হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা যদি না থাকে তবে ঘরের ভেতরের মূর্তি আর
কোরানে তফাৎ কোথায় ? আপনি জোর করে কারো ঘর থেকে কোরান আর মূর্তি আলাদা করতে
পারেন, কিন্তু এমন কি ক্ষমতা আছে যে, যা দিয়ে তার মন থেকে আপনি মূর্তি বা
কোরাণ আলাদা করতে পারেন। কারো শরিয়ত থেকে মারিফত আলাদা করতে পারেন। যে
দম্পতিকে ঘরে একসাথে কোরান ও মূর্তি রাখার দায়ে অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার
করা হল, এই মুহুর্তে জানা দরকার ছিল আসলে তারা জন্মসূত্রে মুসলিম হয়ে কেন
ঘরে মূর্তি রাখতেন। তারা কি মনে করে এক সাথে দুটি বিষয়কেই নিজ গৃহে স্থান
দিয়েছেন। কিভাবে তারা তাদের হৃদয়ের মন্দির আর কাবার দুরত্ব গুছিয়ে ফেলেছেন।
এটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।
আমি গ্রামে অনেক জন্মসূত্রে মুসলিম দেখেছি, যারা কবিরাজি বা বিভিন্ন গায়েবি অধিবিদ্যার কাজে জড়িত, যারা কারো সাপের কামড়ের ঝাঁড়ফুক করতে আসলে মুখে মা মনসার নাম নিত, কামরুপ কামাক্ষা বলে বার বার প্রণাম করত, একই সাথে বড় পীর আব্দুল করিম জিলানীর নাম নিত, আবার ৩৬০ আউলিয়া সহ বাবা শাহজালাল আউলিয়ার নাম ও নিত। এদেরকে কেউ কখনো কিছুতে আপত্তি করত না। এমনকি সামাজিক কাজের অংশগ্রহণে ও না ।
আমাদের রাষ্ট্র যে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে, সেই অনুযায়ী, একই প্রগ্রামে কোরান তেলাওয়াত পাঠ হয়, গীতা পাঠ, ত্রিপিটক ও বাইবেল পড়ানো হয়। অনেক বিশ্ববিদ্যলয়ে একই সাথে মন্দির থাকে , মসজিদ থাকে। এতো দিন পর্যন্ত এই ছিল অবস্থা। কারো ঘরে মূর্তি বা একই সাথে কোরান রাখতে পারবে কি না, এই নিয়ে কোন বিধি জানা মতে নাই ।ব্যাপারটা পুরোপুরিই সামাজিক। এই সামাজিক বিষয়ের উপর পুলিশি হস্তক্ষেপ তথা রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হল রাষ্ট্রের সাথে ধর্ম যোগ। রাষ্ট্রের সেই অধিকার নাই। কারন কেন একজন লোক তার ঘরে দুটি ভিন্ন ধর্মের জিনিস রাখল সেটার তো কোন আইনি ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। তবে সামাজিক জাজ হতে পারে। সামাজিক জাজ অনুযায়ী ব্যাক্তি পাপের শিকার হবে কিন্তু রাষ্ট্রীয় জাজ অনুযায়ী ব্যাক্তি অপরাধের শিকার হচ্ছেন। পাপ আর অপরাধ এক নয়। তার বিচার ও এক নয়।রাষ্ট্র পাপের দায়ে অপরাধের বিচার করতে পারে না।এটা অন্যায়। এটি হতে পারে না। কথা এই জায়গায় বলা দরকার। তবে আরেকটি বিষয় আছে তা হল, ঐ ব্যাক্তির নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রকে পাশে থাকতে হবে। যদি রাষ্ট্র বাক স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন। সে যদি ব্লাস্ফেমিতে বিশ্বাস করে তাহলে ভিন্ন প্রশ্ন।
