আমাদের দেশে যত গুলো শিক্ষা
ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তার মধ্যে সব থেকে অশ্লীল ব্যবস্থাটি হল 'মাদ্রাসা'
শিক্ষা পদ্ধতি।কেন অশ্লীল বলছি?প্রচলিত অর্থে অশ্লীল বলতে আমরা বুঝে থাকি
নগ্নতা কে।কিন্তু নগ্নতাই অশ্লীলতা নয়।যাই মানব জীবনের প্রগতির পথে,উন্নতির
পথে বাধা দেয়;যা আমাদের সুস্থ মানসিকতা কে আক্রান্ত করে সেটাই অশ্লীল।এবং
সেই বিবেচনায় মাদ্রাসা ব্যবস্থা একটি অশ্লীল শিক্ষা ব্যবস্থা।শুধু অশ্লীলই
নয়,অপ্রয়োজনীয় এবং এটাই একমাত্র শিক্ষা পদ্ধতি যা থেকে আমরা কিছু আশা করতে
পারিনা,যা থেকে দেশ লাভবান হচ্ছেনা।কেবল বলার জন্য বলা নয়,আসুন একটু খতিয়ে
দেখা যাক কেমন আছে আমাদের মাদ্রাসার শিশুরা,কেমন চলছে সেখানে পড়াশুনা,তারা
কি শিখছে,তাদের ভবিষ্যৎ কি দাড়াচ্ছে?
মাদ্রাসা ( আরবি ভাষায়: مدرسة, madrasa বহুবচনে مدارس, madāris) আরবি শব্দ দারসুন থেকে উদ্ভূত, এর অর্থ পাঠ। মাদ্রাসা মূলত মুসলমানদের অধ্যয়ন-অধ্যাপনা গবেষণা ইত্যাদির স্থান বা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।অর্থাৎ শব্দগত ভাবে মাদ্রাসা হওয়া উচিত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র।কিন্তু মাদ্রাসা শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে এমন একটি অন্ধকার বদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কথা,যেখানে শুধু মাত্র কোরআন-হাদিস শিক্ষা দেয়া হয়।এখানে মসজিদের মক্তব বা অনাবাসিক মাদ্রাসার কথা বলছিনা,মূল আলোচনা করছি আবাসিক মাদ্রাসা নিয়ে।আচ্ছা একটি প্রশ্নের জবাব দিন- 'কোন বাবা মা তার সন্তান কে কেন মাদ্রাসায় দেন?'
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারণ গুলো খুবই সাধারণ।মূল কারণ হল-দারিদ্র্য।মাদ্রাসায় স্বল্প খরচে বা বিনা খরচে থাকা খাওয়া হয়ে যাচ্ছে।মূল ধারার পড়াশুনার থেকে যা অনেক সাশ্রয়ী।দ্বিতীয়ত,ডানপিটে দুষ্ট ছেলেটিকে 'শায়েস্তা' করার জন্য মাদ্রাসায় দেয়া হয়।তৃতীয়ত,মাদ্রাসায় সন্তানটি যদি হাফেজ হয়ে বের হয় তাহলে সেই সন্তানের আলখাল্লার কোনা ধরে বেহেশতে গমন নিশ্চিত!মানে স্বল্প খরচে বেহেশতের টিকিট নিশ্চিত করা হল-যা পৃথিবীতে শান্তিতে থাকার চেয়ে একটি দরিদ্র মানুষের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।কারণ সে তার দারিদ্র্য কে মনে করে 'আল্লাহর ইচ্ছা' এবং এই আশায় বসে থাকে এই কালে তার অবস্থার পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়,পরকালই তার একমাত্র আশা।সেই পথ টাকে আরও পরিষ্কার করার জন্য সন্তান কে মাদ্রাসায় অমানবিক জীবনে পাঠাতে গরিব মানুষটি কুন্ঠা বোধ করেনা।
বেশ কয়েকবার আমার মাদ্রাসার শিশুদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।সেই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিলনা।মাদ্রাসা গুলো জেল খানার সাথেই তুলনীয়।সেখানে বাচ্চাদের বাইরের 'আউট বই' পড়া নিষিদ্ধ।একবার একটি বাচ্চার কাছে সুকুমার রায়ের একটি বই পাওয়া গিয়েছিল বলে তাকে বেত্রাঘাত করা হয়েছিল।অবশ্য বেতের বাড়ি মাদ্রাসায় খুবই সাধারণ ঘটনা।মাদ্রাসার বাচ্চা দের সাথে কথা বলাটা অবশ্য সহজ ব্যাপার ছিলনা,আমি যেকবারই বিভিন্ন মাদ্রাসায় গিয়ে কাজ করেছি সাথে সার্বক্ষনিক একজন হুজুর ছিল।সেই হুজুর আমাদের যেখানে নিয়ে যেত শুধু সেই ঘর গুলোই দেখার সুযোগ পেতাম আমরা।আমার অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি অবজারভেশন-
১.মাদ্রাসায় উপরের ক্লাসের একটি ছাত্র ইংরেজিতে পুরো একটি বাক্য বলতে পারেনা।'আমার নাম অমুক' এই সাধারণ বাক্যটিও অনেকে ইংরেজি তে বলতে পারেনা।
২.তাদের অধিকাংশের কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই।যখন তাদের জিজ্ঞেস করেছি- "বড় হয়ে কি হবে?" তখন তারা শূণ্য দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল।বড় হয়ে যে কিছু হওয়া যায় এটাই তাদের ধারণার বাইরে।
৩.বাইরের জগৎ সম্পর্কে,জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল রহস্যময় জগৎ সম্পর্কে তাদের কোন ধারনা নেই।শিক্ষক দের তত্ত্বাবধায়নে তারা শিক্ষকদের সিলেক্ট করা কিছু পত্রিকা পড়ে।
ইবনে সিনা মাদ্রাসা কে এমন একটি বিশেষ যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন যে সেক্ষেত্রে ছাত্রদের কর্তব্য হল,কোন সামাজিক মর্যাদার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে প্রায়োগিক যোগ্যতা অর্জন করা।তিনি লিখেছেন যে চৌদ্দ-ঊর্ধ ছেলেমেয়েদেরকে তাদের নিজ ইচ্ছামত কোন বিষয় বেছে নিয়ে সেবিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে দেয়া উচিৎ যাতে সে আগ্রহবোধ করে, তা হতে পারে ব্যবহারিক দক্ষতা, সাহিত্য, দ্বীনের দাওয়াত, জ্যামিতি, ব্যবসা-বানিজ্য, কারূকর্ম অথবা অন্য যেকোন এমন বিষয় বা বৃত্তি যা অনুযায়ী সে ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে তুলতে চায়।বলাই বাহুল্য ইবনে সিনা তাঁর সময়কার মোল্লা দের দ্বারা মুরতাদ অভিধা পেয়েছিলেন,যদিও বর্তমানের ভন্ড মুসলমানেরা তাকে নিয়ে মুসলিম মনীষী হিসেবে গর্ব করে!
মাদ্রাসায় শারীরিক শাস্তি প্রদান কে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা কিনা আমাদের দেশের আইনে দন্ডনীয় অপরাধ।সেখানে শিক্ষক দের হাতে চক ডাস্টারের থেকেও সাধারণ বস্তুটি হল বেত।এখন দেখা যাক মাদ্রাসা শিক্ষার উপযোগীতা কি কি?মাদ্রাসা গুলো আমাদের কি দিচ্ছে?সমাজ-দেশ তাদের থেকে কিভাবে উপকৃত হচ্ছে?
প্রথমত,মাদ্রাসার ছাত্ররা দেশের প্রচলিত স্রোতের সাথে মিশে যেতে পারছেনা।মাদ্রাসা থেকে পাশ করে একটি ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষায় অংশ নিতে পারে।কিন্তু সেখানে তার দৌড় কতটুকু সেটা সহজেই অনুমেয়।এরা দেশের জন্য বোঝা হিসেবে তৈরি হয়।এরা যখন দেখে তাদের বয়সি ছেলে মেয়েরা ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে,ভবিষ্যত নিয়ে রঙ্গিন স্বপ্ন দেখছে,নাটক করছে,গান গাচ্ছে,একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরিতে যাচ্ছে- তখন এদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয় আমরা কি তার খোজ রেখেছি?আমরা না রাখলেও একটি অংশ কিন্তু ঠিকই রেখেছে এবং সেই অংশ টি এই হতাশা কে উগ্রতায় রূপান্তরিত করে দিতে পারছে সহজেই।যে অল্প বয়সি তরুন জঙ্গি হয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে বুকে বোমা বেধে ঝাপিয়ে পড়ছে সে তো মংগল গ্রহ থেকে উদয় হয়নি,আমার আপনার আশপাশ থেকেই এসেছে।এবং শতকরা ৯৯ ভাগই এসেছে ঐ মাদ্রাসা থেকে।মাদ্রাসা গুলো হচ্ছে জঙ্গি তৈরির কারখানা,এটা আর এখন কোন মনগড়া দাবি নয়,প্রমাণীত সত্য।রাজনৈতিক দল গুলো যখন তখন ধর্মের নাম নিয়ে উস্কে দিচ্ছে এই উগ্রতা কে।৫ মে হেফাজতের সমাবেশে যে লাখ লাখ শিশু কিশোর আসলো তারা তো আমাদেরই সন্তান!আমরা কি কখনও তাদের কথা ভেবে দেখেছি?
আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার কথা না হয় নাই বললাম।একটি স্বনামধন্য মাদ্রাসায় আমরা আমাদের নারীকর্মি দের পাঠাতে পেরেছিলাম।তাদের কাছেই মেয়েরা নিজেদের বন্দি জীবনের দুঃখের কথা বর্ণনা করেছে।আমাদের এক কর্মী একটি মেয়ের গান গাওয়া রেকর্ড করে এনেছিল নিজের মুঠোফোনে।সেই গান শুনে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল।এই মেয়েটি কোনদিনই কি তার এই যাদুকরি কন্ঠ কাজে লাগাতে পারবে?
আমাদের দেশে মাদ্রাসা ব্যবস্থারও দুটি ধারা চালু আছে।একটি আলিয়া,যা সরকারের নিয়ন্ত্রনে।অন্যটি কাওমি,যার উপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রন নেই।এই কাওমি মাদ্রাসা গুলোর অবস্থা মধ্যযুগীয়।সরকারের নিয়ন্ত্রন নেই বলে তারা ইচ্ছা মত তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে বললেই সেটা করা সম্ভব নয় এই মুহুর্তে।তবে কিছু কাজ আমরা করতে পারি,করা উচিত-
১.কাওমি মাদ্রাসা গুলোতে সরকারি নজর দারি জারি করতে হবে।
২.ধর্মীয় বিষয় গুলো ছাড়া অন্য বিষয় গুলো বাইরের শিক্ষক দ্বারা পড়াতে হবে।অর্থাৎ ইংরেজি পড়াবেন ইংরেজিতে ডিগ্রী পাওয়া কেউ,গণিত পড়াবে সত্যিকারের গণিতের শিক্ষক।
৩.আধুনিক সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে।তারা মূল ধারার শিক্ষার্থীদের মতই সব বিষয় পড়বে,ধর্মের অংশ টুকু পড়বে অতিরিক্ত।
৪.নারী মাদ্রাসা গুলোতে নিয়মিত নারী অধিকার আদায়ে নিয়োজিত সমাজ কর্মীদের দ্বারা মনিটরিং করাতে হবে।
৫.শারীরিক শাস্তি প্রদানের বিরূদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে...
আরও অনেক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরা যায় কিন্তু সেগুলো কোনটিই আসলে সমাধান নয়।মূল সমাধান একটিই,সেটি হল মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা কে আরও সহজ লভ্য করা,জনপ্রিয় করা।প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর উন্নয়ন করা।আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান ভয়াবহ রকমের খারাপ।ভাল শিক্ষকদের জন্য চাই সম্মান জনক বেতন।যেখানে একজন প্রাইমারি শিক্ষকের বেতন দারোয়ানের থেকেও অনেক কম সেখানে কে শিক্ষক হতে চাইবে?আর এর জন্য চাই বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি।যেখানে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার কথা সেখানে আমরা করি ২ শতাংশ।প্রাইমারি হল মূল ভিত্তি।আমাদের ভিত্তিটা দুর্বল রেখে কি করে আমরা উন্নতির স্বপ্ন দেখি?দুর্বল ভিত্তির উপর আমরা যতই উন্নয়নের প্রাসাদ গড়িনা কেন,সেটা ভেঙ্গে পড়তে কিন্তু এক মুহুর্ত সময় লাগবেনা।
আলো দিয়েই একমাত্র অন্ধকার দূর করা সম্ভব।অন্ধকার কে আরেকটু সহনিয় করে সেটা সম্ভব নয়।এদেশে আমেরিকা থেকেও 'মাদ্রাসার উন্নয়ন' এর জন্য সাহায্য আসে।কাজেই ব্যাপারটা খুব সহজ নয়।মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমেই কেবল এই অন্ধকার কে দূর করা সম্ভব।আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি চাই।একটি সুন্দর আলোকিত দেশ না একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদ?