ইতিহাস ভোলে না। ইতিহাসকে অনেকেই স্মৃতিভ্রষ্ট করতে চায়, নিজেদের পছন্দের রঙে রঙিন করতে চায়, নিজেদের অতীত ঢাকবার জন্য কিম্বা অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। ইতিহাস তাতে কর্ণপাত করে না। সে শুধু নিজ গতিতে বয়ে চলে সময়ের হাত ধরে। ইতিহাস হল সময়; ইতিহাস হল বহতা নদী – যেখানে বর্তমানে জমা জঞ্জাল আবর্জনা সবই হারিয়ে যাবে একদিন, রয়ে যাবে শুধু সময়ের সারসংক্ষেপ কিম্বা অনাবৃত সত্য। আমরা নশ্বর মানুষ ইতিহাসকে পদানত করতে চাই অবুঝের মত, বারংবার, ইতিহাসের শিক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করে। বিগত কয়েক শতকের মানুষের ইতিহাস এই ইতিহাস-বিনির্মানের অপচেষ্টার ইতিহাস। সত্য মিথ্যাকে গুলিয়ে দিয়ে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়ার মতন বেওকুফীর ইতিহাস।
বিজয়ীদের রচিত ইতিহাসের অনেক আবর্জনা সরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় আজ উন্মোচিত হয়েছে। আদিবাসীরা পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে এই ভূখন্ডে বসবাস করে আসছিল; এক দৈব-দূর্বিপাকে গত দুশো বছর তারা নিজদেশে পরবাসী। ইউরোপীয়ানদের আমদানীকৃত সভ্যতার ইতিহাসে তারা ফুটনোটেও জায়গা পায় নি। সেই মানুষেরা আজ তাদের অতীত থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছে নতুন করে নতুন দুনিয়াতে লড়াই করবার, নতুন নিয়মে লড়াই করবার। মেলবোর্নের ডার্টি মাইলের ইতিহাস একই সাথে বেদনা ও আনন্দের ইতিহাস, পরাজয়ের গ্লানি্র স্মৃতি ও বহুল আকাঙ্খিত জয়ের পূর্বাভাস। চলুন, যাওয়া যাক মেলবোর্ন শহরের দামী, অভিজাত ও ফ্যাশনেবল পাড়া ফিটজরয় (Fitzroy) এবং কলিংউডে। মেলবোর্ন এলাকার এবোরিজিনালদের ভাষায়, ওমিন-জেকা! স্বাগতম।
আজকের ফিটজরয় মেলবোর্নের সেরা সব রেস্টুরেন্ট, পাব, ফ্যাশনেবল কাপড়চোপড়ের দোকানপাটে ঠাসা। মাঝে মাঝে দু’একটা শতাব্দীপ্রাচীন বিল্ডিং বিগত শতাব্দীর অস্ট্রেলিয়ার বেশকিছু সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা আজকের প্রজন্মের কাছে একেবারেই অজানা। এইসব রাস্তাঘাটে আমিও হেঁটেছি অনেকবার, সেখানকার রাস্তার মোড়ের পাবে বসে বিয়ার গিলেছি, কিন্তু সেখানকার ইতিহাস আমার কাছে ধরা দেয় নি এতদিন। ফিটজরয়ের রাস্তার পরতে পরতে, মোড়ে মোড়ে ইতিহাসের নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে এখনো; দেখার চোখ থাকলে, এবং একবার সেই ইতিহাসের সিঁড়িঘরের চাবির সন্ধান হাতে পেলে, উনিশ শতকের শেষের এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকের এবোরিজিনালদের সংগ্রামের একটা জ্বলন্ত চিত্র ফুটে উঠবে আপনার সামনে। এই এলাকায় এখনো রয়ে গেছে কিছু পাথরের তৈরী ম্যানসন, যা গোল্ড রাশ যুগের মেলবোর্নের স্মৃতিবাহী। অন্যদিকে, এই এলাকার অনেক পাব, চিকন সব অলিগলি, ওয়্যারহাউস কিম্বা ছোটখাট একতলা/দোতলা দালান ফিটজরয়ের আরেক ইতিহাস ধারণ করে – যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সাধারণ কর্মজীবী মানুষেরা সুখে-দুঃখে পাশাপাশি বাস করত। এই এলাকার তরুন কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় সে সব দিনের কথা, কেউ কেউ হয়তো একটু আধটু মনে করতে পারবেন, কারণ তাদের বাবা-দাদারাই তো সেই সব কর্মজীবী মানুষ। কিন্তু যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় অভিজাত কিম্বা উচ্চমূল্যের এই এলাকার সাথে এবোরজিনদের সম্পর্কের কথা, অনেকেই চমকে উঠবেন। হয়তো কেউ কেউ বলে বসবেন, এই পাড়ায় এবো’দের কি কাজ? এবো মানে এবোরিজিনিস, মানে আদিবাসীরা, তুচ্ছার্থে।
ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান মিলিয়ে আমরা জানি যে, অস্ট্রেলিয়ার এবোরিজিনরা দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের অধিকারী। কয়েক হাজার বছর আগে তারা গণ্ডুয়ানাল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এবং শুষ্ক এই মহাদেশকে তাদের আবাস হিসেবে পায়। সেখানে গড়ে ওঠে মাটি-সংলগ্ন এক জীবনধারা। ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুকের অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের পর দৃশ্যপট পালটায় দ্রুত; তার দুই দশকের মধ্যেই এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত হয়। এই মাটির পঞ্চাশ হাজার বছরের বাসিন্দারা সেদিন আসা ইউরোপীয়ানদের কাছে পরাজিত হয়ে পরিণত হয় নিজ দেশে পরবাসীতে। এর পরের অস্ট্রেলিয়া ইউরোপীয়ান অস্ট্রেলিয়া, কিম্বা ব্রিটিশ অস্ট্রেলিয়া। ব্রিটিশরা এই দেশ দখল করে নেয়, আর এবোরিজিনরা জায়গা পায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বস্তিতে, যা কিনা এবোরিজিনদের নিরাপত্তার (!) জন্যই বানানো হয়েছিল বলে দাবী করেন সেই সময়ের অস্ট্রেলিয়ার কর্তারা। তার আগে অবশ্য অনেক এবোরিজিনাল ইউরোপীয়ানদের বয়ে আনা নানা রোগে ভুগে, কিম্বা দখলদারদের অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করে। কারো কারো জায়গা হয় খ্রিস্টান মিশনারীদের আস্তানায়, যেখানে এই আদিবাসীদেরকে ভাষা ও ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে আধুনিক বানানোর চেষ্টা চলতে থাকে।
নানা কারণে বিশ শতকের শুরুর দিকে ভিক্টোরিয়ার এই রকম অনেক মিশন এবং এবোরিজিনাল বসতি ভেঙে পড়তে থাকে, এবং অনন্যোপায় হয়ে এবোরিজিনাল মানুষেরা মেলবোর্নে এসে ভীড় করতে থাকেন। আজকে যেখানে ফিটজরয় ও কলিংউড, সেখানে তখনো অনেক ফাঁকা জায়গা, মাঠ-ঘাট ছিল। এবোরিজিনালরা সেখানেই তাদের আবাস গড়ে তোলে। কার্লটন গার্ডেন্স, ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকাভুক্ত রয়্যাল এক্সিবিশান বিল্ডিং, গেরট্রুড স্ট্রীট থেকে শুরু করে ব্রান্সউইক স্ট্রীট পেরিয়ে স্মিথ স্ট্রীট পর্যন্ত নানা অলি-গলি মেলবোর্নের সেই সময়ের এবোরিজিনালদের এবং তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক নানা দাবী আদায়ের সংগ্রামেরও চিহ্ন বহন করে। তাদের কারণেই প্রায় মাইলখানেক লম্বা এই এলাকা সে সময় ডার্টি মাইল, ব্ল্যাক মাইল বা ডার্টি গের্টি (গেরট্রুড থেকে গের্টি) নামে পরিচিতি পায়। এবোরিজিনদের কুরি গোত্র উদ্ভূত লেখক জন হার্ডিং এই ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন, যিনি তার পরিবারের সাথে ভিক্টোরিয়ার কান্ট্রি এলাকা থেকে ফিটজরয়তে বাস করতে আসেন ষাটের দশকে। তিনি বলেন, ফিটজরয় ছাড়া আর কোথায় যাব, বলুন? সারা দেশে তখন এবোরিজিনালদের আর থাকার জায়গা নেই। এমনকি সরকারী সেটেলমেন্ট কিম্বা মিশনারীদের চার্চগুলোও আর এবোরিজিনদের জায়গা দিচ্ছে না, কাজেই মেলবোর্নে আসতেই হল। (এই সব সেটেলমেন্ট আসলে ছিল এক ধরণের বন্দীদশা – সরকার বাহাদুর ঠিক করলেন যে, সব এবোরিজিনালকে তাদের জন্য নির্ধারিত এলাকাতে বসবাস করতে হবে তাদের নিরাপত্তার খাতিরে – সেখান থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও যেতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। কর্তৃপক্ষই খাবার দাবার সরবরাহ করত, সাথে বিনামূল্যে ধর্মশিক্ষা ইত্যাদি। সহজেই অনুমেয়, সেখানকার জীবনের মান সাধারণ অস্ট্রেলিয়ানদের মত ছিল না। এরকম কিছু সেটেলমেন্ট আজও রয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ার নর্দার্ন টেরিটরিতে, যেখানে এবোরিজিনালদের ছেলেপুলেরা বিয়ার খেয়ে আর জুয়া খেলে জীবন কাটিয়ে দেয়। তৃতীয় বিশ্বের গরীব কোন বস্তির সাথে সেসব এলাকা তুলনীয় ছিল এই সেদিন পর্যন্ত)। আর, মেলবোর্নে বিশ শতকের বিশ-তিরিশের দশক থেকে এবোরিজিনালরা যে একালায় বসতি গড়ে তুলেছে, সেখানে যেয়েই আমরা আমাদের জাতি ও আমাদের অতীতের সাথে একাত্নতা বোধ করলাম। এই কমিউনিটি ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা এবোরিজিনাল কমিউনিটি, সন্দেহ নেই। এই এলাকাটা আমাদের জাতির মানুষের জন্য একটা মিলনমেলাতে পরিণত হয়েছিল। আমাদের অনেকেই এখনো মেলবোর্নে এলে কি এক অজানা কারণে এই এলাকাতে একবার না একবার অবশ্যই আসেন, কিসের যেন একটা টান অনুভব করেন এই এলাকার প্রতি।’
একবার মোহাম্মদ আলী এসেছিলেন মেলবোর্নে। এই এলাকায় এসে একটা গলিতে দাঁড়ানো মাত্র কি করে যেন প্রায় আট’শ মানুষ বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়। গেরট্রুড স্ট্রীটের মোড়ে আলীর দেওয়া ভাষণ এবোরিজিনালদেরকে তাদের অধিকার আদায়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। সে সময় পুরো ফিটজরয় এলাকা ছিল কালো মানুষদের আস্তানা – সবাই সবাইকে চিনত, সবাই এই এলাকাকে নিজের এলাকা মনে করে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করত। মেলবোর্নে এবোরিজিন যারাই এসেছিল, ফিটজরয় সবাইকে আশ্রয় দিয়েছিল তার কোলে। কাউকে খুঁজতে হবে? ফিটজরয়তে গেলেই পাওয়া যাবে। সে সময় ফিটজরয়তে যাওয়াটা অনেকটা তীর্থগমনের মত একটা ব্যাপার ছিল এবোরিজিনদের জন্য। এই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার কোন একটা শহরে এবোরিজিনাল লোকেরা স্বাধীনভাবে বসতি গেড়েছে, সরকারী সেটেলমেন্টে আর চার্চের বাইরে নিজেদের একটা জগত বানিয়ে নিয়েছে, তাও আবার শহুরে এলাকায়। এখান থেকেই আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন দানা বাঁধে। জন হার্ডিং বলছেন, ‘আমার বাবা মা আর আমরা ভাইবোনেরা থাকতাম গোর স্ট্রিটের একটা বাসায়। ফিটজরয়ের সব পরিবার সব পরিবারকে চিনত। আগে আমাদের কোন অধিকার ছিল না ইউরোপীয়ানদের পাবে বা দোকানে ঢোকার, অথচ ফিটজরয়তে আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য সব তৈরী করতে শুরু করলাম।’
এ বছর রানীর জন্মদিনে ৭০০ জন অস্ট্রেলিয়ান ‘অর্ডার অফ অস্ট্রেলিয়া’ সন্মাননা পান। তাদের মধ্যে ছিলেন একজন এবোরিজিনাল গীতিকার ও গায়ক, আর্চি রোচ। তিনিও আশির দশকে তরুন বয়সে বাবা’মার হাত ধরে এই ফিটজরয়তে এসেছিলেন, আর এখানকার আলোহাওয়া তাকে দিয়ে লিখিয়েছিল বিখ্যাত সেই প্রতিবাদী গান, টুক দ্যা চিলড্রেন এওয়ে – স্টোলেন জেনারেশানের গল্প নিয়ে (লিংক নীচে)। আরো অনেক এমন গান লিখে ও গেয়ে আদিবাসীদের সংগ্রামের রসদ জুগিয়েছেন তিনি।
টুক দ্যা চিলড্রেন এওয়ে, আর্চি রোচ
২০০৯ সালে ফিটজরয়ের এবোরিজিনাল ইতিহাস স্মরণ প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় স্মৃতিচারণ করলেন একজন মহিলা – আমি কুমেরাগুঞ্জা এবোরিজিনাল স্টেশান থেকে পালিয়ে আসা একজন মহিলা।(কুমেরাগুঞ্জা স্টেশান ওয়াক-অফ অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের ইতিহাসে এক বিখ্যাত ঘটনা। ১৯৩৯ সালে দক্ষিণ নিউ সাউথ ওয়েলসের কুমেরাগুঞ্জা মিশন থেকে কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সেই আদিবাসী ক্যাম্প বা সেটেলমেন্ট থেকে অনেক আদিবাসী পালিয়ে এসেছিল। অনেকেই মারে নদী পেরিয়ে ভিক্টোরিয়ায় চলে আসে, এবং কেউ কেউ শেপার্টন/ইছুকায় রয়ে যায়। বেশীরভাগের গন্তব্য ছিল মেলবোর্ন, তথা মেলবোর্নের ফিটজরয়)। আমার জন্ম হয়েছিল ফিটজরয়তে, কার্লটন গার্ডেন্সের ঠিক সামনের একটা বাসায়, ১৯৩৫ সালে। আমার মা’কে ১৯৩০ সালের দিকে খ্রীস্টান মিশন থেকে মেলবোর্নে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মিশন থেকে সব ১৫-১৬ বছরের মেয়েদেরকেই বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হোত, যাতে তারা নিজেদের গোত্রের বা অন্য কোন আদিবাসী গোত্রের কাউকে বিয়ে করতে না পারে। মনে করা হোত যে, সাদাদের সাথে রক্তের মিশেলে ধীরে ধীরে একটা সাদা অস্ট্রেলিয়া গড়ে উঠবে, যা ছিল আসলে একটা গণহত্যার সমতূল্য। কিন্তু কিছু করার ছিল না, এটাই ছিল সরকারী নীতি।
একার্থে, ১৯২০-৩০ সালের দিকে ফিটজরয় ও কলিংউডে যে এবোরিজিনাল কমিউনিটি গড়ে উঠেছিল, তার পেছনে এই কালো আদিবাসীদেরকে সাদা করণ প্রকল্পের একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। ১৮৮৬ সালে হালফ-কাস্ট এক্ট প্রবর্তিত হয়, যার মাধ্যমে তরুন আদিবাসীদেরকে ইউরোপীয়ানদের সাথে মিশতে ও বিবাহে উতসাহিত করা হত, যাতে তারা মূলধারার সাথে মিশে যেতে পারে। এই আইন এবং সেই সময়ের অর্থনৈতিক মন্দা অনেক আদিবাসী মানুষকে কাজের সন্ধানে শহরে আসতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে তারাই একত্রিত হয়ে একটি কমিউনিটি গড়ে তোলে নিজেদের জন্য। হিতে বিপরীত! কিন্তু মেলবোর্নে এত জায়গা থাকতে কলিংউড/ফিটজরয়তেই কেন গড়ে উঠল এই বসতি? কারণটা সম্ভবত এই যে, ওগুলো ছিল খেটে খাওয়া মানুষের বাসের এলাকা, ফলে সেখানে অনেক বোর্ডিং হাউস বা মেস বাড়ি শস্তায় মিলত, এবং জিনিসপত্রের দামও কম ছিল অন্যান্য এলাকার তুলনায়। আরও ছিল স্নো-বল ইফেক্ট; প্রথম দু-তিনটা পরিবার ওখানে বসতি গাড়ার পরে তাদের চেনাজানা অন্যরাও শহরে এসে সেই এলাকাতেই বাসা বাঁধে। এভাবে এক দুই তিন করে আস্তে আস্তে খবরটা শহরমূখী সব আদিবাসীদের কানেই পৌঁছে যায়। এভাবে ফিটজরয় হয়ে যায় তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অবশ্যই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্নায়ুকেন্দ্র। সাদারা এই দেশে আসার আগেও তো এমনই ছিল – আদিবাসীদের মিলিত হওয়ার এক একটা জায়গা থাকত, যেখান থেকে তারা সামাজিক নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। সাদারা আসার পরের যে ঝড়, তার পরে এই প্রথম আবার তারা সে রকম একটা জায়গা পেল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুদ্ধফেরত সৈন্যদের পূনর্বাসন করতে গিয়ে সরকার আদিবাসী মিশনগুলো বন্ধ করে দেয় অথবা সেই মিশনেই সৈন্যদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেক এবোরিজিনালও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে যুদ্ধ করেছিল, তবে তারা সে সব সুযোগ-সুবিধার কিছুই পায় নি। ইতিহাস থেকেও তাদেরকে বাদ দিয়ে হয়েছে। আদিবাসী সৈন্যরা দেশে ফিরে এসে দেখলেন, তাদের সাদা সহকর্মীরা জমি-বাড়ি-পেনশান নানা কিছুই পাচ্ছেন প্রাক্তন বীর হিসেবে, আর তাদের জন্য এমনকি যাওয়ার জায়গাটুকুও অবশিষ্ট নেই এবোরিজিনাল মিশনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে – ফলে তারা শহরের পথ ধরলেন। ততদিনে ফিটজরয়ের নাম চাউর হয়ে গেছে আদিবাসীদের মাঝে। এইসব মানুষেরা সেখানে এসে জুটলেন, এবং অবশ্যই যুদ্ধে যাওয়ার আগের চেয়ে অনেক বেশী রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে সেখানে জুটলেন।
যারা ভুলে গেছেন তাদেরকে মনে করিয়ে দিই, ১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ বন্দিশিবির স্থাপনের পর থেকে এবোরিজিনালরা আসলে তাদের ভূমি ও আবাসস্থল থেকে সমূলে উতখাত হয়েছিল। শুধু এটুকুতেই শেষ হয় নি – তারা আসলে হাফ কাস্ট এক্ট এবং খ্রীস্টান ধর্মপ্রচার মিশনের হাতে বন্দীও হয়েছিল। বলা চলে, ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত কলোনিয়াল সভ্যতার চাকার তলায় পিষ্ট হয়েছিল। তাদের জমি দখল করে গড়ে উঠেছিল গরুর খামার, আখের ক্ষেত, কিম্বা বাজারঘাট সড়ক দোকানপাট সেলুন বেশ্যালয় পুলিশকেন্দ্র ভূমিঅফিস ধর্মপ্রচারমিশন রেস্তারা জুয়ারআসর নাগরিক ও বনিকসমেত শহর। ফলে সেখানে আদিবাসীদের থাকার কোন উপায়ও ছিল না। আপন দেশে পরদেশী হওয়ায় আদিবাসীদের কেউ কেউ মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল বটে, তবে তাতে উন্মত্ত নগরবাসীরা ক্ষেপে গিয়ে এবোরিজিনদেরকে একেবারে সমূলে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এবোরিজিনদেরকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যে তাদেরকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, এবং তাদের বাড়িঘরগুলিকেও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। পুরো ব্যাপারটাকে সভ্যতার দাবীর কাছে অসভ্য বর্বরদের স্বাভাবিক পরাজয় হিসেবে ব্যাখ্যা করে ১৮৭৪ সালে কুকটাউন হেরাল্ড পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে,
When the savages are pitted against civilization, they must go to the wall; it is the fate of their race. Much as we may deplore the necessity for such a state of things, it is absolute necessary, in order that the onward march of civilization may not be arrested by the antagonism of the aboriginals.
যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে ফিটজরয়তে এলেন, তারা যেন এক জীবন খুঁজে পেলেন। স্বাধীন জীবন। আশেপাশে অনেক ফ্যাক্টরী; কাজ করলেই নগদ টাকা। মিশনের সেই নিয়ন্ত্রিত জীবন আর নয়। তারা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন। শত প্রতিকূলতা সত্বেও ইউরোপীয়ানদের ভাষা শিখে, তাদের নিয়ম শিখে নিজেদের অধিকার আদায়ের স্বপ্নে বিভোর হতে লাগলেন। সেখানেই অস্ট্রেলিয়ান এবোরিজিনদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন, অস্ট্রেলিয়ান এবোরিজিনিস লীগ গঠিত হয় তিরিশের দশকে। গ্যারি ফোলি ছিলেন একজন সক্রিয় আদিবাসী অধিকার কর্মী, যার উদ্যোগে ১৯৭২ সালে ক্যানবেরায় এবোরিজিনাল টেন্ট এম্বাসি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনিও সিডনী থেকে এই ফিটজরয়তে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন সত্তুরের দশকে। এইসব প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের সংগ্রামকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। ফিটজরয়ের প্রথম দিকের সবচেয়ে বিখ্যাত মুখ ছিলেন ডগলাস নিকলস, যিনি ১৯২০ এর দশকে কূখ্যাত কুমেরাগুঞ্জা এবোরিজিনাল স্টেশান থেকে এসেছিলেন। কার্লটন ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলার অফার পেয়েছিলেন তিনি। এই ফুটবল সকার নয়, অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল, যা আসলে রাগবীর মতন একটা খেলা যেখানে হাত-পা দিয়ে ওভাল আকারের একটা বল নিয়ে প্রতি দলে আঠারোজন খেলোয়াড় মিলে খেলে। ফুটবল তথা সকার, রাগবী, ক্রিকেট, হকি, এমনকি অলিম্পিকের নানা খেলাকে ছাপিয়ে এই অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলই অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। অন্যান্য খেলোয়াড়দের বর্ণবাদী আচরণের কারণে কার্লটনের হয়ে তার ফুটবল খেলা হয় নি। পরে তিনি দূর্বল নর্থকোট ক্লাবে যোগ দেন। ১৯২৯ সালে এই ক্লাবটি যখন চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে, সেখানে ডগলাস নিকলস একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি যোগ দেন ফিটজরয় ফুটবল ক্লাবে। ১৯৩২ সালেই তিনি উইলিয়াম কুপারের সাথে মিলে গড়ে তোলেন অস্ট্রেলিয়ান এবোরিজিনিস লীগ। জাতীয় পর্যায়ে এবোরিজিনদের মৌলিক মানবাধিকার এবং নানা সমস্যার সমাধানের জন্য কাজ করাই ছিল এই লীগের উদ্দেশ্য। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবোরিজিনাল এডভান্সমেন্ট লীগ। তখনো এবোরিজিনদের ভোটাধিকার ছিল না, এমনকি আদমশুমারীতেও তাদেরকে গোণা হত না। ১৯৬৭ সাল থেকে এসব বদলে যায়, যার কৃতিত্ব এবোরিজিনদের এসব প্রতিষ্ঠানের, আর সে সবের সূতিকাগার ছিল ফিটজরয়। ১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়া পায় তাদের প্রথম আদিবাসী এমপি, আর ১৯৭২ সালে ডগলাস নিকলস প্রথম আদিবাসী হিসেবে স্যার উপাধী প্রাপ্ত হন, এবং ১৯৭৬ সালে তিনি সাউথ অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের গভর্নর হন।
শুরুর দিকে অনেক এবোরিজিনাল অস্ট্রেলিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। সেই পার্টির সদর দফতর ছিল ফিটজরয়তে। তারা এবোরিজিনালদের ভূমির অধিকার সহ অন্যান্য অধিকারকে সমর্থন করত। গত শতকের তিরিশের দশকে তারাই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা এবোরিজিনালদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থপূর্ণ সায়ত্বশাসনের মত ব্যাপারগুলোকে সাপোর্ট করত। এখনকার সমাজতান্ত্রিক দল, সোশ্যালিস্ট অলটারনেটিভের আস্তানাও এই এলাকাতেই। এই সোশ্যালিস্ট অলটারনেটিভের উদ্যোগে গত বছর ফিটজরয়তে একটা পথনাট্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নাম ছিল ‘দ্যা ডার্টি মাইল’।
উপরে যে জন হার্ডিং এবং গ্যারী ফোলি’কে উদ্ধৃত করেছি, এই পথনাটকটি তাদেরই লেখা, আর ইলবিয়েরি এবোরিজিনাল এন্ড টরেস আইল্যান্ডার থিয়েটারের প্রযোজনা। এটি ছিল মূলতঃ ইন্ডিজেনাস ফিটজরয়ের ইতিহাসের উপর দিয়ে হাঁটার অনুষ্ঠান। আক্ষরিক অর্থেই হাঁটা – কার্লটন গার্ডেনসের একটা বড় বটগাছের তলা থেকে শুরু করে গেরট্রুড স্ট্রীট হয়ে নানা অলিগলি পেরিয়ে বিভিন্ন ঠিকানায় দাঁড়িয়ে সেখানকার ইতিহাস শোনা এবোরিজিনাল কমিউনিটির সিনিয়রদের মুখে। অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা ছিল সেটি। থিয়েটার বলতে আমরা বুঝি প্রায়ান্ধকার হলঘরে বসে পপকর্ন চিবুতে চিবুতে অভিনয় দেখা। অনেকে ঘুমিয়েও যায় সেখানে। আর এই ‘দ্যা ডার্টি মাইল’ শো’তে আমরা দর্শক-শ্রোতা-অংশগ্রহণকারীরা উত্তেজনা আর অপরাধবোধের এই যুগলবন্দীর মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করছিলাম এক প্রায় ভুলে যাওয়া ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। না, আমেরিকান কালোদের সংগ্রামের মতন এই এবোরিজিনদের সংগ্রাম প্রবাদপ্রতিম হয় নি। হয়নি ভারতীয়দের স্বাধীনতার সংগ্রামের মতন সাফল্যমণ্ডিত। তবে তারপরেও অতি অল্পসময়ে যেভাবে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
কার্লটন গার্ডেনসের সেই বড় বটগাছটি শতবর্ষজীবী। এই এলাকার অনেক কিছুই পালটে গেছে, তবে রাস্তাঘাটগুলি একই রকম রয়ে গেছে, আর রয়ে গেছে এই গাছটি। এই গাছটিই ছিল এবোরিজিনদের অলিখিত ক্যানবেরা, অর্থাৎ মিলনস্থল। রাজধানী অর্থে বলিনি; ক্যানবেরা একটি এবোরিজিনাল ভাষার শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ মিলনমেলা। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হল। একেক জায়গায় গিয়ে থামছি, আবার হাঁটছি, এই করে শেষে হাজির হলাম স্মিথ স্ট্রিটের সমান্তরালে চারকোল লেইনে। অনেকটা যেন আদিবাসী মানুষের যাত্রার মতই – ইউরোপীয়ানদের আগমনে নিজের বাস্তুভিটা থেকে উতখাত, পরে এবোরিজিনাল সেটেলমেন্টে কিম্বা খ্রীস্টান মিশনে, মিশন বন্ধ হয়ে গেলে আবার শহরে, কেউ কেউ নিজ পরিবার থেকে ‘চুরি’ হয়ে ইউরোপীয়ানদের তত্বাবধানে, এভাবে পথে পথে ঘুরতে থাকা এক অনিশ্চিত জীবনেরই রেপ্লিকা যেন! অনেক জায়গায় থামল আমাদের কাফেলা, অনেক গল্প শোনা হল। বসন্তের বিকেলে আমরা ২০ ডলারে টিকেট খরিদ করা প্রায় শ’খানেক লোক একসাথে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম কেউ বুমেরাং, কেউ এবোরিজিনদের চেনা নানা গাছের পাতা/ডাল বা কাঠবাদাম হাতে নিয়ে, কেউ কেউ সেই সময়ের ছবি আঁকা নানা পোস্টার হাতে নিয়ে। এক জায়গায় একজন ড্রাইভার তার গাড়ি পার্ক করছিল। ওই ভবনটি একসময় ছিল এবোরিজিনাল হাউজিং বোর্ড – এখন সেখানে দামী ইউরোপীয়ান ব্রান্ডের ফ্যাশন আউটলেট। কেউ জানে না। অথবা জানে।
ফিটজরয়ের এইসব আদিবাসী মানুষেরা ছিল নানা গোত্রের। ইউরোপীয়ানদের আসার আগে যেখানে তারা নানা গোত্রে বিভক্ত ছিল, সেখানে দু’শ বছরের বঞ্চনার পরে তারা অবশেষে ফিটজরয়তে এসে একে অন্যের সাথে আপন হল, নিজেদেরকে এক করে ভাবতে শিখল। নিজেরা এক সাথে লড়তে শিখল। অনেকটা ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ফলে যেমন উত্তর-দক্ষিন-পূর্ব-পশ্চিম ভারত একসূত্রে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল, সেরকম। যেহেতু ইউরোপীয়ানদের কাছে তাদের ছিল একটাই পরিচয়, ব্ল্যাক ফেলা (black fella), কাজেই তারা নিজেরা নিজেদের গোত্রবিভেদ ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছিল নিজেদের সম্মিলিত অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। আন্তগোত্র বিয়ে, যা আগে খুবই কম হত, তা অনেক বেশী হতে লাগল। অস্ট্রেলিয়ার নানা প্রান্তের এবোরিজিনালরা পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা বোধ করত, যা তারা আগে তাদের কৌম সমাজে দেখে নি। ফলে এই যাত্রায় সাফল্যই তাদের ভবিতব্য ছিল। কথায় আছে না, একতাই বল।
কলোনাইজেশানের প্রথম কয়েক দশকেই এবোরিজিনদের তিন চতুর্থাংশ মারা গিয়েছিল সংঘর্ষে, ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত রোগে, ইউরোপের শেখানো মাদক-আফিমে এবং স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে উতখাত হয়ে। দু’শ বছরের বন্দীজীবনের পরে তারা মুক্ত হয়েছে, তবে এখনো মূলধারার মানুষের সাথে সামাজিক-অর্থনৈতিক-স্বাস্থ্যগত নানা সূচকে তারা পিছিয়ে আছে। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী আদিবাসীদের উপরে সকল বৈষম্য ও অন্যায়ের জন্য, বিশেষ করে স্টোলেন জেনারেশানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান। আদিবাসীরা তাদের জমির অধিকার ফিরে পেয়েছে ১৯৯২ সালে। আদিবাসীদের উপরে অত্যাচারের কথা এদেশে স্বীকার করা হয়, পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হয়, এবং যে কোন সরকারী অনুষ্ঠানের শুরুতে ওই এলাকার আদিবাসী গোত্রের প্রতি সন্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। ফেডারেল সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী প্রতিবছর ‘ক্লোজ দ্যা গ্যাপ’ নামে একটা রিপোর্ট পেশ করেন সংসদে, যেখানে মূলধারার মানুষের সাথে আদিবাসীদের জীবনমানের পার্থক্য কতখানি কমল/বাড়ল তা পর্যালোচনা করা হয়, এবং নানা সুপারিশ করা হয়। অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদেরকে বলা হোত Aboriginal, তুচ্ছার্থে এবং সংক্ষেপে বলা হোত Abo, Aborigini বা Abrogini। এসব অপমানসূচক নামগুলো এখন ব্যবহার করা অস্ট্রেলিয়ান আইনে নিষিদ্ধ। এমনকি ‘এবো
