ইসলামি পাটিগণিত-১
সূচনাঃ-
ইসলামি পণ্ডিতেরা এবং ইসলামি ঐতিহাসিকেরা সর্বদাই প্রচার করে চলেছেন যে ইসলাম বিশ্বকে অঙ্কশাস্ত্র বিশেষত বীজগণিত উপহার দিয়েছে। ভাব-সাব এমন যেন ইসলামের পূর্বে বিশ্ব অঙ্কশাস্ত্রের প্রচলন ছিল না। কিন্তু সত্য হল সংখ্যাতত্ত্ব বিশেষত আধুনিক দশমিক সংখ্যা তথ্যের উদ্ভব করেছে হিন্দুরা—ভারতবর্ষেই। পরে আরবেরা এই সংখ্যা-তথ্য অবলম্বন করে এবং ধীরে ধীরে তা বিশ্বের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
এই রচনায় আমরা দেখব ইসলামের উৎস, তথা কোরান এবং হাদিগুলোতে কীভাবে পাটিগণিতের ব্যবহার করা হয়েছে।
আল্লাহ্র পরিসংখ্যান তথ্য
আমরা প্রথমেই দেখি কোরানে আল্লাহ্ তা’আলা লিখেছেন যে উনি পাটিগণিত জানেন। সূরা মারইয়ামে আল্লাহ্ লিখেছেন:
১৯:৯৪ তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
দেখা যাচ্ছে আল্লাহ্ তা’লার কাছে বিশ্বের সবকিছুর হিসাব রয়েছে। আমরা ধরে নিতে পারি এই হিসাবের জন্য পাটিগণিতের মৌলিক বিধান—যথা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি আল্লাহ্ তা’আলা খুব ভালোভাবেই জানেন। আরও ধরে নিতে পারি যে আল্লাহ্র কাছে যে পরিসংখ্যান আছে তা নির্ভুল এবং সাম্প্রতিক। অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক অনুমানের উপর হিসাব রাখেন না।
আয়াত ১৯.৯৪-এর প্রসঙ্গ হচ্ছে: আল্লাহ্ জানলেন যে খ্রিষ্টানেরা নাকি বলেছে যে আল্লাহ্র এক সন্তান আছে। এই ব্যাপার জেনে আল্লাহ্ অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে পড়লেন, এবং দাবী করলেন যে উনি সবকিছুই গণনা করে সব কিছুর তথ্য ও হিসাব জানেন। এই প্রসঙ্গে ইব্নে কাসির লিখেছেন:
সবারই গণনা তাঁর কাছে রয়েছে। তাঁর জ্ঞান সবকে পরিবেষ্টন করে আছে। সবাই তাঁর ক্ষমতা আওতার মধ্যে রয়েছে। সমস্ত পুরুষ, নারী, ছোট ও বড় এবং ভাল ও মন্দের খবর তিনি রাখেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর জ্ঞান তাঁর আছে। (তাফসীর ইব্নে কাসির, চতুর্দশ খণ্ড, পৃঃ ২০৩)।
সূরা আস-সাফ্ফাতে হযরত ইউনুস প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক লিখেছেন:
৩৭:১৪৭ এবং তাঁকে, লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করলাম।
৩৭:১৪৮ তারা বিশ্বাস স্থাপন করল অতঃপর আমি তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপভোগ করতে দিলাম। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
দেখা যাচ্ছে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর পরিসংখ্যান সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান রাখেন না। আল্লাহ্ হযরত ইউনুসকে মাছের পেটের থেকে মুক্তি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন মসুলের কাছে নিনেভার জনতার মাঝে। কিন্তু তখন নিনেভার জনসংখ্যা কত ছিল আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য রাখেননি। এই সমস্যা এড়াবার জন্য কোরানের ব্যাখ্যাকারীরা নানা আবোল তাবোল লিখেছেন; যেমন ইব্নে কাসির লিখেছেন:
তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ ত্রিশ হাজার বা এর চেয়েও কিছু বেশী বা সত্তর হাজারের বেশী অথবা এক লক্ষ দশ হাজার। একটি মারফূ’ হাদিসের বর্ণনা হিসেবে তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ বিশ হাজার। (তাফসীর ইব্নে কাসির, ষষ্টদশ খণ্ড, পৃঃ ২৩০)।
এদিকে পরিসংখ্যানে আল্লাহ্র জ্ঞানের স্বল্পতা ঢাকতে মাওলানা মৌদুদি লিখেছেন:
এক লাখ বা এর বেশী ”বলার মানে এ নয় যে, এর সঠিক সংখ্যার ব্যাপারে আল্লাহ্র সন্দেহ ছিল বরং এর অর্থ হচ্ছে, যদি কেউ তাদের জনবসতি দেখতো তাহলে সে এ ধারণাই করতো যে এ শহরের জনসংখ্যা এক লাখের বেশীই হবে, কম হবে না। (তাফহীমুল কুর আন, সূরা আস্ সা-ফ্ ফা-ত, পৃঃ ৭৫)।
এই প্রসঙ্গে একটি হাদীসও উল্লেখ করা যেতে পারে:
আলী ইব্ন হুজর (র)...উবাই ইব্ন কা’ব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
তাকে (ইউনুস আ) আমি লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম (সাফ্ফাত ৩৭:১৪৭) আয়াতটি সম্পর্কে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেনঃ এরা ছিল (এক লক্ষ) বিশ হাজার।
হাদীছটি গারীব। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৫০১, হাদীস ৩২২৯)
স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আল্লাহ্র ভুল ঢাকতে গিয়ে তাফসিরকার এবং অনুবাদক নিজেদের মনগড়া কথাবার্তা বন্ধনীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে এই ধরণের ইসলামী পরিসংখ্যান কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে—যেখানে শুধু আল্লাহ্ই নন, উনার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তথা নবী মুহাম্মদেরও পরিসংখ্যান জ্ঞান একেবারেই মূল্যহীন বা অ-নির্ভরযোগ্য।
কোরানের একটি আয়াতে আল্লাহ্ আমাদেরকে ইসলামি নরকের আকৃতির ব্যাপ্তি সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা দিয়েছেন।
৮৯:২৩ এবং সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, কিন্তু এই স্মরণ তার কি কাজে আসবে? [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এই আয়াত নিয়ে সুনান তিরমিযীতে অন্তর্গত একটি হাদীস পড়া যাক।
আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবদুর রহমান (র.)...আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সেইদিন (কিয়ামতের দিন) জাহান্নামকে আনা হবে। এর থাকবে সত্তর হাজার লাগাম। প্রতিটি লাগামের সাথে থাকবে সত্তর হাজার ফিরিশতা। তারা এটি ধরে তা টানবে।
...আবদুল্লাহ ইব্ন আবদুর রহমান বলেনঃ ছাওরী (র.) হাদীছটি মারফূ’ রূপে বর্ণনা করেন নি।
...আবদ ইব্ন হুমায়দ (র।)...আলা ইব্ন খালিদ (র।) সূত্রে উক্ত সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে এটি মারফূ নয়। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৫৫, হাদীস ২৫৭৪)
এখন গণনা করা যাক, কতজন ফেরেশতা জাহান্নামকে টেনে আনবে—সত্তর হাজারকে সত্তর হাজার দিয়ে গুণ করলে আমরা পাই (গণনাযন্ত্র বা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করুন) ৪.৯ বিলিয়ন বা ৪৯০ কোটি ফেরেশতা। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, উনি যা চাইবেন তা নিমেষেই করে ফেলতে পারেন (২:১১৭)। তাই যদি হয় তবে এই বিশাল সংখ্যক ফেরেশতার কী প্রয়োজন?
