দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে অভিবাসী ও
আশ্রয়প্রার্থীর নামে শরনার্থীদের যে স্রোত এখন চলছে তা কী নতুন আরেকটি
বিশ্বযুদ্ধের আগমনী বার্তা? আর যদি ঘটনা ধীরে ধীরে সেদিকে যায় তাহলে কী
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সত্যি সত্যিই সমাগত? আগের দুইটি বিশ্বযুদ্ধে প্রধান
প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি। ঘটনা বিবেচনায় যদি ইউরোপ অভিমুখে বর্তমান
শরনার্থীদের ঢলকে সত্যি সত্যি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি বলতে চাই,
তাহলে কী জার্মানি আবারো প্রধান প্রতিপক্ষ হতে যাচ্ছে সেই বিশ্বযুদ্ধের?
চলুন, ইউরোপ অভিমুখে বর্তমান সময়ের শরনার্থীদের একটা চিত্র সম্পর্কে আলোচনার শুরুতে একটা ধারণা নেওয়া যাক। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপ অভিমুখে শরনার্থীদের ঢল নামায় বিবিসি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। যেখানে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএইচসিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিবিসি বলছে, সিরিয়ায় আইএস বা ইসলামী স্টেট ও সিরিয় সরকারের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে, কেবলমাত্র কয়েকলাখ সিরিয়বাসী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থণা করেছেন। মূলত ইউরোপের পাঁচটি দেশে সিরিয় শরনার্থীদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন সবচেয়ে বেশি। আর এ সংখ্যাটি তিন লাখ ৪৮ হাজার ৫৪০। যার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্দ সম্পন্ন দেশ জার্মানি।
২০১১ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত জার্মানিতে প্রায় ৯৮ হাজার ৭৮৩ জন সিরিয় শরনার্থী রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সুইডেন। সুইডেনে অন্তত ৬৪ হাজার ৬৮৫ জন সিরিয় শরনার্থী রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন। এরপর তৃতীয় স্থানে রয়েছে সার্বিয়া। সার্বিয়ায় অন্তত ৪৯ হাজার ৪৪৬ জন সিরিয় শরনার্থী রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার জন্য আবেদন করেছেন। হাঙ্গেরিতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন অন্তত ১৮ হাজার ৭৭৭ জন সিরিয় শরনার্থী। অস্ট্রিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন ১৮ হাজার ৬৪৭ জন সিরিয় শরনার্থী।
বিবিসির ওই প্রতিবেদন বলছে, এখন পর্যন্ত ইউরোপের অন্যান্য দেশের মধ্যে বুলগেরিয়ায় ১৫ হাজারের বেশি, নেদারল্যান্ডে প্রায় ১৪ হাজার, ডেনমার্কে প্রায় ১২ হাজার, সুইজারল্যান্ডে প্রায় ৮ হাজার, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে প্রায় ৬ হাজার, স্পেনে সাড়ে ৫ হাজার, নরওয়েতে সাড়ে চার হাজার, গ্রিসে চার হাজার, মন্টেনিগ্রোতে সাড়ে তিন হাজার, সাইপ্রাসে তিন হাজার, ইতালি ও মেসিডোনিয়ায় আড়াই হাজার, মাল্টা, পোল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডে অন্তত এক হাজার সিরিয় শরনার্থী রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। এছাড়া ইউরোপের ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিক, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, আলবেনিয়া ও লুক্সেবার্গেও সিরিয় শরনার্থীরা রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন।
সংকটের শুরুর কথা:
ওয়ান ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে অভিযান চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক অভিযানের সময় বৃটেন, ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেক মোড়ল দেশ তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সাদ্দাম যুগের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক থেকে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল, তখন শুরু হলো মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে আরব বসন্তের নামে সরকার পতনের ঘটনা। ইয়েমেন দিয়ে যার শুরু আর লিবিয়া দিয়ে যার শেষ। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। কারণ বাশার আল আসাদের পেছনে রয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
