Thursday, September 10, 2015

"প্রশ্নের শক্তি : আরজ আলী মাতুব্বর" (১) -অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ

বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই। জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন।’



ধর্ম নিয়ে খোলা আলোচনা কিংবা বিশ্লেষণ বাংলাদেশের সমাজ-ক্ষমতা অনুমোদন করে না। কিন্তু আবার সমাজ, মানুষ, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, বন্ধন-নিপীড়ন-শৃঙ্খল এবং সেগুলো থেকে মুক্তি পাবার লড়াইয়ের বিষয় আলোচনা করতে গেলে ধর্মের প্রসঙ্গ এসেই যায়। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, একটা পথ পেতে গেলে ধর্মের প্রসঙ্গ নীরবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলে না। এর কারণ কী? কারণ ধর্ম একটা বিশ্বাস হিসেবে যেরূপই ধারণ করুক না কেন এই ধর্মের মধ্যে আসলে বসবাস করে সমাজ। বসবাস করে সমাজের নানা বিধি, নিয়মনীতি, নৈতিকতা, অনুশাসন। সমাজের, রাষ্ট্রের বিধিই উপস্থিত হয় ঐশ্বরিক বিধান হিসেবে, ধর্মরূপে। এই ধর্মের মধ্যেই আবার থাকে, যেভাবে মার্কস বলেছিলেন, ‘‘হৃদয়হীনের হৃদয়, নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস”।

ধর্ম নিয়ে আরজ আলীর ভাবনা বা গবেষণা, সর্বোপরি প্রশ্ন উত্থাপন কোন পরিকল্পিত কাজ নয়। বাস্তব জীবনে, শৈশবের একটা ধাক্কাই তাঁকে এই পথে নিয়ে আসে, প্রশ্নের মুখোমুখি তাঁকে দাঁড় করায়, প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তাঁকে ব্যস্ত রাখে আজীবন। তাঁর আলোচনা, প্রশ্ন, দার্শনিক বিশ্লেষণ আসলে শুধুই ধর্ম গ্রন্থ নিয়ে নয়। ধর্মের গ্রন্থ বা শাস্ত্র আর জনগণের মধ্যে তার উপস্থিতি এক নাও হতে পারে। গ্রন্থ বা ধর্ম জনগণের মধ্যে কীভাবে উপস্থিত তাকে নিয়েই আরজ আলী মাতুব্বরের বিশেষ মনোযোগ। বস্তুত : জনগণ কিভাবে ধর্মকে গ্রহণ করেন তা শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে না। শাস্ত্রই যদি ধর্ম নির্ধারণ করতো তাহলে একটি ধর্ম পৃথিবীর সর্বত্র এবং সর্বকালে একইরকম হতো। শাস্ত্র আসলে মানুষের বাস্তব জগতে ধর্মের একটি দিক গঠন করে, সেটাকে আমরা কাঠামো বলতে পারি। কিন্তু তার রক্তমাংস, মাথা-মগজ, শরীর, চোখ ইত্যাদি তৈরি করে তার দাঁড়ানোর জায়গা-তার সমাজ ও তার সংস্কৃতি, তার সময়। এই সবকিছুই আরজ আলীর মনোযোগ আকর্ষণ করে, কেননা তিনি এই সবকিছুর মধ্যে মানুষের শৃঙ্খল উপলব্ধি করেছিলেন এবং তার থেকে বেরুবার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলেন। সেভাবেই তৈরি হলেন আমাদের আরজ আলী মাতুব্বর।

শহুরে মধ্যবিত্ত কিংবা গ্রামীণ ক্ষমতাবান কারও কাছেই আরজ আলী মাতুব্বর গ্রহণযোগ্যতা পাননি। কারণ এদেশে মধ্যবিত্ত কিংবা বিদ্বৎসমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে সেখানে ভক্তি দিয়ে জগৎ-সংসার দেখাতেই তার স্বস্তি, তাতেই তার আসক্তি। এই ভক্তি যেমন সৃষ্টিকর্তা কিংবা ধর্মের প্রচলিত বয়ানের প্রতি, তেমনি এই ভক্তি প্রচলিত বা যাকে বলা চলে বিশ্বব্যাংকীয় উন্নয়ন দর্শনের প্রতিও। দুটোই তার আশ্রয়। এই আশ্রয়ের খোলসে নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য তার অস্থিরতা এখন আগের চাইতে বেশি। প্রশ্ন তাই তার জন্য বিপদের কারণ, অস্বস্তির কারণ। আরজ আলী মাতুব্বর তাই তাদের কাছে ভীতিকর। হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম বাদে ‘বুদ্ধিজীবীদের’ কাছে আরজ আলী গৃহিত হননি কারণ প্রথমত: তিনি তাদের ‘উঁচু নাকে’ টোকা দিয়েছেন এবং দ্বিতীয়ত: আরজ আলীর প্রশ্ন উত্থাপনের ভঙ্গী ও ক্ষেত্রকে তারা বিপজ্জনক বিবেচনা করেছেন।   

পা ভাঁজ করে মহাবিশ্ব দেখা  

আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের এক কোণে বড় হয়েছেন। সেই গ্রাম কোনদিক থেকেই বিশিষ্ট নয়। অন্য আর দশটা গ্রামের মতোই তার সবকিছু। সেখানে সুন্দর প্রকৃতি এবং নিষ্ঠুর সমাজ দুইই ছিল। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাও কোন অনন্য কিছু নয়। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের জীবনে এইরকম কাহিনী পাওয়া যাবে। তখন তো বটেই, এখনও। কী সেটা?

ছোটবেলায় বাবা মারা যান। মাকে নিয়ে যখন তাঁর হাবুডুবু অবস্থা তখন মহাজনী চাপে তাঁর বাবার কৃষিজমি যায়। ঘর ছিল “দৈর্ঘ্যে পাঁচ হাত ও প্রস্থে চার হাত। ঘরখানা তৈরির সরঞ্জাম ছিল ধৈঞ্চার চাল, গুয়াপাতার ছাউনী, মাদারের খাম, খেজুরপাতার বেড়া ও ঢেঁকিলতার বাঁধ। আর তারই মধ্যে ছিল ভাতের হাঁড়ি, পানির কলসী, পাকের চুলো, কাঁথা-বালিশ সবই। রাতে শুতে হতো পা গুটিয়ে। ঘুমের ঘোরে কখনো পা মেলে ফেললে হয়তো ভাতের হাঁড়ি কাত হয়ে পড়তো বা জলের কলসী পড়ে গিয়ে কাঁথা বালিশ ভিজে যেতো। একটি এঁটেকলা দ্বারা তখন আমরা মায়ে-পুতে পান্তাভাত খেতাম দুবেলা।”

এরকম অবস্থায় যারা বসবাস করেন তাদের জীবনের পরবর্তী অধ্যায় এর থেকে খুব ভিন্ন কিছু হয় না। কেননা এটা হলো এক দুষ্টচক্রের মতো। এই অবস্থার কারণেই জগতের সকল সুযোগ ও সম্ভাবনা থেকে তাঁদের বঞ্চিত থাকতে হয় আবার এই বঞ্চিত থাকার কারণেই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করা সম্ভব হয় না। নিজেদের মেধা, সৃজনশীলতা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়, অপচয় হয়, বিনষ্ট হয়। এই দুষ্টচক্রের থেকে আরজ আলী যে খুব বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তা নয়। তবে এরকম পা ভাঁজ করে শোয়ার অবস্থা থেকে যে তিনি বিশ্বকে দেখার ক্ষমতা আয়ত্ত করেছিলেন সেখানেই আরজ আলী মাতুব্বর হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ।    

আরজ আলী মাতুব্বরের গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। পরে এক মক্তব হয়। সেখানে তিনি কিছুদিন পড়েছেন কিন্তু বই খাতা কেনার পয়সা ছিল না। এরকম ভাঙাচোরা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে গেলেও পয়সা লাগে, পরিবারের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজন হয়। সেটা ছিল না বলে ‘মেধাবি ছাত্র’ বলে পরিচিত হবার কোন সুযোগ তিনি পাননি। এই প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রহের বাইরে থেকেই তাঁর বিদ্যাচর্চার প্রতি দুর্মর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। সেজন্য তাঁর শৈশবের সবচাইতে আনন্দদায়ক, উত্তেজনাকর ঘটনা ছিল জ্ঞাতিচাচার কাছ থেকে (বাংলা ১৩২১ সাল) সীতানাথ বসাক কৃত তৎকালীন ‘‘দুআনা দামের একখানা আদর্শলিপি বই’’ পাওয়া। নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন তা আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষের শৈশবের আনন্দ ও বেদনার স্মৃতি। তিনি বলছেন, “সেদিন আমি যে কতটুকু আনন্দ লাভ করেছিলাম, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবো না। সেদিনটি ছিলো আমার জীবনের সর্বপ্রথম বই হাতে ছোঁয়ার দিন। তাই আনন্দ-স্ফূর্তিতে আমার মনটা যেনো ফেটে যাচ্ছিলো। আমি বইখানা হাতে নিয়ে নৃত্য করতে করতে গিয়েছিলাম প্রতিবেশীর বাড়িতে সহপাঠীদের বইখানা দেখাতে। ...সারাক্ষণ পড়তাম ও সাথে সাথে রাখতাম। ...কিন্তু আমার সে সাধের সম্পত্তিটুকু রক্ষা করতে বিষাদ দেখা দিলো বর্ষাকালে। ...চালে বৃষ্টির পানি মানায় না। ...অল্প বৃষ্টির সময় যেখানে রাখতাম, বৃষ্টি বেশী হলে সেখান থেকে সরাতে হতো, অত্যধিক বৃষ্টি হলে কোথাও স্থান পেতাম না, তখন উপুড় হয়ে বইখানা রাখতাম বুকের নীচে।”        

আমাদের সমাজের অসংখ্য মানুষের এই অভিজ্ঞতা অভিন্ন হলেও এই লড়াইয়ে টিকে থাকার এবং ফলাফলের অভিজ্ঞতায় আরজ আলী ভিন্ন। ভয়াবহ কঠিন জীবন সংগ্রাম এবং অভাব অনটন তাঁর পুস্তকপ্রীতি আর কৌতুহল শেষ করতে পারে নি। আদর্শলিপি পাবার সাত বছরের মাথায় তিনি অনটনের মধ্যেও ‘পুঁথি-পুস্তক’ সংগ্রহ শুরু করেন। ১৮ বছরে তিনি বই সংগ্রহ করেছিলেন ৯০০; বইএর আলমারি ছিল না, কেনার সাধ্যও ছিল না। সেজন্যই এক ঘুর্ণিঝড়ে দুর্বল ঘরের সঙ্গে বইগুলোও উড়ে চলে যায়। উন্মাদের মতো চেষ্টা করেছিলেন বহু বছরে বহু কষ্টের সংগ্রহ পুনরুদ্ধার করতে। কিন্তু লাভ হয়নি-- “পরের দিন পথে-প্রান্তরে পেয়েছিলাম দু’চারখানা ছেঁড়া পাতা। মাতৃশোকে আমি কাঁদিনি, কিন্তু বইগুলোর দুঃখে সেদিন আমার যে কান্নার বান ডেকেছিলো, তা আমি রোধ করতে পারিনি।”  

হেরে না গিয়ে আবার বই সংগ্রহে নিয়োজিত হলেন। কিন্তু ঘরের উন্নতি না হওয়ায় বই পুস্তক নতুন ভাবে সংগ্রহ করবার ১৭ বছর পর একই ঘটনা তাঁর জীবনে আবারও ঘটলো। বলাই বাহুল্য, বই রাখতে গেলে শুধু ঘর থাকাই যথেষ্ট নয়, দরকার যথেষ্টই শক্তপোক্ত ঘর।   

আরজ আলী গ্রামীণ জগতে মানুষের প্রয়োজন এবং দৈনন্দিন কাজ ও সমস্যা থেকে কখনও বিযুক্ত হননি, হবার অবসরও পাননি। এই যুক্ততা ছিল তাঁর জীবন, ছিল তাঁর জীবিকা। তিনি আমিন-এর কাজ করতেন। গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন কাজের সুবিধার জন্য তিনি স্বল্প খরচের চুলাও তৈরি করেছিলেন। দ্বিতীয় খণ্ডে এর নকশা ও প্রস্তুত প্রণালী আছে। জমি জমার পরিমাপের সামান্য ভুলত্রুটি কিংবা জালিয়াতির কারণে বাংলাদেশে কত পরিবার ধ্বংস হয়েছে তার হিসাব করা কঠিন। পরিচিতজনেরা বলেছেন আমিন হিসেবে আরজ আলী এতটাই নিখুঁত ছিল এবং তা সকলের বিশ্বাস এমনভাবেই অর্জন করেছিল যে শুধুমাত্র তাঁর কাজের জন্যই বহু মানুষের জীবন বেঁচেছে, বহুসংঘাত আর খুনোখুনির হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে মানুষ। কাজের এই দক্ষতা ও নিষ্ঠার কারণে শুধু নিজ গ্রাম নয় আশেপাশের একটি বড় অঞ্চল জুড়ে তাঁর একটি গণভিত্তি তৈরি হয়েছিল।

এই গণভিত্তিই তাঁকে শক্তি যুগিয়েছিল প্রচলিত অনেক বিশ্বাস ও প্রথা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের। তাঁকে নাস্তিক বলে কেউ কেউ কোণঠাসা করতে চাইলেও তিনি খুব কদর নিয়ে সারাজীবন কাজ করেছেন। এমনকি আশেপাশের পীর, ধর্মীয় নেতারাও তাঁর বিরুদ্ধে কখনও ফতোয়া জারি করেননি। আরজ আলী এই বিষয় নিয়ে সবার সঙ্গেই আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি উন্মুক্ত ছিলেন, যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করলে তাঁর প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিলে তিনি তা গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। এবং সেটাই, এবং প্রশ্ন উত্থাপনের ভঙ্গিই তাঁকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী করেনি, তাঁকে নিঃসঙ্গ করেনি, যদিও “স্থানীয় বিশেষ সমাজে” তিনি দীর্ঘদিন “অবহেলিত ও তিরস্কৃত” হয়েছেন। 



জ্ঞানের কি ডিগ্রী হয়?            

নিজের নামে পাননি বলে অন্যের নামে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়েছেন। এক পর্যায়ে এসে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ওয়ারিশদের বুঝিয়ে দিয়ে কাজ করেছেন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি নিজেই বলেছেন, “দিনমজুরী করেছি মাঠে মাঠে আমিনগিরি রূপে। ...টাকা আমার নেই। আর জীবিকা নির্বাহের জন্য আমার টাকার প্রয়োজনও নেই।”  নির্মাণের খরচ কমানোর জন্য লাইব্রেরি নির্মাণে শারীরিক অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি খুব পরিষ্কার ছিলেন এই বিষয়ে যে, “বস্তুত: বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই। জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন। সেই অসীম জ্ঞানার্জনের মাধ্যম স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তা হচ্ছে লাইব্রেরি।”  

এই লাইব্রেরি নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি বহু মানুষের কাছে হাত পেতেছেন, তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছেন। কিন্তু সবার কাছ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা একরকম হয়নি। যাদের সঙ্গতি নেই তাঁদের কাছ থেকেই তিনি সহযোগিতা পেয়েছেন সবচাইতে বেশি। সেজন্যই তিনি বলেন, “লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে স্থানীয় বিত্তবানদের আমি সহানুভূতি পাইনি। তবে মজুরদের সাহায্য পেয়েছি প্রচুর। ...তাঁরা তাঁদের মজুরীর অর্ধেক নিয়ে আমার লাইব্রেরির নির্মাণকাজ সমাধা করেছেন। কাজেই এ গ্রামের মজুরদের কাছে আমি ঋণী, হুজুরদের কাছে নয়।”

