এক (ভূমিকা)
বছরের এই সময়টাতে সাধারণত বৃষ্টি হতে দেখা যায়না। কিন্তু এবছর প্রকৃতি তার সনাতনি প্রথা ভেঙ্গে মেঘ বৃষ্টির এক নতুন খেলা চালু করেছে। কয়েকদিন যাবৎ কখনও সখনও সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে বটে কিন্তু অঝরে বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামটি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর তুলনায় উঁচু হওয়ায় গ্রামের ভিতরে বৃষ্টির পানি জমে নেই তবে গ্রামের চারপাশ দিয়ে সবুজ আবৃত্ত মাঠগুলো বৃষ্টির পানি জমে সাদা হয়ে আছে। সেই জমে থাকা সাদা পানি ফূড়ে ধানের পাতাগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে রোদ্র সঙ্গ কামনা করছে, আর বলছে হে রোদ্র তুমি আস এই নাছড় বৃষ্টির সাথে পরকিয়া সম্পর্ক ছেড়ে তোমার সাথে পুরাতন সম্পর্কের দোলযাত্রায় ফিরে যাব। তবে এই বদ্ধ পানির খাঁচা থেকে কিছু অতিকায় লম্বা ধানগুলি প্রকৃতি বা মালিক পক্ষের সহেযোগিতা ব্যতিত সযত্নে নিজেদেরকে বড় করে তুলার সংগ্রামে লিপ্ত।
শহরের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় গ্রামের অনেক যুবক স্বল্প খরচে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে কিন্তু চাকুরী দাতাদের পাশ্ববর্তী স্থলে না থাকার কারণের সেই ভাবে অনেকেই চাকুরীর সুযোগ পায়নি। উচ্চ শিক্ষিতি যুবকগুলো যেন প্রকৃতির খেয়ালী খেলার ফলসৃত অতিবৃষ্টির পানিতে জমে থাকা ধানগুলোর মত বলছে হে চাকুরী তুমি আস আমাদের হাতে ধরা দাও তুমি নাছড় বেকারত্ত্বের হাত থেকে আমাদেরকে বাঁচাও। তবে যতই চাকুরী কামনা করুক না কেন ‘দুষ্প্রাপ্য চাকুরী’ নামক সু-প্রাপ্য শব্দের সহজলভ্যতায় বেকারত্ত্ব তকমা পাওয়া যুবকগুলো দিনে দিনে ব্যক্তি থেকে বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। তবে এর মধ্য থেকে কোন কোন যুবক অতিকায় ধানের মত নিজগুণে চাকুরী নামক প্রবাদী সোনার হরিণকে নিজের কর-আয়ত্বে আনতে সক্ষম হয়েছে বা হচ্ছে। তেমনি একজন যুবক অর্ণব।
মাঝারির মানের উচচ্চতার সাথে পেটানো শরীরে শ্যামলা বর্ণের রঙ তার সাথে মিলিত হয়েছে জোড়া ভুরু, লম্বা মোটা ধাচের কাল চুল ও কাল বড় বড় দু’টি চোখ। সবগুলোর সংমিশ্রণের অসাধারণ এক সাধারণ চেহারার যুবক অর্ণব। পড়াশোনা, খেলাধুলা, মুখ-অবয়ব, আচার আচরণ সবকিছুতেই অর্ণব সাধারণ। সমগ্র সাধারণের সম্মিলিত রূপে অর্ণব একজন অনন্য সাধারণ যুবক হিসাবে এলাকায় সুপরিচিত। অন্যন্য সাধারণের সাথে তার জ্ঞান পিপাসু অনুসন্ধিৎসু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে দাম্ভিকতা ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্ন মর্যাদায় নিয়ে গেছে কিন্তু সে দাম্ভিক নয়।
সাধারণ দরিদ্র পরিবারের বাবা মায়ের প্রথম সন্তান হওয়ায় পরিবারের ভোরণপোষণের দায়ভার চাপানোর পায়তারা সফল করার নিমিত্তে কৃষক বাবা পাড়ায় পাড়ায় প্রায় গর্ব করে বলে-আর কেউ চাকুরী পাক বা না পাক আমার ছেলে চাকুরী পাবেই। অর্ণবের বাবার এই গৌরবপূর্ণ প্রচারে যতটা না গৌরব থাকে তার চেয়ে বেশী থাকে প্রত্যাশা। কারণ বয়সের কারণেই হোক বা অন্য যে কোন কারেণেই হোক তার কাজের ঈস্পৃহা নিষ্প্রভ হতে চলেছে। অন্যদিকে অর্ণবের অবশিষ্ট্য ৩ ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ, বাবা ও মায়ের ছোটখাট অসুখগুলোর জন্য অর্ণবের বাবাকে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়ে তা বর্গা নেওয়া জমিতে কাজ করে সেই অর্থের খুব সামান্য পরিমাণই আসে।
