স্ট্রিং তত্ত্ব ও মহাবিশ্বঃ-
আসুন জেনে নেওয়া যাক স্ট্রিং তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের ধারনাটি কেমন। পদার্থবিদ্যার আধুনিক ধারনা অনুসারে একটি মহাজাগতিক স্ফীতির মধ্য দিয়ে আমাদের মহাবিশ্বের শুরু।স্ফিতির ঠিক পরেই একটি বড়সর বিস্ফোরণের(বিগ ব্যাং) মাধ্যমে মহাজাগতিক বস্তুগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে। আর আমরা সেই বিস্ফোরণের অনেক পরের একটি সময়ে অবস্থান করছি।মহাবিশ্ব সম্পর্কে এই ধারনা চিত্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করুন।এই চিত্র অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্ব একটিই ।আর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো মহাবিশ্বের সর্বত্র একই রকম, বা অন্যভাবে বলা যায়, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো শুধুমাত্র একই রকম হতে পারে।
আসুন জেনে নেওয়া যাক স্ট্রিং তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের ধারনাটি কেমন। পদার্থবিদ্যার আধুনিক ধারনা অনুসারে একটি মহাজাগতিক স্ফীতির মধ্য দিয়ে আমাদের মহাবিশ্বের শুরু।স্ফিতির ঠিক পরেই একটি বড়সর বিস্ফোরণের(বিগ ব্যাং) মাধ্যমে মহাজাগতিক বস্তুগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে। আর আমরা সেই বিস্ফোরণের অনেক পরের একটি সময়ে অবস্থান করছি।মহাবিশ্ব সম্পর্কে এই ধারনা চিত্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করুন।এই চিত্র অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্ব একটিই ।আর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো মহাবিশ্বের সর্বত্র একই রকম, বা অন্যভাবে বলা যায়, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো শুধুমাত্র একই রকম হতে পারে।
কিন্তু স্ট্রিং থিওরী বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এই তত্ত্ব মতে একদম শূন্য
থেকে অসংখ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমাদের মহাবিশ্বই যে একমাত্র
মহাবিশ্ব এমন ভাবার কোন কারন নেই। আর বিষয়টি এমন নয় যে, কোন একটি নির্দিষ্ট
সময়ে এই মহাবিশ্বগুলো সৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে
সময়ের কোন নির্দিষ্ট পরিমাপ নেই। কেননা আমাদের দুনিয়ার সময়ের সাথে সেই
সময়ের কোন যোগাযোগ নেই। সৃষ্টির এই প্রক্রিয়ায়, আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি
হবার আগেও যেমন অসংখ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে তেমনি আমাদের এই স্থান-কালের
বাইরে শূন্য থেকেই আরও বিশ্ব সৃষ্টি হয়েই চলেছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আর এই
প্রতিটি মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি যে আমাদের মত সেটিও না।
আমাদের মত নিয়ম সমৃদ্ধ মহাবিশ্বও যেমন আছে, তেমনি সম্পূর্ণ আলাদা নিয়মের
মহাবিশ্বও আছে অসংখ্য।
প্রতিটি আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বগুলো কেমন হবে, তা নির্ভর করে স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো কিভাবে পেচিয়ে আছে তার উপর।আমরা আগেই জেনেছি স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো চাইলেই ইচ্ছেমত জড়িয়ে পেচিয়ে থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলোর প্যাঁচ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। এই অন্তর্বর্তী জগতের প্যাঁচের আকার-আকৃতিই বিভিন্ন ভৌত ধ্রুবক যেমন, ইলেক্ট্রনের চার্জ, মৌলিক কণিকাগুলোর পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদির মান নিয়ন্ত্রণ করে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, এই প্যাঁচের আকৃতিই প্রকৃতির দৃশ্যমান নিয়ম গুলো নিয়ন্ত্রন করে। এখানে দৃশ্যমান নিয়ম বলতে, মৌলিক চারটি বল ও তাদের পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ধরন, মৌলিক কণিকা যেমন, কোয়ার্ক বা নিউট্রিনোর ভর, আধান ইত্যাদির কথা বোঝানো হচ্ছে। আর এসব দৃশ্যমান নিয়মগুলো আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে।অর্থাৎ স্ট্রিং তত্ত্বের নিয়মগুলোই হল প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক নিয়ম, যেগুলোর উপর ভিত্তি করে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়মগুলোর উদ্ভব ঘটে।
এভাবে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মত প্রাকৃতিক নিয়মযুক্ত, বিভিন্ন ধরনের মহাবিশ্ব উদ্ভব হতে পারে। শুধুমাত্র প্রতিটি মহাবিশ্বের অন্তর্বর্তী জগত ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পেচিয়ে থাকবে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, স্ট্রিং তত্ত্বের অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলো প্রায় ১০^৫০০ উপায়ে পেচিয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ এই তত্ত্ব মতে ১০^৫০০ সংখ্যক আলাদা আলাদা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম সমৃদ্ধ মহাবিশ্ব সম্ভব । এই সংখ্যাটি কতটা বড় সেটি বুঝতে চাইলে এমন একজন বিজ্ঞানীর কথা ভাবুন যিনি স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধান থেকে কোন শক্তিশালী কম্পিউটারের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ১০০০ টি নিয়ম বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে। এত ক্ষমতা সম্পন্ন যন্ত্র থাকার পরও তিনি যদি তিনি বিগ ব্যাঙের পর থেকে আজ পর্যন্ত হিসেব করতে থাকেন, তাও মাত্র ১০^২০ টি মহাবিশ্বের নিয়ম গণনা করতে পারবেন। আর এমন প্রতিটি নিয়মের মহাবিশ্ব সংখ্যাও অগনিত।
প্যারালাল ইউনিভার্স(Parallel Universe) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব
স্ট্রিং তত্ত্বের এরকম সমাধানের পর মহাবিশ্বের ধারনা বদলে মাল্টিভার্স(Multiverse) বা বহুবিশ্বে রূপ নিয়েছে। এরকম অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিতর এমন অনেক মহাবিশ্ব আছে যেগুলোর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো হয়ত হুবহু আমাদের মত। আর এদের ভিতর অনেকেই আবার আকার আয়তন সবদিক থেকেই দেখতে আমাদের মহাবিশ্বের মত। এদেরকে বলা হয় প্যারালাল ইউনিভার্স(Parallel Universe) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব। এরকম সমান্তরাল মহাবিশ্বের সংখ্যা যেহেতু অগণিত, তাই এমন কিছু মহাবিশ্ব পাওয়া যাবে যেগুলোর সবকিছুই হুবহু আমাদের মহাবিশ্বের মত।যেন ঠিক জমজ ভাই-বোন। ঠিক আপনার মতই আরেকজন আপনি হয়ত আরেকটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে বসে ঠিক এই বইটিই পড়ছে।
