আমরা ছোট থেকেই যে যতটুকুই বিজ্ঞান পড়েছি তা থেকে অন্তত এতটুকু বুঝেছি যে বিজ্ঞান হল প্রকৃতির ঘটনাগুলোকে নিয়মে বেঁধে দেয়া । “সবকিছুরই একটা নিয়ম থাকবে- নিয়মের বাইরে কিছু ঘটবে না”- এটাই বিজ্ঞানের মূলকথা । আর এই নিয়মগুলো আবিষ্কার করাটাই “বিজ্ঞান” । কিন্তু পরবর্তীতে এমন কিছু ব্যাপার আবিষ্কৃত হল যা বিজ্ঞানের এই মূলনীতিকেই টলিয়ে দিল। অতি ক্ষুদ্র কণিকার জগত নিয়ে বিজ্ঞানীরা যত ঘাঁটাঘাঁটি করা শুরু করলেন ততই দেখলেন এই কণিকাগুলো যেন হতচ্ছাড়া ধরনের- কোন নিয়ম ই যেন এদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে কি বিজ্ঞান অর্থহীন? উঁহু, বরং এই পর্যায়ে এসে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন তারা কতটা Cool ... তারা এই ক্ষুদ্র কণিকাগুলোর অবাধ্যতা নিয়েই খুলে বসলেন পদার্থবিজ্ঞানের নতুন শাখা- “কোয়ান্টাম ফিজিক্স”!!
আমরা জানি প্রতিটি বস্তুই অতি ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। যাকে আমরা বলি পরমাণু। এই পরমাণু ও তৈরি বিভিন্ন আরও ক্ষুদ্র কণা দিয়ে । এগুলোকে বলে মৌলিক কণিকা। আর এসব কণিকার পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ধর্ম, আচরণ – আসব নিয়েই “কোয়ান্টাম ফিজিক্স” । এই কোয়ান্টাম ফিজিক্স যেসব চমকপ্রদ ব্যাপার আবিষ্কার করেছে, তার মাঝে ১ টি হল “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” (Quantum Fluctuation) এবং বোধ করি সবচেয়ে আশ্চর্যকর জিনিসগুলোর মাঝে এটি একটি ।
“কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” নিয়ে বলার আগে একটু পেছনে যেতে হবে...
আমরা স্কুলে পড়েছিলাম “শক্তির নিত্যতার সূত্র” এবং “ভরের নিত্যতার সূত্র”। মহাবিশ্বে মোট শক্তির পরিমাণ সমান , মোট ভর ও তাই। কিন্তু পরে আমরা জানলাম ব্যাপারটা সত্যি না পুরপুরি । আসলে ভর ও শক্তি নিজেদের মাঝে পরিবর্তিত হতে পারে। আইনস্টাইন এর E = mc2 প্রমাণ করে ভর ও শক্তি একই জিনিস। একটা নির্দিষ্ট স্থানে ভর ও শক্তির পরিমাণ একসাথে নির্দিষ্ট – আলাদা আলাদা ভাবে নয় । একে আমরা বলি “ভর ও শক্তির নিত্যতা”। একটা নির্দিষ্ট স্থানে ভর ও শক্তির মিলিত পরিমাণ কখনো পরিবর্তিত হবে না- এটাই এর মুল কথা। কিন্তু এই ধারনায় চির ধরাল সেই গোলমেলে হতচ্ছাড়া কণিকা জগত । আবির্ভাব হল কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর।
একটি নির্দিষ্ট স্থানে অনবরত বিভিন্ন ধরনের কণিকা (অর্থাৎ ভর তথা শক্তি)তৈরি হয় এবং অল্প সময় পর আবার তা মিলিয়ে যায় – এটাই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন। অবাক লাগছে? ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করি – এই কণিকাগুলো কিন্তু “কোনকিছু” থেকে উৎপন্ন হয় না। অর্থাৎ Something from nothing !! আরও বেশি অবাক লাগছে? বিশ্বাস ই হচ্ছে না- তাই না? কিন্তু এটাই হয়- এবং সব সময় ই হয়। আপনার আশপাশে যা কিছু দেখছেন তাদের ভেতরে অতি ক্ষুদ্র জগতে ঢুকতে পারলে আপনি দেখতেন কত অবিশ্বাস্য ব্যাপার স্যাপার সেখানে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে...
