Wednesday, September 9, 2015

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র পর্ব ১-৬ঃ-

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০১)
প্রাচীন ভারতে নারী জীবন সংসার তথা বিবাহ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ছিল। নারীর শৈশব-যৌবন-বার্ধক্য যথাক্রমে পিতা-স্বামী-পুত্রের দ্বারাই নির্ধারিত থাকতো। এর ফলে পুরুষ অধীনতা নারীর জন্য হয়ে পড়ে অপরিহার্য। হিন্দুধর্মের থেকে অপেক্ষাকৃত আপাতদৃষ্টিতে উত্তম ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে এই ভারতে। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ থেকে শুরু করে ঈশ্বরের প্রচলিত আরাধনার মতো অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত ছিল বলে একে আপাতদৃষ্টিতে উত্তম ধর্ম বলেই গণ্য করেন অনেকে।
বৌদ্ধ শাস্ত্র যতখানি অধ্যায়ন করার সুযোগ হয়েছে তাতে আমি দেখেছি আর সব প্রচলিত ধর্ম মতের মতোই বৌদ্ধ ধর্মে বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে রয়েছে সমসাময়িকতার প্রবল প্রভাব। আমাদের আলোচনার বিষয় বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক তত্ত্ব নয় বরং আজকে আমরা আলোচনা করবো বৌদ্ধ ধর্মে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাবলয় নিয়ে। এই আলোচনা করার অন্যতম কারণ হল, আমাদের বাঙ্গালীদের মধ্যে অনেকেরই বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই এই ধর্মের প্রতি এক ধরনের বিশেষ অনুরাগ কাজ করে। তাছাড়া বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে বাংলা ভাষায় বিশেষ করে অনলাইনে ততোটা আলোচনা বা সমালোচনা আমার খুব বেশী দেখার সুযোগ হয়নি যতটা ইসলাম বা হিন্দু ধর্ম নিয়ে হয়েছে।
গৌতম বৌদ্ধ বিতৃষ্ণ ছিলেন তৎকালীন সাংসারিক জীবনাবর্তে। এই জন্য তিনি তার স্ত্রীকেও ত্যাগ করেন। যেহেতু সংসারে বসে অষ্টাঙ্গিক মার্গ পালন করে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব নয়, সেহেতু অবশ্যই সাংসারিক মায়া ও কাম ত্যাগ করে গৃহত্যাগী হতে হবে। আর সাংসারিক মায়া ও কাম ত্যাগ করার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে নারীকে চিহ্নিত করেন গৌতম বৌদ্ধ। তিনি বলেন, “নারী যেহেতু গৃহের মোহ তৈরি করে তাই নারী অবশ্যই পরিত্যাজ্য।”
সমগ্র বৌদ্ধ বানীকে তৃতীয় মহাসঙ্গিতি সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম নামে অভিহিত করা হয়। এদেরকে একত্রে বলা হয় ত্রিপিটক। যেহেতু আমরা বৌদ্ধ ধর্মে নারীদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবো সেহেতু আমাদের বেশীর ভাগ আলোচনাই হবে সূত্রপিটকের খুদ্দক নিকায়ের অন্তর্গত জাতকের কাহিনীতে আলোচিত নারীর প্রতি গৌতম বৌদ্ধের নির্দেশনামূলক বক্তব্য। জাতক কাহিনীতে নীতিকথা সম্পন্ন হয় সাধারনত তিনটি পর্যায়ে যথা-
১) বর্তমান বস্তু (এখানে কোন সংকট উপস্থাপিত হয়েছে শাস্তা বা পথপ্রদর্শকের কাছে।)
২) অতীত বস্তু (এখানে সংকট মীমাংসার জন্য অতীতের দৃষ্টান্ত প্রদান করেন শাস্তা।)
৩) সমাধান (অতীত বাস্তবতার আলোকে বর্তমানের টীকাভাষ্য রচনা করে দিকনির্দেশনা দেন শাস্তা।)
কথা না বাড়িয়ে আমরা শাস্ত্রে চলে যাই, প্রথমে আলোচনা করবো বৌদ্ধশাস্ত্রের ৫৩৬ নম্বর জাতক যার নাম কুণাল জাতক। এই জাতকের প্রধান চরিত্র হল কুণাল যার মুখ নিঃসৃত বানী থেকে আমরা নারীদের সম্পর্কে জানতে পারি । কুণাল বলেন নারী কখনই বিশ্বাসযোগ্য নয়, নারী স্বভাবতই বিশ্বাস ঘাতিনী। নারী কোন ভাবেই প্রশংসার যোগ্য নয়। পৃথিবী যেমন সকলের আধার তেমনি নারীও কামাচারে পাত্রাপাত্র বিচার করে না। কুণালের মুখে উচ্চারিত হয় নীতি গাথাঃ
“সদা রক্ত মাংস প্রিয়, কঠোর হৃদয়, পঞ্চায়ুধ, ক্রূরমতি সিংহ দুরাশয়। অতিলোভী, নিত্য প্রতিহিংসা পরায়ণ, বধি অন্যে করে নিজ উদর পূরণ। স্ত্রীজাতি তেমতি সর্বপাপের আবাস, চরিত্রে তাহাদের কভু করো না বিশ্বাস।” তারমানে আমরা বুঝলাম পুরুষের অবশ্যই কখনো নারীর চরিত্রে বিশ্বাস করা উচিত নয়। শুধু কি বিশ্বাস? কুণালের মতে, নারীকে বেশ্যা, কুলটা বললেই সব বলা হয় না, নারী প্রকৃত পক্ষে এর অধিক কিছু। নারীরা হলো-
@ উন্মুক্ত মলভাণ্ডের মতো দুর্গন্ধ যুক্ত।
@ বিষমিশ্রিত মদিরার মতো অনিষ্টকারী।
@ কুটিলা সাপের মতো দুই জিহ্বা বিশিষ্ট।
@ পাতালের ন্যায় অতল গভীর।
@ রাক্ষসীর ন্যায় সন্তোষহীন।
@ অগ্নির ন্যায় সর্ব গ্রাসিনী।
@ নদীর ন্যায় সর্ব বাহিনী।
@ বায়ুর ন্যায় যথেচ্ছা গামিনী।
@ বিষবৃক্ষের ন্যায় বিষফল প্রসবিনী।
নারীরা কীভাবে মলের মতো দুর্গন্ধময় এ সম্পর্কে কুনাল বলেন,

“নারী হল উন্মুক্ত মলভাণ্ডের ন্যায়। উন্মুক্ত মলভাণ্ড দেখিলে মাছি সেখানে ঝাপ দিবেই তাকে রোহিত করা কষ্টকর। কিন্তু একজন জ্ঞানী মানুষ সব সময় এই মলভাণ্ডের দুর্গন্ধ উপলব্ধি করে তা এড়িয়ে চলে। তদ্রূপ নারীরুপ মলভাণ্ডে মাছিরূপ পুরুষ ঝাপ দিবেই কিন্তু একজন জ্ঞানী ভিক্ষু এই উন্মুক্ত মলভাণ্ডরূপ নারীদের দুর্গন্ধ উপলব্ধি করিয়া তাদের সদাই পরিত্যাগ করেন।”

খবরদার আবার আপনারা দাবী করবেন না যেন, বৌদ্ধধর্মে নারীকে মল বলা হয়েছে। আপনাদের বুঝতে হবে বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয়েছে নারী মলের মতো। আল্লামা শফি যেমন তেতুলের মতো বলেছেন বলে অনেকে দাবী করেন তেতুল বলেছেন যা নাকি ঠিক নয়। আপসুস নারীরা তেঁতুলের মতো না মলের মতো এটা বিবেচনার দায়িত্ব নেয় আমাদের ধার্মিক পুরুষেরা আর এভাবে নারীকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করে। এখন দেখবো কুণাল তার নিতিগাথায় কি বলেন-

“চৌর, বিষদিগ্ধসুরা, বিকত্থি বণিক কুটিল হরিণ শৃঙ্গ, দ্বিজিহ্বা সর্পিণী প্রভেদ এদের সঙ্গে নেই রমণীর। প্রতিচ্ছন্ন মলকুপ, দুষ্কর পাতাল দুস্তোস্যা রাক্ষসী, যম সর্বসংহারক প্রভেদ এদের সঙ্গে নাই রমণীর। অগ্নি, নদী বায়ু, মেরু (পাত্রাপাত্রভেদ জানে না যে) কিংবা বিষবৃক্ষ নিত্যফল প্রভেদ এদের সঙ্গে নাই রমণীর।”

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০২)
কুণাল জাতক নামে বৌদ্ধ শাস্ত্রের ৫৩৬ নম্বর জাতকে কুণাল পুরুষদের উপদেশ দেন – বলদ(ষাঁড়), ধেনু(গাভী), যান(বাহন) ও রমণী এই চারটি কখনো অন্যের আশ্রয়ে রাখতে হয়না। এদেরকে নিজের আশ্রয়ে সুরক্ষিত রাখতে হয়, তা না হলে সংকট তৈরি হয়। এই সম্পর্কিত নীতিগাঁথায় কুণাল বলেন-
“বলীবদ্র, ধেনু, যান, ভার্যা নিজ তব রাখিও না অন্য গৃহে কখনো এসবো। যান নষ্ট হয় পড়ে আনাড়ির হাতে বলীবদ্র প্রাণে মরে অতি খাটুনিতে। দুধ ধুয়ে বাছুরের জীবনান্ত করে রমণী প্রদুষ্টা হয় থাকি জ্ঞাতিঘরে।”
আবার কুণালের মতে সব নারীই প্রকৃতপক্ষে বেশ্যা। এরা পঙ্গু দেখলেও ব্যাভিচারে রত হয়। সব নারীই হচ্ছে পরপুরুষগামিনী এবং বিশ্বাস অযোগ্যা। আসুন দেখি কুণাল তার নীতিগাঁথায় কি বলেছেন –

