১
এবারের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। একটি হল পদার্থ বিজ্ঞানে, নীল এলইডি (LED) বাতি আবিষ্কারের জন্য নাগয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসামু আকাসাকি, হিরোশি আমানো এবং বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারা ক্যাম্পাসের অধ্যাপক শুজি নাকামুরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যেই পত্রপত্রিকা থেকে নীল এলইডি বাতির প্রয়োগের ব্যাপারটা জেনে গেছেন।
এর মধ্যে যদি না জেনে থাকেন, তবে আমি বলব রাগিবের খুব সহজ সরল কিন্তু কাজের একটি লেখা থেকে জানুন। প্রিয় লেখক রাগিব হাসান চমৎকার একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেসবুকে। তার কথা উদ্ধৃত করেই বলি:
‘‘খুব কাছ থেকে দেখা এমন একজন বিজ্ঞানী ছিলেন আমার পিএইচ-ডি’র সময়কার ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় এট আরবানা শ্যাম্পেইনের নিক হলোনিয়াক। তিনি ছিলেন লাইট এমিটিং ডায়োড (LED) এর আবিষ্কর্তা। নোবেল বাদে সব পুরস্কার পেয়েছেন, এটাই খালি বাকি। তাই অক্টোবর এলেই ধরা হয় উনি পাবেন হয়তো। কিন্তু এখনও এবারেও তার ভাগ্যে সেটা জুটল না। কিন্তু জুটেছে নীল রঙের এলইডি বাতির আবিষ্কারক তিনজনের কপালে।
এলইডি বাল্বের নানা সুবিধা আছে, খুব ছোট, অনেক কম বিদ্যুৎ খরচ, আর আলো অনেক বেশি। কিন্তু নব্বইএর দশক পর্যন্ত ত্রিশ বছর ধরে গবেষণা করেও কেউ নীল এলইডি বানাতে পারেননি, কেবল লাল-সবুজই হত। ফলে বাসায় ব্যবহার করার মতো সাদা আলোর জন্য এলইডি বানাতে পারেননি কেউ। অনেকে তো এটাকে রীতিমতো অসম্ভব বলে রায় দিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু জাপানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন বিজ্ঞানী নব্বইএর দশকের শুরুতে অনেক খেটেখুটে নীল এলইডি বাতি বানাবার কৌশল বের করলেন। তবে সেটা ঠিক সস্তায় সহজে বানানো যায় না। এগিয়ে এলেন এক ছোট্ট ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির একজন প্রকৌশলী। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা ‘এইটা করা সম্ভব নয়’ বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার তোয়াক্কা না করে তিনি বানিয়ে ফেললেন খুব সস্তায় নীল এলিইডি বাতি। সবগুলা প্রাথমিক রঙ দিয়ে সাদা আলোর বাল্ব বানাতে আর বাধা রইল না।
সেই নীল এলইডি বাতির জয়জয়কার তখন থেকেই, সেটা নীল লেজার বানাতে, ব্লু রে ডিভিডি বানাতে, কিংবা অন্য নানা কাজে। আজকের এলইডি টিভি থেকে শুরু করে এলইডি বাল্ব, সেগুলার কোনোটাই সম্ভব হত না, যদি এই দুইজন বিজ্ঞানী আর এক প্রকৌশলী তাদের স্বপ্ন থেকে যেতেন পিছিয়ে, ‘বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞ’দের কথা বিশ্বাস করে এই কাজ করা অসম্ভব, তা ভেবে বসতেন।
অসম্ভবকে সম্ভব করাই, আপনার, আমার, মানুষের কাজ।”
LED টিভি থেকে শুরু করে LED বাল্ব, কোনোটাই সম্ভব হত না, যদি দুই বিজ্ঞানী আর এক প্রকৌশলী স্বপ্ন থেকে যেতেন পিছিয়ে।
