Wednesday, September 9, 2015

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল: রহস্য কি ফুরালো?

আসলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য সেই ১৯৭৫ সালেই ফুরিয়েছে। তারপরও আমাদের কৈশরে, সেই রহস্য জিইয়ে রেখেছিল সেবা প্রকাশনী । তো, কী ভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য ফুরালো? বলছি। ঢাকার শনির আখড়ার নাম তো শুনেছেন- ডেমরা থানাধীন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যে অভিশপ্ত (!) জায়গাটি সড়ক দূর্ঘটনার জন্য কুখ্যাত। আসলে হিসেবনিকেশ করে দেখা যাবে শনির আখড়ার দূর্ঘটনার সংখ্যা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের দূর্ঘটনার সংখ্যা থেকে খুব একটি বেশি নয়-শনির আখড়া নিয়ে খামাখা চাঞ্চল্যকর কাহিনী ছড়ানো হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য সংক্রান্ত এরকমই এক হিসেব দাখিল করেছিলেন অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভারসিটির গ্রন্থাগারিক লরেন্স ডেভিড কাসচি। তিনি ১৯৭৫ সালে “দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মিসট্রি : সলভড” নামে একখানি বই প্রকাশ করেন। যে বইয়ে কাসচি যুক্তিপ্রমাণ হাজির করে দেখান যে আসলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য নিয়ে অতিরঞ্জিত কাহিনী ছড়ানো হয়েছে। আসলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে ‘মিসটিফাই’ বা রহস্যঘন করা হয়েছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে গায়েব হয়ে যাওয়া জাহাজ ও উড়োজাহাজের সংখ্যা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের নৌ ও বিমান দূর্ঘটনার সংখ্যা চেয়ে খুব বেশি নয়! ত্রিভূজ কল্পনা না করলে জায়গাটিকে সাধারন স্থানই বলে মনে হয়।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অবস্থান ক্যারিবীয় সমুদ্রে। এর এক প্রান্ত ছুঁয়েছে বারমুডায়, অন্য প্রান্তটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মায়ামি এবং আরেকটি প্রান্ত স্পর্শ করেছে পুয়োর্তরিকোর সাজ জুয়ান।
১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৬ তারিখে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের এক প্রবন্ধে সাংবাদিক ই ভি ডাবলিউ জোনস প্রথম বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অস্বাভাবিক ঘটনার কথা লিখেন । লেখাবাহুল্য, শনির আখড়ায় প্রথম দূর্ঘটনার দিনক্ষণ বাঙালির মনে থাকার কথা নয়। এর দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ‘ফেট’ ম্যাগাজিন-এর জর্জ এক্স সান্ড লিখেন “সি মিসট্রি অ্যাট আওয়ার ব্যাক ডোর”। বাংলা ভাই যেমন মিডিয়ার তৈরি, বুঝতেই পারেন ...মিডিয়া কী ভাবে একটি অঞ্চলকে রহস্যঘন করে তুলতে পারে।
আর কেউই বিশ্বাস নাই করুক আমি অন্তত বিশ্বাস করি যে এখানেই ছিল প্রাচীন আটলানটিস। অবশ্য গ্রিক ইতিহাস আর মানচিত্র সম্বন্ধে যাদের বিন্দুমাত্র জানাশোনা আছে তারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। কেননা, সমুদ্রসভ্যতা আটলানটিস-এর কথা প্রথম উল্লেখ করেন মাননীয় গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। প্লেটোর পক্ষে যেমন আই পি এল, ললিত মোদী কিংবা ক্যারিবীয় ক্রিকেটের কথা জানা সম্ভব নয়, তেমনি