খুশির জোয়ার অর্ণবের বাড়ীরে সকল অভাব অনটন ও দু:খ কষ্ট আজ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে যার মত করে পাচ্ছে আনন্দ করে যাচ্ছে। অর্ণবের পূর্বপুরুষ/পূর্ব মহিলাদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে তার বংশের কেউ কোনদিন বসের তোষামদি আর সরকারের চাটুবৃত্তি করার দূর্ভাগ্যের সুযোগ পায়নি। অর্ণবের জীবনের সেই সুযোগগুলো এসেছে। তাই বোনের চোখে নতুন নতুন স্বপ্নের সুতোগুলো জাল বুনাতে ব্যস্ত। বাবার চোখে ছয় দশকের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের নানান পরিকল্পনা ঘোরাফেরা করছে, মায়ের চোখে রোগমুক্তির পথ্য গ্রহণের মাধ্যমে পরমায়ূ বৃদ্ধির আনন্দ উচ্ছ্বাস।
কিন্তু কেন? পরবর্তী পর্বে—-
দুই (যাত্রা)
অর্ণব আজকের পূর্বে ঢাকায় বেশ কয়েক বার গেছে। অন্যবারের চেয়ে এবার কার যাওয়ার বেশ কিছু পার্থক্য আছে। যেমন পূর্বে যে কয়বার গিয়েছিল সেটা শুধু চাকুরী খুঁজতে এবার যাচ্ছে চাকুরীতে যোগদান করতে। আগের সময়গুলোতে গিয়েছিল বাসের ঝাকুনী খেতে খেতে এবার যাচ্ছে চেয়ার কোচে ঘুমাতে ঘুমাতে।
অর্ণব যে সীটে বসে আছে সেটি হাফ ফোল্ড করা তাতে না পারছে সোজা হয়ে বসে থাকতে না পারছে শুয়ে থাকতে। কিন্তু সেটা সোজা করতে পারছেও না বা পুরো ফোল্ড করতেও পারছে না। কিভাবে সেটা ফোল্ড করতে হয় কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ বোধ হচ্ছে। অর্ণব বাসের মধ্যে এদিক-ওদিক করে তার মত পরিস্থিতে নিপতিত একজন সঙ্গী খুঁজতে লাগল। সৌভাগ্য বশত: সামনের দিকে তাকিয়ে জিন্সের প্যান্ট পরা গায়ে অদ্ভুত ধরনের একটা পোশাক (যে পোশাকটার নাম অর্ণব জানে না) পরা যুবতী মেয়েকে পেয়ে গেলো। মেয়েটার সীটের দিকে তাকিয়ে কাজটি কি ভাবে করে দেখে শিখে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এধরনের স্মার্ট মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকাটাও খুবই বিব্রতকর আবার না তাকানোটাও বেশ মুশকিল। বিব্রতকর, মুশকিল এর সাথে যুক্ত হয়েছে চেয়ারে বসে থাকার অস্বস্তি। এই মূহুর্তে অর্ণব অস্বস্তিকর বসে থাকা অবস্থা থেকে রেহায় পাওয়ার অজুহাতে বিব্রতকর পরিস্থিতির সুযোগটাই গ্রহণ করল। চুপি চুপি মেয়েটার নিকট থেকে চেয়ার ফোল্ড করা শিখে এখন চেয়ার হেলান শুয়ে স্বপ্নের সিঁড়িতে পা দেওয়ার ভাইভা বোর্ডের ঘটনাগুলো অর্ণবের মনে পড়েছে।
-স্যার আসতে পারি।
-আসুন। বসুন বোর্ডের একজন বলেলন। আপনার নাম কি?
-রাকিবুল ইসলাম অর্ণব।
-অর্ণব
- হ্যাঁ.. হ্যাঁ.. হ্যাঁ..বোর্ডের একজন হেসে উঠলেন। রাকিবুল ইসলাম অর্ণব নামটা কেমন জানি খাপ ছাড়া মনে হচ্ছে। রাকিবুল ইসলাম এর সাথে অর্ণব শব্দটা বড্ড বেশি বেমানান মনে। যাই হোক অর্ণব শব্দের অর্থ বলতে পারবেন?
-সমুদ্র।
-বাবার নাম কি?
-ইসমাইল হোসেন।
-আপনি ইসলাম আপনার বাবা হোসেন। কেমন হয়ে গেলো না?
-What is Major in Mastares of you? আরেকএজন জিজ্ঞেস করলেন।
-Accounting & Information System
-Define the accounting.
-The systematic recording, reporting, and analysis of financial transactions of a business.
-What is accounting Information?
-An accounting information system is a system of collection, storage and processing of financial and accounting data that is used by decision makers.
-What are function of Dr. & Cr.?
-Incraseing asset, Expenses & Decreasing of Liablitye Dr. Drcreasing of asset, income & increaseing of liablity Cr.
-OK, শিক্ষক বললেন।
-এ পর্যন্ত কতজন বাঙ্গালী নোবেল পেয়েছেন? অন্য আরেক এজন টিচার জিজ্ঞেস করলেন।
-তিন জন।
-এই উপমহাশের আর একজন মহান মানুষের জন্য নোবেল ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত নোবেল দেওয়া হয়নি, সেই ব্যক্তিটি কে? এবং কেন তাকে শেষ পর্যন্ত নোবেল দেওয়া হয়নি?
-সরি স্যার, বলতে পারব না।
ভাইভা বোর্ডে তাকে বেশকিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল যা তার চাকুরীর সাথে কোন ভাবেই সম্পৃক্ত নয়। এমন কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল যার সবগুলোর উত্তর জানলেও তার পাওয়া ব্যাংকের চাকুরীতে কোন কাজে আসবে না। অর্ণব ভেবে পায়না কেন এধরনের প্রশ্ন করা হয়। যেমন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল সমুদ্রের সবচেয়ে গভিরতম স্থান কোনটি? এবং এর গভিরতা কত? এর সাথে ব্যাংকের চাকুরীর কি সম্পর্ক অর্ণব বুঝতে পারেনা।
-ভাই টিকিট টা দেখি। গাড়ীর কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করলেন।
পকেট থেকে টিকিটা কন্ডাক্টারকে দিল।
ভাইভা বোর্ডে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিতে না পারায় চাকুরীটা অর্ণব পাবে তা কখনও ভাবেনি।
-আগুণের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, গানটি অর্ণবের স্বল্প দামের চাইনাই তৈরী মোবাইলটিতে বেজে উঠল। হ্যাঁলো মা। হ্যাঁ মা ভাল আছি, না মা পথে কোন সমস্যা হচ্ছে না। তুমি চিন্তা করনা মা। হ্যাঁ মা আমি সাবধানেই যাচ্ছি। বাবাকেও চিন্তা করতে না কর। আর বেশ ভাল ভাবেই যাচ্ছি। ঠিক আছে মা এখনকার মত রাখ।
আজ ঘাটে কোন প্রকার জ্যাম নেই। গাড়ীটা সরাসরি ফেরীতে উঠে গেল। বাস থেকে নেমে ব্যাগটা হাতে করে সরাসরি ফেরির ছাদের উপর উঠে গেলো। অর্ণব কখনও ফেরির ছাদে উঠেনি। ছাদটা অনেক উঁচু হওয়ায় নদীর অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এটাকে জীবনের প্রতিচ্ছবি বলে অর্ণব কাছে মনে হচ্ছে।।
নানান ব্যস্ততার ভিড়ে সুপ্তিকে ফোন দেওয়া হয়নি। ফোন যখন দেওয়া হয়নি এখন ফোন দিবেনা। একবারে চাকুরীতে যোগদানের পরই ফোন করবে। সুপ্তি সেই মেয়ে যে অর্ণবকে অনেকবার ভাল বাসার কথা জানিয়েছে কিন্তু অর্ণব কখনও হ্যাঁ বলেনি। তবে নাও বলেনি। সুপ্তির বাবা উচ্চ মধ্যবিত্ত হওয়ায় অর্ণব সুপ্তির কথায় কখনও হ্যাঁ বলার দু:সাহস দেখায়নি কিন্তু অর্ণব সুপ্তিকে প্রচন্ড ভাল বাসে। অর্ণব মনে করে সুপ্তি তাকে যতটা ভালবাসে, সুপ্তিকে অর্ণব তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভাল বাসে। সুপ্তি অর্ণবের ভালবাসায় সাড়া না পাওয়ার জন্য অর্ণবের সামনে অনেক বার কেঁদেছে কিন্তু অর্ণব সাড়া না দিতে পারায় গোপনে গোপনে অনেক কেঁদেছে। সুপ্তি ভালবাসাকে প্রকাশ করেছে আর অর্ণব ভালবাসাকে করেছে অনুভব।
প্রায় 250 কি.মি দূর থেকে ঢাকা আসতে সময় লেগেছে সাড়ে 4 ঘন্টা কিন্তু ঢাকা শহরের মধ্যে 5 কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ইতিমধ্যেই প্রায় ২ ঘন্টা সময় পার হয়ে গেছে। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যামের অবকাশে নানান ধরনের ভাবনা ভাবতে হচ্ছে। প্রায় দেড়কোটি লোকের বসবাসরত ঢাকা শহরের মানুষের প্রতিদিন কত কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে এবং তার আর্থিক মূল্যই বা কত? অর্ণবের খুব জানতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এই রকম কোন পারিসাংখ্যিক তথ্য আছে বলে অর্ণবের জানা নেই।
তিন। (অন্তিম যাত্রা)
বলাকার মত ডানা মেলে উড়তে পারলে ভাল লাগত। সৃষ্টিকর্তা অতি সাধারণ প্রাণীদেরকে অসাধারণ ক্ষমতা দিয়েছে কিন্তু মানুষের মত অসাধারণ প্রাণীদেরকে অসাধারণ ক্ষমতা দেয়নি। পাখিরা কি সুন্দরভাবে আকাশে উড়ে সমস্ত শহরকে একনজরে দেখতে পায়। মানুষ তা পারেণা। সৃষ্টিকর্তা কেন মানুষকে সেই ক্ষমতা দিলনা সৃষ্টি কর্তার কাছে অর্ণবের সেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। চাকুরী যোগদান করার পর অর্ণবের উড়তে ইচ্ছা করছে। নানান সময়ে জন্ম নেওয়া নানান