Wednesday, September 9, 2015

পুরুষতন্ত্রের মোড়কে ধর্ষণ প্রতিদিন প্রতিরাতে---

প্রতিদিন আমরা পত্রিকার খবর থেকে জোরপূর্বক যৌন কর্ম করার যে চিত্র দেখতে পাই সেগুলোকে ধর্ষণ বলি। আমাদের দেশে অসংখ্য নারী প্রতিদিন প্রতিরাতে স্বামীর বিছানায় ধর্ষিত হয়, হচ্ছে সেকথা কখনও ভেবে দেখেছি কি? বিবাহিতা নারীর স্বামীর কাছে ধর্ষিতা হবার এই বিষয়টিকে আদতেই আমরা ধর্ষণ বলি না কিম্বা স্বামীর হাতে ধর্ষিত হচ্ছে বা হতে পারে এটা কখনও ভেবে দেখার প্রয়োজনও বোধ করিনা। কারণ, খুবই হতাশাব্যঞ্জক ! খুব সহজ ভাষায় বললে এই বিষয়টি দুজন মানুষের ( স্বামী ও স্ত্রী)পারস্পারিক বোঝাপড়ার (খুব ইনিয়ে বিনিয়ে বললে ভালবাসার) এক শারীরিক প্রকাশ; যা সকল জীবমাত্রেই রয়েছে, মানুষের বেলায় এই বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত, অপ্রকাশিত আর পর্দার আড়ালের ব্যপার, অন্ততঃ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। আর এর পেছনে রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণ, যা যথেষ্ট অযৌক্তিক বলে মনে হয়নি। আর তাই এক্ষেত্রে ‘পারস্পারিক’ শব্দটি অতি গুরুত্ববহ। এই পারস্পারিক কিম্বা দ্বিপাক্ষিক বিষয়টির অনুপস্থিতি ঘটলেই যত বিপত্তি; তাতে কেউ বয়ফ্রেন্ড হোক কিম্বা স্বামীই হোক; সম্পর্কের ধরণ আর ঢং এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেই। যৌন সম্পর্কে নারীর ভূমিকা আসলে কী? নারী কী আদৌ তার যৌন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে তার জীবনসঙ্গীর কাছে? কখনোই মুখ ফুটে বলে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা-চাহিদার কথা? কিম্বা কীভাবে, কোন কৌশলে সে অধিক আনন্দ পায় এসব কথা খোলাখুলি আলোচনা করে তার সঙ্গীর সাথে? এ বিষয়ে আশির দশকের শেষভাগে “ জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’’ (নিপোর্ট)এর তত্ত্বাবধানে এক গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল। যার ফলাফল হিসেবে দেখা গিয়েছিল শতকরা ৯৬ ভাগ নারীরা স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্রহীতার ভূমিকায় থাকে। তাদের কিচ্ছুটি বলার নেই, না কোনো অনুভূতি না কোনো ইচ্ছার প্রকাশ । এই হিসেব শহুরে, শিক্ষিতা, চাকরিজীবী নারীরা স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে ছিল । তথাপিও সেই শহুরে নারীদের মধ্যে ৮৩ ভাগ নারীর মতামত এসেছিল যৌন কর্ম সম্পাদনে তাদের ভূমিকাহীন থাকার কথা। যা গবেষকদের অতিমাত্রায় আশাহত করেছিল। পরবর্তীকালে সরাসরি এই বিষয়ে আর কোনো গবেষণা সংঘটিত হয়নি। দাতাগোষ্ঠীর অভিপ্রায়ে কেবল নারীর অগ্রযাত্রার গবেষণাই পরিচালিত হয়েছে। তাই এই শতকরা হারের কী অগ্রগতি আজকের বাংলাদেশে তা হলফ করে বলতে পারছিনা। তবে জীবনের নানা আয়োজনের সাথে জড়িয়ে দুই দশক পরে অভিজ্ঞতাও কিছু কম হয়নি। সেসব বাস্তব অভিজ্ঞতার বলেই বলতে পারি খুব কম ক্ষেত্রেই শুনেছি যে স্ত্রীর ইচ্ছে না হলে, স্ত্রী যৌন আবেদন অনুভব না করলে, কিম্বা স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করলে কিম্বা স্ত্রীর ঋতুকালীন স্বামী নামক পুরুষ কর্তাটি নিজের যৌন ক্ষুধা নিবারণ থেকে সেই মুহূর্তে কিম্বা সেইদিনগুলিতে নিজেকে বিরত রাখেন। স্ত্রীকে জোর করেই সেই মুহূর্তে স্বামীর যৌন সঙ্গী হতে হয়, এক্ষেত্রে স্ত্রীকে সুখী করা কিম্বা পূর্ণ তৃপ্তি দেওয়ার বিষয়টিও স্বামীর দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা। কখনও কোন স্বামী প্রশ্ন করেন বলে শুনিনি যে ঠিক একইভাবে একই সময়ে তার যৌন সঙ্গীটি এই কর্ম থেকে সমানভাবে আনন্দ লাভ করেছেন কিনা। এর কারণ নিহিত রয়েছে পুরুষতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে । মূলতঃ স্ত্রী হল যৌন দাসী, তার এ বিষয়ে ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভাল লাগা মন্দ লাগা এসব অনুভূতির কথা আসাটাই অপ্রাসাংগিক। স্ত্রী মুখ ফুটে এ সম্মন্ধে তার মতামত প্রকাশ করবে পুরুষতন্ত্রে এটাকে ধৃষ্টতা বলেই স্বীকৃত হয়। স্ত্রী মানেই তো দাসী, সে সব বিষয়ে স্বামীর সেবাশুশ্রূষা করে মনোরঞ্জন করে জীবন কাটিয়ে দেবে পুরুষতন্ত্র এটাই দেখতে চায়। সুতরাং, যৌন কর্মটি হল স্বামীর মনোরঞ্জনের একটি বিষয়, স্বামী কর্তা এটি দেবেন, আর স্ত্রী পাত পেতে নেবেন। স্বামী যে দেবেন এটাই তো অনেক বড় বিষয়। এটি স্বামীদেবতার উদারতা। এখানে স্বামীপ্রভুটি দাতা। তাই স্ত্রী দাতার দান মন-শরীর না চাইলেও, না সায় দিলেও তাকে ফিরিয়ে দেবার কিম্বা মুখের ওপরে ‘না’ বলার সাহস-শক্তি অর্জন করেনি। তাই তাকে গ্রহীতার ভূমিকায়ই থাকতে হয়। আর সেভাবেই হাজার বছর ধরে সমাজের নানাবিধ প্রথা-সংস্কার-আচার-বিচার চলে আসছে। ধর্ষণের সংজ্ঞা যদি হয় নারী- পুরুষ কারো অসম্মতিতে অনিচ্ছাতে কাউকে জোর করে যৌনকর্মে বাধ্য করা তবে আমি বলব আমাদের দেশের বিবাহিত নারীরা প্রতিঘরে প্রতিদিন প্রতিরাতে স্বামীর বিছানায় ধর্ষিত হচ্ছে।
বিবাহিত নারী স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। স্বামী তাকে ছিঁড়ে কামড়ে গিলে যেমন খুশী খেতে পারেন। মোদ্দা কথা নারী মানেই তো এক খাদ্যদ্রব্য; একতাল মাংসপিণ্ড। এই খাবার খেতে গিয়ে বুদ্ধিমান পুরুষ কৌশলে, মিষ্টি কথায়, দামী উপহারে, দায়িত্ব নেবার কিম্বা ভালবাসার ছল করে তাকে ভোগ করছে। ক্ষেত্র বিশেষে সহানুভূতি দেখাচ্ছে, সম্মান জানানোর ভান করছে। আর ধর্ষকরা কোনোরূপ কৌশল ছাড়াই কিছুই বিনিময় না করেই এই সুস্বাদু খাবার প্রতিদিন খাচ্ছে। কোনরূপ ভণিতা ছাড়াই প্রভুত্ব খাটায়, সম্পত্তির মালিকানা দেখায়। কারণ, নিজের সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার নিজেরই। সুতরাং যখন খুশী, যেভাবে খুশী সে ভোগ করবে, তার বিনিময় মূল্য বলে কিছু নেই। কারণ, বিবাহ নামক এক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত দলিল বলে নারীকে চিরদিনের জন্য ভোগ দখলের অধিকার পেয়ে যায় স্বামীটি । আর তাই প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নারীটিকে ভালবাসাবিহীন যৌন সম্ভোগের অধিকার রয়েছে তার । এমন ঘটনা অহরহ দেখেছি, শুনেছি যে স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে স্বামী মহাপুরুষটি ঘরে বান্ধবী, অফিসের কলিগ, কিম্বা প্রতিবেশী যে কারো সাথে বিছানায় যেতে পারেন। স্ত্রী গর্ভবতী হলেও এমন ঘটনা খুবই সচারচার; এমনকি বাসার কাজের মেয়েরাও বাদ যায় না সেসব ক্ষেত্রে। অতি আশ্চর্যজনকভাবে সত্য হল সমাজও এ বিষয়টি মেনে নিয়েছে। অনেক নারী তার স্বামীর এ কূকর্মের কথা জেনেও কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করেনা। সে কী শুধু ভাত-কাপড়-আশ্রয় হারানোর ভয়ে নাকি পুরুষতন্ত্রের শেখানো মন্ত্রের কারণে ছাড় দিয়ে দেন স্বামী দেবতাকে? স্বামীর সাথে যৌন দাসত্ব ছাড়াও কোন কোন নারীকে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনও সহ্য করতে হয় স্বামীর সংসারে। কেবল দুবেলা দুমুঠো খেতে পারার জন্য নয়, সমাজ- পরিবার-সন্তানের কথা ভেবে অনেক নারীই সেই ধর্ষক- নিপীড়ক স্বামীর সাথে জীবন পার করে দেয়। কিন্তু নারীর এই মেনে নেওয়া এই সহনশীলতা ধর্ষক পুরুষ কোন কালেই সম্মানের চোখে দেখেনি; বরং এটাকেই নারীর দুর্বলতা ভেবেছে। এটার মূল শেকড়ও নিহিত রয়েছে পুরুষতন্ত্রের গভীরে। নারী যেখানে মানুষ বলেই স্বীকৃত নয়, সেখানে নারীর ত্যাগ তিতিক্ষার আর ভালবাসার মূল্য কোথায় ?
