“ঐখানে সে থাকতো বসে, হাওয়ায় উড়তো
চুলের গুচ্ছ ঐ উঠোনের মাটির কোণে থাকতো বসে
অন্যমনে এবং গোপন কোন কথাটির বক্র পুচ্ছ
ধ’রে, যখন যেমন হাসি, তেমন কান্না।
ঐ বয়সে আমরা ওকে পাগল বলতে
শিখেছিলাম
এখন ওকে মনে পড়ায় কলসের জল আপনি
গড়ায় বুকের ভিতর যে-পথগুলি চেতন-রুক্ষ
লাগুক তাতে বৃষ্টি-ভরা কিশোর-দুঃখ।
(কিশোর-দুঃখ)
এই কবিতা বিখ্যাত, এই কবিতা আমাদের
অনেকের মুখস্থ। কী আছে কবিতাটির
ভেতরে, যা আমাদের ভালো লাগায়?
ছন্দদোলা, শব্দের মায়া মমতা, যাদু।
অমোঘ, লক্ষ্যভেদকারী সব ছবি। পাগল।
আমরা তো আদর করেও বলি লোককে,
ছেলেদের, মেয়েদের, নিজেদের
সন্তানসমদের, আহা, পাগল!
সেভাবেই এ-শব্দ আমরা ধরি,
নস্টালজিয়ায়। কেননা কিশোর-দুঃখ
কথাটিও আছে তার পরে। কিন্তু শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের লেখালেখির সঙ্গে এই
পাগল শব্দটার একটা কোনো যোগ আছে যা
এই আপাত চটুল, অতি তরলমতি পাঠক কুলের
কাছে প্রতিভাত নয়। প্রতিভাত হতে গেলে
সেই অন্তর্বয়ন পরিষ্কার হওয়া দরকার,
জীবনানন্দ যাকে বলেছিলেন সুড়ঙ্গলালিত
সম্পর্ক।
পড়া যাক এই লেখাটি, শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যসংগ্রহের “গদ্যের
গার্হস্থ্য” থেকে।
“তা হোক, তবু চাকরি চাকরিই। চলে
যাচ্ছিলো। কোম্পানির ক্যান্টিনে চার
দফার লাঞ্চ। ভোর সাতটায় বাড়ি থেকে
বেরুই, রাত নটা নাগাদ আপিস থেকে ছুটি।
তারপর ডাইনে-বাঁয়ে করে রাতদুপুরে বাড়ি।
উল্টোডাঙার কাঠের টলমলে ব্রিজ। নিচে
কালো পাথরের মতন জলরেখা। কাঠের
ব্রিজ জুড়ে কোনো কোনো দিন পাগল গোল
চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার
ভালো লাগে। ঐ লোকটার তেমন কোনো
কাজ নেই। গাড়ি তৈরি নেই। আলস্য আছে।
"ওর আলস্য আমায় ধীরে ধীরে আক্রমণ করে।
আমি কয়েক দিনের মধ্যেই ওর পাশে গিয়ে
দাঁড়াই। চাঁদ দেখি। ওর মুখের দিকে
তাকাই। ও কোনোদিন ভুলেও আমার দিকে
তাকায় না। এক সময় মনে হতে থাকে, ওকে
যেন কোথায় দেখেছি। মুখটি খুবই চেনা
লাগছে। কোথায় দেখেছি, মনে করতে
পারছি না ঠিক। একটা দারুণ, অনিবার্য
অস্বস্তি নিয়ে ঘরে ফেরা।
"এরপর যতবার ওকে দেখেছি ওর পাশে গিয়ে
দাঁড়িয়েছি। ও চাঁদের দিকে পলকহীন
তাকিয়ে। হয়তো জানেই না আমি ওর কাছে
দাঁড়াই। ওকে চিনতে চেষ্টা করি
প্রতিদিন। শুধু কথা বলতে ভরসা পাইনা।
যদি ওর ধ্যান ভাঙে। যদি ও রাগারাগি
করে। কিংবা কামড়ে দেয়। তাহলে তো
মেঘ না ডাকলে ছাড়বে না।
"এরপর, অনেক অনেকদিন বাদে টের
পেয়েছি, ঐ শিয়রচাঁদা লোকটা আমারই
যমজ। ওর সঙ্গে আমার মুখোমুখি হবার নয়।
কোথাও গিয়ে হয়তো শুনি, আরে ও তো একটু
আগেই এখানে ছিলো। খোঁজো তো, গেলো
