( মানব কে
হত্যা ক’রে কি সত্যান্বেষণ থামিয়ে রাখা যাবে? “ কোপ দিয়ে গলা কাটা যায়,
কিন্তু কণ্ঠস্বরকে দমানো যায় না”। তাই ধর্মকে জানতে অকুতো ভয়ে প্রশ্ন করুণ,
সমালোচনা-আলোচনা করুণ, অনৈতিক-অমানবিক-অযৌক্তিক-অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস তথাকথিত
ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকলেও প্রশ্ন করুণ।
(১)ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি,“ যাহা নাই মহা-ভারতে, তাহা নাই ভারতে”। অনেকেই আবার জ্ঞানগম্ভীর স্বরে বিজ্ঞপন্ডিতের মতো বলতেন, এখানে শেষের “ভারত” মানে কিন্তু পৃথিবী। অর্থ্যাৎ মহাভারতের কাহিনীর বিশালত্ব বোঝাতে সারা পৃথিবীকে সারা “ভারত” হিসেবেই মান্য কিংবা গন্য করা হতো। এটা তর্কের খাতিরে সঠিক ধরে নিলে আরেকটি নির্মম সত্যকেও মেনে নেয়া হয় যে, মহাভারতে ভারতের চেয়ে অনেক অনেক গুন বিশাল পৃথিবীর (ভারত ব্যতিত) প্রকৃতি ও মানুষের কথা এক বিন্দুও নেই।
মহাভারতের কাহিনী ভারতবর্ষের তখনকার সময়ের এক কাব্যিক বা মহাকাব্যিক বর্ণনা। সেখানে তাই ভারতবর্ষের বাইরের অন্যান্য স্থানের প্রকৃতি, মানুষ ও সমাজব্যবস্থার বর্ণনা না থাকাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বিপত্তি বাধে তখনি যখন এ মহাকাব্যের কোন চরিত্রকে সর্বজ্ঞানী ও সর্বদ্রষ্টা ঈশ্বর কিংবা ভগবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়। কেননা, তখন এই সর্বজ্ঞানী ও সর্বদ্রষ্টার দৃষ্টি ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে?
শুধু মহাভারত কেন, সে সময়ে রচিত আরেক মহাকাব্য রামায়ণ, সেখানেও তখনকার বৃহত্তর ভারতবর্ষের ( বর্তমানের শ্রীলঙ্কাসহ ) বাইরের অন্য কোন জায়গার উল্লেখ নেই। এটা শুধু রামায়ন কিংবা মহাভারতের ক্ষেত্রেই নয়, তারও এক-দেড় হাজার বছর আগের যে প্রাচীন গ্রন্থ বেদ, যাকে অনেকেই একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ( যাঁদের সময়ের পরিবর্তণে হিন্দু বলা হয়ে থাকে) ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মনে করেণ, সে চতুর্বেদের কোথাও ভারতবর্ষের বাইরের মানুষ, প্রকৃতি,পশু-পাখি, জীবজন্তু, সমাজব্যবস্থা, সভ্যতা, আচার-ঐতিহ্য কোন কিছুরই উল্লেখ নেই। অথচ বেদেরও প্রায় হাজারখানিক বছরের পুরানা দক্ষিন আমেরিকার মায়াসভ্যতা ( খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০) কিংবা ভারতবর্ষ থেকে বেশী দূরে নয় মিশরিয় সভ্যতা (খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০/২৯০০)। বেদ, রামায়ণ,মহাভারত এ সমস্ত গ্রন্থপুরাণে ভারতের বাইরের কোন মানুষজনের অস্তিত্বের কথাও আকার ইংগিতে উল্লেখ নেই; অথচ পরিকল্পিত স্বর্গ কিংবা নরকের আনুলম্ভিক ঊর্ধ্ব কিংবা অধঃ অবস্থানের ঠিক-ই উল্লেখ আছে; নেই শুধু আনুভূমিক অন্যপ্রান্তের মানুষের কথা।
তাই যাঁরা এ সমস্ত গ্রন্থে উল্লেখিত কোন চরিত্রকে দেব-দেবী কিংবা ঈশ্বর-ভগবান হিসেবে মান্য-গন্য করতে চান, তাঁরা তাঁদের আরাধ্যের সাথে সর্বজ্ঞানী,সর্বদ্রষ্টা,সর্বজনীন, সর্বমানুষের স্রষ্টা –এ সকল গালভরা ভারী কথার বিশেষণ বসানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত ভেবে দেখবেন। কেননা, তাঁদের সর্বদ্রষ্টার রাডারে ভারতবর্ষের বাইরের কিছুই ছিল না, এখনো আছে কিনা কে জানে?
