আর কয়েকটি দিন সবুর করুন, মঙ্গলই হয়ে উঠবে আমাদের ঘরবাড়ি! লাল গ্রহের জল-মাটি-মিথেন গ্যাস আর সাগরের জলের নুনই হয়ে উঠবে আমাদের এই নীল গ্রহের বাসিন্দাদের পরিচিত পরিবেশ। আমাদের বেঁচে থাকার জল-বায়ু। 'নেক্সট-জেন হিউম্যান সিভিলাইজেশন!' তার জন্য অনন্ত প্রতীক্ষারও দরকার নেই। আর কয়েকটা দশক। তারপর মঙ্গলেই গড়ে উঠবে মানবসভ্যতার 'দ্বিতীয় উপনিবেশ'!
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা নাসাই এ কথা জানিয়েছে। আর ১৫ বছরের মধ্যেই লাল গ্রহে মানুষ হাঁটবে বলে নাসার তরফে আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল। এবার বলা হলো, ২৫ বছরের মধ্যে কিভাবে মানবসভ্যতার 'দ্বিতীয় উপনিবেশ'টা মঙ্গলে গড়ে তোলা যায়, তার যাবতীয় পরিকল্পনা, প্রযুক্তি-প্রকৌশল আর নকশাও তিরিশের দশকের মধ্যেই চূড়ান্ত করে ফেলা হবে।
খাতাকলমে নাসা সেই পরিকল্পনার 'ব্লু-প্রিন্ট' প্রাথমিকভাবে প্রকাশ করেছে সদ্য প্রকাশিত একটি ডকুমেন্টে। যার নাম 'নাসা'স জার্নি টু মার্স-পাইওনিয়ারিং নেক্সট স্টেপস ইন স্পেস এক্সপ্লোরেশন'।
কোনো উল্লম্ফন নয়, নাসা চায়, ধাপে ধাপে এগোতে। অন্তত তিনটি পর্যায়ে। প্রথম ধাপটির নাম 'আর্থ রিলায়ান্ট'। মানে, লাল গ্রহে মানুষের 'দ্বিতীয় উপনিবেশ' গড়ে তোলার যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা-প্রস্তুতির কিছুটা হবে পৃথিবীতেই, গবেষণাগারে। মহাকাশচারীদের 'প্রেনিং ক্যাপসুলে'। তবে বেশির ভাগই হবে পৃথিবীর ৩৭০ কিলোমিটার ওপরে, মহাকাশে থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে।
দ্বিতীয় পর্যায়টির নাম 'প্রুভিং গ্রাউন্ড'। এর অর্থ বিভিন্ন সময়, দিনে বা রাতে অথবা বিভিন্ন পার্থিব 'ঋতু'তে সুগভীর মহাকাশে মহাকাশচারীদের পাঠিয়ে দেখা হবে, মঙ্গলের পরিবেশ, জল-বায়ু কখন, কতটা সহনীয় হচ্ছে মানুষের পক্ষে। এই পর্যায়টি এমনভাবে করা হবে যাতে মহাকাশচারীদের প্রয়োজনে খুব তাড়াতাড়ি এই গ্রহে ফিরিয়ে আনা যায়। এটা আদতে মঙ্গলে বসতি গড়ার আগে, 'প্র্যাকটিস পিরিয়ড'।
আর শেষ ধাপটিতে যাবতীয় পার্থিব নির্ভরতাকে 'গুড বাই' জানানো হবে। এই পর্যায়টির নাম 'আর্থ ইনডিপেনডেন্ট', যখন মানুষ গিয়ে কিছু দিন করে থাকতে শুরু করবে লাল গ্রহে। নাসা বলছে, মানুষ চাষবাসও করবে লাল গ্রহে গিয়ে। পানি শোধন করে তা পানযোগ্য করে তুলবে। আর নিয়মিত ও দ্রুত যোগাযোগ রাখার জন্য গড়ে তুলবে একেবারে সর্বাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। নাসা বলছে, আমাদের এই গ্রহের কারোর পাঠানো মেসেজের জবাব লাল গ্রহ থেকে পাওয়া যাবে। শুধু একটু সবুর করতে হবে। দূরত্বটা যে একটা 'ফ্যাক্টর'। মঙ্গলের মানুষের জবাব আমাদের কাছে পৌঁছতে সময় নেবে ২০ মিনিট।
তবে আমার আশঙ্কা মঙ্গল অভিযানের সকল চ্যালেঞ্জের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হবে মঙ্গলে গ্রহান্তরিত মানুষের সামাজিক মানবিক সহনশীলতা রক্ষা, পারস্পরিক মুল্যবোধ এবং চুড়ান্তভাবে মানবিক সম্প্রীতি রক্ষা করা যেটা আমরা পৃথিবীনামক এই নীল গ্রহটায় সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করতে পারিনি। নইলে এক মুহুর্তের সহিংসতায়, মুহুর্তের উচ্ছৃঙ্খলতা উগ্রতায় দাহ্য মিথেনপূর্ণ লালগ্রহটি মুহুর্তেই জ্বলে পুড়ে ধ্বংস হতে পারে, যেটা কারোর জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবেনা। তাই মঙ্গলে দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ার আগে তাকে পার্থিব জাতীগত বা ধর্মীয় বা আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক পারিবারিক ব্যক্তিক দ্বান্ধিক বিভেদ বিদ্বেষ ভুলে, একই মানবতার অভিন্ন আদর্শিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানব তোমার মঙ্গলযাত্রা এবং মঙ্গলবসতি শুভ হউক। মঙ্গল যেনো আমাদের পরিপূর্ণ অভিন্ন মানবতাবাদী আলোকিক সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার অবধারিত সেই প্রেরণাটুকু যোগাতে পারে, ২৫টি বছর খুব বেশী নয়, হয়তো দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে যাবে। প্রজন্ম সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় এখনি কাউন্ট ডাউন করতে পারে।।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত।