ডাণ্ডি শব্দের অর্থ ফুল বাবু।
ব্রিটিশভারতের ইতিহাসে শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল হিন্দুদের জন্য শব্দটিকে
ব্যবহার করা হলেও পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে হিন্দুদের নিচু করার জন্য
শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মুহাম্মাদ শব্দটি থেকে উৎপত্তি Mohammedan
শব্দটির। যার অর্থ মুহাম্মদের অনুসারী। যদিও অর্থগত দিক থেকে খারাপ কিছুই
নেই, তবে শুনেছি কলকতায় মুসলামানদের ক্ষেপানোর জন্য শব্দটি ব্যবহার করা
হয়। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে মুসলমানদের একাধিকবার মহামেডন বলা হয়েছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের পাহাপাশি ধর্মীয় নানা বিষয়ে বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে
খুবই সূক্ষ্ম কাজ করা হয়েছে। এই লেখার মাধ্যমে আমরা সেই সব সূক্ষ্ম
বিষয়ের প্রয়োজনীয় অংশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
আমরা জানি হিন্দুধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ দুইভাবে বিভক্ত, একটি শ্রুতি অন্যটি স্মৃতি। শ্রুতি হল যা ঈশ্বরের থেকে শুনে লেখা হয়েছে। যেমন বেদ। অন্যদিকে স্মৃতি হল মুনি ঋষিরা যা বংশ পরম্পরায় লিখেছেন। যেমন রামায়ণ-মহাভারত। যেসব ধর্মীয় কাল্পকাহিনী কবিতার ছন্দে প্রকাশ করা হয় তাকে বলা হয় মহাকাব্য। তাই রামায়ণ ও মহাভারতকে স্মৃতি মহাকাব্য বলা হয়। রামায়ণের প্রধান চরিত্রের নাম রাম। অনাকাঙ্ক্ষিত এক দুর্ঘটনার ক্ষোভ থেকে রামের স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় লঙ্কার সম্রাট রাবণ। স্ত্রী সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রাণ রাম। পৃথিবীর নানা প্রান্তঘুরে কোথাও দেখা মিলে না রাবণের। এমন দুঃসময়ের দিনে সীতার অবস্থান নির্ণয়ে সাহায্যে আসে হনুমান। লঙ্কা যেতে এক বিশাল দুর্গম পথ পারি দিতে হয়। আধুনিক ভাষায় এই পথকে দুই দেশের সীমানা বলতে পারি। দুঃসময়ের পথ পারি দিতে হনুমানকে পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়।
হনুমানের আরেক নাম বাজরাঙ্গ বলি। যারা কুস্তী খেলে তাদের বুঝায় বলা হয় বলি। লক্ষণীয় ছবিতে কুস্তী খেলার দৃশ্যের উপর বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। হনুমানের পিতার নাম পবন কুমার। ছবিতে সালমান খানের নাম বাজরাঙ্গির পাশাপাশি হুনুমানের পিতার নাম অনুসারে পবন কুমার চতুর্বেদী রাখা হয়। তবে এখানে চতুর্বেদী শব্দটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা উচিৎ। হিন্দু ধর্মের জাত প্রথায় মানুষের শ্রেণীকে বিভিন্নভাগে ভাগ করা হয়েছে। তার মধ্যে সবার উপরের শ্রেণীর নাম ব্রাহ্মণ, তারপরের শ্রেণি ক্ষত্রিয়। আবার ব্রাহ্মণদের মধ্যেও অনেক ভাগ আছে। ব্রাহ্মণদের একটি অংশের নাম চতুর্বেদী। হিন্দুদের প্রধান ধর্মশাস্ত্র বেদে’র চারটিতে যারা পণ্ডিত তাদের বলা হয় চতুর্বেদী। ছবিতে আমরা দেখেছি সালমান নিজের বাবার পরিচয় দেওয়ার সময় বলেছিল তার বাবা চার বেদের চারোটিতে পণ্ডিত। হিন্দুরা মনে করে চতুর্বেদীদের পৃথিবীতে আসার কারন ছিল সুপার এছিভমেন্টের জন্য, অর্থাৎ অসম্ভব কিছু সম্ভবের জন্য। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে আমরা সেই বিষয়টার প্রতি লক্ষ্য ছিল। পাবন কুমার চতুর্বেদী তেমনি একটি অসম্ভব সম্ভবের মিশনে নেমেছিল।
আলকায়েদা-তালেবানের মত বাজরাঙ্গ দল হল একটি ভারতীয় হিন্দু জঙ্গি সংগঠন। তবে তাদের মাঝে পার্থক্য হল ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন তুলনামূলক যুদ্ধে বিশ্বাস করে, আর বাজরাঙ্গি দল ধর্মান্তরে জোর দেয়। মৌলবাদী এই সংগঠনটি রামায়ণের হনুমান দেবতার নাম অনুস্বারে নিজেদের নাম রেখেছে বাজরাঙ্গ দল। তারা বিশ্বাস করে ভারত শুধুই হিন্দুদের দেশ; ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে আঘাত হানছে মুসলমানরা। তাই তাদের শ্লোগান হল “হিন্দু হও, নয়তো ভারত ছাড়ো।” সালমানের বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে বাজরাঙ্গ দলের প্রতি কোনো বার্তা ছিল কিনা জানি না। তবে বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবি দেখে বাজরাঙ্গ দল তীব্র বিরোধিতা করে বড় ধরণের অঘটনের হুমিক দিয়েছিল। ছবির মূল বিষয়ে প্রবেশের আগে আমাদের আরও কিছু জেনে নেওয়া উচিৎ। নিচে তা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
নব্বইয়ের দশকে গোয়ান্দাবৃত্তি এবং বোমাহামলার অভিযোগে সরবজিত সিং নামের এক অবৈধ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান পুলিশ। পাকিস্তান সরকার কোনো ধরণের তথ্যপ্রমাণ ছাড়া অনৈতিকভাবে সরবজিতের ফাঁসির আদেশ দেয়। সরবজিতের মুক্তির জন্য আন্দোলনে নামে ভারতীয় হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন বাজরাঙ্গি দল। অনলাইনে তার মুক্তির জন্য “ফ্রী_সরবজিত_সিং_ক্যাম্পেইন” খোলা হয়। সালমান খানও তার মুক্তির পক্ষে আন্দোলনে নেমেছিল। অবশেষে কূটনৈতিক হিসেব নিকেশের মাঝে সরবজিতের ফাঁসি না হলেও দীর্ঘ বাইশ বছরের বন্দী জীবনের শেষ মুহূর্তে পাকিস্তান সরকারের প্ররোচনায় জেলের মাঝেই খুন হয় সরবজিত। তার মৃত্যুর পর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে বাজরাঙ্গি দল। দাবী উঠে পাকিস্তান এম্বাসি বন্ধের। সরবজিতের মৃতদেহ পাকিস্তান থেকে ভারতে আনার সময় সীমান্তের চারপাশে ঢল নামে হাজার মানুষের। বলা যায় ইন্টেরনেটের মাধ্যমে সরবজিতের ঘটনা ভারত পাকিস্তানের মাঝে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে আমরা দেখেছি পাবন (সালমান) এবং মুন্নি পাকিস্তান এমব্যাসিতে যাওয়ার সময় করমজিত সিং নামে এক ব্যাক্তির মুক্তির জন্য কিছু মানুষ আন্দোলন করছিল। আন্দোলনকর্মীদের মাথায় হলুদ কাপড় এবং হাতের পতাকা দেখে অনুমান করা যায় ইঙ্গিতটা বাজরাঙ্গ দলের প্রতিই ছিল। তবে বিতর্ক এড়াতে ছবিতে সরবজিত সিং নাম ব্যবহার না করে করমজিত নামটা ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ছবির শেষের দিকে দেখতে পাই, সালমান খান পাকিস্তান পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে পাকিস্তানী হাইকমান্ড থেকে অবৈধ উপায়ে কনফেস করে তাকে গোয়েন্দা বানানোর চেষ্টা করছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে জানা যায় সরবজিত সিং এর ক্ষেত্রে একই ধরণের কনফেস করানোর ঘটনা হয়েছিল। বিশ্বমিডিয়ার কাছে পাকিস্তানী হাইকমান্ড তাকে RAW এজেন্ট হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। কোন ধরণের তথ্য প্রমাণ ধারণা করছি ছবির এই দুই পৃথক মিল সরবজিত সিং এর ঘটনাকে ইঙ্গিত করছে।
ভারত-পাকিস্তানের মূল বিতর্কের কারন দ্বিজাতিতত্ত্ব। দুই জাতিকে পৃথক করে ভারত এবং পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়ার সময় ভবিষ্যৎ বিতর্ক সৃষ্টির জন্য বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ করেন বৃটিশ আইনজীবী রেডক্লিপ। দেশভাগের সময় ৫৬৫ টি রাজ্যের রাজ্যপ্রধানকে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কার সঙ্গে থাকতে চায় তা জানোর জন্য। সাধারণত হিন্দু প্রধান রাজ্যগুলি যোগ দিয়েছিল ভারতের সাথে এবং মুসলিম প্রধান রাজ্যগুলি যোগ দেয় পাকিস্তানের সাথে। কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজ্যপ্রধান ছিলেন একজন হিন্দু, কিন্তু জনসংখ্যার দিকে বেশি ছিল মুসলমান। ফলে জন্ম হয় কাশ্মীর সীমান্ত বিরোধের। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে ঐতিহাসিক কাশ্মীর সীমান্তের প্রতি খুবই নজর দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীর সীমান্ত বিরোধে ভারত-পাকিস্তান-চীন এই তিন দেশ বেশ শক্তভাবে যুক্ত। আমরা ছবিতে লক্ষ্য করেছি ওমপুরীর (মওলানা) একটি মন্তব্য আছে, “থোরা সা কাশ্মীর হামারে বি হে!” অর্থাৎ, “কিছুটা কাশ্মীর পাকিস্তানেরও আছে।“ মূলত এই মন্তব্যের কারনে বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিটি পাকিস্তানে নিষিদ্ধের ডাক উঠেছে। কারন পাকিস্তান মনে করে কাশ্মীরের দাবীদার পাকিস্তান একা। কাশ্মীর নিয়ে ছবিতে প্রথমদিকের দৃশ্যে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। ছবির শুরুতে যে ট্রেনটি দেখানো হয় তার নাম সামজোতা এক্সপ্রেস। ভারত-পাকিস্তানের “কাশ্মীর বিরোধ রোধ করতে” দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের রক্ষার জন্য এই সমজোতা এক্সপ্রেসের যাত্রা শুরু হয়। তবে ২০০৭ সালে এই ট্রেনের উপর মারাত্মক বোমা হামলা হয়েছিল। এখনও লাস্করি তৈয়ব এবং হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি মাঝে মধ্যে হামলার হুমকি দিচ্ছে। তাই কাশ্মীর সীমান্ত উত্তেজনার মাঝে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর হামলা রোধ করতে জন্য খুবই উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মাঝে এই ট্রেন চলাচল করে।
বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে আমরা দেখেছি পাবন (সালমান) এবং রাসিকার (কারিনা) পিতা দয়ানন্দের (শরত সাক্সেনা) মাঝে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় বিষয়ে বিবাদ হয়েছিল। ব্রাহ্মণরা সাধারণত নিজের ঘরে ব্রাহ্মণদেরকেই থাকতে দেয়। তবে যুগের পরিবর্তনে ব্রাহ্মণের ঘরে ক্ষত্রিয় রাখার বিতর্ক উঠে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন জানা যায় মুন্নি পাকিস্তানি এবং মুসলমান তখন সবার প্রতিক্রিয়া ছিল মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত। অবশ্য প্রতিক্রিয়ার দেখানোর বেশ যুক্তিসঙ্গত কারন আছে। তাজমহলের স্রষ্টা শাহজাহানের পুত্রের নাম আওরঙ্গজেব। মানুষ হিসাবে তেমনটা ভালো ছিলেন না। পিতা শাহজাহানকে সাত বছর বন্ধী করে খুন করেছিলেন তিনি। অত্যাচারী আওরঙ্গজেব একদিন হামলা চালায় চতুর্বেদীদের ঘরে। এক কথায় তাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে ফেলে দেয় আওরঙ্গজেব। চতুর্বেদীরা পালিয়ে বেঁচে যায়। সেই থেকে চতুর্বেদীরা মুসলমানদের দেখতে পারে না। ছবিতেও আমরা একই বিষয় লক্ষ্য করেছি।
তাছাড়া দয়ানন্দ চরিত্রটি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত একটি সন্দেহ কাজ করছে। আঠারো শতকের দয়ানন্দ সরস্বতী ছিলেন হিন্দু ধর্মের সংস্কারকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন কলকতার ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ। বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ধর্ম নিয়েও মন্তব্য করেছেন। ইসলাম নিয়ে তিনি বলেছেন “ইসলাম ধর্ম অনৈতিকতা এবং যুদ্ধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন আল্লহ কেন অবিশ্বাসীদের দেখতে পারে না। নবী মুহাম্মদকে কেন মানুষ হত্যা করেছিল? এমনকি তিনি মুহাম্মদকে ভন্ড বলেছিলেন, আরও বলেছিলেন, কোরান মুহাম্মদের মুখের বাণী।“ এক কথায় বলা যায় দয়ানন্দ মুসলমান এবং ইসলাম দেখতে পারতেন না। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে কারিনার (রাসিকার) বাবার চরিত্রে অভিনয় করা শরত সাক্সেনাকে দায়নন্দের সেই ঐতিহাসিক ভূমিকাতেই দেখেছি কিনা বলে পারি না। তবে ছবিতে দেখা যায় তিনি মুসলমানদের দেখতে পারেন না।
ইসলাম নিয়ে আপত্তিকর ভিডিও থাকায় ২০০৮ থেকে পাকিস্তানে ইউটিউব নিষিদ্ধ। কিন্তু আমরা দেখেছি সাহায্য ও আন্দোলনের ডাক দেওয়ার জন্য ইউটিউব ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া চাঁদ নাওয়াব নামে যে চরিত্রটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে ইউটিউবের কারনে তা বেশ জনপ্রিয় বলা যায়। ছবির অভিনেতা নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকীকে প্রথম যে দৃশ্য দেখা যায় তা একটি বাস্তব ঘটনার উপর তৈরি। পাকিস্তানের করাচির চাঁদ নাওয়াব নামে এক রিপোর্টারের হাস্যকর ভিডিও ২০০৮ সালে ইউটিউবে ছড়িয়ে। বলা যায় ভিডিওটি বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। ভিডিওটি আমি দেখেছিলাম ২০১১ সালে। সেই হাস্যকর মুহূর্তের খুবই সামান্য অংশ পরিবর্তন করে ছবিতে প্রথম আগমন হয় নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকীর। প্রসঙ্গত আবারও বলে রাখি বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে ইউটিউব ব্যবহার, ইসলামের কটূক্তি এবং পাকিস্তান বিষয়টি অন্তরঙ্গভাবে জড়িত।
ছবির শেষের দিকে আমরা দেখতে পাই পাবন (সালমান) পরোক্ষভাবে মিথ্যে বলে। এই মিথ্যা বলারও একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, এবং তা অন্য আরেকটি মহাকাব্য মহাভারতের সাথে সম্পর্ক রাখে। মহাভারত হল পাণ্ডব এবং কৌরব নামে দুই পরিবারের যুদ্ধের কাহিনী। মূল যুদ্ধ হয়েছিল কুরুক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধে সবার অস্ত্রগুরু দ্রোণ নৈতিক কারনে ছিল অধর্মের পক্ষে। মহভারতের কাহিনীতে দুই মহানয়ক হল অর্জুন এবং যুধিষ্ঠির। অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুকে দ্রোণ হত্যা করেছিল। কিন্তু দ্রোণের হাতে যতক্ষণ অস্ত্র থাকবে তাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। তাই সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে বেঁচে নেওয়া হয়েছিল মিথ্যে বলার জন্য। যুধিষ্ঠির অস্ত্রগুরুকে মিথ্যে বলতে অস্বীকার করে। তবে কৃষ্ণের আদেশে যুধিষ্ঠির পরোক্ষভাবে আংশিক মিথ্যে বলে। এই মিথ্যে না বললে ধর্ম ও সত্যের জয় অসম্ভব ছিল। আমরাও ছবিতে দেখেছি সালমান খান সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হলেও আংশিক মিথ্যে বলেছিল। ছবিতে এই নিয়ে একটি চমৎকার সংলাপও আছে।
নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকীঃ অতপর তুমি তাহলে মিথ্যে বললে?
সালমান খানঃ আমি কখন বললাম?
নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকীঃ আমাকে দিয়ে বলিয়েছ তো!
সালমান খানঃ তাতে কি হয়েছে, মহাভারত দেখো নি?
এখানে "মহাভারত দেখনি বাক্যটিতে" যুধিষ্ঠিরের মিথ্যে বলাটাকে ইঙ্গিত করেছে।
ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ হল আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, এবং মুহাম্মাদ তার রসূল। এই বাক্যটিকে আরবি ভাষায় বলা হয় সাহাদা। ছবিতে আমরা দেখেছি মুন্নি নামের ছোট্ট মেয়েটির পারিবারিক নাম সাহাদা। লক্ষণীয় ছোট্ট মেয়েটি ছয় বছরের থেকে নামাজ পড়ার প্রতি আগ্রহী। এমনকি ছবিতে দেখা যায় মেয়েটিকে হনুমানের মূর্তিকে প্রমাণ করতে বললে মেয়েটি উঠে নামাজ পড়তে চলে যায়। এর কারন হতে পারে সাহাদা নামের অর্থই হল আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং ইসলামে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। তবে ছবির শেষ দৃশ্যে আমরা দেখেছি মুন্নি নামের ছোট মেয়েটির প্রথম মুখের প্রথম বচনটি ছিল “জয় শ্রী রাম মামা।” একই ধরণের স্ববিরোধীতা সালামান খানের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। একজন হনুমান ভক্ত সবসময় রামের নামই স্মরণ করে, অন্যকিছু তার জন্য পাপ। কিন্তু ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায় সালমান খান সূফী পীর আমীন শাহের স্মরণ নিচ্ছে।
হিন্দু ধর্ম মতে হনুমান বান মন্ত্রকে বলা হয় প্রতিজ্ঞা রক্ষার খুবই শক্তিশালী অঙ্গিকারনামা। ছবিতে আমরা দেখেছি কারানি কাপুড়ের একটি উক্তি ছিল, “হনুমানের কসম তিনি আসলেও আমাকে তোমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।“ বলা বাহুল্য হনুমানের নামে কোনো অঙ্গিকার করা হলে তা সত্য করে ছাড়তেই হয়। ছবিতে হনুমান চল্লিশা মন্ত্রের বেশ ব্যবহার দেখা যায়। পতিতালয়ের দৃশ্যে থেকে সালমান খানের পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত এই তিন মিনিটে হনুমান চল্লিশার প্রথম অংশ এবং মাঝখানের অংশ পাঠ করা হয়েছে। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে কারিনা কাপুরের ভূমিকা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবে ছবিতে কারিনার (রাসিকার) প্রথাবিরোধী একটি মন্তব্য দেখা যায়। সাতান্ন মিনিটের কাছাকাছি সময়ে কারিনা (রাসিকা) মন্তব্য করে, “জাত ধর্ম সব ভুয়া। ওসব নিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।“
ছবিতে দেখা যায় পাবন (সালমান) মিথ্যে বলে না, চুরি করে না, নিজ থেকে কারো অনিষ্ঠ করে না। তবে আমার জানা মতে এই সবকটি বৈশিষ্ট্য হনুমানের মূল চরিত্রের বিপরীত। হুনুমান ছোট থেকে মানুষের বিরক্ত করে আনন্দ পেতো, চুরি করে ফলমূল খেয়ে ফেলত, ধ্যানে মগ্ন কোন মুনিকে উড়িয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতো। এমনকি দুষ্টামি করে সূর্যকেও গিলে খেয়ে ফেলেছিল। হনুমানের বিরুদ্ধের বিতর্কিত সত্যগুলির অন্যতম তিনি ধোঁকা দিয়ে তার ভাইকে হত্যা করেছিল। তবে ছবিতে হনুমান ভক্ত হিসাবে সালমান খানের একটি বিষয় সত্য ছিল, বীর হনুমান অন্যকে না বলে পালিয়ে যেতো না। রামায়ণ মহাকাব্যে রাম হনুমানকে সীতা খুঁজতে পাঠানোর সময় সীতাকে আগামনি বার্তা দেওয়ার জন্য একটি আংটি দিয়েছিল। সীতাকে খুঁজে পাওয়ার পর সেই আংটি সীতার হাতে দিয়ে হনুমান সীতাকে প্রস্তাব করেছিল তার পিঠে উঠতে। যাতে সে লঙ্কা থেকে সীতাকে নিয়ে উড়ে যেতে পারে। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে এই ধরণের পিঠে উঠার দৃশ্য আছে। তবে এটিও সত্য এই ধরণের কাকতালীয় মিলকে যুক্তিতে আনা অযৌক্তিক, খুবই হাস্যকর। সীতা চেয়েছিল হনুমানের পিঠে না উঠে রামের যুদ্ধ বিজয়ের পর বাড়ি ফিরতে। তাই হনুমানে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এই সময় হনুমানের মাথায় বুদ্ধি এলো লঙ্কায় এলাম যখন পালিয়ে যাবো না। রাবণের সাথে দেখা করে অস্তিত্বের চিহ্নটা রেখেই যাই এবং অনুমতি নিয়েই পালাবো। ছবিতেও আমরা দেখেছি একই বিষয়। সালমান খানের পালিয়ে যাওয়া অপছন্দ করতো।
মূল বিষয়বস্তু থেকে একটু দূরে থেকে ছবির কিছু নির্মাণ কৌশল নিয়েও আমরা আলোচনা করতে পারি। অনেকে হয়তো জানেন ভারতের বাবরি মসজিদ এবং রাম মন্দিরের অবস্থান সামনাসামনি। ভারতে তেমনি অনেক মন্দির আছে যার পাশেই মসজিদ আছে। ছবিতে আমরা মন্দির মসজিদের পাশাপাশি হওয়ার কিছু দৃশ্যলক্ষ্য করেছি। কিন্তু ছবির মধ্যভাগের পরবর্তী অংশে পাকিস্তানভূখণ্ডে কোনো ধরণের হিন্দুদের মন্দিরের দৃশ্য দেখতে পাই না। যার ইঙ্গিত কিন্তু বিচক্ষণের জন্য সুদূরপ্রসারী বলা যায়।
বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে দুইজন ইসলামী সাধকের নাম নেওয়া হয়েছে। একজন খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া এবং অন্যজন হযরত আমিন শাহ। দুইজনেই বেশ বিখ্যাত এবং সূফী সাধক ছিলেন। আমাদের সিলেটের শাহ জালাল এই খাজা নিজাম উদ্দিন আওয়লিয়ার আদেশেই বাঙলাতে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন। খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়াকে নিয়ে নানা ধরণের অলৌকিক কিংবদন্তী শোনা গেলেও বোবার মুখে কথা ফুটাতে পারেন এই ধরণের কিংবদন্তীর দেখা মিলে নি। অন্যদিকে আমীন শাহ তিনিও একজন সূফী সাধক। তবে তার নামেও হারানো কিছু খুঁজে দেওয়ার কিংবদন্তী পাওয়া যায় না।
শেষ করবো, তবে তার আগে বলে রাখা উচিৎ হবে হয়তো অনেকগুলি অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই আলোচনায় আনা হয়েছে, আবার অনেকগুলি প্রয়োজনীয় বিষয় বাদ পড়েছে। তবে সব কিছু মিলিয়ে বলা যায় বাজরাঙ্গি ভাইজান খুবই পণ্ডিত স্ক্রিপ্ট রাইটের হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। এবং সব কিছু মিলিয়ে বাজরাঙ্গি ভাইজান একটি পরিপূর্ণ ছবি।
আমরা জানি হিন্দুধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ দুইভাবে বিভক্ত, একটি শ্রুতি অন্যটি স্মৃতি। শ্রুতি হল যা ঈশ্বরের থেকে শুনে লেখা হয়েছে। যেমন বেদ। অন্যদিকে স্মৃতি হল মুনি ঋষিরা যা বংশ পরম্পরায় লিখেছেন। যেমন রামায়ণ-মহাভারত। যেসব ধর্মীয় কাল্পকাহিনী কবিতার ছন্দে প্রকাশ করা হয় তাকে বলা হয় মহাকাব্য। তাই রামায়ণ ও মহাভারতকে স্মৃতি মহাকাব্য বলা হয়। রামায়ণের প্রধান চরিত্রের নাম রাম। অনাকাঙ্ক্ষিত এক দুর্ঘটনার ক্ষোভ থেকে রামের স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় লঙ্কার সম্রাট রাবণ। স্ত্রী সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রাণ রাম। পৃথিবীর নানা প্রান্তঘুরে কোথাও দেখা মিলে না রাবণের। এমন দুঃসময়ের দিনে সীতার অবস্থান নির্ণয়ে সাহায্যে আসে হনুমান। লঙ্কা যেতে এক বিশাল দুর্গম পথ পারি দিতে হয়। আধুনিক ভাষায় এই পথকে দুই দেশের সীমানা বলতে পারি। দুঃসময়ের পথ পারি দিতে হনুমানকে পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়।
হনুমানের আরেক নাম বাজরাঙ্গ বলি। যারা কুস্তী খেলে তাদের বুঝায় বলা হয় বলি। লক্ষণীয় ছবিতে কুস্তী খেলার দৃশ্যের উপর বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। হনুমানের পিতার নাম পবন কুমার। ছবিতে সালমান খানের নাম বাজরাঙ্গির পাশাপাশি হুনুমানের পিতার নাম অনুসারে পবন কুমার চতুর্বেদী রাখা হয়। তবে এখানে চতুর্বেদী শব্দটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা উচিৎ। হিন্দু ধর্মের জাত প্রথায় মানুষের শ্রেণীকে বিভিন্নভাগে ভাগ করা হয়েছে। তার মধ্যে সবার উপরের শ্রেণীর নাম ব্রাহ্মণ, তারপরের শ্রেণি ক্ষত্রিয়। আবার ব্রাহ্মণদের মধ্যেও অনেক ভাগ আছে। ব্রাহ্মণদের একটি অংশের নাম চতুর্বেদী। হিন্দুদের প্রধান ধর্মশাস্ত্র বেদে’র চারটিতে যারা পণ্ডিত তাদের বলা হয় চতুর্বেদী। ছবিতে আমরা দেখেছি সালমান নিজের বাবার পরিচয় দেওয়ার সময় বলেছিল তার বাবা চার বেদের চারোটিতে পণ্ডিত। হিন্দুরা মনে করে চতুর্বেদীদের পৃথিবীতে আসার কারন ছিল সুপার এছিভমেন্টের জন্য, অর্থাৎ অসম্ভব কিছু সম্ভবের জন্য। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে আমরা সেই বিষয়টার প্রতি লক্ষ্য ছিল। পাবন কুমার চতুর্বেদী তেমনি একটি অসম্ভব সম্ভবের মিশনে নেমেছিল।
আলকায়েদা-তালেবানের মত বাজরাঙ্গ দল হল একটি ভারতীয় হিন্দু জঙ্গি সংগঠন। তবে তাদের মাঝে পার্থক্য হল ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন তুলনামূলক যুদ্ধে বিশ্বাস করে, আর বাজরাঙ্গি দল ধর্মান্তরে জোর দেয়। মৌলবাদী এই সংগঠনটি রামায়ণের হনুমান দেবতার নাম অনুস্বারে নিজেদের নাম রেখেছে বাজরাঙ্গ দল। তারা বিশ্বাস করে ভারত শুধুই হিন্দুদের দেশ; ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে আঘাত হানছে মুসলমানরা। তাই তাদের শ্লোগান হল “হিন্দু হও, নয়তো ভারত ছাড়ো।” সালমানের বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে বাজরাঙ্গ দলের প্রতি কোনো বার্তা ছিল কিনা জানি না। তবে বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবি দেখে বাজরাঙ্গ দল তীব্র বিরোধিতা করে বড় ধরণের অঘটনের হুমিক দিয়েছিল। ছবির মূল বিষয়ে প্রবেশের আগে আমাদের আরও কিছু জেনে নেওয়া উচিৎ। নিচে তা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
নব্বইয়ের দশকে গোয়ান্দাবৃত্তি এবং বোমাহামলার অভিযোগে সরবজিত সিং নামের এক অবৈধ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান পুলিশ। পাকিস্তান সরকার কোনো ধরণের তথ্যপ্রমাণ ছাড়া অনৈতিকভাবে সরবজিতের ফাঁসির আদেশ দেয়। সরবজিতের মুক্তির জন্য আন্দোলনে নামে ভারতীয় হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন বাজরাঙ্গি দল। অনলাইনে তার মুক্তির জন্য “ফ্রী_সরবজিত_সিং_ক্যাম্পেইন” খোলা হয়। সালমান খানও তার মুক্তির পক্ষে আন্দোলনে নেমেছিল। অবশেষে কূটনৈতিক হিসেব নিকেশের মাঝে সরবজিতের ফাঁসি না হলেও দীর্ঘ বাইশ বছরের বন্দী জীবনের শেষ মুহূর্তে পাকিস্তান সরকারের প্ররোচনায় জেলের মাঝেই খুন হয় সরবজিত। তার মৃত্যুর পর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে বাজরাঙ্গি দল। দাবী উঠে পাকিস্তান এম্বাসি বন্ধের। সরবজিতের মৃতদেহ পাকিস্তান থেকে ভারতে আনার সময় সীমান্তের চারপাশে ঢল নামে হাজার মানুষের। বলা যায় ইন্টেরনেটের মাধ্যমে সরবজিতের ঘটনা ভারত পাকিস্তানের মাঝে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে আমরা দেখেছি পাবন (সালমান) এবং মুন্নি পাকিস্তান এমব্যাসিতে যাওয়ার সময় করমজিত সিং নামে এক ব্যাক্তির মুক্তির জন্য কিছু মানুষ আন্দোলন করছিল। আন্দোলনকর্মীদের মাথায় হলুদ কাপড় এবং হাতের পতাকা দেখে অনুমান করা যায় ইঙ্গিতটা বাজরাঙ্গ দলের প্রতিই ছিল। তবে বিতর্ক এড়াতে ছবিতে সরবজিত সিং নাম ব্যবহার না করে করমজিত নামটা ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ছবির শেষের দিকে দেখতে পাই, সালমান খান পাকিস্তান পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে পাকিস্তানী হাইকমান্ড থেকে অবৈধ উপায়ে কনফেস করে তাকে গোয়েন্দা বানানোর চেষ্টা করছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে জানা যায় সরবজিত সিং এর ক্ষেত্রে একই ধরণের কনফেস করানোর ঘটনা হয়েছিল। বিশ্বমিডিয়ার কাছে পাকিস্তানী হাইকমান্ড তাকে RAW এজেন্ট হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। কোন ধরণের তথ্য প্রমাণ ধারণা করছি ছবির এই দুই পৃথক মিল সরবজিত সিং এর ঘটনাকে ইঙ্গিত করছে।
ভারত-পাকিস্তানের মূল বিতর্কের কারন দ্বিজাতিতত্ত্ব। দুই জাতিকে পৃথক করে ভারত এবং পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়ার সময় ভবিষ্যৎ বিতর্ক সৃষ্টির জন্য বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ করেন বৃটিশ আইনজীবী রেডক্লিপ। দেশভাগের সময় ৫৬৫ টি রাজ্যের রাজ্যপ্রধানকে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কার সঙ্গে থাকতে চায় তা জানোর জন্য। সাধারণত হিন্দু প্রধান রাজ্যগুলি যোগ দিয়েছিল ভারতের সাথে এবং মুসলিম প্রধান রাজ্যগুলি যোগ দেয় পাকিস্তানের সাথে। কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজ্যপ্রধান ছিলেন একজন হিন্দু, কিন্তু জনসংখ্যার দিকে বেশি ছিল মুসলমান। ফলে জন্ম হয় কাশ্মীর সীমান্ত বিরোধের। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে ঐতিহাসিক কাশ্মীর সীমান্তের প্রতি খুবই নজর দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীর সীমান্ত বিরোধে ভারত-পাকিস্তান-চীন এই তিন দেশ বেশ শক্তভাবে যুক্ত। আমরা ছবিতে লক্ষ্য করেছি ওমপুরীর (মওলানা) একটি মন্তব্য আছে, “থোরা সা কাশ্মীর হামারে বি হে!” অর্থাৎ, “কিছুটা কাশ্মীর পাকিস্তানেরও আছে।“ মূলত এই মন্তব্যের কারনে বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিটি পাকিস্তানে নিষিদ্ধের ডাক উঠেছে। কারন পাকিস্তান মনে করে কাশ্মীরের দাবীদার পাকিস্তান একা। কাশ্মীর নিয়ে ছবিতে প্রথমদিকের দৃশ্যে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। ছবির শুরুতে যে ট্রেনটি দেখানো হয় তার নাম সামজোতা এক্সপ্রেস। ভারত-পাকিস্তানের “কাশ্মীর বিরোধ রোধ করতে” দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের রক্ষার জন্য এই সমজোতা এক্সপ্রেসের যাত্রা শুরু হয়। তবে ২০০৭ সালে এই ট্রেনের উপর মারাত্মক বোমা হামলা হয়েছিল। এখনও লাস্করি তৈয়ব এবং হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি মাঝে মধ্যে হামলার হুমকি দিচ্ছে। তাই কাশ্মীর সীমান্ত উত্তেজনার মাঝে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর হামলা রোধ করতে জন্য খুবই উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মাঝে এই ট্রেন চলাচল করে।
বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে আমরা দেখেছি পাবন (সালমান) এবং রাসিকার (কারিনা) পিতা দয়ানন্দের (শরত সাক্সেনা) মাঝে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় বিষয়ে বিবাদ হয়েছিল। ব্রাহ্মণরা সাধারণত নিজের ঘরে ব্রাহ্মণদেরকেই থাকতে দেয়। তবে যুগের পরিবর্তনে ব্রাহ্মণের ঘরে ক্ষত্রিয় রাখার বিতর্ক উঠে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন জানা যায় মুন্নি পাকিস্তানি এবং মুসলমান তখন সবার প্রতিক্রিয়া ছিল মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত। অবশ্য প্রতিক্রিয়ার দেখানোর বেশ যুক্তিসঙ্গত কারন আছে। তাজমহলের স্রষ্টা শাহজাহানের পুত্রের নাম আওরঙ্গজেব। মানুষ হিসাবে তেমনটা ভালো ছিলেন না। পিতা শাহজাহানকে সাত বছর বন্ধী করে খুন করেছিলেন তিনি। অত্যাচারী আওরঙ্গজেব একদিন হামলা চালায় চতুর্বেদীদের ঘরে। এক কথায় তাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে ফেলে দেয় আওরঙ্গজেব। চতুর্বেদীরা পালিয়ে বেঁচে যায়। সেই থেকে চতুর্বেদীরা মুসলমানদের দেখতে পারে না। ছবিতেও আমরা একই বিষয় লক্ষ্য করেছি।
তাছাড়া দয়ানন্দ চরিত্রটি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত একটি সন্দেহ কাজ করছে। আঠারো শতকের দয়ানন্দ সরস্বতী ছিলেন হিন্দু ধর্মের সংস্কারকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন কলকতার ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ। বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ধর্ম নিয়েও মন্তব্য করেছেন। ইসলাম নিয়ে তিনি বলেছেন “ইসলাম ধর্ম অনৈতিকতা এবং যুদ্ধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন আল্লহ কেন অবিশ্বাসীদের দেখতে পারে না। নবী মুহাম্মদকে কেন মানুষ হত্যা করেছিল? এমনকি তিনি মুহাম্মদকে ভন্ড বলেছিলেন, আরও বলেছিলেন, কোরান মুহাম্মদের মুখের বাণী।“ এক কথায় বলা যায় দয়ানন্দ মুসলমান এবং ইসলাম দেখতে পারতেন না। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে কারিনার (রাসিকার) বাবার চরিত্রে অভিনয় করা শরত সাক্সেনাকে দায়নন্দের সেই ঐতিহাসিক ভূমিকাতেই দেখেছি কিনা বলে পারি না। তবে ছবিতে দেখা যায় তিনি মুসলমানদের দেখতে পারেন না।
ইসলাম নিয়ে আপত্তিকর ভিডিও থাকায় ২০০৮ থেকে পাকিস্তানে ইউটিউব নিষিদ্ধ। কিন্তু আমরা দেখেছি সাহায্য ও আন্দোলনের ডাক দেওয়ার জন্য ইউটিউব ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া চাঁদ নাওয়াব নামে যে চরিত্রটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে ইউটিউবের কারনে তা বেশ জনপ্রিয় বলা যায়। ছবির অভিনেতা নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকীকে প্রথম যে দৃশ্য দেখা যায় তা একটি বাস্তব ঘটনার উপর তৈরি। পাকিস্তানের করাচির চাঁদ নাওয়াব নামে এক রিপোর্টারের হাস্যকর ভিডিও ২০০৮ সালে ইউটিউবে ছড়িয়ে। বলা যায় ভিডিওটি বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। ভিডিওটি আমি দেখেছিলাম ২০১১ সালে। সেই হাস্যকর মুহূর্তের খুবই সামান্য অংশ পরিবর্তন করে ছবিতে প্রথম আগমন হয় নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকীর। প্রসঙ্গত আবারও বলে রাখি বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে ইউটিউব ব্যবহার, ইসলামের কটূক্তি এবং পাকিস্তান বিষয়টি অন্তরঙ্গভাবে জড়িত।
ছবির শেষের দিকে আমরা দেখতে পাই পাবন (সালমান) পরোক্ষভাবে মিথ্যে বলে। এই মিথ্যা বলারও একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, এবং তা অন্য আরেকটি মহাকাব্য মহাভারতের সাথে সম্পর্ক রাখে। মহাভারত হল পাণ্ডব এবং কৌরব নামে দুই পরিবারের যুদ্ধের কাহিনী। মূল যুদ্ধ হয়েছিল কুরুক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধে সবার অস্ত্রগুরু দ্রোণ নৈতিক কারনে ছিল অধর্মের পক্ষে। মহভারতের কাহিনীতে দুই মহানয়ক হল অর্জুন এবং যুধিষ্ঠির। অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুকে দ্রোণ হত্যা করেছিল। কিন্তু দ্রোণের হাতে যতক্ষণ অস্ত্র থাকবে তাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। তাই সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে বেঁচে নেওয়া হয়েছিল মিথ্যে বলার জন্য। যুধিষ্ঠির অস্ত্রগুরুকে মিথ্যে বলতে অস্বীকার করে। তবে কৃষ্ণের আদেশে যুধিষ্ঠির পরোক্ষভাবে আংশিক মিথ্যে বলে। এই মিথ্যে না বললে ধর্ম ও সত্যের জয় অসম্ভব ছিল। আমরাও ছবিতে দেখেছি সালমান খান সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হলেও আংশিক মিথ্যে বলেছিল। ছবিতে এই নিয়ে একটি চমৎকার সংলাপও আছে।
নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকীঃ অতপর তুমি তাহলে মিথ্যে বললে?
সালমান খানঃ আমি কখন বললাম?
নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকীঃ আমাকে দিয়ে বলিয়েছ তো!
সালমান খানঃ তাতে কি হয়েছে, মহাভারত দেখো নি?
এখানে "মহাভারত দেখনি বাক্যটিতে" যুধিষ্ঠিরের মিথ্যে বলাটাকে ইঙ্গিত করেছে।
ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ হল আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, এবং মুহাম্মাদ তার রসূল। এই বাক্যটিকে আরবি ভাষায় বলা হয় সাহাদা। ছবিতে আমরা দেখেছি মুন্নি নামের ছোট্ট মেয়েটির পারিবারিক নাম সাহাদা। লক্ষণীয় ছোট্ট মেয়েটি ছয় বছরের থেকে নামাজ পড়ার প্রতি আগ্রহী। এমনকি ছবিতে দেখা যায় মেয়েটিকে হনুমানের মূর্তিকে প্রমাণ করতে বললে মেয়েটি উঠে নামাজ পড়তে চলে যায়। এর কারন হতে পারে সাহাদা নামের অর্থই হল আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং ইসলামে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। তবে ছবির শেষ দৃশ্যে আমরা দেখেছি মুন্নি নামের ছোট মেয়েটির প্রথম মুখের প্রথম বচনটি ছিল “জয় শ্রী রাম মামা।” একই ধরণের স্ববিরোধীতা সালামান খানের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। একজন হনুমান ভক্ত সবসময় রামের নামই স্মরণ করে, অন্যকিছু তার জন্য পাপ। কিন্তু ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায় সালমান খান সূফী পীর আমীন শাহের স্মরণ নিচ্ছে।
হিন্দু ধর্ম মতে হনুমান বান মন্ত্রকে বলা হয় প্রতিজ্ঞা রক্ষার খুবই শক্তিশালী অঙ্গিকারনামা। ছবিতে আমরা দেখেছি কারানি কাপুড়ের একটি উক্তি ছিল, “হনুমানের কসম তিনি আসলেও আমাকে তোমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।“ বলা বাহুল্য হনুমানের নামে কোনো অঙ্গিকার করা হলে তা সত্য করে ছাড়তেই হয়। ছবিতে হনুমান চল্লিশা মন্ত্রের বেশ ব্যবহার দেখা যায়। পতিতালয়ের দৃশ্যে থেকে সালমান খানের পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত এই তিন মিনিটে হনুমান চল্লিশার প্রথম অংশ এবং মাঝখানের অংশ পাঠ করা হয়েছে। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে কারিনা কাপুরের ভূমিকা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবে ছবিতে কারিনার (রাসিকার) প্রথাবিরোধী একটি মন্তব্য দেখা যায়। সাতান্ন মিনিটের কাছাকাছি সময়ে কারিনা (রাসিকা) মন্তব্য করে, “জাত ধর্ম সব ভুয়া। ওসব নিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।“
ছবিতে দেখা যায় পাবন (সালমান) মিথ্যে বলে না, চুরি করে না, নিজ থেকে কারো অনিষ্ঠ করে না। তবে আমার জানা মতে এই সবকটি বৈশিষ্ট্য হনুমানের মূল চরিত্রের বিপরীত। হুনুমান ছোট থেকে মানুষের বিরক্ত করে আনন্দ পেতো, চুরি করে ফলমূল খেয়ে ফেলত, ধ্যানে মগ্ন কোন মুনিকে উড়িয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতো। এমনকি দুষ্টামি করে সূর্যকেও গিলে খেয়ে ফেলেছিল। হনুমানের বিরুদ্ধের বিতর্কিত সত্যগুলির অন্যতম তিনি ধোঁকা দিয়ে তার ভাইকে হত্যা করেছিল। তবে ছবিতে হনুমান ভক্ত হিসাবে সালমান খানের একটি বিষয় সত্য ছিল, বীর হনুমান অন্যকে না বলে পালিয়ে যেতো না। রামায়ণ মহাকাব্যে রাম হনুমানকে সীতা খুঁজতে পাঠানোর সময় সীতাকে আগামনি বার্তা দেওয়ার জন্য একটি আংটি দিয়েছিল। সীতাকে খুঁজে পাওয়ার পর সেই আংটি সীতার হাতে দিয়ে হনুমান সীতাকে প্রস্তাব করেছিল তার পিঠে উঠতে। যাতে সে লঙ্কা থেকে সীতাকে নিয়ে উড়ে যেতে পারে। বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে এই ধরণের পিঠে উঠার দৃশ্য আছে। তবে এটিও সত্য এই ধরণের কাকতালীয় মিলকে যুক্তিতে আনা অযৌক্তিক, খুবই হাস্যকর। সীতা চেয়েছিল হনুমানের পিঠে না উঠে রামের যুদ্ধ বিজয়ের পর বাড়ি ফিরতে। তাই হনুমানে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এই সময় হনুমানের মাথায় বুদ্ধি এলো লঙ্কায় এলাম যখন পালিয়ে যাবো না। রাবণের সাথে দেখা করে অস্তিত্বের চিহ্নটা রেখেই যাই এবং অনুমতি নিয়েই পালাবো। ছবিতেও আমরা দেখেছি একই বিষয়। সালমান খানের পালিয়ে যাওয়া অপছন্দ করতো।
মূল বিষয়বস্তু থেকে একটু দূরে থেকে ছবির কিছু নির্মাণ কৌশল নিয়েও আমরা আলোচনা করতে পারি। অনেকে হয়তো জানেন ভারতের বাবরি মসজিদ এবং রাম মন্দিরের অবস্থান সামনাসামনি। ভারতে তেমনি অনেক মন্দির আছে যার পাশেই মসজিদ আছে। ছবিতে আমরা মন্দির মসজিদের পাশাপাশি হওয়ার কিছু দৃশ্যলক্ষ্য করেছি। কিন্তু ছবির মধ্যভাগের পরবর্তী অংশে পাকিস্তানভূখণ্ডে কোনো ধরণের হিন্দুদের মন্দিরের দৃশ্য দেখতে পাই না। যার ইঙ্গিত কিন্তু বিচক্ষণের জন্য সুদূরপ্রসারী বলা যায়।
বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে দুইজন ইসলামী সাধকের নাম নেওয়া হয়েছে। একজন খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া এবং অন্যজন হযরত আমিন শাহ। দুইজনেই বেশ বিখ্যাত এবং সূফী সাধক ছিলেন। আমাদের সিলেটের শাহ জালাল এই খাজা নিজাম উদ্দিন আওয়লিয়ার আদেশেই বাঙলাতে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন। খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়াকে নিয়ে নানা ধরণের অলৌকিক কিংবদন্তী শোনা গেলেও বোবার মুখে কথা ফুটাতে পারেন এই ধরণের কিংবদন্তীর দেখা মিলে নি। অন্যদিকে আমীন শাহ তিনিও একজন সূফী সাধক। তবে তার নামেও হারানো কিছু খুঁজে দেওয়ার কিংবদন্তী পাওয়া যায় না।
শেষ করবো, তবে তার আগে বলে রাখা উচিৎ হবে হয়তো অনেকগুলি অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই আলোচনায় আনা হয়েছে, আবার অনেকগুলি প্রয়োজনীয় বিষয় বাদ পড়েছে। তবে সব কিছু মিলিয়ে বলা যায় বাজরাঙ্গি ভাইজান খুবই পণ্ডিত স্ক্রিপ্ট রাইটের হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। এবং সব কিছু মিলিয়ে বাজরাঙ্গি ভাইজান একটি পরিপূর্ণ ছবি।