Wednesday, September 9, 2015

হুজুগে বাঙালির ভবিষ্যৎ---

হুজুগে বাঙালিপনা দৈনন্দিন সংঘটিত প্রায় প্রতিটা ঘটনাতেই কমবেশি দেখা যায়! না যাওয়ারও অবশ্য বিশেষ কোনো কারণ নেই!আসলে আমাদের এইসব “হুজুগ” সহসা যে বিলুপ্ত হবেনা সেটাও অবধারিত। আমরা চিরকাল “কান নিয়েছে চিলে” শুনে কান যথাস্থানে আছে কীনা তা নিজের কানে হাত দিয়ে পরীক্ষা না করেই চিলের পিছে ছুটতে থাকবো! জনগণ যতই চিলের পিছে ছুটবে কর্তাব্যক্তিরা ততই ইচ্ছামাফিক দেশ চালাবার লাইসেন্স পাবেন। আমাদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না দিতে কর্তাব্যক্তিরা প্রয়োজনে “উদ্দেশ্যহীন সিলেবাস” প্রণয়ন করবেন, প্রশ্ন আউট করে গণমাধ্যমে দিয়ে দিবেন (গতবার ফেবুতে পাওয়া গেছিলো, এবার কি তাহলে ইনবক্সে…!?); পাছে সবাই ঠিকঠাক শিখে ফেলে আর চিলের পিছে ছোটা বন্ধ হয়ে যায়! হিসাব খুব সোজা!
তার মানে কী এসব হুজুগ জিইয়ে রাখার জন্য কেবল কর্তাব্যক্তিরা দায়ী?
উত্তর: নেতিবাচক
মানুষ আসলে শেখে বহুভাবে! পড়ে, দেখে, ঠেকে কিংবা ঠকে। বাঙালি যে পড়ে কিংবা দেখে শিখবে না তা তো সুস্পষ্ট! (তেমনটা হলে আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা চিন-জাপানকে দেখে অনেক কিছুই শিখতে পারতাম) এর মানে হলো তারা হয় ঠেকে শিখবে নাহয় ঠকে!
আমাদের দেশে মোটামুটি গোটা শতেক প্রিন্ট মিডিয়া ও গোটা চল্লিশেক ইলেকট্রনিক মিডিয়া আছে যারা দৈনিক গড়ে বেশ কয়েকটি “রোমহর্ষক” ঘটনা প্রচার করে। আশ্চর্য্যজনকভাবে খবরগুলো পড়ে/দেখে আমাদের কোনো বিকারই হয়না, যেখানে এসব পড়লে/দেখলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার কথা। আমরা দৈনিক নিদেনপক্ষে ৫-১০ জন মানুষের অপঘাতে মৃত্যুর খবর শুনি বা পড়ি।
খেয়াল করুন! আমরা কী অবলীলায় ৫-১০ জন মানুষের (হ্যাঁ! আমার-আপনার মতোই রক্তমাংসের মানুষ! যার একটা পরিবার আছে, কর্মক্ষেত্র আছে, কিছু স্বপ্ন আছে, আছে নিজস্ব একটা জগৎ!) মৃত্যুর খবর পড়ে ফেললাম! যেখানে আমরা আমাদের নিজেদের মৃত্যুর কথাটা চিন্তাও করতে পারি না; সেই আমরাই আমাদের মতো অপর এক বা একাধিক রক্ত-মাংসে গড়া মানুষের মৃত্যুতে তেমন বিচলিত বোধ করলাম না! আসলে সামান্য মাত্রায় নিয়মিত বিষ গ্রহণ করতে থাকলে এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর ডোজ বাড়াতে থাকলে একসময় এমন হয় যে খোদ বিষধর গোখরার ছোবলেও কিছু হয় না। আমাদের দশা হয়েছে সেরকমই!
দৈনিক এতো এতো রোমহর্ষক খবর পড়তে পড়তে এখন এসব আমাদের গা সহা হয়ে গেছে! এখন লাশের সংখ্যাটা “ডাবল ফিগার” না হলে আমাদের যেনো চোখেই পড়ে না!