মিশরে হুসনে মোবারকের পতন হয়েছে, লিবিয়ায় কর্নেল মুয়ামের গাদ্দাফির পতন হয়েছে। ইয়েমেনে আবদে রাবু মনসুর হাদি'র সরকারের পতন হয়েছে। কেবল পুতিনের সার্পোট নিয়ে টিকে গেছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। নইলে এতদিনে আসাদেরও পতন ঘটত। আসাদের পতন ত্বরান্বিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আল-কায়েদা স্টাইলে সৃষ্টি করল আইএস বা ইসলামী স্টেট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যা সমর্থন যুগিয়েছে তাদের অন্যতম মিত্র বৃটেন। অর্থ্যাৎ মধ্যপ্রাচ্যে সংকট বজায় রাখার জন্য বর্তমানে যে আইএস বা ইসলামী স্টেটের অস্তিত্ব, সেটি মার্কিনী ও তাদের মিত্রদেরই সৃষ্টি করা।
আবার এদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রোপাগাণ্ডায় লিপ্ত মার্কিন ও বৃটিশ মিডিয়াগুলো। ইসলামী স্টেট বা আইএস জঙ্গীরা যতই ইসলামের নামে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইসলামী স্টেট স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেন না কেন, এটি আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের তেলের দখল ও অস্ত্র বিক্রির নিশ্চয়তা বাড়াতে একটি ষড়যন্ত্র মাত্র। যার শিকাড় এখন মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ সিরিয়, লিবিয়া ও ইরাকি শরনার্থীরা। আইএস বা ইসলামী স্টেট জঙ্গীরা ইতোমধ্যে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার একটা বিশাল জায়গা নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হয়েছেন। যার মধ্যে ইরাক ও লিবিয়ায় রয়েছে মার্কিন মদদপুষ্ট পুতুল সরকার। আর সিরিয়ায় রয়েছে রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট আসাদ সরকার। এছাড়া মার্কিনীদের মিত্র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছে সৌদি আরব, ইয়েমেন, কাতার, তুরস্ক, মিশরসহ অনেক আরব দেশ। এদের অনেকের দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের সঙ্গে বিরোধ থাকলেও এরা মার্কিনীদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুভাবে যুক্ত। ইরানের অবস্থান উভয়মুখী। ইরানের সম্পর্ক রাশিয়ার সঙ্গে যতোটা ভালো, আইএস বা ইসলামী স্টেট প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ততটা ভারসাম্যপূর্ণ।
আইএসআইএস বা ইসলামী স্টেট:
এবার চলুন আইএসআইএস বা ইসলামী স্টেট জঙ্গীরা আসলে কারা তাদের সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের অনুগত সুন্নী সেনাদের একটা বিশাল অংশই আসলে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর আইএসআইএস বা ইসলামী স্টেট নাম নিয়ে ইরাকের ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। সাদ্দামের অনুগত সেসব সেনাদের অর্থসাহায্য দিয়ে সহায়তা করছে সৌদি আরব ও কাতারসহ কিছু আরব দেশ। আর এদের কাছে গোপনে অস্ত্র বিক্রি করছে স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন এবং তাদের মিত্ররা। আবার শিয়াপ্রধান ইরান, ইরাকে মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারকে সহায়তা করার জন্য আইএস জঙ্গীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত, এমন গুজবও রয়েছে। আসলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য সংকটের প্রধান কলকাঠি যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার হাতে। সুযোগ বুঝে এরা একজন একটি পক্ষে অবস্থান করছে।
একদিকে সারা বিশ্ব থেকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী সুন্নী মুসলমানরা দলে দলে সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে গিয়ে আইএস বা ইসলামী স্টেটে যোগদান করছেন। অন্যদিকে মার্কিন ও বৃটিশদের মিডিয়া এদেরকে সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠন বলে প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের মদদে সৌদি আরব ও কাতার আইএসকে অর্থসহায়তা দিচ্ছে। আর আইএস-এর কাছে গোপনে অস্ত্র বিক্রির ধান্দা করছে আবার এরাই। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সমর্থনে আবার রাশিয়া থাকায় এই আইএস কিন্তু একতরফা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারছে না। ইরান শিয়াপ্রধান এবং রাশিয়ার মিত্র হলেও গোপনে আইএস-এর কাছে অস্ত্রও বিক্রি করছে আবার প্রকাশ্যে আইএস-এর বিরুদ্ধে ইরাকে মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারকে সহায়তায় যুদ্ধও করছে। অর্থ্যাৎ আইএস প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যে কেবল ইরান রয়েছে দ্বৈত ভূমিকায়।
২০১১ সালের এপ্রিল থেকে আইএস জঙ্গীদের সঙ্গে ইরাক, সিরিয়া, মিশর ও লিবিয়ায় সরকার সমর্থকদের যুদ্ধ আসলে ধীরে ধীরে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে পরিনত হয়েছে। যার ফলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে লাখ লাখ মানুষের ঢল ছুটছে ইউরোপের উদ্দেশ্যে। ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এসব শরনার্থীরা ইউরোপে উন্নত জীবনের আশায় ছুটছেন। যুদ্ধের মধ্যে মরার চেয়ে ইউরোপে গিয়ে বাঁচার আশা করছে এসব অসহায় মানুষেরা।