ক্যারিবীয় সমুদ্রের কথাও জানার কথা নয় ...
যা হোক ‘ফেট’ ম্যাগাজিন-এর সাংবাদিক জর্জ এক্স সান্ড ৫ জন ইউএস নেভি সহ ১৯ নং ফ্লাইটের নিখোঁজ সংবাদ ছাপেন । এই জর্জ এক্স সান্ড বিশাল কামেল লোক। কেননা, সান্ডই প্রথম ঐ এলাকায় কাল্পনিক একটি ত্রিভূজ আঁকেন। বুঝেন এইবার, লোকটা কত বড় মাতবর! এরে এখন ঢাকায় জীবিত পেলে ‘কালের কন্ঠ’ আর ‘প্রথম আলো’ কী রকম টানাটানি করত ভাবেন একবার ...যা হোক। সান্ড লিখেছে ... নিরুদ্দিষ্ট ১৯ নং ফ্লাইটের ক্যাপ্টেইন নাকি বলছিলেন- “আমরা ক্রমশ সাদা পানিতে ঢুকে পড়েছি। কিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আমরা জানি না আমরা কোথায়। পানি সাদা না সবুজ। ”
প্রশ্ন : আচ্ছা, যে প্লেনটি চিরতরে হারিয়ে গেল তার পাইলটের কথা কীভাবে শোনা গেল?
উত্তর: কেন প্ল্যানচেটের মাধ্যমে।
আর কি কি ভাবে কখন কোন্ কোন্ জাহাজ বা বিমান ওই রহস্যময় (!) স্থানে গায়েব হয়ে গেছে তার তালিকা দিয়ে অহেতুক এই পোষ্ট লম্বা করে লাভ নেই।
উনিশ ’শ পঞ্চাশের পর দীর্ঘদিন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে ঘিরে নানান গা-ছমছমে রোম-খাঁড়ানো কল্প কাহিনী আপনার আমার মতো পৃথিবীর রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য (!) নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র বই, নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র-এমন কী চলচ্চিত্রও। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভারসিটির লাইব্রেরিয়ান লরেন্স ডেভিড কাসচি পৃথিবীর রোমাঞ্চ প্রিয় মানুষের অতি উৎসাহে পানি ঢেলে দিয়েছেন। আগেই বলেছি কাসচি ১৯৭৫ সালে “দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মিসট্রি : সলভড” নামে একখানি বই প্রকাশ করেন। সে বইটি কাসচি কয়েকটি সিদ্ধান্তের কথা জানান:
১ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে নিরুদ্দিষ্ট জাহাজ ও উড়োজাহাজের সংখ্যা পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি নয়। (আমি মনে করি ঢাকাস্থ ডেমরা থানাধীন শনির আখড়া সম্বন্ধেও একই কথা প্রয়োজ্য ... )
২ ক্যারিবীয় সমুদ্রের ওই বিশেষ জলসীমায় প্রায়ই ট্রপিক্যাল ঝড় ভয়ঙ্কর রুপ নেয় , কাজেই ঝড়েন ঘূর্ণিপকে জলযান নিঁখোজ হওয়াটা কি রহস্যময় ? সাংবাদিক ই ভি ডাবলিউ জোনস, জর্জ এক্স সান্ড প্রমূখ যারা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল ঘিরে রহস্য ছড়িয়ে দিয়েছেন তারা ঝড়ের কৌশলে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে।
৩ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে গায়েব হয়ে যাওয়া জাহাজ/উড়োজাহাজ সংখ্যা যত না - তার চেয়ে বেশি দাবী করা হয়েছে। সেই সঙ্গে একটি জাহাজ নিখোঁজ হলে সিরিয়াসলি রিপোর্ট করা হয়েছে কিন্তু ফিরে এলে সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকেছে।
৪. কোনও কোনও সময়ে নিরুদ্দেশের ঘটনাই ঘটেনি। বলা হয়েছে ১৯৩৭ সালে একটি প্লেন ক্র্যাশ করেছে। আসলে ওমন কিছুই ঘটেনি।
৫. আসলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য হল ‘প্রস্তুতকৃত রহস্য’ বা ম্যানুফাকচারড মিসট্রি ...যা লেখকরা ভুল ধারণার ওপর জিইয়ে রেখেছে, এর পিছনে কাজ করেছে মিথ্যে যুক্তি আর রগরগে কাহিনী ছড়ানোর বাতিক। আমরা দিন কয়েক আগের ভন্ডপির সংক্রান্ত ‘প্রথম আলোর’ সেই তোলপাড় করা প্রতিবেদনের কথা মনে করতে পারি।
১৯৭৫ সালে কাসচি যাইই লিখুন আজও রোমাঞ্চপ্রিয় বিশ্ববাসীর বিশ্বাস ক্যারিবীয় সাগরের বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অতি রহস্যময় স্থান। আসলে লরেন্স ডেভিড কাসচি অতি বাস্তববাদী লোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান তো-একঘর বইয়ের মধ্যে বাস করে রসকষ শুকিয়ে গেছে কাসচি-র। আসলে বেঁচে থাকতে চাই বিস্তর রসবোধ। আপনার পাশের বাড়ির ছাদে যদি মধ্যরাতে ভূতপ্রেতের আড্ডা নাই বসে তো তাহলে কেমন অস্বস্তি হয় না? তাই বলছি, আপনি যদি মনে করেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বাস্তবিকই অতি রহস্যময় স্থান আর কাসচি লোকটাই ভূয়া ... তাহলে আপনাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন আমি অন্তত বলব না । যতদিন বেঁচে থাকা যায় ততদিন গালগপ্পে ভরা রগরগে জীবনই ভালো-অফিসের টিফিন টাইমে কলিগদের বলবেন মাঝরাতে জানালার পর্দা ফাঁক করে পাশে বাড়ির ছাদে কি সব দেখলেন ...তাইই বলছিলাম এইটুকুন জীবনে এত কট্টর যুক্তিপ্রমান দিয়ে কি হবে। জীবনে প্রচুর রহস্যরোমাঞ্চ থাক-আমরাও যন্ত্রের চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হওয়া অভাগা মানুষ সামান্য কল্পকথার তোড়ে তেলতেলে হয়ে টইটুম্বুর ভাবে বেঁচে থাকি না কেন...কাসচির যুক্তির চেয়ে এই গা ছমছমে ছবিটা টানে বেশি.