Friday, October 16, 2015

ধর্মানুভূতি, মিডিয়া ও অবাঞ্চিত নাস্তিক্য চিন্তা – ১, ২ বা শেষঃ



ধর্মানুভূতি, মিডিয়া ও অবাঞ্চিত নাস্তিক্য চিন্তা – ১

গত ১৪ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় ’৭১ টিভিতে ব্লগার এবং তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে যে সংলাপটা হয়েছে, তাতে সুস্পষ্টভাবে নাস্তিক্য চিন্তার প্রতি এক ধরণের বৈমা্ত্রিয় আচরণ দুই বিশেষ বক্তার বক্তব্য এবং আলাপে উঠে এসেছে। যদিও র‍্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদ মুক্ত চিন্তার একটা ব্যাখ্যা তুলে ধরতে চেয়েছেন, কিন্তু তার চেয়ে বেশি মুক্ত চিন্তার নামে হাতে গোনা গুটিকয় ব্লগারের ধর্মকে নিয়ে ক্যারিকেচারটাকে রঙ মাখিয়ে শ্রোতা-দর্শকের সামনে যেভাবে তুলে আনা হয়েছে, মুক্তচিন্তার ব্লগার হিসেবে তা আমাকে দারুণভাবে আহত করেছে।

আমি এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি, ব্লগিং সমাজ এবং ব্লগার শুধু এতে হেয় হয়নি, সে সাথে দেশে ধর্মীয় অশান্তি সৃষ্টি এবং উগ্র মৌলবাদীদের হাতে ব্লগারদের মারা যাওয়ার ঘটনাগুলোতে প্রকারান্তরে ব্লগারদেরই দোষী করা হয়েছে। অথচ সমস্যার ভেতরটা যে কত গভীর তারা তা জেনেও জানেন না। অথবা দোষটা এমন একটা শ্রেনীর প্রতি চাপিয়ে দিলে নিজেদেরকে দায়ভাগ থেকে নিরাপদ রাখা যাবে বলে মুক্তিবুদ্ধি চর্চার ব্লগাররাই সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছে। মুক্তিবুদ্ধি চর্চার ব্লগারদের এখন যে উভয় সংকট সেটা তারা স্পষ্ট করেন তাদের জোরালো বক্তব্য এবং আলোচনায়। হিংস্র ধর্মীয় উগ্রবাদীদের টার্গেট যেমন মুক্তমনা ব্লগাররা, আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্লগার এবং সরকারের টার্গেটও যখন মুক্তবুদ্ধির ব্লগাররা, তখন মুক্তমনাদের উভয় সংকট না বলে উপায় কি? ধর্ম নিয়ে রাজনীতির লেবাসটা এত উগ্রভাবে চোখে পড়ছে যে, মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে সবাই উদগ্রীব। অথচ মুক্তবুদ্ধির চর্চা থমকে গেলে, সভ্যতার এগুনো তো দূরে থাক, কোন দেশই প্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে না।

ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্ব অনেক আগেই ধর্মকে রাষ্ট্র এবং রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে অগ্রগতি এবং মুক্তচিন্তার বিকাশের স্বার্থে। কিন্তু বাংলাদেশ, তার সরকার এবং রাজনীতি যেভাবে দিনকে দিন ধর্মকে আঁকড়ে ধরে রাজনীতির খেলায় মেতে উঠছে, তাতে খুব করে আফগানিস্থানে তালিবানি পশ্চাৎপদ সময়ের কথাটাই মনে পড়ছে। সভ্যতার চাকাকে বেঁধে দিতে হলে, আপনাকে একটা আবদ্ধতার লেবাস লাগাতেই হবে, আর সে লেবাসে মুক্তবুদ্ধির চর্চাটা অবশ্যই নির্বাসিত।

মুক্তবুদ্ধির হতে হলে কোন পূর্ব বিশ্বাস বা মতবাদ মাথায় রেখে সম্ভব নয়। আর সে কারণেই মুক্তবুদ্ধির মানুষরা যুগে যুগে প্রচলিত বিশ্বাস বা মতবাদের লোকদের কাছে নিরন্তর নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে। মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষদের সমস্যার জায়গাটা হলো, তাদেরকে কোন রাখ-ঢাক না রেখে, কোন গোষ্ঠীর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির দিকে না চেয়ে, কোন রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষের চাপে না থেকে সত্যটাকে অকপটে উচ্চারণ করতে হয়। কেননা ঐসব বিষয়-আশয় গুলো তাদের মাথায় একদম থাকে না। তাতে ঝামেলাটা বেধে যায় গতানুগতিকতা (status quo)-র সাথে।

ব্রুনো, গ্যালিলিও-রা কেমন তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন অবলীলায় তাদের লব্ধ সত্যকে প্রকাশ করতে যেয়ে। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি আপনার জানাকে অবরুদ্ধ রাখবেন কি না কোন ধরণের চাপ, রাজনীতি বা হুমকির বশবর্তী হয়ে? অথবা আপনার মাঝে ভিন্ন চিন্তার উদয় হলে প্রচলিত ধ্যাণ, ধারণা বা বিশ্বাসকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবেন কি না? তাদের স্থায়ীত্ব সম্পর্কে সন্দেহবাদীতা প্রকাশ করবেন কি না? যদি প্রচলিত ধ্যাণ-ধারণা বা বিশ্বাস যথেষ্ট উদারতা পোষণ করে, তবে তারা আপনার এই প্রশ্নবাণ বা সন্দেহবাদীতাকে উষ্কানি না বলে সহিষ্ণুতার পরিচয় দেবে এবং আপনার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর দেবার চেষ্টা করবে। তারা একটা সমাধানে বা নিদেনপক্ষে শান্তিপূর্ণ বোঝা-পড়ায় আসার চেষ্টা করবে সুস্থ বক্তব্য এবং আলোচনার মাধ্যমে।


পক্ষান্তরে, যারা গতানুগতিকতাকে জিইয়ে রাখতে চায়, তারা তাতে যৎসামান্য সংস্কার দিয়েই শুরু করবে, যতটুকুই তাদের প্রয়োজন। তাদের হারাবার ভয়টা খুব বেশি। সৃজনশীলতা্র স্পর্শ টানতে তাদের বাধবে। গতানুগতিকতায় চালিত এই লোকগুলোরও প্রয়োজন আছে, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং কৌশলগত জগতে তাদের কিছু সমর্থক শ্রেণী তৈরি করা। এই সমর্থকরা আবার মুক্তবুদ্ধি চর্চার জগতের মানুষের মত সাত-পাঁচ না ভেবে কাজ করে না। তারা যথেষ্ট কৌশলী স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এবং সে অনুযায়ী বন্ধু-বিভেদ এবং গ্রহণ-বর্জনের সংজ্ঞা তৈরি করে দেয়।

