত করেছিলেন-- ঐ লিখন পদ্ধতি এখনও প্রচলিত রয়েছে। কুরআনের ঐ প্রতিলিপিতে নুকতা: ও স্বর চিহ্ন ছিল না, ফলে অনআরবদের পক্ষে ঐ কুরআনগ্রন্থ শুদ্ধভাবে পাঠ করা কঠিন ছিল।[পরবর্তীতে নোক্তা ও কারক বিভক্তি সংযোজন করা আল্লাহ-রাছুল, জিব্রাইল তথা খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের ইচ্ছা ও কাজের ওপর সাধারণ মানুষের অনধিকার হস্তক্ষেপ। কুরআনগ্রন্থের নোক্তা, কারক বিভক্তি সংযোজন করা হয় খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের প্রায় ১৪০ থেকে ৩৫০ বছর পরে]
১১. কুরআনের প্রামাণ্য পাঠ সুনির্ধারিত রাখার জন্য উমাইয়া যুগে আরবি বর্ণমালার সমরূপী বর্ণসমূহের বিভিন্নতা সূচক নুক্তা: চিহ্ন (বিন্দু) প্রযুক্ত হয়। এতদ্ব্যতীত স্বরচিহ্নসমূহ ও তানভীন স্ত্রীলিঙ্গসূচক অন্ত্য গোল ‘তা’, আলিফের ব্যঞ্জন বর্ণসমূহের দ্বিত্ববোধক চিহ্ন (তাসদিদ) ও প্রচলিত হয়--।
১২. - পাঠ বিচারের এই মান অনুযায়ী সপ্তকারীর পাঠ ইছলামী সমাজে প্রচলিত ছিল। বর্তমান কালে এদের দুজনের পাঠ মাত্র প্রচলিত আছে-। মিশর ব্যতীত আফ্রিকার সর্বত্র নাফি’র পাঠ এবং মিশরে ও পৃথিবীর বাকি অংশে হাফাসে’র পাঠ প্রচলিত।
১৩. স্বর চিহ্নসমূহ প্রথমে বর্ণের বিভিন্ন স্থানে নুক্তারূপে লিখিত হতো। অষ্টম শতাব্দির মধ্যভাগে এই ব্যবস্থা পরিবর্তীত করে ‘আলিফ’, ‘ওয়াও’, এবং ‘য়্যা’-এর অনুকরণে বর্তমানে ব্যবহৃত যবর, পেশ ও যের প্রবর্তিত হয়। কেউ কেউ কুরআনের লিপিতে এগুলোর ব্যবহার সঙ্গত মনে করেননি। [৭-১৩ নং দ্র: সং. ই. বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ, পৃ: ৩৩৬-৩৩৮; ই. ফা.]
১৪. ছুরা তওবা ব্যতীত সকল ছুরার প্রারম্ভে লেখা ‘বিছমিল্লা-হির রাহমা-নির রাহিম’ আয়াতটি অহি নয়; সুতরাং ১১৩ টি আয়াত অযথা ও অতিরিক্ত সংযোগ করা হয়েছে বলে তা হিসেবে ধরাও হয় না।
১৫. ইছলামিক ফাউন্ডেশনসহ সকল কুরআনগ্রন্থে লেখা আছে: ‘বিছমিল্লা-হির রাহমা-নির রাহিম’ পক্ষান্তরে ইউছুফ আলীর লিখিত সংকলনে আছে ‘বিছমে আল্লাহ আররহমান আররাহিম।’ আলিফ-লাম-মিম-এর উপরে তাসদিদসহ দুটি বড় মদ আছে কিন্তু ইউছুফ আলীর লিখিত কুরআনগ্রন্থে তাসদিদ নেই আছে মাত্র দুটি বড় মদ; অনুরূপ উলা-ইকা লিখতে আলিফের উপরে শুধু পেশ পক্ষান্তরে ইউছুফ আলীর সংকলনে আলিফের উপরে হামজা অতঃপর পেশ। অর্থাৎ বিশ্বে দ্বৈত মতের (কুফি ও মাদানী) লেখা ও উচ্চারণ-সংবলিত কুরআনগ্রন্থ প্রচলিত! কথিত হয় যে, ওসমানের সংরক্ষিত কুরআনে এমনকি জের, যবর, পেশ কিছুই নেই।