পদার্থ বিজ্ঞানের এই খবরের বাইরে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংবাদ হল, এবার মেডিকেলে নোবেল পেয়েছেন তিনজন নিউরোসায়েন্টিস্ট– জন ও’কিফ, মে-ব্রিট মোসার ও অ্যাডভার্ড আই মোসার। এদের দুইজন নরওয়েজীয় বিজ্ঞানী (মে-ব্রিট ও অ্যাডভার্ড আই মোসার আসলে দম্পতি) এবং অন্যজন (জন ওকিফ) ইংল্যান্ডে কর্মরত আমেরিকান বিজ্ঞানী।
সিএনএনএর রিপোর্ট থেকে জানলাম, তিন বিজ্ঞানী মস্তিষ্কে কিছু কোষ শনাক্ত করেছেন, সেগুলির মাধ্যমেই নাকি আমাদের ‘ইনার জিপিএস’ গঠিত হয়। অর্থাৎ, আমরা কোথায় আছি, কী করছি, কোথায় চলেছি– আবিষ্কৃত এই কোষগুলির কাজের মাধ্যমেই নাকি তা নির্ধারিত হয়। এর ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্ল্যানিংএ সুবিধা হয়। আমার মাথায় এই কোষগুলো একটু কম আছে বলে আমার স্ত্রীর ধারণা। অবশ্য আমার প্ল্যানিংএর যে ছিরি তা দেখে এই সিদ্ধান্তে আসতে কারও আইনস্টাইন হওয়া লাগে না।
যা হোক, নোবেল পাওয়া এই তিনজন বিজ্ঞানীর কাছ থেকে আলঝেইমার্সে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাজকর্মও বোঝা সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। এখানে বলে রাখি, আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায় ক্ষেত্রেই কোথায় আছেন বা কী করছেন তা যে বুঝতে পারেন না হয়তো তার কারণ, তাঁদের মস্তিষ্কের এই জায়গাগুলোই বিনষ্ট হয় আগে। কে জানে!
এটি সত্য হলে এই তিন গবেষকের আবিষ্কার এবং কাজ হয়তো ভবিষ্যতে আলঝেইমার্সের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।
২
এবারে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ফরাসি লেখক প্যাট্রিক মোদিয়ানো। আমি ভদ্রলোকের কোনো বই পড়িনি, পুরস্কার পাওয়ার আগে তাঁর নামও শুনিনি। আমি সাহিত্যের মানুষ নই, বিজ্ঞান এবং দর্শনের জগতেই আমার পদচারণা বেশি। তাই আমার সাহিত্যের জ্ঞানশূন্যতার বিষয়টি পাঠকেরা ক্ষমা-ঘেন্না করে ছেড়ে দেবেন বলে আশা করছি। আমি এ বিষয়ে কিছু লিখব না আগেই ঠিক করেছি।
তবে সাহিত্যের ব্যাপারটা ছেড়ে দিলেও, এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিষয়টি নিয়ে কিছু লিখতেই হচ্ছে। বিশেষত আমার সাম্প্রতিক ফেসবুকের ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা আমাকে বাধ্য করছে এ নিয়ে দু’কলম লিখতে।
‘সারাদিন নর্দমা ঘাটা যার স্বভাব, ফুলের গন্ধ তার নাকে যায় না’– গান্ধী কি বলেছিলেন কথাগুলো? যে-ই বলুন, মালালা প্রসঙ্গে বাঙালির ফেসবুকীয় বুদ্ধিজীবিতার নমুনা দেখে আমার নিরেট মাথায় কেন যেন এ কথাগুলোই বার বার ঘুরেফিরে উঠে আসছে।
মালালা ইউসুফজাইয়ের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ের খবর পত্রিকায় আসার পর থেকেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শুরু হয়েছে নিরন্তর বাণী প্রক্ষেপণের মহড়া। এর মধ্যে আবার কেউ কেউ মালালা সম্বন্ধে একবিন্দু না জেনে তার কাজ কিংবা অবদান সম্বন্ধে জ্ঞান না রেখে গালির তুবড়ি ছোটাচ্ছেন অহর্নিশি– “একটা গুলি খায়াই নোবেল পায়া গেল?” কেউ বা বলছেন, “মালালা একটা গুলি কেয়ে নোবেল পাইল, আমারে কামান মার।” কেউ আবার বলছে, “একটা গুলি খাওয়া ছাড়া মালালার শান্তিতে কী অবদান আছে কইবেন কেউ?”
