ধর্ম নিয়ে, ইসলাম নিয়ে কথা বলতে
গেলে, লেখালেখি করতে গেলে অনেকে বলেন- আপনার মুখে তো দাড়ি নাই, মাথায় টুপি
নাই, পাগড়ী নাই, গায়ে জুব্বা নাই ইত্যাদি আপনি আবার কী ইসলামের কথা বলবেন!
আগে তো নিজেদের শরীরে ইসলাম কায়েম করতে হবে।
এ প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই আমি বলব, ইসলাম আসলে কী এবং কেন, তা আগে
আমাদের বুঝতে হবে। যদি এই প্রশ্ন দুটির উত্তর আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়,
তাহলে আশা করি আমরা বুঝতে পারব আসলে দাড়ি, টুপি, পাগড়ীর সাথে ইসলামের
সম্পর্ক কতটুকু।ইসলাম শব্দের অর্থ হলো শান্তি। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যখন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে তখন ঐ শান্তিপূর্ণ সমাজকেই বলা যাবে ইসলাম। ইসলাম বা শান্তি হচ্ছে সত্য-জীবনব্যবস্থা প্রয়োগের ফল। অর্থাৎ দীনুল হক্ব কার্যকরী করা হলে মানবজীবন থেকে অন্যায় অবিচার বিলুপ্ত হয়ে যে নিরাপত্তা, সুবিচার, ন্যায় ইত্যাদি অর্থাৎ এক কথায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে- এই শান্তিটাই হচ্ছে ইসলাম। এটা ইতিহাস সুতরাং অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ১৪০০ বছর আগে অর্ধেক পৃথিবীতে এই দীন প্রবর্তন করার ফলে ঐ সমস্ত এলাকায় মানবজীবনের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত, অর্র্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সকল প্রকার শোষণ, অবিচার, অন্যায়, নিরাপত্তাহীনতা দূরীভূত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চূড়ান্ত শান্তি, নিরাপত্তা ও সুবিচার, তথা ইসলাম।
এই হলো ইসলামের সঠিক আকিদা বা ধারণা। এই ধারণা মোতাবেক আসলে ইসলামের সাথে দাড়ি, টুপি, পাগড়ী, জুব্বার সম্পর্ক কোথায়? ইসলাম নির্ভর করে মানবজীবনের শান্তি-অশান্তির উপর। আল্লাহ প্রেরিত দীনুল হক্ব হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ। অর্থাৎ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই এই জীবন-ব্যবস্থার এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এসব কিছু মিলেই দীনুল হক্ব নামক বৃক্ষ পূর্ণতা পায়, আর এই পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষের শান্তি নামক ফল হচ্ছে ইসলাম। সুতরাং যারা শরীরে ইসলাম নাই এই প্রশ্ন করেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- শান্তি কি শরীরে ধারণ করা যায়, নাকি সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হয়? একটি দেশের সব মানুষ যদি দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জোব্বা গায়ে দেয় কিন্তু তাদের অর্থনীতি যদি পুজিবাদী হয়, বিচারব্যবস্থা ন্যায়ভিত্তিক না হয়ে ভারসাম্যহীন, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তিমূলক আইন দ্বারা হয় তাহলে কি সেই দেশে শান্তি এসে যাবে? সাধারণ জ্ঞান কী বলে?
অনেকের ধারণা এই যে, দাড়ি ছাড়া ইসলামই হয় না, সেই দাড়ি তো আল্লাহর রসুলের বিরোধিতাকারী, ঘৃণিত কাফের আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়েবার মুখেও ছিল। তারাও জুব্বা পরত, রসুল (সা.) যে জুব্বা পরতেন ঠিক একই ধরনের জুব্বা। প্রকৃতপক্ষে দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, জুব্বার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই, প্রকৃতির আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থার সাথে এগুলোর সম্পর্ক রয়েছে।
টুপি তো ইহুদিরা, শিখরা বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুরাও পরেন, তাদেরও দাড়ি আছে, তারাও জুব্বা পরেন, তাদের অনেকেই পাগড়ী পরেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাড়ি, টুপি, জোব্বা সবই ছিল, আপনাদের দৃষ্টিতে সে তো হিন্দু। শুধু ধর্মীয় সাধু সন্ন্যাসী নয়, আল্লাহর অস্তিত্বে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচিত অনেকেরই দাড়ি ছিল যেমন কার্ল মার্কস, চার্লস ডারউইন, আব্রাহাম লিঙ্কন প্রমুখ যাদেরকে আপনারা নাস্তিক বলেন। দাড়ি-টুপিই যদি ইসলামের পরিচায়ক হতো তাহলে এরাও তো ইসলামেরই ধারক হবার যোগ্য! আসলে দাড়ি-টুপি-পাগড়ী-পাজামা-জোব্বার সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই। এগুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা নেহায়েত বোকামীর শামিল। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধে গিয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া একপ্রকার মূর্খতা বলে আমি মনে করি।
গত কয়েক শতাব্দী ধরে এই জাতির দুর্ভাগ্যজনক পরাজয়ের কারণ এগুলিই। অথচ এটা ইতিহাস যে রসুলের একদল সর্বত্যাগী সাহাবী যাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হতো, তারা বাড়ী-ঘরে যেতেন না, মসজিদে নববীতে থাকতেন আর অপেক্ষা করতেন রসুল (সা.) কখন কী হুকুম দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সে হুকুম বাস্তবায়ন করতেন, সেই সাহাবীদের অনেকেরই গায়ে জুব্বা তো দূরের কথা ঠিকমত লজ্জাস্থান ঢাকার মতো কাপড় সংস্থান করতেও কষ্ট হত।