আরও একটি হাদীস দেখা যাক—হাদীসটি ইসলামি স্বর্গসুখের নমুনা।
সুয়ায়দ ইব্ন নাসর (র)...আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন। রাসূলুল্লাহ্ বলেছেনঃ জান্নাতীদের মাঝে সর্বনিম্ন যে তারও হবে আশি হাজার সেবক, বাহাত্তর হাজার সঙ্গিনী। মোতী, যবরজদ এবং ইয়াকূত পাথরে নির্মিত পাথরে জাবিয়া থেকে সান’আ পর্যন্ত দূরত্বের ন্যায় (১) বিস্তৃত এক বিরাট গুম্বজ বিশিষ্ট প্রাসাদ তার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হবে।
...এই সনদেই নবী (সা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ছোট বা বড় যে বয়সেই মারা যাক না কেন জান্নাতে গিয়ে তার বয়স হবে ত্রিশ। কখনও তাদের বয়স বাড়বে না। জাহান্নামীদের অবস্থা তদ্রূপ হবে।
...এই সনদে নবী (সা) থেকে আরো বর্ণিত যে, তিনি বলেন, জান্নাতীদের যে তাজ হবে এর সবচে’ নিম্নমানের মোতীটিরও ছটাও পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে যা কিছু সব কিছু উজ্জ্বল করে ফেলবে।
...হাদীছটি গারীব। রিশদীন ইব্ন সা;দ (র.)-এর রেয়ায়ত ছাড়া এটি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই।
পাদটিকা (১): জাবিয়া—দামিশ্কের একটি নগর। সানআ—ইয়ামনের একটি শহর। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৪৯-৫০, হাদীস ২৫৬৪)
আমরা অনেকেই শুনেছি যে ইসলামি স্বর্গে প্রত্যেক মুমিন বান্দা বাহাত্তরটি স্ত্রী পাবে—যাদেরকে হুরী বলা হয়। যেটা আমরা অনেকেই জানিনা সেটা হচ্ছে—প্রত্যেক মুমিনের বাহাত্তর হাজার (৭২০০০) সঙ্গিনীও থাকবে। এই সব বাহাত্তর হাজার সঙ্গিনীরাও যে যৌন-সঙ্গিনী হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা এদেরকে মেয়ে-বন্ধু বা ইসলামি গার্ল-ফ্রেন্ড বলতে পারি। আর লক্ষ্য করতে হবে যে এইসব সংখ্যা হচ্ছে সর্বনিম্ন—এর চাইতে বেশী হবে, কম হবে না। আরও মনে রাখতে হবে যে এই সংখ্যা হচ্ছে সাতটি ইসলামি স্বর্গের সর্বনিম্ন স্তরের স্বর্গের সংখ্যা।
আসুন, এবার আমরা একটি হিসাব করে নেই। সংখ্যার বিশালতার জন্য সাধারণ গণনাযন্ত্রে বা ক্যালকুলেটরে এই হিসাব হয়তো নাও করা যেতে পারে।
ধরা যাক আজকের বিশ্বে মুমিন মুসলিমদের সংখ্যা ১.৫ বিলিয়ন বা ১৫০ কোটি। সংখ্যার বিশ্বস্ততার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি ১৫০ কোটি মুমিনরা সবাই সর্বনিম্ন বেহেশত (বা ইসলামি স্বর্গ) পাচ্ছেন।
যেহেতু এই ইসলামি স্বর্গের সব ফুর্তি সুধুমাত্র পুরুষদের জন্য সেই জন্য এই সংখ্যাকে অর্ধেক করতে হবে। অর্থাৎ ৭৫ কোটি মুসলিম পুরুষেরাই এই ভোগ বিলাসে মত্ত থাকবে।
চাকর বা নফর—৮০ ০০০ গুণ ৭৫০ ০০০ ০০০—সংখ্যাটি এত বিশাল যে সাধারণ সংখ্যা লেখার পদ্ধতিতে সংখ্যাটি লিখলে তা হবে এই প্রকারঃ ৬০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০, যা হচ্ছে ৬০ ট্রিলিয়ন (বাংলায় কি হবে আমার জানা নেই, খুব সম্ভবত ৬০ লক্ষ কোটি)।
ইসলামি মেয়ে-বন্ধু বা গার্ল-ফ্রেন্ড—৭২ ০০০ গুণ ৭৫০ ০০০ ০০০ যার ফল হচ্ছে ৫৪ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ বা ৫৪ ট্রিলিয়ন (বাংলায় খুব সম্ভবত ৫৪ লক্ষ কোটি)।
এ কি বিশাল ইসলামি ভোগসুখের কারখানা তা আমরা কেউ চিন্তাই করতে পারি না। অন্ততপক্ষে সংখ্যার দিকে এ এক অকল্পনীয় ব্যাপার।
আরও লক্ষণীয় ব্যাপার—ইসলামি স্বর্গে আল্লাহ তা’আলা প্রতি মুমিনের বয়স ত্রিশ বছর করে দিবেন। আল্লাহ্ মনে করেন ত্রিশ বছর বয়সে এক মুমিন পুরুষের যৌনকামনা তুঙ্গে থাকে। কিন্তু আল্লাহ পাক মুমিন নারীদের ব্যাপারে কিছু জানান নাই।
ইসলামি পাটিগণিত-২
[খণ্ড ১]
সৃষ্টি-সংখ্যায় বিভ্রান্তিঃ-
আল্লাহ্ পাকের সৃষ্টি-সময়ের গোলমাল নিয়ে আজকাল বেশ রচনা লেখা হয়েছে। এখানে সংক্ষিতভাবে দেখা যাক আল্লাহ কেমন করে এই বিষয়ে গণনা করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাইবেলে লেখা আছে ঈশ্বর ছয়দিনে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। আরও মনে রাখা দরকার যে পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অতিশয় ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।
দেখা যাক এই ব্যাপারে কোরানে কি লেখা আছেঃ
৭:৫৪ নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি পরিয়ে দেন রাতের উপর দিনকে এমতাবস্থায় যে, দিন দৌড়ে দৌড়ে রাতের পিছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র স্বীয় আদেশের আনুগামী। শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ্ বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এই আয়াতে আল্লাহ্ পাক পরিষ্কার বলেছেন পৃথিবী ও আকাশ সমূহ সৃষ্টি করতে তাঁর ছয়দিন লেগেছে। নভোমণ্ডল বলতে আল্লাহ্ কি বুঝাচ্ছেন তা পরিষ্কার নয়। তাফসিরবিদগণ নভোমণ্ডলকে সপ্ত-আকাশই মনে করেন। আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে যে এর কোন যোগাযোগ নেই তা বলার দরকার নেই। কোরানের অনেক আয়াতেই আকাশকে ছাদ বলা হয়—অর্থাৎ পৃথিবীর উপরে রয়েছে সাতটি ছাদ। যেমন এই আয়াত:
৪০:৬৪ আল্লাহ্ পৃথিবীকে করেছেন তোমাদের বাসস্থান, আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতি সুন্দর করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন পরিচ্ছন্ন রিযিক। তিনি আল্লাহ্, তোমাদের পালনকর্তা। বিশ্বজগতের পালনকর্তা, আল্লাহ্ বরকতময়। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
তাই ৭:৫৪ আয়াতে ছয়দিনের সৃষ্টি বলতে পৃথিবী এবং তার উপরের সাতটি ছাদের কথাই বলা হয়েছে।
আরও অনেকগুলো আয়াতে আল্লাহ্ ছয়দিনে পৃথিবী ও নভোমণ্ডল সৃষ্টির কথা বলেছেন। এই সব আয়াতগুলো হচ্ছে: ১০:৩, ১১:৭, ২৫:৫৯, ৫০:৩৮, ৫৭:৪।
এখানে লক্ষণীয় যে ৭:৫৪, ১০:৩, ১১:৭, ৫০:৩৮, ৫৭:৪ আয়াতগুলিতে আল্লাহ্ বলেছেন—প্রথমে নভোণ্ডল সৃষ্টি হয়েছে, তার পর ভূমণ্ডল বা পৃথিবী।
অর্থাৎ, নভোমণ্ডল (প্রথম) + ভূমণ্ডল (দ্বিতীয়) সৃষ্টির সময় = ৬ দিন।
আয়াত ২৫:৫৯-এ আল্লাহ্ বলছেন উনি প্রথমে নভোমণ্ডল, তারপর ভূমণ্ডল, তারপর এতদুভয়ের মধ্যে যাবতীয় যা আছে সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে।
অর্থাৎ নভোমণ্ডল (প্রথম) + ভূমণ্ডল (দ্বিতীয়) + এতদুভয়ের মধ্যে সব কিছ সৃষ্টির সময় (তৃতীয়) = ৬ দিন।
উপরের দুটি সমীকরণ থেকে আমরা বলতে পারি—মহাশূন্যে যা আছে, যেমন, ছায়াপথ, নীহারিকা, অন্যান্য গ্রহ, ধুমকেতু, কৃষ্ণ গহবর...ইত্যদি তৈরী করতে আল্লাহর সময় লেগেছে = ০ (শূন্য) দিন।
তাজ্জব হবারই ব্যাপার।
এবার দেখা যাক নিচের আয়াতগুলো:
৪১:৯ বলুন, তোমরা কি সে সত্তাকে অস্বীকার কর যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দু’দিনে এবং তোমরা কি তাঁর সমকক্ষ স্থির কর? তিনি তো সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা।
৪১:১০ তিনি পৃথিবীতে উপরিভাগে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন এবং চার দিনের মধ্যে তাতে তার খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন—পূর্ণ হল জিজ্ঞাসুদের জন্যে।
৪১:১১ অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্রকুঞ্জ, অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম।
৪১:১২ অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীকে দু’দিনে সপ্ত আকাশ করে দিলেন এবং প্রত্যেক আকাশে তার আদেশ প্রেরণ করলেন। আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুশোভিত ও সংরক্ষিত করেছি। এটা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ্র ব্যবস্থাপনা। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এইসব আয়াতগুলো থেকে সাধারণ জ্ঞানে আমরা যা বুঝি তা এই প্রকার:
প্রথমে আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন পৃথিবী বা ভূমণ্ডল—সময় লাগলো ২ দিন।
দ্বিতীয় আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন পৃথিবীর উপরিভাগে পর্বতমালা ও খাদ্যদ্রব্য—সময় লাগলো ৪ দিন।
তৃতীয় আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন নভোমণ্ডল—সময় লাগলো ২ দিন।
এখন এই সংখ্যাগুলো যোগ করা যাক, অর্থাৎ ২ + ৪ + ২ = ৮ দিন