এখন মনে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন উকি দিচ্ছে- তাই না? প্রথমটা নিশ্চয়ই – “কেন আমরা আমাদের জীবনে এই ফ্লাকচুয়েশন দেখতে পাই না??বুঝতে পারি না? “ কারন ওই যে- ক্ষুদ্র জগত ... এত ক্ষুদ্র পর্যায়ে এটা ঘটে যে এটা বোঝা আমাদের জন্য অসম্ভব । ভর যখন বাড়ে- তখন ফ্লাকচুয়েশন কমে যায়... (ডি ব্রগলী এর সমীকরণ এর মত) এবং আমাদের চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান আপ্লিকেবল হয় ।এরপরে প্রশ্ন আসে- “তাহলে ভর-শক্তির কোন নিত্যতা নেই?” না। ভর শক্তির নিত্যতার এই সূত্র ও ভেঙ্গে পড়ে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর কারনে। কিন্তু খুবই কম সময়ের জন্য। কিন্তু একটা জিনিস বলে রাখি- কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে শক্তি বা ভর এর এই তারতম্য অত্যন্ত কম সময়ের জন্য হলেও এর প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী হতে পারে। যেমন ফ্লাকচুয়েশন এর কারনে ইলেকট্রন এর চার্জ কম বেশি হয় ।এ ব্যাপারে পরে অনেক আলোচনা করব। এখন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে উৎপন্ন কণাগুলোর প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যাক ।
কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে কণা,প্রতিকণা ও ভার্চুয়াল কণা সবই তৈরি হতে পারে। প্রতিকণা সম্পর্কে অনেকের ধারনা নেই। একটি কণার সমান ও বিপরীত চার্জ যুক্ত এবং সমান ভরের একটি “কণা”, যা প্রথম কণার সাথে সংঘর্ষে সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে যায় এবং শক্তি তৈরি করে তাকে বলে প্রথম কণাটির প্রতিকণা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এই “কণা” ও “প্রতিকণা”র মাঝে শুধু একটি মাত্রায় ( Dimension ) এই পার্থক্য । আর তা হল চতুর্থ মাত্রা – “সময়” !!!! আমরা চারদিকে যা কিছু দেখছি (কণার জগতে) তারা , অর্থাৎ আমরা সবাই সময়ের যেই দিকে যাচ্ছি- প্রতিকণা তার উল্টোদিকে যাচ্ছে !! ব্যাপারটা সাইন্স ফিকশনের মত লাগছে হয়ত ,কিন্তু এটা মোটেও “ফিকশন” না । পুরোটাই “সাইন্স” । প্রকৃতির মোটামুটি সব কণারই প্রতিকণা আছে । যেমন আমাদের সবার চেনা ইলেকট্রন এর প্রতিকণা “পজিটিভ ইলেকট্রন” বা “পজিট্রন” । এই “পজিট্রন” ইলেকট্রনের সাথে মিলিত হয়ে শক্তিরূপে ফোটন কণা নির্গত করে । নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় পজিট্রন উৎপন্ন হয় এবং তা ইলেকট্রনের সাথে মিলিত হয়ে শক্তিশালী “গামা রে” তৈরি করে ।
এরপর আসি ভার্চুয়াল কণিকায় । ভার্চুয়াল কণিকা হল ভরবিহীন এমন এক ধরনের কণিকা যারা নির্দিষ্ট স্থান-কালে উৎপন্ন হয় জোড়ায় জোড়ায় (কণা ও প্রতিকণা) । আমাদের খুব চেনা একটি ভার্চুয়াল কণিকা হল ফোটন । এই ভার্চুয়াল কণা কিন্তু এমন কিছু ঘটনা ঘটায় যা মোটেও “ভার্চুয়াল” না- বাস্তব এবং তা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে ।ভার্চুয়াল কণিকা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক...
কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রকৃতির কিছু জটিল সমস্যার সমাধান করেছে সুন্দর ভাবে ।