কোথায়? আমি জানি, ও পালিয়েছে। ওর
সঙ্গে আমার মুখোমুখি হবার নয়। কখনো
হয়নি, হয়তো হবেও না কোনোদিন। দুজনের
দুরকমের কাজ। দুজন দুরকমভাবে করবো।"
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চাঁদ আর পাগলকে
চিনে নিতে পারি আমরা। চন্দ্রাহত
কবিতা লিখবেন শক্তির পরের প্রজন্মের
কবি। শক্তি বলেছিলেন অনন্ত কুয়োর জলে
চাঁদ পড়ে আছে। কেন বলেছিলেন ওপরের ঐ
গদ্য থেকে বুঝতে পারি যেন একটু একটু।
কবিতার কাজ আড়ালে থাকা, লুকিয়ে
থাকা কথাগুলোকে বার করে আনা। অথবা,
আরো খটমট করে বললে, কবিতা গোপনকে
উন্মুক্ত করে, ছেৎরে খুলে দেয় ভেতরের
অন্ধকার, পাপ, অন্যায় ও নিজস্ব অন্ধতা।
কবিতা বোমার মতো বিস্ফোরক।
এক ২০০০-পরবর্তী কবির ভাষায়ঃ
“আমার কবিতা যেন বিস্ফোরকভর্তি
স্যুটকেস/ দেখতে নিরীহ, আর ভেতরে অনন্ত
আর ডি এক্স/ বারবার রেখে আসি ভিড়
বাসে, মন্দিরে, হাওড়া স্টেশনে.../কিন্তু
শালা কিছুতেই ফাটে না কেন যে.../ কে
জানে” (অভিষেক ভট্টাচার্য)
এই অভিপ্রায় কবির। সমাজ তাকে যা যা
শেখায়, সবটাকে সে উলটে দিতে চায়, সে
উল্টোমুখে চলতে চায়, অভিকর্ষণের নিয়ম
না মেনে সিলিং এ গিয়ে উঠতে চায়
ভেসে, সে নিয়মকানুন ভাঙে, আর যা যা
শান্তশীলতার শিক্ষা তাকে দেওয়া
হয়েছিল সেগুলো হাট করে খুলে দিয়ে অসভ্য
হতে চায় খুব।
কেননা কবি স্বাধীন। স্ব ইচ্ছা সম্পন্ন।
কবি আসলে নিজের মতো থাকতে
চেয়েছিল। সমাজ তাকে থাকতে দেয়নি,
দেয়না, তাই সে কবিতা লেখে। কবি আসলে
নিজের ঘরে থাকতে চেয়েছিল। তার ঘর
ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সেই ঘর জ্বালিয়ে
দিয়েছে সমাজের বিধিনিষেধ। তাই সে
বেঘর, সে চির ট্র্যাম্প, সে
ভবঘুরে...বেগানা, দূরচারী।
যেকোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি,
লিখেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। পরে,
ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, যে-কোন
লাইন থেকেই একটা কবিতা শুরু হতে পারে,
আর যে-কোন লাইনেই শেষ হয়ে যেতে
পারে সেই কবিতা। কবিতা হবে আপাত
সরল। হাজারমুখো। বিষয়ের কোন
বাছবিচার থাকবে না। আর কবিতার একটা
লাইন থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব হবে
কয়েকশ কিলোমিটারের। কিন্তু অদৃশ্য একটা
তলদেশে থাকবে মিলিমিটারের নিবিড়
সম্পর্ক।
মনে করে দেখব, মধ্যযুগের শেষে, আধুনিক
সময়ের শুরুতে যখনই নতুন করে সমাজ
পরিষ্করণ, শোধন আর মূল্যবোধের ইনস্টলেশন,
তখন থেকেই সমাজের মূল স্রোত থেকে
বিবর্জিত, প্রান্তবাসী হয়ে গেলেন কিছু
বেশ্যা, কুষ্ঠরোগী, ভিখিরি আর ভবঘুরে
মানুষ। তৈরি হল এই সব স্টিরিওটাইপ। এইসব
মিথ। সমাজ থেকে বর্জিত তারা, বার বার
নিয়ন্ত্রিত, শাসিত, সুসভ্য সমাজ এদের
সন্দেহ করেছে, উনবিংশ থেকে বিংশ শতক
অব্দি লক্ষ লক্ষ রোমানি বা রোমা
উপজাতীয়, মূলত যাযাবর, জিপসিরা খুন হয়ে
চলেছিলেন, সমাজকে পাপ আর দুষ্টতা
থেকে পরিষ্করণের মহতী উদ্যোগে। আজও,
ফ্রান্সের ডকুমেন্টারিতে পড়ি, কীভাবে
রাষ্ট্র ক্ষমতা বেছে বেছে রোমাদের
চিহ্নিত করে, বেশ্যাবৃত্তি আর বেআইনি
কাজে লিপ্ত বলে দোষারোপ করে চালান
করে দেয় হয় কারাগারে নয়ত সীমান্তের
বাইরে। আজও, আমেরিকার পার্কগুলো যতই
সুসজ্জিত হোক, কোণে কোনও একটা
বেঞ্চির ওপরে প্লাস্টিক স্টাফ করা
ওভারকোটে, অনেক প্লাস্টিকের
শিশিবোতল আর থলি পুঁটলি নিয়ে, একজন
না একজন গৃহহীনকে পাবই আমরা, কেননা
কর্মহীনতা, বাড়ি ভাড়া দিতে না পারা,
অসুস্থতা অথবা নিছকই তীব্র গতিশীল
প্রতিযোগিতামূলক সমাজে টিঁকে থাকতে
না পেরে ইঁদুর দৌড় থেকে ছিটকে পড়া
বলেই সেই ব্যক্তির মাথার ওপর খর শীতেও
ছাত নেই, খাদ্য জোটে কি জোটেনা,
রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত লঙ্গরখানায়। আজও, শুনি,
আমেরিকায় এক গবেষিকার অধ্যয়নের বিষয়
গৃহহীন মানুষের জীবনযাপন, তাঁদের সঙ্গে
সঙ্গে চলতে থাকা গান, কথামালা,
লোকসাহিত্য, ভাষা। যা প্রায় হারিয়ে
যেতে বসেছে... এই হারিয়ে যাওয়া
মানুষগুলির সঙ্গে সঙ্গে। সমাজে যে-সব
মানুষ গুনতির বাইরে, যাদের ইতিহাস নেই,
কীর্তি নেই, অতুল ক্ষমতার সাক্ষর নেই,
যারা আজ এক স্টেট তো কাল অন্য
হাইওয়েতে, নিয়ত বড় বড় ট্রাকে বা
ট্রেলারে করে ভ্রাম্যমান।
সাকিনহীন, ভিটেমাটি ছিন্ন, উদ্বাস্তু
মানুষের সংখ্যা, আজও, এই পৃথিবীতে নানা
দেশের নানা জাতির ভেতরে কিছু কম নয়।
সুতরাং শক্তির বিখ্যাত প্রশ্ন, “যেতে
পারি, কিন্তু কেন যাবো” আর তার
বিপরীতে দাঁড়ানো, “ছেড়ে দিলেই পারি/
এই যে বাগান, ফুলের বাগান – বকনো সরা
হাঁড়ি/ ছেড়ে দিলেই পারি”( সহজ) দুটিকেই
মেলাতে পারবেন পাঠক।
এরই সঙ্গে, পারবেন মেলাতে, স্মৃতি-চারী
গদ্যটিতে, চাইবাসা, উত্তর বাংলা এসবের
দীর্ঘ বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে, “ওই শৈল শিখর
থেকে নেমেছি শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি।
সেখান থেকে দৌড়ে গেছি ভূটান। পূর্ব
ভূটানে তিতি নদীর পাশে “ক্যাম্প আমি
ফেলিয়াছি”। ... প্রায় কোনও জনপদই বাদ
পড়েনি। তবু এক অহরহ টান লেগেই আছে।
সময়-সুযোগ করতে পারলেই ভোঁদৌড়।"
বিখ্যাত সব গল্প জানি আমরা। এই সব
ভ্রমণের মুখে মুখে ফেরা সচিত্র
কাহিনিগুলি জানি। তুমুল বিখ্যাত, তুমুল
জনপ্রিয় ভবঘুরে-পনার সেই সব কাহিনি,
জ্যান্ত কিংবদন্তী হয়ে থাকা শক্তি
চাটুজ্জের।
কিন্তু জেনে আমাদের কী লাভ হল?