বেচারি মালালা! মাত্র সতের বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী হয়েও গালি খাচ্ছেন তালিবানদের, ইসলামিস্টদের, মৌলবাদীদের। পাশাপাশি, দেশপ্রেমিক বাঙালিদের, জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশিদের, সেক্যুলারিস্টদের, কমিউনিস্টদের। সবার!
তালিবানি ইসলামিস্ট ঘরানার লোকজন মালালার উপর কেন খ্যাপা তা বোধহয় বিশ্লেষণ না করলেও চলবে। কিন্তু অন্যরা? অন্যদের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং!
‘পাইক্কা-বিরোধী’ দেশপ্রেমিক বাঙালিরা, জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশিরা, সেক্যুলারিস্টদের কিছু অংশ খ্যাপা; কারণ পাকিস্তানের সবকিছুই তাদের কাছে হারাম, এমনকি তাদের কেউ ‘যদি ফুল নিয়ে আসে তবুও’। তাদের বাঙালিপনা এমনই যে উর্দু-ফার্সি শব্দ, মায় ভাষাও জঘন্য– যদিও তাদের অনেক কথাতেই উর্দু শব্দের আধিক্য চোখে পড়বে, রুনা লায়লার ‘দমাদম মাসকালান্দার’ তো বটেই, বলিউডি সিনেমার কিছু চোস্ত উর্দু ডায়ালগও তাদের ঠোঁটস্থ। তাতে কী? ‘পাইক্কার সঙ্গে সম্পৃক্ত’ যে কোনো কিছুতেই ‘গাইল’ দিতে হবে না? এদের কাছে তালিবান যা– আসমা জাহাঙ্গীর, পারভেজ হুদোভয়ও তা– ব্যতিক্রম নয় মালালাও।
সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী হয়েও মালালা গালি খাচ্ছেন তালিবানদের, ইসলামিস্টদের, মৌলবাদীদের, দেশপ্রেমিক বাঙালি, জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশিদের, সেক্যুলারিস্টদের, কমিউনিস্টদের-- সবার
কমিউনিস্ট আর বাম ঘরানার লোকজনের কাছে মালালার পুরস্কার কেবলই ‘পশ্চিমা পুঁজিবাদী চাল’ । এদের অনেকে নিশ্চিত, মালালাকে ‘খাড়া’ করা হয়েছে ইসলাম আর আইসিসের বিপরীতে ‘প্রোপাগাণ্ডা মেশিন’ হিসেবে। এদের মধ্যে একজন দেখলাম গ্রামসীয় হেজিমনি কায়দায় তত্ত্ব দিয়েছেন– ‘‘আইসিস আর ইসলামোফোবিয়ার দ্বন্দ্বে এবারের নোবেল পিস প্রাইজ হিসেবে মালালার নির্বাচন তাৎপর্যময়।’’
এবারে যারা মনে করেন গুলি খাওয়া ছাড়া মালালার কোনো অবদান নেই, তারা বোধহয় জানেনও না যে, গুলি খাওয়ার তিন বছর আগে, মাত্র এগার বছর বয়সে বিবিসির সাইটে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং তালিবানদের প্রচারণার বিরুদ্ধে ব্লগিং শুরু করেছিলেন মালালা। এত কম বয়সে ব্লগিং শুনে হয়তো অনেকে ‘অসম্ভব’ ভেবে নাক কুঁচকাতে পারেন, যেমনটি অনেকে কুঁচকেছেন আমার এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস ফেসবুকে দেবার পর। কিন্তু আমার অভিমত হল, এগার বছরের মেয়ে অবশ্যই ব্লগিং করতে পারেন। আর উদ্যোগটা যেহেতু বিবিসির, তাই তাকে ব্লগিং করতে সাহায্য করার লোক ছিল বিবিসি থেকে। বিবিসির উর্দুসহ ছাব্বিশটি ভাষার সার্ভিস আছে জানেন তো?