এইসব দ্ব্যর্থক এবং বিসদৃশ আয়াতের বিব্রতকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কোরানের ব্যাখাকারীরা কতই না কসরত করে যাচ্ছেন। অনেকে বলেন: কোরানের ছয় দিন সৃষ্টির অনেক কাজই যুগপৎ চলেছে—অর্থাৎ যখন আল্লাহ্ পৃথিবী বা ভূমণ্ডল সৃষ্টি করছিলেন সেই সাথে নভমণ্ডল বা সপ্তাকাশ নির্মাণের কাজও চলছিল। তার অর্থ দাঁড়ায়—ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল সৃষ্টি করতে সর্বমোট সময় লেগেছে দুই দিন।
কিন্তু ৪১:৯-১২ পরিষ্কার বলা হচ্ছে পৃথক পৃথক সৃষ্টির কথা—পৃথিবী—তারপর পর্বতমালা ও খাদ্য দ্রব্য—তারপর আকাশমণ্ডলী।
আয়াত ২:২৯-এ আল্লাহ্ লিখেছেন:
২:২৯ তিনিই সে সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমীনে রয়েছে সে সমস্ত। অতঃপর তিনি মনোসংযোগ করেছেন আকাশের প্রতি। বস্তুতঃ তিনি তৈরী করেছেন সাত আসমান। আর আল্লাহ্ সববিষয়ে অবহিত। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন বাংলা (অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এখানে আল্লাহ তা’আলা এই সব সৃষ্টির সময় উল্লেখ করেননি।
অর্থাৎ আল্লাহ্ প্রথমে ভূমণ্ডল এবং এর সাথে জড়িত সব কিছু তৈরী করলেন। তারপর তৈরী করলেন সপ্ত-আকাশ—সময় = অনির্দিষ্ট।
অবশ্য, অনেকেই বলতে পারেন যে এই আয়াতে শুধু সৃষ্টি-সংবাদ বা তথ্যই দেয়া হয়েছে—কোন সময় দেওয়া হয় নাই।
আমরা এটাও অনুমান করে নিতে পারি আল্লাহ্ তাৎক্ষণিকভাবে এইসব তৈরী করেছেন। কারণ আল্লাহ কয়েক জায়গায় লিখেছেন যে উনি চাইলেই তা সাথে সাথে হয়ে যায়। যেমন:
১৯:৩৫ আল্লাহ্ এমন নন যে, সন্তান গ্রহণ করবেন, তিনি পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, তিনি যখন কোন কাজ করা সিদ্ধান্ত করেন, তখন একথাই বলেন: হও এবং তা হয়ে যায়। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
অর্থাৎ, আল্লাহ্ প্রথমে ভূমণ্ডল এবং এর সাথে জড়িত সব কিছু তৈরী করলেন। তারপর তৈরী করলেন সপ্ত-আকাশ—সময় = ০ দিন।
আল্লাহ্র এই খামখেয়ালিপনার ব্যাপারে ইব্নে কাসিরের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। যেমন ২:২৯ আয়াত সম্পর্কে ইব্নে কাসির লিখেছেন:
এ আয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে, যে মহান আল্লাহ্ প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর সাতটি আকাশ নির্মাণ করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অট্টালিকা নির্মাণের এটাই নিয়ম যে, প্রথমে নির্মাণ করা হয় নীচের অংশ এবং পরে উপরের অংশ। মুফাস্সিরগণ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা ইনশাআল্লাহ এখনি আসছে। কিন্তু এটা বুঝে নেয়া উচিত যে, আল্লাহ্ পাক অন্য স্থানে বলেছেনঃ “আচ্ছা! তোমাদেরকে সৃষ্টি করাই কি কঠিন কাজ, নাকি আসমান? আল্লাহ্ ওটা (এরূপে) নির্মাণ করেছেন যে, ওর ছাদ উঁচু করেছেন এবং ওকে সঠিকভাবে নির্মাণ করেছেন। আর ওর রাতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছেন ওর দিনকে প্রকাশ করেছেন এরপর জমীনকে বিছিয়ে দিয়েছেন। তা হতে পানি ও তৃণ বের করেছেন এবং পর্বত সমূহ স্থাপন করেছেন। (তিনি এসব কিছু করেছেন) তোমাদের ও তোমাদের পশুপালের উপকারের জন্যে।” [৭৯:২৭-৩৩]। এ আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, তিনি আকাশের পরে জমীন সৃষ্টি করেছেন। [তাফসীর ইব্নে কাসির, খণ্ড ১, ২, ৩, পৃঃ ২১৪]।
ইব্নে কাসির আরও লিখেছেন:
কেউ কেউ বলেছেন যে, পরবর্তী আয়াতটিতে আসমানের সৃষ্টির পরে জমীন বিছিয়ে দেয়া ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে, সৃষ্টি করা নয়। তাহলে ঠিক আছে যে, প্রথমে জমীন সৃষ্টি করেছেন, পরে আসমান। অতঃপর জমীনকে ঠিকভাবে সাজিয়েছেন। এতে আয়াত দু’টি পরস্পর বিরোধী আর থাকলো না। এ দোষ হতে মহান আল্লাহ্র কালাম সম্পূর্ণ মুক্ত। [তাফসীর ইব্নে কাসির, খণ্ড ১, ২, ৩, পৃঃ ২১৪]।
বুঝা যাচ্ছে ইব্নে কাসিরের সময়ও আল্লাহ্র বিভ্রান্তিমূলক আয়াত নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে এবং ইসলামি পণ্ডিতগণ ইসলামকে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে অর্থহীন যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন।
দেখা যাক আল্লাহ্ কি লিখেছেন ২:১১৭-এ:
২:১১৭ তিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন কোন কার্য সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’, তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
অর্থাৎ, প্রথমে নভোমণ্ডল, তারপর পৃথিবী বা ভূমণ্ডলের সবকিছু—সময় = ০ (শূন্য) দিন।
ইব্নে কাসির লিখেছেন:
সেই আল্লাহ্র ক্ষমতা ও প্রভাব ও প্রতিপত্তি এতো বেশী যে, তিনি যে জিনিসকে যে প্রকারের সৃষ্টি ও নির্মাণ করতে চান তাকে বলেন—‘এভাবে হও এবং এরকম হও’ আর তেমনই সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেন:
অর্থাৎ ‘যখন তিনি কোন জিনিসের (সৃষ্টি করার) ইচ্ছে করেন, তখন তাঁর রীতি এই যে, ঐ বস্তুকে বলেন—‘হও’ আর তেমনই হয়ে যায়।’ (৩৬:৮২)
অন্য জায়গায় বলেনঃ
অর্থাৎ “যখন আমি কোন বস্তু (সৃষ্টির) ইচ্ছে করি তখন আমার কথা এই যে, আমি তাকে বলি—‘হও’ আর তেমনই হয়ে যায়।” (১৬:৪০)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছেঃ
অর্থাৎ “চোখের উঁকি দেয়ার মত আমার একটি আদেশ মাত্র।” (৫৪:৫০) [তাফসীর ইব্নে কাসির, খণ্ড ১, ২, ৩, পৃঃ ৩৭৯]।
আল্লাহর সৃষ্টি-বিভ্রান্তি নিয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘আবদুল্লাহ্ ইবন্ ‘আমর ইবনুল ‘আস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ্পাক আকাশমণ্ডলী ও ভূখণ্ড সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে তাক্দীরসমূহ নির্ধারণ করে রেখেছেন। (মুসলিম, তাবারাণী ও তিরমিযী, তিনি হাদীসটি হাসান ও সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন।) [মুসনাদে আহমদ: প্রথম খণ্ড: তকদির অধ্যায়, পৃঃ ১০৩, হাদীস ১]
পঞ্চাশ হাজার বছর কে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করলে আমরা পাই ১৮ ২৫০ ০০০ (১৮.২৫ মিলিয়ন) বা প্রায় ১.৮ কোটি দিন।
আর এদিকে কোরানে দেখা যাচ্ছে ভূ-মণ্ডল ও নভোমণ্ডল তৈরী করতে আল্লাহ্র লেগেছে মাত্র ছয় অথবা আট দিন।
আধুনিক কালে পশ্চিমা দেশে অবস্থানরত কিছু ইসলামি পণ্ডিত ব্যাপারটা টের পেয়ে বলতে শুরু করেছেন, যে আল্লাহ্র সৃষ্টি নিয়ে যে সব দিন উল্লেখ তা আসলে দিন (অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার দিন) নয়। এগুলো হচ্ছে পর্ব—অর্থাৎ ছয় অথবা আট পর্ব।
তাজ্জবেরই কথা—যেখানে প্রায় সমস্ত প্রখ্যাত অনুবাদক এবং তাফসিরবিদ্গণ এই সময়কে দিনই বলেছেন সেখানে নাম না জানা কিছু ইসলামি পণ্ডিত কোরানের বিরুদ্ধেই লিখে চলেছেন!
আয়াত ১০:৩ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত তফসিরবিদ জালালাইন লিখেছেন যে এই সময় নির্ণয় করা হয়েছে সেইভাবে যেভাবে পৃথিবীর সময় নির্ণয় করা হয়, যেহেতু তখন কোন সূর্য বা চন্দ্র ছিল না। [তাফসির জালালাইন ইংরাজি, আয়াত ১০:৩, অনুবাদ লেখকের]
এর অর্থ হচ্ছে সৃষ্টির ছয় দিন হচ্ছে, ৬ গুণ ২৪ = ১৪৪ ঘণ্টা।
আট দিন হচ্ছে ৮ গুণ ২৪ = ১৯২ ঘণ্টা।
কিসের প্রয়োজন ছিল এতদিন অপেক্ষা করে (১.৮ কোটি দিন) বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করার যখন আল্লাহ্ এক নিমেষেই সবার তকদীর নির্ধারিত করে দিতে পারেন সৃষ্টির সাথে সাথে?
ইসলামী পাটিগণিত-৩
ইসলামি বর্ষপঞ্জী বা ক্যালেণ্ডারঃ-
প্রতি বৎসর ইসলামি বিশ্বে এক দারুণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যখন দেখা যায় যে বিভিন্ন দেশে ঈদ পালিত হচ্ছে বিভিন্ন দিনে। যেদিন সৌদি আরবে ঈদ পালিত হয় হয়তো তার এক বা দুই দিন পরে বাংলাদেশে ঈদ পালিত হয়। অনেক সময় এই সময়ের তারতম্য দুইদিনেরও বেশী হতে পারে। রমজান বা রোজা রাখা নিয়েও এই পরিস্থিতি। আমার জানা মতে বর্ষপঞ্জী নিয়ে ইসলাম ছাড়া এই ধরণের বিদঘুটে পরিস্থিতি অন্য কোন ধর্ম বা সমাজব্যবস্থায় নেই। এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির কোন সমাধান আজ পর্যন্ত ইসলামি বিশ্ব করে নাই বা করতে রাজী নয়। তার কারণ কি? আল্লাহ পাক কি এই ধরণের বিভ্রান্তি চান?
