Saturday, September 12, 2015

বিদ্রোহ চলবে----

কিছুদিন আগে একটা খবরের কাগজের আন্তর্জাতিক খবরের পাতায় একটা বিরক্তিকর হেডলাইন দেখতে পেলামঃ নারীর একক স্বাধীন জীবন আজও ব্রাত্য ইরানে”। ভাবলাম এ আর নতুন কি! খবরের কাগজ ভর্তি করার জন্য এই এক চর্বিত চর্বণ! কিন্তু অন্য সব খবর পড়ার পর ভাবলাম পড়েই দেখি, হাতে অনেকটা সময় আছে। কিন্তু যত পড়তে লাগলাম, মনে বিরক্তির বদলে আনন্দ ফুটে উঠলো। খানিকটা অংশ তুলে দিচ্ছি আপনাদের---

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর স্বাধীনতা আজও ধৃষ্টতা ইরানে... (বর্ণনা)...এই সুতো ছিঁড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক কঠিন সংগ্রাম চালাচ্ছেন একবিংশ শতকের স্বাধীন চেতা নারীরা। কিভাবে? একটা ছোট্ট ঘটনা দেখে নেওয়া যাক—শওকফ নামক একটি মেয়ে, বয়স ২৪। অবিবাহিতা।সর্বদা একটি বিবাহের চিহ্ন সাদা সোনার আংটি পরে থাকেন। এটি তিনি করেছেন শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার জন্য। শুধু তাই নয়, বিবাহিত না হলে কোনও মহিলা সেখানে হোস্টেল বা বাড়িভাড়া পান না। তাই এই ছদ্ম পরিচয়।” এটি কোনও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত নয়। “...শওকফের মতো কত মেয়ে আজ ইরানের শহরে বাসা বেঁধেছে তার সরকারী পরিসংখ্যান না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় মেয়েদের ক্রমবর্ধমান অন্তর্ভুক্তি এর কিঞ্চিৎ আভাস দেয়... ঐতিহ্যবাহী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন জীবনের প্রতি তরুণীদের আকর্ষণে উদ্বিগ্ন মৌলবি থেকে রাজনৈতিক নেতারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।”

এরপর বর্ণনা করা হয়েছে ইরান সহ মধ্যপ্রাচ্যে কিভাবে পণপ্রথা থাবা বসাচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্কে। (যারা মনে করেন যে ইসলামে পণপ্রথা নেই, তাদের একবার আর্টিক্যাল টা পরে নেওয়া উচিত।)

“...ভাড়াবাড়ি হারানোর ভয়ে শওকফ তার আসল নাম জানান নি। কিন্তু তার পরিবারের অকুণ্ঠ সমর্থনেই নিজের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন বলে জানান তিনি... এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাবা- মায়ের সমর্থনই শক্তি যোগায় তাকে।”

এরপর জানান হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য --

“...সাম্প্রতিক অতীতেও বিবাহ-বিচ্ছিন্না একা নারী ছিল সমাজের কলঙ্কের ভাগী। বিবাহের পর বাপের বাড়িতে ছোটবেলার ঘরে বন্দী হত তাদের বাকী জীবন... এখন টিভি সংবাদ মাধ্যম কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা ইরানী মহিলাদের স্বাধীন জীবনের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। অবিবাহিত মহিলাদের স্বাধীনতাকে ইরান গ্রহণ না করলেও ৬০% মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার হতে পেরেছেন।”

এইসব খবর দিনদিন মনটাকে আরও আশাবাদী করে তোলে। ইতিহাস নিয়ে একটু আধটু পড়াশুনা করি ঠিক, তবু লিখতে ইচ্ছে হয় না তেমন। কিন্তু আজ ভাবলাম ইসলামের তৈরি চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় থেকেও নারীর অবিরত সংগ্রাম নিয়ে না লিখলে তাদের যেমন অসম্মান করা হয়। তাই আজ সংক্ষিপ্ত আকারে বিষয়টা দেখানোর চেষ্টা করছি—

ভেবে দেখুন সেই সময়ের আরবের কথা, যখন আরবরা সরল কিন্তু বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী ছিল। যেখানে নির্মল প্রেম, কবিতা এবং লোকসঙ্গীতের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। পুরো সমাজটাই অসাধারণ রকমের ভাল ছিল, এমন বলছি না কিন্তু অনেক ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত আরব সমাজের দুই একটা গোষ্ঠীতে কিছু নিষ্ঠুর প্রথার প্রচলন ছিল ঠিকই কিন্তু তাই বলে ওই বিশাল অঞ্চলের সমাজকে দোষারোপ করা যায় না। যাই হোক সেই ভাল মন্দে মেশা একটা স্বচ্ছ মানবসমাজের উপর প্রলয় হয়ে নেমে এলো ইসলামের মতো চরম রক্ষণশীল একটি ধর্ম, যেখানে প্রেম, কবিতা, গান, শিল্পকলা অব নিষিদ্ধ হল। নারীরা অবরুদ্ধ হল গৃহে। অতীতের ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হল সমস্ত নিদর্শন নষ্ট করে। উপর্যুপরি জেহাদের ফলে অসংখ্য প্রাণহানি আর হাহাকার হয়ে উঠলো মানুষের নিত্যসঙ্গী। ঠিক তখনই নারী সঙ্গীতকে প্রেমের সাথে মিশিয়ে দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল অন্য একপ্রকার বিদ্রোহ, যে বিদ্রোহে ধ্বংস ছিল না, ছিল নতুন সৃষ্টির নেশা।

হজরত আলীর নাতনী সুকায়না বা সুকন্যা ছিলেন এমনই একজন স্বাধীনতাকামী নারী। তিনি না বোরখা পরতেন, না দিতেন হিজাব। এমনকি পতি-দেবতাকেও অমান্য করে তিনি প্রণয় সঙ্গীতের মজলিশ বসাতেন রাতভর। সেখানে গান, কবিতা সুরাপান চলত অবিরাম। তারা মানবিক অনুভূতি, বিশেষত নারীর চাওয়া পাওয়ার দাবীগুলো নিয়ে গান বাঁধতেন, ছড়িয়ে দিতেন সারা আরবের প্রতিটি বালুকণায়। যৌনতাকেও তারা শিল্পের সু-উচ্চ মার্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

নতুন ধর্ম ইসলাম শঙ্কিত হল। বলল, কবিতা আর গান নারীকে ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এথেকে তাদের দূরে রাখা হোক। কিন্তু সংগীত কে কি বাঁধা যায়? আরবের প্রতিটি কোন থেকে শোনা যেতে লাগলো সঙ্গীত। এরপর পারস্য থেকে অনুষঙ্গ হিসাবে এলো বাদ্যযন্ত্র ( যা পরবর্তীকালে গীটার এর রূপ নেয়)। প্রেম এবং যৌনতার মহান বন্ধনকে যখন নারী শিল্পের রূপ দিতে চলেছে, তখন আরেক অভিযোগ নিয়ে এলো ধার্মিকতা—এসব নাকি কামোদ্দীপক, ফল স্বরূপ ইসলামী ধার্মিকতা চাইলো চিরকালের জন্য স্তব্ধ করে দিতে এই সঙ্গীতময়তাকে। যৌনতায় মনের যে প্রাধান্য তারা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই ধার্মিকরা নির্দেশ দিলেন, নারী তোমাদের শস্যক্ষেত্র, তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাতে গমন করতে পারো” নরনারীর সম্পর্কের এই কদর্য বর্ণনা এর আগে বা পরে বিশ্ব আর কখনো দেখেনি। ফলস্বরূপ কবি এবং সঙ্গীতজ্ঞরা (বিশেষত নারী) পড়লেন রোষের মুখে। হত্যা করা হল অনেককে। অবশ্য এর আগে যে কবি সঙ্গীতজ্ঞ নারীরা সুখে ছিলেন, এমন নয়। এর আগেও আল্লাহ্‌র নির্দেশে দুগ্ধপানরত শিশুকে মায়ের বুক থেকে সরিয়ে ফেলে দিয়ে মায়ের বুকে বেঁধা হয়েছিল বিষাক্ত খঞ্জর। অপরাধ ছিল নতুন ধর্মকে নিয়ে ব্যঙ্গ কবিতা রচনা। এই অসমসাহসী নারীর বুকের দুধ না রক্ত, কোনটা ফেলনা? এত এত নারীর অভিশাপ তো পাওনা ছিল ইসলামের।

প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লো আরবের প্রতিটি প্রান্তে। ভাঙ্গন ধরল ইসলামে। জন্ম হল বিদ্রোহী মুতাযিলাদের। জন্ম হল অনেক পুরুষ কবি এবং গায়কের, যারা ইসলাম নয়, প্রেমকে মুক্তির মূলমন্ত্র বলল। এরা শুধু ইসলামের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেই চলত না, ইসলামকে প্রতিনিয়ত ছিন্ন ভিন্ন করতো প্রশ্নের আঘাতে। সংগীত  এবং কবিতাকে তারা আরও ছড়িয়ে দিল।পারসিক কবি বাশার বৃদ্ধ বয়সেও প্রতিবাদ করে উঠলেন। ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গীতে বললেন, “ এতদিন ‘সত্য’ ভাষণ করতে গিয়ে আমি অনেক মিথ্যাচার করেছি, নিজের সঙ্গে ছলনা করেছি”। শেষমেশ তিনি ইসলাম এবং খলিফাকে অস্বীকার করলেন। পরিণতি হল মৃত্যুদণ্ড। হত্যা করা হল তাঁকে। আস্তে আস্তে মুতাযিলাদেরও শেষ করে দেওয়া হল। বলা হল প্রশ্ন করাও নিষিদ্ধ ইসলামে। গ্রন্থসমুহ নষ্ট করে দেওয়া হল তাদের, নারীকেও বাধ্য করা হল পর্দানশীন হতে। দর্শন ও সাহিত্য ধ্বংস হয়ে গেল কিন্তু আঁচড় পড়লো না সঙ্গীত ও কবিতায়। থামান গেলনা এদের। একের পর এক জন্ম নিলেন ইবনে দাউদ, ইবনে হাজম এর মত দার্শনিকরা। বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ ইবনে আরাবী (১১৬৫-১২৪০) লিখলেনঃ

“My Heart is open to all the winds
It is a pasture for gazelles
And a home for christion monks
A temple for idols
The Black Stone for meccan pilgrim
The table of the Torah
And the book of the Koran
Mine is the religion of love
Wherever God’s caravans turn
The religion of love
Shall be my religion and my faith.”
ইসলামের কঠোর রক্ষণশীলতার দিনেও এই দর্শন তখন মানুষের মন জয় করে ফেলেছে। এই দর্শনকে তারা প্রকাশ করতে শুরু করেছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। একদিন এই মুক্তচিন্তার কবিতা, মানবিক অনুভূতির কবিতা পারস্যের হাত ধরে পৌঁছে গেল পাশ্চাত্যে। ইউরোপকে করে তুলল সংগীতময়।
(চলবে)

বি: দ্র: লেখাটি যেহেতু আমার মৌলিক লেখা নয়, তাই লেখার শেষে তথ্যসূত্র দেওয়া হবে।