“পাইলে নিভৃত স্থান, পাইলে অবসর হেন নারী নাই এই পৃথিবীর ভিতর। না করিবে পাপ যেই, না পেলে অপরে পঙ্গুর সহিত রত হয় ব্যাভিচারে। সত্য বটে ভাবে লোকে সুখদা রমণী কিন্তু সর্ব নারী হয় পরপুরুষ গামিনী। দমিতে নারীর মন নিগ্রহের বলে শক্তি কাহারো নাই এ মহীমণ্ডলে। প্রিয়ঙ্করী, তবু এরা বিশ্বাস অযোগ্যা, বেশ্যা, তীর্থবৎ এরা সর্বজন ভোগ্য।”

এইবার কুণাল বলেন কি কি কারণে স্ত্রীদের কলঙ্ক হয়। কুণালের মতে যেসব কারণে নারীদের কলঙ্ক হয় তার মধ্যে রয়েছে-
@ আরামে উদ্যানে ভ্রমণ করলে।
@ জ্ঞাতি কুটুম্বের বাসায় বেড়াতে গেলে।
@ মদ্য পান করলে।
@ বিচিত্র জামা কাপড় পড়তে চাইলে।
@ বিনা কাজে ঘোরাঘুরি করলে।
@ অন্য পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করলে।
@ দরজায় দাড়িয়ে থাকিলে।
কুণাল তার নীতিগাঁথায় এ সম্পর্কে বলেন –

“আরামে, উদ্যানে, রথে, জ্ঞাতিপর কূলে সদা বেড়াইতে যায়, মদ্যপান করে যারা, পরিতে বিচিত্র বস্ত্র
সদা যারা চায়। বিনা কাজে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করে যারা
সদা শূন্যমন, দ্বারে থাকে দাঁড়াইয়া, কুলষিতা হয় নারী এই নব কারন।”
বৌদ্ধ শাস্ত্রের ৫৩৬ নম্বর জাতকে কুণাল আরও বলেন,
@ গরুরা নতুন ঘাসের আশায় নিজের গোয়াল থেকে বের হবার জন্য ছুটে, নারীও তেমনি নতুন নাগর লাভের আশায় ছোটাছুটি করে।
@ নৌকা যেমন এপারে-ওপারে, এখানে-সেখানে যথা প্রয়োজনে লাগে, নারীও তদ্রূপ প্রিয় অপ্রিয় বিবেচনা না করেই সর্ব পুরুষেই গমন করে।
@ কোন বুদ্ধিমান কখনো নারীর চরিত্রে বিশ্বাস স্থাপন করে না। যারা করে তারা নির্বোধ।
@ যতই নারীকে ধনে পরিপূর্ণ করা হোক না কেন সুযোগ পেলেই অসতীরা পুরুষের সম্মান নষ্ট করে।
@ নারীদের এতোই জঘন্য স্বভাব যে এখানে সেখানে তারা যদিচ্ছা ঘুরাফেরা করে।
@ নারীদের চোখের পানিতে গলে যাওয়া ঠিক না কারণ নারীদের সত্য মিথ্যার সমান।
@ নারীরা সব সময় প্রেমালাপে পুরুষদের বস করে যদিও মনের মধ্যে তাদের থাকে খারাপ অভিলাস।
@ তীর্থে যেমন সকলেই ভ্রমন করতে পারে, নারীও তেমন তীর্থসম।
@ টাকা হীন কুলীন ব্রাহ্মণ নারীর কাছে চণ্ডালের মতো। তাইতো ধনবান চণ্ডাল কে নারী আজীবন পূজিতে পারে শুধু ধনের আশায়।
আসুন এই বিষয়ে আমরা কুণালের নীতিবাক্যর গাঁথাগুলো দেখি –

“মনের মতো রমণী লভিয়া ধনপূর্ণা ধরা কর তারে দান, তথাপি অসতি পেলে অবসর কভু না রাখিবে তোমার সম্মান। নারীদের এমন জঘন্য স্বভাব সদা সর্বস্থানে করি বিলোকন, করে কি কখনো বুদ্ধিমান জন
চরিত্রে তাহাদের বিশ্বাস স্থাপন? ভালোবাসে মোরে ভাবি ইহা মনে করো না বিশ্বাস কভু নারীগণে,
অশ্রু বিসর্জন দেখিয়া তাহার ভিজে নাকো যেন মন কখনো তোমার। এ পারে, ও পারে নদীর যেমন
লাগে গিয়া নৌকা যথা প্রয়োজন, প্রিয় বা অপ্রিয় বিচার না করি সেবে পরপুরুষেরে সর্বজন নারী। অতীব দুঃশীলা, অতি অসংযতা রতিদানে মুড়ে তুষিতে নিরতা, প্রামালাপ করে বসি তব পাশ মনে কিন্তু সদা পাপের অভিলাষ। তীর্থসম সর্বভোগ্যা নারীগণ নারীরে বিশ্বাস করো না কখন, নাই তাদের সত্য মিথ্যা জ্ঞান সত্য তাদের মিথ্যার সমান। গবীসম নব তৃণের আশায় গোচর বাহিরে ছুটি যথা যায়, নবীন নাগর লোভিতে তেমনি ছোটাছুটি করে সকল রমণী। নির্ধন কুলীনে নারী করে হেয় জ্ঞান সে জন নারীর চক্ষে চণ্ডাল সমান, অথচ চণ্ডাল যদি হয় ধনেশ্বর ধনহেতু ভজে তারে নারী নিরন্তর।”

নারী প্রসঙ্গে বৌদ্ধ শাস্ত্রের ঐ একই জাতক অর্থাৎ কুণাল জাতকে, কুণাল আর গ্রিথরাজের মধ্যে কথোপকথন প্রণিধানযোগ্য। এখানে গ্রিথরাজের কাছে কুণাল নারী চরিত্র কেমন তা বর্ণনা করেন। নারীর প্রকৃত চরিত্র কেমন সে সম্পর্কে কুনাল যা যা বলেন তা হলঃ
@ ব্রাহ্মণ, সাগর, নরপতি আর নারী এই চারকে কখনোই কেউ সন্তুষ্ট করতে পারে না।
@ একজন নারীর যদি আটজন সেক্সি স্বামীও থাকে তারপরও সে নবম জনার প্রতাশা করে।
@ নারীর জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো যোনী সব সময়ই অপূর্ণ থাকে।
@ নারী অগ্নির মতো সব কিছু গিলে খায়।
@ নারী নদীর মতো সব দিকে প্রবাহিত হয়।
@ নারী হল কাটা গাছের ন্যায়।
@ নারী সব সময় পুরুষের দুঃখের কারণ হয়।
@ নারী ধনের জন্য কুপথে যায়।
@ নারী নিজের স্বামীকে সেবা না করে পরপুরুষকে সেবা দেয়।
@ নারী যেহেতু অধঃগামী তাই তাদের নরক নিশ্চিত।
এইসব কারনেই বুদ্ধিমানের অবশ্যই নারীকে পাশ কাটিয়ে চলা উচিত। আসুন কথা না বাড়িয়ে আমরা কুণালের মতে নারী চরিত্রের নীতিগাঁথা শুনী।

“নারীর চরিত্র আমি বলিতেছি আজ সাবধানে শ্রবণ করো হে গ্রিথরাজ সমুদ্র, ব্রাহ্মণ, নরপতি আর নারী পুরীতে কাহারো সাধ্য নাই এই চারি। এক রমণীর যদি হয় অষ্টপতি বীর বলবান সবে, কামপ্রদ অতি লবিতে নবম তবু চায় সেই মনে আগ্নেয়গিরি অপূর্ণ তার থাকে সর্বক্ষণে। অগ্নিসম সর্বভক্ষা সকল রমণী নদিসমা সর্বনারী সর্বপ্রবাহিণী কন্টকশাখার তুল্য রমণী সকল পুরুষের হয় হেতু দুঃখের কেবল। ধনলোভে সব নারী কু পথেতে যায় ত্যাজি পতি রত হয় পরপুরুষ সেবায় নারীর গমন সদা অধঃপথে
মরনের পর নরকে নিবাস তাই সুধীগণ অতি সাবধানে দুর হতে ত্যাজি নারীদের পাশ। ডুবিলে নারীর মায়ার আবর্তে ব্রহ্মচর্য পায় অচিরে বিনাশ তাই সুধীগণ অতি সাবধানে দূর হতে ত্যাজি রমণীর পাশ।”

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০৩)
কুণাল জাতকের পর এইবার আমরা আলোচনা করবো ৫৪৫ নম্বর জাতক যার নাম বিদূরপণ্ডিত জাতক। বিদূরপণ্ডিত জাতকের মূল চরিত্রে আছেন মহাপণ্ডিত বিদূর। এই মহাপণ্ডিত মহাপুরুষ বিদূরের ছিল মাত্র এক সহস্র ভার্যা এবং শপ্তশত গণিকা। যৌন সম্পর্কে অত্যাধিক অভিজ্ঞ পণ্ডিত বিদূরের কাছে আমরা জানতে পারি যৌন বিজ্ঞান সম্পর্কে। পণ্ডিত বিদূরের মতে অত্যাধিক নারীর সহিত মিলনে পুরুষের বীর্যক্ষয় হয়। যেহেতু একজন বীর্যবান পুরুষের কাছে সব থেকে মূল্যবান বস্তু হল তার বীর্য তাই যে কোন প্রকারেই হোক এই মহামূল্যবান বীর্যকে সংরক্ষণ করতেই হবে। আর পুরুষের অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে এই বীর্য সংরক্ষণের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল নারী।
আসুন এখন কথা না বাড়িয়ে আমরা মহাপণ্ডিত বিদূরের কাছ থেকে নারী সম্পর্কিত নীতিগাঁথা গুলো শুনিঃ