আমরা দেখব কেন এই সমস্যা কেয়ামত অবধি বিদ্যমান থাকবে। ইসলামি পাটিগণিত যে কেমন অনির্ভরযোগ্য তা এই ইসলামি বর্ষপঞ্জীর হাল থেকেই বুঝা যাবে।
ইসলামি বর্ষপঞ্জী শুরু হয় খৃঃ ৬২২ সালে (উইকিপিডিয়া)। এই বর্ষপঞ্জী শুরু হয় নবী মুহাম্মদের মদিনায় হিজরির দিন থেকে। এই দিন, যথা ১৭-ই জুলাই ৬২২ থেকে এই হিজরি বর্ষপঞ্জী শুরু। অর্থাৎ, ১৭-ই জুলাই ৬২২ হচ্ছে ইসলামি হিজরি পহেলা (১) মুহররম হিজরি ১ সন। হিজরি বর্ষপঞ্জীতে বারোটি মাস নির্ধারিত হয়েছে: যথা—মুহররম, সফর, রবিউল-আওয়াল, রবিউল-আখির, জামাদউল-আওয়াল, জামাদিউল-আখির, রজব, শাবান, রমজান, জ্বেল-ক্বদ, জ্বেল-হজ্ব।
ইসলামের আগমনের অনেক আগে থেকেই আরব বেদুইনরা ঠিক করেছিল যে তারা সারা বছর রক্তপাত করবে না। তাই তারা বৎসরের চারটি মাসকে ‘নিষিদ্ধ’ বা পবিত্র মাস হিসেবে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। এই চারটি মাস হচ্ছে—জ্বেল-ক্বদ, জ্বেল-হজ্ব, মুহররম এবং রজব। মুহাম্মদের আগমনের পূর্বে কোন আরব গোষ্ঠী কখনই এই নিয়ম ভঙ্গ করে নাই, যতই শত্রুতা থাকুক না কেন বিভিন্ন গোত্রের মাঝে। যতটুকু জানা যায় একমাত্র নবী মুহাম্মদই একতরফা ভাবে অনেক সময় এই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন—এই সব নিষিদ্ধ মাসগুলিতে যুদ্ধ চালিয়েছেন এবং রক্তপাত ঘটিয়েছেন।
আল্লাহ পাক নিজেই পৌত্তলিক আরবদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই সব সম্মানের মাসগুলিকে সম্মানের মাস হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন।
৯:৩৬ নিশ্চয় আল্লাহ্র বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সূপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ্ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন।
কিন্তু আল্লাহ্ পাক কোরানের কোথায়ও পরিষ্কারভাবে জানান নাই এই সম্মানিত মাসগুলি কোন কোন মাস।
এখন আমরা দেখব কী বিচিত্র এই ইসলামি বর্ষপঞ্জী।
ইসলামি বর্ষপঞ্জী চন্দ্র বৎসরের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ব্যবস্থা ইসলামের আগমনের অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ইসলামি বর্ষপঞ্জীতে আছে ৩৫৪ অথবা ৩৫৫ দিন। এই তারতম্যের কারণ হচ্ছে—গ্রেগরিয়ান (বর্তমান ইংরাজি) বর্ষপঞ্জীর মতো ইসলামি বর্ষপঞ্জীতেও লিপ-ইয়ারের ব্যাবস্থা আছে। এই ইসলামি লিপ ইয়ার হয় প্রতি সাত বছরে এক বার।
আল্লাহ্ তা’আলা কোরানে বলেছেন ইসলামি বর্ষপঞ্জী গণনা চন্দ্রের উপর নির্ভর করে।
১০:৫ তিনিই সে মহান সত্তা, যিনি বানিয়েছেন সুর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনযিলসমূহ, যাতে করে তোমরা পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ্ এই সমস্ত কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি, কিন্তু যথার্থতার সাথে। তিনি প্রকাশ করেন লক্ষণসমূহ সে সমস্ত লোকের জন্য যাদের জ্ঞান আছে।
মনে রাখতে হবে চন্দ্রের আবর্তন চক্র (সাইকেল) হচ্ছে ২৮দিন। সেই মতে এক বৎসরে ইসলামি দিনের সংখ্যা হওয়া উচিত ১২ গুন ২৮ = ৩৩৬ দিন।
এখন ৩৫৪ কে ১২ দিয়ে ভাগ করলে আমরা পাই ২৯.৫ দিন।
৩৫৫ কে ১২ দিয়ে ভাগ করলে আমরা পাই ২৯.৫৮ দিন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ইসলামি বর্ষপঞ্জী কোনভাবেই চন্দ্রের আবর্তন-চক্র পালন করছে না।
সেই জন্য কোন কোন ইসলামি মাস ধরা হয় ২৯ দিন আর কোন কোন ইসলামি মাস ধরা হয় ৩০ দিন—অনেকটা ইংরাজি বর্ষপঞ্জীর পদ্ধতিতে।
তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?
লক্ষ্য করুন যে ইংরাজি মাসগুলোতে কত দিন হবে তা অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত হয়েছে: যেমন, জানুয়ারি-৩১ দিন, ফেব্রুয়ারি ২৮ দিন (লিপ-ইয়ার ছাড়া), মার্চ ৩১ দিন, এপ্রিল ৩০ দিন...ইত্যাদি। এই পদ্ধতি বিশ্বের সর্বত্র একই ভাবে পালন করা হয়। তাই যে সব আচার অনুষ্ঠান ইংরাজি বর্ষপঞ্জীর উপর প্রতিষ্ঠিত সেগুলি প্রতি বছর ঐ একই দিনে পালিত হয়, কোন ব্যতিক্রম হয় না। তাই ইংরাজি বর্ষপঞ্জী নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু ইসলামি গণনা পদ্ধতি এমন নয়। ইসলামি মাসের গণনা শুরু হয় চাঁদ দেখা গেল বা দেখা গেল না এর উপর। ইসলামি দিন গণনা শুরু হয় সন্ধ্যায়, চাঁদ দেখার পর। যদি মাসের ২৯ দিনে সন্ধ্যায় নতুন চাঁদ দেখা যায় তবে ঐ মাস হবে ২৯ দিন, আর যদি না দেখা যায় তবে ঐ মাসটি হবে ৩০ দিন। এই জন্যই কোন কোন বছর ২৯টি রোজা হয় আর কোন কোন বছর রোজা হয় ৩০ টি আবার কোন কোন বছর ২৮ দিনও। এমনও হয় যে কোন বছর দুইবার রমজানের শুরু হয় এবং ঈদও হয় দুইবার। আমাদের জীবদ্দশাতেই হয়তো অনেকেই তা পর্যবেক্ষণ করেছি। লক্ষ্য করবেন যে এক সময় রমজান পালিত হচ্ছে হাড় কাঁপানো শীতকালে আবার এক সময় রমজান পালিত হচ্ছে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমের সময়। আর যখন এক ইসলামি দেশে ঈদ বা রমজান শুরু হয় অন্য আর এক (এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশেও) দেশে তা হয় না।
ইসলামি বর্ষপঞ্জীর আরও অনেক দ্ব্যর্থকতা বা অস্পষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায় এই কয়েকটি আয়াতে:
২৯:১৪ আমি নূহ (আঃ)—কে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছিলাম। তিনি তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর অবস্থান করেছিলেন। অতঃপর তাদেরকে মহাপ্লাবন গ্রাস করেছিল। তারা ছিল পাপী।
১৮:২৫ তাদের উপর তাদের গুহায় তিনশ’ বছর অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে।
তাজ্জবের ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহ্ পাক সরাসরি নির্ভুলভাবে বলতে পারেন না কত সময় লেগেছিল—তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এই অদ্ভুত ভাষা ব্যবহার করেছেন। এখন চিন্তা করুন চিকিৎসা ক্ষেত্রে অথবা গাড়ী বা বাড়ী কিনবার সময় যদি এই ধরণের ভাষা ব্যবহার করা হয় তবে তার পরিণতি কি হতে পারে।
এইসব বিভ্রান্তিমূলক গণনা কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত তা আল্লাহ্ তা’আলা জানান নাই। এই বিড়ম্বনা এড়াতে আজকাল অনেক ইসলামি পণ্ডিত বলেন—বৎসরগুলি চন্দ্র এবং সৌর গণনার উপর। কি বিচিত্র যুক্তি! কিন্তু রূপান্তরিত গণনা করলেও আমরা এই দুই সংখ্যা এক পাব না। এখানে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আয়াত ২৯:১৪ দেখুন:
আমরা আগেই দেখেছি এক সৌর বছরে আছে ৩৬৫ দিন আর এক চন্দ্র বছরে আছে ৩৫৪ দিন (লিপ ইয়ার বাদে)। মনে রাখতে হবে এক দিনের সময় মাপ একই হতে হবে অর্থাৎ এক দিন = ২৪ ঘণ্টা তা সৌর বছরই হউক বা চন্দ্র বছরই হউক।
এখন গণনা করা যাক:
চন্দ্র বছরে ১০০০ বছর গুণ ৩৫৪ = ৩৫৪ ০০০ দিন
সৌর বছরে ৯৫০ বছর গুণ ৩৬৫ = ৩৪৬ ৭৫০ দিন
এই দুই হিসাবের তারতম্য হচ্ছে ৩৫৪ ০০০ বিয়োগ ৩৪৬ ৭৫০ = ৭ ২৫০ দিন
এই তফাতকে সৌর বছরে রূপান্তরিত করা যাক—৭ ২৫০ ভাগ ৩৬৫ = ১৯.৯ বছর বা ১৯ বছর ৩২৯ দিন।
তাহলে ইসলামি পণ্ডিতদের যুক্তির সার্থকতা কোথায়?
