Saturday, October 17, 2015

আত্মহত্যা নামক বিষবৃক্ষ এবং প্রতিকার-প্রতিরোধে করণীয়


(১)
সময় যতই গড়াচ্ছে, সভ্যতা ততই এগোচ্ছে। সভ্যতার অগ্রযাত্রার এই মাহেন্দ্রক্ষণেও এমন কিছু অসংগতি, ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যায় প্রতিনিয়ত, যা সভ্যতার উৎকর্ষতাকে পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশেই ম্লান করে দেয়; ভূকম্পনের মতো নিমেষেই আমাদের মানবিক ভিতটিকে কাঁপিয়ে দেয়। আর সেগুলোর মধ্যকার আত্মহত্যা নামক অশুভ অভিশাপটি অন্যতম, যা আমাদের সামাজিক বিপর্যয়কে শক্তভাবে তোলে ধরে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

বর্তমান সময়টাতে আত্মহত্যা ক্যান্সারের চেয়েও মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। ক্যান্সারে মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক ও পীড়াদায়ক হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেটাকে মেনে নিতে পারা যায়, কিন্তু আত্মহনন নামক বিষাক্ত নাগিণীর ছোবলে অকালে ফুরিয়ে যাওয়া প্রাণগুলোর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই মানতে পারা যায় না। এটা নিছক কোনো দুর্ঘটনা কিংবা অপমৃত্যু নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে অসংখ্য কারণ ও মোটিভ।

বাংলাদেশে প্রতিবছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষপান করে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে। আর প্রতিদিন করছে প্রায় ২৮ জন। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের প্রথম সাতমাসে ৬ হাজার ৪৯২ জন, ২০১৩ সালে ১০ হাজার ১২৬ জন, ২০১২ সালে ১০ হাজার ১০৫ জন, ২০১১ সালে ৯ হাজার ৬৩২ জন লোক ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষপানে আত্মহত্যা করেছে অর্থাৎ ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সালের প্রথম সাত মাস পর্যন্ত ৩০ হাজার ১৪৮ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, যাদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এবং সিংহভাগই নারী।

চলতি বছরেও আত্মহত্যার পরিমাণ পূর্বেকার বিপৎজনক মাত্রা-ই রয়েছে এবং ৬৫ লাখ মানুষ বর্তমানে আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সাথে আরেকটি দুঃসংবাদও যুক্ত হয়েছে তাতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার(ডব্লিউএইচও) জরিপে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০তম যা ২০১২ সালে ৩৪তম অবস্থানে ছিল। শুধু তাই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার(ডব্লিউএইচও) আরও একটি গবেষণা অনুসারে, ২০২০ সাল নাগাদ প্রতিবছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবে এবং আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবে এরও ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ। (তথ্যসূত্রঃদৈনিক সমকাল)

উল্লেখ্য, সারা বিশ্বব্যাপি বছরে যতগুলো লোক আত্মহননকে বেছে নিচ্ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশি রয়েছে ২.০৬% ।

কতোটা ভয়াবহ ও সাংঘাতিক!সংবাদটি মোটেই শুধু আমাদের জন্য নয়, বরং গোটা মানবজাতির জন্যই সুখকর নয়। আমরা প্রতিনিয়ত বাঁচার জন্য সংগ্রাম করি, জীবনসীমাকে একটি মিনিট বর্ধিত করবার জন্য কতো চেষ্টা, তদবির, আকাঙ্ক্ষাই না করি ! কিন্তু আমাদের মাঝে এমন অসংখ্য লোক রয়েছে, যারা জীবনটাকে বিরক্তিকর, তুচ্ছ জ্ঞান করে স্বইচ্ছায় পাড়ি জমায় অনন্তলোকে। তাদের ধরণীমাতার রূপ, রস, গন্ধ, স্নেহ, মোহ কোনোটাই আকৃষ্ট করতে পারে না। তারা অবলীলায় চলে যায় নীরবে-নিভৃতে সমস্ত সীমা অতিক্রম করে সীমাহীন অসীম গন্তব্যে।

কিন্তু কেনো?

গবেষণায় উঠে এসেছে, আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—-হতাশা, যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন, ইভটিজিং, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, প্রতারণা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, দাম্পত্যকলহ, নারীর অপ্রত্যাশিত গর্ভবতী হওয়া, দারিদ্র ও বেকারত্ব, প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা, মানসিক অসুস্থতা, জটিল শারীরিক রোগ- যন্ত্রণা, নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা।

(২)
বাংলাদেশে যে হারে আত্মহত্যার পরিমাণ ও প্রবণতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে বিষয়টিকে মোটেই অগ্রাহ্য কিংবা হালকাভাবে নেয়ার কোনো অবকাশ নেই। চোখের সামনে নিভৃতে ঝরে যাওয়া সদ্য ফোটা প্রাণগুলো ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও উচিত নয়। নির্মম, পীড়াদায়ক আত্মহত্যার ভয়াল থাবা হতে শুভ্র প্রাণগুলোকে রক্ষা করার দায়িত্ব গোটা সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র জাতিকেই নিতে হবে। কেননা একটি আত্মহত্যা শুধু একটি জীবনকেই নষ্ট করে না, বরং প্রতিটি আত্মহত্যার বিরূপ প্রভাব বয়ে বেড়াতে হয় গোটা পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং কি পুরো রাষ্ট্রকেই। কারণ রাষ্টের মূল সম্পদ জনসমষ্টি।আর এক একটি জীবন অকালে ঝরে যাওয়া মানে, এক একটি অমূল্য সম্ভাবনা ঝরে যাওয়া। বিষয়টিকে মাথায় রেখেই অভিশপ্ত এই পথ থেকে দেশের নারী-পুরুষকে বিচ্যুত করার সমাধান এখনি খুঁজতে হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুভার্গ্যের বিষয় হলো, প্রতিনিয়ত আত্মহত্যা নামক প্রেতাত্মার প্রভাবে লাশের মিছিল ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও আমাদেন যেনো টনক মোটেই নড়ছে না। রাষ্ট্রযন্ত্রও এক্ষেত্রে পুরোপুরি উদাসীন। গতকালও(৭ই অক্টোবর) রাজধানীতে বউকে না পেয়ে শ্বশুড়ের প্ররোচনায় মুরাদ চৌধুরী নামে এক কলেজ ছাত্র ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। তাছাড়া বখাটেদের উৎপাতে নিষ্পাপ তরুণীরা যখন আত্মহননকে আলিঙ্গন করে, তখন ক’জন দোষীর শাস্তি হয় অভাগা এই দেশে ! ক’জন এমপি, মন্ত্রী, রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব শোকাহত হন এতে? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও কী শোকাহত হন কখনো? আমাদের ঔদাসীন্য আর দায়িত্বহীনতার কারণে আত্মহত্যার পথ কেউ বেছে নিলে, আমরা কেউ-ই তার দায় এড়াতে পারি না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সেটা পারেন না, এমন কি সমগ্র বিশ্বের কোনো প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থমস্তিস্ক সম্পন্ন জীবিত মানুষই তা পারে না। আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যতো হ্রাস পাবে, প্ররোচনাকারীদের উৎসাহ ততো বৃদ্ধি পাবে। আমরা ক’জন নির্যাতনকারীকে, ক’জন প্ররোচনাকারীকে উপযুক্ত দন্ড দান করতে পেরেছি? স্পষ্ট ভাষায় জোর গলায় বলা যায়, একটিও না। কিন্তু কেনো? আমরা কী তাহলে ঔ সমস্ত পিশাচদের হয়ে দালালি করি, যারা নিষ্পাপ মানুষদের হত্যার জন্য দায়ী? বিষয়টি এখনি ভাবা উচিত। তা না হলে হয়তো একসময় গোটা সমাজব্যবস্থাই ধসে যাবে।

(৩)
আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলোর বিপরীতে জোরালো সমাধান খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। পুলিশের দেয়া তথ্যানুসারে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যকার ৬০ শতাংশই নারী, যাদের আত্মহত্যার মূল কারণ হচ্ছে নির্যাতন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং, অপ্রত্যাশিত গর্ভবতী হওয়া, দাম্পত্যকলহ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি।বাংলাদেশে নারীদের উপর শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন এক রকম ঐতিহ্য বা প্রথায় রূপ নিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নারীরা আশংকাজনকহারে আত্মহননকে বেছে নিচ্ছে। পাশা-পাশি সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও এক্ষেত্রে এনজাইমের মতো কাজ করছে। নারীদের আত্মহত্যার ভয়াল গ্রাস হতে রক্ষা করতে হলে সমস্ত রকমের নির্যাতন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে নির্যাতনকারীদের বা উত্ত্যক্তকারীদের কঠোরতম শাস্তি সুনিশ্চিত করা, নির্যাতিতা নারীদের পুনর্বাসন, আইনি সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান সফলভাবে সম্পন্ন করা গেলে আত্মহননকে অনেকাংশে রুখে দেয়া সম্ভব। পাশা-পাশি নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অত্যন্ত জোরদার করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মকান্ডগুলোকে বিস্তৃত করা উচিত। পুরুষদের আত্মহননের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—হতাশা, বেকারত্ব, প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা। এক্ষেত্রে বেকার যুবকদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান প্রদান, মানসিক ট্রিটমেন্ট ও সচেতনতা বৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনোরোগবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহননকারীদের মধ্যকার ৯৫ শতাংশই কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের জেলা অথবা উপজেলা পর্যায়ে মানসিক রোগের চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা নেই। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সরকারি হিসেবে দেশে মাত্র ২০০ জন মানসিক রোগের চিকিৎসক রয়েছে। মাত্র ২২টি মেডিকেল কলেজ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পাবনার হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা করা হয়। (তথ্যসূত্রঃ দৈনিক সমকাল)

বিষয়টি একই সাথে দুর্ভাগ্যের ও লজ্জারই বটে! আত্মহননকে রুখে দিতে হলে জেলা, উপজেলা এমন কি ইউনিয়ন পর্যায়ে মানসিক রোগের চিকিৎসার সুব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজেও এ সুব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং পর্যাপ্ত মানসিক রোগের চিকিৎসক নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত বিশ্বে সম্ভাব্য আত্মহননকারীকে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ঘৃণ্য এ পথ হতে বিচ্যুত করা হয়। কারণ আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে এমন মানুষকে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং করা হলে তাকে বাঁচানো সম্ভব। আমাদের দেশেও যদি কাউন্সেলিং কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয়, তবে আত্মহননকে অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশা-পাশি আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতাও রোধ করতে হবে। ধর্মীয় দিক থেকেও আত্মহত্যাকে মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ্ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে, এ বিষয়টিও সবার মাঝে ছড়িতে দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ হওয়ায় এটি অসাধারণভাবে কাজ করবে। মসজিদের ইমাম ও ধর্মীয় বক্তাগণ এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। সেইসাথে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টাকারীকে সর্বোচ্চ এক বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড দেবার যে বিধান রয়েছে, সেটিকেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। আর সরকারকেও হতে হবে এ ব্যাপারে পুরোপুরি আন্তরিক।