(এই সিরিজে নাস্তিকদের কমন ২০টি প্রশ্নের ধারাবাহিক উত্তর দেয়ার
চেষ্ঠা করা হবে ইনশাআল্লাহ। পাঠকদের নিকট আন্তরিক অনুরোধ, উপযুক্ত
সমালোচনা, পরামর্শ ও যুক্তি দিয়ে উৎসাহিত করবেন। এই উত্তরগুলো সংকলন করে
ভবিষ্যতে বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে। তাই সকল প্রকার পরামর্শ একান্ত
কাম্য)
প্রশ্ন ১: বলা হয় ঈশ্বর আছেন। এর মূল হিসেবে “কারণ তত্ত্ব (Law of Causation)” উপস্থাপন করা হয় যার মূল বক্তব্য হলো প্রতিটি সৃষ্টিই কোন না কোন স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্ট, যেমন তাঁতী কাপড় সৃষ্টি করে, চিত্রকর ছবি সৃষ্টি করে ইত্যাদি। সেই যুক্তিতে এই বিশাল বিশ্ব সৃষ্টির পিছনেও কোন না কোন স্রষ্টাতো অবশ্যই আছে, যিনি এটি সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু এই সূত্র ধরেই বলা হয়, সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা আবশ্যক, একই সূত্র ধরেই এই প্রশ্নও আসে, তাহলে স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করেছেন?
উত্তর: এই প্রশ্নটা আপাত: দৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও আসলে ভিত্তিহীন। এখানে যে মূল দন্দ্বটা প্রকাশ পায়- “যদি সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা আবশ্যক, তাহলে স্রষ্টাকে সৃষ্টি করলো কে”- কথাটি যে স্ববিরোধী তা সামান্য আলোচনায় প্রমাণ করা সম্ভব।
এই প্রশ্নে যে ভূলটা করা হয় তা হলো স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে একই আইনে বিচার করা।এটাকে আমরা
“Law of Causation” বা কারণতত্ত্ব বলি। কারণতত্ত্ব শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা সময় এবং স্থানের আওতাধীন। স্রষ্টা সময় ও স্থান উভয়ের স্রষ্ঠা এবং নি:সন্দেহে এই কারণে তিনি উভয়ের উর্ধ্বে। সুতরাং, এ্গুলো বা এগুলো দ্বারা নির্ধারিত কোন তত্ত্ব দ্বারা তাকে বিচার করা ভ্রান্তি। এটার উদাহরন এমন হতে পারে, এক ব্যক্তি পুতুল নাচের পুতুল দেখে ভাবলো, এই পুতুল গুলোকে যেমন একজন সূতা দ্বারা নিয়ন্ত্রন করে, ঐ ব্যক্তিকেও কেউ একজন একইভাবে সূতা দ্বারা নিয়ন্ত্রন করে। তাকে যদি বলা হয়, ঐ ব্যক্তিকে কেউ এভাবে নিয়ন্ত্রন করে না, সে তা বিশ্বাসও করতে চায় না কারন তার যুক্তিতে সবকিছুই এভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ঠিক একইভাবে, এই প্রশ্নকারী ঈশ্বরের স্বকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, কারণ তিনি তার চারপাশে যা দেখেন তার সবটুকুই এমন কারণে আবদ্ধ বিধায় তিনি ভিন্ন চিন্তা করতে পারেন না বা করতে চান না বা করার চেষ্ঠা করেন না।