অাবার, আমরা যারা নিজেদের সুশীল বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি তাদের আড্ডা অাবার রগরগে ঘটনা ছাড়া ঠিক “জমে” না; আর কোনো ইস্যু ঠিকঠাক না জমলে আমাদের পেটের ভাতও হজম হয়না; দিনটাই কেমন মাটি মাটি মনে হয়! মিডিয়াগুলোর কাহিনিও তাই! ওরা যার যার পত্রিকা\ চ্যানেলের কাটতি বাড়ানোর জন্য রগরগে খবর কামনা করে! আর কেউ কেউ তো “সাংবাদিকতা মহান পেশা” – এ আপ্তবাক্যটি ভুলে গিয়ে কারো স্বার্থেই হোক কিংবা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে- সংবাদকে “মনের মাধুরী মিশিয়ে” প্রচার করতেই পছন্দ করেন!
আর এই করতে করতে আমাদের মানসিকতাটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে! আমরাই চাই না সরকারী দল ও বিরোধী দল এক হোক! কারণ তাহলে যে এদের মধ্যকার “লাইভ গ্যাঞ্জাম” দেখতে পাবো না!
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আমি আমার আশ-পাশের অনেককে বলতে শুনেছি, “ধুর! বিম্পি কোনো দলই না! এরা কি বালের হরতাল ডাকে?! রাস্তায় তো দেখি জ্যাম লেগে যাচ্ছে! তার চাইতে জামাত-শিবিরের হরতালই ভালো! সব টাইট থাকে!”
সংবাদ পাঠককে বলতে শুনি, “সারাদেশে ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালন হয়েছে” -ভাবখানা এমন যে এতে ওনারা যার-পর-নাই “কষ্টিত” হয়েছেন!
অনেকে আবার হরতালকে “ছুটির দিন” হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায় বলে কিছুদিন পর পর হরতাল কামনা করেন!
এসব কিসের আলামত? আমরা কি “ব্যক্তিস্বার্থে”র পেছনে ছুটতে ছুটতে “মনুষ্যত্ববোধই” হারিয়ে ফেলছি? তাহলে এখন থেকে আর আমরা নিজেদের “মানুষ”বলে দাবি করতে পারবোনা!
বাস্তবতা হলো, আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের এ রাস্তা হতে ফিরে আসতে হবে; তা না হলে জাতি এই বিশ্বায়নের যুগে নিজেরা নিজেরা কামড়া-কামড়ি করেই ধ্বংস হয়ে যাবে- অচিরেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বাংলাদেশীরা.…
আসুন আমরা আবার সেই আগের ধ্যান-ধারণায় ফিরে যাই, যখন প্রতিটা মানুষের অপঘাতে মৃত্যুকে “মানুষের” মৃত্যু বলে ভাবতাম; কেউ চোখের সামনে বিপদে পড়তে দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম…
পথ আপনার সামনে; বেছে নিন আপনার পছন্দ কোনটা- ত্যাগের পরিপূর্ণ শান্তি কিংবা স্বার্থের মেকি শান্তি…
আজ যে পিটিয়ে মেরে ফেলা ছেলেটার জন্য (রাজন) আমাদের দয়া উথলে উথলে পড়ছে তার কতটুকু সত্য আর কতটুকু মেকি সেটা নিয়েও অামি সন্দিহান! কারণ, যারা আজ হা-হুতাশ করছেন তাদের হাত থেকে দামী মোবাইলটা যদি কেউ নিয়ে যেতো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে (ছিনতাইকারী) যদি তারা বমাল ধরতে পারতো তাহলে তারা গার দুই গালে দুইটা চুম্বন দিতো না নিশ্চয়ই!
খবরটা প্রচারিত হওয়ার পর সবগুলো পত্রিকাতেই দেখলাম “আসলে চুরি করেনি/ চুরির সাথে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি” টাইপের কথাকে হাইলাইট করতে। তার মানে কী? যদি ছেলেটা আসলেই চুরি করতো তাহলে তাকে মারা জায়েজ হয়ে যেতো? তখন কি ছেলেটা এতগুলো লোকের সহানুভূতি পেতো?
যারা সহানুভূতি প্রকাশ করছেন তারা কি জানেন না সারা দেশেই এমন “সন্দেহের বশে” পিটিয়ে হত্যা করা কিংবা পঙ্গু করে ফেলা ঘটনা এখন অার অপ্রতুল নয়? তাহলে এই ছেলেটার জন্যই কেনো বিশেষভাবে সহমর্মিতা জ্ঞাপন? বাকিগুলো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় অতটা ফোকাস হয় না বলে? তাহলে কী দাঁড়ালো?