এবার আমরা দেখি, ভিন্ন ধর্মের উপাদান রাখার দায়ে রাষ্ট্র যদি ঐ দম্পতিকে গ্রেফতার করতে পারে তাহলে তারা আর কি কি বিষয় আমলে নিতে পারে। যদি রাষ্ট্র এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে তাহলে, তাকে অবশ্যই সবার আগে,আকবরের চিন্তা দর্শন নিয়ে কথা বলতে হবে। দীন-ই-ইলাহি ছিল সকল ধর্মের সারমর্ম নিয়ে একটি মানবিক দার্শনিক চিন্তা। তাকে কথা বলতে হবে, লালনের ভাবদর্শন নিয়ে কারন এটি এমন একটি ভাবদর্শন, যেখানে এমন একটি মানব সমাজ সৃজনের কথা বলা হয়েছে যেখানে কোন ধর্মভেদ থাকবে না । কথা বলতে হবে মধ্য যুগের কবি, চন্ডীদাসের বিখ্যাত লাইন 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই' এই লাইন নিয়ে। কথা বলতে হবে, শাহজালালের মাজারে কেন, সকল ধর্মের মানুষ যাবে সেটা নিয়ে। নজরুলকে নিয়ে ও আরো কথা বলার আছে। নজরুল হিন্দু মুসলিমের অপূর্ব সম্মিলন চেয়েছিলেন,যেমন তিনি বলেছিলেন, ''এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই'' । কারো ঘরের মূর্তি আর কোরানের চেয়ে এগুলো অনেক বেশি ক্ষমতাবান অবস্থান নিয়ে আছে সমাজে।মানুষের ভেতরে। রাষ্ট্রের পুলিশ দিয়ে তার কতটুকু ভাঙ্গবে বা গ্রেফতার করবে? তবে এখানে ভাঙ্গার চেয়ে প্রশ্ন হল-রাষ্ট্র সেটা ভাঙ্গার অধিকার আছে কি না?
একইভাবে, রাষ্ট্র আরো অনেক কিছুতেই এই যুক্তিতে বাঁধা দিতে পারে। যেহেতু একজন শিশু অন্যের দ্বারা প্রভাবিত পারে সেজন্য তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ভিন্ন ধর্মের শিশুর সাথে মেলা মেশাকে ও বন্ধ করে দিতে পারে। হিন্দু শিশুকে ঈদ উপভোগ আর মুসলিম শিশুকে পুজা উপভোগেও বাঁধা দিতে পারে। গান শোনা বন্ধ করে দিতে পারে। এমনকি পারে, পহেলা বৈশাখ ও বন্ধ করে দিতে পারে।
এই যে দম্পতি গ্রেফতার এটি হল আমাদের সেকুলার সমাজের সাথে বর্তমান নন-সেক্যুলার রাষ্ট্রের দ্বন্দ। দিন দিন রাষ্ট্র ও সমাজের দ্বন্দে পিছিয়ে যাচ্ছে সমাজ। এগিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র মহাপরাক্রমশালী হয়ে সমাজের ভেতরটা শুকিয়ে মেরে ফেলছে। এটাই সেক্যুলার সমাজের সাথে নন –সেক্যুলার রাষ্ট্রের দ্বন্দ। অন্যদিকে বলা যায়, পাওয়ার ডিসকোর্সের কেন্দ্র হিসেবে রাষ্ট্র যা ক্রমাগত ডিসিপ্লিন তৈরির নামে , মেকানিকাল হয়ে উঠছে। রাষ্ট্র যত আধুনিক হচ্ছে, ততই সে নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়ছে ব্যাক্তির সব কিছুর উপরে। ফুঁকো, যাকে বলতেন পাওয়ার অফ সার্ভিলেন্স। আপনি কি কি করবেন, সব রাষ্ট্রের কাছেই ডকুমেন্টেড হবে। এমনকি আপনার বেড রুমে কি করছেন, সেটা ও রাষ্ট্রের দেখভাল করার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তাই হচ্ছে আদতে।
বাংলাদেশ জন্মের আগে অনেকগুলো সেক্যুলার উপাদান নিয়ে তার সামাজিক বিকাশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রাক-ঐতিহাসিক উপাদান বাদ দিলেও দেখা যাবে যে, ১৯৫২ সালে এই দেশ সংগ্রাম করেছে ভাষা মুক্তির প্রশ্নে। ভাষা একটা সেক্যুলার উপাদান। তার পরে আমরা একটা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছি, দেশের জন্য। দেশ ও একটি সেক্যুলার উপাদান। বাংলাদেশ নামক