Tuesday, October 13, 2015

প্রাচীন বাংলায় গৌতম বুদ্ধ এবং তারপর...—ইমন জুবায়ের (না পড়ে থাকলে হয়ত মিস করে থাকবেন)


প্রাচীন বাংলায় গৌতম বুদ্ধ এবং তারপর...—ইমন জুবায়ের (না পড়ে থাকলে হয়ত মিস করে থাকবেন)
প্রাচীন বাংলার মানুষের কাছে দার্শনিক চিন্তাভাবনা প্রচার
করার জন্য বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ প্রাচীন
বাংলায় এসেছিলেন। সময়টা যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও
পাঁচশ বছর আগে। বুদ্ধ মূলত ছিলেন প্রাচীন
ভারতের গভীর চিন্তার অধিকারী একজন নরম
হৃদয়ের মানুষ। জীবন-জিজ্ঞাসায় অস্থির হয়ে
শেষাবধি তিনি একটি দার্শনিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে
পেরেছিলেন - পরবর্তীকালে যা 'বৌদ্ধদর্শন'
নামে পরিচিত হয়েছে । আরও পরে যা পরিচিত
হয়েছে বৌদ্ধধর্ম নামে।

বুদ্ধ জানতেন যে সংসারের বিষয়ী মানুষ দার্শনিক
আলোচনায় আকর্ষন বোধ করে না। তাই তিনি সমমনা
দলছুট ভাবকুদের নিয়ে একটি আলাদা ‘গ্রুপ’ গঠন
করেছিলেন। এই ‘গ্রুপ’ কে পালি ভাষায় বলা হয় ‘সংঘ’ ।
তো সংঘ বলতে আমরা মঠ বুঝতে পারি। মঠ বলতে
আমরা আবার বড় একটি বাড়ি বুঝতে পারি। তো, বুদ্ধ
মঠে বসে সমমনা ভাবুকদের নিয়ে নানা বিষয়ে
আলোচনা করতেন । (যিনি বলেছিলেন ' জগতের
সকল প্রাণি সুখি হোক'-কাজেই বোঝা যায় বুদ্ধ মঠে
বসে সমমনা ভাবুকদের নিয়ে কী আলোচনা
করতেন ) ... তো সেই মঠবাসীদের বলা হত
ভিক্ষু। স্বভাবতই ভিক্ষুরা ছিলেন নরম হৃদয়ের
অধিকারী সৎ, এবং সংযমী। তাদের জীবনযাপন ছিল
খুবই সাধারণ।

তবে বুদ্ধ মঠে বাস করলেও করলেও মোটেও
সমাজবিচ্ছিন্ন ছিলেন না। তিনি লোকালয়েও যেতেন।
মঠটি কখনও লোকালয়েই তৈরি হত। বুদ্ধ মূলত
প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যে বাস করতেন। বুদ্ধ
মগধ রাজ্যের অধিবাসীদের কাছে তার চিন্তাভাবনা
ভাবনা প্রচার করতেন।

কেন?

কারণ বৌদ্ধের ভাবনায় দয়াশীলতার ভূমিকা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ । বুদ্ধ মনে করতেন এমন কী সংসারের
বিষয়ী মানুষেরও দয়াশীল হওয়া দরকার-যারা
ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝামেলা তৈরি করে।

তাছাড়া সমাজসচেতন বুদ্ধ ছিলেন যুদ্ধবিরোধী এবং
তিনি প্রাণিহত্যারও বিরোধীতা করেছিলেন। মগধের
সম্রাট অজাতশক্র ছিলেন মগধের রাজা বিম্বিসারের
পুত্র। ( রাজা বিম্বিসারের কথা জীবনানন্দের বনলতা
সেন কবিতায় রয়েছে।) ... তো মগধের রাজা
অজাতশক্র গঙ্গা নদীর উত্তরে গণরাজ্য আক্রমন
করতে উদ্যত হয়েছিলেন। বুদ্ধ তখন সেই সামরিক
অভিযানের তুমুল বিরোধীতা করেছিলেন। শুধু তাই
নয়-বুদ্ধ বৈদিক যজ্ঞে অযাথা পশুহত্যারও প্রবল
বিরোধীতা করেছিলেন। বুদ্ধ এমন কী যজ্ঞপশুর
সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে ঋত্বিককে (যিনি যজ্ঞ
পরিচালনা করেন ) বলতেন, তার চে বরং আমাকে হত্যা
করো, এই ষাঁড়টিকে নয় ...