’৭১ টিভি-কেও দেখা গেছে ঠিক সেভাবেই তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে দিয়ে তাদের সংলাপ সাজাতে। মান্যবর আইনমন্ত্রী, র‍্যাব প্রধান এবং বাংলা ব্লগ জগতের প্রতিনিধি হিসেবে ব্লগার অমি রহমান পিয়াল। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিলো, যেখানে তারা ব্লগার এবং ব্লগারদের নিরাপত্তা বিষয়ক কথা বলছেন, সেখানে যে ব্লগের তিনজন ব্লগার এই পর্যন্ত চরমপন্থী ধর্মীয় জঙ্গীদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সে ব্লগ থেকে কাউকে তাদের আলোচনায় অন্তর্ভূক্ত করা হলো না।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে যদি বলি, তবে দেখা যাচ্ছে অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, এবং নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল) ‘মুক্তমনা’ ব্লগের সাথে জড়িত ছিলেন, যদিও নীল ইস্টিশন ব্লগেরও ব্লগার। আমরা আরো জানি, এই ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিই রয়েছে চরমপন্থী মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রচন্ড আক্রোশ এবং ’৭১ টিভির সেই অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যারা প্রকৃতই মুক্তমনা বলে দাবীদার এবং সে কারণে প্রাণ-বিসর্জনও দিয়েছেন, তাদের প্রতিনিধিত্ব স্থানীয় কাউকে পেলাম না কেন?

অভিজিৎ রায় তার স্টেটাসে সুস্পষ্ট ঘোষনাই দিয়েছেন: “যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি। জামাত শিবির, রাজাকারেরা নির্বিষ ঢোরা সাপ না, তা একাত্তরেই আমরা জনেছিলাম। আশি নব্বইয়ের দশকে শিবিরের রগ কাটার বিবরণ আমি কম পড়িনি। আমার কাছের বন্ধুবান্ধবেরাই কম আহত হয় নাই।

থাবা বাবার মর্মান্তিক খবরে আমি ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, উন্মত্ত, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এক ফোঁটা বিচলিত নই। জামাত শিবির আর সাইদী মাইদী কদু বদু যদু মোল্লাদের সময় যে শেষ এ থেকে খুব ভাল করেই আমি বুঝতে পারছি। এরা সব সময়ই মরার আগে শেষ কামড় দিতে চেষ্টা করে। ৭১ এ বিজয় দিবসের দুই দিন আগে কারা আর কেন বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল শকুনের দল, মনে আছে? মনে আছে স্বৈরাচারের পতনের ঠিক আগে কি ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল ডাক্তার মিলনকে? এগুলো আলামত। তাদের অন্তিম সময় সমাগত। পিপিলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে!
বিজয় আমাদের অবশ্যাম্ভাবী।”

উপরের কথাগুলো যিনি বলে ফেলেন, তিনি নিশ্চয়ই গভীর এক সত্যকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলে এই রকম বলতে পারেন। আর এই গভীর সত্যকে অনুধাবন করাটা যে একেবারেই আমাদের এবং বিশ্ব ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে উঠে এসেছে সেটা পরিষ্কার। কিন্তু সেই সত্যকে অনুধাবন করার মত যথেষ্ট দূরদর্শিতা ’৭১ টিভির আলোচকদের কাছ থেকে আসেনি, এমনকি যার কাছ থেকে আসা উচিৎ ছিল নিদেনপক্ষে, সে অমি রহমান পিয়াল বিষয়টাকে সুস্পষ্টতা না দিয়ে বরং ‘মুক্তমনা’ শব্দটাকে সম্ভবতঃ অচ্ছুৎ কিছু একটা বোঝাতে চেয়েছেন।


একদিকে ওনারা বলছেন, কিছু ব্লগার ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর বা উস্কানীমূলক বক্তব্য দিচ্ছে বলে, সে সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মান্ধ মৌলবাদ এখন মুক্তিযুদ্ধ বা গণজাগরণ মঞ্চের স্বপক্ষের ব্লগারদের নাস্তিক বলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। চমৎকার। এখন তাদের এই বক্তব্যটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে এগুলে কেমন হয়?

যে দু’জন আক্রান্ত ব্লগারের লেখাতে ধর্ম নিয়ে ক্যারিকেচার করা হয়েছে, তারা হলেন, আসিফ মহিউদ্দিন এবং রাজীব হায়দার। তাদের কারণে নাস্তিকের কার্ডটা ব্যবহার করে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা আস্তিক-নাস্তিকের বিভেদ তুলে ধরে ইসলামকে ব্যবহার করে এক বিকৃত খেলায় মেতে উঠে। এই খেলা থেকে দু’টো বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে।

এক. নাস্তিকের ট্যাগ ব্যবহার করে কোন ব্লগারকে হত্যা করলে এই ধর্মভীরু দেশে মৃত ব্লগারের প্রতি জনসমর্থন বা জন-সহানুভূতির আক্রা দেখা দেবেই।

দুই. ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের মত সরকারও ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চায় নাস্তিক্যবাদের কোন স্থান বাংলাদেশে নেই। অর্থাৎ নাস্তিকরা এক পাপী শ্রেনীর, তাদের কোন স্বীকৃতি নেই। তাদের কোনরকমের স্বাধীনতা দেয়া উচিৎ নয়, বাক স্বাধীনতা তো নয়ই। বরং নাস্তিকদের প্রতি রোষানল নেমে আসাটা অন্যায়ের কিছু নয়, তা অবধারিতই। এমন একটা ম্যাসেজ সরকার খুব সহজে মিডিয়া ব্যবহার করে জনগণকে জানিয়ে দিচ্ছে। এটা যে সরকারের তরফ থেকে কত বড় অপমান, তা নাস্তিকরা ভালভাবে বুঝে। এটাও বুঝে বাংলাদেশে তাদের কোন স্থান নেই।

কিন্তু সমস্যার গভীরে গেলে বোঝা যায়, ধর্মকে নিয়ে ক্যারিকেচারের কারণ ধর্ম, এবং বিশেষ করে ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মান্ধ ধর্মগুরুদের কারণেই। আমি আগে এক লেখায় বলেছি, “মনে রাখতে হবে, একজন অন্য ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিক (নিরীশ্বরবাদী) বা সন্দেহবাদী মানুষের কাছে, নবী-রাসূলরা শ্রেফ একজন মানুষই, তাদের মাধ্যমে আসা ধর্মগ্রন্থ শ্রেফ একটা গ্রন্থ। যেমন, মুসলমানদের কাছে হিন্দু ধর্মের দেব-দেবী, রাম-শ্রীকৃষ্ণ যেমন, তেমনি হিন্দুদের কাছে মুসলমানদের নবী-রসূল আল্লাহ তেমন।” নাস্তিকদের নিয়েও তো কম ক্যারিকেচার করা হয় না। তখন কোন সমস্যা নেই। দুর্দান্ত বাজে মন্তব্যে জর্জরিত হয়ে নাস্তিকরা যদি তাদের সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারে, তবে ধর্মবাদীরা তা পারে না কেন?