সমাজ তার ভেতর থেকে বার বার অনেক সেক্যুলার উপাদানের জন্ম দিয়েছে, মানুষকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই রাষ্ট্র কখনো সমাজটাকে সেক্যুলার পথে বিকশিত করতে পারে নাই। সমাজ তার পেটে সেকুলার উপাদান নিয়ে রাষ্ট্রের নন-সেক্যুলার উপাদানের পীড়ন মাথায় বহন করে চলছে। স্বাধীনতার পর থেকে এটি বেশি হচ্ছে। অথচ ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, ফরাসী সমাজ ধর্ম ও যাজক তন্ত্রের বিরুদ্ধে ( আরো অনেক উপাদান ছিল, তবে এটা মুখ্য ছিল) যুদ্ধ করে সেক্যুলার রাষ্ট্র ও সমাজ দুটোই নির্মাণ করতে পেরেছে। তারা করেছে ধর্ম নিয়ে, আমরা করেছি ভাষা বা দেশের মত সেক্যুলার উপাদান নিয়ে। কিন্তু ফলাফল উলটো ঘটেছে। আমরা সেক্যুলার উপাদান নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন হাঁটছি একটি কমিউনাল, নন-সেক্যুলার, অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে আর ফরাসী সমাজ নন –সেক্যুলার (মুখ্যত) উপাদানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে হাঁটছে সেক্যুলার সমাজের দিকে। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের এই বিস্তর ব্যবধানের ফারাক গুছানোর ক্ষেত্রে আসল বিষয় হল এই জায়গাটি। কেন আমরা ইতিহাসের পশ্চাতে হাঁটছি? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে আগামি দিনের বাংলাদেশ নির্ভর করছে। নির্ভর করছে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রাদায়িক দেশ নির্মাণের বাস্তব সমস্যা গুলো। নির্ভর করছে কারো ঘরে কোরান নাকি পুরাণ থাকল সেটা নিয়ে মাথাব্যাথা থাকা না থাকা ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র বর্তমান সময়ে একটা প্লুরাটির (সমাজ) ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র সেখানে প্লুরাটির ক্রাইসিস নিয়ন্ত্রনে ব্যার্থ হয়ে দিন দিন নিপীড়ণ মূলক হয়ে উঠছে। আমরা যদি গত ২০০০-২০১৫ সাল পর্যন্ত কিছু বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে কিছু বিষয় চোখে পড়বে মোটা দাগে। এখানে সামাজিক মিডিয়া বা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা শিক্ষিত মানুষের কমিউনিকেশনের এ্যাকসেস এতো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে, যা আমরা হঠাৎ প্রত্যক্ষ করছি। এখানে যে কোন বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্য খুব উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বাক স্বাধীনতার বিষয়টা সামনে এসেছে জোড়ালোভাবে। এখানে, মতামত উন্মুক্ত হবার কারনে, নাস্তিক বনাম আস্তিক বা সেক্যুলার বনাম নন-সেক্যুলার, ধর্ম যুক্ত চিন্তা বনাম ধর্ম বিযুক্ত চিন্তা ক্রমাগত বাড়ছে। শুধু বাড়ছে বললে ভুল হবে। এটা এখন একটা টেনশন পর্যায়ে আছে। এই সময়ে, ৪২ বছরের অসাধ্য একটা বিষয়, যুদ্ধাপরাধির বিচার হচ্ছে যার মূল নায়ক অনলাইন আর ব্লগের কর্মীরা। ফলে প্রথাগত রাজনৈতিক