(২)
সময়ের হিসেব করলে চতুর্থ (অথর্ব) ও প্রথম (ঋক)বেদের রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০/১৩০০; আর মহাভারত ও রামায়নের রচনা কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ২০০/৩০০ কিংবা মতান্তরে রচনাকালের একটু-আধটু হেরফের হতে পারে। তবে এ প্রাচীন গ্রন্থগুলো যে কয়েক হাজার বছরের পুরানো সে ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। কিন্তু আরেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ( যাঁদে্রকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলা হয়) তাঁদের ধর্মীয় গ্রন্থ, যার নাম “কুরআন” কিংবা “আল- কুরআনুল করীম” কিন্তু সে তুলনায় অনেক অনেক সমসাময়িক (কন্টেম্পোরারি) কালে রচিত বা অবতীর্ণ, যাই বলি না কেন। সময়ের হিসেবে সে সময়কাল খ্রিস্টাব্দ ৮/৯ শতক।
ইসলাম ধর্মানুসারীদের ধর্মীয় গ্রন্থটির কোথাও কিন্তু মুসলিম,ইহুদি,খৃষ্টান বা বিধর্মী কাফের (মূলত যাঁরা সে সময়ে আরবে মূর্তিপূজক)ব্যতিত অন্য কোন সম্প্রদায়, অন্য কোন দেশ-কাল-স্থান, অন্য কোন সভ্যতা-ইতিহাস-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্য কিছুরই উল্লেখ নেই। এমনকি সে সময়ে আরবের অনতিদূরের সভ্যতার কথাও উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই ভারতবর্ষের কথা। উল্লেখ নেই ইউরোপ কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার কথাও।
অনেক ইসলামী চিন্তাবিদকে বলতে শুনি এক হাদিসের কথা, সেখানে উল্লেখ আছে জ্ঞানার্জণের জন্য সুদূর চীন দেশেও যাও। অথচ চীনের চেয়ে অতিকাছের মিসর কিংবা ভারতবর্ষ তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক সোনালী সময় অতিক্রম করছে। উল্লেখ করার মতো শুধু একটি ঘটনার কথাই বলা যায়। এ ধর্মীয় গ্রন্থটি রচিত কিংবা নাজেল হওয়ারও প্রায় ৪শ’ বছর আগেই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সুদূর চীন দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা এসে লেখাপড়া কিংবা জ্ঞান ও বানিজ্য বিনিময় করেছেন। আরবের একেবারে ঘরের কাছেও ছিল অনেক সমৃদ্ধশালী সভ্যতা। সে সবের উল্লেখ কোথাও নেই। উল্লেখ নেই ভারতবর্ষ, আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাসকারী অন্য কোন মানবসম্প্রদায়ের কথাও। শুধু উল্লেখ আছে এলাকায় অবস্থিত ইহুদি, খৃষ্টান ও আরবের মূর্তিপূজকদের কথা, যাঁদের সাথে ছিল নবীজী ও তাঁর গোত্রের বিবাদ-বিসম্বাদ।
(৩)
পূর্বেও যে কথা বলেছি এখানেও তাঁর পূনরোক্তি করা যেতেই পারে। স্রষ্টা যদি সর্বজ্ঞানী, সর্বদ্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান হয়ে থাকেন, তবে তাঁর প্রেরিত গ্রন্থ এত আঞ্চলিকতা ও বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ কেন? পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মানুষ, যাঁরা বাস করে সুদূর দূরে, যাঁরা এ নতুন অবতীর্ণ হওয়া স্রষ্টার অগোচরেই বিশাল বিশাল নগর-সভ্যতা-সংস্কৃতি সৃষ্টি করে চলেছেন হাজার হাজার বছর পূর্ব থেকেই, তাঁদের কি আর নতুন করে নতুন স্রষ্টার দরকার আছে? যদি এ নতুন স্রষ্টাকে ছাড়াই এত কিছু ঘটে যেতে পারে, তবে তাঁকে এক, অদ্বিতীয়, সর্বজ্ঞানী, সর্বদ্রষ্টা কিংবা সর্বশক্তিমান বলবেন কোন্ যুক্তিতে?
শুধু হিন্দু কিংবা মুসলিম নয়, ইহুদি-খৃস্টান-বৌদ্ধ-শিখসহ সকল প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেই একথা কম-বেশী প্রযোজ্য। তাই মোদ্দা কথা, গ্রন্থের ভিতরে ঈশ্বর না খুঁজে বরং নিজের ভিতরের ঈশ্বরকে খোঁজাই উত্তম। গ্রন্থে আরোপিত ঈশ্বরে আছে অলৌ্কিক শোনা কথা আর অন্ধ বিশ্বাস কিন্তু নিজের ভিতরের যুক্তি, বোধ ও জ্ঞান দিয়ে যে সত্য পাওয়া যাবে তা শাশ্বত, মানবিক, আধুনিক ও পরিবর্তণশীল। আর তাই এ পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মগুলো দিনে দিনে পর্যবসিত হচ্ছে শেওলা জমা এক বদ্ধ ডোবায়, সেখানে পরিবর্তনের স্রোত নেই, নেই অগ্রগতির হাওয়া-জলও। মানুষ যত তাড়াতাড়ি মুক্তি পাবে এই গ্রন্থারোপিত ঈশ্বরে বিশ্বাস থেকে, তত শীঘ্রই বইবে বিশ্বমানবতার সুবাতাস।