১৬. ১৪শ বছরের কুরআন সংকলন ৮ম বার সংশোধন করার পরেও ইছলামিক ফাউন্ডেশনের অনূদিত কুরআনে আনকাবুত ছুরার আয়াত সংখ্যা ৬৯-এর স্থলে লেখা আছে ৬৭; ছুরা যুমার-এর ২৩ নং আয়াতে ‘মাশানিয়া’র স্থলে ‘মানানিয়া’ শব্দটি ভুল লেখা আছে।খ. অনুবাদক: আলহাজ্ব তোফাজ্জল হোসেন, চুড়ান্ত নিরীক্ষক মা: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্লা; প্রকাশকাল: ১১ই এপ্রিল, ২০০৬; একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিসার্স লাইব্রেরীর প্রকাশিত ’আল কুরআনুল মজিদ’ গ্রন্থের ৩৪ নং ছুরা সাবা’র ৫৪টি আয়াতের মধ্যে ২৩ নং থেকে শেষের সাড়ে ৩২টি আয়াত নেই; অনুরূপ ৩৫ নং ছুরা ফাতির এর ৪৫টি আয়াতের মধ্যে প্রথম ২০টি আয়াতই নেই। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বাজারের অন্যান্য অনুলিপিগুলি ঠিক থাকলেও আমাদের হস্তগত অনুলিপিতে এই গুরুতর ভুল/ঘাটতি রয়েছে।অতএব প্রচলিত বিভিন্ন অনুবাদ/অনুলিপিগুলি ধারাবাহিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভুল পাওয়া অস্বাভাবিক নয় এবং তাতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই।কিন্তু আশ্চর্য হওয়ার বিষয় হলো এই ’কাগুজে কুরআনগ্রন্থ আল্লাহ সংরক্ষণ করেন’ বলেশরয়িতী বিশ্বাস এক্ষণে মিথ্যা বিভ্রান্তকর বলেই প্রমানিত।
১৭. ‘নাছেক’ ‘মনছুক’ নামে শরিয়তি-মারেফাতি এবং শিয়া-ছুন্নী অসংখ্য তফছিরকারগণ বেশ কিছু আয়াতের ওপর লিখিত প্রমাণাদিসহ আদিকাল থেকে সন্দেহ পোষণ করে আসছেন।ইমাম বাকের বলেন, তিন শতের ওপর কুরআনের বাক্য ‘তাহরীফ’ অর্থাৎ ‘বদল’ করা হয়েছে যা আহলে বাইতের শানে ছিল। এদের মধ্য থেকে ইমাম নেসাই ১৫০টি স্ব-প্রমাণ করেছেন। সিরাতুন্নবি অর্থাৎ নবীর চারিত্রিক গুণরাজি যে সকল বাক্যে উল্লিখিত ছিল তাদের মধ্য থেকে ১১৪টি বাক্য বদল করা হয়েছে। এ সকল বাক্যের অনেকগুলো ইবনে কাছির তার তফসীরে টীকাতে প্রকাশ করেছেন। কী ছিল এবং তার স্থলে কী আছে তা তিনি প্রমাণ করেছেন। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে মাত্র ৩টি উদাহরণ লক্ষণীয়:ক. ছুরা আহযাবের প্রথম বাক্যটি এরূপ ছিল: ইয়া আইয়ুহান নাবি কুল এত্তাকিল্লাহা অলা তুতিইল কাফেরীনা অল মোনাফেকিনা-। অর্থাৎ হে নবী, আপনি (বিশ্বাসীগণকে) বলে দিন আল্লাহকে ভয় করতে এবং কাফের ও মোনাফেকগণকে অনুসরণ না করতে-। বাক্যটিতে ‘কুল’ অর্থাৎ ‘বলে দিন’ কথাটি ফেলে দিয়ে এই ছুরার প্রথম তিনটি বাক্যে উল্লিখিত হেদায়েত নবীর ওপরেই হয়েছিল বলে চাপিয়ে দেয়া হলো। এতে নবীর চরিত্র অত্যন্ত হীন এবং সাধারণ মানব চরিত্রে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এরূপ বহু জায়গায় নবীর নিষ্কলংক চরিত্রের মধ্যে কত যে কলঙ্কের রেখাপাত কুরআনগ্রন্থে তৈরি করে দেয়া হয়েছে তা চিন্তাশীল পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন যদিও প্রতিকার করতে অক্ষম।