দলের বিপরীতে একটা মতামত তৈরির অবস্থান খুব শক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে। এটা খুব লক্ষনীয়। আগে দেশের যে কোন ইস্যু পরিচালিত হত রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের ভেতরে। কিন্তু বর্তমানে এটা অনলাইনেই জাজ হয়ে যাচ্ছে, এমনকি আগে দলের একজন কর্মী নেতার দিকে তাকিয়ে থাকত সিদ্ধান্ত বা মতামতের জন্য কিন্তু বর্তমানে অনলাইন এই ভিত্তিকে দিন দিন ভেঙ্গে দিচ্ছে। সামাজিক মিডিয়াতেই মতামত তৈরি হচ্ছে, এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবনতায় ব্যাক্তি স্বাধীনতার জোড়ালে প্রকাশ পাচ্ছে । এই সময়ে, দেশের বিরাট সংখ্যক মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, তারা কর্মমুখী হচ্ছে, ফলে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি ক্রমাগত বাড়ছে। দেশে বর্তমানে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের উপর একটা রাষ্ট্রীয় বৈষম্য চলছে। এটা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্পের কারনে অর্থনীতির উল্লম্পন বাড়ছে। সম্পদের বৈষম্যের চাপ বাড়ছে। এই প্রতিটা বিষয় যে দেশে আগে ঘটে নি তা নয় কিন্তু বর্তমান সময়ের এই সবের একটা উল্লম্ফন ঘটার সময় যাচ্ছে । প্রতিটা বিষয়ের গতিপথ এস্টাবলিস্টমেন্ট্রের দিকে। বাক স্বাধীনতা থাকবে কিনা? নাস্তিকের কথা বলার অধিকার আছে কিনা? মেয়েদের সমানাধিকার পাবে কি না? শ্রমিকরা কতটুকু অধিকার পাবে এসব নিয়ে টেনশন বাড়ছে। রাষ্ট্র ক্রমাগত এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য উপায় না খুঁজে, আলোচনা না করে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে। নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে।
আজ এই সমাজের দম্পতি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের নির্যাতনের ভুল শিকার। এভাবে অনেকেই শিকার হবেন সামনে। যেভাবে শিকার হয়েছিলেন প্রবীর শিকদার বা ব্লগাররা। যেভাবে হয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতারা। বাদ যাবেন না কেউ। কেউ রাজনীতির নামে। কেউ ধর্মের নামে। শুধুই নিয়ন্ত্রনে পড়বেন। এজন্য সামাজিক উপাদান ভাষা, দেশ, লালন, হাছন, নজরুলকে রাষ্ট্রের সামনে নিয়ে আসতে হবে। এমনকি ধর্মের সামজিক উপাদানকে ও সামনে নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে, সমাজকে গলা টিপে ধরবে রাষ্ট্র । এখন একই ধর্মের দম্পতি যেমন কোরান আর মূর্তির জন্য আটক হয়েছেন। সামনে ভিন্ন ধর্মের দম্পতিরা এক সাথে থাকার জন্য ও আটক হবেন। রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে যায় এমন সব কিছুকেই কেবল আটকে দিতে চাইবে ।
আমি গ্রামে অনেক জন্মসূত্রে মুসলিম দেখেছি, যারা কবিরাজি বা বিভিন্ন গায়েবি অধিবিদ্যার কাজে জড়িত, যারা কারো সাপের কামড়ের ঝাঁড়ফুক করতে আসলে মুখে মা মনসার নাম নিত, কামরুপ কামাক্ষা বলে বার বার প্রণাম করত, একই সাথে বড় পীর আব্দুল করিম জিলানীর নাম নিত, আবার ৩৬০ আউলিয়া সহ বাবা শাহজালাল আউলিয়ার নাম ও নিত। এদেরকে কেউ কখনো কিছুতে আপত্তি করত না। এমনকি সামাজিক কাজের অংশগ্রহণে ও না ।