এখন আয়াত ১৮:২৫ যে সময়ের কথা আল্লাহ্ পাক বলেছেন তার গণনা করুন উপরের উদাহরণের মত। দেখুন কি ফলাফল।
সূচনাঃ-
ইসলামি পণ্ডিতেরা এবং ইসলামি ঐতিহাসিকেরা সর্বদাই প্রচার করে চলেছেন যে ইসলাম বিশ্বকে অঙ্কশাস্ত্র বিশেষত বীজগণিত উপহার দিয়েছে। ভাব-সাব এমন যেন ইসলামের পূর্বে বিশ্ব অঙ্কশাস্ত্রের প্রচলন ছিল না। কিন্তু সত্য হল সংখ্যাতত্ত্ব বিশেষত আধুনিক দশমিক সংখ্যা তথ্যের উদ্ভব করেছে হিন্দুরা—ভারতবর্ষেই। পরে আরবেরা এই সংখ্যা-তথ্য অবলম্বন করে এবং ধীরে ধীরে তা বিশ্বের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
এই রচনায় আমরা দেখব ইসলামের উৎস, তথা কোরান এবং হাদিগুলোতে কীভাবে পাটিগণিতের ব্যবহার করা হয়েছে।
আল্লাহ্র পরিসংখ্যান তথ্য
আমরা প্রথমেই দেখি কোরানে আল্লাহ্ তা’আলা লিখেছেন যে উনি পাটিগণিত জানেন। সূরা মারইয়ামে আল্লাহ্ লিখেছেন:
১৯:৯৪ তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
দেখা যাচ্ছে আল্লাহ্ তা’লার কাছে বিশ্বের সবকিছুর হিসাব রয়েছে। আমরা ধরে নিতে পারি এই হিসাবের জন্য পাটিগণিতের মৌলিক বিধান—যথা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি আল্লাহ্ তা’আলা খুব ভালোভাবেই জানেন। আরও ধরে নিতে পারি যে আল্লাহ্র কাছে যে পরিসংখ্যান আছে তা নির্ভুল এবং সাম্প্রতিক। অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক অনুমানের উপর হিসাব রাখেন না।
আয়াত ১৯.৯৪-এর প্রসঙ্গ হচ্ছে: আল্লাহ্ জানলেন যে খ্রিষ্টানেরা নাকি বলেছে যে আল্লাহ্র এক সন্তান আছে। এই ব্যাপার জেনে আল্লাহ্ অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে পড়লেন, এবং দাবী করলেন যে উনি সবকিছুই গণনা করে সব কিছুর তথ্য ও হিসাব জানেন। এই প্রসঙ্গে ইব্নে কাসির লিখেছেন:
সবারই গণনা তাঁর কাছে রয়েছে। তাঁর জ্ঞান সবকে পরিবেষ্টন করে আছে। সবাই তাঁর ক্ষমতা আওতার মধ্যে রয়েছে। সমস্ত পুরুষ, নারী, ছোট ও বড় এবং ভাল ও মন্দের খবর তিনি রাখেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর জ্ঞান তাঁর আছে। (তাফসীর ইব্নে কাসির, চতুর্দশ খণ্ড, পৃঃ ২০৩)।
সূরা আস-সাফ্ফাতে হযরত ইউনুস প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক লিখেছেন:
৩৭:১৪৭ এবং তাঁকে, লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করলাম।
৩৭:১৪৮ তারা বিশ্বাস স্থাপন করল অতঃপর আমি তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপভোগ করতে দিলাম। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
দেখা যাচ্ছে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর পরিসংখ্যান সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান রাখেন না। আল্লাহ্ হযরত ইউনুসকে মাছের পেটের থেকে মুক্তি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন মসুলের কাছে নিনেভার জনতার মাঝে। কিন্তু তখন নিনেভার জনসংখ্যা কত ছিল আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য রাখেননি। এই সমস্যা এড়াবার জন্য কোরানের ব্যাখ্যাকারীরা নানা আবোল তাবোল লিখেছেন; যেমন ইব্নে কাসির লিখেছেন:
তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ ত্রিশ হাজার বা এর চেয়েও কিছু বেশী বা সত্তর হাজারের বেশী অথবা এক লক্ষ দশ হাজার। একটি মারফূ’ হাদিসের বর্ণনা হিসেবে তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ বিশ হাজার। (তাফসীর ইব্নে কাসির, ষষ্টদশ খণ্ড, পৃঃ ২৩০)।
এদিকে পরিসংখ্যানে আল্লাহ্র জ্ঞানের স্বল্পতা ঢাকতে মাওলানা মৌদুদি লিখেছেন:
এক লাখ বা এর বেশী ”বলার মানে এ নয় যে, এর সঠিক সংখ্যার ব্যাপারে আল্লাহ্র সন্দেহ ছিল বরং এর অর্থ হচ্ছে, যদি কেউ তাদের জনবসতি দেখতো তাহলে সে এ ধারণাই করতো যে এ শহরের জনসংখ্যা এক লাখের বেশীই হবে, কম হবে না। (তাফহীমুল কুর আন, সূরা আস্ সা-ফ্ ফা-ত, পৃঃ ৭৫)।
এই প্রসঙ্গে একটি হাদীসও উল্লেখ করা যেতে পারে:
আলী ইব্ন হুজর (র)...উবাই ইব্ন কা’ব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
তাকে (ইউনুস আ) আমি লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম (সাফ্ফাত ৩৭:১৪৭) আয়াতটি সম্পর্কে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেনঃ এরা ছিল (এক লক্ষ) বিশ হাজার।
হাদীছটি গারীব। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৫০১, হাদীস ৩২২৯)
স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আল্লাহ্র ভুল ঢাকতে গিয়ে তাফসিরকার এবং অনুবাদক নিজেদের মনগড়া কথাবার্তা বন্ধনীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে এই ধরণের ইসলামী পরিসংখ্যান কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে—যেখানে শুধু আল্লাহ্ই নন, উনার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তথা নবী মুহাম্মদেরও পরিসংখ্যান জ্ঞান একেবারেই মূল্যহীন বা অ-নির্ভরযোগ্য।
কোরানের একটি আয়াতে আল্লাহ্ আমাদেরকে ইসলামি নরকের আকৃতির ব্যাপ্তি সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা দিয়েছেন।
৮৯:২৩ এবং সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, কিন্তু এই স্মরণ তার কি কাজে আসবে? [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এই আয়াত নিয়ে সুনান তিরমিযীতে অন্তর্গত একটি হাদীস পড়া যাক।
আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবদুর রহমান (র.)...আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সেইদিন (কিয়ামতের দিন) জাহান্নামকে আনা হবে। এর থাকবে সত্তর হাজার লাগাম। প্রতিটি লাগামের সাথে থাকবে সত্তর হাজার ফিরিশতা। তারা এটি ধরে তা টানবে।
...আবদুল্লাহ ইব্ন আবদুর রহমান বলেনঃ ছাওরী (র.) হাদীছটি মারফূ’ রূপে বর্ণনা করেন নি।
...আবদ ইব্ন হুমায়দ (র।)...আলা ইব্ন খালিদ (র।) সূত্রে উক্ত সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে এটি মারফূ নয়। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৫৫, হাদীস ২৫৭৪)
এখন গণনা করা যাক, কতজন ফেরেশতা জাহান্নামকে টেনে আনবে—সত্তর হাজারকে সত্তর হাজার দিয়ে গুণ করলে আমরা পাই (গণনাযন্ত্র বা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করুন) ৪.৯ বিলিয়ন বা ৪৯০ কোটি ফেরেশতা। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, উনি যা চাইবেন তা নিমেষেই করে ফেলতে পারেন (২:১১৭)। তাই যদি হয় তবে এই বিশাল সংখ্যক ফেরেশতার কী প্রয়োজন?
আরও একটি হাদীস দেখা যাক—হাদীসটি ইসলামি স্বর্গসুখের নমুনা।
সুয়ায়দ ইব্ন নাসর (র)...আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন। রাসূলুল্লাহ্ বলেছেনঃ জান্নাতীদের মাঝে সর্বনিম্ন যে তারও হবে আশি হাজার সেবক, বাহাত্তর হাজার সঙ্গিনী। মোতী, যবরজদ এবং ইয়াকূত পাথরে নির্মিত পাথরে জাবিয়া থেকে সান’আ পর্যন্ত দূরত্বের ন্যায় (১) বিস্তৃত এক বিরাট গুম্বজ বিশিষ্ট প্রাসাদ তার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হবে।
...এই সনদেই নবী (সা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ছোট বা বড় যে বয়সেই মারা যাক না কেন জান্নাতে গিয়ে তার বয়স হবে ত্রিশ। কখনও তাদের বয়স বাড়বে না। জাহান্নামীদের অবস্থা তদ্রূপ হবে।
...এই সনদে নবী (সা) থেকে আরো বর্ণিত যে, তিনি বলেন, জান্নাতীদের যে তাজ হবে এর সবচে’ নিম্নমানের মোতীটিরও ছটাও পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে যা কিছু সব কিছু উজ্জ্বল করে ফেলবে।
...হাদীছটি গারীব। রিশদীন ইব্ন সা;দ (র.)-এর রেয়ায়ত ছাড়া এটি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই।
পাদটিকা (১): জাবিয়া—দামিশ্কের একটি নগর। সানআ—ইয়ামনের একটি শহর। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৪৯-৫০, হাদীস ২৫৬৪)
আমরা অনেকেই শুনেছি যে ইসলামি স্বর্গে প্রত্যেক মুমিন বান্দা বাহাত্তরটি স্ত্রী পাবে—যাদেরকে হুরী বলা হয়। যেটা আমরা অনেকেই জানিনা সেটা হচ্ছে—প্রত্যেক মুমিনের বাহাত্তর হাজার (৭২০০০) সঙ্গিনীও থাকবে। এই সব বাহাত্তর হাজার সঙ্গিনীরাও যে যৌন-সঙ্গিনী হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা এদেরকে মেয়ে-বন্ধু বা ইসলামি গার্ল-ফ্রেন্ড বলতে পারি। আর লক্ষ্য করতে হবে যে এইসব সংখ্যা হচ্ছে সর্বনিম্ন—এর চাইতে বেশী হবে, কম হবে না। আরও মনে রাখতে হবে যে এই সংখ্যা হচ্ছে সাতটি ইসলামি স্বর্গের সর্বনিম্ন স্তরের স্বর্গের সংখ্যা।
আসুন, এবার আমরা একটি হিসাব করে নেই। সংখ্যার বিশালতার জন্য সাধারণ গণনাযন্ত্রে বা ক্যালকুলেটরে এই হিসাব হয়তো নাও করা যেতে পারে।
ধরা যাক আজকের বিশ্বে মুমিন মুসলিমদের সংখ্যা ১.৫ বিলিয়ন বা ১৫০ কোটি। সংখ্যার বিশ্বস্ততার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি ১৫০ কোটি মুমিনরা সবাই সর্বনিম্ন বেহেশত (বা ইসলামি স্বর্গ) পাচ্ছেন।
যেহেতু এই ইসলামি স্বর্গের সব ফুর্তি সুধুমাত্র পুরুষদের জন্য সেই জন্য এই সংখ্যাকে অর্ধেক করতে হবে। অর্থাৎ ৭৫ কোটি মুসলিম পুরুষেরাই এই ভোগ বিলাসে মত্ত থাকবে।
চাকর বা নফর—৮০ ০০০ গুণ ৭৫০ ০০০ ০০০—সংখ্যাটি এত বিশাল যে সাধারণ সংখ্যা লেখার পদ্ধতিতে সংখ্যাটি লিখলে তা হবে এই প্রকারঃ ৬০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০, যা হচ্ছে ৬০ ট্রিলিয়ন (বাংলায় কি হবে আমার জানা নেই, খুব সম্ভবত ৬০ লক্ষ কোটি)।
ইসলামি মেয়ে-বন্ধু বা গার্ল-ফ্রেন্ড—৭২ ০০০ গুণ ৭৫০ ০০০ ০০০ যার ফল হচ্ছে ৫৪ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ বা ৫৪ ট্রিলিয়ন (বাংলায় খুব সম্ভবত ৫৪ লক্ষ কোটি)।
এ কি বিশাল ইসলামি ভোগসুখের কারখানা তা আমরা কেউ চিন্তাই করতে পারি না। অন্ততপক্ষে সংখ্যার দিকে এ এক অকল্পনীয় ব্যাপার।
আরও লক্ষণীয় ব্যাপার—ইসলামি স্বর্গে আল্লাহ তা’আলা প্রতি মুমিনের বয়স ত্রিশ বছর করে দিবেন। আল্লাহ্ মনে করেন ত্রিশ বছর বয়সে এক মুমিন পুরুষের যৌনকামনা তুঙ্গে থাকে। কিন্তু আল্লাহ পাক মুমিন নারীদের ব্যাপারে কিছু জানান নাই।
ইসলামি পাটিগণিত-২
[খণ্ড ১]
সৃষ্টি-সংখ্যায় বিভ্রান্তিঃ-
আল্লাহ্ পাকের সৃষ্টি-সময়ের গোলমাল নিয়ে আজকাল বেশ রচনা লেখা হয়েছে। এখানে সংক্ষিতভাবে দেখা যাক আল্লাহ কেমন করে এই বিষয়ে গণনা করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাইবেলে লেখা আছে ঈশ্বর ছয়দিনে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। আরও মনে রাখা দরকার যে পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অতিশয় ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।
দেখা যাক এই ব্যাপারে কোরানে কি লেখা আছেঃ
৭:৫৪ নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি পরিয়ে দেন রাতের উপর দিনকে এমতাবস্থায় যে, দিন দৌড়ে দৌড়ে রাতের পিছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র স্বীয় আদেশের আনুগামী। শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ্ বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এই আয়াতে আল্লাহ্ পাক পরিষ্কার বলেছেন পৃথিবী ও আকাশ সমূহ সৃষ্টি করতে তাঁর ছয়দিন লেগেছে। নভোমণ্ডল বলতে আল্লাহ্ কি বুঝাচ্ছেন তা পরিষ্কার নয়। তাফসিরবিদগণ নভোমণ্ডলকে সপ্ত-আকাশই মনে করেন। আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে যে এর কোন যোগাযোগ নেই তা বলার দরকার নেই। কোরানের অনেক আয়াতেই আকাশকে ছাদ বলা হয়—অর্থাৎ পৃথিবীর উপরে রয়েছে সাতটি ছাদ। যেমন এই আয়াত:
৪০:৬৪ আল্লাহ্ পৃথিবীকে করেছেন তোমাদের বাসস্থান, আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতি সুন্দর করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন পরিচ্ছন্ন রিযিক। তিনি আল্লাহ্, তোমাদের পালনকর্তা। বিশ্বজগতের পালনকর্তা, আল্লাহ্ বরকতময়। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
তাই ৭:৫৪ আয়াতে ছয়দিনের সৃষ্টি বলতে পৃথিবী এবং তার উপরের সাতটি ছাদের কথাই বলা হয়েছে।
আরও অনেকগুলো আয়াতে আল্লাহ্ ছয়দিনে পৃথিবী ও নভোমণ্ডল সৃষ্টির কথা বলেছেন। এই সব আয়াতগুলো হচ্ছে: ১০:৩, ১১:৭, ২৫:৫৯, ৫০:৩৮, ৫৭:৪।
এখানে লক্ষণীয় যে ৭:৫৪, ১০:৩, ১১:৭, ৫০:৩৮, ৫৭:৪ আয়াতগুলিতে আল্লাহ্ বলেছেন—প্রথমে নভোণ্ডল সৃষ্টি হয়েছে, তার পর ভূমণ্ডল বা পৃথিবী।
অর্থাৎ, নভোমণ্ডল (প্রথম) + ভূমণ্ডল (দ্বিতীয়) সৃষ্টির সময় = ৬ দিন।
আয়াত ২৫:৫৯-এ আল্লাহ্ বলছেন উনি প্রথমে নভোমণ্ডল, তারপর ভূমণ্ডল, তারপর এতদুভয়ের মধ্যে যাবতীয় যা আছে সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে।
অর্থাৎ নভোমণ্ডল (প্রথম) + ভূমণ্ডল (দ্বিতীয়) + এতদুভয়ের মধ্যে সব কিছ সৃষ্টির সময় (তৃতীয়) = ৬ দিন।
উপরের দুটি সমীকরণ থেকে আমরা বলতে পারি—মহাশূন্যে যা আছে, যেমন, ছায়াপথ, নীহারিকা, অন্যান্য গ্রহ, ধুমকেতু, কৃষ্ণ গহবর...ইত্যদি তৈরী করতে আল্লাহর সময় লেগেছে = ০ (শূন্য) দিন।
তাজ্জব হবারই ব্যাপার।
এবার দেখা যাক নিচের আয়াতগুলো:
৪১:৯ বলুন, তোমরা কি সে সত্তাকে অস্বীকার কর যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দু’দিনে এবং তোমরা কি তাঁর সমকক্ষ স্থির কর? তিনি তো সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা।
৪১:১০ তিনি পৃথিবীতে উপরিভাগে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন এবং চার দিনের মধ্যে তাতে তার খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন—পূর্ণ হল জিজ্ঞাসুদের জন্যে।
৪১:১১ অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্রকুঞ্জ, অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম।
৪১:১২ অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীকে দু’দিনে সপ্ত আকাশ করে দিলেন এবং প্রত্যেক আকাশে তার আদেশ প্রেরণ করলেন। আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুশোভিত ও সংরক্ষিত করেছি। এটা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ্র ব্যবস্থাপনা। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এইসব আয়াতগুলো থেকে সাধারণ জ্ঞানে আমরা যা বুঝি তা এই প্রকার:
প্রথমে আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন পৃথিবী বা ভূমণ্ডল—সময় লাগলো ২ দিন।
দ্বিতীয় আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন পৃথিবীর উপরিভাগে পর্বতমালা ও খাদ্যদ্রব্য—সময় লাগলো ৪ দিন।
তৃতীয় আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন নভোমণ্ডল—সময় লাগলো ২ দিন।
এখন এই সংখ্যাগুলো যোগ করা যাক, অর্থাৎ ২ + ৪ + ২ = ৮ দিন
এইসব দ্ব্যর্থক এবং বিসদৃশ আয়াতের বিব্রতকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কোরানের ব্যাখাকারীরা কতই না কসরত করে যাচ্ছেন। অনেকে বলেন: কোরানের ছয় দিন সৃষ্টির অনেক কাজই যুগপৎ চলেছে—অর্থাৎ যখন আল্লাহ্ পৃথিবী বা ভূমণ্ডল সৃষ্টি করছিলেন সেই সাথে নভমণ্ডল বা সপ্তাকাশ নির্মাণের কাজও চলছিল। তার অর্থ দাঁড়ায়—ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল সৃষ্টি করতে সর্বমোট সময় লেগেছে দুই দিন।
কিন্তু ৪১:৯-১২ পরিষ্কার বলা হচ্ছে পৃথক পৃথক সৃষ্টির কথা—পৃথিবী—তারপর পর্বতমালা ও খাদ্য দ্রব্য—তারপর আকাশমণ্ডলী।
আয়াত ২:২৯-এ আল্লাহ্ লিখেছেন:
২:২৯ তিনিই সে সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমীনে রয়েছে সে সমস্ত। অতঃপর তিনি মনোসংযোগ করেছেন আকাশের প্রতি। বস্তুতঃ তিনি তৈরী করেছেন সাত আসমান। আর আল্লাহ্ সববিষয়ে অবহিত। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন বাংলা (অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এখানে আল্লাহ তা’আলা এই সব সৃষ্টির সময় উল্লেখ করেননি।
অর্থাৎ আল্লাহ্ প্রথমে ভূমণ্ডল এবং এর সাথে জড়িত সব কিছু তৈরী করলেন। তারপর তৈরী করলেন সপ্ত-আকাশ—সময় = অনির্দিষ্ট।
অবশ্য, অনেকেই বলতে পারেন যে এই আয়াতে শুধু সৃষ্টি-সংবাদ বা তথ্যই দেয়া হয়েছে—কোন সময় দেওয়া হয় নাই।
আমরা এটাও অনুমান করে নিতে পারি আল্লাহ্ তাৎক্ষণিকভাবে এইসব তৈরী করেছেন। কারণ আল্লাহ কয়েক জায়গায় লিখেছেন যে উনি চাইলেই তা সাথে সাথে হয়ে যায়। যেমন:
১৯:৩৫ আল্লাহ্ এমন নন যে, সন্তান গ্রহণ করবেন, তিনি পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, তিনি যখন কোন কাজ করা সিদ্ধান্ত করেন, তখন একথাই বলেন: হও এবং তা হয়ে যায়। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
অর্থাৎ, আল্লাহ্ প্রথমে ভূমণ্ডল এবং এর সাথে জড়িত সব কিছু তৈরী করলেন। তারপর তৈরী করলেন সপ্ত-আকাশ—সময় = ০ দিন।
আল্লাহ্র এই খামখেয়ালিপনার ব্যাপারে ইব্নে কাসিরের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। যেমন ২:২৯ আয়াত সম্পর্কে ইব্নে কাসির লিখেছেন:
এ আয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে, যে মহান আল্লাহ্ প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর সাতটি আকাশ নির্মাণ করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অট্টালিকা নির্মাণের এটাই নিয়ম যে, প্রথমে নির্মাণ করা হয় নীচের অংশ এবং পরে উপরের অংশ। মুফাস্সিরগণ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা ইনশাআল্লাহ এখনি আসছে। কিন্তু এটা বুঝে নেয়া উচিত যে, আল্লাহ্ পাক অন্য স্থানে বলেছেনঃ “আচ্ছা! তোমাদেরকে সৃষ্টি করাই কি কঠিন কাজ, নাকি আসমান? আল্লাহ্ ওটা (এরূপে) নির্মাণ করেছেন যে, ওর ছাদ উঁচু করেছেন এবং ওকে সঠিকভাবে নির্মাণ করেছেন। আর ওর রাতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছেন ওর দিনকে প্রকাশ করেছেন এরপর জমীনকে বিছিয়ে দিয়েছেন। তা হতে পানি ও তৃণ বের করেছেন এবং পর্বত সমূহ স্থাপন করেছেন। (তিনি এসব কিছু করেছেন) তোমাদের ও তোমাদের পশুপালের উপকারের জন্যে।” [৭৯:২৭-৩৩]। এ আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে, তিনি আকাশের পরে জমীন সৃষ্টি করেছেন। [তাফসীর ইব্নে কাসির, খণ্ড ১, ২, ৩, পৃঃ ২১৪]।
ইব্নে কাসির আরও লিখেছেন:
কেউ কেউ বলেছেন যে, পরবর্তী আয়াতটিতে আসমানের সৃষ্টির পরে জমীন বিছিয়ে দেয়া ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে, সৃষ্টি করা নয়। তাহলে ঠিক আছে যে, প্রথমে জমীন সৃষ্টি করেছেন, পরে আসমান। অতঃপর জমীনকে ঠিকভাবে সাজিয়েছেন। এতে আয়াত দু’টি পরস্পর বিরোধী আর থাকলো না। এ দোষ হতে মহান আল্লাহ্র কালাম সম্পূর্ণ মুক্ত। [তাফসীর ইব্নে কাসির, খণ্ড ১, ২, ৩, পৃঃ ২১৪]।
বুঝা যাচ্ছে ইব্নে কাসিরের সময়ও আল্লাহ্র বিভ্রান্তিমূলক আয়াত নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে এবং ইসলামি পণ্ডিতগণ ইসলামকে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে অর্থহীন যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন।
দেখা যাক আল্লাহ্ কি লিখেছেন ২:১১৭-এ:
২:১১৭ তিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন কোন কার্য সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’, তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
অর্থাৎ, প্রথমে নভোমণ্ডল, তারপর পৃথিবী বা ভূমণ্ডলের সবকিছু—সময় = ০ (শূন্য) দিন।
ইব্নে কাসির লিখেছেন:
সেই আল্লাহ্র ক্ষমতা ও প্রভাব ও প্রতিপত্তি এতো বেশী যে, তিনি যে জিনিসকে যে প্রকারের সৃষ্টি ও নির্মাণ করতে চান তাকে বলেন—‘এভাবে হও এবং এরকম হও’ আর তেমনই সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেন:
অর্থাৎ ‘যখন তিনি কোন জিনিসের (সৃষ্টি করার) ইচ্ছে করেন, তখন তাঁর রীতি এই যে, ঐ বস্তুকে বলেন—‘হও’ আর তেমনই হয়ে যায়।’ (৩৬:৮২)
অন্য জায়গায় বলেনঃ
অর্থাৎ “যখন আমি কোন বস্তু (সৃষ্টির) ইচ্ছে করি তখন আমার কথা এই যে, আমি তাকে বলি—‘হও’ আর তেমনই হয়ে যায়।” (১৬:৪০)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছেঃ
অর্থাৎ “চোখের উঁকি দেয়ার মত আমার একটি আদেশ মাত্র।” (৫৪:৫০) [তাফসীর ইব্নে কাসির, খণ্ড ১, ২, ৩, পৃঃ ৩৭৯]।
আল্লাহর সৃষ্টি-বিভ্রান্তি নিয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘আবদুল্লাহ্ ইবন্ ‘আমর ইবনুল ‘আস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ্পাক আকাশমণ্ডলী ও ভূখণ্ড সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে তাক্দীরসমূহ নির্ধারণ করে রেখেছেন। (মুসলিম, তাবারাণী ও তিরমিযী, তিনি হাদীসটি হাসান ও সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন।) [মুসনাদে আহমদ: প্রথম খণ্ড: তকদির অধ্যায়, পৃঃ ১০৩, হাদীস ১]
পঞ্চাশ হাজার বছর কে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করলে আমরা পাই ১৮ ২৫০ ০০০ (১৮.২৫ মিলিয়ন) বা প্রায় ১.৮ কোটি দিন।
আর এদিকে কোরানে দেখা যাচ্ছে ভূ-মণ্ডল ও নভোমণ্ডল তৈরী করতে আল্লাহ্র লেগেছে মাত্র ছয় অথবা আট দিন।
আধুনিক কালে পশ্চিমা দেশে অবস্থানরত কিছু ইসলামি পণ্ডিত ব্যাপারটা টের পেয়ে বলতে শুরু করেছেন, যে আল্লাহ্র সৃষ্টি নিয়ে যে সব দিন উল্লেখ তা আসলে দিন (অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার দিন) নয়। এগুলো হচ্ছে পর্ব—অর্থাৎ ছয় অথবা আট পর্ব।
তাজ্জবেরই কথা—যেখানে প্রায় সমস্ত প্রখ্যাত অনুবাদক এবং তাফসিরবিদ্গণ এই সময়কে দিনই বলেছেন সেখানে নাম না জানা কিছু ইসলামি পণ্ডিত কোরানের বিরুদ্ধেই লিখে চলেছেন!
আয়াত ১০:৩ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত তফসিরবিদ জালালাইন লিখেছেন যে এই সময় নির্ণয় করা হয়েছে সেইভাবে যেভাবে পৃথিবীর সময় নির্ণয় করা হয়, যেহেতু তখন কোন সূর্য বা চন্দ্র ছিল না। [তাফসির জালালাইন ইংরাজি, আয়াত ১০:৩, অনুবাদ লেখকের]
এর অর্থ হচ্ছে সৃষ্টির ছয় দিন হচ্ছে, ৬ গুণ ২৪ = ১৪৪ ঘণ্টা।
আট দিন হচ্ছে ৮ গুণ ২৪ = ১৯২ ঘণ্টা।
কিসের প্রয়োজন ছিল এতদিন অপেক্ষা করে (১.৮ কোটি দিন) বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করার যখন আল্লাহ্ এক নিমেষেই সবার তকদীর নির্ধারিত করে দিতে পারেন সৃষ্টির সাথে সাথে?
ইসলামী পাটিগণিত-৩
ইসলামি বর্ষপঞ্জী বা ক্যালেণ্ডারঃ-
প্রতি বৎসর ইসলামি বিশ্বে এক দারুণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যখন দেখা যায় যে বিভিন্ন দেশে ঈদ পালিত হচ্ছে বিভিন্ন দিনে। যেদিন সৌদি আরবে ঈদ পালিত হয় হয়তো তার এক বা দুই দিন পরে বাংলাদেশে ঈদ পালিত হয়। অনেক সময় এই সময়ের তারতম্য দুইদিনেরও বেশী হতে পারে। রমজান বা রোজা রাখা নিয়েও এই পরিস্থিতি। আমার জানা মতে বর্ষপঞ্জী নিয়ে ইসলাম ছাড়া এই ধরণের বিদঘুটে পরিস্থিতি অন্য কোন ধর্ম বা সমাজব্যবস্থায় নেই। এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির কোন সমাধান আজ পর্যন্ত ইসলামি বিশ্ব করে নাই বা করতে রাজী নয়। তার কারণ কি? আল্লাহ পাক কি এই ধরণের বিভ্রান্তি চান?