রিজিনাল’ শব্দটার ব্যবহারও কমে যাচ্ছে; তাদেরকে Indigenous Australians এবং First Australians বলা হয়।
ডার্টি মাইল নামে খ্যাত সেই গেরট্রুড স্ট্রীট এখনো আছে তার আগের জায়গাতেই। ওপথে আমার যাওয়া হলে ইতিহাস এসে যেন একটা ঝাপটা মারে আমার অলস চোখেমুখে, আর মনে করিয়ে দেয় আদিবাসীদের সেই অবিস্মরণীয় সংগ্রামগাথা। ফার্স্ট অস্ট্রেলিয়ানদের নতুন করে অস্ট্রেলিয়ান হওয়ার সেই সংগ্রামগাথা।
বিজয়ীদের রচিত ইতিহাসের অনেক আবর্জনা সরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় আজ উন্মোচিত হয়েছে। আদিবাসীরা পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে এই ভূখন্ডে বসবাস করে আসছিল; এক দৈব-দূর্বিপাকে গত দুশো বছর তারা নিজদেশে পরবাসী। ইউরোপীয়ানদের আমদানীকৃত সভ্যতার ইতিহাসে তারা ফুটনোটেও জায়গা পায় নি। সেই মানুষেরা আজ তাদের অতীত থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছে নতুন করে নতুন দুনিয়াতে লড়াই করবার, নতুন নিয়মে লড়াই করবার। মেলবোর্নের ডার্টি মাইলের ইতিহাস একই সাথে বেদনা ও আনন্দের ইতিহাস, পরাজয়ের গ্লানি্র স্মৃতি ও বহুল আকাঙ্খিত জয়ের পূর্বাভাস। চলুন, যাওয়া যাক মেলবোর্ন শহরের দামী, অভিজাত ও ফ্যাশনেবল পাড়া ফিটজরয় (Fitzroy) এবং কলিংউডে। মেলবোর্ন এলাকার এবোরিজিনালদের ভাষায়, ওমিন-জেকা! স্বাগতম।
আজকের ফিটজরয় মেলবোর্নের সেরা সব রেস্টুরেন্ট, পাব, ফ্যাশনেবল কাপড়চোপড়ের দোকানপাটে ঠাসা। মাঝে মাঝে দু’একটা শতাব্দীপ্রাচীন বিল্ডিং বিগত শতাব্দীর অস্ট্রেলিয়ার বেশকিছু সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা আজকের প্রজন্মের কাছে একেবারেই অজানা। এইসব রাস্তাঘাটে আমিও হেঁটেছি অনেকবার, সেখানকার রাস্তার মোড়ের পাবে বসে বিয়ার গিলেছি, কিন্তু সেখানকার ইতিহাস আমার কাছে ধরা দেয় নি এতদিন। ফিটজরয়ের রাস্তার পরতে পরতে, মোড়ে মোড়ে ইতিহাসের নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে এখনো; দেখার চোখ থাকলে, এবং একবার সেই ইতিহাসের সিঁড়িঘরের চাবির সন্ধান হাতে পেলে, উনিশ শতকের শেষের এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকের এবোরিজিনালদের সংগ্রামের একটা জ্বলন্ত চিত্র ফুটে উঠবে আপনার সামনে। এই এলাকায় এখনো রয়ে গেছে কিছু পাথরের তৈরী ম্যানসন, যা গোল্ড রাশ যুগের মেলবোর্নের স্মৃতিবাহী। অন্যদিকে, এই এলাকার অনেক পাব, চিকন সব অলিগলি, ওয়্যারহাউস কিম্বা ছোটখাট একতলা/দোতলা দালান ফিটজরয়ের আরেক ইতিহাস ধারণ করে – যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সাধারণ কর্মজীবী মানুষেরা সুখে-দুঃখে পাশাপাশি বাস করত। এই এলাকার তরুন কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় সে সব দিনের কথা, কেউ কেউ হয়তো একটু আধটু মনে করতে পারবেন, কারণ তাদের বাবা-দাদারাই তো সেই সব কর্মজীবী মানুষ। কিন্তু যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় অভিজাত কিম্বা উচ্চমূল্যের এই এলাকার সাথে এবোরজিনদের সম্পর্কের কথা, অনেকেই চমকে উঠবেন। হয়তো কেউ কেউ বলে বসবেন, এই পাড়ায় এবো’দের কি কাজ? এবো মানে এবোরিজিনিস, মানে আদিবাসীরা, তুচ্ছার্থে।
ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান মিলিয়ে আমরা জানি যে, অস্ট্রেলিয়ার এবোরিজিনরা দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের অধিকারী। কয়েক হাজার বছর আগে তারা গণ্ডুয়ানাল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এবং শুষ্ক এই মহাদেশকে তাদের আবাস হিসেবে পায়। সেখানে গড়ে ওঠে মাটি-সংলগ্ন এক জীবনধারা। ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুকের অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের পর দৃশ্যপট পালটায় দ্রুত; তার দুই দশকের মধ্যেই এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত হয়। এই মাটির পঞ্চাশ হাজার বছরের বাসিন্দারা সেদিন আসা ইউরোপীয়ানদের কাছে পরাজিত হয়ে পরিণত হয় নিজ দেশে পরবাসীতে। এর পরের অস্ট্রেলিয়া ইউরোপীয়ান অস্ট্রেলিয়া, কিম্বা ব্রিটিশ অস্ট্রেলিয়া। ব্রিটিশরা এই দেশ দখল করে নেয়, আর এবোরিজিনরা জায়গা পায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বস্তিতে, যা কিনা এবোরিজিনদের নিরাপত্তার (!) জন্যই বানানো হয়েছিল বলে দাবী করেন সেই সময়ের অস্ট্রেলিয়ার কর্তারা। তার আগে অবশ্য অনেক এবোরিজিনাল ইউরোপীয়ানদের বয়ে আনা নানা রোগে ভুগে, কিম্বা দখলদারদের অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করে। কারো কারো জায়গা হয় খ্রিস্টান মিশনারীদের আস্তানায়, যেখানে এই আদিবাসীদেরকে ভাষা ও ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে আধুনিক বানানোর চেষ্টা চলতে থাকে।
নানা কারণে বিশ শতকের শুরুর দিকে ভিক্টোরিয়ার এই রকম অনেক মিশন এবং এবোরিজিনাল বসতি ভেঙে পড়তে থাকে, এবং অনন্যোপায় হয়ে এবোরিজিনাল মানুষেরা মেলবোর্নে এসে ভীড় করতে থাকেন। আজকে যেখানে ফিটজরয় ও কলিংউড, সেখানে তখনো অনেক ফাঁকা জায়গা, মাঠ-ঘাট ছিল। এবোরিজিনালরা সেখানেই তাদের আবাস গড়ে তোলে। কার্লটন গার্ডেন্স, ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকাভুক্ত রয়্যাল এক্সিবিশান বিল্ডিং, গেরট্রুড স্ট্রীট থেকে শুরু করে ব্রান্সউইক স্ট্রীট পেরিয়ে স্মিথ স্ট্রীট পর্যন্ত নানা অলি-গলি মেলবোর্নের সেই সময়ের এবোরিজিনালদের এবং তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক নানা দাবী আদায়ের সংগ্রামেরও চিহ্ন বহন করে। তাদের কারণেই প্রায় মাইলখানেক লম্বা এই এলাকা সে সময় ডার্টি মাইল, ব্ল্যাক মাইল বা ডার্টি গের্টি (গেরট্রুড থেকে গের্টি) নামে পরিচিতি পায়। এবোরিজিনদের কুরি গোত্র উদ্ভূত লেখক জন হার্ডিং এই ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন, যিনি তার পরিবারের সাথে ভিক্টোরিয়ার কান্ট্রি এলাকা থেকে ফিটজরয়তে বাস করতে আসেন ষাটের দশকে। তিনি বলেন, ফিটজরয় ছাড়া আর কোথায় যাব, বলুন? সারা দেশে তখন এবোরিজিনালদের আর থাকার জায়গা নেই। এমনকি সরকারী সেটেলমেন্ট কিম্বা মিশনারীদের চার্চগুলোও আর এবোরিজিনদের জায়গা দিচ্ছে না, কাজেই মেলবোর্নে আসতেই হল। (এই সব সেটেলমেন্ট আসলে ছিল এক ধরণের বন্দীদশা – সরকার বাহাদুর ঠিক করলেন যে, সব এবোরিজিনালকে তাদের জন্য নির্ধারিত এলাকাতে বসবাস করতে হবে তাদের নিরাপত্তার খাতিরে – সেখান থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও যেতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। কর্তৃপক্ষই খাবার দাবার সরবরাহ করত, সাথে বিনামূল্যে ধর্মশিক্ষা ইত্যাদি। সহজেই অনুমেয়, সেখানকার জীবনের মান সাধারণ অস্ট্রেলিয়ানদের মত ছিল না। এরকম কিছু সেটেলমেন্ট আজও রয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ার নর্দার্ন টেরিটরিতে, যেখানে এবোরিজিনালদের ছেলেপুলেরা বিয়ার খেয়ে আর জুয়া খেলে জীবন কাটিয়ে দেয়। তৃতীয় বিশ্বের গরীব কোন বস্তির সাথে সেসব এলাকা তুলনীয় ছিল এই সেদিন পর্যন্ত)। আর, মেলবোর্নে বিশ শতকের বিশ-তিরিশের দশক থেকে এবোরিজিনালরা যে একালায় বসতি গড়ে তুলেছে, সেখানে যেয়েই আমরা আমাদের জাতি ও আমাদের অতীতের সাথে একাত্নতা বোধ করলাম। এই কমিউনিটি ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা এবোরিজিনাল কমিউনিটি, সন্দেহ নেই। এই এলাকাটা আমাদের জাতির মানুষের জন্য একটা মিলনমেলাতে পরিণত হয়েছিল। আমাদের অনেকেই এখনো মেলবোর্নে এলে কি এক অজানা কারণে এই এলাকাতে একবার না একবার অবশ্যই আসেন, কিসের যেন একটা টান অনুভব করেন এই এলাকার প্রতি।’
একবার মোহাম্মদ আলী এসেছিলেন মেলবোর্নে। এই এলাকায় এসে একটা গলিতে দাঁড়ানো মাত্র কি করে যেন প্রায় আট’শ মানুষ বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়। গেরট্রুড স্ট্রীটের মোড়ে আলীর দেওয়া ভাষণ এবোরিজিনালদেরকে তাদের অধিকার আদায়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। সে সময় পুরো ফিটজরয় এলাকা ছিল কালো মানুষদের আস্তানা – সবাই সবাইকে চিনত, সবাই এই এলাকাকে নিজের এলাকা মনে করে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করত। মেলবোর্নে এবোরিজিন যারাই এসেছিল, ফিটজরয় সবাইকে আশ্রয় দিয়েছিল তার কোলে। কাউকে খুঁজতে হবে? ফিটজরয়তে গেলেই পাওয়া যাবে। সে সময় ফিটজরয়তে যাওয়াটা অনেকটা তীর্থগমনের মত একটা ব্যাপার ছিল এবোরিজিনদের জন্য। এই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার কোন একটা শহরে এবোরিজিনাল লোকেরা স্বাধীনভাবে বসতি গেড়েছে, সরকারী সেটেলমেন্টে আর চার্চের বাইরে নিজেদের একটা জগত বানিয়ে নিয়েছে, তাও আবার শহুরে এলাকায়। এখান থেকেই আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন দানা বাঁধে। জন হার্ডিং বলছেন, ‘আমার বাবা মা আর আমরা ভাইবোনেরা থাকতাম গোর স্ট্রিটের একটা বাসায়। ফিটজরয়ের সব পরিবার সব পরিবারকে চিনত। আগে আমাদের কোন অধিকার ছিল না ইউরোপীয়ানদের পাবে বা দোকানে ঢোকার, অথচ ফিটজরয়তে আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য সব তৈরী করতে শুরু করলাম।’
এ বছর রানীর জন্মদিনে ৭০০ জন অস্ট্রেলিয়ান ‘অর্ডার অফ অস্ট্রেলিয়া’ সন্মাননা পান। তাদের মধ্যে ছিলেন একজন এবোরিজিনাল গীতিকার ও গায়ক, আর্চি রোচ। তিনিও আশির দশকে তরুন বয়সে বাবা’মার হাত ধরে এই ফিটজরয়তে এসেছিলেন, আর এখানকার আলোহাওয়া তাকে দিয়ে লিখিয়েছিল বিখ্যাত সেই প্রতিবাদী গান, টুক দ্যা চিলড্রেন এওয়ে – স্টোলেন জেনারেশানের গল্প নিয়ে (লিংক নীচে)। আরো অনেক এমন গান লিখে ও গেয়ে আদিবাসীদের সংগ্রামের রসদ জুগিয়েছেন তিনি।
টুক দ্যা চিলড্রেন এওয়ে, আর্চি রোচ
২০০৯ সালে ফিটজরয়ের এবোরিজিনাল ইতিহাস স্মরণ প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় স্মৃতিচারণ করলেন একজন মহিলা – আমি কুমেরাগুঞ্জা এবোরিজিনাল স্টেশান থেকে পালিয়ে আসা একজন মহিলা।(কুমেরাগুঞ্জা স্টেশান ওয়াক-অফ অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের ইতিহাসে এক বিখ্যাত ঘটনা। ১৯৩৯ সালে দক্ষিণ নিউ সাউথ ওয়েলসের কুমেরাগুঞ্জা মিশন থেকে কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সেই আদিবাসী ক্যাম্প বা সেটেলমেন্ট থেকে অনেক আদিবাসী পালিয়ে এসেছিল। অনেকেই মারে নদী পেরিয়ে ভিক্টোরিয়ায় চলে আসে, এবং কেউ কেউ শেপার্টন/ইছুকায় রয়ে যায়। বেশীরভাগের গন্তব্য ছিল মেলবোর্ন, তথা মেলবোর্নের ফিটজরয়)। আমার জন্ম হয়েছিল ফিটজরয়তে, কার্লটন গার্ডেন্সের ঠিক সামনের একটা বাসায়, ১৯৩৫ সালে। আমার মা’কে ১৯৩০ সালের দিকে খ্রীস্টান মিশন থেকে মেলবোর্নে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মিশন থেকে সব ১৫-১৬ বছরের মেয়েদেরকেই বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হোত, যাতে তারা নিজেদের গোত্রের বা অন্য কোন আদিবাসী গোত্রের কাউকে বিয়ে করতে না পারে। মনে করা হোত যে, সাদাদের সাথে রক্তের মিশেলে ধীরে ধীরে একটা সাদা অস্ট্রেলিয়া গড়ে উঠবে, যা ছিল আসলে একটা গণহত্যার সমতূল্য। কিন্তু কিছু করার ছিল না, এটাই ছিল সরকারী নীতি।
একার্থে, ১৯২০-৩০ সালের দিকে ফিটজরয় ও কলিংউডে যে এবোরিজিনাল কমিউনিটি গড়ে উঠেছিল, তার পেছনে এই কালো আদিবাসীদেরকে সাদা করণ প্রকল্পের একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। ১৮৮৬ সালে হালফ-কাস্ট এক্ট প্রবর্তিত হয়, যার মাধ্যমে তরুন আদিবাসীদেরকে ইউরোপীয়ানদের সাথে মিশতে ও বিবাহে উতসাহিত করা হত, যাতে তারা মূলধারার সাথে মিশে যেতে পারে। এই আইন এবং সেই সময়ের অর্থনৈতিক মন্দা অনেক আদিবাসী মানুষকে কাজের সন্ধানে শহরে আসতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে তারাই একত্রিত হয়ে একটি কমিউনিটি গড়ে তোলে নিজেদের জন্য। হিতে বিপরীত! কিন্তু মেলবোর্নে এত জায়গা থাকতে কলিংউড/ফিটজরয়তেই কেন গড়ে উঠল এই বসতি? কারণটা সম্ভবত এই যে, ওগুলো ছিল খেটে খাওয়া মানুষের বাসের এলাকা, ফলে সেখানে অনেক বোর্ডিং হাউস বা মেস বাড়ি শস্তায় মিলত, এবং জিনিসপত্রের দামও কম ছিল অন্যান্য এলাকার তুলনায়। আরও ছিল স্নো-বল ইফেক্ট; প্রথম দু-তিনটা পরিবার ওখানে বসতি গাড়ার পরে তাদের চেনাজানা অন্যরাও শহরে এসে সেই এলাকাতেই বাসা বাঁধে। এভাবে এক দুই তিন করে আস্তে আস্তে খবরটা শহরমূখী সব আদিবাসীদের কানেই পৌঁছে যায়। এভাবে ফিটজরয় হয়ে যায় তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অবশ্যই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্নায়ুকেন্দ্র। সাদারা এই দেশে আসার আগেও তো এমনই ছিল – আদিবাসীদের মিলিত হওয়ার এক একটা জায়গা থাকত, যেখান থেকে তারা সামাজিক নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। সাদারা আসার পরের যে ঝড়, তার পরে এই প্রথম আবার তারা সে