মগধের ইতিহাসের বইয়ে এসব মানবিক কথা লেখা
রয়েছে।

তো, বুদ্ধ যখন প্রাচীন বাংলায় এসেছিলেন সে
সময়টায় প্রাচীন বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষ
কেমন ছিল?

অনুমান করি প্রাচীন বাংলার বাঙালি সে সময়টায় প্রধানত
ফসলের মাঠে চাষবাসই করত; উৎপাদিত ফসল মূলত ধান
ও আখ। অবশ্য অন্যান্য ফসলও ফলাত তারা। তারা নৌকা
বাইত, মাছ ধরত। বাঙালি তো চিরকালই মাছে-ভাতে
বাঙালিই ছিল। অনুমান করি:... ছবির মতন সবুজ-সুন্দর
গ্রামের পাশে দিগন্ত অবধি ধানের ক্ষেত। আর
নদী-নালা- খাল-বিল।আর বিলের কি সৌন্দর্য! সে
সৌন্দর্য দেখে বাঙালি হয়ে উঠেছিল ভাবুক। মাথা নত
করেছিল দৃশ্যের ওপারের পরম সত্তাকে। বাঙালি
যখন অরণ্যবাসী ছিল, তখন তারা ছিল নিষাদ ,(আদিবাঙালির
এই নাম দিয়েছিল বৈদিক আর্যরা) নিষাদ মানে বৈদিক আর্যরা
বুঝত- শিকারী। সেই প্রাগৈতিহাসিক বাংলার নিষাদজাতি কথা
বলত অস্ট্রিক ভাষায়। আমরা যেমন আজ কথা বলি বাংলা
ভাষায়। নিষাদেরা তীরধনুক দিয়ে অরণ্যে শিকার করত,
বনের ফলমূল কুড়োত। তো, হয় কী- মানুষের
হাতিয়ারের উন্নতি হয়।

কেন?

মানুষ চিন্তাশীল বলেই। মানে মানুষ বিমূর্ত চিন্তা
করতে পারে বলেই।

যে কারণে প্রাচীন বাংলায় লোহার আবিস্কারের পর
সে লোহা দিয়ে নিষাদজাতি দা-কুড়োল-বঁটি তৈরি
করতে শিখল । সেসব দিয়ে তারা বনের গাছ কাটল।
কালক্রমে তারা তৈরি করল লাঙ্গল। চাষ করল নতুন জমিনে
। গড়ে তুলল নতুন বসতি ।

সে বসতির নাম তারা দিল: গ্রাম।

অরন্যচারী নিষাদ হয়ে উঠল আদি/বাঙালি।


গ্রামের পাশে খাল। প্রাকৃতিক খাল সম্ভবত। তখনও কি
বাঙালি খাল কেটে নদী থেকে পানি আনার কথা
ভেবেছিল? আমি ২৫০০ বছর আগের কথা বলছি।
তো খালের পাড়ে হাট। হাটে চলত কেনাকাটা ।
কেনাকাটা বাদেও চলত আড্ডা। বাঙালি আড্ডাপ্রবণ
বলেই।

হয়তো বুদ্ধ প্রাচীন বাংলার কোনও গ্রাম্য হাটে
এসে বসতেন।

সবার কথা মন দিয়ে শুনতেন। তারপর নিজের কথা
বলতেন ...