“অত্যধিক স্ত্রী সংসর্গে হয় বীর্যঃক্ষয় কাস, শ্বাস, দুর্বলতা, সর্বাঙ্গে বেদনা বুদ্ধির বিলোপ আর এসব কুফল দেখি স্ত্রী সংসর্গে সদা হয় মিতাচার। ধনরত্নে পরিপূর্ণ বসুন্ধরা যদি দেয় কেহ রমণীকে ভাবি ইহা মনে আমিই ইহার প্রিয় অন্য কেহ নয়, অবকাশ পেলে কিন্তু সেই নারী আবার করিবে সে পুরুষকে তৃণবৎ জ্ঞান। নারীর চরিত্রে হেন কলুষতা হেরি অসতীর সঙ্গ ত্যাগ করে ধর্মবিদ।”

নারীরক্ষা পুরুষতন্ত্রের জন্য অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ। নারীদের যে কখনোই বিশ্বাস করতে হয়না তার দৃষ্টান্ত আমরা পাই ৩৯ নম্বর জাতকে যার নাম নন্দ জাতক। এই জাতকের অতীত বস্তুতে দেখা যায়, বৃদ্ধের তরুণী স্ত্রীর গর্ভে একটা পুত্র সন্তান জন্মায় আর এনিয়ে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং তার মতো বৃদ্ধের পক্ষে আসলেই উৎপাদন করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে মনে মনে সংশয় প্রকাশ করে। এছাড়া বৃদ্ধ বলে “আমার স্ত্রী যুবতী, আমার মৃত্যু হলে না জানি অন্য কোন পুরুষকে আশ্রয় করবে।”

এভাবেই স্ত্রীকে সন্দেহ করে যাচ্ছে পুরুষ যদিও পুরুষকে সন্দেহ করার অধিকার পুরুষতন্ত্র দেয়নি নারীকে।
শত্তুভস্ত্রা জাতক নামক ৪০২ নম্বর জাতকের অতীত বস্তুতে দেখা যায়, এক ব্রাহ্মণ তার ভিক্ষালব্ধ জিনিষ অন্য এক ব্রাহ্মণের হেফাজতে রাখে কিন্তু দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ তা খরচ করে ফেলায় আপন কন্যার সাথে প্রথম ব্রাহ্মণের বিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত ঋণমুক্ত হয়। এখানে নারীকে বিক্রয় করা হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবেনা। পিতা দায়মুক্ত হল ঠিকই কিন্তু কন্যার কথা চিন্তা করলেন না। যুবতী কন্যা বাবার বয়সী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সহবাসে তৃপ্ত না হওয়ায় এক তরুন ব্রাহ্মণের প্রতি প্রনয়াসক্ত হয়। আর এর মাধ্যমেই তরুণী যে কতো বড় বেশ্যা তা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝানো হয়েছে এই জাতকটিতে।
পুরুষতন্ত্রের নিকট নারীর দুর্নামের ক্ষেত্রে মাতাকেও ছাড় দেয়নি বৌদ্ধ ধর্মীয় শাস্ত্র। আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করবো ৬১ নম্বর জাতক যাকে অশাতমন্ত্র জাতক বলা হয়। এই জাতকের বর্তমান বস্তুতে রয়েছে, গৃহকর্মে উৎসাহী ব্রাহ্মণ যুবককে তার পিতামাতা পুনর্বার গুরুর নিকট পাঠায় নারী চরিত্রের দোষ অনুধাবন করে সংসার-বৈরাগ্য লাভের উদ্দেশে। মাতাপিতার পরামর্শে সে গুরুর নিকট অশাতমন্ত্র দীক্ষায় প্রত্যাশী হয়। অশাতমন্ত্র বলতে সহজ ভাবে বুঝানো হয় অমঙ্গল বিষয়ে সচেতনতার বিদ্যা আর বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে নারীরাই হল এই বিদ্যার কেন্দ্র অর্থাৎ অমঙ্গলের মূল।
গুরুর বৃদ্ধ মাতা জীবিত ছিল এবং গুরুই তার সেবা করতো। এজন্য লোকে গুরুকে ঘৃণা করতো কিন্তু মাতৃসেবা কেন ঘৃণ্য বিষয় হবে তার কোন ব্যাখ্যা জাতকটিতে নেই। ব্রাহ্মণ পুত্রকে গুরু তার মাতার সেবায় নিয়োগ করলেন। ব্রাহ্মণ পুত্র সেবা করতে করতে গুরু মাতার প্রশংসা করতো এই ভাবেঃ “জরাগ্রস্ত হইয়াও আপনার কি অপরূপ দেহকান্তি, না জানি যৌবনকালে আপনি কীদৃীশি রুপলাবণ্যসম্পন্না ছিলেন।” এভাবে কিছুদিন রুপকীর্তন করার ফলে বৃদ্ধার মনে হল ব্রাহ্মণ পুত্র প্রণয় প্রত্যাশী।
বৃদ্ধ মাতা ব্রাহ্মণ পুত্রকে প্রণয়ে উৎসাহিত করলে ব্রাহ্মণ পুত্র তার গুরুভীতির কথা জানান। বৃদ্ধা মাতা তখন তার পুত্র অর্থাৎ গুরুকে হত্যা করার জন্য ব্রাহ্মণ পুত্রকে উৎসাহিত করেন। কিন্তু তাতে ব্রাহ্মণ পুত্র স্বীকৃত না হওয়ায় নিজেই কৌশলে নিজ পুত্রকে হত্যা করতে আগ্রহী হয়। জাতকের ভাষায় –


“ স্ত্রীজাতি এমনি অসতী ও নীচাশয়া যে এতো অধিক বয়স্কা বৃদ্ধাও কামভাবের বশবর্তী হইয়া বোধিসত্তের ন্যায় ভক্তিশীল ও শুশ্রষাপরায়ণ পুত্রের প্রাণসংহারের জন্য প্রস্তুত হইলো।”


কিন্তু ব্রাহ্মণ পুত্র তার গুরুকে তার মায়ের সব কিছু বলে দেয়। ব্রাহ্মণ পুত্রের প্রণয় না পেয়েই লজ্জায় অপমানে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় বৃদ্ধা মাতা। বৃদ্ধার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে গুরু তার বিদ্যার্থীকে জানায়ঃ “বৎস স্ত্রীজাতি মানেই অসতী এবং ইহাই অসতমন্ত্রের সারকথা। তোমার পরিবার আমার কাছে পাঠিয়েছে ইহার কারণ এই যে তুমি স্ত্রীজাতির দোষ জানিতে পারিবে। আমার মাতার চরিত্রে কি দোষ ছিল তাহা তুমি স্বচক্ষে দেখিতে পারিলে। ইহা হইতেই বুঝিতে পারিবে রমণীরা কীদৃীশি অসতী হতে পারে।” এরপর বিদ্যার্থী ব্রাহ্মণ পুত্র নারী বিষয়ে জ্ঞানলাভ করার পর সংসারে ফিরে না গিয়ে প্রব্রজ্যা (সন্ন্যাস) গ্রহণ করে। গুরু দ্বারা অশতমন্ত্র প্রাপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণ পুত্রের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে নীতিগাথাঃ

“নারীর চরিত্র হায়, কে বুঝিতে পারে? অসতী প্রগলভা বলি জানি সবাকারে। কামিনী কামাগ্নি তাপে জবে দগ্ধো হয় উচ্চে নীচে সমভাবে বিতরে প্রণয়। খাবার প্রস্তুতে বিচার নাই আগুনের ঠাই নারীর প্রেমে পাত্রাপাত্র ভেদ জ্ঞান নাই। অতএব ত্যাজি হেন জঘন্য সংসার সন্ন্যাসী হইবো এই সংকল্প আমার।”

এইবার আমরা আলোচনা করবো বৌদ্ধ শাস্ত্রের ৬২ নম্বর জাতক যার নাম অন্ধভূত জাতক। এই জাতকের বর্তমান বস্তুতে শাস্তা এক উৎকণ্ঠিত ভিক্ষুর উদ্দেশ্যে বলেন- “রমণীরা নিতান্তই অরক্ষণীয়া। পুরাকালে জনৈক পণ্ডিত কোন রমণীকে তাহার ভূমিষ্ঠ হইবার সময় অবধি রক্ষণাবেক্ষণ করেও সৎপথে রাখিতে পারেন নি।” এই জাতকের অতীত বস্তুতে আমরা জানতে পাই, বোধিসত্ত্ব ছিলেন রাজা যিনি তার পুরোহিতের সাথে দ্যূতক্রিয়া করতেন। এই ক্রিয়ায় তিনি একটি মন্ত্র পাঠ করতেন এবং পুরোহিত প্রতিবারেই হেরে যেতো। মন্ত্রটার গাথা হল নিম্ন রুপঃ