রকম একটা জায়গা পেল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুদ্ধফেরত সৈন্যদের পূনর্বাসন করতে গিয়ে সরকার আদিবাসী মিশনগুলো বন্ধ করে দেয় অথবা সেই মিশনেই সৈন্যদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেক এবোরিজিনালও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে যুদ্ধ করেছিল, তবে তারা সে সব সুযোগ-সুবিধার কিছুই পায় নি। ইতিহাস থেকেও তাদেরকে বাদ দিয়ে হয়েছে। আদিবাসী সৈন্যরা দেশে ফিরে এসে দেখলেন, তাদের সাদা সহকর্মীরা জমি-বাড়ি-পেনশান নানা কিছুই পাচ্ছেন প্রাক্তন বীর হিসেবে, আর তাদের জন্য এমনকি যাওয়ার জায়গাটুকুও অবশিষ্ট নেই এবোরিজিনাল মিশনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে – ফলে তারা শহরের পথ ধরলেন। ততদিনে ফিটজরয়ের নাম চাউর হয়ে গেছে আদিবাসীদের মাঝে। এইসব মানুষেরা সেখানে এসে জুটলেন, এবং অবশ্যই যুদ্ধে যাওয়ার আগের চেয়ে অনেক বেশী রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে সেখানে জুটলেন।
যারা ভুলে গেছেন তাদেরকে মনে করিয়ে দিই, ১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ বন্দিশিবির স্থাপনের পর থেকে এবোরিজিনালরা আসলে তাদের ভূমি ও আবাসস্থল থেকে সমূলে উতখাত হয়েছিল। শুধু এটুকুতেই শেষ হয় নি – তারা আসলে হাফ কাস্ট এক্ট এবং খ্রীস্টান ধর্মপ্রচার মিশনের হাতে বন্দীও হয়েছিল। বলা চলে, ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত কলোনিয়াল সভ্যতার চাকার তলায় পিষ্ট হয়েছিল। তাদের জমি দখল করে গড়ে উঠেছিল গরুর খামার, আখের ক্ষেত, কিম্বা বাজারঘাট সড়ক দোকানপাট সেলুন বেশ্যালয় পুলিশকেন্দ্র ভূমিঅফিস ধর্মপ্রচারমিশন রেস্তারা জুয়ারআসর নাগরিক ও বনিকসমেত শহর। ফলে সেখানে আদিবাসীদের থাকার কোন উপায়ও ছিল না। আপন দেশে পরদেশী হওয়ায় আদিবাসীদের কেউ কেউ মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল বটে, তবে তাতে উন্মত্ত নগরবাসীরা ক্ষেপে গিয়ে এবোরিজিনদেরকে একেবারে সমূলে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এবোরিজিনদেরকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যে তাদেরকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, এবং তাদের বাড়িঘরগুলিকেও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। পুরো ব্যাপারটাকে সভ্যতার দাবীর কাছে অসভ্য বর্বরদের স্বাভাবিক পরাজয় হিসেবে ব্যাখ্যা করে ১৮৭৪ সালে কুকটাউন হেরাল্ড পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে,
When the savages are pitted against civilization, they must go to the wall; it is the fate of their race. Much as we may deplore the necessity for such a state of things, it is absolute necessary, in order that the onward march of civilization may not be arrested by the antagonism of the aboriginals.
যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে ফিটজরয়তে এলেন, তারা যেন এক জীবন খুঁজে পেলেন। স্বাধীন জীবন। আশেপাশে অনেক ফ্যাক্টরী; কাজ করলেই নগদ টাকা। মিশনের সেই নিয়ন্ত্রিত জীবন আর নয়। তারা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন। শত প্রতিকূলতা সত্বেও ইউরোপীয়ানদের ভাষা শিখে, তাদের নিয়ম শিখে নিজেদের অধিকার আদায়ের স্বপ্নে বিভোর হতে লাগলেন। সেখানেই অস্ট্রেলিয়ান এবোরিজিনদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন, অস্ট্রেলিয়ান এবোরিজিনিস লীগ গঠিত হয় তিরিশের দশকে। গ্যারি ফোলি ছিলেন একজন সক্রিয় আদিবাসী অধিকার কর্মী, যার উদ্যোগে ১৯৭২ সালে ক্যানবেরায় এবোরিজিনাল টেন্ট এম্বাসি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনিও সিডনী থেকে এই ফিটজরয়তে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন সত্তুরের দশকে। এইসব প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের সংগ্রামকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। ফিটজরয়ের প্রথম দিকের সবচেয়ে বিখ্যাত মুখ ছিলেন ডগলাস নিকলস, যিনি ১৯২০ এর দশকে কূখ্যাত কুমেরাগুঞ্জা এবোরিজিনাল স্টেশান থেকে এসেছিলেন। কার্লটন ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলার অফার পেয়েছিলেন তিনি। এই ফুটবল সকার নয়, অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল, যা আসলে রাগবীর মতন একটা খেলা যেখানে হাত-পা দিয়ে ওভাল আকারের একটা বল নিয়ে প্রতি দলে আঠারোজন খেলোয়াড় মিলে খেলে। ফুটবল তথা সকার, রাগবী, ক্রিকেট, হকি, এমনকি অলিম্পিকের নানা খেলাকে ছাপিয়ে এই অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলই অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। অন্যান্য খেলোয়াড়দের বর্ণবাদী আচরণের কারণে কার্লটনের হয়ে তার ফুটবল খেলা হয় নি। পরে তিনি দূর্বল নর্থকোট ক্লাবে যোগ দেন। ১৯২৯ সালে এই ক্লাবটি যখন চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে, সেখানে ডগলাস নিকলস একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি যোগ দেন ফিটজরয় ফুটবল ক্লাবে। ১৯৩২ সালেই তিনি উইলিয়াম কুপারের সাথে মিলে গড়ে তোলেন অস্ট্রেলিয়ান এবোরিজিনিস লীগ। জাতীয় পর্যায়ে এবোরিজিনদের মৌলিক মানবাধিকার এবং নানা সমস্যার সমাধানের জন্য কাজ করাই ছিল এই লীগের উদ্দেশ্য। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবোরিজিনাল এডভান্সমেন্ট লীগ। তখনো এবোরিজিনদের ভোটাধিকার ছিল না, এমনকি আদমশুমারীতেও তাদেরকে গোণা হত না। ১৯৬৭ সাল থেকে এসব বদলে যায়, যার কৃতিত্ব এবোরিজিনদের এসব প্রতিষ্ঠানের, আর সে সবের সূতিকাগার ছিল ফিটজরয়। ১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়া পায় তাদের প্রথম আদিবাসী এমপি, আর ১৯৭২ সালে ডগলাস নিকলস প্রথম আদিবাসী হিসেবে স্যার উপাধী প্রাপ্ত হন, এবং ১৯৭৬ সালে তিনি সাউথ অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের গভর্নর হন।
শুরুর দিকে অনেক এবোরিজিনাল অস্ট্রেলিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। সেই পার্টির সদর দফতর ছিল ফিটজরয়তে। তারা এবোরিজিনালদের ভূমির অধিকার সহ অন্যান্য অধিকারকে সমর্থন করত। গত শতকের তিরিশের দশকে তারাই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা এবোরিজিনালদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থপূর্ণ সায়ত্বশাসনের মত ব্যাপারগুলোকে সাপোর্ট করত। এখনকার সমাজতান্ত্রিক দল, সোশ্যালিস্ট অলটারনেটিভের আস্তানাও এই এলাকাতেই। এই সোশ্যালিস্ট অলটারনেটিভের উদ্যোগে গত বছর ফিটজরয়তে একটা পথনাট্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নাম ছিল ‘দ্যা ডার্টি মাইল’।