বুদ্ধের জন্মের দুশো বছর আগে ভারতবর্ষে
লোহার আবিস্কার হয়েছিল। ফলে বনজঙ্গল
কেটে সাফ করে বৈদিক আর্যদের পূর্বমুখি
অভিপ্রয়াণ (মাইগ্রেশন) সহজ হয়েছিল। আর্যরা
প্রাচীন বাংলায় এসেছিল। বসতি স্থাপন করেছিল।
প্রাচীন বাংলার মানুষ আর্যদের গ্রহন করেছিল।
প্রাচীন বাংলার মানুষ উদার বলেই গ্রহন করেছিল।

পরবর্তীকালে - প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে বাংলার
উদার মানুষ আরও অনেক ভিনদেশি জাতি
গোষ্ঠীকে বাংলার মাটিতে ঠাঁই দিয়েছিল। কী
কারণে বাঙালি এখন আর ভিনদেশি জাতি গোষ্ঠীকে
ঠাঁই দিতে চাচ্ছে না ...ইতিহাসে একথা লেখা থাকবে।
এই কলঙ্কের কথা ...

প্রাচীন বাংলার বাঙালি হাটে কি ফসলের মাঠের পাশে
বসে বুদ্ধের কথা শুনতো।

কিন্তু, কি বলতেন বুদ্ধ?

বলতেন-১/ জীবনে দুঃখ আছে।২/ কাজেই
আমাদের দয়াশীল হওয়া উচিত। এবং ৩/ জীবনকে
অত সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নাই।

বুদ্ধের বাণী গ্রহন বা বর্জন করার কিছু ছিল না; ছিল শুধু
সে বাণীকে কনর্ফাম করা। কারণ বুদ্ধের কথার
মধ্যে মন্দ কিছু তো ছিল না। বাংলার চাষি, কামার-কুমোর
তাইই করেছিল- তারা তাদের অনুসৃত ধর্ম বজায়
রেখেই বুদ্ধের চিন্তাকে কনর্ফাম করেছিল।

কিন্তু বুদ্ধ কোথায় বসে তাঁর বাণী প্রচার করতেন?

ওই যে বললাম, ফসলের মাঠের পাশে কিংবা গ্রাম্য
হাটে।

বুদ্ধ, কপিলবস্তু নগরের সেই গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী;
এসে বসতেন, ধরা যাক-কোনও ফসলের মাঠের
পাশে। পাশে শিষ্য আনন্দ কিংবা উপালি। বুদ্ধ নিরবে
বসে থাকতেন। তাঁর পরনে গেরুয়া বসন। (যে বসন
উনিশ শতকের বাঙালি যোগী স্বামী
বিবেকানন্দকে অবধি প্রভাবিত করেছিল ...) সোনার
বরণ তাঁর শরীর । সোনার বরণ হবে না কেন? বুদ্ধ
যে রাজপুত্র ! অবশ্য রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করার পর
বুদ্ধের গায়ের রং যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে
উঠেছে। মাথাটি মসৃণভাবে কামানো। চোখ দুটি
অর্ধ-মুদিত; ডিম্বাকৃতির মুখমন্ডলে গভীর প্রসন্ন ভাব।

ফসলের মাঠে নিরানি দিয়ে আগাছা সাফ করছে একজন
কৃষক। কৃষকের নাম তিলক। ( কৃষকের নাম তিলক ...
কেননা ২০০ বছর ধরে বাংলায় বৈদিক আর্যরা বসবাস
করছে। নিষাদ/বাঙালি বৈদিক আর্যদের ধর্ম/সংস্কৃতি
গ্রহন করেছে ... )

তিলক কৃষক। বাংলার বিখ্যাত কৃষক। সেকালেও কৃষকের
সংগ্রাম ছিল, একালেও আছে; আমরা জানি। এ কালের
কৃষক বোরো ধানের সত্যিকারের দাম পায় না। আর
সেকালের রাজা ছিল কৃষকের প্রতি উদাসীন; রাজার
সময়মতো খাজনা চাই-নাইলে পরিবারসমেত ধরে
নিয়ে যায়। টর্চার করে। একালের রাজাগণ অবশ্য
ওপরে-ওপরে কৃষকবন্ধু, কৃষিকাজে ভর্তুকি দেয়,
তারপরও কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না ...