এক ধরণের অবজ্ঞা এবং বিদ্রুপ এই হরে-কৃষ্ণ গোষ্ঠিদেরকেও ক্যানাডাতে করতে দেখেছি। সুতরাং এখন একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বা নাস্তিক ব্লগারের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যদি মনে হয়, ধর্মের কোন বাণী বা ধর্মীয় গুরুদেবদের কোন আচরণ হাস্যরসের উদ্রেক করছে, তবে সেটাকে নিয়ে সে ক্যারিকেচার করতেই পারে। সে তার দৃষ্টিভঙ্গিগত স্বাধীনতা।


আবার কোন ব্লগার যুক্তি-বুদ্ধি দিয়েই যখন অনুধাবন করতে পারে যে, খুব গুরুত্ব এবং ভারিক্কি বজায় রেখে ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রচার এবং প্রসার, আমাদের শিক্ষার আলো থেকে দূরে অবস্থিত ধার্মিক জনগোষ্ঠীর সুস্থ চিন্তা-ভাবনাকে মন্দভাবে প্রভাবিত করছে, সেক্ষেত্রে সে ব্লগারের ক্যারিকেচারের আশ্রয় নেয়াটা জনগণকে বিষয়টির অন্তঃসারশূণ্যতার প্রতি দিকপাত করার একটা প্রয়াস বলে প্রতীয়মান হতে পারে। এটা যেন ছোট বাচ্চার রাজা ন্যাংটা বলার মতই।

তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা তা উল্লেখ না করলেই নয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগণের তথাকথিত ধর্মীয় গুরুদের বীভৎস আচরণ বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে সাথে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের জনগণের জন্য মোটেই সুখকর নয় – চরম লজ্জার, কষ্ট-বেদনার নিষ্ঠুরতার। ’৭১-এ প্রায় সব ইসলাম ধর্মীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো কী অবলীলায় পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে বাঙ্গালির মুক্তিকে টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছিলো, সেটা যে কোন সংবেদনশীল তরুণকে ধর্মের প্রতি অনীহা তৈরি করাতেই যথেষ্ট। ইসলামের এই ধর্মগুরুরা গণিমতের মাল বলে নিজ দেশের মা-বোন-কন্যাদের জীবনকে দুর্বিসহ করেছে, এখনও সে শক্তি সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিধর হয়ে আছে, এতে করে কি ধর্মকে নিয়ে তরুণ প্রজন্মের কোন অংশ যুক্তিসংগতভাবে নিন্দা ছুঁড়ে দিতে পারে না? ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে একের পর এক গণহত্যা রাগী তরুণ সমাজকে, ধর্মকে নিয়ে ক্যারিকেচারে ঠেলে দিলে তার দায়-দায়িত্ব মূলতঃ ধর্মগুরুদেরই নিতে হবে। আওয়ামী সোনার সন্তানেরা দোষ করলে সেটা আওয়ামীলীগের উপরেই পড়ে।

অথচ আমাদের ধর্মগুরুরা তাদের সন্তান সমতূল্য, ক্ষেত্রবিশেষ নাতি সমতূল্যদের ধর্মকে অবমাননার নামে ফাঁসী চান। কাফের হত্যাকে যায়েজ বলে ফতোয়া দেন। অথচ ব্লগারদের সাথে নিদেনপক্ষে আলাপ-আলোচনায় বসতে রাজী হন না। রাষ্ট্রও থাকে নীরব যেন তার এক প্রছন্ন সমর্থন – ধর্মগুরু এবং ধর্মবাদীদের আনুকূল্যে ও আশীর্বাদে ক্ষমতাকে নির্বিঘ্নে শক্তকরণ এবং সে সাথে কৌশলে আগাম ভোট ব্যাংক তৈরিকরণ।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র “লালসালু”-তেও মোল্লাতন্ত্রের নিশ্ছিদ্র নিয়ন্ত্রণের ভেতরেও সূক্ষ্ম প্রতিবাদের প্রকাশ থাকে, তা যত ক্ষীণই হোক। অতএব মানবতার জাগরণ প্রয়াসে এক ধরণের শ্বাসরুদ্ধকর সৃজনশীলতাহীন, সৃষ্টিহীন বাস্তবতা্র নিরিখে, ধর্মকে আঘাত দিয়ে যদি কোন তরুণ তার ক্রোধের নালিশ জানিয়ে দেয়, তাকে নাস্তিকের ট্যাগে আক্রান্ত করা গেলে, ক্ষমতাসীন এবং ধর্মগুরুদের অন্যায় অসত্যকে ঢাকা দেবার একটা সুপরিকল্পিত ফন্দি তৈরি হয়ে যায়।


কবি নজরুলও ধর্মকে আঘাত দিয়ে জাগাতে চেয়েছেন, বেগম রোকেয়া আরো একধাপ এগিয়ে কথা বলেছেন, [“যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপে অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষ-গণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষোচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।” – “আমাদের অবনতি” প্রবন্ধ হতে]। আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত তো কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলেছেন, রামের বিপরীতে রাবণকে নায়ক করে রাবণায়ণ (মেঘনাধ বধ কাব্য) সৃষ্টি করেছেন।

সরকারের ভূমিকায় একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, যা অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়কেও অবলীলায় বলে ফেলতে হয়েছে, “… ব্লগার হত্যায় সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে।” [৪ জুলাই ২০১৫, বিডিনিউজ২৪ডটকম, http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article992145.bdnews]। নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের হত্যাকান্ডের পর সরকারের উপর ভেতর-বাহিরের চাপ পড়েছে, সেখানে সরকারের প্রমাণের প্রয়োজন হয়ে উঠেছে যে, তারা ধর্মান্ধ ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখার (appease) কাজে ব্যাপৃত নয়। সরকার এমন এক পরিস্থিতি নিজের জন্য তৈরি করেছে, যেখানে তাকে ধর্মান্ধ উগ্র ইসলামী মৌলবাদকে মেনে নিতে হচ্ছে (যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আওয়ামী ওলামা লীগ), আর অন্যদিকে প্রগতিশীল মুক্তমনা বুদ্ধিবৃত্তিক যে একটা ক্ষীণধারার সৃষ্টি হয়েছে, তাদের ক্ষুরধার লেখনীই যেন সরকারের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর ধর্মান্ধ মৌলবাদ মুক্তবুদ্ধি বৃত্তিক এই ক্ষীণধারাকে যথেষ্ট জোরালো মনে করে এর বিরুদ্ধে চাপাতিহস্ত হওয়াটা তাদের রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের মোক্ষম সুযোগ বলে ধরে নিয়ে এগুচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রধানতঃ তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে ভয়ংকর নাজুক অবস্থায় উপনীত করায়, এখন নাস্তিক-আস্তিক স্নায়ু যুদ্ধ-টা মোকাবিলায় কলমে পেরে না উঠে চাপাতিহস্ত হওয়া ছাড়া বিকৃত ঘৃণ্য মৌলবাদের আর কোন বিকল্পই খোলা নেই। বাংলাদেশে তাদের এই কোণঠাসা অবস্থা থেকে শৌর্য-বীর্যে উত্তরণ ঘটার অন্য কোন পন্থা এই মূহুর্তে আছে বলে আমার জানা নেই।