উপরে যে জন হার্ডিং এবং গ্যারী ফোলি’কে উদ্ধৃত করেছি, এই পথনাটকটি তাদেরই লেখা, আর ইলবিয়েরি এবোরিজিনাল এন্ড টরেস আইল্যান্ডার থিয়েটারের প্রযোজনা। এটি ছিল মূলতঃ ইন্ডিজেনাস ফিটজরয়ের ইতিহাসের উপর দিয়ে হাঁটার অনুষ্ঠান। আক্ষরিক অর্থেই হাঁটা – কার্লটন গার্ডেনসের একটা বড় বটগাছের তলা থেকে শুরু করে গেরট্রুড স্ট্রীট হয়ে নানা অলিগলি পেরিয়ে বিভিন্ন ঠিকানায় দাঁড়িয়ে সেখানকার ইতিহাস শোনা এবোরিজিনাল কমিউনিটির সিনিয়রদের মুখে। অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা ছিল সেটি। থিয়েটার বলতে আমরা বুঝি প্রায়ান্ধকার হলঘরে বসে পপকর্ন চিবুতে চিবুতে অভিনয় দেখা। অনেকে ঘুমিয়েও যায় সেখানে। আর এই ‘দ্যা ডার্টি মাইল’ শো’তে আমরা দর্শক-শ্রোতা-অংশগ্রহণকারীরা উত্তেজনা আর অপরাধবোধের এই যুগলবন্দীর মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করছিলাম এক প্রায় ভুলে যাওয়া ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। না, আমেরিকান কালোদের সংগ্রামের মতন এই এবোরিজিনদের সংগ্রাম প্রবাদপ্রতিম হয় নি। হয়নি ভারতীয়দের স্বাধীনতার সংগ্রামের মতন সাফল্যমণ্ডিত। তবে তারপরেও অতি অল্পসময়ে যেভাবে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
কার্লটন গার্ডেনসের সেই বড় বটগাছটি শতবর্ষজীবী। এই এলাকার অনেক কিছুই পালটে গেছে, তবে রাস্তাঘাটগুলি একই রকম রয়ে গেছে, আর রয়ে গেছে এই গাছটি। এই গাছটিই ছিল এবোরিজিনদের অলিখিত ক্যানবেরা, অর্থাৎ মিলনস্থল। রাজধানী অর্থে বলিনি; ক্যানবেরা একটি এবোরিজিনাল ভাষার শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ মিলনমেলা। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হল। একেক জায়গায় গিয়ে থামছি, আবার হাঁটছি, এই করে শেষে হাজির হলাম স্মিথ স্ট্রিটের সমান্তরালে চারকোল লেইনে। অনেকটা যেন আদিবাসী মানুষের যাত্রার মতই – ইউরোপীয়ানদের আগমনে নিজের বাস্তুভিটা থেকে উতখাত, পরে এবোরিজিনাল সেটেলমেন্টে কিম্বা খ্রীস্টান মিশনে, মিশন বন্ধ হয়ে গেলে আবার শহরে, কেউ কেউ নিজ পরিবার থেকে ‘চুরি’ হয়ে ইউরোপীয়ানদের তত্বাবধানে, এভাবে পথে পথে ঘুরতে থাকা এক অনিশ্চিত জীবনেরই রেপ্লিকা যেন! অনেক জায়গায় থামল আমাদের কাফেলা, অনেক গল্প শোনা হল। বসন্তের বিকেলে আমরা ২০ ডলারে টিকেট খরিদ করা প্রায় শ’খানেক লোক একসাথে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম কেউ বুমেরাং, কেউ এবোরিজিনদের চেনা নানা গাছের পাতা/ডাল বা কাঠবাদাম হাতে নিয়ে, কেউ কেউ সেই সময়ের ছবি আঁকা নানা পোস্টার হাতে নিয়ে। এক জায়গায় একজন ড্রাইভার তার গাড়ি পার্ক করছিল। ওই ভবনটি একসময় ছিল এবোরিজিনাল হাউজিং বোর্ড – এখন সেখানে দামী ইউরোপীয়ান ব্রান্ডের ফ্যাশন আউটলেট। কেউ জানে না। অথবা জানে।
ফিটজরয়ের এইসব আদিবাসী মানুষেরা ছিল নানা গোত্রের। ইউরোপীয়ানদের আসার আগে যেখানে তারা নানা গোত্রে বিভক্ত ছিল, সেখানে দু’শ বছরের বঞ্চনার পরে তারা অবশেষে ফিটজরয়তে এসে একে অন্যের সাথে আপন হল, নিজেদেরকে এক করে ভাবতে শিখল। নিজেরা এক সাথে লড়তে শিখল। অনেকটা ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ফলে যেমন উত্তর-দক্ষিন-পূর্ব-পশ্চিম ভারত একসূত্রে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল, সেরকম। যেহেতু ইউরোপীয়ানদের কাছে তাদের ছিল একটাই পরিচয়, ব্ল্যাক ফেলা (black fella), কাজেই তারা নিজেরা নিজেদের গোত্রবিভেদ ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছিল নিজেদের সম্মিলিত অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। আন্তগোত্র বিয়ে, যা আগে খুবই কম হত, তা অনেক বেশী হতে লাগল। অস্ট্রেলিয়ার নানা প্রান্তের এবোরিজিনালরা পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা বোধ করত, যা তারা আগে তাদের কৌম সমাজে দেখে নি। ফলে এই যাত্রায় সাফল্যই তাদের ভবিতব্য ছিল। কথায় আছে না, একতাই বল।
কলোনাইজেশানের প্রথম কয়েক দশকেই এবোরিজিনদের তিন চতুর্থাংশ মারা গিয়েছিল সংঘর্ষে, ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত রোগে, ইউরোপের শেখানো মাদক-আফিমে এবং স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে উতখাত হয়ে। দু’শ বছরের বন্দীজীবনের পরে তারা মুক্ত হয়েছে, তবে এখনো মূলধারার মানুষের সাথে সামাজিক-অর্থনৈতিক-স্বাস্থ্যগত নানা সূচকে তারা পিছিয়ে আছে। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী আদিবাসীদের উপরে সকল বৈষম্য ও অন্যায়ের জন্য, বিশেষ করে স্টোলেন জেনারেশানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান। আদিবাসীরা তাদের জমির অধিকার ফিরে পেয়েছে ১৯৯২ সালে। আদিবাসীদের উপরে অত্যাচারের কথা এদেশে স্বীকার করা হয়, পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হয়, এবং যে কোন সরকারী অনুষ্ঠানের শুরুতে ওই এলাকার আদিবাসী গোত্রের প্রতি সন্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। ফেডারেল সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী প্রতিবছর ‘ক্লোজ দ্যা গ্যাপ’ নামে একটা রিপোর্ট পেশ করেন সংসদে, যেখানে মূলধারার মানুষের সাথে আদিবাসীদের জীবনমানের পার্থক্য কতখানি কমল/বাড়ল তা পর্যালোচনা করা হয়, এবং নানা সুপারিশ করা হয়। অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদেরকে বলা হোত Aboriginal, তুচ্ছার্থে এবং সংক্ষেপে বলা হোত Abo, Aborigini বা Abrogini। এসব অপমানসূচক নামগুলো এখন ব্যবহার করা অস্ট্রেলিয়ান আইনে নিষিদ্ধ। এমনকি ‘এবো
রিজিনাল’ শব্দটার ব্যবহারও কমে যাচ্ছে; তাদেরকে Indigenous Australians এবং First Australians বলা হয়।
ডার্টি মাইল নামে খ্যাত সেই গেরট্রুড স্ট্রীট এখনো আছে তার আগের জায়গাতেই। ওপথে আমার যাওয়া হলে ইতিহাস এসে যেন একটা ঝাপটা মারে আমার অলস চোখেমুখে, আর মনে করিয়ে দেয় আদিবাসীদের সেই অবিস্মরণীয় সংগ্রামগাথা। ফার্স্ট অস্ট্রেলিয়ানদের নতুন করে অস্ট্রেলিয়ান হওয়ার সেই সংগ্রামগাথা।