আমাদের রাষ্ট্র যে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে, সেই অনুযায়ী, একই প্রগ্রামে কোরান তেলাওয়াত পাঠ হয়, গীতা পাঠ, ত্রিপিটক ও বাইবেল পড়ানো হয়। অনেক বিশ্ববিদ্যলয়ে একই সাথে মন্দির থাকে , মসজিদ থাকে। এতো দিন পর্যন্ত এই ছিল অবস্থা। কারো ঘরে মূর্তি বা একই সাথে কোরান রাখতে পারবে কি না, এই নিয়ে কোন বিধি জানা মতে নাই ।ব্যাপারটা পুরোপুরিই সামাজিক। এই সামাজিক বিষয়ের উপর পুলিশি হস্তক্ষেপ তথা রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হল রাষ্ট্রের সাথে ধর্ম যোগ। রাষ্ট্রের সেই অধিকার নাই। কারন কেন একজন লোক তার ঘরে দুটি ভিন্ন ধর্মের জিনিস রাখল সেটার তো কোন আইনি ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। তবে সামাজিক জাজ হতে পারে। সামাজিক জাজ অনুযায়ী ব্যাক্তি পাপের শিকার হবে কিন্তু রাষ্ট্রীয় জাজ অনুযায়ী ব্যাক্তি অপরাধের শিকার হচ্ছেন। পাপ আর অপরাধ এক নয়। তার বিচার ও এক নয়।রাষ্ট্র পাপের দায়ে অপরাধের বিচার করতে পারে না।এটা অন্যায়। এটি হতে পারে না। কথা এই জায়গায় বলা দরকার। তবে আরেকটি বিষয় আছে তা হল, ঐ ব্যাক্তির নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রকে পাশে থাকতে হবে। যদি রাষ্ট্র বাক স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন। সে যদি ব্লাস্ফেমিতে বিশ্বাস করে তাহলে ভিন্ন প্রশ্ন।
এবার আমরা দেখি, ভিন্ন ধর্মের উপাদান রাখার দায়ে রাষ্ট্র যদি ঐ দম্পতিকে গ্রেফতার করতে পারে তাহলে তারা আর কি কি বিষয় আমলে নিতে পারে। যদি রাষ্ট্র এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে তাহলে, তাকে অবশ্যই সবার আগে,আকবরের চিন্তা দর্শন নিয়ে কথা বলতে হবে। দীন-ই-ইলাহি ছিল সকল ধর্মের সারমর্ম নিয়ে একটি মানবিক দার্শনিক চিন্তা। তাকে কথা বলতে হবে, লালনের ভাবদর্শন নিয়ে কারন এটি এমন একটি ভাবদর্শন, যেখানে এমন একটি মানব সমাজ সৃজনের কথা বলা হয়েছে যেখানে কোন ধর্মভেদ থাকবে না । কথা বলতে হবে মধ্য যুগের কবি, চন্ডীদাসের বিখ্যাত লাইন 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই' এই লাইন নিয়ে। কথা বলতে হবে, শাহজালালের মাজারে কেন, সকল ধর্মের মানুষ যাবে সেটা নিয়ে। নজরুলকে নিয়ে ও আরো কথা বলার আছে। নজরুল হিন্দু মুসলিমের অপূর্ব সম্মিলন চেয়েছিলেন,যেমন তিনি বলেছিলেন, ''এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই'' । কারো ঘরের মূর্তি আর কোরানের চেয়ে এগুলো অনেক বেশি ক্ষমতাবান অবস্থান নিয়ে আছে সমাজে।মানুষের ভেতরে। রাষ্ট্রের পুলিশ দিয়ে তার কতটুকু ভাঙ্গবে বা গ্রেফতার করবে? তবে এখানে ভাঙ্গার চেয়ে প্রশ্ন হল-রাষ্ট্র সেটা ভাঙ্গার অধিকার আছে কি না?