আমাদের অনেকের মনেই হয়ত প্রশ্ন ছিল ছোট থেকে-চুম্বক কিভাবে লোহাকে টানে কোন সংস্পর্শ ছাড়াই ? মহাকর্ষের জন্য ও একই প্রশ্ন । এগুলোর উত্তর দিয়েছে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান । আধুনিক তত্ত্ব বলে যেসকল বল কোন ধরনের ফিজিক্যাল কন্টাক্ট ছাড়াই ক্রিয়া করে- যেমন ( মহাকর্ষ বল, চৌম্বক বল ) তাদের এই বল কাজ করে ভার্চুয়াল কণা দিয়েই । এদেরকে বলা হয় তখন Force Carrier । এই Force Carrier কণা একটি বস্তু থেকে উৎপন্ন হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে নির্দিষ্ট পথে । আর এই পথ আমরা পাই যে বলের Force Carrier সে বলের বলরেখা থেকে । যেমন চুম্বক থেকে বের হওয়া Force Carrier কণা চৌম্বক-বলরেখা বরাবর ছড়িয়ে যায় । মহাকর্ষ বা ত্বরিত-চুম্বক বলের জন্য সোজা ছড়িয়ে যায় কণাগুলো । এরপর নির্দিষ্ট ধরনের বস্তুর দ্বারা শোষিত হলে তা ১ টি ভরবেগ তৈরি করে । প্রতি একক সময়ে যে পরিমাণ ভরবেগ তথা কণা যুক্ত হয় তাই ওই শোষণকারী বস্তুর ওপর সৃষ্ট বল । যেমন ১ টি চুম্বক থেকে Force Carrier কণা চৌম্বক-বলরেখা বরাবর ছড়িয়ে যায় এবং চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে । এই ক্ষেত্রে বিশেষ বস্তু তথা ধাতু থাকলে কণাগুলো শোষিত হয় এবং বল সৃষ্টি করে ধাতুর ওপরে ।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রকৃতির সবকিছুকে এই কণা বা ক্ষেত্র দিয়ে প্রকাশ করতে চায় । উদাহরণ স্বরূপ আমরা ফোটনের ভরশূন্যতার কথা বলতে পারি...১টা কণা কিভাবে ভরশূন্য হয়- তা আমরা কল্পনা করতে পারি না । (সেদিন আপেক্ষিকতার ক্লাসে আমাদের সেকেন্ড বয় স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছেল- “১ তা পদার্থ ভর ছাড়া হয় কিভাবে ?” স্যার তেমন কোন উত্তর দেননি ।)কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে এই ভর ও একটি কণার ফসল ! এর নাম “হিগস” কণা । “হিগস” কণা কোন বস্তু বা অন্য কোন কণার সাথে যুক্ত থাকলেই শুধু তার ভর থাকবে । না থাকলে থাকবে না! ভার্চুয়াল কণা যেমন বিভিন্ন Force Carrier কণা- ফোটন, গ্র্যাভিটন এদের সাথে “হিগস” থাকে না জন্যই এরা ভরহীন । সুতরাং এতদিন যা জেনে এসেছি আমরা- ভর বস্তুর মৌলিক ধর্ম- ব্যাপারটা তেমন সত্যি না !! আপনার শরীর থেকে সব হিগস সরিয়ে নিলে আপনার ভর থাকবে না... যদিও আপনি থাকবেন ! (আমি অবশ্য জানি না এটা Practically সম্ভব কি না )তবে হিগস নিয়ে আমাদের জ্ঞান অনেক কম । CERN এর LHC তে এটা নিয়ে গবেষণা চলছে ।
এবার ফিরে যাই আবার কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে । কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস আমাদের সামনে এনেছে , যা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের চিন্তার জগতকে CHANGE করে দেয় । যেমন –
১. পরম শূন্যটা বলে কোন কিছু নেই । আপাত দৃষ্টিতে শূন্য স্থানের মাঝেও শক্তি ও ভরের এক কানামাছি ভো ভো খেলা প্রতিনিয়ত চলছে।
২. একটা স্থানের মোট শক্তি-সময় (নির্দিষ্ট সময়ে শক্তি ) কখনো নির্ণয় করা যাবে না। হাইজেনবার্গ এর অনিশ্চয়তা নীতি থেকে আমরা জানতে পাই যে কোন ক্ষুদ্র কণা (যেমন ইলেকট্রন) এর ভরবেগ ও অবস্থান কখনো একসাথে জানা যাবে না। একটা জানা গেলে অপরটা জানা অসম্ভব । এখানে ভরবেগ-স্থান যেরকম যুগল , ঠিক তেমনি সময়-শক্তিও সেরকম যুগল কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে । আসলে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন ও হাইজেনবার্গ এর অনিশ্চয়তা নীতি থেকেই এসেছে ।
৩. মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে নতুন ধারনা। এই বিষয়টার কথাই আমি শুরুতে বলেছিলাম । চলুন এটা নিয়ে একটু কথা বলা যাক –
কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন আসার আগ পর্যন্ত মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারটি সবচে ভালোভাবে যে তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করত তা হল “বিগ-ব্যাং” থিউরি ।(এখনও তা সঠিক বলেই মানা হয়, কিন্তু একটু “এডিট” করা হয়েছে) মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে-এই তথ্যকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে উৎপত্তি লাভ করেছে“বিগ-ব্যাং”। এই তত্ত্ব বলে মহাবিশ্ব শুরুতে ১ টা অতিক্ষুদ্র কণার মত ছিল । যার ঘনত্ব ছিল অসীম । কোন এক কারনে এই কণা বিস্ফোরিত হয় এবং প্রসারিত হয়ে হয়ে বর্তমান মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয় । বিস্ফোরণের ফলে সেই কণাটির ভর চারদিকে ছড়িয়ে যায় এবং এখনকার গ্রহ- উপগ্রহ (এবং আমরাও)সেখান থেকেই এসেছে । “বিগ-ব্যাং” এই প্রসারণের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারনা দেয় ।
এই বিগ-ব্যাং তত্ত্ব কিন্তু কিছু জিনিসকে মেলাতে পারে না। তার মাঝে একটি হল -দূর মহাকাশে এমন অনেক নক্ষত্র আছে যাদের দূরত্ব বিগ ব্যাং থেকে প্রাপ্ত জগতের বয়সের সমান আলোকবর্ষের চেয়ে বেশী । অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরে আমরা যে গতিতে প্রসারণের কথা ভাবা হয়েছিল , এখন যে মাত্রায় প্রসারণ ঘটছে , তার চেয়ে অনেক বেশী মাত্রায় প্রসারণ ঘটেছে অতীতের কোন এক সময়ে । এ সময় এলো “ইনফ্লেশন থিউরি” । এই তত্ত্ব মতে -সেই আদি অতিক্ষুদ্র কণায় বিস্ফোরণের পরে কিছুটা সময়ের জন্য অত্যধিক মাত্রায় প্রসারণ ঘটেছিল । মুহূর্তে মহাবিশ্ব বিশাল আকারে চলে আসে , তারপর আবার স্তিমিত মাত্রায় প্রসারণ চলতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এই ইনফ্লেশনের সময়, হার নিখুঁতভাবে বের করে ফেলেন । ফলে ১ টা সমস্যার সমাধান হয়ে যায়- “ইনফ্লেশন থিউরি”, “বিগ-ব্যাং থিউরির” “EXTENSION “ হিসেবে রাখা হয়... কিন্তু আরও বড় প্রশ্নের সমাধান তখনও হয়নি ।
এই যে “অতি ক্ষুদ্র কণিকা” তার আগে কি ছিল? সেটাই বা এলো কিভাবে ? কোত্থেকে এলো ?
নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কথা কোন দিকে যাচ্ছে । হ্যাঁ, বিগ ব্যাং এর সেই ক্ষুদ্র কণা আসলে এসেছিল কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর মাধ্যমে । আর যেহেতু এটা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন – সুতরাং কোথা থেকে এসেছে- তা আমরা জানি ই । কোথাও থেকে আসেনি- একা একাই সৃষ্টি হয়েছে । কোন কিছু যে একা একা তৈরি হতে পারে না – এই ধারনা থেকে আমাদেরকে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বের করে এনেছে। কিন্তু কথা হল, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন থেকে তৈরি কণার তো আয়ু স্বল্পস্থায়ী সবার কথা, হল না কেন ? এর উত্তর আগেই আমরা পেয়েছি “ইনফ্লেশন থিউরি” থেকে । ফ্লাকচুয়েশন থেকে সৃষ্ট কণাটিতে ইনফ্লেশন ঘটে । আর এ কারনেই তা ফুলে-ফেঁপে change হয়ে যায় । এরপর আসতে পারে ফ্লাকচুয়েশন এর আগে কি ছিল ? কেনই বা ফ্লাকচুয়েশন হল। আমরা আগেই দেখেছি – ফ্লাকচুয়েশন এর কোন কারন লাগে না- সে একা একাই হতে থাকে-বাইরের শক্তি- বল লাগে না। এক্ষেত্রেও এটাই প্রযোজ্য । আর যদি বলেন-এই ছোট ব্যাপারটা থেকে কিভাবে এত বড় জগত তৈরি হল-আগেও বলেছিলাম- ফ্লাকচুয়েশন ছোট হলেও এর প্রভাব বড় হতে পারে । (ইলেকট্রনের চার্জ পরিবর্তনের উদাহরণ এ জন্যই দিয়েছিলাম)