কবিতার ভেতর অব্দি আমরা কি চারিয়ে
দিতে পারলাম সেই জন্ম ভবঘুরেপনাকে?
আমাদের ভবঘুরে না হয়ে ভবঘুরে ভাণকে শুধু
পোক্ত করতে চাইলাম হয়ত বা।
এই ভবঘুরেপনা কি তবে অন্তর্গত রক্তের
ভেতর খেলা করা এক ঔদাসীন্য, এই পাগল
কি তবে জেনেটিক কোডিং-ভুক্ত এক
পাগলামির বীজ, যা শক্তি, মানুষ-শক্তি,
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন?
না কি এ বীজাকারে মন্ত্রোপম এসেছিল
তাঁর ভেতরে, অন্য কোনো সূত্রে?
আমরা শক্তির ঐ গদ্যেই পাচ্ছি “আঠারো
বছর বয়সী মহাকবির” কথা। পঞ্চাশের বহু
কবিই যে কবির মধ্যে দিয়ে কাব্যভাবনার
সবকটা দীপ জ্বালিয়ে নিয়েছিলেন। সেই
কবি আজন্ম ভবঘুরে ছাড়া আর কীই বা!
“কবি হবেন দ্রষ্টা, নিজেকে তিনি
বানাবেন দ্রষ্টা। নিজেকে তিনি দ্রষ্টা
বানাবেন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের এক দীর্ঘ
বিশাল আর সচেতন ভ্রষ্টতার ভেতর দিয়ে।
সব রকমের প্রেম, কষ্ট এবং উন্মাদনার মধ্য
দিয়ে। কবি নিজেকে খোঁজেন। নিজের
ভেতরের সব বিষকে তিনি খরচ করে ফেলেন,
রেখে দেন শুধু তাদের নির্যাস। অকথ্য
অত্যাচার করেন নিজের ওপর, যেখানে তার
সমস্ত বিশ্বাস প্রয়োজন, সমস্ত অমানুষিক
ক্ষমতা, যেখানে তাকে হয়ে উঠতে হয় সমস্ত
মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় রোগী, বিশাল
অপরাধী এবং অভিশপ্ত একজন। আর, বিশাল
পণ্ডিত। কেননা, তিনি পৌঁছতে পারেন
অজানায়।“ (আর্তুর র্যাঁবো, চিঠি)
লিখেছিলেন র্যাঁবো, তাঁর শিক্ষক
ইজামবারকেও, আর একটি বিখ্যাত চিঠিতে,
‘আমি হলাম অন্য কেউ। কী দুরবস্থা সেই
কাঠের টুকরোর, যে হঠাৎ দেখে, সে হয়ে
উঠেছে বেহালা।'
নিজেকে অন্য কেউ করে তোলাটাই একজন
মানুষের কবি হয়ে ওঠা। এ বাংলায় ত্রিশ
দশকে ও তার পরবর্তী প্রতিটি দশকেই,
নিজেকে দ্রষ্টা তৈরি করতে কবিদের যে
পরিশীলন, যে আত্মঘাত, যে দীর্ঘ পরিশ্রম,
যা আমাদের দিয়েছে এক সারণী, অসংখ্য
কবির। যদি বুদ্ধদেব বসু বা জীবনানন্দ
দাশকে আমরা এই মহান দানবীয়তার সঙ্গে
মিলিয়ে দেখতে পারি, তাহলে পরবর্তী,
পঞ্চাশের শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেও পারব।
আর শক্তির ভেতরে এই দুর্মদ “কবি” হয়ে
ওঠার ইচ্ছা, নিজের ভেতরের কাঠের
টুকরোকে বেহালা করে সুরে সুরে
বাজানোর ইচ্ছাকে আমরা বুঝতে পারব। এ
অবশ্যই নিন্দার্থে বলা কথা “আরোপিত”
নয়, কিন্তু এই কবিত্ব নয় ধাতুগত, বরঞ্চ
অবিরত চর্চায় হয়ে ওঠার এক প্রক্রিয়া।
আর সেই হয়ে ওঠা যত না শব্দ দিয়ে, তার