চিত্রঃ উপরের প্রতিটি গোলকই এক একটি আলাদা মহাবিশ্ব,এদের মধ্যে কিছু আবার আছে হুবহু আমাদের মহাবিশ্বের মতই দেখতে।
সমান্তরাল মহাবিশ্বের কথা শুনতে হয়ত অনেকের কাছে আজগুবী মনে হতে পারে। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব ছাড়াও মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য বর্ণনাকারী- ইনফ্লেশন তত্ত্বও একই রকম কথা বলে। কেওটিক ইনফ্লেশন তত্ত্ব অনুসারে বিজ্ঞানী আঁদ্রে লিণ্ডে কম্পিউটার সিমুলেশন করে দেখেছেন, এই ধরনের স্ফীতি তত্ত্বও স্ট্রিং তত্ত্বের মত আলাদা ধরনের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম কার্যকর অসংখ্য মহাবিশ্বের কথা বলছে। এমআইটির( MIT) কসমোলজিস্ট ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের পরিচিত গনিতের সম্ভাবনার সাহায্যে হিসেব কষে দেখিয়েছেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব থেকে প্রায় ১০^১০^২৮ মিটার দুরেই হয়ত হুবহু আপনার মত দেখতে একজন সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়েই ভাবছে।কিন্তু সমস্যা হল আপনি বা আপনার টুইন কেউই কারও সম্পর্কে জানতে পারবেন না।
টেগমার্ক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে চার রকম প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলেছেন । লেভেল ওয়ান প্যারালাল ইউনিভার্স হল সবচেয়ে মজার। বলা যেতে পারে আপনি যদি আপনার বর্তমান অবস্থান থেকে যথেষ্ট দূরে ভ্রমন করতে পারেন তাহলে আপনি আবার আপনার বাসাতেই ফিরে যাবেন। সেখানে দেখা যাবে হবহু আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহে আপনার মতই একজন বসে স্ট্রিং তত্ত্বের কোন বই পড়ছে। শুনতে অবাক লাগবে, বহুবিশ্বের কথা বিবেচনা না করলেও, এরকম প্যারালাল জগত থাকার সম্ভবনা রয়েছে। কারন ইনফ্লেশন তত্ত্বের বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানি মহাবিশ্বকে আগে যতটুকু বড় মনে করা হত এটি তার থেকে ঢের বেশি বড়। আক্ষরিক অর্থেই অসীম বলা যেতে পারে।বিজ্ঞানীরা গাণিতিক সম্ভাবনার সাহায্যে হিসেব কষে দেখেছেন, এই অসীম মহাবিশ্বে আমাদের সৌরজগতের একটি টুইন খুজে পাবার সম্ভবনা বেশ প্রবল।একই রকম এসব মহাবিশ্বকে লেভেল-1 প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়।
স্ট্রিং তত্ত্বের সমীকরণ বিশ্লেষণ করে একদল বিজ্ঞানী বলছেন আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল দুটি ব্রেনের সংঘর্ষের কারনে। দুটি ব্রেনের এরকম সংঘর্ষের ফলেই ইনফ্লেশনের সৃষ্টি হয়। এরকম সংঘর্ষ কিন্তু কোন নির্দিষ্ট একটি স্থানে হয় না, বরং আমাদের মহাবিশ্বের বাইরের শুন্যতায় এরকরম সংঘর্ষ হয়েই চলেছে, ফলে সৃষ্টি হয়ে চলেছে অসংখ্য মহাবিশ্ব। এই অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিতর আমাদের মহাবিশ্বের মত কোন একটি থাকা খুবই সম্ভব। ব্রেনের সংঘর্ষের কারনে এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই তত্ত্বকে ইকপাইরোটিক থিওরি(Ekpyrotic Theory) বলা হয়। এই তত্ত্ব ঠিক হলে আমাদের মহাবিশ্বের মত দেখতে আরও কোন মহাবিশ্ব থাকাটা বাধ্যতামূলক। এরকম মহাবিশ্বগুলোকে লেভেল-2 প্যারালাল ইউনিভার্স বলে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সম্ভাব্যতা ও এর বর্ণনাকারী ওয়েব ফাংশনকে ব্যাখ্যা করার জন্য আরেক ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলা হয়।এ ধরনের মহাবিশ্বের কথা বুঝতে চাইলে “হিলবার্ট স্পেস” নামে এক ধরনের তাত্ত্বিক ও বিমূর্ত স্থানের কথা ভাবতে হবে। এই তাত্ত্বিক স্পেস অসীম-মাত্রিক এবং একটি কোয়ান্টাম জগত এই হিলবার্ট স্পেসের সাপেক্ষে বিভিন্নভাবে ঘুরতে পারে। এই তত্ত্ব মতে যে ধরনের মহাবিশ্বের কথা বলা হয়, সেগুলো প্রত্যেকটি একই জায়গায় এবং একই সময়ে সহ-অবস্থান করছে, কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা ডাইমেনশনে অবস্থিত বলে কেউ কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। যোগাযোগ করতে না পারলে কি হবে,প্রতিটি মুহূর্তে নেয়া আপনার সিদ্ধান্তগুলো হয়ত আপনার মত অসংখ্য আপনার হুবহু প্রতিরুপের সাথে মিলিত ভাবেই নেওয়া হচ্ছে। আপনার নাকের ডগায়ই হয়ত একটি সমান্তরাল মহাবিশ্ব রয়েছে, শুধু আলাদা মাত্রায় অবস্থিত বলে তাকে ধরা ছোঁয়া যাচ্ছে না। এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতারা মনে করেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত নিয়মগুলোর উৎপত্তি আসলে এরকম অসীমসংখ্যক প্যারালাল ইউনিভার্সের যোগাযোগের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এ ধরনের সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলোকে লেভেল থ্রি প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়।
স্ট্রিং তত্ত্বে অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলো বিভিন্ন ভাবে পেচিয়ে থাকার কারনে বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক নিয়মাবলী সমৃদ্ধ মহাবিশ্বের উদ্ভব হতে পারে। এ রকম আলাদা আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বগুলোর সবকিছুই আলাদা। এমন সব মহাবিশ্বের বেশিরভাগই প্রান ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য অনুপযোগী। যদিও আমরা এমন মহাবিশ্বের প্রমান পাইনি, কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এরকম মহাবিশ্বের সংখ্যা প্রায় অসীম, ১০^৫০০।আর এর ভিতর আমাদের মহাবিশ্বের মত নিয়ম যুক্ত মহাবিশ্বের সংখ্যাও অগণিত। বর্তমান প্রযুক্তির ধরা ছোঁয়ার বাইরে হলেও, ভবিষ্যতে কোন দিন হয়ত আমরা এমন মহাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হব। এমন বিভিন্ন নিয়ম যুক্ত মহাবিশ্বকে বলা হয় লেভেল-4 প্যারালাল ইউনিভার্স।
উপরে চার ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলা হয়েছে।স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধানগুলো শুধু লেভেল-3 ছাড়া বাকি সবগুলোর অস্তিত্ব দাবি করে। স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধানগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় অবশ্যই কোথাও আমাদের মহাবিশ্বের মত অন্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে। এই তত্ত্ব আমাদের সামনে সৃষ্টির যে চিত্র তুলে ধরে তাতে বহুবিশ্ব ও সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব খুবই বাস্তব।
ওয়ার্মহোল (Wormhole)