এর পর আসে “তার আগে কি ছিল? ” বিগ-ব্যাং , ইনফ্লেশন, ফ্লাকচুয়েশন সবাই বলে এর আগে কোন স্থান- কাল ছিল না। অর্থাৎ অন্যরকম এক জগত ছিল যেখানে আমাদের চেনা জানা কার্যকারণ সম্পর্ক (যাকে পদার্থবিজ্ঞানে বলে “CASUALITY”) অনুপস্থিত ছিল । আমাদের সমস্ত জ্ঞানের যে মূলভিত্তি কার্যকারণ সম্পর্ক অর্থাৎ- “এটা করলে এই কারনে ওটা হবে” সেখানে ছিল না। তাই আমরা বলতে পারব না সেখানে কি ছিল-না ছিল। তবে হ্যাঁ, এতটুকু বলা যায় যে তা ছিল এমন একটি সাব-এটমিক অবস্থা, যেখানে CASUALITY ছিল না।
বিজ্ঞান গতিময় , নিয়ত তা পরিবর্তিত হচ্ছে । আর এটাই বুঝি এর সবচেয়ে বড় শক্তি । যে কেউ একে প্রশ্ন করতে পারে, একে পরিবর্তন করতে পারে। তাই আজ আমরা যা জানি- কাল তার ভিন্নটা জানব । চিন্তার জগত , চিন্তার স্টাইল চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে অনবরত। কিছুই স্থির থাকছে না। হয়ত আজ আমরা যাকে বলছি – “তাই আমরা বলতে পারব না সেখানে কি ছিল-না ছিল” তাই হয়ত কাল ছোট বাচ্চাদের পড়ার বিষয় হয়ে যাবে । তাই আসুন , সেই পরিবর্তনকে নব মাত্রা জুড়ে দেই (অন্তত চেষ্টা করি)। শরীক হই এই মহান যাত্রায়। আর নব চিন্তা চেতনাকে গ্রহণ করি যুক্তির সাথে, জ্ঞানের নিরিখে।
আমরা জানি প্রতিটি বস্তুই অতি ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। যাকে আমরা বলি পরমাণু। এই পরমাণু ও তৈরি বিভিন্ন আরও ক্ষুদ্র কণা দিয়ে । এগুলোকে বলে মৌলিক কণিকা। আর এসব কণিকার পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ধর্ম, আচরণ – আসব নিয়েই “কোয়ান্টাম ফিজিক্স” । এই কোয়ান্টাম ফিজিক্স যেসব চমকপ্রদ ব্যাপার আবিষ্কার করেছে, তার মাঝে ১ টি হল “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” (Quantum Fluctuation) এবং বোধ করি সবচেয়ে আশ্চর্যকর জিনিসগুলোর মাঝে এটি একটি ।
“কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” নিয়ে বলার আগে একটু পেছনে যেতে হবে...
আমরা স্কুলে পড়েছিলাম “শক্তির নিত্যতার সূত্র” এবং “ভরের নিত্যতার সূত্র”। মহাবিশ্বে মোট শক্তির পরিমাণ সমান , মোট ভর ও তাই। কিন্তু পরে আমরা জানলাম ব্যাপারটা সত্যি না পুরপুরি । আসলে ভর ও শক্তি নিজেদের মাঝে পরিবর্তিত হতে পারে। আইনস্টাইন এর E = mc2 প্রমাণ করে ভর ও শক্তি একই জিনিস। একটা নির্দিষ্ট স্থানে ভর ও শক্তির পরিমাণ একসাথে নির্দিষ্ট – আলাদা আলাদা ভাবে নয় । একে আমরা বলি “ভর ও শক্তির নিত্যতা”। একটা নির্দিষ্ট স্থানে ভর ও শক্তির মিলিত পরিমাণ কখনো পরিবর্তিত হবে না- এটাই এর মুল কথা। কিন্তু এই ধারনায় চির ধরাল সেই গোলমেলে হতচ্ছাড়া কণিকা জগত । আবির্ভাব হল কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর।
একটি নির্দিষ্ট স্থানে অনবরত বিভিন্ন ধরনের কণিকা (অর্থাৎ ভর তথা শক্তি)তৈরি হয় এবং অল্প সময় পর আবার তা মিলিয়ে যায় – এটাই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন। অবাক লাগছে? ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করি – এই কণিকাগুলো কিন্তু “কোনকিছু” থেকে উৎপন্ন হয় না। অর্থাৎ Something from nothing !! আরও বেশি অবাক লাগছে? বিশ্বাস ই হচ্ছে না- তাই না? কিন্তু এটাই হয়- এবং সব সময় ই হয়। আপনার আশপাশে যা কিছু দেখছেন তাদের ভেতরে অতি ক্ষুদ্র জগতে ঢুকতে পারলে আপনি দেখতেন কত অবিশ্বাস্য ব্যাপার স্যাপার সেখানে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে...
এখন মনে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন উকি দিচ্ছে- তাই না? প্রথমটা নিশ্চয়ই – “কেন আমরা আমাদের জীবনে এই ফ্লাকচুয়েশন দেখতে পাই না??বুঝতে পারি না? “ কারন ওই যে- ক্ষুদ্র জগত ... এত ক্ষুদ্র পর্যায়ে এটা ঘটে যে এটা বোঝা আমাদের জন্য অসম্ভব । ভর যখন বাড়ে- তখন ফ্লাকচুয়েশন কমে যায়... (ডি ব্রগলী এর সমীকরণ এর মত) এবং আমাদের চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান আপ্লিকেবল হয় ।এরপরে প্রশ্ন আসে- “তাহলে ভর-শক্তির কোন নিত্যতা নেই?” না। ভর শক্তির নিত্যতার এই সূত্র ও ভেঙ্গে পড়ে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর কারনে। কিন্তু খুবই কম সময়ের জন্য। কিন্তু একটা জিনিস বলে রাখি- কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে শক্তি বা ভর এর এই তারতম্য অত্যন্ত কম সময়ের জন্য হলেও এর প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী হতে পারে। যেমন ফ্লাকচুয়েশন এর কারনে ইলেকট্রন এর চার্জ কম বেশি হয় ।এ ব্যাপারে পরে অনেক আলোচনা করব। এখন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে উৎপন্ন কণাগুলোর প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যাক ।
কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে কণা,প্রতিকণা ও ভার্চুয়াল কণা সবই তৈরি হতে পারে। প্রতিকণা সম্পর্কে অনেকের ধারনা নেই। একটি কণার সমান ও বিপরীত চার্জ যুক্ত এবং সমান ভরের একটি “কণা”, যা প্রথম কণার সাথে সংঘর্ষে সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে যায় এবং শক্তি তৈরি করে তাকে বলে প্রথম কণাটির প্রতিকণা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এই “কণা” ও “প্রতিকণা”র মাঝে শুধু একটি মাত্রায় ( Dimension ) এই পার্থক্য । আর তা হল চতুর্থ মাত্রা – “সময়” !!!! আমরা চারদিকে যা কিছু দেখছি (কণার জগতে) তারা , অর্থাৎ আমরা সবাই সময়ের যেই দিকে যাচ্ছি- প্রতিকণা তার উল্টোদিকে যাচ্ছে !! ব্যাপারটা সাইন্স ফিকশনের মত লাগছে হয়ত ,কিন্তু এটা মোটেও “ফিকশন” না । পুরোটাই “সাইন্স” । প্রকৃতির মোটামুটি সব কণারই প্রতিকণা আছে । যেমন আমাদের সবার চেনা ইলেকট্রন এর প্রতিকণা “পজিটিভ ইলেকট্রন” বা “পজিট্রন” । এই “পজিট্রন” ইলেকট্রনের সাথে মিলিত হয়ে শক্তিরূপে ফোটন কণা নির্গত করে । নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় পজিট্রন উৎপন্ন হয় এবং তা ইলেকট্রনের সাথে মিলিত হয়ে শক্তিশালী “গামা রে” তৈরি করে ।
এরপর আসি ভার্চুয়াল কণিকায় । ভার্চুয়াল কণিকা হল ভরবিহীন এমন এক ধরনের কণিকা যারা নির্দিষ্ট স্থান-কালে উৎপন্ন হয় জোড়ায় জোড়ায় (কণা ও প্রতিকণা) । আমাদের খুব চেনা একটি ভার্চুয়াল কণিকা হল ফোটন । এই ভার্চুয়াল কণা কিন্তু এমন কিছু ঘটনা ঘটায় যা মোটেও “ভার্চুয়াল” না- বাস্তব এবং তা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে ।ভার্চুয়াল কণিকা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক...
কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রকৃতির কিছু জটিল সমস্যার সমাধান করেছে সুন্দর ভাবে ।
আমাদের অনেকের মনেই হয়ত প্রশ্ন ছিল ছোট থেকে-চুম্বক কিভাবে লোহাকে টানে কোন সংস্পর্শ ছাড়াই ? মহাকর্ষের জন্য ও একই প্রশ্ন । এগুলোর উত্তর দিয়েছে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান । আধুনিক তত্ত্ব বলে যেসকল বল কোন ধরনের ফিজিক্যাল কন্টাক্ট ছাড়াই ক্রিয়া করে- যেমন ( মহাকর্ষ বল, চৌম্বক বল ) তাদের এই বল কাজ করে ভার্চুয়াল কণা দিয়েই । এদেরকে বলা হয় তখন Force Carrier । এই Force Carrier কণা একটি বস্তু থেকে উৎপন্ন হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে নির্দিষ্ট পথে । আর এই পথ আমরা পাই যে বলের Force Carrier সে বলের বলরেখা থেকে । যেমন চুম্বক থেকে বের হওয়া Force Carrier কণা চৌম্বক-বলরেখা বরাবর ছড়িয়ে যায় । মহাকর্ষ বা ত্বরিত-চুম্বক বলের জন্য সোজা ছড়িয়ে যায় কণাগুলো । এরপর নির্দিষ্ট ধরনের বস্তুর দ্বারা শোষিত হলে তা ১ টি ভরবেগ তৈরি করে । প্রতি একক সময়ে যে পরিমাণ ভরবেগ তথা কণা যুক্ত হয় তাই ওই শোষণকারী বস্তুর ওপর সৃষ্ট বল । যেমন ১ টি চুম্বক থেকে Force Carrier কণা চৌম্বক-বলরেখা বরাবর ছড়িয়ে যায় এবং চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে । এই ক্ষেত্রে বিশেষ বস্তু তথা ধাতু থাকলে কণাগুলো শোষিত হয় এবং বল সৃষ্টি করে ধাতুর ওপরে ।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রকৃতির সবকিছুকে এই কণা বা ক্ষেত্র দিয়ে প্রকাশ করতে চায় । উদাহরণ স্বরূপ আমরা ফোটনের ভরশূন্যতার কথা বলতে পারি...১টা কণা কিভাবে ভরশূন্য হয়- তা আমরা কল্পনা করতে পারি না । (সেদিন আপেক্ষিকতার ক্লাসে আমাদের সেকেন্ড বয় স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছেল- “১ তা পদার্থ ভর ছাড়া হয় কিভাবে ?” স্যার তেমন কোন উত্তর দেননি ।)কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে এই ভর ও একটি কণার ফসল ! এর নাম “হিগস” কণা । “হিগস” কণা কোন বস্তু বা অন্য কোন কণার সাথে যুক্ত থাকলেই শুধু তার ভর থাকবে । না থাকলে থাকবে না! ভার্চুয়াল কণা যেমন বিভিন্ন Force Carrier কণা- ফোটন, গ্র্যাভিটন এদের সাথে “হিগস” থাকে না জন্যই এরা ভরহীন । সুতরাং এতদিন যা জেনে এসেছি আমরা- ভর বস্তুর মৌলিক ধর্ম- ব্যাপারটা তেমন সত্যি না !! আপনার শরীর থেকে সব হিগস সরিয়ে নিলে আপনার ভর থাকবে না... যদিও আপনি থাকবেন ! (আমি অবশ্য জানি না এটা Practically সম্ভব কি না )তবে হিগস নিয়ে আমাদের জ্ঞান অনেক কম । CERN এর LHC তে এটা নিয়ে গবেষণা চলছে ।
এবার ফিরে যাই আবার কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে । কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস আমাদের সামনে এনেছে , যা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের চিন্তার জগতকে CHANGE করে দেয় । যেমন –
১. পরম শূন্যটা বলে কোন কিছু নেই । আপাত দৃষ্টিতে শূন্য স্থানের মাঝেও শক্তি ও ভরের এক কানামাছি ভো ভো খেলা প্রতিনিয়ত চলছে।
২. একটা স্থানের মোট শক্তি-সময় (নির্দিষ্ট সময়ে শক্তি ) কখনো নির্ণয় করা যাবে না। হাইজেনবার্গ এর অনিশ্চয়তা নীতি থেকে আমরা জানতে পাই যে কোন ক্ষুদ্র কণা (যেমন ইলেকট্রন) এর ভরবেগ ও অবস্থান কখনো একসাথে জানা যাবে না। একটা জানা গেলে অপরটা জানা অসম্ভব । এখানে ভরবেগ-স্থান যেরকম যুগল , ঠিক তেমনি সময়-শক্তিও সেরকম যুগল কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে । আসলে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন ও হাইজেনবার্গ এর অনিশ্চয়তা নীতি থেকেই এসেছে ।
৩. মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে নতুন ধারনা। এই বিষয়টার কথাই আমি শুরুতে বলেছিলাম । চলুন এটা নিয়ে একটু কথা বলা যাক –
কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন আসার আগ পর্যন্ত মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারটি সবচে ভালোভাবে যে তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করত তা হল “বিগ-ব্যাং” থিউরি ।(এখনও তা সঠিক বলেই মানা হয়, কিন্তু একটু “এডিট” করা হয়েছে) মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে-এই তথ্যকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে উৎপত্তি লাভ করেছে“বিগ-ব্যাং”। এই তত্ত্ব বলে মহাবিশ্ব শুরুতে ১ টা অতিক্ষুদ্র কণার মত ছিল । যার ঘনত্ব ছিল অসীম । কোন এক কারনে এই কণা বিস্ফোরিত হয় এবং প্রসারিত হয়ে হয়ে বর্তমান মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয় । বিস্ফোরণের ফলে সেই কণাটির ভর চারদিকে ছড়িয়ে যায় এবং এখনকার গ্রহ- উপগ্রহ (এবং আমরাও)সেখান থেকেই এসেছে । “বিগ-ব্যাং” এই প্রসারণের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারনা দেয় ।
এই বিগ-ব্যাং তত্ত্ব কিন্তু কিছু জিনিসকে মেলাতে পারে না। তার মাঝে একটি হল -দূর মহাকাশে এমন অনেক নক্ষত্র আছে যাদের দূরত্ব বিগ ব্যাং থেকে প্রাপ্ত জগতের বয়সের সমান আলোকবর্ষের চেয়ে বেশী । অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরে আমরা যে গতিতে প্রসারণের কথা ভাবা হয়েছিল , এখন যে মাত্রায় প্রসারণ ঘটছে , তার চেয়ে অনেক বেশী মাত্রায় প্রসারণ ঘটেছে অতীতের কোন এক সময়ে । এ সময় এলো “ইনফ্লেশন থিউরি” । এই তত্ত্ব মতে -সেই আদি অতিক্ষুদ্র কণায় বিস্ফোরণের পরে কিছুটা সময়ের জন্য অত্যধিক মাত্রায় প্রসারণ ঘটেছিল । মুহূর্তে মহাবিশ্ব বিশাল আকারে চলে আসে , তারপর আবার স্তিমিত মাত্রায় প্রসারণ চলতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এই ইনফ্লেশনের সময়, হার নিখুঁতভাবে বের করে ফেলেন । ফলে ১ টা সমস্যার সমাধান হয়ে যায়- “ইনফ্লেশন থিউরি”, “বিগ-ব্যাং থিউরির” “EXTENSION “ হিসেবে রাখা হয়... কিন্তু আরও বড় প্রশ্নের সমাধান তখনও হয়নি ।
এই যে “অতি ক্ষুদ্র কণিকা” তার আগে কি ছিল? সেটাই বা এলো কিভাবে ? কোত্থেকে এলো ?
নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কথা কোন দিকে যাচ্ছে । হ্যাঁ, বিগ ব্যাং এর সেই ক্ষুদ্র কণা আসলে এসেছিল কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর মাধ্যমে । আর যেহেতু এটা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন – সুতরাং কোথা থেকে এসেছে- তা আমরা জানি ই । কোথাও থেকে আসেনি- একা একাই সৃষ্টি হয়েছে । কোন কিছু যে একা একা তৈরি হতে পারে না – এই ধারনা থেকে আমাদেরকে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বের করে এনেছে। কিন্তু কথা হল, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন থেকে তৈরি কণার তো আয়ু স্বল্পস্থায়ী সবার কথা, হল না কেন ? এর উত্তর আগেই আমরা পেয়েছি “ইনফ্লেশন থিউরি” থেকে । ফ্লাকচুয়েশন থেকে সৃষ্ট কণাটিতে ইনফ্লেশন ঘটে । আর এ কারনেই তা ফুলে-ফেঁপে change হয়ে যায় । এরপর আসতে পারে ফ্লাকচুয়েশন এর আগে কি ছিল ? কেনই বা ফ্লাকচুয়েশন হল। আমরা আগেই দেখেছি – ফ্লাকচুয়েশন এর কোন কারন লাগে না- সে একা একাই হতে থাকে-বাইরের শক্তি- বল লাগে না। এক্ষেত্রেও এটাই প্রযোজ্য । আর যদি বলেন-এই ছোট ব্যাপারটা থেকে কিভাবে এত বড় জগত তৈরি হল-আগেও বলেছিলাম- ফ্লাকচুয়েশন ছোট হলেও এর প্রভাব বড় হতে পারে । (ইলেকট্রনের চার্জ পরিবর্তনের উদাহরণ এ জন্যই দিয়েছিলাম)
এর পর আসে “তার আগে কি ছিল? ” বিগ-ব্যাং , ইনফ্লেশন, ফ্লাকচুয়েশন সবাই বলে এর আগে কোন স্থান- কাল ছিল না। অর্থাৎ অন্যরকম এক জগত ছিল যেখানে আমাদের চেনা জানা কার্যকারণ সম্পর্ক (যাকে পদার্থবিজ্ঞানে বলে “CASUALITY”) অনুপস্থিত ছিল । আমাদের সমস্ত জ্ঞানের যে মূলভিত্তি কার্যকারণ সম্পর্ক অর্থাৎ- “এটা করলে এই কারনে ওটা হবে” সেখানে ছিল না। তাই আমরা বলতে পারব না সেখানে কি ছিল-না ছিল। তবে হ্যাঁ, এতটুকু বলা যায় যে তা ছিল এমন একটি সাব-এটমিক অবস্থা, যেখানে CASUALITY ছিল না।
বিজ্ঞান গতিময় , নিয়ত তা পরিবর্তিত হচ্ছে । আর এটাই বুঝি এর সবচেয়ে বড় শক্তি । যে কেউ একে প্রশ্ন করতে পারে, একে পরিবর্তন করতে পারে। তাই আজ আমরা যা জানি- কাল তার ভিন্নটা জানব । চিন্তার জগত , চিন্তার স্টাইল চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে অনবরত। কিছুই স্থির থাকছে না। হয়ত আজ আমরা যাকে বলছি – “তাই আমরা বলতে পারব না সেখানে কি ছিল-না ছিল” তাই হয়ত কাল ছোট বাচ্চাদের পড়ার বিষয় হয়ে যাবে । তাই আসুন , সেই পরিবর্তনকে নব মাত্রা জুড়ে দেই (অন্তত চেষ্টা করি)। শরীক হই এই মহান যাত্রায়। আর নব চিন্তা চেতনাকে গ্রহণ করি যুক্তির সাথে, জ্ঞানের নিরিখে।