ফসলের মাঠ পুড়ছে জ্যৈষ্ঠের খরতাপে। বুদ্ধ
ঘামছেন। কিন্ত তাঁর নিজেকে নিয়ে অত ভাবনা নেই।
কৃষকের কালো পিঠটা ঘামছে। ওই দৃশ্যে বুদ্ধ
যন্ত্রণাকাতর হয়ে ওঠেন। কিন্তু প্রকাশ করেন না।

বেলা দ্বিপ্রহর।

কৃষকের অস্টাদশী কন্যাটি (অঞ্জনা) ভাত নিয়ে
আসে। বুদ্ধকে দেখে অঞ্জনা অবাক। পুরুষমানুষ
এত সুন্দর হয়! নারী বলেই অঞ্জনা পুরুষ মানুষকে
মন দিয়ে দেখে। অঞ্জনা অভিভূত। এই মানুষকেই
তো অঞ্জনা এতকাল স্বপ্নে দেখে এসেছে।

তিলক নিকটবর্তী জলা থেকে হাতমুখ ধুয়ে
এসেছে। এখন খেতে বসবে। অঞ্জনা তার বাবার
সামনে বসে গামছার গিঁট খুলতে থাকে । গামছায় ভাত/
ডাল/তরকারি।

চিরদিন বাঙালি অতিথিপরায়ণ। তিলক বুদ্ধকে আহার করতে
অনুরোধ করে। বুদ্ধ সায় দেয়। কেননা, তিনি
মানুষের ভিতরের সহৃদয়তা খোঁজেন্। তার দেখা
পেলে কৃতজ্ঞতা বোধ করেন। বুদ্ধ আহার সামান্যই
করেন, বেঁচে থাকতে যতটুকু প্রয়োজন ।
খাবারের আয়োজনও সামান্য। ভাত, ডালের বড়া, অরহর
ডাল । ব্যাস।

অঞ্জনা মমতাভরে বুদ্ধের পাতে একটি ডালের বড়া
তুলে দেয়।

সময়টা সময়টা যিশু খ্রিস্টের জন্মের পাঁচশ বছর
আগে।

খাওয়ার পর তিলক বললেন, ধর্মাবতার, এবার আমাদের
উপদেশ দিন।

বুদ্ধ বলেন: কেবল তিনটি কথা মনে রেখ।

বলুন।

(১) জীবনে দুঃখ আছে। (২) কাজেই আমাদের
দয়াশীল হওয়া উচিত (৩) জীবনকে অত সিরিয়াসলি
নেওয়ার দরকার নাই।

এই আর কিছু না? অঞ্জনা জানতে চায়।

না। আর কিছু না। বুদ্ধ জলদ গম্ভীর কন্ঠে বলেন।

অঞ্জনা: তাহলে আপনার দেবতা কে?

বুদ্ধ: তুমি।

অঞ্জনা: আমি? (চমকে উঠে)

বুদ্ধ: হ্যাঁ, তুমি। তুমিই আমার দেবতা।

অঞ্জনা অবাক।

এই ঘটনার আড়াই হাজার বছর পর লালন নামে বাংলারই এক
সাধক গেয়ে উঠবেন:

মানুষগুরু নিষ্টা যার ভবে মানুষগুরু নিষ্টা যার/
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার ...

কি আশ্চর্য!

একেই কি আবহমান বাংলা বলে?

অঞ্জনা তারপর অঞ্জনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এঁটো
বাসনকোসন নিয়ে চলে যায়। অষ্টাদশী বাড়ি ফিরতে
ফিরতে ভাবল, আহা, মানুষটার কি রূপ, আর কি ভাষা, কি
গভীর চিন্তা!

অঞ্জনা বৈষ্ণব। কেননা, বাংলায় ততদিনে উত্তর ভারত
থেকে বৈদিক আর্যরা এসেছিল বলে অঞ্জনা
তাদের বৈদিক ধর্মটির অনুসারী হয়ে উঠেছে।
অঞ্জনা বিশ্বজগতের পালক বিষ্ণুর পূজারী। অঞ্জনার
পূর্বপুরুষ নিষাদেরা ছিল প্রকৃতিপূজারী। তারা কথা বলত
অস্ট্রিক ভাষায়। ‘পূজা’ শব্দটি অস্ট্রিক ভাষারই একটি শব্দ।
যেজন্য অঞ্জনারা বৈদিক নিয়মে বলি-টলি দেয় না।
বিষ্ণুমূর্তি পূজা করে।