বলাবাহুল্য, মালালাকে কেউ গবেষণা-প্রবন্ধ লিখতে বলেনি; মালালা যা লিখছিলেন তা একটা ডায়েরির মতো। Gul Makai (পশতুন লোকগীতির এক বীর নারী) ছিল তার ‘পেন নেইম’। সেটা করা একেবারে অসম্ভব কিছু ছিল না মালালার জন্য। কারণ তিনি তার স্কুলের শীর্ষস্থানীয় ছাত্রী ছিলেন, প্রায় প্রতি বছরই প্রক্টর হিসেবে নির্বাচিত হতেন। যখন এ লেখাটা লিখছি তখন আমার হাতে এ বছর প্রকাশিত I am Malala বইটা ধরা। সেখানে স্কুলের অগণিত ট্রফি হাতে মালালার ছবিও আছে। ওর বাবা ছিলেন শিক্ষক, একসময় ছিলেন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল। তাই মালালার পক্ষে ইংরেজিটা রপ্ত করা সহজ হয়েছিল।
অবশ্য ব্লগিং যে মালালা করবেনই তা তিনি আগে থেকেই ঠিক করে রাখেননি। এই সময়টা এক বিশাল ক্রান্তিলগ্ন। সোয়াতের মতো পশতুন এলাকাগুলো আফগানি তালিবানরা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছিল। মেয়েদের স্কুল জোর করে বন্ধ করে দিচ্ছিল। তালিবানরা জায়গাগুলো দখল করে মেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিষিদ্ধ করতে থাকে; তাদের বাধ্যতামূলকভাবে নিকাব, বোরকা প্রভৃতি পরার জন্য চাপ দিতে থাকে। ঠিক এই সময়টাতেই বিবিসির পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে ব্লগিংএর। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রীদের কেউ রাজি না হওয়াতে অনেকটা বাধ্য হয়েই মালালাকে এ দায়িত্ব নিতে হয়।
মালালা অবশ্য শুরু থেকেই ছিলেন কিছুটা বিদ্রোহী; মুখঢাকা, বোরকা-পরার বিরুদ্ধে সোচ্চার। I am Malala বইটি থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি–
I told my parents that no matter what other girls did, I would never cover my face like that. My face was my identity. My mother who is quite devout and traditional, was shocked. Our relatives thought I was very bold (some said rude). But my father said, I could do as I wished. “Malala will live as free bird” he told everyone.
মালালা তার প্রথম ব্লগটি লিখেন ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে, I am afraid শিরোনামে। তালিবানদের বিরুদ্ধে ব্লগিং যখন শুরু করলেন, মৃত্যু-হুমকি পেয়েছিলেন অজস্র। তার লেখায় এমনই আক্রান্ত বোধ করেছিল তালিবানি জঙ্গিরা যে, যে বাসে করে মালালা স্কুল থেকে ফিরত সেখানে তারা হামলা করে বসে। দু’জন তালিবানি যুবক বাসে উঠে রাইফেল তাক করে তার সহপাঠীদের দিকে। তাদের বাধ্য করা হয় বাসের মধ্যে মালালা কোন জন সেটা চিনিয়ে দিতে। সহপাঠীদের একজন ভয় পেয়ে মালালাকে চিনিয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে ওরা।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তিন দিন মালালা সংজ্ঞাহীন ছিলেন। জ্ঞান ফিরেছিল ইংল্যান্ডে নেওয়ার পর। সেখানে সার্জারি করে তার গলার কাছ থেকে বুলেট অপসারণ করা হয়। তার মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ থামাতে খুলির কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে হয়েছিল।
যারা মালালাকে আজ উঠতে-বসতে গাল দিচ্ছেন, তাদের কেউ কি অনুধাবন করতে পারছেন যে, যে সময়টা হেসে-খেলে বেড়াবার বয়স, সেই কৈশোরেই কী রকম ‘চাইল্ডহুড ট্রমা’র মধ্য দিয়ে মেয়েটাকে যেতে হয়েছিল!শুধু এই কারণেই তো মালালা শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা পেতে পারেন আমাদের কাছ থেকে। তার আগের কিংবা পরের কাজ ও পুরস্কারগুলো– যেমন, নারীশিক্ষার জন্য মালালা ফান্ড গঠন, মৌলবাদ বিরোধিতা, ২০১৩ সালে ইউএনএ তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা, ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস পিস প্রাইজের জন্য ডেসমন্ড টুটুর নমিনেশন, শাখারভ পুরস্কার, টাইম ম্যাগাজিনের চোখে ২০১৩ সালের ‘অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তি’ নির্বাচিত হওয়া-– সেগুলো না হয় বাদ দিলাম।
যাহোক, অনেক হাবিজাবি স্ট্যাটাসের ভিড়ে শিবরাজ চৌধুরীর এই স্ট্যাটাসটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, এটি পড়তে অনুরোধ করি–
‘একটা গুলি খায়াই নোবেল পায়া গেল’, পাবলিকের কথায় মনে হয় গুলি খাওয়াটা মনে হয় খুব ইজি, যে কেউ খাইতে পারে। অক্টোবর ২০১২ তে মালালা গুলি খাইছিল। কেন খাইছিল সেইটা কি কেউ জানে? এইটুক একটু জানাই।
পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় যখন তালিবানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল, তালেবান কী করল? এরা খালি গোলাগুলি ছাড়া সবকিছুই ব্যান করতে পারে। মেয়েদের স্কুলের কথা তো বলাই বাহুল্য। এইসব যখন শুরু হইছে, তখন বিবিসি উর্দু চিন্তা করল যে ওইখানের আম আদমিরা কী ভাবতেছে সেইটা ফোকাসে আনা উচিত, এনোনিমাসলি। মালালার বাবা জিয়াউদ্দিন সাহেব একটা স্কুল চালান। তাঁর সাথে পরিচয় ছিল বিবিসি উর্দুর স্থানীয় প্রতিনিধির। তাকে বলার পর এই ব্যাপারে স্টেপ নেওয়া হল। কিন্তু তালেবানের ভয়ে কেউ রাজি হচ্ছিল না। আয়েশা নামের একটা মেয়ে, যে কিনা মালালার চেয়ে বয়সে বড় ছিল, সে প্রথমে রাজি হয়েছিল। পরে তার অভিভাবকরা পারমিট করে নাই। পরে জিয়া সাহেব রিস্ক নিয়ে নিজের মেয়েকেই এই দায়িত্ব দেন। মালালাকে তিনি ওই অস্থিতিশীল অঞ্চলেই নিজে পড়াতেন, অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন মালালার সাথে। মালালা ইংলিশ, উর্দু এবং পশতুতে ফ্লুয়েন্ট। যারা সমালোচনা করল, তারা ভুলে যাচ্ছে যে, সোয়াত উপত্যকা ছেড়ে উনি পরিবার নিয়ে করাচি, পিন্ডি চলে যেতে পারতেন। যান নাই কেন? জিয়া সাহেব নিজেও একজন এডুকেশন একটিভিস্ট।
যাই হোক, মালালা তখন ব্লগ লেখা শুরু করল। লিংক–
http://news.bbc.co.uk/2/hi/south_asia/7834402.stm
‘ডায়েরি অব আ পাকিস্তানি গার্ল’। মালালা মাত্র এগার বছর বয়সে করাচি প্রেসক্লাবে তালিবান শাসন নিয়ে বলেছিল। উইকিপিডিয়া থেকে তুলে দিলাম। ওখানে লিংক দেওয়া আছে।
‘‘How dare the Taliban take away my basic right to education?” Yousafzai asked her audience in a speech covered by newspapers and television channels throughout the region.