একইভাবে, রাষ্ট্র আরো অনেক কিছুতেই এই যুক্তিতে বাঁধা দিতে পারে। যেহেতু একজন শিশু অন্যের দ্বারা প্রভাবিত পারে সেজন্য তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ভিন্ন ধর্মের শিশুর সাথে মেলা মেশাকে ও বন্ধ করে দিতে পারে। হিন্দু শিশুকে ঈদ উপভোগ আর মুসলিম শিশুকে পুজা উপভোগেও বাঁধা দিতে পারে। গান শোনা বন্ধ করে দিতে পারে। এমনকি পারে, পহেলা বৈশাখ ও বন্ধ করে দিতে পারে।
এই যে দম্পতি গ্রেফতার এটি হল আমাদের সেকুলার সমাজের সাথে বর্তমান নন-সেক্যুলার রাষ্ট্রের দ্বন্দ। দিন দিন রাষ্ট্র ও সমাজের দ্বন্দে পিছিয়ে যাচ্ছে সমাজ। এগিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র মহাপরাক্রমশালী হয়ে সমাজের ভেতরটা শুকিয়ে মেরে ফেলছে। এটাই সেক্যুলার সমাজের সাথে নন –সেক্যুলার রাষ্ট্রের দ্বন্দ। অন্যদিকে বলা যায়, পাওয়ার ডিসকোর্সের কেন্দ্র হিসেবে রাষ্ট্র যা ক্রমাগত ডিসিপ্লিন তৈরির নামে , মেকানিকাল হয়ে উঠছে। রাষ্ট্র যত আধুনিক হচ্ছে, ততই সে নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়ছে ব্যাক্তির সব কিছুর উপরে। ফুঁকো, যাকে বলতেন পাওয়ার অফ সার্ভিলেন্স। আপনি কি কি করবেন, সব রাষ্ট্রের কাছেই ডকুমেন্টেড হবে। এমনকি আপনার বেড রুমে কি করছেন, সেটা ও রাষ্ট্রের দেখভাল করার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তাই হচ্ছে আদতে।
বাংলাদেশ জন্মের আগে অনেকগুলো সেক্যুলার উপাদান নিয়ে তার সামাজিক বিকাশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রাক-ঐতিহাসিক উপাদান বাদ দিলেও দেখা যাবে যে, ১৯৫২ সালে এই দেশ সংগ্রাম করেছে ভাষা মুক্তির প্রশ্নে। ভাষা একটা সেক্যুলার উপাদান। তার পরে আমরা একটা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছি, দেশের জন্য। দেশ ও একটি সেক্যুলার উপাদান। বাংলাদেশ নামক সমাজ তার ভেতর থেকে বার বার অনেক সেক্যুলার উপাদানের জন্ম দিয়েছে, মানুষকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই রাষ্ট্র কখনো সমাজটাকে সেক্যুলার পথে বিকশিত করতে পারে নাই। সমাজ তার পেটে সেকুলার উপাদান নিয়ে রাষ্ট্রের নন-সেক্যুলার উপাদানের পীড়ন মাথায় বহন করে চলছে। স্বাধীনতার পর থেকে এটি বেশি হচ্ছে। অথচ ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, ফরাসী সমাজ ধর্ম ও যাজক তন্ত্রের বিরুদ্ধে ( আরো অনেক উপাদান ছিল, তবে এটা মুখ্য ছিল) যুদ্ধ করে সেক্যুলার রাষ্ট্র ও সমাজ দুটোই নির্মাণ করতে পেরেছে। তারা করেছে ধর্ম নিয়ে, আমরা করেছি ভাষা বা দেশের মত সেক্যুলার উপাদান নিয়ে। কিন্তু ফলাফল উলটো ঘটেছে। আমরা সেক্যুলার উপাদান নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন হাঁটছি একটি কমিউনাল, নন-সেক্যুলার, অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে আর ফরাসী সমাজ নন –সেক্যুলার (মুখ্যত) উপাদানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে হাঁটছে সেক্যুলার সমাজের দিকে। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের এই বিস্তর ব্যবধানের ফারাক গুছানোর ক্ষেত্রে আসল বিষয় হল এই জায়গাটি। কেন আমরা ইতিহাসের পশ্চাতে হাঁটছি? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে আগামি দিনের বাংলাদেশ নির্ভর করছে। নির্ভর করছে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রাদায়িক দেশ নির্মাণের বাস্তব সমস্যা গুলো। নির্ভর করছে কারো ঘরে কোরান নাকি পুরাণ থাকল সেটা নিয়ে মাথাব্যাথা থাকা না থাকা ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র বর্তমান সময়ে একটা প্লুরাটির (সমাজ) ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র সেখানে প্লুরাটির ক্রাইসিস নিয়ন্ত্রনে ব্যার্থ হয়ে দিন দিন