এটা ঠিকই অনুমেয়, মুক্তবুদ্ধির ব্লগারদের ধারালো যুক্তি-তর্কের কাছে পরাস্থ ধর্মীয় মৌলবাদ, তাদের জন্য অংশনি সংকেত বলে বুঝে নিলেও সরকারের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত তা মোটেও অস্বস্থিকর ছিল না, যতক্ষণ না ধর্মান্ধ মৌলবাদ চাপাতিহস্ত হয়ে কতলে নেমে পড়ে। হেফাজতের জঙ্গী কর্মকান্ড এবং আচরণ থেকে সরকার ভালভাবে উপলব্ধি করেছে, এদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন হতে হলে বা ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে হলে ধর্মীয় মৌলবাদের (সে যেমন ধরণেরই হোক না কেন) প্রতি বিনম্র থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর তাই, একদিকে ব্লগারদের সীমা অতিক্রম না করার ছবক দিচ্ছেন, অন্যদিকে ব্লগার হত্যা নিয়ে সরকার তাদের তদন্ত কার্যতঃ খুব জোরালোভাবে চলছে বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সরকারের এই নীতির পক্ষে জোরালো প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখতে তার বশংবদ শ্রেণীর প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

’৭১ টিভির অনুষ্ঠানটা সেদিকটাকে লক্ষ্য করে পুরোপরি সাজানো বলে মনে হয়েছে। আর নির্ধারিত আলোচক তিনজনও যেন তাদের বক্তব্যকে ঠিক সেভাবে সাজিয়েছেন। মান্যবর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তো সরাসরি সরকারী ভাষ্য তুলে ধরে বললেন, তাদেরকে জনগণের সাথে থাকতে হবে, জনগণের সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর র‍্যাব প্রধান তার চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চার উপর একটা ছোটখাট বক্তব্য দিয়ে শেষমেশ ব্লগারদের বিদেশ যাবার জন্য ইসলাম ধর্মকে নিয়ে গালাগালি এবং ক্যারিকেচার করার কারণ উল্লেখ করেছেন। তার অতীত কর্মকান্ডে সরকারী দলের স্বার্থ রক্ষা নিলর্জ্জভাবে উঠে এসেছিল, বর্তমানও যে তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়, সেটা বোধগম্য। যিনি এত বড় বড় কথা বলেন, তার তো বোঝার অগম্য নয় যে, তিনি যেভাবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, সেভাবে উন্নত বিশ্বের উর্ধ্বতন পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা করে না। ব্লগারদের কর্মকান্ডকে যিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, তিনিই বা কতদূর সরকারী দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করছেন, সেটাই বিবেচ্য।

সবচেয়ে আপত্তিকর এবং বিব্রতকর ঠেকেছে, যখন ব্লগারদের প্রতিনিধি হয়ে আসা অমি রহমান পিয়ালও সরকারের সেই একই সুরকে গলায় তুলে প্রতিবাদী যুক্তিবাদী মুক্তমনা ব্লগারদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে পরিচয় করিয়ে দেন ৯ বছরের অধিককাল মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধ নিয়ে লেখা একজন ব্লগার হিসেবে। যখন র‍্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদ বলেন, তার দৃষ্টিতে ব্লগাররা শুধু ইসলাম ধর্মকে আক্রমণ করে লিখেন, তখন অমি পিয়ালের কাছে তথ্য এবং বক্তব্য থাকে না যে, চাপাতিতে নিশ্চিহ্ন হওয়া প্রাণ, অভিজিৎ রায়, নিলয় নীল শুধু ইসলামকে নয়, হিন্দুধর্মসহ অন্যান্য ধর্মগুলোকেও সমালোচনার মুখে ফেলেছেন, চ্যালেজ্ঞ ছুঁড়ে দিয়েছেন। অনন্ত বিজয় দাসও যুক্তি-তর্ককে মূখ্য করে বিজ্ঞানমনস্ক লেখালেখি করেছেন।





র‍্যাব প্রধানকে মনে হয়েছে, তিনি একটা এজেন্ডা নিয়ে এসেছেন, আর তাহলো ব্লগারদের বাজে-ভাবে ইসলাম বিরোধী হিসেবে দাঁড় করাতে পারলে, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীদের তদন্তে অগ্রগতির ব্যর্থতাকে ঢেকে দেয়া এবং সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে হাসিল করার প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করা। হেফাজতে ইসলামীর মতিঝিল জমায়েতের ঘটনার পর, সরকার ইসলামী মৌলবাদী শক্তির সাথে যে আপোষরফা এবং সন্তুষ্টি বিধানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তাতে অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুকে একটা প্রচ্ছন্ন উত্তাপহীন আবরণে জড়িয়ে রাখলে সাপেও মরে, লাঠিও থাকে অভঙ্গুর।

এই মৌলবাদী শক্তির বর্তমান প্রাণপুরুষ আল্লামা শফী হুজুর কাফের/নাস্তিক হত্যা যায়েজ বলে ফতোয়া দিয়ে আইনকে হাতে তুলে নেবার মত বর্বরতার প্রচারণা করলে সরকার চুপ থাকে, ততদূরই চুপ যতদূর ব্লগার হত্যা সরকারের কাছে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কিছু নয়। তবে দেশি-বিদেশী চাপ এলে তা মোকাবিলা করতে জনগণ এবং বিদেশী শক্তির চোখ-পরিষ্কার (eye-wash)-এর প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

আর তাও যদি যথেষ্ট না হয়, তবে সাথে থাকা উচিৎ সরকারী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মীগণ। নাট্য সংস্থাগুলোরও প্রয়োজন হয়ে পড়ে আবার শহীদ মিনার সমাবেশে, যে শহীদ মিনারকে আমরা জেনে এসেছি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্তবুদ্ধির স্বপক্ষে চারণভূমি। সেখানে ব্লগারদের কাছে সরকারী মতামতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঘোষণা আসে, বাক-স্বাধীনতা যেন ‘ধর্মানুভূতি’-কে আঘাত না করে। এখন ধর্মানুভূতিটা কি এবং এটার ব্যাখ্যাটা কিভাবে করি? মানুষের সামান্যতম বাঁচার অনুভূতি বা সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মর্যাদার অনুভূতি পদে পদে নিষ্পিষ্ট হলেও ধর্মানুভূতিটা যে করেই হোক অটুট রাখতে হবে। সব দেখে-শুনে আমার মনে হচ্ছে, যে জাতি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, নৈতিকতায় যত অনুন্নত তাদের ধর্মানুভূতির ভণ্ডামিটা তত শির উচ্চ। লেখক হুমায়ুন আজাদ বা বাংলাদেশী ক্যানেইডিয়ান গণিতজ্ঞ লেখক মীজান রহমানও যথেষ্ট বলেছেন, সেখানে আমার নতুন কিছু বলার নেই।