চেয়েও বেশি জীবন দিয়ে।
র্যাঁবো-র ইল্যুমিনেশন্স এর কথা মনে করে
দেখুন। বার বার কীভাবে ভাষার শরীরকে
তছনছ করছেন তিনি। বার বার
বোদলেয়ারের অনুগামী হয়েও, ফ্ল্যর দু মাল
বা ক্লেদজ কুসুমের ভাষাভঙ্গির
রোম্যান্টিকতাকে ভাঙছেন, ব্যকরণ
ভাঙছেন, ইচ্ছাকৃত দানবীয়তায় যেন রাশি
রাশি ছন্দ-মাত্রা-গঠনগত সামঞ্জস্যকে
ভেঙে দিচ্ছেন। ষোল বা সতেরো বছর বয়সে
তিনি যাবতীয় রোমান্টিক কবিতার, তাঁর
আগে লেখা হয়ে যাওয়া রোমান্টিক
কবিতার প্যারডি লিখছেন। বোদলেয়ারের
শিল্পভাবনার সারবস্তু তুলে আনছেন, যা
কালো অন্ধকার আর বিপুল পাপের গল্প
বলতে চেয়েছিল সমসাময়িক ভাষাভঙ্গিকে
নস্যাৎ না করেই। র্যাঁবো কিন্তু ভেঙে
দিচ্ছেন সেই ভাষাভঙ্গিই। অনেক ভেতর
অব্দি গুঁড়ি মেরে গিয়ে বোমার মত
ফাটিয়ে দিতে চাইছেন, কবিতার মূল
এডিফিস, মূল মন্দিরটির ভিত।
“যথেষ্ট দেখা গেল। দৃশ্যের সাক্ষাত ঘটেছে
সকল বায়ুস্তরে।
যথেষ্ট পাওয়া গেল। নগরের গুঞ্জন সন্ধ্যায়,
রৌদ্রে, সর্বক্ষণ
যথেষ্ট জানা গেল, জীবনের সব বাধা –
আহা গুঞ্জন আর দৃশ্য !
নতুন স্নেহ আর নতুন কলরোলে
যাত্রা।" (যাত্রা, অনুবাদ অরুণ মিত্র)
আমরা জানছি, র্যাঁবোকে নিয়ে পঞ্চাশের
কবিদের তুমুল উন্মাদনার কথাও। অন্য নানা
লেখা থেকেই। র্যাঁবো নামক সেই ভবঘুরের
জীবনকথা কিংবদন্তীর পর্যায়ে । যে
র্যাঁবো লেখা ছেড়ে দিয়ে উনিশবছর বয়সে
পাড়ি দেন মহাসমুদ্রে, আফ্রিকার
কলোনিতে, চামড়া মধু কাঠ আর দাস
কেনাবেচার জন্য।
শক্তিও কি এমন ভাবেই নিজের জীবনকে
করে তুলতে চাননি কিংবদন্তীর মতো? তাঁর
নেশা, তাঁর কবিতা ও গদ্য লেখা এবং
হারিয়ে ফেলার পৌনঃপুনিকতা,
অগোছালো জীবনের বিখ্যাত অভ্যাসগুলি,
কখনো বা কুখ্যাতও, সব দিয়ে? বাংলার
সংস্কৃতির গালগল্পে আগামী বহু বছর ধরেই
যা অবশ্যউল্লেখ্য। পা থেকে মাথা পর্যন্ত
টলমল করা, ফুটপাত বদল হওয়া মধ্যরাতে।
কলকাতা চমকানো। যারা কবিতাকে
ভদ্রলোকের ড্রয়িংরুম থেকে প্রথম
নামিয়ে আনবেন খালাসিটোলার মদের
আড্ডায়।
আবার বলি, আরোপিত নয়, সে-অর্থে যে-
অর্থে নকল। কিন্তু সচেতন। কেননা সেই
কাঠের টুকরো থেকে বেহালা হয়ে ওঠার
প্রয়োজনীয়তা।
পঞ্চাশ দশকের কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিদের
সম্মিলিত অ্যাজেন্ডার কথাও ভুললে চলবে
না। এই স্বীকারোক্তির কৃত্তিবাসীরা,
মূলত সুনীল শক্তি সমরেন্দ্র তারাপদ
শরৎকুমার এবং দীপক মজুমদারদের কাছে
ভ্রমণ-নেশা-যৌনতার এক্সপেরিমেন্টেশন
জীবনযাপনের সবরকমের অভিজ্ঞতার