ধরা যাক এমন এক জোড়া স্বামী-স্ত্রীর কথা; যেখানে স্ত্রীটি পড়াশোনা জানে, ভাল রোজগার করে; কথাবার্তায় চাল চলনে মন্দ নয়, মোটামুটি স্মার্ট বলা যায় । অনেকটা খোলা মনের -উদার, সমাজ সচেতন, অনেক বেশি হৈচৈ হাসি আনন্দ বেড়ানো- আড্ডা প্রিয়, রক্ষনশীলতা একেবারেই নেই, তবে উগ্র নয় কোনক্রমেই। অপরপক্ষে, স্বামী ব্যাক্তিটি বাইরে বেশ পরিপাটি, ভদ্র, সামাজিক, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল, খুব স্বল্পভাষী, জীবন ও জগতের অনেক কিছুর প্রতিই সে উদাসীন, তার বৈষয়িক জ্ঞান খুব সীমিত, পড়াশোনার আর রোজগারের দৌড় স্ত্রীর থেকে পেছনে, ধর্মীয় রক্ষনশীলতা তীব্র (বলা বাহুল্য স্ত্রীর প্রতি আচরণ কেমন হবে); কিন্তু এরা দুজন নারী ও পুরুষ। আবার সমাজের বেধে দেওয়া নিয়মে স্বামী-স্ত্রীও বটে । জীব জগতের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এদেরও শরীরের চাহিদা থাকার কথা। একজন আরেকজনকে কাছে টানার কথা, কিন্তু স্বভাবে এত বৈপরীত্য নিয়ে শুধুমাত্র যৌন চাহিদার কারণে কি একটি সম্পর্ক টিকে থাকতে পারে নাকি থাকে কেবল বিবাহ নামক খাঁড়াটি মাথার ওপরে ঝুলছে বলে? আর এই ক্ষেত্রে যদি এদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক হতে থাকে সেটি কি ধর্ষণ নয়, নিপীড়ন নয় ?
এই গল্পের সবচেয়ে জলন্ত সত্য হল স্ত্রীটি প্রতিরাতে না হলেও প্রায়শঃই স্বামীটির যৌন আনন্দের দাসত্ব করে; যদিও বিবাহের রাতেই জেনেছিল স্বামীটি অক্ষম, মেয়েটির যৌন ক্ষুধা মেটাতে পারেনা। অনেকদিন অপেক্ষা করে প্রায় দুবছর পাড় করে স্বামীকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বলেছিল চিকিৎসার জন্য। অনেক কৌশল করে নিয়েও গিয়েছিল চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু পরিণাম… ভয়াবহ দুর্ব্যবহার…মেয়েটিকে তার ভদ্র স্বামী বলেছিল ‘বেশ্যা’। বেশ্যারা স্বামীর আদরে তুষ্ট হয়না, তাদের অনেক বেশি চাই, নির্লজ্জ… স্বামীর কাছে কিভাবে মুখ ফুটে বল যে স্বামী যা দিচ্ছে তাতে তুমি খুশী না, এটা কোন ভদ্র মেয়েরা বলেনা। আর এভাবেই সেই থেকে রচিত হয়েছিল তার বুকের ভেতর হাজারো স্বপনের সমাধি। মেয়েটি এখনো কারো সাথে কথা বললেও স্বামী ব্যাক্তির মনে হয় তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অবৈধ হস্তক্ষেপ। সুতরাং সে ছেড়ে কথা কয়না, অনেক নোংরা মন্তব্য করে, গালিগালাজ করে, কিন্তু মেয়েটিকে মুক্তি দেয়না কিম্বা ডিভোর্সের কথাও ভাবেনা। মেয়েটি কেন এত কিছুর পরেও এই স্বামীকে ত্যাগ করেনা সেটাও প্রশ্ন; তবে আজ আপনাদের কাছে প্রশ্ন স্বামীর এই আচরণকে এহেন ব্যবহারকে আপনারা কী বলেন ভালবাসা, স্বামীত্ব নাকি পুরুষতন্ত্র?