শরনার্থী সংকট:
২০১১ থেকে লাখ লাখ উদ্বাস্তু এবং অভিবাসী ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় পাবার চেষ্টা করছে। আশ্রয় প্রার্থীদের বেশির ভাগই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে এসেছেন। এসব আশ্রয় প্রার্থীরা সার্বিয়া এবং গ্রিস থেকে হাঙ্গেরি, তারপর অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি হয়ে জার্মানি যাবার চেষ্টা করছেন। এসব শরনার্থীদের প্রধান টার্গেট এখন ইউরোপের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র জার্মানি। এখন পর্যন্ত অন্তত ৪০ লক্ষেরও বেশি সিরিয় দেশত্যাগ করেছেন। তারা বর্তমানে কোন দেশে কতজন আশ্রয় পেয়েছে সেই হিসাব দিতে গিয়ে বিবিসি বলছে, চলতি বছর (২০১৫) ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট অন্তত ৪০ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯ জন সিরিয় বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৯৯ জন সিরিয় শরনার্থী। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে লেবানন। লেবাননে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ১১ লাখ ১৩ হাজার ৯৪১ জন সিরিয় নাগরিক। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জর্দান। জর্দানে অন্তত ৬ লাখ ২৯ হাজার ২৬৬ জন সিরিয় নাগরিক আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া ইরাকে প্রায় ২ লাখ ৪৯ হাজার ৪৬৩ জন, মিশরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৭৫ জন ও লিবিয়ায় ২৪ হাজার ৫৫ জন সিরিয় নাগিরক আশ্রয় নিয়ে শরনার্থী জীবন যাপন করছেন। যাদের একটা বিশাল অংশই এখন ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন।
ইউরোপের পথে পথে সিরিয় শরণার্থীদের ঢলের ছবি দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে আরব দেশগুলো এদের জন্য কী করছে? বিশেষভাবে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল বা জিসিসিভূক্ত দেশ– সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত এসব শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ রেখেছে কেন? এই প্রশ্নের জবাবে সৌদি আরব দাবি করছে, ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা প্রায় ৫ লাখ সিরিয় নাগরিকদের চাকরি দিয়েছে। কাতার দাবি করেছে, কাতার পেট্রোলিয়াম-এর কর্মচারিরা তাদের বেতন থেকে প্রতি মাসে কিছু অর্থ সিরিয় শরণার্থীদের জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যান্য জিসিসিভুক্ত দেশ এখনো এই প্রশ্নে অনেকটাই নিরব। আসলে মার্কিন ও বৃটিশদের শিখিয়ে দেওয়া কথাই এরা এদের মিডিয়ায় প্রোপাগাণ্ডা হিসেবে তথ্য আকারে প্রচার করছে।
ইউএনএইচসিআরের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকেছে অন্তত ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯০২ জন। এদের মধ্যে ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মারা গেছে অন্তত ২ হাজার ৮৫০ জন। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশই এসেছে ১০টি দেশ থেকে। এসব শরনার্থীদের সংখ্যার দিক থেকে এই দেশগুলোর তালিকায় ৯ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। বিবিসি বলছে, মোট সংখ্যার অন্তত ১ শতাংশ বাংলাদেশি। ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, চলতি বছর সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী ঢুকেছে সিরিয়া থেকে। যা মোট শরণার্থীর প্রায় ৫১ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে থাকা আফগানিস্তান থেকে ঢুকেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এছাড়া ইরিত্রিয়া থেকে ৮ শতাংশ, নাইজেরিয়া থেকে ৪ শতাংশ, ইরাক থেকে ৩ শতাংশ শরণার্থী ঢুকেছে ইউরোপে। আর ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে এখন পর্যন্ত নৌদুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২ হাজার ৮৫০ জন।
এখন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকেছে প্রায় ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯০২ জন শরনার্থী। ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে মূলত দুটি দেশে যাচ্ছে এসব শরণার্থীরা। যার মধ্যে গ্রিসে ঢুকেছে প্রায় ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৫৫ জন এবং ইতালিতে ঢুকেছে অন্তত ১ লাখ ২১ হাজার শরনার্থী। এসব শরনার্থীদের বেশিরভাগের লক্ষ্য এখন হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানি। গত সপ্তাহে জার্মানীর চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেল এসব শরনার্থীদের একটা বিশাল অংশকে জার্মানীতে আশ্রয় দেবার ঘোষণা দেবার পর, জার্মানীর দ্বিতীয় শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যাক্তি ভাইস চ্যন্সেলর জিগমার গ্যাব্রিয়েল গতকাল বলছেন, আগামী কয়েক বছর জার্মানি প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ করে শরণার্থীকে জায়গা দিতে সক্ষম। মূলত জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর জিগমার গ্যাব্রিয়েলের এই কথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতির ব্যাপারটি। ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জার্মানি প্রায় ৮ লাখ শরনার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেখানে এক লাখ ৬০ হাজার শরনার্থীদের কে কতজনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে, তা নিয়ে দর কষাকষি করছেন, সেই মুহূর্তে জার্মানির এমন ঘোষণার আড়ালে আসলে অন্য একটি সত্য লুকিয়ে আছে। জার্মান আসলে শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়ে গোটা ইউরোপে তাদের শক্তিমাত্রা আরো বাড়ানোর পায়তারাই করছে। ওদিকে এক লাখ ৬০ হাজার আশ্রয়প্রার্থীর দায় ইউরোপের কোন দেশকে কতটা নিতে হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আগামীকাল ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্যক্লদ ইয়ংকার ঘোষনা করবেন।
মধ্যপ্রাচ্য সংকটের শেষ কোথায়?
তাহলে মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে ঘিরে কী নতুন করে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পাল্টে যাবে? এই প্রশ্নের আসল উত্তর লুকিয়ে আছে আসলে জার্মানির প্রতি বছর ৫ লাখ শরনার্থীকে আশ্রয় দিতে সক্ষম এমন দুঃসাহসী উচ্চারণের ভেতরে। যা আসলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব কিনা এই মুহূর্তে চট করেই তা বলা মুশকিল হলেও, জার্মানির আটসাট বেঁধে প্রস্তুতিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেরকমটি ইঙ্গিত করছেন। তাহলে কী আইএস বা ইসলামী স্টেটের নামে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মানচিত্র আবারো বদলে যাবে? এই প্রশ্নের আসল জবাব হয়তো সময়ই বলে দেবে।
কিন্তু গোটা মধ্যপ্রাচ্য সংকট যারা তৈরি করছেন, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের আব্বা ইসরাইল কিন্তু ইউরোপে লাখ লাখ শরনার্থীদের ঢল নামার মুহূর্তে কিছুটা হলেও নিশ্চুপ। হয়তো এরা নতুন করে কিভাবে মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে আরো ঘনিভূত করা যায়, সেই দূরভিসন্ধি নিয়েই এখন টেবিলওয়ার্ক করছেন। কারণ, রাশিয়া বাদে গোটা ইউরোপ মার্কিনীদের মিত্র হলেও সিরিয় শরনার্থীদের ঢল যেভাবে ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকছে, তাতে গোটা ইউরোপ এখন মধ্যপ্রাচ্য সংকটের চাপে অনেকটাই নাস্তানুবুদ। যে কারণে এক লাখ ৬০ হাজার শরনার্থীদের কে কত ভাগ নেবে সেই প্রশ্নটি এখন ইউরোপীয় নেতাদের আলোচনার টেবিলে গড়ালেও খুব শীঘ্রই যে এই সংখ্যাটি রাতারাতি আরো বেড়ে যাবে, সেই আশংকাই এখন ইউরোপী নেতাদের চোখেমুখে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার এবং মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তিশালী দেশগুলোর অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যই দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কোনো সমাধান নেই। যার সমাধান আসলে এসব শক্তিশালী দেশের হাতেই রয়েছে। যা হয়তো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমেই কেবল নিষ্পত্তি হতে পারে। যেখানে আবারো একটি অন্যতম পক্ষ ভাবা হচ্ছে জার্মানিকে। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান গৃহযুদ্ধ এবং ইউরোপের উদ্দেশ্যে শরনার্থীদের মিছিলের একটা ফয়সালা হয়তো কেবল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত আরেকটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধই এর সমাধান দিতে পারে। গোটা মধ্যপ্রচ্য পরিস্থিতি এবং জার্মানির শরনার্থী বিষয়ক প্রস্তুতি অন্তত সেই ইঙ্গিত দেয়। আর সেটি যদি ঘটে তাহলে আবারো গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মানচিত্রে যে বদল ঘটবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।...