আমি সাদা-মাটা যা বুঝি, সেটা হলো, একটা শিশু যখন মুক্তভাবে বেড়ে উঠে ব্যক্তি, সমাজ এবং পারিবারিক প্রভাবমুক্ত হয়ে, তখন তার মাঝে একটা স্বতঃস্ফূর্ত মানসিকতার সৃষ্টি হয়। আর তাহলো, সে তার পারিপার্শ্বিক সব কিছু সম্পর্কে নির্দোষ প্রশ্ন রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিবিধ কারণে, বিবিধ চাপের মুখে পড়ে শিশুকে তার মত করে বাড়তে দেয়া হয় খুব কম। বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা-ব্যবস্থা সেক্ষেত্রে আরো অনেক দূর বিস্তৃত শিশুর স্বাতন্ত্র্য জিজ্ঞাসাগুলোর যুক্তিনির্ভর উত্তর দেবার ব্যাপারে। ধর্ম এমনভাবে আমাদের উপর চেপে বসেছে, এই নিয়ে আদৌ প্রশ্ন করা সম্ভব যদি না হয়, তবে সেটা মানুষের বিকাশ এবং সভ্যতার অগ্রগতিতে বড় এক বাধা এবং সমস্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

ফেসবুকে কাজী রায়হান রাহীর সাথে বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ফারাবী শফিউর রহমানের সাথে একখন্ড কথোকপথনের ঘটনার কথা আমরা জানি। নবীজির মৃত্যুর পর তার অল্পবয়সী স্ত্রী-রা পুনরায় বিবাহ করেছে কীনা এমন ধরণের প্রশ্ন রাহী রেখেছিলো। কিন্তু এই প্রশ্ন করায় নবীজির স্ত্রীদের সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য করা হয়েছে বলে রাহী-কে দায়ী করা হয়েছিলো। বাংলাদেশ সরকারও এই ধর্মান্ধ মুসলিম মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করতে রাহী-র মত অল্পবয়সী তরুণকে সেইসময় গ্রেফতার করে এবং জামিন না দিয়ে নিজেদের রাজনীতিকে উগ্র মৌলবাদ বান্ধব করে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে। আর সেই সরকারের মাননীয় মন্ত্রী যখন জনগণের সাথে থেকে তাদের ধর্মানুভূতি রক্ষার কথা বলেন, তখন সেটা একধরণের অন্ধত্ববাদিতার পদলেহন করে তাকে জিইয়ে রাখার করুণ-ভব্যতা বহির্ভূত অপপ্রয়াস ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।






ধর্মানুভূতি, মিডিয়া ও অবাঞ্চিত নাস্তিক্য চিন্তা – ২

যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞান ছাড়া এই মানব সভ্যতা এগুতে পারে কি? সেটা যদি নাই হয়ে থাকে, তবে ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ দিয়েই রোগ-বালাই দূর করার চেষ্টা চালানো যেতে পারে। নিউটনের আপেল মাথায় না পড়ে উড়ে গেলো না কেন, এমন চিন্তাটাই মুক্তমনা হওয়ার প্রধান লক্ষণ। প্রচলিত ধ্যাণ-ধারণা এবং বদ্ধতার বাইরে ভাবেন বলে, আমরা পদার্থবিদ্যার জগতে আইনস্টাইনকে পাই, আর জীববিদ্যার জগতে ডারউইনকে। বলা হচ্ছে যে, জীববিজ্ঞান ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত – এর স্বপক্ষে রয়েছে হাজারো উদাহরণ। ক্যানাডার টোরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে পড়ুয়া আমার বোনঝিও যখন বলে, “Life science is based on evolution theory”, বাংলা ব্লগের কোন এক মহারথী বিবর্তনবাদকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে উঠে পড়ে লাগেন, তখন তার জ্ঞানের দৌরাত্ম কতটুকু, তা নিয়ে আর প্রশ্নের অবকাশ থাকে না।

রিচার্ড ডকিন্স মূলতঃ একজন জীববিজ্ঞানী। তিনি তার জ্ঞানের আলোকে ধর্মকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, এবং সবই দিয়েছেন নিজের পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে। সুতরাং তার রেফারেন্স টেনে কথা বলাটা তাকে নবী-র স্তরে উন্নীত না করে বলা যেতে পারে, বিজ্ঞানসম্মত তার বিশ্লেষণকে উদ্ধৃত করা। মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানের যতদূর অগ্রগতি হয়েছে, এখন পর্যন্ত কেউই কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কোন ধর্ম বা ধর্মীয় গ্রন্থের কোন বিষয়-আশয়কে রেফারেন্স হিসেবে উপস্থিত করতে পারেন নি। এইখানে ধর্ম সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আর সম্ভবতঃ এই কারণেই এমেরিকার সংবিধানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা পুরোপরি নিষিদ্ধ। আমরা বিবর্তনবাদ নিয়ে পড়াশুনা করবো (যদিও বাংলাদেশে বিবর্তনবাদ নিয়ে যে পড়াশুনা হয়, তাকে আধা-খ্যাঁচড়া বললে অত্যুক্তি হবে না), আবার বিপরীত দিকে বিবর্তন মনস্ক চিন্তাধারাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবো, তাতো হতে পারে না! তবে কি বিবর্তনবাদ মিথ্যা বা বিবর্তনবাদের মত এমন একটা বিদ্‌ঘুটে তত্ত্ব এই জগতে প্রচলিত আছে, সেটা জানার জন্য আধা-খ্যাঁচড়াভাবে বিবর্তনবাদ পড়ছি? অদ্ভূত তো! পড়ারই বা দরকার কি?