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে স্পেস বা স্থানকে আমরা যেরকম সমতল বলে ভাবি, স্পেস আসলে তেমন না, বরং এটি বাঁকানো। আলো যখন মহাশূন্যের(স্পেস) ভিতর দিয়ে ভ্রমন করে, তখন এই বাঁকানো স্পেসের ভেতর দিয়ে একটি বাঁকানো পথে চলতে বাধ্য হয়।কিন্তু এই বাকা পথের পাশাপাশি একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তাও আছে। এই সংক্ষিপ্ত পথকেই ওয়ার্মহোল বলা হয়। ওয়ার্মহোলকে অনেক সময় আইনস্টাইন-রজেন ব্রিজ নামেও ডাকা হয়ে থাকে।দুটি স্থানে যাবার এই বিভিন্ন রাস্তা থাকার কারনে গণিতবিদরা একে বহুভাবে সংযুক্ত স্থান(Multiply connected spaces) বলেন। কিন্তু পদার্থবিদরা একে ওয়ার্মহোল বলেন কারন, একটি পোকা যেমন মাটি খুড়ে পৃথিবীর এই প্রান্তের সাথে অন্য প্রান্তের একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তা তৈরি করতে পারে, তেমনি একটি ওয়ার্মহোলও মহাবিশ্বের দুটি স্থানের ভিতর একটি বিকল্প সংক্ষিপ্ত রাস্তা তৈরি করে।
আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রপুঞ্জ হল আলফা সেন্টরাই। সৌরজগৎ থেকে আলোর বেগে ভ্রমন করলেও পার্শ্ববর্তী এই নক্ষত্রপুঞ্জে যেতে আমাদের কমপক্ষে ৪.৩ বছর সময় লাগবে(বাস্তবে যা অসম্ভব,কেননা কোন কিছুর পক্ষেই আলোর বেগে ভ্রমন সম্ভব নয়)।কিন্তু যদি কেউ একটি ওয়ার্মহোল দিয়ে যেতে পারে তবে ডিনার করতে করতেই আলফা সেন্টরাই থেকে ঘুরে আসা সম্ভব।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব আমাদের মহাবিশ্বের দুটি ভিন্ন স্থানের মধ্যে ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে ভ্রমনের কথা বললেও, স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধান অনুযায়ী আমরা যদি একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পারি তা আমাদের মহাবিশ্বের যেকোনো গালাক্সির পাশাপাশি অন্য মহাবিশ্বে ভ্রমনের সম্ভাব্যতার কথাও বলে।এমনকি একটি ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে শুধু দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বেই নয়, এমনকি অতীত ও ভবিষ্যতেও ভ্রমন করা সম্ভব। স্ট্রিং তত্ত্ব যে অতিরিক্ত মাত্রার কথা বলে, আমরা যদি সেই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো দিয়ে একটি আন্তঃমাত্রিক ভ্রমনের পথ তৈরি করতে পারি, তাহলে খুব কম সময়েই অন্য মহাবিশ্বের অন্য সময়ে গিয়ে উপস্থিত হতে পারব। অনেক পদার্থবিজ্ঞানী মনে করেন, আমাদের মহাবিশ্ব যখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পরবে, তখন আন্তঃমাত্রিক ভ্রমনের মাধ্যমে আমরা অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দিয়ে আমাদের সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পারব।
স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. মিচিও কাকু একটি হাইপোথিটক্যাল এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছেন। এতে আমরা স্থান-কালের দেয়াল ভেদ করে ওয়ার্মহোল দিয়ে অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দিতে পারব।পদ্ধতিটি খুব বেশি জটিল না। প্রথমে আমাদের যেকোনো একটি নক্ষত্রকে বেছে নিতে হবে।তারপর একটি শক্তিশালী গামা-রে গান দিয়ে সেই নক্ষত্রের চারিদিকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে গামা-রে গুলোকে আবার নিজেদের উপরে ফেলতে হবে। এরকম শক্তিশালী রশ্নি নিজের উপর চক্রাকারে উপরিপাতন হবার ফলে শক্তির পরিমান বাড়তেই থাকবে।একসময় প্রচুর শক্তি সৃষ্টি হলে, স্থান-কালের দেয়ালে একটি ওয়ার্মহোল তৈরি হবে। এখন এই ওয়ার্মহোলকে নিয়ন্ত্রন করে অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দেয়া যাবে!
সুপারসিমেট্রি(Supersymmetry)
স্ট্রিং থিওরির একটি অন্যতম ভিত্তি হল এই সুপারসিমেট্রি। বাংলায় একে মহাপ্রতিসাম্যতা বলা যেতে পারে। এই প্রতিসাম্যতা প্রকৃতির ভিন্ন ধরনের মৌলিক কণিকাদের মধ্যে এক ধরনের আন্তঃসম্পর্কের কথা বলে। প্রকৃতিতে যত রকম মৌলিক কনিকা পাওয়া যায় তাদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের কণিকাদের বলা হয় বোসন আর অন্যদের বলা হয় ফার্মিওন। এমনিতে এই দুই ধরনের কণিকার বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু সুপার সিমেট্রি অনুসারে- প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সব বোসনের জন্য একটি করে ফার্মিওন কনা রয়েছে,আবার সব ফার্মিওনের জন্যই একটি করে বোসন কনা রয়েছে । এসব কণিকাদের বলা হয় সুপারপার্টনার। এই ধারনা গ্রহন করার ফলে আমাদের মৌলিক কণিকার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে ! স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের মতে, একটি একীভূত তত্ত্ব গঠন করার জন্য সুপারসিমেট্রির কোন বিকল্প নেই। সুপারসিমেট্রির ধারনা গ্রহন করার পর স্ট্রিং তত্ত্বের নাম হয়ে গেছে- “সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব”।
হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল(Holographic principle)
বিজ্ঞান আমাদের অনেক রকম বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছি এমনকি সময়ও ধীর হয়ে যায়। কিন্তু স্ট্রিং থিওরির এমন কিছু অনুসিদ্ধান্ত আছে যা সকল প্রকার কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।এমন একটি অনুসিদ্ধান্তের নাম হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল। এই তত্ত্ব মতে আমি, আপনি, আপনার এই বই সহ পুরো মহাবিশ্বটিই একটি বিশাল হলোগ্রাফিক চিত্র ছাড়া আর কিছু না। অর্থাৎ, আমরা যাকে চিরন্তন বাস্তব বলে ভেবে আসছি তা তেমন কোন পরম বাস্তবতা নয়। এই প্রিন্সিপল আমাদের বলে যে- আমাদের মহাবিশ্বের ত্রিমাত্রিক স্থানে যা কিছু ঘটছে, তার সব তথ্যই একটি মহাজাগতিক দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে জমা করা আছে। আর সেই পৃষ্ঠ থেকে এক ধরনের হলোগ্রাফিক প্রতিফলনের প্রকাশই হল- আমি, আপনি ও আমাদের এই মহাবিশ্ব ।
এখন প্রশ্ন জাগছে, তাহলে আমরা এই যে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেরাচ্ছি, কত রকম অনুভূতি হচ্ছে এসব কি করে মিথ্যা হয় ? এই তত্ত্ব মতে, আমারা যা কিছু দেখছি এগুলো আসলে এক ধরনের উচ্চ মাত্রার বাস্তবতার(High order of reality) প্রতিফলন। সেই দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠেকে কোন তত্ত্ব দ্বারা বর্ণনা করা হলে, সেই তত্ত্ব আর আমাদের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তত্ত্ব, সমতুল্য হবে। তাই আমাদের বাস্তবতাকে বেশি বাস্তব বলাটা কোন ভাবেই ঠিক হবে না। বরং আমরা যে বস্তবতায় বাস করি তার সাহায্যে ব্ল্যাক হোলের কিছু বিষয় সহ অনেক কিছুই বর্ণনা করা যায় না। হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সত্য হবার পেছনে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তাত্ত্বিক প্রমান পেয়েছেন। এই তত্ত্ব বিজ্ঞানী মহল সহ, সমগ্র পৃথিবীর বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের মাঝে বাস্তবতা নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। ১৭ জানুয়ারি, ২০০৯ নিউ সায়েনটিস্টের কাভার ফটোতে লিখা হয় “Are you a hologram… projected form the edge of universe”