“যাহার স্বভাব যেই, সেই মতে চলে সেই, কি সাধ্য কাহার করে প্রকৃতি লঙ্ঘন? বনভূমি পায় যথা, তরুরাজি জন্মে তথা, আঁকা বাঁকা পথে সদা নারীর গমন। পাপাচার পরায়ণ, জানিবে রমণীগণ, স্বভাব তাদের এই নাহিক সংশয়। যখনই সুবিধা পায়, কুপথে ছুটিয়া যায়, ধম্মে মতি তাহার কভু নাহি হয়।”

প্রতিদিন হারতে হারতে পুরোহিত বুঝতে পারলো চরিত্র দোষ হয়নি এমন একজন নারী সংগ্রহ করতে পারলেই এই মন্ত্রের ক্ষমতা হারিয়ে যাবে। এজন্য সে সদ্যভূমিষ্ঠ কন্যা সংগ্রহ করে লালন পালন করতে লাগলো এবং মেয়েটি যৌবনে পদার্পণ করলে পুরোহিত তাকে নিজেই বিয়ে করলো। পরে একদিন রাজার সঙ্গে দ্যূতক্রিয়ায় প্রবিত্ত হয়ে পুরোহিত জিতে গেলো। রাজা মন্ত্র পাঠ করলেও জিততে না পেরে বুঝল যে পুরোহিতের গৃহে নিশ্চয়ই এমন কোন নারী আছে যে পতি ব্যাতিত অপর কোন পুরুষে আসক্ত হয়নি। রাজার অনুমান সত্য হওয়ায় নারীটিকে প্রলোভনের ফাদে ফেলে চরিত্রভ্রষ্ট করলো রাজা।
এরপর আবার দ্যূতক্রিয়ায় হেরে গেলো পুরোহিত। তখন পুরোহিত বুঝতে পারলো যে ইতিমধ্যেই তার রমণীর পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে। তখন রাজা বলেন “রমণীদের নিজের কুক্ষির অভ্যান্তরে রাখিয়া নিয়ত সঙ্গে লইয়া বেড়াইলেও রক্ষা করা অসম্ভব। জগতে বোধহয় এমন স্ত্রী নেই যে স্বামীভিন্ন পুরুষান্তরের সংসর্গে আসে নাই।
“ রাজার বক্তব্য জানার পর পুরোহিত তার স্ত্রীকে প্রশ্ন করে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে অবগত হতে পারেনা, বরং নারীটি তার চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য অগ্নি পরীক্ষা দিতেও প্রস্তুত হয়। এদিকে পরিচারিকার মাধ্যমে নারীটি পূর্বেই ধূর্তকে সংবাদ প্রদান করে এবং অগ্নিতে প্রবেশের পূর্বেই ধূর্ত নারীটির হাত ধরে ফেলে। নারীটি তখন ঝাপ না দিয়ে দাবী করে যে এই হাত ধরার মাধ্যমেই তার সতীত্ব নষ্ট হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ বুঝতে পারে সবোই নারীটির কৌশল এবং এজন্য সে নারীটিকে প্রহারের পরে বিতাড়িত করে। জাতকের শেষাংশে রাজারুপী বোধিসত্তের নারী সম্পর্কিত নির্দেশনা উচ্চারিত হয় এভাবে,

"নারীর স্বভাব এই দেখিবারে পাই, চৌরী, বহুবুদ্ধি তারা; সত্যজ্ঞান নাই। জলমধ্যে যাতায়াত করে মৎস্যগণ কে পারে তাদের পথ করিতে দর্শন? রমণী হৃদয় ভাব তেমতি দুর্জ্ঞেয় মিথ্যা তারা সত্য বানায়, সত্য করে হেয়। নিত্য নব তৃণ খোঁজে গাভীগণ যথা কামিনী নতুন বর নিত্য চায় তথা। ভুজঙ্গিনী খলতায় মানে পরাজয়, চাপল্যে বালুকা ভয়ে দূরে সরে যায়। পুরুষ চরিত্র জ্ঞানে অদ্বিতীয়া নারী, নখদর্পণেতে আছে সংসার তাহারি।

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০৪)
বৌদ্ধশাস্ত্র পাঠ করার সময় বোধিসত্ত্ব কথাটা বারবার চলে আসে। বোধিসত্ত্ব কথাটা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন মনে করছি। বোধিসত্ত্ব শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, বুদ্ধত্ব (শাশ্বত জ্ঞান) প্রাপ্তিই যাঁর ভবিতব্য অর্থাৎ যিনি বোধিলাভ করার জন্যই জগতে আবির্ভূত হয়েছেন। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন শাখায় বোধিসত্ত্বের বহুবিধ ব্যাখ্যা থাকলেও মহাযান বৌদ্ধধর্ম মতে বোধিসত্ত্ব হলেন তিনিই যিনি জগতের কল্যাণের জন্য স্বয়ং নির্বাণলাভ থেকে বিরত থাকেন এবং বিশ্বের সকল জীবের মুক্তিলাভের উপায় করেন।
ত্রিপিটকে পালি ভাষায় বোধিসত্ত্ব শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেছিলেন শাক্যমুনি বুদ্ধ। বোধিসত্ত্ব শব্দটি দ্বারা তিনি তাঁর পূর্বজন্মের অবস্থা থেকে বোধিলাভ করার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত জীবনকে বুঝিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর পূর্বজন্মের কাহিনি ব্যক্ত করতে গিয়ে গৌতম বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব শব্দটির প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ এখান থেকে অনুধাবন করা যায় যে বোধিসত্ত্ব হলেন তিনিই যাঁর জীবনের একমাত্র ব্রতই হল বোধিলাভ।
বুদ্ধের বোধিসত্ত্বাবস্থার এই সকল কাহিনি বর্ণিত হয়েছে জাতকে। মহাযান বৌদ্ধধর্মানুসারে একজন বোধিসত্ত্ব হলেন তিনিই যিনি বুদ্ধত্বলাভের প্রায় প্রতিটি স্তরই উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি স্বয়ং পরম জ্ঞান লাভ করেছেন এবং সেই শাশ্বত বোধের আলোকে প্রতিটি জীবকে আলোকিত করছেন ও তাদের রক্ষার্থ জীবন উৎসর্গ করেছেন।
গত পর্বের অশাতমন্ত্র জাতকে আমরা দেখেছি যে বৌদ্ধ ধর্ম নারীর সর্বাপেক্ষা আদর্শ চরিত্র মাতাকেও কলঙ্কিত করতে কুণ্ঠিত হয়নি। এখন আমরা আলোচনা করবো বৌদ্ধ শাস্ত্রের ৬৪ নম্বর জাতক যার নাম দুরাজান জাতক। এই জাতকে আচার্য রুপী শাস্তা জানালেনঃ
“রমণীগণ যেদিন দুষ্কার্য করে সেদিন স্বামীর অনুবর্তন করে, দাসীর ন্যায় বিনীত হইয়া চলে, কিন্তু যেদিন দুষ্কার্য করে না সেদিন তাহারা মদোদ্ধতা হইয়া স্বামীকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। দুঃশীলা ও পাপপরায়ণা রমণীদের এইরূপই স্বভাব।”
এরপর তিনি ছাত্রের উদ্দেশ্যে একটি গাথা উচ্চারণ করেনঃ

“ভাল যদি বাসে নারী হইও না হৃষ্ট তায়, যদি ভালো নাহি বাসে, তাতেই কি আসা যায়? নারীর চরিত্র বুঝি হেন সাধ্য আছে কার? বারি মাঝে চরে মাছ কে দেখিবে পথ তার?”

এর ঠিক পরের জাতকটি অর্থাৎ ৬৫ নম্বর জাতক হল অনাভিরতি জাতক। এখানে বৌদ্ধরূপী শাস্তা বলেন, স্ত্রীজাতির চরিত্রহীন হইবে এ আর এমন কি? এটা দেখে বুদ্ধিমানের রাগ করতে নেই। গাঁথাটি হল এরকম-

“নদী, রাজপথ, পানের আগার উৎসব, সভাস্থল আর, এই পঞ্চস্থানে অবাধে সকলে ভুঞ্জে সম অধিকার।
তেমতি রমণী ভোগ্যা সকলের, কুপথে তাহার মন, চরিত্রস্খলন দেখিলে তাহার রোষে না পণ্ডিত জন।”

আমাদের এখন আলোচনার বিষয় ১০২ নম্বর জাতক, পর্ণিক জাতক নামে এই জাতকের বর্তমানবস্তুতে আমরা দেখতে পাই নিজের মেয়ের যৌন শুদ্ধতা নিয়ে উদ্বিগ্ন পিতা। তাই গোত্রান্তরিত করার পূর্বে মেয়ে প্রকৃত কুমারী কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় পিতা। কন্যাকে নিয়ে বনপ্রান্তে গিয়ে হাত চেপে ধরে পিতা, এতে কন্যা আতঙ্কিত হয়। প্রশ্ন উত্তরে পিতা জানতে পারে কন্যা এখনো কুমারী ধর্ম রক্ষা করেছে। এরপর কন্যাকে নিশ্চিতভাবে গোত্রান্তরিত করার ভরসা পায় পিতা।
পিতা দ্বারা কন্যার সতীত্ব পরীক্ষার আরও উদাহরণ পাওয়া যায় জাতক গুলোতে। ১০২ নম্বর জাতকের মতো প্রায় একই ধরণের কাহিনী আমরা দেখতে পাই ২১৭ নম্বর জাতকে। এই জাতকের নাম সেগগু জাতক। জাতকটির অতীতবস্তুতে পিতা তার কন্যার চরিত্র পরীক্ষাকালে জানায়ঃ

“সর্বত্র দেখিতে পাই নরনারীগণ ইচ্ছামতো হয় ভোগবিলাসে মগন। তুমি কিলো সেগগু একা এতবড় সতী
না জান বৃষলীধর্ম হইয়া যুবতী? বনে ধরিয়াছি হাত, কান্দো সে কারণ, রয়েছে কুমারী যেন সারাটা জীবন।”
আতঙ্কিত কন্যা তার পিতাকে বলেন এই ভাবেঃ

“যে জন রক্ষার কর্তা সেই পিতা মম বনমাঝে দুঃখ কেন দেন অতীব বিষম। বনমাঝে কেবা মোর পরিত্রাতা হবে? রক্ষক ভক্ষক হয় কে শুনেছে কবে?”