অবশ্য আর্যদের ধর্মদর্শনটিও চমকপ্রদ। যেমন:
ঈশ্বর সর্ব শক্তিমান বলেই ঈশ্বরের সাকার ও নিরাকার
দুটি রূপই রয়েছে। ঈশ্বরের নিরাকার রূপ হলেন
ব্রহ্মা। আর সাকার রূপ হলেন বিষ্ণু। (যারা শিবের কথা
বলবেন তাদের আমি বলি: শিব অনার্য দেবতা। আর
আমি লিখছি আজ থেকে ২৫০০ বছর আগের কথা।
আমার মনে হয় তখনও ভারতবর্ষের বৈদিকসমাজ
শিবকে গ্রহন করেনি) ...বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা কেউ
নন। মহাবিশ্বে যা হয় তা হল পরিবর্তন। তবে ঈশ্বরের
সাকার রূপের আরাধনা করা বিধেয়। এই জন্য বলি দিয়ে
ঈশ্বরকে তুষ্ঠ করতে হয়।

অঞ্জনা বিষ্ণুর উপাসক বলেই বৈষ্ণব। কিন্তু, তাতে কি
হয়েছে। বুদ্ধের কথা মেনে চললে আমি
ধর্মচ্যূত হব না। তাছাড়া বুদ্ধ কত ভালো ভালো কথা
বললেন আজ , বললেন, জলের ফোঁটার প্রতিও
আমার দয়া হয়।

এ কেমন মানুষ!

অঞ্জনা কেঁপে ওঠে।

বুদ্ধের বাণী মনে মনে গ্রহন করে অষ্টাদশী
কিশোরী। তবে ও বৈষ্ণবই রয়ে গেল। কারও,
সে যে ধর্মেরই হোক-তার নীতিকথা গ্রহন
করলে কি ধর্মসংস্কৃতি বদলে যায়?

অপরাহ্নে বুদ্ধ আরেক গ্রামে দিকে চললেন।
দুএক দিনের মধ্যেই বঙ্গের আরও পুবে যাওয়া
ইচ্ছে। যে জায়গাটি পরবর্তীকালে চিহ্নিত হবে
আরাকান নামে।

বিকেল হয়ে এসেছে।

তিলক ফসলের মাঠ থেকে ধীরেসুস্থে ঘরে
ফিরে এল। তার মনে নতুন চিন্তার আলোরণ। চিন্তা
মানে বুদ্ধের ওই তিনটি কথার অনুরনন। তবে সে চিন্তা
একেবারে নতুন কিছু নয়। কেননা, বুদ্ধের জন্মের
১০০ কি ১৫০ বছর আগে প্রাচীন বাংলায় একজন
মেধাবী চিন্তাবিদ জন্ম গ্রহন করেছিলেন। তাঁর নাম
কপিল। কপিল বলেছিলেন: জগতে প্রত্যেক প্রাণি
দুঃখভোগ করে। আর বুদ্ধ বললেন, জীবনে দুঃখ
আছে। কপিল অবশ্য বলেননি যে- আমাদের
দয়াশীল হওয়া উচিত কিংবা জীবনকে অত সিরিয়াসলি
নেওয়ার দরকার নেই।

যা কপিল বলেন নি, তাই বুদ্ধ বললেন।

এভাবে মানবচিন্তা এগিয়ে যায় ...

তো, কৃষক তিলকও বিষ্ণুর পূজারী। দেবতা বিষ্ণুকে
ঘিরেই তাঁর ধর্মীয় জীবন আর ধর্মীয় সংস্কৃতি
গড়ে উঠেছে। সে প্রত্যহ বিষ্ণুর আরাধনা করে।
লক্ষীপূজাও করে। লক্ষ্মী হলেন বিষ্ণুর স্ত্রী-
ধন/সম্পদের দেবী। তবে বুদ্ধের তিনটি কথা
যেন তিলকের মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। তিলক
বিষ্ণুর কাছে কেবলই নিরাপত্তা চায়, সুখ চায়, শান্তি চায়।
কিন্তু, এটা কেমন যেন স্বার্থপরের মতো দেখায়
না?

কিন্তু বুদ্ধ আজ বললেন: জীবনে দুঃখ আছে।
কাজেই আমাদের দয়াশীল হওয়া উচিত । আর
জীবনকে অত সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নাই। তিলক
ভাবতে থাকে। বুদ্ধ কি যেন বলতে চেয়েছেন,
কেবল দেবতার কাছে চাওয়া নয়, মাথা নত করা নয়:
গ্রামের মানুষের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তার।

তিলক দাওয়ায় বসে গায়ে সর্ষের তেল ঘঁষছে।
এখনই স্নান করতে যাবে সে। তিলকের স্ত্রী
চন্দনবালা। সে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, দুপুর
থেকে আমার রূপার নোলক খুঁজে পাচ্ছি না গো।

উদাস স্বরে তিলক বলল্, না পেলে, না পেলে।
তাতে কী?

তাতে কী মানে! নারী বলেই ফোঁস করে উঠল
চন্দনবালা।


তিলক বলল, জীবনকে অত সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার
নাই। বলে গামছা আর ধূতি কাঁধে ফেলে পুকুরের
দিকে যেতে লাগল। স্বামীর এহেন আচরণে দুঃখ
পেল চন্দনবালা। সে কাঁদতে বসল।

অঞ্জনা এসে বলল, জীবনে দুঃখ আছে মা। তুমি যত
ইচ্ছে কাঁদ। সমস্যা নেই।

চন্দনবালা অবাক। মেয়ে ও মেয়ের বাবার হল কী
আজ!

তখন সন্ধ্যা নামছিল।

চন্দনবালা দুপধাপ পা ফেলে ঘরে গিয়ে ঘর অন্ধকার
করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাটির ঘর। ঘরের কোণে
বড় একটা মাটির ধামা। তাতে ধান। মৃদু টকটক গন্ধ ছড়িয়ে
আছে বাতাসে।

অঞ্জনা দাওয়ায় বসে বুদ্ধের মুখটা স্মরণ করছিল।
দেখল উঠান পেরিয়ে হরিবালা আসছে। হরিবালা
গ্রামের হতদরিদ্র বিধবা। স্বামী কে সাপে
কেটেছিল বছর দুয়েক আগে। একমুঠো ধান
চাইতে এসেছে বিধবা। ছেলেমেয়ে নিয়ে
উপোস করছে নাকি।

অঞ্জনা উঠে ঘরে আসে। বলে, মা হরিবালা
এসেছে। একমুঠো ধান চায়।

চন্দনবালা বিরক্ত হয়ে বলল, বলে দে, আজ হবে
না। রোজ রোজ ধান চাইছে। আমি নোঙ্গরখানা
খুলে বসেছি আর কী!

আজ বুদ্ধের সঙ্গে দেখা না-হলে অঞ্জনা
হরিবালাকে তাই বলত। কিন্তু অঞ্জনা বলল, জীবনে
দুঃখ আছে মা। কাজেই আমাদের দয়াশীল হওয়া উচিত।

চন্দনবালার প্রতিক্রিয়া আর নাই-বা লিখলাম।

এই হল বুদ্ধের শিক্ষা।

ওই তিনটি কথার জন্যই বাংলার মানবতাবাদের উৎস বুদ্ধ।

বাংলায় ধর্মচিন্তার ধাপগুলো এরকম।

(১) অষ্ট্রিকভাষী নিষাদরা প্রকৃতির আরাধনা করত। ওদের
সূর্য দেবতা ছিলেন ‘বোঙ্গা’। অনেকের মতে
এই বোঙ্গা শব্দ থেকেই বাংলা নামের উদ্ভব। আমার
এমনই ভাবতে ভালো লাগে।

(২) তারপর বৈদিক আর্যরা এল বাংলায়। সময়টা ৮০০ থেকে
৬০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে। তাদের ছিল মহাগ্রন্থ
বেদ। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক একটি ধর্ম। যে ধর্ম
নির্দেশ দেয়: যজ্ঞ করে দেবতাকে খুশি করো।
তবে প্রাচীন বাঙালি যজ্ঞের ধারেকাছেও
ঘেঁষেনি। তারা ভালোবাসত পূজা করতে আর
তীর্থভ্রমন করতে।

(৩) এরপর এলেন বুদ্ধ। ইনি যাগযজ্ঞ-ভিত্তিক বৈদিক
শিক্ষা একেবারে অস্বীকার করেছিলেন।
বলেছিলেন...

আজও বাংলার মরমী বাউলগানে বুদ্ধের মানবতাবাদী
বাণী উঁকি দেয়। যে কারণে এক সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট
লেখক আহমদ ছফা বলেছেন: ‘গৌতম বুদ্ধের যে
চিন্তা, তা কবীরের কাছ থেকে বাহিত হয়ে লালন তা
ধারণ করেছেন। লালনের গানগুলোর মধ্যে গৌতম
বুদ্ধের শিক্ষা ও চিন্তা এখনও বেঁচে আছে।’
(আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারসমগ্র; সম্পাদনা নূরুল
আনোয়ার। পৃষ্ঠা,১৩২ )

বৌদ্ধদর্শন কিংবা ধর্ম যাই বলুন বাংলার সঙ্গে তার নাড়ির
সর্ম্পক ।

এর কারণ তিনটে।

(১) প্রাচীন বাংলার মানুষ বুদ্ধের বক্তব্যকে কনর্ফাম
করেছিল।পরে এক বিশাল জনগোষ্ঠী বুদ্ধের
ধর্ম/দর্শনকে গ্রহন করেছিল।

(২) ছয়শো খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন বৌদ্ধবিরোধী
তুমুল আন্দোলনে উত্তর ভারতে বৌদ্ধদের অবস্থা
নিদারুন হয়ে উঠেছিল বাংলা তখন বৌদ্ধধর্মের
পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছিল ।

(৩) বাংলার চিন্তাবিদেরা বৌদ্ধদর্শনকে বদলে দিয়ে
তাকে নারীবাদী তান্ত্রিক করে তুলেছিল।

কিন্তু, তারপর কি হল?

বৌদ্ধ পাল রাজারা চারশ বছর (৬০০ থেকে ১০০০
খ্রিস্টাব্দ) ধরে বাংলা শাসন করেছিলেন। এই সময়ে
বৌদ্ধধর্মটি নারীবাদী তান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল। তবে
নানা বিতর্কিত এবং গোপন আচারপ্রথার কারণে বৌদ্ধধর্ম
অনেকটা অধঃপতিত হয়ে পড়েছিল। কাজেই
পরবর্তীকালে (খ্রিস্টীয় দশম শতকে) যখন
নীতিবাগীশ সেনরা বাংলা শাসন করতে এলো-এবং
যখন তারা যৌননির্ভর বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্ব
শুনল- ঘৃনায় তাদের গা রি রি করতে লাগল। তারা বৌদ্ধদের
ওপরে হয়ে উঠেছিল খড়গহস্ত। তারা বাংলা থেকে
বৌদ্ধধর্ম উচ্ছেদ করার জন্য উঠে পড়ে লাগল।
এতে বৌদ্ধরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

এরপর আরও দুশো বছল কাটল।

ত্রয়োদশ শতকে (১২০০ খিস্টাব্দ) বাংলায় এল মুসলিম
রাজশক্তি। তার আগে থেকেই অর্থাৎ দশম শতাব্দী
থেকেই পারসিক সুফিসাধকগণ বাংলায় সুফিবাদের প্রচার
শুরু করেছিলেন। সেনশাসনের ওপর বিতৃষ্ণ এবং
বিপর্যস্ত বৌদ্ধরা সেই সুফিদের জিজ্ঞেস করল,
আমাদের বৌদ্ধধর্মে নারীর অনেক সম্মান। তা
আপনার ধর্মের নারীর অবস্থান কি?

সুফিরা হেসে বললেন, আমাদের ধর্মে মায়ের
পায়ের তলায় সন্তানের বেহেস্ত।

জন্ম হল বাঙালি মুসলমানের।

তবে অঞ্জনার মতো্ই তাদের হৃদয়ে রয়ে গেল
বুদ্ধের শিক্ষা।

এভাবে বাংলার মানবতাবাদী ধারাটি অব্যাহত রইল ...