আপনি দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ চাইবেন, আবার বিপরীতে যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে চাপাতিহস্ত হবেন, অথবা চাপাতিহস্তদের ফাঁদে পা দিয়ে তথাকথিত আস্তিক-নাস্তিকের বিভেদের ফর্মূলায় উঠতে-
বসতে নাস্তিকদের মুন্ডুপাত করবেন, এ কেমন কথা! নাস্তিক হওয়াটা ইসলাম ধর্মে অন্যায় হতে পারে, ইসলামধর্ম ত্যাগীরাও ধর্মের চোখে অত্যন্ত পাপী হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র! সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কি এমনি এমনি অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলো এই কালে? একটা কথা আমি বারে বারে বলি, এখনও বলছি, এই পৃথিবীতে মানুষের স্থায়ীত্ব যত দীর্ঘ হবে, মানুষ যতই সম্মুখ পানে ধাবিত হবে, স্বভাবতঃই মানুষ তার আশ-পাশের সবকিছুকে নিয়ে প্রশ্ন করবে, কষ্টিপাথরে যাচাই করবে এবং চ্যালেজ্ঞ করবে। বিজ্ঞান তাই করছে। এতে নির্দয়-নিষ্ঠুরভাব ধর্মগ্রন্থগুলোও বাছ-বিচারের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি বাণী, বাক্য, শব্দ, বর্ণ মানুষের পরীক্ষণ-নিরীক্ষণের কবলে পড়বে। মানুষের সীমা সীমিত, সেই সীমিত সীমায় সে অসীমের শক্তিকে বুঝবে কীভাবে, এধরণের গাল-গল্পে মানুষের মন ভরছে না, ভরেনি কখনো বলেই সবকিছুতেই প্রশ্ন রেখে উত্তর খোঁজা হচ্ছে, সে ধারাবাহিকতায় বিশ্বসভ্যতা এগুচ্ছে। এখানে অন্ধত্বের কানাকড়ি মূল্য নেই।

এই সত্যটা ব্লগার, ব্লগ জগতের একটা অংশ অনুধাবন করতে পারছে বলেই তারা মুক্তবুদ্ধি চর্চার জয়গান করছেন, সাহস দেখাচ্ছেন তাদের মতামত প্রকাশে। কিন্তু আরেকটা অংশ বিবিধ কারণে ধর্মের প্রসংগ এলেই, নিজেদের বাক্‌ স্বাধীনতাকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। ধর্ম নিয়ে কোন প্রশ্ন বা চ্যালেজ্ঞ চোখে পড়লে তারা তার থেকে শত হাত দূরত্বে থাকার নীতি অবলম্বন করছেন। পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধির চর্চার সেসব ব্লগারকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। আর নাস্তিক্যবাদের ছিঁটে-ফোঁটা দেখলে তো কথাই নেই, গালি-গালাজ, নিন্দায় চরমে উঠছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানে নাস্তিক্যবাদ অলিখিতভাবে এক অপরাধমূলক আইন বলে সংশোধনী হিসেবে যুক্ত হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। আপনি নাস্তিক হলে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিবিধ নৃ-গোষ্ঠীর চেয়েও নিম্নমানের নাগরিক অধিকারপ্রাপ্ত হিসেবে পরিগণিত হবেন। এ যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের কাছে ইহুদীরা যেমন। আপনার নাগরিক অধিকার আদৌ আছে কী না সেটাই এখন বিবেচ্য। না, আপনি এখানে অচ্ছুৎ, কোনভাবেই আপনাকে বাংলাদেশের নাগরিক বলা যাবে না। বাংলাদেশে আপনার আদৌ স্থান নেই। এইজন্যই আপনার নিরাপত্তা না দিয়ে, আপনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পুলিশ মহোদয় উপদেশ দিচ্ছেন, সরকার জেনে-শুনেও আপনার নিরাপত্তা দেবেন কোন দুঃখে। তাকে তো অন্ধ ধর্মীয় মৌলবাদকে পাশে নিয়ে চলতে হয়। নতুবা সরকারের পায়ের তলায় মাটি থাকে না। এমনই একটা ধর্মীয় গোঁড়ামীর জালে বাংলাদেশ আবদ্ধ যে, এ থেকে নিস্তার পেতে হলে ‘জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি’ করতে হয় বৈকি!

অচলায়তন ভাঙ্গার সময় হয়েছে বলেই অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয়-কে জীবন বিসর্জন দিতে হয়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে লেখালেখি করি বলে ব্লগ জগতের মহারথী ’৭১ টিভি মিডিয়ায় নিজের গৌরব প্রকাশের দম্ভ দেখান, অথচ মুক্তিবুদ্ধি প্রচারের স্বাধীনতা রুদ্ধ হওয়াটা তিনি চোখ মেলে দেখেও দেখেন না। ৪৪ বছর আগের বাস্তবতা নিয়ে তিনি তার কলমে ঘাম ঝরান, কিন্তু বর্তমানের সংকটকে দেখেও সযত্নে, স্বার্থবাদিতায় জড়িয়ে যান। হয়ে উঠেন সরকারের বশংবদ।

’৭১-এর ধারবাহিকতায় সমাজ, মানুষ এবং সভ্যতার অগ্রগতির জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করে এ পর্যন্ত যারা শহীদ হয়েছেন বর্তমান সময়ে অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয় অগ্রগণ্য হয়ে থাকবেন। তারা বাংলাদেশের জনগণের দেখায়, শোনায় এবং চিন্তায় নতুন ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার প্রয়াস পেয়েছেন। জনগণের চোখ-কান এবং মননে যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরিতে ছিলেন সজাগ সৈনিক। ’৭১-এ স্বাধীনতাই আমরা অর্জন করেছি, কিন্তু আমাদের মুক্তবুদ্ধির বিকাশে যে বন্ধ্যাত্ব চলছিল, তাতে তারা নাড়া দিয়েছেন বলেই হুমায়ুন আজাদ-এর মতই মৌলবাদের ক্রোধান্ধের বলি হলেন।

বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডে সব ধরণের অনুভূতি নিষ্পিষ্ট, জর্জরিত হলেও শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুভূতিটা বড় বেশি অটুট রাখাটা জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম পূর্বে কখনো এমন ধরণের কোন সংকটে নিপতিত হয় নি। ’৭১-এর আগে ও পরে বাম-রাজনীতির কমিউনিস্টরা ধর্মকে অস্বীকার করলেও ইসলাম বা অন্য কোন ধর্ম তখনও এমন সংকটে পড়েনি। এখন দু’চারজন ব্লগার তাদের লেখনীতে ইসলাম ধর্মের জন্য এমন সংকটের সৃষ্টি করেছে যে, একে ইনকিউবেটর বা ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট (নিবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষে)-এ রাখা ছাড়া উপায় নেই। বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের ধর্মানুভূতি এখন দারুণভাবে বিপর্যস্ত। পাইক-পেয়াদা দিয়ে তাকে সংরক্ষণ করতে হবে। পাইক-পেয়াদা ও তাদের হর্তাকর্তা সরকার বেশ উদাসীন ছিলেন বলে চাপাতি-প্রাণ কিছু মুমিন মুসলিম নাস্তিক-কাফের ব্লগারদের উপর ধর্মীয় আক্রোশে চাপাতিহস্ত হয়েছেন এবং কাপুরুষের মত জান-কবচ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জানি না, আজরাইলের অংশগ্রহণ কতটুকু ছিলো সে জান-কবচে, আমার জানার খুবই ইচ্ছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই ধর্মানুভূতিতে আঘাত নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।