খ. ছুরা আল এমরানের পাঁচ নম্বর বাক্যটি হল: ইন্নাল্লাহা লা ইয়াখ্ফা আলাইহে শাইউন ফিল্ আরদে অলা ফিছ্চ্ছামায়ে। এটা নিম্নরূপে ছিল বলে উল্লিখিত আছে: ‘ইন্নাল্লাহা (নফ্সা ইল্লা উছয়াহা) লা ইয়াখ্ফা আলাইহে শাইউন ফিল্ আর্দে অলা ফিছচ্ছামায়ে।’ বাক্যটি থেকে ‘নফসা ইল্লা উছয়াহা’ কথাটি বাদ দিয়ে বাক্যটি রাখা হয়েছে।গ. অ ইন্নাহু লা এলমুন লিচ্ছায়াতে ফালা তাম্তারুন্না বেহা অত্তাবেউনী। হাজা সিরাতুম মুস্তাকীম। [৪৩: যুখরুখ-৬১] অর্থ: এবং নিশ্চয় তিনি (ঈছা) হলেন সায়াতের জন্য জ্ঞান, সুতরাং তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ করো না এবং আমাকে অনুসরণ করো। এটাই সিরাতুম মোস্তাকীম।ইবনে মাগাজেনী ফকিয়ে শাফেয়ী মনাক্বেবের মধ্যে জাবের বিন আবদুল্লাহ আনসারী থেকে সনদসহ উল্লেখ করেছেন যে, উক্ত ৬১ নং বাক্যে আসলে এইভাবে নাজেল হয়েছিল: অ ইন্না আলীয়ান লেএলমু লিছ-মুস্তাকীম।
১৮. ৩: এমরান-১৪৪ নং আয়াতের অর্থ: মুহাম্মদ একজন রাছুল ব্যতীত নহেন। নিশ্চয়ই তার পূর্বে বহু রাছুল গত হয়েছেন। যদি তিনি মরে যান অথবা কতল হন; তোমরা কি পশ্চাদপদ হয়ে ফিরে যাবে? ...এই বাক্য কুরআনগ্রন্থের নয় বলে প্রাচীন তফসীরকারগণের লিখিত তফসীর থেকে আজও কোনো কোনো তফসীরকার মন্তব্য প্রকাশ করে আসছেন। [তথ্যসুত্র: ১০, ১১, ১২: তফসীর দুর্বে মনসুর: ২য় খ.পৃ: ১৪০; তফসীর কাশ্শাফ ১ম খ. পৃ: ৩৯০; তফসীর কবির ৩য় খ. পৃ: ২০০ (মিশরীয় প্রকাশনা)। তথ্য: হাদিছ সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ: ১০৮-১১৬; সাদ উল্লাহ্]১৯. ড. রাশাদ খলিফার নাম জানা আছে। তিনি অলৌকিক ‘১৯’ সংখ্যার সাহায্যে কম্পিউটারে কুরআনগ্রন্থের প্রত্যেকটি ছুরা নির্ভুলতা প্রমাণ করতে গিয়ে ছুরা তওবার শেষ দুটি আয়াতের জন্য পূর্ণ নির্ভুলতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাছুল দাবি করতঃ ঐ দুটি আয়াত মানুষের সংযোজন এবং কুরআনে নয় বলে ঘোষনা দেন এবং সর্বমোট আয়াতসংখ্যা ৬৬৬৬ ও ৬২৩৬ এর পরিবর্তে ৬২৩৪টি আয়াত নির্ধারণ করেছেন। [দ্র: কুরআন, দি ফাইনাল টেস্টামেন্ট, অথরাইজ্ড ইংলিশ ভারসান; ড. রাশাদ খলিফা] (চলবে-৩)