Ads/CFT correspondence
এই তত্ত্বের নামটি খটোমটো দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। দেখতে একটু কাঠখোট্টা হলেও মূল বিষয়টি খুব সহজ। এখানে বলা হয় , দুটি তত্ত্ব দেখতে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলেও কিছু নির্দিষ্ট শর্তের ভিতর তারা একই রকম আচরণ করতে পারে। ভিন্ন ধরনের তত্ত্ব দুটির একটি হল কোয়ান্টাম থিওরি, আর অন্যটি হল স্ট্রিং থিওরি। এই তত্ত্ব দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যতগুলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব আছে তার সবগুলোতেই স্থান-কালের ধারনা স্ট্রিং তত্ত্বের থেকে একদম আলাদা। তাই আপাত দৃষ্টিতে এদের কোনভাবেই মেলান সম্ভব নয়। কিন্তু Ads/CFT correspondence মতে, কিছু বিশেষ শর্তের ভিতর এই দুটি তত্ত্বই একই রকম ফলাফল দেখাবে।
এরকম যোগাযোগ(correspondence) , প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এই correspondence স্ট্রিং থিওরির একটি মৌলিক নীতি। উপরে যে হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তার একটি প্রমান হল এই তত্ত্ব। এছারাও কোয়ান্টাম জগতের অনেক রহস্যময় ঘটনার ভেতরের কারন বোঝার জন্য এই তত্ত্বটি অনেক সাহায্য করবে বলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা ।
পদার্থ থেকে সুপারস্ট্রিং
ধরা যাক আমাদের রান্না ঘরে প্রেসার কুকারের মধ্যে এক টুকরো বরফ রাখা আছে। স্টোভটি জ্বেলে দিলে কি হবে আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু ভাবুন তো, একে যদি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ড্রিগ্রি তাপমাত্রা পর্যন্ত গরম করতে থাকি, তাহলে কি ঘটবে ?
যদি বরফ টুকরোটি গরম করতে শুরু করা হয় প্রথমে এটি গলে পানিতে পরিনত হবে। এর মানে বরফ টুকরোটি তার দশা পরিবর্তন করে কঠিন থেকে তরলে পরিনত হল। এখন পানিটুকু ফুটতে শুরু করার আগ পর্যন্ত যদি তাপ দেওয়া হয়, তাহলে এটি আবারও একটি দশা পরিবর্তনের মাধ্যমে তরল থেকে বাষ্পে পরিনত হবে। এখন যদি আমরা তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকি তাহলে একসময় পানির অণুগুলো ভেঙ্গে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের আলাদা পরমাণুতে পরিনত হবে। পানির অণুগুলো যে শক্তি দ্বারা নিজেদের মধ্যে যুক্ত ছিল, তার থেকে বেশি শক্তি প্রয়োগ করায় এটি তখন আর পানি থাকবে না। বরং এটি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের একটি মিশ্র ও উত্তপ্ত গ্যাসে পরিনত হবে।
এখন যদি তাপমাত্রা ৩০০০ K পর্যন্ত বাড়ানো হয়, তাহলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণুগুলোও ভাঙতে শুরু করবে। ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। এটি তখন এক ধরনের উচ্চ তাপমাত্রার আয়নিত গ্যাসে পরিণত হবে।পদার্থের এই অবস্থাটি প্লাজমা নামে পরিচিত।কঠিন, তরল, বায়বীয় এই তিনটি দশার পাশাপাশি পদার্থের এই প্লাজমাক অনেকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলে থাকে। যদিও দৈনন্দিন জীবনে আমরা পদার্থের এই প্লাজমা অবস্থার সাথে পরিচিত না, তবে আমাদের সূর্যের দিকে তাকালেই আমরা প্লাজমা দেখতে পাব। মূলত সূর্যের মত সব নক্ষত্রগুলোতে পদার্থ এই প্লাজমা আকারেই থাকে।আর আমাদের মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পদার্থই প্লাজমা আকারে আছে।
এখন আমাদের স্ট্রোভের তাপমাত্রা আর একটু বাড়িয়ে ১ বিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন করে ফেলব। এই তাপমাত্রায় অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসগুলো ভেঙ্গে গিয়ে নিউট্রন ও প্রোটনের গ্যাসে পরিণত হবে। পদার্থের এই অবস্থাও কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বে অচেনা না। নিউট্রন স্টার বা পালসারের ভিতর পদার্থগুলো এই অবস্থায়ই থাকে।
এই নিউট্রন ও প্রোটনের গ্যাসকে যদি ১০ ট্রিলিয়ল কেলভিন তাপমাত্রায় নেওয়া যায়, তাহলে এই অতি-পারমানবিক কনিকারা ভেঙ্গে গিয়ে কোয়ার্কে পরিণত হবে। এখন আমাদের হাতে যা আছে তা হল, কোয়ার্ক আর লেপটনের(ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো) মিশ্র গ্যাস। এই তাপমাত্রায় আমরা কোয়ার্ক, ইলেকট্রন আর নিউট্রিনোগুলো স্বতন্ত্র কনা হিসেবে পাব।
আমরা তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকব। এবার কোয়ার্ক-লেপ্টনের গ্যাসের তাপমাত্রা যখন ১ কোয়াড্রিলিয়ন পর্যন্ত উঠবে, তড়িৎ-চুম্বক বল ও নিউক্লিয়ার দুর্বল বল এক হয়ে যাবে। এদেরকে আর আলাদা বল হিসেবে সনাক্ত করা যাবে না। এই তাপমাত্রায় SU(2) X SU(1) সিমেট্রি তৈরি হবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, তখন নতুন একটি প্রতিসামতা প্রকাশ পাবে, ফলে এই দুটি বলের প্রকৃতি হবে একই রকম। এই দুই বলের একিভুত রুপকে বলা হয় তাড়িৎ-দুর্বল বল।
এবার যখন তাপমাত্রা বাড়িয়ে ১০ ^ ২৮ ডিগ্রি কেলভিন করা হবে, তখন সবল নিউক্লিয়ার বল ও তাড়িৎ-দুর্বল বল একীভূত হয়ে GUT সিমেট্রি দেখা দেবে [ SU(5) , O(10) অথবা E(6)] । এই প্রতিসাম্যতা তৈরির পর নিউক্লিয় বল বলে আলাদা কিছু থাকবে না।
সবশেষে যখন ১০^৩২ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় মহাকর্ষ বল, GUT বলের সাথে একিভুত হবে তখন দশমাত্রার সুপারস্ট্রিং জগতে তৈরি হবে, দেখা দেবে সব প্রতিসাম্যতা । এখন আমাদের স্টোভের ভিতর যা আছে তা হল সুপারস্ট্রিং-এর গ্যাস।(এই তাপমাত্রায় প্রকৃতির সকল প্রতিসাম্যতা দেখা দেবে ফলে স্ট্রিংগুলো তাদের সুপার পার্টনারের সাথে মিলিত হয়ে সুপারস্ট্রিং গঠন করবে )। এই বিশাল তাপমাত্রায় স্থান-কালের মাত্রা পরিবর্তন হয়ে যাবে। পরিচিত চতুর্মামাত্রিক জগত আর কোঁকড়ানো ছয় মাত্রার জগত মিলে দশমাত্রার সুপারস্ট্রিং এর জগত তৈরি হবে। সুপারস্ট্রিং গ্যাসের মধ্যে, ইন্টার-ডাইমেনশনার ট্রাভেল করা যাবে, হয়ত চোখের সামনেই দেখা যাবে একটি সুন্দর ওয়ার্মহোল। তবে এই পরিস্থিতিতে ঐ রান্নাঘর থেকে যত তারাতারি বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল !
প্রতিটি আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বগুলো কেমন হবে, তা নির্ভর করে স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো কিভাবে পেচিয়ে আছে তার উপর।আমরা আগেই জেনেছি স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো চাইলেই ইচ্ছেমত জড়িয়ে পেচিয়ে থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলোর প্যাঁচ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। এই অন্তর্বর্তী জগতের প্যাঁচের আকার-আকৃতিই বিভিন্ন ভৌত ধ্রুবক যেমন, ইলেক্ট্রনের চার্জ, মৌলিক কণিকাগুলোর পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদির মান নিয়ন্ত্রণ করে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, এই প্যাঁচের আকৃতিই প্রকৃতির দৃশ্যমান নিয়ম গুলো নিয়ন্ত্রন করে। এখানে দৃশ্যমান নিয়ম বলতে, মৌলিক চারটি বল ও তাদের পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ধরন, মৌলিক কণিকা যেমন, কোয়ার্ক বা নিউট্রিনোর ভর, আধান ইত্যাদির কথা বোঝানো হচ্ছে। আর এসব দৃশ্যমান নিয়মগুলো আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে।অর্থাৎ স্ট্রিং তত্ত্বের নিয়মগুলোই হল প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক নিয়ম, যেগুলোর উপর ভিত্তি করে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়মগুলোর উদ্ভব ঘটে।
এভাবে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মত প্রাকৃতিক নিয়মযুক্ত, বিভিন্ন ধরনের মহাবিশ্ব উদ্ভব হতে পারে। শুধুমাত্র প্রতিটি মহাবিশ্বের অন্তর্বর্তী জগত ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পেচিয়ে থাকবে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, স্ট্রিং তত্ত্বের অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলো প্রায় ১০^৫০০ উপায়ে পেচিয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ এই তত্ত্ব মতে ১০^৫০০ সংখ্যক আলাদা আলাদা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম সমৃদ্ধ মহাবিশ্ব সম্ভব । এই সংখ্যাটি কতটা বড় সেটি বুঝতে চাইলে এমন একজন বিজ্ঞানীর কথা ভাবুন যিনি স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধান থেকে কোন শক্তিশালী কম্পিউটারের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ১০০০ টি নিয়ম বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে। এত ক্ষমতা সম্পন্ন যন্ত্র থাকার পরও তিনি যদি তিনি বিগ ব্যাঙের পর থেকে আজ পর্যন্ত হিসেব করতে থাকেন, তাও মাত্র ১০^২০ টি মহাবিশ্বের নিয়ম গণনা করতে পারবেন। আর এমন প্রতিটি নিয়মের মহাবিশ্ব সংখ্যাও অগনিত।
প্যারালাল ইউনিভার্স(Parallel Universe) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব
স্ট্রিং তত্ত্বের এরকম সমাধানের পর মহাবিশ্বের ধারনা বদলে মাল্টিভার্স(Multiverse) বা বহুবিশ্বে রূপ নিয়েছে। এরকম অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিতর এমন অনেক মহাবিশ্ব আছে যেগুলোর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো হয়ত হুবহু আমাদের মত। আর এদের ভিতর অনেকেই আবার আকার আয়তন সবদিক থেকেই দেখতে আমাদের মহাবিশ্বের মত। এদেরকে বলা হয় প্যারালাল ইউনিভার্স(Parallel Universe) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব। এরকম সমান্তরাল মহাবিশ্বের সংখ্যা যেহেতু অগণিত, তাই এমন কিছু মহাবিশ্ব পাওয়া যাবে যেগুলোর সবকিছুই হুবহু আমাদের মহাবিশ্বের মত।যেন ঠিক জমজ ভাই-বোন। ঠিক আপনার মতই আরেকজন আপনি হয়ত আরেকটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে বসে ঠিক এই বইটিই পড়ছে।
চিত্রঃ উপরের প্রতিটি গোলকই এক একটি আলাদা মহাবিশ্ব,এদের মধ্যে কিছু আবার আছে হুবহু আমাদের মহাবিশ্বের মতই দেখতে।
সমান্তরাল মহাবিশ্বের কথা শুনতে হয়ত অনেকের কাছে আজগুবী মনে হতে পারে। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব ছাড়াও মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য বর্ণনাকারী- ইনফ্লেশন তত্ত্বও একই রকম কথা বলে। কেওটিক ইনফ্লেশন তত্ত্ব অনুসারে বিজ্ঞানী আঁদ্রে লিণ্ডে কম্পিউটার সিমুলেশন করে দেখেছেন, এই ধরনের স্ফীতি তত্ত্বও স্ট্রিং তত্ত্বের মত আলাদা ধরনের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম কার্যকর অসংখ্য মহাবিশ্বের কথা বলছে। এমআইটির( MIT) কসমোলজিস্ট ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের পরিচিত গনিতের সম্ভাবনার সাহায্যে হিসেব কষে দেখিয়েছেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব থেকে প্রায় ১০^১০^২৮ মিটার দুরেই হয়ত হুবহু আপনার মত দেখতে একজন সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়েই ভাবছে।কিন্তু সমস্যা হল আপনি বা আপনার টুইন কেউই কারও সম্পর্কে জানতে পারবেন না।
টেগমার্ক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে চার রকম প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলেছেন । লেভেল ওয়ান প্যারালাল ইউনিভার্স হল সবচেয়ে মজার। বলা যেতে পারে আপনি যদি আপনার বর্তমান অবস্থান থেকে যথেষ্ট দূরে ভ্রমন করতে পারেন তাহলে আপনি আবার আপনার বাসাতেই ফিরে যাবেন। সেখানে দেখা যাবে হবহু আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহে আপনার মতই একজন বসে স্ট্রিং তত্ত্বের কোন বই পড়ছে। শুনতে অবাক লাগবে, বহুবিশ্বের কথা বিবেচনা না করলেও, এরকম প্যারালাল জগত থাকার সম্ভবনা রয়েছে। কারন ইনফ্লেশন তত্ত্বের বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানি মহাবিশ্বকে আগে যতটুকু বড় মনে করা হত এটি তার থেকে ঢের বেশি বড়। আক্ষরিক অর্থেই অসীম বলা যেতে পারে।বিজ্ঞানীরা গাণিতিক সম্ভাবনার সাহায্যে হিসেব কষে দেখেছেন, এই অসীম মহাবিশ্বে আমাদের সৌরজগতের একটি টুইন খুজে পাবার সম্ভবনা বেশ প্রবল।একই রকম এসব মহাবিশ্বকে লেভেল-1 প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়।