এই লাইব্রেরি যাতে তাঁর মৃত্যুর পরও টিকে থাকে সেজন্য তাঁর উদ্বেগ ছিল এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও তিনি গ্রহণ করেছেন। লিখিতভাবে তহবিল, লাইব্রেরি ও যাবতীয় অনুষ্ঠানাদির পরিকল্পনা জানিয়ে গেছেন। মৃত্যুর পর নিজের অবশিষ্টাংশ যাতে মানুষের কাজে লাগে সে ব্যবস্থাও করেছেন। মৃতদেহ বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে দান করেন। চক্ষুদ্বয় চক্ষুব্যাংকে।   গ্রন্থের প্রতি আরজ আলীর যে এই অপ্রতিরোধ্য আগ্রহ-- তার কারণ কী? ডিগ্রী লাভের তো তাঁর কোন অবস্থাই ছিল না কারণ মক্তবের পর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এদেশের অধিকাংশ মানুষের মতোই, তাঁরও প্রবেশাধিকার কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। ছোটবেলা থেকেই কাজ করেই তাঁর বই সংগ্রহ এবং পড়া। ডিগ্রী লাভের জন্য অবশ্য বই খুব বেশি দরকারও হয় না, চারপাশে দেখি, অনেকসময় ডিগ্রী-পিপাসু ব্যক্তিদের বই-এর প্রতি, বিদ্যাচর্চার প্রতি এক সীমাহীন ঔদাস্য এমনকি বিকর্ষণও তৈরি হয়। এইসব মানুষের মনের মধ্যে ছোট-বড় ডিগ্রীর অল্পশিক্ষা-কুশিক্ষা এমনই জমাট বেঁধে বসে যে সব কৌতূহল, জগত-মানুষ-সমাজ সম্পর্কে সব প্রশ্নও বিলুপ্ত হয়। অচল মস্তিষ্ক এবং বড় বড় ডিগ্রী যে একসঙ্গেই চলতে পারে তার উদাহরণ পাবার জন্য আমাদের খুব বেশি পরিশ্রম করতে হবে না।    

অন্যদিকে আরজ আলী মাতুব্বরের বই-এর প্রতি, বিদ্যাচর্চার প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহের প্রধান কারণই হলো জগত মানুষ সংসার নিয়ে, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে, অপার কৌতুহল এবং মাথায় অনেক প্রশ্ন। আসলে কৌতূহল আর প্রশ্ন এমনই যে, তার কোন সীমা বলে কিছু নেই। কৌতূহল পূরণ করবার জন্য যত প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করা যায় ততই নতুন নতুন প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটে। কাজেই কেউ যদি প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে শুরু করেন সে এক অবিরাম যাত্রা। এই যাত্রা কঠিন কেননা তা প্রচলিত অনেক বোধ-বিশ্বাসকে আঘাত করে, এই যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ কেননা তা বিদ্যমান ক্ষমতার কাঠামোকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে, এই যাত্রা গভীর আনন্দের কেননা তা ক্রমান্বয়ে সীমানা সম্প্রসারিত করতে থাকে, অসীমের দিকে তাকানোর ক্ষমতা বা আত্মবিশ্বাস দান করে এবং সীমার মধ্যে নিজকেই যেন পূর্ণ করতে  থাকে। এই প্রশ্নই আমাদের সামনে আরজ আলী মাতুব্বরকে উপস্থিত করেছে।

তিনি তাঁর জ্ঞানের সীমা সম্প্রসারণে তাঁর সমাজের সকল জ্ঞানচর্চার মাধ্যমকেই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুঁথি পাঠ করে করে তাঁর পাঠের ক্ষমতা যেমন বাড়ে তেমনি নতুন নতুন চিন্তার জগত উন্মোচিত হতে থাকে। তিনি লিখেছেন, “স্থানীয় কতিপয় তরুণের আগ্রহে পুঁথি ও সারি গানের দল গঠনপূর্বক গান করিতে আরম্ভ করি এবং বিভিন্ন মৌলবি সাহেবদের নিকট কোরান, হাদিস, কেয়াস, ফেকাহ ইত্যাদি মুসলিম ধর্মগ্রন্থগুলির ও পুরুত- ভটচাজ্জিদের নিকট বেদ, পুরাণ, গীতা, রামায়ণ-মহাভারতাদি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলির বঙ্গানুবাদ পাঠ ও শ্রবণ করি-- উক্ত গানের তর্কসমুদ্র পার হওয়ার জন্য।”  

কাদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন আরজ আলী মাতুব্বর? তিনি নিজেই বলেন, “প্রশ্নের কারণ কি? কারণ ‘অজানাকে জানার স্পৃহা মানুষের চিরন্তন’ এবং এইরকম ‘কি’ ও ‘কেন’র অনুসন্ধান করিতে করিতেই মানুষ আজ গড়িয়া তুলিয়াছে বিজ্ঞানের অটল সৌধ”; আরজ আলী মাতুব্বর এই সৌধ নির্মাণে হাত দিয়েছেন কোন প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন ছাড়াই।




প্রশ্ন নিয়ে যায় অকূল চিন্তার সাগরে    

আমাদের সমাজ প্রশ্ন উত্থাপনকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে। বারবার বলে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’; মানুষের মনোজগতে প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করবার ক্ষেত্রে অস্বস্তি এবং ভয় কাজ করে। আরজ আলীর বিশিষ্টতা এখানে যে, তিনি এই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বর লিখেছেন, “এলোমেলোভাবে মনে যখন যে প্রশ্ন উদয় হইতেছিল, তখন তাহা লিখিয়া রাখিতেছিলাম, পুস্তক প্রণয়ণের জন্য নহে, স্মরণার্থে। ওগুলি আমাকে ভাসাইতেছিল অকূল চিন্তা-সাগরে এবং আমি ভাসিয়া যাইতেছিলাম ধর্মজগতের বাহিরে।”  

যে প্রশ্নগুলি তিনি টুকে রাখছিলেন সেগুলো তাঁর আশেপাশে মানুষের জীবনযাপন, বিশ্বাস, প্রথা, অনুশাসনকে ঘিরেই। এর প্রায় সবগুলোই ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এর সব ধর্মগ্রন্থে নাও থাকতে পারে। বাস্তবে ধর্ম যেভাবে উপস্থিত সেটাই আরজ আলীর বিবেচনার বিষয় হয়েছে। এই প্রশ্নগুলি নিয়ে শুধু যে তিনিই অকূল সাগরে ভেসে যাচ্ছিলেন তা নয়, তাঁর আশেপাশের মানুষদেরকেও তা নাড়া দিচ্ছিল ভয়ানকভাবে। আর কিছু নয় শুধুই প্রশ্ন। অল্পদিনের মধ্যেই প্রচারিত হলো তিনি নাস্তিকতা প্রচার করছেন। এই প্রচার শুনে এলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, ‘সমাজ-শাসন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত’ সরকারি কর্মকর্তা। ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে (ইং ১৯৫১ সালে) ১৩৫৮ সালের ১২ জ্যৈষ্ঠ বরিশালের তৎকালীন ‘ল-ইয়ার ম্যাজিষ্ট্রেট ও তবলিগ জামাতের আমির’কে তিনি প্রশ্নের তালিকা দেন। জবাবে সন্তুষ্ট হলে তিনি জামাতভুক্ত হবেন এই প্রতিশ্রুতিও প্রদান করেন। কিন্তু সেই ‘‘করিম সাহেব চলিয়া যাইবার পরে আমি পাইয়াছিলাম কম্যুনিজমের অপরাধে আসামী হিসাবে ফৌজদারী মামলার একখানা ওয়ারেন্ট, কিন্তু আমার প্রশ্নগুলির জবাব আজও পাই নাই।’’  

১৯৫১ সালের ১২ই জুলাই কোর্টে জবানবন্দী দিতে গিয়ে আগের প্রশ্নগুলোই সুসংগঠিত আকারে ‘সত্যের সন্ধান’ নামে তিনি উপস্থাপন করেন। তিনি বলছেন, ‘সত্যের সন্ধান’-এর পাণ্ডুলিপিখানার বদৌলতে সে মামলায় আমি দৈহিক নিষ্কৃতি পেলাম বটে, কিন্তু মানসিক শাস্তি ভোগ করতে হলো বহু বছর। কেননা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা আমি প্রকাশ করতে পারবো না ও ধর্মীয় সনাতন মতবাদের সমালোচনামূলক অন্য কোনো বই লিখতে পারবো না এবং পারবো না কোনো সভা-সমিতিতে-বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বমত প্রচার করতে। যদি এর একটি কাজও করি, তবে যে কোনো অজুহাতে আমাকে পুনরায় ফৌজদারীতে সোপর্দ করা হবে। অগত্যা কলম-কালাম বন্ধ করে আমাকে বসে থাকতে হলো ঘরে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো আমার কর্মজীবনের অমূল্য ২০টি বছর। বাংলাদেশে কুখ্যাত পাকিস্তান সরকারের সমাধি হলে পর ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা প্রকাশ করা হয় ১৩৮০ সালে, রচনার ২২ বছর পর।”

শুধু প্রশ্ন উত্থাপনের অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিকে কলম কালাম চর্চা থেকে রাষ্ট্রের বল দিয়ে থামিয়ে রাখা হলো। প্রশ্নের প্রতি এত ভয় রাষ্ট্রের, কলম ও কালাম নিয়ে এত ভয়!   সেই ১৯৫১ সালের প্রশ্ন থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে নিভৃত গ্রামে একা, মৃদু কেরোসিনের বাতি নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বর যেসব বিষয় অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ ও সূত্রবদ্ধ সেগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।
এগুলো হল:
(১)    দৈনন্দিন দুর্ভোগ এবং তার পরিবর্তনের সম্ভাব্যতা। 
(২)    লোভ এবং ভয় কেন্দ্রিক ধর্ম-ডিসকোর্স।
(৩)    জগতের উদ্ভব এবং তার নিয়ম। 
(৪)    ঈশ্বর, শয়তান, রাম, রাবণ, ফেরেশতা, দেবতা সম্পর্কিত মিথ পর্যালোচনা।  

আল্লাহর গজব কিংবা কপালের লেখা

আরজ আলী মাতুব্বরকে বিশেষভাবে ভাবিত করেছে মানুষের দৈনন্দিন দুর্ভোগ এবং সে সম্পর্কে মানুষের নিজস্ব ব্যাখ্যা, সমাজে অধিপতি চিন্তায় সেসব দুর্ভোগ আর অপমান যুক্তিযুক্ত করবার চেষ্টা। এসব বিষয় অনুসন্ধান করতে গিয়েই তিনি ক্রমশঃ আরও গভীর দার্শনিক বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। দারিদ্র, অনাহার, অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্গতি ইত্যাদি আরজ আলীকে বাইরে থেকে দেখতে হয়নি। তিনি এর মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু এসব ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে করতে তিনি সেই বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন যা মনে করে বা মনে করতে শেখায় যে, এসব কিছুই কপালের লেখা, এর পরিবর্তন সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে এযাবতকাল যত বড় দুর্যোগে মানুষ পড়েছেন তার সবগুলোতেই এর কারণ হিসেবে শোনা গেছে যে, এগুলো হল ‘আল্লাহর গজব’। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর কিংবা ১৯৯১ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে যখন লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিলেন তখন ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ঘুরতে গিয়ে এরকম কথা আমি নিজেও অনেক শুনেছি। ১৯৯১ সালের সেই ঘুর্ণিঝড়ে গ্রামের পর গ্রাম সমান হয়ে গিয়েছিল। অক্ষত ঘর তখন সমগ্র এলাকায় খুঁজে পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটো ঘর অক্ষত পাওয়া যাচ্ছিল যেগুলো পাকা, মসজিদও। যুক্তিসঙ্গত কারণেই, যেগুলো পাকা সেগুলো টিকেছিল, ধ্বসে পড়েছিল কাঁচাগুলি। যারা এসবকিছুকে অল্লাহর গজব বলছিলেন তাঁদের বক্তব্য ছিল ‘এগুলো হল পাপের ফল’; কিন্তু পাপ কি তাদেরই বেশি যাদের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় থাকতে হয় এবং যাদের আশ্রয় খুবই ভঙ্গুর? যারা টেকসই বাড়িতে বসবাস করেন এবং নিরাপদ জায়গায় থাকেন হারাম পয়সায়, তাদের পাপে গজব হয় কোথায়? এই বিষয়গুলি নিয়েই আরজ আলী প্রশ্ন তুলেছিলেন।