বিবিসির ব্লগ সূত্রে ওকে নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটা ডকুমেন্টারি বানাবে বলে ঠিক করল। যাই হোক, এইভাবে তালিবান মালালারে চিনল। এরপরে টার্গেট করল। দা রেস্ট ইজ হিস্ট্রি।
সুতরাং, মালালা খালি গুলি খায়াই নোবেল পায় নাই। সোয়াতের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে থেকে যে এতটুকু সাহস নিয়ে এগিয়ে এল তালেবানের বিরুদ্ধে, এত অনিরাপদ জীবন নিয়েও যে তারা ওই জায়গা থেকে নিরাপদ জায়গায় চলে যাবার কথা ভাবে নাই, এইসব নিয়ে দেখি কারও মাথাব্যথা নাই।
যাই হোক, এই বেলায় আরেকটু তথ্য দিই। মালালা গুলি খাবার আগেই সে চিলড্রেন রাইটস একটিভিস্ট হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ আফ্রিকার ডেসমন্ড টুটু (আমি নিশ্চিত, জাতি টুটুরেও চিনে না) ২০১১ সালে মালালাকে ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস পিস প্রাইজের জন্যে নমিনেট করেছিলেন। পুরষ্কার আরেকজন পেয়েছিল সেবার। তবে মালালার ব্যাপারে বলা হয়েছিল,
Malala dared to stand up for herself and other girls and used national and international media to let the world know girls should also have the right to go to school.
সুতরাং, আবালামি করার আগে একটু জাইনা নিলে ভালো হয়।’’
কৈশোরেই যে ‘চাইল্ডহুড ট্রমা’র মধ্য দিয়ে মেয়েটাকে যেতে হয়েছিল, শুধু এই কারণেই তো সে শ্রদ্ধা সহমর্মিতা পেতে পারে
হ্যাঁ, আবলামি করার আগে জেনে নিলে ভালো হয়, এমন উপদেশ শিবরাজ চৌধুরী দিচ্ছেন বটে, কিন্তু যাদের দিচ্ছেন তাদের কাছে এটা উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতোই। এরা জানার চেয়ে আমার আপনার চোদ্দগুষ্টি নিয়ে ‘গাইল’ দিতে ওস্তাদ। এত জানার সময় কোথায় এদের?
গত বছর টিভিতে জন স্টুয়ার্টের ‘ডেইলি শো’ দেখছিলাম বলে মনে আছে। সেখানে একটি পর্বে মালালাকে আনা হয়েছিল। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল– ‘‘তোমাকে যারা গুলি করেছিল, আবার যদি তাদের কারও সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয়, তবে তুমি কী বলবে?’’
উত্তরে মালালা বলেছিলেন-–
‘‘আমি বলব, মেয়েদের পড়ালেখার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তোমার মেয়ের শিক্ষার জন্যও আমি লড়ব।’’
আমরা বুড়ো হাবড়ারা যখন এ-ওর পেছনে লাগতে ব্যস্ত, ব্যস্ত কথার তুবড়ি ছোটাতে আর কিছু না পড়ে না জেনে ফেসবুকীয় বুদ্ধিজীবিতা জাহির করতে– তখন এই ষোল-সতের বছরের মেয়েটা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে কাজ করতে হয়।
আমি আমার স্ট্যাটাসটা ফেসবুকে দেওয়ার পর অবধারিতভাবে সেই স্পর্শকাতর বিষয়টিও উঠে এসেছে যে, যে পাকিস্তান, তার মিলিটারি ত্রিশ লক্ষ বাঙালির হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তার সবকিছু অস্বীকার করাটা দোষের কোথায়? এমনটি লিখেছেন এক ফেসবুক বন্ধু স্ট্যাটাসের মন্তব্যে। আমি বলব, কেউ কিন্তু অস্বীকার করছে না যে, পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। আমরা তার প্রতিবাদ করছি, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিও চাচ্ছি।
ঘৃণিত পাকসেনাদের বিচার দাাব করছি, দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও।
আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। বড় হয়েছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিমণ্ডলেই। তাই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ জিনিসটা এত সংকীর্ণ হবার কথা নয় যে, একটি সাহসী মেয়ে তালিবানদের বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ করছে, নারীশিক্ষার প্রসারে কাজ করছে, অথচ তাকে সাধুবাদ দিতে পারব না, প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হব! এটা করলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই অপমান করা হয়। আসুন বিশ্বমানব হতে শিখি। বাঙালিত্বের অপর নাম যে বিশ্বমানব হবার শিক্ষা– তা ভুলে যাই কেন?