স্ট্রিং তত্ত্বের সমীকরণ বিশ্লেষণ করে একদল বিজ্ঞানী বলছেন আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল দুটি ব্রেনের সংঘর্ষের কারনে। দুটি ব্রেনের এরকম সংঘর্ষের ফলেই ইনফ্লেশনের সৃষ্টি হয়। এরকম সংঘর্ষ কিন্তু কোন নির্দিষ্ট একটি স্থানে হয় না, বরং আমাদের মহাবিশ্বের বাইরের শুন্যতায় এরকরম সংঘর্ষ হয়েই চলেছে, ফলে সৃষ্টি হয়ে চলেছে অসংখ্য মহাবিশ্ব। এই অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিতর আমাদের মহাবিশ্বের মত কোন একটি থাকা খুবই সম্ভব। ব্রেনের সংঘর্ষের কারনে এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই তত্ত্বকে ইকপাইরোটিক থিওরি(Ekpyrotic Theory) বলা হয়। এই তত্ত্ব ঠিক হলে আমাদের মহাবিশ্বের মত দেখতে আরও কোন মহাবিশ্ব থাকাটা বাধ্যতামূলক। এরকম মহাবিশ্বগুলোকে লেভেল-2 প্যারালাল ইউনিভার্স বলে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সম্ভাব্যতা ও এর বর্ণনাকারী ওয়েব ফাংশনকে ব্যাখ্যা করার জন্য আরেক ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলা হয়।এ ধরনের মহাবিশ্বের কথা বুঝতে চাইলে “হিলবার্ট স্পেস” নামে এক ধরনের তাত্ত্বিক ও বিমূর্ত স্থানের কথা ভাবতে হবে। এই তাত্ত্বিক স্পেস অসীম-মাত্রিক এবং একটি কোয়ান্টাম জগত এই হিলবার্ট স্পেসের সাপেক্ষে বিভিন্নভাবে ঘুরতে পারে। এই তত্ত্ব মতে যে ধরনের মহাবিশ্বের কথা বলা হয়, সেগুলো প্রত্যেকটি একই জায়গায় এবং একই সময়ে সহ-অবস্থান করছে, কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা ডাইমেনশনে অবস্থিত বলে কেউ কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। যোগাযোগ করতে না পারলে কি হবে,প্রতিটি মুহূর্তে নেয়া আপনার সিদ্ধান্তগুলো হয়ত আপনার মত অসংখ্য আপনার হুবহু প্রতিরুপের সাথে মিলিত ভাবেই নেওয়া হচ্ছে। আপনার নাকের ডগায়ই হয়ত একটি সমান্তরাল মহাবিশ্ব রয়েছে, শুধু আলাদা মাত্রায় অবস্থিত বলে তাকে ধরা ছোঁয়া যাচ্ছে না। এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতারা মনে করেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত নিয়মগুলোর উৎপত্তি আসলে এরকম অসীমসংখ্যক প্যারালাল ইউনিভার্সের যোগাযোগের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এ ধরনের সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলোকে লেভেল থ্রি প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়।
স্ট্রিং তত্ত্বে অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলো বিভিন্ন ভাবে পেচিয়ে থাকার কারনে বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক নিয়মাবলী সমৃদ্ধ মহাবিশ্বের উদ্ভব হতে পারে। এ রকম আলাদা আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বগুলোর সবকিছুই আলাদা। এমন সব মহাবিশ্বের বেশিরভাগই প্রান ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য অনুপযোগী। যদিও আমরা এমন মহাবিশ্বের প্রমান পাইনি, কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এরকম মহাবিশ্বের সংখ্যা প্রায় অসীম, ১০^৫০০।আর এর ভিতর আমাদের মহাবিশ্বের মত নিয়ম যুক্ত মহাবিশ্বের সংখ্যাও অগণিত। বর্তমান প্রযুক্তির ধরা ছোঁয়ার বাইরে হলেও, ভবিষ্যতে কোন দিন হয়ত আমরা এমন মহাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হব। এমন বিভিন্ন নিয়ম যুক্ত মহাবিশ্বকে বলা হয় লেভেল-4 প্যারালাল ইউনিভার্স।
উপরে চার ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলা হয়েছে।স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধানগুলো শুধু লেভেল-3 ছাড়া বাকি সবগুলোর অস্তিত্ব দাবি করে। স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধানগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় অবশ্যই কোথাও আমাদের মহাবিশ্বের মত অন্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে। এই তত্ত্ব আমাদের সামনে সৃষ্টির যে চিত্র তুলে ধরে তাতে বহুবিশ্ব ও সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব খুবই বাস্তব।
ওয়ার্মহোল (Wormhole)
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে স্পেস বা স্থানকে আমরা যেরকম সমতল বলে ভাবি, স্পেস আসলে তেমন না, বরং এটি বাঁকানো। আলো যখন মহাশূন্যের(স্পেস) ভিতর দিয়ে ভ্রমন করে, তখন এই বাঁকানো স্পেসের ভেতর দিয়ে একটি বাঁকানো পথে চলতে বাধ্য হয়।কিন্তু এই বাকা পথের পাশাপাশি একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তাও আছে। এই সংক্ষিপ্ত পথকেই ওয়ার্মহোল বলা হয়। ওয়ার্মহোলকে অনেক সময় আইনস্টাইন-রজেন ব্রিজ নামেও ডাকা হয়ে থাকে।দুটি স্থানে যাবার এই বিভিন্ন রাস্তা থাকার কারনে গণিতবিদরা একে বহুভাবে সংযুক্ত স্থান(Multiply connected spaces) বলেন। কিন্তু পদার্থবিদরা একে ওয়ার্মহোল বলেন কারন, একটি পোকা যেমন মাটি খুড়ে পৃথিবীর এই প্রান্তের সাথে অন্য প্রান্তের একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তা তৈরি করতে পারে, তেমনি একটি ওয়ার্মহোলও মহাবিশ্বের দুটি স্থানের ভিতর একটি বিকল্প সংক্ষিপ্ত রাস্তা তৈরি করে।
আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রপুঞ্জ হল আলফা সেন্টরাই। সৌরজগৎ থেকে আলোর বেগে ভ্রমন করলেও পার্শ্ববর্তী এই নক্ষত্রপুঞ্জে যেতে আমাদের কমপক্ষে ৪.৩ বছর সময় লাগবে(বাস্তবে যা অসম্ভব,কেননা কোন কিছুর পক্ষেই আলোর বেগে ভ্রমন সম্ভব নয়)।কিন্তু যদি কেউ একটি ওয়ার্মহোল দিয়ে যেতে পারে তবে ডিনার করতে করতেই আলফা সেন্টরাই থেকে ঘুরে আসা সম্ভব।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব আমাদের মহাবিশ্বের দুটি ভিন্ন স্থানের মধ্যে ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে ভ্রমনের কথা বললেও, স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধান অনুযায়ী আমরা যদি একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পারি তা আমাদের মহাবিশ্বের যেকোনো গালাক্সির পাশাপাশি অন্য মহাবিশ্বে ভ্রমনের সম্ভাব্যতার কথাও বলে।এমনকি একটি ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে শুধু দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বেই নয়, এমনকি অতীত ও ভবিষ্যতেও ভ্রমন করা সম্ভব। স্ট্রিং তত্ত্ব যে অতিরিক্ত মাত্রার কথা বলে, আমরা যদি সেই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো দিয়ে একটি আন্তঃমাত্রিক ভ্রমনের পথ তৈরি করতে পারি, তাহলে খুব কম সময়েই অন্য মহাবিশ্বের অন্য সময়ে গিয়ে উপস্থিত হতে পারব। অনেক পদার্থবিজ্ঞানী মনে করেন, আমাদের মহাবিশ্ব যখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পরবে, তখন আন্তঃমাত্রিক ভ্রমনের মাধ্যমে আমরা অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দিয়ে আমাদের সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পারব।