ডারউইন ধর্ম পালন করতেন কী না জানি না। কিন্তু তার বিবর্তনতত্ত্ব ভীষণভাবে ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছে, ধর্মগুলো সম্পূর্ণভাবে চ্যালেজ্ঞের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কোন বক্তব্য আছে কী না, জানা নেই। বিগত ১৫০ বছরে ডারউইনের সেই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ধর্মের প্রতি সেই চ্যালেজ্ঞ এমন এক পর্যায়ে উন্নীত যে, “১৯৯৫সালে আমেরিকার বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের মধ্যে চালানো জরীপে (Gallup poll, 1995) দেখা যায় এদের মধ্যে মাত্র ৫% সৃষ্টিবাদী, বাকি সবারই আস্থা আছে বিবর্তন তত্ত্বে। আর যারা জীববিজ্ঞান এবং প্রাণের উৎস নিয়ে গবেষণা করেন তাদের মধ্যে তো ইদানিংকালে সৃষ্টিবাদীদের খুঁজে পাওয়াই ভার। ৪,৮০,০০০ জন জীববিজ্ঞানীদের উপর চালানো জরিপে মাত্র ৭০০ জন সৃষ্টিতাত্ত্বিক পাওয়া গেছে, শতকরা হিসেবে যা ০.১৫ এরও কম। কিন্তু এদের মধ্যে আবার অনেকেই প্রাণের প্রাথমিক সৃষ্টি কোন এক সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমে হয়েছে মনে করলেও তারপর যে প্রাণের বিবর্তন ঘটছে প্রাকৃতিক নিয়মেই তা মেনে নেন। এ জরিপের ফল শুধু আমেরিকার ভেতর থেকেই উঠে এসেছে, যে দেশটি আক্ষরিক অর্থেই ‘সৃষ্টিবাদীদের আখড়া’ হিসেবে পরিচিত এবং রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে অনেক বেশী রক্ষণশীল। এদিক দিয়ে অনেক বেশী প্রগতিশীল থাকা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোন সৃষ্টিবাদী বিজ্ঞানী নেই বললেই চলে।

বহু বৈজ্ঞানিক সংগঠন বিবর্তনের স্বপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণকে এতই জোরালো বলে মনে করেন যে, বিবর্তনের সমর্থনে তারা নিজস্ব statement পর্যন্ত প্রকাশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত National Academy of Science এর মত প্রথিতযশাঃ সংগঠন ১৯৯৯ সালে বিবর্তনের স্বপক্ষে লিখিত বক্তব্য দিয়ে একটি ওয়েবসাইট পর্যন্ত প্রকাশ করেছে। ১৯৮৬ সালে লুজিয়ানা ট্রায়ালে বাহাত্তর জন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী সুপ্রিম কোর্টে বিবর্তনের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন প্রদান করেছিলেন।

জীববিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জিনোমিক্স বা আণবিক জীববিদ্যার কোন শাখাই বিবর্তনের কোন সাক্ষ্যের বিরোধিতা করছে না; … ডারউইনের পরে গত দেড়শো বছরে … বিবর্তন তত্ত্ব পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত হয়েছে। জেনেটিক্সের বিভিন্ন শাখার গবেষণা যে গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে আশা করা যায় আমরা অচিরেই আরও অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পেতে সক্ষম হব। আর বিজ্ঞানীরা সে লক্ষ্যেই নিরন্তর কাজ করে চলেছেন।” [বিবর্তনের পথ ধরে (পরিশিষ্ট), পৃষ্ঠা ২২-২৩, বন্যা আহমেদ]।

সৃষ্টিবাদী তাদেরই বলে, যারা মনে করে, বিশ্বের এই তাবৎ প্রাণীকূল কোন এক সৃষ্টিকর্তার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। উপরের উদ্ধৃতি থেকে ভালভাবেই প্রতীয়মান যে, বাংলাদেশ এবং তার জনগণ বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে এখনো যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করার মত মানসিকতায় উপনীত হয়নি। আর এ কারণেই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের নগ্ন ফ্যাসিবাদী আচরণ এই ভূ-খন্ডে নির্মম হয়ে উঠেছে। দু’টি বিরুদ্ধ মত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকার যে দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হবার প্রয়োজন, সেই সংস্কৃতি থেকে আমরা অনেক দূরবর্তী। আমাদের ইসলাম ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, এই উদ্যত-উগ্র মনোভাব ভিন্নমতের বিকাশের পেছনে বড় অন্তরায়।

সে সাথে যারা প্রতিনিয়ত নতুন জ্ঞান এবং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সভ্যতাকে হৃদ্য করছে, তাদের বেড়ে ওঠার, বেঁচে থাকার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এই উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ। রাষ্ট্র নিজেকে এতই দুর্বল করে তুলেছে যে, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে বেরিয়ে এসে এই নষ্ট ধর্মীয় মৌলবাদীতার সাথে আপোষকামী হয়ে উঠেছে। অথচ আমাদের ‘৭১-এর স্বাধীনতার মূলনীতি থেকে সেটা অনেক দূরে সরে আসা। এর জন্য দায়ী কে? সেটা হবে ভিন্ন এক আলোচনা। রাষ্ট্রকে এতটুকু সতর্ক থাকা উচিত যে, হিটলারেরও জার্মানীতে বিপুল জনসমর্থন ছিল। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও সে সময় সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। বর্তমান সরকার যদি এই অন্ধ মৌলবাদী জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ছক আঁকে, তবে তা সেরকম রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় পরিবেশের দিকে আমাদের ঠেলে দেবে, যার ফলাফল হিটলারের জার্মানীর মত ভয়াবহ না হলেও তালেবানী আফগানিস্থানের মতই হবে ভয়াবহ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্মবাদী ধার্মিক এবং যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তমনারা সহ-অবস্থানের নীতিতেই চলছে সব ধরণের সংঘাত এড়িয়ে। বাংলাদেশে তা সম্ভব না হওয়ার জন্য দায়ী অন্ধ মৌলবাদী জনগণ এবং তাদের সরকার। আর তাই এই জনগণের সেন্টিমেন্ট বুঝে চলার নীতিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশের সরকার, মিডিয়ায় মন্ত্রী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ব্যক্তিদের প্রকাশ্য বক্তব্য তারই প্রমাণ দিচ্ছে অনায়াসে।