কোন দেশে ধর্মবিশ্বাস অনেক থাকলেও যদি পানি দূষিত হয় কিংবা পুষ্টির অভাব থাকে সর্বোপরি যদি চিকিৎসার ব্যবস্থার অভাব থাকে তাহলে সেখানে অকাল মৃত্যুর হার অনেক বেশি। শাসকেরা এবং তাদের রক্ষা করতে নিয়োজিত থাকেন যেসব ধর্মপ্রচারক তাঁরা পানি, খাদ্য-পুষ্টি কিংবা চিকিৎসার বিষয়ে প্রশ্ন না তুলে অভিযুক্ত করতে থাকেন যারা গরীব, যারা ভুগছেন তাদেরই।  বলেন, দেশের মানুষের ঈমান কম। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, কেন তবে যেসব দেশে ধর্মবিশ্বাস কম সেসব দেশে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু কম? আবার ধর্মের মিথ ধরে প্রশ্ন করেন, “...আর যদি যাবতীয় জীবের খাদ্যই মেকাইল বণ্টন করেন, তবে জগতের অন্য কোন প্রাণীকে নীরোগ দেহে শুধু উপবাসে মরিতে দেখা যায় না, অথচ মানুষ উপবাসে মরে কেন? বৈষম্য কেন?”     

এর সঙ্গেই প্রশ্ন, ভাগ্য। কপালের লেখা। তিনি বলেন, “ভাগ্যলিপি কি অপরিবর্তনীয়? ...রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে শিক্ষা দিতেছে— কর্ম কর, ফল পাইবে। কিন্তু ধর্ম শিক্ষা দিতেছে ইহার বিপরীত। ধর্ম বলিতেছে— কর্ম করিয়া যাও, ফল অদৃষ্টে (তকদীরে) যাহা লিখিত আছে তাহাই পাইবে। ...বিশেষত মানুষের কৃত ‘কর্মের দ্বারা ফলোৎপন্ন’ না হইয়া যদি ঈশ্বরের নির্ধারিত ‘ফলের দ্বারা কর্মোৎপত্তি’ হয় তবে ‘সৎ’ বা ‘অসৎ’ কাজের জন্য মানুষ দায়ী হইবে কেন?”

সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলে উত্তরাধিকার প্রশ্নটিও গুরুত্বের সঙ্গে আসে। বর্তমান সকল প্রধান ধর্মেই যেহেতু সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাকে স্থায়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে সেহেতু সব ধমের্ই উত্তরাধিকার বিষয়েও নিয়মবিধি আছে। ইসলাম ধর্মে এ সংক্রান্ত যে বিধি সে সম্পর্কে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে তিনি বলেন, “মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তি তাহার ওয়ারিশগণের মধ্যে বণ্টনব্যবস্থাকে বলা হয় ‘ফরায়েজ নীতি’; ইহা পবিত্র কোরানের বিধান। মুসলিম জগতে এই বিধানটি যেরূপ দৃঢ়ভাবে প্রতিপালিত হইতেছে, সেরূপ অন্য কোনটি নহে। এমনকি পবিত্র নামাজের বিধানও নহে। ইহার কারণ বোধহয় এই যে, ফরায়েজ বিধানের সঙ্গে জাগতিক স্বার্থ জড়িত আছে।” তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন বিধান অনুযায়ী সবাইকে সম্পত্তি বণ্টন করলে মোট সম্পত্তি দিয়ে কুলায় না। দরকার হয় ষোল আনার স্থলে আঠারো আনা। এই সমস্যার সমাধান করেন হজরত আলী। তিনি যে নিয়মের দ্বারা উহার সমাধান করিয়াছিলেন, তাহার নাম ‘আউল’।  মানুষের কেন এই সংশোধনের দরকার হল? তিনি প্রশ্ন করেন, ‘পবিত্র কোরানের উক্ত বিধানটি ত্রুটিপূর্ণ কেন?’
নারীর অবস্থান, নারীর অধিকার, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের ‘বৈধতা’-‘অবৈধতা’, সন্তানের উপর অধিকার সম্পর্কে সকল ধর্মেই কড়া বিধিবিধান আছে। ইসলাম ধর্মে কোরান এবং হাদিস থেকে এসব বিধিবিধান গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হয়। আরজ আলী মাতুব্বর এক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন ‘হিল্লা বিয়ে’ নিয়ে। এই বিয়ের প্রথা, অন্যান্য আরও অনেক আইনের মতো, কত নারীর জীবনকে বিষময় ও বিপর্যস্ত করেছে, কত নারীকে ভয়াবহ অপমানের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছে তার পরিসংখ্যান বের করা অসম্ভব। এটি এখনও চলছে। স্বামী ভুলে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আবার যদি তাঁকে গ্রহণ করতে চায় তবে তার একমাত্র বিধিসম্মত ব্যবস্থা হল স্ত্রীকে অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে যার সঙ্গে কোন ভালবাসা তৈরি হবে না কিন্ত নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আরজ আলী মাতুব্বর বলেন, “অথচ পুনরায় গ্রহণযোগ্যা নির্দোষ স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে ‘হিল্লা’ প্রথার নিয়মে স্বামীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় সেই নির্দোষ স্ত্রীকেই। অপরাধী স্বামীর অর্থদ-, বেত্রাঘাত ইত্যাদি না-ই হউক, অন্তত তওবা পড়ারও বিধান নাই, আছে নিষ্পাপিনী স্ত্রীর ইজ্জতহানির ব্যবস্থা। একের পাপে অন্যকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় কেন?”  তিনি পুরো ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করে আরও প্রশ্ন করেন যে, “এইরূপ মিলন ব্যাভিচারের নামান্তর নয় কি?”  অথচ ‘ব্যাভিচারের’ অপরাধে কত নারী পুরুষকে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ধর্মের বিধান অনুযায়ী নিষ্ঠুর যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়েছে এমনকি প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। 
ভাগ্য গড়বার জন্য, ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্য নানাবিধ আয়োজন ও ব্যবস্থা আছে বিভিন্ন ধর্মে। ইসলাম ধর্মে শবেবরাত বা হিন্দুধর্মে লক্ষীপূজা এরকম দুটি পদ্ধতি যা দিয়ে বৈষয়িক জীবন উন্নতি অনুমোদন করেন ঈশ্বর-- এরকম বিশ্বাসই প্রবলভাবে কাজ করে। কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বর চারপাশের, বিশ্বের নানা দেশের উদাহরণ দিয়ে দেখান যে, সম্পদ বা স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর কোন সম্পর্ক দেখা যায় না।  বরঞ্চ যারা বিপুল সম্পদের মালিক, বৈষয়িকভাবে সফল যাদের বরাত ‘ভাল’ তাদের বেশিরভাগ এসবের ধারে কাছেও নেই। তাঁদের বরঞ্চ বরাত ভাল হবার পর ধর্মের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখা যায় ভিন্ন কারণে।                   

হিন্দুধর্মে পশুবলি বা ইসলামে কোরবানী প্রথা সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও তাঁকে খুশি করবার একটি পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে কোরবানীর ব্যাপারে উৎসাহ দিনে দিনে বাড়ছে। এইজন্য যে আয়োজন, উল্লাস এবং প্রতিযোগিতা দেখা যায় সেসব আলোচনা করে আরজ আলী বলেছেন এতে পশুর হয় ‘আত্মত্যাগ’ এবং কোরবানী দাতার হয় ‘সামান্য স্বার্থত্যাগ’; মাংস ভোগের মহোৎসব দেখে তিনি প্রশ্ন করেন যে, এই সামান্য স্বার্থত্যাগের বিনিময়ে যদি দাতার স্বর্গলাভ হইতে পারে, তবে কোরবানীর পশুর স্বর্গলাভ হইবে কিনা?

কেন তাঁকে দাঁড়াতে হয় লোভ আর ভয়ের উপর?  ধর্মের বিভিন্ন বক্তব্য, নিয়মনীতি সর্বোপরি প্রধান ধর্মগুলোর ধর্মগ্রন্থসমূহকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণের মধ্যে আনা দরকার। আরজ আলী মাতুব্বর বলেন যে, “ধর্মগ্রন্থের বাণীসমূহ লৌকিক বা অলৌকিক যা-ই হোক, তাতে মানব জীবনের অত্যাবশ্যকীয় বহু মূল্যবান তথ্যও আছে। তাই যাবতীয় ধর্মগ্রন্থই আমাদের পরম শ্রদ্ধার্হ ও সমান আদরণীয়।”

আরজ আলী নিজে জন্মের পর থেকেই ইসলামের আবহেই বড় হয়েছেন। এই ধর্ম তাঁর অনেক নিকটবর্তী যার একদিকে শাস্ত্রীয় বক্তব্য অন্যদিকে তার বাস্তব প্রয়োগের রূপও তিনি দেখেছেন। কোরান সম্পর্কে তিনি বলেন, “পবিত্র কোরান মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ এবং ইহা ঐশ্বরিক গ্রন্থ বলিয়া পরিচিত। যেসব গ্রন্থকে ঐশ্বরিক বলিয়া দাবি করা হয়, পবিত্র কোরান তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বরং অতুলনীয়।”     

ধর্ম আর মানুষ কে কাকে তৈরি করে, কে কাকে পালন করে? এর জবাবই ঠিক করে দেয় একজনের মতাদর্শিক অবস্থান। আরজ আলী এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “ধর্ম মানুষকে পালন করে না, বরং মানুষ ধর্মকে পালন করে এবং প্রতিপালনও।” আরজ আলী বলেন, “সাধারণত আমরা যাহাকে ‘ধর্ম’ বলি তাহা হইল মানুষের কল্পিত ধর্ম।” ধর্ম প্রবর্তকদের তিনি অভিহিত করেছেন মহাজ্ঞানী হিসেবে যারা ‘যুগে যুগে’ ‘স্রষ্টার’ প্রতি মানুষের কর্তব্য এবং ‘মানুষের সমাজ ও কর্মজীবনের গতিপথও’ দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছে অনেক ধর্ম ও তা নিয়ে বিভেদ। অনেক রক্তক্ষয়ী সংঘাতও সৃষ্টি হয়েছে এটি থেকে। 