স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. মিচিও কাকু একটি হাইপোথিটক্যাল এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছেন। এতে আমরা স্থান-কালের দেয়াল ভেদ করে ওয়ার্মহোল দিয়ে অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দিতে পারব।পদ্ধতিটি খুব বেশি জটিল না। প্রথমে আমাদের যেকোনো একটি নক্ষত্রকে বেছে নিতে হবে।তারপর একটি শক্তিশালী গামা-রে গান দিয়ে সেই নক্ষত্রের চারিদিকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে গামা-রে গুলোকে আবার নিজেদের উপরে ফেলতে হবে। এরকম শক্তিশালী রশ্নি নিজের উপর চক্রাকারে উপরিপাতন হবার ফলে শক্তির পরিমান বাড়তেই থাকবে।একসময় প্রচুর শক্তি সৃষ্টি হলে, স্থান-কালের দেয়ালে একটি ওয়ার্মহোল তৈরি হবে। এখন এই ওয়ার্মহোলকে নিয়ন্ত্রন করে অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দেয়া যাবে!
সুপারসিমেট্রি(Supersymmetry)
স্ট্রিং থিওরির একটি অন্যতম ভিত্তি হল এই সুপারসিমেট্রি। বাংলায় একে মহাপ্রতিসাম্যতা বলা যেতে পারে। এই প্রতিসাম্যতা প্রকৃতির ভিন্ন ধরনের মৌলিক কণিকাদের মধ্যে এক ধরনের আন্তঃসম্পর্কের কথা বলে। প্রকৃতিতে যত রকম মৌলিক কনিকা পাওয়া যায় তাদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের কণিকাদের বলা হয় বোসন আর অন্যদের বলা হয় ফার্মিওন। এমনিতে এই দুই ধরনের কণিকার বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু সুপার সিমেট্রি অনুসারে- প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সব বোসনের জন্য একটি করে ফার্মিওন কনা রয়েছে,আবার সব ফার্মিওনের জন্যই একটি করে বোসন কনা রয়েছে । এসব কণিকাদের বলা হয় সুপারপার্টনার। এই ধারনা গ্রহন করার ফলে আমাদের মৌলিক কণিকার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে ! স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের মতে, একটি একীভূত তত্ত্ব গঠন করার জন্য সুপারসিমেট্রির কোন বিকল্প নেই। সুপারসিমেট্রির ধারনা গ্রহন করার পর স্ট্রিং তত্ত্বের নাম হয়ে গেছে- “সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব”।
হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল(Holographic principle)
বিজ্ঞান আমাদের অনেক রকম বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছি এমনকি সময়ও ধীর হয়ে যায়। কিন্তু স্ট্রিং থিওরির এমন কিছু অনুসিদ্ধান্ত আছে যা সকল প্রকার কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।এমন একটি অনুসিদ্ধান্তের নাম হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল। এই তত্ত্ব মতে আমি, আপনি, আপনার এই বই সহ পুরো মহাবিশ্বটিই একটি বিশাল হলোগ্রাফিক চিত্র ছাড়া আর কিছু না। অর্থাৎ, আমরা যাকে চিরন্তন বাস্তব বলে ভেবে আসছি তা তেমন কোন পরম বাস্তবতা নয়। এই প্রিন্সিপল আমাদের বলে যে- আমাদের মহাবিশ্বের ত্রিমাত্রিক স্থানে যা কিছু ঘটছে, তার সব তথ্যই একটি মহাজাগতিক দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে জমা করা আছে। আর সেই পৃষ্ঠ থেকে এক ধরনের হলোগ্রাফিক প্রতিফলনের প্রকাশই হল- আমি, আপনি ও আমাদের এই মহাবিশ্ব ।
এখন প্রশ্ন জাগছে, তাহলে আমরা এই যে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেরাচ্ছি, কত রকম অনুভূতি হচ্ছে এসব কি করে মিথ্যা হয় ? এই তত্ত্ব মতে, আমারা যা কিছু দেখছি এগুলো আসলে এক ধরনের উচ্চ মাত্রার বাস্তবতার(High order of reality) প্রতিফলন। সেই দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠেকে কোন তত্ত্ব দ্বারা বর্ণনা করা হলে, সেই তত্ত্ব আর আমাদের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তত্ত্ব, সমতুল্য হবে। তাই আমাদের বাস্তবতাকে বেশি বাস্তব বলাটা কোন ভাবেই ঠিক হবে না। বরং আমরা যে বস্তবতায় বাস করি তার সাহায্যে ব্ল্যাক হোলের কিছু বিষয় সহ অনেক কিছুই বর্ণনা করা যায় না। হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সত্য হবার পেছনে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তাত্ত্বিক প্রমান পেয়েছেন। এই তত্ত্ব বিজ্ঞানী মহল সহ, সমগ্র পৃথিবীর বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের মাঝে বাস্তবতা নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। ১৭ জানুয়ারি, ২০০৯ নিউ সায়েনটিস্টের কাভার ফটোতে লিখা হয় “Are you a hologram… projected form the edge of universe”
Ads/CFT correspondence
এই তত্ত্বের নামটি খটোমটো দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। দেখতে একটু কাঠখোট্টা হলেও মূল বিষয়টি খুব সহজ। এখানে বলা হয় , দুটি তত্ত্ব দেখতে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলেও কিছু নির্দিষ্ট শর্তের ভিতর তারা একই রকম আচরণ করতে পারে। ভিন্ন ধরনের তত্ত্ব দুটির একটি হল কোয়ান্টাম থিওরি, আর অন্যটি হল স্ট্রিং থিওরি। এই তত্ত্ব দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যতগুলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব আছে তার সবগুলোতেই স্থান-কালের ধারনা স্ট্রিং তত্ত্বের থেকে একদম আলাদা। তাই আপাত দৃষ্টিতে এদের কোনভাবেই মেলান সম্ভব নয়। কিন্তু Ads/CFT correspondence মতে, কিছু বিশেষ শর্তের ভিতর এই দুটি তত্ত্বই একই রকম ফলাফল দেখাবে।
এরকম যোগাযোগ(correspondence) , প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এই correspondence স্ট্রিং থিওরির একটি মৌলিক নীতি। উপরে যে হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তার একটি প্রমান হল এই তত্ত্ব। এছারাও কোয়ান্টাম জগতের অনেক রহস্যময় ঘটনার ভেতরের কারন বোঝার জন্য এই তত্ত্বটি অনেক সাহায্য করবে বলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা ।
পদার্থ থেকে সুপারস্ট্রিং
ধরা যাক আমাদের রান্না ঘরে প্রেসার কুকারের মধ্যে এক টুকরো বরফ রাখা আছে। স্টোভটি জ্বেলে দিলে কি হবে আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু ভাবুন তো, একে যদি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ড্রিগ্রি তাপমাত্রা পর্যন্ত গরম করতে থাকি, তাহলে কি ঘটবে ?