এইবার আমরা আলোচনা করবো ১২০ নম্বর জাতক যার নাম বন্ধনমোক্ষ জাতক। এই জাতকের অতীতবস্তুতে বারানসীরাজ তার অন্তঃপুরে ষোড়শ সহস্র নর্তকী থাকলেও শুদ্ধভাবে জীবনযাপন করতো কিন্তু তার মহিষী ছিল ব্যভিচারিণী। রাজা রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্রোহ দমনে গেলে রানী ৬৪ জন দূতের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় কিন্তু সর্বশেষ রাজপুরোহিতরূপী বোধিসত্ত্ব রানীর আহ্বানে সারা দেয়না। কিন্তু রানীই বোধিসত্ত্বের কাম প্রস্তাবের অভিযোগ আনে, তবে শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় বোধিসত্ত্ব নির্দোষ। তখন রাজা বোধিসত্ত্ব বাদে বাকি ৬৪ জনকে প্রাণদণ্ডাদেশ দিলে বোধিসত্ত্ব মহারাজ কে বলেনঃ
“মহারাজ ইহাদের বা দোষ কী? ইহারা দেবীর আদেশ মতো তার অভিলাষ পূরণ করিয়াছে। স্ত্রী জাতি স্বভাবতই দুস্প্রবিত্তি ও দুর্দমনীয়া, তাদের প্রয়োজনেই এরা সাড়া দিয়েছে সুতরং এদের আর দোষ কি?”

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০৫)
প্রতিটা ধর্মেই কমবেশী উদ্ভট গালগল্প রয়েছে, যুক্তিবাদী ধর্ম হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধধর্মের শাস্ত্রেও রয়েছে এই ধরণের বেশকিছু গল্প। যেহেতু আমাদের আলোচনার বিষয় নারীর প্রতি বৌদ্ধশাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি তাই উদ্ভট গল্পে না যেয়ে নারী প্রসঙ্গেই আসি যদিও সেখানেও আমরা উদ্ভট গালগল্প পাবো। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারে নি, সম্ভবত সেজন্যই এই ধরণের অযৌক্তিক গল্পগুলো বৌদ্ধশাস্ত্রের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
আজকে এই বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো সমুদগ জাতক নিয়ে। ৪৩৬ নম্বর এই জাতকের বর্তমানবস্তুতে বোধিসত্ত্ব কোন এক উৎকণ্ঠিত ভিক্ষুর উদ্দেশ্যে বলেন,

“দেখো তুমি রমণী লাভের জন্য এতো ব্যগ্র কেন? রমণীরা পাপাসক্ত ও অকৃতজ্ঞা। পূর্বে ব্রহ্মদৈত্য কোন রমণীকে গিলিয়া নিজের কুক্ষির মধ্যে রাখিয়া বিচরণ করিতো, তথাপি সে তাহার চরিত্র রক্ষা করিতে ও তাহাকে একমাত্র পুরুষে আসক্ত রাখিতে পারে নাই। সে যাহা না পারিয়াছে তুমি তাহা পারিবে কেন?”

এই জাতকের অতীতবস্তুতে জানা যায়, বোধিসত্ত্ব প্রবজ্জা নিয়ে হিমালয়ে বসবাস করেছিলেন। সেসময় ব্রহ্মদৈত্য এক কুলকন্যাকে আহারের নিমিত্তে ধরে আনিলেও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজ গুহায় দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। কিন্তু দানব কন্যাটির চরিত্রের উপর আস্থা রাখতে পারেননি। এজন্য তিনি নারীটিকে একটি বাক্সের মধ্যে বন্দি করে নিজেরই উদরে গোপন রাখতেন।
একদা বাক্সটি খুলে নারীটিকে কিছু সময়ের জন্য বাতাস লাগাতে বলে নিজে স্নানের জন্য গেলে নারীটি কৌশলে বায়ুপুত্রকে বাক্সের ভিতর গ্রহণ করে নেয় এবং সেখানে উভয়ে কামলীলায় মত্ত হয়। বাক্সসহ ব্রহ্মদৈত্য বোধিসত্ত্বের নিকট ধর্মকথা শুনতে গেলে তিনি তিনজনকে স্বাগতম জানান। তিনজন শুনে ব্রহ্মদৈত্য অবাক হলে বোধিসত্ত্ব বায়ুপুত্রের সাথে নারীটির যৌনতার সবকিছু খুলে বলেন।
এরপর ব্রহ্মদৈত্যকে বোধিসত্ত্ব কিছু উপদেশ দেন যার মধ্যে অন্যতম –
@ ছলনাময়ী নারীদের চরিত্রে কখনোই বিশ্বাস করতে নেই।
@ যত সাবধানেই নারীকে রক্ষা করো না কেন তারা বহুগামি হবেই।
@ নরকের পথে সব সময় নারীদের গমন।
@ রমণী ত্যাগ করা পুরুষই একমাত্র প্রকৃত সুখ লাভ করতে পারে।
@ রমণী ত্যাগ করে ধর্ম করাই মঙ্গল।
@ নারী সংসর্গ দুর্গতি আনয়ন করে।
নিম্নে দানবকে প্রদান করা বোধিসত্ত্বের উপদেশ গাঁথা তুলে ধরা হলঃ

“তুমি তব ভার্যা যারে পেটিকা ভিতরে পুরিয়া কুক্ষিতে সদা রাখো রক্ষাতরে, তৃতীয় বায়ুর পুত্র ভার্যা সঙ্গে তব কুক্ষি মধ্যে করিতেছে মদন উৎসব। যত সাবধানে করো না কেন রক্ষণ বহু ছল জানে নারী, বিশ্বাস কখন চরিত্রে তার আর করা নাহি যায় নরকের পথে নারী প্রপাতের প্রায়। রমণী সংসর্গ ত্যাজি যে জন বিচরে, বীত সুখ হয়ে সেই সুখ লাভ করে। রমণী সংসর্গ ত্যাজি ধর্ম অনুষ্ঠান ইহাই বিজ্ঞের পক্ষে মঙ্গল নিদান। এই সুখ তাহাদের প্রার্থনীয় অতি রমণী সংসর্গে ঘটে অশেষ দুর্গতি।”

কোন বিশেষ নারী নয়, নির্বিশেষে সকল নারীই ব্যভিচারিণী, না এটা আমার কথা নয় বলেছেন স্বয়ং বোধিসত্ত্ব যার মহত্ত্ব সম্পর্কে চতুর্থ পর্বে বর্ণনা করেছিলাম। সকল নারীই যে ব্যভিচারিণী এই বিষয়ে আলোচনা করবো ১৪৫ নম্বর জাতক যার নাম রাধ জাতক। এই জাতকের অতীতবস্তুতে ব্যভিচারিণী ব্রাহ্মণীকে ব্রাহ্মণ বাঁধা দিতে গেলে বোধিসত্ত্ব বলেন, “ভাই তুমি নিতান্তই অবোধ, কিছুই বুঝো না, তাই এইরূপ বলিতেছো। রমণীদের সঙ্গে বহন করিয়া লইয়া বেড়াইলেও রক্ষা করিতে পারা যায় না।” এরপর বোধিসত্ত্ব নিম্নোক্ত গাঁথাটি বলেনঃ

“তুমি নাহি জান আরও কতো জন না হইতে অর্ধ রাত্রী দিবে দর্শন! নিতান্ত অবোধ তুমি, তাহারই কারণ
বলিলে করিতে মোরে অসাধ্য সাধন। কামিনীর কুপ্রবিত্তি, পতিভক্তি বিনা দমিতে যে পারে কেহ, আমিতো দেখিনা। কিন্তু সেই পতিভক্তি, হায় হায় হায় নারীর হৃদয়ে কিছু নাহি দেখা যায়।”

নারী নিয়ন্ত্রণ পুরুষতন্ত্রের জন্য অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ। বৌদ্ধশাস্ত্রের নারী সংক্রান্ত প্রতিটি উপদেশের মধ্যে নারীকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রকট ভাবে দেখা যায়। কিন্তু তারপরও “নারী হলো দুর্নিবার, তাকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না” এই উপদেশও দিয়েছেন স্বয়ং বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্বের মতে, “রমণীরা একবার খারাপ হওয়া শুরু করলে তাকে কখনোই ফিরানো সম্ভব হয় না। তাই পূর্বে থেকেই রমণীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”
এই বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো বৌদ্ধশাস্ত্রের ২৬২ নম্বর জাতক যার নাম মৃদুপাণি জাতক। এই জাতকের বর্তমানবস্তুতে কোন এক উৎকণ্ঠিত ভিক্ষুকে উদ্দেশ্য করে বোধিসত্ত্ব বলেন, “রমণীরা স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ আরম্ভ করিলে তাহাদিগকে রক্ষা করা অসম্ভব। পুরাকালে পণ্ডিতজনেও নিজের কন্যা রক্ষা করিতে পারেন নাই। পিতা কন্যার হাত ধরিয়াছিলেন, তথাপি সেই কন্যা প্রণোদিত হইয়া পিতার অজ্ঞাতসারে পুরুষান্তরের সহিত পলায়ন করিয়াছিলো।”
এই জাতকের অতীত বস্তুতে জানা যায়, বোধিসত্ত্ব পুরাকালে বারানসীর রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। তার কন্যা ও ভাগিনেয় পরস্পর প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে। পুরুষের প্রেমে নারীটি এতোই উদ্বেলিত ছিল যে, সংকেতস্থলে মিলনের জন্য কৌশলে পলায়ন করে। এজন্যই বোধিসত্ত্ব বলেছেন, ‘হাত ধরিয়া বেড়াইলেও কেহ রমণীদিগকে রক্ষা করতে পারে না। রমণীরা এমনই অরক্ষণীয়া।’ এ বিষয়ে বোধিসত্ত্ব যে গাঁথাটি বলেন তা হলোঃ

“কে পারে তুষিতে বল রমণীর মন সাবধানে বলি সদা মধুর বচন! নদীতে ঢালিলে জল, কে কবে লভিবে ফল? ললনার বাসনার অন্ত নাহি পাই। নিয়ত নরক পথে নারীর গমন দূর হতে সাধু তারে করে বিসর্জন। তুষিতে নারীর মন যে করে যতন, ভালোবাসে দেয় তারে যত পারে ধন, ইহা মুত্র নাশ তার যেন নারী দুর্নিবার, ইন্ধনে লভিয়া পুষ্টি তাহাই যেমন মুহূর্তের মধ্যে নাশ করে হুতাশন, তেমনি নারীগণে যেবা ভালোবাসে তাহাকেই পিশাচীরা অচিরে বিনাশে।”

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০৬)
নারীকে পরিত্যাজ্য ভাবার পরও পুরুষ তাকে সর্বাংশে অস্বীকার করতে পারে নি। ঘুরেফিরে নারীর চারপাশে পুরুষ তৈরি করেছে নিজের আবর্ত। আবার পুরুষের প্রয়োজন শেষ হলে নারীকে ছুড়ে ফেলে দিতেও কার্পণ্য না করার দৃষ্টান্ত জাতকগুলোতে পাওয়া যায়। এখন আমরা একটি বিখ্যাত জাতক নিয়ে আলোচনা করবো যার নাম অলম্বুষা জাতক। এই জাতকে বিখ্যাত ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যান বর্ণীত রয়েছে। সংস্কৃত বা বাংলায় আমরা তাকে ঋষ্যশৃঙ্গ নামে চিনলেও পালি ভাষায় তিনি ইসিসিঙ্গ (Isisinga) নামেই সমাধিক পরিচিত। আমি আমার লেখায় ঋষ্যশৃঙ্গ নামটাই ব্যবহার করলাম।
অলম্বুষা জাতক ত্রিপিটকের সূত্র পিটকের খুদ্দক নিকয়ের জাতকের অন্তর্গত জাতক কাহিনীর ৫২৩ নম্বর জাতক। এই জাতকের বর্তমানবস্তুতে কোন এক ভিক্ষু তার স্ত্রীর প্রলোভনে ধর্মকর্ম বাদ দিয়ে গৃহস্থের জীবন শুরু করেছিলো। তখন বোধিসত্ত্ব ঐ ভিক্ষুকে উপদেশ দেন এই বলে যে,

“দেখো এই রমণী তোমার অনর্থকারিণী, ইহারই জন্য তুমি ধ্যানভ্রংশবশত তিন বৎসর মূঢ় ও বিধ্বংস হইয়া পড়িয়াছিলে। অতঃপর সংজ্ঞা লাভ করিয়া অতি দুঃখে পরিবেদন করিয়া বেড়াইয়াছিলে।”

এই জাতকের অতীতবস্তুতে জানা যায়, বোধিসত্ত্ব পুরাকালে কাশীরাজ্যের কোন এক ব্রাহ্মণকুলে জন্ম নিয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে অরণ্যবাসী হন। অরণ্যে কোন এক মৃগী বোধিসত্ত্বের বীর্যমিশ্রিত তৃণ ভক্ষণ করে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এরপরে বোধিসত্ত্বের আশ্রমের চারপাশে সেই মৃগী বিচরণ করতে থাকেন। অবশেষে ঐ মৃগী একটি মানবশিশু প্রসব করেন আর সেই মানবশিশুকে বড় করে তুলেন তার পিতা বোধিসত্ত্ব। এই শিশুর নাম হলো ঋষ্যশৃঙ্গ। শিশুটি বড় হলে বোধিসত্ত্ব তাকে প্রব্রজ্যা দিলেন এবং এর সাথে সাথে নারীর স্বভাব সম্পর্কে জ্ঞানদান করতে লাগলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ঋষ্যশৃঙ্গ কখনোই নারী দেখেন নি, তার পিতার মুখ থেকেই নারী সম্পর্কে যা জানার জেনেছেন।
এরপর ঋষ্যশৃঙ্গ ধ্যানমগ্ন হয়ে হিমালয়ে বসবাস করতে লাগলেন। ঋষ্যশৃঙ্গের কঠোর সাধনা দেখে অন্য সাধুরা হিংসায় জ্বলে গিয়ে পরিকল্পনা করলেন ধ্যান ভঙ্গের। তারা অতীব রূপসী অলম্বুষাকে পাঠালেন ঋষ্যশৃঙ্গের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য। অপ্সরা অলম্বুষা ভয়ে ভয়ে শেষপর্যন্ত তাপস সন্নিধানে উপনীত হলেন। অলম্বুষার রূপ দেখে বিস্মিত হলেন তাপস ঋষ্যশৃঙ্গ। তিনি অলম্বুষাকে প্রশ্ন করেন –

কে তুমি তড়িৎকান্তি দাড়ায়ে ওখানে, পূর্বাকাশে শুকতারা প্রভাতে যেমন?

অলম্বুষা নিজের পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য গোপন করে ঋষ্যশৃঙ্গকে আমন্ত্রণ জানান এই বলে যে,
এস মোরা রতিসুখে ভুঞ্জি এ আশ্রমে এস প্রিয়, আলিঙ্গনে বদ্ধ হই মোরা নানাবিধ রতিসুখ করি আস্বাদন।
ঋষ্যশৃঙ্গ তার পিতার মতো বনের এখানে ওখানে নিজ প্রচেষ্টায় বীর্যপাত করলেও রতিসুখ কি জিনিষ তা তিনি জানতেনই না। রতিসুখ তো দুরের কথা অলম্বুষার পূর্বে তিনি জীবনে কখনো নারীই দেখেন নি। কিন্তু অলম্বুষা রমণীজনোচিত মায়ামোহে আবদ্ধ করে ঋষ্যশৃঙ্গকে শয্যায় গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে রতিরঙ্গে তিনটি বছর কেটে যায়। এরপর ঋষ্যশৃঙ্গের তপস্যাহীন সময় পার করার জ্ঞান হয়। তখন অলম্বুষার প্রতি ভয়ানকভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিশাপ দিতে চাইলে অলম্বুষা অভিশাপের ভয়ে তাকে সবকিছু খুলে বলে।
অলম্বুষা জানায়, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসলেও এখন সে ঋষ্যশৃঙ্গকে ভালোবেসে ফেলেছে। সে ঋষ্যশৃঙ্গকে ছাড়া অন্য কিছু কল্পনাও করতে পারে না, এইভাবে অনন্ত জীবন যদি পার হতো, আহ কি ভালোই না হতো। কিন্তু ঋষ্যশৃঙ্গ আর নারীমোহে তার জীবন অপচয় করতে চাইলেন না। তার মনে পড়ে গেলো পিতার উপদেশবানী –

"নারীগণ ফুল্ল কমলের মতো হরে মন, লয় বিপদে টানিয়া জানে যেন ইহা পুরুষে সতত বক্ষে রমণীর আছে গণ্ডদ্বয় থাকে যেন ইহা মনেতে তোমার।"

অবশেষে ঋষ্যশৃঙ্গ অলম্বুষার ভালোবাসার কানাকড়ি মূল্যায়ন না করেই তাকে ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ঋষ্যশৃঙ্গ সারাজীবন ধরে কঠোর তপস্যা করেন আর দুঃখ করেন তার তিনটি বছর নারীঘটিত দুর্মতিতে অতিবাহিত করার জন্য। পুরুষ নারীকে প্রয়োজন শেষে ত্যাগ করার অনেক দৃষ্টান্ত সেই প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। এমনকি পুরুষ তার প্রয়োজন মিটিয়ে নিজের ভুলের জন্য আজীবন আপসুস করতে পারলেও যে রমণী তাকে ভালোবাসে তার কথা একবারও চিন্তা করতে চায় না। এরপরও তারাই মহাপুরুষ হয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়।
আরেকটা ব্যপার এখানে লক্ষণীয় যে, হিন্দু সন্ন্যাসী থেকে শুরু করে বৌদ্ধভিক্ষু প্রব্রজ্যা গ্রহণকারী বা মুসলিম সূফীদের মধ্যে যারা নারীদেরকে তাদের সাধনার প্রতিবন্ধকতা মনে করতো তারা নারীর বিকল্প হিসেবে হস্তের দ্বারস্থ হতে কুণ্ঠিত হতো না। জনৈক এক সাধুর জনপ্রিয় একটি উক্তি ছিলো,
থাকিতে নিজ হস্ত কেন হবো অন্যের দ্বারস্থ?
এই জন্যই বনে সাধনা করতে গেলেও বনের এখানে ওখানে তাদের বীর্য পাওয়ার গল্প শোনা যেত। এগুলো আবার পশুপাখি তাদের খাদ্যের সাথে খেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ার গল্পও আমরা পেয়ে থাকি বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে।
বৌদ্ধধর্মানুযায়ী নারীগণ শুধু সাধনার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীই নয় তারা সামগ্রিক অশুদ্ধতার প্রতিমূর্তিও। এই বিষয়ে আমরা এখন আলোচনা করবো মহাহংস জাতক নিয়ে। মহাহংস জাতক ত্রিপিটকের জাতক কাহিনীর ৫৩৪ নম্বর জাতকের অন্তর্গত। এই জাতকের কাহিনীতে বর্ণীত আছে – পুরাকালে বারাণসীরাজের ক্ষেমা নামে একজন অগ্রমহিষী (অনেকগুলো স্ত্রীর মধ্যে প্রধান স্ত্রী) ছিলেন। তার হংসের মুখে ধর্মকথা শোনার আকাঙ্ক্ষা ছিলো, যদিও তার স্বামী তার আকাঙ্ক্ষার মূল্যায়ন করতে চায় নি।
কিন্তু ক্ষেমা তার দোহদের সময় আবার সুবর্ণহংসমুখে ধর্মকথা শুনতে চাইলো। যারা দোহদের অর্থ জানেন না তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, দোহদ হচ্ছে গর্ভকালীন ইচ্ছা। বোঝা যায় সন্তান জন্মানোর সময় নারী তার ইচ্ছাপূরণের সুযোগ পেতো। পুরুষ সম্ভবত দয়া করেই এই ইচ্ছাটা পূরণ করতো কারণ তৎকালীন সময়ে সন্তান জন্ম দেয়া মানে মৃত্যুকে দর্শন করার মতো ছিলো। তাছাড়া বিশেষ করে যে পুত্রসন্তানটি জন্মাবে সেটি তো পুরুষের, নারী তো শুধু পুত্রসন্তান জন্মানোর আধার মাত্র।
দোহাদ বলেই রাজা অবশেষে সুবর্ণহংস এনে দিতে রাজি হলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে ২ টি হংস পাওয়া গেলো, এদের একটির নাম হচ্ছে ধৃতরাষ্ট্র এবং আরেকটির নাম হচ্ছে সুমুখ। ধৃতরাষ্ট্র তার নিজের স্ত্রীর জন্য বিলাপ করতে থাকলে সুমুখ তাকে স্ত্রীজাতি সম্পর্কে উপদেশ দেন এভাবে –
রমণী যে শ্রেষ্ঠরত্ন, এ প্রলাপ করো তুমি অর্ধ উন্মক্ত হইয়া নিশ্চয়।
সাধারণ ভোগ্যা তারা, শৌণ্ডিকের পানাগার যথা সর্ব অধিগম্য হয়।
মায়া তারা মরীচিকা, রোগ-শোক-উপদ্রব সর্ববিধ অশান্তিনিধান।
প্রখরা পাপের পঙ্কে, বান্ধে তারা জীবগণে তাহা হতে নাই পরিত্রাণ।
দেহরূপ গুহামধ্যে, মৃত্যুপাশসমা তারা পদে পদে বিপদ ঘটায়।
এহেন রমণীগণে, যে জন বিশ্বাস করে নরকূল অধম সে নিশ্চয়।

এভাবে সুমুখের উপদেশ থেকেই জাতকটিতে বুঝানো হলো যারা এতো অনাসৃষ্টির মূল নারীকে বিশ্বাস করে তারা মানুষেরও অধম। এই পিতৃতান্ত্রিক ধর্মকথা আবার একজন নারীই ভক্তিভরে শ্রবণের জন্য বায়না ধরে তার পতির কাছে! সত্যিই প্রতিটি ধর্মে নারী নিষ্পেষিত হলেও নারীবিরোধী ধর্মকথা শোনার আগ্রহ নারীদেরই কেন বেশী তা আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলুম না!
মন্তব্যঃ প্রদীপ-
নিলয়, 
আপনি তো সোৎসাহে লিখে চলছেন । কেন লিখছেন সেটা জানেন, কিন্তু যা লিখছেন, তা কী সাহিত্য, নাকি ইতিহাস তা ঠিক কত ধাতস্থ করেছেন তা বুঝা যাচ্ছে না । বুদ্ধ তো কোন মিথ নয় । মুহাম্মদ কে আনতে হয় যখন ইসলামের প্রসঙ্গ আসবে, সেরকম বুদ্ধকে আনতে হবে,কারন তিনি তো ব্যক্তি – একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। তাঁর জীবদ্ধশাকে ধর্ম হিসেবে ধরতে হবে। বোধি সত্ব একটা রূপক,তিনি কোন ঐতিহাসিক চরিত্র নন। জাস্ট এ মেটাফর । নিছক কল্পনা প্রসূত । যাকে আপনি জাতিস্মর বলতেই পারেন । তাই একটা সাহিত্য নিয়ে তাঁর ধর্ম (Basket of tools) কে আলোচনা লজিক্যাল নয় ।
বুদ্ধ অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে তাঁর শিষ্য প্রশিষ্য বর্গ মিলিত হয়ে মহা সাঙ্গিতির মাধ্যমে তাঁর শিক্ষা গুলো সুসংবদ্ধ আকারে গ্রথিত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, যা ইতিহাসে সুবিদিত । সংস্কৃতে যা ত্রিপিটক(three basket) সে সময়ে তাঁর আলোচনা বা ধর্মোপদেশ(discourse), সংঘ এর নিয়মাবলী(monastic rules) এবং ধর্মের দার্শনিক ,মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা সম্বলিত(Philosophical and psychological discourse) এই তিন বিষয় কে আলাদা করে যে গ্রন্থের সুচনা হয়েছিল সংস্কৃতে যা ত্রিপিটক(three basket) নামে খ্যাত । সেখানেই কোন কোন জায়গায় জাতক এর প্রসঙ্গ দেখা যায় । বক্তব্যের গভীরতা বোঝাতে গিয়ে জাতকের কাহিনী র প্রসঙ্গ এসেছে। যেখানে বক্তা স্বয়ং বুদ্ধ, কাহিনীর সময়কাল অতীত ,কাহিনীর নায়ক বোধিসত্ব । সেখানে বোধি সত্ব মাছ, পাখি , জীব জন্তু , দেবতা, ইন্দ্র, বাহক ,দ্বার রক্ষী, দড়া বাজি কর , চন্ডাল, কৃষক, বনিক ইত্যাদি রূপে আবির্ভূত । কামের প্রসঙ্গ, নারীর চারিত্রিক চপলতার প্রসঙ্গ , তাঁর বিশ্বাসহীনতার প্রসঙ্গ এসব উপাদান গুলো ততকালীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার ইঙ্গিত বাহী । অতীতের সাথে বর্তমানের যুগল সম্মিলনে বোঝানো হয়েছে মানবের পূর্ণতা প্রাপ্তির উৎস তাঁর অতীত সুকর্ম । সেই সুত্রে এসেছে জন্মান্তর বাদ । এখানে উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে যে, প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা এবং ভারতের বৌদ্ধ সভ্যতা সমসাময়িক। এই উভয় সভ্যতার মাঝে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুগভীর সাদৃশ্য দেখা যায় , যা সত্যি ই চিত্তাকর্ষক । যেমন গ্রীক দার্শনিক পিথাগোরাস এবং বুদ্ধ সমসাময়িক বা পিথাগোরাস তাঁর অব্যবহিত কিছু আগে । পিথাগোরাসের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে তিনিও ও তাঁর অতীত জন্ম সম্পর্কে অবহিত ছিলেন । বুদ্ধের ক্ষেত্রেও তা আমরা দেখতে পাই যে, বুদ্ধ জাতিস্মর ছিলেন। জাতকের ৫৫০(বা ৫৪৭)টি কাহিনীতে জাতিস্মর বুদ্ধ সেই অতীত জন্মের কাহিনী বলছেন । ধর্মীয় বিশ্বাসের এই অংশটা ছাপিয়ে জাতক হয়ে উঠেছে বিশ্ব সাহিত্যের অনতিক্রম্য একটা নিদর্শন। যা পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর আদি রূপ কে অতিক্রম করে তাঁর বর্ণনার কৌশল , সমসাময়ীক লোক গাথার সাথে মিশে একই কাহিনী ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে তা নবজন্ম পেয়েছে। প্রসঙ্গটা ছিল, ধর্মের ইতিহাসে নারীর অবস্থান ।সকল ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে তাঁর মানবিক সম্মান থেকে বঞ্চনার চিত্র দেখাতে গিয়ে, একই সমান্তরালে বৌদ্ধ ধর্মীয় ইতিহাসে ও যে নারী কে যথেচ্ছ অসম্মান করা হয়েছে তা প্রতিষ্টিত করা করা । জাতক সাহিত্যের ৫৫০ টি গল্প থেকে ‘কুনাল জাতক’ নামে একটি জাতকে নারীর প্রতি প্রবল ঘৃণা এবং অবমাননাকর উপমা মিশ্রিত কাহিনীর উদাহরন ।
আমরা প্রয়শ সাহিত্য এবং ধর্ম কে একসাথে ঘুলিয়ে ফেলি। ধর্মীয় আবেগের বশে মানুষ এ দুয়ের মোটা দাগের দুরত্বকে মুশে দেবার প্রয়াস পেয়েছে। যা একদিকে যেমন ধর্মের মৌলিক বিষয়ের অর্থ হানি হয়েছে অপরদিকে তার সাহিত্য রস ধর্মীয় জাতাকলে পক্কাহঘাত গ্রস্ত হয়েছে। যেমন মহাভারত,রামায়নের মতো পৌরাণিক মহাকাব্য যা বিশ্ব সাহিত্য সৃষ্টির ভান্ডারে অতুলনীয় গৌরবের আসনে না থেকে তা হয়ে উঠেছে ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তেমনি বিশ্বের প্রাচীন সাহিত্যের অনবদ্য অলংকার এই জাতক সাহিত্য ও ধর্মীয় উপাচারে ভূষিত হয়ে একই পরিনতির সুত্রপাত করেছে। ধর্ম বা ধর্মীয় ইতিহাস কে কেন্দ্র করে যুগে সাহিত্য রচিত হয়েছে। তা হয় উপন্যাস না হয় কাব্য । কারবালার যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে যেমন ‘বিষাদ সিন্ধুর’ মতো গ্রন্থ রচিত হয়ে বাঙলা সাহিত্যে, তেমনি রবীন্দ্র কাব্য সাহিত্য আলোকিত করে আছে মহাভারত ,রামায়ন এবং জাতকের অনেক সমৃদ্ধ কাহিনী । এরকম অজস্র উদাহরণ সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কিন্তু মানুষের ধর্মীয় আবেগ কিছুতেয় সায় দিতে চায় না যে , এসব নিছক সাহিত্য সৃষ্টি ,ধরমের অংশ নয় । হতে পারে তাতে ধর্মের নৈতিকতাকে ,তাঁর মরমবানীর উপাদান কে লেখক তুলে আনার প্রয়াস পেয়েছেন,কিন্তু তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তা হচ্ছে মানুষের চিত্ত বিনোদন ।যুগে যুগে ,কালে কালে তাঁর উপাদান গুলো বদলেছে,কিন্তু উদ্দেশ্য থেকে গেছে একটাই।
জাতক সাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও,দেখা যাবে ধর্মের মর্ম বাণী কে অবলম্বন করে প্রাচীন ভারতের সামাজিক , সাংস্কৃতিক চিত্র কী ভাবে নৈপুণ্যের সাথে চিত্রায়িত হয়েছে।
। আমার জানামতে,বুদ্ধের কোন discourse (সুত্র) এ নারী কে নিয়ে আলাদা বক্তব্য নেই। বুদ্ধ sexist ছিলেন কীনা, তাঁর জীবনী থেকে সেটা বের করতে পারেন, তাহলেই প্রমান করতে পারবেন যে ,তাঁর ধর্মে নারীর অবমাননা বিদ্যমান। আমি তা পাইনি। তিনি তাঁর সংঘ কে নারী থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছেন। সেটা একটা সেনা বাহিনীর নিয়ম শৃঙ্খলার বিষয় হতে পারে, এ ছাড়া আর কোন ঘটনা বা বক্তব্য আমার জানা নেই । আপনি পারলে বের করবেন । কিন্তু জাতক নয়
বুদ্ধের জীবদ্ধশায় এমন কোন ঐতিহাসিক ঘটনা নেই, যেখানে প্রমাণিত হয়েছে নারীকে অমর্যাদা করা হয়েছে। আপনার জাতকের উদাহরণ তো অনেক দূরে ।বিশাখা, ক্ষেমা, উতপলাবর্না ,পটাচারা এসব ঐতিহাসিক নারী চরিত্র বুদ্ধের জীবদ্ধশায় আমরা পাই , যারা ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। যেমন পাই আম্রপালীর মতো নগর বেশ্যাকে, যার আতিথ্য বুদ্ধ স্বয়ং গ্রহন করেছিলেন ।
এর পর আসা যাক বৌদ্ধ সমাজে নারী র অবস্থান কী। ধর্মে যা থাকবে,সমাজে ও তাই থাকবে, যেমন ইসলাম । ১৯৭৯ এ আগষ্ট ,university of western Australia তে অনুষ্টিত
international conference of Indian studies শীর্ষক সম্মেলনে women in primitive Buddhism নামক একটা গবেষনা পত্রে দেখানো হয়েছে শ্রী লঙ্কা, থাইল্যান্ড , মিয়ানমার এবং তিব্বত এর নারীদের জীবন ব্যবস্থার সাথে পশ্চিমা নারীদের জীবন ব্যবস্থার কোন বৈসাদৃশ্য নেই, বরং নারী বাদিদের কাছে তা হবে বীজমন্ত্রের মতো। স্বয়ং আমি মিয়ানমারের মাতৃ তান্ত্রিক সমাজের উপাদান দেখে বিস্মিত হয়েছি ।
১৭৬৯ খ্রি এর একটা ঘটনা বলি । বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে সে সময়কার ডাচ শাসক স্রীলঙ্কার ক্যান্ডির প্রধান বৌদ্ধ পুরহিত এর কাছে প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন,ধরমে তা কতটুকু বিবেচ্য ।বৌদ্ধ ভিক্ষু যে উত্তন ডাচ গভর্নর এর কাছে পাঠিয়েছিলেন,বিবাহ বিচ্ছেদ নিস্পত্তির জন্যে, ইতিহাসে তা ‘লাক্রাজলাসিরিতা’ নামে খ্যাত । সেখানে দেখা গেছে,তাতে পুরুষের ইচ্ছা কে প্রাধান্য দেয়া হয়নি ।নারীকেই প্রমান করতে হবে তিনি তাঁর পুরুষের প্রতি অনুরক্ত নন । নারীর বসন ব্যসনে বিবাহিতা বা বিধবাদের কোন পার্থক্য নেই, বিধবাদের নেই কোন রীতিগত বাধা । এমনকি পুনর বিবাহে ও । বিধবাদের সম্পত্তির রয়েছে উত্তরাধিকার । এমনকি উপপত্নির ও রয়েছে বিবাহিতার সম মর্যাদা । সন্তানের বৈধতা ।মনু সনহিতায় আছে একমাত্র পুত্র ই মুখাগ্নি করবে,কিন্তু বৌদ্ধ নারীরা পিতা মাতার মুখাগ্নি করার কোন বাধা নেই ।
http://www.sacred-texts.com/bud/j5/j5029.htm – লিঙ্ক এ এর কাহিনী আপনি নেন নি, নিয়েছেন ছন্দোবদ্ধ কাহিনী যা ,আদি জাতক নয় ।এই ছন্দ বদ্ধ পদ্য গুলো রচিত হয়েছে অনেক অনেক পরে,এবং সেখানে প্রবিষ্ট হয়েছে আপন মনের মাধুরি । জাতক সাহিত্যের যে আদি উদেশ্য ছিল তা এই সব পদ্যে সম্পূর্ণ নগন্য করে,আপন রস সৃষ্টি কে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা হয়েছে ।
গৌতম বুদ্ধ ছিলেন একজন মানুষ, তিনি দেবতা বা এ ধরনের কিছু ছিলেন না। যে অর্থে আমরা ধর্ম বুঝি, সেই প্রচলিত অর্থে বৌদ্ধ ধর্ম ‘ধর্ম’ নয় । বুদ্ধের ধর্মে(শিক্ষায়) স্বর্গ নরক, পাপ এসব নেই । যেখানে ঈশ্বর থাকবে, সেখানে এসব থাকবে । পাপ থাকবে কারন ঈশ্বর তাঁর জন্যে শাস্তি রেখেছে । পুন্য থাকবে, কারন তাঁর জন্যে স্বর্গ থাকবে ।কর্ম, কর্ম ফল্কে বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছেন,এই মুহুতের আমি যা ,তা গত মুহুতের আমি র ফল । এবং শরীর টা রিসাইকেল আইটেম কিন্তু মন বা চেতনা সাইকেল আইটেম ,সেটার মৃত্যু নেই যাকে তিনি বলেছেন লাইফ সাইকেল(জন্মজন্মান্তর) । গৌতম বুদ্ধ যা বলেছেন, তা হচ্ছে নৈতিকতা । তিনি নৈতিকতার কিছু টুলস(হাতিয়ার) দিয়েছেন, যা দিয়ে মানুষের মনে এবং কর্ম জীবনে সৌন্দর্য নির্মাণ কর যায়। সেই টুলস যে যত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করবে, সে তত বেশী সৌন্দর্য তৈরি করতে পারবে । তাঁর ধর্ম কোন নির্দিষ্ট সেক্ট(সম্প্রদায়ের) নয়। সেখানে কোন আচার নেই, তাই তা ইউনিভার্সাল বা সর্ব মানবিক ।জাতক হচ্ছে মুলত সাহিত্যের অংশ, যেমন বুদ্ধের ইমেজ একটা শিল্পের সবাক ইম্প্রেশন ।তিনি তাঁর প্রিসেপ্ট (নিয়ম/শীল) এ কোথাও বলেন নি পাপ – বলেছেন অসুন্দর । তিনি বলেন নি ,’আমাকে পুজা দাও,আমার সামনে নত হও,আমি আশীর্বাদ করব’,মন্দিরে আসো,সেখানে আমি আছি ইত্যাদি,মানুষ তাঁকে ভুল বুঝেছে….তাঁর আমিত্ব নেই্‌ , আমিত্ব নিরবাপিত,সেটাই নির্বাণ । বৌদ্ধ ধর্ম হছে এগনস্টিক বা অজ্ঞেয় বাদি, যা ঈশ্বরে অজ্ঞ এটাই বুঝায় । নাস্তিক রা পরোক্ষে ঈশ্বরকে স্বীকার করে(মানি না বলার মাঝে), কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম তাও স্বীকৃতি দেয় না।