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়্যেল কান্ট তার “Critique of Pure Reason” নামক বইয়ে উল্লেখ করেছেন “অসীম বাস্তবতা একটি নির্দিষ্ট বিশেষের সাথে সংশ্লিষ্ট যা মানব মস্তিস্ক সাধারণত: উপলব্ধি করতে পারে না। ঈশ্বরের মত একটি মহাবৈশ্বয়িক এবং স্বয়ংভূ অস্তিত্ব উপলব্ধি করতেও স্বভাবতই এটি অক্ষম। বিবেকর মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা হয়েছে, কারণের মাধ্যমে নয়। ঠিক যেমন পানির পিপাসা আমাদের পানির অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত করে, ন্যায় বিচারের প্রতি আমাদের ব্যাকুলতা আমাদের ন্যায় বিচারের অস্তিত্বের জানান দেয়।”
কারণতত্ত্বের ব্যাখ্যায় অ্যারিস্টটল কারণের চেইনটা এভাবে বর্ণনা করেছেন- কাঠ থেকে চেয়ার, গাছ থেকে কাঠ, বীজ থেকে গাছ এবং রোপনকারী থেকে বীজ। অবশ্য তাকে এই বলেই সমাপ্তি টানতে হয়েছিল যে, এই চেইন যা কোন এক অনির্দিষ্ট সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করে, যা কোন “অকারণের” কারনেই শুরু হয়েছিল। এই অকারণটি যেন এমন একটি গাড়ী যার কোন চালকের প্রয়োজন নেই, এমন একজন স্রষ্ঠা যিনি কারো দ্বারা সৃষ্টি হননি।
অপরদিকে, বিশ্বখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে আরাবি ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছেন-এরূপ প্রশ্নকে “একটি বিশৃঙ্খল চিন্তার বহি:প্রকাশ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সন্দেহের উর্ধ্বে এবং অন্য কোন কিছু বা মহাবিশ্বকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমান হিসেবে উপস্থাপন করা ভ্রমাত্মক।
হাদিসে কুদসীতে (যে হাদিসে রাসূল (সা আল্লাহর নিজের কথা বর্ণনা করেছেন) বলা হয়েছে যে, আল্লাহ বলেন “ একমাত্র আল্লাহ, যিনি সব ব্যবস্থাপনায় এবং অনুসন্ধানে সাহায্য করেন, কিন্তু এমন কোন প্রমাণ নেই যা তার দিকে ইঙ্গিত করে।“
সুতরাং, ঈশ্বর এমন একটি প্রমান, যা প্রমাণের জন্য অন্য কোন প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা নেই। তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ সত্য, এবং তিনিই সেই প্রমান যা অন্য সবকিছুর সত্যায়ন করে। তিনি স্পষ্টতা দানকারী, সবকিছুর বিন্যাসে, সূক্ষতায়, সৌন্দর্যে এবং ধারাবাহিকতায়; গাছের পাতা, পাখির পালক, প্রজাপতির ডানা, ফুলের সুগন্ধ, কোকিলের গান, গ্রহ নক্ষত্রের সামঞ্জস্যতা যাকে আমরা মহাবিশ্ব বলি- এসব কিছুর যর্থার্থতা প্রদানকারী একমাত্র তিনিই। যদি আমরা বলি এগুলোর সবকিছুই একা একা বা ঘটনাক্রমেই অস্তিত্ব লাভ করেছে, তাহলে এই ধারনা থেকে এ কথাও বলা যেতে পারে যে টাইপরাইটারের অক্ষরগুলোরকে ইচ্ছামত টিপাটিপি করলেই নজরুলে অগ্নিবীণার মতো বা শেখ সা’দীর গুলিস্তার মতো সাহিত্যকর্ম একা একাই সৃষ্টি হয়ে যাবে।
কুরআন এ সমস্ত যুক্তিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে অল্প কিছু শব্দের মাধ্যমেই। কোন দ্বিধাদন্দ না রেখে কুরআনের স্পষ্ট ঘোষনা:
“বলুন, আল্লাহ এক। আল্লাহ অদ্বিতীয়।না তিনি কারো হতে জন্ম নিয়েছেন আর না তিনি কাউকে জন্ম দিয়েছেন। এবং তার সমকক্ষ আর কেউই নেই।“ (সূরা ইখলাস, আয়াত:১-৪)