যদি বরফ টুকরোটি গরম করতে শুরু করা হয় প্রথমে এটি গলে পানিতে পরিনত হবে। এর মানে বরফ টুকরোটি তার দশা পরিবর্তন করে কঠিন থেকে তরলে পরিনত হল। এখন পানিটুকু ফুটতে শুরু করার আগ পর্যন্ত যদি তাপ দেওয়া হয়, তাহলে এটি আবারও একটি দশা পরিবর্তনের মাধ্যমে তরল থেকে বাষ্পে পরিনত হবে। এখন যদি আমরা তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকি তাহলে একসময় পানির অণুগুলো ভেঙ্গে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের আলাদা পরমাণুতে পরিনত হবে। পানির অণুগুলো যে শক্তি দ্বারা নিজেদের মধ্যে যুক্ত ছিল, তার থেকে বেশি শক্তি প্রয়োগ করায় এটি তখন আর পানি থাকবে না। বরং এটি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের একটি মিশ্র ও উত্তপ্ত গ্যাসে পরিনত হবে।
এখন যদি তাপমাত্রা ৩০০০ K পর্যন্ত বাড়ানো হয়, তাহলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণুগুলোও ভাঙতে শুরু করবে। ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। এটি তখন এক ধরনের উচ্চ তাপমাত্রার আয়নিত গ্যাসে পরিণত হবে।পদার্থের এই অবস্থাটি প্লাজমা নামে পরিচিত।কঠিন, তরল, বায়বীয় এই তিনটি দশার পাশাপাশি পদার্থের এই প্লাজমাক অনেকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলে থাকে। যদিও দৈনন্দিন জীবনে আমরা পদার্থের এই প্লাজমা অবস্থার সাথে পরিচিত না, তবে আমাদের সূর্যের দিকে তাকালেই আমরা প্লাজমা দেখতে পাব। মূলত সূর্যের মত সব নক্ষত্রগুলোতে পদার্থ এই প্লাজমা আকারেই থাকে।আর আমাদের মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পদার্থই প্লাজমা আকারে আছে।
এখন আমাদের স্ট্রোভের তাপমাত্রা আর একটু বাড়িয়ে ১ বিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন করে ফেলব। এই তাপমাত্রায় অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসগুলো ভেঙ্গে গিয়ে নিউট্রন ও প্রোটনের গ্যাসে পরিণত হবে। পদার্থের এই অবস্থাও কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বে অচেনা না। নিউট্রন স্টার বা পালসারের ভিতর পদার্থগুলো এই অবস্থায়ই থাকে।
এই নিউট্রন ও প্রোটনের গ্যাসকে যদি ১০ ট্রিলিয়ল কেলভিন তাপমাত্রায় নেওয়া যায়, তাহলে এই অতি-পারমানবিক কনিকারা ভেঙ্গে গিয়ে কোয়ার্কে পরিণত হবে। এখন আমাদের হাতে যা আছে তা হল, কোয়ার্ক আর লেপটনের(ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো) মিশ্র গ্যাস। এই তাপমাত্রায় আমরা কোয়ার্ক, ইলেকট্রন আর নিউট্রিনোগুলো স্বতন্ত্র কনা হিসেবে পাব।
আমরা তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকব। এবার কোয়ার্ক-লেপ্টনের গ্যাসের তাপমাত্রা যখন ১ কোয়াড্রিলিয়ন পর্যন্ত উঠবে, তড়িৎ-চুম্বক বল ও নিউক্লিয়ার দুর্বল বল এক হয়ে যাবে। এদেরকে আর আলাদা বল হিসেবে সনাক্ত করা যাবে না। এই তাপমাত্রায় SU(2) X SU(1) সিমেট্রি তৈরি হবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, তখন নতুন একটি প্রতিসামতা প্রকাশ পাবে, ফলে এই দুটি বলের প্রকৃতি হবে একই রকম। এই দুই বলের একিভুত রুপকে বলা হয় তাড়িৎ-দুর্বল বল।
এবার যখন তাপমাত্রা বাড়িয়ে ১০ ^ ২৮ ডিগ্রি কেলভিন করা হবে, তখন সবল নিউক্লিয়ার বল ও তাড়িৎ-দুর্বল বল একীভূত হয়ে GUT সিমেট্রি দেখা দেবে [ SU(5) , O(10) অথবা E(6)] । এই প্রতিসাম্যতা তৈরির পর নিউক্লিয় বল বলে আলাদা কিছু থাকবে না।
সবশেষে যখন ১০^৩২ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় মহাকর্ষ বল, GUT বলের সাথে একিভুত হবে তখন দশমাত্রার সুপারস্ট্রিং জগতে তৈরি হবে, দেখা দেবে সব প্রতিসাম্যতা । এখন আমাদের স্টোভের ভিতর যা আছে তা হল সুপারস্ট্রিং-এর গ্যাস।(এই তাপমাত্রায় প্রকৃতির সকল প্রতিসাম্যতা দেখা দেবে ফলে স্ট্রিংগুলো তাদের সুপার পার্টনারের সাথে মিলিত হয়ে সুপারস্ট্রিং গঠন করবে )। এই বিশাল তাপমাত্রায় স্থান-কালের মাত্রা পরিবর্তন হয়ে যাবে। পরিচিত চতুর্মামাত্রিক জগত আর কোঁকড়ানো ছয় মাত্রার জগত মিলে দশমাত্রার সুপারস্ট্রিং এর জগত তৈরি হবে। সুপারস্ট্রিং গ্যাসের মধ্যে, ইন্টার-ডাইমেনশনার ট্রাভেল করা যাবে, হয়ত চোখের সামনেই দেখা যাবে একটি সুন্দর ওয়ার্মহোল। তবে এই পরিস্থিতিতে ঐ রান্নাঘর থেকে যত তারাতারি বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল !