টেলিভিশনের
পর্দায় এমন দৃশ্য আমরা সবাই দেখেছি, যেখানে মহাকাশে নীল মরুদ্যানের মতো
শোভা পাচ্ছে পৃথিবী। তখনই মনে প্রশ্ন জাগে, “বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র
পৃথিবীতেই কী প্রাণের স্পন্দন রয়েছে? নাকী অন্য কোথায়ও প্রাণের বিকাশ
সম্ভব?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে গত কয়েক বছরে গবেষণা অনেক বেড়ে
গেছে।বিজ্ঞানীরা বহু দশক ধরে খোঁজ চালাচ্ছেন এমন জগতের, যেখানে প্রাণের
অস্তিত্ব সম্ভব। শুধু মঙ্গল গ্রহই নয়, তাঁরা নজর রাখছেন মহাকাশের গভীরেও।
কিন্তু সমুদ্র সৈকতে বালুকণা
খোঁজার মতো কঠিন সেই কাজকেও আজ বিজ্ঞানীরা সহজ
করে ফেলছে।
বহুকাল ধরে মানুষের জিজ্ঞাসা মহাশূন্যে পৃথিবীর মতো আর কোন গ্রহ আছে কী নেই। পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কী না সেটাও জানার চেষ্টা চলছে বহুকাল ধরে। বিজ্ঞানীরাতো বটেই, সাধারণ মানুষদেরও এ নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই।গত ২২ জুলাই মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা [National Aeronautics and Space Administration (NASA)] এই কৌতুহলের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিয়েছে।
নাসা জানিয়েছিল- ২৩ জুলাই সংবাদ মিডিয়ার সামনে বিজ্ঞানীদের উপস্থিতিতে আলোচনায় বসবেন। নাসার ঘোষণায় তাবৎ বিশ্ব অপেক্ষায় ছিল, কী সংবাদ হতে পারে সেই আলোচনা সভায়? তবে কী তারা আরেকটি পৃথিবীর সন্ধান দিতে যাচ্ছেন?
নাসার বিজ্ঞানীরা আবেগাপ্লুতভাবে ঘোষণা করেন- “হয়তো এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। কয়েক হাজার বছর ধরে আমরা ভিনগ্রহের প্রাণী সম্পর্কে বহু কল্পনা করেছি, রূপকথা শুনেছি। এখন সেসব স্বপ্নই সত্যি হতে চলেছে হয়তো”!
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নাসা সত্যি সত্যিই নুতন এক গ্রহের সন্ধান দিল। নাসার ঘোষণামতে পৃথিবীর মতো অথচ এরচেয়েও বড় ও পুরণো আরেক গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রহটির নাম রাখা হয়েছে কেপলার-৪৫২বি। https://en.wikipedia.org/wiki/Kepler-452b
মজার ব্যাপার হলো, নাসার বিজ্ঞানীরা গ্রহটিকে আর্থ টু পয়েন্ট জিরো বা ‘দ্বিতীয় পৃথিবী’ এবং ‘পৃথিবীর বড় ভাই’ বলে অভিহিত করেছেন। কেপলার-৪৫২বি গ্রহটির দূরত্ব পৃথিবী থেকে ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে। কেপলার-৪৫২বি যে নক্ষত্রটিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে, তার সাথে দূরত্ব পৃথিবী থেকে অনেকটা সূর্যের দূরত্বের মতোই। আর ব্যাসার্ধর হিশেবে কেপলার-৪৫২বি’র অক্ষপথ পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ বড়। কেপলার-৪৫২বি’র তাপমাত্রাও পৃথিবীর মতোই। কেপলার-৪৫২বি’র মাধ্যাকর্ষণ ক্ষমতা পৃথিবীর চেয়ে দ্বিগুণ এবং পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ১৪০০ আলোকবর্ষ।
আরও অবাক করা ব্যাপার হলো, নাসা জানিয়েছে কেপলার-৪৫২বি’র চারপাশে আমাদের সৌরজগতের মতোই স্বতন্ত্র সৌরজগৎ রয়েছে। এবং আমাদের সৌরজগৎ মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথেই এটির অবস্থান। নতুন আবিস্কৃত এই গ্রহটির সূর্য এবং পৃথিবীর সূর্য একই গোত্রের। আমাদের সৌরজগত যে ছায়াপথে, নতুন গ্রহের অবস্থান সেখানেই। অর্থাৎ আকাশগঙ্গাতেই মিলেছে নতুন পৃথিবী।
নাসা বিজ্ঞানীদের মতে এই নক্ষত্রটির ভর সূর্যের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। সূর্যের তেজকেও সে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এর চারদিকে কেপলার-৪৫২বি’র ঘুরতে সময় লাগে ৩৮৫ দিন। গ্রহটিতে প্রচুর পানি থাকার সম্ভাবনার কথা জানালেও বিজ্ঞানীরা এখনো গ্রহটির ভর জানাতে পারেন নি। তারা নিশ্চিত করেছেন, সূর্যের থেকে আয়তনে চার শতাংশ বড় এবং দশ শতাংশ বেশি উজ্জ্বল এই গ্রহ। টেলিস্কোপের লেন্সবন্দি ছবির বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে সেই গ্রহের রাসায়নির গঠন। গ্রহটি পাথুরে পদার্থে তৈরি।
কেপলার-৪৫২বি’র বয়স আনুমানিক ৬শ কোটি বছর। অর্থাৎ আমাদের সূর্য ও সৌরজগতের চেয়ে কেপলার-৪৫২বি প্রায় ১৫০ কোটি বছর বেশি পুরনো। গ্রহটির বয়স পৃথিবীর চেয়ে বেশি হওয়ার কারণে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন।
কেন কেপলার-৪৫২বি’কে পৃথিবীর বড় ভাই বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে নাসার বিজ্ঞানী জেফ কফলিন বলেন- “গ্রহটিকে পৃথিবীর বড় ভাই বলা যুক্তিসঙ্গত। কারণ গ্রহটির আকার, তাপমাত্রা, বৈশিষ্ট্য সবকিছু পৃথিবীর মতোই পাথুরে, ভূপৃষ্ঠে পানি থাকার সম্ভাবনা থাকায় সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব প্রাপ্তির আশা জাগিয়েছে”।
নাসার বিজ্ঞানীদের মতে, এর পরিবেশ এতই অনকূল যে, সেখানে গাছপালা পাঠালে তা বেঁচে থাকতে পারবে। ধারণা করা হচ্ছে, এর উপরিভাগ পাথুরে এবং এতে পর্যাপ্ত পানি ও আকাশে মেঘ রয়েছে।
গত ৬ বছর ধরে পৃথিবীসদৃশ এই গ্রহের সন্ধানে বহির্বিশ্বে কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করেছে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। প্রথমদিকে প্রায় লক্ষাধিক নক্ষত্রকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ধরে কাজ করে সে। ২০০৯ সালে প্রথম এই টেলিস্কোপটি উৎক্ষেপন করা হয়। বাসযোগ্য গ্রহ অনুসন্ধানে মহা-কর্মযজ্ঞের এই মিশনের নামও রেখেছিল ‘কেপলার মিশন’। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে- পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে যে দূরত্ব, মহাকাশে অন্য কোনও গ্রহের সঙ্গে তার ধারক-নক্ষত্রসমুহের দূরত্বও যদি তেমন হয়; তাহলে সেই গ্রহ বাসযোগ্য হতে পারে। জোতির্বিজ্ঞানীদের মতে এই ব্যবধানের মাঝখানের এলাকা হলো ‘গোল্ডিলকস জোন’। যেখানে বাসযোগ্য পৃথিবীর মতো একটি গ্রহ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কেপলারকে।
কেপলার স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে এখনোব্দি ৩৮০০ এরও বেশি গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কোন কোন গ্রহ গ্যাসীয় হলেও খুব বেশি উত্তপ্ত বা শীতল নয়। যেগুলোর আয়তন বৃহস্পতি গ্রহের চেয়ে সামান্য বড় কিংবা সমান। কেপলার স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যমতে ৮টি গ্রহের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের দ্বিগুণেরও কিছু কম। এই ৮টি গ্রহকে কেন্দ্র করেই গবেষণায় এগোচ্ছে নাসার বিজ্ঞানীরা।
https://youtu.be/G_zcEgx1IgQ
বিজ্ঞানীরা এও বলছেন, পৃথিবী যে দূরত্বে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, এই গ্রহটিও সেই দূরত্বে নিজের নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে। এই দূরত্বের সুবিধা হল- এতে গ্রহের তাপমাত্রা কখনই খুব বেশি বা খুব কম হয় না। এই ধরনের পরিস্থিতি জলবায়ু তৈরি ও প্রাণসৃষ্টির পক্ষে একেবারে আদর্শ। এ থেকেই তাদের ধারণা, একসময় হয়তো সেই গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু, ক্রমশ শেষ হয়ে যাওয়া নক্ষত্রের অতিরিক্ত তাপে হয়তো নদী, ঝিল ও সমুদ্র বাষ্পীভূত হয়ে গ্রহটি পাথুরে পদার্থে পরিণত হয়েছে। কেপলার-৪৫২বি’র মধ্যে পৃথিবীরও ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, ওই গ্রহে গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা উষ্মায়ন শেষের মুখে। পৃথিবীতে প্রকৃতির সেই ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি সবে শুরু হয়েছে। আজ থেকে একশো কোটি বছর পরে পৃথিবীও হয়তো ওই গ্রহের মতোই একটি পাথুরে পিণ্ডে পরিণত হবে।
পৃথিবীর বাইরে প্রাণের খোঁজে বা প্রাণের বিকাশের অনুকূল পরিবেশের খোঁজে যে নিরন্তর চেষ্টা চলছে, এই গ্রহের আবিষ্কার সেদিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধারনা করা হচ্ছে, এই নতুন গ্রহ বিশ্লেষণ করে মিলতে পারে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য। জানা গিয়েছে, এই নতুন গ্রহে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি ও সেই সঙ্গে জল থাকার সম্ভাবনাও প্রবল। আর এই তথ্যই ওই গ্রহে ভিনগ্রহী রয়েছে কীনা সেই কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
নাসার বিচক্ষণ বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত ২৬টি দল এ বিষয় নিয়ে নিরন্তর কাজ কাজ করে চলেছেন। কেপলার নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক আশাবাদী। হয়ত এ গ্রহই হয়ে যেতে পারে এলিয়েনদের গ্রহ! ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা ডেবরা ফিশ্চারের মতে কেপলার টেলিস্কোপের আবিষ্কৃত কেপলার-৪৫২বি অবশ্যই মহাকাশ বিদ্যার দুর্দান্ত একটি আবিষ্কার। হয়ত হলিউড সাইন্স ফিকশন ‘স্টার ট্রেক’ চলচ্চিত্রটি সত্যে পরিণত হতে চলেছে।
সূত্র:
1. National Aeronautics and Space Administration (NASA)
2. Cable News Network (CNN)
3. The New York Times
4. Kepler’s Tally of Planets
5. Space.com
===================================