প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে ঈশ্বর একজন কেন? একাধিক ঈশ্বরও তো হতে পারে, যারা মহাবিশ্বের
এর উত্তর কুরআন বা সুন্নাহ থেকে দেয়ার আগে কিছু বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে্ও উত্তর দেয়া যেতে পারে। তা এরকম যে, ঈশ্বর একজনই; তার কারণ এই মহাবিশ্বও একটি মাত্র মৌলিক পদার্থ থেকে পর্যায়ক্রমে এবং একত্রিকরণের পরিকল্পনামাফিক সৃষ্টি হয়েছে। মেন্ডেলিফ সারণির ৯২টা মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি; সমস্ত মৌলিক পদার্থই হাইড্রোজেন হতে গলন, একীভবন, সংমিশ্রন ও নির্গমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে; ঠিক যে প্রক্রিয়ায় পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে মহাশুন্যের নক্ষত্রগুলো জ্বলে।
ওয়ান এনাটমিক্যাল প্নান (One anatomical plan) অনুযায়ী, সকল জীববস্তু কার্বনের যৌগিক সংমিশ্রনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে; ফলেই তা আগুণে সম্পূর্ণ রূপে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।সঙ্গত কারণেই ব্যাঙ, খরগোশ, কুমির, জিরাফ এমনকি তিমির একই বৈশিষ্টপূর্ণ দৈহিক গঠন পরিলক্ষিত হয়। সবগুলো্রই একই রকম ধমনি, শিরা, হৃদ প্রকোষ্ঠ, অস্থি সঙ্গতি দেখা যায়। ব্যাঙের সামনের পায়ের গঠন আর পাখির ডানার গঠন প্রায় একই রকম, হাড়ে সামান্য কিছু পার্থক্য বাদে। জিরাফের লম্বা গলা সাতটি কশেরুকা দিয়ে গঠিত, আবার সজারুর গলাও সাতটি কশেরুকা দিয়েই গঠিত।সবগুলো প্রাণির স্নায়ুতন্ত্র মস্তিস্ক, মেরুদন্ড, মোটর ও সংবেদনশীল স্নায়ুর সমন্বয়ে গঠিত।সবগুলোই পরিপাকতন্ত্র পাকস্থলি, গ্রহনকেন্দ্র, ক্ষুদ্রান্ত্ ও বৃহদান্তের সমন্বয়ে গঠিত। সবগুলোর প্রজননতন্ত্র ডিম্বাশয়, জরায়ু, অন্ডকোষ ও নির্গমন নল (ducts) আবার সকলেই মুত্রাশয়, কিডনী, ইউরিটার ইত্যাদির সমন্বয়ে মূত্রপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। প্রতিটি প্রাণীরই শারীরিক গঠনের একক কোষ। উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষ, সকলের ক্ষেত্রেই জীবন প্রক্রিয়া একই সাধারন নিয়ম দেখা যায়- জন্ম, শ্বসন, বংশবিস্তার ও মৃত্যু।
এসব দিক বিচার করে ঈশ্বরের একত্বে কোন দ্বিধা থাকে কি? তিনি কি সৃষ্টির পূর্ণতা প্রদানে কোন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন? মোটেই না, বরং সৃষ্টির এই সাধারণ বৈশিষ্ট মোটেই সম্ভবপর হতো না যদি একাধিক সৃষ্টিকর্তা থাকতো। ঈশ্বর যদি একাধিক হতেন, তবে তারা নিজেদের সৃষ্টি নিয়ে দ্বন্দে লিপ্ত হতেন এবং সৃষ্টি অচিরেই ধ্বংস হয়ে যেত (যেমনটি কিছু বহুঈশ্বরবাদী ধর্মের গ্রন্থে দেখাও যায়)। ঈশ্বর এমনি এক স্বত্তা যার মহামহিমা এবং কর্তৃত্ব প্রকাশের জন্য কোন অংশীদারের প্রয়োজন নেই।