আমরা দেখব কেন এই সমস্যা কেয়ামত অবধি বিদ্যমান থাকবে। ইসলামি পাটিগণিত যে কেমন অনির্ভরযোগ্য তা এই ইসলামি বর্ষপঞ্জীর হাল থেকেই বুঝা যাবে।
ইসলামি বর্ষপঞ্জী শুরু হয় খৃঃ ৬২২ সালে (উইকিপিডিয়া)। এই বর্ষপঞ্জী শুরু হয় নবী মুহাম্মদের মদিনায় হিজরির দিন থেকে। এই দিন, যথা ১৭-ই জুলাই ৬২২ থেকে এই হিজরি বর্ষপঞ্জী শুরু। অর্থাৎ, ১৭-ই জুলাই ৬২২ হচ্ছে ইসলামি হিজরি পহেলা (১) মুহররম হিজরি ১ সন। হিজরি বর্ষপঞ্জীতে বারোটি মাস নির্ধারিত হয়েছে: যথা—মুহররম, সফর, রবিউল-আওয়াল, রবিউল-আখির, জামাদউল-আওয়াল, জামাদিউল-আখির, রজব, শাবান, রমজান, জ্বেল-ক্বদ, জ্বেল-হজ্ব।
ইসলামের আগমনের অনেক আগে থেকেই আরব বেদুইনরা ঠিক করেছিল যে তারা সারা বছর রক্তপাত করবে না। তাই তারা বৎসরের চারটি মাসকে ‘নিষিদ্ধ’ বা পবিত্র মাস হিসেবে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। এই চারটি মাস হচ্ছে—জ্বেল-ক্বদ, জ্বেল-হজ্ব, মুহররম এবং রজব। মুহাম্মদের আগমনের পূর্বে কোন আরব গোষ্ঠী কখনই এই নিয়ম ভঙ্গ করে নাই, যতই শত্রুতা থাকুক না কেন বিভিন্ন গোত্রের মাঝে। যতটুকু জানা যায় একমাত্র নবী মুহাম্মদই একতরফা ভাবে অনেক সময় এই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন—এই সব নিষিদ্ধ মাসগুলিতে যুদ্ধ চালিয়েছেন এবং রক্তপাত ঘটিয়েছেন।
আল্লাহ পাক নিজেই পৌত্তলিক আরবদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই সব সম্মানের মাসগুলিকে সম্মানের মাস হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন।
৯:৩৬ নিশ্চয় আল্লাহ্র বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সূপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ্ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন।
কিন্তু আল্লাহ্ পাক কোরানের কোথায়ও পরিষ্কারভাবে জানান নাই এই সম্মানিত মাসগুলি কোন কোন মাস।
এখন আমরা দেখব কী বিচিত্র এই ইসলামি বর্ষপঞ্জী।
ইসলামি বর্ষপঞ্জী চন্দ্র বৎসরের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ব্যবস্থা ইসলামের আগমনের অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ইসলামি বর্ষপঞ্জীতে আছে ৩৫৪ অথবা ৩৫৫ দিন। এই তারতম্যের কারণ হচ্ছে—গ্রেগরিয়ান (বর্তমান ইংরাজি) বর্ষপঞ্জীর মতো ইসলামি বর্ষপঞ্জীতেও লিপ-ইয়ারের ব্যাবস্থা আছে। এই ইসলামি লিপ ইয়ার হয় প্রতি সাত বছরে এক বার।
আল্লাহ্ তা’আলা কোরানে বলেছেন ইসলামি বর্ষপঞ্জী গণনা চন্দ্রের উপর নির্ভর করে।
১০:৫ তিনিই সে মহান সত্তা, যিনি বানিয়েছেন সুর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনযিলসমূহ, যাতে করে তোমরা পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ্ এই সমস্ত কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি, কিন্তু যথার্থতার সাথে। তিনি প্রকাশ করেন লক্ষণসমূহ সে সমস্ত লোকের জন্য যাদের জ্ঞান আছে।
মনে রাখতে হবে চন্দ্রের আবর্তন চক্র (সাইকেল) হচ্ছে ২৮দিন। সেই মতে এক বৎসরে ইসলামি দিনের সংখ্যা হওয়া উচিত ১২ গুন ২৮ = ৩৩৬ দিন।
এখন ৩৫৪ কে ১২ দিয়ে ভাগ করলে আমরা পাই ২৯.৫ দিন।
৩৫৫ কে ১২ দিয়ে ভাগ করলে আমরা পাই ২৯.৫৮ দিন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ইসলামি বর্ষপঞ্জী কোনভাবেই চন্দ্রের আবর্তন-চক্র পালন করছে না।
সেই জন্য কোন কোন ইসলামি মাস ধরা হয় ২৯ দিন আর কোন কোন ইসলামি মাস ধরা হয় ৩০ দিন—অনেকটা ইংরাজি বর্ষপঞ্জীর পদ্ধতিতে।
তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?
লক্ষ্য করুন যে ইংরাজি মাসগুলোতে কত দিন হবে তা অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত হয়েছে: যেমন, জানুয়ারি-৩১ দিন, ফেব্রুয়ারি ২৮ দিন (লিপ-ইয়ার ছাড়া), মার্চ ৩১ দিন, এপ্রিল ৩০ দিন...ইত্যাদি। এই পদ্ধতি বিশ্বের সর্বত্র একই ভাবে পালন করা হয়। তাই যে সব আচার অনুষ্ঠান ইংরাজি বর্ষপঞ্জীর উপর প্রতিষ্ঠিত সেগুলি প্রতি বছর ঐ একই দিনে পালিত হয়, কোন ব্যতিক্রম হয় না। তাই ইংরাজি বর্ষপঞ্জী নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু ইসলামি গণনা পদ্ধতি এমন নয়। ইসলামি মাসের গণনা শুরু হয় চাঁদ দেখা গেল বা দেখা গেল না এর উপর। ইসলামি দিন গণনা শুরু হয় সন্ধ্যায়, চাঁদ দেখার পর। যদি মাসের ২৯ দিনে সন্ধ্যায় নতুন চাঁদ দেখা যায় তবে ঐ মাস হবে ২৯ দিন, আর যদি না দেখা যায় তবে ঐ মাসটি হবে ৩০ দিন। এই জন্যই কোন কোন বছর ২৯টি রোজা হয় আর কোন কোন বছর রোজা হয় ৩০ টি আবার কোন কোন বছর ২৮ দিনও। এমনও হয় যে কোন বছর দুইবার রমজানের শুরু হয় এবং ঈদও হয় দুইবার। আমাদের জীবদ্দশাতেই হয়তো অনেকেই তা পর্যবেক্ষণ করেছি। লক্ষ্য করবেন যে এক সময় রমজান পালিত হচ্ছে হাড় কাঁপানো শীতকালে আবার এক সময় রমজান পালিত হচ্ছে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমের সময়। আর যখন এক ইসলামি দেশে ঈদ বা রমজান শুরু হয় অন্য আর এক (এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশেও) দেশে তা হয় না।
ইসলামি বর্ষপঞ্জীর আরও অনেক দ্ব্যর্থকতা বা অস্পষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায় এই কয়েকটি আয়াতে:
২৯:১৪ আমি নূহ (আঃ)—কে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছিলাম। তিনি তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর অবস্থান করেছিলেন। অতঃপর তাদেরকে মহাপ্লাবন গ্রাস করেছিল। তারা ছিল পাপী।
১৮:২৫ তাদের উপর তাদের গুহায় তিনশ’ বছর অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে।
তাজ্জবের ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহ্ পাক সরাসরি নির্ভুলভাবে বলতে পারেন না কত সময় লেগেছিল—তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এই অদ্ভুত ভাষা ব্যবহার করেছেন। এখন চিন্তা করুন চিকিৎসা ক্ষেত্রে অথবা গাড়ী বা বাড়ী কিনবার সময় যদি এই ধরণের ভাষা ব্যবহার করা হয় তবে তার পরিণতি কি হতে পারে।
এইসব বিভ্রান্তিমূলক গণনা কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত তা আল্লাহ্ তা’আলা জানান নাই। এই বিড়ম্বনা এড়াতে আজকাল অনেক ইসলামি পণ্ডিত বলেন—বৎসরগুলি চন্দ্র এবং সৌর গণনার উপর। কি বিচিত্র যুক্তি! কিন্তু রূপান্তরিত গণনা করলেও আমরা এই দুই সংখ্যা এক পাব না। এখানে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আয়াত ২৯:১৪ দেখুন:
আমরা আগেই দেখেছি এক সৌর বছরে আছে ৩৬৫ দিন আর এক চন্দ্র বছরে আছে ৩৫৪ দিন (লিপ ইয়ার বাদে)। মনে রাখতে হবে এক দিনের সময় মাপ একই হতে হবে অর্থাৎ এক দিন = ২৪ ঘণ্টা তা সৌর বছরই হউক বা চন্দ্র বছরই হউক।
এখন গণনা করা যাক:
চন্দ্র বছরে ১০০০ বছর গুণ ৩৫৪ = ৩৫৪ ০০০ দিন
সৌর বছরে ৯৫০ বছর গুণ ৩৬৫ = ৩৪৬ ৭৫০ দিন
এই দুই হিসাবের তারতম্য হচ্ছে ৩৫৪ ০০০ বিয়োগ ৩৪৬ ৭৫০ = ৭ ২৫০ দিন
এই তফাতকে সৌর বছরে রূপান্তরিত করা যাক—৭ ২৫০ ভাগ ৩৬৫ = ১৯.৯ বছর বা ১৯ বছর ৩২৯ দিন।
তাহলে ইসলামি পণ্ডিতদের যুক্তির সার্থকতা কোথায়?
এখন আয়াত ১৮:২৫ যে সময়ের কথা আল্লাহ্ পাক বলেছেন তার গণনা করুন উপরের উদাহরণের মত। দেখুন কি ফলাফল।