-দিনশেষে আমরা সবাই হুজুগে বাঙালি…
কিংবা দিন শেষে আমরা সবাই পশু…
হাজার বছরের বিবর্তনে শারিরিক দিক থেকে হয়ত আমাদের বিবর্তন হয়েছে কিন্তু মানসিক দিক থেকে আমরা এখনো পশুত্বকে ত্যাগ করতে পারিনি।
এবার অাসুন এসবের কার্যকারণ জানা যাক! বাস্তবতা কী বলে? সরকার যতই “বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ” কিংবা “জিডিপি বৃদ্ধি”র ভিডিও/ বিলবোর্ড দেখিয়ে বেড়াক না কেনো, এখনো সব মানুষের স্বচ্ছ্বলতা আসেনি। সমাজের সর্বস্তরে যখন স্বচ্ছলতা অাসবে তখন এতো ঝামেলা করে সেসব দেখাতে হবে না; ব্যক্তির মুখ দিয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়িয়ে আসবে সরকারের জয়গাঁথা।
যাহোক! চারপাশের খবরাখবর দেখে মনে হচ্ছে, আমরা ফিরে যাচ্ছি অামাদের একসময়কার পূর্বপুরুষেরা যখন পশু (এপ) ছিলো তখনকার মানসিকতায়; ধীরে ধীরে , একটু একটু করে। ঠিক নিচের ছবিগুলোর মতো…
এটা হলো রাগের চরম মূহূর্ত, যখন অামাদের নাক-কান রক্তিম বর্ণ ধারণ করে
ক্রোধের সময় এমন কাজ সম্ভব যা স্বাভাবিক অবস্থায় সম্ভব নয়
অন্ধকারে ভয়, অজানাকে না জানার ভয়, প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের ভয় ধর্মের উৎপত্তিতে বড় প্রভাব রেখেছে। এরই মধ্যে মানব মস্তিষ্কের বিবর্তন এতোটা হয়েছে যে আমাদের মধ্যে এপদের তুলনায় বেশ কয়েকটি নতুন ও ভিন্নধর্মী (ততোধিক জটিল) আবেগের সঞ্চার হয়েছে। একদিকে সেসবকে আয়ত্বে আনতে আর অন্যদিকে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে গিয়ে মানুষকে নানারকম চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। মানুষ প্রতি পদে পদে শিক্ষা নিয়েছে। এভাবে তাদের মধ্যে ভিন্নধর্মী একটা “অবসারভেশন টুলস” চলে এসেছে ।
যদিও ঋতুগুলো একই চক্রে ঘূর্ণায়মান তথাপি প্রকৃতি একটু-আধটু ভিন্ন অাচরণ সারা বছরই করে। প্রকৃতি যখন ভিন্ন অাচরণ করে তখন অবসারভেশনেও উল্টাপাল্টা রেজাল্ট আসে। সেসব রেজাল্ট দেখে তাদের আবার গ্রাস করে অজানাকে না জানার ভয়। এরকম কোনো একটা অবস্থা থেকে শুরু হয় প্রকৃতি পূজা। তাদের দক্ষতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা বাড়ার সাথে সাথে তাদের ঈশ্বর পরিবর্তন হতে থাকলেও ধর্মবিশ্বাসে ছেদ পড়ে না। আসলে তখন সামগ্রিকভাবে ধর্মকে উড়িয়ে দেয়ার মতো অতটা শক্তিশালী এভিডেন্স ছিলো না। এর মধ্যেই ধর্ম মোটামুটিভাবে সার্বজনীন হয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছিলো। যারা এসব ধর্মের গোড়ার দিকে ছিলেন তারাও দেখতে পেলো বসে বসে খাওয়ার এরচাইতে উৎকৃষ্ট পন্থা হতেই পারেনা। এছাড়াও এটি পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদী রাজাদের দ্বারাও প্রমোট লাভ করে। কারণ এর দোহাই দিয়ে অনেক কাজই সাধারণদের দিয়ে করিয়ে নেয়া যায়। মোটামুটি এভাবেই ধর্ম দাঁড়িয়ে যায় নিজের পায়ে। অনুকূল পরিবেশ ও যত্নআত্তি পেতে পেতে সময়ের সাথে সাথে এর প্যাটার্ন পরিবর্তন হয় কেবল।
ধর্মপ্রচারকারীরা ধর্মগুলোকে নৈতিকতার মাপকাঠি বললেও আসলে কিন্তু তা নয়।