স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে শুরু করেছে। মায়ের রোগমুক্তি, বাবার কঠোর পরিশ্রম থেকে মুক্তি, ছোট্ট বোনের টেলিভিশনের স্বপ্ন, ভাইয়ের স্মার্ট ফোনের স্বপ্ন এবং সুপ্তিকে নিয়ে সমুদ্র স্নানের স্বপ্ন এগুলো পূরণ করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এত স্বপ্ন পূরণের সাধ্য সুখের মধ্যেই এই মূহুর্তে একটা বিষয় অর্ণবকে কষ্ট দিচ্ছে। অর্ণব চেয়েছিল আজকে ঢাকাতে থাকতে। বন্ধুর নিকট থেকে কিছু টাকা ধার করে নিয়ে এসেছে। যে টাকা দিয়ে অর্ণব মা, বাবা ভাই-বোন ও সুপ্তির জন্য শপিং করতে চায়। অর্ণবের মনে আছে এই বন্ধুর নিকট ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজিস্ট্রষনের সময় 5 শ টাকা টাকা ধার চেয়েছিল তখন সে টাকাগুলো ধার দেয়নি। এবার ও কিছু পোশাক কেনার জন্য 3 হাজার টাকা ধার চাই কিন্তু দিয়েছে 5 হাজার টাকা। হঠাৎ করে কি কারণে যেন আগামী কাল 12 ঘন্টার হরতাল ডেকেছে একটি রাজনৈতিক সংগঠন। তাই আজকেই বাড়ী চলে যেতে হবে। কেনাকাটার কোন সুযোগ পাবেনা।
মসজিদ থেকে মাগরীবের আযান ভেসে আসছে। হরতাল আগামীকাল অথচ আজ সন্ধ্যা থেকে বিক্ষুব্ধ ভাবে পিকেটিং শুরু হয়ে গেছে। অর্ণবের গাড়ীতে উঠতে ভয় লাগছে। কিন্তু থাকার কথাও ভাবতে পারছে না। কারণ ইদানিং প্রায়ই হরতালের সময় পিকেটারদের সাথে পুলিশের গন্ডগোল হচ্ছে ফলে হারতালের মেয়াদ বাড়ছে। আগামীকাল এর ব্যতিক্রম না ঘটতে পারে তাই। আজকেই চলে যেতে হবে।
আসাদ গেট থেকে গাবতলী উদ্দেশ্যে একটি বাসে উঠল। গাড়ীতে খুব বেশী ভিড় নেই, যেহেতু হরতালের পূর্বের দিন; হরতাল বিষয়ে সকলেই অবগত তাই রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যাও তুলনামূলক ভাবে কম। অর্ণবকে বহনকারী গাড়ীটি সতর্কতার সাথে গাবতলীর দিকে আসছে। যখনই পিকেটিং দেখতে পাচ্ছে গাড়ী থামিয়ে দিচ্ছে। যখন পুলিশে পিকেটারদেরকে ধাওয়া করছে তখন গাড়ীটি আবার চলা শুরু করছে। বহনকারী গাড়ীটি মাজার রোডের কাছে পৌঁছানো মাত্রই কয়েকজন পিকেটার দেখে গাড়ীর ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন পুলিশ এসে পিকেটারদের ধাওয়া করল। অন্যপাশ থেকে আরও কয়েকজন পিকেটার এসে পুলিশের দিকে ইট ছুড়তে লাগল। গাড়ীর ড্রাইভার হেল্পার মিলে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল গাড়ী নিয়ে আর সামনের দিকে যাবে না। সবাইকে নেমে যেতে বল্ল, পরিস্থিতির কারণে যাত্রীরা নেমে যেতে রাজী হলো। কিন্তু পুলিশ ও পিকেটারদের গলযোগের মধ্যে কেউ গাড়ী থেকে নামল না। যে দিকে পুলিশ পিকেটারদেরকে ধাওয়া করল ঠিক তার উল্টো দিক থেকে কয়েকজন পিকেটার এসে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ীর দিকে ইট ছুড়তে শুরু করল। গাড়ীর কয়েকটা গ্লাস ভেঙ্গে গেল। যাত্রীরা দিকবিদিক ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্ণব বুঝতে পারছেনা ও এখন কি করবে। এর মধ্যে একটা আধলা ইট সরাসরি অর্ণবের কপালে লাগল। মুহুর্তের মধ্যেই অর্ণব জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়ল। একজন পিকেটার গাড়ীতে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল।
অর্ণবের বাড়ীতে আজ প্রচুর পরিমাণে চেনা ও অচেনা জনসমাগম হয়েছে। এই বাড়ীর চেনা লোকটি আজ অচেনা হয়ে গেছে। চার পাশে নানান লোক জন কান্নাকাটি করছে কিন্তু অর্ণবের মা বাবা ও বোনটি কান্নাকাটি করছে না কারণ তাদের কান্নার ক্ষমতাটুকু সম্পূর্ণরুপে হারিয়ে গেছে।
সুপ্তি বিগত ৭ বছর ধরে অর্ণবের জন্য অনেক বার কেঁদেছে কিন্তু কখনও বুঝতে পারেনি সেই কান্না কবে শেষ হবে। সব সময় ভেবেছে একদিন নিশ্চয় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার সুযোগ আসবে সেটাই হবে শেষ কাঁদা। তবে আজকে সুপ্তি বুঝতে পেরেছে অর্ণবের জন্যই আজকের কাঁদায় শেষ কাঁদা।