কিন্তু ‘সাপে নেউলে’ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধর্মের সারবস্তুর মধ্যে অমিলের চাইতে মিলই বেশি। আরজ আলী প্রশ্ন করেন, ‘‘লক্ষাধিক পয়গম্বর প্রায় সবাই আরব দেশে জন্মিলেন কেন?’’ বাস্তবিকই আরব অঞ্চলের পর ভারত, চীন, জাপান প্রভৃতি অঞ্চলকেই ধর্ম প্রবর্তনের কেন্দ্র হিসেবে পাওয়া যায়। দখল-পূর্ব আমেরিকার ধর্মের খবর এখনও প্রকাশিত হচ্ছে। সেমিটিক ধর্মগুলো ধারাবাহিকতা রেখেছে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। হজরত ইব্রাহিম থেকে শুরু হয়ে ইসলাম ধর্ম পর্যন্ত। ভারত, চীন, জাপান ইত্যাদি অঞ্চলে ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন ধারাবাহিকতা। এটা ঠিক এরকম নয় যে, একটি ধর্ম এসেছে এবং তার সূত্র ধরে সমাজ-অর্থনীতি এগিয়েছে। ঘটনাটা বরঞ্চ উল্টো। সমাজ অর্থনীতির ধরনের উপরই  ধর্মের রূপ দাঁড়িয়েছে। বহু ধর্ম মরে গেছে। আবার বহু ধর্ম মিশে গেছে অন্য কোনটির সঙ্গে আবার কোন কোনটি ব্যাপক প্রভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। হিন্দু ধর্ম, যাকে বৈদিক ধর্মও বলা হয়, অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে বহু ক্ষুদ্র আঞ্চলিক ধর্ম, পাওয়া যাবে সেগুলোর দেবদেবী বিশ্বাস আচার। 

আরজ আলী ভারতে প্রবর্তিত এই বৈদিক ধর্মের বহু বিশ্বাস ও রীতিনীতির সাথে মিল দেখাচ্ছেন আরবে প্রবর্তিত সেমিটিক ধর্মগুলোর সঙ্গে। এক ধর্মে ‘পৌত্তলিকতা’ ও অন্য ধর্মে ‘পৌত্তলিকতা বিরোধিতা’র মতো মৌলিক তফাৎ থাকলেও এই সাদৃশ্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
তিনি অভিন্নতার একটি তালিকা তৈরি করেছেন নিম্নরূপে :  
১.    ঈশ্বর এক-- একমেবাদ্বিতীয়ম (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)।
২.    বিশ্ব-জীবের আত্মাসমূহ এক সময়ের সৃষ্টি।
৩.    মরণান্তে পরকাল এবং ইহকালের কর্মফল পরকালে ভোগ।
৪.    পরলোকের দুইটি বিভাগ-- স্বর্গ ও নরক (বেহেস্ত-দোজখ)।
৫.    স্বর্গ সাত ভাগে এবং নরক সাত ভাগে বিভক্ত
৬.    স্বর্গ বাগানময় এবং নরক অগ্নিময়।
৭.    স্বর্গ ঊর্ধ্বদিকে অবস্থিত।
৮.    পূণ্যবানদের স্বর্গপ্রাপ্তি এবং পাপীদের নরকবাস।
৯.    যমদূত (আজ্রাইল) কর্তৃক মানুষের জীবনহরণ।
১০.    ভগবানের স্থায়ী আবাস ‘সিংহাসন’।
১১.    স্তব-স্তুতিতে ভগবান সন্তুষ্ট।
১২.    মন্ত্র (কেরাত) দ্বারা উপাসনা করা।
১৩.    মানুষ জাতির আদিপিতা একজন মানুষ-- মনু (আদম)।
১৪.    নরবলি হইতে পশুবলির প্রথা প্রচলন।
১৫.    বলিদানে পূণ্যলাভ (কোরবানী)
১৬.    ঈশ্বরের নামে উপবাসে পূণ্যলাভ (রোজা)।
১৭.    তীর্থভ্রমণে পাপের ক্ষয়-- কাশীগয়া (মক্কা-মদিনা)।
১৮.    ঈশ্বরের দূত আছে ফেরেস্তা)।
১৯.    জানু পাতিয়া উপাসনায় বসা।
২০.    সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত (সেজদা)।
২১.    করজোড়ে প্রার্থনা (মোনাজাত)।
২২.    নিত্যউপাসনার নির্দিষ্ট স্থান-- মন্দির (মসজিদ)।
২৩.    মালা জপ (তসবিহ পাঠ)
২৪.    নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা করা-- ত্রিসন্ধ্যা।  
২৫.    ধর্মগ্রন্থপাঠে পূণ্যলাভ
২৬.    কার্যারম্ভে ঈশ্বরের নামোচ্চারণ
২৭.    গুরুর নিকট দীক্ষা
২৮.    স্বর্গে গণিকা আছে-- গন্ধর্ব, কিন্নরী, অপ্সরা (হুর-গেলমান)
২৯.    উপাসনার পূর্বে অঙ্গ ধৌত করা (অজু)
৩০.    দিকনির্ণয়পূর্বক উপাসনায় বসা বা দাঁড়ানো
৩১.    পাপ-পূণ্য পরিমাপে তৌলযন্ত্র ব্যবহার (মিজান)
৩২.    স্বর্গগামীদের নদী পার হওয়া-- বৈতরণী (পোলছিরাত)।