নিপীড়ণ মূলক হয়ে উঠছে। আমরা যদি গত ২০০০-২০১৫ সাল পর্যন্ত কিছু বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে কিছু বিষয় চোখে পড়বে মোটা দাগে। এখানে সামাজিক মিডিয়া বা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা শিক্ষিত মানুষের কমিউনিকেশনের এ্যাকসেস এতো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে, যা আমরা হঠাৎ প্রত্যক্ষ করছি। এখানে যে কোন বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্য খুব উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বাক স্বাধীনতার বিষয়টা সামনে এসেছে জোড়ালোভাবে। এখানে, মতামত উন্মুক্ত হবার কারনে, নাস্তিক বনাম আস্তিক বা সেক্যুলার বনাম নন-সেক্যুলার, ধর্ম যুক্ত চিন্তা বনাম ধর্ম বিযুক্ত চিন্তা ক্রমাগত বাড়ছে। শুধু বাড়ছে বললে ভুল হবে। এটা এখন একটা টেনশন পর্যায়ে আছে। এই সময়ে, ৪২ বছরের অসাধ্য একটা বিষয়, যুদ্ধাপরাধির বিচার হচ্ছে যার মূল নায়ক অনলাইন আর ব্লগের কর্মীরা। ফলে প্রথাগত রাজনৈতিক দলের বিপরীতে একটা মতামত তৈরির অবস্থান খুব শক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে। এটা খুব লক্ষনীয়। আগে দেশের যে কোন ইস্যু পরিচালিত হত রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের ভেতরে। কিন্তু বর্তমানে এটা অনলাইনেই জাজ হয়ে যাচ্ছে, এমনকি আগে দলের একজন কর্মী নেতার দিকে তাকিয়ে থাকত সিদ্ধান্ত বা মতামতের জন্য কিন্তু বর্তমানে অনলাইন এই ভিত্তিকে দিন দিন ভেঙ্গে দিচ্ছে। সামাজিক মিডিয়াতেই মতামত তৈরি হচ্ছে, এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবনতায় ব্যাক্তি স্বাধীনতার জোড়ালে প্রকাশ পাচ্ছে । এই সময়ে, দেশের বিরাট সংখ্যক মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, তারা কর্মমুখী হচ্ছে, ফলে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি ক্রমাগত বাড়ছে। দেশে বর্তমানে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের উপর একটা রাষ্ট্রীয় বৈষম্য চলছে। এটা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্পের কারনে অর্থনীতির উল্লম্পন বাড়ছে। সম্পদের বৈষম্যের চাপ বাড়ছে। এই প্রতিটা বিষয় যে দেশে আগে ঘটে নি তা নয় কিন্তু বর্তমান সময়ের এই সবের একটা উল্লম্ফন ঘটার সময় যাচ্ছে । প্রতিটা বিষয়ের গতিপথ এস্টাবলিস্টমেন্ট্রের দিকে। বাক স্বাধীনতা থাকবে কিনা? নাস্তিকের কথা বলার অধিকার আছে কিনা? মেয়েদের সমানাধিকার পাবে কি না? শ্রমিকরা কতটুকু অধিকার পাবে এসব নিয়ে টেনশন বাড়ছে। রাষ্ট্র ক্রমাগত এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য উপায় না খুঁজে, আলোচনা না করে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে। নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে।
আজ এই সমাজের দম্পতি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের নির্যাতনের ভুল শিকার। এভাবে অনেকেই শিকার হবেন সামনে। যেভাবে শিকার হয়েছিলেন প্রবীর শিকদার বা ব্লগাররা। যেভাবে হয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতারা। বাদ যাবেন না কেউ। কেউ রাজনীতির নামে। কেউ ধর্মের নামে। শুধুই নিয়ন্ত্রনে পড়বেন। এজন্য সামাজিক উপাদান ভাষা, দেশ, লালন, হাছন, নজরুলকে রাষ্ট্রের সামনে নিয়ে আসতে হবে। এমনকি ধর্মের সামজিক উপাদানকে ও সামনে নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে, সমাজকে গলা টিপে ধরবে রাষ্ট্র । এখন একই ধর্মের দম্পতি যেমন কোরান আর মূর্তির জন্য আটক হয়েছেন। সামনে ভিন্ন ধর্মের দম্পতিরা এক সাথে থাকার জন্য ও আটক হবেন। রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে যায় এমন সব কিছুকেই কেবল আটকে দিতে চাইবে ।