সংশ্লেষণ থেকে কবিতায় পৌঁছনোর আর্তি,
একটা রূপ পায় অ্যালেন গিনসবার্গদের
সাহচর্যে। এই তীক্ষ্ণ সূচিমুখ অ্যাজেন্ডাটি
তৈরি হতে থাকে। লিখিত, ডকুমেন্টেড
হতে থাকে।
রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, ব্যক্তিগত সব
স্তরকে ছুঁয়ে গেছে স্বীকারোক্তি।
অবধারিতভাবে এসে পড়েছে যৌন
স্বীকারোক্তি। এসেছে নেশার নানা রূপ,
মদ্যপান এবং অথবা মাদকসেবন।
সচেতনভাবে। সচেতন, কেননা, কলকাতায়
এসে গেছেন গিনসবার্গ। কৃত্তিবাসের ষোল
নম্বর সংকলন সম্বন্ধে শরৎকুমার
মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ষোল নম্বর
সংকলনে কৃত্তিবাস ফেটে বেরুল। তারিখ
১৩৬৯ চৈত্র। ...কবিত্বের খোলস ছেড়ে একদল
অতৃপ্ত যুবকের অকস্মাৎ বেরিয়ে পড়ার জন্যে
যে প্রচণ্ড অস্বস্তি ও বেগ-এর প্রয়োজন
ছিল। অ্যালেনদের সাহচর্য তা জুগিয়েছিল
আমাদের।' সংখ্যাটি কলকাতা পুলিশের
দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অশ্লীলতা
সম্পর্কে। ...ঘামে নুন, যোনিদেশে চুল (পৃঃ
৫), দেখেছি সঙ্গম ঢের সোজা, এমনকি
বেশ্যারও হৃদয়ে পথ আছে (পৃঃ ২২), যোনির
ঝিনুকে রাখা পোকাগুলি মুক্তা হয়ে
গিয়েছে বিস্ময়ে (পৃঃ ৪৫)...আসলে যে
কাণ্ড ঘটেছিল সব কবিদের বুকের মধ্যে তা
হল প্রচণ্ড বিরক্তি থেকে উদ্ভুত ধ্বংস করার
ইচ্ছে – সৃষ্টির নামান্তর – যা কিছু পুরনো
পচা, ভালমন্দ সোনারুপোর খনি, এমনকি
নিজেদের শরীর ও অস্তিত্ব – সর্বস্বের
সর্বনাশ“ (শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ,
কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কৃত্তিবাস
পঞ্চবিংশ সংকলন, ১৯৬৮)।
'আমরা চেয়েছিলাম এস্টাবলিশমেন্টের
দখল নিতে। আমরা দখল করব, করে আমরা
আমাদের নিজের লেখাই লিখব।'
কৃত্তিবাসের আড্ডা--সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
রাজনৈতিক কবিতা লেখার পথে না
গিয়েও একটি পত্রিকা যে নিজের কব্জির
জোরে নিজেই রাজনীতি হয়ে উঠতে পারে,
এর প্রমাণ কৃত্তিবাস পত্রিকা।
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রথম যুগের
সীমানা চিহ্নিত করেছে এই পত্রিকাটি।
তার গোষ্ঠীবদ্ধতা, প্রকাশের ব্যাপারে
তার অনিয়মিততা, খামখেয়ালিপনা, কিন্তু
কিছুতেই একেবারে থেমে না যাওয়া।
‘কৃত্তিবাস পত্রিকার সূচনার ইতিহাস
বিচিত্র। তার জন্মলগ্নে কোন আয়োজন বা
পরিকল্পনার চিহ্ন ছিল না। দুটি অর্বাচীন
কবিযশঃপ্রার্থী যুবক প্রকাশনাজগতের
প্রবাদপুরুষ সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার
গুপ্তের (ডি কে গুপ্ত) কাছে এসেছিলেন
তাঁদের লেখা কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে।
উদ্দেশ্য, একটি সৌষ্ঠবী কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশের ব্যবস্থা করা। ডি কে তাঁদের
উচ্চাশা ও স্বপ্ন ভেঙে দেননি। বরং
পরামর্শ দিয়েছিলেন, শুধু দুজনের কবিতার
বই কেন, তার চেয়ে একটি পত্রিকা
প্রকাশিত হোক, যেখানে সমকালের
বাংলা কবিতার ছবি ফুটে উঠবে। এই
পরামর্শ সেই দুই অর্বাচীনের মনঃপুত হল।
আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে জুটিয়ে তাঁরা
একটি পত্রিকা প্রকাশের কাজে নেমে
পড়লেন। দিলীপকুমার বাংলার এক
আদিকবির নামে পত্রিকার নাম দিলেন –
কৃত্তিবাস।‘ (ভেতরমলাট, কৃত্তিবাস পঞ্চাশ
বছর নির্বাচিত সংকলন, সম্পাদনা সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় )
প্রথম থেকেই এই আপতিকতার ব্যাপারটা
‘কৃত্তিবাস’কে ঘিরে আছ। অনিবার্য অথচ
স্বতঃস্ফূর্ত। কী অদ্ভুত কম্বো! ১৯৫৩ সালে
আবির্ভূত পত্রিকাটির সবচেয়ে বড় কথা
তার স্পর্ধা। তার আত্মবিশ্বাস আর
কবিতার প্রতি সত্যবদ্ধ অভিমান। এক বছর
পূর্তির সংখ্যায় সম্পাদক সুনীল
লিখেছিলেন, “এক হিসেবে কৃত্তিবাসের
মূল্য ঐতিহাসিক। কারণ, এখানে ভবিষ্যৎ
বাংলা কবিতার গতিপথের চিহ্ন
রইল। ...বাংলাদেশের তরুণ কবিরা
প্রত্যেকেই তিনমাসের মধ্যে যেটি শ্রেষ্ঠ
কবিতা লিখবেন, সেটি কৃত্তিবাসে
পাঠাবেন। কারণ এই কৃত্তিবাসের
পাতাতেই তাঁদের ভবিষ্যতের সঙ্গে চুক্তি
সাক্ষরিত হবে।" এর সঙ্গেই নবীন লেখকদের
প্রতি নোটিস দিয়েছিল এক বছর পূর্তির
কৃত্তিবাস, “কৃত্তিবাস শুধু কবিতার পত্রিকা
নয়, আধুনিক কবিতার পত্রিকা। ... আধুনিক
কবিতা যাঁরা লিখবেন তাঁদের আধুনিক
কবিতার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সজাগ থাকা
প্রয়োজন।" বেশ দাপুটে দাবি, বলা চলে
নির্দেশিকা। একই সঙ্গে অশ্লীলতা অথবা
স্বীকারোক্তিমূলক লেখার দায়ে
কৃত্তিবাসের বিতর্কিত হয়ে ওঠার প্রবণতাও
আইকনিক। ঐতিহাসিক। গিনসবার্গের
আগমনকে ঘিরে যে কিংবদন্তী তাও কিন্তু
আজ অব্দি প্রচল। এই স্মৃতিচারণের দায় তুলে
নিয়েছেন পরবর্তীরাও। পড়া যাক
সদ্যপ্রকাশিত সুবোধ সরকারের একটি লেখা,
এক সাময়িক পত্রিকার পাতায়ঃ
“অ্যালেন কালীঘাটে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ছবি
তুলতে পারেন, এতটাই তিনি ভবঘুরে, আমি
সেই দুর্লভ ছবি দেখেছি বব রজেনথলের
কাছে, বব কবি এবং অ্যালেনের
বিবলিওগ্রাফার। টাইমস্ স্কোয়ারে একটি
চল্লিশতলার ঘরে অ্যালেনের আর্কাইভ,
সেখানে অ্যালেনের সব তথ্য মজুত রয়েছে।
একেই বলে ইতিহাসের মুচকি হাসি, যে-
ভবঘুরে অ্যালেন যশোর রোড ধরে
বাংলাদেশ সীমান্তে চলে যাচ্ছেন
মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে, যে-
অ্যালেন জাপানে গিয়ে বুদ্ধের পায়ে
পড়ছেন, জাপানটা অবশ্য জ্যাক কেরুয়াকের
কলোনি ছিল, (অন দ্য রোডের কিংবদন্তী
লেখক কেরুয়াক এখনো সমান আধুনিক), ঠিক
যেরকম কলকাতাটা ছিল অ্যালেনের, ঘুরে
বেড়াচ্ছেন নিমতলা ঘাট থেকে বেনারসের
মণিকর্ণিকা। সে সময় অ্যালেনের পায়ের
নীচে সর্ষে। চোখে স্বপ্ন। হাতে বোমা।
বোমা নামিয়ে রেখে পাঠ নিচ্ছেন
বৌদ্ধধর্মে। নির্বাণ কথাটা তাঁর কবিতায়
বার বার ফিরে এসেছে। বারবার উঠে
এসেছে বাউল শব্দটা। এমনকী তিনি
বাউলদের স্টাইলে কবিতা লিখেছেন, “ইন
ইমিটেশন অফ বাউল পোয়েমস”। দিনের পর
দিন শ্মশানঘাটে ভোর রাত্রি পর্যন্ত শুয়ে
থাকতেন অ্যালেন, সুনীল শক্তি তাঁকে
জোর করে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি
ফিরত। বাংলা কবিতায় এরকম
বোহেমিয়ানিজম আগেও আসেনি একমাত্র
মাইকেল ছাড়া, পরেও এল না, সুনীল শক্তির
পরে যা এসেছে, তা একেবারে থার্ডক্লাস
জেরক্স, শক্তির গলা নকল করা
দণ্ডবায়স।" (অ্যালেন গিন্সবার্গ এক
আন্তর্জাতিক ভবঘুরে/ সুবোধ সরকার/শুভম
সাময়িকী মার্চ ২০১৫)
ভবঘুরের জেনেটিক, ভবঘুরের ভাইরাস,
সুতরাং শক্তির মত কবিরা, তাঁদের
শক্তিশালী লাল টকটকে রক্তে, বলা বাহুল্য
যা নীল নয়, যা মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত,
জেলা ও মফস্বলীয়, সেই রক্তের ভেতরের
রাগ দাপট স্পর্ধার সঙ্গে সঙ্গে তুলে
নিয়েছিলেন।
ভবঘুরে কোন ন্যালাক্যাবলাপনা নয়। তা এক
প্রার্থিত, কাঙ্ক্ষিত, বেছে নেওয়া
স্বাধীন সচেতন প্রয়াস।
কিন্তু, মাঝে মাঝে এও মনে হয় যে,
বাকিদের চেয়ে শক্তি একটু বেশিই যেন,
তাঁর আরো ভেতরে কোথাও বহন করেছেন
সেই ভাইরাস। কেননা বাকিদের গোছানো
হয়ে উঠেছে কিছুবা, কাজের গৃহিণীপনায়,
জীবনযাপনে। সন্তান-সংসার টাকা-পয়সা
চাকরি-বাকরিতে। যদিও ভাইরাস মাঝে
মাঝে বহু গদ্যের মাঝে সুনীলকে দিয়ে
লিখিয়েছে তীব্র গৃহহীন পঙ্ক্তি বা
অসময়ে চাকরি ছাড়িয়েছে শরৎকুমার
মুখোপাধ্যায়কে। তবু, শক্তি শক্তিই।
তিনি পাগল আর ভবঘুরে থেকেই চলে
গেছেন। আমি স্বেচ্ছাচারী। সেইসব
স্বেচ্ছাচারের স্বপ্ন দেখে যাব আমরা,
তাঁর পঙ্গু উত্তরাধিকারীরা।