সুপ্তির জন্য অর্ণবের অদৃশ্য কান্না অদৃশ্য রয়েই গেলো।
বছরের এই সময়টাতে সাধারণত বৃষ্টি হতে দেখা যায়না। কিন্তু এবছর প্রকৃতি তার সনাতনি প্রথা ভেঙ্গে মেঘ বৃষ্টির এক নতুন খেলা চালু করেছে। কয়েকদিন যাবৎ কখনও সখনও সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে বটে কিন্তু অঝরে বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামটি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর তুলনায় উঁচু হওয়ায় গ্রামের ভিতরে বৃষ্টির পানি জমে নেই তবে গ্রামের চারপাশ দিয়ে সবুজ আবৃত্ত মাঠগুলো বৃষ্টির পানি জমে সাদা হয়ে আছে। সেই জমে থাকা সাদা পানি ফূড়ে ধানের পাতাগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে রোদ্র সঙ্গ কামনা করছে, আর বলছে হে রোদ্র তুমি আস এই নাছড় বৃষ্টির সাথে পরকিয়া সম্পর্ক ছেড়ে তোমার সাথে পুরাতন সম্পর্কের দোলযাত্রায় ফিরে যাব। তবে এই বদ্ধ পানির খাঁচা থেকে কিছু অতিকায় লম্বা ধানগুলি প্রকৃতি বা মালিক পক্ষের সহেযোগিতা ব্যতিত সযত্নে নিজেদেরকে বড় করে তুলার সংগ্রামে লিপ্ত।
শহরের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় গ্রামের অনেক যুবক স্বল্প খরচে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে কিন্তু চাকুরী দাতাদের পাশ্ববর্তী স্থলে না থাকার কারণের সেই ভাবে অনেকেই চাকুরীর সুযোগ পায়নি। উচ্চ শিক্ষিতি যুবকগুলো যেন প্রকৃতির খেয়ালী খেলার ফলসৃত অতিবৃষ্টির পানিতে জমে থাকা ধানগুলোর মত বলছে হে চাকুরী তুমি আস আমাদের হাতে ধরা দাও তুমি নাছড় বেকারত্ত্বের হাত থেকে আমাদেরকে বাঁচাও। তবে যতই চাকুরী কামনা করুক না কেন ‘দুষ্প্রাপ্য চাকুরী’ নামক সু-প্রাপ্য শব্দের সহজলভ্যতায় বেকারত্ত্ব তকমা পাওয়া যুবকগুলো দিনে দিনে ব্যক্তি থেকে বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। তবে এর মধ্য থেকে কোন কোন যুবক অতিকায় ধানের মত নিজগুণে চাকুরী নামক প্রবাদী সোনার হরিণকে নিজের কর-আয়ত্বে আনতে সক্ষম হয়েছে বা হচ্ছে। তেমনি একজন যুবক অর্ণব।
মাঝারির মানের উচচ্চতার সাথে পেটানো শরীরে শ্যামলা বর্ণের রঙ তার সাথে মিলিত হয়েছে জোড়া ভুরু, লম্বা মোটা ধাচের কাল চুল ও কাল বড় বড় দু’টি চোখ। সবগুলোর সংমিশ্রণের অসাধারণ এক সাধারণ চেহারার যুবক অর্ণব। পড়াশোনা, খেলাধুলা, মুখ-অবয়ব, আচার আচরণ সবকিছুতেই অর্ণব সাধারণ। সমগ্র সাধারণের সম্মিলিত রূপে অর্ণব একজন অনন্য সাধারণ যুবক হিসাবে এলাকায় সুপরিচিত। অন্যন্য সাধারণের সাথে তার জ্ঞান পিপাসু অনুসন্ধিৎসু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে দাম্ভিকতা ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্ন মর্যাদায় নিয়ে গেছে কিন্তু সে দাম্ভিক নয়।
সাধারণ দরিদ্র পরিবারের বাবা মায়ের প্রথম সন্তান হওয়ায় পরিবারের ভোরণপোষণের দায়ভার চাপানোর পায়তারা সফল করার নিমিত্তে কৃষক বাবা পাড়ায় পাড়ায় প্রায় গর্ব করে বলে-আর কেউ চাকুরী পাক বা না পাক আমার ছেলে চাকুরী পাবেই। অর্ণবের বাবার এই গৌরবপূর্ণ প্রচারে যতটা না গৌরব থাকে তার চেয়ে বেশী থাকে প্রত্যাশা। কারণ বয়সের কারণেই হোক বা অন্য যে কোন কারেণেই হোক তার কাজের ঈস্পৃহা নিষ্প্রভ হতে চলেছে। অন্যদিকে অর্ণবের অবশিষ্ট্য ৩ ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ, বাবা ও মায়ের ছোটখাট অসুখগুলোর জন্য অর্ণবের বাবাকে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়ে তা বর্গা নেওয়া জমিতে কাজ করে সেই অর্থের খুব সামান্য পরিমাণই আসে।
খুশির জোয়ার অর্ণবের বাড়ীরে সকল অভাব অনটন ও দু:খ কষ্ট আজ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে যার মত করে পাচ্ছে আনন্দ করে যাচ্ছে। অর্ণবের পূর্বপুরুষ/পূর্ব মহিলাদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে তার বংশের কেউ কোনদিন বসের তোষামদি আর সরকারের চাটুবৃত্তি করার দূর্ভাগ্যের সুযোগ পায়নি। অর্ণবের জীবনের সেই সুযোগগুলো এসেছে। তাই বোনের চোখে নতুন নতুন স্বপ্নের সুতোগুলো জাল বুনাতে ব্যস্ত। বাবার চোখে ছয় দশকের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের নানান পরিকল্পনা ঘোরাফেরা করছে, মায়ের চোখে রোগমুক্তির পথ্য গ্রহণের মাধ্যমে পরমায়ূ বৃদ্ধির আনন্দ উচ্ছ্বাস।
কিন্তু কেন? পরবর্তী পর্বে—-
দুই (যাত্রা)
অর্ণব আজকের পূর্বে ঢাকায় বেশ কয়েক বার গেছে। অন্যবারের চেয়ে এবার কার যাওয়ার বেশ কিছু পার্থক্য আছে। যেমন পূর্বে যে কয়বার গিয়েছিল সেটা শুধু চাকুরী খুঁজতে এবার যাচ্ছে চাকুরীতে যোগদান করতে। আগের সময়গুলোতে গিয়েছিল বাসের ঝাকুনী খেতে খেতে এবার যাচ্ছে চেয়ার কোচে ঘুমাতে ঘুমাতে।
অর্ণব যে সীটে বসে আছে সেটি হাফ ফোল্ড করা তাতে না পারছে সোজা হয়ে বসে থাকতে না পারছে শুয়ে থাকতে। কিন্তু সেটা সোজা করতে পারছেও না বা পুরো ফোল্ড করতেও পারছে না। কিভাবে সেটা ফোল্ড করতে হয় কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ বোধ হচ্ছে। অর্ণব বাসের মধ্যে এদিক-ওদিক করে তার মত পরিস্থিতে নিপতিত একজন সঙ্গী খুঁজতে লাগল। সৌভাগ্য বশত: সামনের দিকে তাকিয়ে জিন্সের প্যান্ট পরা গায়ে অদ্ভুত ধরনের একটা পোশাক (যে পোশাকটার নাম অর্ণব জানে না) পরা যুবতী মেয়েকে পেয়ে গেলো। মেয়েটার সীটের দিকে তাকিয়ে কাজটি কি ভাবে করে দেখে শিখে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এধরনের স্মার্ট মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকাটাও খুবই বিব্রতকর আবার না তাকানোটাও বেশ মুশকিল। বিব্রতকর, মুশকিল এর সাথে যুক্ত হয়েছে চেয়ারে বসে থাকার অস্বস্তি। এই মূহুর্তে অর্ণব অস্বস্তিকর বসে থাকা অবস্থা থেকে রেহায় পাওয়ার অজুহাতে বিব্রতকর পরিস্থিতির সুযোগটাই গ্রহণ করল। চুপি চুপি মেয়েটার নিকট থেকে চেয়ার ফোল্ড করা শিখে এখন চেয়ার হেলান শুয়ে স্বপ্নের সিঁড়িতে পা দেওয়ার ভাইভা বোর্ডের ঘটনাগুলো অর্ণবের মনে পড়েছে।
-স্যার আসতে পারি।
-আসুন। বসুন বোর্ডের একজন বলেলন। আপনার নাম কি?
-রাকিবুল ইসলাম অর্ণব।
-অর্ণব
- হ্যাঁ.. হ্যাঁ.. হ্যাঁ..বোর্ডের একজন হেসে উঠলেন। রাকিবুল ইসলাম অর্ণব নামটা কেমন জানি খাপ ছাড়া মনে হচ্ছে। রাকিবুল ইসলাম এর সাথে অর্ণব শব্দটা বড্ড বেশি বেমানান মনে। যাই হোক অর্ণব শব্দের অর্থ বলতে পারবেন?
-সমুদ্র।
-বাবার নাম কি?
-ইসমাইল হোসেন।
-আপনি ইসলাম আপনার বাবা হোসেন। কেমন হয়ে গেলো না?
-What is Major in Mastares of you? আরেকএজন জিজ্ঞেস করলেন।
-Accounting & Information System
-Define the accounting.
-The systematic recording, reporting, and analysis of financial transactions of a business.
-What is accounting Information?
-An accounting information system is a system of collection, storage and processing of financial and accounting data that is used by decision makers.
-What are function of Dr. & Cr.?
-Incraseing asset, Expenses & Decreasing of Liablitye Dr. Drcreasing of asset, income & increaseing of liablity Cr.
-OK, শিক্ষক বললেন।
-এ পর্যন্ত কতজন বাঙ্গালী নোবেল পেয়েছেন? অন্য আরেক এজন টিচার জিজ্ঞেস করলেন।
-তিন জন।
-এই উপমহাশের আর একজন মহান মানুষের জন্য নোবেল ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত নোবেল দেওয়া হয়নি, সেই ব্যক্তিটি কে? এবং কেন তাকে শেষ পর্যন্ত নোবেল দেওয়া হয়নি?
-সরি স্যার, বলতে পারব না।
ভাইভা বোর্ডে তাকে বেশকিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল যা তার চাকুরীর সাথে কোন ভাবেই সম্পৃক্ত নয়। এমন কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল যার সবগুলোর উত্তর জানলেও তার পাওয়া ব্যাংকের চাকুরীতে কোন কাজে আসবে না। অর্ণব ভেবে পায়না কেন এধরনের প্রশ্ন করা হয়। যেমন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল সমুদ্রের সবচেয়ে গভিরতম স্থান কোনটি? এবং এর গভিরতা কত? এর সাথে ব্যাংকের চাকুরীর কি সম্পর্ক অর্ণব বুঝতে পারেনা।
-ভাই টিকিট টা দেখি। গাড়ীর কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করলেন।
পকেট থেকে টিকিটা কন্ডাক্টারকে দিল।
ভাইভা বোর্ডে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিতে না পারায় চাকুরীটা অর্ণব পাবে তা কখনও ভাবেনি।
-আগুণের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, গানটি অর্ণবের স্বল্প দামের চাইনাই তৈরী মোবাইলটিতে বেজে উঠল। হ্যাঁলো মা। হ্যাঁ মা ভাল আছি, না মা পথে কোন সমস্যা হচ্ছে না। তুমি চিন্তা করনা মা। হ্যাঁ মা আমি সাবধানেই যাচ্ছি। বাবাকেও চিন্তা করতে না কর। আর বেশ ভাল ভাবেই যাচ্ছি। ঠিক আছে মা এখনকার মত রাখ।
আজ ঘাটে কোন প্রকার জ্যাম নেই। গাড়ীটা সরাসরি ফেরীতে উঠে গেল। বাস থেকে নেমে ব্যাগটা হাতে করে সরাসরি ফেরির ছাদের উপর উঠে গেলো। অর্ণব কখনও ফেরির ছাদে উঠেনি। ছাদটা অনেক উঁচু হওয়ায় নদীর অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এটাকে জীবনের প্রতিচ্ছবি বলে অর্ণব কাছে মনে হচ্ছে।।
নানান ব্যস্ততার ভিড়ে সুপ্তিকে ফোন দেওয়া হয়নি। ফোন যখন দেওয়া হয়নি এখন ফোন দিবেনা। একবারে চাকুরীতে যোগদানের পরই ফোন করবে। সুপ্তি সেই মেয়ে যে অর্ণবকে অনেকবার ভাল বাসার কথা জানিয়েছে কিন্তু অর্ণব কখনও হ্যাঁ বলেনি। তবে নাও বলেনি। সুপ্তির বাবা উচ্চ মধ্যবিত্ত হওয়ায় অর্ণব সুপ্তির কথায় কখনও হ্যাঁ বলার দু:সাহস দেখায়নি কিন্তু অর্ণব সুপ্তিকে প্রচন্ড ভাল বাসে। অর্ণব মনে করে সুপ্তি তাকে যতটা ভালবাসে, সুপ্তিকে অর্ণব তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভাল বাসে। সুপ্তি অর্ণবের ভালবাসায় সাড়া না পাওয়ার জন্য অর্ণবের সামনে অনেক বার কেঁদেছে কিন্তু অর্ণব সাড়া না দিতে পারায় গোপনে গোপনে অনেক কেঁদেছে। সুপ্তি ভালবাসাকে প্রকাশ করেছে আর অর্ণব ভালবাসাকে করেছে অনুভব।
প্রায় 250 কি.মি দূর থেকে ঢাকা আসতে সময় লেগেছে সাড়ে 4 ঘন্টা কিন্তু ঢাকা শহরের মধ্যে 5 কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ইতিমধ্যেই প্রায় ২ ঘন্টা সময় পার হয়ে গেছে। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যামের অবকাশে নানান ধরনের ভাবনা ভাবতে হচ্ছে। প্রায় দেড়কোটি লোকের বসবাসরত ঢাকা শহরের মানুষের প্রতিদিন কত কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে এবং তার আর্থিক মূল্যই বা কত? অর্ণবের খুব জানতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এই রকম কোন পারিসাংখ্যিক তথ্য আছে বলে অর্ণবের জানা নেই।
তিন। (অন্তিম যাত্রা)
বলাকার মত ডানা মেলে উড়তে পারলে ভাল লাগত। সৃষ্টিকর্তা অতি সাধারণ প্রাণীদেরকে অসাধারণ ক্ষমতা দিয়েছে কিন্তু মানুষের মত অসাধারণ প্রাণীদেরকে অসাধারণ ক্ষমতা দেয়নি। পাখিরা কি সুন্দরভাবে আকাশে উড়ে সমস্ত শহরকে একনজরে দেখতে পায়। মানুষ তা পারেণা। সৃষ্টিকর্তা কেন মানুষকে সেই ক্ষমতা দিলনা সৃষ্টি কর্তার কাছে অর্ণবের সেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। চাকুরী যোগদান করার পর অর্ণবের উড়তে ইচ্ছা করছে। নানান সময়ে জন্ম নেওয়া নানান স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে শুরু করেছে। মায়ের রোগমুক্তি, বাবার কঠোর পরিশ্রম থেকে মুক্তি, ছোট্ট বোনের টেলিভিশনের স্বপ্ন, ভাইয়ের স্মার্ট ফোনের স্বপ্ন এবং সুপ্তিকে নিয়ে সমুদ্র স্নানের স্বপ্ন এগুলো পূরণ করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এত স্বপ্ন পূরণের সাধ্য সুখের মধ্যেই এই মূহুর্তে একটা বিষয় অর্ণবকে কষ্ট দিচ্ছে। অর্ণব চেয়েছিল আজকে ঢাকাতে থাকতে। বন্ধুর নিকট থেকে কিছু টাকা ধার করে নিয়ে এসেছে। যে টাকা দিয়ে অর্ণব মা, বাবা ভাই-বোন ও সুপ্তির জন্য শপিং করতে চায়। অর্ণবের মনে আছে এই বন্ধুর নিকট ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজিস্ট্রষনের সময় 5 শ টাকা টাকা ধার চেয়েছিল তখন সে টাকাগুলো ধার দেয়নি। এবার ও কিছু পোশাক কেনার জন্য 3 হাজার টাকা ধার চাই কিন্তু দিয়েছে 5 হাজার টাকা। হঠাৎ করে কি কারণে যেন আগামী কাল 12 ঘন্টার হরতাল ডেকেছে একটি রাজনৈতিক সংগঠন। তাই আজকেই বাড়ী চলে যেতে হবে। কেনাকাটার কোন সুযোগ পাবেনা।
মসজিদ থেকে মাগরীবের আযান ভেসে আসছে। হরতাল আগামীকাল অথচ আজ সন্ধ্যা থেকে বিক্ষুব্ধ ভাবে পিকেটিং শুরু হয়ে গেছে। অর্ণবের গাড়ীতে উঠতে ভয় লাগছে। কিন্তু থাকার কথাও ভাবতে পারছে না। কারণ ইদানিং প্রায়ই হরতালের সময় পিকেটারদের সাথে পুলিশের গন্ডগোল হচ্ছে ফলে হারতালের মেয়াদ বাড়ছে। আগামীকাল এর ব্যতিক্রম না ঘটতে পারে তাই। আজকেই চলে যেতে হবে।
আসাদ গেট থেকে গাবতলী উদ্দেশ্যে একটি বাসে উঠল। গাড়ীতে খুব বেশী ভিড় নেই, যেহেতু হরতালের পূর্বের দিন; হরতাল বিষয়ে সকলেই অবগত তাই রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যাও তুলনামূলক ভাবে কম। অর্ণবকে বহনকারী গাড়ীটি সতর্কতার সাথে গাবতলীর দিকে আসছে। যখনই পিকেটিং দেখতে পাচ্ছে গাড়ী থামিয়ে দিচ্ছে। যখন পুলিশে পিকেটারদেরকে ধাওয়া করছে তখন গাড়ীটি আবার চলা শুরু করছে। বহনকারী গাড়ীটি মাজার রোডের কাছে পৌঁছানো মাত্রই কয়েকজন পিকেটার দেখে গাড়ীর ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন পুলিশ এসে পিকেটারদের ধাওয়া করল। অন্যপাশ থেকে আরও কয়েকজন পিকেটার এসে পুলিশের দিকে ইট ছুড়তে লাগল। গাড়ীর ড্রাইভার হেল্পার মিলে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল গাড়ী নিয়ে আর সামনের দিকে যাবে না। সবাইকে নেমে যেতে বল্ল, পরিস্থিতির কারণে যাত্রীরা নেমে যেতে রাজী হলো। কিন্তু পুলিশ ও পিকেটারদের গলযোগের মধ্যে কেউ গাড়ী থেকে নামল না। যে দিকে পুলিশ পিকেটারদেরকে ধাওয়া করল ঠিক তার উল্টো দিক থেকে কয়েকজন পিকেটার এসে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ীর দিকে ইট ছুড়তে শুরু করল। গাড়ীর কয়েকটা গ্লাস ভেঙ্গে গেল। যাত্রীরা দিকবিদিক ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্ণব বুঝতে পারছেনা ও এখন কি করবে। এর মধ্যে একটা আধলা ইট সরাসরি অর্ণবের কপালে লাগল। মুহুর্তের মধ্যেই অর্ণব জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়ল। একজন পিকেটার গাড়ীতে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল।
অর্ণবের বাড়ীতে আজ প্রচুর পরিমাণে চেনা ও অচেনা জনসমাগম হয়েছে। এই বাড়ীর চেনা লোকটি আজ অচেনা হয়ে গেছে। চার পাশে নানান লোক জন কান্নাকাটি করছে কিন্তু অর্ণবের মা বাবা ও বোনটি কান্নাকাটি করছে না কারণ তাদের কান্নার ক্ষমতাটুকু সম্পূর্ণরুপে হারিয়ে গেছে।
সুপ্তি বিগত ৭ বছর ধরে অর্ণবের জন্য অনেক বার কেঁদেছে কিন্তু কখনও বুঝতে পারেনি সেই কান্না কবে শেষ হবে। সব সময় ভেবেছে একদিন নিশ্চয় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার সুযোগ আসবে সেটাই হবে শেষ কাঁদা। তবে আজকে সুপ্তি বুঝতে পেরেছে অর্ণবের জন্যই আজকের কাঁদায় শেষ কাঁদা।
সুপ্তির জন্য অর্ণবের অদৃশ্য কান্না অদৃশ্য রয়েই গেলো।