আর যে সব বাম ঘরানার লোকজন মালালার পুরস্কারের পেছনে যথারীতি, ‘পশ্চিমা চক্রান্ত’-এর গন্ধ পাচ্ছেন, হেজিমনির ‘হেঁজেল’ গোঁফে তা দিয়ে ভাবছেন হঠাৎ করেই আইসিস ঠেকাতে এ বছর মালালাকে নির্বাচন করা হয়েছে নোবেলের জন্য, তারা জানেনও না যে, মালালার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল গত বছরই। সে সময় অনেক বিখ্যাত জন পিটিশন করেছিলেন মালালার পক্ষে। ২,৫৯,০০০ সাক্ষর জমা হয়েছিল সপ্তাহখানেকের মধ্যেই; এমনকি রিচার্ড ডকিন্সের মতো বিজ্ঞানীর পক্ষ থেকেও ক্যাম্পেইন করা হয়েছিল। ২৫৯ টি নমিনেশন পেছনে ফেলে মালালা এগিয়েও ছিলেন; কিন্তু তবু সেবার তিনি নোবেল কমিটির বিবেচনায় উত্তীর্ণ হননি।
তবে সবাই বুঝেছিল মালালার নোবেলপ্রাপ্তি কেবল সময়ের ব্যাপার। তাই এ বছর তিনি নোবেল পেলে সেটা ভুঁইফোড় হিসেবে অথবা ‘আইসিস ও ইসলামোফোবিয়া’ ট্যাকলের জন্য হবে কেন, তা আমার বোধগম্য হল না কোনোভাবেই।
অবশ্য এর মাধ্যমে আমি বোঝাতে চাইছি না যে, নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক নেই। অবশ্যই আছে। ওবামা, রুজভেল্ট, হেনরি কিসিঞ্জারের মতো লোকজন এই পুরস্কার পেয়েছেন, যা অবশ্যই বিতর্কিত। কিন্তু এ পুরস্কার তো মার্টিন লুথার কিং, শাখারভ, মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলাও পেয়েছেন, সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন? মালালা এ পুরস্কার পেলেন বলে পুরস্কারটা ‘ঘৃণিত’ হয়ে যাবে? নোবেল পিস প্রাইজের ‘কবর’ রচনা হবে তাতে? মালালার পুরস্কারে খুশি হতে না পারি, ঘৃণা করার মতো কিছু তো ঘটেনি।
আরেকটি ব্যাপার। মালালার এ পুরস্কারের প্রচার ও আর বিতর্কে কৈলাস সত্যার্থীর পুরস্কারপ্রাপ্তির ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। তার “বাঁচপান বাঁচাও” আন্দোলন ভারতের শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখনও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী অধিকারবঞ্চিত দিন কাটাচ্ছে। সেখানে যে কৈলাস সত্যার্থীর মতো লোকজন এ জন্য কাজ করে চলেছেন সেটাই আশার কথা।
তার চেয়েও বড় কথা, উপমহাদেশের দুই চিরশত্রু অন্তত একটি ব্যাপারে এক হয়ে পুরস্কার ভাগ করে নিতে যাচ্ছে– এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।