বিজ্ঞান যুক্তি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এসব কিছুই মুক্তমন এবং মুক্তবুদ্ধিতেই করতে হয়। যে কোন পূর্বতর সংস্কার এবং আবদ্ধ বিশ্বাস আমাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির লাগাম টেনে ধরাটাই খুব স্বাভাবিক। সৃষ্টিশীল এবং সৃজনশীলতার বিকাশে পরিপূর্ণ স্বাধীন চিন্তা ভীষণ অপরিহার্য। সুতরাং নবীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনায়, পুরাতন সব কিছুই চ্যালেজ্ঞের মুখোমুখি হবেই। এতে আপনার জন্ম থেকে প্রাপ্য লালিত বিশ্বাসীয় অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হয়, দায় আপনারাই। এ নতুন কালের বাস্তবতায় আপনাকেই আপনার অনুভূতি্র রাশ টেনে ধরতে হবে। আপনার প্রাচীন এই অনুভূতিকেই যুগের বাস্তবতায় তাবৎ প্রশ্ন এবং চ্যালেজ্ঞের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। অন্যের চিন্তার রাশ টানার অধিকার আপনাকে সংবিধানে দেয়া হয় নি। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত বিশ্বে, স্বাধীন মত প্রকাশকে অনেক আগেই যায়েজ করা হয়েছে।

একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, স্বনামধন্য জহির রায়হানও এই ইসলামী মৌলবাদীদের চরিত্র নিরূপণ করেছিলেন, তার ছাত্রাবস্থায়, “ … আজকের যুগে জন্মগ্রহণ করেও এ যুগের সাথে তারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। বিজ্ঞানকে তারা অবজ্ঞা করছে। দর্শনকে করছে অস্বীকার। যুক্তিতর্ক মানতে তারা কোন সময়েই প্রস্তুত নয়। অন্ধ ভক্তির দর্শনে সকল যুক্তিকে নস্যাৎ করার জন্যে এরা সব সময় খড়গ হস্ত। বৈজ্ঞানিক ও সুচিন্তিত যুক্তিতর্ক নিয়ে যদি কেউ এদের সম্মুখীন হয় – তাহলে ভয়ে এদের বাকরুদ্ধ হয়, বুক দুরু দুরু করে, নাভিশ্বাস উঠে। তখন দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এরা চিৎকার করে বলে উঠে, ‘আমরা যা বলছি তা বিনা যুক্তিতেই বিশ্বাস করো। কেননা বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।” এরপরেও যদি কেউ যুক্তি যুদ্ধ চালাতে তৎপর হন, তাহলে আঃর রক্ষে নেই। এরা এদের অন্ধভক্তদের আপনার পিছনে লেলিয়ে দেবে। আঃর তারা আপনাকে শুধুমাত্র জাহান্নামে যাও বলে ক্ষ্যান্ত থাকবে না। আপনার ধড় থেকে প্রাণটাকে বিচ্ছিন্ন করে তবে তৃপ্ত হবে।” [জহির রায়হানের ১৯৫৬ সালের ডায়েরী থেকে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।]

সুতরাং দ্বন্দ্বটা হচ্ছে, নতুন জ্ঞান আহরণের দিকে ধাবিত হওয়ার সাথে প্রাচীন বিশ্বাস এবং মূল্যবোধে আজীবন আকঁড়ে থাকার।

সম্প্রতি ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র মাঝি (MANJHI)-র কেন্দ্রীয় চরিত্র দশরথ মাঝিকে চলচ্চিত্রের শেষের দিকে জিজ্ঞেস করা হয় এক সাংবাদিকের ভাষ্যে, আপনি তো একজন সুপারম্যান, অসম্ভবকে সম্ভব করার পর আপনি কিছু একটা বলুন! তখন মাঝি উত্তর দিয়েছিলেন, ভগবানের উপর খুব বেশি নির্ভর করো না। সম্ভবতঃ ভগবানই আমাদের উপর নির্ভর করে আছে। তারপর তিনি হে হে করে যেভাবে হাসতে থাকেন, মনে হলো, আমাদের পুরো সমাজ বাস্তবতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অগাধ সত্যই যেন উচ্চারিত হলো, এক উপভোগ্য পরিহাসে। কবি নজরুলের কথার (মানুষ এনেছে ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোন) অন্য এক অনুরণন খুঁজে পাই মাঝির বক্তব্যে। বাংলা সাহিত্য দেব-নির্ভরতা বা দেব-বন্দনা থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই মধুসূদনের আধুনিক কালের সূচনার ঠিক আগে আগেই, গেয়ে গেছে মানুষের অবারিত উন্মোচনের গান, তার অজেয় শক্তি ও অনুভূতির সুনিপুণ চিত্রাঙ্কন।

কিন্তু এখন আমাদের ভেতরের আদিম-প্রাচীন গুহায় নিত্য নতুন আলোর ঝলকানি আঁধারের মানুষদের ভীত করে তুলেছে। তারা ‘৭১-এ যেমন ইসলাম ধর্মের নামে মানবতার বিরুদ্ধে গণ-ঘাতক হয়ে উঠেছিলো, মানুষ হত্যা, লুটতরাজ, মা-বোন-কন্যাদের ধর্ষণের বস্তু বানিয়েছিলো, হিন্দু-মুসলিম অমানবিক এক ভেদাভেদ টেনে জাতিসত্ত্বাকে বিধ্বস্ত করেছিলো, এখনও সে ধারাবাহিকতায় আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু তুলে দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের প্রান্তে তুলে দিতে অতি তৎপর। আর মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীরাই তাই তাদের গোঁদের উপর বিষফোঁড়া বলে তাদেরকে নিধন করাটা অতীব জরুরী হয়ে উঠেছে।

রাজনীতির সংস্পর্শে কোন কিছুকেই শুদ্ধ রাখা সহজ নয় বলে রাজনৈতিক ইসলামের এক ভয়াবহতা (যা থেকে রাষ্ট্র ‘৭১-এ বেরিয়ে আসতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেছিলো) রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দিয়ে ধর্মান্ধ ইসলামী মৌলবাদ তাদের দায়িত্বের শেষ এবং শুরুকে এক বিন্দুতে নিয়ে এসেছে। এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্লগারদের যথাযথ ভূমিকাই পালন অত্যাবশ্যক। প্রচলিত সরকার বা রাজনীতির তল্পি বহনকারী হিসেবে ব্লগারদের নিজেদের পরিচয় উন্মোচন করলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। সেই গুরু দায়িত্ব থেকেই ব্লগারদের সত্য উচ্চারণের কন্ঠকে আরো উচ্চকিত করতে হবে। এই অনলাইনের যুগে মুক্তমত প্রকাশে সরকার এবং মৌলবাদের স্বার্থে, কোন রকমের মুখা (MUZZLE ME NOT) পরিয়ে দেবার মত ছলচাতুরীকে দারুণভাবে উপেক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতির বিবেককে এ সময়ে ধারণ করতে পারে, একমাত্র ব্লগাররাই, তাদের চিন্তাশীল এবং মেধাবী লেখনীতে।